অবন্তী রায়
১
ইরা সেনের সকাল শুরু হয় সাদা ছিমছাম বিছানার পাশে রাখা ফোনের ঝিকিমিকি আলো দিয়ে। অ্যালার্মের আগেই সে জেগে ওঠে, যেমনটা প্রায় প্রতিদিনই হয়—মানসিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে স্ক্রিনের আলোয় দিন শুরু করার রীতি। চোখ মেলেই তার হাত ফোনের দিকে এগিয়ে যায়, পাসওয়ার্ড দিয়ে স্ক্রিন খুলতেই একগুচ্ছ নোটিফিকেশন: “New collaboration request from GreenGlow Cosmetics”, “Your reel crossed 1M views!”, “10 new DMs waiting”। সে হালকা হাসে—না, খুশির হাসি নয়—কাজের রুটিন শুরু করার ক্লান্ত অভ্যস্ততা থেকে উঠে আসা এক যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া। ক্যাপশন ভাবতে ভাবতেই সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মেকআপ শুরু করে, কারণ সকাল ৯টার মধ্যে তাকে নতুন কফি ক্যাফের প্রোমো রিল শ্যুট করতে হবে। নিজের মুখটাকে সাজিয়ে এমনভাবে ক্যামেরার দিকে তাকায় যেন সব স্বপ্ন সফল হয়ে গেছে, যেন সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে—যে কিনা কেবল সকালে কফির কাপ হাতে একটা ক্যাফের জানালার পাশে বসে লাইফ এনজয় করে। অথচ ওই জানালার বাইরেই বাস্তব শহরটা রোদে হাঁসফাঁস করছে, আর জানালার ভিতরে ইরার ভেতরের জীবনটা এক ভয়ানক ফাঁকা ঘরে ঢুকে বসে আছে।
শ্যুটিং শেষ হলে সে গাড়িতে বসে ফোন চেক করে, PR মিটিংয়ের লোকেশন, দুপুরের খাবারের কন্টেন্ট শ্যুট, রাতের ব্র্যান্ড ইভেন্ট—একটার পর একটা লাইন দিয়ে সাজানো তার দিন। সে জানে এই গ্ল্যামার, এই ব্র্যান্ড, এই লাইফস্টাইল—সবই নির্ভর করছে তার পরবর্তী পোস্ট কেমন হচ্ছে তার উপর। একটাও যদি কম পারফর্ম করে, তার এনগেজমেন্ট ড্রপ করবে, স্পনসর কাটা পড়বে, কোম্পানি মুখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু আজকের দিনে কিছু যেন ঠিক জমছে না। দুপুরে সে একটা ব্রাঞ্চ স্পটের বাইরে একঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল নিখুঁত আলোয়ের জন্য, কিন্তু ছবি দেখে তার নিজের মুখটাই কেমন অচেনা লাগলো—সাজানো, সুশ্রী, কিন্তু প্রাণহীন। সারাদিনের কনটেন্ট প্ল্যান শেষ করে সন্ধ্যায় সে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকে, যার সব কিছুরই রঙ মিলিয়ে রাখা—ব্ল্যান্ড কিন্তু ইন্সটাগ্রাম-যোগ্য। একটা চকচকে শো-পিসের মতো তার ফ্ল্যাট, কিন্তু সেখানে কারও জন্য কোনো চায়ের কাপ রাখা নেই, কোনো শব্দ নেই, এমনকি ফোনের রিংটোনও তার নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করা, যেন বাইরের জগৎটার প্রতিটা জিনিসও কৃত্রিমভাবে সাজানো একটা নাটকের মতো। সে সোফায় বসে, এক হাতে ফোন, আরেক হাতে কফির মগ—আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখে, নিজের চোখে ক্লান্তি জমেছে। সে একটা সেলফি তোলে, ফিল্টার দিয়ে ত্বক উজ্জ্বল করে, একটা ক্যাপশন লেখে: “Breathe. Smile. Live.” তারপর পোস্ট করে। ঠিক তার মিনিট দশেক পরেই ইনবক্সে মেসেজ আসে, “You’re glowing queen!”, “Wish I had your life”—আর ইরা মুচকি হেসে উত্তর দেয় ইমোজি দিয়ে, যেন সেটাই তার দায়িত্ব, কিন্তু এই মুহূর্তে তার কাঁধে যেন হাজার কেজির ভার।
রাতের খাবারটা সে অর্ডার করে, একা বসে খায়, নেটফ্লিক্স চালিয়ে রেখে, কিন্তু মন নেই স্ক্রিনে। সে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তার আগামী এক সপ্তাহের ক্যালেন্ডার—প্রতিদিন ব্র্যান্ড শ্যুট, মিটিং, ট্রাভেল ব্লগিং—একটা খালি দিন নেই। হঠাৎ একটা ফলোয়ারের কমেন্ট চোখে পড়ে: “You’re lucky to live a dream life! Always smiling, always shining. I wish I was you.” ইরা যেন কেঁপে ওঠে—এই চকমকে লাইফটা যে আসলে একটা সাজানো আয়না, সেটা কি কেউ বোঝে না? এই ক্যামেরার পেছনে যে একটা মানুষ আছে, যার রাত্রি কাটে ঘুমের ওষুধে, যার হাসি তৈরি হয় রিংলাইট আর ফিল্টারে, যার প্রতিটি মুহূর্ত আসলে একটা স্পনসরড বাস্তবতা—তার অস্তিত্ব কি কেবল ক্লিকের ভেতরেই সীমাবদ্ধ? সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, শহরের আলো ঝলমলে, নিচে গাড়ির হর্ণ, রাস্তায় মানুষ—কিন্তু সেই কোলাহলের মধ্যেও সে যেন নিঃসঙ্গ। হঠাৎ তার মনে হয়—একদিন যদি সব বন্ধ করে দেওয়া যেত! যদি একটা সকাল ফলোয়ার, স্টোরি, লাইক ছাড়া শুরু করা যেত! সে চোখ বন্ধ করে, মনে মনে বলে—“আমি কি আর আছি, না কেবল প্রেজেন্স হয়ে উঠেছি?” আর সেই মুহূর্তেই তার মনে হয়, হয়তো সময় এসেছে সব বন্ধ করে নিজেকে খুঁজে বের করার, একদিন, একটিবার… আনপ্লাগড হওয়ার।
২
ইরা পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমবারের মতো ফোনের স্ক্রিন না দেখে কিছুক্ষণ ছাদের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে। যেন মনে মনে একটা নিরব শব্দ শোনা যাচ্ছে—একটা ডাকে, যেটা আসে বাইরে থেকে নয়, বরং তার ভিতর থেকে। বিছানায় শুয়ে থাকার সময়েই তার মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলতে থাকে—“আমি কি আজ একটা দিন নিজের মতো করে কাটাতে পারি? ক্যামেরা ছাড়া, পোস্ট ছাড়া, লোক দেখানো হাসি ছাড়া?” সে জানে, এ শহরের গতি থেমে না, আর তার ক্যালেন্ডার অ্যাপ থেমে গেলে তার ক্যারিয়ারও থেমে যাবে, এই ভয় তাকে বছরখানেক ধরে তাড়া করে ফিরেছে। কিন্তু আজ একটা অদ্ভুত বিক্ষোভ কাজ করে তার মধ্যে। সে উঠে পড়ে, ফোনটা নেয়, সব নোটিফিকেশন চেক না করেই ‘Airplane Mode’ অন করে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে—এই মুখটাই সে গত চার বছর ধরে শোয়ো-জাগো সাজিয়েছে, কিন্তু আজ যেন অন্যরকম মনে হয়। সে খুব সাধারণ একটা পোশাক পরে, মেকআপ ছাড়াই, শুধু একটা ছোট ব্যাগে পোশাক, পানির বোতল, আর একটা ডায়েরি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। কেমন যেন হালকা লাগে—যেন অনেকদিন পর সে একটা ভার ফেলে দিয়ে হাঁটছে, একটা দমবন্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে নতুন হাওয়ায় ঢুকছে।
স্টেশনে পৌঁছে সে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য ঠিক না করে ট্রেন টাইমিং দেখে। হঠাৎ চোখ পড়ে—একটা লোকাল ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে একটা অচেনা জায়গার দিকে—নামতা। সে ভাবে, “এই জায়গাটা কোথায় জানি না, কিন্তু জানাটা কি জরুরি?” সেই মুহূর্তেই সে টিকিট কাটে, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফোনটা অফ থাকায় কোনো কিছু চেক করার উপায় নেই—না লোকেশন, না লোকজন, না রিভিউ। ট্রেনে উঠে জানালার পাশে বসে সে খেয়াল করে—প্রথমবারের মতো ফোন না থাকলেও তার পাশে বসে থাকা মানুষগুলোর মুখ দেখা যাচ্ছে, কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, রেল লাইনের কাঁপুনি অনুভব করা যাচ্ছে। আগে হলে সে এই মুহূর্তটা রেকর্ড করে রিল বানাত, কিন্তু এখন সে শুধু দেখছে, অনুভব করছে। ট্রেন ছুটছে, ইরার মুখে হাওয়ার ছোঁয়া পড়ছে, আর তার মন ধীরে ধীরে এক অচেনা শান্তির দিকে যাচ্ছে—যেখানে কারো কিছু ‘দেখানোর’ নেই, শুধু ‘বাঁচার’ আছে।
ট্রেন কয়েক ঘণ্টা পর থামে—একটা ছোট স্টেশন, চারপাশে কাঁচা রাস্তা, গাছের ছায়া, কিছু রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। ইরা নেমে পড়ে—এটাই ‘নামতা’। জায়গাটা যেমন নিরিবিলি, তেমনই অপরিচিত। কোথাও কোনো বিলবোর্ড নেই, না আছে ওয়াই-ফাই বোর্ড, না কোনো রেস্টোরেন্টের QR মেনু। সে এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালার কাছে জানতে চায়, কাছাকাছি থাকার জায়গা আছে কিনা। লোকটি হাসে, বলে, “রমা দির হোমস্টে আছে—সরাসরি বাড়ির একটা অংশ দিচ্ছে—খুব ভালো মানুষ।” ইরা রিকশায় ওঠে, গ্রামের সরু রাস্তায় ঢুকে পড়ে। কাঁচা রাস্তা, দুই পাশে সরিষার ক্ষেত, মাঝে মাঝে ছোট খাল, আর কিছু শিশু মাঠে খেলে বেড়াচ্ছে—এইসব দৃশ্য যেন কোনো ফিল্টার ছাড়া পোস্টকার্ড। হোমস্টেতে পৌঁছে রমা দি দরজা খুলে বলে, “তুমি শহর থেকে এসেছো বুঝি?” ইরা মাথা নাড়ে—বলতে চায়, “হ্যাঁ, কিন্তু শহরটা আমায় ক্লান্ত করে দিয়েছে।” সে ঘরে ঢোকে—একটা কাঠের খাট, একটা পুরোনো আয়না, জানালায় পাতলা পর্দা, আর ছোট আলনায় একটা বই—সবকিছু যেন নিঃশব্দে বলে ওঠে, “তুমি এখানে বিশ্রাম নিতে এসেছো, দৌড়াতে নয়।” ইরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, আর মনেই হয় না—তার ফোনটা বন্ধ, নেটওয়ার্ক নেই, কোনো অ্যাপ তাকে তাড়া করছে না। ঠিক সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে—এই নীরবতাই ছিল তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, এই থেমে থাকা, এই আনপ্লাগড থাকা—যেটার ডাক এতদিন সে শুনছিল না, আজ তা স্পষ্ট, স্পর্শযোগ্য হয়ে ধরা দিয়েছে।
৩
ইরার ঘুম ভাঙে পাখির ডাক আর দূর থেকে আসা কুয়াশাভেজা গ্রামের মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনিতে—যেটা কলকাতার কোলাহল থেকে একেবারে ভিন্ন এক পৃথিবীর মতো। সে চোখ খুলে দেখে, কাঠের জানালার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছে মাটির ঘরের মেঝেতে, বাতাসে ঘুরছে লেবুপাতা আর ধানের ঘ্রাণ। রমা দি আগে থেকেই তার জন্য লাল চায়ের কাপ রেখে গেছে জানালার পাশে, আর একটা ছোট্ট নোট—“সকালে হাঁটতে যেও, খুব ভালো লাগবে।” ফোন তখনও অফ, যেন তার অস্তিত্ব এই নতুন পরিবেশে একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। ইরা বাইরে বের হয়, পায়ে পড়ে চটি, মুখে একটুও মেকআপ নেই, শুধু একজোড়া কৌতূহলী চোখ—যা খুঁজছে এক নতুন উপলব্ধির ছবি। সে হাঁটতে হাঁটতে দেখে—একটি ছোট্ট পুকুরে একদল শিশু স্নান করছে, একটি বুড়ো মানুষ বসে বাঁশের পাখা বুনছে, আর পাশের গাছের নিচে এক বালক কাগজে কিছু আঁকছে। এইসব সাধারণ দৃশ্যগুলোতে যেন সে এমন এক জাদু খুঁজে পায়, যা তার ইনস্টাগ্রামের হাজারটা ছবিতেও ছিল না।
গ্রামের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে ইরা দেখতে পায়, একটি পুরোনো চায়ের দোকানে বেশ কয়েকজন মানুষ চা খাচ্ছে, আলোচনা করছে রাজনীতি, বৃষ্টির সময় আর আসন্ন পূর্ণিমার কথা। তাদের কেউই তার দিকে তেমন করে তাকায় না—কারণ এখানে সে কেউ না, কোনো তারকা নয়, কোনো ইনফ্লুয়েন্সার নয়—শুধু এক আগন্তুক। হঠাৎ এক বাচ্চা মেয়ে, হয়তো আট-নয় বছরের হবে, কৌতূহলে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, “আপনি শহর থেকে এসেছেন? আপনি সিনেমায় কাজ করেন?” ইরা হেসে বলে, “না, আমি শুধু একটু ঘুরতে এসেছি।” মেয়েটির নাম মিনু, সে খুব দ্রুত ইরাকে তার ‘বন্ধু’ বানিয়ে ফেলে। সে ইরাকে গ্রামের স্কুল দেখায়, পুকুর পাড়ের বটগাছ, আর রঙচঙে জামরুল গাছের নিচে বসে নিজেদের খেলা দেখায়। ইরার মনটা যেন ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে—এই সহজ, অকৃত্রিম সম্পর্কগুলোতে সে এতদিন কোথায় ছিল? সে ভাবে, “আমরা শহরে এত কিছু জানি, কিন্তু কতো কিছু ভুলে যাই—জীবনের স্বাদ, সম্পর্কের নির্ভরতা, নিঃশর্ত হাসি।”
বিকেলের দিকে ইরা হোমস্টেতে ফিরে দেখে রমা দি রান্না করছে, ধোঁয়া উঠছে মাটির চুলা থেকে, পাশে খাটে বসে আছেন দুলাল কাকু—একজন অবসরপ্রাপ্ত পাত্র শিল্পী, যিনি এখন আর বাজারে কাজ বিক্রি করেন না, শুধু গ্রামের ছেলেমেয়েদের শেখান। ইরাকে দেখে তিনি বলেন, “তুমি কি ছবি আঁকো?” ইরা মাথা নাড়ে, “না, আমি পোস্ট লিখি। গল্প বলি। ছবি তুলতে ভালোবাসি।” দুলাল কাকু মুচকি হেসে বলেন, “তবে তো তুমি শিল্পী—যতক্ষণ মানুষ দেখে, বোঝে আর হৃদয়ে ছুঁয়ে যায়, সবই শিল্প।” সেই সন্ধ্যেটা কাটে দুলাল কাকুর গল্প শুনে—তিনি একসময় বড় শহরে গিয়েছিলেন, শিল্প প্রদর্শনী করেছিলেন, তারপর ফিরে এসে দেখেছিলেন—মাটির কাছাকাছি থাকলেই মানুষ সবচেয়ে স্থির থাকে। ইরা তাকিয়ে থাকে তার মুখের ভাঁজে জমে থাকা অভিজ্ঞতায়—এখানে কোনো ক্যামেরা নেই, কোনো মঞ্চ নেই, তবু যেন প্রতিটি শব্দ একটা আলোকচিত্র হয়ে উঠছে তার চোখে। রাতের খাওয়ার পর ইরা একবার ফোনের দিকে তাকায়, কিন্তু ছোঁয় না—কারণ আজকের দিনটা এতটাই পূর্ণ ছিল, যা কোনো পোস্টে ধরাই যাবে না। তার চোখ বুঁজে আসে ধীরে ধীরে, আর মাথার ভিতর শুধু একটাই শব্দ গুনগুন করে—নামতা, এক অচেনা জায়গা, যেটা এখন নিজের মতো আপন হয়ে উঠছে।
৪
পরদিন সকালেও পাখির ডাকেই ঘুম ভাঙে ইরার, তবে আজ তার মধ্যে একটা আলাদা রকমের শান্তি কাজ করে। সে মনে মনে ভাবে, এই গ্রামে আসার সিদ্ধান্তটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তগুলোর একটি। এক কাপ ধোঁয়া ওঠা লাল চা হাতে নিয়ে সে উঠোনে বসে, সূর্যরশ্মির নরম ছোঁয়া গায়ে মেখে চুপচাপ দূরের মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো ইনস্টাগ্রাম স্ক্রোল নেই, কোনো স্টোরি প্ল্যান নেই, এমনকি আজ তার কী পরা উচিত সেই চিন্তাও নেই। হঠাৎ রমা দি এসে বলে, “আজ দুপুরে দুলাল কাকু পাত্র তৈরি শেখাবে—চলে যাস তো?” ইরা প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়ে, কারণ সে তো কোনোদিন এধরনের মাটির কাজ করেনি। কিন্তু তারপর সে ভাবে—এটাই তো শেখার সময়, নতুন কিছু করার সুযোগ। দুপুরে সে মিনুর হাত ধরে গিয়ে পৌঁছায় দুলাল কাকুর বাড়ির উঠোনে—যেখানে একটা মাটির চাক, কিছু ভিজে মাটি আর কয়েকটা শুকনো তৈরি পাত্র রাখা। কাকু হেসে বলে, “হাত নোংরা করতে পারলে মনটা পরিষ্কার হয়।” ইরা একগাল হেসে চাকের পাশে বসে পড়ে।
চাক ঘোরে, মাটি নরম হয়, আঙুলের স্পর্শে আকার পায়। প্রথমবারেই তার বানানো পাত্রটা একটু কুৎসিত হয়, একটু বেঁকেও যায়, কিন্তু দুলাল কাকু তাতে দুঃখ পান না। বরং বলেন, “সৌন্দর্য কেবল নিখুঁত রূপে নয়, ইচ্ছার ভেতরেও লুকিয়ে থাকে। তোর ইচ্ছা ছিল তৈরি করার, সেটাই আসল।” ইরার মনে পড়ে যায়—তার বহুদিনের অভ্যাস ছিল সবকিছু নিখুঁত করার, সব ছবি, সব ক্যাপশন, এমনকি নিজের মুখটাও। কিন্তু এই গ্রামে এসে সে বুঝতে পারছে—সবসময় নিখুঁত হতে হয় না। বিকেলে, পাত্র তৈরির ক্লান্তি পেরিয়ে সে যখন উঠোনে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, একটা চেনা অনুভূতি আসে তার ভিতর—এটা যেন তার বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া কোনো আপন জায়গা, যেখানে কেউ তাকে বিচার করছে না, শুধু স্বীকার করছে। মিনু এসে তার পাশে বসে, বলে, “আপনি ভালো বানাতে পারলেন তো!” ইরা বলে, “না রে, আমি শুধু চেষ্টা করলাম।” মিনু গম্ভীর হয়ে বলে, “তাহলে আপনি অনেক ভালো”—এই সরল বাক্য শুনে ইরার চোখে জল আসে।
সন্ধ্যাবেলায় রমা দির সঙ্গে রান্নাঘরে বসে ইরা শিখে কিভাবে সরষে দিয়ে মাছে স্বাদ আনা যায়, আর কীভাবে কথা না বললেও কারো পাশে বসে থাকলে আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। রান্নার ফাঁকে রমা দি নিজের গল্প বলে—স্বামী মারা গেছেন বহু বছর আগে, সন্তান শহরে থাকে, কিন্তু সে এই গ্রাম ছাড়েনি কারণ এখানেই সে নিজের সত্যিকারের জীবন খুঁজে পায়। ইরা অবাক হয়ে শোনে—এখানে সবার জীবনে কত কষ্ট, কত অভাব, অথচ কারো মুখে অভিযোগ নেই। বরং তাদের কাঁচা কথাগুলো এত সোজাসাপ্টা আর মানবিক যে তা শহরের চকচকে শব্দের চেয়েও অনেক বেশি মূল্যবান। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ইরা তার ডায়েরিতে লিখে: “আজ আমি নতুন কিছু বানালাম, নতুন কিছু শিখলাম, নতুন কাউকে চিনলাম। কোনো ক্যামেরা ছিল না, কোনো ক্লিক নয়, তবু এই মুহূর্তগুলোই আমার জীবনের আসল ছবিগুলো।” সে টেবিলের উপর বানানো তার বেঁকা পাত্রটির দিকে তাকায়, আর মনে মনে বলে—হ্যাঁ, আমি এখন একটু একটু করে মানুষ হচ্ছি, সেই মানুষ, যার মধ্যে ক্যামেরার বাইরের আলো জ্বলছে।
৫
সকালটা শুরু হয় মেঘলা আকাশ আর মাটি ছোঁয়া কুয়াশার আলতো পরশে, যেন প্রকৃতি নিজেই চারপাশে এক শান্ত চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। ইরা খেয়াল করে, আজ তার মনে কোনো তাড়া নেই—না কোনো ক্যাপশন ভাবার চাপ, না কোনো পোশাক মিলিয়ে তোলার ক্লান্তি। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা দেখে—চোখে কাজল নেই, ঠোঁটে লিপস্টিক নেই, তবু মুখখানা যেন অন্যরকম আলোকিত। এ একধরনের আলো, যা আসছে ভিতর থেকে। এই গ্রামের কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা তার ভেতরের স্তব্ধ আত্মাকে জাগিয়ে তুলেছে। আর সে বুঝতে পারছে, তার এতদিনকার জাগরণ ছিল কেবল বাইরের চেহারার ঝলক—আসল জাগরণ আসলে শুরু হয়েছে এখন, আয়নার মুখ না দেখে, আয়নার বাইরে নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে। আজ তার পরিকল্পনা—গ্রামের স্কুলে যাওয়া, কারণ মিনু তাকে আগেরদিন বলেছিল, “আপনি একদিন আমাদের স্কুলে এলে দারুন হবে, ম্যাডাম আপনাকে গান শুনাবেন।”
স্কুলটা খুব ছোট, টিনের ছাউনি আর কাঁচা মেঝের ক্লাসরুম, কিন্তু দেয়ালজুড়ে নানা রঙের ছবিতে ভরা—পাহাড়, নদী, মাছ, পাখি, আর স্কুলের বাচ্চাদের নাম লেখা তাদের আঁকা ছবির পাশে। ইরা সেখানে গিয়ে অবাক হয় দেখে—ছেলেমেয়েরা কতটা প্রাণবন্ত, কতটা খোলা মনের। তারা প্রশ্ন করে না ইরার ফলোয়ার সংখ্যা, তারা জানতে চায় সে কেমন গল্প লেখে, তার প্রিয় রং কী, সে কখনও হারিয়ে গিয়েছিল কিনা। শিক্ষক রত্না দি খুব আন্তরিক, তিনি বলেন, “আমরা শুধু বই পড়াই না, মানুষ তৈরি করার চেষ্টা করি। এখানে যা আছে, তার মধ্যেই আমরা আনন্দ খুঁজি।” ক্লাসরুমের মেঝেতে বসে ইরা বাচ্চাদের সঙ্গে একটা ছোট গল্প লেখার খেলা খেলে, যেখানে সবাই এক এক লাইন করে লিখে। সেই খেলায় এমন কিছু কথা আসে, যা ইরার নিজের পোস্টেও কখনও আসেনি—“আমার স্বপ্ন একদিন মেঘের কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করব, সে এত কাঁদে কেন”, বা “বাবা বাজারে গেলে আমি মনে মনে ভাবি, সে একটা মিঠাই নিয়ে ফিরবে”—এইসব লাইনগুলো যেন জীবনের সারল্যকে গভীর করে তোলে।
সন্ধ্যায় স্কুল থেকে ফেরার সময় একদল ছেলেমেয়ে তাকে পথ পর্যন্ত এগিয়ে দেয়, কেউ বলে—“আপনি গল্পের মতো”, কেউ বলে—“আপনার চোখ হাসে।” এই কথাগুলো কোনো ভিউয়ের জন্য নয়, কোনো কনটেন্ট রিচ করার জন্য নয়—এটা হৃদয়ের একেবারে গভীর থেকে বেরিয়ে আসা নিখাদ ভালোবাসা। ইরা হোমস্টেতে ফিরে স্নান করে, ছাদে উঠে চুপচাপ বসে থাকে। তার ফোন এখনও বন্ধ, আর সে চায় না তা চালু করতে। চারদিকে ঝিঁঝিঁর ডাক, দূরের কুয়াশার নিচে গ্রাম নিঃশব্দে ঘুমোতে শুরু করেছে। তখন রমা দি এসে পাশে বসে বলে, “তুই এই কয়দিনে অনেক হালকা হয়ে গেছিস, মুখখানায় তুই ফিরে এসেছিস।” ইরা চুপ করে থাকে, তার চোখে জল আসে না, কিন্তু মনটা ভরে যায়। সে ভাবে—আয়নায় আমি যা দেখতাম, তা ছিল সাজানো মুখ; এখানে আমি যা দেখছি, তা হলো আমার সত্যিকারের রূপ। সে বুঝে যায়—প্রথমবারের মতো কেউ তাকে সুন্দর বলেছে তার মুখ নয়, তার ‘মনের হাসি’ দেখে। সেই রাত ইরার ডায়েরির পাতায় লেখা থাকে শুধু একটি লাইন: “আজ নিজেকে আয়না ছাড়া দেখতে শিখেছি।”
৬
ইরা সকাল থেকে চুপচাপ, আজ তার মন ভরে উঠেছে এক অদ্ভুত অনুভবে—যেন গ্রামটাকে সে দীর্ঘদিনের চেনা কোনো বন্ধুর মতো ভালোবেসে ফেলেছে। সে কাঠের জানালার পাশে বসে, হাতের ডায়েরির পাতা খুলে একটার পর একটা লেখা যোগ করে। গত কয়েকদিন ধরে সে কেবল অনুভব করেছে, আজ তার মধ্যে সেই অনুভবগুলোকে শব্দে বাঁধার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছে। প্রথম পাতায় সে লেখে—“কলকাতায় আমার ঘর বড় ছিল, কিন্তু মনের ভিতরে ছিল শুধু একটানা আওয়াজ—লাইক, কমেন্ট, এনগেজমেন্ট রেট… এখানে সেই শব্দ নেই, শুধু নিঃশব্দে জমে থাকা সত্যি অনুভূতির গন্ধ।” সে স্মরণ করে, কীভাবে তার প্রতিটি মুহূর্তকে সে এতদিন ধরে রঙ আর রিংলাইট দিয়ে সাজিয়েছে, এমনভাবে যে বাস্তব মুহূর্তগুলো ধীরে ধীরে কাচের দেয়ালের ওপারে চলে গেছে।
সে একটা সময় প্রতিটি হাসি তোলার আগে ভাবতো, ফ্রেম ঠিকঠাক আছে তো? চুলের ভাঁজ সোজা তো? রঙ স্যাচুরেটেড? কিন্তু এই গ্রামের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো—জলের ছিটে, মাটির ঘ্রাণ, রমা দির রান্নাঘরের আগুনের গন্ধ, মিনুর খিলখিল হাসি—এগুলো কোনো ফিল্টারে ধরা পড়ে না। এক বিকেলে সে খেতের পাশে হাঁটতে হাঁটতে দেখে দুলাল কাকু একপাশে বসে এক ছেলেকে শেখাচ্ছেন কিভাবে চক্রের গতি মাটির আকার পাল্টে দেয়। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে, যেন তার চোখের সামনে সময় থেমে আছে। কলকাতায় এমন মুহূর্ত হলে সে ক্যামেরা তুলত, একটা পাসিং শট নিত, তারপর একটা আবেগঘন ক্যাপশন লিখত—“Legacy of hands and heart”—কিন্তু এখন সে ছবি তোলে না, শুধু দেখেই সন্তুষ্ট থাকে। সে বুঝে যায়—সব ছবি ক্যামেরায় তোলা যায় না, কিছু ছবি চোখেই থাকুক, মনে থাকুক, আর হৃদয়ে জমে থাকুক।
রাতে ইরা তার পুরোনো ফোনের গ্যালারির কিছু ছবি দেখতে বসে, কিন্তু তার চোখ স্থির হয় একটি বিশেষ ছবিতে—নিজের এক জন্মদিনের, যেখানে সে একঝাঁক বেলুন, কেক আর রঙিন ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার চোখে কেমন যেন দৃষ্টি নেই। সে ভাবে, “এই ছবিটা হাজারজন লাইক করেছিল, অথচ আমি নিজেই জানতাম, সেই মুহূর্তে আমি কাঁদতে চাচ্ছিলাম।” সে ফোন বন্ধ করে, ডায়েরিতে লিখে—“আমরা অনেক সময় স্মৃতিকে বানিয়ে ফেলি; আমি এতদিন ধরে শুধু সাজানো স্মৃতির ছবি জমিয়েছি, কিন্তু এবার আমি আসল স্মৃতিগুলো বানাতে চাই।” ঘরের কোনায় রাখা তার বাঁকা পাত্রটার দিকে তাকিয়ে সে হালকা হেসে ফেলে—এই পাত্রটা হয়তো নিখুঁত নয়, কিন্তু একদিনের অভিজ্ঞতা, নিজের হাতের ছোঁয়া আর মাটির সঙ্গে বন্ধুত্বের সাক্ষ্য হয়ে রয়ে গেছে। সে বুঝে নেয়—জীবন একটা গল্প নয় যা সবসময় দেখাতে হয়, জীবন এক একটা মুহূর্ত যা শুধু অনুভব করতে হয়। সেই রাতে যখন সে ঘুমাতে যায়, তার মনে হয়—একটা সময় আসবে, যখন সে শহরে ফিরে যাবে, কিন্তু এই গ্রামের প্রতিটা স্মৃতি থাকবে তার সঙ্গে—ফিল্টার ছাড়া, গাঢ় হয়ে থাকা জীবনের আসল রংয়ে।
৭
ইরার নামতা গ্রামে কাটানো সময় যেন ধীরে ধীরে গলে এসে তার রক্তে মিশে গেছে, তার মন, শরীর, চোখ—সব কিছু এক আশ্চর্য ভারমুক্ত শান্তির মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে। আজ তার নামতা-র শেষ দিন, অন্তত আপাতত। সকালের আলোয় সে উঠোনে বসে রমা দির বানানো লুচি আর আলুর তরকারি খায়—এই খাবারের স্বাদ এতটাই আন্তরিক যে ইরা জানে, কোনো শহুরে রেস্তোরাঁতে এমন খাবার সে খুঁজে পাবে না। মিনু দৌড়ে এসে বলে, “আপনি চলে যাবেন? আমরা তো মাটি দিয়ে আপনাকে কিছু বানিয়েছি।” ইরার বুক একটু ভারী হয়ে ওঠে—এই ছোট্ট মেয়েটা, যার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছে মাত্র ক’দিনে, এমন আন্তরিকতা নিয়ে তাকে বিদায় জানাতে এসেছে! মিনু হাতে তুলে দেয় একটুকরো মাটির তৈরি ছোট্ট পাখি—যার পাখা ছড়িয়ে, চোখে রঙতুলির দাগ, আর নিচে আঁকা আছে একটি লাইন: “উড়তে গেলে নিজের পাখা চাই।”
ইরা সেটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। দুলাল কাকু এসে বলেন, “তুই নিজেকে খুঁজে পেয়েছিস, এখন আবার শহরে ফিরে গিয়ে নিজেকে হারাবি না যেন।” ইরার চোখে জল চলে আসে, কিন্তু সে হাসে, মাথা নাড়ে। রমা দি তার হাতে ছোট একটা খাবারের পুঁটলি দিয়ে বলেন, “যাত্রা পথে খেতে হবে, আর যখন মন খারাপ করবে, তখন মনে করবি—তোকে কেউ না চিনলেও, এই গ্রামে কেউ তোকে মনে রাখবে।” ইরা ফোনটা চালু করে—একটা একটানা কাঁপুনি আসে নোটিফিকেশনের; মেইল, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ডিএম—সব ভরে গেছে। সে স্থির চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, অথচ মন সেখানে নেই। এই কয়েকদিনে সে উপলব্ধি করেছে, স্ক্রিনের সংযোগ ছিন্ন করে সে যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে, তা কোনো কৃত্রিম ‘ফিড’-এ পাওয়া সম্ভব নয়। সে ফোনের সেটিংসে গিয়ে একটা নতুন রুল তৈরি করে—“সপ্তাহে একদিন: আনপ্লাগড ডে”—একটা অ্যালার্ম সেট করে দেয় যাতে প্রতি শুক্রবার তাকে মনে করিয়ে দেয় নিজের জন্য একটা দিন রেখে দিতে হবে।
স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই ইরা ট্রেনের জানালার ধারে বসে। পেছনে মাঠ, গাছ, দুলাল কাকুর উঠোন, মিনুর স্কুল, রমা দির চুলা—সব কিছু ছোট হয়ে যেতে থাকে, তবু তার বুকের মধ্যে সেই ছবিগুলো বড় হতে থাকে। ট্রেন ছুটছে, কিন্তু ইরার মনে হয়, তার ভিতরকার চলমানতাও নতুন কিছু শুরু করেছে। কলকাতায় পৌঁছে সে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসে, কিন্তু এবার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সে আর আগের মতো অনুভব করে না। দেয়ালের ছবিগুলো এখন কৃত্রিম লাগে, রিং লাইটের আলো চোখে লাগে, এবং আয়নায় নিজের মুখ দেখে সে মনে মনে বলে, “তুই ফিরেছিস, কিন্তু এবার ভেতরের আলোটা নিয়ে।” পরদিন সকালে সে নিজের ইনস্টাগ্রামে একটা নতুন পোস্ট দেয়—একটা খুব সাধারণ ছবি, কোনো মেকআপ নেই, পেছনে গ্রামের একটা মাঠ, আর ক্যাপশন: “Sometimes, to reconnect with the world, you must first unplug from it. #UnpluggedDiaries”।
মিনিট দশের মধ্যেই ডিএম ভরে যায়—“This is so real!”, “You look peaceful”, “Where is this place? I want to go too.” ইরা মনে মনে হাসে, কিন্তু এবার সে পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় নিজেকে খুঁজে পেতে চায় না। সে জানে, এই সংযোগ, এই নতুন ‘কানেক্টেড’ জীবন আর আগের মতো হবে না। এবার সে নিজের গল্প নিজের মতো করে বলবে, কোনো ফিল্টার ছাড়া। সে খাতা খুলে লিখতে শুরু করে—নতুন একটা অধ্যায়, নতুন এক জীবনের রূপরেখা, যেখানে ভার্চুয়াল নয়, বাস্তব হাসি, বাস্তব কান্না, বাস্তব প্রেম থাকবে। সে নিজের ভিতরে একটাই প্রতিজ্ঞা তোলে—সংযোগ থাকবে, কিন্তু তার আগে থাকবে নিজেকে জানা।
৮
কলকাতার ঘড়ির কাঁটা এখনো সেই পুরনো গতিতে চলে, রাস্তায় গাড়ির হর্ণ, বিলবোর্ডে ঝলমলে বিজ্ঞাপন, রিং লাইট আর ট্রেন্ডিং অডিওর দুনিয়ায় সকালের শুরু। কিন্তু এই শহরে ফিরে আসার পর ইরা সেন আর আগের মতো নেই। তার ফ্ল্যাট, যার প্রতিটি কোণ সাজানো ছিল ‘ইনস্টাগ্রামযোগ্য’ভাবে, এখন মনে হয় নিঃশব্দ আর অনাহূত। কিন্তু সে আর সেই নিঃশব্দকে ভয় পায় না। সে এখন জানে—এই নিঃশব্দের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়, আর সেই খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞতা এখন তার আত্মার সঙ্গে গাঁথা। ইরা নিজের কনটেন্টের ধরণ বদলে দেয়—সে আর পারফেক্ট লাইফস্টাইল ভিডিও বানায় না, বরং শুরু করে এক নতুন সিরিজ—Unplugged Diaries। সেখানে সে প্রতিদিনের ছোট ছোট অনুভব, গ্রামে শেখা অভিজ্ঞতা, মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠা নিখাদ সংযোগ আর নিজের ভেতরের প্রশ্নগুলো নিয়ে কথা বলে। তার প্রথম ভিডিওতেই সে বলে—“আজ আমি কোনো সাজ নিয়ে আসিনি, শুধু নিজেকে নিয়ে এসেছি। এই আমি তোমাদের ফলোয়ার না, এই আমি শুধুই আমি।”
ভিডিওটা ভাইরাল হয় না, কিন্তু অদ্ভুতভাবে অনেক ‘রিচ’ না পেলেও সেটার নিচে ভরে যায় গভীর কমেন্টে—“তোমাকে আজ চিনলাম”, “এমন একটা গল্প শুনে বুক হালকা হয়ে গেল”, “আমিও এবার unplug করবো”—এই প্রতিক্রিয়াগুলো ইরাকে আগের চেয়ে বেশি আনন্দ দেয়। সে বুঝতে পারে—যেখানে আগে সে হাজার লাইকেও ফাঁকা অনুভব করত, এখন কয়েকটা সত্যিকারের কথা তার মন ভরিয়ে দেয়। সেই পাত্রটা, যা সে নামতা-য় বানিয়েছিল, এখন তার ডেস্কে রাখা থাকে, একটা স্মৃতির মতো নয়, একটা প্রতীক হিসেবে—যেটা তাকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়, imperfect কিন্তু সত্যিকারের হবার সাহস কতটা প্রয়োজন। প্রতিদিনের কনটেন্টের মাঝে এখন সে একদিন রেখে দেয়—‘Silence Day’—যে দিন সে কিছু পোস্ট করে না, ফোন হাতে নেয় না, শুধু নিজেকে নিয়ে থাকে। সেই দিনগুলোতে সে কখনও কোনো পার্কে গিয়ে বসে, কখনও এক কাপ চা নিয়ে ছাদে চুপ করে আকাশ দেখে, কখনও শুধু একটা বই পড়ে—কোনো ক্যামেরা ছাড়া, কোনো কৃত্রিমতা ছাড়া।
এক বিকেলে, যখন সূর্য ঢলে পড়েছে, জানালার ধারে বসে ইরা সেই ছোট্ট পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকে—মাটির তৈরি, মিনুর হাতের কাজ, নিচে আঁকা সেই লাইন—“উড়তে গেলে নিজের পাখা চাই।” তার চোখে হালকা জল আসে, কিন্তু সেই জল দুঃখের নয়—তাতে থাকে বিস্ময়, কৃতজ্ঞতা আর গভীর ভালোবাসা। সে জানে, সে আবার নামতা-তে ফিরবে, শুধু একজন দর্শক হয়ে নয়, একজন সত্যিকারের মানুষ হয়ে। সে জানে, জীবনে সবসময় সংযুক্ত থাকা জরুরি নয়, বরং কখনো কখনো সবকিছু থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলে তবেই নিজেকে ভালোভাবে সংযুক্ত করা যায়। গল্পটা শেষ হয় যখন ইরা, নিজের জানালার ধারে বসে, কোনো ফোন ছাড়া, কোনো ক্যামেরা ছাড়া, শুধু একটি খোলা নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ হাসে। সেই হাসিটা ক্যাপচার হয় না, কিন্তু থেকে যায় তার ভিতরে—সবচেয়ে সত্যি, সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে মুক্ত। কারণ সে জানে—আনপ্লাগড হয়ে তবেই সে জেগে উঠেছে।
৯
শহরে ফেরার পর কেটে গেছে কিছু সপ্তাহ। ইরা সেন এখন আর সোশ্যাল মিডিয়ার তীব্র বর্ণচ্ছটায় ডুবে থাকেন না। সে যতটুকু যুক্ত থাকে, ঠিক ততটুকুই। আগের মতো প্রতিদিন স্টোরি পোস্ট করে না, আর ক্যাপশন নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা মাথা খারাপ করে না। এখন সে ধীরে কথা বলে, ধীরে হাঁটে, আর সবচেয়ে বড় কথা—ধীরে ভাবে। তার মধ্যে যেন একটা ঘন গভীরতা তৈরি হয়েছে, নামতা নামক সেই নির্জন গ্রামের ধুলো, আলো আর মানুষের সরলতা যা তাকে এক অন্য মানুষ করে গড়ে তুলেছে। “Unplugged Diaries” এখন আর শুধু একটা কনটেন্ট সিরিজ নয়, এটা একটা মনন, একটা আন্দোলন—নীরব এবং ব্যক্তিগত। সে মেসেজ পায় নামতা থেকে—মিনু স্কুলে নতুন গল্প লিখেছে, দুলাল কাকু তার আঁকা নিয়ে নতুন ওয়ার্কশপ শুরু করেছেন, রমা দি জিজ্ঞেস করেন, “তুই আবার কবে আসবি রে মা?” ইরা উত্তর দেয়, “শিগগিরই। কিন্তু এবার শুধু ঘুরতে নয়, কিছু দিতে চাই।”
এক সন্ধ্যায়, বইয়ের দোকানে ইরা নিজের একটা বই খুঁজতে যায়—একটা খসড়া পাণ্ডুলিপি, যা সে নিজেই লিখছে, নাম “আনপ্লাগড”। সেখানে সে তার অনুভব, পরিবর্তন, ভুল আর উপলব্ধিগুলোর কথা বলেছে। দোকানের কেয়ারটেকার এক বয়স্ক ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কি আগের সেই ইনফ্লুয়েন্সার ইরা সেন? যিনি খুব গ্ল্যামারাস ছিলেন?” ইরা হেসে বলেন, “হ্যাঁ, আমি সেই ইরা, কিন্তু এখন আমার রিংলাইট নেই, এখন আমি কেবল আলোয় বাঁচতে চাই।” এই উত্তর শুনে ভদ্রলোক চুপ করে থাকেন, তারপর বলেন, “আপনার গল্পটা একদিন পড়তে চাই”—ইরার বুক ভরে ওঠে। সে বুঝে যায়, এখন তাকে মানুষ মনে রাখছে কনটেন্ট দিয়ে নয়, হৃদয়ের স্পর্শ দিয়ে।
অবশেষে, সে ঠিক করে আবার ফিরে যাবে নামতা-য়—এইবার ক্যামেরা নিয়ে নয়, বরং কাগজ-কলম, বই আর গল্প নিয়ে। সে স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা ছোট্ট লাইব্রেরি গড়ে তুলতে চায়, মিনুর হাতে দিতে চায় রঙ-তুলি আর খাতা, আর দুলাল কাকুর সঙ্গে একসঙ্গে পাত্র তৈরি করতে চায়—not for show, but for soul। ট্রেনে চেপে সে আবার পৌঁছায় সেই ছোট্ট স্টেশনে, যেখানে কোনো বিজ্ঞাপন নেই, কেবল একটি বেঞ্চ আর খেজুর গাছের ছায়া। রিকশা থেকে নেমে সে হাঁটতে হাঁটতে রমা দির উঠোনে পৌঁছে—যেন এক চেনা নদীর ঘাটে ফিরছে কেউ। মিনু দৌড়ে আসে, দুলাল কাকু হাঁসেন, রমা দি বলেই ফেলেন, “তুই তো একেবারে পাল্টে গেছিস।” ইরা হেসে বলে, “না রে, আমি আসলে এখন নিজে হয়েছি।”
সেই রাতে তারা একসঙ্গে বসে, খাটের পাশে কুপি জ্বালানো আলোয় গল্প করে। ইরা চুপ করে থেকে ভাবে—এই আলোয় মুখের দাগ-ছোপগুলো গায়ে লাগে না, এখানে ফিল্টার দরকার নেই। এখানে সবাই যেমন, তেমন। সে জানে, সে শহরে আবার ফিরে যাবে, আবার কাজ করবে, কিন্তু এবার তার মধ্যে একটা শক্ত ভিত আছে, যেটা কোনো সোশ্যাল ট্রেন্ড না, বরং নিজের গভীর জীবনচর্চা। শেষ রাতে, সে মাঠের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ডায়েরিতে একটা লাইন লেখে: “এই ফিরে আসা কোনো পলায়ন নয়, এই ফিরে আসা নিজেকে নতুন করে পাওয়ার অঙ্গীকার।” আকাশে তখন একফালি চাঁদ, মাটির গন্ধ, আর তার পায়ের নিচে সেই পুরোনো ধুলা—যা তাকে শিখিয়েছে, কখনো কখনো নিজেকে খুঁজে পেতে হলে, নিজেকে হারাতে হয় ঠিক এমন এক জায়গায়, যেখানে ফোন কাজ করে না, কিন্তু হৃদয় করে।
১০
নামতা এখন আর ইরার জন্য শুধুমাত্র একটি গ্রাম নয়, এটি তার মানসিক মানচিত্রের এক পবিত্র ঠিকানা, যেখানে সে নিজেকে নতুন করে চিনেছে, গড়েছে এবং ভালোবেসেছে। শহরের ফেরার আগে ইরা স্কুলে যায়—সঙ্গে নিয়ে যায় নিজের তৈরি কিছু গল্পের বই, আঁকার খাতা, রঙতুলি আর কয়েকটি ছোট ছোট উপহার। ছেলেমেয়েরা তাকে ঘিরে ধরে, তাদের চোখে যে উচ্ছ্বাস, তা কোনো ক্যামেরা ধরে রাখতে পারে না। রত্না দি চোখে জল নিয়ে বলেন, “তুই এসেছিস, এটাই আমাদের বড় পাওয়া।” দুলাল কাকু পেছন থেকে একটা পাত্র হাতে এগিয়ে দেন—মাটির তৈরি, যার গায়ে আঁকা লেখা: “আলো বহে ভিতর থেকে”। ইরা পাত্রটা হাতে নিয়ে অনুভব করে—এই একটা লাইনের ভেতরে তার গোটা পরিবর্তনের কাহিনি লুকিয়ে আছে। রমা দি তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “তুই যেমন এসেছিলি, তেমন থাকিস—নিজের মতো। আর নিজের ভিতরের আলোটাকে নিভতে দিস না।”
ট্রেনে ফেরার সময় ইরা জানালার পাশে বসে থাকে, কিন্তু তার মন আজ আর ছুটছে না, বরং গভীরভাবে স্থির হয়ে গেছে। তার ব্যাগে এখন কোনো মেকআপ কিট নেই, নেই কোনো স্ক্রিপ্টেড রিলের পরিকল্পনা—আছে কিছু গল্প, কিছু অদৃশ্য স্পর্শ, আর অনেকগুলো নিঃশব্দ উপলব্ধি। শহরে ফিরে সে আবার নিজের ঘরে ঢোকে—কিন্তু এবার সে প্রথমেই ফোন চালু করে না, বরং বইয়ের আলমারিতে জায়গা করে নেয় নামতা থেকে আনা পাত্রটা। তার ডেস্কে লেখা একটা নতুন স্লোগান: “Being seen is easy. Being whole is rare.” সে সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়—তার নতুন বই প্রকাশ হবে খুব শিগগিরই, নাম হবে ঠিক সেই কথাটাই যা তার জীবন বদলে দিয়েছে—“আনপ্লাগড”।
দিন, সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে যায়। ইরার জীবন বদলাতে থাকে, কিন্তু এই বদল আর কৃত্রিম নয়। সে মাঝে মাঝে শহরের একেকটি স্কুলে যায়—কথা বলে কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে, যারা সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে পথ হারিয়ে ফেলেছে। সে তাদের শেখায়—স্ক্রিনে দেখা মুখটাই সব নয়, বাস্তবের মুখ আরও স্পষ্ট, আরও জীবন্ত। সে নিজের জীবন থেকে নেওয়া গল্প বলে, নামতা গ্রামের কথা বলে, মিনুর কথা বলে, সেই পাত্রের কথা বলে, যার বাঁকানো রূপ তাকে শিখিয়েছে—পরিপূর্ণতার চেয়ে সত্যতা অনেক বেশি শক্তিশালী। একটা অনুষ্ঠানে সে মঞ্চে উঠে বলে—“আমি একসময় দৌড়াচ্ছিলাম, অনেক দূর গিয়েছিলাম, কিন্তু কোথাও পৌঁছোতে পারিনি। এখন আমি হেঁটে চলেছি, ধীরে, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি।” সেই কথায় করতালির শব্দ ওঠে, কিন্তু ইরা জানে, তার সবচেয়ে গভীর সম্মতি এসেছে নিজের ভেতর থেকে।
এক রাতে, ছাদে চুপ করে বসে, চাঁদের আলোয় ইরা সেই পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকে—মাটির তৈরি, মিনুর হাতে আঁকা, নিচে লেখা: “উড়তে গেলে নিজের পাখা চাই।” সে এবার হাসে, না কোনো তপ্ত চোখে, না কোনো আফসোসে—বরং সেই শান্ত, স্থির হাসি, যা নিজের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়ে গেলে আসে। সে জানে, এখনো তার যাত্রা শেষ নয়—বরং প্রতিদিন সে নিজেকে নতুন করে খুঁজবে, জাগাবে, গড়বে।
আর এই গল্পের শেষ লাইন লিখে সে ডায়েরির পাতায় একটিই বাক্য যোগ করে—
“আমি আর কখনো নিজেকে হারাব না, কারণ এখন আমার কাছে নিজের ঠিকানার নাম—আনপ্লাগড।”
সমাপ্ত




