Bangla - ভ্রমণ

আন্দামানের নির্জন দ্বীপ

Spread the love

ঋত্বিক দত্ত


পার্ট ১: যাত্রার প্রথম সকাল

শহরের ভিড়ভাট্টা থেকে সমুদ্রের দিকে যাত্রা শুরু করার মুহূর্তটাই যেন এক অদ্ভুত মুক্তি। কলকাতা বিমানবন্দরের জানালার কাচের ওপার থেকে ভোরবেলা আকাশের নীলচে আলো যখন সোনালি হতে শুরু করছিল, তখন আমার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক উৎকণ্ঠা কাজ করছিল। দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখেছিলাম আন্দামান যাওয়া হবে—কেবল হাভলক বা নীল দ্বীপের সমুদ্রস্নান নয়, আমি চেয়েছিলাম খুঁজে বের করতে অজানা এক কোণ, যেখানে পর্যটকদের কোলাহল নেই, নেই রঙিন বিজ্ঞাপনমাখা হোটেলের ছায়া, আছে কেবল নির্জনতার ঘন অরণ্য আর সমুদ্রের শ্বাস।

বিমান মেঘ কাটিয়ে নামতে শুরু করতেই জানালার বাইরে নীলের উপর সবুজের ছোপ দেখা গেল। দূর থেকে যেন অসংখ্য পাথরের উপর শ্যাওলা গজিয়েছে। এগুলোই দ্বীপ—সমুদ্রের বুকে ভেসে থাকা অচেনা ভূমি। পাশে বসা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, যিনি দেখতে স্থানীয় বলেই মনে হলো, হাসিমুখে বললেন, এগুলো ছোট ছোট দ্বীপ, কিছু জনমানবহীনও। অনেকের নামও নেই।” তার কণ্ঠে ছিল একরাশ সহজতা, যেন প্রকৃতি আর মানুষের মাঝের সেতু তিনি সহজেই বুঝে ফেলেন।

পোর্ট ব্লেয়ারে নামতেই ভিন্ন এক গন্ধ নাকে এল। আর্দ্রতার মধ্যে লবণ, শৈবালের ঝাঁঝ, আর কোথাও যেন ভিজে কাঠের মতো এক ঘ্রাণ। শহরটি ছোট, তবে ভেতরে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা। রঙিন দোকানপাট, মাছভাজা আর নারকেলের পানির ডাক—সব মিলিয়ে পরিবেশ যেন এক অন্য জগতের সূচনা।

কিন্তু আমার মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরছে—কোথায় সেই দ্বীপ? স্থানীয়দের কাছে আগেই শুনেছিলাম এক রহস্যময় দ্বীপের কথা, যেটা নাকি মানচিত্রে খুব একটা চিহ্নিত নয়। ওখানে পৌঁছতে হলে সরকারি ফেরি নয়, বরং স্থানীয় মাঝিদের সঙ্গে যেতে হয়। তবে পথটা সহজ নয়, আর আবহাওয়ার মর্জির উপর নির্ভর করে।

হোটেলে চেক-ইন করার পরপরই আমি বেরিয়ে পড়লাম জেটির দিকে। সাগরের ঢেউয়ে বাঁধা ছোট ছোট নৌকা, জেলেদের ব্যস্ততা, আর পর্যটকদের গলার আওয়াজ মিশে একাকার। আমি খুঁজছিলাম এমন কাউকে যে আমাকে গোপন দ্বীপের গল্প শোনাতে পারে। কয়েকজন মাঝিকে জিজ্ঞাসা করতেই কেউ হেসে উড়িয়ে দিল, কেউ বলল “ওসব গুজব”, আবার কেউ চুপ করে রইল। অবশেষে এক রোদপোড়া মুখের মানুষ—নাম তার মনোজ—কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর জিজ্ঞাসা করল, আপনি কেন ওখানে যেতে চান?”

প্রশ্নটার ভেতর ছিল অবিশ্বাস আর সতর্কতা। আমি বললাম, আমি লেখালিখি করি। ভ্রমণকাহিনি লিখি। অচেনা জিনিসের খোঁজ করি। শুনেছি সেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু লুকোনো কাহিনি আছে।”

মনোজ চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, সব গল্প কাগজে লেখা যায় না। কিছু গল্প সমুদ্রেই রয়ে যায়।” তার এই কথার মধ্যে অদ্ভুত এক রহস্য লুকিয়ে ছিল।

আমরা নৌকার ধারে বসে নারকেলের জল খেলাম। সে আমাকে জানাল, কয়েক ঘণ্টার যাত্রা, আরেক সমুদ্রপথে পৌঁছতে হবে। দ্বীপে কোনো লোকালয়ের অস্তিত্ব নেই, কেবল ঘন অরণ্য আর কিছু ভগ্নপ্রায় কাঠামো। মনোজের দাদু নাকি ব্রিটিশ আমলে সেখানে জেলেদের সঙ্গে কাজ করতেন। তখন থেকেই দ্বীপটিকে ঘিরে নানা গুজব—কেউ বলে সেখানে অভিশপ্ত সৈনিকদের আত্মা ঘুরে বেড়ায়, কেউ বলে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা গোপনে সেখানে লুকিয়ে থাকত।

গল্প শোনার পর আমার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। আমি অনুরোধ করলাম আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে। প্রথমে সে অস্বীকার করল, কিন্তু আমার জেদের কাছে শেষে রাজি হলো, তবে শর্ত দিল—আপনি যা দেখবেন, সবটা না লিখলেও চলবে। কিছু জিনিস নিজের কাছে রাখবেন।”

সন্ধেবেলা সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে আমি দেখছিলাম সূর্যের ডোবা। লালচে আলো সমুদ্রের উপর ছড়িয়ে পড়ছে, ঢেউয়ের ছন্দ যেন আরও ধীর হয়ে আসছে। আমার মনে হচ্ছিল, সত্যিই কি আমি এমন এক অভিযাত্রায় নামতে চলেছি, যেখানে শুধু প্রকৃতি নয়, ইতিহাস আর রহস্যও হাতছানি দিচ্ছে?

রাতের হাওয়া ভারি হয়ে উঠল। হোটেলের জানালা দিয়ে সমুদ্রের শব্দ ভেসে আসছে। দূরে কোথাও নৌকার ইঞ্জিনের আওয়াজ, মাঝেমধ্যে কুকুরের ডাক। আমি খাতা খুলে লিখতে বসলাম—যাত্রার শুরু মানেই নতুন গল্পের বীজ। হয়তো কাল থেকেই শুরু হবে সেই দ্বীপের পথে যাত্রা, হয়তো কালই আমি আবিষ্কার করব এমন এক অধ্যায়, যা কোনো মানচিত্রে নেই, কেবল মানুষের স্মৃতি আর কল্পনায় আছে।

পার্ট ২: দ্বীপের পথে নৌযাত্রা

সকালের প্রথম আলো যখন জেটির উপর পড়ছিল, আমি তখন মনোজের নৌকার সামনে দাঁড়িয়ে। সারা রাত ঠিক মতো ঘুম হয়নি, মাথায় বারবার ঘুরছিল অজানা সেই দ্বীপের ছবি। মনে হচ্ছিল এ যেন কেবল ভ্রমণ নয়, কোনো এক অদ্ভুত অনুসন্ধানের শুরু।

মনোজ আগেভাগেই এসে নৌকাটাকে তৈরি করে রেখেছে। কাঠের গায়ে লবণ জমে সাদা হয়ে আছে, তবু তার চোখে একরাশ নির্ভরতা। সে আমাকে একবার দেখেই বলল, আজ সমুদ্র শান্ত আছে। তবে দুপুরের পর হাওয়ার দিক বদলাতে পারে।”

আমি ব্যাগটা নৌকার ভেতর রাখতেই ঢেউয়ের টান অনুভব করলাম। ছোট ছোট মাছের ঝাঁক পানির উপর ঝিলমিল করে উঠছে। দূরে পোর্ট ব্লেয়ারের শহরটাকে তখনও ঘুমন্ত মনে হচ্ছিল, অথচ আমার ভেতর উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছিল।

নৌকা ধীরে ধীরে ছাড়ল। সমুদ্রের উপর ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছে, চারপাশের জল যেন রূপার মতো চকচক করছে। মনোজ চুপচাপ বৈঠা চালাচ্ছিল, মাঝে মাঝে ইঞ্জিন চালু করছিল। আমি তাকে প্রশ্ন করতে চাইলেও সে প্রথমে কোনো উত্তর দিল না, যেন শব্দের চেয়ে ঢেউয়ের আওয়াজই বেশি দরকার।

কিছুক্ষণ পর সে বলল, আমার দাদু বলত, সেই দ্বীপে ব্রিটিশরা বন্দীদের নিয়ে যেত। কিন্তু সেলুলার জেলের মতো বড় কোনো কাঠামো ওখানে হয়নি। হয়তো কিছু অস্থায়ী ঘর, হয়তো জঙ্গলের মধ্যে গোপন কোনো আস্তানা। এখন সব ধ্বংস হয়ে গেছে।”

আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। ব্রিটিশ আমলে আন্দামান মানেই তো সেলুলার জেলের দুঃখগাথা। তবে এর বাইরে যদি কোনো অজানা জায়গা থাকে, তবে সেটা ইতিহাসের গোপন অধ্যায়।

নৌকা যত এগোতে লাগল, ততই চারপাশের সমুদ্র বদলে যাচ্ছিল। একসময় নীল জলের রং গাঢ় সবুজ হয়ে উঠল। হাওয়ার আর্দ্রতা বাড়ছিল, আর দূরে অরণ্যের রেখা দেখা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সমুদ্র আর জঙ্গল যেন একে অপরকে জড়িয়ে আছে।

মনোজ আমাকে ইশারা করে দেখাল, ওইদিকে দ্বীপ।”

আমি তাকিয়ে দেখি—দূরে এক অদ্ভুত নীরব দ্বীপ দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোলাহল নেই, কোনো নৌকার চলাচল নেই। কেবল ঘন অরণ্য আর কালো শ্যাওলাধরা পাথর। দ্বীপটিকে দেখে মনে হলো সমুদ্রের বুকের উপর একরাশ রহস্য দাঁড়িয়ে আছে।

আমার বুকের ভেতর হঠাৎ অজানা ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা কাজ করল। নৌকা যত কাছে যাচ্ছে, ততই মনে হচ্ছিল আমি এক নিষিদ্ধ ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে চলেছি।

মনোজ বলল, এখানে লোকজন খুব একটা আসে না। জেলেরা আসে, তবে খুব কম। অনেকেই বলে রাতে এখানে অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়। কারও কারও মতে সেই শব্দ বন্দীদের কান্না।”

তার কথা শুনে শরীর কেঁপে উঠল। কিন্তু একই সঙ্গে মনে হলো এটাই তো আমি খুঁজছিলাম—অজানা, অচেনা, এবং রহস্যময়তার ভেতর দিয়ে ভ্রমণের আসল স্বাদ।

নৌকা দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছতেই ঢেউয়ের গতি বেড়ে গেল। পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ছে জল, শব্দে চারপাশ ভরে উঠছে। মনোজ সাবধানে নৌকাটাকে একটি ছোট খাঁড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিল। ভেতরে ঢুকতেই যেন হঠাৎ শান্তি নেমে এলো। ঢেউয়ের শব্দ কমে গিয়ে কেবল অরণ্যের ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল।

আমরা নৌকা থেকে নামলাম। চারপাশে যতদূর চোখ যায় কেবল ঘন জঙ্গল। বাতাসের মধ্যে ছিল আর্দ্রতা আর এক ধরনের শ্বাসরুদ্ধকর গন্ধ। যেন বহুদিন ধরে জমে থাকা ইতিহাসের ছায়া বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

মনোজ একটা ছোট পথ দেখিয়ে দিল, যেটা জঙ্গলের ভেতর ঢুকেছে। বলল, এটাই একমাত্র পথ। তবে সাবধানে চলবেন। এখানে সাপও আছে।”

আমি পথ ধরে এগোতে শুরু করলাম। গাছপালার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে সূর্যের আলো এসে পড়ছিল, কিন্তু বেশিরভাগ জায়গা অন্ধকারে ঢেকে ছিল। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, অচেনা পাখির আওয়াজ আর মাটির উপর ভেজা পাতার গন্ধ। মনে হচ্ছিল আমি সভ্যতা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি।

হঠাৎ একটা জায়গায় পৌঁছে দেখি, ভাঙা পাথরের দেয়ালের মতো কিছু আছে। কাছে যেতেই বোঝা গেল এটা আসলে পুরনো কোনো কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ। অর্ধেক মাটির নিচে ডুবে গেছে, অর্ধেক শ্যাওলায় ঢেকে আছে।

মনোজ নিঃশব্দে বলল, এটাই দাদুর বলা জায়গা। ব্রিটিশরা এখানে বন্দীদের রাখত। তবে দীর্ঘদিন ধরে কেউ নিয়ে কিছু বলেনি। সরকারও জানে না।”

আমি দেয়ালের কাছে গিয়ে হাত রাখলাম। ঠান্ডা, ভিজে, আর অদ্ভুত রুক্ষ অনুভূতি। যেন এই দেয়াল এখনো সেই দিনের আর্তনাদ নিজের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছে।

চারপাশ হঠাৎ আরও নীরব হয়ে গেল। বাতাস থেমে গেল, পাখিদের ডাক মিলিয়ে গেল। আমি অনুভব করলাম, এই দ্বীপে কেবল ইতিহাস নয়, আরও কিছু আছে—যা বোঝা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়।

পার্ট ৩: দ্বীপের গভীরে

জঙ্গলের ভেতর পা বাড়াতেই চারপাশের হাওয়া বদলে গেল। সমুদ্রের গর্জন এখানে এসে থেমে গেছে, জায়গা নিয়েছে অদ্ভুত এক ভারী নীরবতা। মনোজ সামনের পথ দেখাচ্ছিল, তার কাঁধে দড়ি বাঁধা থলে, ভেতরে মশাল, পানি আর শুকনো খাবার। আমি পেছনে খাতার ব্যাগ নিয়ে হাঁটছিলাম, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ যেন আমাকে সভ্যতা থেকে আরও দূরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

গাছগুলো এত ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে যে আকাশ প্রায় অদৃশ্য। কোথাও কোথাও গাছের শেকড় উঠে এসে রাস্তা আটকে দিয়েছে। ভেজা পাতার উপর হাঁটলে মচমচে আওয়াজ হয়, আর সেই শব্দ যেন জঙ্গলের বুকের ভেতর প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার ফিরে আসে।

মনোজ হঠাৎ থেমে গেল। একটা গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে সে নিচু স্বরে বলল, শুনছেন?”

আমি কান পাতলাম। প্রথমে কিছু শোনার মতো লাগল না, কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর স্পষ্ট শব্দ পেলাম—মাটির নিচ থেকে যেন ধাতব কিছু ঘষে যাওয়ার মতো আওয়াজ। কাঁপা গলায় বললাম, এটা কী?”

মনোজ মাথা নাড়ল, আমি জানি না। তবে দাদু বলত, এখানে রাতে অনেক অদ্ভুত শব্দ হয়।”

আমরা হাঁটা শুরু করলাম আবার। কিছুদূর এগোতেই জঙ্গল ফাঁকা হয়ে এল। একটা খোলা জায়গা, মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা পাথরের স্তম্ভ। স্তম্ভের গায়ে ইংরেজি অক্ষরে কিছু লেখা, তবে শ্যাওলায় ঢেকে অর্ধেক পড়া যায় না। যতটুকু বোঝা গেল—“1901, Penal Settlement.”

আমার বুক কেঁপে উঠল। সত্যিই তাহলে এখানে কোনো বন্দীশিবির ছিল। ইতিহাসের বইয়ে এর উল্লেখ নেই, অথচ দ্বীপের বুকের ভেতর এই নিদর্শন আজও দাঁড়িয়ে।

আমি খাতা খুলে লিখতে শুরু করলাম। শব্দগুলো কাগজে আসতে আসতে আমার মনে হচ্ছিল আমি কেবল ভ্রমণকাহিনি লিখছি না, বরং হারিয়ে যাওয়া এক ইতিহাস খুঁজে বের করছি।

হঠাৎ পাশের ঝোপ নড়ল। আমি আঁতকে উঠলাম। মনোজ সঙ্গে সঙ্গে দড়ি থেকে মশাল বার করে জ্বালাল। আলো ফেলে দেখা গেল—একটা বিশাল টিকটিকি দৌড়ে চলে যাচ্ছে। আমরা দুজনই হেসে ফেললাম, কিন্তু সেই হাসির ভেতরেও একটা অস্বস্তি রয়ে গেল।

আমরা আরও ভেতরে এগোলাম। এবার দেখা গেল অর্ধেক ভাঙা ইটের ঘর। ছাদ নেই, দেয়ালে গর্ত। ভেতরে ঢুকে দেখি মেঝেতে মরচে ধরা লোহার শিকল পড়ে আছে। শিকলের পাশে একটা কংকালসদৃশ কাঠামো—যেন মানুষের হাড়, তবে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে।

আমার হাত কেঁপে উঠল। মনোজ গম্ভীর গলায় বলল, এখানে অনেক বন্দী মারা গিয়েছিল। কেউ বলে রোগে, কেউ বলে নির্যাতনে।”

আমি দেয়ালের কাছে গিয়ে হাত রাখলাম। এক মুহূর্তে মনে হলো, ভেতর থেকে কেউ যেন আমাকে ছুঁয়ে দিল। হাতটা ঠান্ডা হয়ে গেল, শরীর শিউরে উঠল। আমি দ্রুত হাত সরিয়ে নিলাম, কিন্তু সেই অনুভূতি দীর্ঘক্ষণ থেকে গেল।

মনোজ বলল, চলুন, বাইরে যাই।”

আমরা আবার জঙ্গলের পথ ধরলাম। এবার চারপাশের পাখির ডাকও বন্ধ হয়ে গেছে। হাওয়াও থমথমে। মনে হচ্ছিল যেন দ্বীপটা আমাদের ওপর চোখ রেখে আছে।

হঠাৎ একটা জায়গায় এসে দেখি মাটির নিচে একটা গর্ত। গর্তটা সিঁড়ির মতো নিচে নেমে গেছে। আমি টর্চ ফেলে তাকালাম, দেখা গেল ভেতরে অন্ধকারের ভেতর পাথরের দেয়াল। মনোজ বলল, এটা দাদু একবার দেখেছিল। নাকি এখানে গোপন কক্ষ ছিল।”

আমার শরীরের প্রতিটি স্নায়ু কেঁপে উঠল। আমি ফিসফিস করে বললাম, চলুন নেমে দেখি।”

মনোজ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যা হওয়ার হোক।”

আমরা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম। মশালের আলোতে পাথরের দেয়াল ভেসে উঠল। নিচে পৌঁছে দেখি ছোট একটা কক্ষ, ভেতরে ভাঙা কাঠের বাক্স, ছেঁড়া কাপড় আর কয়েকটা মরচে ধরা লোহার সরঞ্জাম।

হঠাৎ আমি দেয়ালে আঁকা কিছু চিহ্ন দেখতে পেলাম। আলো ফেলে বোঝা গেল, এগুলো হাতের ছাপ। লাল রঙে করা, হয়তো রক্ত, হয়তো কোনো রঙ। হাতের ছাপগুলো যেন বন্দীদের শেষ প্রতিবাদের ভাষা।

আমার গলা শুকিয়ে গেল। মনোজ ধীরে ধীরে বলল, এখানে অনেক কিছু চাপা পড়ে আছে।”

আমরা নিঃশব্দে কক্ষ থেকে বেরোলাম। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই আবার জঙ্গলের আলো চোখে পড়ল। কিন্তু মনে হচ্ছিল আমরা আর আগের মতো নেই। দ্বীপের অন্ধকার যেন আমাদের ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

আমি হঠাৎ অনুভব করলাম, কারও দৃষ্টি আমার ওপর পড়ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম—জঙ্গলের ভেতর যেন ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মিটমিট করতেই সেটি মিলিয়ে গেল। আমি থমকে দাঁড়ালাম।

মনোজ জিজ্ঞেস করল, কী হলো?”

আমি মাথা নাড়লাম, কিছু না… তবে মনে হলো কেউ আমাদের দেখছে।”

পার্ট ৪: রাতের দ্বীপে

সূর্যের আলো ফিকে হয়ে আসছিল। আকাশে লালচে রেখা, সমুদ্রের ওপরে ধোঁয়াটে সোনালি আভা। জঙ্গলের ভেতর তখন থেকেই গাঢ় অন্ধকার জমে উঠতে শুরু করেছে। আমি আর মনোজ নৌকার দিকে ফিরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু হঠাৎ আবহাওয়া পাল্টে গেল। পশ্চিম দিক থেকে ঘন কালো মেঘ আসছে, আর বাতাসের গায়ে সমুদ্রের ভিজে গন্ধ।

মনোজ বলল, এখন সমুদ্রে নামা ঠিক হবে না। ঢেউ বেড়ে গেলে নৌকা টিকবে না। আজ রাতটা এখানে কাটাতে হবে।”

আমার বুকের ভেতর কেমন কেঁপে উঠল। দ্বীপের এই নির্জন জঙ্গলে রাত কাটানো মানেই অচেনা ভয়কে সামনে ডেকে আনা। কিন্তু অন্য কোনো পথ নেই। আমরা একটা খোলা জায়গায় গিয়ে শুকনো ডালপালা জড়ো করলাম। মনোজ আগুন ধরাল। শিখার আলোতে চারপাশ যেন কিছুটা প্রাণ ফিরে পেল।

আগুনের পাশে বসে আমি খাতায় লিখতে শুরু করলাম দিনের অভিজ্ঞতা। শব্দগুলো কাগজে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল এ কেবল ভ্রমণের বিবরণ নয়—বরং ভয় আর বিস্ময়ের মিশ্রণ। মনোজ চুপ করে দূরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাঝে মাঝে তার চোখে ভয় দেখছিলাম, যদিও সে মুখে কিছু বলছিল না।

কিছুক্ষণ পর হাওয়ার সঙ্গে জঙ্গলের ভেতর থেকে অদ্ভুত আওয়াজ আসতে লাগল। যেন একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষ ফিসফিস করছে। আমি শিউরে উঠলাম। বললাম, শুনতে পাচ্ছেন?”

মনোজ মশালটা শক্ত করে ধরল। বলল, এই দ্বীপে রাত নামলে অনেক অদ্ভুত শব্দ হয়। জেলেরা বলে এগুলো বন্দীদের আত্মার ফিসফিসানি।”

কথাগুলো শুনে শরীর হিম হয়ে গেল। কিন্তু কৌতূহলও দমল না। আমি টর্চ নিয়ে অন্ধকারের ভেতর আলো ফেললাম। প্রথমে কিছু দেখা গেল না। তারপর হঠাৎ দেখা গেল এক ছায়া, যেন একজন মানুষ গাছের আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে। আমি চমকে উঠতেই সেটা মিলিয়ে গেল।

মনোজ কঠিন গলায় বলল, দেখছেন তো? বলেছিলাম।”

আমরা আগুনের পাশে আরও কাছে বসলাম। রাত গভীর হতে লাগল। সমুদ্রের গর্জন দূরে শোনা যাচ্ছে, তার সঙ্গে মিশছে জঙ্গলের অদ্ভুত সুর। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, কেউ যেন আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

হঠাৎ ঝোপ নড়ে উঠল। আমি হাত থেকে খাতা ফেলে দিলাম। আলো ফেলতেই দেখা গেল—একটা হরিণ। আমরা দুজনই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ টিকল না। কারণ ঠিক পর মুহূর্তেই অন্য শব্দ উঠল—লোহার শিকল টেনে নেওয়ার মতো শব্দ, যেন কেউ মাটির উপর দিয়ে শিকল টেনে হাঁটছে।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মনোজ ধীরে ধীরে মশাল উঁচু করল। আলো ফেলে কিছু দেখা গেল না, কিন্তু শব্দটা ক্রমেই স্পষ্ট হতে লাগল, যেন কাছে চলে আসছে। আমার শরীরের রক্ত যেন জমে গেল।

হঠাৎ আগুনের শিখা কেঁপে উঠল, তারপর নিভে গেল। চারপাশে কেবল অন্ধকার। আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম, তখন মনোজ আমার মুখ চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল, চুপ… ওরা বুঝে ফেলবে।”

তার চোখের ভেতর অদ্ভুত ভয়ের ছাপ। আমি কিছু বললাম না, কেবল অন্ধকারে কান পাতলাম। শিকল টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দটা থেমে গেছে, কিন্তু তার জায়গায় এসেছে মানুষের মতো গোঙানির আওয়াজ।

আমরা নিঃশব্দে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। তারপর মনোজ আবার আগুন ধরাল। আলো ফিরে আসতেই চারপাশ ফাঁকা। যেন কিছুই হয়নি।

কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি টের পেলাম—আমার খাতা নেই। মাটির উপর থেকে হঠাৎ যেন উধাও হয়ে গেছে। আমি চারদিকে খুঁজলাম, কোথাও নেই। মনোজ বলল, শুধু জিনিস নয়, স্মৃতিও ওরা নিয়ে যায়।”

কথাগুলো শুনে শরীর কেঁপে উঠল।

রাত আরও গভীর হলো। আকাশের মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ উঠল। আলোয় দ্বীপটা যেন রহস্যময় আলোয় ভরে উঠল। আমি হঠাৎ দূরে তাকিয়ে দেখি, ভাঙা স্তম্ভের কাছে কয়েকটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। একে অপরের হাত বাঁধা, মাথা নিচু, যেন বন্দী।

আমি চোখ মুছে আবার তাকালাম—কেউ নেই। কিন্তু বুকের ভেতর তখনো ধুকপুকানি চলছে।

মনোজ বলল, কাল সকালে আমরা এখানে থেকে বেরিয়ে যাব। এর বেশি এখানে থাকা উচিত নয়।”

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম, কিন্তু জানতাম—এই রাতের অভিজ্ঞতা আমার ভেতর চিরকাল থেকে যাবে।

পার্ট ৫: বিদায়ের ভোর

সারা রাত প্রায় ঘুমই হয়নি। কখনও ঢেউয়ের গর্জন, কখনও অরণ্যের ফিসফিসানি, কখনও আবার অচেনা গোঙানির আওয়াজ—সব মিলিয়ে ভয়ের সঙ্গে সময় কেটেছে। আগুনের আলো নিভে যাওয়ার পর আমরা একে অপরের মুখও স্পষ্ট দেখতে পাইনি। শুধু অপেক্ষা করেছি ভোরের জন্য।

অবশেষে আকাশ ফর্সা হতে শুরু করল। গাছের ফাঁক দিয়ে প্রথম আলো ঢুকে পড়তেই চারপাশ কিছুটা স্বস্তি পেল। রাতের অদ্ভুত শব্দগুলো থেমে গেছে। পাখিদের ডাক আবার শোনা যাচ্ছে, বাতাসেও হালকা শীতলতা। কিন্তু আমার বুকের ভেতর তখনও ভারি অস্বস্তি জমে আছে—যেন দ্বীপটা এখনো আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

মনোজ বলল, চলুন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমুদ্রে নামতে হবে। আজ হাওয়া ঠিক আছে।”
আমি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে রাজি হলাম।

আমরা নৌকার দিকে ফিরতে শুরু করলাম। পথে সেই ভাঙা কাঠামোগুলো আবার চোখে পড়ল। দিনের আলোয় সেগুলো কম ভীতিকর মনে হলেও, দেয়ালে লেগে থাকা শ্যাওলা আর ভেতরের মরচে ধরা শিকলগুলো যেন রাতের আতঙ্ককেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল। আমি হঠাৎ থেমে গিয়ে পকেট থেকে কলম বের করে একটা দেয়ালের ফাঁকা জায়গায় লিখে দিলাম—“আমরা এখানে এসেছিলাম, ২০২৫।” হয়তো একদিন কেউ এসে দেখবে, আর বুঝবে এই দ্বীপ এখনো কথা বলে।

মনোজ পিছন থেকে বলল, চলুন, এখানে বেশি দেরি করা ঠিক নয়।”

আমরা দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম। সমুদ্রের ধারে এসে দেখি, জলের রঙ বদলে গেছে। ভোরের আলোয় নীলের মধ্যে এক অদ্ভুত ধূসরতা। যেন সমুদ্র নিজেই রাতের অভিজ্ঞতা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

নৌকায় উঠতেই মনোজ ইঞ্জিন চালু করল। ঢেউয়ের ছন্দে নৌকা দুলতে লাগল। আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম—দ্বীপটা ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। ঘন জঙ্গল, কালো শ্যাওলাধরা পাথর, আর সেই ভাঙা স্তম্ভগুলো ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।

কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল দ্বীপটা আমাকে ছাড়ছে না। বুকের ভেতর এখনো সেই অদ্ভুত দৃষ্টি, সেই শিকলের শব্দ বাজছে। আমি চোখ বন্ধ করলাম, তবুও অনুভব করলাম—কেউ যেন আমার কাঁধে হাত রাখল। চমকে উঠে দেখি—চারপাশে কেবল সমুদ্র আর মনোজ।

আমি ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বললাম, মনোজ, আপনি বিশ্বাস করেন এগুলো সত্যি?”
সে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিল, সব সত্যি আর সব গুজবের মাঝেই এই দ্বীপ বেঁচে আছে। আপনি কী বিশ্বাস করবেন সেটা আপনার সিদ্ধান্ত।”

পোর্ট ব্লেয়ারের জেটি দেখা যাচ্ছিল। মানুষের কোলাহল, দোকানপাট, রঙিন ছাতা—সবকিছু যেন অন্য এক দুনিয়া। কিন্তু আমি জানতাম, গত রাতের অভিজ্ঞতা আমাকে আর কখনো ছাড়বে না।

হোটেলে ফিরে এসে ব্যাগ খুলতেই অবাক হয়ে গেলাম। যে খাতাটা রাতে হারিয়ে গিয়েছিল, সেটা আমার ব্যাগের ভেতর রাখা। আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। পাতাগুলো উল্টাতেই দেখি—শেষ পাতায় নতুন কিছু লেখা আছে, অথচ সেটা আমার হাতের লেখা নয়। বাঁকা অক্ষরে লেখা—
আমরা এখানেই আছি।”

শরীর শিউরে উঠল। খাতাটা বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলাম। বাইরে সমুদ্রের গর্জন আবার ভেসে আসছিল, যেন দ্বীপটা এখনো আমার সঙ্গে কথা বলছে।

এই ভ্রমণকাহিনি আমার কাছে কেবল সমুদ্রযাত্রা নয়, বরং ইতিহাস আর রহস্যের ভেতর এক অদ্ভুত যাত্রা। আন্দামানের সেই নির্জন দ্বীপ আজও মানচিত্রের বাইরে রয়ে গেছে, কিন্তু আমার খাতার ভেতর তার স্মৃতি চিরকাল বেঁচে থাকবে। হয়তো সত্যিই কিছু গল্প কখনো পুরোটা লেখা যায় না—কিছু গল্প কেবল অনুভব করা যায়।

 

পার্ট ৬: ফিরে আসার পর

পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে আসার পরও আমার মন শান্ত হলো না। চারপাশে যতই হাসি, রঙিন দোকান, আর সজীব জীবন থাকুক না কেন, মনে হচ্ছিল আমি এখনো সেই দ্বীপের অন্ধকারে বসে আছি।

হোটেলের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আমি সাগরের দিকে তাকালাম। ঢেউগুলো আসছে আর ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু সেই শব্দের ভেতরেও যেন শোনা যাচ্ছে শিকলের টান, বন্দীদের গোঙানি। আমি খাতাটা বার করলাম ব্যাগ থেকে। ভেতরে শেষ পাতায় বাঁকা অক্ষরের সেই লেখা এখনো রয়ে গেছে—
আমরা এখানেই আছি।”

কয়েকবার চোখ বুলিয়ে দেখলাম, অক্ষরগুলো যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো খাতাটা জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিই, কিন্তু পারলাম না। কারণ এই খাতা আমার একমাত্র প্রমাণ যে দ্বীপে সত্যিই কিছু ঘটেছিল।

সন্ধেবেলা আমি মনোজকে খুঁজতে গেলাম। কিন্তু জেটিতে গিয়ে শুনলাম, সে নাকি সকালেই আবার মাছ ধরতে বেরিয়েছে। কেউ বলতে পারল না কবে ফিরবে। আমি অদ্ভুত এক শূন্যতায় ভরে গেলাম। যেন দ্বীপের সঙ্গে যে মানুষটা আমাকে যুক্ত করেছিল, সেও হঠাৎ মিলিয়ে গেছে।

পরদিন সকালে আমি শহরের এক পুরনো লাইব্রেরিতে গেলাম। আন্দামানের ইতিহাস ঘাঁটতে শুরু করলাম। সেলুলার জেল, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাহিনি, ব্রিটিশদের নির্মমতা—সবকিছুর বিস্তারিত বর্ণনা আছে। কিন্তু সেই দ্বীপের উল্লেখ কোথাও নেই। একেবারেই নেই।

তখনই বুঝলাম, ইতিহাস সব বলে না। কিছু সত্য ইতিহাস ইচ্ছে করেই আড়াল করে রাখে।

লাইব্রেরির এক বৃদ্ধ কর্মচারী আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বললেন, আপনি কি সেই দ্বীপের খোঁজ করছেন?”
আমি চমকে গেলাম। ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। আপনি জানেন কিছু?”

তিনি নিঃশব্দে বললেন, আমার দাদু বলতেন, ব্রিটিশরা কয়েকটা গোপন বন্দিশিবির করেছিল, যেগুলোর খোঁজ রাখা হয়নি। কারণ সেগুলো ছিল অমানবিকতার সীমা ছাড়ানো। অনেক বন্দী সেখানে মারা যায়। কিন্তু স্বাধীনতার পর সরকার চায়নি সেই কাহিনি প্রকাশ পাক। তাই সব দলিল মুছে দেওয়া হয়।”

আমার শরীর শিউরে উঠল। মনে হলো আমি সত্যিই এমন এক জায়গায় গিয়েছিলাম, যেটাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে।

লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে দেখলাম আকাশ কালো হয়ে গেছে। দূরে সমুদ্রের ওপরে ঝড় জমছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল ঝড় কেবল সমুদ্রের ওপর নয়, আমার ভেতরেও।

রাতে হোটেলে ফিরে আবার খাতা খুললাম। কিন্তু এবার নতুন কিছু দেখলাম। খাতার মাঝখানের এক পাতা ভিজে আছে, যদিও আমি কোথাও জল ফেলিনি। ভেজা পাতার ওপর আঙুল বোলাতেই স্পষ্ট হলো শব্দগুলো—
ফিরে এসো।”

আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। দ্বীপ যেন আমাকে ডাকছে।

আমি জানতাম, ভ্রমণ শেষ হয়নি। কেবল শুরু হয়েছে।

 

পার্ট ৭: আবার ডাকে দ্বীপ

হোটেলের ছোট ঘরে সেদিন রাতটা একেবারেই স্বাভাবিক ছিল না। বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। কখনও মনে হচ্ছিল জানালার ওপারে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কখনও মনে হচ্ছিল করিডরের শেষে কারও ছায়া নড়ছে। কিন্তু জানালা খুলে দেখলে কেবল সমুদ্রের অন্ধকার, আর করিডরে নিস্তব্ধতা।

সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই খাতাটা আবার হাতে নিলাম। ভেজা পাতার অক্ষরগুলো শুকিয়ে গেছে, কিন্তু ছাপ রয়ে গেছে—
ফিরে এসো।”

আমার ভেতর অদ্ভুত দ্বন্দ্ব শুরু হলো। একদিকে ভয়, অন্যদিকে কৌতূহল। কেন আমাকে ডাকছে দ্বীপ? কী আছে সেখানে, যা এখনো প্রকাশ পায়নি?

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আবার যেতে হবে।

কিন্তু মনোজ কোথায়? জেটিতে খোঁজ করেও তার সন্ধান পেলাম না। লোকজন বলল, হয়তো দূরে অন্য কোনো দ্বীপে মাছ ধরতে গেছে। তখনই আমার মনে হলো—একাই যদি আবার যাই?

ঠিক সেই মুহূর্তে পরিচয় হলো একজনের সঙ্গে। নাম অরিত্রা মিত্র, কলকাতার একজন গবেষক, ইতিহাস খুঁজতে আন্দামানে এসেছে। ক্যাফের এক কোণে বসে সে স্থানীয় দলিলপত্র পড়ছিল। কথায় কথায় আমি দ্বীপের কথা বলতেই সে চমকে উঠল।

আপনি কি সত্যিই ওখানে গেছেন?”—তার চোখে বিস্ময় আর উত্তেজনা।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, আর ওটা আমাকে আবার ডাকছে।”

অরিত্রা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমিও খুঁজছি সেই দ্বীপের কথা। আমার থিসিসে স্বাধীনতা সংগ্রামের অজানা অধ্যায় নিয়ে লিখছি। কিন্তু কোথাও স্পষ্ট প্রমাণ পাইনি। যদি সত্যিই ওখানে বন্দিশিবির থাকে, তাহলে সেটা ইতিহাসের জন্য বিশাল আবিষ্কার।”

তার কথায় আমি একরাশ সাহস পেলাম। হয়তো একা যাওয়া উচিত নয়। হয়তো এই রহস্য উদঘাটনের জন্য আরেকজন দরকার, যে কেবল পর্যটক নয়, গবেষকও।

আমরা দুজনে পরিকল্পনা করলাম। এক দিনের মধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে রওনা দেব। খাবার, মশাল, দড়ি, টর্চ সবকিছু জোগাড় করব। এবার আর হালকা ভ্রমণ হবে না—এবার হবে অনুসন্ধান।

সন্ধেবেলা আমি আবার খাতা খুললাম। এবার কোনো নতুন লেখা নেই। কিন্তু পাতার ভেতর থেকে আসছিল ভেজা লবণের গন্ধ, যেন সমুদ্রের শ্বাস। মনে হলো দ্বীপ আমাদের অপেক্ষা করছে।

রাতে ঘুমাতে গেলেও মনে হচ্ছিল কেউ ফিসফিস করছে কানে। শব্দগুলো অস্পষ্ট, তবু একবার যেন শুনলাম—
এবার সত্যি দেখতে হবে।”

আমার বুকের ভেতর কাঁপুনি শুরু হলো। জানলাম, আর ফেরার পথ নেই।

পরদিন সকালে আমরা জেটিতে দাঁড়িয়ে মাঝিদের খুঁজছিলাম। কিন্তু সবাই দ্বীপের নাম শুনেই মাথা নাড়ল। কেউ যেতে রাজি নয়। অবশেষে এক বৃদ্ধ মাঝি এগিয়ে এল। মুখে গভীর দাগ, চোখে ভয়ের ছাপ। বলল, তোমরা যদি সত্যিই যেতে চাও, আমি নিয়ে যাব। তবে মনে রেখো—ওখান থেকে ফিরতে সবাই পারে না।”

আমি আর অরিত্রা একে অপরের দিকে তাকালাম। তারপর একসঙ্গে মাথা নেড়ে রাজি হলাম।

নৌকা প্রস্তুত হলো। সমুদ্র শান্ত, আকাশে হালকা মেঘ। আমরা যখন যাত্রা শুরু করলাম, মনে হচ্ছিল ঢেউয়ের ভেতর দিয়ে কেউ আমাদের পথ দেখাচ্ছে।

দূরে দ্বীপের সবুজ অরণ্য দেখা দিতেই বুকের ভেতর আবার সেই পরিচিত শিহরণ জেগে উঠল। এবার আর ভ্রমণ নয়—এবার যেন সত্যিই এক যুদ্ধের শুরু।

পার্ট ৮: আবার দ্বীপে ফেরা

নৌকা ধীরে ধীরে অজানা দ্বীপের দিকে এগোচ্ছিল। সমুদ্রের ঢেউ আজ শান্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার বুকের ঢেউ যেন থামছে না। পাশে বসে অরিত্রা নোটবুক খুলে লিখছে—যেন প্রতিটি মুহূর্ত লিপিবদ্ধ করতে চায়। মাঝি চুপচাপ বৈঠা চালাচ্ছে, মুখে অদ্ভুত গাম্ভীর্য।

দূরে দেখা গেল জঙ্গলে ঢাকা কালো দ্বীপ। সূর্যের আলোয় সবুজের গায়ে এক ধরণের অস্বাভাবিক আভা। কাছে আসতেই মনে হলো দ্বীপ যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে না, বরং সাবধান করছে।

নৌকা খাঁড়ির ভেতর ঢুকল। নেমেই আমি পরিচিত সেই বাতাস পেলাম—আর্দ্র, ভারি, আর ভিজে গন্ধে ভরা। অরিত্রা চারপাশ দেখে ফিসফিস করে বলল, এটা সত্যিই অন্যরকম।”

আমরা জঙ্গলের ভেতর হাঁটা শুরু করলাম। আগেরবার যেসব ভাঙা কাঠামো দেখেছিলাম, সেগুলো আবার চোখে পড়ল। কিন্তু এবার দিনের আলোয় আমি খেয়াল করলাম নতুন কিছু—দেয়ালের গায়ে আঁচড় কাটা দাগ, যেন কেউ নখ দিয়ে ঘষেছে। অরিত্রা ছবি তুলতে লাগল।

হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম সেই গোপন সিঁড়ির কাছে। নিচের অন্ধকার যেন আমাদের ডেকে নিচ্ছে। আমি মশাল ধরালাম। অরিত্রা আমার দিকে তাকাল—চোখে ভয়, কিন্তু কৌতূহলও। আমরা ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলাম।

ভেতরে ঢুকতেই শীতলতা অনুভব করলাম। কক্ষটা আগের মতোই, ভাঙা বাক্স আর মরচে ধরা শিকল ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এবার আমরা নতুন কিছু দেখতে পেলাম—দেয়ালের কোণে একটা লোহার বাক্স। অর্ধেক মাটির নিচে ডুবে ছিল।

অরিত্রা বলল, এটা খুলতে হবে।”

আমরা মাটি সরিয়ে বাক্সটা বের করলাম। মরচে ধরলেও তালাটা এখনো অটুট। মাঝি দড়ি থেকে হাতুড়ি বার করে দিল। কয়েকবার আঘাতের পর তালা ভেঙে গেল।

বাক্স খুলতেই ভেতর থেকে বেরোল হলদে হয়ে যাওয়া কিছু কাগজ, ছেঁড়া ডায়েরি আর কয়েকটা মরচে ধরা লোহার প্লেট। অরিত্রা ডায়েরি খুলে পড়তে শুরু করল। অক্ষরগুলো কষ্টেসৃষ্টে বোঝা যাচ্ছিল, কিন্তু কয়েকটা লাইন স্পষ্ট—
এখানে আমরা বন্দী। আমাদের নাম কেউ জানবে না। এই অন্ধকারই আমাদের কবর।”

আমার বুক কেঁপে উঠল। অরিত্রার হাত কাঁপছিল, কিন্তু সে পড়া চালিয়ে গেল। আরেকটা পাতায় লেখা—
যদি কেউ কখনো এটা খুঁজে পায়, আমাদের কণ্ঠকে মুক্তি দাও।”

ঘরটা হঠাৎ ভারি হয়ে উঠল। বাতাসে যেন গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। মশালের শিখা কেঁপে উঠল। মাঝি ফিসফিস করে বলল, এখান থেকে বেরোই। ওরা রাগ করবে।”

আমরা দ্রুত বাইরে উঠে এলাম। জঙ্গলের আলো চোখে লাগছিল, কিন্তু ভেতরের অস্বস্তি ছাড়ল না। অরিত্রা বলল, এটা বিশাল আবিষ্কার। ইতিহাসের বইতে এর কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু এখন প্রমাণ পাওয়া গেছে।”

আমি কিছু বললাম না। কেবল অনুভব করছিলাম—আমরা কেবল ইতিহাস খুঁজে পাইনি, বরং বন্দীদের আত্মাকে জাগিয়ে তুলেছি।

হঠাৎ অরণ্যের ভেতর থেকে ভেসে এল এক দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ। আমরা একসঙ্গে ঘুরে তাকালাম। দূরে ভাঙা স্তম্ভের পাশে কয়েকটা ছায়া দাঁড়িয়ে। এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—তাদের হাত বাঁধা, চোখ ফাঁকা, মুখে যন্ত্রণার রেখা।

অরিত্রা হাঁটু গেড়ে বসে গেল, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। আমি হাত দিয়ে তার কাঁধ ধরলাম। কিন্তু যখন আবার তাকালাম—ছায়াগুলো মিলিয়ে গেছে।

আমরা নিঃশব্দে নৌকার দিকে ফিরতে লাগলাম। প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল দ্বীপ আমাদের অনুসরণ করছে।

নৌকায় ওঠার পর মাঝি বলল, তোমরা দরজা খুলেছ। এখন ওরা তোমাদের পিছু নেবে।”

আমরা চমকে উঠলাম। অরিত্রা কণ্ঠ কাঁপিয়ে বলল, কোন দরজা?”
মাঝি উত্তর দিল না। শুধু বৈঠা চালাতে লাগল।

সমুদ্রের দিকে ফিরতে ফিরতে আমার মনে হচ্ছিল, দ্বীপটা এবার আর আমাদের ছেড়ে দেবে না।

 

পার্ট ৯: ছায়াদের পিছু

নৌকা যখন খাঁড়ি ছেড়ে খোলা সমুদ্রে বেরোল, আকাশ তখন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। ঢেউগুলো একের পর এক আছড়ে পড়ছে, কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল আমার মনে হচ্ছিল যে আমরা একা নই। যেন নৌকার পেছন থেকে কেউ আমাদের অনুসরণ করছে।

অরিত্রা চুপ করে বসেছিল, তার চোখ বারবার খাতার দিকে চলে যাচ্ছিল। সেই খাতার মাঝের ভেজা পাতাগুলো এখন যেন আরও ভারি হয়ে উঠেছে। আমি তাকাতেই সে বলল, ওরা আমাদের ছেড়ে যাবে না। আমরা ওদের কণ্ঠ জাগিয়ে তুলেছি।”

মাঝি মাথা নিচু করে বৈঠা চালাচ্ছিল। মুখে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু তার চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।

পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। আমরা ভিজে একেবারে হোটেলে ফিরলাম। ঘর অন্ধকার, জানলার ওপারে সমুদ্রের দাপাদাপি। আমি খাতা টেবিলে রেখে বিছানায় বসতেই শুনলাম ফিসফিসানি। শব্দটা খাতার ভেতর থেকে আসছে—
আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি।”

অরিত্রা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে খাতা বন্ধ করে দিল। কিন্তু শব্দ থামল না, বরং ঘরের চারদিক থেকে আসতে লাগল।

রাত গভীর হলো। হঠাৎ লাইট নিভে গেল। চারপাশে অন্ধকার। জানলার কাঁচে স্পষ্ট ছায়ার মতো কিছু ভেসে উঠল। হাত বাঁধা, মাথা নিচু করা কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আমি আর অরিত্রা দুজনেই চিৎকার করে উঠলাম, কিন্তু শব্দ আমাদের গলা থেকে বেরোল না—শুধু ভেতরে ভেতরে চেপে রইল।

আমি টর্চ জ্বালাতেই ছায়াগুলো মিলিয়ে গেল। কিন্তু বিছানার পাশে জল জমে আছে। সেই জলে ভেসে আছে লোহার মরচে ধরা একটা শিকল।

অরিত্রা কাঁপা গলায় বলল, ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে। আমরা দরজা খুলেছি, আর এখন ওরা মুক্ত।”

আমার বুকের ভেতর হাহাকার শুরু হলো। আমি ভেবেছিলাম ভ্রমণ মানেই অচেনা অভিজ্ঞতা, কিন্তু এ তো এক অভিশাপ।

পরদিন সকালে হোটেলের ম্যানেজার আমাদের ডাকল। সে বলল, আপনাদের ঘরে কাল রাতে ভিজে জল কোথা থেকে এল? উপরের ঘরেও লিক নেই।”
আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম, কিছু বললাম না।

অরিত্রা তখন সিদ্ধান্ত নিল, এ রহস্য শুধু ভয় পেয়ে শেষ করা যাবে না। তার গবেষণার দায়িত্ব আছে। সে বলল, আমরা আবার দ্বীপে ফিরব। এবার সত্যিটা পুরোপুরি জানতে হবে।”

আমি দ্বিধায় পড়লাম। মনোজ নেই, মাঝি আমাদের সতর্ক করেছে, অথচ দ্বীপ যেন নিজেই আমাদের ডাকছে।

সেদিন সন্ধ্যায় খাতা খুলে দেখলাম নতুন লেখা এসেছে—
শেষ অধ্যায় এখনো বাকি।”

আমি ঠান্ডা ঘামে ভিজে গেলাম। জানলাম, আমাদের যাত্রা এখনো শেষ হয়নি।

পার্ট ১০: শেষ অধ্যায়

খাতার পাতায় লেখা সেই চারটি শব্দ—শেষ অধ্যায় এখনো বাকি”—আমাকে আর শান্ত থাকতে দিল না। আমি জানতাম, ভয় যতই থাকুক, পালিয়ে লাভ নেই। দ্বীপ আবার আমাকে ডাকছে, এবার শেষবারের মতো।

অরিত্রাও একই কথা বলল। তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু একরাশ দৃঢ়তা। আমরা যদি না যাই, তবে এই রহস্য অসমাপ্ত থেকে যাবে। আর ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে না।”

আমরা প্রস্তুতি নিলাম। এবার সঙ্গে নিলাম ক্যামেরা, অতিরিক্ত টর্চ, শুকনো খাবার আর পানি। কিন্তু সবকিছুর চেয়ে বেশি ছিল এক অজানা শঙ্কা—যেন আমরা আর ফিরে আসব না।

বৃদ্ধ মাঝি আবার রাজি হলো, তবে এবার তার কণ্ঠ ভাঙা। আমি শেষবারের মতো নিয়ে যাব। কিন্তু ফিরে আসার পর আর কোনোদিন দ্বীপের নাম মুখে আনবে না।”

নৌকা সমুদ্রের বুক চিরে এগোতে লাগল। আকাশে মেঘ, বাতাস ভারি। দূরে দ্বীপ দেখা দিতেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। অরণ্য যেন কালো দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের আগমনের অপেক্ষায়।

আমরা নেমেই সোজা সেই ভাঙা সিঁড়ির দিকে এগোলাম। এবার আর ভয় পেছনে টেনে ধরল না। অরিত্রার চোখে উন্মাদনা, আর আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন ইতিহাসের শেষ পৃষ্ঠায় দাঁড়িয়ে আছি।

নিচের কক্ষে পৌঁছতেই দেখি, আগেরবার যেসব বাক্স দেখেছিলাম সেগুলো উধাও। কেবল ভেজা মেঝে, আর দেয়ালের গায়ে হাতের ছাপগুলো যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

হঠাৎ কক্ষের ভেতর ঠান্ডা বাতাস বইতে লাগল। মশালের শিখা কেঁপে উঠল। আর তখনই শুনলাম একসঙ্গে অনেকগুলো কণ্ঠ—
আমাদের মুক্তি দাও।”

অরিত্রা হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে লাগল। আমি খাতাটা বের করলাম। তার পাতাগুলো নিজে থেকেই উল্টাতে লাগল, আর শেষ পাতায় স্পষ্ট হয়ে উঠল অক্ষরগুলো—
আমাদের কণ্ঠ লিখে দাও।”

আমি কলম হাতে নিলাম। যেন অচেনা শক্তি আমাকে চালাচ্ছে। কাগজে কাগজে লিখতে শুরু করলাম—যন্ত্রণা, নির্যাতন, মৃত্যু আর বন্দিত্বের গল্প। শব্দগুলো আমার নয়, যেন কারও অদৃশ্য হাত দিয়ে লেখা হচ্ছে।

ঘর কাঁপতে লাগল, দেয়াল থেকে ধুলো ঝরে পড়ল। অন্ধকারের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ছায়ারা বেরিয়ে এলো। তাদের মুখ ফাঁকা, চোখে শূন্যতা, কিন্তু ঠোঁটে মুক্তির আকুতি।

আমি লিখতে থাকলাম। যত লিখছি, ততই ছায়াগুলো হালকা হতে লাগল, যেন কুয়াশার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে।

শেষ শব্দটা লিখে খাতা বন্ধ করতেই কক্ষটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ঠান্ডা হাওয়া থেমে গেল, মশালের আলো স্থির হলো। ছায়াগুলো আর নেই।

অরিত্রা ফিসফিস করে বলল, ওরা চলে গেছে।”

আমরা ধীরে ধীরে বাইরে উঠে এলাম। জঙ্গলের বাতাস এবার আর ভারি নয়। পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে, সমুদ্রের শব্দ স্বাভাবিক। যেন দ্বীপ অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে।

নৌকায় চড়ে ফিরতে ফিরতে আমি পেছনে তাকালাম। দ্বীপটা দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই, কিন্তু তার অন্ধকার যেন হালকা হয়েছে। মনে হলো, বন্দীদের আত্মা অবশেষে মুক্তি পেয়েছে।

পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে অরিত্রা বলল, এটা শুধু ভ্রমণকাহিনি নয়। এটা ইতিহাস। আমরা ওদের কণ্ঠ লিখে দিয়েছি। এখন আর কেউ ওদের নাম মুছে ফেলতে পারবে না।”

আমি খাতার দিকে তাকালাম। পাতাগুলো ভেজা নেই, নতুন কোনো লেখা নেই। কিন্তু শেষ পাতায় সেই শেষ বাক্যটাই রয়ে গেছে—
আমরা মুক্ত।”

 

আমার আন্দামান ভ্রমণ এখানেই শেষ নয়, বরং এক নতুন শুরু। আমি জানি, পাঠক যখন এই কাহিনি পড়বে, তখন শুধু সমুদ্র বা জঙ্গলের ছবি নয়, শুনতে পাবে সেই বন্দীদের ফিসফিসানি। ইতিহাস যাদের নাম মুছে দিয়েছে, তারা আবার ফিরে এসেছে শব্দের ভেতর দিয়ে।

এটাই হয়তো ভ্রমণের আসল মানে—কেবল জায়গা দেখা নয়, সময় আর স্মৃতির অচেনা দরজা খুলে ফেলা।

WhatsApp-Image-2025-08-26-at-6.14.46-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *