Bangla - ভূতের গল্প

আতর ঘর

Spread the love

প্ৰদ্যুম্ন মুখার্জী


অধ্যায় ১ – আতরের গন্ধে ভরা ঘর

অরিত্র ছিল এক তরুণ ইতিহাসবিদ, যিনি অদ্ভুত বিষয় আর অজানা ইতিহাসের খোঁজে ঘুরে বেড়াতেন। কলকাতার শহরতলির বিস্মৃত গলি আর সময়ের ধুলো জমা রাজবাড়িগুলো তার গবেষণার মূল ক্ষেত্র। একদিন তিনি শুনলেন এক প্রাসাদের কথা, যা আজও স্থানীয়দের কাছে রহস্যে মোড়া। এই প্রাসাদটি একসময় জমিদার দীনেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ছিল, যার রাজকীয় ঐশ্বর্য বহু আগেই মাটির তলায় মিশে গেছে, কিন্তু রয়ে গেছে এক অদ্ভুত গুজব—প্রাসাদের ভেতরে একটি ঘর আছে, যেখানে ঢুকলেই ভেসে ওঠে আতরের গন্ধ। অথচ সেই ঘরে আর কেউ থাকে না, বরং বহু বছর আগে সেখানে এক নববধূর মৃত্যু হয়েছিল। গ্রামের মানুষজন এখনো সন্ধ্যার পর প্রাসাদের কাছ ঘেঁষতে ভয় পায়, আর কেউ সেই ঘরের নাম উচ্চারণও করতে চায় না। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে অরিত্র কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিল না, বরং এরকম কাহিনি তার কাছে চ্যালেঞ্জের মতো। তাই এক সন্ধ্যাবেলা হাতে খাতা, কলম আর ক্যামেরা নিয়ে পৌঁছে গেল প্রাসাদের বিশাল দালানে। লোহার ফটকটিকে ঠেলেই তার মনে হলো যেন এক বিস্মৃত কালের দ্বার খুলে যাচ্ছে। ভেতরে ঘাসে ঢাকা পথ, ভাঙা দালানের খসে পড়া দেওয়াল, আর ফিকে লাল রঙের দরজা—সবই যেন এক অন্য সময়ের গল্প শোনাচ্ছিল।

প্রাসাদের ভেতরে ঢুকেই অরিত্রর মনে হলো, যেন সে হঠাৎ করে সময়ের স্রোতে পিছিয়ে গেছে। ধুলো-মলিন করিডর, ছাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া বিকেলের আলো, আর ভাঙাচোরা ঝাড়বাতির কাচগুলোতে আলো খেলে যাচ্ছে। প্রতিটি কক্ষে ঢুকে সে ছবি তুলতে লাগল, খাতায় লিখে রাখল তার পর্যবেক্ষণ। কিন্তু যখন সে সেই ‘বিশেষ’ ঘরের দরজার সামনে পৌঁছল, তখনই এক অদ্ভুত শিহরণ তার শরীর বেয়ে বয়ে গেল। দরজাটি অন্য সব কক্ষের দরজার চেয়ে ভারী ও গাঢ় রঙের। তালা নেই, শুধু একটি আধখোলা দরজা তাকে আহ্বান জানাচ্ছিল। ভিতরে পা রাখতেই প্রথমে মনে হলো, হয়তো ধুলো, ফাঙ্গাস, পুরনো কাঠের গন্ধ পাবেন। কিন্তু না—ঘরের ভেতরে ঢুকেই তার নাকে ভেসে এল হালকা অথচ স্পষ্ট এক আতরের গন্ধ। গন্ধটি অতিরিক্ত নয়, বরং এতটাই সূক্ষ্ম যে মনে হয় যেন বাতাসের ভেতরে মিশে আছে। অরিত্রর বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি খেল, অথচ সে নিজেকে শক্ত রাখল। ঘরের ভেতরে একটি ভাঙা খাট, কিছু জীর্ণ আসবাব, আর এক কোণে পুরনো আয়না পড়ে আছে। আয়নার পৃষ্ঠে ধুলো জমলেও সেখানে নিজের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, আর অদ্ভুতভাবে সেই প্রতিচ্ছবির চোখের ভেতরে যেন অন্য এক দুঃখ লুকিয়ে ছিল। আতরের গন্ধটি একবার হালকা হয়, আবার প্রবল হয়ে ওঠে, যেন কেউ অদৃশ্যভাবে ঘরে হাঁটাহাঁটি করছে।

অরিত্র জানত স্থানীয়রা এই ঘরকে অভিশপ্ত বলে মনে করে। কথিত আছে, জমিদারের পুত্রবধূ—এক নববধূর মৃত্যু ঘটেছিল এই ঘরেই। তার গায়ে সবসময় আতরের গন্ধ লেগে থাকত, আর সেই গন্ধই নাকি আজও ঘরটিতে ভেসে বেড়ায়। কেউ বলে, সে আত্মহত্যা করেছিল; কেউ বলে, তাকে হত্যা করা হয়েছিল। সত্যিটা আজও অজানা। অরিত্রর মনে কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। সে খাতায় নোট করতে করতে ঘরের প্রতিটি কোণ পরীক্ষা করতে লাগল—কাঠের খাটের নিচে জমে থাকা ধুলো, ছাদের কড়িকাঠে ঝুলে থাকা জাল, আর জানালার বাইরে ভাঙা বারান্দা সবকিছুই তার কাছে মূল্যবান তথ্য। কিন্তু যতক্ষণ সে ঘরে থাকল, আতরের সেই গন্ধ তাকে ছেড়ে গেল না। গন্ধটা মাঝে মাঝে এতটাই তীব্র হয়ে উঠছিল যে তার মনে হচ্ছিল যেন কেউ তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তবুও ভয়ের সঙ্গে মিশে থাকা রহস্যের টান তাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় হঠাৎ যেন তার কানে ভেসে এলো ক্ষীণ এক নারীকণ্ঠ—কিন্তু মুহূর্তেই তা মিলিয়ে গেল। সে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড, তারপর বুঝল, এ গল্প শুধু স্থানীয়দের কুসংস্কার নয়; এখানে আসলেই লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত রহস্য, যার সূত্রপাত সেই নববধূর মৃত্যুর মধ্যেই। আর এই রহস্যের উত্তর খুঁজে বের করা এখন তার গবেষণার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠল।

অধ্যায় ২ – প্রাসাদের অশরীরী ইতিহাস

অরিত্র প্রাসাদের প্রথম পরিদর্শনের পর থেকেই বুঝতে পেরেছিল, এই দালান শুধু ভাঙা ইট-পাথরের স্তূপ নয়, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অমোঘ ইতিহাস। তাই দ্বিতীয় দিনেই সে স্থানীয় গ্রন্থাগার থেকে পুরনো দলিল, খবরের কাগজের কাটিং আর জমিদারি সংক্রান্ত রেকর্ড ঘাঁটতে শুরু করল। ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটল ধুলো জমা নথির ভেতরে, আর ধীরে ধীরে ভেসে উঠতে লাগল প্রাসাদের অতীত। জানা গেল, এই প্রাসাদের প্রকৃত মালিক ছিল চৌধুরী পরিবার—একসময়ের নামজাদা জমিদার, যাদের দাপট ছড়িয়ে ছিল গোটা অঞ্চলে। দীনেশচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন শেষ প্রজন্মের জমিদার, তার দুই ছেলে—অশোক ও অমল। বড় ছেলে অশোক পড়াশোনা করতে চলে গিয়েছিল বিদেশে, আর ছোট ছেলে অমল ছিল পরিবারের সোনার টুকরো। তার বিয়ের রাতেই নাকি ঘটে যায় ভয়াবহ ঘটনা, যা চৌধুরী পরিবারকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। স্থানীয়দের গল্প, গুজব আর কাগজপত্র মিলে ধীরে ধীরে অরিত্র যেন এক পাজল সাজাতে লাগল, যার প্রতিটি টুকরোতে রক্তাক্ত ইতিহাস আঁকা।

গল্পটা ছিল এরকম—অমলের বিয়ে হয়েছিল পাশের গ্রামের সুন্দরী কন্যা মাধবীলতার সঙ্গে। বিয়ের দিন প্রাসাদে ছিল উৎসবের ছড়াছড়ি, আলোয় ঝলমল, ঢাকঢোলের শব্দে ভরে উঠেছিল আকাশ। সবাই বলাবলি করছিল, মাধবীলতা ছিলেন অদ্ভুত রূপসী, তার গায়ের গন্ধে নাকি আতরের মিষ্টি সুবাস থাকত সর্বদা। কিন্তু সেই আনন্দ উৎসবের মাঝেই ঘটে যায় অশুভ এক ঘটনা। রাত বাড়তেই হঠাৎ মাধবীলতা হারিয়ে যান। ঘর থেকে নিখোঁজ হয়ে যান যেন উধাও হয়ে গেছেন হাওয়ায় মিশে। প্রথমে সকলে ভেবেছিল হয়তো নববধূ ঠাট্টা করে কোথাও লুকিয়েছেন, কিন্তু ঘণ্টা পেরোলেও তিনি আর ফিরলেন না। আতঙ্কে চারদিকে হইচই শুরু হয়, প্রাসাদের প্রতিটি ঘর তল্লাশি করা হলো, বাগান চষে ফেলা হলো, এমনকি পুকুর পর্যন্ত খুঁজে দেখা হলো। কিন্তু কোথাও কোনো হদিশ মিলল না। অবশেষে মধ্যরাতের কিছু পর আতঙ্কিত পরিবারের সদস্যরা দেখলেন—প্রাসাদের দক্ষিণ দিকের ওই অদ্ভুত ঘর থেকে ভেসে আসছে আতরের গন্ধ। দরজা খুলতেই দেখা গেল, মাধবীলতা নিথর হয়ে পড়ে আছেন মেঝেতে, কপাল থেকে রক্ত ঝরছে। মৃত্যুর কারণ নিয়ে আজও কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই—কেউ বলে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন, কেউ বলে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল, তার দেহ থেকে ভেসে আসছিল অতিরিক্ত আতরের গন্ধ, যা নাকি সেদিন রাত থেকে আর কখনো ঘর ছেড়ে যায়নি।

অরিত্র যখন এই সব তথ্য জানতে পারল, তার মনে কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল—কেন মাধবীলতার মৃত্যু সেই ঘরেই ঘটল? আর কেন তার গায়ের আতরের গন্ধ আজও সেখানে ভেসে বেড়ায়? প্রাসাদের পতনের ইতিহাসের সঙ্গে যেন এই মৃত্যুর কাহিনি জড়িয়ে আছে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে। কারণ মাধবীলতার মৃত্যুর পর চৌধুরী পরিবারে অশান্তি শুরু হয়। বড় ছেলে অশোক বিদেশ থেকে ফিরে এসে পরিবারকে ভেঙে দিতে চাইলে দীনেশচন্দ্র ভেতর থেকেই ভেঙে পড়েন। লোকজন বলতে লাগল, প্রাসাদে অশরীরীর ছায়া ভর করেছে। বিয়ের রাতের সেই কান্না, আতরের গন্ধ, আর মাধবীলতার অদৃশ্য থেকে মৃত্যুর রহস্য যেন চৌধুরী পরিবারের অস্তিত্বকে মুছে দিল। কয়েক বছরের মধ্যেই পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, কেউ প্রাসাদ ছেড়ে চলে যায়, কেউ আবার অকালে মারা যায়। শুধু রয়ে যায় আতরের গন্ধভরা সেই ঘর—যা আজও গ্রামবাসী ভয় পায়। অরিত্র বুঝতে পারল, এ শুধু কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং এর সঙ্গে লুকিয়ে আছে গভীর রহস্য, হয়তো ষড়যন্ত্র কিংবা প্রতিহিংসার গল্প। তার মনে হলো, এই সত্য উদঘাটন করাই তার কাজ, কারণ যতক্ষণ না এই ইতিহাসের আসল পর্দা উন্মোচিত হয়, ততক্ষণ আতরের ঘরের রহস্য অমোঘ হয়ে থাকবে। আর সেই ভাবনায় অরিত্র প্রতিজ্ঞা করল—সে এই প্রাসাদের অশরীরী ইতিহাসের প্রতিটি স্তর ভেদ করবেই, যত ভয়, কুসংস্কার আর অন্ধকারই তাকে ঘিরে ধরুক না কেন।

অধ্যায় ৩ – মায়াবী আতরদানি

অরিত্র আবার ফিরে এলো প্রাসাদের সেই ঘরে, যেখানে আতরের গন্ধ যেন অদৃশ্য কণ্ঠে তাকে ডেকে নিয়ে যায় বারবার। ভাঙাচোরা খাট, আয়নার ধুলোমাখা প্রতিচ্ছবি আর নীলচে আলোয় ভিজে থাকা অন্ধকার কক্ষটির ভেতরে এবার তার দৃষ্টি আটকে গেল এক অদ্ভুত বস্তুতে। খাটের পায়ের কাছে, ধুলো-মাকড়সার জালের ভেতরে অর্ধেক ডুবে থাকা একটি রূপার আতরদানি। বস্তুটি যেন প্রাচীন কোনো শিল্পীর হাতে গড়া—পাশে খোদাই করা সূক্ষ্ম নকশা, উপরে লতানো লতার চিহ্ন, আর মাঝখানে এক অদ্ভুত প্রতীক যা কোনো এক অচেনা মন্ত্রচক্রের মতো। অরিত্র হাঁটু গেড়ে বসে আতরদানিটিকে হাতে তুলতেই অনুভব করল, ধুলো-মলিন জিনিসটির ভেতরে যেন অস্বাভাবিক উষ্ণতা জমা আছে। চারপাশে হঠাৎ অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এলো, যেন ঘরের দেয়ালগুলো নিঃশ্বাস ফেলে থেমে গেছে। আতরের গন্ধ হঠাৎ আরও ঘন হয়ে উঠল, আর অরিত্রর বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল। সে জানত, এটি সাধারণ কোনো অলঙ্কার নয়, বরং হয়তো সেই অভিশপ্ত ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু।

আতরদানির ঢাকনাটিতে হাত রাখতেই তার চোখের সামনে যেন ঘন কুয়াশা নেমে এলো। মেঝেটি দুলে উঠল, অন্ধকার ঘরটি মিলিয়ে গিয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠতে লাগল এক ভিন্ন দৃশ্য। সে যেন সময়ের পর্দা ভেদ করে চলে গেল বহু বছর আগের প্রাসাদে। চারদিকে আলো ঝলমল করছে, শঙ্খধ্বনি ও শীতল ঢাকের আওয়াজ, আর নববধূ সাজানো এক কিশোরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে শ্বেতশাড়ি, কপালে লাল টিপ, অথচ তার চোখ ভরা আতঙ্কে। ঠোঁট কাঁপছে নীরব কান্নায়, কিন্তু তার কণ্ঠ থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। মনে হলো, সে যেন কারো কাছে সাহায্য চাইছে, অথচ তার চারপাশে উৎসবের উল্লাসে কেউ সেই কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। অরিত্রর মনে হলো, এ-ই মাধবীলতা, সেই নববধূ যিনি আতরের গন্ধে ভেসে থাকতেন। দৃশ্যটি দ্রুত পাল্টে গেল—মাধবীলতাকে দেখা গেল সেই একই ঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে। চারদিকের দরজা বন্ধ, জানালা ঝাপসা, ঘরে শুধু আতরের গন্ধ। সে আতঙ্কে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, যেন কেউ অদৃশ্যভাবে তাকে ঘিরে ধরেছে। হঠাৎ করেই মাধবীলতার চোখে ভেসে উঠল এক আতঙ্ক, আর তার ঠোঁট নিঃশব্দে বলে উঠল—“বাঁচাও।” মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্য অদৃশ্য হয়ে গেল, অরিত্র ফের দাঁড়িয়ে রইল প্রাসাদের ধুলোভরা ঘরে, আতরদানিটি এখনো তার হাতে ধরা।

ঘামের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিল অরিত্রর কপাল থেকে। সে বুঝতে পারল, আতরদানিটি সাধারণ কোনো বস্তু নয়, বরং এটি এক অদ্ভুত মাধ্যম—অতীতের স্মৃতি আর অভিশপ্ত ঘটনার সাক্ষী। মাধবীলতার ভয়ে কাঁপা চোখের সেই দৃশ্য তাকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। সে অনুভব করল, মাধবীলতার মৃত্যু কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা নয়, বরং এর আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গোপন ষড়যন্ত্র। আতরদানিটি হয়তো সেই রহস্যের দরজা, যা খোলার সাহস আজ পর্যন্ত কেউ করেনি। কিন্তু একথা ভেবে তার ভেতরেই আবার ভয় কাজ করতে লাগল—যদি এই বস্তু সত্যিই অভিশপ্ত হয়? যদি এটি শুধু অতীত দেখায় না, বরং অশরীরী শক্তিকে জাগিয়ে তোলে? ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে সে হঠাৎ টের পেল, দেয়ালের ফাঁক দিয়ে যেন কোনো শীতল হাওয়া এসে তার ঘাড়ে স্পর্শ করল, যেন কেউ অদৃশ্যভাবে তার কানে নিঃশ্বাস ফেলছে। আতরের গন্ধ এতটা ঘন হয়ে উঠল যে শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে গেল। তবুও অরিত্র আতরদানিটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখল, কারণ সে জানত—এই বস্তুই প্রাসাদের গোপন সত্য উন্মোচনের একমাত্র চাবিকাঠি। আর সেই চাবি হাতে পেয়েই সে প্রতিজ্ঞা করল, যত ভয়ই সামনে আসুক, আতরের ঘরের এই অভিশপ্ত কাহিনি সে ভেদ করবেই।

অধ্যায় ৪ – পুজোর রাতে মৃত্যুর ছায়া

অরিত্রর হাতে পাওয়া আতরদানির অভিজ্ঞতা তাকে কেবল কৌতূহলী করেনি, বরং এক অদ্ভুত অস্থিরতাও এনে দিয়েছিল। মাধবীলতার চোখে দেখা সেই নীরব কান্না, ঠোঁটের নিঃশব্দ আবেদন তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল প্রতিটি মুহূর্তে। সে জানত, সত্য জানার একমাত্র উপায় হলো স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলা, কারণ এই গ্রামেই লুকিয়ে আছে সেই অভিশপ্ত কাহিনির বহু অজানা টুকরো। তাই এক দুপুরে সে গ্রামের পুরনো চায়ের দোকানে গিয়ে বসলো। দোকানটি ছিল জমজমাট আড্ডার জায়গা, যেখানে গ্রামের প্রবীণ মানুষজন এখনো অতীতের গল্প বলে সময় কাটাতেন। কথায় কথায় অরিত্র প্রাসাদের কথা তুলতেই চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া বৃদ্ধরা একে অপরের দিকে তাকালেন, তারপর নীরবে মাথা নেড়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অরিত্র যখন ধৈর্য ধরে প্রশ্ন করতে লাগল, তখন ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেরোতে লাগল একেকটি গল্প। সবাই এক কথায় বলল—নববধূর মৃত্যু ঘটেছিল দুর্গাপুজোর অষ্টমীর রাতে, যখন গোটা গ্রাম মাতোয়ারা ছিল উৎসবে। উৎসবের আনন্দের আড়ালে রক্তাক্ত হয়েছিল প্রাসাদের এক কোণ।

তবে মৃত্যুর কাহিনি নিয়ে গ্রামের মানুষজনের মধ্যে একেবারেই মিল ছিল না। কারও মতে, মাধবীলতা নিজের প্রাণ নিজেই বিসর্জন দিয়েছিলেন। তিনি নাকি অমলকে ভালোবাসতেন না, বিয়েটি ছিল সম্পূর্ণ পারিবারিক চাপে। বিয়ের পরের সেই রাতে মানসিক যন্ত্রণা আর আতঙ্ক তাঁকে এমন জায়গায় ঠেলে দিয়েছিল, যেখান থেকে ফেরার পথ ছিল না। আতরের গন্ধ, যা তাঁর গায়ে সারাক্ষণ লেগে থাকত, সেই সুবাসই নাকি ছিল তাঁর মৃত্যুর মুহূর্তের সাক্ষী। কিন্তু অন্যদিকে আরও ভয়ঙ্কর এক গুজব প্রচলিত ছিল। কেউ কেউ বলল, মাধবীলতা নাকি বিয়ের আগেই প্রেমে পড়েছিলেন এক সাধারণ যুবকের, যার সঙ্গে সম্পর্ক জানাজানি হয়ে গেলে চৌধুরী পরিবার অপমানের ভয়ে তাঁকে চিরদিনের জন্য থামিয়ে দিয়েছিল। তাঁদের মতে, মাধবীলতার মৃত্যু আত্মহত্যা নয়, একেবারে পরিকল্পিত খুন, যার উদ্দেশ্য ছিল পরিবারের সম্মান বাঁচানো। অষ্টমীর রাতে যখন বাইরে ধূপধুনোর গন্ধ, শাঁখের আওয়াজ আর ঢাকের তালে দেবী আরাধনা চলছিল, ঠিক তখনই প্রাসাদের ভেতরে শিউরে ওঠা কান্নায় নিভে গিয়েছিল এক নববধূর জীবন।

অরিত্র এসব শুনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। দুই বিপরীত গল্প তার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে বুঝতে পারল, মাধবীলতার মৃত্যু কেবল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং গোটা গ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। হয়তো গ্রামের মানুষও সত্যিটা জানে, কিন্তু ভয় বা লজ্জার কারণে কেউ মুখ খুলতে চায় না। অষ্টমীর রাত—যে রাত বাঙালির কাছে পবিত্র উৎসবের চূড়ান্ত মুহূর্ত, সেই রাতেই ঘটেছিল মৃত্যুর ছায়ায় ঢাকা এক অভিশাপ। অরিত্র মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে থামবে না। আতরদানির রহস্য, মাধবীলতার আতঙ্কিত মুখ, আর গ্রামবাসীর দ্বিধাভরা গলাগুলো তাকে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছিল—সত্য যতই ভয়ঙ্কর হোক, তা খুঁজে বের করতেই হবে। সে জানত, একদিন সেই রাতের অন্ধকার পর্দা সরে যাবে, আর প্রকাশ পাবে সেই ভয়ঙ্কর কাহিনি, যা এত বছর ধরে লুকিয়ে আছে আতরের গন্ধে ভরা ঘরের মধ্যে।

অধ্যায় ৫ – দিনলিপির আবিষ্কার

প্রাসাদের ঘরগুলো অরিত্র যত খুঁটিয়ে খুঁজতে থাকে, ততই তার সামনে খুলে যেতে থাকে নতুন নতুন অজানা দ্বার। আতরদানির অভিজ্ঞতা আর স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া বিভ্রান্তিকর গল্প তার মনের ভেতরে এক অদম্য তাড়না তৈরি করেছিল—সত্যি কী ঘটেছিল সেই রাতে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই একদিন সে পৌঁছে গেল প্রাসাদের পশ্চিম দিকের একটি জরাজীর্ণ ঘরে। ঘরটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, জানালার ফাঁক দিয়ে আসা হাওয়ায় ভেসে আসছিল স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। কোণের দিকে একটি ভাঙা কাঠের আলমারি পড়ে ছিল, যার দরজা আধখোলা। কৌতূহলবশত অরিত্র যখন আলমারির দরজা খুলল, ভেতরে পুরনো কাপড়, কিছু ভাঙাচোরা বাসনপত্র আর ধুলো জমা কয়েকটি বই দেখতে পেল। সেগুলোর মধ্যে একটি কালচে রঙের মোটা খাতার দিকে তার দৃষ্টি আটকাল—একেবারে সাধারণ দিনের খাতার মতো দেখতে, কিন্তু পাতাগুলোর প্রান্ত হলদেটে হয়ে গেছে, আর কভারের কোণে স্পষ্ট হাতের লেখা—“দিনলিপি।” অরিত্র যখন খাতাটি সাবধানে হাতে তুলে নিয়ে প্রথম কয়েকটি পাতা উল্টাল, তার শরীর শিহরিত হয়ে উঠল। সেখানে লেখা প্রতিটি বাক্যে ভেসে উঠছিল এক কিশোরীর কণ্ঠস্বর—মাধবীলতার।

দিনলিপির পাতাগুলোতে মাধবীলতা নিজের বেদনার কাহিনি নিঃশব্দে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। অরিত্র পড়তে পড়তে আবিষ্কার করল, এই বিয়ে ছিল একেবারেই জোরপূর্বক। মাধবীলতা অমলকে কখনো ভালোবাসেননি; তার হৃদয় বাঁধা ছিল গ্রামেরই এক সাধারণ যুবক, যার নাম দিনলিপিতে স্পষ্ট লেখা হয়নি, কেবল একটি আদ্যক্ষর—“র।” সমাজের ভয়ে কিংবা পারিবারিক চাপে তিনি নাম প্রকাশ করতে পারেননি, কিন্তু প্রতিটি পাতায় ঝরে পড়ছিল সেই অপ্রকাশিত প্রেমের তীব্রতা। তিনি লিখেছিলেন, কিভাবে চৌধুরী পরিবার তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিয়েছিল, কিভাবে নিজের পরিবারও জমিদারের প্রভাবের কাছে মাথা নত করেছিল। দিনলিপির এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন—“আমার হৃদয় অন্য কারও কাছে বাঁধা, অথচ আমাকে এখানে আটকে রাখা হয়েছে, যেন খাঁচায় বন্দি একটি পাখি।” পড়তে পড়তে অরিত্র যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল মাধবীলতার নীরব কণ্ঠস্বর, তার কান্নার সুর। পাতার পর পাতা জুড়ে উঠে আসছিল এক নারীর ভেতরের লড়াই, তার আশা-নিরাশার মিশ্রণ, আর স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

দিনলিপির শেষ কয়েকটি পাতায় অরিত্রর চোখ আটকে গেল। সেখানে মাধবীলতা লিখেছিলেন, কিভাবে তিনি এবং তাঁর প্রেমিক পালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। দুর্গাপুজোর অষ্টমীর রাতকে বেছে নেওয়া হয়েছিল সেই পরিকল্পনার জন্য, কারণ সেদিন প্রাসাদে উৎসবের আড়ালে নজরদারি শিথিল থাকবে। তিনি লিখেছিলেন—“আমরা ঠিক করেছি, দেবীর সামনে অঞ্জলি দেওয়ার পর আমি চুপিসারে বেরিয়ে যাব। সে আমাকে অপেক্ষা করবে দক্ষিণের পুরনো বটতলায়। তারপর আর কিছুই আমাদের আটকাতে পারবে না।” কিন্তু এখানেই থেমে গেছে লেখা। শেষ পাতার কয়েকটি লাইন কেটে দেওয়া, যেন কেউ ইচ্ছে করে তা মুছে দিয়েছে। কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, মাধবীলতার মুক্তি আর প্রেমের স্বপ্ন কোনোদিন পূর্ণ হয়নি। হয়তো সেই রাতেই ঘটে গিয়েছিল মর্মান্তিক বিশ্বাসঘাতকতা। দিনলিপি বন্ধ করে অরিত্রর হাত কেঁপে উঠল। সে অনুভব করল, এ কেবল একটি খাতা নয়, বরং এক নিঃশব্দ কণ্ঠস্বর, যা এত বছর ধরে ঘরের দেয়ালের ভেতরে বন্দি ছিল। আতরের গন্ধে ভরা সেই ঘরের রহস্য আরও গভীর হয়ে উঠল, আর অরিত্র জানল—সত্য খুঁজে বের করার লড়াই এখন শুধু গবেষণার বিষয় নয়, বরং এক মৃত কণ্ঠের প্রতি তার দায়বদ্ধতা।

অধ্যায় ৬ – আতর ঘরের অশরীরী উপস্থিতি

দিনলিপি আবিষ্কারের পর থেকে অরিত্রর জীবনে এক অদ্ভুত ছায়া নেমে এলো। প্রতিদিন প্রাসাদে ফিরে গিয়ে সে খাতার পাতাগুলো পড়তে চাইত, যেন মাধবীলতার নিঃশব্দ কণ্ঠস্বর তাকে ডেকে নিচ্ছে। কিন্তু সেই সঙ্গে শুরু হলো অদ্ভুত সব ঘটনারও আবির্ভাব। আতরের গন্ধ, যা আগে শুধু সেই নির্দিষ্ট ঘরে ভেসে উঠত, এখন যেন প্রাসাদের করিডর পেরিয়ে তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। কখনো বিকেলের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে টের পাচ্ছিল, গায়ের কাছে যেন কেউ অদৃশ্যভাবে হাঁটছে, বাতাসে মিশে আসছে আতরের সেই তীব্র, মিষ্টি সুবাস। আবার কখনো, বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে সে টের পাচ্ছিল পায়ের কাছে নরম কাপড়ের মতো কিছু স্পর্শ করে গেল। প্রথমে অরিত্র এসবকে কাকতালীয় ঘটনা ভেবে এড়িয়ে যেতে চাইত, কিন্তু যত দিন যাচ্ছিল, ততই ঘটনার তীব্রতা বাড়ছিল। আতরের গন্ধ এখন কেবল উপস্থিতির ইঙ্গিত নয়, বরং যেন এক অদৃশ্য হাতের স্পর্শ, যা তাকে ঘিরে ধরতে চাইছে।

সবচেয়ে ভয়ানক অভিজ্ঞতা ঘটল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আতর ঘরের পুরনো আয়নাটিতে প্রতিদিন অরিত্র নিজের প্রতিফলন দেখত, কিন্তু একদিন সেখানে দেখা গেল অন্য এক মুখ। সে প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো ধুলো কিংবা আলোর খেলায় এমনটা হচ্ছে। কিন্তু না—সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল এক নারীর মুখ, যার চোখে অদ্ভুত শূন্যতা, আর ঠোঁটে চাপা কান্না। সাদা শাড়ি পরা সেই মুখটি কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। অরিত্রর বুক কেঁপে উঠল, শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল। আতরের গন্ধ এতটাই ঘন হয়ে উঠল যে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সে আয়নার দিকে হাত বাড়াতেই আয়নার পৃষ্ঠে যেন জল কাঁপল, যেন অন্য দিক থেকে কেউ তার হাত ধরতে চাইছে। ভয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেও, সেই চোখদুটি তার মনের ভেতর গভীর ছাপ ফেলে গেল। মাধবীলতার দিনলিপি পড়ে সে বুঝেছিল নববধূর অস্থিরতা, কিন্তু এবার যেন নিজের চোখেই তার সেই বন্দিদশার প্রমাণ পেল। মনে হলো, সেই অশরীরী সত্তা তাকে ব্যবহার করছে নিজের গল্প শোনানোর জন্য।

রাত নামতেই আতর ঘরের ভেতরে ভয়ের পরিবেশ আরও প্রকট হয়ে উঠতে লাগল। গভীর রাতে, যখন চারদিক নিস্তব্ধ, হঠাৎ করেই করিডরে ভেসে আসত শাড়ির ঘর্ষণের শব্দ। অরিত্রর মনে হতো, কেউ পায়ের কাছে শাড়ি টেনে হেঁটে যাচ্ছে, অথচ আলো জ্বালালে দেখা যেত শূন্য পথ। কখনো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কানে আসত ক্ষীণ গলায় ফিসফিস—কিন্তু শব্দগুলো স্পষ্ট শোনা যেত না, যেন হাওয়ার ভেতরে ডুবে যাচ্ছে। এক রাতে তো সে টের পেল, কেউ তার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে; চোখ খুলতেই বাতাসে ঘুরে বেড়াল আতরের তীব্র গন্ধ, কিন্তু চারদিকে কোনো চিহ্ন নেই। এসব ঘটনায় ভয়ে তার ভেতর কেঁপে উঠলেও, অরিত্র পিছু হটল না। বরং মনে হলো, মাধবীলতা তাকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তাকে টেনে নিচ্ছেন সত্যের আরও কাছে। অরিত্র বুঝল, প্রাসাদের রহস্য শুধু ইতিহাসের পাতায় লেখা নেই—এখানে এক অদৃশ্য আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে, যে মুক্তি চাইছে, যে তার গল্প শোনাতে চাইছে। আর সেই দায়িত্ব থেকে সে পিছু হটতে পারবে না, কারণ আতরের গন্ধে ভরা এই ঘর এখন তার জীবনকেই নতুন এক পথে ঠেলে দিয়েছে।

অধ্যায় ৭ – গোপন কক্ষের দরজা

অরিত্রর আগের অভিজ্ঞতাগুলো যত দিন এগোছিল, তার কৌতূহল তত বেশি প্রবল হয়ে উঠছিল। আতর ঘরের অশরীরী উপস্থিতি আর দিনের আলোয় স্পষ্ট হওয়া অদ্ভুত প্রতিফলন তাকে বারবার ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে, এখানে আরও কিছু লুকানো আছে—কিছু যা এখনো প্রকাশ পায়নি। একদিন সে ঘরের মেঝের দিকে নজর দিল, আর হঠাৎ লক্ষ্য করল—মেঝের এক কোণে কাঠের তক্তাগুলো অন্য তক্তার তুলনায় হালকা, যেন নতুন করে বসানো। ধীরে ধীরে সে তক্তাগুলো সরাতে শুরু করল, আর মাটির নিচ থেকে ভেসে এলো অদ্ভুত আকারের ছোট একটি দরজা। প্রথমে মনে হলো, হয়তো পুরনো কোনো ড্রয়ার বা সঞ্চয়কক্ষ, কিন্তু যখন সে ধুলো-মলিন হ্যান্ডলটি ধরে টানল, তখন দরজা ঘরে এক অদ্ভুত ঠেক লাগানো শব্দের সঙ্গে খুলতে শুরু করল। আচ্ছন্ন হয়ে অরিত্র ধীরে ধীরে হেটাল নেমে গেল অন্ধকার গহ্বরের দিকে, হাতের বাতি জ্বালিয়ে। বাতির আলোয় দেখা গেল মেঝের নিচের গোপন কক্ষ, যেখানে ভেতরে ঝুঁকে থাকা ধুলো আর নাকচে পড়া জিনিসপত্র—সবই পুরনো অথচ স্পষ্টভাবে রেখেছে চিহ্ন।

গোপন কক্ষে ঢুকেই অরিত্রর চোখ আটকে গেল এক দৃষ্টান্তে—একটি রক্তমাখা শাড়ি, যা আকারে ঠিক মাধবীলতার মতো, পাশে ভাঙা চুড়ি, আর একটি ছোট ঝুড়ি যেখানে ধুলো জমেছে, কিন্তু রঙের দাগ এখনও স্পষ্ট। কক্ষটি এতটাই ছোট যে, এটিকে কেউ সহজে নজরে আনতে পারত না। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আতরের সেই তীব্র গন্ধ আরও ঘন হয়ে উঠল, যেন নীরবভাবে বলছে—“এখানেই আমার মৃত্যু হয়েছিল।” অরিত্রের মনে হলো, নববধূকে হত্যা করার পর হয়তো তাকে এখানে লুকানো হয়েছিল। সে মনে মনে ছবির মতো পরিস্থিতি আঁকতে লাগল—রাত্রি, অষ্টমীর উৎসবের কোলাহল, মাধবীলতার অশান্ত চোখ, এবং অমল বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দ্রুততার সঙ্গে শাড়ি ঝুলিয়ে লাশ গোপন করার চেষ্টার দৃশ্য। সমস্ত প্রমাণ দেখিয়ে দিচ্ছিল, মৃত্যু কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; এটি একটি পরিকল্পিত হত্যা, যা পারিবারিক সম্মান রক্ষার নাম করে গোপন রাখা হয়েছিল।

অরিত্র ধীরে ধীরে প্রতিটি জিনিসপত্র পরীক্ষা করতে লাগল। শাড়ির রঙের দাগ, চুড়ির ভাঙা অংশ, কক্ষের ছোট কণ্ঠে জমে থাকা ধুলো—সবকিছুই বলছিল এক ভয়ঙ্কর সত্যের কথা। তার মনে হলো, মাধবীলতার দিনলিপি, আতরদানির অতীত দৃশ্য আর অশরীরী উপস্থিতি—সবই যেন তাকে এই কক্ষ পর্যন্ত টেনে এনেছে। কক্ষের ভেতর দাঁড়িয়ে সে বুঝল, শুধু গল্প নয়, বরং এক নিষ্পাপ প্রাণের বিরুদ্ধে সংঘটিত ষড়যন্ত্র, যা এত বছর ধরে ইতিহাসের পৃষ্ঠে অদৃশ্য থেকে গেছে। তার শরীরে শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল, তবুও সে কোনোভাবেই পিছিয়ে গেল না। কারণ এই গোপন কক্ষের আবিষ্কার তার কাছে শুধু প্রমাণ নয়; এটি ছিল সেই মৃত কণ্ঠস্বরের চূড়ান্ত আক্ষেপ, যা তাকে চাইছিল—“সত্য জানো, এবং পৃথিবীকে বলো।” বাতির আলোয় রক্তমাখা শাড়ির দাগ আর ভাঙা চুড়ি তার চোখে চমক তুলে ধরল, আর অরিত্র বুঝল—এখানেই শেষ পর্যন্ত নববধূর জীবনের সব রহস্য লুকিয়ে আছে, যা সে উদঘাটন করতে বাধ্য।

অধ্যায় ৮ – প্রেমিকের সত্যি কাহিনি

গোপন কক্ষের রহস্য উন্মোচনের পরও অরিত্রর মনে এক অসম্পূর্ণ প্রশ্ন জমে ছিল—যে যুবকের কথা মাধবীলতা দিনলিপিতে শুধু আদ্যক্ষর দিয়ে লিখেছিল, তার ভাগ্য কী হয়েছিল? সে জানত, পুরো কাহিনি কেবল নববধূর দৃষ্টিকোণ থেকে লিখিত, আর তার প্রেমিকের উপস্থিতি ও ভাগ্য সম্পর্কে অজানা। তাই এক সন্ধ্যায় সে দিনলিপির শেষ কয়েকটি পাতাকে আরও গভীরভাবে পরীক্ষা করল। পাতাগুলোতে আঘাতের চিহ্ন, দাগ আর অর্ধেক লেখা বাক্য লক্ষ্য করল, যেন কেউ ইচ্ছে করে তা রদ করে দিয়েছে। কিন্তু শেষ অবশিষ্ট শব্দগুলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অরিত্রর চোখের সামনে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল পুরো চিত্র—মাধবীলতার প্রেমিক, যার নাম ছিল রবীন, নববধূর বিয়ের রাতে চৌধুরী পরিবারের পলাতক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। রবীনকে দ্রুত হত্যা করা হয়েছিল, যাতে কেউ নববধূর প্রেমের কথা জানতে না পারে। একেবারে নিখুঁত পরিকল্পনা—নববধূর আত্মহত্যার ভান করা, তার লাশ গোপন করা, আর প্রেমিকের দেহ সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য করে দেওয়া। দিনের আলোয় ঘরগুলো খুঁটিয়ে দেখে অরিত্র বুঝতে পারল, আতরের সেই ঘন, মিষ্টি সুবাস, যা মাধবীলতার মৃত্যু এবং তার প্রেমিকের হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে, এক রূপকথার মতো নয়—বরং এটি সেই রাতের নিঃশব্দ সাক্ষী।

অরিত্র যখন পড়ছিল, তখনই মনে হলো যেন ঘরের বাতাস ঘন হয়ে উঠছে। আতরের গন্ধ এতটা প্রবল হয়ে গেল যে শ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। তার চোখে আয়নায় দেখা গেল সেই অদ্ভুত প্রতিফলন, এবার আরও স্পষ্ট—শ্বেতশাড়ি পরা মাধবীলতার মুখ, আর পাশে খামখেয়ালিপূর্ণ ধূসর রূপে রবীনের ছায়া। ঘরে যেন অতীতের ঘটনাগুলো আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে। রাতের অষ্টমীর উৎসবের শব্দ, ঢাকের ধ্বনি, মাধবীলতার তীব্র আতঙ্ক, আর রবীনের নিঃশব্দ প্রতীক্ষা—সবই ঘরে ভেসে উঠল। অরিত্র বুঝতে পারল, প্রেমিকের মৃত্যুও কেবল পারিবারিক সম্মান রক্ষার জন্য পরিকল্পিত হত্যার অংশ ছিল। কেউ শোনার সাহস করলেই ইতিহাসের সত্য উদঘাটিত হয়ে যেত। অথচ আতরদানিটি, যা ঘরে এতদিন অব্যাহতভাবে সুবাস ছড়িয়ে আসছিল, ঠিক সেই রাতের নিঃশব্দ প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তার উপস্থিতি বজায় রেখেছিল। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, ঘরটি শুধু অতীতকে ধরে রাখছে না, বরং সে এখনো এক অশরীরী সাক্ষী হয়ে আছে, যা সব সত্যকে নিঃশব্দে জানাচ্ছে।

অরিত্রর মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। দিনলিপি, আতরদানির রহস্য, গোপন কক্ষের রক্তমাখা শাড়ি—সবকিছু মিলিয়ে একটি চূড়ান্ত সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠল: মাধবীলতা ও রবীনের প্রেম, পরিবার ও সমাজের শোষণ, আর সেই রাতে সংঘটিত হত্যার ষড়যন্ত্র—সবই এত বছর ধরে প্রাসাদের দেয়াল, মেঝে এবং বাতাসে বন্দি ছিল। অরিত্র বুঝতে পারল, এই নিঃশব্দ ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে আতরদানিই একমাত্র মাধ্যম, যা অতীতকে বর্তমানের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। সে প্রতিজ্ঞা করল, ইতিহাসের এই নির্দোষ কণ্ঠস্বরকে লুকিয়ে রাখবে না; পৃথিবী জানতে পারবে নববধূ ও তার প্রেমিকের সত্যি কাহিনি, যাদের মৃত্যু এত নিখুঁতভাবে আড়াল করা হয়েছিল। সেই রাতের রহস্য, যে রাতের অন্ধকারে পলাতক ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হয়েছিল, আজ অরিত্রের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে চলেছে, আর আতর ঘরের নিঃশব্দ উপস্থিতি, যা একদম শুরুর দিন থেকে তাকে পথ দেখাচ্ছিল, অবশেষে সত্যকে প্রমাণের আকারে ধরে রাখতে সক্ষম হবে।

অধ্যায় ৯ – প্রতিশোধের আতরঘ্রাণ

রাত যখন নেমে এলো, অরিত্র জানত তার আর কোনো বিকল্প নেই—প্রাসাদের আতর ঘরে রাত কাটাতে হবে। বাইরে ঘরের আড়ালে উৎসবের আলো আর ঢাকের শব্দ এখনও দমবন্ধ করা কোলাহল জাগিয়ে রাখছে, কিন্তু এই ঘরের ভেতরে শূন্যতা ও নিঃশব্দের এক অদ্ভুত চাপ বিরাজ করছে। সে জানালার পাশে ছোট চেয়ার ধরে বসে, বাতি জ্বালাল, আর নিজের হাতে আগের দিনলিপি ও আতরদানিটিকে রেখে দিল। প্রথম দিকে তার কপাল ভিজে যাচ্ছিল ঘামের ফোঁটায়, শরীর কেঁপে উঠছিল; কারণ সে জানত—যে ঘর এত বছর ধরে রহস্য লুকিয়ে রেখেছে, সে এখন নিঃশব্দে তার উপস্থিতি অনুভব করছে। হঠাৎ ঘরের বাতাসে তীব্র আতরের গন্ধ ছড়িয়ে গেল। গন্ধটা সাধারণ না, বরং ভীষণ শক্তিশালী, প্রায় ঘেমে ওঠার মতো। অরিত্র বুঝল, এটি শুধু অতীতের অবশিষ্ট সুবাস নয়, বরং কোনো অশরীরী শক্তি—মাধবীলতার আত্মা—তার উপস্থিতি স্বীকার করছে। সে হঠাৎ টের পেল, ঘরে যেন কেউ ধীরে ধীরে হাটছে, শাড়ির ঘর্ষণের ক্ষীণ শব্দ ধীরে ধীরে কাছে আসছে। সেই নিঃশব্দ চলাফেরার সঙ্গে সঙ্গে আতরের গন্ধ আরও ঘন হয়ে উঠল, যেন নতুন করে তার প্রতি নিঃশব্দ বার্তা দিচ্ছে—“সত্য জানো, এবং তা প্রকাশ করো।”

অরিত্র তখনই অনুভব করল, এক অদৃশ্য শক্তি তার মন ও অনুভূতিতে ঢুকে পড়েছে। আতরদানির অতীত দৃশ্যের মতো, এবার সে সরাসরি অনুভব করল মাধবীলতার শেষ মুহূর্ত। ঘরের এক কোণে শ্বেতশাড়ি পরা মাধবীলতার ছায়া ধীরে ধীরে ফুটে উঠল। চোখে সে আতঙ্ক, ঠোঁটে নিঃশব্দ কান্না, আর হাতে কিছু লিখতে চেয়েও লিখতে পারেনি—কারণ মৃত্যু তার হাত থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছিল। অরিত্রের মন ভিজে গেল এই নিঃশব্দ বেদনায়। সে বুঝল, নববধূ শুধু নিজের মৃত্যু নিয়ে কথা বলছে না, বরং সমাজের, পরিবারের এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে তার চূড়ান্ত প্রতিশোধ চাইছে। আত্মা যেন বারবার বলছে—“আমার গল্প লুকিয়ে রাখো না, পৃথিবীকে জানাও, যে আমি কে ছিলাম, আর কেন আমার মৃত্যু ঘটল।” প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি দিক থেকে আসা শীতল বাতাস ও আতরের ঘ্রাণ অরিত্রকে ভীত করলেও, একই সঙ্গে শক্তি জুগাচ্ছিল—সে জানল, এই রাত তার জন্য এক অবিস্মরণীয় পরীক্ষা, যেখানে সাহস, ধৈর্য এবং ন্যায়ের বোধই তাকে এগিয়ে রাখবে।

রাত গভীর হয়ে এলো, ঘরটি নিঃশব্দে স্থির হয়ে গেল, কিন্তু আতরের ঘ্রাণ কখনো কমল না। অরিত্র বসে রইল, হৃদয় কেঁপে উঠছিল, চোখে অশ্রু জমে গেল, এবং সে শুনতে পেল নববধূর নিঃশব্দ ব্যথার ভাষা। ঘরের প্রতিটি কোণ, দেয়াল, মেঝে—সব কিছু যেন এই বেদনার সাক্ষী। অরিত্র ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল, এই ঘর, এই আতরের গন্ধ, এবং এই রাত—সব মিলিয়ে এক ধরনের প্রতিশোধের মাধ্যম। নববধূর আত্মা তার কাছে এসেছে শুধু ইতিহাস জানানোর জন্য নয়, বরং চাইছে যে তার সত্য যেন দুনিয়ার সামনে প্রকাশ পায়। সে জানল, যতই ভয়ঙ্কর হোক, যতই অশরীরী উপস্থিতি তাকে ভীত করুক, এই সত্যকে লুকিয়ে রাখা বা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। সেই রাতের দীর্ঘ নিঃশ্বাস আর আতরের ঘ্রাণের মধ্য দিয়ে অরিত্র প্রতিজ্ঞা করল—সে মাধবীলতা ও রবীনের কাহিনি, তাদের প্রেম, যন্ত্রণা, এবং হত্যার রহস্য উন্মোচন করবে, আর সেই সত্যকে দুনিয়ার সামনে এনে প্রতিশোধের ঘ্রাণকে পূর্ণ করবে।

অধ্যায় ১০ – মুক্তি নাকি অভিশাপ?

অরিত্রর দীর্ঘ যাত্রা শেষে, সব প্রমাণ ও রহস্য উন্মোচনের পর, সে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল—মাধবীলতা ও রবীনের সত্যি কাহিনি বিশ্বের সামনে আনবে। সে গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করল, ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিকদের কাছে সমস্ত তথ্য প্রকাশ করল। আতর ঘরের দিনলিপি, গোপন কক্ষের রক্তমাখা শাড়ি, ভাঙা চুড়ি, এবং আতরদানির সাক্ষী হিসাবে থাকা অতীতের অভিজ্ঞতাগুলো—সব মিলিয়ে কাহিনিটি যেন ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠল। গ্রামের মানুষ, যারা এত বছর ধরে রহস্যটি লুকিয়ে রেখেছিল, অবশেষে সত্যের মুখোমুখি হলো। নতুন আলোড়নের মধ্যে, প্রাসাদ যেন পুনরায় জীবন্ত হয়ে উঠল—বৃহৎ কক্ষগুলোতে জড়িয়ে উঠল উত্তেজনা, উৎসাহ, এবং বিচ্ছিন্ন ভীতির ছায়া। অরিত্র দেখল, ইতিহাসের এই খণ্ডাংশ শুধু অতীতের ছায়া নয়, বরং বর্তমানের মানুষের মনেও গভীর ছাপ ফেলেছে। তিনি জানালেন, মাধবীলতা ও রবীনের মৃত্যু কোনো সাধারণ ট্র্যাজেডি নয়—এটি ছিল প্রেম, ষড়যন্ত্র, এবং সমাজের চাপের ভয়াবহ মিশ্রণ। সেই রাতের ঘটনা, যে রাতের অন্ধকারে মৃত্যু ও প্রতারণা জড়িয়ে ছিল, আজ প্রকাশ্যে এসেছে, আর প্রাসাদের প্রতিটি মানুষ এ উপলব্ধি করতে পারল।

কিন্তু সত্য প্রকাশের আনন্দের মাঝেই, অরিত্র অনুভব করল—ঘরে এখনো কিছু ভিন্ন। আতর ঘরের বাতাসে সেই অতীতের গন্ধ ঝুলছে, ঘন হয়ে ভেসে আসছে। সে টের পেল, মাধবীলতার অশরীরী উপস্থিতি এখনও ঘরটি ত্যাগ করেনি। রাতের অন্ধকারে, আয়নার দিকে তাকাতেই দেখা গেল সেই নিঃশব্দ প্রতিফলন, চোখে বেদনা, ঠোঁটে নিঃশব্দ কান্না। প্রতিটি শ্বাসের সঙ্গে আতরের ঘ্রাণ যেন আরও শক্তিশালী হচ্ছে, আর শাড়ির ক্ষীণ ঘর্ষণের শব্দ ভেসে আসছে, অদৃশ্যভাবে ঘরে ঘুরছে। অরিত্র বুঝল, সত্য প্রকাশ করা মাধবীলতার আত্মাকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পারেনি। প্রতিশোধ যে তাকে আর কোনোদিন শান্তি দেবে, তা নয়—বরং, অভিশাপের ছায়া এখনো প্রাসাদের দেয়ালে, মেঝে ও বাতাসে জড়িয়ে আছে। মনে হলো, নিঃশব্দ কণ্ঠস্বর বলছে—“আমার মৃত্যু দেখেছো, আমার গল্প শুনেছো, কিন্তু এখনও পূর্ণ শান্তি হয়নি।”

শেষ রাতে, অরিত্র ঘরে দাঁড়িয়ে বুঝল, ইতিহাসের সত্য প্রকাশ করলেই সব শেষ হয় না। মাধবীলতা ও রবীনের আত্মা এখনও তার চারপাশে ঘুরছে, আতরের ঘ্রাণে ভাসছে। প্রাসাদ আবার শান্ত হয়ে গেল, কিন্তু সেই ঘ্রাণ কখনো মিলিয়ে যাবে না, এবং নববধূর কণ্ঠের নিঃশব্দ আবেদনও কমবে না। অরিত্র অনুভব করল, মুক্তি ও অভিশাপের সীমা এত সূক্ষ্ম যে একে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। সে জানল, সত্য প্রকাশ করলেও, সেই রাতের বেদনা, প্রেম, এবং হত্যা—সবই প্রাসাদের সঙ্গে চিরদিনের জন্য বাঁধা। আতরের ঘ্রাণ, গোপন কক্ষ, দিনলিপি—সবই নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে রইল। অরিত্র বের হয়ে আসল, ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেও মনে হলো, সেই অতীতের ছায়া, মাধবীলতার আত্মা, প্রতিশোধ ও অভিশাপ—সবই প্রাসাদের ভেতরে চিরস্থায়ী। মুক্তি কি সত্যি পাওয়া গেল, নাকি অভিশাপ চিরদিনের জন্য স্থায়ী হলো—এটি কে জানে? তবে অরিত্র জানল, সে সত্যের পথে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের প্রতিটি কণ্ঠকে সম্মান জানাল, আর সেই সত্য চিরকাল প্রাসাদের বাতাসে, আতরের ঘ্রাণে এবং নিঃশব্দ কণ্ঠে জেগে থাকবে।

শেষ

 

1000067735.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *