তিয়াস চক্রবর্তী
১
বটগাছটা ছিল বিশাল, ছায়াময় আর পুরনো। বনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গাছটাকে পাখিরা ডাকে “আকাশদ্বার”—যেন তার ডালপালায় সিঁড়ি বেয়ে আকাশ ছোঁয়া যায়। সেখানে বাস করত রকমারি পাখি—নীল টিয়া, সবুজ বেনেবউ, সোনালি ঘুঘু আর শাদা পায়রা। প্রত্যেকের নিজের গান ছিল, নিজের আভিজাত্য। গাছজুড়ে প্রতিদিন সকালবেলা এক অপূর্ব সঙ্গীতসন্ধ্যা বসত—কারও কণ্ঠে মিষ্টি রাগ, কারও গলায় ঝংকারের ঝরনা। এই সংগীতের মাঝেই বসবাস ছিল একমাত্র সেই পাখিটির—যার গলায় ছিল না কোনো সুর, যার গায়ে ছিল না কোনো রং। তার নাম কেউ নেয় না—সবাই তাকে বলে “ওই কাকটা।” সে নিজে নিজের নাম রেখেছিল কাকু। কাকু কালো, সাধারণ, আর তুচ্ছ—এই তিন অভিধায় সবাই তাকে চিহ্নিত করত। কখনো বুলবুলির রিহার্সালের সময় সে পাশে বসতে চাইলে বুলবুলি বলে উঠত, “তুই থাক! তোর কণ্ঠটা শোনামাত্রই আমার সুর ভেঙে যাবে।” আর পায়রা শুভ্রা—গর্বিত ও গোঁড়া, তার চোখে কাকু যেন বনজ খলনায়ক। “কালো মানেই বিষাদ, কাক মানেই কাকাতুয়া ডাক”—এই ধারণায় বিশ্বাস করে সবাই। অথচ কাকু এসব কথা শুনে চুপ করে থাকত। তার চোখে ছিল বিস্ময়ের এক রেশ—”তারা এত সুন্দর গান গায় কেমন করে? আর আমি কেন পারি না?”
প্রতিদিন সকালে কাকু জেগে উঠত সূর্য ওঠার আগেই। গাছে গাছে পাখিরা ঘুমচোখে ডানা গুটিয়ে থাকত, আর কাকু নদীর দিকে উড়ে যেত একা একা। সে বসত একটি ঝরাপাতা ভর্তি ঘাসজমির পাশে, যেখানে মাটির গন্ধ ও বাতাসের সুর ছিল। কাকু শুনত ঝিরঝিরে জলের শব্দ, বাতাসে নুয়ে পড়া কাশফুলের ফিসফাস, শুকনো পাতার ঘূর্ণির আওয়াজ। মনে হতো, যেন প্রকৃতি তার নিজের ভাষায় গান গাইছে। এইসব অদৃশ্য সুরের মধ্যে কাকুর মন কাঁপত, গলা উঁচিয়ে কিছু একটা বলতে চাইত, কিন্তু মুখ খুললেই বেরোত সেই পুরনো কাকাতুয়া ডাক—খসখসে, কর্কশ, নিষ্প্রভ। তবুও কাকু বিশ্বাস হারাত না। তার ছোটবেলায় সে একবার আকাশের রং দেখে গেয়ে উঠেছিল, “আ…আআআ…” — কিন্তু তখনই সবাই হেসে উঠেছিল। সেই দিনের অপমান আজও তার মনে গাঁথা, কিন্তু সেই গান গাওয়ার ইচ্ছেটাও আজও তার হৃদয়ে লুকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারে না, তার কণ্ঠটা কেন এমন। হয়তো তার ভিতরে কোনো সুর আছে, যেটা ঠিকমতো বের হতে পারছে না। হয়তো সে সঠিক উপায় খুঁজে পায়নি—আর এই ‘হয়তো’ থেকেই তার প্রতিদিনের একাকী অনুশীলন।
একদিন দুপুরবেলা, যখন পাখিরা গাছে গাছে বিশ্রাম নিচ্ছে, কাকু একা উড়ে গেল বনের সীমানা ছাড়িয়ে গ্রামঘেঁষা এক খালি মাঠের দিকে। সেখানে একটা পরিত্যক্ত মানুষবসতি, মাটির ঘরগুলো ভেঙে পড়েছে, জানালার কাঁচ নেই, আর উঠোনে জমে আছে শুকনো পাতা আর বৃষ্টির জলের ছাঁট। কাকু সেই জায়গায় উড়ে গিয়ে বসতেই এক অদ্ভুত শব্দ তার কানে এল—টিং টিং টিং। সে খুঁজে দেখল, ভাঙা উঠোনের পাশে পড়ে আছে একটা বাঁশি। পুরনো, মাটি আর কাদায় লেপ্টে থাকা, কিন্তু তবুও তার গায়ে একটা চেনা ছন্দ। কাকু বাঁশিটা ঠোঁট দিয়ে তুলে আনল, তার দিকে তাকিয়ে রইল এক অপার কৌতূহলে। সে কিছুটা ঘষে মাটি সরাল, বাঁশির ছিদ্রগুলো স্পষ্ট হল। একসময় সে ফুঁ দিতে চেষ্টা করল—কিন্তু কিছুই হল না। আবার চেষ্টা করল—এইবার একটা টুক করে আওয়াজ হল। প্রথমে সে চমকে উঠল। এই প্রথম তার ঠোঁট দিয়ে একটা ‘অন্য’ শব্দ এল, যেটা কাকের ডাক নয়, যেটা আগেও কখনো সে দেয়নি। তার মনে হল—এই জিনিসটার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে তার গান। কাকু ধীরে ধীরে বাঁশিটা ঠোঁটে তুলে আবার বাজাল—ভুল, ভুল, আবার ভুল—কিন্তু সেই ভুলের মধ্যেও সে খুঁজে পেল এক আশ্বাস। সে বুঝে গেল—এই যন্ত্রটার সাথেই তার গলায় হারানো সুর মিশে যেতে পারে, এই বাঁশিই হতে পারে তার “আলোর রসদ”।
২
গ্রামের সেই ভাঙা উঠোনে কাকু বাঁশি নিয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। বাতাসে শুকনো ধুলো উড়ছিল, দূরে কোথাও একটা শালিক ডাকছিল ক্লান্ত স্বরে। কাকুর ঠোঁটে বাঁশি, কিন্তু গলা কাঁপছে। সুর নামাতে গিয়ে যেন তার মধ্যে এক আশ্চর্য ভয় জন্ম নিচ্ছিল—যদি আবার ভুল হয়? যদি সবাই বলে, “এ তো বাজানোই নয়, এ তো আওয়াজের অপমান”? এই সবকিছু ভাবতে ভাবতেই সে চোখ বন্ধ করে বাঁশিতে ধীরে ধীরে ফুঁ দিল। না, কোনো রাগিনী নয়, না কোনো তাল—তবুও একটা হালকা, কাঁচা আওয়াজ বাতাসে ভেসে উঠল। প্রথমে একটু হেসে ফেলল কাকু—নিজেকে নিয়ে, ভুল নিয়ে। কিন্তু তারপর তার সেই হাসি মিলিয়ে গিয়ে এক আশ্চর্য আনন্দে রূপ নিল। সে অনুভব করল—এই ভুলের আওয়াজটা তার নিজের। কেউ শিখিয়ে দেয়নি, কেউ বানিয়ে দেয়নি। এ তার আত্মার আওয়াজ। সে যেন সেই প্রথম নিজের জন্য একটা সুর তৈরি করল, যদিও তা ছিল অসম্পূর্ণ। এরপর থেকে প্রতিদিন কাকু ফেরা শুরু করল সেই ফেলে-দেওয়া উঠোনে, যেখানে কেউ ছিল না, কোনো পায়রা ছিল না, কেউ হাসত না—শুধু ছিল বাতাস, শালপাতা আর কাদামাটির গন্ধ।
বনের অন্য পাখিরা বুঝত না—কাকু হঠাৎ বনের গান ছেড়ে বাইরে কোথায় যায়? শুভ্রা মাঝে মাঝে খোঁচা দিয়ে বলত, “কালো কাক গান শিখতে গেছে বুঝি! সাবধান! ও আবার সঙ্গীতের গুরু হয়ে ফিরবে না তো?” হাসির রোল উঠত বটগাছের ডালপালায়। কাকু কিছু বলত না, কিছু বোঝাতও না। সে জানত, কথা দিয়ে নয়, সুর দিয়েই যদি কিছু প্রমাণ করতে হয়, তবে সেটা চুপচাপ করাই ভালো। বাঁশি এখন তার সঙ্গী। একেকদিন সে শিখত কিভাবে ঠোঁটের জোর কমিয়ে ধীরে ধীরে ফুঁ দিতে হয়, আবার কোন ছিদ্রে বাতাস গেলে কেমন আওয়াজ হয়। বাঁশির তানগুলো গলার নয়, মনের—এটা সে বুঝে ফেলেছিল। এমনকি মাঝে মাঝে সে খেয়াল করত, ভাঙা বাড়ির ছাদে বসে থাকা কাঠবিড়ালিরাও তার সেই টুকরো টুকরো সুরে কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে। এক সন্ধ্যায়, যখন আকাশে হালকা রঙের খেলা চলছিল, কাকু একটি নতুন ছন্দ তুলল—নতুন মানে তার নিজের তৈরি, গাছের পাতার নড়াচড়ার মতন, নদীর ঢেউয়ের মতো। সেই সুর শুনে সে নিজেই চমকে উঠেছিল। কোথা থেকে এল এমন একটা আওয়াজ? তার নিজের বুকের ভেতরেই যেন কিছু খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
এরপর দিনগুলো কেটে যেতে লাগল—একদিকে বনের বর্ণিল পাখিরা, যাদের সকাল শুরু হয় অভ্যস্ত গান দিয়ে, আর অন্যদিকে এক নির্জন মাঠের প্রান্তে বসে থাকা এক কালো পাখি, যার গান এখনো পুরোপুরি গান হয়ে ওঠেনি, কিন্তু প্রতিদিনই একটু একটু করে আত্মার কাছে সুর নিয়ে যাচ্ছে। একদিন বনের মধ্যে আচমকা বৃষ্টি নেমে এলো—সেই ভেজা দিনে কাকু তার বাঁশি নিয়ে ছুটে গেল নিজের প্রিয় উঠোনটায়। সে বসে পড়ল কাদার মধ্যে, গা বেয়ে জল গড়াচ্ছে, কিন্তু সে থামল না। সে জানত, সুর তখনই আসে যখন মনের ভিতরে কিছু ভাঙে, কিছুর কষ্ট হয়, কিছু নতুন হয়ে গড়ে ওঠে। সে ফুঁ দিল, আর আজকের সুর ছিল একেবারে ভিন্ন—ভিজে পাতার কান্না, ধূলির মধ্যে দোলা দেওয়া বাতাস, আর তার নিজের একাকিত্বের ঝাঁঝ। সেই মুহূর্তে, কাকু বোঝে—গান শুধুমাত্র শোনানোর জন্য নয়, এটা আসলে বাঁচার ভাষা। আর সেই ভাষা, সে যতই ধীরে শিখুক না কেন, একদিন ঠিক পৌঁছে যাবে অন্যের মন পর্যন্ত।
৩
কাকু এবার সেই পরিত্যক্ত উঠোনে প্রতিদিন যাচ্ছে, যেন বাঁশিটা তার প্রিয় ডানা হয়ে উঠেছে। বনের গানমাখা সকালে, যখন অন্য পাখিরা নিজেদের গলায় গাইতে ব্যস্ত, কাকু নিরবে বেরিয়ে পড়ে। বাঁশি তার ঠোঁটে থাকেই—কখনো ডালে বসে, কখনো ঘাসের ফাঁকে, আবার কখনো বৃষ্টিভেজা জানালার ধারে। প্রথমদিকে তার সুর এলোমেলো, রুক্ষ, যেন শব্দ আর নীরবতার মাঝে একটা অবাধ্য সম্পর্ক গড়ে উঠছে। কিন্তু কাকু তাতে দমে না। সে বুঝে গেছে, বাঁশিটা যেন একটা ফেলে রাখা চাবির মতো, যার মধ্যে গোপন দরজা খুলে যেতে পারে—শুধু সময় আর মনোযোগের দরকার। বাঁশির ফোঁড়ে তার ঠোঁটের অভ্যেস ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে, বাতাসের নিয়ন্ত্রণে সে একেক সময় খুঁজে পাচ্ছে একেক রকম ছায়াসুর। বাঁশির গা থেকে ধুলো যখন সরে যায়, তার নিচের কাঠের পরতগুলো যেন গেয়ে ওঠে নিজেই। কাকু আবিষ্কার করে—এই বাঁশিটা আগে কারো ছিল, কেউ একসময় একে খুব ভালোবেসে বাজাত। হয়তো কোনো বালক, যার গান হারিয়ে গেছে মানুষের শব্দে। এখন সেই গান খুঁজে নিচ্ছে এক কাক।
একদিন দুপুরবেলায় যখন গাছের পাতা সোনালি আলোয় ঝলমল করছিল, কাকু বাঁশির নতুন একটা তান বাজাতে চেষ্টা করল। এই সুরটা ছিল অন্যরকম—আশ্চর্যরকম কোমল, যেন দুঃখ আর আনন্দ একসাথে হাঁটছে। হঠাৎ করেই কাকু টের পেল, আশেপাশে কেউ নেই, কিন্তু বাতাস থেমে গেছে। শালগাছের ছায়া আর নুয়ে পড়া ঘাস যেন চুপচাপ তার বাঁশির সুর শুনছে। এই অনুভূতিটা নতুন ছিল তার জন্য। সে ভাবল—“এই সুর যদি আমি একদিন সবাইকে শুনাতে পারি…” কিন্তু সেই চিন্তা পরমুহূর্তেই হারিয়ে যায়—কারণ সে জানে, সমাজের চোখে সে এখনও সেই ‘কালো কাক’, যার গান মানে শুধুই কর্কশতা। কিন্তু তার ভিতরের কাকু যে ভিন্ন! সে যে এখন আর শুধু একটি পাখি নয়—সে সুরের সন্ধানী। বাঁশির প্রতিটি ছিদ্রে সে খুঁজে পায় নিজের না বলা কথা, নিজের দীর্ঘশ্বাস। সে জানে না, কেউ তার এই চেষ্টা দেখছে কি না, কিন্তু সে নিজেই তার সবচেয়ে বড় শ্রোতা।
তবে যেটা সে জানে না, তা হলো—তার এই প্রতিদিনের বাঁশিবাজনা একদিন শুনে ফেলেছে এক কৌতূহলী চোখজোড়া। বনের বাইরে, এক কিশোর নাম তার আরব, চুপচাপ বসেছিল ঘরের ধারে, সেই ফেলে দেওয়া বাড়িরই এক কোনায়। সে একদিন মাঠে হাঁটতে গিয়ে এই আওয়াজ শুনেছিল—সেই বাঁশির সুর, যা একসাথে তীক্ষ্ণ আর কোমল, বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যার মতো। পরদিন সে আবার আসে, লুকিয়ে বসে থাকে ভাঙা জানালার পাশে। আর দেখে—একটা কাক, একটানা একটা বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে মন দিয়ে। সে দেখে, পাখিটা থেমে থেমে নিজের ভুল বুঝছে, আবার বাজাচ্ছে, আবার থামছে, আবার হাসছে নিজের ভুলে। কিশোর আরবের চোখে জল এসে যায়—সে আগে কখনও কাককে এভাবে দেখেনি। তার মনে হয়, এই কাকটা যেন একা একটা পৃথিবী বানিয়ে নিয়েছে। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, কিছু বলে না। তার মনে একটা ইচ্ছা জন্মায়—এই কাককে কেউ যেন অবজ্ঞা না করে, যেন সবাই একদিন এই সুরটা শুনতে পায়। সে নিজের মনে বলে—“তুই বাজা, কাকু। আমি শুনছি।” কিন্তু কাকু এখনো জানে না, তার নিষ্প্রভ আকাশে আরেকটি চুপচাপ শ্রোতা যোগ হয়েছে, যে কিনা তার আলো জ্বালানোর যাত্রাপথে নীরব প্রেরণা হয়ে উঠবে।
৪
দিনগুলো এখন কাকুর জীবনে বাঁশির ছন্দে ভাগ হয়—সকালের আগে বাঁশির প্রস্তুতি, দুপুরে একান্ত প্র্যাকটিস, আর সন্ধ্যায় আকাশের সঙ্গে নিজের নতুন সুর ভাগ করে নেওয়া। বাঁশির প্রতিটি ফোঁড়ে সে যেন নিজের একটা অংশ ঢেলে দেয়। যতবার বাজায়, তার মনে হয় বাঁশি তার সঙ্গে কথা বলে—কখনো সে আনন্দের কথা বলে, কখনো অভিমানের, কখনো শুধুই নিরবতার মধ্যে সুর খোঁজে। কাকুর শরীর যেমন বদলায়নি, তেমনই তার গলার স্বরও না; কিন্তু বাঁশির সাহায্যে তার আত্মা যেন নতুন একটা গলা পেয়েছে, যেটা দিয়ে সে প্রকাশ করতে পারে নিজের অনুভব, নিজের ছোঁয়া পাওয়া ও না-পাওয়া। কোনো প্রশিক্ষক নেই, কোনো শ্রোতা নেই—তবু তার অনুশীলন থামে না। কারণ সে বাজায় নিজের জন্য, নিজের অস্তিত্বকে বুঝতে। পাখিরা যখন গান গায় গলা দিয়ে, কাকু তখন গায় মন দিয়ে, ঠোঁট দিয়ে, বাতাসের মৃদু প্রবাহে। এই নিভৃতে গড়ে ওঠে এক ‘অভ্যাসের অর্কেস্ট্রা’, যেখানে কাকুর বাঁশি আর প্রকৃতি একসঙ্গে বাজতে শিখে যায়।
একদিন বিকেলবেলায়, কাকু বাঁশির নতুন একটা তান তৈরি করল—এটা ছিল তিন ধাপের, প্রথমটা ধীরে ধীরে বেয়ে ওঠে, তারপর এক আকস্মিক স্তব্ধতা, শেষে একটা মিষ্টি গুঞ্জন। এই সুরটা যেন নদীর স্রোতের মতো—শুরুতে শান্ত, মাঝপথে উত্তাল, শেষে মিলিয়ে যায় নীরবতায়। সে এই তান নিয়ে খেলতে খেলতে যখন চোখ তুলল, তখন দেখে গাছের ডালে বসে আছে শুভ্রা। পায়রার চোখে ছিল বিরক্তি, তাচ্ছিল্য—সে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “তুই এখনও বাজাচ্ছিস? পাখি হয়ে বাঁশি বাজাচ্ছিস? গান শিখে কী হবে তোর? তোর ডাক তো ডাকই থাকবে।” তারপর সে ডানা মেলে উড়ে গেল, কিন্তু কাকুর গলায় কোনো কষ্ট জমল না। কারণ সে জানে—এই কষ্টের সুরই একদিন তার সবচেয়ে বড় সংগীত হয়ে উঠবে। সে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে আবার বাজাতে শুরু করল, যেন শুভ্রার বিদ্রুপ সেই সুরের ভেতরেই গলে গেল এক অচেনা শক্তিতে। কাকু জানত, প্রশংসা বা তালি না পেলেও, তার অভ্যেসের ভিতরে গড়ে উঠছে এক অবিনাশী আস্থা—নিজের ভিতরের সত্তাকে চেনার সাহস।
এইভাবে দিন যায়, ঋতু বদলায়, আকাশের রঙ পাল্টায়—কিন্তু কাকুর রুটিন বদলায় না। একদিন সকালবেলা হঠাৎ করে রোদের আলো পড়ল বাঁশির গায়ে, আর সেই আলোয় বাঁশির গা যেন জ্বলে উঠল সোনালি বর্ণে। কাকু সেই মুহূর্তে বুঝতে পারল—তার এই যন্ত্রটা শুধু বাঁশির কাঠ নয়, এটা সময়ের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা। সেদিন সে তার অভ্যেসের অর্কেস্ট্রা সাজাল পুরো নতুন করে—পাঁচ রকমের তান, থেমে থেমে, আলতো করে, কখনো জোরে, কখনো নিঃশব্দের কিনারায় দাঁড়িয়ে। প্রতিটি সুর যেন তার একটা স্মৃতি, একটা অভিমান, একটা খুশি। আরব, সেই কিশোর, গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল, আর এবার তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠছিল গর্বে। সে মনে মনে বলছিল—“এই কাকটা অন্যরকম। কেউ বোঝে না, কিন্তু আমি জানি।” সেই মুহূর্তে যেন কাকুর বাঁশি কেবল বাতাস কাঁপাচ্ছিল না—তার সুরের ভিতর দিয়ে হাওয়া হচ্ছিল নীরব বিদ্রোহের গান, যা বলছিল, “আমি আছি, আমি বদলেছি, আমি বাজাচ্ছি।”
৫
শীতের রোদ পড়ে এসেছে বটগাছের পাতায় পাতায়, পাখিরা সেজেছে রঙিন পালকে। আজ বনভূমিতে উৎসব—‘উড়ন্ত সুরমেলা’। এই দিনে সবাই মিলে গায়, নিজেদের সেরা সুরে প্রতিযোগিতা করে, আর কে কত সুন্দর গাইতে পারে, তার জন্য মেলে শাবাশির ঝরনা। টিয়া ‘রাগ বহার’ গায়, বুলবুলি ‘ঠুমরী’ তোলে, আর পায়রা শুভ্রা গেয়ে ওঠে ‘সাদা দুপুরের গান’। সবাই মুগ্ধ হয়ে শোনে, প্রশংসায় মুখর বন। কাকু গাছের এক কোণে বসে থাকে চুপচাপ, বাঁশিটা ঠোঁটে রাখতে চায়, কিন্তু দ্বিধায় কেঁপে ওঠে। তার মনে হয়—এই উৎসব কি তার জন্য? যে কখনো স্বীকৃতি পায়নি, যার গান ‘গান’ বলেই মানে না কেউ? সে বুঝে যায়, বাঁশির সুর যতই প্রিয় হোক, এই সুরমেলায় তার জায়গা নেই। হঠাৎ, শুভ্রা তার দিকে ফিরে বলে—“তুই এখানে বসে আছিস কেন? গান শোনাচ্ছিস না? না কি ভয় পাচ্ছিস? তোর সেই বাঁশি কি গুনগুন ছাড়া আর কিছু শেখাতে পারেনি?” আশেপাশের কিছু পাখি হেসে ওঠে। এই ঠাট্টা যেন ছুরি হয়ে বিঁধে যায় কাকুর বুকের ভিতর, কিন্তু সে মুখে কিছু না বলে শুধু বাঁশিটার গায়ে আঙুল বুলিয়ে যায়।
তবে আজকের কাকু আগের মতো নয়। সে বোঝে, কারও বিদ্রুপ তার সুরকে বন্ধ করতে পারবে না—কারণ সে যেটা গড়েছে তা উপহাসে তৈরি হয়নি, তা তৈরি হয়েছে নির্জনতা, ত্যাগ আর চেষ্টা দিয়ে। সে চোখ বন্ধ করে, একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। বনভূমির এই গর্জনের মাঝেও সে শুনতে পায় ভেতরের সেই শান্ত শব্দ, যে শব্দ শুধু তার নিজের। সে মনে মনে বলে—“যারা বুঝবে না, তাদের বোঝানোর দরকার নেই। সুর তো বাতাসের মতো, কোথায় কাকে ছুঁয়ে যাবে, কেউ জানে না।” হঠাৎ করেই কাকু নিচে নেমে যায়, আর একা একা বনের শেষ প্রান্তে গিয়ে বসে। সেখানে বাতাস কম, শব্দ কম, কেবল পাতা পড়ে ঝরে পড়ে। সে ধীরে ধীরে বাঁশি তুলে নেয় ঠোঁটে। একটি সুর বাজে—একটা দীর্ঘ, ধীরে ধীরে এগোনো, তারপর কেঁপে ওঠা, আবার ফিরে আসা—যেন কোনো পুরোনো অভিমানের আখ্যান বলছে। তার বাঁশিতে আজ কোনো কাঁপুনি নেই, কোনো দ্বিধা নেই। সে জানে, এই সুর কেউ না শুনলেও, সে নিজে শুনছে। সে আজ নিজের শ্রোতা, নিজের বিচারক, নিজের আশ্বাস।
কাকু যখন সেই গভীর আত্মনিমগ্নতায় ডুবে সুর তুলছে, তখন কিছু পাখি উড়ে এসে দূর থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারা কিছু বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে। শুভ্রাও সেখানে আসে, কিন্তু এবার আর মুখে ব্যঙ্গ নেই—তার চোখে কৌতূহল, কিছুটা বিস্ময়। সে দেখে, যে পাখিটাকে এতকাল শুধু ‘কাক’ বলে ডাকা হতো, সে আজ একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে—মাথা উঁচু, চোখে দীপ্তি, সুরে স্থিরতা। সে দেখে, কাকু আর সেই ‘হাসির পাত্র’ নয়—সে এখন এক সঙ্গীতশিল্পী, যার ভাষা বাঁশির ফোঁড়ে, আর whose গান চুপচাপ শ্রোতার বুকের ভিতরে ঢুকে যায়। শুভ্রা সেই প্রথমবার চুপ করে শোনে, কিছু বলে না। কাকুও কিছু বলে না। শুধু বাজায়, বাজতেই থাকে। আর সেই দিন থেকে বনভূমির আকাশে এক নতুন ধ্বনি যুক্ত হয়—একটা কালো পাখির আত্মার সুর, যা বিদ্রুপকে জয়ের দিকে নিয়ে যায়, এবং বলে, “সুন্দরতা কণ্ঠে নয়, মনে; সুর কেবল আওয়াজ নয়, অনুভব।”
৬
সেদিন সন্ধ্যা যেন অন্যরকম নেমে এল। আকাশে সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়, সারা বনভূমি লালচে আলোয় ভরে উঠেছে। গাছের ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছে, বাতাসে কেমন এক শীতলতা। পাখিরা একে একে ডালে ফিরে আসছে, কেউ ক্লান্ত, কেউ আনন্দিত—দিবসের সঙ্গীত শেষে বিশ্রাম নিতে প্রস্তুত। কিন্তু কাকু আজ গাছে ফেরেনি। সে একা বসে আছে সেই পুরনো মাঠের কিনারে, বাঁশি তার ঠোঁটে। আজ সে কোনো কথা ভাবছে না, কোনো বিচার করছে না—শুধু নিজের ভেতরটাকে খুলে দিচ্ছে বাতাসের সামনে। একটানা বহুদিনের অনুশীলন যেন আজ নিজে থেকেই সুর হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কাকু চোখ বন্ধ করে বাজাতে শুরু করে, আর সেই সুর একেবারে আলাদা—তা না প্রশিক্ষিত, না চেনা, না কোনো মানুষের শেখানো; এটি যেন কোনো স্বপ্নে শোনা এক গানের প্রতিধ্বনি, যেটা কাকু বহুদিন আগে হারিয়ে ফেলেছিল।
বাঁশির সেই সুর ধীরে ধীরে ভেসে বেড়াতে থাকে বাতাসে। প্রথমে নরম, লাজুক, তারপর একটু একটু করে গভীরতা বাড়ে। মনে হয়, সেই সুরে আছে বিস্মৃতি, আছে একাকীত্ব, আবার আছে ভালোবাসার ছায়াও। কাকুর সেই সন্ধ্যার গান যেন আকাশে ছড়িয়ে পড়ে—চাঁদের আলোতে স্নান করে ধীরে ধীরে পৌঁছে যায় গাছের মাথায়। আর সেই গাছেই এক কোণে বসে ছিল শুভ্রা—সারাদিনের ব্যস্ততার পরে ক্লান্ত, ভাবছিল নিজের সাফল্য নিয়ে। হঠাৎ সেই সুর তার কানে এসে লাগে। প্রথমে সে অবাক হয়, তারপর এক মুহূর্তে বুঝে যায়—এটা সেই কাকের সুর! তার বুক কেমন কেঁপে ওঠে—এই সুর তো এমন নয় যা কোনো কাকের ঠোঁট থেকে আসতে পারে! এ সুর তো মন ছুঁয়ে দেয়, চোখ ভিজিয়ে দেয়। সে আর নিজেকে সামলাতে পারে না, ডানায় ভর দিয়ে উড়ে আসে মাঠের ওপারে, যেখানে কাকু নিজের মধ্যেই ডুবে আছে, কোনো দর্শককে না দেখে, কোনো প্রশংসার আশায় না থেকে।
শুভ্রা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার চোখে বিস্ময়, কিন্তু সেই বিস্ময়ের সঙ্গে রয়েছে সম্মানও। সে জীবনে বহুবার গান শুনেছে—টিয়া, কোকিল, বুলবুলির গান; শিখেছে গুরুদের কাছ থেকে, গেয়েছে উৎসবের মঞ্চে। কিন্তু আজকের এই বাঁশির সুর যেন সবকিছুর বাইরে—এ এক আত্মার উচ্চারণ, যা কোনো আয়োজনে জন্মায় না, কেবল যন্ত্রণার গভীর থেকে উঠে আসে। শুভ্রা কাছে এগিয়ে আসে, কিন্তু কাকু চোখ খুলে তাকায় না। সে এখনো বাজাচ্ছে। সুর শেষ হলে, শুভ্রা হঠাৎ নিচু গলায় বলে—“তুই… এই সুর কোথা থেকে পেলি?” কাকু তখন ধীরে চোখ তোলে, মুখে কোনো গর্ব নেই, কোনো উত্তরও না। শুধু বলে, “খুঁজে পেয়েছি, আমার ভিতরেই ছিল।” শুভ্রা কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর নিঃশব্দে বসে পড়ে তার পাশে। সেই মুহূর্তে, কোনো রাজত্বের নেই রাজা, নেই প্রজা—আছে শুধু দুটি পাখি, একটি বাঁশি, আর সন্ধ্যার সুর—যা এক বিদ্রুপের দেওয়াল ভেঙে ফেলেছে চিরতরে।
৭
পরদিন সকালে বনের বাতাসে যেন নতুন কিছু ভেসে বেড়াচ্ছে। বটগাছের পাতা-ছায়ায় পাখিরা জেগে উঠেছে আগের মতোই, কিন্তু তাদের মধ্যে একটা চাপা কৌতূহল—কাল সন্ধ্যায় যারা দূর থেকে কাকুর সুর শুনেছিল, তাদের মন যেন অদ্ভুতভাবে নরম হয়ে গেছে। শুভ্রা কিছু বলেনি কারও সঙ্গে, কিন্তু তার চোখে যেন এক অন্য আলো—সম্মতির, বোধের। আজ সকালে সে কাউকে কিছু না বলেই কাকুকে ডাকে—“তুই বাজাবি আবার?” কাকু প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়ে, তারপর মাথা হেঁট করে বলে, “বাজাতে পারি, যদি কেউ শুনতে চায়।” শুভ্রা আর কিছু না বলে এক ডাকে বাকি পাখিদের ডাকে—টিয়া, বুলবুলি, ঘুঘু—যারা এতদিন শুধু নিজের গানেই গর্ব করত। তারা আসে অবিশ্বাসে, কিছুটা হাসি চেপে, কিছুটা উৎসাহে। কাকু বাঁশি তোলে ঠোঁটে, আর প্রথমেই যে সুরটা সে তোলে, তা যেন পাতা ঝরা হেমন্তের সকালের মতো—শান্ত, কোমল, অথচ মধুরতায় পূর্ণ।
প্রথমে কেউ কিছু বোঝে না। কেউ বলে, “এটা তো গান নয়, এটা তো ফুঁ।” কিন্তু দ্বিতীয় মিনিটে সুরের বাঁকে তারা কেঁপে ওঠে—কেননা কাকুর সুরে হঠাৎ একচিলতে রোদ এসে পড়ে মনে। যে টিয়াটি এতকাল নিজের কণ্ঠের অহংকারে গর্ব করত, সে দেখে তার গলার শক্তি নেই এই সুরের সামনে দাঁড়াবার। বুলবুলি, যে পাখিটি ‘আদর্শ সৌন্দর্য’ বলে নিজেদের দাবি করত, সে আজ শুনছে এক কালো পাখির অনভ্যস্ত ঠোঁটের ভিতর থেকে জন্ম নেওয়া আত্মার গুঞ্জন। বাঁশির সেই সুর কখনো নদীর কলকল, কখনো বৃষ্টির পরে জমা জল, আবার কখনো নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় নীচু হয়ে আসা আকাশ। সবার চোখে মুখে তখন বিস্ময়, নীরবতা, সম্মতি। শুভ্রা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, আর শেষবারের মতো ভাঙা গলায় বলে—“তোর এই গান আমার কোনোদিন শেখা হয়নি… তুই সুর খুঁজিসনি, তুই নিজেকেই খুঁজে পেয়েছিস।”
তখন কাকু কিছু বলে না, শুধু বাঁশিটাকে বুকের কাছে টেনে নেয়। সে বোঝে, তার ভিতরের গান এখন আর তাকে একা রাখবে না। এই পাখিরা, যারা একসময় হাসত, যারা তার প্রতি কটাক্ষ ছুঁড়ত, আজ তারা শ্রোতা। কাকু তাদের জয় করেনি কণ্ঠ দিয়ে, রঙ দিয়ে নয়, কিংবা জোর দিয়ে নয়—সে জয় করেছে মন দিয়ে। সেই সকাল থেকে কাকু আর ‘সাধারণ’ কাক নয়—সে হয়ে ওঠে একটা নিদর্শন। তার সুর নতুন করে বাতাসে ছড়াতে শুরু করে, পাখিরা একে একে কাছে আসে, শোনে, চুপ করে, শেখে। কেউ কেউ চেষ্টা করে কাকুর সঙ্গে তালে বাজাতে, কেউ বলে, “আমার ভেতরেও হয়তো কোনো সুর লুকিয়ে আছে।” আর সেই অনুপ্রেরণার বীজ হয়ত তখনই জন্ম নেয়—একটা ভুলে যাওয়া বাঁশির ফুঁ থেকে উঠে আসা এক কালো পাখির ‘মন জয়ের গান’ থেকে।
৮
বনের ভেতরে এবার এক নতুন সকাল। বটগাছের ডালে, সেই যেখানে এতদিন ধরে গাওয়া হতো শুধুই প্রথাগত গান, আজ সেখানে কাকুর বাঁশির সুরে ভরে উঠেছে বাতাস। আর আজ সে একা নয়—তার পাশে বসে টিয়া, বুলবুলি, ঘুঘু, এমনকি শুভ্রাও। তারা কেউ গাইছে না, শুধু শুনছে। এই শুনতে চাওয়ার ভিতরেই কাকুর বড় জয়। আজ কাকুর চোখে কোনো দ্বিধা নেই, তার ঠোঁটে বাঁশি, আর মনে একটা নির্ভার শান্তি। সে জানে, আজ যে সুর সে তুলবে তা কেউ থামাতে পারবে না। কারণ এটা কেবল গলার নয়, এটি আত্মার অভিব্যক্তি। কাকু ধীরে ধীরে শুরু করে—প্রথম সুরটা বাতাসে মিশে যায় যেমন প্রথম আলো গাছের পাতায় পড়ে। এরপর সে বাজাতে থাকে একের পর এক সুর—প্রত্যেকটি যেন একেকটা গল্প, একেকটা জীবন, একেকটা অপমানের উত্তরণ। বনভূমি নীরব হয়ে শোনে, পাখিরা থেমে যায়, আর কিশোর আরব দূরের গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলে—“এই তো সেই কাক, যে আলোয় কথা বলে।”
এইভাবে কাকু হয়ে ওঠে বনভূমির নতুন কাহিনির কেন্দ্র। সে গানের জন্য আর কারও অনুমতি চায় না, প্রশংসাও না। কারণ সে এখন জানে—নিজের ভেতরের সত্যকে আঁকড়ে ধরলে, বাহিরের দৃষ্টি বদলাতেই হয়। তার বাঁশি এখন এক প্রতীক, এক আশ্বাস—যা বলে, “তোমার গলায় যদি সুর না থাকে, মন দিয়েও তুমি গান গাইতে পারো।” ছোট পাখিরা তার কাছে এসে বলে, “আমরা তোমার মতো হতে চাই।” আর কাকু তাদের শেখায় কেমন করে নিরবতা শোনা যায়, বাতাসকে ছোঁয়া যায়, আর কেমন করে একটা ফেলে দেওয়া বাঁশি হতে পারে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সেতু। একদিন বনের সবচেয়ে বয়স্ক পাখি, কূজন-ঠাকুরদা, এসে বলে, “আজ থেকে তোকে কাক বলব না—তুই এখন ‘আলোর কাক’। তোকে দেখলেই বোঝা যায়, কীভাবে নিজের ছায়ার ভেতর থেকেও আলো জ্বালানো যায়।”
সেই থেকে প্রতি সন্ধ্যায়, যখন রোদ গাছের মাথায় নরম হয়ে নামে, কাকু বসে তার পুরোনো উঠোনে, ঠিক যেখানে সে প্রথম সুর তুলেছিল। তার বাঁশি বাজে—কখনো একা, কখনো শ্রোতার ভিড়ে। সেদিনের শুভ্রা, যে একসময় তাকে ব্যঙ্গ করেছিল, আজ পাশে বসে বাজায় তবলা-স্বরের ঠোঁটসুরে। তারা একসঙ্গে গান গায় না, তারা একসঙ্গে অনুভব করে। আরব মাঝেমাঝে মানুষদের নিয়ে আসে, যারা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, ভাবে—“কীভাবে সম্ভব?” তখন তারা দেখে, এক কালো পাখি, যার গলা নয়, আত্মা কথা বলে; যার ডানা নয়, ধ্বনি উড়ে চলে—সে কেবল কাক নয়, সে ‘আলোর কাক’। এই গল্প এখানেই শেষ নয়, কারণ প্রতিটি হারানো বাঁশির ভেতর হয়তো লুকিয়ে আছে এমন আরও কাক, যারা একদিন নিজেদের সুর খুঁজে নেবে—এই কাকুর মতো, নিজের অন্ধকারের ভিতর থেকে আলো হয়ে উঠবে।
***




