অরিন্দম ঘোষ
পর্ব ১ : নাইন মাইলের ছেলেটি
জ্যামাইকার পাহাড়ি গ্রাম নাইন মাইল— চারপাশে কুয়াশায় মোড়া সবুজ পাহাড়, খেজুর আর বাঁশঝাড়ে ছাওয়া সরু পথ, মাটির ঘরে বসবাস আর দরিদ্র অথচ প্রাণবন্ত এক সম্প্রদায়। এই গ্রামেই ১৯৪৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জন্ম নিল এক শিশু, নাম রাখা হলো রবার্ট নেস্টা মার্লে। তার বাবা নরভাল সিনক্লেয়ার মার্লে ছিলেন এক সাদা ত্বকের ইংরেজ বংশোদ্ভূত নৌসেনা কর্মকর্তা, বয়সে অনেক বড়, আর মা সিডেলা বুকার, স্থানীয় কালো বর্ণের তরুণী। এ এক অদ্ভুত জুটি— যা সমাজ সহজে মেনে নেয়নি।
শিশু বব ছোটবেলা থেকেই মিশ্র পরিচয়ের ভার বহন করত। গ্রামে তাকে “হাফ-কাস্ট” বলে কটাক্ষ করা হতো। সাদা বাবার ছাপ ছিল তার ত্বকে, কিন্তু গ্রাম জানত সে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মায়ের সন্তান। বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রায় অনুপস্থিতই ছিল— নরভাল মার্লে দূরে দূরে থেকেছেন, কিছু অর্থ সাহায্য করেছেন, কিন্তু সন্তানের জীবনে স্নেহভরা উপস্থিতি রাখেননি কখনোই। ফলে সিডেলাই হয়ে উঠলেন তার পৃথিবীর কেন্দ্র।
দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হতে হতে বব ছোট থেকেই উপলব্ধি করেছিল অন্যায়ের স্বাদ। স্কুলে বন্ধুরা তার মিশ্র রক্ত নিয়ে ঠাট্টা করলে সে চুপ করে থাকত, কিন্তু অন্তরে জমা হত ক্ষোভ। সেই ক্ষোভই ধীরে ধীরে সঙ্গীতে রূপ নেবে, কারণ ববের মনে গানই ছিল একমাত্র আশ্রয়।
শৈশবে তার হাতে প্রথম আসে এক পুরোনো গিটার, যা ছিল স্থানীয় এক বন্ধুর। ওই গিটার বাজিয়ে বব বুঝতে শিখল— দুঃখ, অন্যায়, আনন্দ, প্রতিবাদ— সবকিছুই সুরে ঢেলে দেওয়া যায়। আর গ্রামের চারপাশে চলতে থাকা আফ্রিকান রিদম, ক্রান্তীয় ড্রাম, চার্চের গান আর লোকসঙ্গীত— সব মিলিয়ে ববের মনে জন্ম নেয় অনন্য এক সঙ্গীতভাষা।
তার মা সিডেলা প্রায়ই বলতেন, “নেস্টা, তুমি ভিন্ন। ঈশ্বর তোমার ভিতরে গান রেখে দিয়েছে।” বব মায়ের সেই কথাকে বিশ্বাস করত। কিন্তু তখনও সে জানত না, এই গান একদিন সারা বিশ্বকে নাড়া দেবে।
নাইন মাইলের খোলা মাঠে সন্ধ্যা নামলে ছেলেরা ফুটবল খেলত। ববও সেই খেলায় দৌড়ে যেত, আর খেলার ফাঁকে গুনগুন করে তৈরি করত নিজের সুর। অল্প বয়সেই তার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত কাঁপন, যেন পাহাড়ি হাওয়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অগ্নিশিখা। গ্রামের মানুষ টের পেত— এই ছেলেটা আলাদা।
যদিও পরিবার ছিল দরিদ্র, তবু সিডেলা বুকার দৃঢ় মানসিকতার নারী। তিনি ববকে শিখিয়েছিলেন— পরিশ্রম, আস্থা আর আধ্যাত্মিকতা ছাড়া জীবন টেকে না। তিনি ছোট্ট ছেলেকে প্রায়ই বাইবেলের গল্প শোনাতেন, আর আফ্রিকান গানের ছন্দে নাচতেন। এই মিশ্র আধ্যাত্মিক আর সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা বব ধীরে ধীরে গড়ে তুলছিল নিজের পৃথিবী— যেখানে মানুষ সমান, যেখানে সুর মানে স্বাধীনতা।
কিন্তু গ্রাম ছোট, সুযোগ সীমিত। একসময় সিডেলা সিদ্ধান্ত নিলেন— ছেলেকে নিয়ে কিংস্টনে চলে যাবেন, শহরে। ওখানে হয়তো কাজ মিলবে, ববেরও জীবন পাল্টাবে। তখনও কে জানত, সেই শহরই একদিন হয়ে উঠবে বব মার্লের গানের জন্মভূমি।
কিংস্টনের পথ ধুলোয় ভরা, কিন্তু সেখানেই অপেক্ষা করছে নতুন ভবিষ্যৎ— সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ, বিপ্লবের ভবিষ্যৎ।
পর্ব ২ : কিংস্টনের গলিঘুঁজি
নাইন মাইলের পাহাড়ি নীরবতা থেকে হঠাৎ কিংস্টনের কোলাহল— এ এক বিরাট পরিবর্তন। শহরের রাস্তায় ট্রামের শব্দ, বাজারের ভিড়, গলির ভিতরে বস্তির ঘিঞ্জি জীবন। সিডেলা বুকার তার ছেলেকে নিয়ে এসে উঠলেন ট্রেঞ্চ টাউন এলাকায়, যা তখন জ্যামাইকার সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত মহল্লাগুলির একটি। এখানে কাঠের ঘর, টিনের চাল, গরমে হাঁসফাঁস করা ঘরোয়া জীবন— আর চারপাশে দারিদ্র্যের সঙ্গে মিশে থাকা প্রাণবন্ত সঙ্গীত।
ট্রেঞ্চ টাউনে প্রবেশ করেই বব বুঝল, এই শহর অন্যরকম। এখানে প্রতিটি দেওয়ালে লেখা প্রতিবাদের স্লোগান, প্রতিটি উঠোনে শোনা যায় রেগে-রিদম, স্কা, রকস্টেডি। দারিদ্র্য যেমন আছে, তেমনই আছে স্বপ্নের উন্মাদনা। ববের কিশোর মন কেমন যেন জ্বলে উঠল— যেন এই রাস্তাগুলির ভেতরেই তার গানের ভাষা তৈরি হবে।
কিন্তু জীবন সহজ ছিল না। সিডেলাকে দিন-রাত কাজ করতে হতো, ধোপার কাজ, গৃহকর্মীর কাজ, যেটুকু মেলে। খাবার জোটে কষ্টে, কখনো কখনো অর্ধেক পেটেই ঘুমোতে হতো। ববও ছোটবেলা থেকে রোজগারের চাপে পড়ল। সে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শিখল, শহরের কারখানায় গিয়ে লোহার কাঠামো জোড়া লাগাতো। কিন্তু ধোঁয়া আর আগুনের ভিতরে তার মন টিকত না। কাজের ফাঁকেই সে গুনগুন করত নিজের সুর, সহকর্মীরা অবাক হয়ে বলত, “এই ছেলেটার গলায় আগুন আছে।”
ট্রেঞ্চ টাউনেই ববের সঙ্গে আলাপ হলো দুই তরুণের— বানি লিভিংস্টন (পরবর্তীতে বানি ওয়েলার) আর পিটার তোশ। তিনজনেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান, কিন্তু তাদের স্বপ্ন একই— গান দিয়ে বেঁচে থাকা। ট্রেঞ্চ টাউনের উঠোনে বসে তিনজন গিটার নিয়ে রাতভর সুর বাঁধত। তখনকার সঙ্গীতের ধারা ছিল স্কা— দ্রুত ছন্দ, নাচের জন্য উপযুক্ত। তারা প্রথমে সেই ছন্দেই গান করত, কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল অন্যরকম ভাষা— ধীর, গভীর, প্রতিবাদী। যা একদিন পৃথিবী জানবে রেগে নামে।
এই সময়ে ববের সঙ্গে আলাপ হয় স্থানীয় সঙ্গীত প্রশিক্ষক জো হিগস-এর সঙ্গে। তিনি ছিলেন এক ধরনের গুরু, যিনি ট্রেঞ্চ টাউনের ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন, সুরে শৃঙ্খলা আনতেন। জো হিগস ববকে বলেন, “তুমি শুধু গাইবে না, অনুভব করবে। গান মানে বার্তা— এটা মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে।” এই কথাই ববের জীবন বদলে দেয়। সে বুঝতে শুরু করে, তার সঙ্গীত কেবল বিনোদনের জন্য নয়, এটা মানুষের বাঁচার অস্ত্রও হতে পারে।
বব, বানি আর পিটার মিলে তৈরি করল এক ব্যান্ড— প্রথমে নাম ছিল দ্য ওয়েলিং ওয়েলার্স, পরে পরিচিত হলো দ্য ওয়েলার্স নামে। তারা সস্তা গিটার, টিনের ড্রাম দিয়ে রিহার্সাল করত। মাঝে মাঝে স্থানীয় স্টুডিওতে সুযোগ মিলত রেকর্ডিংয়ের। বব প্রথমবার নিজের কণ্ঠ রেকর্ড করল “Judge Not” নামে একটি গান। গানটির কথায় ছিল সরল বার্তা— “অন্যকে বিচার কোরো না, কারণ ঈশ্বরই প্রকৃত বিচারক।”
গানটি তখন বড় হিট হয়নি, কিন্তু ট্রেঞ্চ টাউনের ভেতরে ছড়িয়ে গেল খবর— এক নতুন কণ্ঠ এসেছে, যে সত্য কথা গাইতে জানে। ববের গলা ছিল কাঁচা অথচ বিদ্ধকারী, যেন প্রত্যেক লাইনে ক্ষতবিক্ষত জীবনের ছাপ।
এই সময়ে ববের জীবনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রবেশ করল— রাস্তাফারি আন্দোলন। শহরের কোণে কোণে বসে থাকা বৃদ্ধরা, যারা আফ্রিকার মুক্তির কথা বলত, ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসির পূজা করত, তারা ববকে গভীরভাবে প্রভাবিত করল। তারা বলত, “কালো মানুষের মুক্তি আফ্রিকায়, আমরা সবাই আফ্রিকার সন্তান।” বব তাদের কথা শুনত, মনে মনে আগুন ধরত। তার কাছে রাস্তাফারি হয়ে উঠল শুধু ধর্ম নয়, বরং রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক পরিচয়।
বব চুলে ড্রেডলক রাখতে শুরু করল, গাঁজা ধূমপানকে পবিত্র আচার হিসেবে নিল, আর সঙ্গীতে ঢুকিয়ে দিল আফ্রিকার মুক্তির স্বপ্ন। তার গান তখন আর কেবল প্রেম বা বিনোদনের কথা বলত না, বরং বলত শোষণ, স্বাধীনতা আর সমতার কথা।
কিংস্টনের জীবন যত কঠিন হতো, ততই বব আর ওয়েলার্সের গান তীক্ষ্ণ হতো। তারা গাইত দারিদ্র্যের মধ্যে জন্ম নেওয়া মানুষের আশা নিয়ে, পুলিশের দমনপীড়ন নিয়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস নিয়ে। ছোট ছোট কনসার্টে তারা গান করত, কখনো লোকজন চিৎকার করে নাচত, কখনো চোখ ভিজত কান্নায়।
ববের মা মাঝে মাঝে বলতেন, “নেস্টা, তুমি গান গেয়ে নিজের জীবন চালাবে কীভাবে? কাজ করো, সংসার দেখো।” কিন্তু ববের চোখে তখন আগুন— সে জানত, এই গানের ভেতরেই তার মুক্তি।
ধীরে ধীরে কিংস্টনের বাইরে ছড়াতে লাগল ওয়েলার্সের নাম। ছোট স্টুডিও, স্থানীয় রেডিও, গলির পোস্টার— সর্বত্রই ভেসে উঠতে লাগল সেই ত্রয়ীর গান। তবে সাফল্যের পথে বাধাও কম ছিল না। অনেক প্রযোজক তাদের ঠকাত, টাকা দিত না, রেকর্ডিং আটকে রাখত। তবুও তারা থামেনি।
এই সময়েই ববের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করলেন এক তরুণী— রিটা অ্যান্ডারসন, যিনি পরে হবেন রিটা মার্লে। রিটাও ছিলেন গায়িকা, তার কণ্ঠেও ছিল আগুন। দু’জনের প্রেম গড়ে উঠল সঙ্গীতের মঞ্চে দাঁড়িয়েই। রিটা শুধু সঙ্গী নন, হয়ে উঠলেন ববের অনুপ্রেরণা। তিনি ববকে রাস্তাফারি আন্দোলনের গভীর দর্শনের সঙ্গে পরিচয় করালেন, আফ্রিকান চেতনার ভেতরে প্রবেশ করালেন।
বব তখনও জানত না, তার জীবন একদিন কিংস্টনের সীমানা ছাড়িয়ে সারা দুনিয়ায় পৌঁছে যাবে। তবে গলির ভেতরে যে আগুন জ্বলছে, সেটাই তাকে ঠেলে দিচ্ছিল বড়ো মঞ্চের দিকে।
ট্রেঞ্চ টাউনের ভাঙাচোরা বাড়িগুলো, টিনের চালের নিচে জমে থাকা গরম, রাস্তায় খেলা করা দরিদ্র বাচ্চারা— সবই ববের গানের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। তার সুরে ছিল ক্ষুধার্ত পেটের যন্ত্রণা, কিন্তু তার ছন্দে ছিল নাচের উন্মাদনা। এ এক অদ্ভুত মিশ্রণ— দুঃখ আর আনন্দ একসঙ্গে, যেটা পরবর্তীতে হয়ে উঠল রেগের প্রাণ।
রাতে ঘুমোতে গেলে বব অনেক সময় কল্পনা করত, একদিন হয়তো সে গান গাইবে বিশাল মঞ্চে, হাজার হাজার মানুষ তার সঙ্গে গাইবে— “One Love, One Heart…” কিন্তু তখনও সে শুধু ট্রেঞ্চ টাউনের এক যুবক, যে লড়ছে দারিদ্র্য, বৈষম্য আর সংগ্রামের বিরুদ্ধে।
কিংস্টনের অন্ধকার গলি তাকে শেখাল— বাঁচতে হলে গান গাইতে হবে। আর গান গাইতে হলে সত্য বলতে হবে।
পর্ব ৩ : প্রথম সাফল্য আর রেগের জন্ম
কিংস্টনের বস্তির আঁধারে যে আগুন জ্বলছিল, তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল স্টুডিও আর রেডিওর অন্ধকার ঘরে। ষাটের দশকের শুরুতে জ্যামাইকার সঙ্গীতের রাজত্ব করছিল স্কা— দ্রুত তালে বাজানো নাচের সুর, যা শুনলেই মানুষ পা মেলাত। কিন্তু বব মার্লে আর তার সঙ্গী বানি লিভিংস্টন, পিটার তোশ অনুভব করছিলেন, শুধু নাচের জন্য গান গাওয়া যথেষ্ট নয়। তাদের দরকার ছিল এমন এক ভাষা, যা মানুষের দুঃখ-প্রতিবাদ বহন করতে পারবে।
তাদের ব্যান্ড তখনও ছোট্ট— দ্য ওয়েলিং ওয়েলার্স। তারা বিভিন্ন জায়গায় ছোট প্রযোজকদের কাছে রেকর্ড করার চেষ্টা করত। অবশেষে তারা সুযোগ পেল ক্লেমেন্ট “স্যার কক্সসন” ডড নামের এক প্রযোজকের স্টুডিওতে। কিংস্টনের সাউন্ড সিস্টেম কালচারের অন্যতম সম্রাট ছিলেন কক্সসন। তিনি প্রথমে তাদের তেমন গুরুত্ব দেননি, কিন্তু যখন শুনলেন ববের কণ্ঠে সেই আগুন, আর তিনজনের মিলেমিশে তৈরি সুর, তিনি বুঝলেন— এখানে কিছু ভিন্ন আছে।
কক্সসনের লেবেল স্টুডিও ওয়ান থেকে বেরোল তাদের প্রথম বড় গান— “Simmer Down”। গানটির তালে ছিল স্কা, কিন্তু কথায় ছিল একেবারে আলাদা শক্তি। বব গাইছিলেন কিংস্টনের বস্তির তরুণদের উদ্দেশে— হিংসা থামাও, রক্তপাত থামাও, শান্তি আনো। এ ছিল এক ধরনের সামাজিক আহ্বান, যা সেই সময়ের দাঙ্গাপীড়িত কিংস্টনে প্রবলভাবে প্রতিধ্বনিত হলো।
১৯৬৪ সালে গানটি রিলিজ হতেই যেন বিস্ফোরণ। “Simmer Down” জ্যামাইকার চার্টে নাম্বার ওয়ান হলো। হঠাৎ করেই ওয়েলার্স হয়ে উঠল দেশের পরিচিত নাম। মানুষ বলল— এই নতুন কণ্ঠ শুধু গান গাইছে না, আমাদের মনের কথা বলছে। বব তখনও তরুণ, কিন্তু তার কণ্ঠে যেন শতাব্দীর অভিজ্ঞতা, যেন প্রতিটি শব্দের পেছনে অজস্র কষ্ট আর আশা জমা।
এই প্রথম বব বুঝল— গান দিয়ে সত্যিই পরিবর্তন আনা যায়। কিন্তু সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে এলো সংগ্রামও। প্রযোজক কক্সসন ডড তাদের টাকা দিতেন খুবই সামান্য। তারা রেকর্ড করত, গান হিট হতো, অথচ পকেটে থাকত না খাবার কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থও। তবুও তারা থামেনি। বব, বানি আর পিটার দিনরাত গান লিখত, সুর বাঁধত।
এই সময়েই ওয়েলার্সের সঙ্গে যুক্ত হলেন আরও দুই কণ্ঠ— জুনিয়র ব্রেইথওয়েট, বেভারলি কেলসো। যদিও পরে তারা দল ছেড়ে যায়, কিন্তু প্রথম দিকের রেকর্ডিংয়ে তাদেরও অবদান ছিল। ওয়েলার্স ধীরে ধীরে হয়ে উঠছিল একদল, যারা শহরের কষ্টের ভেতর থেকে সুর টেনে আনছিল।
একইসঙ্গে ববের জীবনে দৃঢ়ভাবে ঢুকল রাস্তাফারি দর্শন। কিংস্টনের কোণে বসে থাকা রাস্তাফারি প্রবীণরা— যারা আফ্রিকায় প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখত, ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসিকে দেবতার রূপে মানত— তারা ববকে বলত, “আমরা সবাই দাসপ্রথার শৃঙ্খল ভেঙে আসা মানুষ। আমাদের মুক্তি আফ্রিকার সঙ্গে যুক্ত।” বব শুনত, মনে রাখত, আর সুরে সেই বার্তা মিশিয়ে দিত।
চুলে ড্রেডলক গজাতে শুরু করল, গানেই প্রবেশ করল নতুন গভীরতা। বব অনুভব করল— শুধু প্রেম নয়, শুধু আনন্দ নয়, তার গানের আসল কাজ হলো শোষিত মানুষের মুক্তির ভাষা হওয়া। সে নিজেকে কেবল একজন গায়ক ভাবল না, বরং ভাবল দূত, একজন বার্তাবাহক।
“Simmer Down”-এর সাফল্যের পর ওয়েলার্স একের পর এক গান রেকর্ড করল। কিন্তু সমস্যা হলো, জ্যামাইকার সঙ্গীত ব্যবসা তখনও বিশৃঙ্খল, স্বচ্ছতা ছিল না। প্রযোজকরা প্রায়শই শিল্পীদের ঠকাত। ফলে বব অনেক সময় ক্ষুব্ধ হতো— তার গান চার্টের শীর্ষে, কিন্তু ঘরে খাবার নেই। তবুও সে হাল ছাড়েনি।
এই সময়ে ববের সম্পর্ক আরও গভীর হলো রিটা অ্যান্ডারসনের সঙ্গে। ১৯৬৬ সালে তারা বিয়ে করলেন। রিটা শুধু স্ত্রী নন, ববের অন্যতম শক্তি হয়ে উঠলেন। তিনি গানেও সঙ্গ দিলেন, পরে I-Threes নামক ব্যাকআপ ভোকাল গ্রুপে যোগ দিয়ে ওয়েলার্সের গানকে সমৃদ্ধ করলেন।
১৯৬৬ সালের আরেকটি ঘটনা ববের জীবন পাল্টে দিল। সেই বছর তিনি প্রথমবার আমেরিকায় গেলেন— ডেলাওয়ারে, যেখানে তার মা সিডেলা তখন কাজ করছিলেন। বব কিছুদিন কারখানায় চাকরি করলেন, কঠিন শ্রমজীবনের স্বাদ পেলেন। কিন্তু সেখানে থাকতেই তিনি খবর পেলেন— ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসি জ্যামাইকা সফরে আসছেন। এটি রাস্তাফারিয়ানদের কাছে ঈশ্বরের আবির্ভাবের মতো। বব দ্রুত দেশে ফিরে এলেন।
হাইলে সেলাসির সফর জ্যামাইকার রাস্তায় ঢেউ তুলল। হাজার হাজার মানুষ তাকে অভ্যর্থনা জানাল, আর রাস্তাফারি দর্শন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ববের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হলো— তার সঙ্গীত কেবল সঙ্গীত নয়, এটা আধ্যাত্মিক বার্তা, এক ধরনের মুক্তির পথ।
এই সময় থেকে ওয়েলার্স ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হলো। তাদের গান আর দ্রুত স্কা নয়, বরং ধীর, গভীর বেস, গিটার, ড্রামের ছন্দে নতুন এক সুর তৈরি হলো— যা পরে সারা দুনিয়া জানবে রেগে নামে। এই নতুন সুরে ছিল কষ্টের অনুরণন, কিন্তু একই সঙ্গে ছিল আশা আর প্রতিরোধের শক্তি।
তাদের লেখা গানগুলোতে উঠে আসতে লাগল জীবনের তীব্র অভিজ্ঞতা— দারিদ্র্য, পুলিশি দমন, প্রেম, আধ্যাত্মিকতা। ওয়েলার্স যখন এই নতুন রেগে ধারা নিয়ে গান গাইতে শুরু করল, প্রথমে সবাই অভ্যস্ত হতে পারল না। অনেকেই বলল, এতো ধীর, এতো বিষণ্ণ! কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ বুঝতে শুরু করল, এই সুরের ভেতরে রয়েছে আত্মার আগুন।
বব মার্লে সেই আগুনকে নিজের কণ্ঠে বেঁধে দিলেন। তার কণ্ঠে রেগে হয়ে উঠল শুধু সঙ্গীত নয়, বরং প্রতিবাদ, প্রেম আর মুক্তির ভাষা।
ষাটের দশকের শেষে ওয়েলার্স ছোট ছোট সাফল্য পেলেও বড় সুযোগ আসছিল না। তবুও তারা অবিচল রইল। কিংস্টনের রাস্তায়, গলিতে, ক্লাবে তারা গান গাইত। তাদের চারপাশে ভিড় করত তরুণরা, যারা নিজের জীবনকে খুঁজে পেত এই গানের মধ্যে।
বব প্রায়ই বলতেন, “আমার গান টাকা বানানোর জন্য নয়। আমার গান মানুষের মুক্তির জন্য।”
এই বিশ্বাসই তাকে আলাদা করল অন্য সঙ্গীতশিল্পীদের থেকে।
রেগের জন্মের এই সময়টি সহজ ছিল না, কিন্তু এখানেই তৈরি হচ্ছিল সেই আগুন, যা পরে ক্যারিবিয়ান সাগর পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা— সর্বত্র পৌঁছাবে।
বব তখনও আন্তর্জাতিক তারকা নন। তিনি ছিলেন কিংস্টনের এক তরুণ, যার হাতে গিটার, চোখে স্বপ্ন আর গলায় এমন এক সুর, যা মানুষের হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়।
পর্ব ৪ : লন্ডনের দরজা খুলে গেল
ষাটের দশকের শেষভাগ। কিংস্টনের গলিঘুঁজি আর ছোট স্টুডিওগুলোর ভেতর বব মার্লে ও তার সঙ্গী বানি ওয়েলার আর পিটার তোশ ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছে এক নতুন ধারা—রেগে। কিন্তু সেই সুর তখনও সীমাবদ্ধ জ্যামাইকাতেই। স্থানীয় রেডিওতে বাজত, গলির মানুষ নাচত, প্রতিবাদের স্লোগান তুলত, কিন্তু আন্তর্জাতিক সঙ্গীত দুনিয়া তখনও জানত না—এই ছোট্ট দ্বীপের ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক বিপ্লব।
ওয়েলার্সের গান বারবার স্থানীয় চার্টে উঠলেও টাকার সঙ্কট কাটছিল না। প্রযোজকরা ঠকাত, গান বাজানোর টাকা দিত না, আর্থিক অনিশ্চয়তার মধ্যে একের পর এক দিন কেটে যেত। বব তখনও ওয়েল্ডিং বা অন্য ছোট কাজ করে সংসার চালাত, কিন্তু তার মন টানত কেবল গিটার আর সুরের দিকে। এই টানই তাকে ঠেলে দিল বড় সুযোগের দিকে।
১৯৭১ সালে, এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় এলো ওয়েলার্সের জীবনে। তখন লন্ডনে অবস্থান করছিলেন ক্রিস ব্ল্যাকওয়েল, যিনি আইল্যান্ড রেকর্ডস নামক এক লেবেলের প্রতিষ্ঠাতা। ব্ল্যাকওয়েল ছিলেন এক ধরণের দৃষ্টিসম্পন্ন প্রযোজক— তিনি বিশ্বাস করতেন জ্যামাইকার সুরের মধ্যে আছে এক অদ্ভুত শক্তি, যা বিশ্বকে ছুঁতে পারে। তিনি আগেই মিলে মিক্স করে কিছু জ্যামাইকান স্কা আর রকস্টেডি গান প্রকাশ করেছিলেন ইউরোপে, কিন্তু রেগের প্রকৃত শক্তি তিনি এখনও খুঁজছিলেন।
ঠিক সেই সময় ওয়েলার্স লন্ডনে আসে, আরও সুযোগের আশায়। তারা তখন কার্যত ভাঙা অবস্থায়— হাতে টাকা নেই, খাবারের অভাব, ছোট ছোট হল-এ পারফর্ম করে দিন গুজরান করছে। তাদের এক সাধারণ পরিচিত মানুষ ব্ল্যাকওয়েলের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিল। ব্ল্যাকওয়েল শুনলেন তাদের ডেমো, আর বিস্মিত হলেন। তিনি বললেন, “তোমাদের মধ্যে আমি রক ব্যান্ডের শক্তি দেখছি, কিন্তু ক্যারিবিয়ান আত্মা দিয়ে।”
ব্ল্যাকওয়েল ওয়েলার্সকে বিশ্বাস করলেন। তিনি তাদের অগ্রিম টাকা দিলেন— যা তাদের কাছে তখন অমূল্য। সেই টাকায় তারা স্টুডিওতে ঢুকে তৈরি করল এক অ্যালবাম, যা বদলে দেবে তাদের ভাগ্য।
১৯৭৩ সালে প্রকাশ পেল “Catch a Fire”। এ ছিল ওয়েলার্সের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের অ্যালবাম। কভার ছিল অনন্য— এক সিগারেট লাইটার আকৃতির প্যাকেজিং, যা খুললেই বাজবে গান। আর ভেতরে ছিল ববের বিদ্রোহী কণ্ঠ, পিটারের তীক্ষ্ণ গিটার, বানি ওয়েলারের আধ্যাত্মিক ছোঁয়া।
গানগুলির মধ্যে ছিল “Concrete Jungle”, “Slave Driver”— প্রতিটি শব্দে ছিল শোষণের বিরুদ্ধে চিৎকার, দাসত্বের ইতিহাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। লন্ডনের শীতল রাতের ক্লাবগুলোতে প্রথমবার রেগে বাজতে শুরু করল, আর ইউরোপীয় তরুণেরা অবাক হয়ে শুনল— ছোট্ট দ্বীপের সুরেও আছে বিপ্লবের আগুন।
“Catch a Fire” অ্যালবাম যদিও প্রথমেই বিশাল ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি, কিন্তু সমালোচকরা দৃষ্টি দিল। তারা বলল— এটা নতুন, এটা সত্য। আমেরিকা আর ইউরোপের সঙ্গীত সাংবাদিকরা লিখল, “এক নতুন কণ্ঠ এসেছে, নাম বব মার্লে।”
এই অ্যালবামের মাধ্যমেই ওয়েলার্স প্রথমবার আন্তর্জাতিক ট্যুরে বেরোল। ইংল্যান্ড, আমেরিকা— ছোট ছোট মঞ্চে তারা বাজাতে শুরু করল। দর্শক প্রথমে অপরিচিত সুর শুনে দ্বিধায় থাকলেও ধীরে ধীরে মেতে উঠত। বব মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন চোখ বন্ধ করে গাইতেন, যেন পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা তার গলার মধ্যে জমা হতো, তখন মানুষ বুঝত— এ শুধু গান নয়, এ এক অভিজ্ঞতা।
কিন্তু সাফল্যের পাশাপাশি চাপও বেড়ে গেল। আন্তর্জাতিক ট্যুরের কঠিন জীবন, আর্থিক অনিশ্চয়তা, ম্যানেজমেন্টের টানাপোড়েন— সবকিছু ওয়েলার্সের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করল। বানি ওয়েলার ট্যুরে যেতে চাইতেন না, তিনি চেয়েছিলেন জ্যামাইকায় থেকে রাস্তাফারি জীবনে মনোযোগ দিতে। পিটার তোশেরও নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল— তিনি আরও রাজনৈতিকভাবে সরাসরি গান করতে চাইতেন। ফলে দলের মধ্যে ফাটল দেখা দিল।
তবুও বব এগোতে থাকলেন। ১৯৭৩ সালেই তারা দ্বিতীয় অ্যালবাম “Burnin’” প্রকাশ করল। এই অ্যালবামেই ছিল সেই গান, যা ইতিহাসে অমর হয়ে গেল— “Get Up, Stand Up”। পিটার তোশ আর বব একসঙ্গে লিখেছিলেন এই গান। কথায় ছিল স্পষ্ট বার্তা— উঠে দাঁড়াও, তোমার অধিকার দাবি করো, বসে থেকো না। এ গান পরবর্তীতে বিশ্বের প্রতিটি আন্দোলনের সঙ্গীত হয়ে উঠল।
আরেকটি গান ছিল “I Shot the Sheriff”। গানটিতে বব গাইলেন প্রতীকী ভাষায়— তিনি শেরিফকে গুলি করেছেন, কারণ শেরিফ অন্যায় করছিল। যদিও গানটি রূপক ছিল, তবুও আমেরিকায় বিতর্ক ছড়াল। কয়েক বছর পরে এরিক ক্ল্যাপটন যখন গানটি কাভার করলেন, তখন তা হিট হয়ে গেল পশ্চিমে, আর এর ফলে বব মার্লের নাম আরও পরিচিত হয়ে উঠল।
“Burnin’” অ্যালবাম ববকে প্রতিষ্ঠিত করল এমন এক কণ্ঠ হিসেবে, যে ভয় পায় না সত্য বলায়। যদিও এই সময়েই ওয়েলার্স ভেঙে যেতে শুরু করে। বানি ওয়েলার আর পিটার তোশ দু’জনেই আলাদা পথে গেলেন। বব তখন একাই দাঁড়ালেন দলের কেন্দ্রে। Bob Marley and the Wailers নামেই দল নতুনভাবে যাত্রা করল, সঙ্গে যুক্ত হলেন ব্যাকআপ ভোকাল গ্রুপ I-Threes— রিটা মার্লে, মার্সিয়া গ্রিফিথস আর জুডি মওয়াট। এই নারীকণ্ঠ ববের গানে নতুন মাত্রা যোগ করল।
লন্ডনের দরজা খুলে গিয়েছিল, কিন্তু সামনে অপেক্ষা করছিল আরও বড় ঝড়। বব তখন বুঝে গিয়েছিলেন— তার সঙ্গীত শুধু বিনোদন নয়, বরং অস্ত্র। তিনি গাইবেন নিপীড়িত মানুষের হয়ে, আর এই গান ছড়িয়ে যাবে আফ্রিকা থেকে আমেরিকা, ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত।
ওয়েলার্সের সুর তখন ধীরে ধীরে বিশ্বমঞ্চে উঠছে। কিন্তু বব মার্লের কাছে সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল একটাই কথা— সত্য আর স্বাধীনতা।
পর্ব ৫ : ন্যাটিটি ড্রেড আর বিশ্বমঞ্চের ডাক
১৯৭৪ সালে ওয়েলার্স কার্যত ভেঙে গিয়েছিল। পিটার তোশ আর বানি ওয়েলার নিজেদের পথ বেছে নিলেন। কিন্তু বব থামলেন না। তিনি জানতেন— তার কণ্ঠে এখনও পৃথিবীর সামনে অনেক কিছু বলার আছে। তাই নতুনভাবে দল সাজালেন— Bob Marley and the Wailers। এবার তাঁর পাশে ছিল I-Threes— রিটা মার্লে, মার্সিয়া গ্রিফিথস, আর জুডি মওয়াটের মায়াময় কণ্ঠ। পুরুষালি আগুনের সঙ্গে নারীকণ্ঠের আধ্যাত্মিকতা মিশে তৈরি হলো এক নতুন সাউন্ড, যা শোনামাত্র মনে হলো— এ কণ্ঠ কেবল জ্যামাইকার নয়, সমগ্র বিশ্বের।
এই নতুন রূপেই বেরোল তাদের অ্যালবাম “Natty Dread” (১৯৭৪)। এই অ্যালবামে প্রথমবার বব মার্লে স্পষ্টভাবে সামনে এলেন নেতা হিসেবে। গানগুলির মধ্যে ছিল “Lively Up Yourself”— প্রাণবন্ত ছন্দ, যা মানুষকে নাচিয়ে তুলল। কিন্তু সবচেয়ে বড় গান ছিল “No Woman, No Cry”। কিংস্টনের ট্রেঞ্চ টাউনের দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হওয়া বব লিখলেন— কেঁদো না, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। গানটির প্রতিটি লাইনে ছিল আশা, প্রতিটি সুরে ছিল সান্ত্বনা।
“No Woman, No Cry” প্রথমে তেমন ব্যবসায়িক হিট হয়নি, কিন্তু লন্ডনের লাইভ কনসার্টে যখন বব এই গান গাইলেন, হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে কণ্ঠ মেলাল। সেই মুহূর্তে গানটি হয়ে উঠল চিরন্তন। এটি পরবর্তীতে গরিব মানুষের সান্ত্বনার সঙ্গীত হয়ে যায়— যেন কষ্টের মাঝেও আলো আছে।
“Natty Dread” অ্যালবাম সমালোচকদের চোখে ববকে প্রতিষ্ঠিত করল বিশ্বমানের শিল্পী হিসেবে। Rolling Stone-এর মতো পত্রিকায় লেখা হলো— “এই কণ্ঠ আমাদের সময়ের প্রকৃত কণ্ঠস্বর।”
পরের বছর, ১৯৭৫ সালে, বব লন্ডনের Lyceum Theatre-এ একটি কনসার্ট করলেন। কনসার্টটি রেকর্ড করা হলো এবং প্রকাশ পেল লাইভ অ্যালবাম “Live!”। এখানেই জন্ম নিল সেই গান, যা বব মার্লেকে বিশ্বজুড়ে চিরন্তন খ্যাতি দিল— “No Woman, No Cry (Live)”। দর্শকদের একসঙ্গে গাওয়ার সেই আবহ, ববের চোখ বন্ধ করে গিটার বাজানোর মুহূর্ত— এই রেকর্ড পৃথিবীর কোটি কোটি শ্রোতার হৃদয় কাঁপিয়ে দিল।
এবার বব আর কেবল জ্যামাইকার নায়ক নন, তিনি আন্তর্জাতিক তারকা। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা— সর্বত্র তাঁর নাম উচ্চারিত হতে লাগল।
১৯৭৬ সালে বেরোল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যালবাম— “Rastaman Vibration”। এটি ছিল প্রথম বারের মতো মার্কিন চার্টে টপ ১০-এ ওঠা রেগে অ্যালবাম। গানগুলির মধ্যে ছিল “War”— যা ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসির বক্তৃতা থেকে নেওয়া। গানটির কথায় ছিল— যতদিন না মানুষ মানুষকে সমানভাবে দেখে, যতদিন না ত্বকের রঙ আর জাতির ভেদাভেদ মুছে যায়, ততদিন শান্তি আসবে না।
“War” শোনামাত্রই মানুষ বুঝল— বব মার্লে কেবল গায়ক নন, তিনি রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর। তাঁর গান এখন প্রতিবাদ, সমতার দাবি, ন্যায়ের শপথ।
এই সময়ে জ্যামাইকা রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভুগছিল। দুই বড় দল— People’s National Party আর Jamaica Labour Party— সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছিল। রাস্তায় গুলি চলছিল, মানুষ খুন হচ্ছিল। এই অস্থিরতার মধ্যে বব মার্লেকে দেখা হচ্ছিল সম্ভাব্য শান্তিদূত হিসেবে। তাঁর গান মানুষকে একত্রিত করছিল।
জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী মাইকেল ম্যানলি চাইলেন, বব একটি কনসার্টে গান গাইবেন, যাতে সহিংসতা থামে। সেই কনসার্টের নাম দেওয়া হলো “Smile Jamaica”। বব রাজি হলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন— সঙ্গীত দিয়ে রাজনীতি নয়, মানুষের মন শান্ত করা যায়।
কিন্তু ঠিক কনসার্টের দুই দিন আগে ভয়াবহ ঘটনা ঘটল। ১৯৭৬ সালের ৩ ডিসেম্বর, বব মার্লের কিংস্টনের বাড়িতে বন্দুকধারীরা হামলা চালাল। গুলিতে আহত হলেন বব, তাঁর স্ত্রী রিটা, আর ম্যানেজার ডন টেইলর। ববের হাতে গুলি লাগল, কিন্তু অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে গেলেন। সবাই ভেবেছিল তিনি কনসার্ট বাতিল করবেন।
কিন্তু দুই দিন পরই, ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতে, রক্তমাখা পোশাকে তিনি মঞ্চে উঠলেন। হাজার হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন— “যারা এই দুনিয়াকে খারাপ করতে চেষ্টা করছে, তারা একদিনও ছুটি নেয় না। তাহলে আমরাই বা কেন শান্তির জন্য গান গাওয়া থেকে বিরত থাকব?”
সেই কনসার্ট ইতিহাস হয়ে গেল। গুলি খাওয়ার পরও গান গেয়ে তিনি প্রমাণ করলেন— সঙ্গীত তাঁর কাছে অস্ত্র, যা দিয়ে তিনি শান্তির জন্য লড়বেন।
এই ঘটনাই বব মার্লেকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেল। তিনি কেবল শিল্পী নন, হয়ে উঠলেন এক প্রতীক। মানুষ তাঁকে দেখল সাহসের প্রতিমূর্তি হিসেবে।
কিন্তু রাজনৈতিক হিংসা থেকে দূরে থাকতে বব সিদ্ধান্ত নিলেন— তিনি জ্যামাইকা ছেড়ে যাবেন কিছু সময়ের জন্য। তিনি চলে গেলেন লন্ডনে। এই নির্বাসনকালীন সময়ে তিনি তৈরি করলেন তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অ্যালবামগুলির একটি— “Exodus” (১৯৭৭)।
“Exodus”-এর গানগুলিতে ছিল আধ্যাত্মিকতা, প্রেম, প্রতিবাদ, সবকিছুর মিলন। “Jamming”, “Three Little Birds”, “One Love/People Get Ready”— প্রতিটি গান হয়ে উঠল কালজয়ী।
কিন্তু সেই গল্প শুরু হবে পরের অধ্যায়ে।
পর্ব ৬ : নির্বাসনের শহরে এক্সোডাস
১৯৭৭ সালের লন্ডন। ঠান্ডা কুয়াশা, রাজনৈতিক মিছিল, নতুন রক আর পাঙ্ক সঙ্গীতের উত্থান— এই পরিবেশেই বব মার্লে আশ্রয় নিলেন, যখন জ্যামাইকা তাঁর জন্য হয়ে উঠেছিল বিপজ্জনক। গুলি খেয়ে তিনি প্রাণে বেঁচেছিলেন, কিন্তু বুঝেছিলেন— দেশভাগ করা রাজনীতির মধ্যে তাঁর উপস্থিতি অনেকের চোখে হুমকি। তাই লন্ডন হয়ে উঠল তাঁর নতুন ঠিকানা।
কিন্তু নির্বাসন মানে ববের জন্য থেমে যাওয়া নয়। বরং এখানেই জন্ম নিল তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে প্রভাবশালী অ্যালবাম— “Exodus”।
অ্যালবামের জন্ম
স্টুডিওতে বসে বব লিখছিলেন এমন সব গান, যেখানে জ্যামাইকার অস্থিরতা, আফ্রিকার মুক্তি, আর ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতা এক হয়ে গেল। “Exodus” নামটির ভেতরেই ছিল গভীর তাৎপর্য— এটি ছিল এক ধরনের প্রস্থান, কিন্তু সেই সঙ্গে মুক্তির ডাকও। গানগুলিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল বাইবেলের মোশির কাহিনি, আর সেই সঙ্গে আফ্রিকান মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
অ্যালবামের প্রথম ভাগ ছিল বেশি রাজনৈতিক— যেমন শিরোনাম গান “Exodus”। এখানে তিনি গাইলেন, “আফ্রিকার দিকে এগিয়ে যাও, ঈশ্বরের জাতি, নিজের শেকড়ের দিকে ফিরে যাও।” এই গান ছিল স্পষ্ট আহ্বান, যেন কালো মানুষকে দাসত্বের ইতিহাস ভুলে না গিয়ে স্বাধীনতার পথে হাঁটতে হবে।
কিন্তু অ্যালবামের দ্বিতীয় ভাগে ছিল আশা, প্রেম আর আনন্দে ভরা গান— “Three Little Birds”, যেখানে তিনি সান্ত্বনা দিলেন, “চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।” এই গান আজও পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের সান্ত্বনার মন্ত্র।
আরেকটি গান, “One Love/People Get Ready”, হয়ে উঠল তাঁর দর্শনের সারাংশ। এতে বব বললেন— ভালোবাসা আর ঐক্যের মধ্যেই মুক্তি। গানের রিদমে ছিল সরলতা, কিন্তু বার্তায় ছিল মহাকাব্যের মতো গভীরতা।
লন্ডনের প্রভাব
লন্ডনের সংস্কৃতি ববকে নতুন রূপ দিল। তখনকার ব্রিটিশ তরুণেরা শুনছিল পাঙ্ক— সেক্স পিস্টলস, দ্য ক্ল্যাশ। বিদ্রোহ ছিল তাদের কেন্দ্রবিন্দু। আশ্চর্যের বিষয়, এই বিদ্রোহী তরুণেরা বব মার্লের গানেও নিজেদের প্রতিবাদ খুঁজে পেল। তারা মুগ্ধ হলো তাঁর সাহসী বার্তায়, তাঁর রেগের গভীর ছন্দে। লন্ডনের কনসার্টগুলোতে দেখা যেত, কালো-সাদা তরুণেরা একসঙ্গে নাচছে, কণ্ঠ মেলাচ্ছে— এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
“Exodus” প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই হইচই ফেলে দিল। ব্রিটিশ চার্টে অ্যালবামটি টানা ৫৬ সপ্তাহ ধরে ছিল। Time ম্যাগাজিন পরে ঘোষণা করল, “Exodus is the best album of the century.”
ব্যক্তিগত পরীক্ষা
কিন্তু এই সময়েই ববের জীবনে নেমে এলো অন্ধকার। ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে ফুটবল খেলতে গিয়ে তাঁর পায়ে আঘাত লাগে। পরীক্ষার পর জানা গেল, সেটা ছিল কেবল আঘাত নয়, বরং melanoma নামের এক মারাত্মক ত্বক ক্যান্সার। ডাক্তাররা বললেন, অবিলম্বে অস্ত্রোপচার দরকার। কিন্তু রাস্তাফারি বিশ্বাসে শরীর কেটে ফেলা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অপরাধ। বব দ্বিধায় পড়লেন। অবশেষে আংশিক অস্ত্রোপচার হলেও রোগ সম্পূর্ণভাবে থামানো গেল না।
তবুও বব থামলেন না। তিনি কনসার্ট চালিয়ে গেলেন, গান লিখতে থাকলেন। তাঁর সহকর্মীরা বিস্মিত হতেন— যে মানুষ এমন অসুস্থ, সে কীভাবে মঞ্চে উঠে আগুনের মতো গান গাইতে পারে? বব নিজে বলতেন, “আমার সময় কম। তাই যতদিন আছি, মানুষের জন্য গান গাইব।”
বিশ্বব্যাপী কনসার্ট
“Exodus” অ্যালবামের গান নিয়ে বব শুরু করলেন ইউরোপীয় ট্যুর। প্রতিটি কনসার্ট ছিল ইতিহাস। লন্ডনের Rainbow Theatre-এ যখন তিনি “Exodus” গাইলেন, পুরো হল একসঙ্গে কণ্ঠ তুলল। আফ্রিকার মুক্তি, ক্যারিবিয়ান আশা, আমেরিকার স্বপ্ন— সব এক হয়ে গেল সেই মঞ্চে।
এই সময়েই ববের গান পৌঁছে গেল আফ্রিকার আন্দোলনকারীদের কানে। জিম্বাবুয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা— যেখানে কালো মানুষরা তখনও দমননীতির শিকার, সেখানকার তরুণেরা বব মার্লের গান গেয়ে প্রতিবাদ করছিল। রেগে হয়ে উঠল নিপীড়িত মানুষের অস্ত্র।
পরিবার আর ভালোবাসা
লন্ডনে থাকার সময়ে ববের ব্যক্তিগত জীবনও জটিল হয়ে উঠল। রিটা মার্লে ছিলেন তাঁর স্ত্রীর আসনে, কিন্তু ববের জীবনে এসেছিলেন আরও বহু নারী, এবং তাঁদের সঙ্গে তাঁর বহু সন্তান হয়েছিল। সমালোচকরা প্রায়ই বলতেন, বব ব্যক্তিগতভাবে অসংযত। কিন্তু তাঁর সন্তানরা, এমনকি রিটারাও পরে স্বীকার করেছেন— ববের কাছে পরিবার মানে ছিল বৃহত্তর ধারণা। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি সন্তানই ঈশ্বরের আশীর্বাদ, আর ভালোবাসা সীমিত নয়।
কিংবদন্তি হয়ে ওঠা
১৯৭৮ সালে বব আবার ফিরে এলেন জ্যামাইকায়। দেশে তখনও রাজনৈতিক সংঘাত। সেই বছর আয়োজিত হলো “One Love Peace Concert”। বব মঞ্চে উঠে গাইলেন “Jamming”। আর গানের মাঝখানে তিনি দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক— প্রধানমন্ত্রী মাইকেল ম্যানলি আর বিরোধী নেতা এডওয়ার্ড সিগাকে হাত ধরে মঞ্চে তুললেন। তাদের হাত একত্রে ধরে দাঁড় করালেন হাজারো মানুষের সামনে।
এ দৃশ্য দেখে গোটা জ্যামাইকা স্তব্ধ হয়ে গেল। বব প্রমাণ করলেন— গান সত্যিই রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষকে এক করতে পারে।
“Exodus” থেকে শুরু করে এই কনসার্ট পর্যন্ত, বব মার্লে তখন আর কেবল গায়ক নন। তিনি হয়ে উঠেছেন এক প্রতীক— স্বাধীনতা, ঐক্য আর আশার প্রতীক।
অ্যালবামের উত্তরাধিকার
“Exodus” কেবল একটি অ্যালবাম নয়, এটি ছিল এক যুগান্তকারী ঘোষণা। এর গানগুলো আজও সমান প্রাসঙ্গিক। “One Love” ইউনিসেফের বিশ্বশান্তির স্লোগান হয়ে গেছে, “Three Little Birds” কোটি মানুষের ব্যক্তিগত সান্ত্বনা, আর “Exodus” রাজনৈতিক আন্দোলনের মন্ত্র।
লন্ডনের সেই নির্বাসন-সময়ে ববের শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু তাঁর সঙ্গীত ছড়িয়ে পড়ছিল আরও দ্রুত, আরও গভীরভাবে। মৃত্যুর ছায়া যত ঘন হচ্ছিল, তাঁর গান তত বেশি অমর হয়ে উঠছিল।
পর্ব ৭ : আফ্রিকার ডাক
লন্ডনে “Exodus” অ্যালবামের সাফল্যের পর বব মার্লে হয়ে উঠলেন আন্তর্জাতিক প্রতীক। তাঁর গান পৌঁছে যাচ্ছিল সীমান্ত পেরিয়ে, তাঁর কণ্ঠে মানুষ খুঁজে পাচ্ছিল মুক্তির মন্ত্র। কিন্তু বব নিজে অনুভব করছিলেন— তাঁর সঙ্গীতের আসল গন্তব্য আফ্রিকা। আফ্রিকাই ছিল রাস্তাফারিদের প্রতিশ্রুত ভূমি, আর আফ্রিকাই ছিল কালো মানুষের মুক্তির প্রতীক।
আফ্রিকার প্রতি টান
ছোটবেলা থেকেই রাস্তাফারি দর্শনে বেড়ে ওঠা বব বিশ্বাস করতেন, আফ্রিকায় প্রত্যাবর্তন মানে আধ্যাত্মিক মুক্তি। তাঁর গান “Exodus” আর “Africa Unite”-এ তিনি এই ডাক স্পষ্ট করেছিলেন। লন্ডনে বসেও তিনি কল্পনা করতেন, আফ্রিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি গাইছেন— হাজার হাজার মানুষ সেই সুরে কণ্ঠ মেলাচ্ছে।
১৯৭৮ সালে “One Love Peace Concert”-এর ঐতিহাসিক মুহূর্তের পর তাঁর খ্যাতি আরও বেড়ে গেল। জ্যামাইকায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দুই নেতাকে মঞ্চে একত্রিত করার সেই দৃশ্য সারা পৃথিবীতে আলোচনার বিষয় হলো। এই খবর পৌঁছাল আফ্রিকাতেও। বহু মুক্তি আন্দোলনের নেতা দেখলেন— বব মার্লে এমন এক কণ্ঠ, যিনি অস্ত্র ছাড়াই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন।
“Survival” – প্রতিরোধের অ্যালবাম
১৯৭৯ সালে বব প্রকাশ করলেন “Survival” অ্যালবাম। এ অ্যালবামকে অনেকে বলেন তাঁর সবচেয়ে রাজনৈতিক কাজ। অ্যালবামের কভারে ছিল ৪৮টি আফ্রিকান দেশের পতাকা। গানগুলিতে ছিল স্পষ্ট ডাক— “Africa Unite”, “Zimbabwe”, “So Much Trouble in the World”।
এই গানগুলির মধ্যে “Zimbabwe” ছিল বিশেষ। তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ রোডেশিয়ায় স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী লড়াই চলছে। বব গাইলেন— “Zimbabwe must be free!”। এই গান হয়ে উঠল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা। জঙ্গলের ভেতর যুদ্ধরত সৈন্যরা রেডিওতে শুনত ববের গান আর শক্তি পেত।
জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা
১৯৮০ সালে অবশেষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটল। রোডেশিয়া স্বাধীন হয়ে নাম নিল জিম্বাবুয়ে। স্বাধীনতার প্রথম উদযাপন অনুষ্ঠান হলো রাজধানী হারারেতে। নতুন সরকারের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ পাঠানো হলো বব মার্লেকে।
বব সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন। তিনি জানতেন, এ শুধু একটি কনসার্ট নয়, বরং ইতিহাসের অংশ। তিনি ব্যান্ড নিয়ে উড়ে গেলেন আফ্রিকায়।
১৯৮০ সালের ১৮ এপ্রিল, জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা দিবসে, হারারে-র স্টেডিয়ামে হাজারো মানুষ জড়ো হলো। ভিড়ের মধ্যে ছিলেন আফ্রিকার নেতারা, স্বাধীনতার যোদ্ধারা, সাধারণ মানুষ। বব মঞ্চে উঠে গাইলেন “Zimbabwe”। গান গাইতে গাইতে তিনি চোখ বন্ধ করলেন, আর মনে হলো যেন তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন পূর্ণ হলো।
কনসার্ট চলাকালীনই বাইরে দাঙ্গা বাধল— টিকিট না পাওয়া মানুষরা ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিল। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়ল, গোলাগুলি হলো। কিন্তু বব মঞ্চ ছেড়ে যাননি। তিনি গান চালিয়ে গেলেন। তাঁর কণ্ঠ ছাপিয়ে গেল বন্দুকের আওয়াজ। সেই দৃশ্য আজও আফ্রিকার ইতিহাসে অমর।
বিশ্ব ভ্রমণ
জিম্বাবুয়ে কনসার্টের পর বব শুরু করলেন তাঁর সবচেয়ে বড় ট্যুর— Uprising Tour। ইউরোপের শহরগুলোতে তিনি গান গাইলেন, প্রতিটি কনসার্টেই হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমাল। তাঁর গান এখন আর শুধু রাস্তাফারি বার্তা নয়, বরং হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক প্রতিবাদের ভাষা।
“Redemption Song” এই সময়ে লেখা হলো। হয়তো এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে গভীর গান। এখানে তিনি কণ্ঠে শুধু গিটার নিয়ে গাইলেন— “Emancipate yourselves from mental slavery, none but ourselves can free our minds.” গানটি ছিল মুক্তির সর্বোচ্চ ডাক, যেখানে তিনি বললেন— সত্যিকারের শৃঙ্খল হলো মনের ভেতরে।
অসুস্থতার ছায়া
কিন্তু এই সময়েই তাঁর শরীর দুর্বল হয়ে আসছিল। পায়ের আঘাত থেকে যে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল, তা ছড়িয়ে পড়ছিল শরীরের অন্য অংশে। ডাক্তাররা সতর্ক করছিলেন, কিন্তু বব ট্যুর চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বলতেন, “আমি যদি থেমে যাই, আমার সময় ফুরিয়ে যাবে। যতদিন পারি, আমি গান গাইব।”
১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে একটি ম্যারাথন কনসার্টে তিনি শেষবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে পারফর্ম করলেন। দর্শকসংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ। মানুষ সেদিন দেখল— বব কণ্ঠে আগুন নিয়েই গাইছেন, কিন্তু তাঁর শরীর ক্লান্ত। কনসার্টের পরই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
পরীক্ষায় জানা গেল— ক্যান্সার মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে ছড়িয়ে গেছে। চিকিৎসকরা তাঁকে বিশ্রামের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু বব এখনও গান ছাড়েননি। তিনি বললেন— “আমার জীবন গানের জন্য। আমি যতদিন শ্বাস নিই, ততদিন গান গাইব।”
আফ্রিকার সঙ্গে আত্মিক বন্ধন
জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা উদযাপন বব মার্লেকে বিশ্বমঞ্চে নতুন মর্যাদা দিল। তিনি এখন আফ্রিকার প্রতীক, ক্যারিবিয়ানের দূত, বিশ্বের কণ্ঠ। আফ্রিকার মানুষ তাঁকে নিজের বলে মনে করল।
এক জিম্বাবুই সৈন্য পরে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমরা যখন বনে লড়াই করছিলাম, বব মার্লের গান আমাদের অস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী ছিল।”
বব নিজেও বলেছিলেন, “আমার গান আফ্রিকার জন্য। কারণ আফ্রিকাই আমাদের জন্মভূমি।”
ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব
এই সময়ে ববের পরিবারজীবনও আলোচনায় আসে। রিটা মার্লে তাঁর পাশে ছিলেন, কিন্তু ববের অন্যান্য সম্পর্ক আর সন্তানদের কারণে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। তবুও পরিবার তাঁকে সমর্থন করেছিল, কারণ তাঁরা জানত— ববের জীবন কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি ছিল এক বিশ্বজনীন যাত্রা।
কিংবদন্তির পথে
১৯৮০ সালের শেষদিকে ইউরোপের Uprising Tour চলাকালীন ভিয়েনা, মিউনিখ, মিলান— সর্বত্র তিনি গান গাইলেন। প্রতিটি শহরে মানুষ তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন যেন একজন নবীকে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি জানতেন— সময় ফুরিয়ে আসছে।
তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি মরব না। আমার সঙ্গীত বেঁচে থাকবে।”
এভাবেই বব মার্লে একদিকে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন, আর অন্যদিকে পৃথিবীর কোটি মানুষের জন্য আশা জাগাচ্ছিলেন। তাঁর গান হয়ে উঠছিল আত্মার মুক্তি, দেহের সীমার বাইরে গিয়ে।
পর্ব ৮ : শেষ লড়াই
১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়। Uprising Tour নিয়ে বব মার্লে আর তাঁর ব্যান্ড ঘুরে বেড়াচ্ছে ইউরোপের শহরগুলোতে। প্রতিটি কনসার্ট যেন ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। বার্লিন, মিউনিখ, মিলান, প্যারিস— সব জায়গায় হাজার হাজার মানুষ জড়ো হচ্ছে, শুধু একবার ববকে শোনার জন্য। তাঁর গান তখন আর কেবল ক্যারিবিয়ান রিদম নয়, বরং বিশ্বমানবতার কণ্ঠস্বর।
Uprising – বিদায়ের অ্যালবাম
এই সময়েই প্রকাশ পেল ওয়েলার্সের অ্যালবাম “Uprising”। অ্যালবামের কভারে দেখা গেল ড্রেডলকধারী এক কৃষ্ণাঙ্গ হাত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সূর্যের দিকে— যেন মুক্তির শপথ নিচ্ছে। গানগুলিতে ছিল আধ্যাত্মিকতার গভীর সুর, আবার একইসঙ্গে ছিল মৃত্যুর ছায়া।
অ্যালবামের অন্যতম গান ছিল “Redemption Song”। গিটার হাতে একা বসে বব গাইলেন— “Emancipate yourselves from mental slavery, none but ourselves can free our minds.” এ গান যেন তাঁর জীবনদর্শনের সারাংশ। শুধু রাজনীতি নয়, শুধু আফ্রিকার মুক্তি নয়— এই গান বলল মানুষের অন্তরের মুক্তির কথা। মৃত্যুর আগের ভবিষ্যদ্বাণীর মতো শোনাল তাঁর কণ্ঠ।
আরেকটি গান ছিল “Could You Be Loved”— প্রাণবন্ত, নাচের ছন্দে ভরা। যেন বব বলতে চাইছিলেন— জীবনের সব কষ্টের মাঝেও ভালোবাসা হারিও না। অ্যালবামের প্রতিটি গানেই অনুভূত হচ্ছিল, বব জানেন তাঁর সময় শেষ হয়ে আসছে।
শেষ আমেরিকা সফর
১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে বব মার্লে যুক্তরাষ্ট্রে এলেন ট্যুরের জন্য। নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে দুই রাতের শো হলো। প্রতিটি আসন ভর্তি, মঞ্চে বব এখনও সেই আগুনের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু সহকর্মীরা বুঝছিলেন, তাঁর শরীর ক্লান্ত, চোখে যন্ত্রণার ছাপ।
শো শেষ হওয়ার কয়েকদিন পর বব গিয়েছিলেন সেন্ট্রাল পার্কে দৌড়াতে। হঠাৎ তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। পরীক্ষায় ধরা পড়ল— ক্যান্সার মস্তিষ্ক, ফুসফুস আর যকৃতে ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসকেরা বললেন, খুব বেশি সময় আর বাকি নেই।
কিন্তু বব তখনও গান ছাড়লেন না। পরের কনসার্ট বাতিল করা যায়নি। তিনি পিটসবার্গে গেলেন, ১৯৮০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। সেদিনের কনসার্ট হয়ে উঠল তাঁর জীবনের শেষ পারফরম্যান্স।
পিটসবার্গের স্টেজে দাঁড়িয়ে তিনি “Redemption Song”, “No Woman, No Cry”, “Exodus”— সবই গাইলেন। দর্শকরা বুঝতে পারেনি, এ তাঁর শেষ মঞ্চ। কিন্তু যারা কাছে ছিলেন, তাঁরা দেখেছিলেন— ববের চোখে জল, শরীর কাঁপছে, অথচ গলায় এখনও আগুন।
চিকিৎসার খোঁজে
এরপর বব থেমে গেলেন। ট্যুর বাতিল হলো। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো জার্মানির বিখ্যাত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ড. জোসেফ ইসেলসের কাছে। সেখানে তিনি অদ্ভুত ধরনের চিকিৎসা পেলেন— খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, ভেষজ ওষুধ, রোদে বসা। কিছুটা সময়ের জন্য ববের শরীর ভালোও লাগল, কিন্তু রোগ থামেনি।
এই সময় ববের মনোযোগ ছিল আধ্যাত্মিকতায়। তিনি আরও গভীরভাবে রাস্তাফারি দর্শনে ডুবে গেলেন। বাইবেল পড়তেন, গিটার বাজাতেন, আর বন্ধুদের বলতেন— “মৃত্যু মানে শেষ নয়, মৃত্যু মানে যাত্রা।”
মায়ের কাছে ফেরা
১৯৮১ সালের শুরুতে বব বুঝলেন, তিনি আর বাঁচবেন না। তিনি চাইলেন মায়ের কাছে যেতে। সিডেলা বুকার তখন মায়ামি, ফ্লোরিডায় থাকতেন। কিন্তু জার্মানি থেকে সরাসরি সেখানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ববকে বিমানে করে আনা হলো নিউ ইয়র্ক, তারপর মায়ামির পথে। কিন্তু তাঁর শরীর ভেঙে পড়ছিল দ্রুত।
১৯৮১ সালের মে মাসে মায়ামির এক হাসপাতালে ভর্তি করা হলো তাঁকে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৬। সারা পৃথিবী তখন তাঁর গানের আলোয় ভেসে যাচ্ছে, অথচ তিনি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি।
শেষ দিন
১৯৮১ সালের ১১ মে, ভোরের আলো ফুটবার আগে, বব মার্লে শেষ নিশ্বাস ফেললেন। তাঁর শেষ কথাগুলি ছিল ছেলেকে উদ্দেশ্য করে— “Money can’t buy life.” (টাকা দিয়ে জীবন কেনা যায় না।)
সেই মুহূর্তে সারা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল। জ্যামাইকার ছোট্ট দ্বীপ থেকে উঠে আসা এক যুবক, যিনি গান দিয়ে মানুষের মুক্তি আর ভালোবাসার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তিনি চলে গেলেন।
রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টি
বব মার্লেকে জ্যামাইকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হলো। তাঁর কফিনে রাখা হয়েছিল গিটার, বাইবেল আর একটুকরো গাঁজা— যা তাঁর জীবনের প্রতীক। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এলো তাঁকে বিদায় জানাতে। প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ মানুষ— সবার চোখে জল।
তাঁকে সমাহিত করা হলো জন্মভূমি নাইন মাইলে, সেই পাহাড়ি গ্রামে, যেখানে তিনি প্রথমবার গিটার হাতে গান ধরেছিলেন।
উত্তরাধিকার
বব মার্লের মৃত্যুর পর তাঁর গান আরও ছড়িয়ে পড়ল। Legend নামে একটি সংকলন অ্যালবাম প্রকাশিত হলো ১৯৮৪ সালে, যা আজও বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক বিক্রিত অ্যালবাম। “One Love”, “Buffalo Soldier”, “Redemption Song”— এগুলো হয়ে উঠল চিরন্তন।
আজও পৃথিবীর কোনো প্রান্তে যখন মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, বা ভালোবাসার বার্তা ছড়ায়, বব মার্লের গান সেখানেই বাজে। তাঁর মুখ, তাঁর ড্রেডলক, তাঁর কণ্ঠ হয়ে উঠেছে মুক্তির প্রতীক।
অমর বার্তা
বব একবার বলেছিলেন— “My music will go on forever. Maybe it’s a foolish thing to say, but when me know facts me can say facts. My music will go on forever.”
এবং সত্যিই, তাঁর গান আজও কোটি মানুষের মনে বেঁচে আছে। তাঁর জীবন হয়তো ৩৬ বছরেই শেষ, কিন্তু তাঁর আত্মা আজও সুরের ভেতর অমর।
পর্ব ৯ : কিংবদন্তির পর
১৯৮১ সালের ১১ মে, মায়ামির এক হাসপাতালে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে বব মার্লের মৃত্যু হলো। খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেল। জ্যামাইকার ছোট্ট গ্রাম নাইন মাইল থেকে উঠে আসা এক দরিদ্র ছেলের জীবন শেষ হলো, কিন্তু তাঁর গান তখনই শুরু করল এক অনন্ত যাত্রা।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিদায়
ববের মরদেহ আনা হলো জ্যামাইকায়। তাঁকে দেওয়া হলো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা— যা এর আগে খুব কম শিল্পী পেয়েছিলেন। রাজধানী কিংস্টনের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ল, কেউ কাঁদছিল, কেউ আবার তাঁর গান গাইছিল। সেই বিদায়ের মিছিল যেন পরিণত হয়েছিল এক বিশাল কনসার্টে।
২১ মে, তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হলো। গির্জার ভিতরে রাখা হলো তাঁর কফিন— তাতে ছিল বাইবেল, এক গিটার, আর একটুকরো গাঁজা। কারণ এগুলোই ছিল তাঁর জীবনের তিনটি প্রতীক— আধ্যাত্মিকতা, সঙ্গীত, আর রাস্তাফারি বিশ্বাস। তারপর তাঁকে সমাহিত করা হলো জন্মভূমি নাইন মাইলে। ছোট্ট সেই পাহাড়ি গ্রামেই তিনি আবার ফিরে গেলেন, যেখানে একসময় প্রথম গিটার হাতে স্বপ্ন দেখেছিলেন।
রিটা মার্লে ও পরিবার
ববের মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব নিলেন রিটা মার্লে। তিনি শুধু স্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন ববের ব্যান্ড I-Threes-এর গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠশিল্পী। এখন তাঁর হাতে এল পরিবারের দায়িত্ব, আর উত্তরাধিকার রক্ষার লড়াই।
রিটা নিজের সঙ্গীত ক্যারিয়ারও চালিয়ে গেলেন, আবার একইসঙ্গে মার্লে পরিবারের বাকি সন্তানদের মানুষ করার ভার নিলেন। ববের মোট সন্তান ছিল এগারো জন (আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত), যদিও তাঁর আরও কয়েকজন সন্তান ছিল বিভিন্ন সম্পর্কে। রিটা সবকিছুকেই গ্রহণ করলেন। তাঁর কাছে পরিবার মানে ছিল বিস্তৃত— যেমন বব বিশ্বাস করতেন।
সন্তানেরা
বব মার্লের সন্তানরা পরবর্তীকালে বিশ্বসঙ্গীতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন।
- জিগি মার্লে— ববের জ্যেষ্ঠ ছেলে। তিনি বাবার মতোই গান ধরলেন, Ziggy Marley and the Melody Makers নামের ব্যান্ড তৈরি করলেন। নব্বইয়ের দশকে তাঁদের গান আন্তর্জাতিক হিট হলো, বিশেষ করে “Tomorrow People”।
 - স্টিফেন মার্লে— সুরকার ও গায়ক, বাবার গানের অনেক নতুন সংস্করণ তিনি করেছেন।
 - ডেমিয়ান মার্লে (Junior Gong)— রেগে ও হিপহপ মিলিয়ে তিনি নতুন ধারার সঙ্গীত তৈরি করলেন। তাঁর গান “Welcome to Jamrock” বিশাল জনপ্রিয় হলো।
 - কাই-মানি, জুলিয়ান, সেডেলা— প্রত্যেকেই সঙ্গীত, অভিনয় বা ব্যবসায় নিজেদের আলাদা জায়গা করে নিলেন।
 
এভাবে মার্লে পরিবার হয়ে উঠল এক সঙ্গীত সাম্রাজ্য। তাঁরা শুধু বাবার গান গাইলেন না, বরং নতুন প্রজন্মের জন্য রেগেকে নতুন রূপে উপস্থাপন করলেন।
Legend – উত্তরাধিকার
১৯৮৪ সালে প্রকাশ পেল একটি সংকলন অ্যালবাম— “Legend”। এতে রাখা হলো বব মার্লের সেরা গানগুলো: “One Love”, “No Woman, No Cry”, “Exodus”, “Could You Be Loved”, “Redemption Song” ইত্যাদি।
অ্যালবামটি দ্রুত বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক বিক্রিত অ্যালবামে পরিণত হলো। আজ পর্যন্ত “Legend” বিক্রি হয়েছে ২৫ কোটিরও বেশি কপি। এখনো পশ্চিমে যে কেউ রেগে শব্দটি শুনলেই প্রথমে মনে করে বব মার্লেকে।
“Legend” প্রমাণ করল— বব মার্লের মৃত্যু তাঁর গানের মৃত্যু নয়। বরং মৃত্যু তাঁকে অমর করে দিল।
রেগের প্রসার
আশির দশকের পর রেগে ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে। আফ্রিকায়, ল্যাটিন আমেরিকায়, এমনকি এশিয়ার দেশগুলোতেও রেগে প্রভাব বিস্তার করল। ভারতেও নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিটের ক্যাসেট দোকানে বা মুম্বাইয়ের রেকর্ড শপে বব মার্লের গান বাজতে শোনা যেত।
ববের গান হয়ে উঠল প্রতিবাদের সঙ্গীত, আবার একইসঙ্গে আনন্দেরও। একদিকে “Get Up, Stand Up” মিছিলের কণ্ঠস্বর, অন্যদিকে “Three Little Birds” শিশুদের ঘুমপাড়ানি গান।
ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য
বব মার্লে মৃত্যুর পরও হয়ে উঠলেন এক ব্র্যান্ড। তাঁর নামে বিক্রি হলো পোশাক, পোস্টার, কফি, এমনকি হেডফোনও। সমালোচকেরা বললেন, “এ যেন ববের বিপ্লবকে পণ্য বানানো।” কিন্তু মার্লে পরিবার দাবি করল, এতে তাঁর বার্তাই ছড়িয়ে পড়ছে।
তবুও, এক সত্য অস্বীকার করা যায় না— ববের মুখ আজও পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ছাপানো ছবিগুলির একটি। তাঁর ড্রেডলক আর হাসি হয়ে উঠেছে বিদ্রোহী সংস্কৃতির প্রতীক।
বিশ্বস্বীকৃতি
বব মার্লের নাম যুক্ত হলো নানা স্বীকৃতিতে। ১৯৯৪ সালে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের Rock and Roll Hall of Fame-এ অন্তর্ভুক্ত করা হলো। জাতিসংঘ তাঁকে শান্তির দূত হিসেবে ঘোষণা করল। তাঁর “One Love” গানকে বিবিসি ঘোষণা করল শতাব্দীর সেরা গান।
২০০১ সালে বব মার্লে মরণোত্তর Grammy Lifetime Achievement Award পেলেন। জ্যামাইকার মুদ্রাতেও তাঁর মুখ ছাপা হলো।
সমালোচনা ও বিতর্ক
তবে বব মার্লের উত্তরাধিকার শুধু প্রশংসাতেই ভরা নয়। অনেক সমালোচক বললেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল জটিল— একাধিক নারী, বহু সন্তান, কখনো কখনো দায়িত্বহীনতা। আবার কেউ কেউ অভিযোগ তুললেন, তাঁর মৃত্যুর পর পরিবার তাঁর নামকে অতিরিক্ত বাণিজ্যিক করে তুলেছে।
কিন্তু এসবের মাঝেও একটি সত্য স্পষ্ট— তাঁর গান মানুষকে এখনও এক করে, এখনও আশা দেয়।
ববের দর্শন
ববের দর্শন ছিল সরল— ভালোবাসা, স্বাধীনতা, ঐক্য। তিনি বলতেন,
“One good thing about music, when it hits you, you feel no pain.”
আরও বলেছিলেন,
“My music fights against the system that teaches to live and die.”
এই দর্শনই তাঁকে আলাদা করেছে। তিনি কেবল গায়ক নন, তিনি ছিলেন দার্শনিক, তিনি ছিলেন নবীর মতো।
উত্তরাধিকারী নতুন প্রজন্ম
আজকের দিনে ডেমিয়ান মার্লে বা জিগি মার্লে যখন গান গায়, তখন মনে হয় বব আবার ফিরে এসেছেন। তাদের কণ্ঠে শোনা যায় বাবার আগুন, আবার নতুন যুগের ছোঁয়াও।
আর শুধু রেগেই নয়, হিপহপ, পপ, রক— সর্বত্র বব মার্লের প্রভাব ছড়িয়ে আছে। লরেন হিল, স্নুপ ডগ, উশার থেকে শুরু করে এড শিরান পর্যন্ত বহু শিল্পী তাঁকে প্রেরণা হিসেবে মেনে চলেছেন।
অমরত্ব
বব মার্লের মৃত্যু হয়েছিল তরুণ বয়সে, কিন্তু তাঁর গান তাঁকে অমর করেছে। আজও ক্যারিবিয়ান সৈকতে যখন সূর্য ডোবে, রাস্তায় বাজে তাঁর গান। আবার লন্ডনের বিক্ষোভে বা আফ্রিকার মিছিলে শোনা যায় তাঁর কণ্ঠ।
তিনি হয়তো চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর বার্তা থেকে গেছে—
“One Love, One Heart, Let’s get together and feel all right.”
পর্ব ১০ : রাস্তাফারি, রাজনীতি আর ববের দর্শন
বব মার্লেকে বোঝার জন্য শুধু তাঁর গান শোনা যথেষ্ট নয়— জানতে হয় তাঁর দর্শন। তিনি কেবল গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক আধ্যাত্মিক যাত্রী। তাঁর জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাস্তাফারি আন্দোলন— একটি ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মতবাদ, যা আফ্রিকার শেকড়ের দিকে ফিরে যাওয়ার ডাক দিত।
রাস্তাফারি আন্দোলন
রাস্তাফারির উৎপত্তি হয়েছিল ১৯৩০-এর দশকে, জ্যামাইকায়। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষরা তখনও উপনিবেশিক দাসত্বের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছিল। তাঁদের মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠলেন ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসি I। রাস্তাফারিরা বিশ্বাস করত, তিনি ঈশ্বরের অবতার, যিনি কালো মানুষকে মুক্তির পথে নিয়ে যাবেন।
রাস্তাফারির মূল বিশ্বাস ছিল— আফ্রিকায় প্রত্যাবর্তন, ভালোবাসা, সমতা, আর আধ্যাত্মিক মুক্তি। ড্রেডলক চুল রাখা, গাঁজা (গাঞ্জা) ব্যবহার করা আচার হিসেবে, আর বাইবেলের বিশেষ কিছু ব্যাখ্যা— এগুলোই ছিল তাঁদের চিহ্ন।
বব মার্লে কৈশোরেই রাস্তাফারির সংস্পর্শে আসেন। প্রথমে তা ছিল কৌতূহল, পরে হয়ে উঠল তাঁর জীবনের অঙ্গ। তাঁর গানের প্রতিটি লাইনে, প্রতিটি ছন্দে মিশে গেল রাস্তাফারির দর্শন।
গান আর ধর্ম
“No Woman, No Cry”-এর মতো সাধারণ জীবনের গান থেকে শুরু করে “Exodus”, “Africa Unite” বা “War”-এর মতো রাজনৈতিক গান— সব জায়গাতেই তিনি রাস্তাফারি দর্শনকে প্রকাশ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, গান ঈশ্বরপ্রদত্ত এক অস্ত্র।
তাঁর ভাষায়—
“Reggae is the people’s music. Reggae is news, it carries a message.”
যখন তিনি মঞ্চে উঠতেন, সেটা কেবল বিনোদনের অনুষ্ঠান হতো না— সেটা হয়ে যেত আধ্যাত্মিক উপাসনা। দর্শকরা গান শুনতে শুনতে যেন এক ধরনের সম্মিলিত প্রার্থনার মধ্যে ঢুকে যেত।
রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক
বব মার্লে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হননি। কিন্তু তাঁর গান রাজনৈতিক হয়ে উঠেছিল। জ্যামাইকার দাঙ্গা থামাতে ১৯৭৬ সালের Smile Jamaica Concert-এ গুলি খেয়েও তিনি মঞ্চে উঠেছিলেন। আবার ১৯৭৮ সালে One Love Peace Concert-এ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নেতার হাত একত্রে ধরে সারা দুনিয়াকে দেখিয়েছিলেন— সঙ্গীত রাজনীতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তিনি বলতেন, “I don’t have politics. My politics is life.”
কিন্তু অনেকেই তাঁকে বিপজ্জনক ভাবতেন। কারণ তাঁর গান মানুষকে জাগিয়ে তুলত, প্রতিরোধ শেখাত। জ্যামাইকার রাজনীতিবিদরা ভয় পেতেন, তাঁর জনপ্রিয়তা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দিতে পারে।
আফ্রিকার ডাক
ববের দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল আফ্রিকা। তিনি বারবার গেয়েছেন আফ্রিকার মুক্তির কথা। তাঁর “War” গানটি সরাসরি হাইলে সেলাসির বক্তৃতা থেকে নেওয়া। তাঁর “Zimbabwe” গান হয়ে উঠেছিল জিম্বাবুয়ের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা।
আফ্রিকার অনেক দেশে তাঁকে স্বপ্নের মতো দেখা হতো। তিনি একবার বলেছিলেন,
“Africa is the root. If Africa is not free, no black man will be free.”
১৯৮০ সালে জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা উদযাপনে তাঁর উপস্থিতি ছিল ইতিহাসের অংশ। বন্দুক আর টিয়ার গ্যাসের মাঝেও তিনি গান গেয়েছিলেন— সেটাই ছিল তাঁর দর্শনের প্রমাণ।
রাস্তাফারির বিশ্বব্যাপী বিস্তার
বব মার্লে রাস্তাফারিকে বিশ্বে পরিচিত করে তুললেন। আগে এটি সীমাবদ্ধ ছিল জ্যামাইকার মধ্যে। ববের গান শুনে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকার তরুণেরা রাস্তাফারি দর্শনে আকৃষ্ট হলো। ড্রেডলক চুল আর “One Love”-এর বার্তা হয়ে উঠল বিশ্বজনীন প্রতীক।
অনেকে রাস্তাফারিকে শুধুই স্টাইল হিসেবে নিলেও, এর গভীরে ছিল আধ্যাত্মিকতা। বব বলতেন, “Rastafari is not a culture, it’s a reality.”
ভালোবাসা আর স্বাধীনতার বার্তা
ববের প্রতিটি গানে ছিল ভালোবাসার ডাক। “One Love” গানটি শুধু প্রেমের গান নয়, বরং মানুষের ঐক্যের গান। তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতি, ধর্ম, ত্বক, শ্রেণি— এসব ভেদাভেদ ভাঙতে পারে কেবল ভালোবাসা।
তাঁর দর্শন ছিল একেবারে সারল্যে ভরা:
- ভালোবাসা দাও।
 - সত্য বলো।
 - স্বাধীনতার জন্য লড়ো।
 - আর কখনো আশাহীন হয়ো না।
 
সমালোচনা
তবে সমালোচকরাও ছিলেন। অনেকেই বলতেন, বব মার্লে অতিরিক্ত সরল ছিলেন, তাঁর গান সব সমস্যার সমাধান করতে পারে না। আবার তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
কিন্তু তাঁর ভক্তরা বলতেন— তিনি মানুষ ছিলেন, দেবতা নন। তাঁর ব্যক্তিগত ভুলগুলো তাঁর বার্তাকে খাটো করে না। বরং তিনি যেমন ছিলেন, তেমনই মানুষ হয়েও সত্য বলেছিলেন।
উত্তরাধিকার
আজও বব মার্লের দর্শন টিকে আছে। পৃথিবীর যে কোনো প্রতিবাদে, যে কোনো আন্দোলনে তাঁর গান বাজে। হংকংয়ের গণতন্ত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই— সর্বত্র তাঁর কণ্ঠ শোনা যায়।
২০০০ সালের পর থেকে বহু তরুণ আবার রাস্তাফারির দর্শনের প্রতি আগ্রহী হয়েছে। তারা ববের গান শুনে শিখছে— স্বাধীনতা মানে শুধু রাজনীতি নয়, বরং মানসিক শৃঙ্খল ভাঙা।
এক আধ্যাত্মিক যোদ্ধা
শেষ জীবনে বব প্রায়ই বলতেন, “আমার গান টাকা বানানোর জন্য নয়, মানুষের মুক্তির জন্য।”
তিনি মৃত্যুর আগেই জানতেন— তাঁর জীবন হয়তো সংক্ষিপ্ত হবে, কিন্তু তাঁর সঙ্গীত টিকে থাকবে। আর তাই তিনি লিখেছিলেন “Redemption Song”, যেখানে তিনি কেবল গিটার হাতে বসে বলেছিলেন— “Emancipate yourselves from mental slavery.”
এটাই তাঁর দর্শনের সারাংশ।
পর্ব ১১ : বিশ্বসংস্কৃতিতে বব মার্লে
বব মার্লে শুধু একজন সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন না, তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। তাঁর গান, তাঁর চুলের স্টাইল, তাঁর বিশ্বাস— সব মিলিয়ে তিনি এমন এক প্রতীক, যা জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজও, চার দশক পর, তাঁর প্রভাব দেখা যায় ফ্যাশন, খেলাধুলা, সিনেমা, রাজনীতি— সর্বত্র।
পপ কালচারের প্রতীক
আশির দশকের মাঝামাঝি, বব মার্লে মৃত্যুর পরপরই তাঁর মুখ হয়ে উঠল পোস্টারের ভাষা। লাল, সবুজ, হলুদ রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডে ড্রেডলক চুল আর হাসিমাখা মুখ— এটি হয়ে উঠল বিক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্মের প্রতীক। যেমন চে গেভারা বা জন লেননের ছবি বিদ্রোহের প্রতীক হয়েছিল, তেমনই বব মার্লের ছবিও হয়ে উঠল এক আইকন।
আজও বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের দেয়ালে, কফিশপের টেবিলে, অথবা কোনো বিক্ষোভ মিছিলে বব মার্লের ছবি দেখা যায়। তাঁর মুখ মানে হলো স্বাধীনতা, প্রতিবাদ, আর ভালোবাসা।
ফ্যাশনে প্রভাব
ড্রেডলক চুল একসময় কেবল রাস্তাফারিদের ধর্মীয় পরিচয় ছিল। কিন্তু বব মার্লে একে বিশ্বজুড়ে ফ্যাশনের অংশ বানালেন। আফ্রিকার বাইরে ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি এশিয়ার তরুণরাও ড্রেডলক রাখতে শুরু করল।
শুধু চুল নয়— লাল, সবুজ, হলুদ রঙের মিশ্রণ, যা ইথিওপিয়ার পতাকার রঙ, তা হয়ে উঠল “রেগে কালারস”। টি-শার্ট, ক্যাপ, জ্যাকেট, এমনকি জুতোর ডিজাইনেও এই রঙ ছড়িয়ে পড়ল। আজও কোনো মিউজিক ফেস্টিভ্যালে গেলে দেখা যায়, তরুণরা রেগে কালার পরে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
খেলাধুলায় বব মার্লে
বব মার্লের জীবনে ফুটবল ছিল গভীর ভালোবাসা। ট্যুরে বেরোলেই তিনি মাঠ খুঁজে বের করতেন, দলের সবাই মিলে খেলতেন। তিনি বলেছিলেন— “Football is freedom.”
এই ভালোবাসা তাঁকে খেলাধুলার সংস্কৃতিতেও জায়গা করে দিয়েছে। আজও অনেক ফুটবল ক্লাব বা ভক্তরা তাঁর গান বাজায় ম্যাচের আগে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা ইউরোপের স্টেডিয়ামে “Three Little Birds” বা “One Love” বাজতে শোনা যায়।
নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব Ajax Amsterdam নিজেদের স্টেডিয়ামে প্রতি ম্যাচের আগে “Three Little Birds” বাজায়। হাজার হাজার দর্শক একসঙ্গে গেয়ে ওঠে— “Don’t worry about a thing, ’cause every little thing gonna be all right.” এটি হয়ে উঠেছে তাঁদের অনানুষ্ঠানিক সংগীত।
সিনেমা আর বিজ্ঞাপনে গান
বব মার্লের গান আজও অসংখ্য সিনেমা ও বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়। “One Love” বা “Could You Be Loved” শোনা যায় কমেডি কিংবা রোমান্টিক ছবিতে। “Redemption Song” বাজে রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে।
এমনকি ইউনিসেফ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাঁর গান ব্যবহার করেছে শান্তির বার্তা ছড়াতে।
বব মার্লে ও রাজনীতি
বব মার্লের গান কখনোই সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য লেখা হয়নি। কিন্তু তাঁর বার্তা বিশ্বজুড়ে আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার এন্টি-এপারথেইড মুভমেন্টে, আমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্টে, লাতিন আমেরিকার বামপন্থী আন্দোলনে— সর্বত্র তাঁর গান বাজানো হয়েছে।
তিনি গেয়েছিলেন “Get Up, Stand Up, stand up for your rights.” এই লাইনটি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক পোস্টার, দেয়াললিখন, আর মিছিলের শ্লোগান।
রেগে ও নৃত্য
বব মার্লে জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে যে জিনিসটি এনে দিলেন, তা হলো রেগের নাচ। আগে এটি সীমাবদ্ধ ছিল ক্যারিবিয়ান সংস্কৃতিতে, কিন্তু তাঁর কারণে ইউরোপ-আমেরিকার ক্লাবগুলোতেও মানুষ রেগে রিদমে নাচতে শুরু করল।
এমনকি হিপহপ আর ইলেকট্রনিক ডান্স মিউজিকেও রেগের ছন্দ মিশে গেল। স্নুপ ডগ, শন পল, শন কিংস্টন, শ্যাগি— এঁরা সবাই কোনো না কোনোভাবে বব মার্লের উত্তরাধিকার বহন করছেন।
ভাষা ও কণ্ঠ
বব মার্লে তাঁর গানে ব্যবহার করতেন patois— জ্যামাইকান লোকভাষা। আগে এই ভাষাকে তুচ্ছ মনে করা হতো, কিন্তু বব এটিকে বিশ্বমঞ্চে এনে দিলেন। “I man”, “irie”, “jah” ইত্যাদি শব্দ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল।
আজও কোনো তরুণ যখন বলে “Everything irie, man”— সেটা আসলে বব মার্লের সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফল।
ক্রীড়া জগতে প্রেরণা
ফুটবল ছাড়াও ববের গান ব্যবহার হয়েছে অলিম্পিকস, বিশ্বকাপ, এমনকি বক্সিং ম্যাচেও। মাইক টাইসন থেকে উসাইন বোল্ট— অনেক খেলোয়াড় বলেছেন, ম্যাচের আগে তাঁরা বব মার্লে শুনতেন। কারণ তাঁর গান তাঁদের শক্তি আর আত্মবিশ্বাস দিত।
পপ কালচারের বাণিজ্য
অবশ্য সমালোচনা আছে। অনেকে বলেন, বব মার্লেকে অতিরিক্ত বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁর মুখ ছাপানো হয়েছে সস্তা টি-শার্টে, তাঁর গান বাজানো হয়েছে বিয়ারের বিজ্ঞাপনে। প্রশ্ন ওঠে— তিনি কি চেয়েছিলেন তাঁর নাম দিয়ে ব্যবসা হোক?
কিন্তু অন্যদিকে অনেকে বলেন, এই ব্যবহারের মধ্য দিয়েই তাঁর বার্তা পৌঁছাচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে। যদি কোনো তরুণ ববের ছবি দেখে তাঁর গান শুনতে শুরু করে, তবে তাতে ক্ষতি কী?
সাংস্কৃতিক ঐক্য
সবচেয়ে বড় প্রভাব ছিল এই— বব মার্লে কালো-সাদা, ধনী-গরিব, পূর্ব-পশ্চিম সব বিভেদ ভেঙে দিলেন। তাঁর গান ইউরোপের ডিস্কোতেও বাজল, আবার আফ্রিকার মুক্তিযোদ্ধারাও গাইলেন। আমেরিকার কলেজ ছাত্র যেমন “No Woman, No Cry” গাইতে শিখল, তেমনই জ্যামাইকার বস্তির বাচ্চারাও তাঁর গান শুনে নাচল।
এভাবে তিনি প্রমাণ করলেন— সঙ্গীত সত্যিই সীমাহীন।
উত্তরাধিকার
আজকের দিনে কোনো বড় কনসার্ট, কোনো বড় মিছিল, কোনো শান্তি সম্মেলন— বব মার্লের গান ছাড়া পূর্ণ হয় না। তাঁর নাম উচ্চারণ করলেই মানুষ মনে করে— ভালোবাসা, স্বাধীনতা, আর আশা।
তিনি একবার বলেছিলেন, “My life is only important if me can help plenty people.” বিশ্বসংস্কৃতির প্রতিটি স্তরে তিনি সেটাই করেছেন।
পর্ব ১২ : আগুন ও রিদমের অমরত্ব
১৯৮১ সালের মে মাসে যখন বব মার্লে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ছত্রিশ। বয়সে তরুণ, কিন্তু প্রভাবের দিক থেকে তিনি তখন এক মহাসমুদ্র। মৃত্যুর খবর পৌঁছাল সারা দুনিয়ায়, আর হঠাৎই স্পষ্ট হলো— বব মার্লে আর কেবল একজন গায়ক নন, তিনি এক কিংবদন্তি।
মৃত্যু-পরবর্তী বিস্ফোরণ
বব মারা যাওয়ার পর তাঁর গান আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। ১৯৮৪ সালে প্রকাশ পেল সংকলন অ্যালবাম “Legend”, যা আজও বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক বিক্রিত অ্যালবাম। শুধু সংখ্যার হিসেবেই নয়, এই অ্যালবাম প্রতিটি প্রজন্মকে নতুনভাবে বব মার্লের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
“No Woman, No Cry”, “One Love”, “Redemption Song”— প্রতিটি গান যেন চিরকালীন। ৮০-এর দশকের তরুণরা যেমন এগুলো শুনে জীবন বদলাল, তেমনই ৯০-এর দশকের কলেজ ছাত্ররাও, আবার আজকের যুগের তরুণরাও একইভাবে প্রেরণা পাচ্ছে।
শান্তি আর ঐক্যের প্রতীক
মৃত্যুর পর বব মার্লে হয়ে উঠলেন শান্তির দূত। জাতিসংঘ তাঁর গানকে ব্যবহার করল বিশ্বশান্তির প্রচারে। ইউনিসেফ “One Love” গানকে ঘোষণা করল শিশুদের ঐক্যের সংগীত হিসেবে। ২০০৫ সালে বিবিসি “One Love” গানটিকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গান হিসেবে স্বীকৃতি দিল।
আশ্চর্যের বিষয়, তাঁর গান কেবল রাজনৈতিক আন্দোলনে নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও প্রেরণা হয়ে দাঁড়াল। পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবনের কঠিন সময়ে তাঁর গান শুনে সাহস পেয়েছে। “Three Little Birds” যখন বলে, “Don’t worry about a thing, ’cause every little thing gonna be all right”, তখন সেটি হয়ে ওঠে সবার ব্যক্তিগত সান্ত্বনা।
আফ্রিকা ও ক্যারিবিয়ান
আফ্রিকায় বব মার্লে এখনও এক নবীর মতো। জিম্বাবুয়ে, ঘানা, দক্ষিণ আফ্রিকা— সর্বত্র তাঁর গান শোনা যায়। জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতার অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি তাঁকে আফ্রিকান মুক্তির প্রতীকে পরিণত করেছিল।
জ্যামাইকায় তিনি জাতীয় নায়ক। নাইন মাইলে তাঁর সমাধি এখনো দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিন হাজারো ভক্ত সেখানে ভিড় করে— কেউ প্রার্থনা করতে, কেউ শুধু শ্রদ্ধা জানাতে।
নতুন প্রজন্মে বব
ববের সন্তানরাও তাঁর উত্তরাধিকার বহন করছে। জিগি, স্টিফেন, ডেমিয়ান, জুলিয়ান, কাই-মানি— প্রত্যেকে সঙ্গীতে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। বিশেষ করে ডেমিয়ান মার্লে তাঁর “Welcome to Jamrock” গান দিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে রেগেকে আবার জনপ্রিয় করলেন।
শুধু পরিবার নয়, সারা বিশ্বের শিল্পীরাও বব থেকে প্রেরণা নিচ্ছে। হিপহপ, রক, পপ— প্রতিটি ধারায় বব মার্লের প্রভাব ছড়িয়ে আছে। লরেন হিল, স্নুপ ডগ, শন পল, এড শিরান— অসংখ্য শিল্পী তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
বাণিজ্য বনাম উত্তরাধিকার
বব মার্লের মৃত্যুর পর তাঁর নাম হয়ে উঠল ব্র্যান্ড। পোশাক, ব্যাগ, কফি, হেডফোন— সর্বত্র তাঁর নাম ব্যবহার করা হলো। অনেকেই সমালোচনা করেছেন— এ কি ববের স্বপ্ন ছিল? তিনি কি চেয়েছিলেন তাঁর মুখে ছাপানো টি-শার্ট বিক্রি হোক?
কিন্তু অন্যপক্ষ বলেছে, এসব পণ্যের মাধ্যমে তাঁর বার্তাই ছড়িয়ে যাচ্ছে। যদি কোনো তরুণ ববের ছবি দেখে কৌতূহলী হয়ে তাঁর গান শুনতে শুরু করে, তবে সেটাই আসল জয়।
উত্তরাধিকার
ববের মৃত্যু-পরবর্তী চার দশকে তাঁর গান নানা প্রেক্ষাপটে ফিরে এসেছে। হংকংয়ের গণতন্ত্র আন্দোলন থেকে আমেরিকার ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার মিছিল— সর্বত্র শোনা গেছে তাঁর কণ্ঠ।
তিনি একবার বলেছিলেন,
“My music will go on forever. Maybe it’s a foolish thing to say, but when me know facts me can say facts.”
এবং সত্যিই তাই হলো।
ববের দর্শনের অমরত্ব
তাঁর দর্শন ছিল সহজ:
- সবার প্রতি ভালোবাসা।
 - শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
 - মানসিক দাসত্ব ভাঙা।
 - সঙ্গীতকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।
 
এই দর্শনই তাঁকে অমর করেছে। তাঁর মৃত্যুর পর পৃথিবী যখনই বিভক্ত হয়েছে, তাঁর গান তখনই মানুষকে এক করেছে।
আজকের পৃথিবীতে বব মার্লে
২০২০ সালের কোভিড মহামারীর সময়, যখন মানুষ ঘরে বন্দি, আতঙ্কিত, তখন আবার বাজতে শুরু করল “Three Little Birds”। ইউরোপের ব্যালকনিতে মানুষ গাইল, “Don’t worry about a thing.” যেন বব মার্লে ফিরে এলেন, মানুষকে সাহস দিলেন।
একইভাবে আফ্রিকার বিক্ষোভে এখনও তাঁর “Get Up, Stand Up” বাজে। আমেরিকার কলেজে এখনও তরুণরা “One Love” গেয়ে গিটার বাজায়। ভারতের শহরগুলোতেও রক ব্যান্ডগুলো তাঁর গান কভার করে।
আগুন ও রিদমের সন্তান
বব মার্লে ছিলেন আগুনের মতো— তাঁর কণ্ঠে ছিল ক্ষোভ, প্রতিবাদ, বিদ্রোহ। আবার তিনি ছিলেন রিদমের মতো— তাঁর সুরে ছিল নাচ, আনন্দ, ঐক্য। এ দুই মিলিয়েই তিনি হয়ে উঠলেন আগুন আর রিদমের সন্তান।
তাঁর জীবন হয়তো স্বল্পায়ু, কিন্তু তাঁর গান সীমাহীন। তিনি প্রমাণ করে গেছেন— একজন মানুষের গানও পৃথিবী বদলাতে পারে।
নাইন মাইলের ছোট্ট গ্রাম থেকে শুরু করে আফ্রিকার মুক্তিযুদ্ধ, লন্ডনের কনসার্ট থেকে শুরু করে আমেরিকার মিছিল— সর্বত্র তাঁর উপস্থিতি। আর আজও, যখন কোনো ভোরে কেউ ফিসফিস করে বলে ওঠে, “One Love, One Heart”— তখন বোঝা যায়, বব মার্লে এখনও বেঁচে আছেন।
***
				
	

	


