Bangla - ভূতের গল্প

আশ্বিনের রাত্রি

Spread the love

গৌতম ভৌমিক


শরৎকালীন আকাশে সাদা মেঘের পালক যেন উড়ে বেড়াচ্ছে। দূরে সবুজ ধানের ক্ষেতে হালকা বাতাস বয়ে যায়, তার সঙ্গে মিশে আছে কাশফুলের দোল খাওয়া, গোধূলি রঙে রাঙা হয়ে ওঠা আকাশ, আর তারই ভেতর গ্রামজুড়ে শুরু হয়েছে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি। গ্রামের চৌমাথার কাছে কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্যান্ডেল—এবার থিম ‘নবরূপিণী দুর্গা’। গ্রামের কারিগররা দিনরাত খেটে যাচ্ছেন, বাঁশের গাঁথুনির উপর কাপড়ের ক্যানভাস টাঙিয়ে তুলছেন মণ্ডপ, মাটির মূর্তির গায়ে তুলির টান টেনে আনছেন দেবীর সৌন্দর্য। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ চোখে সেই কাজ দেখে বেড়ায়, আর যুবকেরা আলোর তার ঝোলাচ্ছে গলিপথে। বাজারে পুজোর ভিড় জমেছে; সবাই নতুন কাপড়, ধূপ, মিষ্টি, উপহার কিনছে। মহিলারা পাড়ায় বসে শাঁখ বাজাচ্ছেন, ঢাক-ঢোল ছাড়া দুর্গাপুজো কেমন যেন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে—এই নিয়ে কথা বলছেন। ঠিক তখনই, সন্ধ্যার আঁধার নামার সময়, হঠাৎ করেই অদ্ভুত এক ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসে। আওয়াজটা গ্রামপ্রান্তের অশ্বত্থতলার দিক থেকে—গভীর, মন কাঁপানো, অথচ অচেনা। এই সময়ে তো গ্রামে কোনো ঢাকি আসেনি এখনো, তারা সাধারণত ষষ্ঠীর আগে পৌঁছে। তাই গ্রামের মানুষ থমকে দাঁড়ায়, কানে শোনে সেই অদ্ভুত তাল, যেখানে প্রতিটি ঘা যেন কারও বুকের গভীরে ধ্বনি তুলে দিচ্ছে। মনে হয় যেন স্বয়ং মা দুর্গার আগমনী বার্তা নিয়ে সেই ঢাক বাজছে, তবু কোথাও একটা অস্বস্তির স্রোত বয়ে যায় সবার মনে—কে বাজাচ্ছে এই ঢাক?

শুধু যে শব্দটা অদ্ভুত তাই নয়, তার ভেতরে যেন একটা অচেনা মায়া লুকিয়ে আছে। সাধারণ ঢাকির বাজনায় থাকে আনন্দের ছন্দ, উল্লাসের ডাক—কিন্তু এই ঢাক যেন ভিন্ন। এতে আছে গভীর শোক, আবার এক রহস্যময় আকর্ষণও। গ্রামের বৃদ্ধেরা প্রথমেই চিনে ফেললেন—এ রকম ঢাক তারা কখনো শোনেননি। এমনকি পঞ্চাশ বছর আগেও না। গ্রামের মোড়ে বসা চা দোকানদার গণেশ কাকা নিজের গোঁফে হাত বুলিয়ে বললেন, “এ ঢাকের আওয়াজ মানুষ নয়, অন্য কিছুর।” সবাই তাঁর কথা শুনে আঁতকে ওঠে। অথচ ছেলেমেয়েরা ভয় না পেয়ে বরং টেনে ধরতে থাকে বড়দের হাত—তাদের কাছে এই আওয়াজ যেন রূপকথার ডাক। মেয়েরা শিউরে ওঠে, তারা বলে—“যদি ভূত হয়?” আবার কেউ কেউ ভাবে, হয়তো কোনো অচেনা ঢাকি হঠাৎ এসেছেন, যিনি বাজিয়ে সবাইকে অবাক করে দিচ্ছেন। কিন্তু তারপরই দেখা যায়, অশ্বত্থতলার দিকটা ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেছে, যেখানে শিয়ালের ডাকও মিলিয়ে গেছে। এক-আধজন সাহসী যুবক এগোতে চাইলেও, হাওয়ার দমকে তাদের বুক কেঁপে ওঠে। ঢাকের শব্দটা ক্রমশ জোরে হতে হতে হঠাৎ আবার থেমে যায়—যেন কখনো বাজেনি। গ্রামের প্রতিটি মানুষ নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর নিস্তব্ধতা ভেঙে ওঠে কুকুরের হঠাৎ ডাকে, পল্লির গলিতে শোনা যায় ভীতসন্ত্রস্ত ফিসফিসানি।

সেই রাতে গ্রামে আর কেউ শান্তিতে ঘুমোতে পারল না। কারও কারও মনে হলো, এই ঢাকের শব্দ মা দুর্গার আগমনী সুর নয়, বরং কোনো অচেনা উপস্থিতির বার্তা। বৃদ্ধারা পুরনো গল্প মনে করলেন—অনেক বছর আগে দুর্গাপুজোর সময় গ্রামে এক অজানা ঢাকি এসেছিল, যার বাজনায় সবাই মুগ্ধ হয়েছিল। কিন্তু মহাষ্টমীর রাতে সে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়, আর পরদিন সকালে অশ্বত্থতলার নিচে পাওয়া যায় কেবল এক ভাঙা ঢাক, যার ওপর লাল সিঁদুরের ছোপ শুকনো রক্তের মতো লেগে ছিল। তারপর থেকে নাকি প্রতি বছর পুজোর আগে-পরে গ্রামপ্রান্তে অচেনা ঢাকের শব্দ ভেসে ওঠে। আজকের এই ঘটনার সঙ্গে সেই পুরনো কাহিনি মিলে গিয়ে সবার মন আরও ভীত করে তুলল। অথচ গ্রামটা আলোয় ভরা, উল্লাসে মুখর। মানুষ চেষ্টা করল ভয় ভুলে আবার প্রস্তুতিতে মন দিতে, কিন্তু প্রত্যেকের অন্তরে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল—কে বাজাচ্ছে সেই ঢাক, আর তার আসল উদ্দেশ্য কী? আগমনী সুর কি সত্যিই দেবীর আগমনের বার্তা, নাকি অশুভের সংকেত? এই দ্বন্দ্বের মাঝেই গ্রামের দুর্গাপুজো শুরু হতে চলল, আর আকাশে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তার ছায়া।

পরের দিন সকাল থেকেই গ্রাম যেন একটু অন্যরকম। যদিও চারদিকে দুর্গাপুজোর কোলাহল, প্রতিটি বাড়ি সেজে উঠছে নতুন কাপড়, আলপনা, ধূপের গন্ধে, তবুও মানুষের মধ্যে এক অদৃশ্য অস্বস্তি ঘুরপাক খাচ্ছিল। আগের রাতের সেই অচেনা ঢাকের আওয়াজ কারও মন থেকে মুছে যায়নি। সকালের আলোয় যখন স্থানীয় ঢাকিরা একে একে মণ্ডপে জড়ো হলেন, তখন সবাই অবাক হয়ে একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। এদের সবার হাতেই রয়েছে বহু বছরের অভিজ্ঞতা; দুর্গাপুজো মানেই এঁরা গ্রাম জুড়ে ছন্দের প্রাণ। কিন্তু কেউই দাবি করলেন না যে গত রাতে তিনি বাজিয়েছিলেন। বরং প্রত্যেকেই শপথ করে বললেন—ওই বাজনা তাঁদের কোনো পরিচিত তালের সঙ্গে মেলে না। শহুরে ঢাকিরা সাধারণত একটু ভিন্ন ভঙ্গিতে বাজায়, কিন্তু তাও মানুষের কানে স্পষ্ট বোঝা যায়। অথচ ওই আওয়াজে এমন এক ছন্দ ছিল, যা না গ্রামীণ না শহুরে—যেন অদ্ভুত এক মিলনের রূপ, যার ভেতরে ছিল অভিশপ্ত আনন্দ আর অব্যক্ত যন্ত্রণার রেশ। সকালের বৈঠকে গ্রামের প্রবীণরা স্থির করলেন, হয়তো কোনো নতুন ঢাকি শহর থেকে এসেছে, সে-ই এমন করে বাজাচ্ছে। তাই গ্রামের কয়েকজন যুবককে দায়িত্ব দেওয়া হলো—দিনভর চোখ-কান খোলা রাখতে হবে, মণ্ডপ, বাজার কিংবা মেলা প্রাঙ্গণে যে-ই আসুক, তার খোঁজ নিতে হবে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, যতবার ঢাক বাজল, সবাই শুনল, অথচ বাজনাকারীকে কেউ চোখে দেখল না।

বিকেলের পর আবার শুরু হলো প্রস্তুতি। মণ্ডপে তখন সাজসজ্জার কাজ শেষের পথে, বিদ্যুতের রঙিন বাতি লাগানো হচ্ছে চারপাশে, মেয়েরা মহালয়ার গান গুনগুন করছে। কিন্তু সবার মনেই অদৃশ্য আতঙ্ক। হঠাৎ করে আবার ভেসে এল সেই ঢাকের আওয়াজ—দূরে অশ্বত্থতলা নয়, এবার যেন মেলার দিক থেকে। মুহূর্তের মধ্যে ভিড় জমে গেল। সবাই ভেবেছিল, এবার হয়তো দেখা যাবে সেই অচেনা ঢাকিকে। গ্রামের সাহসী ছেলেরা মেলামাঠে ছুটে গেল, দোকানিরা তাকিয়ে রইলেন চারপাশে, কিন্তু কোথাও কাউকে দেখা গেল না। অথচ আওয়াজটা ক্রমশ তীব্র হতে হতে যেন সবাইকে ঘিরে ধরল। ঢাকির প্রতিটি ঘা মানুষের বুকের ভেতর গিয়ে কেঁপে উঠল, মনে হলো প্রতিটি আওয়াজের সঙ্গে কারও অজানা গল্প লুকিয়ে আছে। ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ কয়েকজন বৃদ্ধা অজ্ঞান হয়ে পড়লেন, তাঁদের চোখে জল গড়িয়ে পড়ছিল। তাঁরা জ্ঞান ফেরার পর বললেন, সেই ঢাক শুনে তাঁদের মনে হয়েছে যেন মৃত স্বজনরা ফিরে এসে ডাকছে। গ্রামের পুরোহিত বিষ্ণুপদবাবু চমকে ওঠেন—এ স্রেফ বাজনা নয়, এ এক অদ্ভুত শক্তির প্রকাশ। তিনি সবাইকে সতর্ক করে বললেন, “এই ঢাককে অবহেলা করো না। যে বাজাচ্ছে, সে হয় মানুষ নয়, না হয় মানুষের ছদ্মবেশে অন্য কিছু।” কথাটা শুনে ভিড়ের ভেতর হিমস্রোত বয়ে গেল। কিন্তু কৌতূহলও বেড়ে গেল—সত্যিই কে বাজাচ্ছে এই ঢাক?

রাত নামতেই ভয়টা আরও ঘনীভূত হলো। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে আলো জ্বলছে, ধূপকাঠির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে, মণ্ডপে মানুষ ভিড় করছে—কিন্তু প্রত্যেকের কান সজাগ। কখন আবার সেই ঢাক বাজতে শুরু করে, কে জানে! অবশেষে, সপ্তমীর রাতে যখন সন্ধিপুজোর সময় ঘনিয়ে এল, হঠাৎ ঢাকিরা নিজেরা বাজনা থামিয়ে দিলেন—কারণ আবারও শোনা গেল সেই অচেনা ঢাকির আওয়াজ। এবার আর দূরে নয়, একেবারে মণ্ডপের ভেতর থেকে। মুহূর্তে হাজার মানুষের ভিড় স্তব্ধ হয়ে গেল। যে ঢাকির শব্দ চারদিক কাঁপিয়ে তুলছে, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঢাকিদের কেউ বাজাচ্ছে না। তাদের হাতে তখন ঢাক স্থির, অথচ শব্দ ধ্বনিত হচ্ছে প্রবল বেগে। ছোটরা কান চেপে ধরল, মহিলারা ভয়ে মূর্তির সামনে প্রণাম করলেন, পুরোহিত বিষ্ণুপদবাবু তো ভয়ে কণ্ঠই খুঁজে পেলেন না। সেই বাজনা কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ থেমে গেল, আর সবাই দেখল—দেবীর চোখের কোণে যেন জল টলমল করছে। ভিড়ের মধ্যে এক সুনসান নীরবতা নেমে এলো, কারও মুখে কোনো কথা নেই। কেবল একটাই প্রশ্ন নিঃশব্দে ছুটে বেড়াতে লাগল—কে বাজায় এই ঢাক? আর তার সঙ্গে দুর্গাপুজোর এই আনন্দঘন উৎসবে অদৃশ্যভাবে কে বা কী প্রবেশ করেছে?

অষ্টমীর সন্ধ্যা, গ্রামজুড়ে যেন অন্য এক আবেশ। চারদিকে আলোর ঝলকানি, মণ্ডপের সামনে ভিড়ের ঢল, পুষ্পাঞ্জলির জন্য অপেক্ষারত মানুষের গুঞ্জন, ধূপ-ধুনোর গন্ধে ভরে আছে চারপাশ। মহিলারা লাল শাড়ি, কপালে সিঁদুর, ছেলেরা নতুন পাঞ্জাবি পরে এসেছে, আর কিশোরীরা সাজগোজে যেন পূজোর মেলায় রঙিন প্রজাপতি। সবাই অধীর আগ্রহে অঞ্জলি দেওয়ার মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছে। পুরোহিত বিষ্ণুপদবাবু গলায় মন্ত্র আওড়াতে প্রস্তুত হচ্ছেন, আর ঢাকিরা ধীরে ধীরে হাত তুলেছে বাজনা শুরু করার জন্য। কিন্তু হঠাৎই, তাঁদের হাত থেমে গেল। কারণ, মণ্ডপের ভেতর গমগম করে উঠল সেই অচেনা ঢাকের আওয়াজ। মুহূর্তেই ভিড়ের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল, তবে সেটা ভয়ের নয়—বরং এক অদ্ভুত মুগ্ধতা। তালটা এত গভীর, এত প্রাণকাড়া যে মনে হচ্ছিল, যেন স্বয়ং দেবী নিজের আবাহন ঘটাচ্ছেন। মণ্ডপের ভেতর দাঁড়ানো মানুষজন একেবারে তন্ময় হয়ে পড়ল, কারও কারও চোখ বুজে এল, কারও ঠোঁট থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল “জয় মা দুর্গা।” ঢাকিরা নিজেদের ঢাক নামিয়ে রেখে হতবাক হয়ে শুনতে লাগল। অথচ এই সময়ে সবাই জানত—মণ্ডপে দাঁড়িয়ে কারও হাতে ঢাক নেই, তবু বাজনা হচ্ছে।

মুহূর্তের মধ্যে অঞ্জলির জন্য ভিড়ের ঢল আরও ঘনীভূত হলো। ঢাকের প্রতিটি আঘাত যেন মানুষের শরীরে প্রবাহিত হলো, যেন বুক কেঁপে উঠল দেবীর উপস্থিতিতে। পুরোহিত বিষ্ণুপদবাবু কিছুক্ষণ মন্ত্র থামিয়ে তাকিয়ে রইলেন চারপাশে। তাঁর চোখে ভয়ও ছিল, বিস্ময়ও ছিল। ভিড়ের মানুষজন ক্রমশ একপ্রকার সম্মোহনের মধ্যে পড়ে গেল। মহিলারা ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থেকেও ভুলে গেলেন কবে অঞ্জলি শুরু হলো, শিশুরা তাদের মায়ের আঁচল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাজনার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল, আর যুবকেরা নিঃশব্দে অনুভব করল, এরকম ঢাকের আওয়াজ তারা কোনোদিন শোনেনি। কিন্তু ঠিক তখনই, প্যান্ডেলের বাইরে থেকে যে-ই বেরোতে চাইছে, অদ্ভুত এক শীতল বাতাস গায়ে এসে লাগছে। বাতাসটা সাধারণ নয়—এর মধ্যে ছিল মৃত্যুর মতো ঠান্ডা এক স্পর্শ, যা শরীরের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিল। কয়েকজন কিশোর বাইরে বেরোতেই থমকে দাঁড়াল, তাদের দাঁত কাঁপতে লাগল শীতে, যদিও বাইরে শরৎকালের স্বাভাবিক গরম আবহাওয়া। কেউ কেউ বলল, এ যেন অশরীরী কোনো ছায়ার নিশ্বাস।

এই অদ্ভুত পরিবেশে প্রথমে শিশুরা ভয় পেতে শুরু করল। তাদের চঞ্চল হাসি মুহূর্তেই থেমে গিয়ে চোখ ভিজে উঠল আতঙ্কে। মায়েরা তাড়াতাড়ি তাদের বুকের কাছে টেনে নিলেন, কিন্তু তাতেও ভয় কাটল না। কয়েকজন বৃদ্ধ, যারা কাঁপা হাতে লাঠি ধরে এসেছিলেন অঞ্জলি দিতে, তাঁরা আর দাঁড়াতে পারলেন না। শীতল বাতাস তাঁদের শরীরের ভেতর দিয়ে ছুঁয়ে গেল, আর তাঁরা যেন অদৃশ্য শীতের ভারে নুয়ে পড়লেন। কারও শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, কারও কপালে ঘাম জমে উঠল, যদিও বাতাস ছিল কাঁপন ধরানো ঠান্ডা। মণ্ডপের ভেতর তখনও ঢাক বেজে চলেছে—মন কাঁপানো, দেহ বিহ্বল করা। কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মনে একটাই প্রশ্ন—এ কি সত্যিই দেবীর আগমনী সুর, নাকি অশুভ কোনো ছায়ার খেলা? মানুষ যতই সেই বাজনায় মোহিত হলো, ততই বাইরে দাঁড়ানোদের মনে ভয় বাড়তে লাগল। ঢাক থামার পর নিস্তব্ধতা গ্রামটাকে আচ্ছন্ন করল। সেদিন অষ্টমীর রাতে আনন্দের সঙ্গে ভয়ও মিশে গেল, আর গ্রামবাসীর মনে চেপে বসল এক অনিশ্চয়তা—এই ঢাক কার হাতে বাজে, আর কেনই বা তার সঙ্গে মৃত্যু-শীতল বাতাস জড়িয়ে থাকে?

অষ্টমীর রাতের অদ্ভুত ঘটনার পরদিন সকালে গ্রামজুড়ে এক অদ্ভুত অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল। মণ্ডপের সামনে বসে সকলে ফিসফিস করে আলোচনা করছে—সেই ঢাকের আওয়াজ আসলে কী? কেউ বলছে দেবীর কৃপা, কেউ বলছে অশুভের ইঙ্গিত। ঠিক তখনই গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ পুরোহিত, নবতিপর হরিপদ ভট্টাচার্যকে ডেকে আনা হলো। সাদা ধুতি, কাঁধে জীর্ণ চাদর, ভেজা চোখে তিনি মণ্ডপে বসে অনেকক্ষণ মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সবাইকে নীরব থাকতে বললেন, তারপর ধীরে ধীরে শুরু করলেন তাঁর স্মৃতির ভাঁড়ার থেকে এক বিস্মৃত কাহিনি। বহু বছর আগে, তিনি তখন তরুণ পুরোহিত। সেই সময় দুর্গাপুজোতেও এ-গ্রামে এক অচেনা ঢাকি এসেছিল। তার বাজনায় মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল গোটা গ্রাম। কেমন যেন যাদু ছিল তার হাতে। কিন্তু মহাষ্টমীর রাতেই এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটে—আকাশ হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে যায়, বজ্রপাত শুরু হয়, আর সেই ঢাকি প্যান্ডেলের কাছেই বজ্রাঘাতে প্রাণ হারায়। লোকজন ছুটে গিয়েছিল, কিন্তু দেখা যায়, তার দেহ ছাইয়ের মতো কালো হয়ে গেছে, হাতে শক্ত করে ধরা ছিল ঢাকের কাঠি। গ্রাম শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে।

হরিপদ ভট্টাচার্য থামলেন, তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, “শুধু এখানেই শেষ হয়নি গল্প।” তিনি জানালেন, সেই ঢাকি মরার আগে মঞ্চে ওঠার সুযোগই পায়নি। প্রতিটি ঢাকির স্বপ্ন—অষ্টমীর অঞ্জলির সময় দেবীর সামনে বাজানো। কিন্তু ভাগ্য তার হাত থেকে সেই সুযোগ কেড়ে নেয়। অনেকে বলেছিল, তার চোখ খোলা ছিল, আর ঠোঁট নড়ছিল—যেন বলছিল, “আমার বাজনা দেবীর সামনে পৌঁছোবে না?” সেই অস্বীকার, সেই অসম্পূর্ণ সাধই নাকি তাকে অশান্ত আত্মায় পরিণত করেছিল। মৃত্যুর পর থেকেই মাঝে মাঝে পুজোর ক’দিন অশ্বত্থতলা থেকে ভেসে আসতে থাকে অদ্ভুত ঢাকের শব্দ। প্রথম দিকে মানুষ ভেবেছিল কাকতালীয় ব্যাপার, কিন্তু বারবার একই ঘটনা ঘটতে থাকায়, সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করল যে মৃত ঢাকির আত্মা প্রতিশোধ নিতে ফেরে। প্রতিশোধ কার বিরুদ্ধে? হরিপদ বললেন—প্রকৃতির বিরুদ্ধে, ভাগ্যের বিরুদ্ধে, আর হয়তো সেই মানুষগুলির বিরুদ্ধেও যারা তাকে প্যান্ডেলে ডাকতে দেরি করেছিল। তার অপূর্ণ সাধ প্রতিটি অষ্টমীতে ফিরে আসে বাজনার রূপে, আর কেউ জানে না, সেই বাজনার অন্তিম পরিণতি কী হতে পারে।

গ্রামবাসীরা শিউরে উঠল এই কাহিনি শুনে। শিশুরা মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরল, যুবকেরা একে অন্যের চোখে তাকাল ভয়ে। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলল, তবে কি গত কয়েকদিন ধরে যে ঢাক বাজছে, সেটি সেই মৃত ঢাকির আত্মারই প্রতিধ্বনি? কেউ আবার বলল, হয়তো সে এখনও অঞ্জলির সময় বাজানোর সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু বৃদ্ধ পুরোহিতের চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল সতর্কতার ছায়া। তিনি বললেন, “যদি সত্যিই সেই আত্মা ফিরে এসে বাজায়, তবে সাবধান হও। ওর বাজনায় মানুষ মোহিত হয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু-শীতল বাতাস বইতে থাকে। এটাই ওর উপস্থিতির লক্ষণ। ও এখনো মুক্তি পায়নি।” ভিড় জমে থাকা গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত হয়ে গেল। অনেকে ভেবে উঠল, পুজোটা এবার শেষ করা ঠিক হবে তো? কিন্তু ততক্ষণে দেবীর চোখ যেন আরও দীপ্তি ছড়াচ্ছিল, আর ঢাকের প্রতিটি আওয়াজ ভেসে উঠছিল মানুষের মনে। প্রশ্ন থেকে গেল—পুরোনো কাহিনি কি কেবল অতীতের গল্প, নাকি বর্তমানের অভিশাপ হয়ে ফিরে এসেছে অষ্টমীর রাতের আঁধারে?

নবমীর দিন মণ্ডপে মানুষের ভিড় ছিল উপচে পড়া। ঢাকিরা নিজেদের বাজনা শুরু করার আগেই গ্রামের মানুষ সজাগ হয়ে বসে ছিল—কবে আবার সেই অচেনা ঢাক বাজবে! বিকেলের পর মেঘলা আকাশে যখন হাওয়া বইতে লাগল, তখনই শুরু হলো সেই অদ্ভুত তাল। গ্রামবাসীরা মনে মনে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু এবার ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা। ঢাকের প্রতিটি আঘাতে প্যান্ডেলের আলো কেঁপে উঠতে লাগল, আর মণ্ডপের ভিতরের কাপড়ের দেয়ালে দেখা গেল এক নাচতে থাকা ছায়া। প্রথমে সবাই ভেবেছিল, কারও শরীরের ছায়া পড়ছে। কিন্তু ভালো করে তাকাতেই দেখা গেল—মণ্ডপের আলো-আঁধারিতে যে ছায়া নাচছে, তার কোনো দেহ নেই। ছায়াটা যেন ঢাকের তালে তালে ভেসে উঠছে, কখনো হাত উঁচিয়ে, কখনো মাথা নত করে, আবার কখনো দেবীর মূর্তির সামনে প্রণাম করছে। ভিড় জমে গেল মণ্ডপের ভেতর। মহিলারা বিস্ময়ে হাত জোড় করে বললেন, “মা এসেছেন!” কেউ কেউ শিউরে উঠলেন, কারণ ছায়ার নাচে যেমন মায়া ছিল, তেমনই ছিল এক অদ্ভুত অস্থিরতা। আর আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো—যে-ই কাছে এগিয়ে গেল, দেখল কিছু নেই। আলো, কাপড় আর মূর্তি সব স্বাভাবিক। তবু দূর থেকে দাঁড়ালে ছায়াটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হলো। একদল বলল, এ দেবীর অলৌকিক রূপ। দেবী নিজে ছায়ার আকারে নেমে এসেছেন তাঁর ভক্তদের সামনে, তাই ঢাকিরাও থেমে গিয়ে মাথা নত করল। ভিড়ের মধ্যে সিঁদুরপরা মহিলারা কাঁদতে কাঁদতে প্রণাম করলেন, মনে হলো তাঁদের বুক ভরে গেছে পরম আনন্দে। কিন্তু আরেকদল সন্দিহান। তাঁদের চোখে এই ছায়ার নাচ কোনো আশীর্বাদ নয়, বরং অভিশাপ। হরিপদ ভট্টাচার্য, বৃদ্ধ পুরোহিত, মুখ গম্ভীর করে বললেন, “দেবী যদি নামেন, তাঁর রূপে শান্তি থাকে। কিন্তু এই ছায়ার নাচে আনন্দের সঙ্গে ভয়ের ছায়াও মিশে আছে। আমি আশঙ্কা করছি, এটা সেই মৃত ঢাকির অসমাপ্ত সাধের প্রকাশ।” কথাটা শুনেই অনেকে আঁতকে উঠল। মহিলারা বাচ্চাদের আঁকড়ে ধরলেন, পুরুষেরা মণ্ডপের বাইরে বেরোতে চাইলো, কিন্তু বাইরে বেরোতেই আবার সেই শীতল বাতাস বয়ে গেল। শিশুদের কাঁপুনি শুরু হলো, বৃদ্ধদের শরীর শিথিল হয়ে পড়ল। ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন তবুও ছায়ার নাচ থেকে চোখ সরাতে পারছিল না, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাঁদের আটকে রেখেছে।

ঢাক বেজে চলল আরও জোরে, ছায়ার নাচও আরও প্রবল হলো। এখন আর এক ছায়া নয়, যেন একাধিক ছায়া মিলে নাচছে। তাদের হাত-পা ছড়িয়ে দিচ্ছে আলোর পর্দায়, কখনো দেবীর পাশে দাঁড়িয়ে, কখনো আবার ভিড়ের দিকে মুখ ফেরাচ্ছে। গ্রামবাসীরা আতঙ্কে ভাবতে লাগল, তবে কি এ কেবল সেই মৃত ঢাকি নয়, বরং আরও আত্মারা যুক্ত হয়েছে তার সঙ্গে? শিশুরা ভয়ে চিৎকার করে উঠল, মহিলারা শাঁখ বাজাতে লাগলেন, যেন সেই আওয়াজে অশুভ দূর হবে। কিন্তু ঢাকের তালে ছায়ারা যেন আরও উন্মত্ত হলো। শেষে হঠাৎ করে বাজনা থেমে গেল, আর মণ্ডপের আলো নিভে অন্ধকার নেমে এলো। সেই অন্ধকারে সবাই শুনতে পেল নিজেদের হৃৎস্পন্দনের শব্দ। যখন আলো ফিরে এলো, তখন ছায়ারা মিলিয়ে গেছে, কিন্তু মানুষের চোখে ভয়ের রেখা স্পষ্ট। কেউ ফিসফিস করে বলল, “এ মা দুর্গা নন, এ এক অভিশপ্ত আত্মার খেলা।” অন্যদিকে ভক্তেরা বলল, “না, এ দেবীর অলৌকিক কৃপা।” দ্বন্দ্বে জর্জরিত গ্রামবাসীরা বুঝল, দুর্গাপুজোর আনন্দের সঙ্গে এ বছর ভয় আর রহস্যও নেমে এসেছে, আর সেই ছায়ার নাচের স্মৃতি আর কোনোদিন মুছে যাবে না।

শারদোৎসবের সেই অষ্টমীর রাতের ভিড় ছিল অন্যবারের তুলনায় অনেক বেশি। ঢাকের তালে-তালে পুজোমণ্ডপের চারপাশে মানুষের উচ্ছ্বাস, হাসি, মন্ত্রপাঠ আর ফুলের সুবাসে চারিদিক মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ভিড়ের ভেতরেই দাঁড়িয়েছিল অরুণ নামের এক কিশোর, প্রায় চৌদ্দ বছরের, কৌতূহলে ভরা চোখ। সে ছিল গ্রামেরই ছেলে, কিন্তু তার স্বভাব অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা—অতিরিক্ত কৌতূহলী, অন্ধকারকে ভয় পেত না, আর রহস্যের গন্ধ পেলে নিজের প্রাণের ভয় না করেই ছুটে যেত। সেই রাতে যখন ঢাকের শব্দ এক অদ্ভুত বুনো তালে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখনই অরুণ প্রথম টের পেল—এই বাজনা আর পাঁচটা ঢাকের মতো নয়। এর মধ্যে যেন এক অদ্ভুত টান আছে, যেন কেউ তাকে ডাকছে। পুজোর ভিড়ের মধ্যেই সে অচেতনভাবে এগিয়ে গেল ঢাকের উৎসের দিকে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো—যতই কাছে যেতে চাইছে, ঢাকির দেখা মিলছে না। কেবল শব্দ বাড়ছে, যেন গভীর অরণ্যের ভেতর থেকে ভেসে আসছে। গ্রামের বড়রা তখন পুজোর কাজে ব্যস্ত, কেউ খেয়ালও করল না যে অরুণ ভিড়ের ভেতর থেকে সরে যাচ্ছে। অরুণ সবার অগোচরে মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে গেল, আর তার পদক্ষেপ ধীরে ধীরে থেমে থেমে অশ্বত্থ গাছের তলায় নিয়ে এল।

অশ্বত্থতলাটা গ্রামের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গাগুলির মধ্যে একটি বলে ধরা হতো। দিনের আলোয় যদিও এটা নিরীহ মনে হতো—গাছের গোড়ায় ছোট ছোট পিঁড়ি, তুলসী গাছ, কখনো বা মহিলারা প্রদীপ জ্বালাতে আসত। কিন্তু রাত হলেই এই গাছটিকে নিয়ে নানা অশরীরী গল্প ঘুরত। গ্রামের বৃদ্ধরা বলত, এই গাছেই নাকি বহু বছর আগে বজ্রপাতে মারা গিয়েছিল সেই অচেনা ঢাকি। মৃত্যুর পরও তার আত্মা শান্তি পায়নি, আর প্রতি দুর্গোৎসবে সে ফিরে আসে—তার অসমাপ্ত বাজনা বাজাতে। অরুণ ঠিক এই গল্পগুলোই মনে করছিল, তবুও কৌতূহলের জোরে এগিয়ে গেল। হাওয়ায় একটা অদ্ভুত শীতলতা ছিল, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কিন্তু ঢাকের শব্দ যেন ক্রমে তার শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে, বুক ধড়ফড় করছে তবুও সে পা থামাচ্ছে না। একসময় গাছের তলায় এসে দাঁড়াতেই সে দেখল—ছায়া নড়ছে। মণ্ডপের আলো এতদূর আসে না, তবুও গাছের তলায় যেন কারও অবয়ব দুলছে, আর সেই দুলতে দুলতেই ঢাকের তীব্র তালে সাড়া দিচ্ছে। অরুণ হাঁপিয়ে উঠে ডাকতে চাইল, কিন্তু গলা থেকে শব্দ বেরোল না। তার চোখ ভরে উঠছিল বিস্ময় আর ভয়ে, কিন্তু অদৃশ্য টানে সে আরও কাছে এগোল।

সেদিনের পর থেকে আর অরুণকে কেউ খুঁজে পায়নি। মণ্ডপের ভিড়ে যখন তার মা খেয়াল করল ছেলে নেই, তখনই হৈচৈ পড়ে গেল। লোকজন মিলে চারদিকে খোঁজা শুরু হলো—পুকুরঘাট, স্কুলের মাঠ, মেলা-প্রাঙ্গণ সব জায়গায়। কেউ বলল, “ঢাকের শব্দের পেছনে গিয়েছিল,” কেউ আবার কেঁপে উঠল, “তা হলে তো সে অশ্বত্থতলার দিকেই গেছে।” একদল তরুণ সাহস করে গিয়ে খুঁজল, কিন্তু গাছের নিচে শুধু শুকনো পাতা আর জোনাকির আলো—অরুণের কোনো চিহ্ন নেই। সেই রাতেই গ্রামের বায়ু বদলে গেল। ঢাকের শব্দ আরও অদ্ভুতভাবে প্রবল হতে লাগল, যেন মণ্ডপ ছেড়ে চারদিক জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ বলল, অরুণের আত্মাও নাকি এখন ঢাকির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। তার মা অজ্ঞান হয়ে পড়লেন, আর গ্রামবাসীর মনে ভয় ঢুকে গেল—এই বাজনা দেবীর মহিমা নয়, বরং এক অভিশপ্ত আত্মার খেলা। যারা সেই রাতে মণ্ডপে ছিল, তারা কসম করে বলল—ঢাকের শব্দ আগের চেয়ে যেন অনেক বেশি কাঁপুনি ধরানো, বুক কাঁপিয়ে দেয়, আর মনে হয় যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি প্রাণ দাবি করছে। তখন থেকেই গ্রামের মানুষ বুঝল, অশ্বত্থতলার রহস্য কেবল লোকগল্প নয়, এর ভেতর সত্যিই এক অশরীরী অভিশাপ লুকিয়ে আছে। আর অরুণ সেই রহস্যের প্রথম শিকার।

অষ্টমীর পরের দিন গ্রামের ভেতরে শঙ্কার ছায়া আরও ঘন হয়ে উঠল। অরুণ নিখোঁজের ঘটনা সবাইকে আতঙ্কিত করেছে, আর সেই রাতের ঢাকের অদ্ভুত সুর যেন গ্রামজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গ্রামপ্রধানরা একমত হলেন—এই অবস্থায় তান্ত্রিক আহ্বান করা ছাড়া আর উপায় নেই। গ্রামের প্রাচীন তান্ত্রিক, রামপ্রসাদ মল্লার, বহু বছর ধরে অশ্বত্থতলার রহস্য নিয়ে জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। তিনি বিশেষজ্ঞ মন্ত্রপাঠ ও আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানে। মল্লার সবাইকে সতর্ক করে বললেন, “যে আত্মা ফিরে এসেছে, সে শান্ত নয়। শুধুই ঢাকের প্রতিধ্বনি নয়, এতে তার অপূর্ণ ইচ্ছা লুকিয়ে আছে। আমরা যদি আহ্বান না করি, তাহলে গ্রামের মানুষ ও পুজোর আনন্দ উভয়ই বিপদে পড়বে।” গ্রামবাসীরা ভয় পেয়েও মানতে বাধ্য হল। মল্লার ঠিক করলেন, প্যান্ডেলের ভেতরে মন্ত্রপাঠের স্থান নির্ধারণ করা হবে, ঢাকির উপস্থিতি টের পেতে সবাই শান্ত মন নিয়ে বসবে, এবং আয়োজিত ছত্রাকের মতো উজ্জ্বল আলো দিয়ে ঢাকিকে আকৃষ্ট করা হবে। সন্ধ্যার শুরুতে, মল্লার ঘুমন্ত মন্ত্রের মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন—ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেল ধ্বনিসমূহ, যেগুলো ঘন আকাশের মতো গ্রামজুড়ে ভেসে গেল।

মন্ত্রপাঠের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকের সুরও ধীরে ধীরে প্রতিধ্বনি দিতে লাগল। তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো—ঢাকির স্বর মল্লারের মন্ত্রকে ঢেকে দিল। প্রত্যেক মন্ত্র যেন বাতাসে ভেসে যাওয়া ধুলো হয়ে গেল, আর ঢাকির আওয়াজ আরও গভীর, আরও মনকাঁপানো হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ পর গ্রামবাসীর চোখে ভয় আর বিস্ময় মিশ্রিত হয়ে গেল। ঢাকের প্রতিটি আঘাত যেন মানুষের বুকের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হলো, মনে হলো প্রতিটি ঘা অদৃশ্য কারও হৃদয়ের বেদনা প্রকাশ করছে। মল্লার তৎপরতার ফলে মানুষ একত্রে বসে থাকলেও, মন কাঁপছিল—কারণ ঢাকের আওয়াজ শোনার সময় তারা বুঝতে পারছিল, এটি কেবল কোনো মৃত ঢাকির প্রতিধ্বনি নয়, বরং সেই ঢাকির আত্মার দীর্ঘায়িত কষ্ট ও অসম্পূর্ণ সাধ। গ্রামজুড়ে বাতাস শীতল হয়ে উঠল, অথচ মন্ত্রপাঠের শব্দে যেন কেউ অনাগত শক্তিকে চেপে ধরছে। সবাই বুঝতে পারল—মন্ত্রপাঠ এবং ঢাকের তালে এক অদ্ভুত লড়াই চলছে।

শেষ মুহূর্তে ঘটে এমন কিছু যা সকলকে স্তব্ধ করে দিল। মল্লারের মন্ত্র ক্রমে তীব্র হয়ে উঠল, ঢাকের সুরও অনবরত প্রতিধ্বনিত হলো। তখন হঠাৎ একটি ভিন্ন ঢাকের সুর শোনা গেল—আগের মতো আগ্রাসী নয়, বরং বিষণ্ণ, বেদনাপূর্ণ। যেন কারও আত্মা কাঁদছে, হাহাকার করছে, দীর্ঘদিন ধরে ধরে রাখা যন্ত্রণার প্রকাশ। মানুষ চোখের সামনে কিছুই দেখতে পারছিল না, তবু শোনা যাচ্ছিল স্পষ্ট সুর। শিশুদের কাঁপুনি বেড়ে গেল, বৃদ্ধেরা মুখে হাত চেপে ধরলেন, আর মহিলারা বললেন—“এ যেন সেই কিশোরের আত্মা, অরুণের অন্তরে লুকানো বেদনা।” ঢাকের এই সুরে মনে হচ্ছিল, তান্ত্রিক মন্ত্রপাঠ এত শক্তিশালী নয় যে সে এই আত্মার সমস্ত কষ্ট মুছে দিতে পারে। মল্লার জানালেন, এটি সেই মৃত ঢাকির অসম্পূর্ণ সাধের চূড়ান্ত প্রকাশ—যেন সে চায়, কেউ তার বার্তা শোনুক। রাত শেষে ঢাক থেমে গেল, মন্ত্রপাঠও শেষ হলো, কিন্তু গ্রামবাসীর মনে সেই ভিন্ন সুরের প্রতিধ্বনি আজীবন থাকবে। তারা বুঝল, পুজোর আনন্দের সঙ্গে অতীতের অভিশাপও জড়িয়ে আছে, আর মল্লারের মন্ত্রও সবসময় এই ঢাকের আত্মাকে পুরোপুরি শান্ত করতে পারবে না।

অষ্টমীর শেষের রাত। মণ্ডপের চারপাশে লোকের ভিড় এখনও ছেঁড়া যায়নি। দুর্গাপুজোর আনন্দ এবং ভয়—দুটোই একসাথে মানুষকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। অরুণ নিখোঁজের ঘটনার পর থেকে গ্রামবাসীর মনে অদ্ভুত এক অস্থিরতা। রাতের নিঃশব্দতা আর ঢাকের তীব্র প্রতিধ্বনি যেন এক অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব প্রমাণ করছে। ঠিক তখনই গ্রামের প্রবীণ বৃদ্ধা কুণালি দেবী উঠে বললেন, “এবার সত্য বলা প্রয়োজন।” সবাই অবাক হয়ে তাকাল। কুণালি দেবী বহু বছর ধরে একাকী থাকেন, মায়ের চোখে কষ্ট আর বেদনার রেখা স্পষ্ট। তিনি বলতে লাগলেন, “সেই ঢাক যে বাজছে, সেটি আমার পুত্র অরুণের। হ্যাঁ, যে অরুণ আমাদের চোখের সামনেই নিখোঁজ হয়েছে, সেই অরুণই অকাল মৃত্যু গ্রাস করার পরও প্রতিটি দুর্গোৎসবে ফিরে আসে। সে চায় না কেউ তাকে দেখুক, শুধু তার বাজনার মাধ্যমে যেন প্রমাণ হয়, সে এখনও জীবিত—অন্তত আত্মার রূপে।” গ্রামবাসী প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কেউ কেউ ভাবল, এতদিন ধরে যা ঘটছে, তা শুধুই অদ্ভুত কাহিনি। কিন্তু কুণালি দেবীর চোখে অশ্রু, কণ্ঠে কাঁপন—সবকিছু সত্য বলে দিচ্ছিল।

তিনি আরও বললেন, “আমি জানতাম, আমার সন্তান আর্থিক বা দৈহিক দিক দিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে না, কিন্তু আত্মার শক্তি কখনো মরে না। প্রতিবার দুর্গাপুজোর সময়, যখন মণ্ডপে ঢাক বাজে, সে আসে। সে চাইছে আমি তার কষ্ট বুঝি, তার অসম্পূর্ণ সাধের গল্প শুনি। তার বাজনা শুধুই তালের খেলা নয়, বরং আত্মার আর্তনাদ। যে রাত তার জন্য নির্ধারিত, সেই রাতেই সে ফিরে আসে, আমার চোখে ধরা না পড়ে, যেন কোনো অভিশপ্ত বন্ধন পুরো হয়। আমি তাকে ডাকতে পারি না, সে নিজের ইচ্ছায় আসে, নিজের ঢাক বাজায়। আমি শুধু প্রার্থনা করি, তার শান্তি যেন পূর্ণ হয়।” বৃদ্ধা কুণালির কথায় গ্রামবাসীর মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। কেউ মন্ত্রপাঠের সাহায্য নেওয়ার কথা বলল, কেউ বলল—এটাই প্রকৃত মায়া, যা কোনো মন্ত্রপাঠের সীমার বাইরে। অরুণের ঢাকের আওয়াজ এখন শুধু ভয় সৃষ্টি করছে না, বরং মায়ের সঙ্গে সন্তানের অন্তর্গত সম্পর্কের এক অদৃশ্য সেতু তৈরি করছে।

সন্ধ্যার শেষ প্রান্তে, মণ্ডপে তখনও বাজছে সেই অচেনা ঢাক। ভিড়ের চোখে ভয়, কুণালির চোখে শান্তি। ধীরে ধীরে গ্রামবাসী উপলব্ধি করল—এখন থেকে আর কেউ অরুণকে খুঁজে পাবে না, কারণ সে চাইছে না। ঢাকির এই উপস্থিতি, মায়ের অনুভূতিতে জড়ানো বেদনা, এবং ভিড়ের মধ্যে মোহিত মানুষ—সবকিছু একত্রে এক রহস্যময়, মায়ার এবং বেদনার গল্প বলে। ঢাকের প্রতিটি ঘা যেন মানুষের হৃদয় স্পর্শ করছে, শেখাচ্ছে অসমাপ্ত সাধ এবং মাতৃস্নেহের শক্তি। সেই রাত শেষ হওয়ার পরও, ঢাকের সুর গ্রামে ভেসে থাকল—মায়ের চোখে অদৃশ্য, ভয়ের মধ্যে মিশে থাকা আনন্দ, আর অশ্বত্থতলার ছায়ায় লুকানো সত্য। গ্রামবাসীরা বুঝল, দুর্গাপুজোর আনন্দের সঙ্গে ভয়, রহস্য আর প্রেমও জড়িয়ে থাকে, আর অরুণের ঢাক সেই আবেশের চিরন্তন প্রতীক হয়ে থাকবে।

অষ্টমীর রাত ক্রমে ফুরোতে আসে। প্যান্ডেলগুলো এক এক করে বন্ধ হয়ে যায়, মণ্ডপের আলো নিভে আসে, আর গ্রামের মানুষ শান্ত হতে শুরু করে। ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ হেসে উঠল, কেউ কেউ নিজের কাঁপানো বুক মলিন করল—যদি অরুণ বা সেই অশরীরী ঢাকি হঠাৎ ফিরে না আসে। পুরো গ্রামে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। বাতাসে এখনও অদ্ভুত এক শীতলতা রয়ে গেছে, যা রাতের দীর্ঘ ঢাকের প্রতিধ্বনির ছাপ ফেলেছে। লোকেরা বলল, “আজ অন্তত একটি রাত শান্ত।” কিন্তু সত্যি কি তাই? মল্লারের মন্ত্রপাঠ, কুণালি দেবীর অশ্রুসিক্ত বাণী—সবকিছু এখন যেন চুপচাপ। মণ্ডপে কেউ থাকছে না, কিন্তু চোখ বুজলে মনে হয়, কোথাও গভীর অন্ধকারে ঢাকির মৃদু প্রতিধ্বনি এখনো আছে। গ্রামের অনেকেই ভেবেছিল, অরুণ হয়তো অবশেষে শান্তি পেয়েছে। মায়া, বেদনা, অভিশাপ—সব মিলিয়ে যেন রাতের বাতাসে হারিয়ে গেছে।

তবে নিঃশব্দতার মাঝে হঠাৎ যেন হাওয়া এক ধরণের গা ছমছমে শীতলতা বয়ে আনল। গ্রামবাসী যাদের চোখে শ্বাসরোধকর ভয়, তারা অচেতনভাবে তাকিয়ে রইল। কেউ বলল, “এ কি শেষ?” কেউ আবার ফিসফিস করে বলল, “হয়তো আরও একটি রাত বাকি আছে।” ঢাকের সেই অদৃশ্য আওয়াজ যেন প্রতিটি পাথর, গাছ, মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কেউ স্পর্শ করতে পারছে না, কেউ দেখতে পারছে না, তবু তা মনে হচ্ছিল—কেউ বা কিছু তাদের চারপাশে এখনও উপস্থিত। শীতল বাতাসের সঙ্গে সেই ঢাকের সুর যেন মানুষের হৃদয়ে অশান্তি, শঙ্কা আর উত্তেজনা মিশিয়ে দিয়েছে। মণ্ডপে থেকে মায়ের চোখে অরুণের অস্তিত্ব অদৃশ্য হলেও, গ্রামের লোকেরা মনে মনে জানে, তার আত্মার প্রভাব এখনও সক্রিয়। তারা বুঝতে পারল, মুক্তি পেয়েছে নাকি অভিশাপ হয়ে ফিরে আসবে—এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।

রাতের শেষ প্রান্তে, গ্রামের আকাশে চাঁদ অল্প অল্প আলো ছড়াচ্ছে। মন্দ বাতাসের সঙ্গে সেই ঢাকের প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে, কিন্তু এখন তা অনেক শান্ত, অনেক দূরে। গ্রামবাসীরা বাড়ি ফিরে গেছে, ঘর-দোর বন্ধ, শ্বাস নরম, আর মনে এক অদ্ভুত শূন্যতা। কেউ কেউ জানল—আজ রাতে আনন্দ আর ভয়ের মিশ্রণ শেষ হয়েছে, তবে আগামী বছর আবার যদি অষ্টমীর রাতে ঢাক বাজে, তখন কি একই অভিশাপ ফিরে আসবে নাকি এ শুধুই মুক্তি—কেউ নিশ্চিত বলতে পারবে না। প্যান্ডেলের বাইরে অশ্বত্থতলা শান্ত, মায়ের চোখে অশ্রু শুকিয়ে গেছে, কিন্তু ভিতরে লুকিয়ে আছে সেই অসমাপ্ত গল্প। ঢাকির প্রতিধ্বনি হয়তো শেষ হয়েছে, কিন্তু গ্রামবাসীর মনে অশান্তি, কৌতূহল আর ভয় এখনো থেকে গেছে, যেন রাতের অভিশাপ চিরকাল ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই রাতের স্মৃতি, অদৃশ্য ঢাক, অশ্বত্থতলার ছায়া—সব মিলিয়ে গ্রামের মানুষের মনে এক অমোঘ রহস্য হয়ে রইল, যা কেউ কখনো ভুলতে পারবে না।

১০

এক বছরের অপেক্ষার পর আবার এসেছে আশ্বিন, আর গ্রামের মানুষ নতুন উদ্দীপনা নিয়ে পুজোর প্রস্তুতি শুরু করল। নতুন মণ্ডপ, সাজানো আলোকসজ্জা, ফুল আর ধূপের সুবাস—সবকিছু আগের দিনের মতোই, কিন্তু সবাই মনে মনে একটু সতর্ক। অরুণের নিখোঁজের রাত এবং ঢাকের সেই অদ্ভুত সুরের স্মৃতি এখনো গ্রামবাসীর চোখে চোখে ভাসছে। প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে, ভক্তরা ভিড় জমিয়েছে, কিন্তু কেউই জানে না—এই শান্তিময় আবহে কি এক অশরীরী শক্তি লুকিয়ে আছে। সপ্তমীর সন্ধ্যায় সমস্ত কিছু শিথিল মনে হলো, ঢাকের শব্দ নেই, মন্দিরের মূর্তিগুলি শান্ত, বাতাস কোমল। গ্রামবাসীরা আনন্দে আত্মহারা, মনে মনে ভাবছে—এক বছর পরও কি দুর্গা তাদের আনন্দকে রক্ষা করবেন? কিন্তু রাতের মধ্যরাত যখন এল, তখন অশ্বত্থতলার দিকে হঠাৎ বাজতে লাগল সেই ঢাক। ধ্বনিটি এত শক্তিশালী, এত অনিবার্য, যে মণ্ডপের সমস্ত আলো, ফুল আর মানুষের হাসি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।

ঢাকের আওয়াজ ক্রমে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। শীতল বাতাস বইতে লাগল, আর মানুষের চোখে আতঙ্কের ছাপ পড়ল। এই বছর ধরে গ্রামবাসী প্রত্যেকেই চিন্তা করছিল—অরুণ কি শান্ত হয়েছে, নাকি তার অসমাপ্ত সাধ আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে? ঢাকের প্রতিটি আঘাত যেন হৃদয় কেঁপে দিচ্ছে, মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য ঢাকি তাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ বলল, “এ কি দেবীর ইচ্ছা, নাকি অভিশপ্ত আত্মার খেলা?” মল্লারের কথাগুলি মনে পড়ল—মন্ত্রপাঠ কেবল ঢাকির শক্তিকে সাময়িকভাবে দমন করতে পারে, কিন্তু অসমাপ্ত বেদনা চিরন্তন। গ্রামের লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে প্যান্ডেলের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকল, কেউ সাহস করে বাইরে তাকাতে পারল না। ঢাকের ধ্বনির সঙ্গে যেন ছায়ার নাচ আবারও শুরু হয়েছে, অদৃশ্য হলেও অনুভূত। ছায়া মেলে বাতাসে, গাছের তলে, যেন এক অশরীরী শক্তি গ্রামকে ভেতর থেকে নাড়ছে।

কিছুক্ষণ পরে, গ্রামের প্রবীণরা হঠাৎ একত্রিত হয়ে মনে করল—ঢাকের এই শক্তি হয়তো কোন মুক্তির বার্তা নয়, বরং মনে করিয়ে দিচ্ছে অতীতের অভিশাপ, অরুণের আত্মার অস্পষ্ট বেদনা। কুণালি দেবীর চোখে আবারও অশ্রু জমল, কিন্তু এবার ভয় নয়, বরং বোঝাপড়ার শান্তি—অরুণকে তারা দেখেছে না, কিন্তু তার উপস্থিতি স্পষ্ট। গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, কৌতূহল, শ্রদ্ধা—সবকিছু মিশে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করল। ঢাক বাজতে থাকে, কিন্তু এবার ভিড় শান্ত। কেউ ছুটছে না, কেউ চিৎকার করছে না; বরং সবাই মন্দিরের দিকে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে, যেন প্রত্যেক ঢাকের আঘাত তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করছে, অদৃশ্য অশ্বত্থতলার ছায়ায় লুকানো সত্যের সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছে। রাত শেষ হয়, তবে ঢাকের প্রতিধ্বনি, অশ্রুসিক্ত মায়ের মন এবং অশ্বত্থতলার রহস্য—সব মিলিয়ে গ্রামের মনে এক চিরন্তন স্মৃতি হয়ে রইল। যে রাতের আবহে ভয়, মায়া, রহস্য ও ভালোবাসা একসাথে মিশেছে, তা যেন আগামী আশ্বিনেও ফেরার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

সমাপ্ত

1000067739.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *