প্রমিত চৌধুরী
১
শান্তিনগর গ্রামের প্রাচীন জমিদারবাড়িটি যেন এক ইতিহাসের দলিল, কিন্তু সেই ইতিহাস আজ ধ্বংসস্তূপের স্তূপে চাপা পড়ে আছে। লাল ইটের গা বেয়ে নেমে এসেছে লতাপাতা, জানালার কাঠের খাঁচাগুলো ভেঙে পড়েছে, আর দালানের ছাদের টালিগুলো অর্ধেক জায়গায় খসে গিয়ে আকাশের আলো ঢুকে পড়েছে ভেতরে। গ্রামবাসী দিনের আলোয় জমিদারবাড়ির পাশ দিয়ে গেলেও ভেতরে প্রবেশ করতে ভয় পায়, কারণ তারা বিশ্বাস করে এখানে কেবল ভগ্নদালান নয়, লুকিয়ে আছে অভিশপ্ত অতীত। তবে এই জমিদারবাড়ির ধ্বংসস্তূপের মাঝেও যেটি অদ্ভুতভাবে টিকে আছে তা হলো আটচালা। প্রাচীন কালের মতোই তার খিলানদ্বারগুলো দাঁড়িয়ে আছে, অর্ধেক জায়গায় ধসে গেলেও এক ধরনের অদ্ভুত দৃঢ়তায় সে দাঁড়িয়ে থেকে যেন কোনো অদৃশ্য কাহিনি পাহারা দিচ্ছে। আটচালাকে কেন্দ্র করেই বছরের পর বছর ধরে শান্তিনগরে ছড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর গুজব—রাত নামলে সেখান থেকে ভেসে আসে এক নারীর অশ্রুসিক্ত বিলাপ, যেন কেউ দম ফাটানো কণ্ঠে কাঁদছে, আবার কখনও ফিসফিস করে সাহায্য চাইছে।
গ্রামের প্রবীণরা বলেন, বহু বছর আগে জমিদার পরিবারের এক তরুণী বধূর নির্মম মৃত্যু হয়েছিল এই আটচালায়। তাঁর নাম হয়তো আজ লুপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু গ্রামের মানুষ তাঁকে চেনে কেবল “আটচালার মেয়ে” বলে। লোককথায় প্রচলিত আছে, তিনি ছিলেন অপরূপা সুন্দরী এবং শিক্ষিতা, কিন্তু স্বামীর অবিশ্বাস ও শ্বশুরবাড়ির চক্রান্ত তাঁকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দিয়েছিল। এক রাতে, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় জমিদারবাড়ির ছায়া যখন নিস্তব্ধ হয়ে ছিল, তখন আটচালা থেকে ভেসে এসেছিল তাঁর আর্তনাদ। পরদিন সকালেই পাওয়া যায় তাঁর নিথর দেহ, তবে কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল তা নিয়ে চিরকালই ধোঁয়াশা রয়ে যায়। কেউ বলে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন, কেউ বলে তাঁকে খুন করে আটচালার অন্ধকার কোণে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। গ্রামের প্রবীণেরা গোপন কণ্ঠে বলেন, জমিদার পরিবার কেলেঙ্কারি চাপা দেওয়ার জন্য মৃত্যু নিয়ে সত্যটা গোপন করেছিল। আর সেই অমীমাংসিত অন্যায়ের কারণেই তাঁর আত্মা আজও মুক্তি পায়নি—আটচালার ভেতর রাত নামলেই শোনা যায় সেই হাহাকার, সেই অশ্রুসিক্ত কান্না।
সময় বদলেছে, জমিদারবাড়ির ঐশ্বর্য মুছে গেছে, নতুন প্রজন্ম এসেছে, কিন্তু কিংবদন্তির ছায়া কাটেনি। গ্রামবাসীরা রাতে আটচালার কাছে ঘেঁষতে ভয় পায়, এমনকি পথ চলতি লোকও সূর্য অস্ত গেলে সেই দিক দিয়ে আর যায় না। কেউ যদি অজান্তে সেখানে পড়ে যায়, পরদিন সকালে তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়—কখনও জ্বর, কখনও মাথা ঘোরা, আবার কখনও অজানা আতঙ্কে কথা হারিয়ে ফেলে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা অল্প বয়সেই শিখে নেয় আটচালার পাশ দিয়ে যেতে হলে দূরে ঘুরে যেতে হয়। অথচ দিনের আলোয় আটচালা দেখতে নিরীহ ভগ্নাবশেষের মতোই লাগে, কিন্তু রাত নামলেই যেন তার ভেতর থেকে জেগে ওঠে অতীতের অন্ধকার। নদীর মতো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সেই কান্নার প্রতিধ্বনি, কুকুরের ঘেউ ঘেউ থেমে যায়, ঝিঁঝিঁর ডাক স্তব্ধ হয়, আর চাঁদের আলোয় জমিদারবাড়ির ছায়া গাঢ় হয়ে ওঠে। গ্রামবাসীর চোখে আটচালা আজ আর কেবল একটি ভগ্ন স্থাপনা নয়—এটি হয়ে উঠেছে অভিশপ্ত অতীতের জীবন্ত স্মৃতি, যেখানে ইতিহাস আর কিংবদন্তি মিলেমিশে তৈরি করেছে অমোঘ এক ভয়ের আভা।
২
শান্তিনগরের মানুষদের মধ্যে দীপন ছিল আলাদা। বয়সে সে গ্রামের অন্য তরুণদের মতোই—মাত্র বাইশের কাঁচা বয়স, চোখে সবসময়ই দুঃসাহসের ঝিলিক। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছিল আটচালার গল্প, কিন্তু কখনও বিশ্বাস করেনি। তার কাছে এগুলো নিছকই লোককথা, অন্ধকারকে ভয় পাওয়ার অজুহাত। গ্রামের প্রবীণদের বারবার বলা সতর্কতা, কিংবা শীতের রাতে কুয়াশার আড়ালে ভেসে আসা কান্নার গল্প—এসবের কোনোটাই তার মনে দাগ কাটেনি। বরং সে ভেবেছিল, সবাই মিলে এক অলীক কাহিনি বানিয়েছে, যাতে আটচালার রহস্য আরো ঘনীভূত হয়। সেই অবিশ্বাসই তাকে টেনে নিয়ে গেল সেই পূর্ণিমার রাতে আটচালার দিকে। আকাশ তখন যেন সাদা আলোয় ভরে উঠেছে, চাঁদ ডুবে গেছে গ্রামের উপরে, চারপাশে নেমে এসেছে এক অদ্ভুত নীরবতা। দীপনের মনে হচ্ছিল, গ্রামের প্রতিটি ঘর যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে—সে কি সত্যিই যাবে আটচালার পথে? সাহসের দম্ভে বুক ফুলিয়ে দীপন হাঁটা দিল। তার মনে কোনো ভয় ছিল না, কেবল প্রমাণ করার এক অদম্য ইচ্ছা—যে ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই।
আটচালার কাছাকাছি যেতেই সে অনুভব করল বাতাসে এক অস্বাভাবিক শীতলতা। শরীরে গা ছমছমে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল, অথচ সে জেদে থামল না। ভগ্ন খিলানদ্বারগুলোর ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমার আলো ঢুকে পড়ছিল, আর তাতে আটচালার গাঢ় ছায়া যেন আরও অন্ধকার হয়ে উঠছিল। গলা শুকিয়ে আসছিল দীপনের, কিন্তু সে পা বাড়াল সামনের দিকে। ঠিক তখনই, চারপাশের নীরবতা ভেঙে এল এক দীর্ঘশ্বাস। প্রথমে মনে হয়েছিল, হয়তো বাতাসের শব্দ, কিন্তু পরক্ষণেই সে স্পষ্ট শুনতে পেল—এক নারীকণ্ঠ, অদ্ভুতভাবে করুণ, বুক ফাটানো কান্নায় ভরা। শব্দটি এতটাই বাস্তব, এতটাই হৃদয়বিদারক ছিল যে দীপনের বুকের ভেতর হৃৎস্পন্দন হু হু করে বেড়ে গেল। চোখ অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে উঠতেই মনে হলো, খিলানের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে এক অস্পষ্ট অবয়ব, সাদা শাড়ির মতো কিছু হাওয়ায় দুলছে। দীপন স্থির হয়ে গেল, তার পা যেন মাটিতে গেঁথে গেল। শরীর জমে গেলেও মাথার ভেতর অস্বীকারের সুর বাজছিল—এটা নিশ্চয়ই ভ্রম, চাঁদের আলোয় চোখ ভুল করছে। কিন্তু নারীকণ্ঠের সেই আর্তনাদ আবার ভেসে এল—এবার আরো কাছে থেকে, আরো শিরশিরে করে। মনে হচ্ছিল, যেন কেউ বুক ভেঙে ফেটে কান্না করছে, সাহায্যের জন্য হাত বাড়াচ্ছে।
দীপনের সমস্ত সাহস মুহূর্তে ভেঙে পড়ল। ঠাণ্ডা ঘামে তার শরীর ভিজে গেল, আর চোখে ঝাপসা হয়ে উঠল চারপাশ। ভয়ে দম ফাটতে লাগল, বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল এক অজানা আর্তনাদ। সে দৌড়ে পালাল, গ্রামের পথে ফিরে যেতে গিয়ে হোঁচট খেল, হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটল যতক্ষণ না নিজের বাড়ির উঠোনে এসে ঢুকে পড়ল। কিন্তু পালিয়ে এলেও কণ্ঠস্বরটা তার কানে বাজতে থাকল—যেন সেই নারী তার পিছু নিয়েছে, যেন কান্নার প্রতিধ্বনি এখনো বাতাসের ভেতরে ঝুলে আছে। রাতভর দীপন শুয়ে রইল, চোখে ঘুম এলো না, কেবল কান পাতল চারপাশে। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল পূর্ণিমার আলো, আর মনে হচ্ছিল আটচালার ভগ্ন খিলান থেকে সেই অশ্রুসিক্ত বিলাপ ছড়িয়ে পড়ছে গোটা গ্রামে। পরদিন সকালে গ্রামবাসীরা যখন দীপনের চোখে ভয় আর মুখে নিস্তব্ধতা দেখল, তখন আর কিছু বলার ছিল না—শান্তিনগরের কাহিনি শুধু কিংবদন্তি নয়, সত্যিই সেখানে লুকিয়ে আছে কোনো অভিশাপ। দীপনও তা-ই বুঝল, কিন্তু ভেতরের ভয়াবহ অনুভূতি তাকে সেদিন থেকেই বদলে দিল—সে বুঝতে পারল, কিছু অন্ধকার রহস্য আছে যেগুলোকে উপহাস করা যায় না।
৩
কলকাতার ব্যস্ত জীবনে ইতিহাস গবেষক অনিন্দ্যর দিন কাটত মূলত লাইব্রেরি, আর্কাইভ আর পুরনো নথিপত্রের ভেতরে। প্রাচীন জমিদার পরিবারগুলোর ইতিহাস, তাঁদের উত্থান-পতন, এবং সেই সব পরিবার ঘিরে জন্ম নেওয়া লোককথা—এসব ছিল তার প্রধান গবেষণার বিষয়। শান্তিনগরের জমিদারবাড়ির কথা সে প্রথম শোনে এক প্রবীণ অধ্যাপকের কাছ থেকে। অধ্যাপক বলেছিলেন, “সেখানে এমন এক কাহিনি লুকিয়ে আছে, যেটি লোককথা হলেও তার ভেতরে ইতিহাসের হাড়গোড় লুকিয়ে আছে।” এ কথাতেই অনিন্দ্যের কৌতূহল বেড়ে যায়। তার অভ্যাস ছিল লোকগাথার আড়ালে চাপা থাকা বাস্তব ইতিহাসকে খুঁজে বের করা, আর শান্তিনগরের জমিদারবাড়ি যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। এক শরৎ সকালের ট্রেনে চেপে সে রওনা দিল শান্তিনগরের দিকে। হাতে ছিল নোটবুক, কিছু পুরনো কাগজপত্র আর একটি টেপ রেকর্ডার। গ্রামের মাটিতে পা রাখতেই তার মনে হলো সে যেন সময়ের গহ্বরে নেমে এসেছে—যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও চারপাশে ইতিহাসের গন্ধ ছড়িয়ে আছে। শান্তিনগরের লোকজন তাকে কৌতূহল ভরে দেখল, কারণ বাইরের লোক সচরাচর এখানে আসে না, বিশেষ করে এমন কেউ যে জমিদারবাড়ির নাম উচ্চারণ করতেও ভয় পায় না।
অনিন্দ্যর উপস্থিতি গ্রামে তৎক্ষণাৎ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল। সে যখনই লোকজনকে প্রশ্ন করতে লাগল জমিদারবাড়ি নিয়ে, একেকজন একেক ধরনের গল্প বলতে শুরু করল। কারো মতে, জমিদার ছিলেন নির্মম শাসক, গ্রামের মানুষকে শোষণ করে নিজের ঐশ্বর্য বাড়িয়েছিলেন। কেউ কেউ বলল, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন তরুণী ও অপার সৌন্দর্যের অধিকারিণী, কিন্তু সেই সৌন্দর্যই তাঁর অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক বৃদ্ধা জানালেন, “ওই বউমা অনেক কষ্ট পেতেন, তার কান্না আমরা কানে শুনতাম। কিন্তু তার মৃত্যু হলো হঠাৎ করেই, কারও কিছু বোঝার আগেই।” আবার আরেকজন বৃদ্ধ কৃষক বললেন, “আত্মহত্যা বলেন! না না, আমরা জানি, ওখানে খুন হয়েছিল। আটচালায় তার দেহ লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।” এতসব ভিন্নমত শোনার পরও অনিন্দ্যর আগ্রহ কমল না, বরং আরও বেড়ে গেল। সে জানত, প্রতিটি গুজবের পেছনে কিছুটা হলেও বাস্তব সত্য লুকিয়ে থাকে। গ্রামবাসীরা বারবার তাকে সাবধান করছিল—“ওদিকে যাবেন না বাবু, রাত হলে তো নয়ই, দিনে গেলেও বিপদ আছে”—কিন্তু সতর্কতা তার মনোযোগ নষ্ট করতে পারল না। বরং মনে হচ্ছিল, এই গ্রাম আর এই জমিদারবাড়ি তাকে টেনে নিচ্ছে অজানা এক গভীরতায়।
তদন্ত শুরু করার জন্য অনিন্দ্য প্রথমে স্থানীয় মন্দিরের পুরোহিত ও গ্রামের প্রবীণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলল। পুরোহিতের ভাষায়, “জমিদারবাড়ির অভিশাপ আজও কেটে যায়নি। ওই বউমার আত্মা ন্যায় চাইছে, কিন্তু কেউ তা দিতে পারেনি।” এরপর সে জমিদারবাড়ির ধ্বংসস্তূপ ঘুরে দেখতে গেল। ভগ্নদালানের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তার মনে হলো, যেন ইতিহাসের অমোঘ ভার তাকে চেপে ধরছে। দেয়ালের খসে পড়া প্লাস্টার, ভাঙা জানালা, আর নিস্তব্ধ করিডোরগুলো যেন অতীতের প্রতিটি যন্ত্রণা চিৎকার করে জানাচ্ছে। বিশেষ করে আটচালার সামনে দাঁড়াতেই তার শরীরে এক অদ্ভুত শীতলতা নেমে এল। চারপাশে কোনো শব্দ ছিল না, কিন্তু মনে হচ্ছিল, বাতাসের ভেতর লুকিয়ে আছে এক গোপন প্রতিধ্বনি—যেটি হয়তো কেবল সাহসী বা কৌতূহলী মানুষই শুনতে পারে। অনিন্দ্যর মন বলছিল, এই জায়গায় কোনো না কোনো লুকানো নথি বা চিহ্ন আছে, যা পুরো কাহিনি উন্মোচন করতে পারে। আর সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলো—গ্রামবাসীর ভয়কে উপেক্ষা করেই সে খুঁজে বের করবে সেই সত্য, যেটি এতদিন ধরে চাপা পড়ে আছে গুজব আর কিংবদন্তির আড়ালে।
৪
অনিন্দ্যর কৌতূহল দিন দিন বেড়ে চলেছিল। গ্রামবাসীর ভয়ে আটচালার ভেতরে না ঢুকলেও সে দিনের আলোয় জমিদারবাড়ির ভগ্নদালানগুলো খুঁজে দেখতে শুরু করল। ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মনে হচ্ছিল, ইতিহাসের প্রতিটি স্তর যেন তার সামনে খসে পড়ছে। দেয়ালে একসময় ঝোলানো ছিল দামি তেলচিত্র, এখন কেবল ছেঁড়া ক্যানভাস আর দাগচিহ্ন। এককালের মহিমাময় বারান্দা ভেঙে পড়েছে, মেঝেতে শুকনো পাতা জমে স্তূপ হয়ে আছে। সে প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করে চোখ বোলাতে লাগল—কোথাও কি পাওয়া যায় কোনো পুরনো কাগজপত্র, বা প্রমাণ যা কিংবদন্তিকে সত্য প্রমাণ করতে পারে? হঠাৎই একটি ছোট ঘরে প্রবেশ করে সে লক্ষ্য করল, কাঠের আলমারির ভাঙা দরজার ফাঁকে কিছু কাগজ উঁকি দিচ্ছে। ধুলোয় মোড়া হলেও কাগজের গন্ধ ছিল অদ্ভুত এক টানটান উত্তেজনা জাগানো। অনিন্দ্য কাগজগুলো টেনে বের করতেই দেখতে পেল, আসলে এগুলো একটি পুরনো ডায়েরির পাতা, যদিও অনেকখানি ছেঁড়া এবং সময়ের ক্ষয়ে মলিন হয়ে গেছে। কাগজে লেখা কালি ফিকে হয়ে গেছে, কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করতেই সে বুঝতে পারল—এটি ছিল এক মহিলার লেখা, হয়তো সেই বধূ যাঁর মৃত্যুর পর আটচালার কিংবদন্তি জন্ম নিয়েছে।
ডায়েরির প্রথম পাতাগুলোতেই ফুটে উঠেছিল তাঁর ব্যক্তিগত যন্ত্রণার কথা। তিনি লিখেছিলেন কেমন করে জমিদার পরিবারের দ্বিতীয় বধূ হয়ে আসার পর থেকেই শ্বশুরবাড়ির চোখে ছিলেন একপ্রকার বোঝা। জমিদারের প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন আগেই, আর দ্বিতীয় বউমার প্রতি কারও মায়া ছিল না। বরং তাকে দোষারোপ করা হতো নানা অজুহাতে। স্বামীও ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছিলেন, গোপনে অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। সেই বিশ্বাসঘাতকতার কষ্ট তিনি প্রতিটি পাতায় উজাড় করে লিখেছেন—“আমার চারপাশে কেউ নেই, সবাই কেবল আমায় দোষ দেয়। আমার স্বামী, যিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন পাশে থাকার, তিনিও আজ আমাকে অন্যের কাছে ঠেলে দিয়েছেন।” তিনি লিখেছেন কীভাবে দিনকে দিন অপমান আর অবহেলা তাঁকে ভেতরে ভেতরে ভেঙে দিচ্ছিল। কখনও কখনও মনে হতো, তিনি যেন বন্দি এক অন্ধকার কারাগারে, যেখানে আলো নেই, ভালোবাসা নেই, কেবল যন্ত্রণা। ডায়েরির শব্দগুলো পড়তে পড়তে অনিন্দ্যের গা শিউরে উঠছিল। এটি আর নিছক কোনো কল্পকাহিনি নয়—এটি এক নারীর বুকচিরে লেখা বাস্তব আর্তনাদ।
সবশেষ পাতায় এসে অনিন্দ্যের শ্বাস আটকে গেল। পাতাটি ছেঁড়া হলেও শেষ কয়েকটি লাইন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তাতে লেখা ছিল—“আজ রাতেই সব শেষ হবে। আমি আর পারছি না। হয়তো কাল আর আমাকে কেউ খুঁজে পাবে না। কিন্তু আমার কান্না হয়তো থেকে যাবে, চাঁদের আলোয় কেউ যদি শোনে, তবে জেনে নেবে—আমি চেয়েছিলাম মুক্তি, চেয়েছিলাম ন্যায়।” এই লাইনগুলো পড়তে পড়তে অনিন্দ্যের মনে হলো, যেন ঘরের ভেতরে হঠাৎ এক শীতল হাওয়া ঢুকে পড়েছে। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছিল সেই পাতার উপর, আর তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত চাপ তৈরি করছিল। সত্যিই কি এই ডায়েরির লেখিকা সেই নারী, যিনি আটচালায় প্রাণ হারিয়েছিলেন? সত্যিই কি তাঁর আত্মা আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে ন্যায় চাইতে? গ্রামবাসীর ভয় পাওয়া কণ্ঠস্বর আর সেই সব গুজব হঠাৎ করেই বাস্তব হয়ে উঠল অনিন্দ্যের কাছে। ডায়েরি হাতে নিয়ে সে বুঝল, এই ভগ্নদালানের অভিশপ্ত ইতিহাসে সে এমন এক সূত্রে হাত দিয়েছে, যা কিংবদন্তিকে ভেদ করে বাস্তবের দিকে এগিয়ে নেবে। কিন্তু তার মনে এক ভয়ও জন্ম নিল—এই তদন্ত কি কেবল ইতিহাস জানার জন্য, নাকি সে নিজেই জড়িয়ে পড়তে চলেছে সেই অভিশাপের অদৃশ্য শিকলে?
৫
শান্তিনগরের চায়ের দোকানগুলোর আড্ডা বরাবরের মতোই জমজমাট। আড্ডার টেবিলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল একটাই বিষয়—জমিদারবাড়ির আটচালা। একদল তরুণ, যারা নিজেদের সাহসিকতার দম্ভে ভরপুর, একের পর এক গল্প টেনে আনছিল। “সব বাজে কথা! ভূত-টুত বলে কিছু নেই,” বলল গ্রামের সাহসী যুবক শুভায়ন। তার কথার পরই সবাই তাকে উস্কে দিতে লাগল। দীপন, যে পূর্ণিমার রাতে নিজে কণ্ঠস্বর শুনেছিল, তীব্র প্রতিবাদ জানাল। কিন্তু বাকিরা হেসে উড়িয়ে দিল, বলল—“ও সব ভয় পেয়ে শোনা কল্পনা। শুভায়ন পারলে গিয়ে প্রমাণ করে দিক।” চ্যালেঞ্জটা শুভায়নের কাছে একেবারে অপমানের মতো লাগল। নিজের সাহস দেখানোর তাগিদে সে ঘোষণা করল—“ঠিক আছে, আজ রাতেই আমি আটচালায় একা রাত কাটাব। যদি একফোঁটা ভূতের ছায়াও দেখি, তবে যা বলবে তাই করব।” এই কথায় উপস্থিত সবাই উত্তেজিত হয়ে উঠল। কেউ কেউ হাসল, কেউ আবার ভয় পেয়ে ফিসফিস করে বলল, “এমন কথা মুখে আনিস না রে, শুভায়ন।” কিন্তু তার চোখে তখন শুধু চ্যালেঞ্জ জেতার জেদ।
রাত বাড়তে শুরু করল। গ্রামের অন্ধকারে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আর মাঝে মাঝে কুকুরের ডেকে ওঠা ছাড়া তেমন কিছু শোনা যাচ্ছিল না। শুভায়ন হাতে একটা টর্চ আর মোটা কম্বল নিয়ে বেরোল। চাঁদের আলোয় শান্তিনগরের জমিদারবাড়ির ভগ্নাবশেষ যেন আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। ভাঙা দেওয়াল, ফাটল ধরা খুঁটি আর মাকড়সার জালে ঢাকা জানালাগুলো এক অদ্ভুত শীতল অনুভূতি এনে দিচ্ছিল চারপাশে। গ্রামের বেশ কয়েকজন দূর থেকে শুভায়নকে যেতে দেখছিল, কিন্তু কেউ তার সঙ্গে ভেতরে ঢোকার সাহস দেখাল না। আটচালার ভেতরে ঢুকে শুভায়ন এক কোণে বসে পড়ল। প্রথমে ভেতরটা অস্বাভাবিক চুপচাপ মনে হলো, শুধু বাতাসে ভাঙা কাঠের কড়মড় শব্দ। নিজের বুকের ভেতরের ঢিপঢিপ আওয়াজ ঢাকতে সে সিগারেট ধরাল, ধোঁয়াটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়তেই এক মুহূর্তের জন্য যেন পরিবেশটা একটু হালকা লাগল। ঘড়ির কাঁটা এগোতে থাকল, শুভায়ন সময় গুনছিল। প্রথম ঘণ্টা, দ্বিতীয় ঘণ্টা কেটে গেল, কিছুই ঘটল না। তার মনে হলো—সবই মিথ্যে। যারা ভয় পায়, তারাই ভূত কল্পনা করে। কিন্তু যত রাত গভীর হতে লাগল, তার বুকের ভেতরে অজানা এক অস্বস্তি জন্ম নিতে লাগল।
মধ্যরাত পেরোতেই হঠাৎ করেই আটচালার নিস্তব্ধতা ভেঙে এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল—প্রথমে যেন কারও দীর্ঘশ্বাস, তারপর সেই দীর্ঘশ্বাস ধীরে ধীরে রূপ নিল করুণ কান্নায়। শুভায়ন প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কানে ভুল শোনার ফল। সে টর্চ জ্বালিয়ে চারপাশে তাকাল, কিছুই নেই। বাতাসও থেমে গেছে, যেন চারপাশের সবকিছু জমে গেছে হঠাৎ। কিন্তু পরের মুহূর্তেই আরও স্পষ্টভাবে ভেসে এল সেই নারীকণ্ঠের বিলাপ—যন্ত্রণাভরা, বুক কাঁপিয়ে দেওয়া এক আর্তনাদ। শুভায়নের শরীর হিম হয়ে গেল। তার হাত কাঁপতে লাগল, সিগারেটের ছাই মাটিতে পড়ল। চোখে জল এসে যাচ্ছিল যেন সেই কান্নার শব্দেই। সে যতই বোঝাতে চাইছিল যে এগুলো শুধু মনের ভুল, ততই শব্দটা তীক্ষ্ণ হয়ে কানে বাজছিল। এক মুহূর্তে মনে হলো, যেন কারও পায়ের শব্দ আসছে আটচালার ভেতরের অন্ধকার কোণ থেকে। শুভায়নের সাহস তখন ভেঙে পড়ছিল, কিন্তু বাইরে বেরোনোর মতো শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলল সে। তার বুকের ভেতরে ধুকপুক শব্দ এমন জোরে বাজছিল, যেন গোটা আটচালা শুনতে পাচ্ছে। সে টলমল করে দাঁড়িয়ে উঠল, কিন্তু পা যেন আটকে গেল জায়গায়। তারপর হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া বইল, আর সেই সঙ্গে নারীকণ্ঠের বিলাপ আরও ভয়ার্ত হয়ে উঠল—শোনাচ্ছিল, যেন মৃত্যু-যন্ত্রণায় কেউ কাঁদছে। শুভায়নের মনে হলো, পুরো আটচালা ভরে গেছে সেই কান্নায়। চোখে অন্ধকার নামতে শুরু করল, কানে শেষ যে শব্দটা বাজল তা হলো—“আমায় বাঁচাও।” পরের মুহূর্তেই সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
৬
শুভায়নের মনে হচ্ছিল যেন রাতটা আর কাটবে না। চারপাশের অন্ধকার তার বুকের ভেতরে ভয়ের পাহাড় চাপিয়ে দিয়েছিল। একদিকে নারীকণ্ঠের বিলাপ, অন্যদিকে ঠান্ডা হাওয়ার হাহাকার—সব মিলিয়ে পরিবেশটা অচেনা ও ভৌতিক হয়ে উঠেছিল। সেই মুহূর্তেই হঠাৎ করে আটচালার এক কোণ থেকে ম্লান আলো ফুটে উঠতে দেখা গেল। শুভায়নের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছিল। সেই আলোয় ভেসে উঠল এক সাদা শাড়ি পরা নারীর ছায়া—মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না, তবে শরীরের অবয়ব ধীরে ধীরে কাছে আসছিল। শুভায়ন ভয়ে জমে গিয়েছিল, শরীর নড়ানোর শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছিল। চোখের সামনে দেখা সেই অবয়ব একেবারেই বাস্তব মনে হচ্ছিল, কল্পনা নয়। তার পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল না, অথচ মনে হচ্ছিল মেঝের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। বাতাস হঠাৎ করেই ভারী হয়ে উঠল, আর সেই সঙ্গে তার শরীর শিউরে উঠল। ঠোঁট কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল চিৎকার করবে, কিন্তু গলা থেকে শব্দ বেরোচ্ছিল না। সাদা শাড়ির ছায়াটা যতই কাছে আসছিল, তার বুকের ভেতর যেন ততই ধ্বসে পড়ছিল সাহসের দেওয়াল।
ছায়াটা একসময়ে আটচালার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। শুভায়নের মনে হচ্ছিল, সে যেন ওই নারীর অশ্রুসিক্ত মুখ দেখতে পাচ্ছে, অথচ চোখ মেললেই সেই মুখ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ভয়ের সঙ্গে মিশে গেল এক অদ্ভুত দুঃখবোধ। চারপাশের বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল প্রতি মুহূর্তে, এতটাই যে শুভায়নের নিশ্বাস বেরোনোর সময় সাদা কুয়াশার মতো হয়ে আসছিল। ঘরের দেওয়ালগুলো কাঁপছে, মেঝে থেকে হাড়কাঁপানো শীত বেরোচ্ছে—সব মিলিয়ে একটা ভয়াল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। হঠাৎ করেই বাইরে থেকে তীব্র ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে গেল আটচালার ভেতরে, দরজাটা প্রচণ্ড শব্দে ধাক্কা খেল, জানালার কপাট ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। সেই ঝড়ে শুভায়নের শরীর যেন জমে গেল। তার মনে হলো, অদৃশ্য কেউ তার কাঁধের ওপর হাত রেখেছে—একটা বরফশীতল হাত। হাড় পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল তার। আতঙ্কে শুভায়ন টর্চ জ্বালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু টর্চের আলোও তখন ম্লান হয়ে এল, যেন অন্ধকারই সব আলো গিলে নিচ্ছে। নারীকণ্ঠের কান্না তীব্র হয়ে উঠল, আর ছায়াটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল, যেন মাটির ওপর ভেসে আসছে। শুভায়নের শরীর অবশ হয়ে আসছিল, চোখ ভারী হয়ে যাচ্ছিল, আর কান্নার শব্দ তার কানে তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো বিঁধছিল।
সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তের পর আর কিছুই মনে নেই শুভায়নের। রাতের অন্ধকার তার চেতনা কেড়ে নিল, আর সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ভোরের প্রথম আলো ফোটার পর গ্রামবাসীরা যখন আটচালার সামনে এল, তখনো চারপাশে অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা ভাব লেগে ছিল। দরজাটা আধখোলা অবস্থায় দুলছিল, ভেতরে ঢুকেই তারা দেখল শুভায়ন মেঝেতে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। তার ঠোঁট শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে, মুখে আতঙ্কের ছাপ যেন এখনো আঁকা রয়েছে। চারপাশে বাতাস ছিল শীতল ও ভারী, আর আটচালার দেওয়ালে মাকড়সার জাল দুলছিল ঝড়ো হাওয়ার মতো করে। কেউ কেউ কাছে গিয়ে শুভায়নকে ডাকতে লাগল, কিন্তু কোনো সাড়া মিলল না। অনেক কষ্টে তাকে টেনে বাইরে আনা হলো। বাইরে বেরোতেই হাওয়ার দমকা থেমে গেল, কিন্তু ভেতরের অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা যেন এখনও গায়ে লেগে রইল সবার। শুভায়নকে জাগাতে জাগাতে গ্রামবাসীরা বুঝল, সে স্বাভাবিক ঘুমে নয়, ভয় ও আতঙ্কের কারণে অচেতন হয়ে পড়েছিল। অনেক পরে, যখন তাকে সজাগ করা হলো, তখনও সে কাঁপছিল, ঠোঁট কাঁপিয়ে শুধু বলছিল—“সে…সে আমার দিকে আসছিল…সাদা শাড়ি…আমি চোখে দেখেছি।” তার কণ্ঠে এমন আতঙ্ক ছিল যে উপস্থিত সবাই শিউরে উঠল। সেই রাতের পর শান্তিনগরের মানুষ আরও নিশ্চিত হয়ে গেল—আটচালার অভিশাপ সত্যি, আর সেখানকার কান্না নিছক গুজব নয়, বরং অদৃশ্য এক ছায়ার উপস্থিতি।
৭
অনিন্দ্যর তদন্ত ক্রমশ গভীর হচ্ছিল। আটচালায় শুভায়নের অভিজ্ঞতার পর গ্রামবাসীরা আতঙ্কে ভরে উঠলেও তার গবেষণার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। হাতে পাওয়া ছেঁড়া ডায়েরির পাতাগুলো আবার তিনি খুঁটিয়ে পড়লেন। প্রতিটি লাইনে যেন যন্ত্রণা ঝরে পড়ছিল—স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনের যন্ত্রণা, একাকিত্বের অভিশাপ, আর মৃত্যুর আগের আতঙ্ক। স্থানীয় প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলেই অনিন্দ্য টুকরো টুকরো তথ্য জোড়া লাগাতে শুরু করলেন। গ্রামের প্রাচীনতম অধিবাসী রত্নেশ্বর মল্লিক, যিনি প্রায় নব্বই পার করেছেন, তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। রত্নেশ্বর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—“আমরা ছোটবেলায় শুনেছি, জমিদারের ছোটবউ সতীশ্বরী দেবী নাকি নিজে থেকে প্রান দিয়েছিলেন। তবে আমি সব সময়ই ভেবেছি, এর পেছনে অন্য কিছু আছে। কারণ তার কান্নার কথা শুধু মৃত্যুর রাতে নয়, তারও আগে বহুবার শোনা গিয়েছিল।” অনিন্দ্যর কাছে এটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। তিনি উপলব্ধি করলেন—ডায়েরির বেদনার সাথে গ্রামের পুরোনো গুজব একসূত্রে বাঁধা। ডায়েরির শেষ লাইন—“আজ রাতেই সব শেষ হবে”—শুধু আত্মহত্যার ইঙ্গিত নয়, বরং মৃত্যুর এক পরিকল্পিত রূপ।
তিনি স্থানীয় কাহিনি একত্রিত করে দেখতে পেলেন, সতীশ্বরী দেবী ছিলেন এক অতি সংবেদনশীল অথচ দৃঢ়চেতা মহিলা। তার স্বামী, জমিদারের ছোট ছেলে, একদিকে নেশায় আসক্ত, অন্যদিকে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই সম্পর্কের অপমান আর অত্যাচার সতীশ্বরীর জীবনকে দমবন্ধ করে তুলেছিল। উপরন্তু, শ্বশুরবাড়ির বড়রা তার স্বর ও প্রতিবাদ পছন্দ করতেন না। তার স্বাধীনচেতা মনোভাব জমিদার পরিবারের ক্ষমতাকেন্দ্রিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছিল। ডায়েরিতে তিনি লিখেছিলেন—“আমি চাই না আমার সন্তানও এ অন্যায়ের সাক্ষী হোক।” এই বাক্য অনিন্দ্যকে ভাবতে বাধ্য করল। তিনি অনুমান করলেন, হয়তো সতীশ্বরী দেবী সন্তানসম্ভবা ছিলেন, এবং পরিবার সেটা কোনোভাবেই মেনে নিতে চায়নি। তাই তাকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সমস্ত কাহিনি খুঁটিয়ে দেখে অনিন্দ্য বুঝতে পারলেন, সতীশ্বরীর মৃত্যু আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল কেবল জমিদার পরিবারের কেলেঙ্কারি এড়ানোর জন্য। সমাজে তাদের সম্মানই ছিল মূল লক্ষ্য, আর একজন মহিলার জীবন সেখানে কিছুই নয়। গ্রামবাসীদের মুখের গল্পও এই সত্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। অনেকেই বলেছিল, মৃত্যুর আগের রাতে আটচালার দিক থেকে চিৎকার শোনা গিয়েছিল, অথচ ভোরে সবাই দেখেছিল তার নিথর দেহ। অথচ অফিসিয়াল ঘোষণা হয়েছিল—তিনি নিজে গলায় দড়ি দিয়ে জীবন শেষ করেছেন।
অনিন্দ্য তার গবেষণার খাতায় সমস্ত তথ্য সাজিয়ে লিখতে শুরু করলেন। প্রতিটি প্রমাণ তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, সতীশ্বরী দেবীর মৃত্যু ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ডায়েরির ছেঁড়া অংশে যন্ত্রণার বিবরণ ছিল, কিন্তু মৃত্যুর ঘটনার কোনো বর্ণনা ছিল না। এটা নিজেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে শেষ মুহূর্তের লেখাগুলো হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করা হয়েছিল, যাতে সত্য লুকিয়ে রাখা যায়। অনিন্দ্য অনুমান করলেন—জমিদার পরিবারের কেউ ডায়েরি থেকে অংশ ছিঁড়ে ফেলেছিল মৃত্যুর পরপরই। এই তত্ত্ব প্রকাশ্যে আনলে হয়তো প্রমাণ জোগাড় করা কঠিন হবে, তবে কিংবদন্তির ভিত কেঁপে উঠবে। তার গবেষণার ভেতর দিয়ে সত্য উন্মোচিত হলো—আটচালার কান্না আসলে এক বধূর মৃত্যুযন্ত্রণার প্রতিধ্বনি, যাকে হত্যা করা হয়েছিল স্বার্থের খাতিরে। গ্রামবাসীরা এতদিন ভূতের গল্প হিসেবে যা শুনে এসেছে, তা আসলে এক দমিত ইতিহাসের আর্তনাদ। অনিন্দ্যর মনে হলো, সতীশ্বরীর আত্মা এখনও শান্তি পায়নি, তাই আজও পূর্ণিমার রাতে আটচালায় শোনা যায় সেই বিলাপ। তিনি উপলব্ধি করলেন, তার গবেষণা আর নিছক ইতিহাস নয়—এটা হলো ন্যায়ের খোঁজ, আর এক বিস্মৃত সত্যকে নতুন করে পৃথিবীর সামনে আনার প্রয়াস।
৮
অনিন্দ্যর গবেষণা ধীরে ধীরে এমন এক মোড় নিল, যেখানে কিংবদন্তির পেছনের অন্ধকার বাস্তব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। সতীশ্বরীর মৃত্যু যে হত্যাকাণ্ড ছিল, সেটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এর পরও একটা প্রশ্ন রয়ে গেল—তার দেহের কী হয়েছিল? গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে একটা গুঞ্জন ছিল, কিন্তু কেউ খোলাখুলি বলতে চাইত না। অবশেষে অনিন্দ্য প্রবীণদের মুখোমুখি হলেন। এক সন্ধ্যায়, শান্তিনগরের বটতলার মোড়ে কয়েকজন বৃদ্ধ বসেছিলেন। তাঁদের কাছে গিয়ে অনিন্দ্য সাবধানে প্রশ্ন করলেন—“সতীশ্বরী দেবীর দেহ কোথায় গিয়েছিল?” অনেকক্ষণ নীরবতা বিরাজ করল। হঠাৎ, নব্বই পেরোনো রত্নেশ্বর মল্লিক কাঁপা গলায় বললেন—“তখন আমরা ছিলাম ছেলেপিলেরা। ভোরবেলা শুনেছিলাম, দেহ নিয়ে যাওয়া হবে শ্মশানে। কিন্তু কোনো সৎকার হয়নি। রাতের অন্ধকারে, ক’জন কুলী আর পরিবার-পরিজন মিলে দেহটাকে গোপনে পুঁতে দেয় আটচালার তলায়।” বাকিরা প্রথমে চুপ থাকলেও, একে একে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। অনিন্দ্যের বুক কেঁপে উঠল। এ মানে দাঁড়ায়, সতীশ্বরীর আত্মা আটচালার ভেতরেই বন্দি হয়ে আছে, কারণ তাকে মুক্তির আলো দেখানো হয়নি। আর সেই অশ্রদ্ধা, সেই অমানবিক গোপনীয়তাই আজও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নারীকণ্ঠের বিলাপে।
এরপর তিনি আরও বিশদে জানতে চাইলেন। প্রবীণদের বক্তব্য থেকে জানা গেল, জমিদার পরিবার সমাজে নিজেদের সম্মান রক্ষার জন্য সতীশ্বরীর মৃত্যুকে প্রকাশ করতে চায়নি। আত্মহত্যার নাম করে যদি কেলেঙ্কারি ছড়াত, তবে তাঁদের মর্যাদা নষ্ট হতো। তাই গোপনেই সব আড়াল করা হয়। আনুষ্ঠানিক দাহক্রিয়া না হওয়ায়, ধর্মীয় আচারও সম্পূর্ণ হয়নি। যেকোনো হিন্দু পরিবারের বধূর জন্য মৃত্যুর পর শাস্ত্রীয় আচার অপরিহার্য, কিন্তু সতীশ্বরী সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। বরং তাকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল যেন এক অচেনা অপরাধী। অনিন্দ্যের মনে হলো, তাই-ই হয়তো তাঁর আত্মা শান্তি খুঁজে পাচ্ছে না। ডায়েরির শেষের যন্ত্রণা, সেই রাতের আর্তনাদ, আর ভোরবেলার গোপন কবর—সব একসাথে মিলিয়ে যেন মাটি থেকেই চিৎকার শোনা যায়। তিনি যখন এই কথা ভাবছিলেন, তখন পাশ থেকে গ্রামের আরেক বৃদ্ধ ফিসফিস করে বললেন—“বছরে একদিন, পূর্ণিমার রাতে, আটচালার ভেতর থেকে যেন মাটি কাঁপতে থাকে। মনে হয়, কেউ হাত বাড়িয়ে উঠতে চাইছে ভেতর থেকে।” এই কথা শুনে উপস্থিত সবাই শিউরে উঠল, আর অনিন্দ্যের মন আরও দৃঢ় হলো। তিনি জানলেন, তাঁর গবেষণার পথ এখন একেবারে সোজা—সেই কবরস্থানের সত্য প্রকাশ করতে হবে।
ভোরের আলোয় জমিদারবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অনিন্দ্যের চোখে ভেসে উঠছিল এক নিদারুণ চিত্র। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্রামবাসীরা এক মহিলার যন্ত্রণাকে ভূতের গল্প ভেবে এড়িয়ে গেছে। অথচ সত্যটা ছিল আরও ভয়াবহ—একজন বঞ্চিত নারী, যিনি শুধু নির্যাতনের শিকারই হননি, মৃত্যুর পরও যাঁর মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আটচালার কান্না তাই নিছক ভূতুড়ে নয়, এটা হলো অবমাননার প্রতিধ্বনি, যেটা ইতিহাস চেপে রেখেছিল। অনিন্দ্য মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি প্রমাণ করবেন যে সতীশ্বরীর আত্মা মুক্তি পায়নি কারণ তাঁকে যথাযথ সৎকার দেওয়া হয়নি। এই অভিশপ্ত কবরই আটচালাকে ভয়ের প্রতীক বানিয়েছে। তিনি জানতেন, সমাজ হয়তো সত্যকে সহজে মেনে নেবে না, কিন্তু এটাই ছিল কিংবদন্তির পেছনের অমোঘ বাস্তব। তার চোখে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল—যতদিন পর্যন্ত সেই গোপন কবরের সত্য প্রকাশ না পাবে, আর সতীশ্বরীর মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া না হবে, ততদিন আটচালার বিলাপ চলতেই থাকবে। আর শান্তিনগর গ্রামের প্রতিটি পূর্ণিমা রাত হবে এক অমোঘ অভিশাপের সাক্ষী।
৯
গ্রাম শান্তিনগরের আকাশ সেদিন কালো মেঘে ঢাকা ছিল। অমাবস্যার অন্ধকার চারপাশে নেমে আসছিল ধীরে ধীরে। সেই ভয়ঙ্কর রাতেই অনিন্দ্য সিদ্ধান্ত নিলেন, আর ভয়ে পালিয়ে লাভ নেই। সত্য প্রকাশ করতে হলে আত্মার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কয়েকজন সাহসী গ্রামবাসী—যাদের মধ্যে ছিল দীপন, শুভায়ন ও আরও তিনজন—তার সঙ্গী হলো। হাতে ধূপ-ধুনো, নারকেলের খোলায় জ্বলতে থাকা আগুন, আর কিছু ফুল নিয়ে তারা জমিদারবাড়ির আটচালার ভেতরে প্রবেশ করল। বাইরে বাতাসে অস্বাভাবিক নীরবতা, কেবল দূরে কুকুরের হাহাকার আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সবার বুকের ভেতর কেমন হিম হয়ে এল। অনিন্দ্য মাঝখানে ধূপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা শুরু করলেন—“হে অশান্ত আত্মা, যদি সত্যিই তুমি এখানে থাকো, তবে আমাদের সামনে এসো। আমরা তোমার যন্ত্রণা শুনতে চাই।” চারপাশে ধোঁয়ার আস্তরণ ছড়িয়ে পড়তে লাগল, ধূপের গন্ধে যেন অদৃশ্য কেউ উপস্থিত হয়ে উঠল। একসময় বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে গেল, আটচালার কাঠের খুঁটি কেঁপে উঠল, আর সবার চোখের সামনে মশালের আগুন অস্বাভাবিকভাবে দুলতে লাগল।
হঠাৎই নিস্তব্ধতা ভেঙে উঠল এক নারীকণ্ঠ। প্রথমে মৃদু দীর্ঘশ্বাস, তারপর ধীরে ধীরে সেই শব্দ রূপ নিল বুক বিদীর্ণ করা কান্নায়। “আমার ন্যায় চাই…আমার ন্যায় চাই…”—শব্দগুলো যেন আটচালার প্রতিটি ইটে প্রতিধ্বনি তুলছিল। দীপনের হাত থেকে ধূপদানী পড়ে গিয়ে গড়িয়ে গেল মাটিতে। শুভায়ন কাঁপতে কাঁপতে অনিন্দ্যের দিকে তাকাল, তার ঠোঁট শুকিয়ে আসছিল। উপস্থিত গ্রামবাসীরা নিজেদের বুক চেপে ধরে ছিল, মনে হচ্ছিল, শরীরের ভেতর থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাবে আতঙ্কে। কিন্তু অনিন্দ্য সাহস করে উঠে দাঁড়িয়ে ধোঁয়ার দিকে হাত জোড় করে বললেন—“সতীশ্বরী দেবী, আমরা জানি আপনার মৃত্যু অন্যায়ভাবে ঘটেছে। আপনার দেহকেও মর্যাদা দেওয়া হয়নি। বলুন, আপনি আমাদের কাছ থেকে কী চান?” এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতার পর আবার গর্জে উঠল অদৃশ্য কণ্ঠ—“আমার সত্য প্রকাশ করো। আমার সৎকার করো। আমি শান্তি চাই।” শব্দে যন্ত্রণা, ক্ষোভ আর অভিশাপের মিশ্রণ এতটাই তীব্র ছিল যে সবাই শিউরে উঠল। বাতাস আরও ঠাণ্ডা হয়ে গেল, এমনকি ধূপ-ধুনোর আগুনও কাঁপতে কাঁপতে নিভে যাওয়ার উপক্রম হলো।
এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে গ্রামবাসীরা বুঝতে পারল, এ আর নিছক ভূতের গল্প নয়। সতীশ্বরী দেবীর আত্মা সত্যিই এখানে বন্দি হয়ে আছে। অনিন্দ্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন, সত্য চাপা দিয়ে রাখা যাবে না। তিনি উচ্চস্বরে বললেন—“আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, আপনার মৃত্যুর সত্য প্রকাশ করব, আর আপনাকে মর্যাদাসহকারে সৎকার দেব।” তার কথার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে প্রবল ঝোড়ো হাওয়া বইতে লাগল, আটচালার জানালা ও দরজা ধাক্কা খেয়ে কাঁপতে লাগল। নারীকণ্ঠ আবারও প্রতিধ্বনি তুলল—“ন্যায়…ন্যায়…”—তারপর ধীরে ধীরে শব্দ মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। পরিবেশ আবার নীরব হয়ে এল, কিন্তু বাতাসের ভারী চাপ থেকে গেল অনেকক্ষণ। উপস্থিত প্রত্যেকেই তখনও কাঁপছিল, বুকের ভেতর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। তবে এবার আর ভয় নয়, তাঁদের চোখে ছিল বিস্ময় আর এক নতুন সংকল্প। গ্রামবাসীরা বুঝতে পারল, আটচালার কান্না কেবল ভূতের ভয় নয়, এটা এক মৃত নারীর ন্যায়ের দাবি। সেই রাত থেকেই অনিন্দ্য ও গ্রামবাসীদের মনে হলো—এখন সময় এসেছে অভিশাপ ভাঙার, সতীশ্বরীর আত্মাকে মুক্ত করার।
১০
গ্রামবাসীরা বহু আলোচনার পর স্থির করল যে সতীশ্বরীর আত্মাকে সম্মান জানানোই একমাত্র উপায়। তারা জমিদারবাড়ির ধ্বংসপ্রাপ্ত জমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলে। স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরির দিন পুরো গ্রাম একত্রিত হয়েছিল। প্রবীণরা শঙ্খ বাজিয়ে আর ধূপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন। শিশুরা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে ছিল, আর মহিলারা মন্ত্রপাঠ করছিলেন। সবাই মনে করেছিল, হয়তো এই পথেই সতীশ্বরীর অস্থির আত্মা মুক্তি পাবে। অনিন্দ্যও সেই মুহূর্তে গভীর শ্রদ্ধাভরে দাঁড়িয়ে ছিল, কারণ সে জানত—এই সত্য প্রকাশ না করলে কাহিনি অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। মাটির স্মৃতিস্তম্ভের ওপর ফুল দিয়ে গ্রামের মানুষ প্রার্থনা করল, “তুমি শান্তি পাও।” সত্যিই, সেই রাতের পর থেকে যেন গ্রামে অদ্ভুত এক প্রশান্তি নেমে এলো। পূর্ণিমার রাত পেরিয়ে গেল, অমাবস্যাও এল, কিন্তু কোথাও কোনো অদৃশ্য কান্না বা হাহাকার ভেসে আসেনি। গ্রামবাসীরা ভেবেছিল, অভিশাপ ভেঙে গেছে। তারা স্বস্তি পেয়ে ধীরে ধীরে পুরনো ভয় ভুলে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেল।
কিন্তু সময় সবসময়ই ভিন্ন সত্য প্রকাশ করে। স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে ওঠার প্রায় এক বছর পরের কথা। আবার এক পূর্ণিমার রাত। কুশাবতী নদীর পাড়ে তখন রূপোলি আলো ঝিকমিক করছে। গ্রামের লোকেরা যখন রাতের খাবার শেষে ঘুমোতে গিয়েছিল, হঠাৎ কিছু কুকুর অদ্ভুতভাবে হাউমাউ করতে শুরু করল। বাতাসে এক অস্বাভাবিক শীতলতা ভেসে উঠল। কয়েকজন যুবক প্রথমে ভেবেছিল, এ নিছক কাকতাল, কিন্তু মিনিট কয়েকের মধ্যেই তারা স্পষ্ট শুনতে পেল—আটচালার ভেতর থেকে করুণ সুরে ভেসে আসছে সেই নারীকণ্ঠ। কণ্ঠস্বর যেন পাহাড় ভেঙে নামা জলের মতো গভীর দুঃখে ভরা—“আমার ন্যায় চাই।” ঘুম ভেঙে সবাই আতঙ্কে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। অনিন্দ্য ছুটে গেল আটচালার দিকে, কিন্তু সেখানে পৌঁছে কিছুই দেখা গেল না। শুধু ভাঙা দেওয়াল আর ফাঁকা অন্ধকার। তবুও সেই কান্নার প্রতিধ্বনি গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের প্রবীণরা হতবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালেন—তাহলে কি আত্মা সত্যিই মুক্তি পায়নি?
পরদিন সকালের আলোয় গ্রামজুড়ে গুঞ্জন শুরু হল। অনিন্দ্য গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বলল, “স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে হয়তো আমরা সম্মান জানিয়েছি, কিন্তু সত্য চাপা রয়ে গেছে। সতীশ্বরীর মৃত্যুর প্রকৃত অপরাধীরা, যারা সমাজের কেলেঙ্কারি ঢাকতে তাকে হত্যা করে আত্মহত্যার রূপ দিয়েছিল, তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। বিচার না হলে কীভাবে আত্মা শান্তি পাবে?” গ্রামবাসীরা তখন বুঝতে পারল যে সত্য যতদিন অস্বীকার করা হবে, সেই কান্না ততদিন থামবে না। কান্না আসলে ছিল অসমাপ্ত ন্যায়বিচারের প্রতিধ্বনি। অনেকেই আবার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল, কিন্তু অনিন্দ্য দৃঢ়ভাবে বলল—“এ অভিশাপ থেকে মুক্তির একটাই উপায়—পুরো সত্য প্রকাশ করতে হবে, জমিদার পরিবারের পাপ যে ইতিহাসকে কলুষিত করেছে, তা সামনে আনতে হবে।” গ্রামবাসীদের মনে তখন এক নতুন উপলব্ধি জন্ম নিল। তারা বুঝল, মুক্তি আর অভিশাপের মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যবধান আছে, আর তা নির্ভর করে সত্যকে সামনে আনার ওপর। সেই রাতে কুশাবতী নদীর ঢেউ যেন তাদের কাছে ফিসফিস করে বলল—“যতদিন সত্য চাপা থাকবে, ততদিন এই হাহাকার নিঃশেষ হবে না।”
শেষ