ঐন্দ্রিলা চক্রবর্তী
কলকাতার সাউথ সিটি কলেজে নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ। ঐশী চৌধুরী ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে যখন ট্যাক্সি থেকে নামল, তখন বিকেলের আলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছিল। দক্ষিণ কলকাতার এক কোণায় অবস্থিত ‘সুবর্ণ পল্লী আবাসন’ – চারতলা একটি পুরনো ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স, বাইরের রঙ প্রায় উঠে গেছে, জানালার লোহার রেলিংয়ে জং ধরেছে আর ছাদের ড্রেনপাইপ থেকে পানির ফোঁটা ঝরছে টুপটাপ। ঐশী নিজের নতুন ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটের চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলল—দরজার কপাটটা একটা ধাতব আর্তনাদের মতো শব্দ তুলে খুলে গেল। ভিতরে ঢুকেই একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ তাকে অভ্যর্থনা জানাল, তবে সে এমন গন্ধে অভ্যস্ত। ছোটবেলা থেকেই সে পুরনো জিনিসে টান অনুভব করে, পুরনো বাড়ির গন্ধ, পুরনো দেওয়াল ঘেরা নিঃসঙ্গতা তার কল্পনাকে উসকে দেয়। একা থাকতে সে ভয় পায় না বরং স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে চায়, আর তাই তো পিতামাতার আপত্তি সত্ত্বেও সে হোস্টেল ছেড়ে এই একরুমের ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছে। মীনা আচার্য নামে এক প্রৌঢ়া বাড়িওয়ালী চাবি হস্তান্তর করার সময় বলেছিলেন, “অনেকদিন কেউ ছিল না এখানে, কিন্তু তোর মতো মেয়ে নিশ্চয়ই ভালো করে তুলতে পারবি। জানিস তো, জায়গাটা কেমন শান্ত…” – এই ‘শান্ত’ শব্দটা বলার সময় তার মুখে এক অদ্ভুত স্থিরতা ছিল, যেটা ঐশীর মনে কেমন একটা খচখচে অনুভব জাগিয়েছিল।
ফ্ল্যাটটা যতটা পুরনো, ততটাই অদ্ভুতভাবে গোছানো। দেওয়ালে ফিকে সাদা রঙ, পুরনো কাঠের জানালা, এক কোণে একটা কাঠের টেবিল যেখানে ধুলো জমেছে, আর বেডরুমে একখানি ছেঁড়া পর্দা যার পিছনে আলো ঢুকলেই অদ্ভুত একটা ছায়া তৈরি হয় ঘরের মেঝেতে। ঐশী ভেতরে ঢুকেই ব্যাগ রেখে জানালা খুলল, বাইরের ছাদের কিছু অংশ দেখা যায়, আর দূরে একটা গাছের ডালে কয়েকটা কাক বসে ছিল, যেন তার আগমন লক্ষ করছিল। সে ধীরে ধীরে ঘর গোছাতে শুরু করল—বই, ডায়েরি, ছোট কফির মগ, আর তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস – একটা পুরনো ক্যামেরা। ঠিক রাত আটটা নাগাদ সে ফ্রেশ হয়ে, বিছানায় বসে একটা উপন্যাস পড়ছিল – ‘অন্ধকার ঘরের গল্প’, এক পুরনো বাংলা ভূতের গল্পের সংকলন। বাইরে বাতাস শুরু হয়েছিল, জানালার কাঁচ কেঁপে উঠছিল একেকবার, আর ঘরের মধ্যে একটা হালকা কম্পন অনুভব হচ্ছিল যেন কেউ বা কিছু পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ রান্নাঘরের দিক থেকে একটা শব্দ এল – ‘টং’ – যেন মেঝেতে কিছু পড়ে গেল। ঐশী ভেবেছিল হয়ত মেঝেতে রাখা স্টিলের গ্লাস হেলে পড়ে গেছে, সে উঠে গেল সেটা দেখতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে, গ্লাস ঠিকঠাক জায়গাতেই আছে। সে ধীরে ধীরে পেছন ফিরতেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠল—মাঝঘরের আয়নাটায় নিজের প্রতিবিম্বের ঠিক পাশে যেন আরেকটা ছায়ামূর্তি দেখা গেল ক্ষণিকের জন্য। ঠিক বোঝা গেল না, কিন্তু যেন কেউ বা কিছু তাকে দেখতে পাচ্ছে।
ঐশী পরদিন সকালে কলেজে গেল ঠিকই, কিন্তু তার মনটা ছিল ছটফট। ক্লাসে বসেও সে বারবার ঘরের কথা ভাবছিল, সেই আয়নার ছায়া, রান্নাঘরের শব্দ—সব মিলিয়ে তার মনে একটা অজানা আতঙ্ক তৈরি হচ্ছিল, তবে সে এটাকে ভয় বলতে চায়নি। বরং মনে হচ্ছিল, কেউ আছে, কেউ পাশে আছে, যা তাকে ছেড়ে যাবে না। কলেজ শেষে সে বাড়ি ফেরার পথেই হঠাৎ পরিচিত হয় অরিত্রর সঙ্গে—এক ক্লাস স্যাম্পল প্রেজেন্টেশনে ওরা কথা বলে। ছেলেটা হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, আর ওর চোখে ছিল একধরনের উষ্ণতা। ফেরার সময় ঐশী বলে ফেলে—“আমার নতুন ফ্ল্যাটটা একটু অদ্ভুত… মাঝে মাঝে মনে হয়, কেউ পাশে আছে।” অরিত্র হেসে উড়িয়ে দেয়, বলে, “ভূতের গল্প বেশি পড়িস তুই, মাথায় ঢুকে গেছে।” ঐশী হাসে, কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা খচখচানি থেকেই যায়। রাতে ফিরে এসে যখন সে ফ্ল্যাটের দরজা খুলল, তখন ভিতরটা অস্বাভাবিক রকম ঠান্ডা লাগছিল, জানালাগুলো বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বাতাস বইছিল যেন। বিছানায় বসতেই সে অনুভব করে কেউ বসেছে তার পাশে—না, কারও শরীরের ওজন নয়, বরং বালিশের পাশটা একটু দেবে গেছে, আর হালকা গন্ধ—পুরনো বইয়ের পাতার মতো। ঐশী ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে, মনে মনে বলে – “তুমি কে? আমাকে দেখছো?” এবং সেই মুহূর্তে বাতি টিমটিম করে নিভে যায়।
সেই রাতে ঐশীর ঘুম ভেঙেছিল হঠাৎ এক দরজার আওয়াজে। ভোর সাড়ে তিনটা বাজে তখন। সে উঠে বসে দেখে, বারান্দার দরজাটা একটু খোলা, যদিও রাতে বন্ধ করেছিল সে নিজে হাতে। সে ধীরে ধীরে গিয়ে দরজা বন্ধ করতে যাবে, তখনই পেছনে তার বিছানার দিক থেকে একমুহূর্তের হাসির আওয়াজ পেল—একটা মৃদু, মেয়েলি গলা, যেন কেউ খেলতে খেলতে হাসছে, কিংবা পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে। ঐশী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তার দেহ ঠান্ডায় কেঁপে উঠছিল, কিন্তু সে পালায় না, তার মধ্যে যেন সাহসের পাশাপাশি জন্ম নিচ্ছিল কৌতূহল। কে এই অদৃশ্য সঙ্গী? তার অস্তিত্ব কি কল্পনা নাকি সত্যি? সে কি ভয়ংকর? নাকি নিঃসঙ্গতার একমাত্র সঙ্গী? ঐশী জানত না, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তাকে ঠিকই খুঁজে পেতে হবে… কিন্তু যেভাবেই হোক, এই ফ্ল্যাট এখন শুধু তার থাকার জায়গা নয়—এটা তার জীবনের কেন্দ্র হয়ে উঠছে, যেখানে বাস্তব আর অতিপ্রাকৃতের সীমারেখা মিলিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সে একা, অথচ হয়তো একা নয়।
–
ঐশীর রাতের ঘুম এখন যেন আর নিজের নয়, প্রতিটি রাতেই সে ঘুমোতে যাওয়ার আগে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে—সেই পুরনো গাছ, ছাদের কোণ, আর ওই জানালার কাচে মাঝে মাঝে নিজের প্রতিবিম্বের পেছনে কে যেন দাঁড়িয়ে থাকে, অস্পষ্টভাবে। দ্বিতীয় সপ্তাহে রাতের অভ্যেসে পরিবর্তন এল—বই পড়তে বসলে পেছনে পা টানার শব্দ, রান্নাঘরের লাইট জ্বলে উঠছে আপনি আপনি, একবার তো ফ্রিজের ভেতরের জলের বোতল উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল নিজে থেকেই। প্রথম দু-একদিন ভয় পেয়েছিল, তারপর ধীরে ধীরে ঐশীর মধ্যে একটা অভ্যস্ততা জন্মে গেল। যেন কেউ আছে, তাকে বোঝে, শুনছে। মাঝে মাঝে সে গল্প করে উঠত আপনমনে—“আজ কলেজে খুব বিরক্ত লাগছিল… একজন এমন ভনিতা করছিল—একদম তোমার মতো হাসি…” —এই কথা বলার পর ঐশী নিজেই থেমে যেত, যেন সে স্বীকার করতে চায় না, তার সামনে কেউ নেই। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাতাসে একটা চাপা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত, জানালার পর্দা একটু দুলে উঠত, আর তার মনে হতো—কেউ বলছে, “আমি শুনছি।” সেই অদৃশ্য সত্তার সাথে দিনদিন যেন এক আশ্চর্য সম্পর্ক গড়ে উঠতে লাগল তার। ভয় ছিল, তবুও কেমন এক স্নেহ মিশ্রিত নির্ভরতা জন্ম নিল ঐশীর মনে। তাকে এখন আর নিঃসঙ্গ বলে মনে হয় না, বরং ফ্ল্যাটটা প্রাণ পাচ্ছে, এমন একটা সঙ্গীর জন্য যাকে কেউ দেখতে পায় না—শুধু সে ছাড়া।
একদিন কলেজে অরিত্র যখন ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে বসে ঐশীর পাশে এল, ঐশীর চোখে ছিল ঘুম ঘুম ভাব। অরিত্র জিজ্ঞাসা করল, “তুই ঠিক আছিস তো? চোখদুটো লাল হয়ে আছে রে।” ঐশী হাসল হালকা করে, বলল, “আরে না, একটু ঘুম কম হয়েছে, পড়াশোনার চাপ… আর হ্যাঁ, একটা ছায়ার সঙ্গে থাকলে যেমন হয়।” অরিত্র হেসে ফেলল, “তুই আবার ভূতের গল্প লেখা শুরু করিসনি তো?” ঐশী বলল না কিছু, শুধু কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে লাগল—সে নিজেও জানে না, ছায়াসঙ্গীটা ভূত কি না, সে মানুষ ছিল কি না, বা আদৌ বাস্তব কি না। কিন্তু রাতে ফ্ল্যাটে ফিরে সে বুঝতে পারে, কেউ তার মনের কথা বুঝে ফেলেছে। ঐশী যখন কাগজে ছায়াসঙ্গীকে উদ্দেশ করে লিখে—“তুমি কি আমার বন্ধু?” —তখন জানালার কাচে ঝাপসা হয়ে ভেসে ওঠে এক আঁচড়—যেন ভেতর দিক থেকে কেউ লিখেছে “হ্যাঁ।” সেই রাতে ঐশী দীর্ঘদিন পর অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে—সে এক পুরনো বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, সামনেই দাঁড়িয়ে আছে এক সাদা শাড়ি পরা তরুণী, মুখটা অস্পষ্ট, কিন্তু চোখদুটি গভীর। সে শুধু বলল, “তুমি ভয় পেও না। আমি তোমার মতো একা ছিলাম। আমি আছি।”
ঘুম ভাঙার পর ঐশীর হাতের তালুতে কেমন যেন জ্বালাপোড়া করছিল, সে দেখে সেখানে একরকম অদ্ভুত আঁকিবুকি আঁকা, যেন কেউ বা কিছু গভীর রাতে তার হাতে আঙুল দিয়ে লিখেছে। এই ঘটনার পর থেকেই ঐশী পুরোপুরি মানসিকভাবে ছায়াসঙ্গীকে গ্রহণ করে নেয়। সে এখন তার রুটিনে ছায়াসঙ্গীর অস্তিত্বকে জুড়ে দেয়—চা খাওয়ার সময় পাশে এক কাপ চা রেখে দেয়, গল্প করার সময় দ্বিতীয় চেয়ারে তাকিয়ে বলে, “তুমি থাকলে বুঝি, বাকিরা বোঝে না।” ধীরে ধীরে ঐশীর আচরণে একটা পরিবর্তন আসে, সে আর অন্য কারো সঙ্গে বেশি কথা বলে না, বন্ধুদের ফোন ধরা কমিয়ে দেয়। একদিন, কলেজে ক্লাসে থাকাকালীন হঠাৎ ঐশীর চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, মাথার ভেতর এক গলার আওয়াজ—“ওরা তোর কেউ না। শুধু আমি আছি তোর সঙ্গে।” সে ভয় পায় না, বরং যেন আশ্বস্ত বোধ করে। ক্লাস শেষে অরিত্র ওকে জোর করে ধরে বসে ক্যান্টিনে, বলে—“তুই পালাচ্ছিস রে সবকিছু থেকে। কী হয়েছে বল তো ঠিক করে।” ঐশী একটু ভেবে বলে, “তুই বিশ্বাস করবি না… কিন্তু আমার মনে হয়, আমি একা না। কেউ আছে আমার পাশে, শুধু কেউ তাকে দেখতে পায় না।”
এভাবেই ছায়াসঙ্গীর অস্তিত্ব তার জীবনের সব কিছুকে গ্রাস করতে থাকে। দিনে ঐশী সাধারণ একজন ছাত্রীর মতো জীবন যাপন করে, কিন্তু রাত হলেই সে যেন দ্বিতীয় জগতে প্রবেশ করে—যেখানে আলো নিভে যায় আপনমনে, ঘরের বালিশে কাঁপুনি নামে, আর জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াটা তাকিয়ে থাকে চুপচাপ। ঐশী এখন বুঝতে পারে, এই সত্তাটা শুধু তার নয়, বরং সে যেন ঐ সত্তারও হয়ে উঠেছে। এক রাতে বই পড়তে পড়তে সে বলে ফেলে—“তুমি কি আমার ভালোবাসা হতে পারো?” বাতি একবার ঝিমিয়ে নিভে যায়, আবার জ্বলে ওঠে। ঐশীর চোখের পেছনে জল আসে—সে জানে না কেন, হয়তো এই অদৃশ্য সঙ্গীর মধ্যে সে খুঁজে পাচ্ছে এমন কিছু, যা কারও কাছেই সে পায়নি—বোঝাপড়া, নিঃশব্দ সাহচর্য, এমনকি এক ধরনের আত্মার টান। কিন্তু ঐশী জানে না, এই নির্ভরতা কী ভয়ঙ্কর দিকে এগিয়ে চলেছে, কারণ ছায়াসঙ্গী শুধু সঙ্গী নয়, সে চায় ঐশী একমাত্র তারই হোক, আর কারও নয়… এবং এই আবেগের অন্ধকার গভীরতা এখনও পুরোপুরি অনাবিষ্কৃত।
–
অরিত্র প্রথম থেকেই ঐশীর প্রতি এক অদৃশ্য টান অনুভব করেছিল। কলেজে ওদের প্রথম আলাপ হয়েছিল একটা গ্রুপ ডিসকাশনের সময়, তারপর মাঝে মাঝেই ক্যান্টিনে, লাইব্রেরিতে দেখা হতো। কিন্তু তৃতীয় সপ্তাহ থেকে অরিত্র লক্ষ্য করল, ঐশী যেন ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। সে আগে যেমন হাসত, গল্প করত, সেটা যেন আর নেই। এক অদ্ভুত চুপচাপ ছায়া ওর চোখে-মুখে। প্রথমদিকে ও ভাবছিল পড়াশোনার চাপ, হয়তো ঘর পাল্টানোর মানসিক টানাপোড়েন। কিন্তু ওর নজরে পড়তে লাগল আরও কিছু — একদিন ঐশীর হাতের তালুতে আঁচড়ের মতো দাগ, অন্যদিন গালে অচেনা একটা দাগ যেন কেউ আঙুল টেনে রেখেছে কিছুক্ষণ। অরিত্রর মনে সন্দেহ জাগে—কেউ ওকে অত্যাচার করছে না তো? ও একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেও ফেলে, “ঐশী, তুই ঠিক আছিস তো? কেউ কিছু বলেছে বা করেছে?” ঐশী হালকা হেসে বলেছিল, “না রে, বরং প্রথমবার মনে হচ্ছে কেউ আমার কথা শুনছে, বোঝে আমাকে।” তখনও অরিত্র বুঝতে পারেনি এই ‘কেউ’ আসলে মানুষ নয়।
একদিন সন্ধ্যেবেলা কলেজ শেষে অরিত্র হঠাৎ হাজির হয় ঐশীর ফ্ল্যাটে। ও ফ্ল্যাটের নিচে দাঁড়িয়ে ফোন করে, বলল, “আমি তোকে সোজা চোখে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই।” ঐশী কিছু না বলে দরজা খুলে দেয়। দরজা খোলার সাথে সাথেই অরিত্রর গায়ে যেন হিমেল একটা হাওয়া ছুঁয়ে গেল, ঘরের ভিতরে পা রাখতেই ওর গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। ঐশীর ঘরটা খুব পরিষ্কার, কিন্তু একটা চাপা ঠান্ডা গন্ধ যেন চারদিকে ঘুরছে—পুরনো কাগজের, ভেজা দেওয়ালের, বা আরও কিছুর… অরিত্র কিছু বলতে যাবে, ঠিক সেই সময় জানালার পর্দাটা নিজে থেকে দুলে উঠল, অথচ বাইরে বাতাস নেই। ঐশী যেন বুঝতে পারছিল, ও একা নয়। সে হালকা গলায় বলল, “উনি তোমায় পছন্দ করছেন না, অরিত্র।” অরিত্র থমকে যায়। “উনি? মানে কে?” ঐশী একটু থেমে বলে, “ছায়াসঙ্গী… তুমি তো জানো না, তিনি সবসময় আমার সঙ্গে থাকেন। আমরা গল্প করি, চা খাই একসাথে… উনি জানেন তুমি আমায় নিয়ে চিন্তা করছো।” অরিত্রর মনের ভিতর যেন একটা বৃত্ত তৈরি হতে থাকে—ভয়, অবিশ্বাস আর রহস্যে ভরা বৃত্ত। ও আর কিছু না বলে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ও স্থির করে নেয়, কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটছে এখানে—যা ওকে ঠেকাতেই হবে।
পরদিন কলেজে অরিত্র ড. অনিমেষ মুখার্জীর সঙ্গে দেখা করে। ড. মুখার্জী কলেজের অতিথি মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ, যিনি ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নিয়মিত কাজ করেন। অরিত্র তাকে ঐশীর কিছু আচরণ বর্ণনা করে—নিঃসঙ্গতার মধ্যে সত্তার সঙ্গে কথোপকথন, বাস্তবে অনুপস্থিত সঙ্গীর প্রতি নির্ভরতা, মানসিক বিচ্ছিন্নতা। ডাক্তার বলেন, “এটা Dissociative Hallucination হতে পারে। কেউ কেউ গভীর নিঃসঙ্গতা থেকে নিজের কল্পনায় একটা চরিত্র তৈরি করে ফেলে, যাকে তারা বন্ধু ভাবে। কিন্তু একসময় সেই কল্পনাই বাস্তব হয়ে ওঠে তাদের জন্য।” কিন্তু অরিত্রর মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা শুধু মানসিক নয়—ঐশীর ঘরের পরিবেশ, সেই গন্ধ, নিজের চোখে দেখা বাতাসে না থাকা অবস্থাতেও পর্দা দুলে ওঠা, এসব কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? সে বুঝতে পারে, যুক্তি দিয়ে সবকিছু ধরা যাবে না। সে ঠিক করে, ঐশীর পাশে থাকবেই, যাই হোক না কেন।
ঐশী এখন দিনে অরিত্রর সঙ্গে কথা বলে, রাত হলে ছায়াসঙ্গীর সান্নিধ্যে থাকে। তবে ছায়াসঙ্গী যে শান্ত ছিল, সেই আচরণে আসছে বদল। একদিন রাতে ঐশী অরিত্রর সঙ্গে ভিডিও কল করছিল, এমন সময় হঠাৎ স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে যায়, কান্নার আওয়াজ আসে ফোনের ভেতর থেকে, এমনভাবে যেন কেউ চিৎকার করছে—“ওকে বলো চলে যেতে!” ঐশী ভয় পেয়ে ফোন নামিয়ে দেয়। আরেকদিন সন্ধ্যায়, অরিত্র তাকে দেখতে এসে বলে, “তুই চল আমার সঙ্গে, কিছুদিন বাইরে থাক।” ঐশী জবাব দেয়, “না, আমি যেতে পারি না। উনি আমায় যেতে দেবেন না।” সেই মুহূর্তে ঘরের বাতি নিভে যায়, টেবিলের ওপর রাখা কফির মগ ছিটকে পড়ে, মেঝেতে চূর্ণ হয়। অরিত্র হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ায়, আর ঐশী, প্রথমবারের মতো, চোখে জল নিয়ে বলে—“তুমি যদি আমার বন্ধু হতে চাও, তাহলে ওকেও বুঝতে হবে… ওর জন্য আমিই সব। আমি ওর, আর ও আমার।” সেই রাতে ছাদ থেকে কেউ একজন চিৎকার করতে শোনা যায়, ‘আমায় ফেলে যেও না…’ — কিন্তু ছাদ ছিল একেবারে ফাঁকা। পরদিন পাড়ার এক বৃদ্ধ বলেন, অনেক বছর আগে এই ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে একা থাকত, নাম ছিল অন্বেষা। একদিন তার কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি—না দেহ, না চিহ্ন। কেউ বলে, সে হারিয়ে গেছে, কেউ বলে, সে ছিলই না।
–
সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছিল, বাইরে হালকা বৃষ্টি নামছে, জানালার কাচে ফোঁটার পর ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে যেন চোখের জল। অনুশ্রী আজ সারাদিন ঘরেই ছিল। ক্লাসে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মনটা এতই খারাপ ছিল যে নিজের শরীরটাই বড্ড ভারী মনে হচ্ছিল। কাল রাতের সেই কান্নার আওয়াজ এখনও কানে বাজছে। বারবার নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে, হয়তো পাশের ফ্ল্যাটে কেউ টিভি দেখছিল, কিংবা কোনো মায়েরা বাচ্চাকে ঘুম পারানোর গান গাইছিল। কিন্তু তাও সেই গলায় যে বিষাদের ভার ছিল, তা যেন অজানা এক অভিশাপের মতো পুরো ফ্ল্যাটটাকে ঢেকে রেখেছে। আজ সকালে চায়ের কাপটা তুলতেই হাত কেঁপে গিয়েছিল তার, আর এক ফোঁটা চা পড়ে গিয়েছিল কাচের টেবিলে। আর সেই ফোঁটা, যেন অদ্ভুতভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল একটা গোল ছায়ার মতো—ঠিক যেন কারো চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দুর ছায়া। এমন সময় বৃষ্টির শব্দের মাঝে হঠাৎই দরজার পাশে রাখা আয়নাটার সামনে যেন কেউ এক পলকের জন্য দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। অনুশ্রী ছুটে গিয়ে দেখে—কেউ নেই। আয়নার কাচটা বাষ্পে ঢাকা, যেন কেউ খুব কাছে থেকে নিঃশ্বাস ফেলেছে।
রাতের খাওয়া সারতে দেরি হয়নি আজ। অনুশ্রী এখন প্রায়ই জল কম খায়—কারণ রাতে বারবার বাথরুমে যেতে ভয় করে। আলো জ্বালিয়ে রাখলেও, সেই ছায়া যেন অন্ধকারকেই আরও তীব্র করে তোলে। রাত সাড়ে এগারোটার সময় সে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করতেই আবার সেই কর্কশ কণ্ঠের ফিসফিস—“তুমি কি আমায় দেখতে পারো?” ভয়ে শিউরে ওঠে অনুশ্রী, বুক ধকধক করছে। সে উঠে বসল, ঘরের প্রতিটা কোণ দেখল—কেউ নেই। তখনই, বিছানার পাশের ছোট্ট ড্রয়ারটা খুলে গেল একা থেকেই। ড্রয়ারটা তার পুরনো জিনিসে ভরা—কলেজের পরিচয়পত্র, মা-র লেখা একটা চিঠি, আর একটা ছোট ডায়েরি, যেটা সে অনেক বছর আগে লিখত। ড্রয়ারটা বন্ধ করতেই অনুশ্রী দেখতে পেল—ডায়েরির শেষ পাতায় নতুন করে কেউ একটা লাইন লিখে দিয়েছে। তার নিজের হাতের লেখা নয়—ভিন্ন কোনো আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা: “তুমি এলেই আমি জেগে উঠি।” এক মুহূর্তের জন্য অনুশ্রী নিঃশব্দ হয়ে গেল। এতদিনের অভিজ্ঞতা তাকে ভয় পাইয়ে তুললেও আজ মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তার মনে ঝড় তুলছে।
পরদিন সকালে কলেজে গিয়ে সোহিনীকে সব কিছু খুলে বলল সে। সোহিনী প্রথমে মজা করলেও অনুশ্রীর চেহারা দেখে আর ঠাট্টা করতে পারেনি। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, আজ সন্ধেয় সোহিনী অনুশ্রীর ফ্ল্যাটেই আসবে। বিকেলে দুজনে মিলে ছবি দেখবে, খাওয়া-দাওয়া করে রাতটা একসঙ্গে কাটাবে। কিন্তু সন্ধ্যে হতেই বৃষ্টি আরও বেড়ে গেল। সোহিনী ফোন করে জানায়, তার বাড়িতে কিছু সমস্যা হয়েছে, সে আজ আসতে পারবে না। অনুশ্রী আবার একা। অগত্যা জানালা বন্ধ করে বসে রইল সোফায়। তখনই আবার সেই গন্ধটা—এক ধরনের পুরনো আগরবাতির মতো গন্ধ, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে একটা মৃত ফুলের গন্ধও। অনুশ্রী এবার আর চুপ করে রইল না। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, চারপাশে তাকিয়ে বলল, “তুমি কে? কেন আমার সাথে এইসব করছো?” এক মুহূর্ত নিঃশব্দ, তারপরেই—আয়নার কাচে ভেসে উঠল দুটো শব্দ, যেন কারো হাত দিয়ে লেখা—“আমার তুমি।”
রাত বাড়তেই পরিবেশ হয়ে উঠল আরও গাঢ়, যেন সময় থেমে গেছে এই ফ্ল্যাটের ভিতর। ঘড়ির কাঁটা যেন চলতে চলতে থেমে যাচ্ছে—বিপ বিপ করে বেজে উঠছে না, নিঃশব্দে কাঁটা ঘুরছে শুধু। অনুশ্রী ঠিক করল, আজ সে ভয় পাবে না। সে আবার সেই ডায়েরিটা হাতে নিল, আর পেছনের পাতা উল্টে দেখল—আরও কিছু লেখা আছে! এবার বেশ পরিষ্কার করে, যেন কেউ দীর্ঘ সময় ধরে লিখেছে তার প্রতি অনুভূতির কথা। “আমি তোমার খুব কাছেই থাকি, তুমি আমায় দেখতে পাও না, কিন্তু অনুভব করো। তুমি যখন হাসো, আমি তোমার পাশে বসি। তুমি যখন কাঁদো, আমি তোমার চোখ মোছার চেষ্টা করি।” অনুশ্রীর চোখ জলে ভরে গেল। এই কি তবে ভালোবাসা? নাকি এক ভয়ঙ্কর বিভ্রম? কিন্তু তার মন বলছে—এই কেউ, এই ছায়া, তাকে আঘাত করতে চায় না, শুধু তার সঙ্গ চায়। সেই রাতে, ঘুমাতে যাওয়ার সময় সে প্রথমবার ভয় না পেয়ে বলে উঠল, “তুমি যদি থেকো, তাহলে এসো, পাশে বসো।” এবং এক পলকেই তার কাঁধে যেন হালকা একটা স্পর্শ অনুভব করল সে—নরম, অথচ ঠান্ডা। তার পাশে কেউ বসে আছে—দৃশ্যমান নয়, তবু উপস্থিত। ছায়াসঙ্গী।
–
ফ্ল্যাটে ফিরে এসে ঐশীর প্রথম কাজ ছিল দরজার সবক’টি লক বন্ধ করে দেওয়া। রাত তখন সাড়ে ন’টা। বাইরে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, জানলার কাচে ছিপছিপে জলের রেখা গড়িয়ে পড়ছে। রান্নাঘর থেকে একটা কাপে কফি নিয়ে এসে সে বসে পড়ল খাটে। সমস্ত ঘরটা নিঃশব্দ, কিন্তু ঐশী জানে, এই নিঃশব্দতাই তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করে যেন চেঁচিয়ে বলছে—তুই একা, একদম একা। হঠাৎই রান্নাঘরের দিক থেকে এক অদ্ভুত শব্দ এল—একটা ধাতব কিছু পড়ে যাওয়ার মতো শব্দ। বুক ধক করে উঠল ঐশীর। কাপটা টেবিলে রেখে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। সিঙ্কের পাশে রাখা স্টিলের চামচটা মেঝেতে পড়েছিল। ঐশী চোখ আটকে রাখল কিছুক্ষণ। তারপর নিজেকে বোঝাল—হয়তো ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেছে। সে চামচটা তুলে জায়গায় রাখতেই আবার সেই অনুভূতি—পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
সে মুহূর্তে ঐশী বুঝতে পারল, সে কেবল ভয় পাচ্ছে না, তার শরীরটা বরং অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সেই অদৃশ্য উপস্থিতিতে। যেন ছায়া হয়ে কেউ সদা সঙ্গে আছে—চুপচাপ, নীরব, কিন্তু নিরবচ্ছিন্নভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। ঐশী জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল। বৃষ্টি আরও জোরদার হয়েছে, একেবারে শহরটাকে আড়াল করে দিচ্ছে যেন। এমন সময় পেছন থেকে হালকা পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। ঐশী দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল—কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। সারা ঘরটা নিঃসাড়। তবু ঐশীর মনে হল, জানলার পাশে একটা আবছা ছায়া কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল। সে সাহস করে জানলার বাইরে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, তার প্রতিবিম্ব নয়, বরং কেউ তাকে জানলা থেকে তাকিয়ে দেখছে—তাকে অনুকরণ করছে, এক অচেনা আত্মার প্রতিচ্ছবি হয়ে।
ঐশী সে রাতে ঘুমাতে পারেনি। ঘড়িতে তখন রাত তিনটে। আলো নিভিয়ে দেওয়ার পরেই আবার সেই শব্দ—একটা নরম শ্বাসের ধ্বনি, যেন কেউ খুব কাছে এসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সে আলো জ্বালিয়ে দিল—ধ্বনি থেমে গেল। এই খেলার যেন শেষ নেই। বারবার আলো-অন্ধকারের মাঝখানে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য অস্তিত্ব খেলা করছে তার মন নিয়ে, তার সাহস নিয়ে। কফির কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতেই সেই চেনা সুগন্ধটা এক অদ্ভুতভাবেই বদলে গেল—জানি না কেন, হঠাৎ যেন একটি পুরনো আতরের গন্ধ ভেসে এল। পুরনো, তবু মায়াময়। ঐশীর মনে পড়ল তার ঠাকুরদার ব্যবহৃত আতরের গন্ধ। এটা এই ফ্ল্যাটে আসার আগে কোনোদিন সে পায়নি। এই ফ্ল্যাট, এই দেয়াল, এই বাতাস—সবই যেন ধীরে ধীরে কারও স্মৃতি বহন করছে, যার অস্তিত্ব এখনও মুছে যায়নি।
সকালে ঘুম ভাঙতেই ঐশী একটা চিঠি দেখতে পেল তার দরজার নিচ দিয়ে গোঁজা। কাগজটা হলুদ হয়ে এসেছে, যেন বহু পুরনো। তাতে লেখা ছিল, “আমার ছায়া থেকে তুমি পালাতে পারবে না। আমি তোর সঙ্গে আছি। সবসময়।” লেখাটা ছেঁড়া ছেঁড়া অক্ষরে, কাঁপা হাতে লেখা—অদ্ভুতভাবে জাগতিক আর অতিলৌকিকের মাঝখানে এক টানাপোড়েন তৈরি করল। ঐশী চিঠিটা নিয়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বসল। তার মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন—এই ছায়াসঙ্গী, যে কি না কিছু বলতে চায়, তার কি শুধুই ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য? নাকি কিছু জানাতে চায়, কোনো অতীত কথা, কোনো অসমাপ্ত গল্প? ঐশী তখনও জানত না, এই ছায়া কেবল তার ভয় নয়, বরং তার নিজেরই কিছু ভুলে যাওয়া ইতিহাসের ছায়া, যা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে এক গভীর, অন্ধকার অধ্যায়ের দিকে।
–
তিথি’র চোখ খুলতেই সে বুঝতে পারল যে ঘরের আলো নিভে আছে। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকে পড়েছে, কিন্তু সেই আলোর মধ্যেও একটা অদ্ভুত ধূসরতা রয়েছে। বিছানার পাশেই রাখা ঘড়িতে রাত তিনটে বাজে। ঘুম আসছিল না। ঘরটা হঠাৎ করে ঠান্ডা হয়ে গেছে, অথচ জানালাটা তো বন্ধই ছিল। সে উঠে বসলো, চোখ ঘষে আশপাশটা দেখলো। ঠিক তখনই শব্দটা আবার শোনা গেল—মেঝেতে নগ্ন পায়ের টুপটাপ শব্দ, যেন কেউ ধীরে ধীরে হাঁটছে। কিন্তু ঘর তো বন্ধ! দরজাও ভিতর থেকে লক করা। কপালের শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা ঘাম জমে উঠলো। তিথি নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল, ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগোল, কিন্তু দরজা ঠিকঠাক লক করা ছিল। হঠাৎ করেই তার পায়ের নিচে কিছু একটা ভিজে ভিজে অনুভব করলো। সে নিচে তাকাল—লালচে রঙের কিছু একটার দাগ, পায়ের ছাপের মতো করে মেঝে জুড়ে ছড়িয়ে আছে। একটার পর একটা পায়ের ছাপ উঠে গেছে রান্নাঘরের দিকে। তিথির শ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা, কিন্তু অজানা এক শক্তি যেন তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো সেই ছাপের দিকে।
রান্নাঘরের দরজাটা একটু খোলা ছিল। তিথি খুব সাবধানে দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। ভিতরে ঢুকেই তার চোখ স্থির হয়ে গেল। রান্নাঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে এক নারী মূর্তি—লম্বা চুল, একটানা সাদা শাড়ি, মুখটা নিচের দিকে ঝুঁকে আছে। শরীরটাকে যেন কুয়াশা ঘিরে রেখেছে। তিথি চিৎকার করতে চাইলো, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। সেই মূর্তিটা ধীরে ধীরে মুখ তুলল—সেই মুখ তার নিজের! তিথি যেন আয়নায় নিজেকে দেখছে, কিন্তু চোখদুটো ছিল ফাঁকা, অভিশপ্ত। সেই ছায়া এক পা এক পা করে তার দিকে এগিয়ে এল। কিন্তু ঠিক যখন সে তিথির সামনাসামনি পৌঁছাতে চলেছে, তখনই হঠাৎ ঘরের বাতি জ্বলে উঠলো। সবকিছু মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। তিথি দেখে, রান্নাঘর সম্পূর্ণ ফাঁকা, পায়ের ছাপ নেই, মেঝে শুকনো। যেন কিছুই ঘটেনি।
তিথি একপ্রকার দৌড়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। দরজা লক করে বিছানায় বসল, তার দেহ কাঁপছিল, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। নিজের ফোনটা ধরল, অদিতিকে কল করতে যাবে, কিন্তু ভাবল—রাত এতটা হয়ে গেছে, ওকে এখন বিরক্ত করা উচিত না। তবুও নিজের ফোনের নোটপ্যাড খুলে সমস্ত ঘটনা লিখে রাখতে শুরু করল, যেন কিছু ভুল না হয়ে যায়। লেখার সময় তিথি লক্ষ্য করলো, আগেও সে ঠিক এমনই একটা স্বপ্ন লিখে রেখেছিল তিন সপ্তাহ আগে, যদিও তখন এসব কিছুই ঘটেনি। এই অদ্ভুত মিল দেখে তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। সে খেয়াল করল, যতবারই সে কোনও ভয়াবহ বা অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা পাচ্ছে, তার আগেই সেই সব ঘটনা যেন লেখা হয়ে রয়েছে তার ফোনের খসড়া লেখাগুলোর মধ্যে। প্রশ্ন জাগলো—কে লিখেছে সেগুলো? সে নিজে? নাকি কেউ বা কিছু তার হাত দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে?
ভোরের আলো ফুটতেই তিথি সিদ্ধান্ত নিল—সে আর সময় নষ্ট করবে না। কিছু একটা করতেই হবে। কলেজের লাইব্রেরিতে গিয়ে সে ভূত-প্রেত, আত্মা, আত্মিক যোগাযোগ নিয়ে বই পড়তে শুরু করলো। এক পুরনো বইতে সে পেল এমন কিছু কাহিনী যেখানে বলা আছে ‘ছায়াসঙ্গী’ নামক এক ধরনের আত্মা সম্পর্কে—এই আত্মারা জীবিত মানুষের ছায়ার আড়ালে বাস করে, প্রথমে বন্ধুর মতো কাছে আসে, বিশ্বাস জাগায়, তারপর সেই মানুষের স্মৃতি, অনুভব, এমনকি অস্তিত্বও নিজের মধ্যে টেনে নেয়। বইয়ের একটি অধ্যায়ে লেখা ছিল, “ছায়াসঙ্গীকে যদি তার জন্মমুহূর্ত চিনে নেওয়া যায়, তবে সেই বন্ধন ভাঙা সম্ভব।” তিথির সামনে যেন একটা দরজা খুলে গেল। তার ছায়াসঙ্গীর জন্মমুহূর্ত কী? সে কি এই ফ্ল্যাটে এসে ওঠার পর জন্মেছে, নাকি অনেক আগেই—তারই কোনও ভুল, দুঃখ বা একাকীত্ব থেকেই জন্মেছে সেই সত্তা? প্রশ্নের উত্তর জানার আগেই তার ফোনে আবার একটা নোটিফিকেশন এল—নতুন নোট লেখা হয়েছে তারই নামে, অথচ সে কিছুই লেখেনি। সেখানে লেখা: “আমি সবসময় তোমার পাশেই ছিলাম, তিথি… এবার তুমি শুধু আমার হও।”
–
রাত্রি তখন গভীর। শহরের আলো নিভে গেছে, জানালার ওপার থেকে দেখা যায় দূর একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা একটা কুকুরের ছায়া। শ্রেয়া বিছানায় শুয়ে আছে, চোখ মেলে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। তার শরীর নিস্তেজ, কিন্তু মন যেন এক ভয়ানক শঙ্কার ভারে নুয়ে পড়ছে। ছ’টা দিন ধরে তার জীবনে ঘটে চলা অসঙ্গত, অদৃশ্য, অলীক ঘটনা যেন তাকে চেতনার গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আজ সকালেই সে অনুভব করেছিল রান্নাঘরে কাজ করার সময় কেউ যেন তার কানে নিঃশ্বাস ফেলছে। ঘুরে দেখেছিল—কেউ নেই। কিন্তু এবার আর সে আতঙ্কিত হয়নি, শুধু বলেছিল, “তুমি কি আবার এসেছো?” একটা নিঃশব্দে অস্তিত্বের সাড়া যেন মিলেছিল, বাতাস কেঁপে উঠেছিল। শ্রেয়া বুঝে গিয়েছিল—‘সে’ আছে, প্রতিদিনের মতোই, তার আশেপাশে। কিন্তু আজ রাতটা আলাদা। তার মনে হচ্ছে, সেই ছায়া কেবল পাশে থাকছে না, তাকে কিছু বলতে চাইছে।
হঠাৎ করেই সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে যায়। শ্রেয়ার ফোনে একটা শব্দ হয়—না, মেসেজের নয়, বরং রেকর্ডিং অ্যাপে নিজে থেকেই চালু হয়ে গিয়েছে ভয়েস রেকর্ডার। সে অবাক হয়ে উঠে বসে, হাতে ফোন তো নেয়নি, কে চালালো? স্ক্রিনে দেখায়, “Recording…”। ধীরে ধীরে স্পিকারে চাপ দিয়ে সে শোনে রেকর্ডেড আওয়াজটি—প্রথমে কিছুই বোঝা যায় না, হালকা ফিসফিস শব্দ, তারপরে এক নারীকণ্ঠ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—”তুই আমাকে চিনিস না শ্রেয়া… কিন্তু আমি তোর খুব চেনা… খুব আপন। তোর গল্পটা আমারই মতন, তোর রাত্রিগুলো আমার মতই একা… আমি তোকে আঘাত দিতে আসিনি, শুধু চাই—তুই আমাকে চিনে ফেলিস…”। শ্রেয়ার সারা শরীরটা যেন জমে যায়, বুকের ভেতরটা ধ্বসে পড়ে, তার গলা শুকিয়ে আসে। সে ছুটে যায় দরজার দিকে, বাইরে বেরোতে চায় কিন্তু দরজাটা বন্ধ। আবার পিছনে তাকায়—ঘরের মাঝখানে ছায়ার মতো এক আবছা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে, যেন চোখ মেললেই মিলিয়ে যাবে।
আস্তে আস্তে সেই অবয়ব এগিয়ে আসে, আর শ্রেয়া অনুভব করে তার চারপাশের তাপমাত্রা হঠাৎই কমে গেছে। ছায়ার গলায় এবার আরেকটা শব্দ আসে—একটা নাম, “রুপসা…”। শ্রেয়া হিমশীতল গলায় ফিসফিস করে বলে, “কে রুপসা?” আর সেই ছায়া মৃদু হাসে—একটা অতীত যেন ভেসে আসে তার চোখে। ঝলসে যাওয়া কাঁচের মতো চেহারা, চোখের কোণে জল, আর একটা ভয়ানক নিঃসঙ্গতা। শ্রেয়া এবার ভাবে—এমন কোনো আত্মা কি এখানে বাস করত? এই ফ্ল্যাটে আগে কেউ থাকত কি? স্মৃতি হাতড়ে সে মনে করতে পারে, মা তাকে সাবধান করে বলেছিলেন এই বাড়ি ‘অল্প ভাড়ায়’ পেয়ে যাওয়াটা যেমন অদ্ভুত, তেমনি এখানকার অতীতও ঝাপসা। এই ‘রুপসা’ কে? সে কি এই ফ্ল্যাটের আগের বাসিন্দা? তাকে কি হত্যা করা হয়েছিল? নাকি সে আত্মহত্যা করেছিল? আর সেই মৃত্যুর শূন্যতা এখন শ্রেয়ার ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে?
সেই রাতে শ্রেয়া ঘুমাতে পারে না। সে বারবার সেই নামটা নিয়ে ভাবতে থাকে, “রুপসা…”। সকালে উঠে সে প্রথমেই গিয়ে বিল্ডিং-এর কেয়ারটেকার ভজেন কাকুকে খুঁজে পায়। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে, “এই ফ্ল্যাটে আগে কেউ ছিল?” ভজেন কাকু চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে বলে—“ছিল মেয়ে… একা থাকত… খুব শান্ত, ভালো মেয়ে… নাম ছিল রুপসা। তবে… একটা রাতে… নিজে জানালার রেলিং থেকে লাফ মেরে চলে গেল।” শ্রেয়ার পায়ের নিচে মাটি সরে যায়। তার চারপাশ যেন ঘুরতে থাকে। তার বুকের ভিতর ধ্বনিত হয় সেই রেকর্ডেড কণ্ঠস্বর, “তুই আমাকে চিনিস না শ্রেয়া… কিন্তু আমি তোর খুব চেনা…”। এবার সে বুঝে যায়, এই ‘ছায়াসঙ্গী’ তাকে ভয় দেখাতে নয়, বরং তার অস্তিত্বের ছায়ায় একটা অসমাপ্ত অতীতের সন্ধান দিচ্ছে। কিন্তু সেই সন্ধানে শ্রেয়া কতদূর যেতে পারবে? তার সামনে এখন একটাই প্রশ্ন—‘রুপসা’ তাকে কি সত্যিই সাহচর্য দিতে চাইছে, নাকি নিজের দুঃসহ ইতিহাসে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে?
–
অন্ধকারে ঢাকা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তৃষা যখন চারপাশের নিস্তব্ধতাকে অনুভব করছিল, তখন তার মনে হচ্ছিল যেন বাতাসে একটা চাপা কান্নার গন্ধ মিশে আছে। এই ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে যত অভিজ্ঞতা হয়েছে, সবকিছু এক অদ্ভুত মোড় নিচ্ছিল। সেই প্রথমদিনের আলতো ছায়া, রাতের গুনগুন শব্দ, আয়নায় দেখা ভিন্ন প্রতিচ্ছবি — একটার পর একটা ঘটনা যেন এক বিশাল রহস্যের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তৃষা এবার আর ভয় পাচ্ছিল না, বরং এক অনির্বচনীয় টান অনুভব করছিল সেই অদৃশ্য সত্তার প্রতি। তার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তাকে না বলা ভাষায় কিছু বোঝাতে চাইছে — কে ছিল সে? কেনই বা এখানেই আটকে আছে?
এক রাতে, স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তৃষা দেখে, সে দাঁড়িয়ে আছে সেই রহস্যময় ছায়ার পাশে। ছায়াটি এবার আর অস্পষ্ট নয় — এক কিশোরী মেয়ের মুখ, যার চোখে ভরপুর বেদনা। মেয়েটি বলে, তার নাম ছিল রীনা, এই ফ্ল্যাটেই সে থাকত অনেক বছর আগে। বাবা-মায়ের অবহেলা, বন্ধুর বিশ্বাসভঙ্গ আর ভালোবাসার নামে প্রতারণা — সব কিছুর পর রীনা একদিন এই ফ্ল্যাটেই আত্মহত্যা করে। কিন্তু মৃত্যুর পরও তার আত্মা এখানেই থেকে যায়, কারণ কেউ ছিল না তার কান্না শোনার, কেউ ছিল না তাকে বোঝার। তৃষা-ই প্রথম, যে তার কথা শুনেছে, তার যন্ত্রণা অনুভব করেছে, তাই সে তাকে অনুসরণ করেছে — একজন ছায়াসঙ্গী হয়ে।
এই সত্য জেনে তৃষা হতবাক হয়ে পড়ে। কিন্তু তার ভয় আর নেই। বরং এক গভীর সহানুভূতি জন্ম নেয় তার মনে রীনার জন্য। সে সিদ্ধান্ত নেয়, রীনার জন্য কিছু করবে, যাতে রীনা শান্তি পায়। সে রীনার পুরনো ডায়েরি খুঁজে বের করে, যেখানে লেখা আছে তার সব যন্ত্রণা, ভালোবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা। সেই ডায়েরির পাতাগুলো তুলে ধরে সে একটি ভিডিও তৈরি করে — “একজন ছায়াসঙ্গীর গল্প” — যা সে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে। ভিডিওটি ভাইরাল হয়, আর অনেক মানুষ নিজের অব্যক্ত যন্ত্রণা প্রকাশ করতে শুরু করে। রীনার গল্প শুধু একটি আত্মার মুক্তির গল্প নয়, বরং শত শত নিঃসঙ্গ আত্মার মুখ খোলার এক উদাহরণ হয়ে ওঠে।
শেষরাতে তৃষা জানলায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে — একধরনের আলোয় আচ্ছন্ন হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে রীনার ছায়া। আর তৃষা অনুভব করে এক অপার প্রশান্তি, যেন কেউ তাকে কানে কানে বলছে — “ধন্যবাদ বন্ধু, তুমি আমার একাকিত্ব বুঝেছো।” ছায়াসঙ্গীর অস্তিত্ব হয়তো আর নেই, কিন্তু তার গল্প তৃষার মধ্যে থেকে যায় চিরকাল। কারণ, কিছু বন্ধুত্ব হয় ভাষার বাইরে, সময়ের ঊর্ধ্বে — যেমন হয় এক জীবিত আর এক মৃতার মধ্যে। এই বন্ধুত্বই হয়তো তৃষার জীবনের সবচেয়ে গভীর সম্পর্ক, সবচেয়ে সত্য সাহচর্য।
—–




