Bangla - প্রেমের গল্প

অসমাপ্ত স্বপ্ন

Spread the love

নন্দিতা বসু


কলকাতার এক গরম দুপুর। শহরের রাস্তাঘাট তখনও গ্রীষ্মের দমচাপা গরমে হাঁসফাঁস করছে। সূর্যের তীব্র আলো জানালা পেরিয়ে লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকছিল, কিন্তু ভেতরের শীতল নীরবতা বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক অনুভূতি তৈরি করেছিল। লাইব্রেরির চিরচেনা গন্ধ—পুরনো বইয়ের মলাট, ধুলোমাখা পাতার গন্ধ, আর কাঠের তাকের গন্ধ মিশে তৈরি করেছে এক অনন্য পরিবেশ। অনন্যা, ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্রী, প্রতিদিনের মতো নিজের গবেষণার কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। রবীন্দ্রনাথের লেখার ওপর তার বিশেষ আগ্রহ, তাই প্রায়ই তাকে লাইব্রেরির কবিতা বিভাগে পাওয়া যায়। সেদিনও সে মন দিয়ে খুঁজছিল একখানা বই—“গীতাঞ্জলি”-র প্রথম সংস্করণের একটি বিশেষ কপি। তাকের সামনে দাঁড়িয়ে বইটা খুঁজতে গিয়ে হঠাৎই সে লক্ষ্য করল, পাশে এক যুবকও একই বইয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে। দু’জনের হাত প্রায় একসঙ্গে বইটির গায়ে ছুঁয়ে গেল। অনন্যা চমকে তাকাল, আর তখনই প্রথমবার তার চোখে পড়ল আরমানকে—গম্ভীর, শান্ত চোখ, গায়ে হালকা নীল শার্ট, আর হাতে ছোট্ট এক নোটবুক। মুহূর্তটা যেন হঠাৎই কোনো অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা হয়ে গেল। অনন্যা লাজুকভাবে হাত সরিয়ে নিলেও চোখ ফিরিয়ে নিতে পারল না।

আরমান সাধারণত খুব নির্লিপ্ত মানুষ। কম কথা বলে, নিজের মধ্যে থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু অনন্যার চোখের ভেতরে সে অদ্ভুত এক জ্যোতি দেখতে পেল। সে মৃদু হেসে বলল, “আপনি যদি চান, বইটা আগে নিতে পারেন। আমি অপেক্ষা করব।” অনন্যা বিস্মিত হলো এই ভদ্রতায়। মৃদু হাসি দিয়ে উত্তর দিল, “না না, আপনি নিন। আমি তো প্রায়ই আসি এখানে।” কয়েক মুহূর্তের সেই সৌজন্য বিনিময় যেন কোনো অদৃশ্য সূত্রে বাঁধল দু’জনকে। পরে দু’জনেই টেবিলে বসে একই বই পড়তে শুরু করল—একটি টেবিলের দুই প্রান্তে। কয়েক মিনিট পর অনন্যা লক্ষ্য করল, আরমান নোটবুকে কিছু লিখছে। কৌতূহল চাপতে না পেরে সে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী লিখছেন?” আরমান একটু ইতস্তত করে বলল, “কবিতা… রবীন্দ্রনাথ পড়লে মনে হয়, নিজের ভেতরের কথাগুলোও লিখে রাখতে হয়।” অনন্যার চোখ বড় হয়ে উঠল। তার নিজেরও কবিতা পড়া ও লেখার নেশা আছে। দু’জনের কথোপকথন আস্তে আস্তে জমে উঠল। তারা রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রিয় লাইন, কবিতার ভেতরের দর্শন, ভালোবাসা ও মানবতার ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা শুরু করল। লাইব্রেরির নিস্তব্ধতা ভেঙে দু’জনের শব্দ খুব নরমভাবে চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছিল, যেন বইগুলোও শুনছিল তাদের কথা।

সেদিনের সেই প্রথম আলাপ দীর্ঘ হলো না, কিন্তু গভীর ছাপ ফেলে গেল দু’জনের মনে। অনন্যা বাড়ি ফেরার পথে বারবার ভেবেছে—একজন অপরিচিত মানুষ কিভাবে এত সহজে তার ভেতরের আগ্রহ, তার নীরব আবেগকে বুঝতে পারল? আবার আরমানও হাঁটতে হাঁটতে এক অদ্ভুত টান অনুভব করছিল, যেটা আগে কোনোদিন কারো প্রতি অনুভব করেনি। সে বুঝতে পারছিল না, এ কি নিছক কাকতালীয় পরিচয়, নাকি ভাগ্যের অদৃশ্য খেলা? লাইব্রেরির সেই প্রথম দেখা হয়তো ছোট্ট এক ঘটনাই ছিল, কিন্তু দু’জনের জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলোর বীজ সেদিনই অচেতনভাবে বপন হয়ে গিয়েছিল। কলকাতার ভিড়ভাট্টা, শব্দ আর চেনা-অচেনা মানুষের সমুদ্রে সেদিন যেন দু’জন হৃদয়ের মধ্যে এক নিঃশব্দ সেতু তৈরি হয়েছিল। আর সেই সেতুর ওপারে অপেক্ষা করছিল নতুন এক যাত্রার শুরু, যেটা তখনও তারা কেউই আন্দাজ করতে পারেনি।

লাইব্রেরির সেই প্রথম আলাপের পর থেকেই অনন্যা আর আরমানের মধ্যে এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হতে শুরু করেছিল। প্রথমদিকে একে অপরের সঙ্গে কথা বলার জন্য কোনো অজুহাত খুঁজে নিতে হতো—কোনো বই, কোনো রেফারেন্স, কিংবা পরীক্ষার প্রস্তুতি। ধীরে ধীরে সেই কথোপকথন বইয়ের পাতার সীমা ছাড়িয়ে পৌঁছাল ব্যক্তিগত জীবনের গল্পে। অনন্যা ক্লাস শেষে প্রায়ই ফোন করত আরমানকে, আর দু’জনে ক্যাম্পাসের ছোট্ট কফিশপে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলত। সেখানে তারা গল্প করত শৈশবের স্মৃতি, পরিবার নিয়ে, এমনকি ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়েও। সেই আড্ডাগুলো কখন যে তাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছিল, তা কেউই বুঝতে পারেনি। একদিন অনন্যা হেসে বলেছিল, “তুমি জানো, আমি আসলে খুব কম মানুষের সঙ্গেই এতটা খুলে কথা বলতে পারি। কিন্তু তোমার সঙ্গে যেন সব সহজ হয়ে যায়।” আরমান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিয়েছিল, “হয়তো কারণ, আমাদের দু’জনের ভেতরের নীরবতাটা একে অপরকে চিনে নিয়েছে।” অনন্যা সেদিন কিছু বলেনি, শুধু মনে মনে টের পেয়েছিল—এই বন্ধুত্বে এক অদ্ভুত আবেগের স্রোত বইছে, যেটা অস্বীকার করা যায় না।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হলো। কলেজ ফেস্টিভ্যালে অনন্যা যখন আবৃত্তিতে অংশ নিল, আরমান তখন ব্যাকস্টেজে থেকে তাকে উৎসাহ দিল। আবার আরমান যখন নিজস্ব কবিতা পাঠের জন্য মঞ্চে উঠল, অনন্যা প্রথম সারিতে বসে হাততালি দিল সবচেয়ে জোরে। তাদের ছোট ছোট এই মুহূর্তগুলো চারপাশের মানুষও টের পাচ্ছিল। সহপাঠীরা মজা করে বলত, “তোমরা কি গোপনে কিছু লুকাচ্ছ?” কিন্তু দু’জনই হাসি মুখে এড়িয়ে যেত। সত্যিই তো, তারা স্পষ্ট করে কখনও বলেনি একে অপরকে ভালোবাসে। অথচ প্রতিটি চোখের দৃষ্টি, প্রতিটি অজান্তে হাত ছোঁয়া, প্রতিটি নীরবতা অনেক কিছু বলে দিচ্ছিল। কফিশপের টেবিলে ছড়িয়ে থাকা চা-দুধের কাপ, শীতকালে উল্টো ঝোলানো ফেস্টুনের নিচে দাঁড়ানো মুহূর্ত, কিংবা গ্রীষ্মের এক বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বসে থাকা—সবই যেন তাদের অঘোষিত প্রেমকাহিনির অংশ হয়ে উঠছিল। তবে তাদের দু’জনের মধ্যেই একধরনের সতর্কতা ছিল; তারা দু’জনেই বুঝত, সমাজ ও পরিবার এত সহজে এই সম্পর্ক মেনে নেবে না। তাই কথায় প্রকাশ করার সাহস তারা দেখাত না, শুধু নিঃশব্দে প্রতিদিন আরও কাছাকাছি আসত।

কখনও কখনও এই নীরব আবেগের ভার অসহ্য হয়ে উঠত। অনন্যা বাড়ি ফিরে যখন রাতের বেলায় একা পড়াশোনা করত, তার খাতা ভর্তি থাকত অজস্র অসমাপ্ত কবিতার লাইনে—যেখানে নাম উচ্চারণ না করেও বারবার ফুটে উঠত আরমানের ছায়া। অন্যদিকে, আরমান নিজের নোটবুকে লিখে যেত এমন কিছু অনুভূতি, যা কারো সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না। তারা দু’জনেই জানত, একে অপরকে ছাড়া জীবন কল্পনা করা কঠিন। অথচ একই সঙ্গে এ-ও জানত, সমাজের দেয়াল, ধর্মীয় ভেদাভেদ আর পারিবারিক নিয়মকানুন হয়তো একদিন তাদের আলাদা করে দেবে। সেই আশঙ্কা তাদের ঠেকাত প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তি থেকে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, এই অঘোষিত টানই তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করে তুলছিল। অনন্যার মনে বারবার বাজত রবীন্দ্রনাথের সেই পঙক্তি—“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।” যেন সে বুঝতে পারছিল, একদিন হয়তো তাকে একলা দাঁড়াতে হবে, তবু এই মুহূর্তগুলোই তার জীবনের সবচেয়ে সত্যি ও সবচেয়ে মূল্যবান অধ্যায়। আর আরমানও প্রায়ই মনে মনে বলত, তাদের এই সম্পর্ক হয়তো সমাজের চোখে নামহীন, কিন্তু তার কাছে এটি জীবনের সবচেয়ে বিশুদ্ধ অনুভূতি। সেইভাবেই বন্ধুত্বের পরতের আড়ালে ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছিল এক গভীর, অথচ অঘোষিত প্রেম, যা দু’জনের জীবনকেই অদ্ভুত এক আলোয় ভরিয়ে তুলছিল।

সেদিন বিকেল থেকেই কলকাতার আকাশ ভারী হয়ে উঠেছিল। কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছিল সূর্যকে, আর বাতাসে ভেসে আসছিল বৃষ্টির গন্ধ। ক্লাস শেষে অনন্যা আর আরমান ঠিক করেছিল গঙ্গার ধারে একটু হাঁটতে যাবে। মল্লিকঘাটের ঘাটে বসে নদীর জলে নৌকার দোল খাওয়া দেখা তাদের দু’জনের খুব পছন্দ ছিল। কিন্তু সেদিনের আবহাওয়াটা ছিল অন্যরকম। দু’জন যখন নদীর ধারে পৌঁছাল, তখন টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চারপাশে ছাতার ভিড়, হইচই, কিন্তু সেই ভিড়ের মধ্যেই তারা যেন নিজেদের জগতে ঢুকে গেল। অনন্যা চুপচাপ বসে ছিল, চোখ নদীর ওপারে, আর হাতের ভেতর কাঁপতে থাকা এক অদৃশ্য প্রশ্ন। বহুদিন ধরে বুকের ভেতর জমে থাকা অনুভূতিগুলো যেন সেদিন ঝড়ের মতো বেরিয়ে আসতে চাইছিল। সে হঠাৎই বলল, “তুমি জানো আরমান, আমি তোমার সঙ্গে থাকলে অন্যরকম একটা শান্তি পাই। মনে হয়, তুমি না থাকলে আমার অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ থেকে যেত।” কথাটা শুনে আরমান প্রথমে কিছুই বলল না, শুধু ভিজে চুল কপালের পাশে সরে গেল, আর দৃষ্টি নিবদ্ধ করল অনন্যার দিকে। সেই দৃষ্টিতেই যেন ছিল অগাধ ভালোবাসার ভাষা, যেটা এতদিন শব্দের আড়ালে চাপা ছিল।

বৃষ্টি তখন আরও জোরে পড়ছে। ঘাটের সিঁড়ি ভিজে গেছে, নদীর জলও যেন আনন্দে নেচে উঠেছে। অনন্যা ভিজতে ভিজতে সাহস সঞ্চয় করে আবার বলল, “আরমান, আমি জানি আমাদের চারপাশে অনেক বাধা আছে। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি… ভীষণ ভালোবাসি।” কথাটা বলতে না বলতেই তার গলাটা কেঁপে উঠল। এতদিনের লুকিয়ে রাখা আবেগ যেন এক মুহূর্তে ঝড়ের মতো বেরিয়ে এলো। মুহূর্তের জন্য চারপাশের সব শব্দ থেমে গেল—শুধু গঙ্গার ঢেউ আর বৃষ্টির শব্দ মিলেমিশে সেই স্বীকারোক্তিকে আরও গভীর করে তুলল। আরমান ধীরে ধীরে অনন্যার হাত ধরল। তার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি, যেন এতদিনের অপেক্ষার শেষ হলো। খুব আস্তে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো কখনও বলবে না। অথচ আমি প্রথম দিন থেকেই জানি, তুমি ছাড়া আমার জীবন অসম্ভব। আমিও তোমাকে ভালোবাসি, অনন্যা। এতটাই ভালোবাসি যে, প্রতিদিন তোমাকে না দেখলে মনে হয় দিনটা অপূর্ণ থেকে গেল।” সেই মুহূর্তে দু’জনের হৃদয় যেন একসঙ্গে ধকধক করছিল, আর ভিজে পোশাক, ভিজে চুল, বৃষ্টির ঠাণ্ডা হাওয়া সবকিছু মিলেমিশে এক অমর স্মৃতি তৈরি করছিল।

সেদিনের সেই সন্ধ্যা তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। এতদিন যে সম্পর্কটা নিঃশব্দে, আড়ালে লুকিয়ে চলছিল, তা সেদিন স্পষ্ট হয়ে উঠল। প্রেমের স্বীকারোক্তি শুধু তাদের দু’জনকেই নয়, যেন পুরো পরিবেশকেই ভিজিয়ে দিল নতুন এক আলোয়। ভিজে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে দু’জনের হাত শক্ত করে ধরা, একে অপরের চোখের গভীরে হারিয়ে যাওয়া—এসব মুহূর্ত তাদের মনে চিরকালীন স্মৃতি হয়ে রইল। তবে ভেতরে ভেতরে দু’জনেই জানত, এই ভালোবাসার পথ এত সহজ নয়। ধর্ম, পরিবার, সমাজ—সবকিছু মিলিয়ে অসংখ্য বাধা আসবে সামনে। তবু সেই মুহূর্তে তারা কোনো ভয় পায়নি। কারণ প্রেমের স্বীকারোক্তির পর যে অদম্য সাহস আসে, তা সব আশঙ্কাকে ঢেকে দেয়। অনন্যা মনে মনে ভাবছিল, “আজ থেকে আমাদের গল্পটা সত্যি শুরু হলো।” আর আরমান বুঝতে পারছিল, জীবনের প্রতিটি দিনে এই এক সত্যই থাকবে অবিচল—সে আর অনন্যা একে অপরের। যতই ঝড় আসুক, এই মুহূর্তের ভেজা প্রতিশ্রুতি তাদের দু’জনকে চিরকাল ধরে রাখবে।

অনন্যা ও আরমানের সম্পর্ক তখন ঠিক প্রথম বসন্তের মতোই—সতেজ, নতুন, আর ভেতরে ভেতরে ফুলে ওঠা অচেনা আবেগে ভরপুর। তারা এখনো প্রকাশ্যে একে অপরকে কিছু বলেনি, কিন্তু চোখের ভাষা, ছোট ছোট অঙ্গভঙ্গি, আর একসঙ্গে কাটানো নিস্তব্ধ মুহূর্তগুলোই তাদের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তুলছিল। কিন্তু সুখের এই গোপন সময়কে যেন ঈর্ষাপরায়ণ ভাগ্য বেশিদিন টিকতে দিল না। একদিন দুপুরে, যখন তারা কলেজ থেকে ফেরার পথে গলির এক কোণে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল, তখনই দূর থেকে অনন্যার এক আত্মীয়, মামাতো দাদা অরিজিৎ, তাদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখে ফেলে। প্রথমে সে কিছু না বললেও, তার চোখের ভঙ্গি আর মুখে চাপা হাসিই বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে বিষয়টা অচিরেই ছড়িয়ে পড়বে। আর তাই-ই হলো। কয়েক দিনের মধ্যেই অনন্যার বাড়িতে গোপন গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল—”মেয়েটা নাকি ছেলেটার সঙ্গে বারবার দেখা করছে!” অনন্যা প্রথমে ভেবেছিল পরিবার হয়তো এটাকে গুরুত্ব দেবে না, কিন্তু ধীরে ধীরে সে টের পেল, প্রতিটি দৃষ্টিতে, প্রতিটি প্রশ্নে এক ধরনের সন্দেহ মিশে আছে। মা নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি, কিন্তু তাঁর দমবন্ধ করা নীরবতা যেন অনেক কথার চেয়েও ভারী।

এদিকে খবর পৌঁছে গেল আরমানের বাড়িতেও। তার মা, যিনি বরাবরই রক্ষণশীল এবং সমাজের চোখকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেন, ছেলের মুখোমুখি বসে কঠিন সুরে বললেন—”এই সম্পর্ক কোনোদিন মেনে নেওয়া যাবে না। ধর্মের নিয়ম আছে, সমাজের চোখ আছে, আর তার বাইরেও আছে আমাদের বংশের সম্মান।” আরমান চেষ্টা করল বোঝাতে, এটা এখনো কেবল বন্ধুত্ব, এর বাইরে কিছু নয়, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরেই যে দ্বিধা লুকিয়ে ছিল, মা তা টের পেলেন। তিনি ধর্মের দোহাই দিয়ে বোঝাতে লাগলেন, এমন সম্পর্ক হলে তা পরিবারে অশান্তি ডেকে আনবে। তর্ক করতে গিয়ে আরমান হেরে গেল, কারণ সে জানত—মায়ের কাছে ভালোবাসা মানেই বিয়ের সামাজিক অনুমোদন, আর তার বাইরের কিছু নেই। অন্যদিকে, অনন্যার বাবা এক সন্ধ্যায় সরাসরি তাকে ডেকে বললেন—”এইসব বাজে ব্যাপারে জড়িয়ে পড়তে নেই। আমাদের পরিবারের একটা সম্মান আছে, তা তুমি নষ্ট করবে না। আর ওই ছেলের সঙ্গে তোমার দেখা করার দরকার নেই।” তাঁর কণ্ঠে কঠোরতা থাকলেও চোখে ছিল এক অদৃশ্য আতঙ্ক—সমাজ যদি কিছু বলে, যদি আত্মীয়রা আঙুল তোলে, তবে তার জবাবদিহি করতে হবে তাকেই। অনন্যা বাবার এই ভাষা শুনে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়লেও কোনো প্রতিবাদ করতে পারল না, কারণ সে জানত বাবার কাছে তার প্রতিটি কথা একরকম অবাধ্যতার মতো শোনাবে।

এইভাবে দুই পরিবারের অন্দরমহলে যেন এক অদৃশ্য দেয়াল গড়ে উঠল—যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে অনুভূত হয়। ফোনে কথা বলা বা হঠাৎ দেখা করা, সবই যেন বেআইনি হয়ে দাঁড়াল। অনন্যা নিজের ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলত, মনে হতো চারপাশের দেওয়ালগুলো তাকে বন্দি করে রেখেছে। অন্যদিকে আরমানও কলেজে অনন্যার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে সাহস পেত না, কারণ আশেপাশের দৃষ্টিগুলোতে যেন সবসময় কৌতূহল মিশে থাকত। সম্পর্কের শুরুতেই যে মিষ্টি উত্তেজনা ছিল, তা এখন ভয় আর দ্বিধার ছায়ায় ঢাকা পড়তে লাগল। অথচ তাদের ভেতরের টান, অজানা আকর্ষণ থেমে রইল না। তারা দু’জনেই জানত, পরিবার হয়তো চায় না এই সম্পর্ক এগিয়ে যাক, কিন্তু তারা নিজের ভেতরে যে স্রোত অনুভব করছে, তাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। এই দ্বন্দ্বই তাদের জীবনে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করল—যা একদিকে সমাজ ও পরিবারের চাপ, আর অন্যদিকে হৃদয়ের অনিবার্য আকর্ষণ। এই দেয়াল কি ভাঙা যাবে? নাকি এ দেয়ালই ধীরে ধীরে তাদের আলাদা করে দেবে? অনন্যা ও আরমান তখনো জানত না, কিন্তু তারা দু’জনেই বুঝতে শুরু করেছিল—ভালোবাসা শুধু দু’জন মানুষের ব্যাপার নয়, এর চারপাশে থাকে পরিবার, সমাজ, আর সেই অদৃশ্য দেয়াল, যা সবকিছুকে বদলে দিতে পারে।

অনন্যার জীবনে এই সময়টা যেন অস্থিরতার ঝড় নিয়ে এল। বাড়ির চার দেওয়ালের ভেতর সে যেন প্রতিদিন নতুন নতুন শেকলে বন্দি হয়ে পড়ছিল। বাবা-মা তার ভবিষ্যৎ নিয়ে যত্নশীল হলেও, অনন্যার চোখে তা সবই কঠোর নিয়ম আর অদৃশ্য জোরজবরদস্তি। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরলেই মা অপেক্ষা করে থাকেন নানা প্রশ্ন নিয়ে—কে সঙ্গে ছিল, কখন ফিরল, কতক্ষণ কোথায় বসেছিল। আর এসব প্রশ্ন অনন্যার কাছে শুধুই এক ধরনের অবিশ্বাসের ছায়া। সে জানে, যদি আরমানের নাম একবার বেরিয়ে আসে, তাহলে আর তর্কের অবকাশ থাকবে না, সরাসরি অগ্ন্যুৎপাত ঘটবে পরিবারে। তাই প্রতিদিনই তাকে অভিনয় করে যেতে হয়—মুখে শান্ত স্বর, চোখে ভদ্রতার ছাপ, কিন্তু ভিতরে ভিতরে জমে ওঠা প্রতিরোধ যেন প্রতিটি মুহূর্তে তার ধৈর্যের সীমা ভেঙে ফেলতে চাইছে। অনন্যা অনেকবার ভেবেছে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে সব বলে ফেলবে, নিজের ভালোলাগার মানুষটার নাম প্রকাশ করবে, তবু সাহস পায়নি। কারণ সে জানে, তার বাবার কাছে প্রেম মানেই পড়াশোনায় বিঘ্ন, ভবিষ্যতের পথে বাঁধা, আর পরিবারের সম্মানহানির আশঙ্কা। এভাবেই দিনের পর দিন চলতে থাকে নিঃশব্দ দ্বন্দ্ব—একদিকে পরিবারের প্রতি কর্তব্য আর অন্যদিকে নিজের মনের দাবি।

ঠিক তখনই আরমানই অনন্যার কাছে হয়ে ওঠে একমাত্র আশ্রয়। ঝগড়াঝাঁটি আর কান্নাকাটির মধ্যে যখন অনন্যার বুক ফেটে যেতে চাইছে, তখন আরমান তাকে শান্ত কণ্ঠে বোঝায়—“আমাদের প্রেমকে টিকিয়ে রাখতে হলে ধৈর্য ধরতে হবে। তাড়াহুড়ো করলে সব ভেঙে যাবে।” আরমানের কথাগুলো যেন মলমের মতো লাগে, কিন্তু একই সঙ্গে এক অদৃশ্য চাপও তৈরি করে। ধৈর্য ধরা মানে কি সবকিছু চুপচাপ মেনে নেওয়া? পরিবার যদি একদিন তার প্রেমের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন কি সে কেবল মুখ বুজে চুপ করে থাকবে? অনন্যা জানে না। তবু আরমানের চোখের বিশ্বাস তাকে শান্ত করে দেয়। তারা দু’জনেই গোপনে দেখা করতে থাকে—কখনও কলেজের লাইব্রেরিতে বইয়ের আড়ালে, কখনও বা শহরের গলিপথে ছোট্ট কোনও কফিশপে। এই চুরি করা মুহূর্তগুলোতেই তারা দু’জনের ভালোবাসা আরও গভীর হয়। প্রতিটি আলিঙ্গনে, প্রতিটি হাত ধরা অনন্যার মনে বিশ্বাস জন্মায়—যতই ঝড় আসুক, আরমান তার পাশে থাকবে। কিন্তু বাস্তবতার চাপও দিন দিন বাড়তে থাকে। চারদিকে যেন শ্বাসরোধ করা পরিবেশ, আর তাতেই অনন্যা টের পায়, তাদের প্রেম এখন আর শুধু স্বপ্নের মতো সরল নেই, এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বিদ্রোহ আর সমঝোতার এক দ্বন্দ্বময় খেলা।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনন্যার ভিতরে এক প্রশ্ন বড় হতে থাকে—এই সম্পর্কের জন্য কতদূর লড়াই করা সম্ভব? পরিবারের চোখ এড়িয়ে চিরকাল বাঁচা যায় না। গোপন সাক্ষাৎ যতই রোমাঞ্চকর হোক, তাতে তো একদিন না একদিন ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। সেই আশঙ্কা অনন্যাকে প্রতিটি পদক্ষেপে ভয় দেখায়। তবুও বিদ্রোহ করার ইচ্ছেটা যেন বুকের ভেতরে আগুনের মতো জ্বলে। অন্যদিকে আরমানের কথায় ভরসা রাখলে তাকে অপেক্ষা করতে হবে—হয়তো বছর বছর ধরে। প্রেম মানে কি শুধু অপেক্ষা? নাকি প্রেম মানেই সাহস করে দাঁড়ানো? অনন্যার মাথার ভেতরে যেন ঝড় বইতে থাকে। কিন্তু এক জায়গায় সে নিশ্চিত—আরমানকে ছাড়া তার জীবনের কোনও মানে নেই। সেই বিশ্বাসই তাকে টেনে রাখে। তবু প্রতিটি দিনের শেষে তার ভেতরটা প্রশ্নে প্রশ্নে ভরে ওঠে—সে কি সত্যিই বিদ্রোহের পথে হাঁটবে, নাকি ভালোবাসার টিকে থাকার স্বার্থে সমঝোতার পথ বেছে নেবে? এভাবেই অধ্যায়টির প্রতিটি মুহূর্তে অনন্যার মনে গড়ে ওঠে এক টানটান সাসপেন্স—প্রেম আর পরিবার, বিদ্রোহ আর সমঝোতার দোলাচলে ঝুলে থাকে তার সমগ্র অস্তিত্ব।

পাড়ার লোকজনের চোখ সবসময়ই কৌতূহলী, আর সেই কৌতূহলই ধীরে ধীরে গুজবে রূপ নেয়। অনন্যা আর আরমানকে একসাথে দেখা যাওয়ার পর থেকে যেন পুরো মহল্লাটা এক অদৃশ্য আদালতে পরিণত হয়েছে, যেখানে দু’জন মানুষকে বিচার করা হচ্ছে সমাজের অলিখিত নিয়মের বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে। একে একে কথার তীর ছুঁড়তে থাকে প্রতিবেশীরা—“এত পড়াশোনা করেও মেয়েটা এসব কী করছে?” বা “ছেলের মা-বাবা কি চোখে দেখে না?”—এমন সব মন্তব্য ধীরে ধীরে অনন্যার বাড়ির দেয়াল ভেদ করে ঢুকে পড়ে। অনন্যার মা যখন বাজারে যান, তখন দোকানদাররা ভদ্রতার মুখোশে ঢাকা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি ছুঁড়ে দেয়। এমনকি পাড়ার মহিলারা নিজেদের আড্ডায় অনন্যাকে নিয়ে কুৎসিত গল্প বানিয়ে তা ছড়িয়ে দেয়, যেন একজন মেয়ের ব্যক্তিগত অনুভূতি আর সিদ্ধান্তকে খোলা মাঠে ছুড়ে দেওয়া যায়, যেখানে সবাই পাথর ছোড়ার অধিকারী। আরমানের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি খুব আলাদা নয়। সন্ধ্যার নামাজ শেষে মসজিদের সামনে দাঁড়ানো বৃদ্ধরা হুঁশিয়ারি দেন, “এই ছেলেটা সমাজের নিয়ম ভেঙে কোথায় যাচ্ছে, কে জানে।” কথাগুলো যেন সরাসরি তার আত্মসম্মানে আঘাত করে, কিন্তু প্রতিবাদ করলেই সেটা দ্বিগুণ শক্তিতে ফিরিয়ে আনে, তাই চুপ করেই সব গিলতে হয় তাকে।

ক্রমে এই কুৎসার বোঝা দুই পরিবারের ভেতরে গভীর ক্ষত তৈরি করতে থাকে। অনন্যার বাবা প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন, মুখে অল্প কথা, কিন্তু চোখে তীব্র ক্ষোভ আর লজ্জার ছাপ। তিনি ভাবেন—সমাজে এত বছর ধরে গড়ে তোলা সম্মানটা কি এক মুহূর্তে ভেঙে যাবে? অন্যদিকে, অনন্যার মা মানসিক যন্ত্রণা সইতে না পেরে মাঝেমধ্যেই চোখের জল ফেলেন রান্নাঘরের কোণে, যেন মেয়ের ভালোবাসার জন্য তাদের সারা জীবনের মানসম্মান তছনছ হয়ে যাচ্ছে। একইভাবে, আরমানের মায়ের উপরও চাপে ভেঙে পড়তে হয়। আত্মীয়-স্বজনদের ফোন আসে গ্রামে—“তুমি ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছ না, নামাজ পড়ানো হয়নি বুঝি?”—এসব শ্লেষ যেন তার মনের ভেতর কাঁটা গেঁথে দেয়। তিনি নিজেও ধর্মের দোহাই দিয়ে আরমানকে থামাতে চেষ্টা করেন, কিন্তু ছেলের চুপচাপ জেদী মুখ দেখে বুঝতে পারেন, ভেতরে ভেতরে সে আর কারও কথা শুনছে না। এই চাপা পরিস্থিতিতে দুই পরিবারই যেন এক অদৃশ্য দেয়ালের ভেতর বন্দি হয়ে পড়ে, যেখানে প্রত্যেকটা নিশ্বাসে সমাজের তিরস্কার মিশে থাকে।

সবচেয়ে নির্মম ব্যাপারটা হলো, যারা এই কুৎসা রটাচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেকেই গোপনে হয়তো নিজেদের জীবনে ভুল করেছে, সম্পর্কের বাইরে গিয়েছে বা অন্যায় করেছে—কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে আসে না বলেই তারা অন্যকে আঙুল তুলতে দ্বিধা করে না। সমাজ সবসময়ই দুর্বল জায়গায় আঘাত করতে ভালোবাসে, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সেই আঘাতটা দ্বিগুণ হয়। অনন্যা বুঝতে শুরু করে, তার স্বাধীনতার পথটা আসলে কতটা কণ্টকাকীর্ণ। আরমানও উপলব্ধি করে, শুধু ভালোবাসা থাকলেই সমাজের চাপ সামলানো যায় না, তার জন্য শক্ত মানসিকতা দরকার, যা ধীরে ধীরে তাদের ভেতরে জন্ম নিচ্ছে। তবু প্রতিদিন ভোরে কিংবা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে, দু’জনেই একবার ভেবে দেখে—এত কষ্ট কি সত্যিই সহ্য করা সম্ভব? নাকি একসময় ভেঙে পড়তে হবে? সমাজের আঙুল যে কত ধারালো হতে পারে, সেই বেদনা তাদের প্রতিটি দিনকে আরও কঠিন করে তোলে। কিন্তু একইসাথে, অদৃশ্যভাবে তাদের সম্পর্ককে এক অদম্য শক্তি দিতেও শুরু করে, কারণ একমাত্র একে অপরই জানে, এই পৃথিবীতে তারা একা নয়।

অনন্যার জীবন যেন হঠাৎ করেই অস্থিরতায় ভরে উঠল। সে যতই আধুনিক শহুরে মেয়ে হোক, বাবার কথার বাইরে যাওয়ার সাহস তার মধ্যে কখনো গড়ে ওঠেনি। অনন্যার বাবা ছিলেন পুরনো মানসিকতার মানুষ, সমাজে মুখ রক্ষার জন্য এবং পরিবারের সম্মান বজায় রাখার জন্য তিনি এক মুহূর্তও দ্বিধা করলেন না মেয়ের বিয়ের ব্যাপারটা নিজের হাতে তুলে নিতে। একদিন হঠাৎই সকালের নাশতার টেবিলে তিনি জানালেন, “অনন্যা, কাল রোহন আর তার পরিবার আসছে তোমাকে দেখতে। ছেলে ভালো চাকরি করে, দায়িত্বশীল, পরিবারটা আমাদের সমান মানানসই।” কথাগুলো শুনে অনন্যা যেন মুহূর্তের মধ্যে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। রোহন নামটা তার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা, অথচ বাবার চোখেমুখে স্পষ্ট ছিল একরাশ সন্তুষ্টি। অনন্যা জানত, বাবার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করা মানেই বাড়িতে ভয়াবহ অশান্তি ডেকে আনা। তার বুকের ভেতর কেবল একটাই নাম ঘুরপাক খাচ্ছিল—আরমান। সেদিন সন্ধ্যায় যখন সে ফোন হাতে নিল, আরমানের কণ্ঠস্বর শুনেই বুকের ভেতর জমে থাকা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। সে কেঁদে কেঁদে জানাল সব কথা, আর আরমানকে আঁকড়ে ধরার মতো ভরসা খুঁজতে লাগল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা এখানেই যে, আরমানের ঘরেও একই কাহিনি চলছিল—তার বাবা-মা তাকে এক আত্মীয়ার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চাপ দিচ্ছিলেন।

আরমান প্রথমে দৃঢ় গলায় বলেছিল, “কিছুতেই মেনে নেব না, অনন্যা। আমি তোমাকেই বিয়ে করব, অন্য কাউকে নয়।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারও আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরতে লাগল। কারণ সে জানত, তার বাবার জেদ ভাঙানো প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে অনন্যাও জানত তার বাবা কখনো সমাজের চোখে ‘অযোগ্য সিদ্ধান্ত’ নিতে দেবেন না। দিনগুলো ধীরে ধীরে ভারী হতে লাগল। দুজনের দেখা-সাক্ষাৎ কমতে শুরু করল, ফোনালাপেও অস্থিরতা জমতে লাগল। যখনই অনন্যা বলত, “আমরা পালিয়ে বিয়ে করলে কেমন হয়?” আরমান মুহূর্তের মধ্যেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ত—“কিন্তু পালিয়ে গেলে আমাদের পরিবারগুলো সম্পূর্ণ ভেঙে যাবে। মা-বাবার মুখ আমি কীভাবে দেখব?” এই দ্বন্দ্বের কথা দুজনেই ভালো করে জানত, কিন্তু মনের ভেতরে জমা ভালোবাসা ক্রমশ চাপা পড়ে যেতে লাগল বাধ্যবাধকতার বোঝার তলায়। রাতের পর রাত অনন্যা ঘুমোতে পারত না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে সিগারেট হাতে চিন্তা করত, কেন সমাজ এখনো দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সিদ্ধান্তকে এত অবজ্ঞা করে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠত আরমানের হাসি, তার হাত ধরা, আর সেই মুহূর্তগুলো যেগুলোতে পৃথিবী যেন নিখুঁত মনে হত। অথচ আজ সবকিছু অচলাবস্থায় আটকে গেছে।

ভালোবাসা মানেই যে সহজ হবে, তা কখনোই নয়। কিন্তু এই চাপা অন্ধকার যেন অনন্যা ও আরমানকে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছিল। অনন্যার বাবা বাড়িতে রোহনের প্রশংসা করতে থাকলেন—“ছেলেটা ভদ্র, মিষ্টি, আমাদের মেয়ের জন্য একেবারে উপযুক্ত।” অন্যদিকে আরমানের বাবা প্রতিদিন নতুন নতুন যুক্তি দেখাতে লাগলেন—“আমাদের পরিবারে মান-সম্মান আছে, সমাজে অবস্থান আছে। তুমি যদি আমাদের কথা না শোনো, তাহলে সব ভেঙে পড়বে।” দুজনের চারপাশে যেন কেবল চাপা গুঞ্জন, অস্বস্তি আর অপরাধবোধ। একসময় তারা একে অপরকে কথা দিয়েছিল, কোনো পরিস্থিতিই তাদের আলাদা করতে পারবে না। কিন্তু এখন তাদের সেই শপথ যেন কাঁচের মতো ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছিল। দেখা হলে তারা চুপচাপ বসে থাকত, চোখের ভাষায় বলার চেষ্টা করত না-পারা যন্ত্রণার কথা। মাঝে মাঝে অনন্যা হঠাৎ ঝড়ের মতো কেঁদে উঠত, আরমান তাকে জড়িয়ে ধরে কেবল বলত, “আমরা কোনো পথ বের করব।” অথচ পথটা কোথায়, তা কেউই জানত না। দুই পরিবার যখন দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে থাকল, প্রেমিক-প্রেমিকা যেন কেবল অসহায় দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভাঙনের প্রথম সূর্যোদয় তখন তাদের সম্পর্কের আকাশে স্পষ্ট রূপ নিতে শুরু করেছে।

আরমান আর অনন্যা দু’জনেই জানত, তাদের সম্পর্ক এক অদ্ভুত অচলাবস্থার মধ্যে আটকে পড়েছে। পরিবারের চাপে, সামাজিক চোখরাঙানিতে আর একে অপরকে হারানোর আতঙ্কে তারা ক্রমশ দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অনেক ভেবেচিন্তে তারা ঠিক করল, আর দেরি নয়—সবকিছু ফেলে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে। আরমানের চোখে ছিল দৃঢ়তা, একরাশ ভালোবাসার উন্মাদনা; আর অনন্যার চোখে অদ্ভুত এক মিশ্রতা—অভিমান, স্বপ্ন আর অচেনা ভয়। তারা পরিকল্পনা করেছিল এক শীতের সকালে শহরের ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে ট্রেনে উঠবে, দূরে কোথাও—যেখানে কেউ তাদের চেনে না, কেউ থামাতে পারবে না। আরমানের মনে হচ্ছিল, হয়তো এটাই মুক্তি, এটাই সেই অদৃশ্য বাঁধন ছিঁড়ে ফেলার শেষ সুযোগ। অনন্যার মনে আবার চলছিল দ্বন্দ্ব। সে কল্পনা করছিল তার বাবা-মায়ের মুখ—মায়ের চোখে অসহায় কান্না, বাবার কঠোর নীরবতা। প্রেমিকের হাত শক্ত করে ধরে রাখলেও তার বুকের ভেতর এক অদৃশ্য প্রশ্ন বারবার আঘাত করছিল—নিজেদের সুখের জন্য পরিবারকে ভেঙে দেওয়া কি সত্যিই সঠিক হবে?

ট্রেন ধরার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে তারা দু’জন স্টেশনে পৌঁছে যায়। লোকজনের ভিড়, ঘোষণার আওয়াজ, চায়ের দোকানের ধোঁয়া—সবকিছু মিলে পরিবেশটা ছিল খুব স্বাভাবিক, অথচ দু’জনের মনে চলছিল ঝড়। অনন্যা হঠাৎ একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল, যেন কিছুতেই আর সামনে পা বাড়াতে পারছে না। আরমান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি হলো? এখন তো পিছু হটার সময় নয়।” অনন্যার চোখে জল এসে গিয়েছিল। সে বলল, “আরমান, আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু যদি এই ভালোবাসার জন্য আমার মা-বাবা আমাকে চিরকালের জন্য ত্যাগ করে? যদি তারা আমাকে একবারও ক্ষমা না করে? আমাদের সুখ কি তাদের কান্নার ওপরে দাঁড়াতে পারে?” আরমান স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছিল, এতদূর আসার পর এই দ্বিধা মানে কি সব শেষ? কিন্তু গভীরভাবে ভেবে সে বুঝল, অনন্যার ভয় আসলে সত্যি। যদি সম্পর্কটা তাদের জীবনে আনন্দ আনে কিন্তু একইসঙ্গে দুই পরিবারকে ভেঙে দেয়, তবে সেই আনন্দ কি পূর্ণতা পাবে? ট্রেনের হুইসেল বাজতে লাগল, কিন্তু দু’জনেই দাঁড়িয়ে রইল এক অদ্ভুত শূন্যতার ভেতরে।

কিছুক্ষণ পর আরমান অনন্যার হাত আলতো করে ছেড়ে দিল। তার কণ্ঠ ভারী হলেও শান্ত, “তুমি ঠিকই বলেছো। প্রেম মানে শুধু দু’জন মানুষের মিলন নয়, প্রেম মানে এমন একটা সেতু, যা মানুষকে কাছাকাছি আনে। যদি আমাদের সম্পর্ক সেই সেতু ভেঙে দেয়, তবে আমরা কী প্রমাণ করব?” অনন্যা চুপ করে কাঁদছিল, আরমান তার চোখের জল মুছিয়ে দিল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে দু’জনেই বুঝতে পারল, পালিয়ে বিয়ে না করার সিদ্ধান্তই হয়তো তাদের সত্যিকারের ভালোবাসার পরিচয়। কারণ ভালোবাসা কখনও পরিবারকে ধ্বংস করে গড়ে ওঠে না, বরং ভালোবাসা সেই পথ খোঁজে যেখানে পরিবার, সমাজ আর নিজের মানুষদের একসঙ্গে রাখা যায়। সেদিন তারা বাড়ি ফিরে গেল, জানত সামনে কঠিন লড়াই অপেক্ষা করছে। হয়তো পরিবার মানবে না, হয়তো অনেক কথা শুনতে হবে, কিন্তু তারা ঠিক করল, পালিয়ে নয়—সামনাসামনি থেকে, সবার সামনে নিজের সম্পর্কের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবে। আরমান অনন্যার হাত শক্ত করে ধরল, আর অনন্যা প্রথমবারের মতো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল—কারণ সে জানল, তাদের প্রেম এখন আগের চেয়ে আরও গভীর, আরও দৃঢ়।

তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন আর সমাজের চাপ নিয়ে বহুদিন ধরে চলা দ্বন্দ্বের শেষ রাত্রিটা ছিল যেন এক গভীর নিস্তব্ধতার আবরণে ঢাকা। অনন্যা আর আরমান বসেছিল কলেজ ক্যাম্পাসের পুরনো অশ্বত্থ গাছটার নিচে, যে গাছের ছায়ায় তাদের প্রেমের প্রথম বীজ বোনা হয়েছিল। চারপাশে ফুরফুরে হাওয়া বইছিল, আর দূরে ম্লান আলোয় ঝাপসা হয়ে আসা শহরের রাস্তাগুলো যেন তাদের নিঃশব্দ যন্ত্রণা সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নীরব রইল, কারণ দু’জনেই জানত কথার শুরু হলে শেষটা অনেক কঠিন হয়ে উঠবে। অনন্যা মৃদু কণ্ঠে বলল, “আমাদের ভালোবাসার সত্যিটা আমরা জানি, কিন্তু সমাজের দেয়াল, পরিবারের অস্বীকৃতি, আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা—এসবের সামনে কি আমরা টিকতে পারব?” আরমান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিগারেট ধরাল, তারপর নিভু নিভু আলোয় তাকিয়ে বলল, “আমি জানি না, তবে আমি চাই না তুমি আমার কারণে সারাজীবন বোঝা বহন করো। ভালোবাসা যদি শুধু সংগ্রাম আর কান্নার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে সেটা সুখ দেয় না।” অনন্যার চোখ ভিজে এল, তবে সে আর অশ্রু গড়াল না। তারা দু’জনেই বুঝতে পারছিল, এই রাত হয়তো তাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তের সাক্ষী হতে চলেছে।

কথোপকথন ক্রমশ গভীর হলো, একসময় অনন্যা বলল, “আমরা হয়তো একসাথে থাকব না, কিন্তু আমার মনের ভেতর তুমি চিরকাল থাকবে। ভালোবাসা কখনো ভাঙে না, ওটা শুধু রূপ বদলায়। তুমি যদি আমাকে আর না-ও পাও, তবু আমার প্রতিটা সকালে তুমি থাকবে, আমার প্রতিটা গানের লাইনে, প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটায়।” আরমান এক মুহূর্তের জন্য চোখ বুজল, যেন কথা গুলো বুকের ভেতরে সঞ্চয় করে রাখছে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমি তোমাকে হারাতে চাই না, কিন্তু তোমাকে কষ্ট দিতেও চাই না। আমরা যদি আলাদা হয়ে যাই, তবে অন্তত এই শান্তিটুকু থাকবে যে আমরা একে অপরকে সত্যিকারভাবে ভালোবেসেছিলাম।” চারপাশের পরিবেশ যেন আরও ভারী হয়ে উঠল, বাতাসের গতি থেমে গেল, শুধু তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছিল নৈঃশব্দ্যে। দু’জনের চোখে জল, কিন্তু মুখে তৃপ্তির হাসি—কারণ এই বিচ্ছেদ কোনো ঘৃণার ফল নয়, বরং এক অনন্য ত্যাগ। সমাজ তাদের ভালোবাসা গ্রহণ করেনি, পরিবার দেয়নি অনুমতি, কিন্তু তারা নিজেদের ভালোবাসাকে অমর করে রাখল জীবনের প্রতিজ্ঞায়।

শেষ মুহূর্তে তারা হাত ধরল, যেন বিদায়টা সহজ হয়। অনন্যা ফিসফিস করে বলল, “তুমি আমাকে মনে রেখো, আমি তোমাকে ভোলার চেষ্টা করব না।” আরমান দৃঢ় গলায় জবাব দিল, “তুমি ভুলো না, তবে এগিয়ে যেও। আমি থাকব তোমার প্রতিটা হাসিতে, প্রতিটা স্মৃতিতে। আমাদের প্রেম কখনো অসমাপ্ত নয়, ওটা কেবল আরেকটা পথে হাঁটার শুরু।” সেই মুহূর্তে রাতের আকাশে অর্ধচন্দ্র ম্লান আলো ছড়িয়ে দিল, আর দুজনের নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা আকাশের বুক জুড়ে অমর হয়ে রইল। তারা জানত, সামনে পথ আলাদা, তবু হৃদয়ের ভেতর তারা চিরকাল একসাথে থাকবে। এ প্রেম ভাঙন নয়, বরং জীবনের গভীর এক স্মৃতি, যা কোনো সমাজ, কোনো নিয়ম, কোনো সময় মুছে ফেলতে পারবে না। তারা উঠে দাঁড়াল, আলাদা পথে হাঁটতে শুরু করল, কিন্তু মনে হলো একই স্রোতে ভেসে যাচ্ছে—ভালোবাসার অদৃশ্য নদীতে, যার কোনো শেষ নেই।

বছর কেটে যায়। সময় যেন ধীরে ধীরে তাদের জীবনের দাগগুলো মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা শুধু গভীর করে তোলে। অনন্যা এখন এক ভিন্ন জীবনের অধিকারিণী—একটি বড় সংসার, ব্যস্ত সময়সূচি, চারপাশে মানুষের ভিড়, কিন্তু তার মনের এক কোণে সবসময়ই একটা ফাঁকা চৌকাঠ পড়ে থাকে। আরমানও নিজেকে নিয়ে নতুন করে গড়ে তোলে, অন্য কোথাও নিজের সংসার শুরু করে। বাইরে থেকে দুজনকেই দেখে মনে হয় তারা জীবনের নিয়মিত পথে এগিয়ে চলেছে, সুখ-দুঃখের ভারসাম্যে নতুন গল্প লিখছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক অদৃশ্য স্মৃতি, এক অর্ধসমাপ্ত অধ্যায়, সবসময়ই তাদের হৃদয়ে শূন্যতা তৈরি করে। রাতের নিস্তব্ধতা কিংবা বৃষ্টির দিনের জানালা—এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই তাদের ভেতরে জমে থাকা অতীতের স্রোতকে ফিরিয়ে আনে। কখনও পুরনো গান, কখনও বইয়ের হলুদ হয়ে যাওয়া পাতায় চাপা দেওয়া কাগজের গন্ধ, আবার কখনও হঠাৎ করে বৃষ্টির ভিজে হাওয়া মনে করিয়ে দেয় সেই দিনগুলো, যখন সবকিছু এতটা জটিল ছিল না, যখন স্বপ্নগুলো একসাথে গড়ে উঠছিল। তারা দুজনেই জানে, সেই স্মৃতি থেকে আর মুক্তি নেই; এ যেন এক অনন্ত প্রতিধ্বনি, যা দূরত্ব সত্ত্বেও একে অপরকে ছুঁয়ে যায়।

এই স্মৃতির দোলা যতটা মধুর, ততটাই বেদনাদায়ক। কারণ তারা জানে, এখন আর কিছুই আগের মতো হতে পারবে না। সমাজ তাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরিণতি বেছে নিয়েছে—দায়িত্ব, শৃঙ্খল, এবং অন্যের প্রত্যাশা তাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। অনন্যা হয়তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে মাঝে মাঝে খুঁজে পায় সেই চেনা দৃষ্টি, যা একদিন আরমানের চোখের সঙ্গে মিলেছিল। অন্যদিকে আরমান, যখনই কোনো পুরনো রাস্তা ধরে হাঁটে কিংবা মেঘলা আকাশ দেখে, তখনই বুকের ভেতরে এক অদৃশ্য কাঁপন অনুভব করে। তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়গুলো যতই পূর্ণ মনে হোক, প্রতিটি আনন্দের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে একরাশ অসম্পূর্ণতা। তারা দুজনেই অন্যদের কাছে হাসিমুখে স্বাভাবিক জীবনের ছবি আঁকে, কিন্তু তাদের অন্তরের গোপন ক্যানভাসে রয়ে যায় অপূর্ণ ভালোবাসার রঙ। ঠিক যেন একটি অসমাপ্ত স্বপ্ন—যা ঘুম ভাঙার পরও মনে লেগে থাকে, চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়, কিন্তু আর বাস্তবের মাটিতে ফোটে না।

শেষমেশ বোঝা যায়, সমাজ হয়তো তাদের আলাদা করে দিয়েছে, নতুন দায়িত্ব, নতুন সম্পর্কের শৃঙ্খলে বেঁধেছে, কিন্তু প্রেম আসলে কোনোদিন মরে যায়নি। ভালোবাসা শুধু সম্পর্কের সীমানায় আটকে থাকে না; তা ছড়িয়ে যায় সময়ের স্রোতে, দূরত্বের সীমা ছাড়িয়ে, এমনকি একেবারে অপ্রকাশিত নিঃশ্বাসের ভেতরেও। অনন্যা হয়তো এক রাতে জানালার পাশে বসে বৃষ্টির ফোঁটা গোনে, আরমান হয়তো কোনো গানের সুরে হঠাৎ করে থেমে যায়—এভাবেই তাদের ভালোবাসা টিকে থাকে। তারা আর একসঙ্গে নেই, হয়তো কখনও হবেও না, কিন্তু হৃদয়ের ভেতর যে শিকড় একদিন গেঁথে গিয়েছিল, তা কেউ মুছে দিতে পারেনি। এই গল্প শেষ হয়েছে কেবল সামাজিক নিয়মের খাতায়, কিন্তু তাদের মনে, তাদের অস্থির নিঃশ্বাসে, এবং তাদের স্মৃতির গভীরে সেই গল্প আজও বেঁচে আছে। “অসমাপ্ত স্বপ্ন” হয়তো কাগজে শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তার সুর তারা দুজনেই বহন করে চলেছে—প্রমাণ হিসেবে যে সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো নিভে যায় না, শুধু অন্যরকম পরিণতি বেছে নেয়।

***

1000055105.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *