Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প

আঁচল

Spread the love

শুভশ্রী হাজরা


অধ্যায় ১: সুতোয় বাঁধা স্বপ্ন

ঝিরঝিরে হাওয়ায় গঙ্গার ধারে ঢেউ খেলছে পাটের সুতো। আঁচল সরকার ধৈর্যের সঙ্গে তা শুকোতে দিচ্ছে রোদে, শাড়ির রঙ যেন ঠিকঠাক বসে। এ দৃশ্য যেন শুধু শিল্প নয়, একটা স্বপ্নের সূচনা।

আঁচলের বয়স মাত্র ২৪। ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর মা সুমিত্রা সরকার আর দিদিমা বাসন্তী সরকারই ছিল তার আশ্রয়। আঁচল বড় হয়েছে এই গ্রামেই — নদিয়ার চরবাঁশবেড়িয়া। ছোট্ট, সরল একটা গ্রাম। কিন্তু তার চোখে ছিল আকাশ ছোঁয়ার বাসনা।

“মা, আজকে পাটের রঙটা যেন ঠিকঠাক না বসে,” রোদে শুকোনো সুতোটা হাতে তুলে এনে আঁচল বলল।

সুমিত্রা উত্তর দিল, “তুই যেমন মন দিয়ে বানাস, তাতে যা-ই রঙ দিস, সেটা নিজের মতো জ্বলে ওঠে।”

“তবু ভয় হয় মা, শহরের লোকেরা কি বুঝবে আমাদের হাতের গন্ধে মেশানো এই শিল্পের দাম?”

এই ভয়টা তার মন থেকে যাচ্ছিল না। শহরের বড় ডিজাইনারদের মাঝে নিজেকে কোথাও যেন তুচ্ছ লাগত আঁচলের। অথচ সে জানত, তার হাতে তৈরি করা ‘নকশী আঁচল’ শাড়ি কেউ একবার পরলে ভুলতে পারে না।

গাঁয়ের মেলার জন্য সে তৈরি করছিল একটি বিশেষ শাড়ি — “সোনার সূর্য”। হলুদের ওপর লাল জরির কাজ। গ্রামে তার বানানো শাড়ির চাহিদা থাকলেও সে চাইছিল আরও বড় কিছু।

একদিন দুপুরবেলা, গাঁয়ের ডাকঘর থেকে খবর এলো — কলকাতার ‘নিউ ভিশন ডিজাইনার হান্ট’ প্রতিযোগিতার জন্য তার আবেদন গ্রহণ হয়েছে।

“আঁচল, তোর চিঠি আইসে গো!” ডাকপিয়ন মাধব হেসে উঠল।

চিঠি খুলে আঁচল পড়ল, মুখে একরাশ আলো।

“আমি নির্বাচিত! মা! দিদিমা! আমি কলকাতায় যাচ্ছি!”

কলকাতা আগমন

ট্রেনের জানালা দিয়ে শহরটা যেন ঝলসে উঠছিল। এত আলো! এত ভিড়! আঁচল প্রথমবার শহরে এল। তার সঙ্গে ছিল মেঘলা, তার বান্ধবী ও সহ-শিল্পী।

হাওড়া স্টেশনে নামার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা হাঁপিয়ে গেল। কিন্তু স্বপ্ন ছিল এত দৃঢ়, ক্লান্তির সুযোগ নেই।

ওরা উঠল সস্তা একটি হোস্টেলে, যেখানে আগে থেকে থাকা আরও কিছু প্রতিযোগী ছিল — কেউ দার্জিলিং থেকে, কেউ মেদিনীপুর, কেউ কুমিল্লা থেকে।

তবে শহরের মেয়েরা যেন অন্যরকম। লিপস্টিক, হাই হিল, ব্র্যান্ডেড জামা — আঁচলের শাড়ির পাশে একেবারে উল্টো।

সাক্ষাৎ সুহাশিনীর সঙ্গে

প্রতিযোগিতার বিচারকদের একজন ছিলেন সুহাশিনী বসু — নাম শুনলেই শহরের ফ্যাশন দুনিয়া কেঁপে ওঠে। একাধারে ডিজাইনার, অন্যদিকে স্টাইল আইকন। সুহাশিনী প্রথম দর্শনেই আঁচলের পোশাকের দিকে তাকালেন, কিন্তু মুখে হাসলেন না।

“তুমি গ্রাম থেকে এসেছো? বেশ… ডিজাইনটা ইন্টারেস্টিং। কিন্তু আরবান ফিনিশিং কই?”

আঁচল মাথা নিচু করল, কিন্তু মেঘলা চাপা স্বরে বলল, “উনি গ্রাম থেকে এসেছেন, কিন্তু শাড়ির নকশাটা কিন্তু ইউনিক, ম্যাম।”

সুহাশিনী একটু হেসে বললেন, “আমার কালেকশনে এমন কিছু কাজ আছে… দেখে নিও।”

আঁচলের চোখে কেমন অস্বস্তি জমে গেল।

কিন্তু সে জানত, প্রতিযোগিতা সহজ হবে না।

পরিচয় স্বপ্ননীলের সঙ্গে

রাতের দিকে হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আঁচল চুপচাপ কলকাতার আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তখনই পেছন থেকে কণ্ঠ ভেসে এলো,

“তুমি কি নাম লিখিয়েছ শহরের বড় কাগজে, না লিখে ফেলেছ হৃদয়ে?”

পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেল এক ছেলেকে — মাথায় ক্যাপ, গলায় আইডি কার্ড ঝুলছে।

“আমি সাংবাদিক। নাম স্বপ্ননীল। ফ্যাশন হান্ট কাভার করতে এসেছি। তুমি আঁচল, তাই তো?”

আঁচল একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “হ্যাঁ… কিভাবে জানলেন?”

“তোমার শাড়ি বলেছে। এত সুন্দর কাজ — শহরের বাতাসে এমন গন্ধ থাকে না।”

ওই এক মুহূর্তে দুজনের মধ্যে এক অদ্ভুত সংযোগ তৈরি হয়ে গেল।

শেষে একটা টুইস্ট

সন্ধ্যায় সুহাশিনীর একটি প্রাইভেট প্রেস ব্রিফিং চলছিল।

স্বপ্ননীল সেখানে ঘুরতে ঘুরতে দেখে — সুহাশিনী এক অচেনা ডিজাইনের শাড়ি প্রদর্শন করছেন, আর বলছেন, “This is my signature creation.”

চোখ কপালে! ওই ডিজাইন তো আঁচলের ‘সোনার সূর্য’!

স্বপ্ননীলের হাতে ক্যামেরা। সে জানে — এই শহরের মঞ্চে কোনও ‘নকশী আঁচল’-এর গল্প চুরি গেলে, তার প্রতিবাদ করতে হবে।

অধ্যায় ২: সুহাশিনীর সোনার খাঁচা

সুহাশিনী বসু — কলকাতার ফ্যাশন দুনিয়ার এক অজেয় নাম। পেজ থ্রিতে তার মুখ না থাকলে যেন পত্রিকার মর্যাদা কমে যায়। মডেল থেকে মন্ত্রী, সবাই তার ডিজাইন করা শাড়ি, গাউন আর লেহেঙ্গার জন্য মুখিয়ে থাকে। “Suhashini Studio” নামটা মানে যেন নিজেই একটা ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি। অথচ এই আলো ঝলমলে আড়ালের পেছনে যে এমন এক অন্ধকার জমে আছে, তা কারও কল্পনাতেও আসেনি।

সন্ধ্যার সময় সুহাশিনীর বালিগঞ্জের ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্টে বসে চলেছে মিডিয়া মিট। হাতে হাতে মকটেল, পেছনে ইনস্টাগ্রামের জন্য পোজ দেওয়া ব্যাকগ্রাউন্ড, সামনে লম্বা কাচের টেবিলের ওপারে সুহাশিনী নিজে — হালকা গোলাপি শিফনের শাড়িতে মোড়া, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিকের ছোঁয়া।

“আমার আগামী কালেকশনের নাম—‘সোনার গল্প’,” তিনি বললেন।

“এই প্রথমবার, আমি গ্রামীণ মোটিফকে আনাড়িভাবে নয়, একদম রাজকীয়ভাবে উপস্থাপন করছি। আমার ডিজাইন দেখলেই বোঝা যাবে—রূঢ়তা আর সূক্ষ্মতার মিলন।”

তার সহকারী কয়েকটা ডিজাইন তুলে ধরল। তাদের মধ্যে একটি শাড়ি দেখে স্বপ্ননীল চোখ সরাতে পারল না।

সোনালি জরির সূর্য আর লাল রেশমের রেখা—ঠিক আঁচলের বানানো ‘সোনার সূর্য’ শাড়িটার মতো!

সে কাঁধের ব্যাগ থেকে ছোট ক্যামেরা বার করে ছবি তোলে।

নিজেকে থামায় না, কারণ সাংবাদিকের চোখে এই মুহূর্তটুকুই ইতিহাসের প্রমাণ।

পরদিন সকালে সে খবরটা নিয়ে বের হয়। তার অফিস, ‘জনবালা সংবাদ’, যদিও প্রথম সারির কাগজ নয়, কিন্তু সাহসী রিপোর্টিং-এর জন্য পরিচিত।

সম্পাদক মধুমালতী রায় বলেন,

“তুমি বলছো, ওই ডিজাইনটা গ্রামের এক মেয়ের করা? প্রমাণ কই?”

স্বপ্ননীল হাসে।

“প্রমাণ আমি নিয়ে আসব। কিন্তু দিদি, আপনি তো জানেন, গ্রামীণ ডিজাইন নিয়ে এই শহরে কতো চুরি হয়। কেউ তো কলম ধরেই না!”

মধুমালতী মাথা নেড়ে বলেন,

“ঠিক আছে। নিয়ে আসো মেয়েটিকে। আমি চাই সত্য বেরিয়ে আসুক। কিন্তু সাবধানে থেকো। সুহাশিনীর পেছনে বড় বড় ক্লায়েন্ট আছে।”

ওদিকে হোস্টেলে আঁচল আর মেঘলা ব্যস্ত তাদের ফাইনাল ডিজাইনের প্রস্তুতিতে।

“আঁচল, শোনেছিস? কালকের মিটে তোর ডিজাইনটাই নাকি সুহাশিনী ম্যাডামের কালেকশনে গেছে!”

মেঘলা একটু উত্তেজনায় বলে উঠল।

 

“মানে?” আঁচল থমকে যায়।

“অর্থাৎ… সেই সূর্য মোটিফটা… আমার তো মনে হয় এটা তোরা গ্রামের নারায়ণ তাঁত থেকে নিজেই বুনেছিলি!”

আঁচলের মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল।

সেই রাত্রেই স্বপ্ননীল এসে জানায়,

“তোমার ডিজাইনটা ও চুরি করেছে। আমি প্রমাণসহ রিপোর্ট তৈরি করছি। কিন্তু তোমাকে সামনে আসতে হবে।”

আঁচল ঘাবড়ে যায়।

“আমি পারব না। আমি তো এই শহরের কাউকে চিনি না। আর ও তো অনেক প্রভাবশালী!”

স্বপ্ননীল তার চোখে চোখ রেখে বলে,

“তোমার সাহসটাই তোমার ডিজাইন। তুমি লড়াই শুরু করলেই আমি পাশে থাকব।”

সুহাশিনী বসু জন্মেছিলেন শ্যামপুকুর অঞ্চলে, একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে। ছোটবেলায় তার মা ছিলেন একজন সেলাইকারি, যিনি দক্ষিণেশ্বরের বুটিক দোকানে কাজ করতেন।

সুহাশিনী ছোটবেলা থেকেই ফ্যাশনে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু বড় ডিজাইন স্কুলে সুযোগ পাননি।

তবু একদিন তিনি হঠাৎই উঠে এলেন লাইমলাইটে। একটা আন্তর্জাতিক ডিজাইন প্রতিযোগিতায় ‘আদিবাসী মোটিফ’ নিয়ে তার এক কালেকশন বিদেশি মিডিয়ায় প্রশংসিত হয়।

কিন্তু সেদিনও কেউ জানত না—সে ডিজাইন আদতে বাঁকুড়ার এক মহিলা তাঁতিকে দিয়ে করানো হয়েছিল।

আর সেই ছিল শুরু।

এরপর থেকে সুহাশিনী নিয়মিতই গ্রাম-গঞ্জ থেকে কাজ করিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দেন।

তিনি তাঁদের স্বাক্ষর নিতে শিখে ফেলেছিলেন চাতুর্য দিয়ে — দু’শো টাকার অগ্রিমে চুক্তি করিয়ে নিতেন, সেখানে লেখা থাকত “সব ডিজাইন Suhashini Studio-র মালিকানা।”

কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই শহরের র‍্যাম্পে চলত সেই শাড়ির প্রদর্শনী।

আঁচল আর মেঘলা এরপর এক পরিকল্পনা নেয় — তারা আবার গ্রামে ফিরে গিয়ে শাড়ির প্রকৃত প্রস্তুতপ্রণালী, ছবিসহ প্রমাণ তুলে আনবে।

তারা গ্রামে ফেরে।

আঁচলের মা সুমিত্রা বলে,

“মেয়ে, এই দুনিয়াটা সহজ নয়। কিন্তু সত্যি যদি তুই দেখাতে চাস, তবে ভয় পাস না।”

তারা শাড়ির নকশা, তাঁত, সুতো, বুননের ভিডিও তোলে। দিদিমার পুরোনো খাতা যেখানে আঁচল আঁকত সেই সূর্য নকশা — সেসবও তুলে আনে।

কলকাতায় ফিরে এসে স্বপ্ননীল এভিডেন্স জমা দেয় ‘জনবালা সংবাদ’-এ।

প্রতিবেদন ছাপা হয়:

“আঁচলের সূর্য, সুহাশিনীর অন্ধকার?”

সঙ্গে আঁচলের শাড়ির ছবি, গ্রামের তাঁতির সাক্ষাৎকার, আর সুহাশিনীর শো থেকে পাওয়া ফুটেজ।

পুরো শহর হকচকিয়ে যায়।

কেউ বলছে—”শুধু নকল নয়, প্রতারণা!”

কেউ আবার বলছে—”গ্রামের মেয়েটা তো দুর্দান্ত সাহসী!”

পরদিন সকাল থেকেই সুহাশিনীর স্টুডিওর সামনে মিডিয়ার ভিড়।

তিনি প্রথমে অস্বীকার করেন,

“আমি এমন কিছু করিনি। আমার কাজ ইউনিক। গ্রাম থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া অন্যায় নয়।”

কিন্তু মিডিয়ায় ফুটেজ দেখানো হলে, তিনি সংক্ষেপে বলেন,

“আমার টিম করেছে, আমি জানতাম না।”

আর তখনই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একজন বলে ওঠে,

“মিথ্যে! আপনি নিজে আমার সই নিয়েছেন ওই নকশার কাগজে!”

সে বিক্রম পাল — যিনি আগে সুহাশিনীর হয়ে গ্রামে কাজ করত, এখন আঁচলের হয়ে সত্যি বলে।

অধ্যায়ের শেষ দৃশ্যে, স্বপ্ননীল আর আঁচল এক ছাদে দাঁড়িয়ে শহরের আলো দেখছে।

আঁচল বলে,

“শহরটাকে একসময় আমার সোনার খাঁচা মনে হতো। এখন মনে হয় — আলোটা গ্রামেই বেশি ছিল।”

স্বপ্ননীল তার দিকে তাকিয়ে হাসে।

“তুমি নিজেই তো আলো, আঁচল। তোমার হাতে বাঁধা সূতোয় যেদিন শহরের মুখোশ খুলে যাবে — সেদিন দেশটাও বদলাবে।”

আকাশে ঝলসে উঠছে আলোর বাজি। আর নিচে এক মেয়ের গল্প রচনা করছে নতুন ইতিহাস।

অধ্যায় ৩: চোখে চোখে বিদ্যুৎ

কলকাতার আকাশ সেদিন ছিল মেঘলা। বাতাসে একধরনের ছেঁড়া কুয়াশা ভাসছিল, যেন শহরটা নিজেই কিছু লুকিয়ে রাখছে। কিন্তু আঁচল আর সপ্ননীলের জীবনে সেই মুহূর্তে কোনও কিছুই লুকানো ছিল না — বরং উন্মোচিত হচ্ছিল এক অজানা অনুভবের ধারা। সেদিন সকাল থেকেই । স্বপ্ননীল আর আঁচল একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল শহরের নানা জায়গায়। কারণ, মিডিয়া কভারেজের পর একাধিক চ্যানেল ও ম্যাগাজিন আঁচলের সাক্ষাৎকার চাইছে। আঁচল প্রথমে রাজি হয়নি, কিন্তু মধুমালতীদি আর স্বপ্ননীল বুঝিয়ে বলেছে, “তোমার কণ্ঠে যদি নিজের গল্প না আসে, তবে আবারও কেউ তোমার গল্প নিয়ে নিজের নামে চালাবে।”

বৃষ্টিভেজা সকাল

আঁচল আর স্বপ্ননীল পৌঁছেছিল দক্ষিণ কলকাতার এক ক্যাফেতে। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি। ভেতরে হালকা জ্যাজ মিউজিক। আঁচলের গায়ে ছিল তার নিজ হাতে বোনা এক সরু নীল সুতোর শাল, আর চোখে সেই পরিচিত দ্বিধার ছায়া।

“তুমি একা এসেছিলে এই শহরে, ভয় লাগেনি?”

স্বপ্ননীল জিজ্ঞাসা করল কফিতে চুমুক দিতে দিতে।

আঁচল একটু হাসল। “ভয় তো লেগেছিল। কিন্তু বাবার একটা কথা মনে পড়েছিল—‘যার আঁচলে সাহস গাঁথা থাকে, তাকে কোনও ভয় ছুঁতে পারে না।’”

স্বপ্ননীল তাকিয়ে রইল তার দিকে। এমন সহজভাবে কথা বলা মেয়েটি যেন কোনও চরিত্র নয়, এক চলমান চিত্রকল্প। তার চোখে ছিল জল, কিন্তু সেই জল কান্নার ছিল না, ছিল সৃষ্টির।

স্বপ্ননীলের গল্প

আঁচল তাকে এক সময় বলল, “তুমি তো শহরের ছেলে। তুমি কেন এমন করে আমার পাশে এসে দাঁড়ালে? আমার তো কিছুই ছিল না তোমার দেবার মতো।”

স্বপ্ননীল জানাল তার নিজের গল্প।

“আমি বড় হয়েছি বেহালায়, বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার। মা মারা যান যখন আমি দশ। তারপর জীবন মানে ছিল নিয়ম আর দায়। কিন্তু সাংবাদিকতা আমাকে একটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। আমি সবসময় খুঁজেছি এমন কিছু, যা সত্যি — যা কাগজের পেছনে, খবরের বাইরে। তুমি সেই সত্যির এক প্রতীক।”

আঁচলের চোখে কেমন যেন আলো এসে পড়ল।

“তাহলে তুমি শুধু রিপোর্টার না… তুমি তো আমার গল্পেরও অংশ হয়ে গেলে।”

প্রথম ছোঁয়া

বিকেলের দিকে ওরা গেল বালিগঞ্জ ফেয়ারগ্রাউন্ডে, যেখানে আঁচলের প্রথম পাবলিক এক্সিবিশন হওয়ার কথা। সেখানে তার ‘সোনার সূর্য’ছাড়াও নতুন কিছু ডিজাইন রাখা হয়েছে।

“তুমি তো নতুন একটা শাড়ির ডিজাইন করছিলে, সেই ‘জলের ছায়া’?”

স্বপ্ননীল প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ, তবে এটা একটু আলাদা,” আঁচল উত্তর দিল।

তারপর সে শাড়িটার ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখাল।

নীল, সাদা আর রুপালি সুতোয় তৈরি এক নকশা — যেন নদীর ওপর ছড়িয়ে থাকা চাঁদের আলো।

“এইটা আমি তোমার কথা ভেবে বানিয়েছি,” আঁচল স্বীকার করল।

স্বপ্ননীল থমকে গেল।

“আমার কথা?”

“তুমি আমার জীবনে এসে যে আলোটা এনে দিয়েছো, সেটা ঠিক নদীতে পড়া চাঁদের আলো। নিজের জলে আলোর ছায়া ধরা সহজ না। কিন্তু তুমিই সেটা করতে পেরেছো।”

এক মুহূর্ত চুপ। তারপর স্বপ্ননীল ধীরে ধীরে আঁচলের হাতটা ধরল। কোনও নাটকীয়তা নয়, কোনও চমক নয় — কেবল স্পর্শের মাধ্যমে দুই মানুষের দুটি বাস্তবতা মিলল। শহরের হট্টগোল থেকে দূরে, এক ছোট্ট এক্সিবিশন স্টলে, দুই অল্পবয়সী মানুষের মাঝখানে জেগে উঠল প্রেম।

ষড়যন্ত্রের ছায়া

কিন্তু শহর শুধু প্রেমের জায়গা নয়। এই শহরে ‘সত্যি’মানেই অনেকের ‘বিপদ’।

সুহাশিনী বসু যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল তার ক্ষমতার ঘেরাটোপে।

কিন্তু সে চুপ করে বসে থাকবে না — সে ফোন করল এক পুরোনো বন্ধুকে — নাম তানভীর ঘোষ, শহরের এক উঠতি গার্মেন্ট ব্যবসায়ী যিনি মাঝে মাঝে ‘তাল সামলাতে’ গুন্ডা ব্যবহার করেন।

“ওই মেয়েটাকে চুপ করাতে হবে, অন্তত সময়ের আগেই। ও যেন আর কোনও মিডিয়ায় না যেতে পারে।”

তানভীর বলল, “ঠিক আছে। আপনার টেনশন করার কিছু নেই। ওর গ্রামে লোক পাঠিয়ে ভয় দেখাই?”

সুহাশিনী মাথা নাড়ল। “না, মেয়েটা শহরে। ভয় দেখাও না, শুধু ওকে ভুলিয়ে দাও, হয়ত কিনে ফেলো।”

তানভীর হেসে বলল, “তোমার জন্য কতবার এসব করেছি! এবারও সামলে নেবো।”

প্রেমের প্রথম বাঁধা

সন্ধ্যায় আঁচল আর স্বপ্ননীল ফেরার সময়, রাস্তায় হঠাৎ এক লাল বাইক এসে সামনে দাঁড়ায়।

দুজন লোক নামল — একজন বলল,

“আপনার নাম আঁচল সরকার? ম্যাডাম আমাদের বলেছে আপনার ডিজাইন খুব ভালো — আপনি যদি ওনার সঙ্গে একটা চুক্তি করেন, অনেক টাকা পাবেন। বিদেশে যাবার সুযোগও থাকবে।”

আঁচল হতচকিত, “আমি কারো সঙ্গে কোনও কিছুর চুক্তি করতে চাই না।”

তারা আবার বলে, “ভাববেন না দিদি। আমরা শুধু বলে যাচ্ছি — ওনার সঙ্গে কথা বললে আপনার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।”

স্বপ্ননীল সামনে দাঁড়ায়।

“আপনারা কীভাবে জানলেন আমরা এখানে আসব?”

লোকগুলো একটু থেমে যায়। তারপর একজনে বলে,

“আমরা তো নিজেরা আগ্রহী, কেউ বলেনি।”

তারা চলে যায়, কিন্তু হুমকি আর সন্দেহের ছায়া রেখে।

আস্থা আর অভিমান

হোস্টেলে ফিরেই আঁচল চুপ করে বসে থাকে।

“তুমি কি মনে করো আমি ভুল করছি, এত সামনে এসে?”

সে স্বপ্ননীলকে জিজ্ঞাসা করে।

“তুমি যদি আজ চুপ করো, কাল কেউ আর সাহস পাবে না।”

স্বপ্ননীল বলে।

কিন্তু আঁচল যেন কিছু একটা বোঝাতে চায়,

“স্বপ্ননীল, তুমি যদি আমার পাশে না থাকো, আমি আবার একা হয়ে যাব।”

স্বপ্ননীল তার কাঁধে হাত রাখে।

“আমি পাশে আছি, আঁচল। শুধু আজ নয়, যতদিন তুমি লড়বে, ততদিন আমি তোমার পাশে থাকব।”

এই কথার মধ্যেই এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলে যায় জানালার বাইরে। আর তাদের চোখে মুখে পড়ে সেই আলো — যেন চোখে চোখে সত্যি একটা নতুন বিদ্যুৎ খেলে গেল।

সিডিউলড ফ্যাশন শো

সুহাশিনীর পিআর টিম হঠাৎ ঘোষণা করে, “এই রবিবার একটি নতুন এক্সক্লুসিভ ফ্যাশন শো হবে, যেখানে Suhashini Studio তাদের গ্রামীণ-অনুপ্রাণিত কালেকশন উপস্থাপন করবে।”

তার মানে, সুহাশিনী আবার চেষ্টা করছে ‘গ্রামীণতা’কে নিজের দখলে আনার।

এইবার স্বপ্ননীল পরিকল্পনা করে—

“আঁচল, তুমিও ওই একই দিন একটা স্টলে নিজের ডিজাইন প্রদর্শন করো। আমাদের পেছনে মিডিয়া আছে, গ্রাম আছে, আর তোমার সত্যিটাও। দেখব কে জেতে—লোভের বোনা রাজনীতি, না আত্মার সুতোয় গাঁথা ‘আঁচল।’”

অধ্যায় ৪: আগুনের র‍্যাম্প

রবিবার, সকাল ৮টা। কলকাতার জ্যোতিষ রায় অডিটোরিয়ামের বাইরের লনে ব্যস্ততা তুঙ্গে। হাই ফ্যাশন জগতের বহু বিখ্যাত মুখ এসে জমেছে এখানে। কারণ আজ Suhashini Studio-র নতুন কালেকশন শো। সেই সাথে, আরেকদিকে ছোট্ট এক কর্নারে এক নতুন নাম—”Anchol’s Threads”—প্রথমবার আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে।

দুটো ভিন্ন জগৎ, দুটো ভিন্ন জীবন, আর দুটো বিপরীত সত্য। একদিকে সুহাশিনী বসু—লোকচক্ষুর সামনে সফল, গ্ল্যামারাস এক ডিজাইনার। আরেকদিকে আঁচল সরকার—একজন গ্রামের মেয়ে, যার নিজ হাতে তৈরি শাড়ির ডিজাইন একসময় কেউ মূল্য দিত না, আজ সেই শাড়িই শহরের আলোকে আসতে চলেছে।

যুদ্ধের আগে নীরবতা

স্বপ্ননীল খুব সকালেই আঁচলকে নিয়ে চলে আসে ভেন্যুতে। আঁচল কিছুটা নার্ভাস, কিন্তু চোখে আগুন।

“তুই পারবি রে,” বলে মধুমালতীদি আঁচলের চুলে বেনী গুঁজে দেয়। “তুই শুধু নিজের কণ্ঠে নিজের কথা বল। দেখবি, শহর শুনবে।”

স্বপ্ননীল আঁচলের চোখে চোখ রাখে।

“তোর তৈরি প্রতিটা সুতো, প্রতিটা রঙ—তুই জীবনের গল্প বুনে দিয়েছিস। এটা শুধু এক্সিবিশন নয়, এটা এক যুদ্ধ।”

আঁচল মৃদু হেসে বলে, “জানি, আর আমার পাশে যখন তুই আছিস, তখন আমি ভয় পাই না।”

র‍্যাম্পের দুই মুখ

সুহাশিনী এদিকে অডিটোরিয়ামের মূল স্টেজে। তার কালেকশন—‘পল্লী বিলাস’ নামে এক সিরিজ, যেখানে ব্যবহৃত কাপড়, মোটিফ আর রঙ স্পষ্টভাবে আঁচলের নকশার ছায়া বহন করছে। কিন্তু তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে কিছু অস্বাভাবিক হতে চলেছে। বরং তার মুখে সেই চিরচেনা আত্মবিশ্বাস।

“এই শো আমার ক্যারিয়ারের আরেকটি উঁচু ধাপ,” মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সে বলে। “গ্রামের ঐতিহ্যকে নতুন করে শহরে এনে দেওয়া—এই তো আমার লক্ষ্য।”

সেই সময়ই, অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে ছোট্ট এক কোণায়, Anchol’s Threads-এর বুথে লোক জমতে শুরু করে। অল্প সময়েই মিডিয়া, ব্লগার আর ইউটিউবাররা হাজির—আঁচলের হাতে তৈরি ‘জলের ছায়া’, ‘রূপের রেখা’ আর ‘ধুলোর কণিকা’ শাড়িগুলি দেখে সকলে চমৎকৃত।

একজন সাংবাদিক বলে, “আপনার ডিজাইন দেখে মনে হচ্ছে, এই গ্ল্যামার পেছনে অনেক ইতিহাস আছে!”

আঁচল সরলভাবে উত্তর দেয়, “আমি শুধু আমার গ্রাম, আমার মাটির কথা বলতে চেয়েছি। ওরাই আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে সুতো দিয়ে সত্যি বলা যায়।”

মুখোমুখি সংঘর্ষ

স্টেজের শুরু হওয়ার কিছু আগে, আঁচল হঠাৎই দেখে সুহাশিনী তার দিকে এগিয়ে আসছে। আশেপাশে কেউ নেই।

সুহাশিনী কড়া গলায় বলে,

“তুমি যদি এতদূর এসেই পড়ো, অন্তত সম্মান নিয়ে ফিরে যাও। এই ফ্যাশন দুনিয়া তোমার জন্য নয়।”

আঁচল ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,

“আপনার কাছ থেকে শিখেছি যে ফ্যাশন মানেই চুরি না, বরং আত্মা থাকাটাই আসল। আপনি আমার গ্রামে গিয়ে ছবি তুলে, সেগুলোর নকশা নকল করেছেন। আমি অন্তত মাটি থেকে উঠে এসেছি, ভুয়ো সার্টিফিকেট থেকে না।”

সুহাশিনীর মুখে এক মুহূর্তের কাঁপুনি।

“তুমি কি প্রমাণ করতে পারবে?” সে গর্জে ওঠে।

ঠিক তখনই, স্বপ্ননীল হাতে এক ল্যাপটপ নিয়ে এসে বলে,

“হ্যাঁ, পারবে। আপনার যে ফ্যাশন ডিজাইন ইনস্টিটিউটের সার্টিফিকেট আপনি দাবি করেন, সেটি গত মাসেই ভুয়ো বলে ধরা পড়েছে। এবং আপনার কলেকশনেও অনেক ডিজাইন মিলে গেছে আঁচলের পুরোনো কাজের সঙ্গে, যা আমরা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করেছি।”

সুহাশিনীর মুখ থমথমে।

“তোমরা এইভাবে আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করবে?”

স্বপ্ননীল উত্তর দেয়,

“আমরা শুধু সত্যি বলছি। বাকিটা শহরের মানুষ বিচার করবে।”

আগুন ছড়ানোর চেষ্টা

সন্ধ্যার দিকে সুহাশিনীর পোষা লোক তানভীর হাজির হয় আরও দুই গুন্ডা নিয়ে। আঁচলের স্টলের কাছেই ধোঁয়ার কুন্ডলি দেখা যায়। কিছু একটা পোড়ানোর চেষ্টা চলছে।

মধুমালতীদি হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে,

“ওরা আগুন লাগাতে চাইছে!”

লোকজন ছুটে আসে। আঁচল ও স্বপ্ননীল বুঝে যায়, এ ওদের চূড়ান্ত চেষ্টা।

স্বপ্ননীল তখনই পুলিশে ফোন করে। ঠিক সেই সময়েই মিডিয়ার ক্যামেরা ঘুরে পড়ে ঘটনাস্থলে। তানভীর পালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ধরা পড়ে যায়। পুলিশ এসে সুহাশিনীকেও তুলে নেয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

আঁচলের স্টল রক্ষা পায়, কিন্তু আতঙ্কের ছায়া থেকে যায়। সে ফিসফিসিয়ে বলে,

“আমি শুধু একটা স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম, ওরা সেটা পুড়িয়ে ফেলতে চাইছিল।”

স্বপ্ননীল তার কাঁধে হাত রেখে বলে,

“তুই আগুনের ভেতর দিয়েই জন্ম নিয়েছিস। এখন তুই অন্যদের জন্য আলো হবি।”

মিডিয়ার সামনে সত্যের মঞ্চ

রাত ৯টা। বিভিন্ন চ্যানেলে হেডলাইন ঘুরছে—

  “Rising Star Anchol Exposes Fashion Fraud!”

“Anchol’s Threads: From Rural Bengal to City Lights”

“Suhashini Basu’s Fake Degree & Stolen Designs Revealed”

স্বপ্ননীলের রিপোর্ট ভাইরাল হয়ে যায়। ফ্যাশন দুনিয়ার অনেকে আঁচলের পাশে দাঁড়ায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ চলে—#AncholIsRealFashion

স্টল বন্ধ হওয়ার সময়, এক প্রবীণ মহিলা আসে আঁচলের কাছে।

“তুমি যে কাজ করছো, তা শুধু কাপড় বোনো নয়, ইতিহাস বোনো। তুমিই সত্যিকারের ডিজাইনার।”

র‍্যাম্পে আঁচল

একটা ছোট্ট অফবিট ডিজাইনার শো’র আয়োজন হয়, যেখানে আঁচল নিজে হাঁটে তার ‘জলের ছায়া’শাড়ি পরে। স্বপ্ননীল তার প্রথম লাইভ রিপোর্ট করে, এক লাইনে লেখে:

“আজকের শহর চোখে দেখেছে কীভাবে আঁচল হতে হয়। শুধু কাপড়ের নয়, সাহসের আঁচল।”

র‍্যাম্পে হাঁটতে হাঁটতে আঁচলের চোখে জল এসে যায়। দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে তালি দেয়।

স্বপ্ননীল দূর থেকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখে ছিল এক প্রশান্ত হাসি—যে হাসি একজন বিজেতার নয়, বরং একজন সঙ্গীর, যে জানে সত্যি আজ জিতেছে।

অধ্যায় ৫: শব্দ আর সুতোর রক্তচাপ

গভীর রাতে আঁচল ট্রেন থেকে নামল। গন্তব্য—তার শেকড়ের গ্রাম, চরবাঁশবেড়িয়া। রাতের অন্ধকারে ট্রেন স্টেশনের আলো ঝিমিয়ে পড়েছে। স্টেশনের বাইরে রিকশা নেই, শুধু একখানা কুয়াশায় ঢাকা পথ। আঁচল একা হাঁটতে শুরু করল। তার মনে এক অদ্ভুত হাহাকার। এ যেন শুধু এক গ্রামে ফেরা নয়, বরং তার শেকড়ের কাছে নিজের অস্তিত্ব ফেরত চাওয়ার এক যাত্রা।

গ্রামের প্রবেশমুখে এসে সে থমকে দাঁড়াল। ছোটবেলার মাঠ, পুকুর, তালগাছগুলো আগের মতোই আছে, কিন্তু যেন কোনো এক নিঃশব্দ ভয়ের ছায়া নেমে এসেছে চারপাশে। তার ছোট্ট ঘরটার সামনে পৌঁছতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল তার মা—সুমিত্রা দেবী। চোখজোড়া জলে টলমল।

“তুই…এতদিন পর?”

আঁচল মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে। মা আর মেয়ে দুজনেই বোবা কান্নায় একে অপরকে আঁকড়ে ধরে।

অতীতের ভয়াবহতা

পরদিন সকালে আঁচল দেখতে পেল তার গ্রামের মেয়েরা এখনো আগের মতোই তাঁতের কাজে জড়িত। কিন্তু তাদের চোখে একরাশ ক্লান্তি, অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা। সে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় বুড়ো মনোরঞ্জনের তাঁতের ঘরে। ছোটবেলায় সেখানেই সে শিখেছিল সুতো জড়ানো, রঙ মেশানো। মনোরঞ্জন কাকু কাশতে কাশতে উঠে বসে,

“তুই যে এত বড় ফ্যাশন ডিজাইনার হবি, তা কে ভাবতে পেরেছিল?”

আঁচল মাথা নিচু করে বলল,

“সবই তো আপনাদের শেখানো। আমি শুধু মঞ্চে দাঁড়িয়ে গেছি।”

মনোরঞ্জন কাকু হালকা হেসে বলল,

“আর তোর গ্রামকে ভুলে গেছিস।”

এই কথাটায় আঁচলের বুকটা যেন ছ্যাঁকা খেল। সে কিছু বলল না। শুধু অনুভব করল—তার আসা কেবল আবেগ নয়, দায়ও।

শহরের ছায়া গ্রামের উপর

এক বিকেলে আঁচল বাজার থেকে ফিরছিল। তখন হঠাৎই দুই বাইক আরোহী তার পথ আটকে দাঁড়াল। তারা কিছু না বলে একটা খাম ছুঁড়ে দিল আঁচলের দিকে। খামের ভেতরে শুধু একটা কাগজ—“চুপ করে যা, না হলে এই গ্রাম থাকবে না।”

আঁচল বুঝে গেল, এটা শুধুই হুমকি নয়। সুহাশিনীর শিকড় এবার গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়েছে। তারা চাইছে আঁচল চুপ থাকুক, যাতে শহরের বাজারে সুহাশিনীর ব্র্যান্ড টিকে থাকে। আঁচলের মুখে থমথমে এক কঠোরতা নেমে এল। সে বাড়ি ফিরে মা-কে কিছুই জানাল না। শুধু ফোন করল স্বপ্ননীলকে।

“তাদের হাত গ্রামে পৌঁছে গেছে।”

ওপাশ থেকে স্বপ্ননীলের গলা,

“তাহলে সামনে থেকে লড়তে হবে। আমি আসছি।”

গ্রামবাসীদের ক্ষোভ

পরদিন পঞ্চায়েত অফিসে আঁচল সভা ডাকল। গ্রামের সব বয়স্ক আর তরুণ-তরুণীরা উপস্থিত। আঁচল বলল,

“তোমরা জানো, আমার তৈরি ডিজাইন এখন শহরে সুহাশিনী নিজের নামে চালাচ্ছে। আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি, কিন্তু সে এখন আমাদের গ্রামেও ভয় দেখাচ্ছে।”

এক প্রবীণ গৃহবধূ বললেন,

“তোর শাড়ির ডিজাইন তো আমাদেরই শেখানো। তুই তো শুধু নাম করলি।”

আঁচল উত্তর দিল,

“আপনারাই আমার শিক্ষক। আমি কিছু পাইনি, শুধু শহরের একটা সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি শুধু আপনাদের কাজটাকে শহরে দেখাতে পেরেছি।”

গ্রামবাসীদের চোখে তখন সত্যিটা ফুটে উঠল। তারা অনুভব করল, আঁচল তাদেরই প্রতিনিধি।

স্বপ্ননীলের আগমন ও তদন্ত

স্বপ্ননীল এসে পৌঁছাল রাতে। সঙ্গে আনল কিছু রেকর্ডিং, সুহাশিনীর প্রাক্তন কর্মীদের সাক্ষাৎকার আর তার নকল ডিজাইন প্রমাণ করার ছবি। পরদিন সে স্থানীয় এক থানা-তে অভিযোগ জানাল—গ্রামে হুমকির ঘটনা নিয়ে। পুলিশ আশ্বাস দিল, তদন্ত শুরু হবে।

এদিকে, আঁচলের উদ্যোগে গ্রামের কয়েকজন তরুণী নিয়ে এক ডিজাইন কর্মশালা শুরু হয়। সুতো, রং, ডিজাইনের খাতায় তারা নতুন করে আঁচলের পুরনো স্কেচ নিয়ে কাজ শুরু করল।

“আমরা এবার নিজেরা শাড়ি বানাব, নিজেরা নাম রাখব, নিজেরা বিক্রি করব,”—বলল এক কিশোরী।

আঁচলের মুখে হাসি ফুটল। সে জানে, এই বিপ্লব শুধু তার একার নয়, এই পুরো গ্রামের।

রাত্রির হামলা

এক রাতে আঁচল উঠোনে বসে ছিল। আচমকাই পেছন দিক থেকে কয়েকটা ছায়ামূর্তি ঢুকে পড়ে। তাদের হাতে লাঠি। তারা আঁচলকে ঘিরে ফেলে।

“আমরা বলে দিয়েছিলাম, চুপ করে যা। এবার শোন না, তোকে শিখিয়ে দেব কীভাবে চুপ থাকতে হয়।”

কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে গেট ভেঙে কয়েকজন গ্রামবাসী ঢুকে পড়ে। তাদের হাতে লাঠি, মশাল। স্বপ্ননীল সঙ্গে করে লোক এনেছিল। হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। আঁচল পড়ে যায় উঠোনে।

স্বপ্ননীল তাকে তুলে ধরে,

“তুই ঠিক আছিস?”

আঁচল শ্বাস নিতে নিতে বলল,

“আমি ঠিক আছি। এবার শুধু সামনে তাকাতে হবে।”

লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞা

পরদিন সকালে পুরো গ্রাম আঁচলের পাশে দাঁড়াল। মেয়েরা বলল, “আমরাও কাজ শিখতে চাই। আমরা ভয় পাব না।” ছেলেরা বলল, “এই গ্রামে বাইরের গুন্ডা ঢুকবে না।”

আঁচল মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলল,

“এই গ্রাম, এই তাঁত, এই মাটি—সবই আমাদের। কেউ এসে আমাদের গল্প কেড়ে নিতে পারবে না। আমরা তৈরি করব আমাদের ব্র্যান্ড, আমাদের নাম, আমাদের ভবিষ্যৎ।”

স্বপ্ননীল তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

“এই গল্প শুধু সংবাদপত্রে নয়, বিশ্বমঞ্চে যাবে। আমি প্রতিটি মুহূর্ত তুলে রাখব। কারণ এই গল্প রক্তের, এই গল্প সুতোর, এই গল্প শব্দের।”

আঁচল তাকিয়ে থাকল সামনে। তার চোখে ভোরের সূর্যের মতো আলো। সামনে একটা নতুন দিন, নতুন প্রতিজ্ঞা, আর নতুন এক বিপ্লব—যেখানে শব্দ আর সুতোর রক্তচাপ মিলেমিশে তৈরি হবে এক ইতিহাস।

অধ্যায় ৬: ভাঙনের শব্দ, গড়ার হাত

রাত পেরিয়ে সকাল আসে। গ্রামে চারদিকে একটা চাপা উত্তেজনা, যেন ঝড়ের আগে নিঃশব্দ প্রস্তুতি। আঁচল উঠোনে বসে শুকনো হলুদ রঙের তুলো মেশাচ্ছে সুতোয়। পাশে দাঁড়িয়ে স্বপ্ননীল ক্যামেরা সেট করছে।

“আজকের ভিডিওটা তোমার গল্প দিয়ে শুরু হবে,” স্বপ্ননীল বলল।

আঁচল মাথা নাড়ল, “আজ গল্প নয়, যুদ্ধের শুরু।”

ডিজাইন কর্মশালার সম্প্রসারণ

গ্রামের প্রায় ২০ জন কিশোরী ও গৃহবধূ মিলে আঁচলের নির্দেশনায় নতুন ডিজাইন শেখা শুরু করেছে। বোনা হচ্ছে নানা ধরনের শাড়ি—তাঁত, জমদানি, ব্লক প্রিন্ট, হ্যান্ড-পেইন্টেড।

কাজ চলার সময় আঁচল প্রত্যেককে শেখায়—

“যে ডিজাইনে হৃদয় থাকে, সেটাই আসল ব্র্যান্ড। নাম নয়, কাজে বিশ্বাস আনো।”

স্বপ্ননীল তাদের গল্প ক্যামেরায় বন্দি করে। সে বলল,

“আমি এটা এক আন্তর্জাতিক ডিজাইন ব্লগে পাঠাব। বিশ্বকে জানতে হবে—এই গ্রামে কেমন সৃষ্টির জন্ম হয়।”

শহরের পাল্টা কৌশল

এদিকে সুহাশিনী বসু ব্যাকফুটে যাওয়ার বদলে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। সে এক নামী আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে নতুন মামলা করে,

“আঁচল সরকার তার নামে কুৎসা রটাচ্ছে, এবং নিজেকে ব্র্যান্ড দাবি করছে যা আদতে তার নয়।”

মামলার কপি আঁচলের হাতে আসে। আঁচল চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে,

“ও যদি আদালতে খেলে, আমিও খেলব। তবে সত্যি নিয়ে।”

স্বপ্ননীল বলল,

“আমার কাছে সব সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। ভিডিও, অডিও, ছবি—সব। এবার লড়াইটা বড় মঞ্চে নিতে হবে।”

প্রশাসনিক যোগাযোগ

আঁচল যোগাযোগ করে পশ্চিমবঙ্গ হ্যান্ডলুম বোর্ডের এক কর্মকর্তার সঙ্গে। প্রথমে কেউ গুরুত্ব দিতে চায় না। কিন্তু যখন আঁচল তাদের কাজের নমুনা, সুহাশিনীর চুরি করা ডিজাইন ও গ্রামের মেয়েদের ভিডিও প্রেজেন্টেশন পাঠায়, তখন একটা ইমেল আসে:

“আপনারা যদি কলকাতায় এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ করেন, আমরা সরকারি স্বীকৃতির জন্য বিবেচনা করব।”

গ্রামে যেন উৎসব শুরু হয়। প্রথমবার, গ্রামের শাড়ি সরকারি মঞ্চে যাবে।

প্রেমের শিকড়

রাত্রির শান্ত চাঁদের আলোয় আঁচল একা বসে। হঠাৎ স্বপ্ননীল পাশে এসে বসে। বলল,

“তুমি জানো, আমি কখনো ভালোবাসা বলতে পারিনি। কিন্তু তোমাকে দেখে বুঝলাম, ভালোবাসা মানে একসঙ্গে গড়া।”

আঁচল একটু হেসে বলল,

“আমারও তো কেউ ছিল না যাকে ভরসা করা যায়, কিন্তু তুই এলি। মনে হল, আমার পাশে একটা পাহাড় দাঁড়িয়ে।”

স্বপ্ননীল তার হাত ধরে। কোনোকথা নেই, শুধু হাতের উষ্ণতায় প্রতিজ্ঞা গাঁথা হয়ে যায়।

কলকাতার প্রদর্শনী

কলকাতার মিত্রসদনে এক বস্ত্র-প্রদর্শনী। আঁচল ও তার দলের নাম ঘোষিত হয়, “চরবাঁশবেড়িয়া তাঁতকথা”। ২৫টি শাড়ি নিয়ে তারা পৌঁছায় মঞ্চে। সুহাশিনীও উপস্থিত। সে চোখে চোখ রাখে আঁচলের সঙ্গে। কিন্তু এইবার আঁচলের চোখে ভয় নেই, আছে স্পর্ধা।

মঞ্চে ঘোষণা আসে—

“এই গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে চরবাঁশবেড়িয়ার নারীশক্তিকে আমরা হ্যান্ডলুম ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করছি।”

আঁচল, স্বপ্ননীল, মনোরঞ্জন কাকু এবং বাকি মহিলারা মঞ্চে ওঠে। সাংবাদিকরা ফ্ল্যাশ জ্বালাতে থাকে।

এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করে,

“আপনি কীভাবে প্রমাণ করলেন সুহাশিনী বসু নকল করেছিলেন?”

স্বপ্ননীল সামনের প্রজেক্টরে চালায় ভিডিও—এক প্রাক্তন কর্মী বলছে,

“ডিজাইনগুলো আঁচল সরকারের নামেই এসেছিল। আমরা শুধু ট্যাগ পাল্টে দিতাম।”

ঘরে পিন পতন নীরবতা। সুহাশিনী মুখ নিচু করে বেরিয়ে যায়।

গ্রামে ফেরা এবং নতুন শপথ

ফেরার ট্রেনে আঁচল জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। স্বপ্ননীল বলে,

“এখন তুই কী করবি?”

আঁচল মৃদু হেসে বলে,

“একটা স্কুল গড়ব। যেখানে গ্রামের মেয়েরা শাড়ি বুনবে, ডিজাইন শিখবে, ব্যবসা বোঝার ভাষা পাবে।”

স্বপ্ননীল বলে,

“তাহলে তোরা শুধু ব্র্যান্ড না, বিপ্লব গড়ছিস।”

আঁচল হাসে, তার চোখে ভোরের মতো এক দৃঢ় আলো।

গড়ার গল্পের শুরু

গ্রামে ফিরে প্রথম দিনেই “তাঁতশালা” নামে একটা নতুন কেন্দ্রের কাজ শুরু হয়। মেয়েরা এসে নাম লেখায়। আঁচল বলে,

“আজ থেকে আমাদের কারখানা শুধু কাপড় নয়, স্বপ্ন বুনবে।”

আর একপাশে স্বপ্ননীল দাঁড়িয়ে ক্যামেরা চালু করে।

তার ভেতরেও এখন কেবল সংবাদ নয়, ভালোবাসার গল্প গড়ে উঠছে।

এইভাবেই আঁচলের জীবন আর গ্রাম একসাথে নতুন স্বপ্নের দিকে এগিয়ে চলে—যেখানে প্রতিটি সুতোয় থাকে আত্মসম্মানের বুনন আর ভালোবাসার শব্দ।

অধ্যায় ৭: আলোর বুনন

পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠছে ধীরে ধীরে। চরবাঁশবেড়িয়ার আকাশ যেন আগুনে লাল, আলোয় রাঙা। আঁচল উঠোনে বসে নতুন এক স্কেচ এঁকে চলেছে—একটা বুননের মাঝখানে ছোট্ট একটা প্রদীপ, যার আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। পাশে রাখা স্কেচবুকের নিচে ‘তাঁতশালা’ নামে তার নতুন প্রতিষ্ঠানের লোগো আঁকা।

পেছন থেকে স্বপ্ননীলের গলা,

“এই স্কেচটা নাম কী রাখছ?”

আঁচল হেসে বলল,

“আলোর বুনন।”

স্বপ্ননীল বলল,

“তাহলে আজ থেকেই নতুন অধ্যায় শুরু হোক।”

তাঁতশালার প্রসার

তাঁতশালা এখন আর শুধু গ্রামের কয়েকজন মেয়ের শেখার জায়গা নয়, বরং এক বিপ্লবের ঘর হয়ে উঠেছে। আশপাশের তিনটে গ্রামের মেয়েরাও আসতে শুরু করেছে। নিয়মিত ওয়ার্কশপ হচ্ছে—ডিজাইন, রঙের ব্যবহার, ডিজিটাল মার্কেটিং, প্রাইসিং ও ব্র্যান্ডিং নিয়ে।

আঁচল এক নতুন মডেল চালু করে—”এক তাঁত, এক কাহিনি”। প্রতিটি শাড়ির সঙ্গে একজন তাঁতকারিণীর ব্যক্তিগত গল্প যুক্ত হয়। সেই গল্প লিখে দেয় স্বপ্ননীল, ভিডিও করে তুলে ধরে সামাজিক মাধ্যমে। এক শাড়ি মানে শুধু একটি পোশাক নয়, বরং এক জীবন, এক সংগ্রামের গল্প।

মুম্বই ইনফ্লুয়েন্সার কনট্যাক্ট

স্বপ্ননীলের যোগাযোগে এক মুম্বইয়ের ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সার—নাতাশা রাও—তাদের ব্র্যান্ডের কিছু শাড়ি অর্ডার করে। সে নিজের ইনস্টাগ্রামে লেখে:

 “আমি আজ যে শাড়িটা পরেছি, সেটি শুধু একটি পোশাক নয়, এটি হল আঁচলের সৃষ্টি, চরবাঁশবেড়িয়ার গল্প, আর এক নারীর লড়াইয়ের নিদর্শন। #Taatshala #WeaveYourStory”

২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫০০টি অর্ডার আসে। আঁচল অবাক। স্বপ্ননীল বলে,

“তুই এখন শুধু ফ্যাশন ডিজাইনার না, এক মুভমেন্টের মুখ।”

সুহাশিনীর প্রত্যাবর্তন

কলকাতার এক ইভেন্টে আঁচলকে বিশেষ অতিথি হিসেবে ডাকা হয়। সেখানে সুহাশিনী বসুও উপস্থিত। দুই নারীর আবার মুখোমুখি হওয়া। সুহাশিনী বলল,

“তুই জিতেছিস, আঁচল। কিন্তু মনে রেখ, আমি তোকে গড়েছিলাম, আজ তুই আমায় ভাঙলি।”

আঁচল শান্তভাবে উত্তর দেয়,

“তুমি আমার নাম নাওনি, আমার গ্রামকে দখল করতে চেয়েছিলে। আমি শুধু ফিরিয়ে দিয়েছি, যা আমাদের।”

এই কথাগুলো হলভর্তি দর্শকদের সামনে অন্য এক আলোয় তুলে ধরে আঁচলকে।

আন্তর্জাতিক ফ্যাশন উইক

তাঁতশালার শাড়িগুলো এবার মনোনীত হয় সিঙ্গাপুর ফ্যাশন উইকে। আঁচল প্রথমবার দেশের বাইরে পা রাখে। গ্রামের মেয়ে, সাধারণ তাঁতের কারিগরদের তৈরি শাড়ি—আন্তর্জাতিক র‍্যাম্পে পা রাখে।

সেখানে একটা থিম-প্রেজেন্টেশনে আঁচল বলে,

“We don’t just weave sarees, we weave voices. This is not fashion, this is identity.”

সারা হল তালি দিয়ে ফেটে পড়ে। মডেলদের পরনে সেই একই গ্রামীণ তাঁত, কিন্তু উপস্থাপন নতুন এক বার্তা—শিকড় থেকে উড়ান।

ব্যক্তিগত সংঘাত ও গ্রহণযোগ্যতা

এক রাতে আঁচল বাড়ি ফিরে দেখে মা সুমিত্রা দেবী বিছানায়। বয়স বেড়েছে, শরীর দুর্বল। মা বলে,

“তুই তো এখন বড়! কিন্তু মনে রাখিস, ছোট থেকে তোর আঁচল আমি ধরেছিলাম, আজও ধরেই আছি।”

আঁচল মায়ের পাশে বসে। চোখে জল। এক অদৃশ্য আশ্রয় যেন আবার ফিরে পায়। সে বুঝে, যত বড় হোক, সে তার শেকড় হারায়নি।

প্রেমের বাঁধন

স্বপ্ননীল এক সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে যায় সেই তালগাছটার নিচে, যেখানে আঁচল ছোটবেলায় খেলা করত। তার হাতে একটা কাপড়ের বাক্স। খুলে দেখায়—একটা ছোট শাড়ি, তাতে লেখা, “আমাদের গল্পের বুনন এখন শুরু হোক, আজীবনের জন্য।”

আঁচলের চোখ ছলছল। সে বলে,

“তুই তো কেবল একজন সংবাদিক না, তুই আমার শব্দহীন সময়ের ভাষা।”

স্বপ্ননীল বলে,

“তুই আমার বুননের কেন্দ্র।”

গ্রামের আলো জ্বলে উঠছে একে একে। তাদের দুজনের চোখেও একইরকম আলো।

ভবিষ্যতের স্বপ্ন

তাঁতশালার ছাদে দাঁড়িয়ে আঁচল সামনে তাকায়। দূরে মাঠে ছেলেমেয়েরা খেলছে, মেয়েরা শাড়ি রঙ করছে, কেউ ভিডিও করছে, কেউ প্রোডাক্ট প্যাক করছে।

সে মনে মনে ভাবে, “আমার স্বপ্ন শহর থেকে গ্রামে ফিরেছে। এখন এই গ্রাম শহর হয়ে উঠবে—আত্মসম্মানের শহর, কাজের শহর, ভালোবাসার শহর।”

সে নিচে নেমে আসে। বোর্ডে লেখা,

“Taatshala – Where every thread tells a story.”

একটা স্বপ্ন যে কতটা দূর যায়, তা নির্ভর করে না কেবল তার দৌড়ের উপর, বরং নির্ভর করে তার মাটির শিকড়ের উপর। আঁচল সেই শিকড়কেই আজ গল্প করে তুলেছে—রঙে, সুতোয়, শব্দে।

অধ্যায় ৮: চূড়ান্ত উন্মোচন

সকালবেলা। চরবাঁশবেড়িয়া গ্রামের মাঠে আজ অন্যরকম ব্যস্ততা। লাল, হলুদ, বেগুনি কাপড়ের ঝালর ঝুলছে চারপাশে। নতুন করে রঙিন করে তোলা হয়েছে তাঁতশালার বাইরের দেয়াল। আঁচল দাঁড়িয়ে আছেন প্রবেশদ্বারে, তাঁর পাশে স্বপ্ননীল। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে প্রশান্তির দীপ্তি। আজ তাঁদের জীবনের সবচেয়ে বড় দিন—তাঁতশালার চূড়ান্ত উদ্বোধন এবং আন্তর্জাতিক ‘রুরাল টেক্সটাইল ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড’প্রদান।

অতিথিদের আগমন

সকাল ১১টা নাগাদ গাড়ি থেকে নামলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হ্যান্ডলুম বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা। সঙ্গে রয়েছেন দু’জন আন্তর্জাতিক গবেষক, এক ফ্যাশন অ্যাক্টিভিস্ট এবং মিডিয়ার অনেকে। তাঁদের চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে থাকে গ্রামের পরিবেশের দিকে। স্বপ্ননীল হাসিমুখে বলে,

“এটাই আমাদের শোরুম, আমাদের স্টেজ, আর এই মাঠটাই আমাদের ক্যাটওয়াক।”

গর্বের মঞ্চ

তাঁতশালার মূল প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী স্টেজ। মঞ্চের ওপর ১২ জন গ্রাম্য মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন—প্রত্যেকের হাতে তাদের বোনা শাড়ির একটি নমুনা। শাড়ির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে QR কোড, স্ক্যান করলেই উঠে আসে সেই শাড়ির পেছনের গল্প, কারিগরের নাম, কতদিন সময় লেগেছে তৈরিতে।

আঁচল মাইকে উঠে বলে, “আজকের এই শাড়ি শুধু পোশাক নয়। এই প্রতিটা সুতোয় রয়েছে আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের স্বপ্ন। এই তাঁতশালায় আমরা শুধু কাপড় তৈরি করি না, আমরা নিজেরা নিজেদের নতুন করে বুনি।”

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

অতিথিদের মধ্যে একজন—ড. ক্যারেন ফস্টার, কানাডার একটি ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল কালচার বিভাগের গবেষক, বলেন, “আমরা এমন বহু প্রজেক্ট ঘুরে দেখেছি, কিন্তু চরবাঁশবেড়িয়ার ‘তাঁতশালা’ এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এখানে কেবল হস্তশিল্প নয়, এক সামাজিক পরিবর্তনের তরঙ্গও কাজ করছে।”

তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আঁচলকে হাতে তুলে দেন সম্মানপত্র ও একটি রৌপ্য ট্রফি। সবাই করতালি দেয়। চোখের কোণে জল ধরে রাখতে পারেন না আঁচল। পাশে স্বপ্ননীল মৃদু হাসে, বলে,

“আজকের দিনটা তোর জীবনের গল্পের শিখর, আঁচল।”

সুহাশিনীর শেষ প্রচেষ্টা

ঘটনার ঠিক আগের রাতে আঁচলের কাছে আসে সুহাশিনী বসু। গাড়ির আলো আঁধারিতে মুখ দেখা যায় না পুরোপুরি, কিন্তু গলায় করুণতা। সে বলে, “তুই যদি চাইস, আমরা একটা যৌথ ব্র্যান্ড করতে পারি। তোকে মুখ করে, আমি ফান্ডিং আর মার্কেটিং সামলাবো।”

আঁচল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল,

“তুমি যখন আমার ডিজাইন চুরি করেছিলে, তখন তো আমি ছিলাম না তোমার ব্র্যান্ডে। আজ যখন আমি দাঁড়িয়ে গেছি, তখন তোমার হাত ধরার প্রয়োজন নেই। আমি একাই যথেষ্ট।”

সুহাশিনী এবার আর কোনো কথা বলেনি। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফিরে গেছে। আঁচল জানত—এটাই শেষ দেখা।

ভালোবাসার প্রস্তাব

সন্ধ্যা নামার সময় মঞ্চে আসে স্বপ্ননীল। সে হাত মাইকে তুলে বলে,

“আজ আমি শুধু সাংবাদিক না, আমি একজন গল্পের চরিত্র। আঁচল, আজ যদি তুই রাজি থাকিস, আমি চাই তোর প্রতিটা গল্প আমি আমার জীবন দিয়ে লিখি।”

সবাই চমকে ওঠে। আঁচল হেসে বলে,

“তুই তো অনেক আগেই আমার হৃদয়ের ক্যানভাসে লেখা হয়ে গেছিস। আজ শুধু তার মোড়ক উন্মোচন।”

তাদের আলিঙ্গন দেখে মাঠে থাকা মানুষজন হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ে।

ভবিষ্যতের রূপরেখা

এক সপ্তাহ পর আঁচল ও স্বপ্ননীল মিলে খুলে ফেলেন ‘তাঁতশালা একাডেমি’—যেখানে বিনামূল্যে শিখবে গ্রামের মেয়েরা ডিজাইন, সোশ্যাল মিডিয়া, বিজনেস মডেল আর লিগ্যাল রাইটস। আঁচলের নতুন স্বপ্ন, প্রতিটি গ্রামে একটি তাঁতশালা। তিনি একটি মোবাইল অ্যাপও চালু করেন, যাতে গ্রাহকরা সরাসরি তাঁতকারিণীর কাছ থেকে পণ্য অর্ডার করতে পারেন। মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না।

উপসংহার

এক দুপুরে, আঁচল আর স্বপ্ননীল উঠোনে বসে চা খাচ্ছে। পাশের উঠোনে মেয়েরা শাড়ি বুনছে, কেউ কেউ নতুন ডিজাইন নিয়ে আলোচনা করছে। দূরে দেখা যায়, ছোট্ট কিশোরী রুপা, আঁচলের প্রথম শিক্ষার্থী, এখন নতুন এক কোর্স চালাচ্ছে।

স্বপ্ননীল বলে,

“তোর কি মনে হয়, এটাই শেষ?”

আঁচল হেসে বলে,

“শেষ নয়, এটা শুরু। কারণ যতদিন এই মাটিতে শব্দ থাকবে, আর হাতে থাকবে সুতো, ততদিন আমাদের গল্প শেষ হবে না।”

চরিত্রেরা এখনো বুনে চলেছে তাদের গল্প। একেকটা সুতোয় বাঁধা রয়ে যাচ্ছে ভালোবাসা, আত্মসম্মান আর প্রতিরোধের ইতিহাস।

এইভাবেই শেষ হয় আঁচলের গল্প। তবে যেখানেই থাকবে অন্যায়ের ছায়া আর প্রতিরোধের সাহস, সেখানেই আঁচলের গল্প নতুন করে বোনা হবে।

শেষ।

WhatsApp-Image-2025-06-06-at-3.29.59-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *