সুদীপ্তা কর
১
সরকার পরিবার বহু পুরোনো। শহরতলির শেষপ্রান্তে, ক্যানেলের ধারে মোটা পাঁচিলে ঘেরা প্রাসাদসদৃশ এক বাড়ি—যার কাঠের দরজার ওপর এখনও খোদাই করে লেখা আছে ‘সরকার ভিলা, ১৯২৩’। প্রবোধ সরকার এখানে জন্মেছিলেন, তাঁর বাবা-মারও জন্ম এই বাড়িতেই। সময় বদলেছে, কিন্তু বাড়ির চালচিত্র, লোহার রেলিং, কাঠের মেঝে—সবই থেকে গেছে ঠিক তেমনি। বিয়ের দিনটা ছিল মাঘের মাঝামাঝি—হালকা শীত, শিউলির শেষ গন্ধ, আর বাড়ি ভরা আলো। বিয়ের কোলাহলের মধ্যে শ্রেয়া এসে পা রাখল এই পুরনো সংসারে, লাল বেনারসীতে ঢাকা মুখে একরাশ লাজ লুকিয়ে। মীনাক্ষী দেবী, নতুন বৌমাকে দেখে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি অনুভব করলেন—মেয়েটা যেন একদম শান্ত, পরিণত, গম্ভীর। সে কম কথা বলে, হাসে ধীরে, আর চোখের চাহনিতে থাকে এক ধরনের অতল নির্লিপ্তি। অভিষেকও মনে মনে খুশি—মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী জীবনে সুন্দরী ও শিক্ষিতা স্ত্রী পেয়ে যেন জীবনের মানে আরও গভীর হয়েছে। কিন্তু কেউ জানত না, ঠিক সেদিন রাত থেকেই এই বাড়ির ইতিহাস আবার জেগে উঠবে। কারণ সেই রাতেই, যখন সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখন মেঝেতে পড়ে রইল লাল আলতার দুটো পায়ের ছাপ—ঘরের দরজা থেকে বারান্দার দিকে।
পরদিন সকালবেলা প্রথম দেখে রাঘব, পুরনো কাজের ছেলে। সে ভোরে উঠেই সিঁড়ি মোছার জন্য জল আনতে গিয়ে বারান্দার দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে। মেঝের উপরে ঠিক যেন নতুন আলতা মেখে কেউ সদ্য হেঁটে গেছে—একজোড়া নিখুঁত পায়ের ছাপ, একটা দুটো করে এগিয়ে গেছে বারান্দার কাঠের দরজার দিকে। রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ছাপগুলো হালকা হয়ে আসছে, কিন্তু এখনও রক্তলালের মতো টাটকা। রাঘব কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ধীরে ধীরে ডেকে তুলল রান্নাঘরের দিদিকে। মীনাক্ষী দেবী ছেলেমেয়েকে না জাগিয়ে চুপচাপ ছাপগুলো মুছে ফেলতে বললেন—“বোধহয় কোনও মেয়ে অতিথি রাতে বাথরুমে বেরিয়েছিল। কিছু না, হতো পারে,” বলে হেসে উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু তাঁর মনটা কেমন যেন খচখচ করছিল। এই বাড়িতে তিনি বিয়ের পর থেকে আছেন, এমন ছাপ এর আগে কখনও দেখেননি। তাছাড়া, শ্রেয়া তো রাতে একবারও ঘর থেকে বেরোয়নি, নিজে দেখেছেন। মনে মনে একবার শুধু ভাবলেন—না কি, সে ঘুমের মধ্যে বেরিয়েছে?
দিন কয়েক কেটে গেল। শ্রেয়া খুব সাধারণভাবেই সংসারে মিশে গেল। মীনাক্ষী দেবী অবাক হয়ে দেখলেন, মেয়েটা কখনও কিছু নিয়ে প্রশ্ন করে না—বাড়ির নিয়ম কানুন নিঃশব্দে মেনে চলে। রান্নাঘরে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে শাশুড়িকে দেখে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, অথচ একবারও বলে না, “আমি করব।” আবার মাঝেমাঝে সে চুপ করে ঘরের জানালার পাশে বসে থাকে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পাঁচিল পেরিয়ে দূরের তালগাছের দিকে। রাতে সে বিছানায় যায় ঠিক সময়েই, কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ দরজার দিকে তার মুখ ঘোরানো অবস্থায় ঘুমাতে দেখে অভিষেক। কয়েকবার তাকে ডাকলে সে হঠাৎ ফিরে আসে স্বাভাবিকতায়, কিন্তু তার চোখে তখন এক অদ্ভুত অনুপস্থিতি থাকে। এরই মধ্যে, দ্বিতীয়বার সেই ছাপ দেখা গেল। এবার শুধু বারান্দা নয়—ছাপগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে উপরতলার ছোট ঘর অবধি। প্রবোধ সরকার ধমক দিয়ে রাঘবকে বলেন, “তুই এসব কিসব বানাচ্ছিস? নিশ্চয়ই কোনও মেয়ে কাজের জন্য বেরিয়েছিল, আলতা পরে থাকতে পারে।” রাঘব কিছু বলেনি, কিন্তু ভেতরে তার হাড়ে হাড়ে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল। সে জানে, তার চোখ ভুল করে না। সেই ছাপ মানুষের নয়—মানুষ এভাবে হাঁটে না, এত নিখুঁতভাবে এমন ছাপ পড়ে না, আর আলতার ঘ্রাণ—তা যেন হাওয়া থেকে আসে, কে যেন তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, “আমি ফিরেছি…”
একদিন গভীর রাতে, বিদ্যুৎ চলে যায় কিছু সময়ের জন্য। অভিষেক মোবাইলের আলো নিয়ে উঠতে গিয়ে দেখতে পায়, শ্রেয়া বিছানায় নেই। ঘরের দরজা অর্ধেক খোলা, আর একটা ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে ভেতরে। সে বাইরে বেরিয়ে দেখে, শ্রেয়া জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। ঠান্ডায় তার গায়ে চাদর নেই, চুলগুলো এলোমেলো, আর সে কাঁপছে না—স্তব্ধ। অভিষেক ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে বলে, “তুমি এখানে?” শ্রেয়া ঘুরে তাকায়—তার চোখে যেন কেউ নেই। সে বলে, “ও ডাকছিল…” “কে?” — অভিষেক অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। শ্রেয়া বলে, “ও বলল, চল…” এরপরেই সে হঠাৎ জ্ঞান হারায়। অভিষেক তাকে ধরে বিছানায় নিয়ে আসে। সকালবেলা কিছুই মনে পড়ে না শ্রেয়ার, সে বলে, “আমি জানালায় গিয়েছিলাম?” এরপর থেকে অভিষেক ও মীনাক্ষীর মধ্যে ভয় ঢুকে পড়ে। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে ঠিক সেই রাতেই—মেঝেতে এবার শুধু পায়ের ছাপ নয়, লাল আলতার ফোঁটা ফোঁটা দাগ ছড়ানো চারপাশে। ঠিক যেন কেউ হেঁটে গেছে, থেমে দাঁড়িয়েছে, আবার এগিয়ে গেছে — এবং কোথাও কোথাও সেই ছাপে পড়েছে জলের দাগ… না, যেন চোখের জলের।
২
বাড়িতে সকালের রোদ ঠিকঠাক আসে না। চারদিকে এত বড় বড় গাছ, পুরোনো পাঁচিল, উঁচু জানালা—সব মিলিয়ে দিনের আলোও যেন ভিতরে ঢোকার আগে একটু দম নেয়। সেইদিন সকালে অভিষেক প্রথম উঠে দেখে, শ্রেয়া চুপ করে জানালার ধারে বসে। চুলগুলো এলোমেলো, সাদা নীলচে নাইটি পরে, চোখ তার দূরের দিকে। “ভালো লাগছে না?” অভিষেক জিজ্ঞেস করে। শ্রেয়া চমকে ওঠে না, ধীরে ঘাড় ঘোরায়। বলে, “না, ঠিকই আছি।” কিন্তু অভিষেক খেয়াল করে, তার গায়ের কাপড় ভেজা, পায়ের পাতা লালচে। সে আর কিছু না বলে ঘরের মেঝে দেখে—আরও একবার, নিখুঁতভাবে আঁকা যেন দুটি পায়ের ছাপ, লাল আলতার মতো টাটকা। এবার সেই ছাপ শুধু জানালা অবধি নয়, বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়েছে। অভিষেক ধীরে ধীরে নিচে নামে, ছাপ অনুসরণ করে। মেঝেতে এক জায়গায় ছাপ থেমে গিয়ে একটু হেলে পড়েছে, তারপর আবার সোজা হয়েছে। যেন কেউ পা টেনে হেঁটেছে… না কি কারও কাঁধে হাত রেখে চলেছে?
নীচে নেমে প্রবোধ সরকার তার অভ্যস্ত দিনের শুরুতে পত্রিকা পড়ছেন, পাশে মীনাক্ষী রান্নাঘরে চা বসাচ্ছেন। অভিষেক কিছু না বলে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। ওখানেই রাঘব মোপ হাতে দাঁড়িয়ে। তার মুখটা ফ্যাকাশে, চোখে রাত জাগার দাগ। “আবার?” অভিষেক নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে। রাঘব কেবল মাথা নাড়ে। বলে, “বাবু, মোছা যায় না। ঘষলেও যায় না। শুকায় না যেন।” অভিষেক নিজেই কাপড় দিয়ে একটা ছাপ মুছতে চেষ্টা করে—কিন্তু কাপড়ে লাল কিছু লাগে না, আবার ছাপটাও পুরোপুরি যাচ্ছে না। শুধু রোদ উঠলে ছাপটা একটু হালকা হয়, কিন্তু তার রেশ থেকে যায়। অভিষেক প্রথমবারের মতো অস্বস্তি অনুভব করে—সে আধুনিক মানুষ, অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী নয়। কিন্তু বাড়ির ইতিহাস তার জানা। তার ঠাকুর্দার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী, ‘বাণী বৌঠান’, এই বাড়িতেই নাকি অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল। যদিও পরিবারের মতে সেটা ছিল রান্নাঘরের দুর্ঘটনা, কিন্তু গ্রামের লোকেরা বলত—সেই মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। অভিষেক এসব গল্প শুনে বড় হয়েছে, কিন্তু বিশ্বাস করেনি। এখন তার চোখের সামনে ঘুরে ফিরে আসছে সেই নাম—‘বাণী’। শ্রেয়ার মুখে কি সত্যিই কিছু মিল রয়েছে তার সঙ্গে?
দুপুরে মীনাক্ষী দেবী শ্রেয়াকে বলেন, “আজ একটু আমার সঙ্গে মন্দির ঘরে এসো। নিত্যপুজোর নিয়মটা একটু শিখে নাও।” শ্রেয়া চুপ করে মাথা নাড়ে। সে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে যায়, কিন্তু তার পায়ের তলায় যেন কিছুর খসখসে আওয়াজ—যেন মেঝেতে কিছু মাখা আছে। মা-বৌমা একসঙ্গে ঠাকুরঘরে বসে। মীনাক্ষী একবার বলে ওঠেন, “তোমার চেহারাটা বড় চেনা লাগে… আমাদের পরিবারের একটা ছবির সঙ্গে মুখটা অনেকটা মেলে।” শ্রেয়া কেবল হালকা হেসে বলে, “হয়তো পূর্বজন্মে আমি এখানেই ছিলাম।” কথা বলার ধরণটা এমনই ছিল যেন একটা ঠাণ্ডা ঠাট্টা—কিন্তু সেই হাসির নিচে ছিল অদ্ভুত শূন্যতা। এরপর, ঘরের কোণে রাখা থালায় প্রসাদ দিতে গিয়ে, শ্রেয়ার হাত কেঁপে উঠে পড়ে যায় ফুল। সে ধীরে ধীরে মাটিতে পড়ে ফুল কুড়িয়ে নিচ্ছে, আর তখনই মীনাক্ষী লক্ষ করেন, মেঝেতে একজোড়া লাল আলতার ছাপ ঠিক যেন পুজোর ঘটের দিকে এগিয়ে গেছে। কিন্তু শ্রেয়া তো কিছু মাখেনি পায়ে… না কি?
সন্ধ্যাবেলায় প্রবোধ সরকার শ্রেয়াকে ডাকেন। বলে, “তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।” ঘরের আলো তখন ম্লান, কাঁচের বাতির নিচে বসে তিনি একটা পুরোনো অ্যালবাম বার করেন। ছবির ভেতরে একটা হলুদ হয়ে যাওয়া সাদা-কালো ছবি—একজন তরুণী, লালপাড় শাড়িতে বসে আছে, মুখে গাম্ভীর্য। ছবির নিচে লেখা — ‘বাণী সরকার, ১৯৫৪’। শ্রেয়া ছবির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর বলে, “আমি ওকে চিনি… স্বপ্নে দেখেছি অনেকবার।” প্রবোধ চমকে ওঠেন, কিন্তু কিছু না বলে আবার অ্যালবাম বন্ধ করেন। ঘরের বাইরে হাওয়া বেড়ে গেছে, জানালার কাঁচ কাঁপছে। সে রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর, অভিষেক আবার জেগে ওঠে—শ্রেয়া পাশে নেই। দরজা খোলা, ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢুকছে। বাইরে গিয়ে সে দেখে, শ্রেয়া এবার ছাদে উঠেছে। অন্ধকার ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে, পেছন ঘোরানো অবস্থায়, চুল উড়ছে হাওয়ায়। সে পায়ের কাছে হেঁটে যাওয়া ছাপ দেখে—লাল, টাটকা, ঠিক তার পায়ের মতোই গঠিত। সে শ্রেয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে ধীরে বলে, “এই ছাপগুলো কবে থেকে?” শ্রেয়া বলে, “ও বলেছিল আমি যেন ভুলে না যাই… আমার ছাপ এখানেই থাকবে চিরকাল।” সেই মুহূর্তে আকাশের গর্জন, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে অভিষেক আর কোনও কথা বলতে পারে না। তার শুধু মনে হয়, এই মেয়েটা তার স্ত্রী তো বটেই, কিন্তু কেউ যেন আরেকটা আত্মা নিয়ন্ত্রণ করছে তাকে… অথবা হয়তো সে-ই সেই আত্মা।
৩
শ্রেয়া রাতের সেই ছাদের ঘটনা পরদিন সকালে আর মনে রাখতে পারল না—অথবা ইচ্ছে করে ভুলে থাকল, কেউ জানল না। অভিষেক অবশ্য ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই নিজের মোবাইলটা হাতে নিল। গতরাতে সে ভিডিও রেকর্ডিং অন করেছিল, যদিও অন্ধকারে স্পষ্ট কিছু দেখা যায়নি, কিন্তু একটা অস্পষ্ট গলার আওয়াজ পাওয়া গেছে—একটা মেয়ে কণ্ঠ বলছে, “এই ছায়ার নিচে আমি রয়ে গেলাম… আলো তো পৌঁছল না।” অভিষেক বারবার শুনে বুঝতে পারল না, এটা শ্রেয়ার কণ্ঠস্বর, না অন্য কারও। সেইসঙ্গে ভিডিওতে ঘরের দরজা খুলে যাওয়ার আওয়াজ, জানালার কাঁচের ঠকঠক করা শব্দও ধরা পড়েছে। এসব অদ্ভুত ঘটনা অভিষেকের মনে সংশয় আর ভয়, দুই-ই জাগিয়ে তুলেছে। তার ছোটবেলায় ঠাকুমা যে গল্প বলতেন—বাড়ির ‘অভিশপ্ত বৌঠান’-এর কথা, তার আত্মার ঘোরাফেরার গল্প—সব হঠাৎ করে যেন বাস্তব হয়ে উঠছে। তবে সে চায় না এটা কেউ জানুক, বিশেষ করে মা-বাবা। শ্রেয়ার প্রতি তার এখনও ভালোবাসা, কিন্তু তার স্ত্রীর চোখে, হাসিতে, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ভঙ্গিতে এখন প্রতিনিয়ত সে খুঁজে পাচ্ছে এক অচেনা ছায়া।
সেইদিন দুপুরে বিদ্যুৎ চলে যায়, আর মীনাক্ষী দেবী পুরনো স্টিলের আলমারি থেকে ধুপকাঠি বের করতে গিয়ে হঠাৎ হাত ফসকে অ্যালবামটা ফেলে দেন। খোলা পাতায় পড়ে থাকে কিছু হলুদ হয়ে যাওয়া ছবি। একটা ছবি তার চোখে পড়ে—‘বাণী সরকার’, তাঁর শাশুড়ির ভাইপোর স্ত্রী। সেই ছবি মেঝে থেকে তুলে নিয়ে তিনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। শ্রেয়ার মুখ ভেসে ওঠে। চোখ, নাক, চিবুক—সবই যেন হুবহু মিলে যায় বাণীর সঙ্গে। ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে যায় তাঁর শরীরে। তিনি ছবিটা নিয়ে সরাসরি শ্রেয়ার ঘরে যান। তখন শ্রেয়া বই পড়ছিল, কিন্তু তাকে দেখে বইটা উল্টে রাখল টেবিলে। “এই ছবি চিনতে পারো?” মীনাক্ষী জিজ্ঞেস করেন। শ্রেয়া ছবিটার দিকে তাকিয়ে প্রথমে কিছু বলে না। তারপর ধীরে বলে, “ওর নাম কি বাণী?” মীনাক্ষী চমকে ওঠেন, “তুমি জানলে কী করে?” শ্রেয়া শান্ত গলায় উত্তর দেয়, “আমার স্বপ্নে ও আসে প্রায়ই। একটা লাল ঘর, খোলা জানালা, আর ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া এক রকম আলোতে… ও দাঁড়িয়ে থাকে।” মীনাক্ষী দেবীর বুক ধকধক করতে থাকে। তিনি জোর করে হাসেন, “স্বপ্নে অনেক কিছুই আসে। কিন্তু বাণী তো… বহু বছর আগেই মারা গেছে।” শ্রেয়া নিচু গলায় বলে, “সবাই তো মরে না ঠিকভাবে, তাই না মা?”
রাতে প্রবোধ সরকার তাঁর পুরনো বন্ধু সোমেশ্বরকে ফোন করেন—যিনি একসময় লোকজ ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। প্রবোধ বলেন, “তুই কি মনে রাখিস, আমাদের বাড়িতে একসময় কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল? বাণীর মৃত্যু?” ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে সোমেশ্বর বলেন, “অবশ্যই। ওর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না, প্রবোধ। পুড়িয়ে মারা হয়েছিল বলেই তখন গুজব উঠেছিল। আর মনে আছে তো, সেই সময় বারবার বাড়িতে আলতার পায়ের ছাপ দেখা যেত? ঠিক যেদিন ও মারা গেল, তার পরদিন থেকেই ছাপগুলো উধাও হয়ে গেছিল। মানে… হয়তো কিছু না, তবে ব্যতিক্রম তো ছিল।” প্রবোধ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর বলেন, “শ্রেয়ার মুখটা ওর সঙ্গে হুবহু মেলে। আমার স্ত্রীও বলছে। আর আবার ছাপ দেখা যাচ্ছে…” ওপাশ থেকে দীর্ঘনিশ্বাস, “ভবিষ্যৎ আর অতীত মাঝেমাঝে ঘেঁটে যায় প্রবোধ, যখন কিছু না বলা সত্যি আবার ফিরে আসে।” কথা শেষ হওয়ার পর প্রবোধ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরের কুয়াশার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই বাড়ির পুরনো ইতিহাস কি আবার নতুন রূপে ফিরে আসছে?
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অভিষেক দেখতে পায়, শ্রেয়া খাটে নেই। দরজা খোলা, বারান্দায় হালকা রোদ। সে বেরিয়ে দেখে, শ্রেয়া দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার শেষ প্রান্তে। তার মুখে হাসি, কিন্তু চোখে যেন ঘোর। “তুমি কিছু খেয়েছ?” জিজ্ঞেস করলে শ্রেয়া মাথা নাড়ে। “চলো নিচে যাই,” অভিষেক বলে। কিন্তু ঠিক তখনই সে লক্ষ করে, শ্রেয়ার পায়ের তলায় মাটি লাল হয়ে আছে—একটি আলতার শিশি খোলা পড়ে আছে জানালার পাশে, অথচ কেউ কখনও তাকে আলতা কিনে দেয়নি। “এই আলতা কোথা থেকে এলো?” অভিষেক প্রশ্ন করে। শ্রেয়া মৃদু হেসে বলে, “ও রেখে গেছে…” “কে ‘ও’?” — অভিষেক তীক্ষ্ণ গলায় বলে। শ্রেয়া মাথা নিচু করে বলে, “যে প্রতিদিন আমার ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকে, দরজার পাশে… জানালার ওপাশে… এই বাড়ির দেওয়ালে যার কান্না লেগে আছে এখনও।” অভিষেক এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সে নিচে ছুটে যায়, ড. অনিরুদ্ধ দে-কে ফোন করে—তার বন্ধু, যিনি একসময় প্যারানরমাল ঘটনা নিয়ে গবেষণা করতেন। “তুই কবে আসতে পারবি?” অভিষেক শুধু একবার প্রশ্ন করে। ওপাশ থেকে উত্তর আসে, “আজ রাতেই।”
৪
বিকেলের আলো পড়ে আসছে পাশের কলতলার দেয়ালে, ঠিক তখনই দোতলার পেছনের জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা মীনাক্ষী দেবী দেখতে পেলেন সরলা বালাকে। সাদা থানের শাড়ি পরে, হাতে একটা ছোট বাজারের থলে, সিঁড়ি ঘরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। একসময় সরকার বাড়ির পরিচারিকা ছিল, প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। এখন পাশের বস্তির এক কোণার ঘরে থাকে, মাঝে মাঝে পুজোর সময় সাহায্য করতে আসে। আজ আচমকা তার উপস্থিতি দেখে চমকে গেলেন মীনাক্ষী। নিচে নেমে এসে দরজায় দাঁড়াতেই সরলা হাসল না, নমস্কারও করল না। চোখে ছিল এক অদ্ভুত গভীরতা। “মাসিমা, তোমার নতুন বউমাকে নিয়ে খুব শান্তিতে তো?” সরলার ঠান্ডা গলা শুনেই বুকের ভেতরে কেঁপে উঠলেন মীনাক্ষী। “তুই হঠাৎ এলি কেন, সরলা?” সরলা একটু এগিয়ে এসে বলল, “মাসিমা, আমি ওর মুখটা প্রথম দিনই দেখেছিলাম… যেদিন বারান্দায় পায়ের ছাপ পড়েছিল, মনে আছে?” মীনাক্ষী চুপ করে রইলেন। সরলা ধীরে ধীরে বলে চলল, “ওর মুখ একেবারে সেই বৌঠানের মতো—বাণী বৌঠান… যে মেয়েটাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল রান্নাঘরের আগুনে… আর তারপর রাতবিরেতে বাড়ি জুড়ে ঘুরে বেড়াত তার আলতা মাখা পা।”
মীনাক্ষী চমকে উঠলেন। “তুই কি বলছিস এসব? কুৎসিত কথা!” সরলা তার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে বলে চলল, “ওর পায়ের ছাপ আমি মুছে দিতে গিয়েছিলাম তখনও—একবার, দু’বার, বারবার… কিন্তু মোছা যেত না। আর এখন আবার… ও ফিরে এসেছে। আমি জানি মাসিমা, ওর চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, সে মানুষ না। ওর চোখে জল নেই, ভয় নেই, শুধু চাহনি। জানো, আমি একদিন স্বপ্নে দেখেছিলাম—বৌঠান বারান্দার ধারে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে আলতার শিশি, বলছে—‘আমার পা মুছে দিয়েছিল ওরা, এবার আমি আবার লিখে যাবো’।” মীনাক্ষীর মুখ শুকিয়ে গেল। সরলা এবার কণ্ঠ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এই বাড়িতে যা শুরু হয়েছে, তা আর থামবে না। তোমার ছেলে… সে বুঝবে না। তুই বলিসনি, একটা অ্যালবামে ছবি ছিল? খুঁজে দেখো না, সেই ছবির পিছনে কী লেখা ছিল?” এই বলে হঠাৎ সরলা থেমে গেল, যেন তার মুখটা অসাড় হয়ে এল, কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নড়ে উঠল—“ও চলে আসছে…” মীনাক্ষী কিছু বলার আগেই সরলা ফিরে দাঁড়াল, চোখে যেন জল জমে উঠেছে, বলল, “আমি যাচ্ছি, আর আসব না মাসিমা। ও আমায় ডেকেছিল… আমি শুনিনি তখন। এবার চুপ করে যাবো।” সরলা সিঁড়ি পেরিয়ে চলে গেল।
সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নামল। অভিষেক তার মোবাইলে সরলার কথা রেকর্ড করে রেখেছিল মায়ের কাছ থেকে শুনে। এবার সে সত্যিই ভয় পাচ্ছে, যুক্তি দিয়ে আর সব বোঝানো যাচ্ছে না। শ্রেয়া যদিও স্বাভাবিকই আছে—রান্নায় সাহায্য করছে, রাতে অভিষেকের পাশে ঘুমোচ্ছে, কিন্তু মাঝেমাঝে এমনভাবে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছে। ঠিক ১২টার সময়। এবং ঠিক ওই সময়েই, বারান্দা থেকে ঘরের ভেতরে ঢোকে আলতা মাখা পায়ের ছাপ—যা প্রথমে কারও চোখে পড়ে না, কিন্তু ভোরবেলা শুকনো মেঝেতে দগদগে লাল আকারে থেকে যায়। রাঘব এবার কাজ ছেড়ে দিতে চায়। সে এক সকালে এসে বলে, “আমার ছোট ছেলেটা রাতে ঘুমোতে পারে না বাবু… আমি কিছু নিয়ে এসেছি বাড়ি থেকে, তাবিজ। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আমি থাকলে ভালো হবে না।” অভিষেক কিছু না বললেও তাকে যেতে দেয়। প্রবোধ সরকার এবার আরও চিন্তিত। তিনি বলেন, “কেউ একজন চাইছে ফিরে আসতে… অথচ তার শরীর নেই। আর এই মেয়েটা হয়ত তার বাহন।”
সেই রাতে প্রথমবারের মতো শ্রেয়া ঘুমের মধ্যে কথা বলল। অভিষেক পাশে শুয়ে ছিল, হঠাৎ কান পাততেই শুনল, স্ত্রীর মুখে অদ্ভুত ভাষা—পুরোনো দিনের বাংলা, এমন কিছু কথা যা সে আগে কখনও শোনেনি। “ওরা আমায় পুড়িয়েছিল… আমি বলেছিলাম আমি ফিরব… ওরা জানল না, আগুনে সব পুড়ে যায় না।” অভিষেক হাত ধরে তাকে নাড়িয়ে দেয়, শ্রেয়া ঘুম থেকে উঠে চমকে ওঠে, বলে, “আমি আবার কিছু বলছিলাম?” অভিষেক কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে তার স্ত্রীর চোখের দিকে—সেই চোখে আজও কোন ছায়া খেলা করে। পরদিন সকালে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে—সরলার বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, সে রাতে ফিরেই নিখোঁজ হয়ে গেছে। তার ঘরের দরজা খোলা ছিল, আর মেঝেতে শুকিয়ে যাওয়া একটা লাল ছোপ, যা অনেকটা আলতার মতো। পাশের বুড়ি একথা বলতেই পরিবার স্তব্ধ হয়ে যায়। অভিষেক এবার আর দেরি না করে ড. অনিরুদ্ধ দে-কে ফোন করে জানায়—“তুই আর সময় নে, আজকেই চলে আয়, নয়তো ওর শরীরে সে পুরোপুরি ঢুকে যাবে।”
৫
চারিদিক নিস্তব্ধ। গ্রামের নিঃশব্দ রাত যেন চিৎকার করে বলে— “সব ঠিক নেই।” নিধি বিছানায় আধশোয়া হয়ে টের পাচ্ছিল, আজ রাতটা অন্যরকম। বাতাসে যেন একটা ঘন জড়তা, একটা চাপা আতঙ্ক। জানালার পর্দা ধীরে ধীরে দুলছে। নিধি ঘুমোতে পারছে না। ওর পাশেই শুয়ে আছে অরুণ, ঘুমিয়ে পড়েছে কিছুক্ষণ আগেই। অথচ নিধির চোখে ঘুম নেই। সে টের পাচ্ছে কিছু একটা আজ ঘটতে চলেছে। আচমকা খাটের নিচে থেকে একটা খসখসে শব্দ হল। নিধি ঝট করে উঠে বসল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল অন্ধকারে। ঘরের কোনে রাখা আলনার ছায়া যেন একটু নড়ল। নিধি ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। সাহস করে সে নিচে নামল না, কেবল ধীরে ধীরে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, কিন্তু কান খাড়া করে রেখেছে— যেন রাতের প্রতিটি শব্দ সে ধরতে চায়।
রাত বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁয়েছে কি না, নিধি নিশ্চিত নয়। তবে হঠাৎ করেই ঘরের বাইরে, মেঝেতে, কেমন একটা টুপটাপ শব্দ হতে লাগল। যেন কারো ভেজা পা মেঝেতে পড়ছে ধীরে ধীরে। নিধি সোজা হয়ে বসে পড়ল। দরজার ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা এসে পড়েছে বিছানার এক প্রান্তে। সে চুপচাপ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। শব্দটা ঘরের ঠিক বাইরে— রান্নাঘরের দিক থেকে আসছে। নিধির শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। এমন ভয় সে জীবনে কখনো পায়নি। হঠাৎই সেই পায়ের শব্দ থেমে গেল। নিধি সাহস করে বিছানা থেকে নামল। জানালার ধারে গিয়ে পর্দা সরাল। বাইরের উঠোন চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। তখনই রান্নাঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে আলোর একটা রেখা মেঝেতে পড়ল, এবং তার ঠিক মাঝখানে স্পষ্ট দেখা গেল— দুটি আলতা মাখা পায়ের ছাপ! তাজা, টাটকা ছাপ— যেন এইমাত্র কেউ হেঁটে গেছে।
নিধির মাথা ঘুরে উঠল। ওর চোখ ছানাবড়া। নিজেকে জোর দিয়ে বলে উঠল— “হ্যালুসিনেশন হচ্ছে নিধি, হ্যালুসিনেশন!” কিন্তু তার পরেই আবার একটা শব্দ হল, যেন রান্নাঘরের বাটিতে কেউ হাত দিয়েছে। নিধি সোজা দরজার দিকে এগোল। হাত কাঁপছে, কিন্তু সে থামল না। দরজার ছিটকিনি খুলে ধীরে ধীরে দরজা খুলল— রান্নাঘরে কেউ নেই। অথচ জানলার কাছে রাখা পিতলের থালায় হাতের ছাপ, আর তার পাশে আবার সেই ছোপ ছোপ আলতা পায়ের ছাপ, যেন সে জানলা দিয়ে ঢুকেছিল। নিধি তৎক্ষণাৎ জানলার দিকে তাকাল— জানলার কপাট খোলা, অথচ ভিতর থেকে বন্ধ করা ছিল সন্ধ্যায়। তাহলে? কে এল, কীভাবে এল? নিধির মুখ শুকিয়ে গেল। রান্নাঘরের ঠিক পাশের প্যাসেজে রাখা পুরনো কাঠের বাক্সটার ঢাকনাও অর্ধেক খোলা। নিধি ঘরের ভিতর ছুটে গিয়ে দরজা আটকে দিল। ওর বুকের ধুকপুকানি এত জোরে হচ্ছিল, যেন কানেও শোনা যায়।
পরদিন সকালে নিধি কারও কিছু বলল না। শুধু রান্নাঘরে ঢুকে প্রথমেই খেয়াল করল— আগের রাতের আলতা পায়ের ছাপগুলো নেই! এমনকি মেঝেতেও কোনও দাগ নেই। যেন কিছুই ঘটেনি! কিন্তু সে জানে, যে দেখেছে, সেই বোঝে। নিধির মুখে কোন কথা নেই, কিন্তু চোখে কেমন একটা পরিবর্তন— ঘুম নেই, আতঙ্ক আছে। জ্যাঠাইমা সকালে খেয়াল করলেন, নিধি একটু চুপচাপ, ঘরের কাজ করলেও মন নেই। বললেন, “কি রে, শরীর খারাপ নাকি?” নিধি মাথা নাড়ল, কিন্তু চোখে জল টলমল করে উঠল। সে বলতে পারল না, কেন যেন মনে হচ্ছে, কেউ ওর ঘরে আছে— যে অদৃশ্য, কিন্তু নিধির ওপর নজর রাখছে প্রতি রাতে। কে সে? জীবিত, না অশরীরী? প্রশ্নটা কেবল বেড়েই চলল নিধির মনে…
৬
নন্দিনার শরীরের ভেতর যেন কোন অজানা শীতল স্রোত বইতে শুরু করেছিল। আগের রাতে আবারও সেই পায়ের ছাপ—তবে এবার শুধু মেঝেতে নয়, বিছানার চারপাশেও ছিল। যেন কেউ তার ঘুমন্ত শরীরকে ঘিরে পায়ের ছাপ ফেলে হেঁটে গেছে। সে চিৎকার করে জেগে উঠেছিল, কিন্তু চারদিকে তখনো ঘন নীরবতা। রাত তখন ঠিক বারোটা পঁচিশ। ঘড়ির কাঁটার শব্দ পর্যন্ত মনে হচ্ছিল গর্জনের মতো। নন্দিনার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। পরপর ক’দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি—কেউ যেন হেঁটে বেড়ায় তার ঘরের মেঝেতে, আলতার লাল ছোপ ছোপ পায়ের ছাপ রেখে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলে সেগুলো উধাও। শ্বশুর-শাশুড়ি সব শুনেও একরকম চেপে যেতে বলেছিলেন। “নতুন বৌমা, এসব ভেবে মাথা খারাপ করো না। আলতার দাগ? তা তো তোমারই হতে পারে,” বলেছিলেন শাশুড়ি। কিন্তু নন্দিনা জানে—এগুলো তার নয়।
সেই রাতে, মনে এক দুরন্ত কৌতূহল নিয়ে, নন্দিনা ঠিক করেছিল অপেক্ষা করবে। সবে বারোটা বাজতে শুরু করেছে, সে নিঃশব্দে উঠে জানালার পাশের ছোট টুলটায় বসল। বাইরের কুয়াশার ভেতরেও যেন ঘরের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করেই জানালার গ্লাসে ঠকঠক শব্দ—নন্দিনার হৃদস্পন্দন থেমে যেতে চাইল। বাইরে কেউ নেই, অথচ জানালার গায়ে লাল আলতার মতো ধারা। সে ধীরে ধীরে জানালার কাছে এগিয়ে গেল। সেই মুহূর্তে ঘরের ভেতর হাওয়ার মত একটা ঠান্ডা শ্বাস এসে পড়ল তার ঘাড়ে। সে চমকে পিছিয়ে এলো, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। ভয় আর রহস্য যেন একসাথে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। আচমকা মেঝেতে আবার দেখা গেল সেই পায়ের ছাপ—তবে এবার পায়ের ছাপ শুধু ঘরের দিকে নয়, বরং ঘর থেকে বারান্দা হয়ে সোজা সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে। কারও উপস্থিতি ছিল ঘরের ভেতরে—নিঃসন্দেহে।
পায়ের ছাপ অনুসরণ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল নন্দিনা। পুরো বাড়ি তখন নিঃসাড়। ঘড়ির টিক টিক ছাড়া কোনো শব্দ নেই। সিঁড়ির নীচে নেমে এসে সে লক্ষ্য করল, ছাপগুলো যাচ্ছে পুরনো পুজোর ঘরের দিকে—যেখানে বহু বছর আগে নাকি পরিবারের এক কন্যার অকালমৃত্যু হয়েছিল। এই তথ্য সে কিছুদিন আগে শাশুড়ির মুখে শুনেছিল, যদিও তারা কিছুতেই বিস্তারিত বলতে চায়নি। পুজোর ঘরের দরজাটা একটু ফাঁকা, আর সেই ফাঁকা দরজার ফাঁক দিয়ে যেন একজোড়া চোখ তাকে দেখছে। এক মুহূর্তের জন্য সব শব্দ স্তব্ধ হয়ে গেল। নন্দিনা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজা ঠেলতেই দেখা গেল একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি—লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা, পা দুটো ভেসে আছে মাটির ওপরে। হঠাৎ সেই ছায়া ঘুরে তাকাল। নন্দিনার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। সে বুঝতে পারছিল—এটা কোনো মানুষ নয়, কোনো আত্মা, যা কোনো অপ্রাপ্তি নিয়ে আবদ্ধ এই বাড়িরই কোথাও।
ছায়াটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল পুজোর ঘরের মেঝের দিকে। পায়ের ছাপও মিলিয়ে গেল এক সময়। ঠিক তখনই পেছন থেকে শাশুড়ির কণ্ঠস্বর, জড়ানো স্বরে, “বৌমা, তুমি ওখানে কেন? রাতে ও ঘরে কেউ যায় না…” নন্দিনা ঘুরে দাঁড়াল, তার চোখে প্রশ্ন, “আপনারা আমাকে এতদিন কেন কিছু বলেননি?” শাশুড়ি কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “বছর দশেক আগে এই বাড়ির বড় বৌমা—শঙ্খার বৌ—পুজোর রাতে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে পাওয়া যায় এই ঘরের মেঝেতে আলতার দাগ… তবে তার দেহ আর কখনও মেলেনি।” কথাটা শুনে নন্দিনার মনে এক ধাক্কা লাগে। যে ছায়াকে সে দেখেছে, সেটি কি সেই হারিয়ে যাওয়া বৌমা? সে কি কিছু বলতে চাইছে? নাকি সাহায্য চাইছে? উত্তর খুঁজতে হবে—এই রহস্যের মধ্যে যে গভীর কোনো বেদনার ইতিহাস লুকিয়ে আছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠল সেই রাতে।
৭
রাত্রি তখন বারোটা পেরিয়েছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা, চাঁদের আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছে। গোটা বাড়িটা নিঃস্তব্ধ, শুধু ঘড়ির কাঁটার শব্দটা যেন দূরে কোথাও ফিসফিস করে চলেছে। ঐন্দ্রিলা আজ রাতে খুব ক্লান্ত। চোখ লাল হয়ে আছে, ঘুম নেই একটুও। বিয়ের পর থেকে যতটা স্বপ্ন ছিল সুখের সংসার নিয়ে, তার একটাও আর মেলে না আজ। প্রতিদিন রাত বারোটার সময় যে অদ্ভুত আলতা পায়ের ছাপ দেখা যায়, তার রহস্যটাই যেন তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আজ রাতে সে স্থির করল, সে দেখবে কে আসে, কীভাবে আসে। তার চোখে ঘুম নেই, হাতে একটা পুরনো নকিয়ার টর্চ দেওয়া ফোন, আর বুকের ভিতর আগুনের মতো কৌতূহল।
রাত প্রায় ১২টা ৪৫। হঠাৎ করেই নীচের মেঝেতে ‘চপ চপ’ শব্দ। ঐন্দ্রিলা নিজের ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে তাকাল। ফ্লোরে আবার দেখা গেল সেই তাজা আলতা পায়ের ছাপ। কিন্তু আজকের ছাপগুলো আগের থেকে স্পষ্টতর এবং আরও বেশি গভীর। মনে হচ্ছে কেউ হেঁটেই চলে যাচ্ছে ড্রইংরুম থেকে বারান্দার দিকে। সে দরজাটা আস্তে করে খুলে বেরোতে গেল—তবে পায়ের তলায় কোনও শব্দ না হয়, তার জন্য ওর লাল নরম চপ্পল হাতে তুলে নিয়েছে। ঐন্দ্রিলা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেই ছাপ অনুসরণ করে। বারান্দার কাছাকাছি পৌঁছে সে দেখতে পেল, বারান্দার এক কোণে লাল রঙের একটি শাড়ি পড়ে আছে—যেটা এই বাড়ির কারোর নয়।
বারান্দায় পৌঁছতেই ঠান্ডা হাওয়া তাকে আছড়ে পড়ল। তার গায়ে তখনও শাড়ি, কিন্তু শরীরটা যেন কেঁপে উঠল ভিতর থেকে। ছাপগুলো শেষ হয়েছে বারান্দার এক কোনায়, যেখানে এক পুরনো কাঠের দোলনা চেয়ারে বসে আছে এক নারী। ঐন্দ্রিলা তার দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু তার কণ্ঠ রুদ্ধ। মহিলার মুখ দেখা যাচ্ছে না, লম্বা চুলে ঢাকা, পরনে সেই একই লাল শাড়ি। হঠাৎ সেই নারী আস্তে করে মাথা তুলে তাকাল। তার চোখদুটো কোটরের মতো ফাঁকা, শুধু শূন্য দৃষ্টি আর ক্ষীণ একটা হাসি ঠোঁটে। ঐন্দ্রিলা ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে এল। তখনই সেই নারী বলল, “তুমি ওর জায়গা নিয়েছো, কিন্তু আমি এখনও রয়েছি এখানে…” কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা ঝাপটা বাতাসে নারীটা হাওয়ার মতো উবে গেল। ঐন্দ্রিলার হাতের ফোন ছিটকে পড়ে গেল নিচে, টর্চ অফ হয়ে গেল, আর পুরো বাড়িটা ঢেকে গেল নিঃশব্দ এক কর্কশতায়।
রাত গড়িয়ে সকাল। ঐন্দ্রিলা কিছুই বলেনি কাউকে, শুধু চুপ করে বসে রইল বারান্দায়, ঠোঁট শুকনো, চোখ স্থির। কিন্তু তার চোখে আজ একটা নতুন ভয়, একটা গভীর উপলব্ধি—এ বাড়ির দেওয়ালে যে কাহিনি লেখা আছে, সেটা কারও সাধারণ চোখে বোঝা সম্ভব নয়। এ যেন কোনও অন্য সময়ের, অন্য সত্ত্বার ইতিহাস। এখন শুধু একটাই প্রশ্ন তার মনে—সে কি সত্যিই নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছে, না কি কেউ তাকে এখানে টেনে এনেছে?
৮
রাতের আকাশ আজ যেন আরও গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। চাঁদ নেই, তারা নেই, শুধু ঘন কুয়াশার চাদর। বিশাল দালানবাড়ির চারপাশে একটা অশরীরি নিস্তব্ধতা নামিয়ে এসেছে। রত্না চুপচাপ বসে আছে দালানের ছাদের কিনারায়। ওর চোখে জল নেই, কিন্তু মনে এক ভয়ানক ঝড় বইছে। আগের রাতে সে যা দেখেছে, তা কোনো দুঃস্বপ্ন নয়—তা বাস্তব, স্পষ্ট, রক্তমাখা। আলতা পায়ের ছাপ এসে থেমেছিল রান্নাঘরের কাছে, তারপর আবার উল্টে ফিরে গিয়েছিল জানালার দিকে। জানালাটা সে নিজে বন্ধ করেছিল—তবু খোলা ছিল। কে এল? কে যায়? কার পায়ের ছাপ? এসব প্রশ্ন আর কাঁটায় কাঁটায় পেঁচিয়ে যাচ্ছে তার মাথায়। অয়ন আজ সারারাত জেগে বসেছিল রত্নার পাশে, কিন্তু আজ সে নিজেও ক্লান্ত। শেষরাতে ও ঘুমিয়ে পড়তেই রত্না আবার হাঁটতে শুরু করে। এবারে রান্নাঘর নয়, সে যায় ঠাকুরঘরে।
ঠাকুরঘরের দরজাটা হালকা খোলা ছিল। ভিতরে একটা দীপ জ্বলছিল—কিন্তু বাতাসে দুলে দুলে তার শিখা কাঁপছিল। রত্না ধীরে ধীরে ভিতরে ঢোকে। হঠাৎ সে দেখে, ঠাকুরঘরের পাশেই কাঠের তক্তার ওপর বসে আছে শাশুড়ি মা—জবা দেবী। কিন্তু ওর চোখ বন্ধ, কাঁধে ঝুলছে একটা লাল শাড়ি, আর হাতে ধরা একটা পুরনো আয়না। আয়নাটার কাঁচে জমেছে ধুলো, কিন্তু সেই ধুলোর মাঝেও এক বিকৃত হাসি দেখা যাচ্ছে। “তুই ফিরেছিস,” জবা দেবী হঠাৎ চোখ মেলে বলে উঠলেন। রত্না থমকে যায়। “আমি? ফিরেছি?” —রাতের কুয়াশা যেন গলার স্বরেও ঢুকে পড়ে। শাশুড়ি আবার বলে ওঠেন, “এই বাড়ির যে বৌ প্রথম গলায় আলতা দিয়েছিল, সে-ই তোর ছায়া হয়ে ফিরেছে। ওর রক্ত এখনও শুকোয়নি। সে খুঁজছে…” রত্না আর কিছু শুনতে পায় না। মাথা ঘুরে ওঠে। হঠাৎ সে দেখে, আয়নার কাঁচে তার নিজের প্রতিবিম্ব নেই—আছে শুধু এক অচেনা, মুখহীন নারী যার পায়ে লাল আলতা।
সকালবেলা বাড়িতে হৈচৈ পড়ে যায়। পুরনো ভৃত্য কমল ঘোষ তুলে আনে বিশাল এক ধুলোমাখা বালিশের নিচে থেকে একটা চিঠি। সেই চিঠি লেখা হয়েছে আজ থেকে ৩৫ বছর আগে। “আমার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। আমি ফিরে আসব, কারণ আমার স্বপ্ন পূর্ণ হয়নি,”—এই কথাটাই বড় করে লেখা। চিঠিটা লেখা হয়েছিল তখনকার বড় বৌমা—মধুমিতা রায়ের হাতে। সে-ই ছিল প্রথম নতুন বৌ এই বাড়ির ইতিহাসে, যার পায়ে আলতা দিয়েই গৃহপ্রবেশ হয়েছিল। কিন্তু তারপর মাত্র তিন মাসের মধ্যেই সে খুন হয়ে যায়—কারণ লেখা হয়নি। পুলিশের কেস ক্লোজড ছিল, কারণ কেউ কিছু বলেনি। সেই কেসের পাতায় ছিল শুধু একটা ছবি—এক জোড়া আলতাভেজা পায়ের ছাপ। রত্না এবার বুঝতে পারে, যে রহস্য তাকে ঘিরে ধরেছে, তার মূল কোথায়। সেই মুখোশ যাকে সে এতদিন শাশুড়ি মনে করে এসেছে, তিনি আসলে জানেন সবকিছু, কিন্তু বলেননি। কেন বলেননি? ভয়, না গোপন অন্যায়?
রাত নামতেই রত্না এবার ছাদের ঘরে উঠে যায়, যেখানে আগে মধুমিতা থাকত। ঘরটা এখন পরিত্যক্ত, ধুলোয় ভরা। কিন্তু দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে যায় শব্দ ছাড়াই। ভিতরে ঢুকে রত্না দেখে এক পুরনো ড্রেসিং টেবিল, যার আয়নার এক কোণ এখনও চকচক করছে। সে ধীরে ধীরে কাছে যায়, এবং হঠাৎই চোখে পড়ে মাটিতে এক জোড়া আলতার দাগ, যেগুলো যেন তাজা। দরজার পাশে রাখা পুরনো ট্রাঙ্ক খোলার চেষ্টা করতেই একটা কাগজ উড়ে আসে—মধুমিতার ডায়েরির পাতা। লেখা আছে, “যদি আমি মরে যাই, তবে জানবে—আমার মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, বিচারহীন এক অভিশাপ। আমি ফিরে আসব, ঠিক মাঝরাতে, আমার শাড়ি পরে, আলতা পায়ে।” রত্নার ঠোঁট শুকিয়ে আসে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা চেনা কণ্ঠ বলে ওঠে, “তুই যদি সত্যিই জানতে চাস, তাহলে আয়… দেখিয়ে দিচ্ছি—কে বেঁচে, কে মরা, কে শুধু ছায়া।” রত্না ঘুরে দাঁড়ায়—দেখে জবা দেবী তার সামনে দাঁড়িয়ে।
৯
বাড়িটা যেন ধীরে ধীরে তার আসল রূপ উন্মোচন করতে শুরু করেছে। প্রতিদিনই একটুখানি করে কিছু না কিছু বেরিয়ে আসছে, যেন বাড়ির প্রতিটা ইট, প্রতিটা দেওয়াল কথা বলতে চাইছে—চিৎকার করে বলতে চাইছে এমন কিছু যা বহুদিন চেপে রাখা হয়েছিল। সপ্তমীর রাত পার হয়ে গেছে। অথচ স্নেহা এক মুহূর্তের জন্যও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। কারণ রাত বারোটার সেই আলতা-পায়ের ছাপ যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে—আরও লাল, আরও জীবন্ত।
সে রাতেও একই সময়, ঘুম ভেঙে যায় স্নেহার। কিন্তু আজ কিছুটা ভিন্ন ছিল সব। মেঝেতে আলতা ছাপ এবার থেমে ছিল না কেবল দরজার সামনে। সেটা এবার সোজা তার খাট পর্যন্ত চলে এসেছে। এবং ঠিক তার পাশে, বিছানার এক কোণে, রাখা ছিল একজোড়া পুরোনো চুড়ি—যা সে কখনো দেখেনি, আর যার গায়ে ছিল শুকনো রক্তের মতো লাল রঙের দাগ। চিৎকার করতে গিয়েও গলা থেকে আওয়াজ বের হয়নি স্নেহার। সে একভাবে তাকিয়ে রইল সেই চুড়ির দিকে, আর দেখতে পেল বিছানার চাদরের এক কোণে আঙুল দিয়ে আঁকা কিছু শব্দ—“আমি এসেছিলাম, তুমি শুনতে পাওনি।”
পরের দিন সকালে, সত্যকেও সেটা দেখায় স্নেহা। কিন্তু চুড়ি আর লেখা তখন আর নেই। সত্যকেতো সবটাই কল্পনা বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু রুনু পিসিমা তখন ধীরে ধীরে মুখ খোলে। বলেন, এই বাড়িতে একবার এরকম ঘটনা ঘটেছিল বহু বছর আগে। তখন বাড়ির ছোট ছেলের বৌ হঠাৎ এক রাতে হারিয়ে গিয়েছিল, আর তার পরদিন থেকে মেঝেতে দেখা যেত এমনই আলতা পায়ের ছাপ। সে বৌমার নাম ছিল কুন্তলা। তিনি নাকি খুব চুপচাপ, কিন্তু ভীষণ রাগী স্বভাবের ছিলেন। একদিন হঠাৎ তার হারিয়ে যাওয়ার পরেও কেউ পুলিশে খবর দেয়নি, কারণ সে সময় পরিবারের সুনামের ভয় ছিল।
স্নেহার মনে হতে থাকে, এই বাড়ির দেয়ালে যেই অদৃশ্য কাহিনি লুকিয়ে রয়েছে, সেটা কেবল অন্ধকারে নয়—দুপুরের আলোতেও তার ছায়া ফেলছে। সে এবার নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়, কুন্তলা বৌমার অতীত জানতেই হবে তাকে। পুরোনো ট্রাঙ্ক ঘেঁটে, পচা কাগজপত্র আর হলদে চিঠির মাঝে একখানা ডায়েরি পায় সে—যার পাতায় পাতায় লেখা এক অভিশপ্ত হৃদয়ের কথা। একটি মেয়ে, যে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল এই বাড়িতে, কিন্তু ভালোবাসা না পেয়ে ঘৃণার, সন্দেহের আর অবহেলার শিকার হয়েছিল। শেষ পাতায় লেখা—”আমার শরীর হয়তো থাকবে না, কিন্তু আমি ফিরব… পায়ের ছাপে… ভালোবাসার প্রতিশোধ নিতে।”
চোখ ছলছল করে ওঠে স্নেহার। সে জানে না, সে এখন কুন্তলার শত্রু না সাথী। কিন্তু তার শরীরে যেন এক অদৃশ্য ঠান্ডা ছায়া ছুঁয়ে যায়। স্নেহা বুঝে যায়, সে এখন শুধু একজন স্ত্রী বা পুত্রবধূ নয়—সে একজন সাক্ষী, এক অন্যায়ের। অতীতের রক্ত-লিখা ইতিহাস তারই পায়ের নিচে জেগে উঠছে, আর সেই ইতিহাসের পাতা যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে মধ্যরাতে, আলতা পায়ের ছাপে…
১০
কুয়াশা ঢাকা শীতের সকালে গ্রামের লোকজন যখন রমেনদের বাড়ির সামনের পুকুরঘাটে ভিড় করে, তখনও কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না যে এতদিন ধরে যে রহস্যে তারা দগ্ধ হচ্ছিল, তার শেষ এমন এক মৃত্যুতে গড়াবে। পূর্ণিমার রাতে আলতা পায়ের ছাপ শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল বারান্দা পেরিয়ে উঠোনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত, ঠিক যেখানে গতরাতে জবা নিজের হাতেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে গেছে, তদন্ত শেষ হয়েছে, কিন্তু উত্তর পাওয়া যায়নি একটাও—সে কেন, কিভাবে, কার দ্বারা?
জবা’র মৃত্যুর একদিন পরেই রেণু, গৌতম আর বুড়ি ঠাকুমা একসঙ্গে বসে একটি বাক্স খুলল, যে বাক্সটি তাদের বাড়ির পূর্বতন ভাঙা চিলেকোঠার কোণায় আট দশক ধরে পড়েছিল, ধুলোয় ঢাকা। জবা’র শেষ কথা ছিল—“বাক্সটা খোলো, ওখানেই ওর ইতিহাস লেখা”—তাই রেণু সাহস করে সেটা খুলল। ভেতরে পুরোনো আলতা, একটি বিবর্ণ রক্তরঙা শাড়ি, আর হাতে লেখা একটি পত্র পাওয়া গেল। পত্রে লেখা ছিল এক মেয়ের আত্মকথা—নামের উল্লেখ নেই, কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হল না এটি সেই অচেনা ছায়াসঙ্গিনীর ইতিহাস, যে হয়তো পূর্বপুরুষদের কোন এক পরিত্যক্ত কন্যা, যাকে বিয়ের ঠিক আগের রাতে জলে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল তার নিজের মা-বাবার হাতে, সমাজের ভয়ে।
পত্রটি পড়া শেষ হলে ঠাকুমা নিঃশব্দে বললেন—”ও আমাদের বংশেরই মেয়ে। ওর অপমান, ওর ক্ষোভ আজও ঘরের ঘরে ঘুরে বেড়ায়। আর জবা… জবা ছিল হয়তো ওর পুনর্জন্ম। এই বাড়ির মধ্যে যার শরীর ওর আত্মাকে স্থান দিয়েছিল। কিন্তু জবা চেষ্টা করেছিল প্রতিরোধের। ও আলতা পায়ের ছাপ মুছে ফেলতে চেয়েছিল, পুজো দিয়েছিল, রাত জেগে জপ করেছিল—তবু পারল না। হয়তো সেই আত্মা আর ওকে ছাড়েনি, কারণ ও সত্যি জানত।” রেণু তখন চোখের জল মুছে বলল—”তাহলে কি এখন সব শেষ? ছাপ আর পড়বে না?”
শেষ প্রশ্নের উত্তর কেউই তখন জানত না। কিন্তু সে রাতে, প্রথমবারের মতো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা রেণু দেখেছিল—ভোরের কুয়াশায় উঠোন জুড়ে এক জোড়া আলতার পায়ের ছাপ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, শেষ হচ্ছে… ঠিক যেমন এক দীর্ঘ অভিশাপ শেষ হয়ে যায় দীর্ঘশ্বাসের মতো। হয়তো সেই আত্মা এবার মুক্তি পেয়েছে, হয়তো জবা নিজের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই ভুল ইতিহাসের ক্ষত মুছে দিতে পেরেছে। কিংবা… হয়তো অন্য কোনো নতুন বৌমা আসা পর্যন্ত শুধু নিঃশব্দ অপেক্ষা…
[সমাপ্ত]