নয়না চক্রবর্তী
(১)
প্রতিদিন সকালে ছাদে উঠে নাচ করাটা ছিল সঞ্চারীর জীবনের রুটিনের মতো। ধান্দার কথা, কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি, অডিশনের প্র্যাকটিস—সব মিলিয়ে একটা ঘূর্ণির মধ্যে বাস করত সে। বেহালার গলির ভেতরের ছোট্ট বাড়িটার জানালা দিয়ে আসা রোদে সঞ্চারী যেভাবে নিজের ছায়াকে নিয়ে খেলা করত, সেই ছবিগুলো এখন শুধু মায়ার স্মৃতি। ওই দিনে, দুর্ঘটনার আগের সকালে, সে স্নিগ্ধ মুখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল—একটা নতুন নাচের স্টেপ তৈরি করেছিল, ভাবছিল কলেজের উৎসবে এটা দেখাবে। অরিজিৎ আগের দিন বলেছিল, “তুই রীতিমতো পেশাদার হয়ে গেছিস রে!”—আর সেই প্রশংসা যেন মনের মধ্যে একটা শিহরণ তুলেছিল। মা তখন ভাত বসাচ্ছিলেন, পেছন থেকে বলেছিলেন, “সঞ্চারী, গ্যাস অফ করিস না—ভুলে যাস মাঝে মাঝে।” জীবনের এমন সাধারণ আর ছিমছাম মুহূর্তগুলো কখন যে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে, কেউ বুঝতে পারে না। সেদিন বিকেলে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাইক করে ফিরছিল সঞ্চারী, হেডফোনে লতাজির গান বাজছিল। একটা ট্যাংকার গাড়ি বাঁ দিক থেকে ওভারটেক করতে গিয়ে হঠাৎ ব্রেক ফেল করে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথিবী উল্টে যায়।
হাসপাতালের বিছানায় চোখ খুলে প্রথম যেটা সঞ্চারী বোঝে, তা হল—চারপাশের আলো এক অচেনা সাদা, একটা ধাতব গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে আছে, আর শরীরের একটা বড় অংশ নিস্তেজ লাগছে। ডাক্তারদের ফিসফিস, নার্সদের কাঁচা কাঁচা হেঁটে চলা, আর একফাঁকে মায়ের কান্না—সব একসঙ্গে মিশে গিয়ে একটা অসহায় নৈঃশব্দ্যে রূপ নিচ্ছিল। তার কোমরের নিচ থেকে কোনো অনুভূতি নেই—এই কথাটা প্রথম যখন শুনেছিল, তখন যেন মাথার মধ্যে সব শব্দ থেমে গিয়েছিল। “Complete spinal cord injury”—ডাক্তারের কণ্ঠে নির্লিপ্ত একটা বিজ্ঞানের ঠান্ডা, যার মানে সঞ্চারীর কাছে তখন শুধুই অন্ধকার। তাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হলো, আর বলে দেওয়া হলো, হয়তো সারাজীবন সে হাঁটতে পারবে না। অনেকদিন ওয়ার্ডে একাকী বসে থাকা, জানলার পাশে হুইলচেয়ারে বসে বাইরের রিকশা, ফুলওয়ালা আর খেলতে থাকা শিশুদের দেখে সঞ্চারীর মনে হতো, যেন সবকিছু এগোচ্ছে—শুধু সে পড়ে আছে পিছনে। বন্ধুদের কেউ ফোন করে, কেউ করে না। যারা আসে, তারা চোখে অতিরিক্ত সহানুভূতি নিয়ে বসে থাকে, এবং বিদায় নেবার সময় মুখে বলে, “তুই শক্ত থাকিস, সঞ্চু”—এই কথাটা শুনলেই সে মনে মনে কেঁদে ফেলত, কারণ তার ভেতরকার সঞ্চারী অনেক আগেই মরে গেছে বলে মনে হতো।
তবে সেই মরতে থাকা সময়ের মধ্যেই মাঝে মাঝে মা’র চোখে একটা অদ্ভুত আলো দেখতে পেত সঞ্চারী—যেন বিশ্বাস করতে চাইছেন, আবার সব ঠিক হবে। কিন্তু মা কিছু বলতেন না, শুধু রাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেও সঞ্চারীর জীবন বদলায় না, বরং আরো কঠিন হয়। সমাজের কৌতূহলী চোখ, আত্মীয়দের করুণা, কলেজে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে চুপ থাকা শিক্ষক—সব মিলিয়ে জীবনের প্রতিটি জানালা যেন ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। একদিন রাত জেগে, ফোনে ইউটিউব স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ তার সামনে আসে এক বিদেশি নারী হুইলচেয়ারে বসে নাচ করছেন—রাগ, ছন্দ, অভিব্যক্তি—সব কিছু দিয়ে একেবারে আত্মাকে নাড়িয়ে দেয় সঞ্চারীর। প্রথমে হেসেছিল সে, “এসব লোক দেখানো,” ভেবে। কিন্তু পরের রাতেও ভিডিওটা খুলে দেখে, আবার দেখে, বারবার দেখে। আর তখনই তার মধ্যে এক ধরণের অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে—যেটা ছিল না বহুদিন। তার মনে হয়, যদি এই নারী পারতে পারেন, সে কেন পারবে না? শুরু হয় নিজের সঙ্গে প্রতিদিনের এক মৌন যুদ্ধ। জানলার পাশে বসে, ফোনের স্ক্রিনে দেখে দেখে সে শিখতে থাকে ছোট ছোট হ্যান্ড মুভমেন্ট, মুখের অভিব্যক্তি, শরীরের উপরের অংশের ছন্দ। তার অঙ্গ কাজ না করলেও, আত্মা যেন ধীরে ধীরে আবার নাচতে শুরু করে। আর সেই রাতে, বহুদিন পর প্রথমবার সে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে বলে, “আমি এখনো শেষ হয়ে যাইনি।”
(২)
বাড়ি ফেরার দিনটা যেন এক বিষণ্ণ শবযাত্রার মতো ছিল। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে শুয়ে বাইরের চেনা অলিগলি আর বাজারের হট্টগোল দেখছিল সঞ্চারী—যা একসময় তার রুটিন জীবনের অংশ ছিল, আজ যেন সবকিছু দূরের এক জগৎ মনে হচ্ছিল। বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়ানো প্রতিবেশীরা কেউ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল, কেউ চোখে করুণা নিয়ে তাকালো। কেউ কেউ বলল, “এখন থেকে তো ওর সবকিছুতেই তোদের সাহায্য লাগবে, বাচ্চাটা কষ্টে আছে।” মীনাক্ষী মাথা নিচু করে শুনে গেলেন সব, আর সঞ্চারী হুইলচেয়ারে বসে ভাবল, এই পৃথিবীটা এত সহজেই কীভাবে কাউকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে পারে? তার ঘরটা বদলে দেওয়া হয়েছে—একটা মেডিকেল বেড, পাশেই বাথরুমে ঢোকার জন্যে নতুন র্যাম্প। কিন্তু ঘরের দেয়ালে ঝোলানো পুরোনো কলেজ ফেস্টের পোস্টারগুলো ঠিক আগের মতোই আছে, যেন একটা টানা অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করে। প্রতিদিন সকালবেলা জানলার পাশে বসে সঞ্চারী শুধু বাইরের হট্টগোল শোনে—সেই স্কুলের বাচ্চাদের হইচই, ফুলওয়ালার হাঁক, আর দূরে বাজতে থাকা কে জানে কার নাচের প্র্যাকটিস। মনে হয়, গোটা পৃথিবী ছুটে চলেছে আর সে তার নিঃশব্দ ঘরে আটকে পড়েছে।
কিন্তু এই নিঃশব্দতাও কখনো কখনো ভয়ঙ্করভাবে সরব হয়ে ওঠে। রাতে ঘুম না এলে সঞ্চারী তার পুরোনো ভিডিওগুলো দেখতে শুরু করে—কলেজ ফেস্টে তার পারফরম্যান্স, যেখানে সে কোমরের মুভমেন্টে ঘুরে গিয়েছিল নিখুঁত ছন্দে; বা সেই অডিশনের দিন, যেখানে বিচারকরা দাঁড়িয়ে করতালি দিয়েছিল। এসব দেখে কখনো হঠাৎ হেসে ওঠে, কখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ খুললে বন্ধুরা খুব একটা মেসেজ করে না—কেউ কেউ খোঁজ নেয়, আবার হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় তখন, যখন কেউ এসে বলে, “তোকে দেখলে বুঝতে পারি, জীবন কত কঠিন”—কারণ তখন মনে হয়, সে যেন একটা জীবন্ত শিক্ষা উপকরণ হয়ে গেছে। এমন এক সন্ধ্যায় মা চুপচাপ এসে তার পাশে বসে পড়ে, চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলেন, “এই সময়টাই আসল পরীক্ষার। বাইরের দুনিয়া তো ঠিক করতে পারবি না, কিন্তু নিজের ভিতরটা ঠিক রাখবি।” সঞ্চারী মায়ের চোখে চেয়ে দেখে—সেখানে দুঃখ আছে, কিন্তু হারের চিহ্ন নেই। সে জানে না, কীভাবে এই মা দিনের পর দিন স্কুল সামলে, সমাজের মুখোমুখি হয়ে, নিজের মেয়েকে নিয়ে এমনভাবে মাথা উঁচু করে থাকতে পারে। সেই রাতেই সঞ্চারী নিজের জীবনের প্রশ্নটা নতুন করে ভাবে—“আমি কি শুধু একটা দুঃখের গল্প হয়ে থাকব?”
পরদিন সকালে নিজের চুল আঁচড়াতে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় সঞ্চারী। সে দেখে, তার মুখটা আর আগের মতো নয়—চোখে অনেকটাই বিষাদ, কিন্তু কোথাও যেন একটু কঠোরতা এসেছে। আয়নার পাশে টাঙানো একটা পুরোনো নাচের ছবি—যেখানে সে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছবিটা দেখে হঠাৎ একটা অনুভব জাগে—সে এখন দাঁড়াতে পারবে না, কিন্তু হাত তো আছে! মুখ তো আছে! অনুভূতি তো এখনো মৃত হয়নি। সে আবার ইউটিউব খুলে সেই হুইলচেয়ার নৃত্যশিল্পীর ভিডিওটি চালায়—এইবার ভয় নয়, মনোযোগ নিয়ে দেখে। খেয়াল করে, কীভাবে একটানা মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে গল্প বলছেন শিল্পী, কীভাবে হাত ও শরীরের ঊর্ধ্বাংশ ব্যবহার করে সৃষ্টি করছেন ছন্দ। হঠাৎ তার মনে হয়, এই ঘরটাই হতে পারে তার মঞ্চ, এই হুইলচেয়ার তার নতুন ছন্দের বাহন। মা ঘরে ঢুকে দেখে সঞ্চারী আয়নার সামনে একা বসে কিছু একটা চেষ্টা করছে—হাত নাচাচ্ছে, মুখে অভিব্যক্তি দিচ্ছে। “নাচ করছিস?” মীনাক্ষীর প্রশ্নে সঞ্চারী চুপ করে থাকে। তার চোখে তখন আর করুণা নেই, সেখানে ঠিক যেন এক নতুন সূর্যোদয়ের আলো। সেই দিন, সেই মুহূর্তে, ঘরের নিঃশব্দ দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে একটা নতুন জীবন মাথা তোলে—একটা এমন জীবন, যা ভাঙা শরীরের মধ্যেও শিল্প খুঁজে নিতে চায়।
(৩)
সকালের আলোটা এখন আর সঞ্চারীর চোখে আগের মতো ধূসর নয়। জানলার ফাঁক গলে পড়া সূর্যের রশ্মি তার মুখে লাগলে সে চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে—তাঁর ভেতরের ছন্দ অনুভব করতে চায়। এবার প্রতিদিনের রুটিনে এসেছে নতুন সংযোজন—হুইলচেয়ারে বসেই সে নাচ শেখে, ইউটিউব খুলে দেখে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের কোরিওগ্রাফি, আর চেষ্টা করে নিজের মতো করে তা রূপ দিতে। প্রথমে তার শরীর বাধা দেয়—হাত উঠছে না ঠিকমতো, ঘাড় ব্যথা করছে, মনের মধ্যে বারবার প্রশ্ন আসে, “আমি কি এটা পারব?” কিন্তু প্রতিদিন কিছু না কিছু শিখতে শেখার আনন্দ তাকে একটা নতুন ধরণের অভ্যেসে টেনে নিচ্ছে। একটা পুরনো শাড়ির ওড়নাকে সে ব্যবহার করে হাতের লাইন তৈরির অনুশীলন করে, আবার মাঝেমধ্যে সংগীত চালিয়ে মুখের অভিব্যক্তি আয়নার সামনে নিজেকে দেখিয়ে ঠিক করে নেয়। সঞ্চারীর ঘরটি যেন ধীরে ধীরে এক গোপন মঞ্চে পরিণত হয়েছে—যেখানে সে নিজেই দর্শক, শিল্পী, নির্দেশক। মা মাঝে মাঝে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে—মেয়েটি আবার হেসে উঠেছে, নিজের সঙ্গে কথা বলছে। হয়তো প্রতিটা মুভমেন্ট নিখুঁত নয়, কিন্তু প্রতিটি চেষ্টা যেন এক একটি বিজয়।
সঞ্চারী জানত, এই নাচ দেখে কেউ উৎসাহ দেবে না, কেউ হয়তো মজা নেবে। তাই প্রথম দিকে ভিডিও করার কথা ভাবেনি। কিন্তু একদিন তার কলেজের পুরোনো বন্ধু অরিজিৎ দত্ত হঠাৎ এসে হাজির হয়—হাতে DSLR ক্যামেরা, মুখে একগাল চওড়া হাসি। “তোর ভিডিও দেখব রে, পারবি তো একটা পারফর্ম করতে?” সঞ্চারী প্রথমে লজ্জা পেল, কিন্তু অরিজিৎ তাকে জানায়, সে ইউটিউবেই দেখেছে এমন নাচ, আর মনে পড়েছে সঞ্চারীর কথা। তারা ঘরের এক কোণ পরিষ্কার করে, সাদা চাদর ঝুলিয়ে একটি ব্যাকড্রপ তৈরি করে। অরিজিৎ জানে সঞ্চারীর অ্যাঙ্গেল, জানে কীভাবে তার মুখের অভিব্যক্তি তুলে ধরতে হবে। ক্যামেরার সামনে প্রথমবার সঞ্চারী নার্ভাস হয়ে যায়, কিন্তু সংগীত বাজতেই তার মধ্যে এক অদ্ভুত রূপান্তর ঘটে—তাকে যেন নিজের অসার পা-দুটোর কথা আর মনে থাকে না। নাচ শেষে ঘেমে উঠে সে যখন ক্যামেরার দিকে তাকায়, তখন অরিজিৎ বলে, “তুই জানিস না, তুই এখন কারা inspiration হতে চলেছিস।” সেই ভিডিওটি পোস্ট হয় ইউটিউবে, নাম দেওয়া হয়: “Dance Beyond Movement”।
প্রথম কয়েক ঘণ্টা নীরব থাকে প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু পরদিন ভোরে অরিজিৎ তাকে ফোন করে বলে, “চেক কর, তোর ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে!” ভিডিওর নিচে কমেন্ট পড়ছে—কেউ লিখেছে, “You just made me cry”, কেউ লিখেছে, “I can’t believe how powerful this is.” সঞ্চারী প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারে না—তার ঘরের কোণে বসে করা একটা নাচ, তার হাত, মুখ, চাহনি—তা এত মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে গেছে! কিছু কমেন্ট তাকে নাড়িয়ে দেয়—একজন লিখেছে, “আমি ক্যান্সার সারভাইভার, তোমার মতো শক্তি পেতে চাই।” অন্যজন বলেছে, “তুমি আমাদের মেয়েদের জন্য আদর্শ।” এই অধ্যায়ে, সঞ্চারী শুধু নিজেকে ফিরে পায় না, সে উপলব্ধি করে—তার শিল্প কেবল তার নয়, হাজারো ভাঙা মানুষদের ভেতর আলো জ্বালাতে পারে। নিজের শরীরের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে সে যা সৃষ্টি করছে, তা পর্দার আড়ালে থাকা অগণিত মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে যাচ্ছে—এবং সেখান থেকেই শুরু হচ্ছে তার নৃত্যের নতুন পরিচয়।
(৪)
সঞ্চারীর জীবনে অরিজিৎ যেন হঠাৎ করে এক নতুন রঙ নিয়ে আসে—একজন পুরনো বন্ধু, যে শুধু পুরোনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয় না, বরং বর্তমানের দিকচিহ্ন দেখায়। ভিডিও ভাইরাল হবার পরদিনই সে সঞ্চারীর ঘরে এসে দাঁড়ায় ক্যামেরা নিয়ে, বলে, “আরও কিছু শ্যুট করি?” সঞ্চারী একটু অবাক হয়, জিজ্ঞেস করে, “মানুষ হাসাহাসি করবে না?” অরিজিৎ উত্তর দেয়, “যারা হাসে, তারা নিজের দুঃখ ঢাকে। তুই ওদের জন্য না, তোর জন্য কর।” সেই কথাটাই যেন সঞ্চারীর মনের মধ্যে বাজতে থাকে সারাদিন। তারা এবার নতুন ভিডিও বানায়—‘Rabindra Fusion on Wheel’। পেছনে রবীন্দ্রসঙ্গীত, সঞ্চারীর মুখভঙ্গি, হাতের চলন আর অরিজিৎ-এর নিখুঁত ফ্রেমিং—সব মিলিয়ে ভিডিওটি যেন এক সজীব আবেগের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। এই কাজের মধ্যে দিয়ে অরিজিৎ এবং সঞ্চারীর বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়। রাতে এডিটিং করতে করতে অরিজিৎ বলে, “তুই জানিস না, তোর প্রতিটা মুভমেন্টে একটা কবিতা আছে।” সঞ্চারী চুপ করে থাকে—ভেতরে কোথাও যেন সেই কথাগুলো আলতো করে ধাক্কা দেয়, যেখানে সে আজও নিজেকে হীন মনে করে।
এই অধ্যায়ে তাদের সম্পর্ক শুধুই বন্ধু থাকেনা—তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য যোগ তৈরি হয়, যা ভাষাহীন। একদিন শ্যুট করতে গিয়ে সঞ্চারীর হুইলচেয়ার হঠাৎ আটকে যায় ঘরের কাঠের ফ্রেমে। সে বিরক্ত হয়ে বলে, “আমি পারব না আর! আমি একটা বোঝা!” অরিজিৎ শান্তভাবে তার পাশে বসে বলে, “তোকে দেখলে মনে হয় ছায়ারও মেরুদণ্ড আছে।” এমন একটা সংলাপের পর, সঞ্চারীর চোখে জল আসে। সে বোঝে, তার জীবনের যন্ত্রণাকে কেউ বুঝেছে—শুধু সাহায্য নয়, সম্মান দিয়েছে। এই অধ্যায়ে সঞ্চারীর কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হয়ে দাঁড়ায়—সম্মান পাওয়ার জন্য নিজেকে বারবার প্রমাণ করতে হয় না; কিছু সম্পর্ক নিজে থেকেই শ্রদ্ধা দিতে শেখায়। অরিজিৎ তার বন্ধু, পরিচালক, সম্পাদনাকারী—সবকিছু। কিন্তু সবকিছুর থেকেও বড়, সে এমন একজন মানুষ, যে সঞ্চারীকে তার সীমাবদ্ধতা নয়, সম্ভাবনা দিয়ে দেখে।
তাদের নতুন ভিডিও একটির নাম হয় “Asha – A Dance of Hope”। ভিডিওটি প্রকাশের তিনদিনের মাথায় তারা একটি মেইল পায়—এক আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী শিল্প উৎসবের পক্ষ থেকে সঞ্চারীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে পারফর্ম করতে। শুরুতে সে বিশ্বাসই করতে পারে না। মা পাশে বসে চিঠি পড়ে বলেন, “তোর নাচ শুধু তোর নয়, এখন সবার হয়ে গেছে।” অরিজিৎ বলে, “তুই যাবি তো?” সঞ্চারী জানে, এই আমন্ত্রণ এক নতুন দরজা খুলে দিচ্ছে। সে জানে না বিদেশে গিয়ে কেমন পারফর্ম করবে, শরীর তার কথা শুনবে কি না, লোকজন তাকে করুণা করবে কি প্রশংসা—তবু সে বলে, “হ্যাঁ, যাব।” কারণ এই অধ্যায়ের শেষে সঞ্চারী বুঝে যায়, তার জীবন এখন আর নিছক একটা বেঁচে থাকার গল্প নয়, এটা এখন চলতে থাকা এক আন্দোলন—যেখানে সে নিজেই নিজের পথ দেখায়, আর পিছনে তৈরি হতে থাকে অসংখ্য মানুষের ছায়াপথ।
(৫)
ভিডিওটি পোস্ট হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেই পরিচিত শব্দ—“ting ting”—বাঁধভাঙা জলের মতো বেজে উঠতে শুরু করে সঞ্চারীর ফোনে। ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক—সবখানেই “Asha – A Dance of Hope” ছড়িয়ে পড়ছে আগুনের মতো। কে একজন লিখেছে, “আমি নিজেই হুইলচেয়ারে বসে ৬ বছর পার করেছি। তোমার নাচ দেখে প্রথমবার মনে হলো আমি এখনো কিছু করতে পারি।” আরেকজন বলেছে, “তুমি আমার মেয়ের রোল মডেল হয়ে উঠেছো।” সঞ্চারী প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়—এই ‘তুমি’ যে সে, তা বিশ্বাসই করতে পারছিল না। কিন্তু এ প্রশংসার ঢেউয়ের মাঝেও আসে কিছু কর্কশ ধ্বনি—“দয়া করে এসব শারীরিক খুঁত নিয়ে লোক দেখানো বন্ধ করুন”, “নাচ মানে পুরো শরীরের ব্যবহার, চাকা নয়”—এসব মন্তব্য প্রথমদিকে তার বুকের মধ্যে কাঁটা হয়ে বিঁধে যায়। এক সন্ধ্যায়, এসব কমেন্ট পড়ে তার মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে, আর সে ফোনটা ছুঁড়ে দেয় বিছানায়। মা এসে পাশে বসে শুধুই বলেন, “যারা নিজে কিছু করে না, তারাই অন্যের আকাশ মাপতে বসে।” সেদিন রাতে সঞ্চারী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলে, “আমি আমার শরীরকে ভালোবাসি—কারণ এই শরীর দিয়েই আমি অন্যদের বাঁচার আলো দেখাতে পেরেছি।”
পরদিন সকালে সে সিদ্ধান্ত নেয়—সোশ্যাল মিডিয়ার দর্শকের সামনে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। সে ইনস্টাগ্রামে একটি রিল তৈরি করে, যেখানে সে বলে: “নাচ শুধুই অঙ্গের নয়, এটা আত্মার প্রকাশ। আমি অসুস্থ নই, আমি পূর্ণ, শুধু আমার ছন্দের ভাষা আলাদা।” সেই ভিডিওটি যেন অগ্নিকাণ্ডের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সঞ্চারী বুঝে যায়, সোশ্যাল মিডিয়া শুধু প্রশংসার জায়গা নয়, এটি প্রতিবাদের ক্ষেত্রও হতে পারে—যেখানে নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সাহস লাগে। ধীরে ধীরে তার ইনবক্সে মেসেজ আসতে থাকে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে—উত্তরাখণ্ডের এক ১৬ বছরের ছাত্রী, যিনি হুইলচেয়ারে বসেই গান শিখতে চান; ভুবনেশ্বরের এক যুবক, যিনি একটি ছোট থিয়েটার গ্রুপে কাজ করেন, তাকে বলে, “আপনার ভিডিও দেখেই আমার নতুন নাটকের ভাবনা জন্মেছে।” সঞ্চারীর চোখে জল আসে, সে ভাবে—একটা হুইলচেয়ারের সীমারেখা পার করে কিভাবে তার কণ্ঠ এই পৃথিবীর নানা কোণায় পৌঁছে যাচ্ছে।
এই অধ্যায়ে সে বুঝতে শেখে, ভাইরাল হওয়া আর গুরুত্বপূর্ণ হওয়া এক জিনিস নয়। ভাইরাল ভিডিও ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু যেটা মানুষের মন স্পর্শ করে, সেটা থাকে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার শুধু ভিডিও বানিয়ে থেমে থাকবে না, বরং একটা ধারাবাহিক শুরু করবে—“Wheel Within”—যেখানে সে প্রতিদিন একটি ছোট গল্প বলবে নিজের সংগ্রামের, মায়ের উৎসাহের, সমাজের অন্ধ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে তার ক্ষুদ্র লড়াইয়ের। অরিজিৎ তার পাশে থেকে প্রতিটি ভিডিও রেকর্ড করে, শব্দ ও আলো সাজিয়ে তোলে সঞ্চারীর ভাবনার মতো। মা বলেন, “তোরা দুজনে এখন যেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছিস।” সত্যিই, এই অধ্যায়ে সঞ্চারী যেন আর একজন হুইলচেয়ার-ব্যবহারকারী তরুণী নয়, বরং এক যোদ্ধা—যার যুদ্ধ অস্ত্রহীন, কিন্তু শব্দে, ছন্দে, চোখের ভাষায় গভীর। সোশ্যাল মিডিয়া তাকে কখনো ভালোবাসে, কখনো বিচার করে—কিন্তু এই যুদ্ধের মাঝে সঞ্চারী নিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শত্রুকে পরাজিত করে—নিজের ভয়কে।
(৬)
এক শনিবার সকাল, মেঘলা আকাশের নিচে জানালার পাশে বসে সঞ্চারী গরম চা খাচ্ছিল। ইনস্টাগ্রামের ইনবক্সে প্রতিদিনের মতো কিছু নতুন মেসেজ আসছে—কেউ প্রশংসা করেছে, কেউ ভালোবাসা জানিয়েছে, কেউ আবার জিজ্ঞেস করেছে নাচ শেখার উপায়। কিন্তু সেইদিন একটা ইমেইল আলাদা করে ধরা দিল, সাবজেক্ট লাইনে লেখা—“Official Invitation – Barcelona International Inclusive Dance Festival”। সঞ্চারীর হাত কেঁপে উঠল। মেইল ওপেন করতেই চোখে পড়ল মারিয়া ফার্নান্ডেজ নামের এক আন্তর্জাতিক হুইলচেয়ার নৃত্যশিল্পী এবং সংগঠকের চিঠি, যেখানে স্পষ্টভাবে লেখা—“Your expression transcends movement. We would be honoured to host you as a featured performer in Barcelona this November.” কিছুক্ষণ সঞ্চারী বসে রইল, কিছু না বলে। যেন চারপাশের শব্দ নিঃশেষ হয়ে গেছে, শুধুই সেই ছয়টি লাইনের গুঞ্জন কানে বাজছে। মা ঘরে ঢুকে বললেন, “কি হয়েছে?” —সে উত্তর দিল না, শুধু ল্যাপটপটা মায়ের দিকে ঠেলে দিল। মীনাক্ষীর মুখে ধীরে ধীরে বিস্ময়ের ছায়া থেকে তৈরি হল এক অপার গর্বের ছাপ। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরল—নীরব, আবেগভরা সেই মুহূর্তে ঘরের দেওয়াল যেন কাঁপল।
কিন্তু উচ্ছ্বাসের মাঝেও ধীরে ধীরে পিছু আসতে লাগল শঙ্কার ছায়া। মা চিন্তিত—বিদেশ যাত্রার জন্য কি যথেষ্ট শারীরিকভাবে প্রস্তুত সঞ্চারী? ওর চিকিৎসক কি অনুমতি দেবেন এত দীর্ঘ যাত্রার জন্য? সমাজের কটাক্ষও খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। কিছু আত্মীয় বলল, “ও তো বসে বসেই নাচে, ওখানে যেয়ে আর কী হবে?” কেউ কেউ বলল, “বিদেশ মানে তো ভীষণ খরচ, কোথা থেকে আসবে এত টাকার জোগাড়?” এসব কথা মাঝে মাঝে সঞ্চারীর মনে কাঁটার মতো বিঁধে, কিন্তু এবার সে পিছিয়ে আসেনি। অরিজিৎ এগিয়ে এল, বলল, “স্পনসর খুঁজে নেব, ভিডিও তৈরি করে কাঁপিয়ে দে প্ল্যাটফর্ম—আমরা রেইজ ফান্ড করব।” সঞ্চারী একটা ভিডিও বার্তা রেকর্ড করল—“আমি শুধু যেতে চাই না, আমি চাই আমার মতো আরও অনেকে এই পথটা দেখতে পাক।” তার ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হতেই এক নতুন আন্দোলন শুরু হল—#DanceBeyondBarriers নামে ফান্ডরেইজিং ক্যাম্পেইন শুরু হল, আর চেনা-অচেনা মানুষ একে একে এগিয়ে এল সাহায্যে। কেউ হাজার টাকা পাঠাল, কেউ পাঁচশো, কেউ শুধুই একটা কমেন্ট করে বলল, “তুমি এগিয়ে যাও, আমরা পাশে আছি।” এই অধ্যায়ে সঞ্চারী বুঝে যায়—আসলে সমাজকে বদলানোর জন্য একশো হাতের দরকার নেই, একটা প্রখর আলোই যথেষ্ট।
ভিসা, ফ্লাইট বুকিং, ওয়ার্কশপ প্ল্যানিং—সবকিছু হুলুস্থুল কাণ্ডের মতো এগোতে থাকে। অরিজিৎ প্রতিদিন ল্যাপটপে পাসপোর্ট, ইনভিটেশন, হাসপাতালের ফর্মালিটি সামলাচ্ছে, আর সঞ্চারী দিনের পর দিন নতুন কোরিওগ্রাফি বানিয়ে চলেছে—মিউজিক ট্র্যাক মিক্স করছে, পোশাক নিয়ে ভাবছে, কোন মঞ্চে কতটা সময় দাঁড়াতে হবে সে হিসাব করছে। মা মাঝে মাঝে থমকে গিয়ে বলে, “তুই কি বুঝতে পারিস, তুই কী করে চলেছিস?” সঞ্চারী চুপ করে মায়ের হাত ধরে, বলে, “তুমি না থাকলে এই পথ আমি চিনতেই পারতাম না।” এদিকে মারিয়া ফার্নান্ডেজের তরফ থেকে নিয়মিত মেইল আসছে—সঞ্চারীর ভিডিও নিয়ে উৎসবের পেজে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, মিডিয়াতে সে ‘The Soul Dancer from India’ নামে পরিচিত হয়ে উঠছে। স্পেন থেকে বার্সেলোনার সেই উৎসবে যাওয়া শুধুমাত্র একটা আমন্ত্রণ নয়, এটা যেন এক রূপকথার দোরগোড়া। এবং এই অধ্যায়ের শেষে সঞ্চারী এক সকালে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে—সূর্যের আলো তার গালে পড়ে, আর তার মনে হয়, অনেক বছর পরে সে সত্যিই নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছে। এবার সে শুধু হুইলচেয়ারে বসা একটা মেয়ে নয়, সে একজন দূত—আত্মবিশ্বাস, লড়াই, আর শিল্পের দূত।
(৭)
বার্সেলোনার ঠান্ডা হাওয়া যেন একেবারে নতুন স্বাদ নিয়ে আসে সঞ্চারীর ফুসফুসে। বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে সে জানত, এই মাটিতে তার চলার গতি চাকার উপর নির্ভরশীল হলেও, গন্তব্য সম্পূর্ণ তার নিজের। মারিয়া ফার্নান্দেজ নিজে এসে তাকে রিসিভ করেন—তাঁর হাসিতে, চোখের উষ্ণতায় সঞ্চারী বুঝতে পারে, এই উৎসবের মঞ্চটা শুধুই প্রতিযোগিতা নয়, বরং একসঙ্গে জয় করার প্ল্যাটফর্ম। সেখানকার অডিটোরিয়াম—বিশাল, আলো ও ছায়ার খেলা, যেখানে শতাধিক আন্তর্জাতিক হুইলচেয়ার নৃত্যশিল্পী rehearsel করছে—প্রথমে ভয় পায় সঞ্চারী। তাদের অভিব্যক্তি, ছন্দ, নান্দনিকতা দেখে সে অনুভব করে, নিজের সাধনা হয়তো অনেকটাই ছোট। কিন্তু পরদিন ওয়ার্কশপে যখন সবাই একসঙ্গে বসে নিজেদের গল্প বলছিল, সঞ্চারী খেয়াল করে, সবার মাঝেই একটি অভিন্ন সুর—সবাই কারও না কারও ভাঙনে জন্ম নিয়েছে, আর সেই ভাঙন থেকে সৃষ্টি হয়েছে শিল্পের শক্তি। সেদিন মারিয়া এক সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বলে, “আমরা এখানে প্রতিযোগী নই, আমরা এখানে সাহসের ভাষা বলি।” সেই কথা যেন সঞ্চারীর ভিতরকার ভয়কে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
পারফর্ম্যান্সের আগের রাতে ঘুম আসে না সঞ্চারীর। অরিজিৎ তাকে ভিডিও কলে বলে, “তুই ভুলে যাস না, তুই কারো থেকে কম কিছু নস।” মা’র পাঠানো ছোট্ট ভিডিও—“সঞ্চারী মানে ছন্দ”—তার বুকে হাত রেখে সে দেখে বারবার। সকালবেলা সে প্রস্তুতি নেয়—হালকা গ্লিটার মেকআপ, একপাশে খোঁপা, পোশাকটা সাদা ও রূপালি, যেন মঞ্চে এক বিস্ময় জ্যোৎস্নার মতো জ্বলে উঠবে। তার পারফরম্যান্সের নাম—“Agni – The Fire Within”। সংগীত শুরু হতেই আলো নিভে যায়। মঞ্চে একা বসে থাকা সঞ্চারীর মুখের ওপর পড়ে একটি স্পটলাইট—তার চোখ স্থির, হাত উঠে আসে ধীরে ধীরে, যেন আগুনের ধোঁয়া। তারপর শুরু হয় সেই ছন্দ—তার মুখের প্রতিটি রেখা, হাতের প্রতিটি ভঙ্গি, ঘাড়ের প্রতিটি বাঁক বলে দেয় একটি অগ্নিগাথা। দর্শকশালা চুপ—শুধু সঞ্চারীর চাকার ঘূর্ণন আর মিউজিকের তান যেন আকাশভাঙা এক প্রাচীন গল্পের ভাষা। শেষ মুহূর্তে সে দু’হাত মেলে ধরে, চোখ বন্ধ করে আর হুইলচেয়ার ধীরে ধীরে ঘোরে—দর্শক বুঝে যায়, এই পারফর্ম্যান্স ছিল কেবল নাচ নয়, এক অন্তর্জাগরণের মুহূর্ত।
নাচ শেষ হলে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা—তারপর বিস্ফোরণ। গোটা হল দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছে, কেউ কেউ কাঁদছে, কেউ তার নাম ধরে চিৎকার করছে—“Sanchari! The Fire Dancer!” বিচারকমণ্ডলী চোখ মুছছে, মারিয়া এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি শুধু পারফর্ম করোনি, তুমি আমাদের আত্মাকে নাড়িয়ে দিলে।” সেই মুহূর্তে সঞ্চারীর মাথায় ভেসে ওঠে হাসপাতালের জানালার পাশে বসে থাকা সে, যে ভেবেছিল সব শেষ; সেই ছোট ঘরের কোণায় আয়নার সামনে নাচতে থাকা সে, যার কাঁধে কেউ ছিল না—আর আজ, তার সেই নাচ সারা দুনিয়ার হৃদয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এই অধ্যায়ের শেষে সঞ্চারী বুঝে যায়, তার আসল শক্তি তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নয়, তার আত্মা; এবং যখন আত্মা জ্বলতে শুরু করে, তখন সে মঞ্চের আগুন হয়ে ওঠে।
(৮)
বার্সেলোনার আকাশে সকালটা ছিল রুপালি কুয়াশার চাদরে মোড়া, কিন্তু সঞ্চারীর মনে সূর্যের আলোয় ভরা উজ্জ্বল এক সকাল। উৎসব শেষ, সম্মাননা হাতে—মঞ্চের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা সে এখন আর শুধু “সঞ্চারী মণ্ডল” নয়, আন্তর্জাতিক শিল্পমঞ্চে এক নতুন নাম—The Fire Dancer from India। ফেরার বিমানে বসে সে বাইরে তাকিয়ে দেখে মেঘের স্তর; মনে হয়, সেই অস্পষ্ট সাদা পৃথিবীটাতেই যেন তার পুনর্জন্ম হয়েছে। কলকাতায় পা রেখেই সাংবাদিকদের ভিড়, ক্যামেরার ঝলকানি, সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো হইচই—এই মেয়েটি যে দেশ ছেড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সাহসের দূত হয়ে। কিন্তু এর মাঝেও সঞ্চারী খুঁজে ফেরে তার সেই শান্ত ঘরটাকে—আয়নার সামনে বসে নিজেকে জিজ্ঞেস করার মুহূর্তগুলোকে।
বাড়িতে ফিরতেই মা দরজায় দাঁড়িয়ে, চোখে জল। সঞ্চারী চুপচাপ তার কোলে মুখ রাখে। অরিজিৎ পরদিন আসে ক্যামেরা হাতে, কিন্তু আজ সে চিত্রগ্রাহক নয়—সে আজ শুধু বন্ধু। চা খেতে খেতে সে বলে, “তুই বুঝিস তো, তুই কী করে ফেলেছিস?” সঞ্চারী হাসে, বলে, “না… আমি শুধু ভেবেছিলাম, আমি শেষ হয়ে যাইনি।” এই অধ্যায়ে সে বুঝতে পারে, আসল বিজয় বিদেশের মঞ্চে নয়, বরং নিজের ভিতরের সেই ভয়, অপমান আর সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে প্রতিদিনের লড়াইয়ে। এবং সেই লড়াইয়ে আজ সে একা নয়। “Wheel Within” এখন হাজারো প্রতিবন্ধী তরুণ-তরুণীর অনুপ্রেরণার কেন্দ্র। প্রতিদিন কেউ না কেউ ভিডিও পাঠায়—কেউ চিত্রাঙ্কন করে, কেউ কবিতা বলে, কেউ গান গায়। সঞ্চারী একদিন এক ভিডিও দেখে কেঁদে ফেলে—এক কিশোরী, জন্ম থেকেই চলাফেরায় অক্ষম, তার মায়ের কোলে বসে নাচছে, আর বলছে, “আমি সঞ্চারীর মতো হতে চাই।”
তখনই সঞ্চারী সিদ্ধান্ত নেয়—এবার তাকে ফিরতে হবে আরও বড় এক যাত্রায়। শুধু শিল্পী হিসেবে নয়, একজন প্রশিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হিসেবেও। সে খুলে ফেলে “Sanchari Studio for Inclusive Arts”—একটা ছোট্ট স্কুল, যেখানে শরীর নয়, ইচ্ছেশক্তিই হবে একমাত্র শর্ত। প্রথম ব্যাচে আসে ছয়জন—কেউ হুইলচেয়ারে, কেউ দৃষ্টিহীন, কেউ কানে শুনতে পায় না। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে সঞ্চারী বলে, “আজ থেকে আমরা সবাই মঞ্চের অংশ—কারো আলো কম, কারো নয়।” এই স্টুডিওটা হয়ে ওঠে তার জীবনের নতুন কেন্দ্র—যেখানে সে আবার শুরু করে নাচ শেখানো, ভালোবাসা ছড়ানো, আর সেই চেনা ছায়াকে আলোতে রূপান্তর করার কাজ।
এই অধ্যায়ে, সঞ্চারী নিজেকে আর একা ভাবে না। সে এখন শুধুই একজন বেঁচে থাকা মানুষের গল্প নয়, সে এখন এক চলমান অনুপ্রেরণার নাম। তার ফিরে আসাটা বিজয় মুকুট পরা নয়, বরং পথ খুলে দেওয়া আরও হাজার মানুষের, যারা হয়তো আজও জানালার পাশে বসে ভেবে চলেছে—“আমার আর কিছুই করার নেই।” সঞ্চারী তাদের মনে ফিসফিসিয়ে বলে, “নাচ শুধু পায়ের নয়, আত্মার; আর আত্মা কখনো থামে না।”
***