আয়ুস্মান ঘোষ
১
কোলকাতার ঠান্ডা জানুয়ারির দুপুরে ছোট্ট ড্রয়িংরুমটা এক আশ্চর্য নিস্তব্ধতায় ঢেকে ছিল। মেঝের রঙচটা মোজাইক, দেয়ালে পুরনো ফ্রেমে বাঁধানো পরিবারের ছবিগুলো আর মাঝখানে কাঠের গোল টেবিলে রাখা এক ধূলিধূসর খাম—এই নিঃশব্দ পরিবেশে যেন একটা অদৃশ্য আবরণ টান টান করে টানছিল অর্ণবের মন। পাশে বসে থাকা ঈশিতা নীরবে তাকিয়ে ছিল সেই খামের দিকে। আজ ছিল তাদের বাবা বিপ্লব মুখার্জির শ্রাদ্ধের দিন, আর সবে অঞ্জলি শেষ হয়েছে। আত্মীয়রা ধীরে ধীরে চলে যাওয়ার পর ঠাকুর ঘর থেকে এসে অর্ণব ও ঈশিতার কাকু, প্রবালবাবু, একবার ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললেন, “এইটা রেখে গিয়েছিল তোমাদের বাবা। বলেছিলেন—শ্রাদ্ধের দিন সন্ধ্যার পরে ওদের হাতে দিও। খুব দরকারি।” সাদা খামটা খোলার সময় অর্ণবের কাঁপা হাত যেন তার ভিতরের উথলে ওঠা আবেগ আর অব্যক্ত প্রশ্নেরই প্রতিফলন ছিল। ভিতরে ছিল হাতে লেখা একটা চিঠি—কাঠি কলমে লেখা বাবার চেনা হাতের অক্ষর, যার প্রতিটি শব্দ যেন একটি করে শব্দছুরির মতো অর্ণবের বুক চিরে ঢুকছিল। বাবার লেখা: “তোমরা যদি সত্যিই বুঝতে চাও জীবনের আলো কোথায়, তবে চলে যেও আন্দামান। আমার অসমাপ্ত অনুসন্ধানটা শেষ করো। সেলুলার জেলে গিয়ে কিছু সময় থাকো, নীল দ্বীপে একটু থামো, আর গভীর জলে ডুবে দেখো—আলো কোথা থেকে উঠে আসে।” আরও লেখা ছিল, “আলো সবসময় রোদের মধ্যে নয়, অনেক সময় অন্ধকারেই তার জন্ম হয়। যদি পারো, খুঁজে নিও সেই আলোর উৎস।” অর্ণব চিঠিটা বারবার পড়ছিল, আর ঈশিতা নিঃশব্দে কাঁদছিল—তাদের প্রিয়, ইতিহাসপাগল, তত্ত্ব ও সত্য খুঁজতে জীবন কাটানো বাবার শেষ চিহ্ন ধরে যেন তারা এক নতুন যাত্রার ডাক পাচ্ছিল।
পরের দিন সকালেই অর্ণব হঠাৎ বলে বসে, “চল, আমরা যাই।” ঈশিতা কিছু না বললেও তার চোখে ভয়ের সঙ্গে মিশে থাকা কৌতূহলের ছাপ ছিল স্পষ্ট। আন্দামান—তাদের কাছে একটা ছুটি কাটানোর জায়গা নয়, বরং বাবার ইচ্ছেপত্রের পথ ধরে এক অব্যক্ত ইতিহাসকে খোঁজার অভিযান। বুকিং, অফিস ছুটি, টিকিট, ফ্লাইট—সব কিছু যেন খুব দ্রুত এগোতে লাগল, যেন সময়ও চায় এই যাত্রা শুরু হোক অবিলম্বে। দু’জনেই জানে না তারা কী খুঁজতে চলেছে, কেবল জানে—এই যাত্রা কোনো সাধারণ সফর নয়। তাদের ছোটবেলার স্মৃতি ঘিরে ছিল বাবার মুখে শোনা বিপ্লবীদের গল্প, আন্দামান জেলের নির্মম ইতিহাস, আর সেই অদ্ভুত ‘আলো’ যা বাবা সবসময় খোঁজ করতেন। অনেকটা সময় কেটেছে বাবার সঙ্গে বইয়ের পাতা উলটে, ডায়েরি লিখে, আর ট্রাঙ্ক ভর্তি ছেঁড়া-পুরোনো চিঠি আর নোটপ্যাডে লেখা প্যারাগ্রাফ নিয়ে। এখন সব কিছু এক কুয়াশার মতো স্মৃতির ভিতর থেকে উঠে আসছে। বাবার কণ্ঠ যেন আবার শুনতে পাচ্ছে অর্ণব—“জানো, আলো দেখতে হলে অন্ধকারে ঢুকতে হয়।” বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে তারা দু’জন চুপ করে বসে থাকে, শুধু মাঝে মাঝে ঈশিতা জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে তখন একটা দ্বীপের ছবি—নীল জল, নিঃসীম নীরবতা, আর একটানা বাতাসে দুলতে থাকা নারকেল গাছের ছায়া। সে জানে না, এই যাত্রা শুধু তাদের বাবার শেষ ইচ্ছার পথে নয়, বরং এক আত্মিক আলো খোঁজার দিশাও বয়ে আনবে।
পোর্ট ব্লেয়ারে নামার পরই প্রথমবার দ্বীপের নিঃসীম নীলাকাশ আর অতল জলরাশি দেখে ঈশিতার মনে হয়, যেন সে কোনও স্বপ্নে ঢুকে পড়েছে। এখানকার বাতাসে যেন কিছুর চাপ আছে—না বোঝা এক অতীতের, না বলা কথার, না দেখা কারও উপস্থিতির চাপ। হোটেলে পৌঁছে তারা একদিন বিশ্রাম নেয়। পরদিন সকালেই সেলুলার জেল ঘুরে দেখার পরিকল্পনা হয়। হোটেলের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে অর্ণব ক্যামেরা হাতে সূর্য ওঠার ছবি তুলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়—লেন্সে ধরা পড়ে এক অদ্ভুত প্রতিফলন, যেন একটা ছায়ামূর্তি। সে চোখ কচলে আবার দেখে, কিছু নেই। এই ছোট্ট মুহূর্তটা অর্ণব মনে রাখে। ঈশিতা, যার শরীর তখনও পুরো পথশ্রম কাটিয়ে উঠতে পারেনি, বিছানায় বসে ডায়েরিতে লিখে ফেলে—“এই দ্বীপে আলো আর ছায়া একসঙ্গে হাঁটে।” হোটেল কর্মচারীরা খুব শান্ত, কিন্তু যেন কিছু বলতে চায় না। তাদের মুখে সেলুলার জেলের কথা উঠলেই এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে। এক কর্মচারী বলে, “দিদি, বিকেলের পরে জেলের দিকে যাবেন না। ওদিকে সময় কেমন যেন বদলে যায়।” এই কথায় ঈশিতা কেঁপে ওঠে, আর অর্ণব চুপচাপ মাথা নেড়ে নেয়। সে জানে, এই জার্নিতে ভয় বা দ্বিধার কোনো স্থান নেই। রাতে তারা বারান্দায় বসে বাবার চিঠির লাইনগুলো আবার পড়ে—“আলোকে খুঁজে পাবে অন্ধকারের উৎসে।” তাদের সামনে সমুদ্র ঢেউ তুলে ফিরে যায়—আর তারা জানে, যাত্রা তো কেবল শুরু হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে হ্যাভলক, নীল দ্বীপ, অতল সমুদ্র আর সেলুলার জেলের গা ছমছমে নিস্তব্ধতা তাদের টেনে নিয়ে যাবে সেই আলোর সন্ধানে, যার গল্প ইতিহাসের পাতায় নেই—আছে শুধু অনুভবে।
২
হ্যাভলক আইল্যান্ড—কিন্তু স্থানীয়দের কাছে পরিচিত স্বরাজ দ্বীপ। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে জাহাজে তিন ঘণ্টার সফর যেন ধীরে ধীরে সময়কে ফেলে দিয়ে পিছিয়ে নিয়ে যায় এক অন্যতর জগতে। অর্ণব আর ঈশিতা জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে, সমুদ্রের নীল জলরাশি আর দুরন্ত হাওয়ার মাঝে অদ্ভুত এক চুপচাপ উত্তেজনায় ভরে উঠছিল। অর্ণব মাঝে মাঝে তার ক্যামেরার লেন্সে বোনকে ধরছিল—সাদা রোদে ঈশিতার চুলের ফাঁকে যেন সময় থমকে দাঁড়াচ্ছে। ঈশিতা জানে, এই সফর নিছক পর্যটনের নয়, কিন্তু দ্বীপের পা ছোঁয়ামাত্র সে যেটা অনুভব করে, তা বোঝানো মুশকিল। নারকেল গাছের ঝাঁক, নির্জনতা, আর ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসা জনবসতি—সব মিলিয়ে হ্যাভলক যেন এক জীবন্ত নীরবতা। তাদের থাকার জায়গা, সৈকতের খুব কাছেই এক কাঠের বাংলো, যেখানে জানালার বাইরেই সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় না, শুধু এক টানা ঢেউয়ের ধ্বনি যেন কোনও প্রাচীন মন্ত্র উচ্চারণ করছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই হঠাৎ বৃষ্টি নামে, আর তারা ছোট বারান্দার ছাউনির নিচে বসে দেখে—কীভাবে সূর্য হঠাৎ মেঘের আড়ালে ঢুকে গিয়ে সমুদ্রের উপর ঘন ছায়া ফেলে। ঈশিতা বলে ওঠে, “এই রকম নির্জনতায় নিজেকেই হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।” অর্ণব কিছু বলে না, শুধু তার নোটপ্যাডে লেখে—‘আলো না থাকলে ছায়াও থাকে না।’ সেদিন রাতে খেতে বসে তারা প্রথম পরিচিত হয় নায়লা দাস-এর সঙ্গে, যিনি হোটেলেরই নির্দিষ্ট স্কুবা ইনস্ট্রাক্টর ও স্থানীয় গাইড। মাঝারি উচ্চতা, গাঢ় গায়ের রঙ, আর চোখে একধরনের গম্ভীর স্থিরতা। প্রথম দেখাতেই অর্ণব বুঝে যায়, এই মেয়েটির ভেতর দ্বীপের ভাষা লুকিয়ে আছে।
নায়লার কথায় দ্বীপ যেন গল্প হয়ে ওঠে। সে বলে, “স্বরাজ দ্বীপ খুব শান্ত, কিন্তু সময় এখানে থেমে থাকে না। মাঝে মাঝে এখানে এমন কিছু হয়, যেটা পর্যটকরা অনুভব করে, কিন্তু বিশ্বাস করতে চায় না।” অর্ণব প্রশ্ন করে, “কী রকম?” নায়লা সামান্য হাসে, “এই দ্বীপে কিছু আত্মা হয়তো এখনও আলো খুঁজছে।” ঈশিতা চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন সে ওই কথার গভীরে কিছু শুনতে পাচ্ছে। এরপর নায়লা স্কুবা ও স্নোরকেলিংয়ের সময়সূচি জানায়, আর বলে কাল সকালে তারা নীল দ্বীপের দিকে যাবে। সেই রাতে অর্ণব ঘুমোতে গিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইরে সমুদ্রের হালকা গর্জন, দূরের বাতিঘরের আলো আর কুয়াশার ছায়ার ভেতর যেন সে দেখতে পায় একটা ছায়ামূর্তি। মুহূর্তে সব মিলিয়ে যায়, কিন্তু অর্ণব অনুভব করে—কেউ যেন কাছেই আছে, খুব কাছেই। তার স্বপ্নে সেই রাতে সে সেলুলার জেলের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে একজন মানুষ, যাঁর চোখ অদ্ভুতভাবে অদৃশ্য—শুধু তীব্র জ্বলন্ত দৃষ্টির আবছা ছায়া। সেই লোক বলে, “তুমি যদি আলো খুঁজতে এসেছো, তবে এই দ্বীপে চোখ মেলে তাকাও। আমি এখানেই আছি।” ঘাম ভেজা অবস্থায় ঘুম ভাঙে অর্ণবের। ঈশিতা পাশেই ঘুমিয়ে, মুখে অদ্ভুত প্রশান্তির ছাপ। কিন্তু অর্ণব জানে—এই দ্বীপ নিছক প্রকৃতি নয়, এর বুকে চাপা পড়ে আছে বহু বছর ধরে অপেক্ষমাণ এক ইতিহাস।
পরদিন সকালেই তারা নায়লার সঙ্গে রওনা দেয় নীল দ্বীপের দিকে। নায়লা মাঝেমাঝেই দ্বীপের পুরনো লোককথা বলে, যেমন—দীপাবলির রাতে নাকি এখানকার নির্জন সৈকতে কেউ একজন প্রদীপ জ্বালায়, কিংবা ঝড়ের রাতে হঠাৎ জলের নিচ থেকে উঠে আসে একটা ছায়া, যাকে সবাই ভয় পায় কিন্তু সে নাকি কখনও ক্ষতি করে না। ঈশিতা প্রথমবারের মতো হেসে বলে, “এই ছায়াগুলো কী আলো খুঁজছে?” নায়লা এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে যায়, তারপর বলে, “হয়তো… অথবা আলো ছুঁয়ে ফিরতে চাইছে।” নীল দ্বীপে পা রাখার মুহূর্তে ঈশিতার বুক কেঁপে ওঠে—কোনও অজানা কারণে তার মনে হয়, সে এখানে আগে এসেছে, যেন কোনও স্মৃতি ঝাপসা হয়ে মগজের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। স্নোরকেলিং শুরু হয়, আর তারা একে একে জলের নিচে ডুব দেয়। জলের নিচে এক অদ্ভুত নীরবতা, কেবল নিজেদের নিঃশ্বাসের বুদবুদ, রঙিন প্রবাল আর রূপোলি মাছের গতি। কিন্তু হঠাৎ ঈশিতা থেমে যায়—তার চোখে পড়ে এক ভাঙা লকেট, আর তার পাশেই একটা কাটা রক্তমাখা গামছার মতো কিছু একটা জলের মধ্যে ভাসছে। সে হাত বাড়াতেই কিছু একটা ঠান্ডা স্পর্শ করে তার আঙুল। মুহূর্তে তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে, গলা শুকিয়ে যায়, ডুবে যেতে যেতে সে দেখে—জলের নিচে এক জ pair of eyes—অথচ কোনও মুখ নেই। সে জোরে চিৎকার করতে চায়, কিন্তু জলের নিচে শব্দ হারিয়ে যায়। ওপরে উঠে এসে ঈশিতা কাঁপতে থাকে। অর্ণব কাছে এসে তাকে আঁকড়ে ধরে, আর তার ক্যামেরা যেটা জলের প্রমাণ সুরক্ষায় রেকর্ড করছিল, সেটার ডিসপ্লে স্ক্রিনে তখন জলের নিচে শেষ দৃশ্যে আবছা একটা মুখ ভেসে আছে—চোখদুটো যেন তাকে চেয়ে আছে, এক টানা। ফিরে এসে হোটেলে, যখন সবাই নিজ নিজ ঘরে, অর্ণব সে দৃশ্য বারবার দেখে—সেই চোখ, সেই জলের অন্ধকার, আর ঈশিতার শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়া নীরব আতঙ্ক। সে ভাবে, “এই দ্বীপ আমাদের ডাকেনি শুধু, বরং আমাদের খুঁজছিল।”
৩
দ্বীপে সকাল মানেই নিঃশব্দ এক আলোয় ভেসে থাকা। সেই সকালেও, নীল দ্বীপের কাঠের বাংলোর বারান্দায় বসে ঈশিতা স্থিরভাবে তাকিয়ে ছিল দূরের সমুদ্রের দিকে। অর্ণব তখন ক্যামেরা হাতে সৈকতের পাড় ঘেঁষে ছবি তুলছিল—রোদ আর জলের খেলা তার লেন্সে ধরা পড়ছিল অসাধারণ রঙে, কিন্তু মনটা ছিল অন্যত্র। কালকের স্নোরকেলিং-এর অভিজ্ঞতা কেউই সহজে ভুলতে পারছিল না। ঈশিতা সারারাত ঘুমোয়নি। তার ডায়েরির পাতা জুড়ে কিছু লাইন লেখা—“জলের নিচে ছিল চোখ, আর সেই চোখে আমি দেখেছি হারিয়ে যাওয়া এক দুঃখ, এক অসমাপ্ত কথা।” সে জানে, ওটা শুধুই বিভ্রম নয়। সকাল বেলাতেই সে অর্ণবকে বলে, “দাদা, আমরা ওখানে আবার যাবো। আজ আরেকবার ডুব দেবো।” অর্ণবের মুখ থমকে যায়। সে নিজেও স্বপ্ন দেখেছিল—জলের নিচে সে যেন হাত বাড়িয়ে একটা কিছুকে ছুঁতে চাইছে, আর সেই কিছু ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তারা ঠিক করে, আজকের ডাইভ হবে একটু গভীর, নির্দিষ্ট এক এলাকায়—যেখানে কাল ঈশিতা লকেটটা দেখেছিল। নায়লা প্রথমে কিছুটা দ্বিধা করে, তারপর বলে, “সেই জায়গাটার নাম আমরা বলি ‘শান্তির খাদ’। খুব কম মানুষ ওখানে যায়। ওখানে একটা পুরনো জাহাজডুবির ধ্বংসাবশেষ আছে। কিন্তু কেউ কখনও কিছু তুলতে পারেনি।” ঈশিতা বলে, “আমরা তুলতে চাই না। আমরা শুধু বুঝতে চাই।” এবং সেই বাক্যেই যেন তালা খোলে এক রহস্যের।
সেই দুপুরে তারা তিনজন ছিপছিপে একটা মোটরবোটে চেপে রওনা দেয় ‘শান্তির খাদ’-এর দিকে। সমুদ্র এখানে আর শান্ত নয়—জল গভীর আর গাঢ়, সূর্যের আলো স্পর্শ করলেও নিচে কী আছে বোঝা যায় না। বোটের ইঞ্জিন বন্ধ হতেই চারপাশ নিঃশব্দ। বোটের নীচে যে অতল নীল জল, তার ভেতরে ঢোকার আগে ঈশিতা নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, চোখে গগলস—তার হৃদস্পন্দন যেন দ্বিগুণ। অর্ণব একটু পেছনেই নামবে ঠিক করেছে, ওর মাথায় একটা ছোট্ট অন্ডারওয়াটার ক্যামেরা লাগানো। নায়লা সঙ্গে আসছে না—সে শুধু বলে, “কিছু দেখলে ভয় পেও না। এখানে অনেক কিছু আছে যা বোঝার জন্য নয়, অনুভব করার জন্য।” ঈশিতা প্রথম নামতেই সেই পুরনো অনুভূতি ফিরে আসে—শূন্যতা, নিস্তব্ধতা, আর একটা অদৃশ্য টান। প্রবাল আর জলজ উদ্ভিদের ভিতর দিয়ে সে পৌঁছায় সেই জায়গায় যেখানে কাল কিছু একটা দেখেছিল। এবং ঠিক সেইখানেই, সে দেখতে পায় ধ্বংসপ্রাপ্ত লোহার অংশ, ছেঁড়া জাল, আর এক কোণে অর্ধেক পচা একটি কাঠের বাক্স। ঈশিতা বাক্সটার দিকে এগোতেই আচমকা তার চোখে পড়ে এক জোড়া চোখ—দূর থেকে যেন তাকিয়ে আছে, জলধারার ভিতরে ভাসছে। এবার আর বিভ্রম নয়। সে স্পষ্ট ভাবে অনুভব করে ঠান্ডা কিছু একটা ছুঁয়ে যাচ্ছে তার হাত। সে চিৎকার করতে চায়, কিন্তু শব্দ হারিয়ে যায় জলসীমানায়। তার চারপাশ ঘিরে আসে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন সমুদ্র হঠাৎ নেমে গেছে অতীতের গভীরে।
ঈশিতা যখন ওপরে উঠে আসে, তার মুখ ফ্যাকাশে। অর্ণবও উঠে আসে পেছনে পেছনে, তার চোখেও চাপা বিস্ময়। ক্যামেরা বন্ধ করার আগের মুহূর্তে সে ঠিক যা দেখেছে, তা ভাষায় বোঝানো যায় না—এক মুখ, অর্ধেক আবছা, অর্ধেক স্পষ্ট, যার চোখ দুটো যেন তাকে ডেকে বলছে, “আমায় শেষ করো না।” বোটে উঠে নায়লা তাদের দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। ঈশিতা বলে, “আমি জানি, সে মরেনি। মানে তার গল্প মরেনি।” নায়লা ধীরে মাথা নেড়ে বলে, “আমার ঠাকুরদা বলতেন—সেলুলার জেল একেকটা আত্মার জেলখানা। কেউ কেউ রয়ে গেছে আলো পায়নি বলে।” ফেরার পথে নায়লা গল্প করে এক বন্দী বিপ্লবীর, যার মৃত্যুর রেকর্ড নেই, অথচ প্রতিটি গাইড, স্থানীয়, পুরনো প্রহরী জানেন—সে ছিল। তার নাম ছিল রনজিত দে। তার নম্বর ছিল ২৪৩। কিন্তু রেকর্ডে নেই সেই নাম। জেলের একটি নির্জন প্রকোষ্ঠে নাকি এখনও রাত হলে কান্নার শব্দ শোনা যায়। ঈশিতা আর অর্ণব দু’জনেই তখন নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে—এই জলের নিচেই কেউ একটা তাদের ছুঁয়ে দিয়ে গেছে, বলে দিয়ে গেছে অসমাপ্ত কিছু। সেই রাতে হোটেলে ফিরে অর্ণব ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আর ঠান্ডা হয়ে যায়—চোখে পড়ে জলের নিচে তার পেছনে একটি মুখ ভেসে ছিল, যা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল এক নিঃশব্দ আলোয়। ঈশিতা ডায়েরিতে লেখে—“সে চেয়েছে কেউ তাকে বোঝে, কেউ তাকে খুঁজে বার করে। আমরা কি তাই করছি?” তারা বুঝে যায়—এই দ্বীপে আলো আর অন্ধকার শুধু প্রকৃতির খেলা নয়, বরং আত্মার পথচলা, ইতিহাসের কান্না, আর কিছু না বলা গল্পের নতুন করে জন্ম।
৪
পোর্ট ব্লেয়ারে ফেরার পথে ফেরি থেকে নেমে ঈশিতা আর অর্ণব অনেকটাই চুপচাপ ছিল। নীল দ্বীপে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তাদের ভেতরে যেন এক অদ্ভুত অস্থিরতা তৈরি করেছে, এক ধরনের অতীন্দ্রিয় টান। বিকেলের আলো তখন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। জলের গাঢ় নীলের জায়গায় ধূসর ছায়া। গাড়িতে বসে হোটেলে ফেরার পথে, ঈশিতা জিজ্ঞাসা করল, “তুই কি তখন আমার পেছনে দাঁড়িয়েছিলি?” অর্ণব কোনও উত্তর দিল না। তার চোখের সামনে এখনও ভাসছে সেই ক্যামেরা ফুটেজের ছায়ামূর্তি—যেটা ধরা পড়েছিল সম্পূর্ণ অজান্তে। সে জানে, সেই অনুভূতিটা নিছক কল্পনা নয়। তারা দুজনেই বুঝতে পারছে, এই দ্বীপ তাদের শুধু দর্শনার্থী হিসেবে নেয়নি, বরং তাদের কিছু একটা দেখাতে চাইছে—কোনও বিস্মৃত ইতিহাস, কোনো অপ্রকাশ্য যন্ত্রণা, কোনো নিঃশব্দ কান্না। এবং এর উৎস সম্ভবত সেই প্রাচীন অন্ধকার: সেলুলার জেল। রাতের খাওয়া সেরে তারা হোটেলের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে—পরদিন সকালে তারা চাইলে একটা বিশেষ পারমিশনে পুরো জেল ঘুরে দেখতে পারবে, এমনকি পুরনো বন্দী প্রকোষ্ঠগুলোতেও যেতে পারবে যেখানে সাধারণত গাইড ট্যুর হয় না। ঈশিতা তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যায়। তার মনে হচ্ছিল, এই ডাকে সাড়া না দিলে কিছু অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অর্ণব একমনে ডায়েরি খুলে লেখে—“আত্মা কি জায়গার মধ্যে আটকে থাকে? যদি তাই হয়, তবে এ জেল যেন অজস্র কান্নার ধ্বনি জমিয়ে রাখা এক নির্জন ঘর।”
পরদিন সকাল। সেলুলার জেলের গেটে পৌঁছেই তাদের মনে হয় যেন তারা এক অন্য সময়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। লাল ইঁটের বিশাল প্রাচীর, লোহার গেট, আর একরকম গা ছমছমে শীতল বাতাস—সব কিছুই যেন অতীতের ছায়া হয়ে নেমে এসেছে চারপাশে। গাইড, এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক যার নাম রামদাস, জানায় এই জেল ১৮৯৬ সালে ব্রিটিশরা নির্মাণ শুরু করে এবং ১৯০৬ সালে শেষ হয়। “এই জেল শুধু বন্দীদের আটকাতে তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছিল আত্মা ভাঙার জন্য,” বলে রামদাস। তারা জেলের তিনতলার কারাগার, বিচ্ছিন্ন প্রকোষ্ঠ, আর নির্জন সেল ঘুরে ঘুরে দেখে। হঠাৎ এক পর্যায়ে রামদাস থেমে বলেন, “এই কোণার প্রকোষ্ঠটা বেশ কয়েক বছর বন্ধ রাখা হয়েছিল। জায়গাটা… ঠিক নেই।” ঈশিতা আকৃষ্ট হয়, এবং রামদাসকে অনুরোধ করে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দেয়। প্রকোষ্ঠটা ছোট, অন্ধকার, দেয়ালে লোহার কড়া, নিচে ভাঙা চাঁদের আলোর রেখা এসে পড়ে। ঈশিতা চুপচাপ ভিতরে ঢুকে দাঁড়ায়। হঠাৎ কেমন যেন একটা ঠান্ডা হাওয়া স্পর্শ করে তার গলা, তারপর মাথার মধ্যে এক চিৎকার, অদ্ভুত গুঞ্জন। সে নিজেই বুঝতে পারে না, কখন তার চোখ বুঁজে যায়, আর সে ফিসফিস করে বলতে থাকে—“বন্দী ২৪৩… আমি এসেছি… আমি শুনতে পাচ্ছি…” বাইরে দাঁড়ানো অর্ণব দৌড়ে ভিতরে ঢোকে, দেখে ঈশিতা নিঃসাড়, নিস্তব্ধভাবে মেঝেতে বসে। তার ঠোঁটে তখনও চলছে অস্পষ্ট উচ্চারণ। অর্ণব তাকে জড়িয়ে ধরে বের করে আনে, মুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরায়। ঈশিতা চোখ মেলে বলে, “সে চেয়েছে আমি তার কথা শুনি। সে এখানেই আছে।”
সেদিন সন্ধ্যায়, হোটেলে ফিরে এসে ঈশিতা বিছানায় শুয়ে পড়ে, কিন্তু তার দৃষ্টি স্থির। অর্ণব নিজের নোটপ্যাডে লিখতে থাকে, তার ক্যামেরার ফুটেজে কিছু নেই, কিন্তু মন বলছে—অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। সে গুগল করে বন্দী ২৪৩ নামের কোনও তথ্য খুঁজে পায় না। সরকারি রেকর্ড, ইতিহাসের বই—সব ফাঁকা। ঈশিতা বলে, “সে বলেছে, তার নাম নেওয়া হয়নি কোথাও। তার পরিচয় মুছে ফেলা হয়েছে।” তারা তখন সিদ্ধান্ত নেয়, পরদিন সেলুলার জেলের সংরক্ষিত আর্কাইভে যাবে, যেখানে স্থানীয় ইতিহাসবিদেরা পুরনো ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করেন। অর্ণব বলে, “আমাদের খুঁজতে হবে। তার কাহিনি যদি বলা না হয়, তবে আলো কিভাবে আসবে?” সেই রাতে ঈশিতা এক স্বপ্ন দেখে—সে দাঁড়িয়ে আছে সেলুলার জেলের ভেতরে, আর এক তরুণ বিপ্লবী, চোখে রক্তবর্ণের তীব্র দৃষ্টি নিয়ে তাকে বলছে, “তুমি এসেছো। কিন্তু আমার গল্প বলবে তো?” স্বপ্নের মধ্যে সে বলে, “হ্যাঁ। আমি বলবো।” আর সেই সঙ্গে জেলখানার অন্ধকার দেয়ালের মধ্যে এক আলো ফুটে ওঠে। সেই আলো ঈশিতাকে আলোড়িত করে, আর সে ঘুম ভেঙে ওঠে। জানালার বাইরে তখন পূর্ণিমার আলো জেলখানার ছাদ ছুঁয়ে নেমে আসছে। তারা বুঝে যায়, ইতিহাস কেবল বইয়ের পাতায় নয়—জায়গার ভেতরে, সময়ের গভীরে, আর আত্মার অপেক্ষায় লুকিয়ে থাকে।
৫
পরদিন সকালেই ঈশিতা আর অর্ণব পৌঁছে যায় পোর্ট ব্লেয়ারের এক পুরনো সংগ্রহশালায়, যেখানে সেলুলার জেলের ইতিহাসের দলিলপত্র, বন্দীদের রেজিস্টার, চিঠিপত্র ও ছবি সংরক্ষিত আছে। জায়গাটা খুব বড় নয়, কিন্তু ছায়াঘেরা কাঠের তাক আর হলদেটে পৃষ্ঠার গন্ধ যেন অতীতের কণাগুলোকে আজও টিকিয়ে রেখেছে। সংগ্রহশালার রক্ষক, এক বৃদ্ধ যার নাম কমলেশ্বর দত্ত, চশমার কাচ মুছতে মুছতে তাদের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনেন। “বন্দী ২৪৩?”, তিনি অবাক হয়ে বলেন, “এই নামটা বহু বছর পর শুনছি। কোনও রেকর্ডে ছিল না, কিন্তু লোকমুখে রয়েছে।” তিনি একটা পুরনো রেজিস্টার বের করেন, যার বেশ কিছু পাতা ছিঁড়ে গেছে, কিছু নাম কালি দিয়ে কেটে দেওয়া—কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই হয়তো। “ব্রিটিশরা অনেক বন্দীর নাম মুছে ফেলেছিল। ইতিহাস থেকে তাদের অস্তিত্ব মুছে দিতে চেয়েছিল। বন্দী ২৪৩ ছিল তাদের মধ্যে একজন। লোকমুখে শোনা যায়, তাঁর নাম ছিল রনজিত দে। খুব তরুণ, পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিলেন। নাকি চিঠিপত্রে লেখালেখি করতেন, জেলের ভেতরেও কাগজের টুকরোয় বিপ্লব লিখে রাখতেন।” অর্ণব চুপচাপ ক্যামেরা চালু করে, প্রতিটি কথা রেকর্ড করে রাখে। ঈশিতা ধীরে ধীরে রেজিস্টারের ছেঁড়া পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে একটি পাতায় থেমে যায়—সেখানে শুধু লেখা আছে “২৪৩ – স্থানান্তরিত – স্থায়ী নিষ্পত্তি, তারিখ: অপরিচিত।” কমলেশ্বর বলেন, “স্থায়ী নিষ্পত্তি মানে—মৃত্যু। কিন্তু তার দেহ আজও কোথায় রাখা হয়েছে কেউ জানে না। কথিত আছে, তার আত্মা এখনও সেলুলার জেলের নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দী হয়ে আছে।”
সংগ্রহশালা থেকে বেরিয়ে তারা হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসে জেলের পাশের লনে, যেখানে তখন সূর্য নেমে আসছে। অর্ণব চুপচাপ বলে, “তুই দেখেছিস, আমি দেখেছি, আজ কমলেশ্বরদার মুখে শুনলাম—রনজিত দে সত্যি ছিল।” ঈশিতা ধীরে মাথা নাড়ে। সে ডায়েরির পাতায় লেখে, “একটি নাম নেই বলেই সে হারিয়ে যায় না। বরং নামহীন হওয়াটাই তাকে চিৎকার করে বাঁচিয়ে রাখে।” হোটেলে ফিরে এসে তারা রনজিতের শেষ অবস্থান খুঁজে বার করতে চায়—যেই প্রকোষ্ঠে তার মৃত্যু হয়েছিল। নায়লা, যিনি সেই রাতে হোটেলে ফিরে আসে, জানতে পেরে বলেন, “আমার ঠাকুরদা ছিলেন এখানকার এক প্রহরী। উনি বলতেন, জেলের পেছনের দক্ষিণ-পূর্ব কোণার একটা সেলে একজন বন্দীর মৃত্যু হয়েছিল যার নাম সরকারি ফাইলেই ছিল না। তার মৃত্যুর পরে কিছুদিন রোজ রাতে কান্না শোনা যেত। তারপর জেল প্রশাসন সেই প্রকোষ্ঠ তালাবন্ধ করে দেয়। এখনো সেটি ‘অব্যবহৃত’ হিসেবে তালিকাভুক্ত।” অর্ণব বলে, “তুমি পারবে আমাদের সেখানে নিয়ে যেতে?” নায়লা একটু ভেবে বলে, “রাতে নয়। সূর্য ডোবার আগেই যেতে হবে। আমি পারবো।” তারা ঠিক করে পরদিন দুপুরে সেই প্রকোষ্ঠে যাবে, ঠিক যেখানে রনজিত দে’র জীবন শেষ হয়েছিল, এবং হয়তো, যেখানে তার আত্মা এখনও আলো খুঁজে ফেরে। সেই রাতে ঈশিতা তার কবিতার খাতায় লেখে—“তুমি অন্ধকারে ছিলে বলেই, আমরা আলো খুঁজছি।”
পরদিন যখন তারা আবার সেলুলার জেলে ঢোকে, তখন সূর্য মাথার ওপরে। নায়লা বিশেষ পরিচয়পত্র দিয়ে গেট পার করে আনে তাদের, আর নিয়ে যায় জেলের দক্ষিণ-পূর্ব কোণার একটি বন্ধ প্রকোষ্ঠের সামনে। দরজাটা ভারী লোহার, জং ধরেছে অনেকটা, কিন্তু তালাটা নতুন। নায়লা চাবি দিয়ে খুলতেই গা ছমছমে একটা শীতলতা নেমে আসে। ভেতরে ঢুকতেই তারা দেখতে পায়, দেয়ালের একপাশে পুরনো খুঁটির দাগ, আর দেয়ালের গায়ে আঁচড়ের মতো চিহ্ন। ঘরের এক কোণায় জমে থাকা ধুলোর স্তরে ঈশিতা এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে ওঠে—সেখানে যেন কেউ বসে ছিল সদ্য, জায়গাটা একদম মসৃণ। আর দেওয়ালের একফাঁকে সে দেখতে পায়, ক্ষীণ হাতে খোদাই করা কিছু অক্ষর—“আমার গল্প বলো। আলো জ্বালো।” ঈশিতার গলা শুকিয়ে আসে। অর্ণব ক্যামেরা চালু করে, শব্দহীন হয়ে পড়ে। হঠাৎ যেন বাতাস থেমে যায়, চারপাশ নিস্তব্ধ, আর সেই নিরবতার ভেতরে ঈশিতা আবার সেই গলা শুনতে পায়, সেই স্বপ্নের মতো—“তুমি তো কথা দিয়েছিলে।” সে চোখ বন্ধ করে বলে, “আমি কথা দিয়েছি। আমি বলবো।” মুহূর্তে যেন ঘরের মধ্যে হালকা আলো ফুটে ওঠে—না সূর্যের আলো, না বৈদ্যুতিক, বরং এক অদ্ভুত শান্ত জ্যোতি। তারা বেরিয়ে আসে, নায়লা দরজা বন্ধ করে দেয়। কেউ কিছু বলে না। অর্ণব শুধু ডায়েরিতে লিখে নেয়—“আলো তখনই জন্মায়, যখন কেউ গল্প বলে।” তাদের এই যাত্রা, এই সন্ধান, আর রনজিত দে’র আত্মার সঙ্গে এই সংলাপ ছিল ইতিহাসের ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সেই সত্য, যা প্রকাশ পেল কেবল তাদের ভেতরের অনুভব আর অদ্ভুত টানেই।
৬
সেলুলার জেলের সেই প্রকোষ্ঠ থেকে ফেরার পরে ঈশিতা আর অর্ণব এক ধরনের নিঃশব্দ দোলাচলে ভেসে চলছিল। গলার ভেতরে যেন কিছু একটা আটকে, বলা যায় না, ছোঁয়া যায় না, শুধু একটা কুয়াশার মতো অনুভব। নায়লা সেদিন রাতে হোটেলে আসে, হাতে এক পুরনো কাঠের বাক্স। সে বলে, “এইটা আমার ঠাকুরদার রেখে যাওয়া। তিনি বলতেন, যদি কোনওদিন কেউ আসে যাদের চোখে সৎ অনুসন্ধান দেখি, তাহলে এটা তুলে দিও।” বাক্সটা খুলতেই তারা দেখতে পায় একটা পুরনো স্কার্ফ, হলদে কাগজে মোড়ানো ছেঁড়া কাগজপত্র, আর একটা রক্তমাখা ধাতব লকেট। ঈশিতা হাত বাড়িয়ে লকেটটা ধরতেই এক অদ্ভুত কাঁপুনি তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সে জানে—এটাই সেই জলের নিচে দেখা লকেট। বাক্সের কাগজগুলো খুলতেই মেলে এক অসমাপ্ত চিঠি, যা শুরু হয়েছিল—“যদি কোনওদিন কেউ পড়ে এই লেখাগুলো, তবে জেনে নিও আমি মরে গিয়েও বেঁচে আছি। আমার নাম রনজিত দে। আমি বন্দী নম্বর ২৪৩…” অর্ণব চুপচাপ ক্যামেরা চালু করে, চিঠি পড়তে পড়তে কাঁপা গলায় বলে, “আমরা যা খুঁজছিলাম, সে নিজেই আমাদের খুঁজছিল।” ঈশিতা জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কিভাবে এটা পেয়েছিলে, নায়লা?” তখনই নায়লা বসে পড়ে, এক লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে, আর তার মুখে এক রহস্যের পর্দা খুলে যায়।
নায়লা ধীরে বলতে শুরু করে, “আমার ঠাকুরদা ছিলেন এই জেলের একান্ত প্রহরী। রনজিত দে-র শেষ দিনগুলোর তিনি সাক্ষী। তিনি বলতেন, রনজিত ছিল খুব শান্ত, কিন্তু তার চোখে ছিল আগুন। সে নাকি বলেছিল, ‘তোমার নাতনি একদিন আসবে। তার হাতেই থাকবে আমার শেষ গল্প বলা।’” ঈশিতা বিস্ময়ে বলে, “সে কীভাবে জানতো?” নায়লা বলে, “তুমি জানো না, আমি জন্মেছিলাম ঠিক সেদিন, যেদিন এই জেলের এক কোণে হঠাৎ আগুন লেগে একটা কোণার দেয়াল ভেঙে পড়ে। কেউ ব্যাখ্যা দিতে পারেনি কীভাবে আগুন লাগল। আর সেই ভাঙা অংশ থেকেই পরে এই বাক্সটা পাওয়া যায়।” অর্ণব বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে—এই দ্বীপ, এই জেল, এই গল্প শুধু যুক্তির নয়, বরং সময়ের ছায়ার। নায়লা আরও বলে, “আমার জীবনে বহু পর্যটক এসেছে। কিন্তু তোমাদের মধ্যে আমি দেখেছি সেই আকুলতা, সেই শ্রদ্ধা, যেটা শুধু সত্যিকারের অনুসন্ধানীর থাকে। এই দ্বীপে বহু আত্মা হারিয়ে গিয়েছে। রনজিত ছিল তাদের একজন, যে শেষ পর্যন্ত একটা কথা রেখে গিয়েছিল—‘আমার গল্পটা যদি কেউ বলে, তবে আলো ফিরবে এই অন্ধ প্রকোষ্ঠে।’” ঈশিতা চুপচাপ শোনে, তার চোখে তখন জল আর আগুনের মিশ্র প্রতিচ্ছবি। সে ধীরে বলে, “আমি বলব ওর গল্প। আমি লিখে যাবো ওর প্রতিটি কথা।”
সেই রাতে তারা বসে শেষ চিঠির প্রতিটি লাইন পড়ে, টর্চের আলোয় হোটেলের বারান্দায়। সমুদ্রের গর্জন তখনও চলছে, কিন্তু তার মধ্যে তারা যেন শুনতে পায় রনজিতের কণ্ঠ—ধীর, শান্ত, কৃতজ্ঞ। চিঠিতে লেখা ছিল—“তারা আমার নাম মুছে ফেলেছে, কিন্তু আমি জানি, কেউ একজন আমাকে মনে রাখবে। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না, কিন্তু বিস্মৃতিকে পাই। যদি তুমি থাকো, তুমি লিখো—যে আমি ছিলাম, লড়েছিলাম, আর আলো চেয়েছিলাম।” ঈশিতা তার খাতায় নাম লেখে—‘রনজিত দে’। তারপর লিখে, “তোমাকে আমরা মনে রাখব। তোমার গল্প লিখব। আর এই জেলের প্রতিটি ইটের মাঝে তুমি আলো হয়ে থাকবে।” তারা জানে, তাদের যাত্রা শেষ হতে চলেছে, কিন্তু এক নতুন শুরু তৈরি হয়েছে—একজন বিস্মৃত বিপ্লবীর কাহিনি আজ আবার ফিরে এসেছে মানুষের মুখে, মানুষের কলমে। সেই আলো, যা রনজিত খুঁজে পেয়েছিলেন না কি মৃত্যুর পরেও খুঁজছিলেন—আজ তা ফিরে এসেছে তার নিজের শব্দে, তার নিজের চিঠিতে, আর ঈশিতা ও অর্ণবের চোখ দিয়ে।
৭
সকালবেলা আন্দামানের আকাশ ছিল ঝকঝকে, অথচ হাওয়ায় ছিল এক অদ্ভুত শীতলতা। ঈশিতা উঠে প্রথমেই নোটপ্যাড খুলে রনজিত দে-র চিঠি থেকে একটি লাইন কপি করে লেখে—“যদি তুমি বিশ্বাস করো আলোয়, তবে অন্ধকারও তোমাকে পথ দেখাবে।” এই বাক্যটাই যেন তাদের গোটা যাত্রার সারাংশ। সেদিন তারা ঠিক করেছিল, রনজিতের চিঠিগুলো নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করবে, যাতে সেলুলার জেলের সেই নামহীন কণ্ঠ খুঁজে পায় নতুন প্রজন্মের কানে পৌঁছানোর রাস্তা। অর্ণব তার রেকর্ড করা ক্যামেরা ফুটেজ আর নোটবুক খুলে গুছিয়ে নেয়, আর ঈশিতা নিজের খাতায় প্রতিটি অনুভব, স্বপ্ন আর ছায়াকে শব্দে রূপ দিতে শুরু করে। সকালটা নিস্তরঙ্গ ছিল, কিন্তু হঠাৎ দুপুরে সমুদ্রের দিক থেকে একঘণ্টার জন্য আকাশ কালো হয়ে আসে, ঝোড়ো হাওয়া ওঠে, আর সেই হাওয়ার শব্দে যেন কারও কান্না মিশে থাকে। নায়লা তখন বলে ওঠে, “এটা ভাল লক্ষণ। এখানে যারা আলো চায়, তারা এমনই ভাবে জানিয়ে দেয় নিজেরা শান্ত হয়েছে।” অর্ণব জানে, যুক্তি দিয়ে সব ব্যাখ্যা করা যায় না, এবং সেই অক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে সত্যিকারের উপলব্ধি। ঈশিতা হঠাৎ বলে ওঠে, “আচ্ছা দাদা, আমরা কি সেলুলার জেলের পেছনের সৈকতে যেতে পারি একবার? আজ শেষ দিন, আমি আবার জলের ধারে দাঁড়াতে চাই।”
বিকেলের আলোয় তারা হেঁটে হেঁটে পৌঁছায় সেই সৈকতে—যেখান থেকে সমুদ্র আর জেলের পাথরের দেওয়াল পাশাপাশি দেখা যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে ঈশিতা চুপ করে থাকে। তার মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন—রনজিত কি এখনও ওদের সঙ্গেই আছে? হঠাৎ একটা ছোট্ট ঢেউ এসে তার পায়ের কাছে কিছু একটা ঠেলে দেয়। সে কুড়িয়ে দেখে—একটা ছোট কাচের বোতল, যার ভিতরে হলদেটে একটা কাগজ। অর্ণব সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে, দু’জনে মিলে খুলে পড়ে—একটি হাতের লেখা, অদ্ভুতভাবে চিঠির শেষ লাইনের সাথে মিল রয়েছে—“আমি ছিলাম। আমি আছি। আমার আলো তোমাদের মধ্যে দিয়েই যাবে। যাদের নাম থাকে না, তাদের গল্পটাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়।” ঈশিতা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বোতলের দিকে। নায়লা তখন বলে, “অনেক বছর আগে এমন আরও একটা বোতল পাওয়া গেছিল। আমার ঠাকুরদা বলতেন, কিছু কিছু আত্মা জলের মধ্যে ভেসে থেকে নিজেদের শেষ বার্তা ঠিক সময়মতো পাঠিয়ে দেয়।” তাদের চোখে জল চলে আসে। জলের ওপর দিয়ে সূর্যের শেষ আলো এসে পড়ে সৈকতের উপর, যেন ওই বোতলের মধ্যে থাকা বার্তাটাই আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। অর্ণব ক্যামেরা চালু করে, শেষ দৃশ্য রেকর্ড করে—নীল সমুদ্র, এক জোড়া মানুষ দাঁড়িয়ে, আর পেছনে ইতিহাসের স্তব্ধ প্রহরী: সেলুলার জেল।
ফেরার দিন সকালে ঈশিতা, অর্ণব আর নায়লা আবার একবার সেই তালাবন্ধ প্রকোষ্ঠের সামনে দাঁড়ায়। দরজা খুলে না, কিন্তু তিনজনেই অনুভব করে সেই নীরব অস্তিত্ব। ঈশিতা তার লেখার একটি পাতার কপি হাতে করে গিয়ে প্রকোষ্ঠের নিচের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। সে লেখে—“তোমার নাম নেই, তবু আমরা জানি তুমি ছিলে। তুমি আলোর সন্ধানে ছিলে, আর সেই আলো আমরা দেখেছি। তোমার কাহিনি আমরা লিখে যাবো। পৃথিবী যেন জানে, রনজিত দে একদিন সত্যিই লড়েছিলেন, আলো চেয়েছিলেন, আর আজও কারও কণ্ঠে বেঁচে আছেন।” তারা ফিরে আসে জেটির দিকে। বোটে উঠবার আগে অর্ণব পেছনে একবার তাকায়। দেখে, জেলের ছাদে একটি পায়রা বসে আছে, গলা উঁচিয়ে যেন কিছুর উত্তর দিচ্ছে, কিম্বা মুক্তির গান গাইছে। নায়লা বলে, “আলো যদি সত্যি হয়, তাহলে আত্মা কখনও হারায় না।” ঈশিতা হাত মুঠো করে চেপে ধরে সেই লকেটটা, যা সে এখন নিজের গলায় পরে রাখে। আর অর্ণব পকেট থেকে বের করে তার ডায়েরি, শেষ পাতায় লেখে—“এই দ্বীপ, এই আলো, আর এক নামহীন বিপ্লবীর গল্প—সবটাই এখন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে। ইতিহাস শুধু স্মৃতি নয়, অনুভব। আর অনুভবই আলো।” বোট ছাড়ে, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ধীরে ধীরে দূরে সরে যায়। কিন্তু তাদের মনে এখনও সেই সমুদ্র, সেই চোখ, আর সেই না বলা শব্দের অনুরণন—“আমি আছি, যতক্ষণ তোমরা লিখে যাও আমার গল্প।”
৮
কলকাতায় ফিরেই ঈশিতা যেন একেবারে বদলে যায়। বিমানের জানালা দিয়ে যখন সে সমুদ্রের নীল আর দ্বীপের ছায়াগুলোকে ক্রমশ পিছনে রেখে এগোচ্ছিল, তখনই সে বুঝেছিল—আন্দামান শুধু ভ্রমণ নয়, ওটা ছিল এক মানসিক পালাবদলের যাত্রা। বাসায় ফিরে এসেই সে তার ডেস্কের সামনে বসে পড়ে—চুপচাপ, একটানা, যেন কোনো অদৃশ্য হাত তার কলম চালিয়ে দিচ্ছে। তার লেখার খাতায় রনজিত দে-র গল্প এবার শব্দ হয়ে উঠছে, লাইন থেকে লাইন, পাতা থেকে পাতা। অর্ণব এই সময় নিজের ফুটেজ নিয়ে বসে গেছে। স্কুবা ডাইভিং থেকে সেলুলার জেলের নির্জন প্রকোষ্ঠ পর্যন্ত সব দৃশ্য একসাথে বসিয়ে সে একটা শক্তিশালী ন্যারেটিভ তৈরি করতে শুরু করে। তাদের মনে হয়, রনজিত যেন ঠিক এইভাবেই চেয়েছিলেন নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে—কোনও রেকর্ডে নয়, বরং কিছু অনুভবী চোখ আর বিশ্বাসী কলমে। একদিন রাতে ঈশিতা লিখতে লিখতে হঠাৎ থেমে যায়। তার চোখ ছলছল করে ওঠে—“এই গল্পটা লিখতে লিখতে আমি নিজের অস্তিত্ব বুঝতে শিখেছি। যে মানুষ তার মৃত্যুর পরও আলো খোঁজে, সে আসলে আমাদের চেয়েও বেশি জীবিত।” সে বুঝতে পারে, রনজিত শুধু ইতিহাসের একজন চরিত্র নন, তিনি এক প্রতীক—ভুলে যাওয়া মানুষের, মুছে দেওয়া নামের, এবং হারিয়ে যাওয়া সাহসের।
স্মৃতির শরীর কখনও কখনও বাস্তবের চেয়েও দৃঢ় হয়। ঈশিতা ও অর্ণবের কাজ ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ হতে থাকে। কলকাতার এক প্রকাশক ঈশিতার লেখায় আগ্রহ দেখায়, আর বলেই দেয়, “এটা নিছক একটি লেখা নয়, এটা এক অসাধারণ আত্মা-সন্ধান।” বইয়ের নাম ঠিক হয়—আলোর সন্ধানে আন্দামান। অন্যদিকে অর্ণবের তৈরি করা ডকুমেন্টারি, নাম—243: The Forgotten Prisoner, সোশ্যাল মিডিয়ায় মুক্তি পাওয়ার পরেই ভাইরাল হয়ে যায়। বহু দর্শক মেসেজ করে জানায়—এই গল্প তাদের চোখে জল এনেছে, তাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে ইতিহাসকে। অনেকে জানতে চায়, রনজিত দে সত্যিই ছিলেন কিনা। ঈশিতা উত্তর দেয়, “তিনি যদি সত্য না হতেন, তাহলে আমাদের এতটা আলো ছুঁতে পারতাম না।” তারা বুঝে যায়, সত্য-মিথ্যার বাইরেও কিছু সত্য থাকে, যেগুলো অনুভবে টিকে থাকে, এবং যা সময়ের থেকেও স্থায়ী। একদিন হঠাৎ নায়লার মেসেজ আসে—সেলুলার জেলের সেই তালাবন্ধ প্রকোষ্ঠটিতে আর কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে না। “জানিস,” নায়লা লিখে পাঠায়, “ওখানে আজকাল রোদের আলো পড়ে ঠিক সকাল সাড়ে দশটায়, যেটা আগে হতো না। মনে হয়, রনজিত এবার শান্তি পেয়েছেন।”
ঈশিতা ও অর্ণব ঠিক করে, বই প্রকাশের দিন তারা একটি খালি চেয়ার রাখবে অনুষ্ঠানের মঞ্চে, যাতে রনজিত দে’র জন্য একটি স্থান থেকে যায়। সেই দিন, শহরের নামী এক গ্যালারিতে আয়োজন হয় ছোট্ট অনুষ্ঠানের। সাংবাদিক, পাঠক, কিছু ইতিহাসবিদ সবাই ভিড় করে। কিন্তু সব আলো ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেই খালি চেয়ারটি—একটি সাদা স্কার্ফ রাখা, পাশে রাখা লকেটটা আর তার নিচে লেখা—“বন্দী ২৪৩: এখন মুক্ত”। ঈশিতা মঞ্চে উঠে বলে, “এই বই লেখার সময় আমি জানতাম না আমি কী লিখছি। এখন জানি, আমি একজন মানুষের শেষ ইচ্ছাকে পূর্ণ করছিলাম।” পুরো অনুষ্ঠান শেষে অর্ণব ক্যামেরা গুছিয়ে নিয়ে চুপচাপ বলে, “তুই বুঝিস, আমরা ফিরে এলেও, একটা অংশ আমাদের থেকে গিয়েছে ওখানে, আন্দামানে। ওটা এখন আমাদের আরেকটা বাড়ি।” ঈশিতা হেসে মাথা নাড়ে। তারা জানে—স্মৃতি শুধু মস্তিষ্কে থাকে না, থেকে যায় হাওয়ায়, কাগজে, গল্পে। আর সেই গল্পই আলো এনে দেয়, এমনকি সেইখানে যেখানে এক সময় শুধু অন্ধকার থাকত।
৯
শীতের এক সন্ধ্যায়, বই প্রকাশের মাসখানেক পর, ঈশিতা একদিন অর্ণবকে ফোন করে জানায়, তার কাছে এসেছে একটি অজানা খামে মোড়া চিঠি—ঠিকানা লেখা নেই, প্রেরকের নামও নয়, কেবল খামের মুখে লেখা “ঈশিতা সেন, গল্পবর্ণিকা প্রকাশনী, কলকাতা।” চিঠি খুলতেই তার হাতে পড়ে পুরনো কাগজে হাতে লেখা কয়েকটি লাইন, যেন সময়ের গভীর থেকে উঠে আসা। সেখানে লেখা ছিল—“তুমি যা করেছো, তাতে শুধু এক আত্মা মুক্ত হয়নি, বরং সময়ও যেন নিজের দায় মেটালো। আমার কথা আজ কেউ জানে। আমার নাম উচ্চারিত হয়, আলো আসে সেই প্রকোষ্ঠে। আমি এবার বিদায় নিতে পারি। কিন্তু তুমিই আমার গল্পের শেষ পৃষ্ঠা, ঈশিতা। তোমাকে আমার অন্তিম নমস্কার।” এই চিঠির নিচে কোনো নাম ছিল না, শুধু একটুকরো কাগজে খোদাই করা সংখ্যা—“২৪৩”। ঈশিতা স্তব্ধ হয়ে পড়ে। তার মনে পড়ে যায় সেই স্নিগ্ধ আলো, সেই চোখজোড়া—যা প্রথমবার নীল জলের নিচে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। সে জানে, এটি কেবল একটি লেখা নয়, এটি সত্যিকারের বিদায়। অর্ণবকে ফোনে সব বলার পর তারা স্থির করে, এবার তারা আবার আন্দামানে ফিরবে—শেষবার, শুধু নিজেদের নয়, বরং রনজিত দে-র গল্পের শেষ অনুচ্ছেদটি নিজে হাতে লিখতে।
দুই সপ্তাহ পর, তারা ফের পৌঁছায় আন্দামান। এবার আর উত্তেজনা নেই, ভয় নেই—শুধু শ্রদ্ধা। সেলুলার জেলের কর্তৃপক্ষ, যাদের কাছে বইয়ের একটি কপি পৌঁছেছে ইতিমধ্যেই, তারা অনুমতি দেন ঈশিতা ও অর্ণবকে জেলের সেই নির্জন প্রকোষ্ঠে একটি ছোট্ট প্রদীপ রাখার। সেই দিন জেলের ইতিহাসে নতুন কিছু ঘটে—প্রথমবার কোনও লেখক সেই প্রকোষ্ঠে বসে এক পঙক্তি লেখে, একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে আসে এক আত্মার উদ্দেশ্যে। ঈশিতা সেই পঙক্তিগুলো দেয়ালের কোণায় খোদাই করে লিখে—*“তুমি আলো চেয়েছিলে, আমরা আলো এনেছি। এখন তুমি শান্তি পেতে পারো।” প্রদীপের মৃদু আলো তখন প্রকোষ্ঠের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে, যেন বহুদিন পর জেগে উঠেছে কোনও ঘুমন্ত প্রাণ। অর্ণব ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়, তারা দুজনে একসাথে বেরিয়ে আসে সেই দরজা দিয়ে, যেটি তারা জানে, আজ সত্যিই চিরতরে বন্ধ হবে। বাইরে বেরিয়ে তারা দেখে, জানালার গা দিয়ে একপাল পায়রা উড়ে যায়—ঠিক যেমন ঈশিতা আগে বলেছিল, ‘পায়রা উড়ে গেলে জানবে, গল্প শেষ।’
বিকেলের দিকে তারা নীল সমুদ্রের পাড়ে বসে থাকে একা একা। ঈশিতা তার খাতায় শেষ পৃষ্ঠা লেখে—“আমি কখনো দেখিনি তোমাকে, ছুঁইনি তোমার হাত, তবু তুমি আমার গল্পের সবচেয়ে সত্যিকারের চরিত্র। তুমি থাকো, এই জলের নীচে, এই হাওয়ার গন্ধে, আর থাকো আমাদের স্মৃতির শরীরে।” হঠাৎই অর্ণব বলে ওঠে, “এই আন্দামান আমাদের শুধু একটি আত্মার গল্প দিল না, আমাদের নিজেরও গল্প দিল।” ঈশিতা মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়, হেসে বলে, “আসলে আমরা সবাই নিজের নিজের রনজিত দে, কেউ না বলা কথা বয়ে নিয়ে চলেছি, আলো খুঁজছি কোথাও।” ঠিক তখন সূর্য ডুবে যেতে থাকে, আলো ছড়িয়ে পড়ে জলের ওপর, আর ঢেউ এসে পায়ের কাছে এসে বলিরেখার মতো ভাঙতে ভাঙতে মিলিয়ে যায়। ঈশিতা প্রদীপের আগুনের দিকে মনে মনে বলে—“তুমি কোথাও গেছো না। তুমি এখন আছো—আমার কলমে, এই আকাশে, আর সেই আলোর ভিতরে যা তুমি নিজেই আমাদের মধ্যে জ্বেলে দিয়ে গেলে।” তারা জানত, এবার বিদায় সময়ের, কিন্তু সম্পর্কের নয়। কারণ একবার যে আত্মা আলো হয়ে যায়, সে আর কখনও হারিয়ে যায় না।
১০
বছরখানেক পেরিয়ে গেছে। কলকাতার বুক জুড়ে একসময় যে আলোড়ন তৈরি করেছিল ‘আলোর সন্ধানে আন্দামান’, এখন তা শান্ত হয়েছে, গভীরে গিয়ে বসেছে পাঠকের মনে। ঈশিতা এখন প্রতিষ্ঠিত লেখক, তার প্রতিটি লেখা মানুষেরা পড়ে সেই অনুভবে—যার ভেতরে গল্প নয়, আত্মা কথা বলে। আর অর্ণব? তার ডকুমেন্টারি এখন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়, বহু ছাত্র-ছাত্রী গবেষণা করছে সেলুলার জেলের অলিখিত ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু এই সমস্ত কিছুর বাইরেও, তাদের প্রতিদিনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক মানুষ—রনজিত দে। ঈশিতা তার লেখার ডেস্কের পাশে এখনো রেখে দেয় সেই লকেটটা, সেই স্কার্ফ আর কাঠের বাক্সটা—যেন তার লেখার সঙ্গী, নীরব অভিভাবক। কখনো কখনো রাতে হঠাৎ জেগে উঠে সে ভাবে, “সে কি সত্যিই গেছে? নাকি এখনো পাশে বসে আমার কলম টেনে দেয়?” অর্ণবও মাঝে মাঝে পুরনো ভিডিওগুলো চালিয়ে দেয়—সেই নিস্তব্ধ সেল, সেই হালকা আলো, সেই রেকর্ডিং যেখানে ঈশিতা বলছে—“তোমার গল্প লিখব আমরা।” এসব তার কাছে এখন শুধু প্রজেক্ট নয়, এক ব্যক্তিগত উত্তরাধিকার।
একদিন বিকেলে তারা দুজন আবার দেখা করে, দক্ষিণ কলকাতার এক ক্যাফেতে। অনেকদিন পর, কোনও কাজ নয়, কোনও রেকর্ডিং নয়—শুধু নিজেদের মতো করে কিছুক্ষণ। কফির কাপের পাশে ঈশিতা একটা পুরনো খাম রাখে, যেটা সে খুঁজে পেয়েছে সম্প্রতি নিজের ডায়েরির পাতা গুছোতে গিয়ে। খুলে দেখে তারা, সেই অজানা চিঠির আরেকটা অংশ, হয়তো কোনওদিন পড়ে গিয়েছিল বা ইচ্ছাকৃতভাবে ঈশিতা নিজের অজান্তে সরিয়ে রেখেছিল। সেখানে লেখা—“তোমরা যাদের নাম বলো, ইতিহাস তাদের মনে রাখে। কিন্তু যাদের গল্প বলো, সময় তাদের আগলে রাখে। আমি সেই সময়ের কাছেই নিজের নাম সঁপে দিলাম।” দুজনেই চুপ করে থাকে। কফির কাপ ঠাণ্ডা হয়ে আসে। অর্ণব হেসে বলে, “তুই বুঝলি তো? রনজিত আসলে আমাদের মধ্যে দিয়ে নিজেকে জীবিত রাখতেই চেয়েছিল।” ঈশিতা মাথা নাড়ে, চোখে তার তৃপ্তি, কিন্তু কোথাও একটা অতৃপ্তিও—“আরও অনেক ‘রনজিত’ আছে দাদা, যাদের কথা আমরা জানিই না।” অর্ণব বলে, “তাহলে আমাদের গল্প বলা থামানো যাবে না।” সেই মুহূর্তে তারা জানে, পরবর্তী যাত্রার সূচনা হতে চলেছে—আরও না-বলা কাহিনি, আরও হারিয়ে যাওয়া নাম, আর আরও আলো।
ঈশিতা আর অর্ণব এবার পরিকল্পনা করে একটি ট্রাস্ট গঠনের—‘আলোকপথ’, যার মূল উদ্দেশ্য হবে ইতিহাসের সেই বিস্মৃত গল্পগুলো তুলে ধরা যেগুলো সরকারী নথিতে নেই, শুধু হৃদয়ের পাতায় রয়ে গেছে। স্কুল, কলেজে তারা আয়োজন করতে শুরু করে গল্প-কথনের অনুষ্ঠান, যেখানে পড়ুয়ারা নিজেদের পরিবার বা অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া চরিত্রদের নিয়ে কথা বলে। একদিন এক ছোট মেয়ে, আন্দামান থেকে আসা, মঞ্চে উঠে বলে—“আমার ঠাকুরদা বলতেন, এক লোক ছিল যিনি জেলে থেকেও আলো চেয়েছিলেন। আমি তার নাম জানতাম না। কিন্তু এখন জানি—রনজিত দে।” ঈশিতা তার দিকে তাকিয়ে চোখে জল নিয়ে ভাবে, “আলো সত্যিই ছড়িয়েছে।” শেষ অধ্যায়ের শেষ লাইনে ঈশিতা লেখে—
“আন্দামানের নীল জল থেকে এক নামহীন কণ্ঠ উঠে এসেছিল, শুধুমাত্র আলো চাওয়ার অধিকার নিয়ে। আমরা সেই কণ্ঠ শুনেছিলাম, লিখে রেখেছিলাম, আর একদিন সবাই বলবে—তারা ছিল, তারা আছে, এবং তারা আলো হয়ে যায়।”
সমাপ্ত




