Bangla - রহস্য গল্প

অষ্টমীর রাতের ছায়া

Spread the love

অরিত্র চক্রবর্তী


পর্ব ১: আলোর ভেতরে অন্ধকার

শহরের উত্তর কলকাতার সেই বনেদি বাড়িটা আসলে আজও এক ঐতিহাসিক চিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে জমিদারি টাকায় যে প্রাসাদ গড়ে উঠেছিল, তার সিংহদ্বার দিয়ে এখনো ঢুকলেই মনে হয় সময় যেন থমকে গেছে। বিশাল লোহার ফটক, ওপরে শ্বেতপাথরের মূর্তি, আর ভেতরে ঢুকলেই বিস্তৃত অঙ্গন—সব মিলিয়ে দুর্গাপুজোর সময়টা হয়ে ওঠে যেন এক স্বতন্ত্র জগৎ। চারদিক আলোয় ভেসে যায়, প্যান্ডেল সাজে গয়নার মতো, কিন্তু তার মাঝেই যেন লুকিয়ে থাকে অদ্ভুত এক ছায়া।

অর্ক প্রথম দিনেই বাড়িটায় পা রাখল। পেশায় সে সাংবাদিক, কিন্তু আসলে উৎসবের পাগল। ছোটবেলা থেকেই দুর্গাপুজো নিয়ে তার এক অন্যরকম নেশা। শহরের বড় বড় বনেদি বাড়ির পুজো ঘুরে বেড়ানো, তাদের ইতিহাস শোনা, আর ফটো তোলা—এটাই তার আনন্দ। এই বছর তার অফিস থেকে তাকে পাঠানো হয়েছে একটি বিশেষ ফিচার কাভার করার জন্য। বাড়িটির নাম—রায়চৌধুরী বাড়ি। প্রায় দুশো বছরের পুরনো এই পুজো নাকি শহরের সবচেয়ে রহস্যময় দুর্গাপূজাগুলির মধ্যে একটি।

প্রথম দিন, ষষ্ঠী। ভিড় তখনও বাড়েনি। তবে আলোর ঝলকানি, সাজসজ্জা, আর ঢাকের আওয়াজ ইতিমধ্যেই আকাশমুখী। অর্ক তার ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে মণ্ডপে ঢুকল। প্রতিটি কোণ সে নিখুঁত চোখে পর্যবেক্ষণ করছিল। ঠাকুরদালান ঘিরে মৃদু ধূপকাঠির গন্ধ ভাসছিল। ভেতরে দেবীর মূর্তিতে ইতিমধ্যেই প্রাণপ্রতিষ্ঠার আয়োজন শুরু হয়েছে।

হঠাৎই তার নজরে এল—এক নারী। গাঢ় লাল শাড়ি, খোপায় সাদা ফুল, মুখে যেন অস্বাভাবিক প্রশান্তি। তিনি এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, কেউ যেন তাঁর দিকে তাকাচ্ছিল না। যেন উপস্থিত থেকেও তিনি অনুপস্থিত। অর্কের মনে হল, তিনি চেনা মুখ নন। অথচ তাঁর ভঙ্গি, তাঁর চোখ—সবকিছুই যেন এক অদ্ভুত টান সৃষ্টি করছিল।

সে মুহূর্তে ঢাকের তালে অঞ্জলি শুরু হলো। ভিড় সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল, সকলে ফুল হাতে দেবীর সামনে প্রণাম জানাতে লাগল। অর্ক ক্যামেরা তুলে সেই মুহূর্ত ধরে রাখতে গেল। আবার তাকিয়ে দেখল, যেখানে নারীটি দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে এখন ফাঁকা। এক মুহূর্ত আগেও তিনি ছিলেন, অথচ এখন কেউ নেই। অর্ক চারপাশে তাকাল, লোকজন ঠাসা, তবু তাঁর সাড়াশব্দ নেই।

“আপনি কাকে খুঁজছেন?”—পাশ থেকে এক কিশোরী কণ্ঠ ভেসে এল।
অর্ক ঘুরে তাকাল। একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। বয়স বেশি নয়, কলেজে পড়ে হবে। পরনে সাদা-লাল শাড়ি, কপালে ছোট লাল টিপ। তার চোখদুটো কৌতূহলে ভরা।
অর্ক একটু হেসে বলল, “না, তেমন কিছু না। একজনকে দেখেছিলাম, হঠাৎ চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেলেন।”
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, “এই ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যাওয়া তো অস্বাভাবিক কিছু নয়।”
অর্ক মাথা নাড়ল, কিন্তু মনে হলো—এটা নিছক ভিড়ের বিষয় নয়।

সন্ধ্যার আরতি শেষ হলে অর্ক উঠোনে বেরিয়ে এল। ঠান্ডা হাওয়া বইছিল, তাতে শিউলির গন্ধ ভেসে আসছিল। মেয়েটিও বেরিয়ে এলো, হাতে প্রণাম করার ফুল।
“আমি অদ্রিজা,” সে নিজের পরিচয় দিলো। “বাড়িরই আত্মীয়। আপনার মনে হচ্ছে হয়তো ভুল দেখেছেন।”
অর্ক হেসে বলল, “হয়তো। তবে অদ্ভুত লেগেছে। এই বাড়ি নিয়ে নাকি অনেক গল্প আছে?”
অদ্রিজা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “গল্প নয়, রহস্য। তবে সব শোনার নয়। এই পুজো শুধু আনন্দ নয়, এর ভেতরে অন্য কিছু আছে। আপনি যদি এখানে বেশিদিন থাকেন, নিজেই বুঝবেন।”

অর্কের মনে কৌতূহল আরও বাড়ল। সাংবাদিকতার অভ্যাস তো বটেই, তার উপর রহস্য তাকে সবসময় টানে। সেই রাতে বাড়ি ফিরে আসার পরও মাথায় ঘুরছিল সেই লাল শাড়ির নারী আর অদ্রিজার কথা।

পরের দিন সপ্তমী। ভিড় আরও বেড়েছে। অর্ক আবার হাজির। সকালের কোলাহল, কাশ ফুলে ভরা রাস্তা, আর ধুনুচি নাচ—সব মিলিয়ে উৎসব জমজমাট। কিন্তু তার চোখ সবসময় খুঁজছিল সেই নারীকে। অদ্রিজার সাথে আবার দেখা হলো। সে হেসে বলল, “আপনি আবার এসেছেন! এখনও কি সেই মহিলাকে খুঁজছেন?”
অর্ক মৃদু হেসে উত্তর দিল, “হয়তো। তবে সত্যি বলতে কি, এখন মনে হচ্ছে আসল রহস্য এই বাড়িতেই লুকিয়ে আছে।”

সন্ধ্যাবেলায় আবার আরতি হলো। তখনই ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা। ঢাকের তালে মণ্ডপ ভরে উঠেছে, সবাই প্রণাম করছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলসে গেল এক মুহূর্তের জন্য। আলো আবার ফিরে আসতেই দেখা গেল—মন্দিরের সামনের আসনে লাল শাড়ি পরা এক নারী বসে আছেন। মাথা নিচু, হাতে অঞ্জলি। কিন্তু ঠিক পরক্ষণেই অদৃশ্য।

অর্ক শিউরে উঠল। ক্যামেরায় সে মুহূর্তটা ধরতে পারেনি। চারপাশে কেউ টেরই পেল না। সে হঠাৎ শুনল অদ্রিজার ফিসফিসানি—“তুমি-ও কি দেখেছ?”
অর্ক তাকিয়ে অবাক হলো। অদ্রিজার চোখে ভয়ের ছাপ। সে ধীরে ধীরে বলল, “হ্যাঁ, আমি দেখেছি। তাহলে তুমি-ও ভুল দেখোনি।”

রাত বাড়তে থাকল। পূজোর ভিড় ধীরে ধীরে কমল। ঠাকুরদালান আলোয় ভরে রইল, কিন্তু অর্কের মনে হলো যেন কোথাও এক অচেনা অন্ধকার জমে আছে। বাড়ির দালানে দালানে বাতাস বইছিল, কিন্তু তার সঙ্গে যেন এক অদৃশ্য ফিসফিসানি ভেসে আসছিল।

অর্ক জানত, এই দুর্গাপুজোর কাভারেজ হয়তো তাকে শুধু একটি সংবাদ দেবে না, বরং এমন এক রহস্যের পথে টেনে নিয়ে যাবে যা সে কল্পনাও করেনি। আর সেই রহস্যের শুরু হয়েছে ঠিক এখানেই—আলোর ভেতরে সেই অদ্ভুত অন্ধকার থেকে।

পর্ব ২: প্যান্ডেলের ছায়া

সপ্তমীর ভোর কাটতেই উত্তর কলকাতার আকাশে আবার ভেসে উঠল শঙ্খ আর ঢাকের আওয়াজ। পাড়ার প্রতিটি গলি যেন সাজিয়ে তোলা হয়েছে, মন্ডপে ভিড় জমতে শুরু করেছে সকাল থেকেই। রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গোৎসবের খ্যাতি শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, ফলে ভিড় সামলানোই যেন কঠিন হয়ে উঠেছে। অর্ক আবার হাজির হল ক্যামেরা নিয়ে, সঙ্গে অদ্রিজার দেওয়া একটা নিঃশব্দ কৌতূহল। আগের রাতে সে যেটা দেখেছে—লাল শাড়ির রহস্যময় নারী—তা ভুলে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।

অদ্রিজা সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়েই অর্ককে স্বাগত জানাল। তার চোখে চাপা উত্তেজনা। “গত রাতে তুমি সত্যিই দেখেছিলে, তাই তো?” সে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল।
অর্ক মাথা নাড়ল, চোখ স্থির ছিল মণ্ডপের দিকে। “আমি শুধু দেখিনি, তোমারও চোখে ভয় দেখেছিলাম।”
অদ্রিজা ধীরে বলল, “এই বাড়ির ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনা আছে, যা কারও জানা নেই। অন্তত বাইরের লোকের কাছে প্রকাশ হয়নি।”

অর্ক আর সময় নষ্ট না করে সরাসরি জানতে চাইল, “কি ঘটনা?”
অদ্রিজা ঠোঁট কামড়ে চুপ রইল। মনে হল সে কিছু বলতে চাইছে, আবার ভয় পাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বলল, “সব বলার সময় আসবে। তবে তুমি যদি এখানে থেকে যেতে চাও, সাবধান থেকো। প্রতিটি বছরেই পুজোর সময় কিছু না কিছু ঘটে।”

তাদের কথোপকথন শেষ হবার আগেই মণ্ডপ থেকে ঢাকের তীব্র শব্দ ভেসে এলো। সকলে ভেতরে চলে গেল। অর্ক ক্যামেরা হাতে মণ্ডপের দিকে এগোল। মাটিতে পড়ে থাকা ধুনুচির ধোঁয়া ধীরে ধীরে উপরে উঠছিল, আর আলোতে সেটা যেন স্বচ্ছ কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ছিল।

হঠাৎই সে লক্ষ করল কিছু অস্বাভাবিক। ঢাকিদের তালে তালে মণ্ডপের ভেতরে একটা ছায়া নড়ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—ছায়াটা কারও সঙ্গে মিলছে না। সেখানে যে ঢাকি দাঁড়িয়ে আছে, তার ছায়া মাটিতে আলাদা পড়ছে, অথচ মণ্ডপের বাঁদিকে খুঁটির গায়ে আরেকটা অচেনা ছায়া দুলছে।

অর্ক স্থির দাঁড়িয়ে রইল। ক্যামেরা তুলতে গিয়েও পারল না, তার চোখ যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ছায়াটি এক মুহূর্তে হাত তুলল, যেন কারও উদ্দেশ্যে আহ্বান জানাচ্ছে। তারপর অদৃশ্য।

“তুমি কি দেখলে?”—পাশ থেকে অদ্রিজার কণ্ঠ এল, সে-ও মণ্ডপের দিকে তাকিয়ে ছিল।
অর্ক শ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ, একটা ছায়া। কিন্তু সেখানে তো কেউ দাঁড়িয়ে নেই।”
অদ্রিজা মাথা নিচু করে বলল, “আমি জানতাম।”

সন্ধ্যার পর আবার ভিড় বাড়ল। ধুনুচি নাচের আয়োজন হলো। আলোর খেলা, ঢাকের গর্জন, মানুষের উচ্ছ্বাসে বাড়ি কেঁপে উঠছিল। অর্ক ভিড়ের ভেতর দিয়ে ক্যামেরা হাতে এগোতে লাগল। কিন্তু তার দৃষ্টি বারবার গিয়ে পড়ছিল মণ্ডপের ছায়াময় কোণাগুলিতে।

অদ্রিজা পাশে এসে দাঁড়াল। তার গলায় আতঙ্কের আভাস। “আমাদের বাড়ির এক শাখার ইতিহাসে বড় অন্ধকার আছে। প্রায় একশো বছর আগে পুজোর সময় একজন ব্রাহ্মণ নিখোঁজ হয়েছিলেন। তার দেহ কখনও পাওয়া যায়নি। অনেকে বলে তিনি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, আবার অনেকে বলে তাকে বলি দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকেই পুজোর সময় এই বাড়িতে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে।”

অর্ক কেঁপে উঠল। “মানে, তুমি বলতে চাইছ এই ছায়া সেই ব্রাহ্মণের?”
অদ্রিজা চোখ তুলে তাকাল, তার দৃষ্টি যেন ভয় আর বিশ্বাসের মাঝামাঝি কোথাও আটকে আছে। “আমি শুধু জানি, কেউ কিছু লুকিয়ে রেখেছে। আর সেই লুকোনো পাপ প্রতিবার পুজোর রাতে ফিরে আসে।”

মধ্যরাতে অর্ক বাড়ির ভেতরে একা হাঁটছিল। অদ্রিজা চলে গিয়েছিল ভেতরের ঘরে। অর্কের কানে ভেসে এলো মৃদু মন্ত্রপাঠের সুর, যেন দূরে কোথাও থেকে কেউ উচ্চারণ করছে। শব্দটা আসছিল মণ্ডপের দিক থেকে।

সে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। মণ্ডপ তখন ফাঁকা, আলো জ্বলছিল ক্ষীণভাবে। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই অর্ক স্তব্ধ হয়ে গেল। মণ্ডপের দেওয়ালে একদম স্পষ্ট ছায়া পড়েছে—একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে প্রদীপ হাতে। অথচ সামনে কেউ নেই।

ছায়াটা ধীরে ধীরে ঘুরল, যেন অর্কের দিকে তাকাল। মুহূর্তে প্রদীপটা মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। অর্ক চিৎকার করে উঠল, কিন্তু গলায় শব্দ আটকে গেল।

তারপরই আলো নিভে গেল। মণ্ডপ ডুবে গেল অন্ধকারে। শুধু শোনা গেল পায়ের শব্দ, যেন কেউ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।

আবার আলো ফিরে আসতেই মণ্ডপ খালি। ছায়াও নেই, প্রদীপও নেই। সব যেন স্বাভাবিক। কিন্তু অর্ক জানত, সে যা দেখেছে তা নিছক কল্পনা নয়।

সেই রাতে ঘরে ফেরার আগে অদ্রিজা ফিসফিস করে বলল, “তুমি এখন বুঝতে পারছ, এখানে শুধু পূজা হয় না। এখানে অতীতের ছায়া এখনও বেঁচে আছে।”

অর্ক চুপ করে রইল। সাংবাদিক হিসেবে তার কাজ ঘটনাকে বাস্তবভাবে উপস্থাপন করা, কিন্তু সে জানত, এখানে যে রহস্য চলছে তার জন্য হয়তো সাংবাদিকতার ভাষা যথেষ্ট নয়। এই বাড়ির প্রতিটি দেওয়ালে, প্রতিটি ছায়ায় লুকিয়ে আছে শতবর্ষের পাপ আর ভয়। আর সেই ভয় এখন তার নিজের জীবনে ঢুকে পড়েছে।

পর্ব ৩: গোপন অলিন্দের দরজা

অষ্টমীর সকাল থেকেই রায়চৌধুরী বাড়ি উৎসবের রঙে ভরে উঠেছিল। গলির কোণে কোণে কাশফুল, ঢাকের আওয়াজে ছন্দ, শঙ্খধ্বনিতে আকাশ কেঁপে উঠছে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ভিড় করছে এই বনেদি বাড়ির পুজো দেখতে। বাড়ির উত্তরাধিকারীরা গর্বভরে অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছে, অথচ অর্কের চোখে সেই গর্ব নয়, বরং ভেসে বেড়াচ্ছে রাতের ছায়াগুলো।

আগের রাতের অভিজ্ঞতা তাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। প্যান্ডেলের ছায়া, প্রদীপ হাতে এক অদৃশ্য মানুষের ছায়াপ্রতিমা—সবকিছু যেন বাস্তবতার গায়ে অচেনা ছায়া ফেলছে। অর্ক সিদ্ধান্ত নিল, আজ সে আরও গভীরে খুঁজবে। সাংবাদিকতার নেশা নয়, যেন নিজের অজানা টানের কাছে হার মানল।

অদ্রিজা ভিড় সামলাতে সামলাতে অর্ককে দেখে এগিয়ে এল। চোখে ঘুমহীনতার ক্লান্তি, কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা। “তুমি আজও থামছ না, তাই তো?”
অর্ক হেসে বলল, “আমি সাংবাদিক, রহস্য এড়িয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি যদি সত্যিই কিছু জানো, তবে আমাকে বলো।”

অদ্রিজা চারপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হলো কেউ শুনছে না। তারপর ধীরে বলল, “তুমি কি জানো, এই বাড়ির দক্ষিণ দিকের পুরনো অংশটা বহু বছর ধরে বন্ধ? সেখানে এক অলিন্দ আছে—যাকে সবাই ‘নিষিদ্ধ অলিন্দ’ বলে। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা বিশ্বাস করেন, সেখানে অশুভ শক্তি বন্দি আছে।”

অর্কের চোখ চকচক করে উঠল। “তাহলে আজ রাতে চলবে আমরা সেখানে?”
অদ্রিজা থমকে গেল। “ওটা সহজ নয়। ওখানে তালা আছে, আর পাহারাদারও বসানো থাকে। তবু…” সে একটু থেমে যোগ করল, “যদি তুমি সত্যিই সাহস করে দেখতে চাও, আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারি।”

দিনের বেলায় পুজোর কোলাহল, অঞ্জলির ব্যস্ততা, প্রিয়জনদের সঙ্গে আড্ডা—সবকিছু মিলে বাড়িটা যেন প্রাণবন্ত। কিন্তু অর্কের চোখে প্রতিটি দেওয়ালেই একটা রহস্যময় ছায়া নাচছিল।

রাত নামল অষ্টমীর। মণ্ডপ ভরে উঠল ভক্তদের ভিড়ে। ধুনুচি নাচ, ঢাকের গর্জন, দেবীর সামনে অঞ্জলির ফুল—সবকিছুই যেন আকাশ ভরিয়ে দিল। কিন্তু মাঝেমাঝেই বাতাসে ভেসে আসছিল অচেনা এক শীতলতা।

ভিড় যখন কমল, তখনই অদ্রিজা অর্ককে ইশারা করল। দুজনে নিঃশব্দে বাড়ির দক্ষিণ দিকের পুরনো অংশে চলে গেল। অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডর পেরিয়ে তারা পৌঁছল এক বিশাল কাঠের দরজার সামনে। দরজাটা কালো রঙে মাখামাখি, আর উপরে প্রাচীন নকশা খোদাই করা। তার ওপর ঝুলছে এক বিশাল লোহার তালা।

অদ্রিজা ফিসফিস করে বলল, “এই অলিন্দ একসময় বাড়ির পূজার প্রধান কেন্দ্র ছিল। পরে হঠাৎ এক ঘটনার পর এটাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঠিক কি ঘটনা ঘটেছিল কেউ খোলাখুলি বলে না।”

অর্ক তালার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে খুলতে হবে।”
অদ্রিজা অবাক হয়ে তাকাল। “তুমি কি পাগল? এটা খোলা মানেই বিপদ ডেকে আনা।”
অর্ক গম্ভীর গলায় বলল, “যদি সত্যিই কোনো অশুভ শক্তি থাকে, তবে সেটা আজও এখানে আছে। আর আমি জানতে চাই, সত্যি কি ঘটেছিল।”

অদ্রিজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের আঁচলের ভাঁজ থেকে একটা ছোট চাবি বের করল। “এটা আমার দিদার কাছে ছিল। একবার কাকতালীয়ভাবে আমি পেয়েছিলাম। তবে আমি কখনও সাহস করিনি ব্যবহার করার।”

অর্ক চাবিটা নিয়ে তালার গায়ে লাগাল। অদ্ভুতভাবে তালাটা খুব সহজেই খুলে গেল। কাঠের দরজাটা হালকা চাপ দিতেই ধীরে ধীরে খুলে গেল, আর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো স্যাঁতসেঁতে গন্ধ।

অলিন্দটা অন্ধকার, দেয়ালে শেওলা জমে গেছে। ভেতরে মৃদু প্রদীপের আলোর মতো ঝলক দেখা যাচ্ছিল, অথচ তারা দুজনই জানত সেখানে কেউ প্রদীপ রাখেনি। মেঝেতে কিছু পুরনো ভাঙাচোরা মূর্তি পড়ে আছে। কোণের দিকে একটি প্রাচীন অট্টালিকা আকৃতির পাথরের খোপ, যার ওপর লাল রঙের দাগ লেগে আছে।

অর্ক মৃদু স্বরে বলল, “এটা রক্তের দাগ মনে হচ্ছে।”
অদ্রিজা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এই অলিন্দেই নাকি সেই ব্রাহ্মণ নিখোঁজ হয়েছিলেন।”

ঠিক তখনই হাওয়ার ঝাপটা এসে দরজা জোরে বন্ধ হয়ে গেল। দুজনেই আঁতকে উঠল। অন্ধকারে তারা একে অপরের হাত চেপে ধরল। আর তার মাঝেই শোনা গেল মৃদু মন্ত্রপাঠ—একটা টানা টানা ধ্বনি, যেন শতাব্দীর পুরোনো সুর ভেসে আসছে।

অর্ক সাহস করে ক্যামেরা বের করে আলো ফেলল। আলো পড়তেই দেখা গেল—খোপটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি। তার হাতে প্রদীপ, চোখ ফাঁকা, ঠোঁট নড়ছে মন্ত্রের তালে।

অদ্রিজা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “এটা সেই ব্রাহ্মণ!”

অর্ক তাকিয়ে দেখল ছায়াটা ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রদীপের আলোতে দেখা গেল তার মুখ স্পষ্ট নয়, বরং এক অদৃশ্য কুয়াশার মতো। তারা দুজনেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মুহূর্তের মধ্যে আলো নিভে গেল। আবার সব অন্ধকার। আর তার সঙ্গে ছায়াটিও মিলিয়ে গেল।

দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল বাইরে থেকে। হাওয়ার দমক এসে দুজনকেই প্রায় ফেলে দিল। তারা দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। বুক ধড়ফড় করছে, গলায় কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না।

অদ্রিজা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তুমি এখন বুঝতে পারছ? এই অলিন্দই হল আসল রহস্যের কেন্দ্র।”
অর্ক শ্বাস নিতে নিতে বলল, “এটা শুধু অলিন্দ নয়, এটা অতীতের অভিশাপের দরজা। আর সেই দরজা আমরা খুলে ফেলেছি।”

দূরে তখন ঢাক বেজে উঠছে। কিন্তু সেই ঢাকের সুরেও অর্ক শুনতে পাচ্ছিল, যেন মিশে আছে আরেকটা ছায়াময় সুর—অতীতের গোপন কণ্ঠস্বর।

পর্ব ৪: মন্ত্রের প্রতিধ্বনি

অলিন্দের দরজাটা যেদিন খুলল, সেদিন থেকেই রায়চৌধুরী বাড়ির আকাশে যেন অদ্ভুত এক অস্থিরতা ভাসছিল। দিনভর পুজোর ব্যস্ততা, অতিথিদের আসা-যাওয়া, ঢাকের গর্জন—সবকিছুই বাহ্যত স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। কিন্তু অর্ক আর অদ্রিজার মনে সেই রাতের ছায়া ঘুরপাক খাচ্ছিল। তারা জানত, দরজার ওপারে যা লুকিয়ে আছে, তা শুধু ইতিহাস নয়—এটা এক অভিশপ্ত সত্য, যা বারবার মাথা তুলে ওঠে।

সন্ধ্যা নামতেই বাড়িটা আবার আলোয় ভরে উঠল। চণ্ডীপাঠের ধ্বনি উঠল, ঢাকের শব্দ যেন আকাশ চিরে দিল। অর্ক ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েই অনুভব করছিল—এই সুরের আড়ালে আরেকটা অচেনা শব্দ লুকিয়ে আছে। যেন ঢাক থেমে গেলে সেই সুরটা আরও স্পষ্ট শোনা যাবে।

অদ্রিজা এসে পাশে দাঁড়াল। তার চোখে ক্লান্তি, ঠোঁটে আতঙ্ক। “আমার মনে হচ্ছে, অলিন্দ খোলার পর থেকে বাড়িটা অন্যরকম হয়ে গেছে। তুমি কি সেটা টের পাচ্ছ?”
অর্ক মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। যেন প্রতিটি ঢাকের তালে মিশে যাচ্ছে অদৃশ্য একটা প্রতিধ্বনি।”

সন্ধ্যার আরতি শেষ হলে ভিড় ধীরে ধীরে ছত্রভঙ্গ হলো। উঠোন ফাঁকা হয়ে এলে অর্ক সিদ্ধান্ত নিল আজ রাতে অলিন্দের ভেতরে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটাবে। অদ্রিজা প্রথমে বাধা দিলেও শেষে রাজি হলো, কারণ তার নিজের মনেও প্রশ্ন জমে আছে।

রাত যখন গভীর, তারা নিঃশব্দে অলিন্দের কাছে ফিরে গেল। চারপাশ নিঝুম, শুধু মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক। দরজার ভেতরে ঢুকতেই সেই স্যাঁতসেঁতে গন্ধ আবার নাকে লাগল। অন্ধকার ভেদ করে তারা মোবাইলের আলো ফেলল।

দেয়ালের ওপর ধুলো জমে আছে, তবু খেয়াল করল—কিছু দাগ যেন একদম নতুন। মনে হচ্ছে কেউ সম্প্রতি এখানে হাত দিয়েছে। মেঝের ওপরও দেখা গেল পায়ের ছাপ, যেন ভিজে পায়ের ছাপ শুকিয়ে গিয়ে দাগ ফেলে রেখেছে।

অর্ক হঠাৎ থমকে গেল। অলিন্দের গভীর থেকে ভেসে আসছে মৃদু মন্ত্রোচ্চারণ। গলা শুকিয়ে এলো তার। অদ্রিজা ফিসফিস করে বলল, “শোনো, এটাই সেই প্রতিধ্বনি।”

শব্দটা ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল—“জয় মা দুর্গা… জয় মা দুর্গা…”। কিন্তু সেই জপে ভক্তির ছোঁয়া নেই, বরং অদ্ভুত এক হাহাকার। গলা যেন বহু বছরের শূন্যতা থেকে উঠে আসছে।

হঠাৎই প্রদীপের মতো ক্ষীণ আলো জ্বলে উঠল খোপটার সামনে। তারা স্পষ্ট দেখল—সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়া। কালো ধুতির মতো পোশাক, কাঁধে গামছা, ঠোঁটে মন্ত্রের আওয়াজ। তার মুখ অস্পষ্ট, কিন্তু চোখ যেন জ্বলছে অগ্নিশিখার মতো।

অর্ক এগোতে চাইছিল, কিন্তু অদ্রিজা তার হাত চেপে ধরল। “যেও না!”

কিন্তু তখনই ছায়াটা হঠাৎ থেমে গেল। খোপের ভেতরে হাত বাড়িয়ে সে কিছু একটা রাখল। তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

তারা দৌড়ে গিয়ে দেখল খোপের ভেতরে একটা পুরনো তামার পাত্র রাখা। তার ভেতরে শুকিয়ে যাওয়া লালচে দাগ—যেন রক্ত। অদ্রিজা কেঁপে উঠল। “এটা… এটা কি তবে বলির পাত্র?”

অর্ক কিছু বলল না। শুধু তার মনে হচ্ছিল—এই বাড়ির অতীত আসলে দেবীর পূজার আড়ালে এক ভয়ঙ্কর রক্তঋণ লুকিয়ে রেখেছে। আর সেই ঋণের মন্ত্রই আজও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

ঠিক তখনই বাইরে থেকে ঢাকের শব্দ থেমে গেল। নিস্তব্ধতার মধ্যে আবার শোনা গেল মন্ত্রোচ্চারণ, এবার অনেক জোরে। আর সেই সঙ্গে হঠাৎ দরজাটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল।

অদ্রিজা আতঙ্কে অর্ককে আঁকড়ে ধরল। তারা দুজনই ঘোর অন্ধকারে বন্দি হয়ে গেল। শব্দটা যেন চারপাশ থেকে আসছিল, একবার বামদিক থেকে, একবার ডানদিক থেকে। প্রতিটি প্রতিধ্বনি যেন তাদের মস্তিষ্কের ভেতরে গিয়ে বাজছিল।

অর্ক ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বালাল। মুহূর্তের জন্য আলো ছড়িয়ে পড়তেই দেখা গেল—দেয়ালে আঁকা পুরনো চিত্র ভেসে উঠেছে। দেবীর রূপ, কিন্তু হাতে অস্ত্রের বদলে যেন রক্তমাখা কুড়ুল। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে একজন ব্রাহ্মণ।

আলো নিভে যেতেই আবার চারদিক অন্ধকার। মন্ত্রের সুর ধীরে ধীরে থেমে এলো, শুধু বাতাসে রইল শিউলি ফুলের গন্ধ আর শীতলতা।

অবশেষে দরজাটা হাওয়ার ঝাপটায় খুলে গেল। তারা বাইরে বেরিয়ে এলো হাঁপাতে হাঁপাতে। অদ্রিজার চোখ ভয়ে বিস্ফারিত, অর্কের গলায় কাঁপুনি।

“এটা কেবল অলিন্দ নয়,” অর্ক ধীরে বলল। “এটা একটা মন্ত্রবন্দি কক্ষ। কেউ একসময় এখানে পাপ ঢেকে রাখার জন্য মন্ত্র উচ্চারণ করেছিল। কিন্তু সেই মন্ত্রই এখন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে।”

অদ্রিজা স্তব্ধ হয়ে রইল। তার মনে পড়ল দিদিমার বলা কথাগুলো—“অষ্টমীর রাত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। দেবী তখন শক্তিশালী, কিন্তু মানুষের পাপও তখন মাথা তোলে।”

আকাশে চাঁদ উঠেছে। বাড়ির উঠোন আলোয় ভরে গেছে, কিন্তু অর্ক জানত—এই আলো আসলে অস্থায়ী। ছায়াগুলো আবার ফিরে আসবে, মন্ত্রগুলো আবার বাজবে। কারণ রায়চৌধুরী বাড়ির ইতিহাসে যে অভিশাপ রয়ে গেছে, তা সহজে মুছে যাবে না।

পর্ব ৫: রক্তরঙা সিঁদুর

অলিন্দে সেই রাতের মন্ত্রধ্বনি যেন অর্ক ও অদ্রিজার মন থেকে কোনওভাবেই মুছে যাচ্ছিল না। ভোর হতেই বাড়ির আঙিনায় ঢাক আবার বেজে উঠল, নারীরা অঞ্জলি দিতে ঠাকুরদালানে ভিড় জমালেন, ছেলেমেয়েরা খিলখিল করে হাসল। চারদিকে যেন উৎসবের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল, অথচ দুজনের মনে চাপা ভয় গেঁথে রইল।

অর্ক বারবার ক্যামেরা হাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল, কিন্তু ছবি তোলার মধ্যেই তার মনে হচ্ছিল যেন কারও চোখ তাকে লক্ষ্য করছে। প্রতিটি ক্লিকে, প্রতিটি শাটারের আওয়াজে, প্যান্ডেলের ভিতরকার আলো-ছায়ার খেলায় সে খুঁজে ফিরছিল সেই অদৃশ্য উপস্থিতিকে।

সকালবেলায় অদ্রিজা তাকে ডাকল। সিঁদুরকুটিরের দেওয়ালে ভিড় জমেছে। অর্ক ছুটে গেল। কাছে গিয়ে দেখল—দেওয়ালে লালচে দাগ, যেন হাতের ছাপ। পুরু সিঁদুর মেখে কেউ হাত রেখে গেছে সেখানে। দাগটা অদ্ভুতভাবে টাটকা, যেন কয়েক মুহূর্ত আগেই কেউ রেখে গেছে।

“এটা কে করল?”—অর্ক প্রশ্ন করল।
বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা ছুটে এলেন। একজন ফিসফিস করে বললেন, “শিশুরা হয়তো মজা করেছে।”
অদ্রিজা তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করল, “না, এটা কোনও শিশু করতে পারে না। দাগগুলো একেবারে সমান, শক্ত করে চাপা হাতের ছাপ।”

অর্ক ক্যামেরা তুলতেই একজন বৃদ্ধা সামনে এসে বাধা দিলেন। “ছবি তুলবেন না। এসব অশুভ জিনিস ছড়ানো উচিত নয়।”
অর্ক কিছু না বলে ক্যামেরা নামিয়ে রাখল। কিন্তু চোখের ভেতর তীক্ষ্ণ সন্দেহ জমে রইল।

মধ্যাহ্নভোজনের পর ভিড় কিছুটা কমল। অর্ক অদ্রিজাকে নিয়ে সেই দেওয়ালের কাছে আবার গেল। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল, হাতের ছাপগুলো নেই। কেউ সিঁদুর ঘষে ঘষে মুছে দিয়েছে। দেওয়ালে হালকা গোলাপি ছোপ রয়ে গেছে বটে, কিন্তু মূল দাগ অদৃশ্য।

অর্ক বলল, “এভাবে মুছে দেওয়া মানে ইচ্ছে করে প্রমাণ লুকোনো। কে যেন চাইছে না, এই রহস্য সামনে আসুক।”
অদ্রিজা মৃদু স্বরে বলল, “আমাদের বাড়িতে বহু পুরোনো প্রথা আছে। সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা সহজ নয়। অনেকেই ভয় পায়।”

অর্ক হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলল, “ভয়ই তো আসল অস্ত্র। যার কারণে পাপ চাপা পড়ে থাকে। কিন্তু আমি জানবই—এই রক্তরঙা সিঁদুরের আড়ালে কী লুকিয়ে আছে।”

সন্ধ্যায় আবার আরতির প্রস্তুতি চলছিল। বাড়ি ভরে উঠেছে আলোর ঝলকানিতে, কিন্তু অর্কের মনে আলো নয়, বরং অন্ধকারই ঘনীভূত হচ্ছিল।

আরতির সময় আবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। দেবীর সামনে অঞ্জলি দেওয়া শেষ হতেই বাতাসে এক অচেনা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—সিঁদুরের সঙ্গে যেন রক্তের গন্ধ মিশে গেছে। অর্ক শিউরে উঠল। তার চোখে ভেসে উঠল সেই দেওয়ালের হাতের ছাপ।

অদ্রিজা ফিসফিস করে বলল, “শুধু তুমি নয়, আমিও টের পাচ্ছি।”
অর্ক হঠাৎ চারপাশে তাকিয়ে দেখল—ভিড়ের ভেতরে এক নারী দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক সেই লাল শাড়ি পরা। তার ঠোঁটে হাসি, কিন্তু চোখে অদ্ভুত শূন্যতা। অর্ক ক্যামেরা তুলতে গেল, কিন্তু ফ্রেমে কিছু ধরা পড়ল না। নারীটা যেন সবার চোখ এড়িয়ে মিলিয়ে গেল।

রাত বাড়তে থাকল। বাড়ির এক প্রৌঢ় সদস্য অর্ককে ডেকে নিলেন। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “তুমি বহিরাগত। কিন্তু মনে রেখো, রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো শুধু আনন্দ নয়। এখানে একটা অমোঘ শপথ জড়িয়ে আছে। কেউ যদি সেই শপথ ভাঙে, তার পরিণতি ভয়ঙ্কর।”
অর্ক জিজ্ঞাসা করল, “কি শপথ?”
বৃদ্ধা বললেন, “দেবীর নামে রক্তদানের শপথ।”

অর্ক স্তব্ধ হয়ে গেল। “রক্তদান মানে বলি?”
প্রৌঢ় নিঃশব্দে সরে গেলেন, আর কিছু বললেন না।

মধ্যরাতে অর্ক আবার সিঁদুরকুটিরের কাছে গেল। চাঁদের আলো পড়েছে দেওয়ালে। অবিশ্বাস্য দৃশ্য—আবার হাতের ছাপ দেখা যাচ্ছে, এবার আরও স্পষ্ট, আরও তাজা। যেন কোনও অদৃশ্য হাত রক্তমাখা সিঁদুরে লেখা রেখেছে।

ছাপগুলোর নিচে হঠাৎই এক অদ্ভুত অক্ষর ভেসে উঠল। প্রাচীন লিপি, অর্ক বুঝতে পারল না। তবে মনে হচ্ছিল, এর মানে কোনও সতর্কবার্তা।

অদ্রিজা তার পাশে এসে দাঁড়াল। তার কণ্ঠ কাঁপছিল, “এটা সেই ব্রাহ্মণের ছাপ। দিদিমা একবার বলেছিলেন, তাঁর আত্মা মুক্তি পায়নি। প্রতিটি অষ্টমীর রাতে সে ফিরে আসে। আর সিঁদুরে হাত রেখে তার অস্তিত্ব জানান দেয়।”

অর্ক তাকিয়ে বলল, “তাহলে এর মানে, দেবীর পুজো আসলে রক্তে কলঙ্কিত।”

হঠাৎই চারপাশে বাতাস ঘন হয়ে উঠল। দেওয়ালের হাতের ছাপগুলো যেন নড়তে লাগল, একে একে মিলিয়ে গেল। আবার দেওয়াল ফাঁকা।

অর্ক ক্যামেরা তোলার চেষ্টা করলেও কিছু ধরতে পারল না। কেবল তার বুকের ভেতর দম বন্ধ হওয়া চাপ অনুভূত হচ্ছিল।

অদ্রিজা কাঁপা গলায় বলল, “অষ্টমীর রাত এখনও শেষ হয়নি। যা আসছে, তার জন্য আমরা প্রস্তুত নই।”

অর্ক গভীর শ্বাস নিল। সে বুঝল—রক্তরঙা সিঁদুর কোনও কাকতালীয় দাগ নয়। এটা অতীতের অভিশাপের ছাপ। আর সেই অভিশাপই ধীরে ধীরে ফিরে আসছে।

দূরে তখন ঢাক বেজে উঠল অদ্ভুত সুরে। কিন্তু অর্কের কানে সেটা নয়, বরং ভেসে আসছিল এক মৃদু ফিসফিসানি—
“শপথ ভেঙেছ তোমরা… শপথ ভেঙেছ…”

পর্ব ৬: অতীতের গোপন শপথ

অষ্টমীর সেই রাত শেষ হলেও অর্ক ও অদ্রিজার মনে ভয়ের প্রতিধ্বনি থেকে গেল। রক্তরঙা সিঁদুরের হাতের ছাপ, অলিন্দে প্রতিধ্বনিত মন্ত্রধ্বনি, আর লাল শাড়ি পরা নারীর অদ্ভুত উপস্থিতি—সবকিছুই যেন তাদের মনে গভীর ছায়া ফেলেছিল। ভোরবেলা আলো ফুটতেই মনে হচ্ছিল চারপাশ আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, কিন্তু তাদের চোখে সেই স্বাভাবিকতা ছিল না।

অর্ক সকালেই সিদ্ধান্ত নিল—এখন ইতিহাস খোঁজার সময়। রহস্যকে শুধু অভিজ্ঞতার স্তরে না রেখে সে প্রমাণ চাইছিল। সাংবাদিকের নেশা তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল সত্যের কেন্দ্রে।

সে বাড়ির পুরনো গ্রন্থাগারে গেল। বিশাল ঘর, সিলিং থেকে মাকড়সার জাল ঝুলছে, কাঠের তাকগুলোতে সারি সারি পুরনো বই আর পুঁথি। ধুলো জমে আছে প্রতিটি পাতায়, তবু সেই ধুলোর গন্ধেই যেন ইতিহাস বেঁচে আছে। অদ্রিজা তার সঙ্গে এল।

অর্ক পুঁথি খুলে একের পর এক পাতা উল্টাতে লাগল। হঠাৎই একটি মোটা পুঁথির ভেতর থেকে হলুদ হয়ে যাওয়া এক কাগজ গড়িয়ে পড়ল। তাতে লাল কালি দিয়ে কিছু লেখা। অর্ক তা পড়তে শুরু করল—

“অষ্টমীর নিশি। দেবীকে সন্তুষ্ট করতে রক্ত শপথ দেওয়া হলো। শপথ হলো—প্রতি প্রজন্মে রায়চৌধুরী বংশ থেকে একজন দেবীর সামনে রক্ত দেবে। এই রক্তেই পূজা সম্পূর্ণ হবে। শপথ ভঙ্গ হলে দেবী ক্রুদ্ধ হবেন, আর বংশ ধ্বংসের অভিশাপ নেমে আসবে।”

অদ্রিজা শিউরে উঠল। “তাহলে এটাই সেই অভিশপ্ত শপথ!”

অর্কের চোখ তীক্ষ্ণ হলো। “এর মানে, কোনও এক সময়ে এই শপথ ভঙ্গ হয়েছে। তাই ব্রাহ্মণের মৃত্যু, তাই সিঁদুরে হাতের ছাপ, তাই প্রতিধ্বনি।”

অদ্রিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দিদিমা বলতেন, এক প্রজন্মে শপথ মানা হয়নি। আমার ঠাকুরদার সময়ে। তখন থেকেই পুজোর সময় এসব ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে শুরু করে।”

অর্ক কাগজটা হাতে নিয়ে গভীরভাবে লক্ষ্য করছিল। সেখানে আরও কয়েকটি শব্দ লেখা ছিল—“প্রায়শ্চিত্ত ব্যতীত মুক্তি নাই।”

“প্রায়শ্চিত্ত!” অর্ক বিড়বিড় করল। “মানে, যদি সেই রক্তঋণ মেটানো যায়, তবে অভিশাপ কেটে যেতে পারে।”

অদ্রিজার চোখ ভিজে উঠল। “কিন্তু রক্তঋণ কীভাবে মেটানো যায়? কি প্রায়শ্চিত্ত করলে দেবী সন্তুষ্ট হবেন?”

অর্ক উত্তর খুঁজে পেল না। তার মাথায় শুধু ঘুরছিল—এক পরিবার কেন দেবীর নামে এমন অমানবিক শপথ করেছিল? মানব বলির মতো এক নিষ্ঠুর প্রথা কীভাবে পূজোর মধ্যে ঢুকে পড়েছিল?

সন্ধ্যায় আবার আরতি শুরু হলো। ঠাকুরদালান আলোয় ঝলমল করছে, মানুষ গাইছে, ঢাকের আওয়াজ উঠছে। কিন্তু অর্কের কানে সেই আওয়াজ আর স্রেফ উৎসব নয়। প্রতিটি ঢাকের তালে যেন লুকিয়ে আছে শপথ ভঙ্গের কান্না।

ঠিক তখনই সে লক্ষ্য করল—মণ্ডপের এক কোণে লাল শাড়ি পরা সেই নারী দাঁড়িয়ে আছে। এবার তিনি আরও স্পষ্ট। হাতে শঙ্খ, ঠোঁটে ফিসফিসানি। চারপাশের কেউ যেন তাকে টেরই পাচ্ছে না। অর্ক ক্যামেরা তুলল, ফ্ল্যাশ করল। কিন্তু ছবিতে কিছু ধরা পড়ল না।

অদ্রিজা তার পাশে এসে কাঁপা গলায় বলল, “ওই নারী আসলে সেই অভিশপ্ত শপথের প্রতীক। হয়তো তিনি সেই বলি দেওয়া আত্মা, হয়তো দেবীর দূত। কিন্তু তিনি প্রতি বছর ফিরে আসেন—আমাদের মনে করিয়ে দিতে, আমরা শপথ ভেঙেছি।”

মধ্যরাতে অলিন্দে আবার শব্দ উঠল। এবার মন্ত্রধ্বনি নয়, বরং যেন এক দীর্ঘশ্বাস। “শপথ ভেঙেছ… শপথ ভেঙেছ…”

অর্ক ও অদ্রিজা সেখানে পৌঁছল। অন্ধকারে মৃদু আলো জ্বলছিল। খোপটার সামনে আবার সেই তামার পাত্র রাখা। কিন্তু এবার পাত্রটা ভরে আছে টাটকা লাল তরলে।

অর্ক শিউরে উঠল। “এটা রক্ত!”

অদ্রিজা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তাহলে কেউ আজও এই শপথ মানছে! কোনও গোপন আচার চলছে।”

অর্ক সিদ্ধান্ত নিল—এখন আর পিছিয়ে আসা যাবে না। “আমাকে জানতে হবে, কে করছে এটা।”

অদ্রিজা তার হাত চেপে ধরল। “সাবধান থেকো। এই বাড়ির ভেতরে সবাই বিশ্বাস করে না, কিন্তু কেউ কেউ এখনও সেই শপথে বিশ্বাসী। তারা যদি টের পায়, আমরা বড় বিপদে পড়ব।”

অর্ক চুপচাপ মাথা নাড়ল। কিন্তু তার চোখে জেদ। এই রহস্য শুধু সাংবাদিকতার গল্প নয়, তার নিজের জীবনেরও এক ভয়ঙ্কর মোড় হয়ে উঠেছে।

রাতের শেষে আবার ঢাক বেজে উঠল, কিন্তু এবার সেই ঢাকের সুর অর্কের কানে শোনাল যেন যুদ্ধের ঢাক। যেন শতাব্দী পুরোনো রক্তঋণ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

আকাশে চাঁদ তখন ডুবে যাচ্ছে, ভোরের আলো ফুটছে। তবু অর্ক ও অদ্রিজা জানত—তাদের জীবনে রাত এখনও শেষ হয়নি। কারণ তারা এখন খুঁজে পেয়েছে অতীতের সেই গোপন শপথ, আর সেই শপথই আসন্ন ভয়ের পথ খুলে দিয়েছে।

পর্ব ৭: অষ্টমীর নিশি

অষ্টমীর দিন যত রাতের দিকে এগোতে লাগল, রায়চৌধুরী বাড়ির পরিবেশ ততই অদ্ভুত হয়ে উঠছিল। বাইরে উৎসবের উল্লাস—ঢাকের গর্জন, ধুনুচি নাচ, শঙ্খধ্বনিতে ভরে থাকা উঠোন। কিন্তু তার ভেতরেই যেন জমছিল অদৃশ্য অন্ধকার।

অর্ক ও অদ্রিজা দুজনেই জানত—আজকের রাত আলাদা। শপথের ইতিহাস, অলিন্দে রক্তমাখা পাত্র, সিঁদুরের হাতের ছাপ—সবকিছুর পরিণতি যেন আজকের রাতেই মিলবে।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় কমে এল। উঠোন ফাঁকা হতে শুরু করল। শুধু দেবীর সামনে প্রদীপ জ্বলছিল ক্ষীণ আলোয়, আর ঢাকি দু’জন শেষ ঢাক বাজিয়ে সরে যাচ্ছিল। বাতাসে শিউলির গন্ধ, তাতে মিশে অদ্ভুত এক শীতলতা।

অর্ক ফিসফিস করে বলল, “এখনই সময়। আজ রাতেই সত্যি প্রকাশ পাবে।”
অদ্রিজা তার দিকে তাকিয়ে ধীরে মাথা নাড়ল। “কিন্তু আমরা কি প্রস্তুত?”
অর্কের ঠোঁটে তীক্ষ্ণ হাসি ফুটল। “প্রস্তুতির সময় নেই। রহস্য নিজের মুখ খুলতে চলেছে।”

মধ্যরাত পেরোতেই চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এল। হঠাৎই মণ্ডপের প্রদীপগুলো কেঁপে উঠল। বাতাসে এক অদৃশ্য স্রোত বয়ে গেল। অর্ক ও অদ্রিজা নিঃশব্দে মণ্ডপের দিকে এগোল।

তখনই তারা দেখল—দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই লাল শাড়ি পরা নারী। এতদিন যাকে তারা ছায়ার মতো দেখেছে, আজ তিনি স্পষ্ট। গায়ে লাল বেনারসি, খোপায় সাদা ফুল, ঠোঁটে মৃদু হাসি। তার হাতে শঙ্খ, আর চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি।

অদ্রিজা কেঁপে উঠল। “ও-ই তো!”
অর্ক সাহস সঞ্চয় করে ক্যামেরা তুলল। ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠল। কিন্তু ছবিতে কিছু ধরা পড়ল না। ক্যামেরার ডিসপ্লে খালি।

নারী ধীরে ধীরে মাথা তুলল। তার ঠোঁট নড়ল—“শপথ… শপথ ভেঙেছ…”

শব্দটা যেন পুরো মণ্ডপে প্রতিধ্বনিত হলো। প্রদীপগুলো একসঙ্গে নিভে গেল। অন্ধকারে কেবল দেবীর চোখদুটো যেন জ্বলতে লাগল।

অর্কের শরীর অবশ হয়ে এলো। মনে হচ্ছিল কেউ তাকে টেনে নিচ্ছে। অদ্রিজা চিৎকার করে উঠল, “না! দেবী, ক্ষমা করুন!”

অচেনা নারী ধীরে ধীরে অগ্রসর হলেন। তার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল না, অথচ মাটির ধুলো উড়ে উঠছিল। তিনি দেবীর সামনে দাঁড়ালেন, শঙ্খ বাজালেন। শঙ্খের সুর ছিল ভয়ানক, যেন কান ফাটিয়ে দিচ্ছে।

অর্ক দেখতে পেল—দেবীর মূর্তির সামনে রক্তের মতো লাল তরল গড়িয়ে পড়ছে। যেন কেউ অদৃশ্যভাবে বলি দিয়েছে।

অদ্রিজা চোখ বন্ধ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার ঠোঁট থেকে বেরোলো একটিমাত্র শব্দ—“প্রায়শ্চিত্ত…”

অর্ক তাকে আঁকড়ে ধরল। “কি প্রায়শ্চিত্ত? বলো!”
কিন্তু অদ্রিজা অচেতন হয়ে গেল।

নারী হঠাৎ অর্কের দিকে তাকালেন। তার চোখে যেন শতবর্ষের দাহ। তিনি হাত তুললেন, আর এক ঝাপটা বাতাস অর্ককে ফেলে দিল।

অর্ক শ্বাস নিতে লড়াই করছিল। সে অনুভব করল, তার শরীরের ওপর ভারি কোনও ছায়া নেমে এসেছে। যেন অতীতের সমস্ত অভিশাপ তার বুক চেপে ধরেছে।

হঠাৎই ঢাক বেজে উঠল। কিন্তু ঢাকিরা তো নেই! তবুও ঢাকের আওয়াজ উঠছে, ভয়ঙ্কর ছন্দে, যেন যুদ্ধের সংকেত।

নারী মণ্ডপ থেকে সরে গেলেন। তিনি অলিন্দের দিকে এগোলেন। অর্ক দুর্বল শরীরে উঠে দাঁড়াল। তাকে অনুসরণ করতেই হবে।

অলিন্দের ভেতর মৃদু আলো জ্বলছিল। নারী খোপটার সামনে দাঁড়ালেন। তিনি হাত বাড়িয়ে রক্তমাখা পাত্র তুলে নিলেন। ঠোঁটে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন।

অর্ক দরজার ফাঁক থেকে তাকিয়ে রইল। তার কানে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল—“রক্ত দাও… রক্ত দাও… শপথ ভাঙা মেটাও…”

হঠাৎই নারী ঘুরে তাকালেন। তার চোখ সরাসরি অর্কের চোখে এসে গেঁথে গেল। ঠোঁট থেকে বেরোল শব্দ—“তুমি সাক্ষী।”

অর্ক হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “না! আমি সাক্ষী নই, আমি সত্যের সন্ধানী। তোমরা যদি পাপ ঢাকতে চাও, আমি উন্মোচন করব!”

কিন্তু মুহূর্তেই আলো নিভে গেল। অলিন্দ ডুবে গেল অন্ধকারে। শুধু শোনা গেল নারীর করুণ হাসি।

অর্ক দৌড়ে বাইরে এল। অদ্রিজা তখন ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে পাচ্ছিল। তার চোখে জল, ঠোঁটে কাঁপুনি।
সে বলল, “আমরা শপথ ভেঙেছি, তাই দেবী ক্রুদ্ধ। কিন্তু এখনও সময় আছে। যদি আমরা প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি, হয়তো মুক্তি মিলবে।”

অর্ক হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “প্রায়শ্চিত্তের উপায় কী?”
অদ্রিজা চোখ মুছে বলল, “দিদিমা বলতেন—প্রায়শ্চিত্ত মানে রক্ত নয়, সত্য প্রকাশ। যতদিন আমরা পাপ চাপা দেব, ততদিন অভিশাপ থাকবে। সত্য উন্মোচনই মুক্তি।”

অর্ক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “তাহলে কাল ভোরের আলোয় আমি সব প্রকাশ করব। এই বাড়ির ইতিহাস, শপথ, পাপ—সব।”

দূরে তখন আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। কিন্তু মণ্ডপের ভিতর এখনও অন্ধকার ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই কণ্ঠস্বর—
“শপথ ভাঙেছ… শপথ ভাঙেছ…”

পর্ব ৮: পুজোর বলি

অষ্টমীর রাতের আতঙ্কে ভোর ফোটার পরও অর্ক ও অদ্রিজার বুকের ধুকপুকানি থামছিল না। উৎসবের বাড়ির লোকেরা তখনও হাসি-আড্ডায় মগ্ন, সকালবেলার অঞ্জলি দিতে ব্যস্ত। চারদিকে ধূপকাঠির গন্ধ, ফুলের সুবাস, দেবীর সামনে শঙ্খধ্বনি—সবকিছুই যেন উৎসবের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনছিল। অথচ এই স্বাভাবিকতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল রক্তমাখা ইতিহাসের অশুভ ছায়া।

অর্ক জানত, সে যা দেখেছে তা কেবল কল্পনা নয়। লাল শাড়ির নারী, রক্তভরা পাত্র, মন্ত্রোচ্চারণ—সবই বাস্তব, এবং এর শিকড় লুকিয়ে আছে বাড়ির অতীতের গভীরে। সে সিদ্ধান্ত নিল আজ আরও গভীরে খুঁজতে হবে।

দিনের বেলায় অর্ক এক বৃদ্ধ কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলল। তাঁর চোখে ভয়, মুখে দ্বিধা। অনেক অনুরোধের পর তিনি ফিসফিস করে বললেন, “বাবু, এই বাড়ির দুর্গাপুজোতে আগে বলি দেওয়া হতো। অনেক বছর আগে সেটা থেমে গেছে বটে, কিন্তু অভিশাপ আজও যায়নি। এক সময়ে আমাদের জমিদার মশাই নাকি গোপনে মানববলির চেষ্টা করেছিলেন।”

অর্ক কেঁপে উঠল। “মানববলি!”
বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ বাবু। তখনকার দিনে অনেক বাড়িতেই পশুবলি চলত। কিন্তু এখানে এক রাতে এক তরুণ ব্রাহ্মণ নিখোঁজ হন। কেউ বলেন দেবীর ক্রোধে তিনি অদৃশ্য, কেউ বলেন, জমিদারের লোভে তাঁকে বলি দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকেই এই বাড়ির দুর্গাপুজো রক্তের দাগ বয়ে বেড়াচ্ছে।”

অর্ক এই তথ্য লিখে নিল। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন ইতিহাসের স্তর ছাড়িয়ে রক্তমাখা সত্যের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

সন্ধ্যা নামতেই বাড়িতে আবার আলোর ঝলকানি। মহাঅষ্টমীর কুমারী পূজো শেষ হয়েছে, এখন সন্ধ্যার আরতির পালা। উঠোন ভরে উঠেছে মানুষের ভিড়ে। ধুনুচির ধোঁয়ায় আকাশ সাদা কুয়াশার মতো। ঢাকের তালে তালে নাচছে মানুষ।

কিন্তু হঠাৎই অর্কের চোখে পড়ল—দেবীর সামনে রাখা প্রসাদে লাল তরল গড়িয়ে পড়ছে। প্রথমে মনে হলো সিঁদুর, কিন্তু গন্ধে বোঝা গেল—এটা রক্ত।

অর্ক বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। পাশে দাঁড়ানো অদ্রিজা হাত শক্ত করে ধরে ফিসফিস করে বলল, “দেখছ? আবার বলি হয়েছে!”

চারপাশের লোকেরা কিছু টেরই পেল না। তারা ভক্তিভরে প্রণাম করছে। কিন্তু অর্ক ও অদ্রিজার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল—কেউ গোপনে বলির আচার চালাচ্ছে।

আরতির শেষে ভিড় কমতেই তারা নিঃশব্দে মণ্ডপে ঢুকল। মেঝেতে রক্তের দাগ স্পষ্ট, দেবীর পায়ের কাছে জমে আছে লাল তরল। অর্ক ক্যামেরা তুলতে গিয়েও থেমে গেল। মনে হচ্ছিল দেবীর চোখদুটি আগুনের মতো জ্বলছে, যেন নিষিদ্ধ সত্য ধরা পড়লে তিনি আরও ক্রুদ্ধ হবেন।

ঠিক তখনই পিছন থেকে এক গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো। “তোমরা এখানে কি করছ?”

অর্ক ঘুরে দেখল—বাড়ির প্রবীণ কর্তা রণদেব রায়চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখ কঠোর, কণ্ঠে রাগ।
অর্ক সাহস করে বলল, “আমি সাংবাদিক। আমি সত্যটা জানতে চাই। এখানে এখনও বলি দেওয়া হচ্ছে, তাই তো?”

রণদেব মুহূর্তের জন্য চুপ করে থাকলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “তুমি যা দেখেছ, সেটা সবাইকে জানানো যাবে না। আমাদের বংশের ঐতিহ্য আছে। দেবীর কাছে রক্ত ছাড়া পুজো অসম্পূর্ণ। এটা আমাদের শপথ।”

অদ্রিজা কেঁপে উঠল। “কাকু! তবে কি এখনও মানববলি হয়?”
রণদেব রাগে গর্জে উঠলেন, “চুপ! অনেক কিছুই তোমার জানা দরকার নেই। শপথ ভাঙা যাবে না। দেবীকে সন্তুষ্ট করতে যা প্রয়োজন তাই করা হবে।”

অর্ক প্রতিবাদ করল, “এটা অন্যায়। দেবী কখনও মানবরক্ত চান না। এটা কুসংস্কার।”
রণদেব কটমট করে তাকালেন। “তুমি বহিরাগত। আমাদের প্রথার বিচার করার অধিকার তোমার নেই।”

এই বলে তিনি সরে গেলেন। কিন্তু তাঁর চোখের দৃষ্টি অর্ককে কাঁপিয়ে দিল।

রাত গভীর হলো। উঠোন ফাঁকা, শুধু মৃদু বাতাসে প্রদীপ নড়ছিল। অর্ক ও অদ্রিজা মণ্ডপের আড়ালে লুকিয়ে থাকল। তারা অপেক্ষা করছিল—দেখবে কে গোপনে এই বলি দেয়।

হঠাৎই পায়ের শব্দ। কেউ ধীরে ধীরে মণ্ডপে ঢুকল। হাতে একটা ছোট থালা, তাতে লালচে তরল ভর্তি। অর্ক চোখ কুঁচকে তাকাল—এ রণদেব নন, অন্য কেউ। মুখ ছায়ায় ঢাকা, বোঝা গেল না কে।

সে দেবীর সামনে গিয়ে মন্ত্রপাঠ শুরু করল। ঠোঁটে অদ্ভুত সুর, আর থালার তরল দেবীর পায়ে ঢেলে দিল। অর্কের মনে হলো—এ যেন রক্ত।

অদ্রিজা ভয়ে কাঁপছিল। ফিসফিস করে বলল, “এটাই সেই পুজোর বলি।”

ঠিক তখনই মণ্ডপের প্রদীপগুলো একসঙ্গে জ্বলে উঠল। আলোয় মুহূর্তে ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হলো। অর্ক ক্যামেরা তুলল। কিন্তু চোখে যা দেখল, ক্যামেরায় কিছু ধরা পড়ল না।

আলো নিভে গেলে ছায়াটি মিলিয়ে গেল। মণ্ডপে শুধু রইল রক্তের দাগ আর ভয়ঙ্কর শীতলতা।

অর্ক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “এখন আমি নিশ্চিত। এই বাড়িতে এখনও বলি হয়, আর সেটা ঢাকতে সবাই মিথ্যে বলে।”
অদ্রিজা তার হাত শক্ত করে ধরল। “কিন্তু আমরা যদি সত্য প্রকাশ করি, আমাদের কেউই বাঁচব না। বংশের ঐতিহ্য ভাঙার শাস্তি ভয়ঙ্কর।”

অর্ক দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “সত্যই মুক্তি দেবে। দেবীর নামে পাপ চাপা দেওয়া চলতে পারে না।”

দূরে তখন ঢাক আবার বেজে উঠল। কিন্তু সেই ঢাকের তালে যেন শোনা গেল অদৃশ্য কণ্ঠস্বর—
“রক্ত দাও… রক্ত দাও…”

অর্ক বুঝল—পুজোর বলির অন্ধকার ইতিহাস শুধু অতীতে নয়, বর্তমানেও বেঁচে আছে। আর এই সত্যই তাকে আরও গভীর বিপদের দিকে নিয়ে যাবে।

পর্ব ৯: মৃতের প্রত্যাবর্তন

রাত যত গভীর হচ্ছিল, রায়চৌধুরী বাড়ির উঠোনে শিউলি ফুলের গন্ধের সঙ্গে যেন অচেনা এক শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছিল। দেবীর সামনে প্রদীপ জ্বলছে, কিন্তু সেই আলোও যেন কালো ছায়ার ভেতরে হারিয়ে যাচ্ছিল। অর্ক ও অদ্রিজা দুজনেই বুঝেছিল—এখন আর পিছু হটার উপায় নেই। সত্য তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আর সেই সত্য রক্তমাখা।

মণ্ডপে আগের রাতের রক্তের দাগ শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে। অর্ক ক্যামেরা তুলতে গিয়েও আবার থেমে গেল। তার মনে হচ্ছিল, শুধু ছবি নয়, তাকে এখন ইতিহাসকে ধরে রাখতে হবে। কিন্তু ইতিহাস শুধু লেখা বা ছবির ভেতরে নেই—সে যেন আজ উঠে এসেছে মাংস-মজ্জায়।

অদ্রিজা হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, “তুমি শুনছ?”
অর্ক কান খাড়া করল। সত্যিই, ভেসে আসছে মৃদু মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ। গলা ভাঙা, ক্লান্ত, অথচ স্পষ্ট। যেন কোনও মৃত মানুষ মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছে কথা বলার জন্য।

তারা দুজন নিঃশব্দে অলিন্দের দিকে এগোল। দরজাটা অল্প খোলা। ভেতরে ঝিমঝিমে আলো। মাটিতে তামার পাত্র রাখা, আর তার সামনে ছায়া।

অর্ক তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। ছায়াটা এবার শুধু অদৃশ্য ছায়া নয়, এক পুরুষের অবয়ব স্পষ্ট। কৃশকায় শরীর, চোখ গর্তের মতো গভীর, মুখ ফ্যাকাশে, গলায় হাড় বেরিয়ে আছে। তার ঠোঁটে মন্ত্রোচ্চারণ, আর হাত জোড় করে সে দেবীর দিকে প্রণাম করছে।

অদ্রিজা কেঁপে উঠল। “ও-ই সেই ব্রাহ্মণ… যিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন।”

অর্ক স্তব্ধ হয়ে গেল। এতদিন যে নিখোঁজ ব্রাহ্মণের কথা শুনে এসেছে, আজ তারই আত্মা যেন ফিরে এসেছে।

ব্রাহ্মণ ধীরে ধীরে মুখ তুলল। তার চোখদুটি যেন আগুনের শিখার মতো জ্বলছে। সে ফিসফিস করে বলল, “শপথ ভাঙা হয়েছে… দেবী ক্রুদ্ধ… মুক্তি নেই…”

অর্ক সাহস করে সামনে এগিয়ে গেল। “তুমি কে? তুমি কেন ফিরে এসেছ?”
ব্রাহ্মণ কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দিল, “আমি সেই রক্তশপথের সঞ্চারক। আমার রক্তেই প্রথম এই পুজোর বলি হয়েছিল। আমাকে প্রতারণা করে মণ্ডপে ডেকে নিয়ে বলি দেওয়া হয়েছিল। দেবীর নামে নয়—মানুষের লোভে। তারপর থেকেই আমার আত্মা মুক্তি পায়নি।”

অদ্রিজা শিউরে উঠল। “মানে, দেবী এটা চাননি?”
ব্রাহ্মণ মাথা নাড়লেন। “না। দেবী কখনও মানববলির দাবি করেননি। এটা ছিল রায়চৌধুরী বংশের অহংকার আর ভয়ের ফল। তারা বিশ্বাস করেছিল, মানবরক্তে পুজো শক্তিশালী হবে। কিন্তু আসলে তারা নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনেছে।”

অর্ক গলা শুকিয়ে গেলেও সাহস সঞ্চয় করে বলল, “তাহলে মুক্তির উপায় কী?”
ব্রাহ্মণ উত্তর দিল, “সত্য প্রকাশ। যতদিন তারা মিথ্যা চাপা দেবে, ততদিন আমার আত্মা এভাবেই ফিরে আসবে। প্রতি বছর, প্রতি অষ্টমীর রাতে। আর একদিন এই অভিশাপ পুরো বংশকে গ্রাস করবে।”

হঠাৎই বাতাস কেঁপে উঠল। প্রদীপগুলো নিভে গেল। অন্ধকারে শুধু ব্রাহ্মণের চোখদুটি জ্বলছিল।
সে কণ্ঠ তুলল, “তুমি যদি সত্য প্রকাশ করো, হয়তো আমার মুক্তি হবে। নইলে আমি আবার আসব—বারবার আসব।”

অর্ক হঠাৎ অনুভব করল, তার শরীর শীতল হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল ব্রাহ্মণ তার ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এক অদৃশ্য শীতলতা বুক চেপে ধরল।

অদ্রিজা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। আলো ফেরার পর তারা দেখল—অলিন্দ ফাঁকা। পাত্র উলটে পড়ে আছে, মাটিতে রক্ত ছড়িয়ে আছে, আর দেওয়ালে হাতের ছাপ।

অর্ক হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “সে আবার ফিরে এসেছে। মৃত ফিরে এসেছে।”
অদ্রিজা তার চোখে তাকাল। “এখন কি আমরা পালাব?”
অর্ক মাথা নাড়ল। “না। এখন সত্য প্রকাশ করাই আমাদের কর্তব্য।”

রাতের আকাশে বজ্রপাত হলো। দেবীর সামনে প্রদীপ আবার জ্বলে উঠল, কিন্তু তার শিখা রক্তিম।

বাড়ির ভেতর থেকে হঠাৎ কোলাহল ভেসে এলো। কয়েকজন লোক ছুটে এল, তাদের হাতে ধূপকাঠি, কেউ কেউ মন্ত্র জপ করছে। তারা দেখে ফেলেছিল রক্তমাখা অলিন্দ।

একজন বৃদ্ধ কেঁপে কেঁপে বললেন, “সে ফিরে এসেছে… মৃত ফিরে এসেছে।”
আরেকজন প্রৌঢ় বললেন, “এখন আমাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। নইলে পুরো বংশ ধ্বংস হবে।”

অর্ক বুঝল—এখন আর শুধু রহস্য নয়, এটা পুরো পরিবারের অস্তিত্বের প্রশ্ন। মৃত ব্রাহ্মণের প্রত্যাবর্তন আসলে সতর্কবার্তা।

অদ্রিজা চোখে জল নিয়ে বলল, “হয়তো কাল ভোরেই দেবীর সামনে সত্য উন্মোচন করতে হবে। নইলে অভিশাপ কাটবে না।”

অর্ক সম্মতি দিল। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল—এটা এত সহজ হবে না। কারণ বাড়ির অনেকেই এখনও বিশ্বাস করে রক্তই দেবীর প্রিয় অর্ঘ্য। তারা কি এত সহজে সত্য মানবে?

দূরে তখন ঢাক আবার বাজতে শুরু করেছে। কিন্তু সেই ঢাকের তালে এবার স্পষ্ট শোনা গেল মৃতের কণ্ঠ—
“আমি আবার ফিরব… যতদিন শপথ পূর্ণ না হয়…”

পর্ব ১০: বিজয়ার প্রভাত

রাতের ভয়াবহতা কাটিয়ে ভোর যখন ধীরে ধীরে আলো ফোটাল, তখনও রায়চৌধুরী বাড়ির অন্দরমহল নিস্তব্ধ। ঢাকিরা ঘুমিয়ে পড়েছে, অতিথিরা ছত্রভঙ্গ, কিন্তু বাড়ির সদস্যদের চোখে লুকোনো আতঙ্ক স্পষ্ট। যেন সকলে বুঝে গেছে—কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

অর্ক সারারাত জেগেছিল। মৃত ব্রাহ্মণের প্রত্যাবর্তনের পর তার মাথা ভরে ছিল একটাই শব্দে—সত্য। সেই ব্রাহ্মণ স্পষ্ট জানিয়ে গেছে—মুক্তি পেতে হলে সত্য প্রকাশ করতে হবে। নইলে অভিশাপ চিরকাল থাকবে।

অদ্রিজা শিউলি ফুল হাতে এসে তার পাশে বসল। চোখে ক্লান্তি, তবুও দৃঢ়তা। “আজ বিজয়ার দিন। দেবীর বিসর্জন হবে। যদি আজই সত্য প্রকাশ না করা হয়, তাহলে আর কখনও হবে না।”
অর্ক মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। আজ দেবীর সামনে সবাইকে জানাতে হবে, কি লুকিয়ে রেখেছে এই বাড়ি।”

সকালের অঞ্জলি শুরু হলো। উঠোনে আবার ভিড়, শঙ্খধ্বনি আর ঢাকের আওয়াজে আকাশ ভরে উঠল। দেবীর মূর্তি আলোয় ঝলমল করছে, কিন্তু অর্কের চোখে সেই আলো নয়, বরং শতবর্ষের রক্তের দাগ ফুটে উঠছিল।

অর্ক হঠাৎ সবার সামনে দাঁড়াল। কণ্ঠ উঁচু করে বলল, “এই বাড়ির ইতিহাসে এক অশুভ শপথ আছে। দেবীর নামে মানববলি দেওয়া হয়েছিল। সেই ব্রাহ্মণের আত্মা আজও মুক্তি পায়নি। গতরাতেই আমরা তাকে দেখেছি।”

বাড়ির লোকেরা হাঁ করে তাকাল। কেউ ভয় পেল, কেউ রাগে গর্জে উঠল। প্রবীণ কর্তা রণদেব চেঁচিয়ে উঠলেন, “চুপ! এসব কুৎসা রটানো যাবে না। এটা আমাদের বংশের অপমান।”

অর্ক দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “না, এটা অপমান নয়। এটা সত্য। দেবী কখনও মানবরক্ত চাননি। এটা ছিল লোভ আর ভয়ের ফল। আর সেই পাপই আজও আমাদের তাড়া করছে। যদি সত্য চাপা দেওয়া হয়, তবে অভিশাপ চিরকাল থাকবে।”

অদ্রিজা তখন সামনে এসে দাঁড়াল। তার কণ্ঠ কাঁপছিল, কিন্তু স্পষ্ট ছিল। “কাকু, আমি-ও দেখেছি। অলিন্দে রক্তমাখা পাত্র, দেওয়ালে হাতের ছাপ। মৃত ব্রাহ্মণ আমাদের সামনে এসে বলেছেন, তিনি মুক্তি চান। আর মুক্তি হবে তখনই, যখন আমরা প্রায়শ্চিত্ত করব—সত্যকে স্বীকার করে।”

চারপাশে শোরগোল শুরু হলো। কেউ বলল, “ওরা পাগল।” কেউ বলল, “হয়তো সত্যিই দেবী ক্রুদ্ধ।”

ঠিক তখনই দেবীর সামনে রাখা প্রদীপগুলো কেঁপে উঠল। হাওয়ার ঝড় বইতে লাগল মণ্ডপ জুড়ে। ভিড় চিৎকার করে উঠল। ঢাকিরা পালিয়ে গেল।

অলিন্দের দিক থেকে ভেসে এলো গম্ভীর কণ্ঠ—“শপথ ভাঙা হয়েছে…”
সঙ্গে সঙ্গে মণ্ডপে আবার দেখা দিল সেই লাল শাড়ি পরা নারী। তিনি দেবীর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন, চোখদুটি অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে।

লোকজন স্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ আর প্রতিবাদ করল না। রণদেব নিজেই ভয়ে কেঁপে উঠলেন। নারীর ঠোঁট থেকে বেরোল শব্দ—“সত্য প্রকাশ করো। প্রায়শ্চিত্ত করো। নইলে এই বংশ রক্ষা পাবে না।”

অর্ক সাহস করে সামনে এগোল। তার কণ্ঠ কাঁপছিল না। “হ্যাঁ, আমরা স্বীকার করছি। এই বাড়ির ইতিহাস কলঙ্কিত। আমাদের পূর্বপুরুষরা দেবীর নামে পাপ করেছেন। আমরা আজ দেবীর সামনে শপথ নিচ্ছি—আর কোনও মিথ্যা নয়, আর কোনও বলি নয়। আজ থেকে এই পূজো হবে সত্য ও ভক্তির পূজো।”

অদ্রিজা ফুল হাতে দেবীর পায়ে রাখল। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। “দেবী, আমাদের ক্ষমা করুন। মৃত ব্রাহ্মণের আত্মাকে মুক্তি দিন।”

হঠাৎই আলো ঝলসে উঠল মণ্ডপে। নারীর অবয়ব ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। বাতাস থেমে গেল, প্রদীপগুলো স্থির শিখায় জ্বলতে লাগল। চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এলো, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার ভেতরে ভয়ের বদলে প্রশান্তি।

অলিন্দ থেকে আর কোনও মন্ত্রধ্বনি শোনা গেল না। যেন শতবর্ষের প্রতিধ্বনি থেমে গেছে।

বাড়ির লোকেরা একে একে দেবীর সামনে মাথা নত করল। প্রবীণ কর্তা রণদেবও কেঁদে ফেললেন। “আমরা ভুল করেছি। এতদিন পাপ চাপা দিয়েছি। আজ থেকে দেবীর নাম ভক্তিতে উচ্চারিত হবে, ভয়ে নয়।”

অর্কের বুক হালকা হলো। মনে হলো মৃত ব্রাহ্মণ যেন দূর থেকে মাথা নত করে বিদায় জানালেন।

বিজয়ার সকাল ফুটে উঠল। শঙ্খ বাজল, ঢাক বেজে উঠল আনন্দের সুরে। নারীরা সিঁদুর খেলায় মেতে উঠল। শিশুদের হাসি উঠোন ভরে দিল। দেবীর চোখে আলো ঝলমল করছিল, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে অর্ক ও অদ্রিজা জানল—অভিশাপ কেটে গেছে।

তবে অর্কের মনে একটুখানি প্রশ্ন থেকে গেল। লাল শাড়ি পরা সেই নারী আসলে কে ছিলেন? তিনি কি মৃত ব্রাহ্মণের আত্মার দূত, নাকি দেবীরই রূপ? উত্তর মেলেনি। কিন্তু হয়তো সত্যের খোঁজ সব প্রশ্নের উত্তর দেয় না, কেবল মুক্তি দেয়।

অদ্রিজা মৃদু হেসে বলল, “তুমি কি লক্ষ্য করেছ? এবার ঢাকের সুর ভিন্ন—এটা আর ভয়ের নয়, আনন্দের।”
অর্ক হাসল। “হ্যাঁ। কারণ এবার সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে বাজছে ঢাক।”

আকাশে তখন বিজয়ার রোদ উঠেছে। নদীর ধারে দেবীর বিসর্জনের জন্য ভিড় জমছে। রায়চৌধুরী বাড়ি এবার এক নতুন শপথ নিল—রক্তের নয়, সত্যের শপথ।

আর অর্ক তার ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে শেষ ছবি তুলল—আলোর ভেতরে দেবীর চোখ, যেখানে আর অন্ধকার নেই।

WhatsApp-Image-2025-09-19-at-6.06.11-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *