Bangla - প্রেমের গল্প

আমার ফেলে আসা শ্রাবণ

Spread the love

সুবর্ণ দে


এক

কলকাতার আকাশটায় সকাল থেকেই একটা চাপা ধূসরতা ঝুলে ছিল। মাঝেমধ্যেই হালকা বাতাসে কুঁচকে ওঠা মেঘেরা যেন কারও চোখের জল লুকোচ্ছে, কেউ কাঁদবে কি না— সেই সংশয়ে মিশে থাকা। দিনভর অফিসের ব্যস্ততা পেরিয়ে সন্ধ্যাবেলায় যখন ঋভু বেরোল, তখন শহরটা যেন অপেক্ষা করছিল শ্রাবণের প্রথম ফোঁটার জন্য। রাস্তাঘাট একটু স্যাঁতসেঁতে, বাতাসে কাঁচা মাটির গন্ধ মিশে আছে, যেটা তার মনটাকে যেন একটু আলগা করে দিল। গলির মাথায় রিকশাওয়ালাকে বলে দিল — “ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম চত্বর”, আজ সেখানে একটা ছোট্ট কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান, যেখানে সে নিমন্ত্রিত। অতিপরিচিত না হলেও, কবিতা ভালোবাসে বলে এই ধরণের ছোট ছোট সমাবেশগুলোতে মাঝে মাঝে চলে যায়, নিজের লেখা পড়ে বা নতুন কবিদের শোনে। কিন্তু আজ তার ভেতরটায় একটা অজানা আলোড়ন কাজ করছিল, হয়তো বৃষ্টির কারণে, হয়তো অন্য কিছু। রিকশা যখন এসপ্ল্যানেড পেরিয়ে মিউজিয়ামের উল্টোদিকে দাঁড়াল, তখনই হঠাৎ করে এক ঝলক হাওয়া এসে ঋভুর চোখে কুয়াশা মাখিয়ে দিল। একটা অদ্ভুত অনুভূতি তাকে স্পর্শ করে গেল— যেন কিছু ঘটতে চলেছে।

অনুষ্ঠানটা ছিল ঘরোয়া — মিউজিয়ামের পেছনের একটি কনফারেন্স রুমে, মৃদু আলো, ছাতা ঝরানো ভিজে ভিজে পায়েচলা, পেছনে বেজে চলা সরোদের সুর। কিছু মুখ চেনা, বেশিরভাগই নতুন। ঋভু ঢুকে নিজের নামটা লিখে ভিতরে এল, জানালার পাশে একটি খালি চেয়ারে বসে। সামনে তখন একজন কবি তাঁর ‘বৃষ্টির স্মৃতিমালা’ পড়ে যাচ্ছেন। তার কানে ঠিক যেন ঢুকছিল না— বরং জানালার বাইরে যেভাবে জলবিন্দুগুলো একটার পর একটা পড়ে যাচ্ছে কাচের গায়ে, সেই দৃশ্য তাকে যেন কোথাও টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গলার আওয়াজ, নিচুস্বরে কেউ কারও কাছে জানতে চাইছে, “সামনের সারিতে বসা যায়?” সেই গলার ধ্বনি যেন কোথাও বহুদিন আগে শোনা— না, ভুল হতে পারে না। সে ধীরে ধীরে ঘাড় ঘোরায়, যেন কোনো যাদুতে বাঁধা পড়ে গেছে তার শরীর, আর তখনই তার চোখে পড়ে একজোড়া চোখ — যা সে শেষবার দেখেছিল ঠিক দশ বছর আগে, শেষ শ্রাবণের বিকেলে, কলেজের মাঠে। চোখ দুটো একটু ক্লান্ত, কিন্তু গভীরতায় এতটুকুও কমতি নেই। সৃজা সেনগুপ্ত— সময় যেন কিছুই বদলায়নি তার মধ্যে, আবার হয়তো অনেক কিছুই পাল্টে গেছে, ঋভুর ভেতরে হঠাৎ তোলপাড় উঠল। সেও তাকিয়ে রইল, কিছু না বলে, শুধু দেখে গেল সেই চেনা মুখ, সেই ভেজা চুলে টুপটাপ জলের ফোঁটা, আর সেই চেনা হাসি— তবে আজ হাসিটা যেন কাঁটার মতো বিধছে।

কোনো কথা হয়নি প্রথম মিনিট দশেক, দু’জনেই যেন সময়ের পাথরের নিচে চেপে যাওয়া পুরনো দিনগুলোকে মনে মনে খুঁড়ে তুলছিল। অনুষ্ঠান এগোচ্ছিল, কেউ কবিতা পড়ছিল, কেউ বাহবা দিচ্ছিল— কিন্তু ঋভু ও সৃজার চারপাশে যেন এক অদৃশ্য স্তব্ধতা নেমে এসেছিল। পরে একটু বিরতির সময় সৃজা এগিয়ে এসে মৃদু হেসে বলে, “তুমি এখনো কবিতা লেখো বুঝি?” ঋভু তাকিয়ে থাকে, একটা ছোট হাসি দেয়, জবাবে বলে, “হ্যাঁ… কিন্তু শ্রাবণ নিয়ে এখন আর লিখি না।” এই একটাই বাক্য যেন তাদের দশ বছরের না বলা কথার সারসংক্ষেপ। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তারা জানে— এই দেখা হঠাৎ নয়, হয়তো কিছুই ইচ্ছাকৃত নয়, কিন্তু তা অনিবার্য। তারা কথা বলে না বেশিক্ষণ, কিন্তু চোখের ভাষায় একটা স্পষ্ট সুর বাজে— “তুমি কি এখনো আমায় মনে রাখো?” উত্তরে আরেক দৃষ্টি বলে, “প্রতিটি শ্রাবণে, চুপচাপ।” মিউজিয়ামের গেট দিয়ে বেরোনোর সময় দু’জনেই একটু থেমে দাঁড়ায়, বৃষ্টি তখন গাঢ় হয়েছে। সৃজা ছাতা খুলে নেয়, ঋভু ভিজতে চায়— যেন জল দিয়ে স্মৃতিকে ধুয়ে ফেলতে। তারা হাঁটে দুই বিপরীত দিকে, কিন্তু জানে— আজ থেকে শহরের প্রতিটি শ্রাবণ, প্রতিটি বৃষ্টি, আবারও তাদের মধ্যে এক অলিখিত সেতু গড়ে তুলবে। বাস্তব তাদের আলাদা করলেও, স্মৃতি তাদের একসঙ্গে বেঁধে রাখবে — এই চুপচাপ শহরের শ্রাবণে, বারবার।

দুই

ঋভু সেদিন রাতে ফিরে এলো এক অদ্ভুত রকমের ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। শহরের রাস্তায় তখনো হালকা বৃষ্টি ঝরছে, কাঁচে পড়া ফোঁটাগুলোয় ভাঙছে রাস্তার আলো, আর তার মধ্যে দিয়ে ট্যাক্সির ভিতর বসে সে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে— যেন সেই জানালার ওপাশেই এখনো দাঁড়িয়ে আছে সৃজা। মনের মধ্যে গুঞ্জন করছে তার হঠাৎ দেখা, সেই প্রশ্নচিহ্ন ছুঁয়ে যাওয়া হাসি, সেই ‘তুমি এখনো কবিতা লেখো বুঝি’ কথাটার ছায়া। কী বলবে, কী ভাবে সামলাবে এই অতীতকে— বুঝে উঠতে পারে না সে। বাড়ি ফিরে এলেই নিজের ঘরের ছাদটা তার কাছে এক অদ্ভুত আশ্রয় হয়ে ওঠে— জানালার পাশে রাখা কাঠের টেবিল, তার ওপরে ছড়িয়ে থাকা কাগজপত্র, পুরনো বই আর একটা ছোট ট্রাঙ্ক, যা বহুদিন খুলে দেখা হয়নি। আজ সে একরকম আকর্ষণে পড়ে ট্রাঙ্কটা টেনে বের করে নেয়। ধুলো জমে আছে, তালার রঙ ঝাপসা হয়ে গেছে, কিন্তু তার ভিতরে রয়েছে তার কলেজ জীবনের সমস্ত চিঠিপত্র, নোটবুক, কিছু কবিতার খসড়া, আর… সৃজার হাতে লেখা সেই অজস্র চিঠি — যেগুলো সে কোনওদিন ছুঁড়ে ফেলতে পারেনি।

চিঠিগুলোর মধ্যে সাদা খামের মধ্যে গুটিয়ে রাখা একেকটা চিঠি খুলে খুলে পড়তে থাকে ঋভু। সেখানে সৃজার হাতের অক্ষর, যার প্রতিটি মোচড় এখনো তার মনে ছাপ ফেলে দেয়। “আজ শ্রাবণ এসেছে, তুমি কোথায়?” — এমন চিঠি, যেখানে বৃষ্টির মধ্যে সৃজার ভিজে যাওয়ার গল্প ছিল, আর সেই আবহে ঋভুকে মিস করার দীর্ঘশ্বাস। কোনো চিঠিতে লেখা — “তোমার কবিতাগুলো আমার বুকপকেটে থাকে, যখন ক্লাসে বসে তোমার দিকে তাকাতে পারি না, তখন ওগুলো পড়ে ফেলি চুপচাপ।” সেই চিঠিগুলোর মধ্যে কিছু ছিল একেবারে হালকা মনের — যেমন, কী খেয়েছে দুপুরে, কিংবা ক্যান্টিনে কার সঙ্গে কথা বলেছে। আবার কিছু ছিল ভীষণ ব্যক্তিগত — তার বাবার রাগ, মায়ের অশ্রু, আর মাঝরাতে কবিতা পড়ে ঘুম না আসার গল্প। চিঠির অক্ষরে অক্ষরে জমে থাকা ভালোবাসা যেন সময়কে পিছনে টেনে আনছিল। ঋভু কিছুক্ষণ পর একপাশে হেলান দিয়ে বসে পড়ে — তার মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে সে সময়ের কোনো জানালায় দাঁড়িয়ে আছে, যার এক পাশে কলেজের সেই ছাতাহীন বৃষ্টি, আর অন্য পাশে আজকের রাতের নিঃশব্দ স্মৃতি। তখনই খেয়াল পড়ে, চিঠির নীচে রাখা ছিল একটা মলিন খাতা — তার নিজের লেখা অসমাপ্ত কবিতার পৃষ্ঠা, যেটা সে কোনোদিন শেষ করতে পারেনি। সেদিন সৃজাকে দেওয়ার কথা ছিল সেই কবিতাটা, কিন্তু তার আগেই সৃজা তাকে জানায়, সে অন্য শহরে চলে যাচ্ছে — হঠাৎ, চুপচাপ, এবং অপূরণীয়ভাবে।

ঋভু ধীরে ধীরে পৃষ্ঠাটা তুলে নেয়। কাগজটা হালকা হলুদ হয়ে এসেছে, কালি খানিকটা ফিকে, কিন্তু শব্দগুলো যেন আজও তাজা। লেখা ছিল —
“তুমি চলে গেলে, আমি জানলাম না
বৃষ্টি কবে বিষাদের রঙ নেয়,
জানালার কাঁচে তুমি আর নেই,
শুধু শব্দ পড়ে থাকে — ঝরঝর ঝর।
তোমার চুলে বৃষ্টির গন্ধ ছিল,
তোমার চোখে একধরনের শ্রাবণ,
আমি সেই চোখে ডুবতে গিয়ে বুঝিনি,
ভিজে যেতে হয় শুধু একবারই।”

এই অবধি লেখা ছিল, বাকিটা ফাঁকা। একটা শব্দও আর লেখা হয়নি। সে জানে, ওই জায়গাটাতেই সে থেমে গিয়েছিল — কারণ সেদিন রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে সৃজার বিদায় তাকে যে শূন্যতা দিয়েছিল, তা শব্দ দিয়ে পূরণ করা যায়নি। ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে সৃজার চোখে জল ছিল না, ছিল একরাশ নিশ্চুপ অভিমান। আর সে দাঁড়িয়ে ছিল প্ল্যাটফর্মের ধারে, ভিজে ছাতার নিচে — হাতে রাখা ছিল ওই অসমাপ্ত কবিতাটা, কিন্তু দেবার সাহস হয়নি। ঋভু আজ বুঝতে পারে, ওই কবিতা শুধু একটি সম্পর্কের নিঃশেষ নয়, ওটা ছিল তার হৃদয়ের অসমাপ্ত অধ্যায়। আবার সে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, বাইরে তখনো বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে — একটানা, থেমে থেমে, যেন পুরনো কথাগুলোর প্রতিধ্বনি। ট্রাঙ্কটা খোলা রেখে সে নিজের খাতায় নতুন পৃষ্ঠা খুলে লেখে — “সেই দিনের চিঠি আজো ভেজা, শুধু তুমি নেই, আর নেই সেই শ্রাবণ…”
এই রাত, এই চিঠি, আর ওই অসমাপ্ত কবিতা — সব মিলিয়ে ঋভুর মনে হয়, সময় যেন ঘুরে ফিরে আবার একই জায়গায় এনে দাঁড় করায় তাকে। সৃজা ফিরে এসেছে নয়তো? নাকি শুধু তার স্মৃতি ফিরে এসেছে, সেই শ্রাবণের মতো, যে প্রতিবারই ফিরে আসে, কিন্তু কিছু রেখে যায় না?

তিন

রাত গভীর হলে স্মৃতির দরজা যেন আরও বেশি করে খুলে যায়। একটানা বৃষ্টির শব্দ, ঘরের নিঃশব্দতা আর জানালার পাশের আলোয় স্নান করা কাগজপত্রের স্তূপ— সব মিলিয়ে ঋভুর ভেতরে আজ যেন একটা ঘূর্ণি উঠেছে। চিঠির পর চিঠি, কবিতার পাতা, আর সেই অসমাপ্ত কথাগুলোর মাঝে হঠাৎ একটা মলিন স্ক্রিপ্ট তার হাতে আসে— “চিত্রাঙ্গদা (সংশোধিত)” লেখা আছে ওপরে। তারই লেখা, পুরোনো নাটকের একটি পুনর্ব্যাখ্যা। স্মৃতির দরজা ভেঙে তখন এক লাফে সে পৌঁছে যায় কলেজের সেই দিনগুলোতে, যখন নাটকের মহড়া চলত ক্যান্টিনের পেছনে ছোট্ট স্টোররুমে, আর গন্ধ মিশে থাকত গরম চায়ের, মঞ্চরঙের, আর মাটির ভেজা ঘামের। সেই সময় সৃজা প্রথম অভিনয় করেছিল রবীন্দ্রনাথের “চিত্রাঙ্গদা”-য়। বাকি সবাই চমকে গিয়েছিল তার আবেগ, উচ্চারণ আর চোখের ভাষা দেখে— কিন্তু ঋভু শুধু তাকিয়ে ছিল এক আশ্চর্য নীরবতায়। অন্যদের চোখে সৃজা হয়ে উঠেছিল মঞ্চের নায়িকা, কিন্তু ঋভুর চোখে সে হয়ে উঠেছিল মনেরই এক অজানা চরিত্র— যাকে শুধু মঞ্চে নয়, প্রতিদিনের জীবনে বুঝতে ইচ্ছে করে। নাটকের জন্য তখন একটি বিশেষ শেষ পর্ব রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ঋভুকে। সে ভেবেছিল, এই নাটকের মধ্যে দিয়েই সে প্রকাশ করবে নিজের মনের ভাষা— না বলা ভালোবাসার অনুভব, যা সে কখনো মুখে বলেনি সৃজাকে।

সেই নাটকের শেষ দৃশ্যটা আজও তার মনে গেঁথে আছে। চিত্রাঙ্গদা তখন বলে, “আমি রাজপুত্রকে বলি, নারী হয়ে নয়, আমি তোমার সহচর হতে চাই”— আর সেই মুহূর্তে সৃজার চোখে যে দৃঢ়তা আর আবেগের মিশেল দেখা গিয়েছিল, তা যেন মঞ্চের বাইরে বাস্তবেও ছাপ ফেলেছিল। নাটকের দিনটায় কলেজের প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি ছিল দর্শকে, শিক্ষকেরা, সহপাঠীরা, বাইরের অতিথিরা— কিন্তু ঋভুর চোখ ছিল শুধু সেই মেয়েটার দিকে, যার প্রতিটি সংলাপ তার লেখা, আর যার প্রতিটি চোখের ভাষা তার হৃদয়ের কথা। পরে সকলের বাহবা পেল নাটকটা, খবরের কাগজেও ছোট্ট করে বেরিয়েছিল তার নাম, কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশংসা পেয়েছিল সৃজা— অভিনয়ের জন্য, চোখের অভিব্যক্তির জন্য, আর সেই দৃঢ় ভাষার জন্য। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর, সবাই যখন ব্যস্ত চা আর ছবি তোলায়, তখন ঋভু ধীরে ধীরে ব্যাকস্টেজে গিয়েছিল। সৃজা তখন আয়না ঘষে ঘষে মুছছিল মুখের মেকআপ, চোখের কোণে জল ছিল কিনা বোঝা যাচ্ছিল না। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল দরজার পাশে। সৃজা তখন পেছন না ফিরে বলে, “শেষ সংলাপটা… শুধু নাটকের জন্য লিখেছিলে, নাকি আমার জন্য?” প্রশ্নটা এত সরাসরি ছিল যে ঋভু কোনও উত্তর দিতে পারেনি। তারা দুজনেই জানত— সেই নাটকের মধ্যে দিয়ে, একটি সম্পর্ক জন্ম নিচ্ছিল— নীরব, অথচ অকপট, ছায়া দিয়ে তৈরি, অথচ বাস্তব।

কিন্তু বাস্তবটা খুব সহজ ছিল না। নাটকের পরপরই কলেজে নানা রকম ঝামেলা, নতুন নাটকের দায়িত্ব অন্যদের হাতে যাওয়া, আর সৃজার নিজের পরিবারে নানা চাপ— সবকিছু একসাথে বদলে দিতে লাগল তাঁদের ঘনিষ্ঠতাকে। সৃজা ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছিল, একরকম না বলা বিদায়ে। নাটকের চিত্রাঙ্গদা যেমন নিজের পরিচয় খুঁজে পায় যুদ্ধ আর সাহসের মধ্য দিয়ে, সেরকমই সৃজা খুঁজছিল নিজের পথ— হয়তো এমন একটা জায়গা যেখানে প্রেম নয়, প্রয়োজন জিতে যায়। একদিন হঠাৎ সে জানায়— অন্য শহরে যাচ্ছে, পড়াশোনা চালিয়ে যাবে, আর নাটক ছেড়ে দিচ্ছে। ঋভু তখন চেষ্টা করেছিল বাধা দিতে, বোঝাতে, কিন্তু মঞ্চে যে সংলাপে “সহচর” হবার প্রতিশ্রুতি ছিল, বাস্তবে তা আর পূর্ণ হলো না। সেদিন মঞ্চের সমস্ত আলো নিভে গিয়েছিল তার জন্য, অন্তত তার মনে। আজ এতদিন পর, সেই স্ক্রিপ্টের পাতা ধরে বসে থাকা ঋভুর মনে হয়— সে শুধু নাটকের শেষাংশই নয়, নিজের জীবনের এক অধ্যায়ও লিখেছিল, যেটা এখনো শেষ হয়নি। সৃজা ফিরে এসেছে, কিন্তু সেটা কি মঞ্চে ফেরা? নাকি দর্শকসারিতে নীরব বসে থাকা? বাস্তব আর নাটকের মাঝে সেই সীমারেখাটা আজও ঝাপসা, আর তাদের সম্পর্কের মতোই, অসমাপ্ত।

চার

কলকাতার দক্ষিণের এক ছোট্ট কফিশপ, যেখানে দেয়ালের গায়ে ঝোলানো আছে কিছু পুরোনো বইয়ের পোস্টার, কাঠের টেবিলের উপর নরম আলো পড়ছে ঝুলন্ত হলুদ ল্যাম্প থেকে, আর পেছনে বাজছে আধোস্বরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বৃষ্টিভেজা কোনো রেকর্ডিং— এমন এক সন্ধ্যায় ঋভু এসে পৌঁছল কিছুটা দেরিতে, কারণ জানত, আজকের এই দেখা হবে ঠিক ঠিক সময়ের কাছে পরাজয় মেনে নেওয়ার মতো। সৃজা জানালার ধারে বসে ছিল আগে থেকেই, সাদা কফিমাগে ধোঁয়া ওঠা আমেরিকানোতে ঠোঁট ছোঁয়ানোর আগে একটিবার ঘড়ি দেখেছিল, আর তারপর বাইরের বৃষ্টিভেজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল এমনভাবে, যেন নিজের সমস্ত প্রশ্নগুলো মুছে ফেলতে চাইছিল তাতে। সে একরকম শান্ত দেখাচ্ছিল, কিন্তু চোখের নিচে লুকানো ছিল একটা দীর্ঘশ্বাস, যা হয়তো দশ বছর ধরে জমে আছে, বলা হয়নি কারো কাছে। ঋভু টেবিলের অপর পাশে বসতেই দুজনের চোখে চোখ পড়ল— অতীতের এক দীর্ঘ, নিঃশব্দ সংলাপ যেন চোখের দৃষ্টিতেই আদানপ্রদান হয়ে গেল। কেউ কিছু বলল না প্রথম কয়েক মিনিট, শুধু কাপের ধোঁয়া আর দেয়ালের ঘড়ির টিকটিক শব্দে জমে উঠল এক অদ্ভুত, ভারী আবহ। কফিশপের ছায়াঘেরা কোণ যেন তাদের জন্যই সংরক্ষিত, যেখানে শহরের কোলাহল ঢুকতে পারে না, আর সময় থেমে যায়।

প্রথম কথা বলেছিল সৃজা— “তুমি এখনো এই কফিশপে আসো?” কণ্ঠটা ছিল একটুখানি জড়ানো, যেন অনিশ্চয়তা আর অভিমান একসঙ্গে মিশেছে তাতে। ঋভু হালকা মাথা নেড়ে বলেছিল, “কখনো কখনো… তবে আজ অনেকদিন পর।” সেই “অনেকদিন” শব্দটা যেন কেটে-কেটে বাজে সৃজার মনে— কারণ তাদের শেষ দেখা হয়েছিল ঠিক এই শহরেই, তবে কোনো কফিশপে নয়, এক রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। এরপর তারা কিছু কথা বলল— বইয়ের, কবিতার, এমনকি আজকের বৃষ্টিরও। কিন্তু প্রতিটি বাক্যের ফাঁকে ছিল থেমে থাকা অনেক প্রশ্ন, যা কেউই সরাসরি জিজ্ঞাসা করল না। সৃজার ঠোঁটে হালকা হাসি থাকলেও চোখে ছিল চাপা অন্যমনস্কতা, যেন কিছু খুঁজে চলেছে ঋভুর মধ্যে, যা অনেক বছর আগের কোনো এক শ্রাবণে হারিয়ে ফেলেছিল। ঋভুও বুঝতে পারছিল, তাদের কথোপকথন যেন শব্দের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা, যেখানে ভাষার চেয়ে চোখ বেশি বলছে। তারা হয়তো জানে, আজ এই দেখা থেকে কোনো সিদ্ধান্ত হবে না— শুধু অসমাপ্তের ওপরে একটা পাতলা শীতল কাপড় জড়ানো হবে।

শেষদিকে, অনেকটা নীরবতার পর, হঠাৎ সৃজা জিজ্ঞেস করেছিল — “সবকিছু ভুলে গিয়েছো?” প্রশ্নটা এতটা সরল ছিল যে তার ভেতরের জটিলতা আরও প্রকট হয়ে উঠল। ঋভু চুপ করে বসে ছিল কিছুক্ষণ, চোখ নামিয়ে রেখেছিল কফির ভেতরের ঘূর্ণিতে। সে জানত, উত্তর দেওয়ার মতো শব্দ নেই তার কাছে— কারণ সে কিছুই ভুলে যায়নি। সেই কাঁচের জানালার ওপারে ভেজা শহর, সেই চিত্রাঙ্গদার সংলাপ, সেই অসমাপ্ত কবিতা, রেলস্টেশনের সেই ট্রেন— সব যেন একে একে ফিরে আসছিল মনে। “ভুলিনি,” সে বলল না, শুধু একরকম মৃদু হাসল— যেন স্মৃতিকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। সৃজা তখন জানালার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “ভুলে গেলে ভালো হতো… কিন্তু তুমিই তো শিখিয়েছিলে— কিছু অনুভবের মৃত্যু হয় না।” এর পর আর কিছু বলা হয়নি। দুজনেই জানত, এই দেখা কোনো উত্তর দিতে আসেনি, বরং শুধু জানতে চেয়েছিল— তাদের হৃদয়ের কোনো কোণ আজও খালি আছে কি না। বৃষ্টির শব্দ তখন আরও ভারী, বাইরে অন্ধকার নামে নামতেই তাদের দুজনের কফির কাপ ফাঁকা হয়ে যায়। বিদায় জানাবার সময় কেউ হাত বাড়ায় না, কেউ জড়িয়ে ধরে না, কেউ কাঁদে না— শুধু চোখের গভীর দৃষ্টিতে একটা অনুচ্চারিত সংলাপ ভেসে ওঠে— “তোমায় হারাইনি… শুধু পেয়ে উঠিনি।”

পাঁচ

দক্ষিণ কলকাতার এক ছিমছাম লেনের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলে একটা ছোট্ট দোতলা বাড়ি চোখে পড়ে, সামনে কয়েকটা গাছ, কিছু ছোটো ছোটো বাচ্চা খেলে বেড়াচ্ছে বারান্দার নিচে। সেখানেই এখন সৃজার দিন কাটে— সে এখন একটি ছোটো NGO চালায়, যেটি পথশিশুদের শিক্ষাদান, পুষ্টি এবং নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কাজ করে। এই কাজটাকেই সে আজ তার অস্তিত্বের স্বরূপ করে তুলেছে, যেন জীবনের অসমাপ্ততা গুলোকে ঢেকে দিতে পারে কিছু সুচিন্তিত ভালোবাসায়। সকাল থেকে সন্ধে সে ব্যস্ত থাকে— কখনো বাচ্চাদের আঁকাবাঁকা হোমওয়ার্ক দেখে, কখনো নতুন ফান্ডিং-এর জন্য মিটিং করে, আবার কখনো টিনের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে শোনে কারও চোখের জলভেজা গল্প। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়, সৃজা যেন একদম বদলে গেছে— তাকে ঘিরে একটা পরিণত, শান্ত আভা, চোখে গভীর অভিজ্ঞতা, আর মুখে একটা অন্যমাত্রার সংযম। কিন্তু ভিতরের যে ঝড়, তা কেউ টের পায় না। সকাল থেকে রাত অবধি সে মুখে হাসি রাখে, ধৈর্য ধরে বোঝায় সবাইকে, কিন্তু রাতে একা বিছানায় শুয়ে থাকলে কোনো এক অতীত গানের কলি বারবার কানে বাজে— “ভুলতে পারিনি যে তোমায়, তাই এই বেদনায় থাকি…”।

তার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর আগে। স্বামী সুজন একজন কর্পোরেট প্রফেশনাল, নিজের দুনিয়ায় ব্যস্ত, হিসেবের অঙ্কে বাঁধা। প্রথমদিকে হয়তো ভালোবাসা ছিল, নাকি ছিল সামাজিক চাহিদার নিঃশব্দ সম্মতি— সেটা সৃজা আজ নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ধীরে ধীরে সম্পর্কটা একধরনের সহাবস্থানে পরিণত হয়েছে— দুজনে একসঙ্গে থাকে, একই ছাদের নিচে, কিন্তু দুটি সম্পূর্ণ আলাদা নদীর মতো। কথা হয়, কিন্তু মন খুলে নয়। একসঙ্গে খাওয়া হয়, কিন্তু চোখে চোখ পড়ে না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সৃজা জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে অন্ধকার— অনেকটা নিজের মনের মতো। সম্পর্ক শীতল হয়ে গেছে, কিন্তু ভাঙেনি— কারণ ভাঙলে আর কিছুই থাকবে না ধরে রাখার মতো। সৃজা নিজেকে বোঝায়— হয়তো সব সম্পর্কেই এমন সময় আসে, হয়তো এটাই পরিণতি। তবুও তার ভিতরে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে— যদি ঋভুর সঙ্গে থাকা যেত? যদি সেই ট্রেন না ছাড়ত? যদি একটা ফোনcall হয়ে যেত সেদিন? কিন্তু সে জানে, প্রশ্নগুলো অবান্তর, কারণ সময় কাউকে ফিরে পেতে দেয় না। সে চেষ্টা করেছে ভুলে যেতে— খুব চেষ্টা। সৃজার স্মৃতির বাক্সে থাকা চিঠিগুলো, পুরোনো ফটোগুলো, নাটকের স্ক্রিপ্ট— সব সে দূরে সরিয়ে রেখেছে, কিন্তু এক একটা নির্জন দুপুর, এক একটা বৃষ্টিভেজা জানালা, অথবা হঠাৎ কোনো অচেনা গন্ধ, তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই সময়ের কাছাকাছি। সে তখন আবার ঋভুর পাশে হাঁটে, কলেজের করিডোরে, বা বসে থাকে লিটল ম্যাগাজিন মেলার চত্বরে— মন তার ভুলে যায় এখনকার ঠিকানা।

এক সন্ধ্যায়, NGO-র অফিস ঘরে বসে, কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে সৃজা থেমে যায়। বাইরের বৃষ্টির শব্দ, আর এক শিশুর কাশি, তার মনকে একটু নরম করে দেয়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে নিজের ডায়েরিটা টেনে নেয়— অনেকদিন ধরে খুলে দেখা হয়নি। পুরোনো এক পৃষ্ঠায় একটা লাইন লেখা— “ভুলে যাওয়ার চেয়ে মনে রাখা বেশি কষ্টের, কিন্তু কখনো কখনো সেই কষ্টই বেঁচে থাকার প্রেরণা।” সে জানে এই লাইনটা লিখেছিল সেই সন্ধ্যায়, যেদিন শেষবার ঋভুকে দেখেছিল। চোখে জল আসে না, কারণ কান্নাও আজকাল আর আসে না। শুধু গভীর একটা নিঃশ্বাস পড়ে— সময়ের ভেতর লুকানো এক দীর্ঘশ্বাস। তখনই সে এক বন্ধুকে ফোন করে হঠাৎ বলে ফেলে— “আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম ভুলে যেতে… পারিনি।” কণ্ঠে কোনো আড়াল ছিল না, কোনো নাটকও নয়— একেবারে খাঁটি স্বীকারোক্তি। বন্ধুটি অবাক হয়ে যায়, কারণ সৃজাকে তো সে সবসময় দেখে এসেছে দৃঢ়, স্থির, সমস্ত কিছুকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এমন। কিন্তু কেউ জানে না, ভিতরে কতখানি ভাঙন জমে থাকে দিনের পর দিন। এই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় সৃজা ঠিক করে— সে আর ভুলে যাওয়ার অভিনয় করবে না। হয়তো স্মৃতিকে ভুলে থাকা যায় না, কিন্তু তাকে আপন করে নেওয়া যায়— একটা শান্ত, চুপচাপ ভালোবাসার মতো। সে জানে, আগামীকাল সকালেও তাকে কাজে যেতে হবে, বাচ্চাদের পড়াতে হবে, হাসিমুখে বলতেই হবে— “তোমরা ভালো থেকো।” কিন্তু আজ রাতে সে জানালার পাশে বসে এক কাপ গরম চায়ে চুমুক দিয়ে মনে মনে বলবে— “তোমায় হারাইনি… শুধু দূরে সরে গিয়েছি।”

ছয়

সন্ধ্যার আলতো আলোয় ঋভুর ঘরটা ধীরে ধীরে ভরে উঠছিল নিঃশব্দতায়। চারপাশে বইয়ের গন্ধ, এক কোণে রাখা ল্যাম্পের হলদে আলো, আর টেবিলের ওপর খোলা একটা পুরোনো ডায়েরি — যেন ঘরটা নিজেই দাঁড়িয়ে আছে সময়ের সীমার বাইরে। বাইরে হালকা বাতাস বইছে, জানালার পর্দা নড়ে উঠছে মাঝে মাঝে, আর সেই ছন্দেই ঋভুর আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ডায়েরির পাতাগুলো উল্টে যাচ্ছিল। প্রতিটি পাতায় লেখা কবিতার লাইন, কোনোটা অসমাপ্ত, কোনোটা কাটাছেঁড়া, আবার কোনোটা ভেতরে অজস্র অনুভূতির গোপন সংকেত। সে জানে এই ডায়েরি সে বহুদিন খুলে দেখেনি— নিজেই যেন ইচ্ছা করে ভুলে গিয়েছিল তার অস্তিত্ব। কিন্তু আজ রাতে, এক অদৃশ্য টান তাকে ফিরিয়ে এনেছে সেই অতীতের কাব্যিক করিডোরে, যেখানে শব্দগুলো একসময় নিঃশব্দ ভালোবাসা হয়ে বেঁচে ছিল। তার আঙুল থেমে যায় একটা পাতায়, যেখানে লেখা কবিতার শেষ লাইনে কেউ যেন নিঃশব্দে কেঁদে ফেলেছে—
“তুই গেলে বৃষ্টি থেমে যায় না,
কেবল রোদ আর ফোটে না আর কোনো দিন।”

ঋভুর চোখ আটকে যায় সেই কবিতার দিকে— এটা সেই কবিতা, যেটা সে কোনোদিন কাউকে দেখায়নি, কোনো পত্রিকায় ছাপেনি, এমনকি কোনো বন্ধুকেও শোনায়নি। কবিতার তারিখ দেখে সে বুঝতে পারে, এটা লেখা হয়েছিল সৃজার চলে যাওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পর। ওই সময়টা যেন কোনো কালো ছায়া ছিল তার জীবনে, যেখানে প্রতিটি দিন ছিল নির্জন, প্রতিটি রাত ছিল অপেক্ষার বিষাদে মোড়া। কবিতার লাইনগুলো পড়তে পড়তে তার চোখে যেন ঝাপসা ভেসে ওঠে সেই পুরোনো সময়— কলেজের গ্রন্থাগার, বারান্দার ধারে বসা সৃজা, তার চোখে ঘোরলাগা দৃষ্টি, আর প্রতিটি কথার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা না-বলা ভালোবাসা। সেই দিনগুলো এখন আর নেই, কিন্তু কবিতার শব্দগুলো সেই স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনে একেবারে স্পষ্টভাবে। এই কবিতায় সে কোনো ছন্দের খেয়াল রাখেনি, কোনো অলংকার বসেনি— বসেছে শুধু নিঃসঙ্গ হৃদয়ের কান্না। সে বুঝে নেয়, সৃজা শুধু একজন মানুষ নয়— সে তার জীবন থেকে চলে যাওয়া এক ঋতুর নাম, সে এক শ্রাবণের প্রতিচ্ছবি, যে বৃষ্টি আনে, কিন্তু সবসময় সঙ্গে করে নিয়ে যায় না শান্তি। সৃজা হয়ে দাঁড়ায় এক অনির্বচনীয় উপস্থিতি— যে কাছেও থাকে, দূরেও।

সেই মুহূর্তে ঋভু টের পায়, যত কবিতা সে জীবনে লিখেছে, তার মধ্যে অধিকাংশই হয়তো সৃজার জন্যই— কখনো সচেতনভাবে, কখনো না-জানায়। সে ভাবে, ভালোবাসা হয়তো এমনই— চলে যাওয়ার পরেও থেকে যায় শব্দে, বাক্যে, নিঃশ্বাসে। ডায়েরির পাতায় সে আরও কিছু কবিতা দেখে— একটা কবিতার নাম ছিল “তুই ফিরে আসবি না জানি, তবু আমি অপেক্ষায় থাকি”, অন্য একটা শুরু হয়েছে এমনভাবে— “আজও চায়ের কাপের ধোঁয়া দেখে তোর গালভর্তি হাসি মনে পড়ে।” এসবই তো আসলে সৃজাকে লেখা চিঠি, যেগুলো সে কোনোদিন পাঠায়নি, শুধু কাগজের গায়ে রেখে দিয়েছে। হঠাৎ করে মনে পড়ে যায়— একবার সৃজা বলেছিল, “তোর লেখা পড়ে আমার কান্না আসে না, মনে হয় আমি সেই লাইনের ভেতরেই হাঁটছি…”। সেই কথা আজ এতদিন পর এসে যেন ফিরে আসে শব্দ হয়ে, গভীর রাতে। ঋভুর বুকের ভিতর একটা ভারি অনুভূতি জমে ওঠে— সে জানে, জীবনে হয়তো অনেক কিছু আসবে, নাম হবে, পরিচয় বদলাবে, কিন্তু সৃজাকে সে কোনোদিন সত্যিকারের ‘অতীত’ বলে মেনে নিতে পারবে না। সে সেই রকম এক স্মৃতি, যাকে ঝেড়ে ফেলা যায় না— শুধু একটু পরিপক্বতা নিয়ে গ্রহণ করতে হয়।

বাইরে বৃষ্টি পড়ে শুরু করেছে— ধীরে, টুপটাপ শব্দে। ঋভু জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়, এক কাপ চা হাতে, ডায়েরি বুকের কাছে চেপে ধরে। সেই মুহূর্তে তার মনে হয়, এই রাতটা শুধু তার নয়— এই রাত হয়তো সৃজারও। হয়তো দূরে কোথাও, অন্য কোনো শহরে, সৃজাও এখন একা, হয়তো তাকেও ছুঁয়ে গেছে বৃষ্টির জল, মনে পড়েছে কোনো না-বলা কবিতার পংক্তি। সে ভাবে, আজ যদি তারা মুখোমুখি হতো, কিছু বলার না থাকলেও, ডায়েরির এই কবিতাটা পড়িয়ে দিতে পারত সৃজাকে— শুধু একটা বার শুনিয়ে দিতে পারত, “তুই গেলেও, আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, এখনো আছি, শুধু ঠিকানাটা বদলে গেছে।” সে জানে, সৃজা আর ফিরে আসবে না, সম্পর্ক আর গড়বে না, কোনো মিলন দৃশ্য লিখবে না ভাগ্য। তবুও এই অলিখিত কবিতা, এই চুপচাপ হৃদয়স্বীকার— এসবই তো বেঁচে থাকার অক্সিজেন, যার ভেতর দিয়ে জীবনের রোদবৃষ্টিকে সহ্য করে নেওয়া যায়। রাতটা গভীর হচ্ছে, কিন্তু ঋভুর চোখে ক্লান্তি নেই— শুধু ডায়েরির পাতাগুলোয় আঙুল বুলিয়ে সে যেন খুঁজে নেয় সেই একটা অনুচ্চারিত কথা, যেটা সারা জীবন বলা হয়নি— “তুই আমার কবিতা হয়ে থাকিস, আমি তোকে আর মানুষের মতো হারাতে পারি না।”

সাত

বৃষ্টির রাত। বাইরের আকাশ ঝিমিয়ে পড়েছে শ্রাবণের এক গভীর নিস্তব্ধতায়। শহরের মাথার ওপর ছড়িয়ে আছে এক দগ্ধ মেঘের চাদর, আর তার নিচে কলকাতার পুরোনো বাড়ির চিলেকোঠায় বসে আছে ঋভু। চারপাশটা নিস্তব্ধ, কেবল জানালার গায়ে বৃষ্টির ফোঁটার টুপটাপ শব্দ এক আশ্চর্য সঙ্গীতের মতো বেজে চলেছে। এমন রাতে সে আর কিছু করে না — শুধু চুপ করে বসে, পুরোনো দিনের মত করে। তার সামনে খোলা সেই পুরনো রেডিওটা, যেটা কোনোদিন ফেলে দিতে পারেনি। রেডিওটা চালু করতেই ভেসে আসে একটি পুরনো গান, ভেসে আসে সেই অস্পষ্ট অথচ চেনা কণ্ঠস্বর — “আজ এই বৃষ্টির কান্না…”। গানটা বাজতে বাজতে ঋভুর মনে এক অদ্ভুত কাঁপুনি জাগে। এই গানটা তারা কতবার শুনেছিল একসাথে! কলেজের দিনগুলোতে, যখন শ্রাবণ মানে ছিল ছাতা না নিয়ে বেরিয়ে পড়া, ভিজে পথ ধরে হাঁটা, একটা হাফ কাপ কফি ভাগ করে খাওয়া। জানালার কাঁচে হাত রেখে সৃজা বলত, “ঋভু, তুমি কবিতা লেখো, আমি পড়ব চুপচাপ। কিছু বলব না। শুধু বোঝার চেষ্টা করব তোমার ভেতরের কথা।” এখন, দশ বছর পর, সেই গানের সাথে সেই কণ্ঠস্বর, সেই জানালার বৃষ্টি, সব যেন মিলেমিশে এক অলৌকিক অনুভূতি হয়ে ওঠে।

ঋভু জানালার পাশে বসে তার চিরপরিচিত খাতা খুলে নেয়। বাঁধাই করা খাতা, যার প্রতিটি পাতায় ছড়িয়ে আছে জীবনের টুকরো টুকরো সময়। আজ এই রাতে, কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো ব্যস্ততা নেই — শুধু সে, তার কলম, জানালার বাইরে পড়ে চলা বৃষ্টি আর রেডিওর পুরনো গান। কলমের কালো কালি ছুঁয়ে সে লিখে চলে এমন কিছু যা বলা হয়নি কোনোদিন। সৃজার চলে যাওয়ার পর এই প্রথম এমনভাবে বৃষ্টি নামছে যেন আকাশ নিজেই কিছু বলতে চাইছে। তার লেখার মাঝে উঠে আসে সেই পুরনো সব দৃশ্য — কলেজের সেই অডিটোরিয়ামের খোলা দরজা, ভিতরে চলছিল নাটকের রিহার্সাল, আর সৃজা পরছিল চিত্রাঙ্গদার সংলাপ। সে তখন ছায়ার মতো বসে, চুপ করে তাকিয়ে থাকত। বা হয়তো সেই দিন, যখন রেলস্টেশনের ভিড়ের মধ্যে সৃজা বলেছিল, “যদি একদিন ফিরে আসি, চিনতে পারবে তো?” — সেই প্রশ্নটা এত বছর পরেও ঋভুর মনে কাঁপুনি ধরায়। বৃষ্টির রাত যেন সেই প্রশ্নের প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসেছে। তার কবিতা আজ আর কাগজে আটকে নেই, তার শব্দেরা যেন জানালার ফোঁটার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, বাতাসে ভেসে যাচ্ছে সেই অতীতের দিকে, যেখানে তারা একসাথে ছিল, এবং ভালোবাসা ছিল ভাষাহীন অথচ নিবিড়।

রেডিওতে তখনো সেই গানটা বেজে চলেছে, হালকা শব্দে, যেন জানে, এই ঘরে কেউ এখনো অতীতের কোনো গন্ধ খুঁজছে। ঋভু কবিতা থামায় না — আজ কোনো ছন্দ, কোনো রীতি মানছে না সে। কেবল লিখছে। বারবার মনে পড়ছে সৃজার সেই চোখের চাহনি, যেটা বলত — “আমায় বোঝার চেষ্টা করো না, আমায় শুধু অনুভব করো।” সে এখন বুঝতে পারে, সৃজা কেবল একজন মানুষ ছিল না — সে এক ঋতু ছিল, এক নামহীন আবেগ, এক অপূর্ণ স্বপ্ন, যা প্রতিবার বৃষ্টি নামলে ফিরে আসে। তার অস্তিত্ব এখনো ছড়িয়ে আছে বাতাসে, জানালার গায়ে জমে থাকা ফোঁটায়, রেডিওর নিঃশব্দ বিরতিতে। “আজ এই বৃষ্টির কান্না…” — গানটা যখন শেষ হয়, ঋভুর কলমও এক জায়গায় থেমে যায়। সে জানে, এই রাত পেরোলেই আবার ভোর হবে, আবার বাস্তবতার কোলাহল ঘিরে ধরবে তাকে। কিন্তু এই মুহূর্ত, এই জানালা, এই বৃষ্টি, আর সেই কণ্ঠস্বর — এগুলোই তো তার সত্যি, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা। এক অলিখিত প্রেম, যেটার কোনো নাম নেই, কোনো ঠিকানা নেই — শুধু আছে তার হৃদয়ের গভীরে, সৃজার নামে।

আট

বৃষ্টিটা তখন ধীরে ধীরে পড়ছে — না ততটা ভারী, না একেবারে গুঁড়ি গুঁড়ি — ঠিক যেমন হয়, যখন শহর ক্লান্ত হয়ে পড়ে দিনের শেষে, আর আকাশ কাঁদে খুব চুপিচুপি। কলেজ স্ট্রিট থেকে শ্যামবাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল ঋভু। কোনো গন্তব্য ছিল না আজ, কেবল হাঁটতে ইচ্ছে করছিল, বহুদিন পর। ভিজতে ইচ্ছে করছিল—অকারণেই, যেন পুরোনো কোনো কিছু ধুয়ে ফেলার চেষ্টা। রাস্তার এক কোণে হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ছায়া—একটা ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে কেউ তাকিয়ে আছে। ছাতার নিচে সেই মুখ—যে মুখ সে ভুলতে চেয়েছিল, ভুলতে পারেনি কখনো। সৃজা। দশ বছর পর, হঠাৎ করে। কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই। সৃজা কি অবাক হয়েছিল? সেটা বোঝা যায়নি—চোখে ছিল অদ্ভুত এক শান্তি, বা হয়তো বিস্ময়, যা মুখের ওপর এক ঝাপসা ভাব রেখে দিয়েছিল। সাদা কুর্তি, নীল দোপাট্টা, আর সেই পুরোনো হাঁটাচলার ছন্দ—সেই একই রকম। দু’জনেই দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ, মুখে কোনো শব্দ নেই, শুধু চোখে চোখ রাখা। এক মুহূর্তে ছাতাটা সৃজার হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে ছায়া ফেলল ঋভুর মাথার ওপর। আর তখনই, যেন দু’জনে একইসঙ্গে হাঁটতে শুরু করল—নির্বাক, নিঃশব্দ, কিন্তু ছন্দে, যেন আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।

বৃষ্টি তখন ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের পায়ের আওয়াজ থেমে না — বরং প্রতিটি ধাপ যেন জুড়ে দিচ্ছিল তাদের মাঝে হারিয়ে যাওয়া সময়গুলোকে। তারা হেঁটে চলেছিল কলেজ স্ট্রিটের ভাঙা পাথরের গলি ধরে, যেখানে একসময় সৃজা বলেছিল, “তুমি কীভাবে এমন লিখতে পারো, ঋভু? এতখানি গভীরতা আসে কোথা থেকে?” সেই গলিতেই আজ আবার শব্দেরা ফিরে আসছে, তবে এবার আর কবিতার ভেতর নয় — বাস্তবের নিঃশব্দ উচ্চারণে। অনেকক্ষণ পরে, সৃজা বলল, খুব ধীরে, “ভিজছো কেন?” ঋভু হেসে বলল, “ভিজলে বুঝি মনে পড়ে যায় অনেক কিছু।” আর তুমিও তো ছাতা আনো সবসময়… তার কথাটা আর বলা হয়নি। সৃজার চোখে তখন একচিলতে হাসি, যেন তীব্র অনুভবের নিচে লুকানো ক্লান্তি। তারা হাঁটছিল—দুজনেই জানে, এই দেখা অনির্ধারিত, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। যেন এমন একটি অধ্যায়, যা লেখা হয়নি কোনোদিন, এখন তারই অসমাপ্ত বাক্যগুলো জুড়ে দিচ্ছে সময়। সৃজা বলে, “আমরা তো একসঙ্গে থাকতেই পারতাম, শুধু একটু সাহস দরকার ছিল।” ঋভু একটুও থামে না, শুধু বলে, “তুমি কি কখনো ভুলেছ?”—একটা চুপচাপ প্রশ্ন, যার উত্তর সৃজার ঠোঁট ছুঁয়ে বেরিয়ে আসে, নিঃশব্দে, “ভুলিনি…”

কথাগুলো বাতাসে মিলিয়ে যায়, কিন্তু ঋভু বুঝতে পারে, এত বছর পর সেই স্বীকারোক্তিটাই ছিল সবচেয়ে সত্যি। তারা তখনো হাঁটছিল—একটু একটু করে শহরকে পিছনে ফেলে। পায়ে জমে থাকা কাদা কিংবা বৃষ্টির ফোঁটা আর গায়ে লাগছিল না—কারণ তাদের ভেতরের আবেগ সেই বাইরের পৃথিবীকে ঢেকে দিচ্ছিল। সৃজা বলে, “আমি অনেকবার ভেবেছি, যদি একদিন হঠাৎ আবার দেখা হয়, কী বলব তোমায়। কিছুই ভাবা হয়নি শেষমেশ। শুধু মনে হতো, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে যদি বলতে পারি—‘ভুলিনি’, তাহলেই হবে।” ঋভু একটানা হাঁটতে হাঁটতে বলে, “আমি কোনোদিন চাইনি তুমি আমার কবিতার লাইন হয়ে যাও। চাইছিলাম, তুমি হও আমার প্রতিটি লাইনের অর্থ।” তারা দাঁড়ায় একবার, এক পুরনো লাইব্রেরির সামনে, যেটার দেওয়ালে এখনো রয়ে গেছে তাদের কোনো এক সময়ের খোদাই করা নাম—‘ঋভু + সৃজা’। সৃজা সেই নাম ছুঁয়ে বলে, “দেখো, সময় শুধু গায়ে ধুলো বসায়। মুছে দিতে পারে না।” আর তখন তারা একসাথে হাঁটতে থাকে আবার, এবার আর কোনো গন্তব্যের কথা না ভেবে—শুধু হেঁটে যাওয়া, যেন হাঁটতে হাঁটতেই কিছুটা দূরত্ব ঘোচে। বৃষ্টি অনেক আগেই থেমেছে, কিন্তু তাদের ভিতরে তখনো এক অদৃশ্য শ্রাবণ পড়ে চলেছে—ভিতরের, নিঃশব্দ, অথচ গভীর।

নয়

সকালটা ছিল খুব সাধারণ, ঠিক যেমন হয় একটা শ্রাবণের শেষভাগে — আকাশ মেঘে ঢাকা, বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ, আর জানলার বাইরে থেমে থেমে গাছের পাতায় জমে থাকা জলের ফোঁটা টুপটাপ পড়ে চলেছে নিচে। ঋভু ঘুম থেকে উঠেছিল একটু দেরিতে। রাতের ঘুমটা ছিল ভারী, যেন ক্লান্তি জমে উঠেছিল শরীরের গভীরে। চোখ খুলেই সে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, অভ্যাসবশে, যেখান থেকে একসময় বহু কবিতার জন্ম হয়েছিল—আর যেখান থেকে মাঝেমাঝে সে সৃজাকে দেখত, সাদাকালো স্মৃতির ভেতর দিয়ে। তখনো জানত না, নিচের ডাকবাক্সে জমে উঠেছে একটা চিঠি—শেষ শ্রাবণের, শেষ প্রতিশ্রুতির। কিছুক্ষণ পর, ঘরের কাজের মানুষটি এসে বলল, “বাবু, চিঠি এসেছে। হাতে লেখা… অনেকদিন পর।” ঋভুর বুকটা কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়। হাতে নিয়ে খামটা সে দেখল, লেখা আছে– শুধু এক লাইন, তার নাম, আর নিচে একটুকরো অচেনা কবিতা, যেন ছায়ায় ঢাকা। ভেতরে খুলে চিঠিটা বের করে যখন পড়তে শুরু করল, তখন যেন শব্দগুলো সরাসরি এসে বুকের ভেতর আঘাত করছিল। সেই হাতে লেখা অক্ষরে লেখা: “আমার শ্রাবণ তোমার কবিতায় থাকুক, বাস্তবে নয়। আমি বেঁচে থাকব, যদি তুমি লিখে যাও। দেখা হবে না আর… কখনো না।” শেষ লাইনে ছিল শুধু একটা তারিখ আর নিচে সাদা ফাঁকা কাগজ। কিছুই লেখা ছিল না আর, অথচ তার চেয়ে বেশি কিছু বলার ছিলও না বোধহয়।

চোখে যেন কিছুই স্পষ্ট ছিল না ঋভুর—সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে, যেমনটা হয় যখন বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তাকালে বাইরের দৃশ্য গলে যায় এক রঙিন অস্পষ্টতায়। চিঠিটা হাতে নিয়ে জানলার পাশে সে চুপ করে বসে পড়ে, পুরোনো কাঠের চেয়ারে, যে চেয়ারটা আজকাল সে ব্যবহার করে না—তবুও সে জানত, এমন দিন এই চেয়ারের জন্য অপেক্ষা করছিল বহুদিন ধরে। জানলার কাঁচে জলের রেখা গড়িয়ে পড়ছে নিচে, যেন বাইরের আকাশ তার জন্য কাঁদছে। সৃজা তাকে ছেড়ে গেল—কিন্তু এবার আর কোনো রাগ নেই, অভিমান নেই, এমনকি অভিযোগও নেই। শুধু একটা নরম যন্ত্রণা—যেটা কোনো কথা বলে না, কিন্তু ভিতরটা ফাঁপা করে দেয়। চিঠির প্রতিটি শব্দ ছিল নিঃশব্দে চিৎকারের মতো। ‘বাস্তবে নয়’—এই কথাটা বারবার ফিরে আসছিল মনে। সৃজা চায়, সে যেন তাকে শুধু কবিতায় রাখে, যেন তার শ্রাবণ থাকে শব্দে, অনুভবে, কিন্তু নয় জীবনের প্রতিদিনে। এ যেন এক চরম আত্মত্যাগ—নাকি এক নির্মম বাস্তবতা? ঋভু জানে না, তার শুধু মনে হচ্ছিল, এত কাছ থেকে কাউকে হারানো যায়? যাকে সে একদিন ধরে রেখেছিল আঙুলের ফাঁকে, তাকেই এখন শুধু অক্ষরের মধ্যে আটকে রাখতে হবে?

শ্রাবণ বৃষ্টির মতোই ঝরে পড়ছিল তার চোখে। ঋভু জানে, এই চিঠি কোনো বিদায় নয়—এ এক অব্যক্ত কবিতা, যেটা শেষ হয় না, কেবল থেমে যায় মাঝপথে। সে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল সৃজাকে—যেভাবে সে কথা বলত, যেভাবে হেসে বলত, “তুমি কবি হবে, ঋভু। তবে মনে রেখো, শব্দের থেকেও জীবন কঠিন।” সৃজার সেই কথা আজ যেন ব্যঙ্গ করছিল তাকে—কারণ তার জীবন এখন শুধুই শব্দের মধ্যে বাঁচবে, বাস্তব হারিয়ে যাবে সময়ের ফাঁকে। চিঠিটা আবার পড়ে, আবার… যতবারই পড়ে, ততবারই নতুন কিছু খুঁজে পায় সে। হয়তো সৃজা চায় না সে তাকে ভেবে স্থবির হয়ে যাক—বরং চায়, সে লিখে যাক, যেভাবে আগে লিখত, প্রতিটি শব্দে সৃজাকে রেখে। এ চিঠি বিদায়েরও নয়, আহ্বানেরও নয়—এ এক আত্মস্থ চূড়ান্ত সত্য, যা হয়তো কোনো এক পরিণতির ইঙ্গিত। ঋভু জানে, সে আজ যা হারাল, তা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, তবু সেই না-ফেরার মধ্যেও সে খুঁজে নেবে এক নতুন ‘থাকা’। হয়তো নতুনভাবে, নতুন ছন্দে, কিন্তু তবুও থাকবে। জানলার বাইরে তখন পাখিরা ডাকে, আর ভেজা হাওয়ায় ভেসে আসে শেষ শ্রাবণের সুর। সেই সুরে বসে থাকে ঋভু—একটা চিঠি হাতে, চোখে জল, আর মনে একটাই প্রার্থনা—সৃজা যেন তার প্রতিটি কবিতায় ফিরে আসে, যেমন সে ছিল—একজন বৃষ্টির মেয়ে, যে ভালোবাসত শব্দহীনভাবে ভালোবাসতে।

দশ

সময় চলে যায়, ঠিক যেমন শ্রাবণের বৃষ্টি একদিন নীরব হয়ে যায়, তেমন করেই। সৃজার চিঠির পরদিন, ঋভু জানালার পাশে বসে অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। দিনের আলো যেমন ধীরে ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকারে গড়িয়ে পড়ে, তার ভেতরেও যেন এক নিঃশব্দ সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। সেই সন্ধ্যায় সে প্রথম কলম ছুঁয়েছিল দীর্ঘদিন পর, অথচ লেখেনি একটাও শব্দ। শুধু ডায়েরির পাতায় কয়েকটা বিন্দু ঝরে পড়েছিল — হয়তো চোখ থেকে, হয়তো শ্রাবণ থেকে। এর পরের কয়েকদিনে সে নিজেকে ঘিরে রেখেছিল এক নিস্তব্ধে, বাইরে শুধু বৃষ্টি, ভিতরে এক অভ্যন্তরীণ ঝড়। তারপর এক সকালে, জানালার বাইরে মেঘ না থাকলেও, সে বসল লিখতে — নিজের জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ, সবচেয়ে গভীর, আর সবচেয়ে নিঃশব্দ কবিতাটি — যার নাম ছিল: “আমার ফেলে আসা শ্রাবণ”।

কবিতাটি ছিল না শুধুই প্রেমের; সেটি ছিল একটি সময়ের সঙ্গেও তার আত্মিক সম্পর্কের রোজনামচা। সেখানে ছিল কলেজের দিনের কথা, রেইন শেডের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি ছায়ামূর্তির কথা, সেই অসমাপ্ত চুম্বনের কথা যা তারা কখনো দিতে পারেনি, নাটকের মঞ্চে হাত ছুঁয়ে যাওয়ার শিহরণ, কফিশপের নিস্তব্ধতা, আর সর্বোপরি ছিল সেই বিদায়ী চিঠির শব্দ—“তুমি লিখে যাও, আমি বেঁচে থাকব।” কবিতার প্রতিটি পংক্তি যেন সৃজার নিঃশ্বাসে ভেজা, প্রতিটি স্তবক যেন একটি বৃষ্টিভেজা জানালার কাঁচ। ঋভু কবিতাটি প্রকাশ করল না সঙ্গে সঙ্গে। একদিন বহুদিন পর, এক তরুণ সম্পাদক এসে তার পাণ্ডুলিপি চাইলে, সে তাকে বলেছিল — “এটা শুধু কবিতা নয়, এটা একটা অসমাপ্ত জীবন।” তবু শেষ পর্যন্ত কবিতাটি প্রকাশিত হয়, এবং পাঠকরা অভিভূত হয়ে যায়। অনেকে চিঠি লেখে, বলে — এই কবিতায় তারা নিজের হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে খুঁজে পেয়েছে। কারও চোখ ভেজে, কারও কলম হাঁটে আবার।

তবে কেউ জানে না সেই কবিতার নায়িকা কে। কারো কাছে সে শুধু ‘শ্রাবণ’ — বৃষ্টির, বিরহের, স্মৃতির এক রূপক। কেউ জানে না, ‘শ্রাবণ’ একদিন ঋভুর জীবনে সত্যিই হেঁটে এসেছিল ছাতা মাথায়, ভিজে সালোয়ার-কামিজে, হেসে বলেছিল — “সবকিছু ভুলে গিয়েছো?” কেউ জানে না, যে ছেলেটি কবিতায় লিখেছে — “ভিজে জানালার ওপারে তুমি রইলে, আর আমি শুধু ছায়া”, সে একদিন সত্যি সত্যি ভিজে জানালার পাশে বসে ছিল একা। ঋভু জানে, সেই কবিতা সে নিজের জন্য লেখেনি। সে লিখেছিল একজনের হয়ে, একজনের কথা, একজনের অনুপস্থিতিকে স্বর দেয়ার জন্য। গল্পটি শেষ হয় না কোনো উল্লাসে, কোনো পুনর্মিলনে। বরং শেষ হয় এক মৃদু হাসিতে — ঋভুর ঠোঁটের কোণে। আর ঠিক তখনই জানালার ওপাশে পড়ে প্রথম শ্রাবণের ফোঁটা — যেন সে ফিরে এসেছে… কবিতার পাতায়, অথবা সেই অমোচনীয় অভ্যন্তরীণ ঋতুতে, যেটা শুধু হৃদয়ে নামে।

-শেষ-

1000050306.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *