Bangla - ভূতের গল্প

আত্মার নদী

Spread the love

ইন্দ্রনীল নস্কর


প্রায় সন্ধ্যার আগমুহূর্তে অর্ণব সেন পৌঁছালো সেই অজপাড়া গাঁয়ে। শহরের চওড়া রাস্তা, আলো ঝলমলে বিলবোর্ড আর ব্যস্ত ট্রাফিকের ভিড় পেরিয়ে, ধীরে ধীরে যখন গ্রামের সরু কাঁচা পথে প্রবেশ করল, তখন মনে হলো যেন অন্য এক জগতে এসে পড়েছে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, কেবল মাঝে মাঝে দূরে শোনা যাচ্ছে শিস দিয়ে হাওয়া বয়ে চলার শব্দ। কোথাও কোথাও কয়েকটি ঝুপড়ি ঘর, ছোট ছোট বাঁশবনের আড়াল, আর সেগুলোর ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা গরু-মোষের ঘণ্টাধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছে গোধূলির আলোয়। এই গ্রামটির কথা অর্ণব আগেই শুনেছিল—একটি প্রাচীন লোককথার জন্য বিখ্যাত। নদীর ধারে নাকি এমন সব ঘটনা ঘটে, যা মানুষের কল্পনারও অতীত। অর্ণব ইতিহাস গবেষক, লোককথা ও গ্রামীণ কাহিনির ভেতর থেকে ইতিহাসের শিকড় খুঁজে বের করাই তার কাজ। তাই এই গ্রামে আসা তার নিছক ভ্রমণ নয়, বরং একপ্রকার অনুসন্ধানী অভিযান। সে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কাঁচা রাস্তায় এগোতে এগোতে মনে করছিল, শহরের আরামের ঘর থেকে এত দূরে আসার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল, তবু ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত আকর্ষণ টানছিল তাকে—সেই নদীর দিকে, যার নাম উচ্চারণ করতেই গ্রামের মানুষ কেঁপে ওঠে।

গোধূলির আলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছিল। আকাশে তখন আধো আলো আধো আঁধার, দূরে একটি পাখির ঝাঁক ভেসে যাচ্ছিল পশ্চিম দিগন্তের দিকে। অর্ণব যখন গ্রামের বাঁশঝাড় পেরিয়ে নদীর ধারে পৌঁছাল, তখন তার মনে হলো এ যেন ক্যানভাসে আঁকা কোনো ছবির মতো দৃশ্য। নদীর বুক বিস্তৃত, তাতে হালকা ঢেউয়ের খেলা, আর তার উপর ভেসে উঠছে লালচে রঙের প্রতিফলন। আকাশের শেষ আলোকরেখা জলের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে, চারপাশে হালকা কুয়াশা নেমে এসেছে। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে অর্ণব যেন সময়কে থমকে যেতে দেখল। সে মনে মনে নোট করতে লাগল—“প্রথম দর্শনেই নদী আমাকে মোহিত করল। চারপাশে রহস্যের আবেশ, অথচ কী এক অদ্ভুত শান্তি।” কিন্তু তার সেই শান্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ পেছন থেকে এক বৃদ্ধ কণ্ঠ ভেসে এলো—“বাবা, এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আজ পূর্ণিমা, সন্ধ্যা নামছে, নদীর ধারে দাঁড়ানো উচিত নয়।” অর্ণব পিছনে তাকিয়ে দেখল একজন সাদা ধুতি আর মলিন শার্ট পরা বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে ভয় আর সতর্কতার ছাপ। বৃদ্ধ আরও বললেন—“আমাদের গ্রামে লোকজন এই সময়ে নদীর কাছে আসে না। শুনেছি তুমি শহর থেকে এসেছো গবেষণা করতে, কিন্তু সাবধান থেকো। এই নদীর ইতিহাস বইয়ে লেখা নেই, এর ভেতরে আছে আত্মার কান্না।” কথাগুলো শুনে অর্ণব একটু কেঁপে উঠলেও চুপ করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ভেতরে ভেতরে সে আরও কৌতূহলী হয়ে উঠছিল, কারণ এমন সতর্কবাণীই তো তাকে টানে অজানা সত্য খুঁজতে।

ঠিক তখনই নদীর ধারে আরেকটি দৃশ্য তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এক তরুণী হাতে মাটির প্রদীপ নিয়ে নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে জল তুলছিল। মেয়েটির পরনে ছিল হালকা নীল শাড়ি, চুল বাঁধা, চোখে যেন এক অদ্ভুত গভীরতা। সে জল ভরতে ভরতে একবার তাকালো অর্ণবের দিকে। চোখাচোখি হতেই অর্ণব অনুভব করল অজানা এক টান, যেন অনেকদিন আগে কোথাও দেখা সেই দৃষ্টি আবার ফিরে এসেছে। মেয়েটি ধীর কণ্ঠে বলল—“আপনি কি নতুন এসেছেন গ্রামে?” অর্ণব মাথা নেড়ে উত্তর দিল—“হ্যাঁ, আমি শহর থেকে এসেছি। শুনেছি এখানে নদী নিয়ে অনেক গল্প আছে।” মেয়েটি হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল—“গল্প নয়, সত্যি। আমার ছোট ভাই এই নদীতে ডুবে গিয়েছিল পূর্ণিমার রাতে। তারপর থেকেই মানুষ বলে, নদীর জলে আত্মারা ডাক দেয়। পূর্ণিমার রাতে কেউ নদীর ধারে এলে সে আর ফেরে না।” কথাগুলো শুনে অর্ণবের শরীর শিউরে উঠল। মেয়েটির নাম জানা গেল—সন্ধ্যা। অর্ণবের মনে হলো, তার গবেষণার পথচলায় এ মেয়ে হয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী হয়ে উঠবে। সেই প্রথম পরিচয়েই সন্ধ্যা যেন তাকে নদীর রহস্যের ভেতর টেনে নিয়ে গেল। আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ ধীরে ধীরে মাথা তুলছে, নদীর জলে প্রতিফলিত আলোয় অর্ণব বুঝতে পারল—তার অভিযান কেবল শুরু হয়েছে।

গ্রামের প্রথম রাতেই অর্ণব ঘুমোতে পারেনি। বাইরের কাকডাকা ভোরের মতো নীরবতা, মাঝে মাঝে দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছিল। মাটির বাড়ির ভেতর কুপি জ্বালিয়ে সে তার ডায়েরিতে নোট করছিল নদীর প্রথম দর্শনের অভিজ্ঞতা। তখনই দরজার আড়াল থেকে হালকা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। দরজা ঠেলে ঢুকল সন্ধ্যা, হাতে একটি লণ্ঠন। সে বলল, “আজ হয়তো আপনার ঘুম আসবে না। যারা প্রথমবার এই গ্রামে আসে, তাদের চোখে সবকিছুই নতুন লাগে। কিন্তু নদীটা… একে কখনো হেলাফেলা করবেন না।” অর্ণব অবাক হয়ে তাকাল। সন্ধ্যার চোখে যেন ভয় আর বেদনার ছায়া। একটু চুপ করে সে বলল, “আপনি জানেন তো, আমি গবেষণা করতে এসেছি। এই নদী নিয়ে যত গল্প শুনছি, সবই লিখে রাখতে চাই। কিন্তু সত্যিই কি এমন কিছু আছে?” সন্ধ্যা একটু হেসে নিঃশ্বাস ফেলল—“আমার ভাই, অমিত। বয়স তখন মাত্র দশ। পূর্ণিমার রাতে খেলার ছলে সে নদীর ধারে চলে গিয়েছিল। তারপর থেকে আর তাকে পাওয়া যায়নি। কেউ বলল সে নদীতে ডুবে গেছে, কেউ বলল নদী তাকে ডেকে নিয়েছে। সেদিন থেকে আমার মায়ের চোখে ঘুম নেই। পুরো গ্রামও বিশ্বাস করে, যারা এখানে ডুবে যায়, তাদের আত্মা নদীর ভেতরে আটকে থাকে। আর পূর্ণিমার রাতে তারা নতুন কাউকে ডেকে নেয়, যেন তাদের দলে ভিড়ায়।” অর্ণব তার কথা শুনে গভীরভাবে ভাবল—এ যেন নিছক কুসংস্কার নয়, বরং এক অমোঘ বিশ্বাস, যা গ্রামের প্রতিটি মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে।

পরদিন বিকেলে অর্ণব নদীর ঘাটে গেল সন্ধ্যার সঙ্গে। সেখানে বসে ছিলেন হরিপদ দাস, যাকে সবাই হরিদা বলে ডাকে। বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি, মাথায় সাদা টুপি, গায়ে জীর্ণ শাল। তার চোখে যেন বহু অদেখা গল্প লুকিয়ে আছে। নদীর ধারে বসে বাঁশের চোঙায় বিড়ি টানছিলেন তিনি। অর্ণব কাছে যেতেই হরিদা হাসল—“তুমি শহরের ছেলে, না? শুনেছি নদী নিয়ে খোঁজখবর করতে এসেছো। এই নদী তোমাকে যতটুকু জানাতে চাইবে, ততটুকুই জানতে পারবে। বেশি জানতে চাইলে বিপদ।” অর্ণব তাকে উৎসাহ দিয়ে বলল, “আপনি এতদিন এখানে আছেন, নিশ্চয়ই কিছু জানেন। একটু বলুন।” তখন হরিদা ধীরে ধীরে লোককথার দরজা খুলে দিল। সে বলল, “অনেক বছর আগে, এই নদীটাকে গ্রামবাসী পূজা করত। বিশ্বাস ছিল, নদী এক দেবী, সে জীবন দেয় আবার জীবন কাড়েও। যারা ডুবে যায়, তাদের আত্মা নদীর বুকে বন্দী হয়ে থাকে। পূর্ণিমার রাতে কুয়াশার ভেতর দিয়ে সেই আত্মারা বের হয়। তারা ডাক দেয়—মানুষের কানে শোনা যায় প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর। কেউ যদি সেই ডাকে সাড়া দেয়, সে সোজা নদীতে নেমে যায়, আর আর কখনো ফেরে না। আমি নিজে আমার চোখে দেখেছি এক যুবককে, রাতের বেলায় হাঁটতে হাঁটতে নদীর জলে ঢুকে গেল। তাকে কেউ টেনে নিল বলে মনে হয়নি, কিন্তু তার চোখ ছিল যেন অন্য জগতের দিকে চেয়ে।” হরিদার গলায় কাঁপন, চোখে ভয়, তবু অভিজ্ঞতার দৃঢ়তা অর্ণবকে চমকে দিল।

সন্ধ্যা চুপচাপ শুনছিল। হরিদার কথাগুলো তার ভেতরে পুরোনো ক্ষতকে আবার জাগিয়ে তুলল। সে ফিসফিস করে বলল, “আমার ভাইও হয়তো এমনই কোনো ডাকে সাড়া দিয়েছিল। হয়তো নদী তাকে মিথ্যে আশা দেখিয়েছিল—মা ডাকছে, কিংবা খেলার সাথীরা ডাকছে।” অর্ণব এই কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। তার বৈজ্ঞানিক মন বারবার বলছিল, এগুলো নিছক লোককথা, গ্রামীণ মানুষের ভয় আর দুঃখ থেকে জন্ম নেওয়া গল্প। কিন্তু অন্যদিকে তার গবেষক হৃদয় টানছিল এই রহস্যময় অজানার দিকে। গ্রামবাসীর আতঙ্ক, সন্ধ্যার ব্যক্তিগত বেদনা আর হরিদার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মিলিয়ে যেন অদ্ভুত এক জটিল সত্য গড়ে উঠছিল। সে মনে মনে ঠিক করল—এখানে কিছু না কিছু খুঁজে বের করতে হবে, যা এই কিংবদন্তির ভেতর লুকিয়ে আছে। রাত তখন ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছিল। নদীর উপর চাঁদের আলো পড়তে শুরু করেছে। বাতাসে শিহরণ জাগানো নীরবতা। আর অর্ণব বুঝতে পারছিল, সে এক ভয়ঙ্কর অভিযানের প্রথম সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গেছে।

পরের দিন সকালে গ্রাম যেন অর্ণবকে অন্যভাবে গ্রহণ করল। যেদিকে সে যাচ্ছে, সেদিকে গ্রামের মানুষ তার দিকে কৌতূহল আর ভয়ের মিশ্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কেউ কেউ অভিবাদন করছে, আবার কেউ কেউ মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে, যেন তার উপস্থিতিই অশুভ সংকেত। সন্ধ্যা তাকে বলল—“গ্রামের মুখিয়া আজ তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান। সাবধান থেকো, উনি খুব গম্ভীর মানুষ, সহজে কাউকে বিশ্বাস করেন না।” অর্ণব মনে মনে হাসল—সে জানে, সত্য উদ্ঘাটন করতে হলে ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী মানুষের আস্থা অর্জন করতেই হয়। দুপুরের একটু পরেই তারা মুখিয়ার বাড়ির পথে পা বাড়াল। গ্রামের এক প্রান্তে বড় দোতলা পাকা বাড়ি, লোহার গেট, সামনে তুলসী মঞ্চ আর পাশে কয়েকজন গৃহকর্মী। অন্য গ্রামবাসীর ঘরের সঙ্গে তুলনা করলে এ যেন আলাদা এক সাম্রাজ্য। অর্ণব বাড়ির বারান্দায় পা রাখতেই এক অদ্ভুত চাপা গাম্ভীর্য তাকে ঘিরে ধরল। ভেতরে বসে আছেন পঞ্চানন ঘোষ, গ্রাম্য পোশাকেই অথচ তার ভঙ্গি যেন জমিদারের মতো। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, কপালে ভাঁজ, আর মুখের রেখায় এক অচেনা কঠোরতা।

অর্ণব ভদ্রভাবে প্রণাম করতেই পঞ্চানন গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। কণ্ঠস্বর গম্ভীর, অথচ নীচে যেন এক চাপা ক্রোধ লুকিয়ে আছে। তিনি বললেন—“শুনেছি তুমি শহর থেকে এসেছো গবেষণা করতে। গ্রামকে নিয়ে বই লেখার ইচ্ছে আছে, তাই তো?” অর্ণব মাথা নেড়ে বলল—“হ্যাঁ, আমি লোককথা আর ইতিহাসের যোগসূত্র খুঁজছি। এখানে নদী নিয়ে যে কিংবদন্তি রয়েছে, তার ভেতরে কিছু সত্য লুকিয়ে আছে বলে মনে করি।” পঞ্চাননের চোখ মুহূর্তের জন্য ঝলসে উঠল। তিনি সামনে ঝুঁকে এসে ধীরে ধীরে বললেন—“শোনো বাবু, গ্রামে লোককথা যতই থাকুক, সব জায়গায় উঁকি মারার চেষ্টা করোনা। নদীটা আমাদের অভিশাপ, আবার আশীর্বাদও। ওটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে তোমার সর্বনাশ হবে। আমি বলছি—পূর্ণিমার রাতে নদীর ধারে যেও না। কতজন গেছে, কতজন ফেরেনি, তার হিসেব নেই। এই গ্রাম শান্তিতে আছে কারণ আমরা ওর নিয়ম মেনে চলি। তুমি যদি ওসব ভাঙতে চাও, তাহলে ফল ভয়ঙ্কর হবে।” তার কণ্ঠস্বর মুহূর্তে যেন বজ্রপাতের মতো হয়ে উঠল। অর্ণব অনুভব করল, শুধু ভয় নয়, পঞ্চাননের চোখে গোপনতার ছাপও রয়েছে। তিনি কিছু জানেন, যা ইচ্ছে করেই লুকিয়ে রাখছেন।

সন্ধ্যা তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। পঞ্চাননের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন তাকেও ভেদ করে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর অর্ণব শান্ত কণ্ঠে বলল—“আমি কাউকে বিরক্ত করতে চাই না। কেবল ইতিহাস জানতে চাই। কেন এত মৃত্যু, কেন এত ভয়ের কাহিনি—এসব লিপিবদ্ধ করলেই বা ক্ষতি কী?” পঞ্চানন হঠাৎ একটুখানি হাসলেন, কিন্তু সেই হাসিতে উষ্ণতা ছিল না, বরং কৌতুক আর হুমকির ছায়া। তিনি বললেন—“ইতিহাস সবসময় লেখা যায় না, বাবু। কিছু ইতিহাস মাটির তলায় চাপা থাকে, কিছু ইতিহাস নদীর জলে ডুবে থাকে। তুমি যদি ওগুলো টেনে তুলতে চাও, তবে তা তোমাকেই টেনে নেবে।” কথাগুলো শুনে অর্ণবের ভেতরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কিন্তু তার কৌতূহল আরও তীব্র হয়ে উঠল। সে বুঝল, নদীর রহস্য শুধু লোককথা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গ্রামবাসীর ভয়, আর হয়তো পঞ্চাননের নিজের কোনো গোপন অতীত। বিদায়ের সময় পঞ্চানন আবারও সতর্ক করে বললেন—“মনে রেখো, নদী তোমার শত্রু নয় যদি তুমি তার নিয়ম মানো। কিন্তু তুমি যদি তাকে অবহেলা করো, তবে আর কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।” অর্ণব নীরবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো, কিন্তু তার মনে তখন একটাই কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—সত্য লুকিয়ে আছে নদীর ভেতরে, আর সেই সত্যের মুখোমুখি হতে হবে তাকেই।

গ্রামে অর্ণবের আগমনের কয়েকদিন পরেই এলো আরেক নতুন মুখ—ড. রণজিৎ সেন। শহরের নামকরা মনোবিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। অর্ণবের সঙ্গে তার আলাপ আগেই হয়েছিল গবেষণা সংক্রান্ত কাজে; এবার তিনি নিজেই গ্রামে এলেন অর্ণবের অনুরোধে। গ্রামের মানুষ প্রথমে ভেবেছিল, তিনি হয়তো কোনো বড়ো ডাক্তার, অসুখ সারাতে এসেছেন। কিন্তু যখন শোনা গেল তিনি আসলে ভৌতিক লোককথা আর মানুষের মানসিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেন, তখন অনেকে ভুরু কুঁচকাল। সন্ধ্যা অবাক চোখে দেখছিল—একদিকে অর্ণব, যে নদীর রহস্য খুঁজতে এসেছে, আরেকদিকে ড. রণজিৎ, যিনি যুক্তি দিয়ে সবকিছু খণ্ডন করতে চান। প্রথম সন্ধ্যাতেই তিনি গ্রামবাসীর এক আড্ডায় যোগ দিলেন, পঞ্চানন ঘোষের দাওয়ায় বসে চারপাশে অনেকেই ভিড় জমাল। বাতাসে কৌতূহল, সন্দেহ আর ভয়ের গন্ধ মিশে ছিল।

ড. রণজিৎ শান্ত কণ্ঠে বললেন—“আপনারা যেটাকে আত্মার ডাক বলেন, সেটা আসলে মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রম। পূর্ণিমার রাতে পরিবেশ আলাদা হয়, আলো-আঁধারি আর কুয়াশা মিলে মানুষের মস্তিষ্ক ভ্রম সৃষ্টি করে। ভয় পেলে মস্তিষ্ক অনেক সময় এমন শব্দ বা দৃশ্য কল্পনা করে, যা বাস্তবে নেই। এভাবেই কারও মনে হতে পারে, মৃত আত্মীয়ের ডাক শুনছে। এটা আসলে ‘অডিটরি হ্যালুসিনেশন’।” তিনি কিছু বই খুলে গ্রামবাসীকে ছবি দেখালেন—মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে ভয়ের প্রভাবে বিভ্রান্ত হয়। কিন্তু তার যুক্তি গ্রামবাসীর মনে কোনো প্রভাব ফেলল না। বৃদ্ধ মাঝি হরিদা সোজা বলে দিল—“ডাক্তারবাবু, আমরা তো নিজের চোখে দেখেছি। কুয়াশার রাতে মানুষের চোখে ফাঁকা দৃষ্টি, তারা হেঁটে যায় নদীর দিকে। কেউ বাধা দিতে পারে না। ওটা কি সব বিভ্রম?” একজন মহিলা কাঁপা কণ্ঠে বলল—“আমার স্বামীকে আমি নিজের চোখে দেখেছি নদীর জলে নামতে। আমি তাকে ডাকলাম, সে ফিরেও তাকাল না। আপনার বই কি সেই শূন্য দৃষ্টি ব্যাখ্যা করতে পারবে?” মানুষের কণ্ঠে যন্ত্রণা, কান্না, আর অটল বিশ্বাস—ড. রণজিৎ যতই বৈজ্ঞানিক যুক্তি দেন, ততই মনে হলো তারা তাকে প্রতিরোধ করছে।

অর্ণব মাঝখানে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। সে জানত, বিজ্ঞান যুক্তি দেয়, কিন্তু বিশ্বাসে যুক্তি চলে না। পঞ্চানন ঘোষ তখন গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—“ডাক্তারবাবু, আমরা অশিক্ষিত হতে পারি, কিন্তু বোকা নই। এই নদী নিয়ে যে ভয়, সেটা গল্প নয়—এটা আমাদের রক্তে, আমাদের জীবনে গাঁথা। আপনি শহরে বসে বই পড়ে যা শিখেছেন, আমরা তা নিজেদের জীবন দিয়ে শিখেছি। আপনারা বলছেন বিভ্রম, আমরা বলছি অভিশাপ। সত্যি কোনটা, তা নিয়ে তর্কের দরকার নেই। তবে মনে রাখবেন, যে নদীকে আমরা ভয় করি, তার নিয়ম ভাঙা মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা।” ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। কেউ কেউ রণজিতের কথায় ক্ষুব্ধ, কেউ আবার চুপচাপ ভয়ে গুটিয়ে গেল। অর্ণব বুঝতে পারল, গ্রামে বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব কেবল যুক্তির প্রশ্ন নয়—এ যেন এক গভীর মানসিক লড়াই। নদীর কিংবদন্তি গ্রামবাসীর কাছে শুধু কুসংস্কার নয়, বরং তাদের অস্তিত্বের অংশ। আর বিজ্ঞান এসে সেই অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছে। সেই রাতে অর্ণব শুয়ে থাকতে থাকতে ভাবছিল—হয়তো সত্যিটা মাঝখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে, যেখানে বিজ্ঞান ব্যাখ্যা দিতে পারে না আর বিশ্বাস উত্তর খুঁজতে চায়।

সেই রাতে আকাশ যেন অদ্ভুত এক রহস্যে মোড়া। পূর্ণিমার চাঁদ ধবধবে আলো ছড়াচ্ছে, অথচ সেই আলোয় নদীর ধারে জমেছে কুয়াশার ঘন পর্দা। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু দূরে কোথাও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর মাঝেমধ্যে কুকুরের ডেকে ওঠা। অর্ণব আর সন্ধ্যা নিরবে হাঁটতে হাঁটতে নদীর দিকে এগোল, যেন অজানার টানে পা চলছে। তারা দু’জনেই জানত, গ্রামের নিয়ম ভেঙে ফেলছে, কিন্তু কৌতূহল আর অদৃশ্য টান তাদের আটকাতে পারল না। নদীর কাছে পৌঁছে তারা থমকে গেল—কুয়াশার ভেতরে নদীর জল চিকচিক করছে রুপোর মতো, কিন্তু জলের ওপরে যেন হালকা নড়াচড়া। মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য কেউ সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ করেই ভেসে এলো অদ্ভুত এক শব্দ—ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকা ডাক, যেন অজানা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে বলছে—“এসো… এসো…”। সন্ধ্যা কেঁপে উঠল, তার শরীর জমে গেল ভয়ে। অর্ণব কানে হাত দিয়ে শুনল, কণ্ঠস্বর নদীর ভেতর থেকে আসছে, আবার বাতাসের দিক থেকেও ভেসে আসছে। শব্দটা এত গভীর, এত শীতল যে মনে হলো কোনো অচেনা শক্তি তাদের দু’জনকে টেনে নিচ্ছে।

ঠিক তখনই পিছন থেকে কাঁপা গলায় আওয়াজ শোনা গেল—“ওরা আত্মারা!” চমকে পেছনে তাকিয়ে অর্ণব দেখল, বৃদ্ধ মাঝি হরিদা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ ফ্যাকাসে, চোখ ভয়ে বড়ো হয়ে গেছে। কাঁপা হাতে লাঠি আঁকড়ে ধরে সে বলল—“পিছনে চলো, আর এক পা-ও এগিয়ো না। এ কণ্ঠস্বরের মানে জানো না তোমরা।” হরিদার চোখে আতঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে ছিল অব্যক্ত যন্ত্রণা, যেন সে অতীতে এই ডাক শুনেছে এবং তার ফল ভুগেছে। সন্ধ্যা থরথর করে কাঁপছিল, তার ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিস করে বলল—“ওই তো… ওই কণ্ঠটা আমার ভাইয়ের মতো শোনাচ্ছে…”। কথাটা শুনে অর্ণবের বুক কেঁপে উঠল। সে জানত, সন্ধ্যার ভাই ছোটবেলায় এই নদীতেই ডুবে মারা গিয়েছিল। তাহলে কি সত্যিই মৃতরা পূর্ণিমার রাতে ফিরে আসে, নাকি ভয় আর স্মৃতির মায়া কণ্ঠস্বরকে রূপ দিচ্ছে? অর্ণব এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধায় পড়ল—তার মনের বৈজ্ঞানিক কৌতূহল তাকে সামনে যেতে বলছিল, অথচ শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা ভয় আর শীতলতায় অবশ হয়ে আসছিল।

কণ্ঠস্বর তখন আরও কাছে আসছে, স্পষ্ট, যেন সত্যিই নদীর গভীর থেকে কেউ হাত বাড়িয়ে ডাকছে—“এসো… এসো…”। নদীর জলও যেন অস্বাভাবিকভাবে নড়ছে, ছোট ছোট ঢেউ উঠে ধীরে ধীরে তীরে আছড়ে পড়ছে। হরিদা কাঁপা কণ্ঠে বলল—“তোমরা বোঝো না, এ ডাক মানুষের নয়। এটা সেইসব আত্মার ডাক, যারা মুক্তি পায়নি। তারা নতুন কাউকে খুঁজছে, তাদের সঙ্গ দিতে। এই গ্রামে যত মৃত্যু হয়েছে, তার অর্ধেকই এই ডাকে সাড়া দিয়ে হয়েছে।” অর্ণব তখন ভেতরে ভেতরে তর্ক করতে চাইছিল—এ সব হয়তো প্রাকৃতিক শব্দ, বাতাসের খেলা, কিংবা মনস্তাত্ত্বিক ভ্রম। কিন্তু তার ঠোঁট থেকে কোনো কথা বেরোল না। বরং মনে হচ্ছিল, অজানা শক্তি তাকে জোর করে নদীর দিকে টেনে নিচ্ছে। সন্ধ্যা তার হাত শক্ত করে ধরে ফিসফিস করে বলল—“ওখানে যেও না, অর্ণব… আমার ভাইয়ের মতো তুমি-ও হারিয়ে যাবে…”। বাতাসে অদ্ভুত শীতলতা, কুয়াশা আরও ঘন হয়ে এল, আর সেই ডাক যেন চারদিক থেকে ভেসে আসতে লাগল। হরিদা কাঁপতে কাঁপতে তাদের টেনে নিয়ে যেতে চাইল, “চলো, তাড়াতাড়ি চলো, নাহলে কেউ আর আমাদের ফিরতে দেবে না।” তিনজনের ছায়া কুয়াশার ভেতর মিলিয়ে গেল, কিন্তু পেছনে রয়ে গেল সেই ভৌতিক ডাক—“এসো… এসো…”—যা এখনও নদীর বুক চিরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

পরদিন সকালে গ্রামের হাওয়া যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। ভোরবেলায় মাঠে কাজ করতে যাওয়া কয়েকজন কৃষক খবর দিল—রাত থেকে গ্রামের এক যুবক, নাম রতন, নিখোঁজ। সে আগের রাতে বাজার থেকে ফিরছিল, আর শেষবার তাকে কেউ দেখেছিল নদীর ধারে হাঁটতে। তারপর আর তার কোনো খোঁজ নেই। খবরটা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়তেই চারপাশে শোরগোল পড়ে গেল। নারীরা কাঁদতে শুরু করল, পুরুষরা ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। কারও চোখে আতঙ্ক, কারও চোখে সন্দেহ। গ্রামের বৃদ্ধেরা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল—“আমরা বলেছিলাম, পূর্ণিমার রাতে নদীর কাছাকাছি যাওয়া মানেই বিপদ। এবার আবার প্রমাণ মিলল।” সন্ধ্যা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছিল, আগের রাতের সেই ভৌতিক ডাক যেন সত্যিই কাউকে টেনে নিয়েছে। অর্ণবও খবর শুনে শিউরে উঠল। রাতের অভিজ্ঞতা এখনো তার মনে তাজা, আর সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার মিল খুঁজে সে অস্বস্তি অনুভব করল। তবুও সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—“এটা কাকতালীয় হতে পারে না। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, আসলে কী ঘটছে।”

মুখিয়া পঞ্চানন ঘোষ সেই সময় এগিয়ে এলেন। তার চেহারায় ছিল গম্ভীরতা, কিন্তু চোখে অদ্ভুত অস্থিরতা। তিনি গ্রামবাসীর সামনে ঘোষণা করলেন—“কোনো হৈচৈ করার দরকার নেই। হয়তো ছেলেটা অন্য কোথাও গেছে, বা শহরে কোনো কাজে বেরিয়েছে। আমরা চাই না, গ্রাম নিয়ে বাইরের লোকেরা হাসাহাসি করুক। তাই এই ব্যাপারটা চেপে রাখাই ভালো।” কথাটা শুনে লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। অনেকেই বুঝতে পারল, মুখিয়া আসলে ভয় চেপে রাখতে চাইছে। কিন্তু হরিদা সেই গলা চিরে উঠল—“না মুখিয়া, তুমি যতই লুকোও, নদীর ডাকে কেউ না কেউ তো যায়ই। রতনকে ওরা ডেকেছে। আমরা নিজের চোখে না দেখলেও বুঝতে পারি।” গ্রামবাসী তখন আরও ভীত হয়ে পড়ল। কেউ বলল, রতনের আত্মা হয়তো এখনই নদীতে ঘুরছে, আবার কারও ধারণা, সে হয়তো আর জীবিত নেই। এভাবেই ভয় যেন গ্রামের রক্তে ঢুকে পড়ছিল, আর মুখিয়ার সতর্কতা সেটিকে চেপে রাখার পরিবর্তে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল।

অর্ণব তখন চুপ করে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল, কিন্তু তার ভেতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা জন্ম নিল। আগের রাতে সে নিজে কণ্ঠস্বর শুনেছে, কুয়াশায় অদ্ভুত ডাক শুনেছে, কিন্তু যুক্তিবাদী মন তাকে বারবার বলছে—“সত্যিই কি আত্মা মানুষকে ডেকে নেয়, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে?” তার মনে হলো, মুখিয়া ইচ্ছে করে কিছু গোপন করছে। গ্রামের মানুষ যেটাকে আত্মার ডাক বলে মনে করছে, তা হয়তো আসলে কোনো ষড়যন্ত্র, কিংবা কোনো অজানা প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু সত্যিটা জানতেই হবে। সে দৃঢ়ভাবে হরিদা আর সন্ধ্যাকে বলল—“রতনের খোঁজ না পেলে এই ভয় আরও বাড়বে। আমি সত্য বের করব। প্রমাণ ছাড়া আমি কিছু মানতে রাজি নই।” সন্ধ্যা তখন দ্বিধায় ছিল। একদিকে তার মনে হচ্ছিল অর্ণব হয়তো ভয়ংকর ঝুঁকি নিচ্ছে, অন্যদিকে সে নিজেও চায় সত্যিটা জানতে। হরিদা কাঁপা গলায় বলল—“বাবু, যদি খুঁজতেই যাও, মনে রেখো, নদীর ধারে গেলে তুমি ফিরতে নাও পারো।” তবুও অর্ণবের সংকল্প টলল না। তার চোখে তখন একরকম অদম্য দৃঢ়তা, যেন ভয়, বিশ্বাস, আর রহস্যের পর্দা ছিঁড়ে সত্যকে সামনে আনতেই হবে। গ্রামের মানুষ তখন কেবল আতঙ্কে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, আর অর্ণব প্রস্তুত হচ্ছিল অন্ধকার রহস্যের গভীরে নামার জন্য।

সেই রাতে চাঁদ অনেক উঁচুতে উঠেছে, অথচ তার আলো যেন নদীর জলে পৌঁছানোর আগেই ম্লান হয়ে যাচ্ছিল। আকাশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হালকা মেঘ কুয়াশার সঙ্গে মিশে এক অস্বাভাবিক অন্ধকার তৈরি করেছিল। অর্ণব আর সন্ধ্যা নিরবে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াল। দু’জনেরই বুক ধড়ফড় করছে, কিন্তু তাদের চোখে এক অদম্য কৌতূহল। নদীর পাশে হরিদার কাঠের নৌকোটা বাঁধা ছিল, আর বাতাসে ভেসে আসছিল স্যাঁতসেঁতে কাদার গন্ধ। চারদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল ব্যাঙের ডাক। অর্ণব চারপাশে টর্চ জ্বালালেও আলো কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই অদ্ভুত ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল। সন্ধ্যার শরীর কেঁপে উঠল, সে অর্ণবের হাত শক্ত করে ধরল। তারপরই কানে ভেসে এল ফিসফিসানি—সেই একই ডাক, যা তারা আগের পূর্ণিমার রাতে শুনেছিল—“এসো… এসো…”। ডাকটা এবার আরও কাছে, আরও স্পষ্ট। অর্ণব নিজের বুকের মধ্যে এক শীতল স্রোত বয়ে যেতে অনুভব করল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাকে সামনে টানছে। সে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও শরীর নিজে থেকেই নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সন্ধ্যা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, “অর্ণব! থামো!” কিন্তু তার নিজের পায়ের নিচেও যেন মাটি সরে যাচ্ছিল। তাদের দু’জনকে এক অদৃশ্য হাত শক্ত করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নদীর অন্ধকার জলের দিকে।

হঠাৎ, সেই মুহূর্তেই কোথা থেকে ড. রণজিৎ হাজির হলেন। তিনি দূর থেকে সবকিছু দেখছিলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন, এটি নিছক মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রম, মানুষের মনের কল্পনা। কিন্তু নিজের চোখে যখন দেখলেন অর্ণব আর সন্ধ্যার শরীর সত্যিই জলের দিকে টেনে নেওয়া হচ্ছে, তখন তার বুকের ভেতরেও ভয় ঢুকে গেল। তিনি চিৎকার করে ডাক দিলেন, “অর্ণব! সন্ধ্যা! দাঁড়াও!” তারপর দৌড়ে গিয়ে তাদের টেনে ধরলেন। একসঙ্গে তিনজন মাটিতে পড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে ঠাণ্ডা হাওয়া থেমে গেল, আর কুয়াশা যেন খানিকটা সরল। অর্ণব হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “তুমি দেখেছো, তাই তো? শুধু আমরা না, তুমিও দেখেছো, আমাদের কেউ টেনে নিচ্ছিল!” রণজিতের মুখ বিবর্ণ। তার বৈজ্ঞানিক মন যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিল না। তিনি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন—হয়তো হ্যালুসিনেশন, হয়তো বাতাসের চাপ বা কোনো চৌম্বকীয় টান। কিন্তু মনের গভীরে এক ভয়ংকর সত্যি ধাক্কা মারছিল—এ দৃশ্য বিজ্ঞানের সীমানার বাইরে। সন্ধ্যা তখনো অর্ণবের হাতে আঁকড়ে ধরে কাঁপছিল। সে ফিসফিস করে বলল, “আমি জানতাম, নদীর ধারে ওরা আছে। আজ তুমি-ও দেখলে।”

কিছুক্ষণ তারা তিনজন চুপ করে বসে রইল, কেবল নদীর জল ধীরে ধীরে তীরে আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অর্ণব ভেতরে ভেতরে আরও দৃঢ় হল—সে বুঝল, এ কেবল ভয় বা লোককথা নয়, এর পেছনে কিছু আছে, যা অদৃশ্য অথচ বাস্তব। তার চোখে তখন এক অদম্য দৃঢ়তা জ্বলে উঠল। সে বলল, “আমি জানি না এ শক্তি কী, কিন্তু এর সত্য আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে।” রণজিৎ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। এতদিন তিনি যেটাকে অন্ধবিশ্বাস বলে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, আজ তার চোখের সামনে তা বাস্তব হয়ে উঠেছে। নিজের ভেতরে ভাঙনের শব্দ তিনি স্পষ্ট শুনতে পেলেন। বিজ্ঞানের দেওয়ালে ফাটল ধরেছে, আর সেই ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করেছে ভয়, সন্দেহ আর এক অচেনা শক্তির শীতল ছায়া। নদীর বুকের অন্ধকারে যেন অদৃশ্য কারও হাসি ভেসে এলো, আর তাদের তিনজনের মনেই গেঁথে গেল এক অব্যক্ত প্রশ্ন—এই নদী আসলে কী লুকিয়ে রেখেছে?

সন্ধ্যার রাতের ভৌতিক অভিজ্ঞতার পর অর্ণব আর ঘুমোতে পারল না। তার মনের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছিল সেই অদৃশ্য শক্তির টান, আর রণজিতের মুখে দেখা ভয় ও অসহায়তার ছাপ। সে বুঝল, গ্রামজুড়ে ভয় ছড়ালেও আসল রহস্য কেউ খুলে বলতে চাইছে না। পরদিন সকালে অর্ণব দৃঢ় সংকল্পে মুখিয়ার বাড়ির দিকে রওনা হল। মুখিয়ার বাড়ি গ্রামের সবচেয়ে বড়, চারপাশে উঁচু দেয়াল, আর ভেতরে পুরনো কাঠের দরজা। মুখিয়া পঞ্চানন ঘোষ বসে ছিলেন আঙিনায়, হাতে হুক্কা। অর্ণব এগিয়ে গিয়ে বলল, “মুখিয়া মশাই, আপনি জানেন নদী নিয়ে অনেক কিছু, কিন্তু গ্রামবাসীকে সত্যি বলেন না। কেন?” পঞ্চাননের চোখ সরু হয়ে এল, তিনি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি অনেক বেশি জানার চেষ্টা করছো, অর্ণব বাবু। এ সব জানার জন্য তোমার প্রাণ পর্যন্ত যেতে পারে।” কিন্তু অর্ণব থামল না, বরং আরও জোর দিয়ে বলল, “আমি জানি আপনি ভয় চেপে রাখতে চান, কিন্তু সত্যি প্রকাশ না করলে গ্রামের মানুষ এই ভয়ে পাগল হয়ে যাবে। আমি দেখেছি অদৃশ্য হাত আমাদের টানছে। এটা আর লোককথা নয়।” মুখিয়ার মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে গেল। কিছুক্ষণ তিনি নীরব থাকলেন, তারপর গভীর নিশ্বাস ফেলে বললেন, “তাহলে শোনো, যে সত্য এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম…”

পঞ্চানন ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন—বহু বছর আগে, যখন তিনি যুবক ছিলেন, তখনই এই গ্রামের ইতিহাসে এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। তাঁর নিজের দুই ভাই নদীতে ডুবে যায় এক পূর্ণিমার রাতে। গ্রামের লোকেরা বলত, ওরা আত্মাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু পঞ্চানন সত্যিই যা দেখেছিলেন, তা তার জীবন বদলে দেয়। সেদিন নদীর জলে ভেসে উঠেছিল অদ্ভুত এক আলো, আর সেই আলোর ভেতরে তিনি দেখেছিলেন ধ্বংসপ্রাপ্ত কোনো স্থাপনার অবয়ব। পরে তিনি গ্রামের কয়েকজন বৃদ্ধ থেকে জানতে পারেন, এই নদীর নিচে আসলে রয়েছে এক প্রাচীন মন্দির। বহু শতাব্দী আগে ভয়ংকর ঝড়ে মন্দিরটি নদীতে ডুবে যায়। সেই মন্দিরে নাকি এমন এক দেবতার পূজা হতো, যিনি জীবিত আর মৃতের সীমারেখা ভেদ করতে পারতেন। সেই মন্দির ধ্বংস হওয়ার পর থেকেই নদীতে অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটতে শুরু করে। যারা মন্দির ধ্বংস রোধ করতে পারেনি, তাদের আত্মা নাকি চিরতরে সেখানে বন্দী হয়ে আছে। পঞ্চানন কাঁপা গলায় বললেন, “আমি জানি, ওরা আজও মুক্তি পায়নি। আর প্রতি পূর্ণিমায় ওরা ডাক দেয় জীবিতদের, যাতে কেউ গিয়ে মন্দিরের অন্ধকারে আটকে পড়ে।” তার চোখে তখন একরকম শূন্যতা ভর করেছিল, যেন অতীতের স্মৃতির ভারে তিনি দম বন্ধ হয়ে আসছে।

অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেল। এতদিন যেটাকে শুধু লোককথা ভেবেছিল, তা এখন যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল এক বাস্তব ইতিহাসে। সে বিস্মিত গলায় বলল, “আপনি এত বড় কথা জানেন, অথচ গ্রামবাসীকে বলেননি কেন?” মুখিয়া হাহাকার ভরা স্বরে উত্তর দিলেন, “বললে কী হতো? ওরা ভয়ে আরও আতঙ্কিত হতো। আমি চাইনি গ্রামটা অভিশপ্ত বলে পরিচিত হোক। তাই চুপ করে থেকেছি। কিন্তু জানতাম, একদিন কেউ না কেউ এ রহস্য খুঁজতে আসবেই। আজ তুমি এসেছো।” সন্ধ্যা আর রণজিৎ তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তারাও কথাগুলো শুনে শিউরে উঠল। রণজিৎ নিজের মনে বলল, “তাহলে বিজ্ঞান যা ব্যাখ্যা দিতে পারছে না, তা আসলে ইতিহাসের গভীরে লুকোনো।” অর্ণবের চোখ তখন ঝলসে উঠল এক নতুন সংকল্পে। সে ধীরে ধীরে বলল, “যদি নদীর নিচে মন্দির থাকে, তবে আমাকে সেখানে নামতেই হবে। আত্মারা বন্দী হয়ে আছে যদি, তবে তাদের মুক্তি দেওয়ার উপায় খুঁজতে হবে।” মুখিয়া হতাশ চোখে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “তুমি যদি সেখানে নামো, হয়তো আর ফিরতে পারবে না।” কিন্তু অর্ণব জানত, এই অভিশাপ ভাঙতে না পারলে গ্রামের আতঙ্ক কোনোদিন দূর হবে না। নদীর বুকের নিচে লুকোনো রহস্য তখন যেন তাকে ডাকছিল, অদৃশ্য স্রোতের মতো—যেখান থেকে আর ফিরে আসার নিশ্চয়তা নেই।

পূর্ণিমার রাত নামতেই গ্রামের বাতাস অস্বাভাবিকভাবে ভারী হয়ে উঠল। আকাশে চাঁদ উঠলেও আলো যেন ম্লান, তার চারপাশে ঘন কুয়াশা পাক খেয়ে নেমে আসছিল নদীর বুক থেকে গ্রামময়। চারদিকের নিস্তব্ধতায় হঠাৎ করেই শোনা গেল অস্পষ্ট গুঞ্জন, যেন হাজারো গলা একসাথে ফিসফিস করছে। অর্ণব, সন্ধ্যা আর রণজিৎ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল, আর তাদের চোখের সামনে ঘটতে লাগল অকল্পনীয় দৃশ্য। কুয়াশার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ভেসে উঠতে লাগল অসংখ্য মুখ—কেউ বৃদ্ধ, কেউ তরুণ, কেউ শিশু। তাদের চোখ ছিল অদ্ভুত শূন্যতায় ভরা, আর ঠোঁটে এক অমানবিক আহ্বান। পুরো নদীর বুক জুড়ে শত শত মুখ নড়ে উঠছে, যেন জলের ভেতর থেকে উঠে এসে জীবিতদের দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। চারদিকের গাছপালা হঠাৎ তীব্রভাবে কাঁপতে শুরু করল, মাটির ওপর দিয়ে শীতল বাতাস বইতে লাগল, আর গ্রামের মানুষ আতঙ্কে ছুটোছুটি শুরু করল। কারও চিৎকার, কারও কান্না, আর শিশুদের আর্তনাদ মিশে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করল।

গ্রামের পুরুষরা প্রথমে সাহস করে নদীর ধারে এগোতে চেয়েছিল, কিন্তু মুহূর্তেই তারা বুঝল, এ কোনো সাধারণ শক্তি নয়। কুয়াশার ভেতর থেকে অদৃশ্য হাত যেন বেরিয়ে এসে তাদের শরীর জাপটে ধরছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। কয়েকজন যুবক চেষ্টা করল অন্যদের টেনে বাঁচাতে, কিন্তু অদৃশ্য টানের সামনে তারা অসহায় হয়ে পড়ল। কারও কাপড় ছিঁড়ে গেল, কারও হাত-পা নদীর জলে অর্ধেক ডুবে গেল, আর সবাই প্রাণপণে পিছু হটতে লাগল। মুখিয়া পঞ্চানন ঘোষ ছুটে এসে চিৎকার করে বললেন, “সবাই ঘরে ফিরে যাও! নদীর ধারে কেউ থাকবে না!” কিন্তু তার নিজের কণ্ঠস্বরও কাঁপছিল। তিনি জানতেন, এ দৃশ্য কোনো মানুষের ক্ষমতার বাইরে। আত্মাদের ক্রোধ এত তীব্র হয়ে উঠেছে যে গ্রামের প্রতিটি মানুষকে তারা নিজের দলে টেনে নিতে চাইছে। সন্ধ্যা ভয়ে অর্ণবের বাহু আঁকড়ে ধরে বলল, “দেখো! ওরা সবাই… যেন চিৎকার করছে!” সত্যিই, সেই ভেসে ওঠা মুখগুলোর ঠোঁট একসঙ্গে নড়ছিল, আর ভয়াবহ এক শব্দ তৈরি হচ্ছিল—“এসো… এসো…”। ডাকটা এত প্রবল যে মনে হচ্ছিল চারদিকের বাতাস ফেটে যাচ্ছে।

অর্ণব নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। সে জানত, ভয় পেয়ে পিছু হটলে কেবলই গ্রামের সর্বনাশ ঘটবে। সে গভীরভাবে লক্ষ করল সেই ভেসে ওঠা মুখগুলোর অভিব্যক্তি। ওরা কেবল ভয় ছড়াচ্ছিল না, বরং তাদের চোখে লুকিয়ে ছিল এক অসহায় আবেদনও। যেন মুক্তির জন্য তারা হাহাকার করছে। কিন্তু সেই হাহাকার এখন রূপ নিয়েছে ক্রোধে, আর সেই ক্রোধ গ্রামকে গ্রাস করতে চাইছে। রণজিৎ হতবাক হয়ে চারদিক দেখছিল। এতদিনের বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি মুহূর্তে ভেঙে চূর্ণ হয়ে গেছে। সে কেবল অসহায়ভাবে বলতে পারল, “এ… এ যে অমানবিক শক্তি… এটা কোনো হ্যালুসিনেশন নয়।” নদীর বুক তখন উথালপাথাল করছে, ঢেউ তীর ছুঁয়ে ফিরে যাচ্ছে, আর প্রতিটি ঢেউয়ের ভেতরে ভেসে উঠছে মৃত মানুষের ছায়া। গ্রামের নারী-পুরুষ সবাই প্রাণ বাঁচাতে দৌড়োচ্ছে, কিন্তু তবু অনেকেই অদৃশ্য টানে পড়ে যাচ্ছে নদীর ধারে। অর্ণব দাঁত চেপে শপথ করল—যেভাবেই হোক, এই আত্মাদের বন্দিত্ব ভাঙতে হবে। না হলে একদিন পুরো গ্রাম ডুবে যাবে কেবল অন্ধকারে। আর এই রাতের ভৌতিক ক্রোধ কেবল শুরু মাত্র, আসল বিপর্যয় তখনও বাকি।

১০

পূর্ণিমার রাত তখন তুঙ্গে। চারদিকে চাঁদের আলোয় কুয়াশার ঘন পর্দা যেন অচল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নদীর বুক উত্তাল, আর আত্মাদের ক্রোধে বাতাস কাঁপছে। অর্ণব ও সন্ধ্যা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দম ফেলতে পারছিল না। অদৃশ্য টান একের পর এক পথিককে গ্রাস করতে চাইছে। চারদিক থেকে আতঙ্কের কান্না শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক তখনই অর্ণব বুক শক্ত করে এগিয়ে গেল নদীর ধারে। তার চোখে ভয় নয়, বরং এক অদম্য দৃঢ়তা। সে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি জানি তোমরা মুক্তি চাও। আমি জানি তোমরা বন্দী। কিন্তু জীবিতদের টেনে নিলে মুক্তি মিলবে না।” তার কণ্ঠে যেন এক অদ্ভুত কম্পন ছিল, যা ভেদ করে পৌঁছে যাচ্ছিল আত্মাদের ভিড়ে। সন্ধ্যা কেঁপে উঠল, সে ভাবছিল অর্ণবকে হয়তো এবার তারা গ্রাস করবে। কিন্তু অর্ণব পিছু হটল না। এদিকে হরিদা, বৃদ্ধ মাঝি, ছুটে এসে দাঁড়াল নদীর পাড়ে। তার কাঁপা হাতে ধরা পুরনো তালপাতার পুঁথি, যেখানে প্রাচীন মন্ত্র লেখা ছিল। কণ্ঠে কাঁপন থাকলেও সে উচ্চারণ শুরু করল সেই মন্ত্র। শব্দগুলো বাতাসে ভেসে উঠতেই কুয়াশার ভেতরে থাকা মুখগুলো থমকে গেল, যেন অদৃশ্য শিকল টান পড়েছে তাদের ওপর।

রণজিৎও তখন এগিয়ে এল। এতদিনের বিজ্ঞানের অহংকার ভেঙে সে বুঝেছে, এখানে কেবল যুক্তি দিয়ে কিছু হবে না। তার শরীর ভয়ে কাঁপছিল, কিন্তু শেষ সাহস জড়ো করে সে হরিদার পাশে দাঁড়াল। তার কণ্ঠে ছিল না মন্ত্র, ছিল কেবল মানুষের ডাক—“তোমরা শান্ত হও! মুক্তির পথ আমরা খুঁজছি। জীবিতদের ছাড়ো!” তার কণ্ঠ মন্ত্রের সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত তরঙ্গ তৈরি করল। নদীর বুক কাঁপতে লাগল, ঢেউয়ের গর্জন মিলল কণ্ঠ ও মন্ত্রের স্রোতে। আত্মারা যেন ক্রোধ ও শান্তির মধ্যে দোদুল্যমান হয়ে পড়ল। কখনও মনে হচ্ছিল ওরা আরও হিংস্র হয়ে উঠবে, আবার কখনও দেখা যাচ্ছিল তাদের চোখে অশ্রুর মতো কিছু ঝিলমিল করছে। অর্ণব তখন সন্ধ্যার হাত শক্ত করে ধরে ছিল। সন্ধ্যা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আমার ভাইও তো এদের ভেতরে আছে, আমি জানি। ওর আত্মাও মুক্তি চায়।” সে কান্নাভরা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল—“ভাই… যদি শুনতে পাও, তবে মুক্ত হও। আমাদের ছেড়ে দাও।” সেই ডাক যেন চারদিকে প্রতিধ্বনিত হলো। হরিদার মন্ত্র আরও জোরালো হলো, রণজিৎ তাতে যোগ দিল, আর অর্ণবের দৃঢ় কণ্ঠে শোনা গেল চূড়ান্ত আহ্বান।

হঠাৎ নদীর বুক থেকে প্রবল আলো বেরিয়ে এলো, যেন গভীরের অন্ধকার ভেদ করে মন্দিরের অন্তর্গত কিছু প্রকাশ পেল। আত্মাদের মুখগুলো একসাথে আকাশের দিকে চেয়ে আর্তনাদ করল। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, পুরো গ্রাম কেঁপে উঠল সেই চিৎকারে। তারপর একে একে মুখগুলো ম্লান হয়ে যেতে লাগল। তাদের ক্রোধ কমে গিয়ে চোখে ফুটে উঠল একরকম শান্তি। যেন বহু যুগের পর তাদের দুঃখ লাঘব হলো। কুয়াশা আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল, বাতাসের শীতলতা কমল, আর নদীর বুক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গ্রামবাসীরা, যারা দূরে ভয়ে জমে গিয়েছিল, অবিশ্বাসের চোখে এই পরিবর্তন দেখছিল। কেউ হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদছিল, কেউ হাত জোড় করে প্রার্থনা করছিল। কিন্তু অর্ণব, সন্ধ্যা, রণজিৎ আর হরিদা জানত—এটা মুক্তি কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আত্মারা শান্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা চিরতরে মুক্তি পেল, নাকি সাময়িক নিস্তব্ধ হয়ে আবার পরের পূর্ণিমায় ফিরে আসবে, সে রহস্য থেকে গেল। মুখিয়া পঞ্চানন দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। তার মুখে অদ্ভুত শূন্যতা, চোখে জল, ঠোঁটে ফিসফিস—“হয়তো ওরা মুক্তি পেয়েছে… হয়তো…”। অর্ণব চুপচাপ নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। কুয়াশা সরে গিয়ে চাঁদের আলো ঝলমল করছে জলের ওপর, কিন্তু সেই আলোয় লুকিয়ে ছিল এক অনিশ্চিত প্রশ্ন—আজকের রাতে কি সত্যিই অভিশাপ ভেঙেছে, নাকি আসন্ন পূর্ণিমা আবার একই আতঙ্ক বয়ে আনবে?

___

 

1000059976.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *