প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী
অধ্যায় ১: জন্ম ও নিরবতা
ঘরের ভেতর দুধের রঙের আলো ছড়িয়ে ছিল সেই সকালে, যেদিন অর্ণবের জন্ম হয়েছিল—চুপচাপ, কান্নাহীন এক শিশু। পুরুষ সন্তান জন্মেছে শুনে বাড়ির দাদু-ঠাকুমা খুশিতে হালকা গলায় গুনগুন করতে শুরু করেছিল, মা কাঁপা গলায় বলেছিল, “কী যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে,” কিন্তু তাতে কেউ পাত্তা দেয়নি। নাম রাখা হয় অর্ণব—সমুদ্রের মতো বিশাল, গভীর, অথচ কখনো কখনো বিধ্বংসী। তার ছোটোবেলা কাটে এক নির্জনতার সাথে—পাড়ার মাঠে খেলতে গেলেও সে বেছে নিত দোলনা কিংবা লুকোচুরি, মারপিট, বল খেলায় তার মন বসত না। চুপি চুপি মায়ের আলমারি খুলে তার শাড়িতে মুখ লুকিয়ে কল্পনায় হারিয়ে যেত—যেন সে একদিন সত্যিই হয়ে উঠবে ঠিক সেই রকম, নরম, স্নিগ্ধ, এক নারীর মতো। কিন্তু অর্ণব জানত, তার শরীর বলে দেয় সে ছেলে, চারপাশ বলে দেয় সে ‘ভুল পথে’ হাঁটছে। একদিন যখন সে একা ঘরে আয়নার সামনে লিপস্টিক লাগিয়েছিল, তখন হঠাৎ মা দেখে ফেলে। মা কিছু বলেনি, শুধু দরজাটা বন্ধ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। সেই দিন অর্ণব বুঝেছিল, তার শরীরটা যতটা নয়, সমাজ তার মুখ, অভিব্যক্তি, হাঁটাচলা—সবকিছুতে খুঁত খুঁজবে, তাকে বদলাতে চাইবে।
বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক, নিয়মে বাঁধা মানুষ, যার চোখে ‘শৃঙ্খলা’ মানেই ছেলে মানে কড়া গলা, শক্ত চেহারা, নিষ্ঠুরতা আর মেয়েলিপনা মানেই লজ্জা, বিকৃতি। অর্ণবের অঙ্গভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি, বা কথার মৃদুতা বাবার সহ্য হত না। বাবার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস তার ছিল না, বরং তার মাথা নিচু থাকত সবসময়। বাড়িতে যখন পুজো হত, তখন মা তাকে বলত “দূর থেকে দেখ, মেয়েদের পাশে বসিস না”, কাকার বউ ঠাট্টা করে বলত, “এই ছেলেটার আবার মেয়ে সাজার শখ”—সব হাসির মধ্যে চাপা থাকত অর্ণবের তীব্র অপমান। স্কুলেও একই দৃশ্য, একদিন এক সহপাঠী তার ব্যাগে একটি গোলাপি ক্লিপ দেখে চিৎকার করে বলে দেয়, “ছেলে হয়ে মেয়ে সাজছিস!” এরপর ক্লাসরুমে সবার চোখে চোখে বিদ্রূপ, দিদিমণির ঠান্ডা অবজ্ঞা—সবকিছু মিলে তার অস্তিত্ব প্রতিদিন একটু একটু করে কুঁচকে যেতে থাকে। কেউ বুঝতে পারত না, অর্ণবের ভেতরে যে ‘আমি’ বাস করে, সে দিনের শেষে বিছানায় শুয়ে শুধু চায়—আয়নার সামনে দাঁড়াতে, চোখে কাজল দিতে, নিজের মতো করে থাকতে। কিন্তু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখত, মুখের উপরে অচেনা এক মুখ, গলার স্বরটা নিজের মতো লাগে না, গায়ের ছাঁটটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া—সবকিছু যেন বলছে, ‘তুই আসলে তুই নোস।’ সেই ভয়, সেই গোপন লুকিয়ে রাখা চিৎকার ধীরে ধীরে জমে উঠত তার ভিতরে, এক অজানা ভূগর্ভে, যার কোনো শব্দ ছিল না—শুধু ছিল নিরবতা।
অর্ণবের জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা ছিল—নিজের অস্তিত্ব আড়াল করে টিকে থাকতে হয়। তার চেয়ে ভালো কেউ বোঝেনি, কীভাবে হাসি মুখে কথা বলতে হয়, অথচ চোখে লুকিয়ে রাখতে হয় অভিমান; কীভাবে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলতে হয় ছেলেদের মতো ভঙ্গিতে, অথচ ভিতরে ভিতরে নিজের মেয়েলি স্বরকে চেপে রাখতে হয়। ছেলেবেলার প্রতিটি পুজো, প্রতিটি জন্মদিন, প্রতিটি স্কুল ফাংশন ছিল একেকটা যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে প্রতিবার হেরে যাওয়া সত্ত্বেও তাকে যুদ্ধে নামতেই হত। এমনও দিন গেছে, যখন স্কুলের শৌচালয়ে ঢুকে সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দরজা বন্ধ করে একা কাঁদত, আর প্রার্থনা করত—“দেও, একটা সুযোগ, যেন আমি আমি হতে পারি।” কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে স্কুল থেকে ফেরার সময় পাড়ার ছেলেদের বাঁকা কথায়, চোখে চোখে বিদ্বেষে সে আর বিচলিত হত না, কারণ সেই ব্যথাগুলো এখন তার শরীরের অংশ হয়ে গেছে। এমনকি মা যখন তাকে ঠাকুরঘরের কাছে যেতে দেয় না, বা বাবা তার কথা শুনেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তখন সে রাগ করে না, কাঁদে না—সে কেবল আয়নার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বলে, “একদিন আমি দেখাবো, কেমন করে আমার মতো হওয়া যায়।”
দিনের পর দিন অর্ণবের ভেতরে জন্ম নিতে থাকে এক নতুন সত্ত্বা—একটা নাম, একটা অস্তিত্ব, যাকে সে মনে মনে বলে অনুরাধা। এই অনুরাধা-ই রাতের নির্জনতায় তার সঙ্গী, তার ছায়া, তার সাহস। আয়নার সামনে সে অনুরাধা হয়ে উঠে দাঁড়ায়, আর ভাবে—এই শহর, এই সমাজ যদি একদিন তার চোখে চোখ রেখে বলতে পারে, “তুমি ঠিক,” তাহলে সে হয়তো মুক্তি পাবে। সে জানত না কীভাবে সেই মুক্তির পথ তৈরি হবে, জানত না কে তাকে গ্রহণ করবে, শুধু জানত—নিজেকে না খুঁজে পাওয়া মানেই এই নিঃশব্দ মৃত্যু, যেটা সে প্রতিদিন মরে মরে বাঁচছে। “আমি”-কে খুঁজে পাওয়ার যাত্রা সেই দিন থেকেই শুরু হয়, যখন সে আর নিজের মুখ, নিজের গলা, নিজের পরিচয় আড়াল করতে চায় না। অথচ সেই সময় সে বুঝতেও পারত না—এই “আমি”-র অস্তিত্ব তৈরিই হবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপ্লব, আর এই বিপ্লবের পথে দাঁড়িয়ে থাকবে ‘ওরা’—অগণন চোখ, যাদের প্রশ্ন, ঘৃণা আর অবজ্ঞা তাকে বারবার থামিয়ে দিতে চাইবে।
অধ্যায় ২: নামহীন বেদনা
কখনো কখনো অর্ণব অনুভব করত তার নামটাই যেন বোঝা, এক নিরব অপমান, যে নামটি সে নিজেই বহন করতে চায় না অথচ সবাই তাকে সে নামেই ডাকে, আদেশ দেয়, শাসন করে, গালি দেয়। নামের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কণ্ঠস্বরটা তার নিজের নয়—‘অর্ণব’ শব্দটা উচ্চারিত হলেই যেন ঘরে একটা ভারী দেয়াল নেমে আসে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কেউ তাকে তার আসল নামে ডাকেনি, কারণ সে তো কাউকে বলেনি, কিন্তু তার ভেতরের সে-নামটা প্রতিদিন একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইত। সে নাম ছিল অনুরাধা—নরম অথচ দৃঢ়, সুন্দর অথচ সাহসী। নিজের আসল নামটা চুপিচুপি লিখে রাখত খাতার পেছনে, একদিন যখন সত্যি নিজেকে খুঁজে পাবে, তখন যেন তার পরিচয় হারিয়ে না যায়। কিন্তু এখন? এখন সে কেবলই একটা অদৃশ্য মুখ, যার স্বপ্ন আছে কিন্তু স্বর নেই, অনুভব আছে কিন্তু পরিচয় নেই। স্কুলের ইউনিফর্মে যখন সে নিজেকে আয়নায় দেখে, তখন মনে হয় এক অপরাধীকে দেখছে, যে সমাজের দেওয়া নিয়ম ভাঙার সাহস দেখিয়েছে বলে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হচ্ছে। এমন এক সময় আসে, যখন সে নিজের চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারে না—কারণ চোখের দিকে তাকালেই দেখতে পায় সেই অগণিত অপমান, যে অপমানে সে আর বারবার ভেঙে পড়তে চায় না।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরে যেটা স্পষ্ট হতে থাকে, সেটা হলো সমাজ তাকে কখনোই গ্রহণ করবে না। তার মুখের ভাষা, হাঁটার ধরণ, বন্ধুবান্ধব বেছে নেওয়া—সবকিছু নিয়ে চলত ঠাট্টা, কটাক্ষ, এমনকি কখনো কখনো সহিংসতা। স্কুলে একদিন বাথরুম থেকে বেরোতেই তিনজন ছেলে তাকে ঠেলে দেয়, বলে “তুই ছেলে না মেয়ে?”—সে কিছু বলতে পারেনি, শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছে, যেন নিজের অস্তিত্বই একটা ভুল। শিক্ষকদের দিক থেকেও সে কোনো সহানুভূতি পায়নি—বরং একবার যখন সে আঁকার খাতায় একটি ঘোমটা পরা নারীর ছবি এঁকেছিল, তখন শিক্ষক বলেছিল, “এইসব বাজে জিনিস মাথা থেকে বার কর।” ক্লাসে কেউ তার পাশে বসতে চাইত না, টিফিন ভাগ করে খেতে চাইত না—সে যেন ছিল এক অশুচি, অদ্ভুত কিছু, যাকে ছুঁলেই নাকি নষ্ট হয়ে যাবে। প্রতিদিনের এই অনভিপ্রেত বিচ্ছিন্নতা তাকে একা করে তুলেছিল, এমনভাবে একা, যা কাউকে বলা যায় না। এমন এক সন্ধ্যা ছিল, যখন সে ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে ভাবছিল—জীবনটা যদি এখানেই থেমে যেত, তাহলে কষ্টগুলোও থেমে যেত কি? কিন্তু পরের মুহূর্তেই ভেতর থেকে একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠেছিল, “তুই এখনো নিজেকে চিনিস না, কষ্ট তো তখনই শেষ হবে, যখন তোকে তুই চিনবি।”
তবে সবচেয়ে বড় বেদনা এসেছিল পরিবার থেকে—বিশেষ করে মায়ের দিক থেকে। মা ছিল তার একমাত্র আশ্রয়, ছোটোবেলায় যখন ঠাকুমা বা বাবা রেগে যেত, মা তাকে কোলে বসিয়ে রাখত, গায়ে তেল মেখে দিত, গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াত। কিন্তু যখন মা বুঝে ফেলে যে তার সন্তান ‘স্বাভাবিক’ ছেলে নয়, তখন সে এক অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি করে নেয়। আর বাবা? তিনি কখনো বুঝতেই চাননি, বরং চিৎকার করে বলতেন—“মেয়ে সাজার সাহস কোথা থেকে আসে তোর?” একবার মা তার জন্য একটি ছেলের শার্ট কিনে এনে বলেছিলেন, “ছেলেরা এসব পরে, এটা পড়লে তুই ঠিক হয়ে যাবি।” অর্ণব সে শার্টটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে জল দেখে নিয়েছিল—সে জানত না ‘ঠিক হওয়া’ মানে কী, কিন্তু জানত সে এখন যা আছে, সেটা তাদের কাছে ‘ভুল’। এই ভুল ধারণাটা এতটাই গভীরে গেঁথে গিয়েছিল, যে সে নিজেই ভাবত—হয়তো সত্যিই আমি একটা সমস্যা, এক ভয়ঙ্কর বর্জনীয় কিছু। তাই ধীরে ধীরে সে নিজের মত প্রকাশ বন্ধ করে দেয়, প্রশ্ন করে না, আবদার করে না, এমনকি নিজের জন্মদিনেও কিছু চায় না—যেন একটা চেনা নিয়ম মেনে সে বাড়ির ছায়া হয়ে উঠছে, যাকে কোনো ঘরের সদস্য হিসেবেও গণনা করা হয় না।
এই সময়টা ছিল এমন এক ধূসর পর্ব, যখন সে নিজের শরীর, নিজের নাম, নিজের অস্তিত্ব—সবকিছু নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগছিল। শরীর বদলাচ্ছিল, কিন্তু সেই পরিবর্তন তাকে নিজের বলে মনে হত না। তার গলা ভারী হচ্ছিল, মুখে গোঁফের রেখা দেখা যাচ্ছিল, অথচ সে আয়নায় দেখত এক কোমল মুখ, চোখের গভীরে যন্ত্রণার সঙ্গে মিশে থাকা আশার ছায়া। একদিন স্কুলে মঞ্চনাটকে মেয়ের চরিত্র করার প্রস্তাব দিলে সে খুশি হয়ে হ্যাঁ বলেছিল, কিন্তু যখন প্রধান শিক্ষক শুনলেন, তখন বলেছিলেন—“এই ছেলেটা আবার মেয়ের চরিত্রে? ও তো এমনিতেই সমস্যা।” সেই এক কথাতেই তার নাম মুছে গেল তালিকা থেকে। সে বুঝে গিয়েছিল, সমাজ তার কোনো জায়গায় তাকে দেখতে চায় না—না ছেলেদের দলে, না মেয়েদের দলে—সে যেন এক মধ্যবর্তী শূন্যস্থান, যাকে কোথাও ফেলা যায় না, রাখা যায় না, শুধু উপেক্ষা করা যায়। এবং এই উপেক্ষাই জন্ম দেয় এমন এক নিঃশব্দ চিৎকার, যার শব্দ কেউ শুনতে পায় না, কেবল বুকের ভেতর অনুরণিত হয় বারবার।
অধ্যায় ৩: পালানো নয়, খোঁজ
ভোর পাঁচটার আলো তখনও জানালার গায়ে গা ছুঁইয়ে বসে ছিল, বাইরের পাখির ডাক স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। অর্ণব নিঃশব্দে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছিল—তাতে ছিল মাত্র তিনটি জামা, একজোড়া স্যান্ডেল, কিছু টাকা, একখানা ছোট ডায়েরি আর তার গোপন নাম–“অনুরাধা”–লিখে রাখা একটি কাগজের টুকরো। তার পায়ের শব্দ যেন কেঁপে উঠছিল ফ্লোরে, যদিও সে চেয়েছিল নিঃশব্দে বেরিয়ে যেতে, যেন কেউ টের না পায়। সে একবার রান্নাঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিল—মা ঘুমোচ্ছিল, নিঃশ্বাসে ক্লান্তির ছায়া ছিল। বাবার ঘর থেকে আসছিল অশান্ত ঘুমের গুঞ্জন। ঠিক তখন, এক অজানা অনুভূতি তার বুক চেপে ধরেছিল—একটা রক্তের টান, যা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ভেতরের দিকে, বলে দিচ্ছিল, “থাক, ফিরে যা।” কিন্তু তার ভেতরের সেই বহুদিনের জমে থাকা কান্না, নিজের হয়ে ওঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষা সবকিছু ঠেলে বলছিল, “তুই পালাচ্ছিস না, তুই তোকে খুঁজতে যাচ্ছিস।” সেই বিশ্বাসেই, অর্ণব বাড়ির দরজা ধীরে ধীরে খুলে পা বাড়ায় বাইরের দিকে—সেই প্রথমবার, যখন সে নিজের পছন্দে, নিজের পরিচয়ের জন্য, নিজের নামে রওনা দেয় এক অজানা শহরের দিকে।
ট্রেনের কামরায় বসে অর্ণব চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। জানালার বাইরে গ্রামের কুয়াশা ঢাকা মাঠ, শুঁটকি রোদ, ঘুমন্ত কাক আর ছুটন্ত গরু—সব যেন একটাই কথা বলছিল, “তুই কোথায় যাচ্ছিস?” তার পাশে বসে ছিল একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা, যিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাচ্ছো একা একা?” সে মিথ্যে বলে, “কাজের খোঁজে কলকাতা।” ভিতরে ভিতরে সে ভয় পাচ্ছিল, যদি কেউ তার ব্যাগ চেক করে, যদি কেউ তার কণ্ঠ শুনে কিছু টের পায়, যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কেন সে ছেলে হয়েও এত চুপচাপ, নরম। ভয় ছিল, তবে সঙ্গে ছিল এক অদ্ভুত আলো—যা তার বুকের ভেতরে উঁকি দিচ্ছিল, বলছিল, “তুই এখন আর ওই বাড়ির জড় পদার্থ না, তুই তোর নিজের রাস্তা ধরেছিস।” সারা পথ সে শুধু নিজের নামটা ভাবছিল—“অনুরাধা… অনুরাধা…” প্রতিবার উচ্চারণে তার মনে হচ্ছিল, কেউ তাকে জড়িয়ে ধরছে, কেউ তাকে বলছে, “হ্যাঁ, তুই তুই–এই নামেই।” প্ল্যাটফর্মে পা রাখার মুহূর্তে সে যেন প্রথমবার নিজের পায়ে দাঁড়াল—চেনা শহর নয়, চেনা মানুষ নয়, কিন্তু এই প্রথমবার কেউ তাকে বাধা দিচ্ছে না, কেউ বলছে না ‘এটা করিস না’, ‘ওভাবে হাঁটিস না’।
শহরের বাস্তবতা অবশ্য খুব শিগগিরিই তাকে ঠকায়। রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে করতে দুপুরের রোদ মাথায় চড়েছিল, এক চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা খাওয়ার পর, দোকানদার তার কণ্ঠ শুনে হেসে বলে, “তোর তো মেয়ে-ছেলের কিছুই বোঝা যায় না রে।” অর্ণব হেসে এড়িয়ে গেলেও ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ছিল। রাতে পার্কে শুয়ে থাকার সময় এক অটোচালক এসে প্রশ্ন করেছিল, “তুই হিজড়ে না?” সেই প্রথমবার সে ‘হিজড়ে’ শব্দটা নিজের কানে এত জোরে শুনেছিল, যেন সেটাই তার পরিচয়। তবু সেই রাতেই তার জীবনের পথ ঘুরে যায়—এক মধ্যবয়সী মহিলা, শোভা দি, এসে তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুই একা? কিছু খেয়েছিস?” তিনি ছিলেন এক এনজিও কর্মী, যিনি নিয়মিত পার্কে এসে গৃহহীন বা নিপীড়িতদের খোঁজ নিতেন। অর্ণব মাথা নিচু করে বলেছিল, “আমি কোথাও যেতে চাই, যেখানে আমাকে ভয় পেতে হবে না।” শোভা দি তাকে নিয়ে যান এক আশ্রয়কেন্দ্রে—সেখানে প্রথমবার সে নিজের মতো করে কথা বলে, কাঁদে, হাসে, আর বলে, “আমার নাম অনুরাধা।” তখন সবাই হাত ধরে তাকে বলে, “স্বাগতম অনুরাধা।” সেই শব্দটাই যেন তার জীবনের প্রথম স্বীকৃতি, যেখানে কেউ তাকে তার নিজের নামে ডাকল, নিজের পরিচয়ে চিনল।
তারপর থেকে ধীরে ধীরে সে হাঁটতে শেখে নিজের পায়ে—নতুন ঘর, নতুন নিয়ম, নতুন মানুষ, আর নিজের পরিচয়ের নতুন এক জগত। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে সে ট্রান্সজেন্ডার সাপোর্ট সেল্টারে ভর্তি হয়, সেখানেই এক মনোবিদ প্রথম তাকে বোঝায় তার শরীর, তার মন, তার অনুভব—সব স্বাভাবিক, সব প্রাকৃতিক। সে জানতে পারে ‘জেন্ডার ডিসফোরিয়া’ কী, ‘ট্রান্সিশন’ মানে কী, ‘সার্টিফিকেশন’-এর প্রক্রিয়া কী। ধীরে ধীরে সে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবিকে ভয় না পেয়ে, ভালোবাসতে শেখে। তার নামের সঙ্গে জুড়ে যায় ভালোবাসা, সম্মান, আর অশ্রুর ফাঁক দিয়ে জন্ম নেওয়া সাহস। সে বুঝে যায়—এটা পালানো ছিল না, এটা ছিল নিজেকে খুঁজে পাওয়ার প্রথম ধাপ। আর সেই খোঁজের পথে সে একা নয়, তার মতো অনেকেই আছে, যারা একেকটা অন্ধকার ভেঙে আজ দাঁড়িয়ে আছে নিজের নাম, নিজের স্বর, নিজের রং নিয়ে। অনুরাধা জানে সামনে পথ দীর্ঘ, সমাজ এখনো তাকে পুরোপুরি গ্রহণ করবে না, কিন্তু অন্তত আজ সে নিজের দিকে তাকিয়ে বলতে পারে—“আমি আছি, আমি অনুরাধা, আমি হারাইনি।”
অধ্যায় ৪: আমি কে?
একটা আয়না, একটা শান্ত ঘর, একটা নরম আলো—এই ছিল সেই মুহূর্তের সাক্ষী, যখন অনুরাধা প্রথম নিজের চোখে নিজের মুখকে ভালোবাসতে শেখে। এটা সেই সময়, যখন সে আর ভয়ের ভেতর নিজের চোখ লুকিয়ে রাখে না, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ঠোঁটের রেখা, চোখের গভীরতা আর চিবুকের আকার পর্যবেক্ষণ করে, আর ভাবে, “আমি কি এই?” এবং তারপর একসময় সাড়া আসে ভেতর থেকে—“হ্যাঁ, এই তুই—এটাই তোর মুখ।” আশ্রয়কেন্দ্রের সহানুভূতিশীল পরিবেশ, সাইকোলজিকাল কাউন্সেলিং, এবং এক মনোবিদ, তনুশ্রী দিদির স্নেহধর্মী আলোচনার মাধ্যমে অনুরাধা শেখে—সে অস্বাভাবিক নয়, অসুস্থ নয়, বিভ্রান্ত নয়। সে আসলে নিজের শরীর আর আত্মার মধ্যে এক অসামঞ্জস্যের শিকার, যাকে বলে জেন্ডার ডিসফোরিয়া। তনুশ্রী দিদি তার হাতে একটা ছবি দিয়েছিলেন—একটা বীজ, যা ছোট্ট গাছ হয়ে উঠছে, তারপর একদিন ফুলে ফলে ভরে উঠেছে। বলেছিলেন, “তুই এখন বীজ—এই তোকে সময় দিতে হবে, ভালোবাসা দিতে হবে। তখনই তুই তোকে পাবি।” অনুরাধার চোখ ভিজে গিয়েছিল সেই কথায়, কারণ এই প্রথম কেউ তাকে মানুষের মতো, সম্ভাবনার মতো দেখেছিল—একজন বিচ্যুত নয়, বরং একজন গড়ে ওঠার অপেক্ষায় থাকা মানুষ হিসেবে।
ট্রান্সিশনের প্রথম ধাপ ছিল নাম পরিবর্তনের আবেদন। অনুরাধা সেই পুরনো নামটা একদিন শেষবারের মতো লিখেছিল কাগজে, তারপর সেটিকে ছিঁড়ে ফেলেছিল খুব সন্তর্পণে, যেন ভাঙা কাঁচ হাত দিয়ে সরিয়ে রাখছে। অনুরাধা নামে সরকারী পরিচয় পাওয়ার লড়াই সহজ ছিল না—বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে অসংখ্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টি, একঘেয়ে প্রশ্ন, ফর্মে লেখা ‘পুরুষ’ বা ‘নারী’ ছাড়া তৃতীয় কোনো পরিচয় না থাকার সমস্যা—সব কিছু পার করে অবশেষে সে যখন নিজের আধার কার্ডে “অনুরাধা ঘোষ, মহিলা” লেখাটা দেখে, তখন সেই ছোটো কার্ডটা তার কাছে পুরো একটি জন্মের সমান হয়ে ওঠে। কিন্তু এই কাগজের যুদ্ধ ছিল বাইরের জগতে, ভেতরের যুদ্ধ ছিল শরীর নিয়ে। হরমোন থেরাপি শুরু হয়—প্রতিটি ইঞ্জেকশনের পর শরীরের ভেতর নতুন কিছু জেগে ওঠে, গলার স্বর বদলাতে শুরু করে, ত্বক নরম হয়, বুকের ওপর হালকা চাপ টের পায়, ঠিক যেমন কিশোরী মেয়েরা প্রথম বুঝতে শেখে নিজেদের দেহের পরিবর্তন। এই অনুভূতি ছিল অদ্ভুত, কখনো আনন্দের, কখনো ভয়ানক যন্ত্রণার, কখনো কাঁদিয়ে ফেলার মতো দারুণ আশার। আয়নায় প্রতিদিন নিজের বদলানো মুখ দেখে সে অবাক হতো, ভাবত, “এই আমি সেই আমি তো? এতদিন পরে নিজেকে পেয়ে গেলাম বুঝি?”
তবে এই পরিবর্তনের পথে শুধু আনন্দ ছিল না—ছিল অনেক ভয়, অসমর্থন, নিজেকেই বুঝে না ওঠার বিপদ। কখনো নিজেকে প্রশ্ন করত, “আমি কি সত্যিই এই পথে চলার উপযুক্ত? সমাজ কি কোনোদিন গ্রহণ করবে?” আশ্রয়কেন্দ্রের অন্যান্য ট্রান্স মেয়েরা কেউ কেউ অপারেশনের পরেও সমাজের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে পড়েছিল, কেউ ভালোবাসার নামে প্রতারিত হয়েছিল, কেউ বেঁচে ছিল যৌনকর্মী হিসেবে। অনুরাধা সেইসব গল্প শুনে ভেতরে কাঁপত, কিন্তু মনে মনে বলত, “আমি এদের মতো হই না হই, এদের গল্পগুলো আমাকে তৈরি করছে, আমার ভয়ের সঙ্গে আমাকেই লড়তে হবে।” একদিন হঠাৎ করে সে তার বাবার মুখটা কল্পনায় দেখে—একটা কড়া চোখ, যেটা সবসময় তাকে নীরব করে দিত। আর ভাবে, “তুমি তো কখনো জিজ্ঞেস করোনি আমি কেমন আছি, আমার শরীরটা আমার সঙ্গে আছে তো?” সেই দিন রাতে সে একটি কবিতা লিখেছিল, যার লাইন ছিল—“আমি আজ আয়নায় তাকিয়ে বুঝি, আমায় বোঝেনি কেউ; অথচ আমি চেয়েছিলাম শুধু একটা নাম, যার পাশে আমি লিখতে পারি, নারী।”
দিনের পর দিন শরীর ও মন মিলিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে শেখে অনুরাধা। সে ধীরে ধীরে সাজগোজ করতে শেখে, নিজের পছন্দে শাড়ি পড়ে বাইরে বেরোয়, মেট্রোতে দাঁড়িয়ে থাকে মাথা উঁচু করে। কেউ কেউ হেসে তাকায়, কেউ আবার হটিয়ে দেয়, তবু সে আর মাথা নিচু করে না। সে এখন জানে—নিজের চোখে নিজেকে ভালোবাসতে শেখাই আসল সাহস। একদিন সে তনুশ্রী দিদিকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি কীভাবে এত দৃঢ় হলে?” তিনি বলেছিলেন, “কারণ আমি জানি আমার যন্ত্রণাকে লুকিয়ে রাখলে ওটা আমার অস্তিত্ব খেয়ে নেবে।” সেইদিন অনুরাধা নিজেকে প্রতিজ্ঞা করেছিল—কোনো কিছুতেই নিজের ‘আমি’কে মুছে ফেলবে না। সে এখন প্রতিদিন নিজের নাম নিজে উচ্চারণ করে, অনুরাধা ঘোষ—এই নাম এখন শুধু কাগজে নয়, তার শরীর, তার চোখ, তার হাঁটা, তার কণ্ঠ—সবকিছুতে লেখা। সে জানে, পথ এখনও কঠিন, কিন্তু সে এখন অন্তত জানে কে সে, কেন সে, এবং কোথা থেকে উঠে এসেছে সে।
অধ্যায় ৫: ওরা কারা?
অনুরাধা যখন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে নিজের মতো করে একটা চাকরির সন্ধানে বেরোয়, তখন তার চোখে ছিল নির্ভরতার আলো, বুক ভরা বিশ্বাস, আর হাতভর্তি কাগজপত্র—আধার কার্ড, সার্টিফিকেট, এবং একটি ছোট রেজিউমে, যাতে স্পষ্ট লেখা—নাম: অনুরাধা ঘোষ | লিঙ্গ: মহিলা | আগ্রহ: হেল্থ কমিউনিকেশন, কাউন্সেলিং, গ্রুপ সাপোর্ট ওয়ার্ক। সে তখন ভাবত, “এবার তো আমি প্রস্তুত—আমার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস আছে, আমার চোখে প্রশ্ন নেই।” প্রথমদিকে কয়েকটি সংস্থা তাকে সাক্ষাৎকারে ডাকে—সেখানে সে নিজের পরিচয় স্পষ্ট করে বলে দেয়, বুক চিতিয়ে বলে—“আমি একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী। আমি চুরি করিনি, আমি ভুল করিনি, আমি শুধু নিজেকে খুঁজেছি।” অনেকেই তখন হাসে, মাথা নাড়ায়, সম্মান দেখায়—কিন্তু তারপর, তারা আর ফোন করে না। “ভালো কথা বলেছেন, আপাতত আমাদের রিকুইয়ারমেন্ট পূরণ হয়েছে”—এই কথাটাই বারবার শোনা যায় ফোনে। একদিন একচেটিয়া কর্পোরেট অফিসের এইচআর তাকে বলে, “আপনি তো সুন্দর বলছেন, কিন্তু ক্লায়েন্টরা কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে সেটা তো ভাবতেই হবে, নয়?” অনুরাধা ফোন রেখে বসে থাকে অনেকক্ষণ—সে বুঝতে পারে, চাকরি খালি অভিজ্ঞতা আর যোগ্যতার ওপর হয় না, তা হয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিচ্ছবিতে। “ওরা”—এই কথাটা তখন ধীরে ধীরে গঠন নেয় তার মনে—ওরা মানে কেবল ধর্মান্ধ লোক না, কেবল রাস্তায় চেঁচানো লোক না—ওরা আসলে এই সভ্য, শিক্ষিত, কর্পোরেট মানুষগুলোও, যারা নরম গলায় বলে “আপনার জন্য কাজ পাওয়া কঠিন হবে”, কিন্তু অন্তরে বলে, “তুমি ঠিক নও।”
অবশেষে সে একটি এনজিও-র স্বাস্থ্যসচেতনতা প্রকল্পে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ পায়—সেখানে সে প্রতিদিন প্রান্তিক এলাকার কিশোরী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের মাসিক স্বাস্থ্য, যৌনশিক্ষা, এবং লিঙ্গভিত্তিক হিংসা নিয়ে আলোচনা করে। এই কাজটি ছিল তার প্রাণের মতো—কারণ সে জানত, এই কিশোরীরা একদিন তার মতোই হয়তো সমাজের চোখে একেকটা ভুল পদক্ষেপ করে ফেলবে, এবং তার আগেই তাদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। অনুরাধা ধীরে ধীরে পরিচিত হয় ‘ফিল্ড’-এর বাস্তবতায়—যেখানে মহিলারা তাকে দেখে ফিসফিস করে বলে, “ওটা তো মেয়ে না ছেলে?” কখনো কেউ দরজা বন্ধ করে দেয়, কখনো কারও চোখে থাকে ভয়, সন্দেহ, বিদ্বেষ। অথচ প্রতিটি ছায়া দেখে অনুরাধার মনে পড়ে যায় তার নিজের ছেলেবেলা—যখন সে কোনো বন্ধুর বাড়িতে গেলে মায়ের চোখ ঠাণ্ডা হয়ে যেত, যেন এক অবাঞ্ছিত উপস্থিতি হাওয়ায় কাঁপিয়ে দিচ্ছে স্নেহের ভিত। তবে এই প্রজেক্টের কোঅর্ডিনেটর শ্বেতা দি একদিন তাকে বলেছিলেন, “তুই জানিস, তোর মতোন কাউকে সামনে রেখে যদি এই কথাগুলো মেয়েরা শুনতে পায়, তাহলে তারা শিখবে ভয় না পেতে। কারণ তুই তো ভয়কে জিতে ফেলেছিস।” এই কথাগুলো অনুরাধার ভেতরটায় আলো ঢেলে দিয়েছিল, কিন্তু পাশাপাশি সে অনুভব করছিল—ওরা শুধু বাইরের চোখে নেই, ওরা অফিসের টেবিলের নীচেও বাস করে, ক্যান্টিনের মুচমুচে আলোচনায় লুকিয়ে থাকে, ওরা বন্ধুদের ঘাড় বাঁকানো হাসির মধ্যে, ওরা সহকর্মীদের মেসেজে লেখা অর্ধেক শব্দেও লুকিয়ে থাকে।
ধীরে ধীরে অনুরাধা নিজের জায়গা করে নিতে শিখে যায়—সে জানে, ওরা তাকে ঘৃণা করে না, ওরা ভয় পায়; ওরা মনে করে, এই ‘মেয়েলিপনা’র মধ্যে একটা বিপদ আছে, একটা টান আছে, যা চিহ্নহীন, ধোঁয়াটে, অথচ চেনা সমাজব্যবস্থায় অনাহুত। একদিন অফিস ক্যান্টিনে বসে সে চা খাচ্ছিল—দুজন নতুন ইন্টার্ন এসে পাশে বসতেই উঠে গিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। সে চুপ করে থাকলেও পরে একজন সহকর্মী এসে হেসে বলেছিল, “তোর সাহস তো দেখছি, পুরা মেয়েদের মতো চলিস বলেই হয়তো ওরা ভয় পায়।” অনুরাধা হেসে বলেছিল, “ওদের ভয় পাওয়া উচিত—কারণ আমি যা হওয়ার কথা, তা হয়ে উঠেছি। ওরা তো এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছে।” এই কথা শুনে সবাই চুপ মেরে গিয়েছিল, কেউ কিছু বলেনি, কিন্তু সেই দিন অনুরাধা বুঝেছিল, ‘ওরা’ আসলে একটি ছায়া, যা ভয় পায় সেই আলোকে, যা নিজেকে ভালোবাসতে শেখে। সেই ভয়ই ওদের ভাবায়, অস্থির করে তোলে, আর তাই তারা দূরে সরিয়ে দেয়, অথবা ছুঁয়ে দেখতে চায়, অথবা তাচ্ছিল্য করে—কিন্তু কোনোদিন হৃদয় দিয়ে বোঝে না।
তবু সে থামে না—প্রতিদিন কাজ শেষে সে ডায়েরি লেখে, রাস্তায় হাঁটে নিজের পরিচয় নিয়ে, মেট্রোয় দাঁড়িয়ে থাকে চোখে চোখ রেখে, নিজের ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায় ঠিক যেমন সে আয়নার সামনে নিজেকে ভালোবেসে দেখেছিল। একদিন এক কিশোরী এসে তাকে বলেছিল, “আপু, আপনি তো মেয়ে, কিন্তু আপনার কণ্ঠটা একটু আলাদা।” অনুরাধা হেসে বলেছিল, “মেয়ে মানে কি সব একইরকম হবে? প্রত্যেকটা ফুলের তো গন্ধ আলাদা, রং আলাদা।” মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে বলেছিল, “আপু, আপনি অনেক সুন্দর।” সেইদিন অনুরাধা জানত, সমাজ হয়তো আজও পুরো বদলায়নি, কিন্তু তবু কেউ কেউ আছে যারা চোখ মেলে দেখে, বুঝে, শেখে। ‘ওরা’-র মধ্যে থেকেও কিছু চোখ উজ্জ্বল হয়, কিছু কণ্ঠস্বর বদলায়, কিছু মন শিখে নেয় গ্রহণ করতে। সেই বিশ্বাসই অনুরাধাকে এগিয়ে রাখে—সে জানে, ওরা হয়তো একদিন বদলাবে না, কিন্তু আমি যে বদলেছি, সেই “আমি” আজ আর একা নয়। সেই আমি এখন প্রশ্ন তোলে, উত্তর চায় না, বরং নিজেই উত্তর হয়ে দাঁড়ায় সমাজের সামনে।
অধ্যায় ৬: ভালোবাসা, না প্রশ্নচিহ্ন?
শহরের শীতে যখন হালকা কুয়াশা নামে, তখন সন্ধ্যাবেলার আলো নরম হয়, ট্রামলাইন ধরে হাঁটা মানুষদের মুখে ক্লান্তি আর গল্পের ছায়া মিশে থাকে। ঠিক এমনই এক সন্ধ্যায় অনুরাধার পরিচয় হয় সৌরভের সঙ্গে—একটি ছোট পুস্তক বিতানের সামনে বই দেখতে দেখতে, দুজনের হাতে ছুঁয়ে গিয়েছিল একই কবিতার বই, জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’। সৌরভ তাকিয়ে হেসে বলেছিল, “আপনি পড়েন কবিতা?” অনুরাধা একটু থেমে বলেছিল, “হ্যাঁ, কবিতায় আমি নিজেকে খুঁজে পাই।” এরপরের গল্প শুরু হয়েছিল খুব ধীরে—কিছু আড়াল, কিছু আগ্রহ, কিছু মৃদু হাসি আর কয়েক কাপ চায়ের ফাঁকে। সৌরভ ছিল আলাদা—কোনো জিজ্ঞাসু চোখ নয়, কোনো অবজ্ঞার সুর নয়, বরং সে শুনত, বোঝার চেষ্টা করত, অনুরাধার কথাগুলোর মাঝে ভয়ের জায়গাগুলোও পড়তে পারত। প্রথমদিকে অনুরাধা নিজের পরিচয় বলেনি, ভেবেছিল, “এবার যদি ভয় পায়? এবার যদি অন্য চোখে দেখে?” কিন্তু সৌরভ ছিল অদ্ভুতভাবে শান্ত, এবং সেই শান্তির ভেতরেই ধীরে ধীরে গলে গিয়েছিল অনুরাধার দীর্ঘদিনের গুটিয়ে রাখা বিশ্বাস। একদিন, এক সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়ার পেছনের ঘাসে বসে সে চোখে চোখ রেখে বলেছিল, “আমি তোমাকে ভালো লাগি, কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে প্রেম করবে এটা বলার আগে একটা কথা বলি—আমি ট্রান্সজেন্ডার। আমি জন্মসূত্রে পুরুষ, কিন্তু আমি নারী। তুমি চাইলে চলে যেতে পারো।”
সৌরভ অনেকক্ষণ চুপ ছিল, তার চোখ ছিল দূরে—সেই শহরের আলোতে, যেটা ঠিক অনুরাধার মতোই, জ্বলছে অথচ নিঃশব্দ। তারপর সে বলেছিল, “তুমি খুব সাহসী। আমি ভাবতে পারিনি তুমি এতটা স্পষ্ট হবে।” সেদিন সে চলে যায়নি। সেই চলে না যাওয়ার মধ্যে ছিল এক নতুন আবিষ্কার—ভালোবাসা শুধু শরীর দেখে হয় না, ভালোবাসা চোখের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস পড়ে নেয়। তারা একসঙ্গে আরও কয়েকবার দেখা করে, সিনেমা দেখে, বই পড়ে, রেস্টুরেন্টে বসে গল্প করে। অনুরাধা ভাবতে শুরু করে—“এটাই কি সেই ভালোবাসা, যার জন্য এতদিন ভেবেছিলাম আমি অযোগ্য?” সে একদিন আড়ালে দাঁড়িয়ে সৌরভের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি কি আমার ভবিষ্যৎ ভাবতে পারো?” সৌরভ বলে, “তুমি তো আছো আমার বর্তমানেই, ভবিষ্যৎও তোমার মতো করে আসবে।” এই উত্তর শোনার পর অনুরাধার মনে হয়েছিল, সত্যিই কেউ একজন আছে, যে তার হাতটা ধরে হাঁটতে চায়, লুকিয়ে নয়, প্রকাশ্যে। কিন্তু ভালোবাসার এই রঙিন স্বপ্নের গায়ে ফাটল ধরতে শুরু করে ঠিক সেই জায়গা থেকে, যেখান থেকে সমাজ তার চোখ রাঙিয়ে বলেছিল, “তুই আলাদা।” সৌরভের বন্ধুবান্ধব, পরিবার যখন জানতে পারে অনুরাধার পরিচয়, তখন চারদিক থেকে চাপ আসে—“তুই ঠিক করছিস তো?”, “ওর সঙ্গে চলা মানে তোর সম্মান শেষ”, “বাবা-মা মেনে নেবে না।”
তাদের প্রেমের ওপর ধুলো জমতে শুরু করে—সৌরভ দোটানায় পড়ে যায়, একদিকে ভালোবাসা, অন্যদিকে পরিচিত পৃথিবীর চোখ। অনুরাধা একদিন ফোন করে পায় না তাকে, মেসেজ পাঠায়—উত্তর আসে না। তারপর একদিন সৌরভ আসে দেখা করতে—চোখে লজ্জা, গলায় ভাঙা সুর। বলে, “আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি, কিন্তু আমি কাউকে বুঝাতে পারছি না।” অনুরাধা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে, “তুমি আসলে নিজেকেই বুঝাতে পারছো না।” সেইদিন আর কোনো কথা হয়নি, সৌরভ চলে গিয়েছিল, আর আরেকবার আসেনি। অনুরাধা জানত, এটা ছিল ভাঙা প্রেম নয়, এটা ছিল একটি লড়াই—যেখানে তার শরীর, পরিচয়, অস্তিত্ব—সব মিলিয়ে তাকে বারবার প্রমাণ করতে হয় যে সে ভালোবাসার যোগ্য। সে জানত, প্রেম কেবল চোখে চোখ রেখে বলা কথা নয়, প্রেম মানে সমাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাত না ছাড়ার সাহস। এবং সেই সাহসটা সবার থাকে না।
অনুরাধা সেই অভিজ্ঞতার পর আর কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় পায় না, কিন্তু জানে—তার ভেতরের ভালোবাসা কোনোদিন মরে না। সে বোঝে, ভালোবাসা চাওয়া অপরাধ নয়, অথচ তার জন্য ভালোবাসা পাওয়া যেন এক যুদ্ধ। সে প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়, ভাবে—এই ঠোঁট একদিন হয়তো কারও জন্য কাঁপবে, কারও নাম উচ্চারণ করবে, কিন্তু সেই মানুষ যদি ‘ওরা’-র ভেতরে পড়ে, তবে ভালোবাসা আবার প্রশ্নচিহ্নে বদলে যাবে। তাই এখন অনুরাধা ভালোবাসা খোঁজে না, সে ভালোবাসা তৈরি করে—নিজের জন্য, তার মতো অন্য মেয়েদের জন্য, যারা এখনও রাতে কাঁথার নিচে মুখ লুকিয়ে ভাবে, “আমিও কি একদিন কারও ‘তুমি’ হতে পারব?” সে তাদের বলে, “ভালোবাসা পেতে হলে আগে নিজেকে ভালোবাসো। তুই নিজের চোখে নিজের যোগ্যতা খুঁজে নে, তোর চোখই একদিন কারও চোখ হয়ে উঠবে।” কারণ অনুরাধা এখন জানে—ভালোবাসা পেলে সে কাঁদে, না পেলে সে লেখে, সে দাঁড়ায়, সে হাঁটে, সে থামে না।
অধ্যায় ৭: রঙের বিপ্লব
শহরের ছাদগুলোর গায়ে রোদ নামে যেমন, তেমনি কিছু মানুষও থাকে, যারা নিজের আলো অন্যকে ছুঁয়ে দিতে জানে—অনুরাধা এখন ঠিক তেমনই একজন হয়ে উঠছে। আশ্রয়কেন্দ্র, সহায়তা প্রকল্প, রোজকার লড়াই আর ভাঙা ভালোবাসার অভিজ্ঞতা একত্রে মিশে গিয়ে তার ভিতরে গড়ে তুলেছে এক ঝলমলে প্রতিজ্ঞা—যে প্রতিজ্ঞা শুধু নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বরং তাদের জন্য যারা এখনও বলতে পারে না, “আমি কে।” একদিন সে ডাক পায় একটি সমাজসচেতনতামূলক কর্মশালায় বক্তা হিসেবে অংশ নিতে—প্রথমবার কোনো প্ল্যাটফর্মে সে “অনুরাধা ঘোষ – ট্রান্স অ্যাক্টিভিস্ট” নামে পরিচিত হয়। বড় মঞ্চ, সামনে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সংগঠক, ফটোগ্রাফার—সবার চোখ যেন কৌতূহলে টান টান। অনুরাধা উঠে দাঁড়ায়, হাতে মাইক ধরে বলে, “আমি জন্মসূত্রে যে ছিলাম, তা নয়। আমি সময়ের সঙ্গে নিজেকে তৈরি করেছি। আমি নিজেকে প্রতিদিন নতুন করে চিনেছি, নতুন করে সাজিয়েছি, আর সেই সাজ আমার পরিণতি নয়, আমার শুরু।” তার কণ্ঠে কম্পন ছিল না—ছিল জ্বলন্ত বিশ্বাস। কথা শেষ হওয়ার আগেই হাততালি পড়ে—না, সবাই বোঝে না, কিন্তু সবাই বুঝতে চায়। এই ছিল সেই মুহূর্ত, যেটা অনুরাধাকে তার ভয়ের শেষ বিন্দু থেকে টেনে আনে সাহসের মুখোমুখি।
এরপর সে একের পর এক কর্মশালায়, স্কুল-কলেজে, সেমিনারে অংশ নেয়—সে কথা বলে নারীত্বের অভ্যন্তরীণ অনুভূতি নিয়ে, ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার প্রাকৃতিক বাস্তবতা নিয়ে, শরীর ও সমাজের দ্বন্দ্ব নিয়ে। সে বলে, “আমরা শুধু কাগজে একটি তৃতীয় লিঙ্গ নই, আমরা রক্তমাংসে তৈরি মানুষ, আমাদের স্বপ্ন আছে, প্রেম আছে, পরিবার গড়ার ইচ্ছে আছে, আর আছে অবসরের দিনে কারও হাত ধরে বসে থাকার আকাঙ্ক্ষা।” একবার এক কলেজের ছাত্র উঠে বলে, “আপনার মতো হয়ে উঠতে গেলে কী লাগে?” অনুরাধা উত্তর দেয়, “নিজেকে ভালোবাসার সাহস লাগে, আর ভয়কে অস্বীকার করার শক্তি লাগে।” এমন সময়েও সে দেখে, ‘ওরা’ এখনও রয়েছে—অনেক জায়গায় হেসে ফিসফিস করে, পিছন ফিরে কটাক্ষ করে, ছদ্ম উদারতার মুখোশ পরে। কিন্তু অনুরাধা এখন জানে, ‘ওরা’র চোখের দিকে তাকানো মানে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া নয়, বরং সে রঙ ছড়িয়ে দেওয়ার সময়, যেন তাদের ধূসর দৃষ্টিও একদিন আলোর সঙ্গে মিশে যায়। একদিন এক রঙের ক্যাম্পেইনে, যেখানে সবাই নিজস্ব রঙের পোশাক পরে নিজের পরিচয় উদযাপন করছিল, অনুরাধা লাল শাড়িতে হাজির হয়—সঙ্গে ছোট্ট ব্যাজ, তাতে লেখা “আমি আছি, আমি রঙ।” সেই দিন সে বুঝেছিল, তার প্রতিটি রঙ, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি হাঁটা—এটাই বিপ্লব।
এখন তার দিন কাটে বিভিন্ন ট্রেনিং প্রোগ্রাম তৈরি করে—সে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের শেখায় কীভাবে ট্রান্স ছাত্রদের সঙ্গে আচরণ করতে হয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মীদের বোঝায় কিভাবে ট্রান্স নারীর প্রয়োজন ভিন্ন হতে পারে। সে সরকারি দপ্তরে গিয়ে কথা বলে লিঙ্গ পরিচয় সংক্রান্ত নীতির পরিবর্তন চেয়ে—প্রতিটি জায়গায়, প্রতিটি কথায় সে শুধুই বলে, “আমরা আলাদা নই, আমরা আছি।” একদিন সে এক বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে দেখা করে, নাম রেশমি—মাত্র চোদ্দ বছর বয়স, শরীর ছেলের মতো, অথচ চোখে এক কোমল ভয় আর পিঠে স্কুলব্যাগ। রেশমি এক কোণে দাঁড়িয়ে চুপ করে ছিল, অনুরাধা তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হলো?” রেশমি চোখ নিচু করে বলেছিল, “আমার নাম কেউ নেয় না ঠিক করে, আমি জানি না আমি কে।” তখন অনুরাধা তার গালে হাত রেখে বলেছিল, “তুই আমার মতো, তুই হয়তো আমার আগের গল্প, কিন্তু তোর সামনে তুই আছিস।” সেই দিন রেশমি তাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল, আর অনুরাধা ভেবেছিল—এই কান্নাগুলোই তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার, কারণ সে এখন শুধু নিজের যন্ত্রণাকে শব্দ দেয় না, সে অন্যদের নিরবতাও ভাঙতে শেখায়।
সমাজে অনেক কিছু বদলায়নি—রাস্তার পাশে দাঁড়ালে কেউ কেউ এখনো বলে, “ওটা কি ছেলে না মেয়ে?” অফিসের আলোচনায় এখনো কেউ ঠাট্টা করে বলে, “ওই যে ট্রান্স অ্যাক্টিভিস্ট, ওর তো কিছুদিন পর অপারেশন হবে নাকি?” কিন্তু এই কথাগুলো আর অনুরাধার হৃদয়ে খোঁচা দেয় না, বরং তার স্পর্ধা জাগায়—সে জানে এই সমাজে রং লাগাতে হলে প্রথমে ধুলো সরাতে হয়, আঁচড় পড়বে, আঘাত লাগবে, কিন্তু তারপরই ফুটে উঠবে সেই মুক্ত চিহ্ন, যা বলে, “তুমি থাকতে পারো যেমন খুশি, তুমি করো না ভয়।” অনুরাধা এখন শুধু একটি নাম নয়, সে একটি স্বপ্ন, একটি আন্দোলন, একটি চলমান পথ—যে পথে হাঁটতে হাঁটতে সে নতুন অনুরাধা তৈরি করে, নতুন বিশ্বাস গড়ে তোলে। তার একার লড়াই আজ অনেক কণ্ঠে ছড়িয়ে গেছে, যাদের কেউ বলে না “আমি আর ওরা”—সবাই বলে, “আমরাও আছি, আমরা আছি একসাথে।”
অধ্যায় ৮: মায়ের চিঠি
তুলসিগাছের নীচে দাঁড়িয়ে ছিল অনুরাধা—সন্ধ্যার আলোর নিচে, গলার চারপাশে একটা হালকা শাল, আর হাতে ধরা ডাকবাক্স থেকে তুলে আনা একটি হলুদ খাম। এই ধরনের খাম অনেক বছর ছুঁয়ে দেখেনি সে—ই-মেইল, মেসেজ, চ্যাটের যুগে এইখানেই লুকিয়ে ছিল তার শৈশবের গন্ধ, সেই বাড়ির বারান্দা, যেখানে মা চুলে তেল দিয়ে বসিয়ে রাখতেন অর্ণবকে, চোখে চোখ রেখে বলতেন, “একদিন তুমি অনেক দূর যাবে।” এখন সেই মা, যিনি তার মেয়েকে কোনোদিন বলে উঠতে পারেননি ‘তুই তুই হ’, সেই মা-ই লিখেছেন একটি চিঠি—পাঠিয়েছেন পোস্ট অফিস থেকে, সাদা কাগজে কালো কালি, ধরা-ধরা অক্ষর, যার প্রতিটি অক্ষরের ওজন হাজার কথার সমান। অনুরাধা প্রথমে খামটা খুলতে ভয় পায়—ভাবতে থাকে, “আবার যদি শাস্তি হয়? আবার যদি চুপ করে রাখার কথা থাকে?” কিন্তু এরপর ভেতর থেকে এক অজানা দৃঢ়তা বলে, “না, এবার বুঝে নিস।” সে চিঠিটা টেনে বের করে, চোখের কোণে টান পড়ে—প্রথম লাইন লেখা, “প্রিয় অনুরাধা”—এই একটি শব্দেই তার বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে, যেন কেউ তার নাম বহু বছর পর প্রথমবার ঠিক করে উচ্চারণ করল, ভুল উচ্চারণে নয়, ভুল বানানে নয়, ভুল বোঝায় নয়—একদম সোজাসুজি, মমতাভরা।
চিঠিতে মা লিখেছেন, “তুই যখন বাড়ি ছাড়লি, আমি ভেবেছিলাম আমার সন্তান বুঝি আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। তোর বাবার চোখে তখন রাগ ছিল, সমাজের চোখে লজ্জা, আর আমার চোখে শুধু ভয়। আমি জানতাম, তুই পালাসনি, তুই খুঁজতে গেছিস—কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম, যদি এই সমাজ তোকে কেটে দেয়, যদি তুই হারিয়ে যাস, যদি কেউ তোকে এমনভাবে ব্যথা দেয়, যেটা আমি কোনোদিন ছুঁয়ে দেখতে পারব না। আমি জানি, তোকে আমি কোনোদিন জড়িয়ে ধরি নি, যখন তুই আয়নার সামনে কাঁদতি, আমি চুপ করে থাকতাম। আজ বুঝি, সেই চুপ করাটাই তোকে সবচেয়ে বেশি একা করে দিয়েছিল।” অনুরাধা যখন এই লাইন পড়ছিল, তখন তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল—সে জানত, এই স্বীকারোক্তি কোনো একুশ শতকের ফেসবুক পোস্ট নয়, এটা এক চিরকালীন মাতৃত্বের ব্যথা, যা সময়ের ভিতর জমে উঠে একদিন ছাপ ফেলে। চিঠির দ্বিতীয় অংশে মা লিখেছেন, “অনেকদিন ধরেই আমি খবর রাখছি, তুই কোথায় কাজ করিস, কারা তোকে ডাকছে, কিভাবে তুই অন্যদের পাশে দাঁড়াস—আমি তোকে দেখতে গেছি দূর থেকে, কোনোদিন ডাকিনি, ভাবিনি তুই চিনে ফেলবি। কিন্তু প্রতিবার তোর কথা শুনে মনে হয়েছে, এই মেয়েটা আমারই পেট থেকে জন্ম নিয়েছে—যে বুকের ভেতর আগুন ধরে রাখতে পারে, অথচ চোখে জলের নরম রেখা রাখে।”
অনুরাধা এবার চিঠিটা দুই হাতে জড়িয়ে ধরে, মনে পড়ে সেই সব দিন, যখন সে মা-র কাছে গিয়ে বলতে চেয়েছিল, “আমার নাম অনুরাধা”, অথচ বলে উঠতে পারেনি, কারণ মা সবসময় বলতেন, “বাড়ির ছেলেরা এসব কথা বলে না।” এখন সেই মা-ই তাকে লিখছেন, “তুই যখন নিজের নাম লিখেছিলি সরকারি ফর্মে, আমি চুপচাপ সেই ফর্মের ছবি দেখে কেঁদেছিলাম। তুই তো নিজের নামটাও আমাকে বলতে পারিসনি, অথচ সেই নামটাই তোকে এখন হাজার মানুষ ডাকে। আমি বলি না, আমি সব বুঝি—আমি এখনো ভুল করব, হয়তো আবার প্রশ্ন করব, কিন্তু আমি চাই, তুই একদিন বাড়িতে আয়—একবার শুধু আয়, আমি তোর কপালে হাত রাখব, বলব, ‘অনুরাধা, তুই আমার মেয়েই।’” অনুরাধা এই শব্দগুলো পড়ে চুপচাপ বসে থাকে, তার গাল বেয়ে জলের রেখা পড়ে নিচে, ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু মুখে থাকে এক ধরনের প্রশান্তি, যেটা অনেকদিন পর কোনো চাওয়া পূরণ হওয়ার মতো। সে জানে, এই চিঠি কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং তার দীর্ঘ পথচলার একটা ছোট্ট জবাব—একটা অজস্র অস্বীকৃতির পর প্রথম ‘হ্যাঁ’, একটা হিমশীতল সম্পর্কের প্রথম উষ্ণতা।
চিঠির শেষ লাইন লেখা ছিল—“তুই তোর মতো থাক, আমার দোয়া তোকে জড়িয়ে রাখুক। আমি জানি, তুই হারাসনি, তুই তৈরি হয়েছিস। এখন আমি শুধু চাই, তুই বাড়িতে আসিস একবার, যেন তোকে জড়িয়ে ধরি।” সেই লাইনটুকু পড়ে অনুরাধা খুব ধীরে করে চিঠিটা ভাঁজ করে বুকের কাছে রাখে। বাইরে তখন সন্ধ্যা নামছে, পাখিরা ফিরে যাচ্ছে গাছে, আর তার মনে হচ্ছিল, একটি হারিয়ে যাওয়া ঠিকানা আবার অল্প অল্প করে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। অনুরাধা জানত, আগামী দিনেও সমাজের দৃষ্টিতে তাকে হয়তো স্বাভাবিক ভাবা হবে না, হয়তো কেউ কেউ বলবে, “মা মেনে নিলেই কী?”—তবু এই চিঠির ভেতর লুকিয়ে ছিল এক মাতৃমনের ভাঙা-গড়া, সাহস আর স্বীকারোক্তির এক অসামান্য মুহূর্ত। সে জানত, তার ফিরে যাওয়া মানেই পুরোনো ঘর, পুরোনো দেওয়াল, সেই পুরোনো দরজা—কিন্তু এবার সে সেই ঘরে ঢুকবে নিজের নাম নিয়ে, নিজের রূপ নিয়ে, আর একদিন হয়তো মা তার সামনে দাঁড়িয়ে বলবেন, “এই আমার মেয়ে, এই আমার আলো।” অনুরাধা জানত, সেই দিন সে আর একা থাকবে না—কারণ চিঠির কালি কাঁদে না, কিন্তু তার শব্দ বুকের ভিতর রং ছড়ায় চুপিচুপি।
অধ্যায় ৯: আমি আর ওরা
অনুরাধা আজ অনেক দূর এসেছে—কিন্তু এই ‘দূর’ শব্দটি কখনো কেবল সময় নয়, কখনো কেবল জায়গাও নয়; এটা একটি মানসিক পরিসর, যা কখনো একটা চিঠির অপেক্ষায় থাকে, কখনো আয়নার সামনে নিজেকে বলার সাহসে, আবার কখনো একদম অচেনা কারো চোখে নিজের প্রতিফলন খুঁজে পাওয়ায়। এখন সে সকাল শুরু করে একটি কফি আর একটি দৈনন্দিন উদ্দেশ্য নিয়ে—আজ কীভাবে একজন মানুষকে তার নিজের ভেতরের “আমি” চিনতে শেখানো যায়। রোজ সকালে সে যে আয়নাটার সামনে দাঁড়ায়, সেখানে আগে শুধুই নিজের মুখ দেখত; এখন দেখে হাজার অনুরাধার মুখ—যারা হয়তো এখনো কথা বলতে পারে না, যাদের পরিবার এখনো বলে “চুপ করে থাক”, যাদের সহপাঠী বলে “ওদের মতো হইস না।” তাদের সবার প্রতিনিধি হয়ে ওঠার ভার কোনোদিন নেয়নি সে, কিন্তু এই পথ পাড়ি দিতে দিতে সেই ভারটুকু যেন আপনিই এসে বসে পড়েছে তার কাঁধে। তাই সে এখন আর কেবল ট্রান্সজেন্ডার নারী নয়—সে এক ভাষ্য হয়ে উঠেছে, এক স্বর, যা কাঁপে না, কেঁপে ওঠায়।
সে একটি শহরের স্কুলে গিয়ে ক্লাস নিচ্ছে আজ—টপিক: “লিঙ্গ পরিচয়ের স্বাধীনতা ও সামাজিক দায়িত্ব।” একাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা চুপ করে বসে থাকে, কাগজের ওপর লিখছে—“আমি কে?” তারপর অনুরাধা বোঝায়, “তোমার শরীর তোমার পরিচয় নির্ধারণ করে না, বরং তোমার চিন্তা, অনুভব আর স্বপ্ন সেটাকে রঙ দেয়।” কেউ একজন জিজ্ঞেস করে, “আপনি তো ওদের মতো ছিলেন, এখন আপনি আমাদের মতো—তা হলে আমরা এক?” সে হেসে বলে, “তোমরা আমার মতো ছিলে না, আমি তোমাদের মতো ছিলাম না—আমরা কেউই কাউকে থেকে আলাদা নই, কারণ আমরা সবাই মানুষ, আর মানুষ মানেই একটা পথ, যার গন্তব্য নিজের সত্যির কাছে পৌঁছনো।” স্কুল শেষে অনুরাধার হাতে একটি ছোট্ট নোট আসে—একটি মেয়ের হাতে লেখা, “আজ আপনি আমার ভয়টা তুলে নিলেন। আমি আমার বাবাকে বলব আমি মেয়ে হতে চাই।” এই একটি লাইনের ওজন কোনো আইন বা ভাষণের চেয়ে ভারী। অনুরাধা জানে, পরিবর্তন এভাবেই হয়—চিৎকারে নয়, কথায় নয়, ভালোবাসায়—ধীরে, গভীরে।
এখন সে বিভিন্ন জাতীয় মঞ্চে ডাকা হয়—তার পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে “অনুরাধা ঘোষ, ট্রান্স ভয়েস অফ বেঙ্গল”। তাকে কেউ কেউ দেখে সম্মানের চোখে, কেউ আবার দেখে “ওর মতো হতে পারলে হয়তো আমাদের ট্রান্স বন্ধুটিকেও কাজে লাগানো যেত” এই হিসাবি দৃষ্টিতে। তবুও সে জানে, এই দৃষ্টিগুলোই ধীরে ধীরে বদলায়, কারণ “ওরা” আর আগের মতো দুর্বল নয়, এখন “ওরা”-র ভেতরেও অনেকে নিজের ছায়া খুঁজে পায়। একদিন একটি প্রেস কনফারেন্সে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি মনে করেন ‘ওরা’ বদলেছে?” অনুরাধা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “আমি আগে ‘ওরা’ বলতাম, এখন বলি ‘আমরা’। কারণ আমি দেখেছি, সেই পুলিশ অফিসার যিনি একদিন আমাকে আটকাতে চেয়েছিলেন, তিনিই আজ বলছেন, ‘আপনি ঠিক বলেন।’ সেই সহকর্মী, যে একসময় ফিসফিস করত, সে এখন নিজের মেয়েকে নিয়ে আসে আমার কাছে, বোঝাতে, মানুষ হওয়া কত জরুরি।” এই কথাগুলো সে বলে একটানা, চোখে জল নেই, কিন্তু কণ্ঠে ছলছল করে অভিজ্ঞতা, আর আত্মবিশ্বাসের নরম বাতাস।
রাতের ঘরে ফিরে সে ডায়েরি লেখে—আজ তার মাথায় ঘুরছিল একটা প্রশ্ন: “আমি আর ওরা—এই বিভাজন কি মুছে ফেলা সম্ভব?” সে লিখে, “আমি জানি না সমাজ সম্পূর্ণ বদলাবে কি না। কিন্তু আমি জানি, আমি আর ওরা—এই দুইয়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একদিন এমন একটা জায়গা আসবে, যেখানে কেউ আর জিজ্ঞেস করবে না, ‘তুমি ছেলে না মেয়ে?’, বরং বলবে, ‘তুমি ভালো আছ তো?’” সে জানে, লড়াই এখনও শেষ হয়নি—রাস্তায়, আদালতে, ঘরের ভেতরেও লড়াই বাকি। কিন্তু সে এটাও জানে, সে এখন একা “আমি” নয়—তার সঙ্গে আছে অনেকে, যারা ধীরে ধীরে “ওরা” থেকে “আমরা” হয়ে উঠছে। সেই সময়ই তার চোখ পড়ে জানালার বাইরে—একটা ছোট মেয়ে সাইকেল চালাচ্ছে, পেছনে হেলমেট পরে একটি ছোট ছেলে বসে আছে, দুজনের চুল উড়ছে, হাসছে, কেউ কারও লিঙ্গ নিয়ে ভাবছে না। অনুরাধা জানে, ওটাই ভবিষ্যৎ—যেখানে আমি আর ওরা একসঙ্গে হবে, এক পৃষ্ঠায়, এক শব্দে, এক ভালোবাসায়।
অধ্যায় ১০: নামের চেয়েও বেশি
মঞ্চের আলো নিভে আসছিল, দর্শক আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াচ্ছিল, তবুও অনুরাধা দাঁড়িয়ে ছিল এক কোণে—হাতজোড়া করে কপালে ঠেকিয়ে যেন নিজেকে থামাতে চাইছিল এই উচ্ছ্বাস থেকে, যা বুকের গভীর থেকে চেপে আসছিল। আজকের অনুষ্ঠানটা ছিল তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের প্রারম্ভিক সুর—একটি শহর তাকে সম্মান জানিয়েছে ‘জীবনকর্মী’ হিসেবে, একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা তার জীবনভিত্তিক কাজের জন্য তাকে দিয়েছে ‘নতুন আশার দীপ্তি’ সম্মাননা। কিন্তু এই পুরস্কার, এই হাততালি, এই গালভরা প্রশংসা—এসব যেন এক মুহূর্তে অতীত হয়ে গিয়েছিল, যখন একজন ষোড়শী মেয়ে অনুষ্ঠান শেষে এসে তার হাত ধরে বলেছিল, “আপু, আপনি না থাকলে আমি আজ বাঁচতাম না।” এই একটি বাক্যই যেন সেই পুরস্কারের থেকেও মূল্যবান হয়ে উঠেছিল অনুরাধার কাছে। সে বুঝে গিয়েছিল, তার নাম এখন আর কেবল একটা আইডেন্টিটি নয়, তার নাম হয়ে গেছে একটা আশ্বাস—যা কেউ কেউ কাঁথার নিচে মুখ লুকিয়ে ভেবে, আবার কেউ কেউ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করে বলে, “আমি অনুরাধা হতে চাই, সাহস পেতে চাই।”
সেই রাতেই অনুরাধা ফিরে আসে নিজের এক কামরার ঘরে, যেখানে দেয়ালে টাঙানো আছে তার প্রথম কবিতা ছাপা হওয়ার খবরের কাগজের কাটিং, মায়ের চিঠিটার ফ্রেমে বাঁধাই করা কপি, আর সেই লাল শাড়ির ছবিটা—যেটা তার জীবনের এক রঙিন দিনকে ধরে রেখেছে চিরদিনের মতো। সে আয়নার সামনে বসে, লিপস্টিক না লাগিয়ে শুধু চেয়ে থাকে নিজের চোখে—সেই চোখ, যেটা একদিন কেঁদেছিল, ভেঙেছিল, আবার নিজের অস্থি দিয়ে নিজেকে গড়েছিল। সে ভাবে, “এই আমি কি সেই অর্ণব, যে স্কুলে দাঁড়িয়ে বলত, ‘আমি ছেলে’, অথচ মনের ভিতর কাঁদত? এই আমি কি সেই মেয়েটা, যাকে কলেজের হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল কেবল নিজের পোশাক আর হাঁটার ভঙ্গির জন্য?” না, এই আমি এখন আর শুধু আমি নয়—এই আমি এখন এক চলমান উত্তর, এক অদৃশ্য প্রশ্নের ভাষা, যা বলে দেয়, “তুমি কে—তা কেউ ঠিক করে দেবে না, তুমি নিজেই ঠিক করবে।”
দিন চলে যায়, সময় বদলায়, শহরের রঙ বদলায়, কিন্তু অনুরাধার কণ্ঠ আরও দৃঢ় হয়—সে লেখে, কথা বলে, শেখায়, আঁকে, বাঁচে। একদিন একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়—‘Voices of the Unheard’ নামক এক গ্লোবাল আডভোকেসি প্ল্যাটফর্মে সে নিজের গল্প শোনায় হাজার মানুষের সামনে। ইংরেজি ভাষায় বলা হলেও তার কথার ভিতর থাকে এক মাটি-মাখা টান, যেটা বলে, “I was not born a mistake. I was born a question—and I answered it with my life.” সেই মুহূর্তে তার চোখ পড়ে এক দর্শকের দিকে—এক যুবক দাঁড়িয়ে কাঁদছে, বুক ধরে কান্না চেপে রেখেছে। পরে সে এসে বলে, “আমার বোন ট্রান্স। সে আজও বলে উঠতে পারেনি। কিন্তু আপনাকে দেখে আমি ওকে বলব, ওর ভয় না পেতে।” অনুরাধা জানে, এই গল্পগুলোই চিরকাল বেঁচে থাকবে। কারণ তার নাম এখন আর শুধু তার ভোটার আইডি বা আধার কার্ডে নেই, তার নাম লেখা আছে কারও সাহসের ডায়েরির প্রথম পাতায়, কারও কবিতার শেষ লাইনে, কারও ভবিষ্যতের ছেঁড়া স্বপ্নের টুকরোগুলোতে।
রাত গভীর হলে সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদের আলো পড়ে তার কাঁধে, মনে হয়, কে যেন আদর করে বলছে, “তুই পারলি, অনুরাধা।” কিন্তু সে নিজেকে কোনোদিন বিজয়িনী ভাবে না, কোনোদিন চূড়ায় পৌঁছানো বলে না—সে ভাবে, “আমি তো শুধু পথ দেখালাম, হাঁটলাম, পড়ে গেলাম, উঠে দাঁড়ালাম।” আজও যখন নতুন কেউ এসে বলে, “আপু, আমি ভয় পাই”, সে শুধু বলে, “ভয় পেও না—কারণ তুই ভয় পেলেই ওরা জিতে যাবে। আর তুই তো ওদের জন্য না, তুই তো তোর নিজের জন্য।” তখন সে বুঝে যায়, তার নাম এখন কেবল অনুরাধা নয়, তার নাম এখন লড়াই, তার নাম এখন বিশ্বাস, তার নাম এখন ভালোবাসা, তার নাম সেই সব মেয়েদের চিৎকার, যারা আর চুপ থাকতে চায় না। আর তাই এই গল্পের নাম—“আমি আর ওরা”—এর মধ্যে সেই ‘আমি’ শব্দটা কখন যেন হয়ে উঠেছে বহু মানুষের মুখ, চোখ, উচ্চারণ, যা সময়কে বদলে দেয়।
***
এই গল্প শেষ হয় না। এই গল্প শুধু থেমে থাকে এক মুহূর্তে—যেখানে অনুরাধা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে, আর ভাবতে থাকে, “আমি যদি এই জীবনে আর কিছুই না পেতাম, শুধু নিজের নামটুকু যদি আমার না থাকত, তবুও আমি কি এভাবে দাঁড়াতে পারতাম?” আয়নার ভেতরের মুখটা তখন হেসে বলে, “না, পারতিস না। কারণ তুই যে নিজেকে চিনেছিস, সেই চেনাটাই তোর সবচেয়ে বড় অর্জন।” আজ যখন শহরের এক প্রান্তে কোনো শিশু জন্ম নেয়, যার পরিচয় সমাজ বুঝতে দেরি করে, তখন কেউ কেউ বলে, “একটা অনুরাধা ছিল, যে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিল।” এই গল্পে ‘আমি’ শব্দটা একা ছিল না, সে সময়ের সঙ্গে ‘আমরা’ হয়ে উঠেছে, আর সেই ‘ওরা’—যারা একসময় তিরস্কার করত, আজ প্রশ্ন করে, “আমরাও কি বদলাতে পারি?” অনুরাধার গল্প কোনো আত্মদম্ভের জাদু নয়, কোনো কষ্টের দলিল নয়—এটা এক নরম আলো, যা ভোর হওয়ার আগের অন্ধকারে জ্বলে ওঠে, কাউকে কিছু না বলে বলে ফেলে, “আছে, আশাটুকু আছে।” যে যেখানে দাঁড়িয়ে পড়ছে, যে যেখানে হারিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য অনুরাধা হয়ে উঠেছে এক চেনা পথের আলপথ, এক বাতাসের হাত, এক নাম, যা শুধু নাম নয়—এক নীরব আশ্বাস, “তুই একা নস।” কারণ শেষমেশ, এই গল্প কেবল একজন ট্রান্সজেন্ডার নারীর আত্মসংগ্রামের বিবরণ নয়—এটা প্রত্যেক মানুষের গল্প, যে নিজের পরিচয়ের জন্য দাঁড়ায়, কাঁদে, আবার হাসে; যে জানে, নিজের নাম উচ্চারণ করার মধ্যে যে সাহস লুকিয়ে থাকে, তা কোনওদিন ফুরোয় না।
-সমাপ্ত-




