Bangla - প্রেমের গল্প

আকাশে দুটি তারা

Spread the love

অন্বেষা সরকার


অধ্যায় ১: মেট্রোর নীরবতা

কলকাতার সকালগুলো যেন একই গানের একেকটা রেওয়াজ। ঘড়ির কাঁটা আটটা পঁচিশ বাজলেই শহরের বুকে এক অদৃশ্য কম্পন ছড়িয়ে পড়ে—ট্রামের ঘণ্টি, চায়ের দোকানের ধোঁয়া, রাস্তায় ছুটতে থাকা ট্যাক্সি, আর সব কিছুর মাঝে পাতালপুরীর সেই নীল রেললাইন, যেখানে প্রতিদিন নিয়মমাফিক নাম লেখায় লক্ষ লক্ষ যাত্রী। সেই যাত্রীদের মাঝে একজোড়া চোখ থাকে প্রায়ই একই জায়গায়—শিয়ালদহ থেকে শুরু করে মহাত্মা গাঁধী রোড পর্যন্ত, একটি নির্দিষ্ট কোচে, নির্দিষ্ট সময়ে। ঈশান বসু। বাদামি রঙের স্লিং ব্যাগে চেপে ধরা স্কেচবুক আর হেডফোনে বাজতে থাকা হেমন্তের পুরনো গান নিয়েই তার সকাল শুরু হয়। ওর চোখ দুটো সাদা আকাশের মতো, যেন প্রতিদিন কিছু না কিছু খুঁজছে, কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই। সে দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে, আর সেখান থেকেই তার চোখ চলে যায় সামনের কোণে—যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে একটি মেয়ে। সে দেখে মেয়েটি প্রায় প্রতিদিনই মেট্রোতে উঠে ঠিক ওই কোণটাতে দাঁড়ায়। মেয়েটির হাতে একটা নীল কাপড়ের ব্যাগ, তাতে হস্ত আঁকা একটি সাদা তারা—চোখে যতবার পড়ে, ঈশানের মনে হয় যেন সেই তারা আকাশ থেকে নেমে এসে পাতালে ঢুকে গেছে, শুধু তাকেই দেখানোর জন্য।

মেয়েটির নাম সে জানে না, কিন্তু ঈশান তার নাম দিয়েছে মনে মনে—”নীল তারা”। মেয়েটি কথা বলে না, তাকায়ও না খুব একটা, কিন্তু মাঝে মাঝে চোখে চোখ পড়ে গেলে মৃদু একটা হাসি তার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে। ঈশান সেটা লক্ষ্য করে প্রতিদিন, নিজের অজান্তেই। আর মেয়েটিও লক্ষ্য করে—তাদের মাঝে তৈরি হয়েছে এক নীরব ছায়াসঙ্গ, যা কেউ কাউকে জানায় না, কিন্তু উভয়েই জানে যে অন্যজন উপস্থিত। লিনি—অর্থাৎ মৃণালিনী দত্ত—একটি প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। সে বাসে বা অটোতে ওঠা পছন্দ করে না। পাতালে নামলে বাইরের পৃথিবীকে কিছুক্ষণের জন্য ফেলে রাখা যায়—সেই ফেলে রাখা সময়েই সে নিজের ডায়েরি খুলে বসে, হাতে থাকে নীল কালির পেন। লিনি ডায়েরিতে লেখে প্রতিদিনের মেট্রোর মানুষদের গল্প—সবাই তার কাছে ছোট ছোট চরিত্র, যাদের সে নিজের মতো করে রঙ করে। ঈশানকে সে ডাকে “Mr. Metro” নামে—যেন এই মানুষটাই তার মেট্রোর একমাত্র চেনা অস্তিত্ব। কেউ কারও ফোন নম্বর জানে না, কেউ কোনোদিন কথা বলেনি। কিন্তু দিনে দিনে, সপ্তাহে সপ্তাহে, সেই নীরবতা এতটাই গভীর হয়ে উঠেছে, যা হাজার শব্দের চেয়েও প্রবল।

তাদের সম্পর্ক ঠিক সম্পর্ক নয়—শুধু একে অপরের অস্তিত্বে স্বস্তি পাওয়া। কেউ কাউকে চোখে পড়ে গেলে মনে হয়, দিনটা ঠিকঠাক যাচ্ছে। না দেখলে যেন কিছু একটা ফাঁকা থেকে যায়। শহরের ব্যস্ততা, অফিসের ক্লান্তি, হোমওয়ার্ক আর চাপের বাইরে এই কিছু মুহূর্তই তাদের বেঁধে রেখেছে এক অলিখিত নিয়মে। কিন্তু আজকের সকালটা একটু আলাদা। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ঈশানের ব্যাগ সরে গিয়ে পড়ে যায় ঠিক লিনির পায়ের সামনে, আর হঠাৎ করেই তাদের চোখ আবার একবার মিলিত হয়, একটু বেশিক্ষণ। লিনি ব্যাগটা তুলে দিয়ে বলে, “সামলে রাখুন।” এতদিন পর প্রথমবার তার কণ্ঠস্বর শুনে ঈশান স্তব্ধ হয়ে যায়। শুধু হেসে ব্যাগ নেয়। তখনও কেউ জানত না—সেই ব্যাগেই আজকে এক ছোট্ট ভুল হবে, যা আগামী দিনগুলো বদলে দেবে। যে ভুল হয়তো দুইটি তারাকে একই নক্ষত্রপুঞ্জে পরিণত করতে চলেছে, একটাই আকাশের নিচে।

অধ্যায় ২: কল্পনার শহর

শহরের ভিতরে আরেকটা শহর থাকে, যেটা মানুষের চোখে দেখা যায় না—যেখানে চলতে চলতে কেউ কাউকে দেখে ভালোবাসে, অথচ কোনোদিন সে ভালোবাসার কথা বলা হয় না। লিনির মনের ভেতরেও এমনই এক শহর তৈরি হয়েছে, আর তার একমাত্র বাসিন্দা “Mr. Metro”। সে জানে না ছেলেটির নাম কী, কোথায় থাকে, কী খায়, এমনকি কোন অফিসে যায়—তবু ঈশানকে ঘিরে তার কল্পনা যেন অজস্র মুখের ভিড়েও আলাদা হয়ে দাঁড়ায়। স্কুল থেকে ফিরে লিনি তার ছোট্ট ঘরে বসে চা খায় আর নিজের নীল ডায়েরি খুলে লেখে—আজ মেট্রোয় ছেলেটার চোখে একরকম বিষণ্ণতা ছিল, মনে হয় সে কিছু ভাবছিল। এইভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে সে ঈশানের চারপাশে এক স্বপ্নের দেয়াল গড়ে তোলে, যেখানে সে একা নয়, বরং কারও অপেক্ষায় থাকা একজন মানুষ। লিনির এই লেখাগুলো তার বাস্তব নয়, কিন্তু তার হৃদয়ের সত্য। এক সময় সে নিজের মনে নিজেরই প্রশ্ন করে—এই মানুষটা কি সত্যিই আছে? নাকি আমার মনেরই সৃষ্টি? কিন্তু পরদিন যখন সে মেট্রোতে উঠে দেখে, ছেলেটা আবার সেই পুরোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তখন সব প্রশ্ন মুছে যায়।

ঈশানের দিকেও সেই অদৃশ্য শহর রোজ একটু একটু করে তৈরি হচ্ছিল। সে জানে না মেয়েটির নাম, কিন্তু তার হাতে যে নীল ব্যাগটা থাকে, তাতে যে তারাটি আঁকা আছে, সেটাই তার কাছে একরকম সংকেত—এই মেয়েটা সাধারণ নয়, তার মধ্যে কোথাও এক টুকরো আকাশ লুকিয়ে আছে। অফিসে বসে ক্লায়েন্টের প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে করতেও তার মাথায় বারবার ভেসে ওঠে মেয়েটির মুখ। সে মাঝে মাঝে নিজের স্কেচবুকে মেয়েটির মুখ আঁকতে চেষ্টা করে—অবিকল নয়, কারণ সে তার মুখ স্পষ্ট করে কখনও দেখেইনি, কিন্তু কিছু কিছু রেখা—চোখের কোণ, ঠোঁটের হাসি—এসব মনে থেকে যায়। এসব নিয়ে কারও সঙ্গে কখনও কথা বলেনি, এমনকি নিজের কাছেও স্বীকার করেনি সে এই মেয়েটিকে নিয়ে ভাবে। কিন্তু আজ ব্যাগ পড়ে যাওয়ার পর মেয়েটি প্রথমবার যখন কথা বলল, তখন তার গলার শব্দ যেন ঈশানের চারপাশে একটা নতুন শব্দজগৎ তৈরি করে দিল। সুর ছিল না, কিন্তু ছিল একরকম শান্তি।

সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে ঈশান নিজের ব্যাগটা খোলার পর চমকে ওঠে। ভিতরে তার স্কেচবুক নেই, বরং একটি নীল কাপড়ের ব্যাগ! তার চেনা ব্যাগ নয়। সে ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখে, তারার চিহ্ন, ডায়েরি, আর কিছু বই—একটি প্রাচীন সংস্করণে লেখা টেগোরের গল্প, একটি ছোট নীলচে টিফিনবক্স, আর একগুচ্ছ খোলা চিঠি। ঈশানের বুক ধক করে ওঠে। সে বুঝতে পারে ব্যাগ বদলে গেছে—এটা ‘তার’ ব্যাগ, মেয়েটির, যাকে সে “নীল তারা” বলে ডাকত মনে মনে। এবার সে কী করবে? ডায়েরিটা হাতে তুলে নেয়, খুলে দেখে ভেতরে লেখা: “Mr. Metro আজ খুব গম্ভীর দেখাল, মনে হলো যেন তার হৃদয়ে একটা কথা আটকে আছে, কিন্তু সে কাউকে বলতে পারছে না।” ঈশান স্তব্ধ হয়ে যায়। এতদিন যে মেয়েটিকে সে দূর থেকে দেখে ভাবত, সে যে তাকেও ঠিক ততটাই দেখত, অনুভব করত, জানত—এ কথা সে কল্পনাও করেনি। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই মেয়েটি, ভিড়ের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকা, ডায়েরির পাতা লিখতে থাকা, আর এই লেখাগুলো ঠিক তার কথাগুলো। প্রথমবার ঈশান অনুভব করে, কল্পনার শহর শুধু একপাক্ষিক নয়, বরং এই শহরে তাদের দুজনেরই সমান অধিকার। সেই রাতে ঘুম আসে না, শুধু মনে হয়—আগামীকাল সকালে দেখা হলেই সে ব্যাগটা ফেরত দেবে… কিন্তু তার চেয়েও বেশি কিছু বলবে কি? সে জানে না, শুধু জানে—এই ব্যাগ বদলের ভুলটা ঠিক ছিল, কারণ এই ভুলের মধ্যেই হয়তো তার জীবনের সবথেকে সঠিক কিছু অপেক্ষা করে আছে।

অধ্যায় ৩: ভুল ব্যাগ

কলকাতার সকালগুলো যেমন গতানুগতিক, তেমনি কখনও কখনও সেই নিয়মের মধ্যেই হঠাৎ এক ফাটল তৈরি হয়—একটা ঘটনা যা বদলে দেয় চেনা পৃথিবীর ছন্দ। আজকের সকালটা তেমনই। লিনি যখন ঘুম থেকে উঠে ব্যাগটায় চোখ রাখে, তখনই যেন এক ঝটকায় তার ঘুম ভেঙে যায় পুরোপুরি। তার নীল ব্যাগের বদলে বিছানায় রাখা বাদামি চামড়ার স্লিং ব্যাগ দেখে সে এক মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে যায়। ভেতরটা খোলার পর তার চোখ ছলকে ওঠে বিস্ময়ে—ডায়েরি নেই, তার প্রিয় বইগুলো নেই, আছে একটা স্কেচবুক, কিছু রঙিন পেনসিল, আর একটি হেডফোন যার তার খোলামেলা জট পাকানো। তার মানে—ব্যাগ বদল হয়ে গেছে! কালকে ট্রেনের ঝাঁকুনিতে যে ছেলেটার ব্যাগ পড়ে গিয়েছিল, সেই ছেলেটি… Mr. Metro-এর ব্যাগ! তার বুক কাঁপতে থাকে। সে তড়িঘড়ি ব্যাগটা বুকে চেপে ধরে, যেন এটি হঠাৎ পাওয়া কোনো গুপ্তধন। স্কেচবুক খুলে দেখে একের পর এক স্কেচ—অদ্ভুত কিছু মুখ, ভিড়ের মধ্যে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, আর একটি মুখ… চোখে বিস্ময়, কপালের ওপর চুল এলোমেলো, হালকা হেসে থাকা ঠোঁট—একদম তার নিজের মতো! লিনির হৃদয়ের গভীর থেকে যেন কিছু একটা ধীরে ধীরে গলে পড়ে, আর সে অনুভব করে, এই মানুষটা তাকে শুধু দেখেছে না, বরং তার অস্তিত্বটাকেই অনুভব করেছে।

ঈশানও ঘুম থেকে উঠেই তেমনই ধাক্কা খায়। নীল কাপড়ের ব্যাগ খুলে একের পর এক বিস্ময়ের মুখোমুখি হয় সে। প্রথমে নীল টিফিনবক্স—ভেতরে রাখা দুটি মিঠে সন্দেশ, তার উপর রুমালের ভাঁজে আঁকা একটা ছোট তারা। তারপর আসে সেই ডায়েরি। তার নাম লেখা নেই, কিন্তু প্রতিটি পাতায় লেখা আছে এমন কিছু যা তাকে কেন্দ্র করে লেখা—তার দাঁড়িয়ে থাকা, তার চোখের ভাষা, এমনকি তার হেসে ওঠার চেষ্টা। ঈশান এমনভাবে পড়তে থাকে যেন কোনো পবিত্র গ্রন্থ। সে প্রথমবার অনুভব করে, কেউ তাকে দেখে, প্রতিদিনের ক্লান্ত মুখটা, চোখের নরম চাহনি—সব কিছু এত নিখুঁতভাবে কেউ অনুভব করতে পারে! সে ভাবে—তবে কি এই মেয়েটিও আমার মতো ভাবত? তবে কি আমাদের মধ্যে যা হচ্ছিল, তা শুধু কল্পনা ছিল না, সত্যিই কিছু তৈরি হচ্ছিল প্রতিদিন সেই মেট্রোর নীরব কোণটায়? ঈশান ডায়েরির শেষ পাতায় চোখ বুলিয়ে থেমে যায়—সেখানে লেখা, “আমি জানি না তার নাম, কিন্তু তার চোখের ভিতর আকাশ আছে। আজ যদি কোনোদিন আমরা একে অপরের ব্যাগে আটকে যাই, তবে বুঝব, এ শুধু কাকতাল নয়—এটা আমার লেখা গল্পের সত্যি হয়ে ওঠা।”

বাইরে তখন শহর চলেছে নিজের গতিতে—ট্রাফিক সিগনাল, চায়ের দোকানের তর্ক, পত্রিকার কাগজে মোড়া ফুলের গন্ধ—সব কিছু আগের মতোই। কিন্তু ঈশান আর লিনির জন্য দিনটা একদম আলাদা। তারা জানে আজ তাদের দেখা হবে। ব্যাগ ফেরত দেওয়ার অজুহাতে তারা মুখোমুখি দাঁড়াবে, আর সেই প্রথম শব্দহীন সম্পর্ক হয়তো পাবে একটুখানি ভাষা। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—কী বলবে তারা? এই অদ্ভুত, অলীক অনুভূতির নাম কী? তারা কি শুধু ব্যাগটা ফেরত দিয়ে নিজের নিজের জীবনে ফিরে যাবে, নাকি সেই ব্যাগের ভেতর গাঁথা হয়ে থাকা হৃদয়ের সুতো এক নতুন কাহিনির সূচনা করবে? ঈশান ব্যাগটা শক্ত করে ধরে রাখে, যেন সেই ব্যাগ নয়—লিনির উপস্থিতি, তার লেখা, তার তারা আঁকা ব্যাগের এক টুকরো ছায়া। অন্যদিকে লিনি সেই স্কেচবুকটাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে, যেন এই কাগজের রেখাগুলোতেই তার হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। মেট্রোর ট্রেন এসে গতি নেয়, প্রতিদিনের মতো। কিন্তু আজকের দিনটা, সেই ট্রেনের এক কোণে বসে থাকা দুই অচেনা তারার কাছে, আর কিছুতেই ‘প্রতিদিন’ নয়।

অধ্যায় ৪: ডায়েরির পাতা খুলে

রাত গভীর। কলকাতা শহর তখন প্রায় নিশ্চুপ, কিন্তু ঈশানের ঘরে আলো জ্বলছে। তার সামনে ছড়িয়ে রয়েছে কিছু কাগজ, কিছু কথা, আর অনেক অস্থিরতা। সে লিনির ডায়েরিটা আবার খুলে বসেছে, আগেরবার যতটা কৌতূহল ছিল, এবার ততটাই শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। পাতায় পাতায় লেখা কিছু অসংলগ্ন শব্দ, কিছু অসমাপ্ত বাক্য, কিন্তু তার মধ্যেই এক তীব্র সংবেদন—“আজ ওর চোখে কষ্ট ছিল, যেন সে কিছু হারিয়েছে… আমি কিছু করতে পারি না, শুধু তাকিয়ে থাকা ছাড়া।” ঈশানের বুকের ভিতরে যেন কেউ খোঁচা মারে। সে কি সত্যিই এত স্পষ্টভাবে চোখে রেখেছিল সেই যন্ত্রণা? এত নিখুঁতভাবে? সে ডায়েরির অন্য পাতায় যায়—“Mr. Metro আজ হেসে উঠেছিল হঠাৎ, তারপর চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। আমি জানি না, সে কি কাউকে দেখে হাসল, না নিজেকে। কিন্তু সেই হাসি আমার দিনটা সুন্দর করে দিল।” ঈশান এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না, ডায়েরির একটা পাতায় সে নিজের হাতে কিছু লিখে দেয়—“আমি তোমার লেখা পড়ে বুঝলাম, আমিও হয়তো কারও দিন সুন্দর করে তুলতে পারি। ধন্যবাদ, নীল তারা।” তারপর চুপ করে সে ডায়েরিটা বন্ধ করে রাখে।

লিনি তখন বসে আছে তার জানালার ধারে, যেখানে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ডানদিকের গালের ওপর। তার হাতে সেই বাদামি ব্যাগ, এবং তার ভেতর থেকে বের করা স্কেচবুক। সে পাতাগুলো উল্টে দেখে, প্রতিটি স্কেচ যেন তার হৃদয়ের ভাষা। বিশেষ করে একটি স্কেচ, যেখানে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ট্রেনের দরজার কাছে, চুল হাওয়ায় উড়ছে, চোখে একটা ক্লান্তি আর আশার মিশ্র অনুভব—ঠিক যেমন লিনি নিজেকে ভাবে। পেছনে লেখা আছে একটি লাইন—“আমি জানি না সে কার জন্য অপেক্ষা করে, কিন্তু আমি প্রতিদিন তার জন্য অপেক্ষা করি।” লিনির চোখে জল চলে আসে। কোনোদিন কোনো মানুষ এমনভাবে তাকে দেখেছে কি? এমনভাবে অনুভব করেছে তার অব্যক্ত কথাগুলো? সে স্কেচবুকটা বুকে চেপে ধরে, যেন ওটাই তার নতুন পাওয়া আত্মার আয়না। তখনই তার চোখ পড়ে স্কেচবুকের ভিতরে রাখা একটি ছোট কাগজে—একটি কবিতা, লেখা ঈশানের হাতের লেখায়:
“নীরবতায় বাঁধা তোমার মুখ
ভিড়ের ভিতরেও আলাদা লাগে,
তোমার এক পলক তাকানোয়
আমার দিন বদলে যায়।”

সেই রাতে তারা দুজনই ঘুমোতে পারে না। একজন ভাবে—কাল কীভাবে তাকে বলবে, যে ডায়েরিটা সে রেখে দিতে চায়, প্রতিদিন নতুন কিছু লিখে পড়তে চায়। আরেকজন ভাবে—এই মানুষটিকে কীভাবে বলা যায়, যে সে প্রতিদিন শুধু তার দেখা পাওয়ার জন্য মেট্রোয় ওঠে। সম্পর্কের কোনো সংজ্ঞা নেই, কোনো নাম নেই, তবু এমন এক গভীরতা তৈরি হচ্ছে, যা স্রেফ চোখের ভাষা আর লেখা-আঁকার মাধ্যমে গড়ে উঠছে। কেউ কাউকে স্পর্শ করেনি, তবু তাদের মধ্যকার দূরত্ব এক আশ্চর্য নৈকট্যে রূপ নিচ্ছে। কলকাতার রাত ক্রমশ শেষের দিকে এগোয়, কিন্তু দু’টি ঘরের দুই জানালায় তখনও আলো জ্বলে—একটি বাদামি ব্যাগে রাখা ডায়েরির জন্য, আর একটি স্কেচবুকে আঁকা মুখের জন্য। সেই আলো, সেই অপেক্ষা, সেই স্পর্শহীন প্রেম—সব মিলিয়ে শহরের ব্যস্ততাকে ছাপিয়ে এক অদ্ভুত নীরবতার মাঝে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন গল্প।

অধ্যায় ৫: বিভ্রান্তি ও দূরত্ব

মেট্রো স্টেশনের সেই চেনা প্ল্যাটফর্মে আজ প্রথমবার তারা একে অপরের মুখোমুখি হয়েও অচেনা হয়ে থাকে। ইরা কিছুটা অভিমান নিয়ে তাকায় না অনির দিকে, আর অনি একবার চোখ মেলিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ব্যাগ বিনিময়ের ভুল থেকে শুরু হওয়া তাদের যে অদ্ভুত সম্পর্ক, তা যেন আজ চুপচাপ দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে—নিরব, ব্যথিত, দুর্ভাবনায় ডুবে। ইরা এখন জানে অনি তার ব্যাগে রাখা একটি প্রিয় বই পড়েছে, যেখানে তার নিজের হাতে লেখা কবিতার খসড়া ছিল—তাকে চিনে ফেলেছে সে কবিতার ছত্রে ছত্রে। অনি জানে ইরার চোখে লুকানো কষ্ট, সেই যে বাবা মারা যাওয়ার পর জীবন যেভাবে তাকে বড় করে তুলেছে, সেই কঠিন বাস্তবতার কাহিনি বইয়ের পাতায় লেখা ছিল। অথচ আজ, তারা কথা না বলেই দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে, এমনকি সেই হৃদয়ের বন্ধনটাও যেন এক মুহূর্তে ছিঁড়ে গেছে।

ইরার ভিতরে চলতে থাকে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। সে কি অনিকে ক্ষমা করতে পারবে? সে কি মুখোমুখি হয়ে বলতে পারবে, ‘তোমাকে আমার ভালো লেগেছে সেইদিন থেকে, যেদিন তুমি আমার ব্যাগ নিয়ে মেট্রো থেকে নেমে গিয়েছিলে ভুল করে’? কিন্তু আবার সে ভাবে—সেই ব্যক্তিগত জিনিস পড়ে নেওয়ার অধিকার কি ছিল অনির? ও কি জানত না, কবিতা মানে একরকম আত্মার উন্মোচন? অনি নিজেও দ্বিধাগ্রস্ত, তার মুখে আসা অনেক কথা সে গিলে নেয় দিনের পর দিন। সে ভাবে, সে হয়তো অন্যায় করেছে, কিন্তু সে নিজেকে সামলাতে পারেনি, সে কবিতাগুলো পড়ে আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, প্রতিটা লাইনে যেন ইরার কষ্টের ছায়া তাকে নাড়া দিয়েছিল। সে কেবল জানতে চেয়েছিল সেই মানুষটিকে, যার ব্যাগে ওইসব কাগজ, ওইসব কবিতা, ওইসব অজানা বেদনার ছাপ ছিল।

দিন যায়। ইরা সিদ্ধান্ত নেয়, আজ কথা বলবেই। সে অনিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেই পুরোনো কোণায়, যেখানে সবসময় তার জায়গা। সে এগিয়ে যায়, কিন্তু হঠাৎই দেখে, অনি আজ আর একা নেই—তার পাশে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হাসছে, গল্প করছে অনির সঙ্গে। ইরার বুকের ভিতর যেন কেউ পাথর ছুড়ে মারে। সে থেমে যায়, ফিরে যায় না দেখে, আর সেদিনের মতো তাদের কথা বলার সম্ভাবনাটা মিলিয়ে যায় শহরের কোলাহলে। অথচ অনির হাসি ছিল কৃত্রিম, সেই মেয়েটি তার কলিগ—কিন্তু ইরা জানে না। সে জানে না, অনির চোখ ছিল প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ইরাকে খুঁজতে ব্যাকুল, তার হাসির ফাঁকেও চোখে ছিল অপেক্ষা, যদি একবার ইরা ফিরে তাকায়। কিন্তু না, দুই তারা আজ আকাশে পাশাপাশি থেকেও আলো দিতে পারে না একে অপরকে, দূরত্ব যেন তাদের হৃদয়ের মাঝেও ছায়া ফেলে।

অধ্যায় ৬: ছায়ার জানলা

কলকাতার এক ছুটির বিকেলে শ্রেয়া বসে ছিল তার বারান্দায়, মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে। তার মন আজ অদ্ভুত শান্তিতে ভরা। দীপ্তর কাছ থেকে পাওয়া সেই ছোট্ট নীল খাম, যেটা সে গতকাল সন্ধ্যাবেলায় মেট্রোর ভিতর হাতে পেয়েছিল, এখন তার বুকের কাছেই রাখা। চিঠিতে দীপ্ত লিখেছিল, “যদি একদিনের জন্য পৃথিবীর সব আওয়াজ থেমে যায়, আমি শুধু তোমার নীরবতার শব্দ শুনব।” সেই কথাগুলো শ্রেয়ার মনে এক অদ্ভুত আলো জ্বালিয়েছিল। সে জানত না এই সম্পর্কের নাম কী, জানত না কোন খাতে বয়ে চলেছে এই যাত্রা, কিন্তু হৃদয়ের গোপন কোন কোণে তার এক নিঃশব্দ ভালোবাসা গেঁথে গিয়েছে দীপ্তর জন্য। আজ সে ঠিক করল, কথা বলবে, এবার প্রথমবার তার নিজের অনুভবের জানলাটা খুলে দেবে দীপ্তর সামনে।

অন্যদিকে, দীপ্তর মনেও চলছিল অনেক কথার কোলাহল। আজ সে এক কাপ কফির সঙ্গে নিজের পুরোনো নোটবুক খুলে বসেছিল, যেখানে সে তার প্রতিদিনের অনুভব লিখে রাখে। শ্রেয়ার মুখ, তার চোখের স্থিরতা, তার নিঃশব্দ উপস্থিতি—এসবই এখন তার ডায়েরির পাতায় উঠে এসেছে। কিন্তু শ্রেয়া কি সেইসব অনুভব জানে? তার ব্যাগ বদলের সেই ঘটনাটাই যেন জীবনকে নতুন মোড় দিয়েছে। কাগজে লেখা তার সেই প্রথম চিঠি, তা কি শ্রেয়ার হৃদয়ে কোনো স্থান করে নিতে পেরেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর সে জানত না, কিন্তু জানত, এবার সময় এসেছে—আরও একধাপ এগোনোর। সে ভাবল, আগামী বৃহস্পতিবারে, ঠিক সন্ধ্যা ছ’টায়, সেই নির্দিষ্ট মেট্রো স্টেশনের বেঞ্চে অপেক্ষা করবে শ্রেয়ার জন্য। তার হাতে থাকবে সেই খামটা, এবার নিজের নামসহ। যদি শ্রেয়া আসে, তাহলে সে বুঝবে—ছায়ার জানলা থেকে আলো ঠিকই ঢুকেছে।

বৃহস্পতিবার এল। স্টেশনটা যেন আজ একটু বেশিই নিঃশব্দ, কিংবা দীপ্তর মনটাই এত বিক্ষিপ্ত যে সব শব্দ চাপা পড়ে যাচ্ছে নিজের ভিতরের গুঞ্জনে। তার হাত কাঁপছে, বুকের ভিতর যেন দম বন্ধ হয়ে আছে। সেই পুরোনো বেঞ্চে বসে সে বারবার ঘড়ির দিকে তাকায়, আবার চোখ ফেরায় সেই মেট্রো গেটের দিকে। মিনিটগুলো যেন আজ ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়চ্ছে। ঠিক যখন দীপ্ত ভাবছিল শ্রেয়া আসবে না, তখন একদম চুপিসারে, যেন হাওয়ার ঝাপটার মতো, শ্রেয়া তার পাশে এসে দাঁড়ায়। দীপ্ত তাকিয়ে থাকে অবাক হয়ে, শ্রেয়া একটু হেসে বলে, “চিঠিতে তুমি নীরবতার শব্দের কথা লিখেছিলে—আজ আমি এসেছি সেই শব্দ শুনতে।” এই কথাগুলো যেন মেট্রোর ব্যস্ততাকে থামিয়ে দেয়। শব্দহীন সেই ছায়ার জানলা এবার খোলে আলোয়, আর আকাশে দুটি তারা একে অপরকে স্পর্শ করে নীরবতার ভাষায়।

অধ্যায় ৭: নিরবতার সুরে

পরবর্তী কয়েকদিন ধরে রাহুল এবং মেঘলা আবার সেই চেনা ছন্দে ফিরে যায়—মেট্রোর নির্দিষ্ট কামরায় নির্দিষ্ট সময়ে দেখা হয়, চোখে চোখ পড়ে, কিন্তু কথা হয় না। তবে এখন সেই নিরবতা আর আগের মতো অচেনা নয়, বরং এক ধরণের শান্ত অন্তর্মিলনের মতো। মেঘলা তার হাতে রাখা বই পড়তে পড়তেও মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখে, রাহুল জানালার বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে থেকেও জানে কেউ তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাদের মধ্যে এই নিরব দৃষ্টি বিনিময়ই যেন হয়ে উঠছে প্রতিদিনের এক অভ্যেস। বাইরের ব্যস্ত শহরের শব্দের মাঝে সেই নিরবতা আর একাকীত্ব দুজনের মাঝে বাঁধতে শুরু করে এক অদৃশ্য সেতু। তারা জানে না কীভাবে এগোতে হবে, কিন্তু তারা জানে—কিছু একটা বদলাচ্ছে।

একদিন মেঘলা মেট্রোর কামরায় উঠেই দেখে রাহুল নেই। তার বুকটা কেমন ধক করে ওঠে, এমনটা আগে কখনো হয়নি। সে জানে না কেন, কিন্তু রাহুলের অনুপস্থিতি যেন তার চারপাশটা ফাঁকা করে দিয়েছে। সারাদিন অফিসের কাজেও মন বসে না তার। পরদিন রাহুল আবার ফিরে আসে—কিন্তু তার চোখে ক্লান্তি আর অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। মেঘলা চিন্তা করে, যদি জিজ্ঞেস করত, “সব ঠিক আছে তো?” কিন্তু নিজের ভিতরের দ্বিধা থামিয়ে দেয় তাকে। কিন্তু সেইদিন সন্ধ্যায় মেঘলা রাহুলকে মেট্রো থেকে বেরিয়ে প্ল্যাটফর্মের এক কোনায় বসে থাকতে দেখে। তার হাতে ছোট্ট একটা নোটবুক, আর চোখে অন্যমনস্ক দৃষ্টি। সেই মুহূর্তে মেঘলা সিদ্ধান্ত নেয়—এই নিরবতার বেড়া এবার ভাঙতেই হবে।

সে ধীরে ধীরে রাহুলের দিকে এগিয়ে যায়। রাহুল প্রথমে তাকে দেখে একটু চমকে ওঠে, কিন্তু তারপর মৃদু হাসে। মেঘলা বসে পড়ে তার পাশে। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। তারপর মেঘলা বলে, “তোমার নোটবুকটা এখনও রাখো?” রাহুল অবাক হয়ে তাকায়, তারপর বুঝে নেয়—ব্যাগ বদল হওয়ার দিনের কথা বলছে সে। মেঘলা আবার বলে, “তোমার লেখাগুলো পড়েছিলাম…সত্যি বলতে খুব ভালো লেগেছিল।” রাহুল একটু লাজুক হেসে বলে, “তোমার চিঠিটাও…আসলে…আবার পড়েছি অনেকবার।” সেই মুহূর্তে দুই অচেনা মানুষ যেন প্রথমবার একে অপরকে চিনতে শুরু করে। মেট্রোর করিডোরে শব্দের ভিড়ে, সেই নিরবতার সুরে জন্ম নেয় এক নতুন কথোপকথনের শুরু।

অধ্যায় ৮: পুরনো ডায়েরির পাতায়

সন্ধ্যার পরের মেট্রোতে আবার দেখা হয় রাহুল আর মেঘলার। তবে আজ দুজনেই একটু আলাদা। চোখে একধরনের প্রশান্তি, ঠোঁটে হালকা হাসি। একসাথে বসে তারা জানালার ধারে, শহরের আলো-অন্ধকার পেরিয়ে যাচ্ছে পিছনের ছায়ার মতো। কথা আজ একটু বেশি হয়। মেঘলা রাহুলকে জিজ্ঞেস করে তার লেখালেখির শুরু কবে থেকে, রাহুল বলে—স্কুল জীবন থেকেই সে শব্দ ভালোবাসে, ডায়েরির পাতায় জমা হতো তার একাকীত্ব, আর কিছু স্বপ্নের টুকরো। মেঘলা মুগ্ধ হয়ে শোনে, যেন রাহুলের প্রতিটি শব্দে সে নিজেরই কোথাও হারিয়ে যায়। রাহুলও খেয়াল করে, মেঘলা শুধু সুন্দর নয়, তার ভিতরে এক গভীর অনুভব রয়েছে, যেটা কথায় বোঝানো যায় না—শুধু অনুভব করা যায়। মেঘলা জানায়, ছোটবেলায় তার এক পুরনো দিদা তাঁকে শিখিয়েছিলেন—নীরবতাও একটা ভাষা। আজ যেন সেই ভাষাই কথা বলছে তাদের মাঝে।

সেদিন রাতে মেঘলা তার নিজের ডায়েরি খোলে, বহুদিন পর। পুরনো পাতাগুলোতে ধুলোর গন্ধ, কালি ঝাপসা হয়ে গেছে কিছু কিছু জায়গায়। সে দেখতে পায়—কত কথা জমা হয়ে ছিল এই পাতায়, যা কাউকে কখনো বলা হয়নি। এক পাতায় লেখা, “একটা অচেনা মুখ প্রতিদিন দেখা হয়, জানি না কেন… মনে হয় বহু পুরনো কোনো সম্পর্কের ছায়া।” মেঘলা বুঝতে পারে—রাহুল তার জীবনে নতুন কেউ নয়, বরং সেই পুরনো চিন্তাভাবনারই পুনর্জন্ম। পরদিন সে রাহুলের জন্য একটা ছোট চিরকুট লেখে—“কখনো কি মনে হয়, আমরা আগে কোথাও দেখা করেছি?” আর একটা ছোট গল্পের কাগজে সেটা ভাঁজ করে রেখে দেয় রাহুলের দিকে এগিয়ে দেওয়া বইয়ের ভাঁজে।

রাহুল সেইদিন যখন বাড়ি ফিরে কাগজটা খোলে, তার বুকটা কেমন করে ওঠে। সে ডায়েরি বের করে আগের চিঠিটা সঙ্গে রেখে দেয় এটা। তারপর সে একটা নতুন পাতায় লেখে—“হয়তো, এটাই পুনর্মিলনের শুরু, হয়তো এই গল্পটাও একদিন গল্প হয়ে উঠবে।” তখনই সে জানে—কিছু একটা বদলাচ্ছে, অদৃশ্যভাবে কিন্তু দৃঢ়ভাবে। একটা অচেনা হৃদয় তার হৃদয়ের সঙ্গে ছায়ার মতো মিশে যাচ্ছে, পুরনো ডায়েরির পাতায় লেখা গল্পের মতই।

অধ্যায় ৯: দূরত্বের রেখাচিত্র

শ্রেয়া জানে, সত্যিকারের ভালোবাসা শুধুই কাছাকাছি থাকার নাম নয়—কখনো কখনো একটু দূরে দাঁড়িয়েও ভালোবাসাকে আগলে রাখা যায়। কিন্তু বাস্তব সব সময় এমন উপলব্ধির দিকে ধাবিত হয় না। সে দিনগুলো যেন ক্রমেই একটা কুয়াশায় মোড়া ভোরের মতো হয়ে উঠছিল, যেখান থেকে সাদা-কালো আবেগগুলো স্পষ্ট বোঝা যায় না। অনির্বাণের সাথে তার হঠাৎ কমে আসা যোগাযোগ, মেট্রোর দিনে দিনে অনুপস্থিতি, ফোনকলের সাড়া না দেওয়া—সব মিলিয়ে শ্রেয়ার মনে চলছিল এক গভীর দ্বন্দ্ব। সে কি ভেবেছিল অনির্বাণ সব কিছু ভুলে গেছে? না কি সে নিজেই তার উপস্থিতি থেকে সরে আসছে? নিজের চারপাশে এক নীরবতা অনুভব করছিল শ্রেয়া, যেন প্রতিটা ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে কিন্তু তার কেউ আর সেই মেট্রোর কামরায় উঠছে না।

অন্যদিকে অনির্বাণের জীবনেও এক অসমাপ্ত লড়াই চলছিল। বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, অফিসে প্রচণ্ড চাপ, আর তার ভেতরের আত্মদ্বন্দ্ব—এই মুহূর্তে শ্রেয়ার জীবনে থাকার জন্য সে নিজেকে উপযুক্ত মনে করছে না। সে জানে, কোনো না কোনো ভাবে এই দূরত্ব শ্রেয়াকে কষ্ট দিচ্ছে, কিন্তু তার নিজের ভিতরে এমন এক টানাপোড়েন চলছে যা সে শব্দে প্রকাশ করতে পারে না। এমন এক মুহূর্তে তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায় এক ‘না বলা কথা’র প্রাচীর। সে জানে, শ্রেয়ার চোখের দিকে তাকালেই সব পড়ে ফেলা যায়, কিন্তু সময় যেন কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছে না তাকে। প্রতিটি মেট্রো স্টেশনে সে চায় একবার তাকাতে, একবার দেখে নিতে—তবে কি শ্রেয়া আজও অপেক্ষা করছে? কিন্তু সে জানে না, শ্রেয়াও একটাই প্রশ্ন নিজেকে করছে প্রতিদিন: “সে কি আর আসবে?”

শেষ পর্যন্ত একদিন, এক শীতের সকালে, সেই পুরোনো ব্যাগটা নিয়ে শ্রেয়া আবার উঠল সেই একই মেট্রোতে। কণ্ঠে নিঃশব্দ অপেক্ষা, চোখে নিঃশব্দ প্রতীক্ষা। এবং হঠাৎ করেই এক স্টেশনে দৃষ্টি আটকে যায়—অনির্বাণ! দু’জনের চোখে এক মুহূর্তের জন্য অতীতের সমস্ত মুহূর্ত ভেসে ওঠে, ঠিক যেন আকাশে দুটি তারা আবার কাছাকাছি এসেছে। কিন্তু তারপর? তারা কি এগিয়ে যাবে আবার? না কি দূরত্বটাই তাদের নতুন পরিচয় হবে? সব প্রশ্নের উত্তরে ছিল নীরবতা—এক অনির্বচনীয় নীরবতা, যেটা কখনো ব্যাগ বদল করে, আবার কখনো হারানো চোখের মিলনে প্রেমের নতুন ছন্দ তুলে ধরে।

অধ্যায় ১০: নতুন সূচনা

কলকাতার মেট্রোর প্ল্যাটফর্মটি আজ বেশ আলাদা লাগছে—হঠাৎ যেন সেই কোলাহল, মানুষের ভিড়, বাতাসে মিশে থাকা নোংরা গন্ধ সব কিছুই একটু কম মনে হচ্ছে। ঈশান আর লিনি একই কামরায় চুপচাপ বসে আছে, তবে এই চুপিচুপি যেন গত কয়েক মাসের অপেক্ষার পর এক নতুন ভাষার সূচনা। আজ তাদের মুখে সেই প্রথম শব্দের ছোঁয়া, কল্পনার শহরের ভেতরে নতুন দরজা খোলে। লিনি একটু লাজুক হাসি দিয়ে বলে, “আমাদের ভুল ব্যাগটার গল্পটা কি শেষ হয়ে গেছে?” ঈশান হেসে উত্তর দেয়, “মনে হয় শুরু হয়েছি—একটা নতুন অধ্যায়ের।”

তারা দুজনেই জানে, এই সম্পর্ক আর শুধু ব্যাগ বদলের ভুল নয়। এটি এমন এক বন্ধন, যেখানে ভাষা কম, অনুভূতি বেশি। তারা একে অপরকে জানার চেষ্টা করছে, চোখের ভেতর দিয়ে, লেখালেখির মাধ্যমে, আর মাঝে মাঝে একসাথে মেট্রোর গতি অনুভব করে। শহরের এই হালকা আলোর নিচে দুজন অচেনা মানুষ ধীরে ধীরে পরিচিতিতে রূপ নেয়। মেট্রোর রিকশার গর্জন আর রাস্তার টালমাটাল ভিড় থেকে তারা একটু দূরে, নিজেদের এক অদ্ভুত জগতে প্রবেশ করেছে, যেখানে শব্দের চেয়ে নীরবতার সুর বেশি গম্ভীর।

কিছুদিন পর, ঈশান লিনির কাছে একটা নীল খাম নিয়ে আসে, যার ভেতর ছোট্ট একটা কাগজে লেখা, “আকাশে দুটি তারা কখনো কখনো আলাদা হলেও একই আকাশকে ভাগ করে নেয়।” লিনি চোখ মেলে দেখে, আর হালকা গলায় বলে, “তাহলে আমরা কি সেই দুই তারা?” ঈশান মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ, আর এই আকাশটা আমাদের গল্পের জায়গা।”

তাদের গল্প কলকাতার মেট্রো স্টেশনের ছোট্ট একটি কোণে শুরু হলেও, এর মাঝেই ছিল হাজারো অনুভূতি, ভুল বুঝাবুঝি, স্বপ্ন আর অপেক্ষা। এই মুহূর্তে তারা বুঝতে পারে, ভুল ব্যাগ তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার ছিল। আকাশের সেই দুটি তারা আজ একে অপরকে চিনে নিয়েছে, আর তাদের ছায়া মিশে গেছে শহরের আলো-ছায়ার গানে। নতুন সূচনা, নতুন আশা, আর নতুন ভালোবাসার গল্প। মেট্রোর গতি যেমন থামে না, তেমনি তাদের এই ভালোবাসাও কখনো থামবে না—একটি অবিরাম যাত্রা, যেখানে তারা দুজনেই একসাথে চলবে, আকাশের নিচে।

সমাপ্ত

1000045674.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *