আয়নান তাসফিয়া
পার্ট ১ — ধুনুচির ধোঁয়ার মধ্যে
চান মিয়া নামে যে ফকিরটার কথা বলে পুরো বরিশালের ময়না ইউনিয়ন, সে এই গ্রামে এসেছিল বছর দশেক আগে, হাটের একেবারে পাশের খালি জমিতে একটা মাটির ঘর বানিয়ে। গা ঢাকা শাদা পাঞ্জাবি, চোখে কাঁচের ফ্রেমের মোটা চশমা, আর হাতে একখানা কাঠের লাঠি। গ্রামের লোক প্রথমে ভেবেছিল কোনো পাগল এসেছে, হয়তো শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া কেউ, বা শ্মশানে ঘুরে বেড়ানো অদ্ভুত লোকদের একজন। কিন্তু খুব দ্রুতই মানুষের ধারণা বদলে গেল।
শুরুটা হয়েছিল এক রাতে। হাটের পাশের কুয়োর জলে সাপ পড়ে গিয়েছিল, আর গ্রামের কেউই সাহস পাচ্ছিল না উঠাতে। তখনই চান ফকির ধুনুচি জ্বালিয়ে, মাটি ছুঁয়ে কিছু বলল আর গর্তে হাত ঢুকিয়ে সাপটাকে টেনে বের করল। সেই রাতেই ময়নার লোকেরা বুঝল, এই লোক সাধু না হোক, ভিন্নধর্মী বটে।
ধীরে ধীরে লোকজন আসতে শুরু করল। কেউ মাথার ব্যথা নিয়ে, কেউ শ্বশুরবাড়ির অশান্তি, কেউ আবার স্বামী পালিয়ে যাওয়ার জন্য কষ্ট নিয়ে। চান ফকির কথা কম বলত, শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত আর হালকা করে বলত, “ধূন জ্বালাও, আগুন জেগে উঠুক।”
চান ফকিরের আখড়াটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপ নিতে লাগল। মাটির ঘরের পাশে গজিয়ে উঠল একটা খোলামেলা আসনঘর, যেখানে সন্ধ্যায় বসত সান্ধ্য গান — বাউল, মারফতি, আর কখনো কখনো লালন। দু-একজন শহর থেকে আসা যুবকও দেখা যেত, যারা ভিডিও করত বা প্রশ্ন করত, “আপনারা ধর্মের নিয়ম মানেন না?” এমন প্রশ্নে চান ফকির কখনো রেগে যেত না। শুধু বলত, “আমরা আল্লাহর ঘর খুঁজি নিজের গা বেয়ে। বাইরে নয়, ভেতরে।”
সেই আখড়ায় ছিল আরও কিছু চরিত্র। মোটা গলায় গান গাওয়া সোনা দাস, যে গলায় একবার গেয়ে উঠলে হাটের গরুগুলোর কান নড়ে উঠত। ছিল মমতা খাতুন, বিধবা, যার বাপের বাড়ি থেকেও তাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল — এখন সে ধুনুচি জ্বালায় আর নারীদের ব্যথার কথা শোনে। ছিল ছোট্ট এক ছেলে, নাম জামিল, যে তার মাকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন এসে আখড়ায় ঢুকেছিল আর থেকে গিয়েছিল চিরদিনের জন্য।
গ্রামের লোকেরা এদের সবাইকে একসময় পাগল বলত, পরে বলত ‘চান ফকিরের লোক’। আর এখন, একেকটা রোগী সেরে উঠে গেলে, একেকটা সংসার জোড়া লেগে গেলে, তারা বলে, “আল্লাহ চান ফকিররে দিছে।”
তবে আখড়ার জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে হিংসাও বাড়ল। এলাকার ইমাম সাহেব, যিনি আগে হাটে হাটে ওয়াজ করতেন, তিনিই একদিন মসজিদের খুৎবায় বললেন, “আজকাল মানুষ সোজা রাস্তা ছেড়ে ফকিরি দীক্ষায় চলেছে। এটা শয়তানের ফাঁদ।” কিন্তু সেটা শুনে গ্রামের অনেকে কান দিল না। বরং তাদের কথা ছিল — “যেখানে শান্তি পাই, সেখানে যাই।”
একদিন সন্ধ্যায়, আখড়ায় বসে গানের রিহার্সাল চলছিল। হঠাৎ করে কয়েকটা অচেনা লোক ঢুকল। গলায় গামছা বাঁধা, চোখে হিংসা। তারা সরাসরি চান ফকিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি লোক ঠকাও। মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলো। আজ হাটে হুজুর সাহেবের নির্দেশ এসেছে — এই আখড়া ভাঙতে হবে।”
চান ফকির মাথা নিচু করে বলল, “ধ্বংসে ভয় নেই। আগুনে ভয় নেই। কিন্তু ভালোবাসায় কেউ জিততে পারে না।”
লোকগুলো সেই রাতে কিছু করল না। তারা ফিরে গেল। কিন্তু বাতাসে চাপা একটা অশুভ গন্ধ থেকে গেল।
জামিল সেই রাতে ঘুমাতে পারেনি। সে সারারাত ধরে আখড়ার বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। চাঁদ ছিল না, ছিল না তারার আলোও। শুধু একটা কাঁপা কাঁপা আলো — যেন ধুনুচির ধোঁয়া লুকিয়ে রেখেছে এক অন্ধকার আগুন।
চান ফকিরের ভিতরে তখন চলছিল অন্য যুদ্ধ। নিজের ভেতরের ভয়, ঈর্ষা, অহংকার — সব কিছু দমন করে রাখার সাধনা। কারণ সে জানত, আখড়া মানে শুধু গান না, কবিতা না, ধুনুচি না — এটা একটা ভাবনা, একটা পথ, একটা বিদ্রোহ।
সেই পথেই সে একদিন এসেছিল। একদিন, বহু বছর আগে, যখন তার নাম ছিল কায়েস চৌধুরী। এক জমিদার ঘরের সন্তান। আর এখন? এখন সে ফকির — আগুনের ধূপে নিজেকে পোড়ানো এক আশ্চর্য সাধক।
পর্ব ২: কাঠের লাঠির গল্প
হাটের দুপুর গড়িয়ে বিকেল যখন গড়িয়ে যায় সান্ধ্য গানের প্রস্তুতিতে, তখন আখড়ার বাতাস একটু আলাদা হয়। ধুপের গন্ধে মিশে থাকে কাঁচা মাটি, পুরোনো তুলসী গাছের পাতা আর কোনো এক অদ্ভুত শান্তির ধোঁয়া। সেদিন সন্ধ্যায় সোনা দাস গলা খোলার আগেই চান ফকিরের ডান হাতের কাঠের লাঠিটা হঠাৎ আছড়ে পড়ে যায় মাটিতে। আখড়ার মানুষদের কাছে এটা ছিল অশুভ ইশারা। কারণ এই লাঠিটা কখনও কারও চোখের সামনে পড়ত না। এটা ছিল যেন একটা নিঃশব্দ তাবিজ, যেমনটা কোনো রাজা তার তলোয়ার গোপনে রাখে।
চান ফকির লাঠিটা তুলে নিয়ে শান্ত গলায় বলল, “লাঠি পড়া মানে চেতনার জাগরণ। সময় এসেছে কিছু বদলের।” তার গলায় না ছিল ভয়, না ছিল দম্ভ — যেন সে আগেই জানত এই পতনের তাৎপর্য।
জামিল তখন মমতা খাতুনের পাশে বসে ধুপের ধোঁয়া নাড়াচ্ছিল। সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “মা, ফকির চাচার লাঠিটা কি সত্যি জাদুর?”
মমতা বলল, “জাদু বলে কিছু নেই, জামিল। তবে বিশ্বাস যখন কাউকে ছুঁয়ে যায়, তখন কাঠও কথা বলে।”
চান ফকির আজ একটু আলাদা বসেছিল। সাধারণত সে মাটির উনুনের পাশে বসে, চোখ বন্ধ করে, গান শোনে। কিন্তু আজ সে উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল, লাঠি হাতে। গান শুরু হতেই সে আস্তে করে পায়ের আঙুল মাটিতে গুঁজে বলল, “আজ রাতে আসবে।”
“কে?” সোনা দাস থেমে জিজ্ঞেস করল।
“যারা হিংসা পুষে চলে। যারা প্রেমকে ভয় পায়। যারা ভাবে, এই আখড়া মানে বিদ্রোহ,” চান ফকিরের গলায় তপ্ত সুর।
তবে আখড়ার মানুষ ভয় খায়নি। তারা জানত, যদি কিছু হয়, তারা গাইবে — বুক ভরে, প্রাণ খুলে, যতক্ষণ না কণ্ঠ ছিঁড়ে যায়।
রাত বারোটা নাগাদ হাটের দিক থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল। কুকুর ডেকেছিল, তবে সেটা ছিল গর্জনের মতো। তার ঠিক পরেই দেখা গেল দশ-বারোজন লোক, হাতে বাঁশ আর কুড়াল, চোখে অদ্ভুত বিদ্বেষ। তারা সরাসরি এগিয়ে এল আখড়ার দিকে।
জামিল প্রথমে ভয় পেয়েছিল, কিন্তু মমতা খাতুন তাকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরল। “ভয় নয় জামিল, দেখো, আজ আমাদের পরীক্ষা,” সে বলল।
তারা এসে দাঁড়াল সোজা চান ফকিরের সামনে। তাদের নেতা, এক পেট মোটা লোক, হয়ত হুজুর সাহেবের কোনো অনুসারী, গলা উঁচিয়ে বলল, “এই আখড়া বন্ধ করো। এখানে শয়তানের গান হয়। ধর্মের নামে লোক ঠকাও!”
চান ফকির শান্তভাবে বলল, “ধর্ম কি কেবল নিয়মের নাম? নাকি প্রেমের? আমি শুধু ভালোবাসা শেখাই। যদি সেটা অপরাধ হয়, তবে আমি দোষী।”
লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, “তুমি কিসের ফকির? তোমার কোনো ওলি-আউলিয়ার শংসাপত্র আছে?”
চান ফকির এবার হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে। তার কণ্ঠে ধ্বনি উঠল, “ইয়া আল্লাহ, আজ আমার কথা নয়, তোর কথা হোক। যে ভালোবাসতে জানে না, তাকে তুমি দাও চোখের আলো।”
তবে হামলাকারীরা নরম হলো না। তাদের একজন ছুটে গিয়ে উঠোনের ধুপে একটা আগুন লাগিয়ে দিল। লাল শিখা এক মুহূর্তে আকাশে ছড়াল। কিন্তু ঠিক তখনই, জামিল ছুটে গেল আর কাঠের লাঠিটা চান ফকিরের হাত থেকে নিয়ে আগুনের চারপাশে একটা বৃত্ত আঁকল মাটিতে।
অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। আগুন ছড়িয়ে না পড়ে, ঘূর্ণি খেয়ে এক জায়গায় বন্দী হয়ে গেল — যেন মাটির রেখাটা আগুনকে আটকে দিয়েছে। সবাই স্তব্ধ।
চান ফকির ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “লাঠিটা শুধু কাঠ নয়। এটা আমার পিতার হাত। আমার পূর্বপুরুষের শ্বাস। আমি কিছু পারি না, তারাই কাজ করেন।”
হামলাকারীরা তখন থমকে গেছে। তাদের নেতা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
ঠিক তখনই একটা কণ্ঠ উঠে এল আখড়ার পিছনের দিক থেকে — কাঁপা কাঁপা গলা, বয়স্ক এক লোক, চোখে অন্ধকার। সে বলল, “চান, আমি তোমার বাবার বন্ধু। আজ চল্লিশ বছর পর তোমায় দেখলাম। তুই ঠিক পথেই আছিস। আমি জানতাম, তুই ফিরবি।”
সেই লোকটা ছিল রফিক মাস্টার, বরিশাল শহরের প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক, যিনি একসময় জমিদার কায়েস চৌধুরী — চান ফকিরের আসল পরিচয়ের সঙ্গী ছিলেন। তিনি এলেন, গলা জড়িয়ে ধরলেন চান ফকিরকে। বললেন, “তুই নিজেকে হারিয়ে দিয়েছিলি বলেই পাবি তোর প্রকৃত পরিচয়।”
সেদিনের রাতে কেউ আর আখড়ায় আগুন লাগাতে পারল না। গান শুরু হলো। সোনা দাস গাইল এক লালনের গান—
“জানার মধ্যে অজানারে খুঁজি,
ভালোবাসার মাঝে বন্দনা বুঝি।”
জামিল সেই রাতে ঘুমাতে পারেনি। সে জানত, আজ রাতের মতো আখড়া বেঁচে গেল। কিন্তু কাল? কাল আবার কেউ আসবে, আবার কেউ আঘাত করবে। আর তাকে চাইতে হবে সাহস, নতুন করে।
চান ফকির লাঠিটা হাতে তুলে নিল আবার। তারপর তাকিয়ে থাকল আকাশের দিকে। চাঁদের আলো নেই, কিন্তু তার চোখে জ্বলছিল এক অন্যরকম দীপ্তি।
পর্ব ৩: বাউলের বুকে বৃষ্টি নামে
রাতটা কেটে গেলে আখড়ার উঠোনে একটা ভারী নীরবতা পড়ে রইল। গানের সুর যেমন গায়েব হয়ে গেল, তেমনি হারিয়ে গেল মানুষের মুখের হাসি। ধুপ আর আগুনের গন্ধ এখনও ঘুরছে বাতাসে, আর জামিল সেই সকালেই বাঁশঝাড়ের পাশে বসে একাই চুপ করে আছে। তার চোখে ভয় নেই, কিন্তু একটা চিন্তার ছায়া। কাল রাতে সে যা করেছে — লাঠি দিয়ে আগুন আটকে দেওয়া — সেটা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল? সে তো কোনো মন্ত্র জানে না, কোনো শক্তিও না। তবে কেন সে অনুভব করেছিল, তার ভিতরে যেন কেউ হাত রাখছিল?
চান ফকির তখন উঠোনের কোণার তুলসী গাছের গোড়ায় বসে। চোখ দুটো বন্ধ, ঠোঁটে এক অদৃশ্য মোনাজাত। তার লাঠিটা তার ডান পাশে রাখা — যেন শুয়ে থাকা সঙ্গী। মমতা খাতুন দুধ আর মধু দিয়ে এক পেয়ালা চা এনে দিল তার সামনে। সে মাথা নাড়ল, নিল না কিছুই। বলল শুধু, “আজ আমি উপবাসে আছি। হৃদয়ের উপবাস।”
মমতা কিছু বলল না। সে জানে, চান ফকির যা করে তা যুক্তিতে হয় না, হয় ভেতরের ডাকে।
এই অবস্থায় হঠাৎ করে বিকেলের দিকে আখড়ায় ঢুকল একটা নতুন মুখ। লম্বা, গাঢ় রঙের পাঞ্জাবি পরে, গলায় একতারা ঝুলিয়ে রাখা — সে এক বাউল। তার চুল এলোমেলো, চোখে উদ্ভ্রান্ত চাহনি, আর মুখে হাসি। সে এসে গলা চড়িয়ে বলল, “এই আখড়ায় কি সুরের জায়গা আছে? নাকি কেবল আগুনের?”
চান ফকির চোখ মেলে তাকাল। “তুমি কে?”
“আমার নাম রাখেনি কেউ। তবে ডাকে গলায় সুর আছে বলে,” সে বলল। “আমি এসেছি এক গান নিয়ে। সেই গান কেউ এখনও শোনেনি। আমি শুধু শুনেছি বাতাসে।”
আখড়ার সবাই অবাক। সোনা দাস তো রীতিমতো ভ眉 কুঁচকে বলল, “এ আবার কেমন লোক? গানেরও কি আগেই জন্ম হয়?”
নতুন বাউল হেসে উঠল। “গান তো জন্মায় না। সে থাকে, ঘুমিয়ে থাকে — কেবল কেউ তাকে জাগিয়ে তোলে। আমি সেই ঘুম ভাঙাতে এসেছি।”
তখন চান ফকির বলল, “আসো। বসো। কিন্তু মনে রেখো, এই আখড়ায় গান কেবল কণ্ঠের নয়, আত্মার।”
বাউল বসে পড়ল। তার একতারা থেকে সুর ভেসে এল — এমন এক সুর, যা মনে করিয়ে দেয় শুকনো মাঠের উপর বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা। তার গলায় গেয়ো ওঠল—
“জন্ম জন্ম ঘুরেছি পথিক,
খুঁজেছি তোকে আখড়ার ঠিক।
তুই যে রে অন্তরে লুকায়,
বাইরে থাকি করিস না ডাক।”
শুনেই জামিল উঠে দাঁড়াল। তার মনে হলো, এই গানের প্রতিটি শব্দ যেন তার নিজের কথা। সেই আগুনের রাত, সেই কুয়াশা ভরা শীতল হাওয়া, সেই ভয় আর সাহসের সন্ধিক্ষণ — সব কিছু যেন এক এক করে ফিরে আসছে।
গান শেষ হলে সবাই স্তব্ধ। কেবল সোনা দাস চোখ মুছছিল। সে বলল, “ভাই, তুই কই থাইক্কা আইলি? তোকে তো আর ছাড়তে মন চায় না।”
বাউল বলল, “আমি তো কোনো জায়গা থেকে আসিনি। আমি এসেছি সময় থেকে। এই আখড়ায় আগুন লেগেছে, আমি জানতাম। আগুন নেভে না গালিতে, নেভে গানে। আমি সেই জল হয়ে এসেছি।”
চান ফকির এবার গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি অনেক কিছু জানো। এত জানো কীভাবে?”
বাউল চোখ বন্ধ করে বলল, “আমি তো কেবল শ্রোতা। বাতাসে যা বলা হয়, মাটিতে যা লেখা হয়, আমি কেবল শুনি আর গাই।”
তারপর হঠাৎ করে সে জামিলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই কাল রাতে আগুনের গায়ে রেখা এঁকেছিলি, না?”
জামিল চমকে উঠল। “তুমি জানো কিভাবে?”
“আমি জানি না। আমি শুনেছি। আকাশ বলেছে,” বাউল বলল।
এ কথা শুনে আখড়ার সবাই চুপ। যেন একটা অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি অনুভব করল সবাই। চান ফকির উঠে এসে বাউলের কাঁধে হাত রাখলেন। “তুমি থাকো এখানে। আমরা সবাই তোমার সুর চাই।”
বাউল বলল, “আমি থাকব, যতদিন এই আখড়া আগুন ছড়াবে না, আলো ছড়াবে।”
সেদিন রাতে আখড়ায় আবার গান হল। জামিল নিজের হাতে ধুপ জ্বালাল। মমতা খাতুন প্রার্থনা করল মাথা নিচু করে। সোনা দাস আর নতুন বাউল মিলে এমন এক যুগল গান করল, যার সুর বাতাসে ভেসে গ্রাম ছাড়িয়ে খালের ধার অবধি পৌঁছাল।
কিন্তু গ্রামের বাইরে আবার একদল লোক জড়ো হচ্ছে। তারা চুপচাপ নয়। তারা রাগে ফুঁসছে। তাদের ধারণা, এই আখড়া তাদের ধর্মীয় কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। তারা ভাবছে, এই মানুষগুলোকে যদি আজ না থামানো যায়, কাল তারা বিশ্বাসের নামেই বিদ্রোহ করবে।
তাদের একজন বলল, “এই চান ফকির আসলে কায়েস চৌধুরী। সে জমিদার ছিল, এখন নিজেকে ফকির সাজায়। তার বিরুদ্ধে প্রমাণ চাই।”
আর একজন বলল, “না। প্রমাণ নয়। আগুন চাই। এবার এমন আগুন, যা গানেও নেভানো যাবে না।”
চান ফকির তখন দূরে, নিজের ঘরের সামনে বসে গুনগুন করে একটা মন্ত্র আওড়াচ্ছে। তার গলা থেকে ভেসে আসছে এক আশ্চর্য শব্দ—
“ও মন, প্রেমে আগুন লাগাইস না,
আগুনে পোড়লে ছাই হবি, মায়ায় হারাইস না।”
জামিল ঘুমোতে পারছে না। সে জানে, আবার কিছু একটা ঘটবে। কিন্তু এইবার সে ভয় পাচ্ছে না। সে জানে, তার ভেতরে একটা আলো জ্বলছে। হয়তো সে এখনও বোঝে না সেই আলোর উৎস কোথায়, কিন্তু সে জানে — সেই আলো নিভে গেলে আখড়াও নিভে যাবে।
আর তাই সে ঠিক করল, কিছু ঘটলে সে পালাবে না। সে থাকবে — ঠিক চান ফকিরের পাশে, ঠিক আগুনের পাশে।
পর্ব ৪: আখড়ার গায়ে ছায়া পড়ে
সকালে সূর্য উঠলেও আখড়ার উঠোনে আলো ঠিকমতো পড়ছিল না। মেঘ যেন স্থির হয়ে বসে আছে আকাশজুড়ে, বাতাস থেমে গেছে, আর চারপাশে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। পাখিরা ডাকেনি, কুকুরগুলোও ঘেউ ঘেউ করেনি। মাটি যেন ঘুমিয়ে আছে কিন্তু তার ভিতরে কেঁপে কেঁপে উঠছে কিছু একটা—যেমন করে আগুন জ্বলবার আগে ছাই ফুসফুসে জমে।
চান ফকির খুব ভোরে উঠে একটা পুরোনো কাপড়ে লাঠিটা মুছছিল। জামিল এসে পাশে বসতেই ফকির বলল, “বুঝেছিস তো, কাল রাত্রে যা ঘটেছে সেটা কেবল শুরু। এখন থেকে আখড়ার বুকে ছায়া পড়বে। গান আর ধুপের ভেতরেও ভয় ঢুকে পড়বে।”
জামিল মাথা নিচু করে থাকল। সে কিছু বলে না, কিন্তু তার চোখ জানে — এই আখড়া এখন শুধু একটা জায়গা না, এটা যুদ্ধক্ষেত্র। গান আর ভালোবাসার পক্ষে এক যুদ্ধ।
সেইসময় মমতা খাতুন এসে জানাল, “দুপুরে প্রশাসনের লোক আসবে শুনেছি। গ্রামের চেয়ারম্যান বলেছেন—এইসব ‘আধুনিক তান্ত্রিকতা’ বন্ধ করতে হবে।”
চান ফকির হেসে বলল, “আমরা তো কেবল আত্মার কথা বলি। ভালোবাসার কথা বলি। এটাও কি এখন নিষিদ্ধ?”
“তবুও, আপনি সাবধান হন,” মমতা বলল। “আমি কিছু নারীদের সাথে কথা বলেছি। তারা বলেছে, আখড়ার পাশে দাঁড়াবে।”
চান ফকির মাথা নাড়লেন। “সাহস একা এলেও হয়, কিন্তু যখন ভালোবাসা সঙ্গে আসে, তখন তা একেকটা পাহাড়ের মতো দৃঢ় হয়।”
ততক্ষণে বাউল লোকটা, যাকে সকলে ‘নামহীন’ বলে ডাকা শুরু করেছে, আখড়ার বাঁশি বাজাতে শুরু করেছে। তার সুরে যেন এক ধরনের প্রাচীনতা, যেন সেই সুর একশো বছর ধরে কোনো বৃক্ষের গায়ে লুকানো ছিল, আজ সে প্রকাশ পাচ্ছে।
তার গান শুনে গ্রামের কিছু ছেলে-মেয়ে ছুটে এল। তারা বসে পড়ল উঠোনে। কেউ কেউ মোবাইলে ভিডিও করছিল। শহর থেকে আসা এক সাংবাদিকও ক্যামেরা হাতে উঠোনের কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, “এই আখড়ার বিরুদ্ধে যদি কোনো পদক্ষেপ নেয় প্রশাসন, আমি সেটা মিডিয়ায় তুলব। মানুষ জানবে, এখানে কী হচ্ছে।”
কিন্তু সেই সাংবাদিকের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল একজন অচেনা যুবক, চোখে কালো চশমা, গলায় জারি গামছা। সে তার ফোনে কিছু ছবি তুলছিল কিন্তু তার চোখের দিকে তাকালে বোঝা যাচ্ছিল—সে কোনো গল্প খুঁজছে না, বরং কোনো ছিদ্র খুঁজছে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই চেয়ারম্যান সাইফুল হাজির হলেন দুই পুলিশ নিয়ে। তাঁর মুখে রাগ আর বিরক্তি, যেন কোনো পাপিষ্ঠ কাজ দেখতে এসেছেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, “এইটা কি বাড়ি? নাকি সার্কাসের মাঠ? গানের নাম করে অশান্তি ছড়াইতেছেন!”
চান ফকির উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনার আসা আমার কাছে সৌভাগ্য। আমি তো চাই এই জায়গা সবাই দেখুক, বুঝুক—ভালোবাসা কীভাবে হৃদয় পাল্টায়।”
চেয়ারম্যান বললেন, “ভালোবাসার নামে ধর্মভ্রষ্টতা চলবে না। হুজুর সাহেব বলছেন, এখানে শয়তানি চালনা হয়।”
“হুজুর সাহেবের চোখ আছে, কিন্তু কান কি আছে?” বাউল বলে উঠল হঠাৎ। “শুনতে পায় না তিনি কিভাবে একটা বাচ্চা ছেলের ভয় গান দিয়ে ঘোচে?”
চেয়ারম্যান চটে গেলেন। “তুমি কে? নাম কী তোমার?”
বাউল মৃদু হেসে বলল, “নাম দিলে মানুষ দাগ দেয়। আমি শুধু হাওয়া।”
চেয়ারম্যান তখন পুলিশকে বললেন, “ঘরটা তালাবদ্ধ করে দাও। আজ থেকে এই আখড়া বন্ধ।”
চান ফকির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। “এই ঘর আমার নয়। এটা ওদের, যারা বঞ্চিত। যারা প্রেমে মরেছে। যারা গানকে বিশ্বাস করেছে। আপনি যদি তালা দেন, তাদের বুকেও তালা পড়ে যাবে।”
পুলিশ দ্বিধায় পড়ে গেল। আখড়ার লোকজন তখন চারদিক থেকে এগিয়ে এল। মমতা খাতুন বললেন, “আমরা এখানেই থাকব। যদি দরজা বন্ধ হয়, তবে উঠোনেই বসব। গান বন্ধ হবে না।”
চেয়ারম্যান তখন কিছু বলার আগেই সাংবাদিক সামনে এসে বলল, “আপনি কি সত্যিই চাচ্ছেন আমরা শিরোনাম করি: ‘ভালোবাসার আখড়ায় তালা’?”
সাইফুল চেয়ারম্যান থেমে গেলেন। সাময়িক বিরতি। তারপর বললেন, “ঠিক আছে। এখনই কিছু করছি না। তবে রিপোর্ট যাবে প্রশাসনে।”
চেয়ারম্যান চলে গেলেন, পুলিশও পিছু হঠল। কিন্তু সেই অচেনা যুবক দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে ছিল কৌতূহল, আর মুখে এক রহস্যময় হাসি।
সন্ধ্যায় আবার ধুনুচি জ্বালানো হল। বাউল গাইল তার নতুন গান—
“আলো যদি মোর চোখে না আসে,
তবু তোর নামে বাঁচি বাসে।”
সেই রাতে জামিল ঘুমোবার আগে ফকিরকে জিজ্ঞেস করল, “চাচা, আখড়া যদি সত্যিই বন্ধ করে দেয়?”
ফকির বলল, “আখড়া একটা জায়গা না জামিল। এটা তোদের হৃদয়। যদি এই উঠোন চলে যায়, তোরা কোথাও বসে গাইবি, কাঁদবি, আবার উঠবি। কারণ ভালোবাসা বন্দি হয় না। সে কেবল রূপ পাল্টায়।”
রাত বাড়তেই আবার কুয়াশা নেমে এল। বাতাস ভারী, আকাশে মেঘ জমা। যেন কিছু একটার অপেক্ষা।
আর আখড়ার গায়ে একটা ছায়া ক্রমে ঘনীভূত হতে থাকল — অন্ধকারের ছায়া, ভয় আর সাহসের টানাপোড়েনের ছায়া।
পর্ব ৫: লুকিয়ে থাকা নামগুলো
রাতটা আবারও অস্বাভাবিক ছিল। যেন চারপাশ নিঃশব্দে জমে থাকা এক প্রতিবাদে ভরে উঠেছিল। আখড়ার ধুপ জ্বলছিল, কিন্তু সেই ধোঁয়া আজ যেন সোজা আকাশে না গিয়ে নিচে নেমে এসে মানুষের শরীর ছুঁয়ে থাকছিল। জামিল ঘুমোতে পারেনি। চাঁদের আলো ছিল না, কেবল একটা কুয়াশার ঘেরাটোপ ঘিরে রেখেছিল আখড়ার উঠোনকে। হঠাৎ মাঝরাতে সে কানে পেল কিছু চাপা গুঞ্জন, যেন কারা যেন কথা বলছে উঠোনের পেছনের তুলসী গাছটার কাছে।
সে উঠে গিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল — সেই অচেনা যুবক, যে দিনের বেলায় ছবি তুলছিল, এখন আখড়ার পিছনের ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে বাউল লোকটার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলছে। বাউল কিছু বলছিল না, শুধু মাথা নিচু করে শুনছিল। হঠাৎ সে মাথা তোলে আর বলে, “তুমি যদি সত্যি জানতে চাও, তবে গান নয়, নিরবতা শোনো।”
তারপর হেঁটে চলে গেল ঘরের দিকে। আর ছায়া ঘেরা সেই যুবক দাঁড়িয়ে রইল একা, গলার নিচে হাত বুলিয়ে। কিছু একটা গোপন রেখেছে সে, জামিল ঠিক বুঝতে পারল না।
পরদিন সকালেই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আখড়ার উঠোনে বসে মমতা খাতুন আর কয়েকজন মহিলা ধুনুচি তৈরি করছিল। হঠাৎ একজন বলল, “এই যে, জামিল কোথায়? ওকে তো আজ সকাল থেকেই দেখছি না!”
চান ফকির তখন গাছতলায় বসে গুনগুন করছিল। জামিলের নাম শুনেই তিনি চোখ মেললেন, উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “তাকে খুঁজতে হবে। আজ আখড়ার ভরসা তার চোখে।”
চারদিকে খোঁজ শুরু হল। কেউ খালের ধার দেখল, কেউ হাটের পেছনের পুকুরে। কোথাও জামিল নেই। হঠাৎ বাউল বলল, “আমি দেখেছি, সে গতরাতে আমার ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিল। হয়ত কিছু শুনেছিল।”
চান ফকির চিন্তায় পড়ে গেলেন। “তাহলে সে হয়তো কিছু জানে। কিন্তু কোথায় গেল? নিজে কোথাও যাবে না সে, যদি না কেউ তাকে ডাকে।”
ঠিক তখনই এক ছেলেমেয়ে দৌঁড়ে এসে বলল, “পূর্বদিকের বাঁশবনের পাশে একটা লাল গামছা পাওয়া গেছে, জামিলের মত লাগছে!”
চান ফকির, বাউল, মমতা খাতুন আর সোনা দাস দৌঁড়ে গেল সেইদিকে। বাঁশবনের ভেতর সত্যিই একটা গামছা পড়ে আছে। আর একটু ভেতরে গিয়ে দেখা গেল জামিল বসে আছে এক পুরোনো পোড়োবাড়ির ভেতরে, চুপচাপ।
চান ফকির ছুটে গিয়ে বলল, “কিরে জামিল, এখানে কেন?”
জামিল মুখ তুলে বলল, “চাচা, আমি যা দেখেছি, সেটা আমি কাউকে বলতে পারব না।”
“তুই যদি না বলিস, তাহলে এই আখড়া বোবা হয়ে যাবে,” চান ফকির বললেন।
জামিল চোখ ভেজা গলায় বলল, “আমি দেখেছি, কাল রাতে সেই অচেনা লোকটা বাউল চাচার সঙ্গে গোপনে কথা বলছিল। ও বলছিল, ‘তোমার নাম যদি প্রকাশ পায়, এই আখড়া পুড়িয়ে দেবে লোকজন।’ আমি বুঝতে পারিনি, কিন্তু এখন বুঝি—এই বাউল চাচা কে জানেন আপনি?”
চান ফকির তাকালেন বাউলের দিকে। বাউল তখন নির্লিপ্ত মুখে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি যাকে খুঁজতে এসেছিলাম, সে জামিল না, সে তুমিই।”
“আমি?” ফকির চমকে উঠলেন।
বাউল ধীরে ধীরে বলল, “তুমি কায়েস চৌধুরী, এক সময়ের জমিদার, যিনি সব ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন। আর আমি—আমি তোমার ভাই, মঈন চৌধুরী। আমি তোমার হারানো সুর। তুমি যে আখড়া তৈরি করেছ, সেটা আমার স্বপ্ন ছিল একদিন, যা তুমি ছিনিয়ে নিয়েছিলে আমার কাছ থেকে।”
সকলের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মমতা খাতুন চমকে তাকাল, সোনা দাস ফিসফিস করে বলল, “ভাই?”
চান ফকির থমকে গেলেন। তাঁর মুখ সাদা হয়ে গেল। “তুই… মঈন? তুই তো হারিয়ে গিয়েছিলি…।”
“না ভাই,” মঈন বলল। “আমি হারাইনি। আমি শুধু দেখছিলাম, কিভাবে তুমি নিজের পথ খুঁজো। আমি জানতাম, তুমি একদিন প্রেম খুঁজবে—কিন্তু জানতাম না, তুমি সেটা এমনভাবে খুঁজবে যে নিজেকে মুছে ফেলবে।”
জামিল এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তাহলে আপনারা ভাই?”
মঈন এগিয়ে গিয়ে জামিলের কাঁধে হাত রাখল। “তুই-ই আমার ভাই জামিল। আমি তোদের মধ্যেই খুঁজছিলাম আমার স্বর।”
চান ফকির কেঁপে উঠলেন। তার মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল, “তাহলে… তুই যদি আজ থেকে এখানে থাকিস, তবে আমি এখানে আর গান গাইতে পারব না।”
“না ভাই,” মঈন বলল। “আমি এসেছি শোনাতে নয়, শিখতে। তোদের সাহস, তোদের গান, তোদের ভালোবাসা—সব কিছু আমি শিখতে চাই। আমার অতীত ভুলিয়ে দাও, আমাকে একজন সাধারণ বাউল হিসেবেই রাখো।”
সেদিন সন্ধ্যায় আখড়ার উঠোনে আরেকটা নতুন গান উঠল। মঈন আর সোনা দাস একসঙ্গে গাইল—
“ভাই রে, ভাই হারায়া খুঁজি যতবার,
তোরে পাই মনের আঁধারে বারংবার।
আখড়ার আগুনে পুড়ে খুলি দরজা,
ভালোবাসা শিখি, রাখি না রাখি সাজা।”
মানুষজন তালি দিল। মমতা চোখ মুছল, আর জামিল একটা নতুন ধুপ ধরাল। তার চোখে এখন ভয় নেই। কারণ সে বুঝে গেছে — আখড়া শুধু একটা জায়গা না, এটা একটা সত্য, একটা সম্পর্ক, যা সময়ের চেয়েও প্রাচীন, আর আগুনের চেয়েও গভীর।
আর সেই অচেনা যুবক? সে সেইদিন রাতে শহরে ফিরে গেল। আর কেউ তাকে দেখেনি। কেউ জানল না, সে কে ছিল। শুধু তার ফেলে যাওয়া মোবাইল থেকে একদিন কিছু ছবি ফাঁস হল—আখড়ার, গান গাওয়ার, ধুপ জ্বলার, আর মায়ায় ভরা মুখগুলোর। আর সেই ছবিগুলোর নিচে লেখা ছিল—
“ভালোবাসা জেগে থাকে ধূপের ছায়ায়।
আখড়া পুড়লেও সুর নিভে না।”
পর্ব ৬: আগুনের নিচে বীজ থাকে
সেই রাতে আখড়ার উঠোন যেন পূর্ণিমার আলোয় ভেসে গেল, অথচ সে রাতে চাঁদ ছিল না। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে একটা অপার্থিব আলো যেন গড়িয়ে পড়ছিল আখড়ার প্রতিটি কোণায়। গান চলছিল না, সুরও নয়—ছিল নিঃশব্দ এক আত্মপ্রকাশ। সবার মুখে যেন একটাই ভাব—আমরা কে? আমরা কেন এখানে?
চান ফকির এক কোণে বসে, কাঠের লাঠিটা কোলে নিয়ে গভীর চেতনায় ডুবে ছিলেন। তাঁর সামনে বসে মঈন—ছোট ভাই, বাউল, সহযাত্রী—চোখ নামিয়ে রেখেছেন। সোনা দাস আর মমতা খাতুন একপাশে দাঁড়িয়ে, যেন এক চিরন্তন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে চোখে চোখে।
“তুমি কি আমাকে ক্ষমা করেছ, ভাই?” চান ফকিরের গলা নরম, ভাঙা।
“ক্ষমা তো তাদেরই করা যায় যারা ভুল করেছে ইচ্ছায়। তুমি তো শুধু খুঁজছিলে,” মঈন বলল। “তবে সেই খোঁজে তুমি আমাকেও হারিয়ে ফেলেছিলে। তাই আমি এসেছিলাম মনে করাতে—তোমার যাত্রা একা ছিল না।”
জামিল সেই মুহূর্তে এক পাটি ধুপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। সে মাটিতে রেখা টানছিল আবার—যেমন করেছিল সেই রাতে আগুন আটকে। এবার সে রেখাটা টানছিল ভাইয়ের চারপাশে, দুই অস্তিত্বের মাঝে। যেন এঁকে দিচ্ছিল সম্পর্কের অদৃশ্য মানচিত্র।
তবে সেই নিঃশব্দ রাতে, দূরে, অন্ধকারের ভিতরে, কিছু অশুভ চোখ জ্বলছিল। হাটের দিক থেকে গ্রামের কিছু প্রভাবশালী মানুষ—হুজুরের অনুসারী, চেয়ারম্যানের গুপ্তচর, আর এক অন্ধকারমুখো উকিল—আলাপ করছিলেন কীভাবে আখড়া ভাঙা যায়।
“এইবার তো দুই ভাই,” একজন বলল।
“আরও বিপজ্জনক। গানের নামে দুই চৌধুরী এখন লোকনেতা হইছে,” আরেকজন যোগ দিল।
“ধর্মের নামে আইন আনা হোক,” তৃতীয়জন বলল। “আর ছবি-ভিডিও? হঠাও। শহরের মিডিয়া যদি বুঝে ফেলে, আমাদের দখল শেষ।”
পরদিন সকালে সেই পরিকল্পনা রূপ নিতে শুরু করল। আখড়ার আশপাশে পোস্টার লাগানো হল—
“ধর্ম অবমাননাকারী আখড়া—প্রতিরোধ চাই”
“তন্ত্র-মন্ত্র আর কুসংস্কারে গ্রামের ছেলেমেয়েদের বিপথে চালনা”
চান ফকির সেই পোস্টার হাতে নিয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ছিঁড়ে ফেললেন না। বরং মাটিতে রাখলেন ধুপের পাশে। বললেন, “যে আগুন পুড়ায়, সে কখনো গন্ধ দেয় না। তবে আমরা যদি ফুল হই, পুড়েও সুবাস ছড়াব।”
মঈন বলল, “তুমি কি এখনো গান গাইবে?”
ফকির বলল, “না। আজ আমি শুনব।”
সেই রাতে আখড়ায় বসেছিল এক বিশাল জমায়েত। গ্রাম, পাশের গ্রাম, শহর থেকে আসা কিছু লোক, এমনকি কিছু প্রতিবাদী তরুণী যারা সমাজে প্রশ্ন তোলে। আখড়ার উঠোন ভর্তি মানুষ—কারও হাতে তাল, কারও হাতে বাচ্চা, কারও চোখে জ্বলজ্বলে অভিমান।
সোনা দাস গলায় তান তুলল, মঈন একতারায় টান দিল, আর জামিল প্রথমবারের মতো একাই গাইল—
“মাটির গায়ে আগুন লাগে,
ভালোবাসা তাও ভাঙে না।
যে গান ছিল হারানো কালে,
আখড়ায় আজ জাগে না?”
সেই সুর যেন অন্ধকার চিরে চলে গেল বহুদূর। ঠিক সেই মুহূর্তে, হাটের দিক থেকে একদল মানুষ ঢুকল লাঠি, বাঁশ, কেরোসিন আর গাঁজপোড়া মন নিয়ে। তারা চিৎকার করে উঠল, “এই আখড়া শয়তানের, এই গান ধ্বংসের! আগুন দাও!”
কেউ কেউ ঘাবড়ে গেল, কিন্তু মমতা খাতুন, জামিল, আর আখড়ার মেয়েরা উঠে দাঁড়াল। কেউ ছুটে গিয়ে তুলসী গাছকে জড়িয়ে ধরল, কেউ ধুপ হাতে এগিয়ে গেল আগুনের সামনে।
চান ফকির এবার উঠে দাঁড়ালেন। “আগুন লাগাবে? লাগাও। কিন্তু মনে রেখো, আগুনে ফুল পুড়ে যায়, কিন্তু তার বীজ থেকে গাছ হয়। আমরা সেই বীজ।”
মঈন এগিয়ে এল, লাঠি ছুঁয়ে বলল, “যদি আমাদের পোড়াও, তবে আমাদের ছায়ারাও প্রতিবাদ করবে।”
তখনই একটি বাচ্চা ছেলে, গ্রামেরই কেউ, চিৎকার করে বলল, “আম্মু, ফকির চাচা আমার বাবাকে বাঁচাইছিল। ওরে মাইরো না!”
লোকগুলো থেমে গেল এক মুহূর্ত। চেয়ারম্যানের লোকেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ভেতরের এক দোলাচল। তারপর কেউ একজন বলল, “চলো। এখন না। পরে দেখা যাবে।”
তারা চলে গেল। তবে সেই আগুন না লাগলেও, ছায়া রেখে গেল।
সেই রাতে আখড়ায় সবাই একসঙ্গে বসে রইল। কেউ গান করল না, কেউ কথা বলল না। কেবল একে অপরের পাশে বসে থাকল—এই নিরবতাই ছিল প্রতিবাদ, এই সহাবস্থানে ছিল বিপ্লব।
চান ফকির বললেন, “আগুন আমাদের শত্রু নয়, সে তো পরীক্ষা। আজকের রাতের মতো আমরা পাশ করেছি। তবে আগামীকালের জন্য, আমাদের ভিতরেই বীজ বুনতে হবে।”
জামিল জিজ্ঞেস করল, “কী বীজ, চাচা?”
ফকির হেসে বলল, “ভয়হীন ভালোবাসার। গান যার জড়তা কাটায়। যে ভয় নয়, প্রশ্ন জাগায়।”
পর্ব ৭: যার গান রইল ধূপে ঢাকা
সকালের আলোটা আজ আরামদায়ক ছিল না। পাখিরা ডাকছিল বটে, কিন্তু যেন হঠাৎ চুপ করে যাচ্ছিল মাঝপথে। গ্রামের মেঠো পথে মানুষজন হাঁটছিল ঠিকই, তবে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছিল না। যেন আখড়ার গায়ে গতর বেয়ে যে আগুন নামেনি, তার ধোঁয়ায় চোখ জ্বালছিল এখনো।
আখড়ার উঠোনে আজও ধূপ জ্বলছিল, জামিল হাতে ধুনুচি নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাতাসে ধোঁয়া ছড়িয়ে দিচ্ছিল। তার মুখে একরাশ তীব্র একাগ্রতা—সে যেন কোনো অনুশীলন করছে নিজেকে ভিতর থেকে শক্ত করে তোলার। সে জানে, এই আখড়ার একটা একান্ত দৃষ্টিপাত এখন তার দিকে। সে শুধু কোনো শিষ্য নয়, সে হয়ে উঠছে এক ভবিষ্যৎ।
মঈন গলায় একতারা ঝুলিয়ে তুলসী গাছের ছায়ায় বসেছিল। হঠাৎ সুর ছুঁয়ে ফেলল তার আঙুল, তারপর ঠোঁট, তারপর বুক। সে গেয়ে উঠল নিচু গলায়—
“ধূপের মাঝে কাঁদে যে গান,
তুই শুনিস কি তার প্রাণের টান?
আলো দিয়ে ঢাকে যে ভয়,
তারে ভালোবাসা বলে কয়?”
এই গানের মধ্যে ছিল অদ্ভুত এক যন্ত্রণার ধ্বনি, যেন কেউ একা বসে প্রার্থনা করছে এমন এক ঈশ্বরকে যে বহুদিন ধরা দেয় না।
চান ফকির চুপ করে সেই গান শুনলেন। তারপর চোখ বন্ধ করে বললেন, “ভাই, আজ তোর গলায় যে সুর শুনলাম, তা বহুদিন পর আত্মায় বাজল। মনে হচ্ছে তুই আর আমি, দুই সুরের দুই রেখা, একাকার হয়ে যাচ্ছি।”
মঈন হালকা হেসে বলল, “তুই যে আমাকে জায়গা দিলি, সেইটুকুই যথেষ্ট। আমি শুধু চেয়েছিলাম তুই বুঝিস—আমি হারাইনি, আমি ছিলাম। আমাদের মাঝে যে দূরত্ব ছিল, তা সময়ের ছিল, মনেও নয়।”
ঠিক তখনই আখড়ার বাইরে শব্দ উঠল। হাট থেকে কিছু লোক ছুটে এসে বলল, “ফকির ভাই, শহরের পত্রিকায় তোমাদের আখড়ার ছবি ছাপা হইছে! লেখাও আছে—‘প্রেমের বিপ্লব গানের ধোঁয়ায়’। আপনারা বিখ্যাত হইয়া গেছেন!”
মমতা খাতুন খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে আখড়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে জামিল ধুনুচি হাতে ধোঁয়া দিচ্ছে, পাশে চান ফকির আর মঈন একসঙ্গে বসে গাইছে, পেছনে গ্রামের নারীরা প্রার্থনায়।
এই চিত্রটা ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত। পরদিনই শহর থেকে একদল মানুষ এল। কেউ সমাজকর্মী, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ সাংবাদিক, কেউ আবার সাধারণ মানুষ, যারা জানতে চায়—এই আখড়ায় ঠিক কী ঘটে!
তারা এসে বসে পড়ল উঠোনে। এক তরুণী বলল, “আমি শুনেছি, এখানে ধর্মভিত্তিক নয়, হৃদয়ভিত্তিক সংগীত হয়। এটা কীভাবে সম্ভব?”
চান ফকির বললেন, “ধর্ম মানুষ তৈরি করে নিজস্বতায়, কিন্তু প্রেম জন্ম নেয় অন্তরে। আমরা বিশ্বাস করি, শব্দের আগে ভালোবাসা—তবেই তা সুর হয়।”
একজন তরুণ ছেলেও প্রশ্ন করল, “এই ভালোবাসা কি সমাজ বদলাতে পারে?”
মঈন বলল, “যদি গান পারে মানুষ কাঁদাতে, তবে গানই পারে সমাজ বদলাতে। আখড়ার গান তো স্রেফ আনন্দ নয়, এটা প্রতিবাদ, এটা প্রস্তাব।”
শহর থেকে আসা মেয়েটা তখন আখড়ার চারপাশে ঘুরে বলল, “এই জায়গাটা আসলে একটা বিশ্ববিদ্যালয়, তাই না? এখানে শিক্ষার ভাষা গান।”
চান ফকির হেসে বললেন, “তুমি বুঝেছো। তবে আমাদের ডিগ্রি নাই, আমাদের আছে ধুপে লেখা ইতিহাস।”
সে রাতে উঠোনে যেন উৎসব। সবাই খেয়ে-দেয়ে গুনগুন করে গান গাইছে। জামিল এবার প্রথমবার নিজেই সুর তুলল। সে গাইল—
“আখড়ায় আগুন লাগেনি, তবু ধোঁয়া চারিদিকে,
ভালোবাসা লেখা ছিল এক কাঁপা কাঁপা ধূপের টিকে।
আমি কাঁদি না আর, হাসি না আর,
আমি শুধু গাই—কারণ এইটাই আমার সৎকার।”
মানুষজন স্তব্ধ হয়ে গেল। মঈন ফিসফিস করে বলল, “এই ছেলেটা আমাদের উত্তরসূরি।”
চান ফকির বললেন, “না, সে শুধু উত্তরসূরি নয়। সে হল আমাদের ভবিষ্যতের কবি। তার গলায় যদি আগুন নামে, তাহলে জানবি, সেই আগুনে ফুল ফোটে।”
আখড়ার গায়ে আবারও ছায়া পড়ল ঠিক তখনই, যখন চেয়ারম্যান সাইফুল তার পুরোনো বন্ধু, হুজুর সাহেবকে নিয়ে এক গোপন সভা ডাকল। শহরের মিডিয়ায় আখড়ার প্রশংসা দেখে তাদের ভিতরে আগুন লাগল।
“এদের থামাতে না পারলে আগামী নির্বাচনে হেরে যাব,” সাইফুল বলল।
“শুধু গান নয়, এরা মন নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। মেয়েরা এখন মসজিদের পরিবর্তে আখড়ায় আসে,” হুজুর বললেন।
তারা ঠিক করল—এইবার সরাসরি প্রশাসনের চাপে তালা দেওয়া হবে আখড়ায়। গান আর ধূপ নয়, কেবল আইন।
এদিকে আখড়ায় যেন কেউ টের পাচ্ছে এসব। না বলা আশঙ্কা জমে উঠছে জামিলের চোখে, মমতার স্পর্শে, সোনা দাসের গলায়। অথচ কেউ কিছু বলছে না। তারা জানে, এক রকম যুদ্ধ আসছে—তবে তলোয়ারে নয়, তালায়।
চান ফকির সেই রাতে মাটিতে শুয়ে শুয়ে তার কাঠের লাঠিটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। চোখে একফোঁটা জল এসে পড়ল। বললেন, “আরে বেটা, তুই তো এতদিন আমার ভরসা ছিলি, এবার তোরাই বল, আমি কী করব? আখড়ার গান যদি বন্ধ হয়, তোদের কী বলব?”
লাঠি তো চুপ, কিন্তু তার ধারে যেন একটা আলো খেলে গেল।
জামিল তখন দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। সে মনে মনে বলল, “চাচা, যদি আইন আসে, আমি দাঁড়াব। আমি শিখেছি এই আখড়ায় কিভাবে ভয় জয় করে, গান দিয়ে আগুন নিভিয়ে দেয়।”
পর্ব ৮: তালাবদ্ধ আকাশের নিচে
সকালের আলো আখড়ার উঠোনে যেন আর ঢুকতে চাইছিল না। রোদ ওঠে, পাখি ডাকে, কিন্তু সেই গানে আগের মত প্রাণ নেই। যেন প্রকৃতিও আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তালা পড়ার গুঞ্জন কাল থেকেই হাওয়ায় ছিল, আর আজ সকালে খবর এল—উপজেলা থেকে লোক আসবে, সরকারি আদেশে আখড়া বন্ধ করতে।
মমতা খাতুন চোখে জল নিয়ে ধুপ সাজাচ্ছিলেন। সোনা দাস গলায় সুর তুলেও থেমে যাচ্ছিল বারবার।
চান ফকির বারান্দায় বসে, কাঠের লাঠিটা হাতে, গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলেন। তাঁর চোখে কোনো রাগ নেই, ভয় নেই—শুধু একটা নিরব অথচ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। পাশে দাঁড়িয়ে মঈন বলল, “ভাই, তালা দিলে আমরা কোথায় যাব?”
চান ফকির বললেন, “আকাশে কেউ তালা দিতে পারে না, মঈন। গানও তো আকাশের সন্তান।”
মঈন চুপ করে রইল।
ঠিক তখনই জামিল ছুটে এল। তার চোখ উজ্জ্বল, মুখে রক্ত জেগেছে।
“চাচা, হাটে খবর ছড়িয়েছে—আখড়ার গান বন্ধ হবে। কিন্তু গ্রামের ছেলেমেয়েরা বলে, তারা গাইবে। আজ দুপুরে সবাই আসবে আখড়ায় দাঁড়াতে।”
চান ফকির হেসে বললেন, “তবে তো তালা দেওয়া হবে না। কারণ একটা ঘর বন্ধ হয়, যদি কেউ ভেতরে না থাকে। কিন্তু যদি হৃদয়ে থাকে সেই আখড়া, তখন তালা কেবল লোহার খাঁচা।”
জামিল দৌড়ে চলে গেল বাকি প্রস্তুতির জন্য। সে আজ আর কেবল ছোট্ট ছেলেটি নয়—সে আখড়ার মুখপাত্র, সে বিশ্বাসের দীপ্ত চেহারা।
দুপুর গড়াতে শুরু করল। গ্রামের প্রায় তিনশো মানুষ এসে জড়ো হল আখড়ার চারপাশে। কেউ উঠোনে বসেছে, কেউ তুলসী গাছ ঘিরে ধূপ জ্বালাচ্ছে, কেউ গলা খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শহর থেকে আসা সেই সাংবাদিক তরুণীও এল, ক্যামেরা হাতে, গলায় প্রশ্ন আর চোখে মুগ্ধতা।
“আপনারা জানেন আখড়ায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তবু গান করবেন?” সে জানতে চাইল মমতা খাতুনের কাছে।
“হ্যাঁ,” মমতা শান্ত গলায় বললেন। “কারণ এই আখড়ায় আমি কান্না ভুলেছি। এই জায়গা আমায় ফিরিয়েছে মানুষ হিসেবে।”
সোনা দাস এসে বলল, “যদি গানেই তালা পড়ে, তবে কণ্ঠই আর দরকার নাই। তখন তো আর বাঁচা মানেই বেঁচে থাকা না।”
একদিকে প্রশাসনের গাড়ি এসে থামল। এক যুবক কর্মকর্তা নেমে এলেন। চোখে সানগ্লাস, হাতে ফাইল, সঙ্গে দুই পুলিশ।
“এই আখড়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে—ধর্মের অপব্যাখ্যা, সমাজে বিভ্রান্তি। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আজ থেকে এই স্থাপনা বন্ধ করা হবে।”
জানাজানি হয়ে গেল চারদিকে।
চান ফকির উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কণ্ঠ পরিষ্কার, শান্ত—তবে শব্দে ছিল এক অনতিক্রম্য জোর।
“আপনারা যদি জায়গা বন্ধ করতে চান, করুন। কিন্তু মানুষের বিশ্বাস বন্ধ করা যায় না। আমরা গান গাই, কারণ সেটা আমাদের দুঃখের ভাষা। যদি এখানে গান চলা অপরাধ হয়, তবে আমি সেই অপরাধের মূল।”
লোকজন চিৎকার করে উঠল, “না! ফকির ভাইয়েরে তুইলা লইন যাবেন না! এই আখড়া আমাদের প্রাণ!”
পুলিশ একটু পিছিয়ে এল। অফিসার তবু কণ্ঠ শক্ত করলেন।
“আপনাদের যা বলার, উপরের অফিসে বলবেন। আজ তালা পড়বেই।”
তখনই জামিল এগিয়ে এল, সামনে দাঁড়াল, বলল,
“তালা দিন, কিন্তু আমরা গান থামাব না। আমরা উঠোনে বসে গাইব, পুকুরপাড়ে বসে গাইব, হাটে গাইব, খালে বসে গাইব। গান কি আর জায়গার অধীন?”
পুরো উঠোনে সাড়া পড়ে গেল। কেউ কেউ তালি দিল, কেউ ধুপ উঁচিয়ে ধরল।
হঠাৎ শহর থেকে আসা সেই সাংবাদিক মেয়েটা ক্যামেরা চালু করে বলল,
“আজ ইতিহাস হচ্ছে বরিশালের ময়নায়। সরকার চায় চুপ করাতে, আর মানুষ গাইতে চায়। এই সংঘাত গানের ভাষায়।”
কর্তা চুপ করে গেলেন। তারপর সোজা এগিয়ে গিয়ে একটা লাল সিলিং কাগজ মাটির ঘরের দরজায় লাগিয়ে দিলেন—“অস্থায়ীভাবে বন্ধ”
লোকজন স্তব্ধ।
তবে ঠিক তখনই মঈন গলায় একতারা তুলে বললেন,
“আজ গান হবে উঠোনে। দরজায় তালা থাকলেও, আকাশ তো খোলা!”
তিনি গেয়ে উঠলেন—
“তালায় যদি বেঁধে রাখো,
সুর পাখি হবে হাওয়া,
যতবারই থামাও বুকে,
গান ততবার গায় চাওয়া।”
চান ফকির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই গান শুনলেন, মুখে একটুও হতাশা নেই। কেবল এক আশ্চর্য শান্তি, যেন তিনি ঠিক জানতেন—এইটুকুই ছিল এই আখড়ার ভবিতব্য।
তিনি মাথা নিচু করে বললেন,
“ধর্ম যদি দেয় গাইবার অধিকার, সমাজ যদি দেয় ভালোবাসার ঠাঁই, তবে এই আখড়া আবার গড়ে উঠবে। আজ তালা পড়ুক, কাল দরজা খুলবে মানুষ আপন হাতে।”
জামিল আস্তে করে তার কাঠের লাঠিটা এনে তাঁর হাতে দিল।
চান ফকির বললেন, “আজ থেকে এই লাঠিটা তোর, জামিল। গান যদি নিভে যায়, তুই জ্বালাবি ধূপ।”
জামিল সেই লাঠি ধরে, আর কিছু না বলে কেবল মাথা নিচু করল। তারপর সোজা উঠে দাঁড়াল, উঠোনের মাঝখানে গিয়ে বলল,
“সবাই একবার গান ধরো। তালা যদি গানে পড়ে, তবে তালা ভাঙা শুরু হোক সুর দিয়ে।”
আর সেই মুহূর্তে উঠোন জুড়ে ভেসে উঠল এক ভয়শূন্য প্রতিবাদের সুর—
“ধর্ম নয়, প্রেমে মিশি,
গানের মাঝে জীবন লিখি।
তালা যদি হোক আকাশে,
আমরা গান গাই নিরাশে।”
গান চলল, ধূপ চলল, আর বাতাসে এক নিরবতাভাঙা চিৎকার ছড়িয়ে গেল—
“আখড়া বন্ধ হয় না,
আখড়া বাঁচে মানুষের ভালোবাসায়।”
পর্ব ৯: তালার ওপারে যে আলো জ্বলে
তালা পড়ে যাওয়ার পরের সকালটা যেন এক অদ্ভুত রকম শান্তিতে ভরা ছিল, ঠিক যেমন ঝড়ের পরে গাছপালারা নিঃশব্দে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, কিংবা বৃষ্টির পরে ভিজে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটির ভেতর জমে থাকা কৌতূহল। আখড়ার মাটির ঘরের দরজায় লাল কালি দিয়ে লেখা সেই সিলিং কাগজ এখন গ্রামের আলোচনার কেন্দ্র। কেউ বলছে ভালো হয়েছে, শৃঙ্খলা ফিরবে। আবার কেউ কাঁদছে, বলছে—“ভালোবাসার ঠিকানায় তালা দেয়ার অধিকার কার?”
মমতা খাতুন সকাল থেকেই উঠোনে বসে তুলসী গাছের গোড়ায় জল দিচ্ছিলেন। তাঁর মুখে কথা নেই, চোখে ক্লান্তি, কিন্তু হাত থামেনি। যেন কাজের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখছেন। তাঁর পাশে বসে আছে জামিল, হাতে ফকির চাচার কাঠের লাঠি। লাঠির উপর তার হাতের স্পর্শ নরম, কিন্তু মুঠো শক্ত।
সে হঠাৎ বলল, “মা, তুমি কি বিশ্বাস করো গান একদিন ফিরে আসবে এই ঘরে?”
মমতা থেমে তাকালেন। তারপর বললেন, “তুই বিশ্বাস করলে গান ফিরবেই। আখড়ার দরজা বন্ধ হলেও, যদি তোদের বুক খোলা থাকে, তবে গান ঘুরে ফিরে ঠিক ঢুকে পড়বে ভেতরে।”
চান ফকির তখন উঠোনের এক কোণায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। চোখে চশমা নেই, কিন্তু দৃষ্টি পরিষ্কার। আজ তাঁর মনে হচ্ছিল, এই তালা আসলে বাইরের নয়—এটা একটা ভেতরের তালা, যা ভাঙা দরকার নিজের মধ্যেই।
মঈন একতারা হাতে পাশে এসে বসে বলল, “ভাই, গান এখন তো বাইরে গাইতে পারি। উঠোনে। তালা কি আমাদের সুর আটকে রাখতে পারে?”
চান ফকির হালকা হাসলেন, “না পারে না। তবে তালা মানুষের ভয় বাড়ায়। ভয় বাড়লে গান কমে যায়। আমাদের কাজ এখন ভয় কাটানো, সুর দিয়ে।”
এই সময়েই ঘটল একটা ঘটনা। দুপুরে হাটের দিকে গিয়ে গ্রামের কয়েকজন ছেলে দেখতে পেল—কোনো এক রাতে সেই তালার উপর কেউ একটা চিঠি গুঁজে দিয়ে গেছে। তাতে লেখা—
“এই আখড়ায় প্রথম প্রেম পেয়েছিলাম, আজ সে বন্ধ। কিন্তু প্রেম কি ঘরে থাকে? আমি আবার গাইব। যদি দরজা না খোলে, আমি জানালা হব।”
সই—অজ্ঞাত বাউল
এই চিঠি এক ঢেউ তুলল আখড়ার ভেতর। জামিল ছুটে গিয়ে সেই কাগজ পড়ে ফেলল। তার চোখ জ্বলছিল। সে বলল, “চাচা, এই বাউল কি আমাদেরই কেউ?”
চান ফকির বললেন, “না, সে আমাদেরই নয়, তবে আমাদের ভাবনার অংশ। এই আখড়ার জন্ম হয়েছে অনেকের চোখে, কানেও নয়—চেতনায়। এই চিঠি সেই চেতনার প্রমাণ।”
দুপুরের রোদে তখন একটা মঞ্চ তৈরি করা হচ্ছিল হাটের খোলা মাঠে। প্রশাসনের লোকেরা হয়ত ভেবেছিল আখড়া বন্ধ করে দিলে গান থেমে যাবে। কিন্তু মানুষের সুর তো দেয়াল চেনে না। জামিল আর গ্রামের তরুণরা হাটের মাঝখানে নতুন করে একটা অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করেছে—তিনটে বাঁশ, একটা তেরপল, কিছু কঞ্চি, আর মাটির ছোট একটি ঘর।
সন্ধ্যায় সেখানে জমে গেল উৎসব। একেকজন এসে নিজের গল্প বলল—কে কিভাবে এই আখড়ার গানে নিজেকে চিনেছে, ভুল মানুষকে ক্ষমা করেছে, ভালোবাসায় ফিরেছে।
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, “আমার নাতি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। তারে একদিন এই আখড়ায় এনেছিলাম। এখন সে গান গায়।”
এক তরুণী বলল, “আমি ভেবেছিলাম, সমাজ শুধু শাস্তি দেয়। আখড়ায় প্রথম শিখলাম—ভালোবাসা শাস্তির বাইরে।”
তখন জামিল উঠল মঞ্চে, হাতে সেই কাঠের লাঠি, আর বলল,
“এই লাঠি চান ফকিরের নয়, এ লাঠি এখন আমাদের গান। আমরা যদি সত্যিই গাইতে চাই, তাহলে কোনো তালা থামাতে পারবে না।”
তিনি গাইল—
“তালা দিলে গানে,
আমি হয়ে যাই জানালা।
যদি মুখ বন্ধ করে দেয়,
তবু চোখ দিয়ে গাই ভালোবাসা।”
লক্ষ মানুষ না থাকলেও, সেই সন্ধ্যায় প্রায় তিন শতাধিক মানুষ এই নতুন উঠোনে বসে গাইল। কারো গলা ভালো ছিল না, কেউ তাল জানত না—তবু একসঙ্গে গাওয়া যেন নিজেই হয়ে উঠেছিল সংগীত।
আর আখড়ার বন্ধ দরজার সামনে বসে ছিলেন চান ফকির, চোখে অশ্রু নয়, ঠোঁটে এক তৃপ্তির হাসি। তিনি মাটিতে ধীরে ধীরে আঙুল দিয়ে লিখছিলেন—
“যেখানে মানুষ বসে পাশাপাশি, সেখানে দরজা লাগে না।”
তখনই হাটের দিক থেকে সাইকেল চালিয়ে এল সেই সাংবাদিক তরুণী। সে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আজ থেকে এই গল্প আমি সারা দেশে ছড়িয়ে দেব। কারণ এটা কেবল গান নয়, এটা একটা আন্দোলন। ভালোবাসার আন্দোলন।”
রাত বাড়তে লাগল। মাঠে আগুন জ্বালানো হল, আর তার চারপাশে গানে গানে চলল সভা। কেউ কেউ মোবাইলে রেকর্ড করছিল, কেউ চুপচাপ কাঁদছিল, আবার কেউ বলছিল, “এটা কোনো একদিন ইতিহাস হবে।”
চান ফকির সেই রাতেই মঈনকে বললেন,
“তুই আখড়ার দায়িত্ব নিস। আমি এখন গান গাইব না, আমি এখন শুনব। মানুষের হৃদয় শোনা শুরু করব।”
মঈন কিছু বলল না। সে জানে, আখড়া যদি সত্যি হয়, তবে তার চেয়ে বড় কিছু আর হয় না।
আর জামিল? সে সেই রাতেই লিখে রাখল তার প্রথম পদ—
“ধূপের গন্ধে জেগে উঠি,
তালার ওপার ভালোবাসা দেখি।
আমি সেই আলো, তালায় থামে না,
আমি সেই আখড়া, কেউ যারে নাম দেয় না।”
পর্ব ১০: যেখানে শেষ নয়, সেখানে আখড়া
রাত পেরিয়ে সকাল যখন ধীরে ধীরে আকাশের কোণে ভেসে উঠল, তখন আখড়ার চারপাশে একটা নতুন আলোয় ভরপুর নিঃশব্দতা নেমে এলো। এই নিঃশব্দতা কোনো পরাজয়ের নয়, বরং দীর্ঘ এক সাধনার পর সেই ক্ষণিক অবসরের—যেখানে মানুষ তার ভেতরের চিৎকারকে শুনতে পায়।
আখড়ার মূল ঘরটা এখনও তালাবদ্ধ। সিলিং কাগজটি রোদে ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। কিন্তু দরজার সামনে ফুল, ধুপকাঠি, কিছু চিঠি পড়ে আছে—মানুষের নীরব প্রতিরোধের চিহ্ন হিসেবে।
চান ফকির আজ আর উঠোনে নেই। তিনি ভোরবেলায় জামিলকে ডেকে বললেন,
“আজ আমি বেরোবো। কোথায় যাব জানি না, তবে আখড়া রেখে যাচ্ছি তোর হাতে।”
জামিল চমকে উঠল। “কোথায় যাচ্ছেন চাচা? এখন যখন সবাই এক হচ্ছে, তখন আপনি চলে যাবেন?”
চান ফকির মৃদু হেসে বললেন, “তুই জানিস, আমি কখনো কিছু তৈরি করি না। আমি কেবল শুরু করে দিই। আখড়া তো এখন তুই, মঈন, মমতা, সোনা আর এই গ্রামের প্রতিটি মানুষ। আমি শুধু সরে যাব, যাতে তোরা জায়গা পাস।”
মঈন তখন এসে দাঁড়াল সামনে। বলল, “তুই গেলে, আমি একা হয়ে যাব।”
চান ফকির বললেন, “তুই একা হবি না। তুই তো আমার সুর।”
চান ফকির নিজের লাঠিটা মাটিতে গেঁথে রেখে বললেন, “এই লাঠি উঠোনে থাক। যখন কেউ সাহস হারাবে, তখন সে এসে ধরবে এইটাকে। মনে রাখবি, এইটা কেবল কাঠ নয়—এটা একটানা ত্যাগের স্মারক।”
তিনি জামিলকে কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কেউ জিজ্ঞেস করল না কোথায় যাচ্ছেন। কারণ সবাই জানত, তার চলে যাওয়া মানেই একটা পর্ব শেষ হয়ে আরেকটি শুরু হওয়া।
এরপর দিনগুলো পাল্টাতে লাগল। উঠোনের পাশে নতুন ঘর তৈরি হল—খোলামেলা, দেয়ালহীন। সেটাই এখন নতুন আখড়া। এর কোনো তালা নেই, দরজা নেই, শুধু খোলা এক মঞ্চ আর গাছতলায় বসে থাকা মানুষ।
মঈন প্রতিদিন গায়, আর তার পাশে এখন বসে জামিল। গানের মাঝে মাঝে সে বলে,
“আমরা কেউই ফকির নই, আমরা সবাই খোঁজ করা মানুষ। আমাদের কাছে গান মানে বেঁচে থাকার ন্যায্যতা। আমাদের ভাষা না থাকলে কেউ শুনত না, এখন গান শুনে আমাদের কেউ ভুলতে পারে না।”
মমতা খাতুন আখড়ার রান্নাঘরের দায়িত্ব নিয়েছেন। যারা দূর থেকে আসে, তাদের খাওয়ানো, থাকা—সব এখন আখড়ার স্বাভাবিক কাজ। আর সোনা দাস নতুন প্রজন্মকে তাল শেখাচ্ছেন।
কয়েক মাসের মধ্যেই আখড়ার গল্প ছড়িয়ে পড়ল ঢাকার মিডিয়ায়, ইউটিউব চ্যানেল, বিদেশি ডকুমেন্টারিতে। একদিন জামিলের লেখা পদ নিয়ে একটি ব্রিটিশ ম্যাগাজিনে লেখাও ছাপা হল—“Smoke of Faith: Songs from the Sealed Door”
তালাবদ্ধ ঘরটি কি খুলল? না, তাও নয়। তা যেমন ছিল, তেমনি রইল। কিন্তু কেউ আর তাকে ‘বন্ধ ঘর’ বলে না। সবাই বলে—“ওটা তো আখড়ার স্মৃতি।”
একদিন হঠাৎ করে একটা চিঠি এসে পৌঁছাল নতুন আখড়ায়। প্রেরক জানানো নেই। খামের ভিতরে একটা লাল কাপড়ে মোড়ানো চিরকুট, তাতে লেখা—
“আমি এখন উত্তরবঙ্গের এক নদীর ধারে বসে গান শুনি। তোদের গান বাতাস বেয়ে আসে। জামিল, তুই ঠিক পথেই আছিস। আমি আর ফিরব না, কারণ তোরাই আখড়া।
—চান”
জামিল সেই চিঠিটা মঞ্চে পড়ে শোনাল। লোকজন চুপ করে শুনল। তারপর সে একবার তাকাল লাঠিটার দিকে—যেটা এখনও উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে, পাড়ার সবার মনের মূর্তির মতো।
সে বলল,
“আজ আমি কোনো গান গাইব না। আজ আমি শুধুই বলব—আমরা হারিয়ে গিয়েও ফিরে আসি, যদি ভালোবাসা থাকুক ধূপের মধ্যে, যদি ভয়কে গান দিয়ে ধুয়ে ফেলা যায়।”
সেই সন্ধ্যায় নতুন আখড়ার ছেলেমেয়েরা প্রথম একসঙ্গে লিখে রাখল একটা মন্ত্র—
“আখড়া মানে দেয়াল নয়, আখড়া মানে হৃদয়ের ভিতর এক খোলা উঠোন।”
সেই মন্ত্র আজ প্রতিদিন গাওয়া হয়, ধূপের ধোঁয়ার সাথে উড়ে বেড়ায়, নতুন কোনো জামিলের কানে গিয়ে পড়ে, যে হয়তো একদিন এই গল্পটা শুনবে—
চান ফকিরের, জামিলের, মঈনের, মমতার, সোনার, আর সেই গানপ্রিয় অজানা বাউলের,
যারা তালা ভেঙে, ভয় পেরিয়ে,
ভালোবাসার আখড়া গড়ে তোলে।
সমাপ্ত