Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প - সামাজিক গল্প

“অ আ ক খ”

Spread the love

নদীর পাড়ের সেই ছোট্ট চায়ের দোকানটা দিনের শেষে যেন এক শান্তির আশ্রয় হয়ে উঠত আশেপাশের শ্রমজীবী মানুষদের জন্য। পাশ দিয়ে গঙ্গার একটি শাখানদী বয়ে গেছে, তার জল সবসময়ই মাটি ছুঁয়ে যায়, আর গ্রীষ্ম হোক বা শীত—সন্ধ্যার দিকে বাতাসে একধরনের স্নিগ্ধতা নেমে আসে। আব্দুল হালিম প্রায় তিরিশ বছর ধরে এই দোকান চালিয়ে আসছেন। বয়স পঞ্চাশ পার করলেও মুখে এখনো সেই নরম হালকা হাসি। সকালে দোকান খোলার সময় সে নিজেই ঝাঁট দেয়, ঠেলাগাড়ি থেকে বিস্কুটের কৌটো নামায়, দুধ ফুটিয়ে চা বানায়। তারপর একে একে আসে রিনা, নিতাই আর গোলাম—তিনজন শিশু-কিশোর, যারা বাড়ির অভাবের কারণে স্কুল ছেড়ে এই দোকানেই কাজ করে। রিনা কাজ করতে করতেই মুখ টিপে হাসে, কথা বলে ক্রেতাদের সঙ্গে, আর নিতাই গামলা ধোয়, গ্লাস মুছে রাখে সারি দিয়ে। গোলাম বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে সে চায়ের কাপ বিলি করে। বিকেল হলেই দোকান গমগম করে ওঠে—কেউ পাটের মিল থেকে ফেরে, কেউ কাঠের সওদাগরি করে, কেউবা কলেজ ফেরত তরুণ। হালিম সবার চা বানাতে বানাতে লক্ষ্য করেন—এই তিনজন ছেলেমেয়ে তার জন্য অনেকটা সময় দিচ্ছে, অথচ ওরা কেউই লেখাপড়ায় নেই।

এক সন্ধ্যায়, ক্রেতারা চলে যাওয়ার পর, চায়ের হাঁড়িটা ধুয়ে রেখে হালিম রিনাকে ডাকে। তার সামনে একটা পুরোনো খাতা রেখে বলে, “তোর নামটা লিখে দেখ তো, রিনা।” রিনা একটু হেসে বলে, “আমি পারি না কাকু।” হালিম অবাক হয় না, শুধু বলে, “ঠিক আছে, আমি দেখাচ্ছি।” তারপর সে কাঠের বেঞ্চিতে বসে গিয়ে পাতায় চক দিয়ে “অ” লেখে—বড় করে, যত্ন করে। তারপর বলে, “এইটা ‘অ’। এবার তুই লেখ।” রিনা একটু ইতস্তত করে, তারপর চেষ্টা করে, বাঁকা টেরা একটা অক্ষর উঠে আসে পাতায়। এরপর নিতাই আর গোলামও এগিয়ে আসে, তারাও দেখে, আগ্রহী হয়। হালিম হঠাৎ বুঝতে পারেন, তার জীবনের এতগুলো বছরের চা বানানো আর হিসেব রাখার বাইরে একটা নতুন দরজা খুলে যাচ্ছে—একটা শব্দের দরজা, যেটা সে নিজেই একদিন বন্ধ করে রেখেছিল। স্কুল সে খুব বেশিদিন যেতে পারেনি, সংসারের টানে মাঝপথেই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বুকের ভিতর সেই চিরকালীন তৃষ্ণা থেকেই গেছিল—অ আ ক খ শেখার, শেখানোর। এবার মনে হয়, এই নদীর পাড়ে সেই তৃষ্ণাকে জল দিতে পারবেন। হালিম আর দেরি করেন না—প্রতিদিন রাতে দোকান বন্ধ করার পর ৩০ মিনিট করে তারা বসে। সে chalk দিয়ে লেখে কাঠের ফলকে, আর রিনারা দেখে, কপি করে।

এরপর দিন গড়ায়। রিনা “অ” থেকে “আ”, “ই”, “ঈ” শিখে ফেলে। নিতাই নিজের নামের প্রথম অক্ষর “ন” চিনে নেয়। চায়ের দোকানের চারপাশের মানুষ প্রথমে মজা করে, বলে, “শিক্ষার ক্লাস নাকি দোকানে?” হালিম হাসেন, কিছু বলেন না। তার চোখের ভিতর একরাশ শান্তি, যেন এই কাজটাই তার জীবনের আসল অর্থ। কিন্তু এই পথ সহজ নয়। একদিন রিনার মা এসে ধমক দিয়ে বলে, “চা বানাতে আসিস, পড়াশোনার ভেলকি ছাড়।” হালিম শান্ত গলায় বলেন, “তোমার মেয়েটা নিজের নামটা লিখতে পারবে, সেটাও কি খারাপ?” এরপর কিছু লোক উৎসাহ দিতে শুরু করে, কিছু চুপ করে দেখে। কিন্তু হালিম জানেন—একেকটা বর্ণ শেখানো মানে একটা মন তৈরির শুরু। আর এই শুরু হয়তো একদিন বদলে দেবে রিনাদের জীবন। দোকানের দেয়ালে হালিম একটা ছোট কাঠের ফ্রেমে টানিয়ে রাখেন—“এইখানে অ আ ক খ শেখানো হয়”—আর তার নিচে তিনটে ছোট মুখ প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে আলোর মতো জ্বলে ওঠে। শব্দেরা ধীরে ধীরে তাদের চিন্তাকে বদলে দিতে থাকে, আর হালিম বুঝে ওঠেন—চায়ের দোকান আজ আর শুধু দোকান নয়, হয়ে উঠছে একটা দরজা, যেখান থেকে তারা এক নতুন পৃথিবীতে পা রাখছে।

শীতের একটা সন্ধ্যা। গাছপালার ফাঁক দিয়ে রোদ পড়ছিল নদীর ওপরে, আর হালিম চাচার দোকান গরম চায়ের ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে উঠছিল। দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চে বসে ছিল রিনা আর নিতাই। তাদের চোখে একটা আশ্চর্য উৎসাহ—আজ তারা নতুন অক্ষর শিখবে। হালিম একটা পুরোনো ইংরেজি ব্যাবসার খাতা নিয়ে বসে বললেন, “আজ আমরা ‘ক’ শিখব। কাক, কলা, কুঁড়েঘর—সব ক দিয়ে শুরু।” রিনা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “কাক ক কাক!” হালিম মুচকি হাসলেন। এই কাক, কলা, খাট—এসব প্রতিদিনের জীবনের জিনিস এখন তাদের শেখার মাধ্যম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খেলার ছলে তারা প্রতিটি অক্ষরের সাথে নিজস্ব গল্প বেঁধে নিচ্ছে। নিতাই বলল, “আমার তো মনে হয় নদীও ক দিয়ে শুরু হয়!”—হাসি ফেটে পড়ে, কিন্তু হালিম তাকে থামান না। তিনি বলেন, “নদী হয়তো ‘ন’ দিয়ে শুরু হয়, কিন্তু ভাবার ক্ষমতা তোমার মধ্যে জেগে উঠেছে, এটাই বড় কথা।”

কিছুদিনের মধ্যেই এই রাতে পড়ার রেওয়াজটা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। দু-একজন বাচ্চা, যারা দোকানে কাজ করে না, তারাও আগ্রহ নিয়ে দেখে। মুকুল নামে একটা ছেলে এসে দাঁড়ায় এক সন্ধ্যায়, বলে, “চাচা, আমিও শিখতে চাই। আমার বাবা বলেছে স্কুলে ভর্তি করাবে না, কিন্তু আমি পড়তে চাই।” হালিম একটু ভেবে নেয়, তারপর মাথা নাড়ে—“আয়, এখানে বস।” রিনারা তাকে জায়গা দেয়। হালিম বুঝতে পারেন, এ তো এখন আর শুধু তার দোকান নয়, এটা হয়ে যাচ্ছে একটা ক্লাসরুম, এক বিকল্প পাঠশালা। রিনা এখন ছোটদের মধ্যে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ। সে শুধু অ আ ক খ শেখেনি, এখন খাতায় নিজেই শব্দ গড়ে, লিখে—”আমার নাম রিনা”, “আমি চা বানাই”, “আমার মা রান্না করে।” এই লেখা সে নিজেই পড়ে aloud করে, আর হালিম চুপ করে শোনেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে দোকান বন্ধ করার আগে বোঝেন, এই অক্ষরের আলোই একদিন তাদের অন্ধকার ভবিষ্যতের পথ দেখাবে।

তবে এই পথের বাঁধাও কম নয়। কিছু অভিভাবক অশিক্ষার অলিখিত সংস্কার নিয়ে অন্ধ। তারা ভাবে—মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে উচ্ছৃঙ্খল হবে, ছেলেরা বই মুখে করে বসলে রোজগার কমবে। একদিন নিতাইয়ের বাবা এসে ধমক দেয়—“চায়ের দোকানে কাজ করিস, ঠিক আছে। কিন্তু লেখাপড়ার ভূত ঢুকেছে তোর মাথায়?” নিতাই চুপ করে থাকে। পরে সে হালিমকে বলে, “আমার বাবাকে বোঝাতে পারি না, কিন্তু আমি আর আগের মতো বাঁচতে চাই না।” হালিম তখন তাকে কাঁধে হাত রেখে বলেন, “একদিন তুই নিজে লিখে বলবি, তোর কী করা উচিত। সেই দিনটা পর্যন্ত আমি আছি।” সেই মুহূর্তে যেন একটা আলোকছটা খেলে যায় তাদের মাঝে—এক অক্ষরের শক্তি তখন আর কাগজে সীমাবদ্ধ থাকে না, ছড়িয়ে পড়ে হৃদয়ে, স্বপ্নে, সাহসে। অ আ ক খ-এর প্রতিটি অক্ষর তখন হয়ে ওঠে প্রতিরোধ, প্রতিজ্ঞা আর প্রেরণার প্রতীক। আর হালিমের দোকান—সে তো নিঃশব্দে আলো ছড়াতে শুরু করেছে।

সেই দিনটা ছিল একটি ছুটির দুপুর। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু গাছের ছায়াগুলি একটু একটু করে ঘুরে পড়ছিল দোকানের পাশে। হালিম তখন দোকানের বেঞ্চে বসে ঘাম মুছছিলেন। রিনা আর নিতাই চায়ের কাপ ধুচ্ছিল পেছনের কলের ধারে। ঠিক তখনই দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন এক শহুরে পোশাক পরা মহিলা—হাতভর্তি কাগজের ফাইল, পিঠে একটা ঝোলা ব্যাগ, চোখে রোদচশমা। তিনি কিছুটা ক্লান্তভাবে বললেন, “এক কাপ লাল চা হবে?” হালিম চমকে উঠে অভ্যর্থনা করলেন। উনি মীনা সেন, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী, কলকাতা থেকে এসেছেন আশপাশের গ্রামের শিশু স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষয়ে একটি ফিল্ড স্টাডি করতে। দোকানের চা খেতে খেতে তিনি রিনার চোখে কিছু আলাদা খেয়াল করলেন—মেয়েটা চুপচাপ থাকলেও তার ভেতরে যেন কিছু বলার আছে। তারপরই মীনার চোখ আটকে গেলো দোকানের পিছনের কাঠের ফলকে, যেখানে খাতায় চক দিয়ে লেখা “অ”, “আ”, “ই”, “ঈ”—আরো কিছু অসম্পূর্ণ অক্ষর। বিস্মিত হয়ে তিনি জানতে চাইলেন, “এগুলো কে লিখেছে?”

হালিম মাথা নিচু করে বললেন, “আমি—মানে, ওরা কেউ পড়তে পারে না। রাতে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে ওদের একটু একটু শেখাই।” মীনা কপালে হাত রাখলেন, যেন গর্বে কিছুটা বিস্ময়ে। “তাহলে আপনি তো একরকম বিকল্প স্কুলই খুলে ফেলেছেন, হালিমদা!”—তিনি হেসে বললেন। এরপর তিনি মিনিট পনেরো বসে রিনার সঙ্গে কথা বলেন, তাকে “তোমার নাম লেখো তো” বলতেই রিনা গুটিগুটি করে খাতায় লিখে দেয়, “রিনা খাতুন”। মীনার চোখে জল এসে যায়। তিনি বুঝতে পারেন—এই যে একটুকরো অক্ষর চুপচাপভাবে জন্ম নিচ্ছে নদীর পাড়ে, তা হয়তো শহরের কংক্রিট দেওয়ালে জন্ম নেওয়া অনেক গ্ল্যামারাস শিক্ষাপ্রকল্পের চেয়েও গভীর, মানবিক ও বাস্তব। সে দিন বিকেলে মীনা দিদি ফিরে গেলেও পরদিন সকালে আবার এসে হাজির হলেন—হাতে দুটো বড় থলে, যার মধ্যে ছিল পেনসিল, খাতা, চার্টপেপার, চক, রংপেন্সিল, আর কয়েকটা ছোট ছোট গল্পের বই।

এরপর শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। সন্ধ্যা নামলেই শুধু হালিম কাকু নয়—মীনা দিদিও আসতেন দোকানে, হাতে করে রঙিন বই, আঁকার খাতা আর চার্ট নিয়ে। রিনাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। মীনা ওদের শেখাতেন ছবি আঁকতে—“এই যে ‘আ’ মানে আম—চলো, আমের ছবি আঁকি!” কিংবা “এই যে ‘উ’ মানে উট—চলো দেখি, কে উট আঁকতে পারে!”—এইভাবে অক্ষর আর দৃশ্য একাকার হয়ে যেত, শেখার আনন্দে। ধীরে ধীরে দোকানের পেছনের দেওয়ালগুলোও রঙিন হয়ে উঠতে শুরু করে। স্থানীয় কয়েকজন যুবক, যারা আগে মুখ ফিরিয়ে রাখত, তারাও কৌতূহল থেকে এগিয়ে আসে, কেউ কেউ ছবি আঁকতে সাহায্য করে, কেউ খাতা কিনে দেয়। আর মীনা বুঝতে পারেন, শুধু বই নয়—এই আন্দোলনের প্রয়োজন ভালোবাসা, কল্পনা, এবং ধারাবাহিকতা। হালিম তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন দোকানের কোণে, তার গলায় সাদা গামছাটা রাখা, চোখে প্রশান্তি—কারণ তিনি জানেন, তার সেই অ আ ক খ এখন একা নয়। সেই অক্ষরের আলোয় জ্বলে উঠছে আরও অনেকের চোখ, আর এই নীরব বিপ্লব, যেটা শুরু হয়েছিল চায়ের কাপে ধোঁয়ার মতো নিঃশব্দে, তা এখন ছড়িয়ে পড়ছে কণ্ঠে, কাগজে আর হৃদয়ে।

মীনা দিদির প্রচেষ্টায় শিক্ষার সেই ছোট্ট বীজটা এখন একটা চারা হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যাবেলা হালিমের দোকানের পাশের খোলা জায়গাটায় শিশুদের জমায়েত এখন নিয়মিত—চায়ের দোকানের ধোঁয়ার পাশে বইয়ের পাতার শব্দ শোনা যায়। একদিন মীনা বললেন, “আমরা কেউই পুরোপুরি শিক্ষক নই, হালিমদা। কিন্তু যদি একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক পাশে থাকতেন, তাহলে আমরা এই পুরো প্রচেষ্টাটাকে একটা কাঠামো দিতে পারতাম।” হালিম মাথা নাড়লেন। আর তখনই মনে পড়লো—বাজারের পাশেই তো থাকেন মুকুন্দ মাস্টার, অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক, যিনি একসময় বহু ছাত্রের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলেছেন। বয়স সাঁইষট্টি পেরোলেও তাঁর চাহনি আজও দৃঢ়। কথা বললে বোঝা যায়, এখনো শব্দের ভিতরে বিশ্বাস রাখেন। পরদিন সকালেই মীনা তাঁর বাড়িতে যান। মুকুন্দ মাস্টার প্রথমে একটু বিরক্ত হন, বলেন, “এ বয়সে নতুন কাজ?” কিন্তু যখন শোনেন, হালিম নামের এক চাওয়ালা নিজে হাতে অ আ ক খ শেখাচ্ছেন, তখন তাঁর কণ্ঠ নরম হয়ে যায়। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, “এই বয়সে সত্যিকারের শিক্ষার্থী পাওয়া যায় কম। আমি আসব, আগামী রবিবার।”

রবিবার সন্ধ্যায় হালিমের দোকানে অন্যরকম সাড়া। পাড়ার লোকজনও কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে, কারণ হালিম কাকুর “স্কুলে” আজ একজন মাস্টারমশাই আসছেন। মুকুন্দ মাস্টার এসে নিজের পরিচয় দেন না, বরং সোজা গিয়ে রিনার পাশে বসেন। বলেন, “তুমি কী শিখছো এখন?” রিনা একটু হেসে বলে, “আমি ‘চ’ পর্যন্ত শিখে ফেলেছি মাস্টারমশাই!”—গর্বের সুর তার গলায়। মুকুন্দ মাস্টার তার খাতায় ‘চ’, ‘ছ’, ‘জ’ লেখেন সুন্দর করে। তারপর বলেন, “আজ আমরা গল্প পড়ব। ধরা যাক, একদিন এক ছেলে বাজারে গেল…”—এইভাবে তৈরি হয় গল্প বলা আর শোনার এক মধুর পরিবেশ। মুকুন্দ মাস্টার শিশুদের প্রতি একটা ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকান, তাদের ভুল বানানে হেসে ওঠেন, আবার ঠিক বানান শেখাতে গিয়ে কড়াও হন। ধীরে ধীরে পড়াশোনায় যুক্ত হয় নিয়ম—দিন ভাগ করে পড়া হয় স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, শব্দগঠন, ছোট বাক্য, ছড়া, গল্প। প্রতিটি শিশুর নাম লেখা হয় একটা খাতার তালিকায়—রিনার পাশে রিনার লেখা, নিতাইয়ের পাশে নিতাইয়ের লেখা। দোকানের পেছনের ফাঁকা জায়গা জুড়ে তৈরি হয় এক অস্থায়ী পাঠশালা, যার দেয়াল না থাকলেও তার ভিত মজবুত।

এই সময়টা থেকেই একটা বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শুধু রিনা, নিতাই নয়—গোলাম, মুকুল, আর কয়েকজন নতুন মুখও নিয়মিত হতে থাকে। তাদের কেউ কেউ সন্ধ্যার পর কাজ সেরে আসে, কেউবা পড়াশোনা করতে এসে চায়ের দোকানে সাহায্যও করতে থাকে। হালিম তখন এই পড়ানোর কাজ আর একা করেন না—মীনা দিদি ভাষার খেলা শেখান, মাস্টারমশাই ব্যাকরণ বোঝান, হালিম অভ্যাস করান লেখার। তারা বুঝে যান, শিক্ষা কেবল বই নয়, শিক্ষা এক ধরণের বিশ্বাস—নিজেকে জানা, অন্যকে বোঝা, আর অন্ধকার থেকে আলোয় এগিয়ে যাওয়ার সাহস। চায়ের দোকানে বসে বসে এখন যে ছেলেটা একসময় খালি গ্লাস ধুতো, সে এখন “আমার মা রান্না করে” লিখে পড়ে; যে মেয়েটা লোকের চা হাতে ধরিয়ে দিত, সে এখন গল্প লিখে নিজেই পড়ে শোনায়। আর পাশে বসে থাকা মুকুন্দ মাস্টার বলেন, “এটাই তো আমার জীবনের শেষ ক্লাস, হালিম। এমন ছাত্র আমি কোথাও পাইনি।”
এই অ আ ক খ এখন আর কেবল অক্ষর নয়—এ এক অদৃশ্য শিকড়, যেখান থেকে জীবন নতুন করে শুরু হয়।

যখনই কোনো নতুন আলো জ্বলে ওঠে, প্রথমে তার চারপাশে ছায়া ঘনিয়ে আসে। হালিমের চায়ের দোকানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় শিশুদের মুখে যে অক্ষরের দীপ্তি জ্বলতে থাকে, তা সবাই সমান চোখে দেখে না। প্রথম প্রথম যেসব পাড়ার মানুষ হেসেছিল—”চাওয়ালা আবার মাস্টার?”—তারা এবার আর ঠাট্টায় থেমে থাকে না, শুরু হয় কানাকানি, প্রশ্ন তোলা। পাড়ার এক পুরনো লোক, হারাধন ঘোষ, একদিন সোজা হালিমকে বলে, “ওরা কাজ করতে আসে তো, লেখাপড়া শিখে কী হবে? পেটে ভাত না থাকলে ‘ক’ দিয়ে কলা বানাবে?” এমন কথা হালিমকে কাঁপায় না, কিন্তু চারপাশের এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা তাকে নাড়িয়ে দেয়। নিতাইয়ের বাবার মতো অনেকেই বলেন, “আমার ছেলে অ আ ক খ শিখে কী করবে? দিনমজুরি করে না খেলে তো ঘরে চাল উঠবে না।” অন্যদিকে রিনার মা রিনাকে ক্লাসে যেতে মানা করে দেন—“মেয়ে নিয়ে এত পড়াশোনা করলে মাথায় ঢুকবে পাকা কথা। কালকে শুনলাম পাড়ার লোক হাসাহাসি করছে।” রিনা অনেকটা চুপ হয়ে যায়। সে সন্ধ্যায় ক্লাসে আসেও না।

পরদিন হালিম নিজে রিনাদের বাড়িতে যান। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নম্রভাবে বলেন, “আপনার মেয়ে অসাধারণ। ওর চোখে আমি আলো দেখেছি। ও যদি নিজের নাম লিখতে পারে, নিজের কথা লিখে বলতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে কাকে বিশ্বাস করবে সেটা ও নিজেই ঠিক করতে পারবে।” রিনার মা কিছুমাত্র গললেন না, বরং মুখ গম্ভীর করে বলে উঠলেন, “সবাই বলে আপনি দোকান ফেলে মাস্টারি করছেন। মেয়েদের মাথায় আপনি আগুন দিচ্ছেন।” হালিম চুপ করে থাকেন। কোনো প্রতিবাদ করেন না। শুধু বলেন, “যদি ভালো না লাগে, ওকে আমি জোর করবো না।” তারপর তিনি ধীরে পেছন ফিরে চলে আসেন। কিন্তু সেই রাতে রিনা, সমস্ত নিষেধ সত্ত্বেও, ক্লাসে চুপচাপ এসে বসে। তার চোখে জল, মুখে ভয়, কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা—“আমি পড়বো। কাকু, আমি পারবো।” মুকুন্দ মাস্টার তাকে খাতায় একটা বাক্য লেখায়—“আমি ভয় পাই না।” রিনা জোরে পড়ে, তারপর আবার পড়ে—বার বার।

এই ঘটনার কয়েকদিন পরই চায়ের দোকানের ক্লাসে এক নতুন জিনিস দেখা যায়—প্রতিটি শিশুকে একটি করে নামের কার্ড দেওয়া হয়, তাদের নিজ হাতে লেখা। দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে তারা কার্ড খুলে ধরে, আর চেঁচিয়ে বলে, “আমি কে?”—পাশ থেকে আরেকজন বলে, “তুমি রিনা, তুমি নিতাই, তুমি গোলাম।” ছোট ছোট পরিচয়ের ভিতর দিয়ে তারা যেন নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে পেতে থাকে। যারা একসময় পরিচয়হীন, শব্দহীন ছিল, তারা আজ নতুন করে নিজেদের খুঁজে নিচ্ছে। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে হালিম আর ব্যাখ্যা দেন না, তিনি বলেন, “যারা শিখছে, তারাই উত্তরের ভাষা।” আর সমাজের চোখে এই নীরব প্রতিবাদ—চায়ের দোকানে লেখার শব্দ, রঙিন খাতায় আঁকা হাতের ছাপ, কার্ডে লেখা নিজের নাম—এগুলোই হয়ে ওঠে প্রশ্নের বিরুদ্ধে উত্তর, অন্ধতার বিরুদ্ধে আলোর টান।
অ আ ক খ এখন আর শুধু বইয়ের অক্ষর নয়, এগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে অস্ত্র—মনের স্বাধীনতার, চিন্তার প্রতিবাদের, আর জীবনের আশার।

রবিবার সকালটা যেন একটু অন্যরকম মনে হচ্ছিল পরেশের। নদীর ওপারের সবুজ মাঠে শিশুরা খেলছিল, আর চায়ের দোকানের এক পাশে বসে রাহুল মাটি দিয়ে ‘অ’ আঁকার চেষ্টা করছিল। পরেশ একটা খাতা নিয়ে ব্যস্তভাবে লিখছিল “অ থেকে আম”, “আ থেকে আকাশ”—জিনিসগুলো যেন এখন তার নিজেরই নতুন করে শেখা হচ্ছে। হঠাৎই দোকানের সামনে একটা জিপ এসে থামল। গাড়ি থেকে নামলেন দু’জন—একজন সদ্য পঁচিশের কোঠায় যুবক, পরনে ঝকঝকে প্যান্ট-শার্ট; সঙ্গে ছিলেন এক মধ্যবয়স্কা নারী, যিনি চেহারায় শিক্ষিকার মতো, চোখে ছিল গোল ফ্রেমের চশমা। দোকানের দিকে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললেন, “এই কি পরেশবাবুর দোকান?” পরেশ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই যুবকটি হাত বাড়িয়ে দিল, “আমি অনিকেত, আর উনি আমার মাসিমা, দীপ্তিমাসিমা। আমরা গোপালগঞ্জ থেকে এসেছি।” শুনে পরেশ একটু অবাক হলেও সম্মান করে বসার জায়গা করে দিল। কিছুক্ষণ চা-নাস্তার পর জানা গেল, অনিকেত এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করে, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাক্ষরতা প্রসারে কাজ করে চলেছে। পরেশের এই ছোট্ট প্রচেষ্টার খবর নাকি কেউ তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, এবং তাঁরা নিজের চোখে দেখতে এসেছেন।

পরেশ প্রথমে বেশ অপ্রস্তুত বোধ করছিল। সে তো কোনও শিক্ষক নয়, স্রেফ একটা দোকানদার। কিন্তু দীপ্তিমাসিমার চোখে যে গর্ব আর কৃতজ্ঞতার ছায়া, তাতে পরেশের ভিতরে একধরনের আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠল। অনিকেত মোবাইলে কিছু ছবি তুলতে চাইলে পরেশ লাজুকভাবে রাজি হয়। এরপর দীপ্তিমাসিমা রাহুলকে একটু পড়তে বলেন—’আ’ চিনতে পারলেই হবে। রাহুল একটু কুঁচকে গেলেও, পরেশের পাশে দাঁড়াতেই মাটি থেকে আঁকা ‘আ’-টা দেখিয়ে দিল। দীপ্তিমাসিমা খুশি হয়ে বললেন, “এই শিশুদের চোখে যখন অক্ষর ফুটে ওঠে, তখন একধরনের আলো তৈরি হয়, যা কোন বৈদ্যুতিক বাতিও দিতে পারে না।” সেদিন বিকেলে অনিকেতরা চলে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, তাঁরা শীঘ্রই কিছু বইপত্র আর বোর্ড পাঠাবেন, যাতে পরেশের ক্লাস আরও নিয়মিতভাবে চলতে পারে। সন্ধ্যায়, পরেশ চুপ করে বসে থাকল নদীর ধারে। তার এই ক্ষুদ্র কাজ যে এতদূর পৌঁছতে পারে, সে নিজেই যেন ভাবতে পারেনি।

তবে পরেশ জানত, এটুকুতে থেমে গেলে চলবে না। সেই রাতেই সে দোকানে বসে নিজে কাগজে কাগজে নতুন করে সিলেবাস বানাতে শুরু করল—প্রথম সপ্তাহে অ-আ-ক, দ্বিতীয় সপ্তাহে গ-ঘ-চ; একেকদিন একেকটি অক্ষর, সাথে একটা গল্প, একটা করে ছবি আঁকা, আর একটা গান। অজান্তেই তার হাতের কলম যেন গানের সুরে বেজে উঠছিল—“অ অজগর আসে তেড়ে, আ আকাশে তারা জ্বলে…”। শিশুদের মুখে এই গান তুলে দিতে পারলে, তারা যে ভাষা ভালবাসবে, সেটা এখন সে বুঝতে পেরেছে। কাল থেকে নতুন ছয়জন বাচ্চা আসবে শুনে সে নিজের দোকানের পেছনের ভাঙা বেঞ্চগুলোকেও নিজে হাত দিয়ে মেরামত করল। একটা শান্ত বিপ্লব বয়ে যাচ্ছিল, অক্ষরের ধ্বনি নিয়ে, নদীর ওপারের সেই সরল চায়ের দোকানে।

দশ দিন ধরে গ্রামের সেই পুরোনো মাঠের আশেপাশে যেন একটা অন্যরকম উত্তেজনার আবহ ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রথমবারের মতো পাথরচাপা গ্রামে আয়োজিত হতে চলেছে “বর্ণপরিচয় উৎসব”—একটি শিক্ষা-উৎসব, যেখানে শুধু শিশুরাই নয়, বৃদ্ধরাও, চা-দোকানের ছেলেমেয়েরা, কামিনিরা, বাবুর্চিরা—যারা কখনও কোনো পাঠশালার গন্ধটুকুও পায়নি—তারা মঞ্চে উঠে বর্ণমালার উচ্চারণ শোনাবে, কবিতা পড়বে, ছবি আঁকবে। আয়োজক? বটতলার কাছে চায়ের দোকানির নাম আজ কেউ শুধু ‘নিতাইদা’ বলে না—লোকেরা বলে, “নিতাই মাস্টার”। ছোট্ট ওই অক্ষরজগতের কারিগর, যিনি রাতের চা-কাপ ফেলে হাতে তুলে নিয়েছিলেন খাতা আর চক।

সন্ধ্যা ঘনাতেই মাঠটা রঙিন হয়ে উঠল। বাঁশ দিয়ে বানানো মঞ্চ, তার পেছনে টাঙানো কাপড়ের ব্যানারে লেখা: “অ আ ক খ – শিক্ষার এক নব সূচনা”। বাঁ পাশে উল্টোদিকের গ্রাম থেকে আসা লোধেরা নাচের জন্য রিহার্সাল করছে। ডানদিকে বসে মিঠু, একেবারে নতুন শাড়ি পরে, তার হাতে কাগজ। আজ সে কবিতা বলবে—রবীন্দ্রনাথের ‘বঙ্গাব্দ’। কে ভাবতে পারত, মাস ছয়েক আগেও যে মেয়েটা চা বানাতে বানাতে হঠাৎ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যেত, সেই মিঠু আজ মুখস্থ কবিতা বলার সাহস পাচ্ছে? নিতাই মঞ্চে উঠতেই সবার করতালি—সে কিছু বলেনি, শুধু হাত তুলেছিল—চুপ করে দাঁড়াল, চোখে জল, ঠোঁটে এক নিঃশব্দ হাসি। তারপর শুরু হলো অনুষ্ঠান। সজল প্রথমে ‘অ’ থেকে ‘ঔ’ পর্যন্ত গেয়ে শোনাল—রবি ঠাকুরের সুরে। তারপর লাবণী আর কাব্য মিলে ছড়া বলল: “ক দাঁড়িয়ে কাক / খ দাঁড়িয়ে খোকা কাঁদে / গ দাঁড়িয়ে গরু আসে / ঘ দাঁড়িয়ে ঘুড়ি উড়ে…”—চারপাশে হাততালি।

কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল শেষ পর্বটা। মঞ্চে উঠে এল গ্রামেরই সত্তর বছরের পঙ্কজদা, যিনি জীবনে একদিনও স্কুলে যাননি, চায়ের দোকানে কাজ করে চার ছেলে মেয়েকে মানুষ করেছেন। তিনি ঘোষণা করলেন, “আমি আজ একটা শব্দ লিখব—নিজের হাতে। এই বয়সে এসে প্রথম শেখা শব্দ।” তারপর হাতে তুলে নিলেন সাদা চক, মঞ্চের একপাশে রাখা ছোট্ট কালো বোর্ডের ওপর লিখলেন—“আলো”। মুহূর্তের মধ্যে নিস্তব্ধতা। আর তারপর—একটা দীর্ঘ, গর্বিত, জয়ধ্বনিময় হাততালি। সেই রাতে নিতাই বাড়ি ফিরল ক্লান্ত শরীরে, কিন্তু এক অদ্ভুত তৃপ্তি নিয়ে। এই যে এতদিন ধরে রাতজাগা, পড়ানো, অনুরোধ করা, হাসি-ঠাট্টা—সব আজ পূর্ণতা পেল। শুধু সে নয়, একটা গোটা গ্রামের স্বপ্ন যেন জন্ম নিল নতুন করে—অ আ ক খ দিয়ে।

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে নদীর পারে সেই চায়ের দোকানটা যেন একটা ছোটো স্কুলে পরিণত হয়। কুপিবাতির আলোয় বসে থাকে সজল, রিনা, বুদু, আর মাঝে মাঝে আরও দু-একজন নতুন মুখ। অক্ষরের গন্ধ মিশে যায় ধোঁয়া ওঠা চায়ের গন্ধের সঙ্গে। শম্ভুদার কণ্ঠে আজকাল আর দ্বিধা নেই—তাঁর হাতে পুরোনো চিঠির খাতা, কালির কলম, আর নিজের হাতে বানানো পাতা ভর্তি চিহ্ন-চিত্র। তিনি জানেন, এই ছোট ছোট অক্ষর একদিন বদলে দিতে পারে এই শিশুদের জীবন। আজকের ক্লাসে ‘ক’ থেকে ‘ণ’ অবধি পড়ানো হবে। রিনা ঝটপট ‘ক’ বলতে পারে, বুদু এখনও ‘ঘ’ আর ‘ঙ’-এ গুলিয়ে ফেলে, কিন্তু তার চোখে এখন আগের সেই ভয় নেই। আর সজল তো এখন নিজে থেকে শব্দ তৈরি করার চেষ্টাও করে। এ যেন এক মূক শব্দের বিপ্লব।

এই পড়াশোনার খবর আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের গ্রামে। স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার একদিন হঠাৎ এসে দাঁড়ালেন শম্ভুদার ক্লাসের পাশে। চুপচাপ সব দেখে শুনে বললেন, “আপনি যা করছেন, সেটা অনেক বড়ো কাজ, শম্ভু। আমরা চাইলেও সবাইকে স্কুলে আনতে পারি না। আপনি স্কুলকে ওদের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন।” এরপর থেকে হেডমাস্টারমশাই মাঝেমধ্যে বইপত্র পাঠাতে শুরু করলেন, পুরনো ব্ল্যাকবোর্ডও দিয়ে দিলেন। চায়ের দোকানটা এখন একটা রাতের পাঠশালা, যার কোনো সরকার নেই, কিন্তু আছে এক অদম্য স্বপ্ন। একদিন এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ে এসে যোগ দিলো স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে, তার নাম ছিল প্রাপ্তি। সে শহর থেকে এসেছে, আর এখানকার এই ছোট্ট উদ্যোগে যোগ দিয়ে সে যেন নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেল। এখন প্রাপ্তি সপ্তাহে দুদিন গল্প পড়ে শোনায় শিশুদের, শেখায় ছড়া আর ছবি আঁকা।

এইভাবে, ‘অ আ ক খ’-এর সেই ছোট্ট উদ্যোগটা আজ এক বিস্তৃত আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সন্ধ্যায় এসে জড়ো হয় নদীর পাড়ে। সেখানে চা’য়ের কাপের সঙ্গে মেলে শব্দ, বাক্য, গল্প আর স্বপ্ন। শম্ভুদা এখন আর একা নন—তার পাশে দাঁড়িয়েছে গ্রাম, স্কুল, শহর, এমনকি কিছু NGO-ও। একদিন সেই দোকানটার সামনে সজল একটা চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিজের হাতে লেখা প্রথম চিঠি—তার মায়ের জন্য। পড়তে শেখার যে আনন্দ, তার মধ্যে ছিল নতুন জন্মের মতো কিছু। শম্ভুদা সেই চিঠি হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখে জল, কিন্তু মুখে হাসি। সেই সন্ধ্যায় কুপিবাতির নিচে শুরু হলো নতুন পাঠ—এইবার তারা গল্প লিখতে শিখছে। আর সেই গল্প হবে তাদের নিজেদের গল্প, যেখানে শব্দ তৈরি করবে ভবিষ্যতের আলোর দিশা।

******

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *