অভিজিৎ দাস
পর্ব ১: আগমনী
কলকাতার বিখ্যাত নাট্যদল ‘অভিনয়নগর’ তাদের পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহরের বাইরে একটা থিয়েটার রিট্রিটের আয়োজন করেছিল। স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল বিষ্ণুপুর—ইতিহাস আর সঙ্গীতের শহর। সেখানে গিয়ে নাটকের মহড়া, স্ক্রিপ্ট রিডিং, ওয়ার্কশপ, আর প্রকৃতির মধ্যে কিছুটা সময় কাটানো—এই ছিল উদ্দেশ্য।
দলের অন্যতম প্রবীণ সদস্য অভিজিৎদা বলেছিলেন, “বিষ্ণুপুরে একটা পুরনো রাজবাড়ির মন্দির আছে। বহুদিন কেউ যায় না, একটু ভৌতিক, কিন্তু জায়গাটা একেবারে থিয়েটার-যোগ্য।” সবার কৌতূহল জাগল। নাটকের ছায়া পড়ার জন্য এমন পরিবেশই তো চাই।
রওনা হয়েছিল দশজন—আটজন অভিনেত্রী, একজন মেকআপ আর্টিস্ট, আর রুদ্র—স্ক্রিপ্ট লেখক এবং নির্দেশক। দলটির গঠন ছিল যেন এক থ্রিলারের চাবিকাঠি। সকলেই নিজস্ব জীবনযন্ত্রণা নিয়ে এসেছিল, যদিও বাইরে থেকে সবাই ছিল হাসিখুশি, প্রাণবন্ত।
মন্দিরে পৌঁছনোর পর প্রথমেই চোখে পড়েছিল লালচে রঙের পোড়ামাটির কারুকাজ। প্রবেশদ্বারের পাশে শ্যাওলা ধরা প্রাচীন স্তম্ভের উপর একটা অদ্ভুত চিহ্ন—”অষ্টভয়ার পথ”—মাথার উপর দিয়ে ঢুকতে গিয়ে নীলাঞ্জনার কাঁধে হালকা আঁচড় পড়ে। সে হেসে বলেছিল, “এই তো শুরু, ভয় পাওয়ার নাটক জমবে!”
অভিজিৎদা বলেছিল, “এই জায়গাটায় নাকি এক সময় তান্ত্রিক ক্রিয়া হত। বহু পুরনো কাহিনি আছে… তবে আমরা তো থিয়েটার করতে এসেছি, ভয় নয়।”
তবে প্রথম রাতেই শুরু হল অদ্ভুত কিছু।
সায়ন্তিকার ঘুম ভেঙে গেল রাত দেড়টায়। কানে যেন ফিসফিস শব্দ। মেঘলা আঁকা ক্যানভাসে হঠাৎ এক কালো নারীমূর্তি আঁকা হয়ে গেছে—সে নিজে কিছু আঁকেনি। রিমঝিম তার ডায়েরিতে লিখে রেখেছিল—“আমার শরীরের মধ্যে কেউ আছে… সে কাঁদছে। আমি নয়।”
রুদ্র লক্ষ্য করছিল, প্রত্যেকের আচরণ অদ্ভুতভাবে পাল্টে যাচ্ছে। ঈশিতা, যে বরাবর চুপচাপ, হঠাৎ করেই খিটখিটে হয়ে উঠেছে। বুলবুলির ঘুম একটানা ৪৮ ঘণ্টা চলে গেল—ডাকাডাকি করেও ওঠানো গেল না।
পরদিন সকালের মহড়ায় রুদ্র নাটকের দৃশ্য পরিবর্তন করতে চাইল। আগের নাট্যরচনার বদলে একটা এক্সপেরিমেন্টাল স্ক্রিপ্ট তৈরি করছিল যেখানে ‘ভয়ের শরীরায়ণ’ হবে—প্রতিটি চরিত্র একেকটি ভয়। মজার ব্যাপার, অভিনেত্রীরা সবাই সেটাতে রাজি হয়ে গেল।
রুদ্র নিজেও জানত না, এই নাটক আসলে কাউকে প্রেরণা দিচ্ছে—কিংবা তার ভেতর দিয়েই চলেছে এক তান্ত্রিক পরিকল্পনা।
তৃতীয় দিন বিকেলে, মন্দিরের গোপন অংশে প্রবেশের পথ আবিষ্কার হল। একটি পাথরের সিঁড়ি, অন্ধকার আর শীতলতা ভরা। নিচে গিয়ে দেখা গেল একটি আটকোণা ঘর—মাঝে আটটি ধাতব আসন, প্রতিটিতে একেকটি রত্ন বসানো, আর এক পুরনো প্রতিমার ছায়া—নারীমূর্তি, চোখ ঢাকা কাপড়ে, জিহ্বা বেরোনো, হাতে তরবারি।
“এটা কে?” প্রশ্ন করেছিল তৃষা।
অভিজিৎদা জবাব দিয়েছিল, “তন্ত্রশাস্ত্রে এক দেবী আছেন—মাতঙ্গী। তিনি অশুচি, নিষিদ্ধ আর ভয়কে গ্রহণ করেন। তার জাগরণ হয় যখন আট নারীর মানসিক ভয় পূর্ণতায় পৌঁছে।”
সবাই হেসেছিল তখন। কিন্তু কেউ জানত না, তারা আটজন আসলে নিজেরাই ‘অষ্টভয়া’ হয়ে উঠেছে—এক অলৌকিক নাটকের চরিত্র, যার কাহিনি লিখে যাচ্ছে কোনো এক অদৃশ্য তান্ত্রিক কলম।
রাত্রি ঘনিয়ে এল। নীলাঞ্জনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ দেখল—তার প্রতিবিম্ব হাসছে, অথচ সে নয়। সায়ন্তিকা ফোনে কারও সাথে কথা বলতে গিয়ে শোনে—উলটো দিক থেকে শুধু বলা হচ্ছে, “আমি আসছি… তোমার বিশ্বাস ভেঙে দিতে…”
আর সেই রাতে রুদ্র একা বসে লেখে এক নতুন দৃশ্য:
“যখন অষ্টভয়ার প্রতিটি ভয় রক্ত হয়ে মাটি ছোঁয়, মাতঙ্গী আসেন… নারী হয়ে, দেবী হয়ে, সর্বনাশ হয়ে।”
তার কলম চলতেই থাকে, মোমবাতির আলোয় ছায়া নড়ে ওঠে।
পর্ব ২: চিত্রিত ছায়া
মেঘলা ছোটবেলা থেকেই ভয় পায় আঁকা জিনিসে। তার আঁকা যেন কেবল তার মনেরই প্রতিবিম্ব নয়, বরং কিছু যেন তাকে দিয়ে নিজের অস্তিত্ব রচনা করায়। বহুবার এমন হয়েছে, সে যে আঁকতে বসেছে তা পরে বাস্তব হয়ে উঠেছে। তাই অনেকদিন আঁকেনি। কিন্তু এই মন্দিরে এসে অজান্তেই তার হাতে রং উঠেছে।
দ্বিতীয় রাতের গভীরে, ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ক্যানভাসের উপর সে হঠাৎ দেখে এক মুখ আঁকা হয়ে গেছে—নারীমুখ, কালো, জিভ বেরোনো, মাথার চারদিকে নীল আভা। সে আঁকেনি, অথচ তার হাত রঙে মাখামাখি।
ঘুমন্ত রিমঝিম চমকে উঠে বলে, “তুই রাত তিনটায় জেগে আঁকলি?”
মেঘলা মাথা নাড়ে, “আমি তো শুলেই ছিলাম।”
“তাহলে কে আঁকল?”
চোখাচোখি হয়। দূরের এক জানালা খুলে যায় হাওয়ার ঝাপটায়। কোথাও কিছু নেই, অথচ অনুভব হয়—এই কক্ষে কেউ আছে।
রুদ্র তখন নিচতলার গোপন ঘরে। দিনের আলোয় একবার সে যেখানে গিয়েছিল, এখন সেখানে অন্ধকার। সে একটা মোবাইল টর্চ জ্বালিয়ে দেখে—আটটি আসনের উপর সাতটি আসনে ধুলো সরানো, একটা আসনে এখনো ধুলো জমে। পাশে লেখা আছে সংস্কৃত শ্লোক—
“যা নিজভয় ত্যজে, সে-ই মাতঙ্গীর যোগিনী হইবে না।”
সে বুঝে না ঠিক, কিন্তু এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়—এই নাট্যরচনা কারও নির্দেশে চলেছে।
ঈশিতা, যার স্পর্শভীতি রয়েছে, আজ রাতে ঘুমোতে পারছিল না। হঠাৎ তার বিছানায় জেগে উঠে দেখে, তার হাত ধরে আছে আরেকটা হাত—শীতল, রুক্ষ, কিন্তু কোনও দেহ নেই। চিৎকার করতে গিয়ে দেখে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। ঘরের দেয়ালে ছায়া কাঁপছে, যেন কোনও নারীনৃত্য—ভীতিকর, অথচ মুগ্ধতাপূর্ণ।
উপরের ঘরে, সায়ন্তিকার ফোনে এল এক ভিডিও কল—নাম নেই, নম্বর নেই। সে ধরে, আর স্ক্রিনে দেখে—সে নিজে, কিন্তু উলটো মুখে দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘরে, ঠিক এই ঘরটা, পেছনে ওই একই মূর্তি যার মুখ ঢাকা, জিভ বেরোনো।
সায়ন্তিকা ফোন ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
এক তলার লবিতে নীলাঞ্জনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবার দেখে সেই অদ্ভুত প্রতিবিম্ব। এবার তার চুল নিজে থেকে খুলে যাচ্ছে, চোখে কালো কাজল ছড়িয়ে পড়ছে নিচের গালে। সে বলে ওঠে, “আমি কে? আমায় কেউ চায় না।” আর আয়নার প্রতিবিম্ব জবাব দেয়—“তাই তো তোকে বেছে নেওয়া হয়েছে।”
তৃষা তার কক্ষে বসে ছিল জানলার পাশে। তার ভয় ছায়া। আজ জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে এক ছায়া, কোনো রূপ নেই, চোখ নেই, কেবল শরীররেখা। ছায়া জানালার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করে ঘরের সমস্ত বাতি নিভে যায়। ছায়া ঢুকে পড়ে ভিতরে।
“তৃষা,” বলে এক ফিসফিসে কণ্ঠ।
তৃষা জিজ্ঞেস করে, “কে?”
“তুই নিজেই।”
দলটির মহিলা সদস্যারা বুঝে ওঠার আগেই তারা প্রত্যেকে আলাদা এক অলৌকিক অভিজ্ঞতার মধ্যে ঢুকে গেছে। আর প্রতিটি অভিজ্ঞতাই তাদের কোনও না কোনও গভীর ভয়কে বাস্তব করে তুলছে। যেন তাদের জীবনের সেই গোপনতম, অব্যক্ত, অপরিচিত ভয়গুলো ধীরে ধীরে শরীর ছুঁয়ে উঠছে।
এদিকে রুদ্র পুরনো নাট্যপুস্তিকাগুলো ঘাঁটতে গিয়ে এক চিঠি পায়—হাতে লেখা, কালি ঝাপসা, কিন্তু কিছুটা পড়া যায়:
“অষ্টভয়ার বরণ হলেই মাতঙ্গী রক্তগ্রহণ করবেন। আট নারীর ভয় যদি চূড়ান্তে পৌঁছে, আটটি আসনে বসে, এবং সেই ভয়কে উৎসর্গ করে, দেবী আত্মারূপে আসবেন।”
রুদ্র এখন নিশ্চিত—এই নাটক আর নাটক নেই। এটি এক ‘আচার’। তাদের মধ্যে আটজন নারী—আটটি ভয়—যা জাগিয়ে তোলা হচ্ছে ধীরে ধীরে।
সে মেঘলাকে দেখে বলল, “তুই কি কিছু আঁকছিস গতকাল?”
মেঘলা চুপ। তারপর মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু আমি জানি না কিভাবে।”
“আঁকিস না। কারও ছবি আসছে তোর ক্যানভাসে।”
“দেবী?”
রুদ্র চোখ বড় করে তাকায়। মেঘলার চোখে ভয়, কিন্তু সেই ভয়ও আজ যেন কারও পছন্দ।
রাত গভীর হয়। আটজন নারী, আটটি ভয়, এবং এক দেবীর প্রতীক্ষা—যিনি ভয় দিয়ে সৃষ্টি করবেন আত্মার রূপ।
পর্ব ৩: নিস্তব্ধতার ঘর
বুলবুলির ঘুমের ইতিহাস আছে। সে এক অদ্ভুত রোগে ভুগত—ঘুমিয়ে থাকত অনিয়ন্ত্রিতভাবে, দিনে দিনে, ঘন্টার পর ঘন্টা। ডাক্তার বলেছিল ‘Hypersomnia’, কিন্তু তার পরিবার জানত—ঘুম তার কাছে যেন এক পালানোর রাস্তা। সেই ঘুমে অনেক সময় সে জেগে থাকত, কিন্তু শরীর সাড়া দিত না। আর তখন সে দেখতে পেত অন্ধকারে চলাফেরা করা কিছু ছায়া—শব্দহীন, নিঃশব্দ।
এই নাট্যশিবিরের তৃতীয় রাত, যখন সবাই ঘুমাতে গেল, বুলবুলির ঘুম এলো না। অনেকদিন পর সে নিজের ঘরে চুপচাপ বসে ছিল, চোখ খুলে, অথচ ভিতরে কেমন যেন নিস্তব্ধতা। জানালার বাইরে বিষ্ণুপুরের রাত শান্ত, তবে ঘরের ভিতর এক অদৃশ্য চাপ যেন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে।
ঘরের বাতিটা হঠাৎ ফ্লিক করতে থাকে। বুলবুলি উঠে গিয়ে বন্ধ করে দেয়, মোম জ্বালে। আলো নরম, নড়ছে, তবু কিছু শান্তি মেলে। কিন্তু সেই মোমের আলোয় দেয়ালে সে দেখতে পায়—ছায়া। অথচ সে একা। ছায়াটা নড়ে না, কেবল দাঁড়িয়ে থাকে।
সে উঠে গিয়ে দেখে দেয়ালে সেই ছায়া নেই। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে—ছায়াটা ঠিক তার পেছনে। সে কাঁপতে কাঁপতে বলে, “কে… কে তুমি?”
কোনো উত্তর নেই। নিস্তব্ধতা আরও গভীর হয়। এমনকি ঘরের শব্দ, বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক, হাওয়ার শোঁ শোঁ সব থেমে যায়। যেন সে এক নিঃশব্দ জগতে ঢুকে গেছে।
হঠাৎ সেই ছায়া এগিয়ে আসে, ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যায় কানের পাশে। কেউ ফিসফিস করে বলে—“তোর ঘুমে আমিই ছিলাম, আমি তোর ভয়।”
বুলবুলি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
পরদিন সকালে সবাই খেয়াল করে বুলবুলি বিছানায় নিস্পন্দ। ডাকলেও সাড়া নেই। শরীর ঠান্ডা নয়, নিঃশ্বাস আছে, কিন্তু চোখ বন্ধ। যেন গভীর ঘুমে। কিন্তু চেহারায় একটা চাপা আতঙ্কের রেখা—চোখের কোণে শুকিয়ে যাওয়া একফোঁটা জল, ঠোঁট অল্প নীলচে।
রিমঝিম বলে, “তাকে হাসপাতালে নিতে হবে।”
রুদ্র ভাবে, “না, এটা ডাক্তারি নয়। এটা তন্ত্র।”
ঈশিতা চুপ করে বসে। তার চোখদুটি লাল। সে বলে, “আমি একটা হাত দেখেছিলাম গতকাল রাতে… আমাকে স্পর্শ করছিল… আমি চিৎকার করতে পারিনি।”
রুদ্র এবার চুপ করে না। সে বলে, “তোদের প্রত্যেকের ভিতরে কিছু আছে, যা বাইরের দুনিয়া দেখে না। এই নাটকটা তোরা যতটা ভাবছিস, তার থেকেও বেশি সত্যি। এখানে নাটক নয়, আত্মার উন্মোচন চলছে।”
সায়ন্তিকা চেঁচিয়ে ওঠে, “মানে? আমরা ভয় পেতে এসেছি, না কি নাটক করতে?”
রুদ্র শান্তভাবে বলে, “ভয় যখন সত্যি হয়, তখন নাটকই তার রূপ নেয়। এটাই হচ্ছে অষ্টভয়ার নাট্যক্রিয়া।”
নীলাঞ্জনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। তার ভয়, যে সে কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারে না—না পরিবার, না বন্ধু, না প্রেমিক। সে মনে মনে বলছিল, “আমি নিজেই তো জানি না আমি কে।” আর তখনই আয়নায় তার প্রতিবিম্ব জবাব দেয়—“তুই তোর ভয়, আর তোর ভয়ই দেবীর আহ্বান।”
ঈশিতা বুলবুলির শীতল হাত ধরে বসে থাকে। হঠাৎ তার কানে এক চুপচাপ শব্দ আসে—কেউ যেন দোতলার ফাঁকা ঘরে কাঁদছে। সে উঠে দাঁড়ায়, ধীরে ধীরে যায় সেই ঘরের দিকে।
ঘরটা ফাঁকা, কেবল মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরনো আলপনা। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে সে দেখে—এক ছায়া। নারীমূর্তি, চোখে কাপড় বাঁধা, হাতে সরু ত্রিশূল, এবং ঠোঁটে হাসি। ছায়াটি বলে—“স্পর্শ ভয় নয়, স্পর্শই জাগরণ।”
ঈশিতা পেছনে তাকায়—কেউ নেই। আবার সামনে তাকাতে ছায়া মিলিয়ে যায়। কিন্তু তার বুক ধড়ফড় করতে থাকে। সেই রাত থেকে তার গায়ে যেন কেউ আঙুল বুলিয়ে যাচ্ছে ঘুমের মধ্যে। কিন্তু সে আর ভয় পায় না, বরং একরকম তীব্র উত্তেজনায় সে জেগে থাকে।
রুদ্র নাটকের নতুন দৃশ্য লিখে ফেলে—
“যখন চুপ থাকে সব শব্দ, নিস্তব্ধতায় এক নারী হাসে—সে হয় ভয়, সে হয় মাতঙ্গী।”
রাত গভীর হলে কেউ আর আলো নিভিয়ে ঘুমাতে চায় না। সবাই একরকম দৌড়ে বাঁচতে চায় নিজের ভয় থেকে, অথচ সেই ভয়ই যেন এক এক করে দরজা খোলার চাবি হয়ে উঠছে।
আর নিচতলার মন্দিরঘরে সাতটি আসনে এখন বসে আছে কালো রেখা, মাথার ওপর বাতাস চলাচল করছে না। অষ্টম আসনটি এখনো খালি। কিন্তু না, কে যেন সেখানে ছুঁয়েছে একবার। এক লালচে ছাপ জেগে উঠেছে পাথরে।
কে সেই অষ্টম ভয়?
পর্ব ৪: স্বপ্নের নিচে শিকল
দিব্যার মুখে সবসময় একটা শান্ত হাসি লেগে থাকে। যেন কিছুই তার ভেতর ঢোকে না, কিছুই তাকে ছোঁয় না। অথচ সেই মেয়েটিই তিন বছর আগে গলায় ওড়না জড়িয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল—নিজের ঘরে, মায়ের পাশের ঘরে। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল। এরপর কাউন্সেলিং, থেরাপি, ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা—সব মিলিয়ে সে ফিরে এসেছিল জীবনযুদ্ধে। কিন্তু কিছু গভীর কবর থাকে, যার ঢাকনা ঢাকলেও ভিতরের ঘ্রাণ বাতাসে রয়ে যায়।
এই নাট্যশিবিরে এসে দিব্যার হাসি বেড়ে গেছে। কারণ অন্যদের ভয় সে টের পাচ্ছে, আর সে নিজে ভেবেছে, নিজের ভয় সে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু বাস্তবে যা শুয়ে থাকে, তা তো হারিয়ে যায় না।
চতুর্থ রাত, মন্দিরের আঙিনায় সবাই বসে নাটকের একটি দৃশ্য রিহার্স করছিল। রুদ্র সবাইকে বলল—“আজকের থিম ‘ঘুমের নিচে লুকনো গল্প’। যে যেমন ঘুমোয়, সে তেমন স্বপ্ন দেখে। আর সেই স্বপ্নে যে ভয় আসে, সেটাই আসলে তোর ভেতরের ছায়া।”
এই কথা শুনে দিব্যা হেসে বলেছিল, “তবে আমার স্বপ্ন ফাঁকা। আমি আর কিচ্ছু দেখি না।”
রুদ্র তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ, তারপর বলেছিল, “ফাঁকা স্বপ্নটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ ওখানে যা ইচ্ছা ঢুকতে পারে।”
সেই রাতে দিব্যা ঘুমিয়ে পড়ে গভীরভাবে। প্রথমে সবকিছু যেন আলোয় ভরা, এক বিস্তৃত মাঠ, দূরে একটা হালকা সাদা ঘর, আর ঘরের জানালায় এক নারী দাঁড়িয়ে—চেনা মুখ, কিন্তু অস্পষ্ট। সেই মুখ ডাকছে তাকে, হাত তুলে বলছে, “এসো…”
দিব্যা এগিয়ে যায়। দরজায় পৌঁছে দেখে ঘরের ভেতর আটজন মেয়ে বসে, সবাই তার পরিচিত, সবাই তার দলের অভিনেত্রী। কিন্তু তাদের চোখ নেই, কেবল ফাঁকা খোপ। মুখে একই কথা—“তুই তো আমাদের মতো ছিলি, কেন পালিয়ে গেলি?”
ঘরের মাঝখানে একটা দড়ি ঝোলানো, তার নিচে চেয়ার। পুরনো গন্ধ। হঠাৎ চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। পায়ের নিচে মাটি নেই। সে পড়ছে, নিচে, এক চক্রাকারে নামতে থাকা খাদে। সেই খাদে রক্তের গন্ধ, ভয় আর কান্না।
দিব্যার ঘুম ভাঙে দম বন্ধ হয়ে। সে উঠে বসে, ঘেমে ভিজে গেছে চাদর, কাঁপছে হাত-পা। কিন্তু তার মাথার কাছে একটা কাগজ পড়ে ছিল—ছেঁড়া, মলিন। লেখা:
“স্বপ্নে যদি ফিরে আসে শিকল, তবে শিকলই তোর নিয়তি।”
সে জানে এই কাগজ তার নয়। তখনই জানালার বাইরে কিছু একটা নড়ে ওঠে। সে হঠাৎ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়—নির্জন অন্ধকার করিডোর পেরিয়ে চলে যায় নিচতলার মন্দিরঘরের দিকে।
সেই গোপন ঘরে তখন বাতাস বন্ধ, দেওয়াল বরাবর প্রদীপের আলো জ্বলছে আপনমনে। দিব্যা ভেতরে ঢুকে পড়ে একরকম ঘোরে। আটটি আসনের সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখে—সাতটি আসনে এখন কালো ছায়া বসে আছে, একটিতে এখনো কেউ নেই।
সে হঠাৎ শুনতে পায় এক মিষ্টি গলা, নারীকণ্ঠ—“তুই তো আমার প্রিয়… যেই না নিজের মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলি… তুই-ই আমায় সত্যি করে তুলবি…”
তার সামনে পড়ে থাকা লাল রঙের রুমাল নিজের থেকেই উড়ে গিয়ে পড়ে অষ্টম আসনে। দিব্যার শরীর কেঁপে ওঠে। কিন্তু সে পেছন ফিরে দেখে—ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সেই নারী, যার চোখে নেই কোনো তারা, কেবল কালো গর্ত।
“তুই নিজেকে ক্ষমা করিসনি, দিব্যা,” বলে সে।
“আমি ভুল ছিলাম…” ফিসফিস করে দিব্যা।
“তুই যদি নিজেকে ক্ষমা না করিস, আমি তোকে গ্রহণ করব,” বলে সেই মূর্তি। “আমার মধ্য দিয়ে তুই ফিরে পাবি আত্মাকে।”
দিব্যা মাটিতে বসে পড়ে। হঠাৎ তার মাথার পেছনে ঝাপটা লাগে, যেন কানে কেউ ফিসফিস করে, “তুইই অষ্টম।”
ততক্ষণে উপরের ঘরে রিমঝিম লক্ষ্য করে দিব্যা নেই। সে নীলাঞ্জনাকে ডাকে, “ও কোথায় গেল?”
দু’জনে মিলে খোঁজে বের হয়। নিচতলার করিডোরে এসে তারা শুনতে পায়—একটা দরজা হালকা খোলা। ভিতরে আলো কমে গেছে। তারা ঢুকে দেখে, দিব্যা মাটিতে বসে আছে, চোখ বন্ধ, মুখে এক শান্ত হাসি।
রিমঝিম বলল, “দিব্যা?”
সে চোখ মেলে তাকায়। কিন্তু তাতে ছিল না আগের সেই শান্ত চাহনি। যেন সেখানে অন্য কেউ আছে।
রিমঝিম ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসে। “নীলা, চলো এখান থেকে।”
কিন্তু নীলাঞ্জনা যেন অবশ। তার দিকে তাকিয়ে দিব্যা বলে—“তোর ভয় এখন আমার। আমি তোর স্বপ্নে যাবো এবার।”
সেই মুহূর্তে মন্দিরের উপর একটা বুনো বাতাস বইতে থাকে। প্রদীপ নিভে যায় একে একে। অষ্টভয়ার অষ্টম আসন এখন পূর্ণ। দেবী এখন নিঃশ্বাস নিচ্ছেন।
পর্ব ৫: বিশ্বাসঘাতিনীর মুখোমুখি
সায়ন্তিকার বিশ্বাস একদিন কেউ ভেঙেছিল—তাকে ভালোবাসার অভিনয় করে ঠকিয়েছিল, একটানা তিন বছর। সেই ছেলেটি, যে কবিতা লিখত, গভীর চোখে তাকিয়ে বলত, “তুই আমার পৃথিবী”, একদিন হঠাৎ বলে দিয়েছিল, “আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পারিবারিক ব্যাপার। তোকে কেউ জানবে না, ভাবিস না।”
সেদিন থেকে সায়ন্তিকার মধ্যে একটা কিছু মরে গিয়েছিল। সে ভেবেছিল, বিশ্বাস শব্দটা তার অভিধান থেকে মুছে গেছে।
কিন্তু এবার বিষ্ণুপুরে এসে, অদ্ভুতভাবে তার সেই পুরনো বিশ্বাসের প্রেত আবার ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে।
পঞ্চম রাত। বৃষ্টি পড়ে চলেছে হালকা। চারদিক নিঃস্তব্ধ। সবাই যার যার ঘরে। রুদ্র নাটকের নতুন একটি সংলাপ লিখছিল—
“বিশ্বাস আর ভয় একই রাস্তায় হাঁটে। একজন পথ দেখায়, আরেকজন গর্ত খুঁড়ে রাখে।”
এই সময়, সায়ন্তিকার ফোনে আবার সেই অজানা নম্বর থেকে ভিডিও কল আসে। এবার সে ধরে না। ফোনটা বিছানায় রেখে দেয়। কিন্তু ফোনটা নিজে থেকেই স্ক্রিন অন করে। তার স্ক্রিনে ভেসে ওঠে—সেই পুরনো বাড়ি, সেই ছেলেটার ঘর, এবং সেই বিছানা, যেখান থেকে তার সম্পর্ক শেষ হয়েছিল।
সে ভেবে পায় না, এ কি কোনো হ্যালুসিনেশন? না কি কেউ ওকে খেলিয়ে চলেছে?
ঠিক সেই সময় ঘরের দরজা হঠাৎ কাঁপতে থাকে। কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ঠুকঠুক করছে।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়, দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে—কেউ নেই।
দরজা খুলতেই দেখি মেঝেতে পড়ে আছে একটি কাগজ—চিরকুট।
লেখা:
“তোকে যে ভালোবেসেছিল, সে তো তোর ভয়। ওকে ফিরিয়ে আনবি?”
সে কাঁপতে কাঁপতে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে। কিন্তু তখনই পিছনে দরজার আয়নায় দেখে—সেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে, পেছন ফিরে, তার গলায় হাত রেখে বলছে, “তুই তো আমায় বিশ্বাস করেছিলি… ভুল করিসনি তো?”
সায়ন্তিকা চিৎকার করতে গিয়েও পারে না। গলার স্বর আটকে যায়। ভয় যেন তার স্বরগ্রন্থিকে চেপে ধরে।
এই সময় পাশের ঘর থেকে ঈশিতা ছুটে আসে। দরজা ঠেলে দেখে সায়ন্তিকা মেঝেতে কুঁকড়ে পড়ে আছে। তার মুখে আতঙ্কের ছাপ, ঠোঁট কাঁপছে, চোখ খোলা, কিন্তু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
ঈশিতা তাকে জড়িয়ে ধরে, ধীরে ধীরে শান্ত করে। সে ফিসফিসিয়ে বলে, “তুই কী দেখেছিস?”
সায়ন্তিকা কাঁপতে কাঁপতে বলে, “সে ফিরে এসেছে… আমার বিশ্বাস… সেই ছায়া হয়ে গেছে…”
ঈশিতা বুঝতে পারে, এটা নিছক ভয় নয়। এটা এক অলৌকিক শক্তির খেলা, যা তাদের প্রত্যেকের দুঃখ আর অস্বীকারের গর্ত খুঁড়ে আনছে।
নীলাঞ্জনা তখন ছাদে বসে ছিল, একা। তার ভিতরেও চলছে দ্বন্দ্ব। সে কেবলই ভাবছে—এই নাটকটা আদৌ কি নাটক? না কি তারা আটজন কোনও শক্তির কাছে বন্দি?
নিচে রুদ্র পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে এক অদ্ভুত চক্ররেখা আঁকতে বসেছে। সে বুঝতে পারছে, এই আট নারীর ভয় কোনও সাধারণ অভিজ্ঞতা নয়, এগুলো পরিকল্পিত। কে যেন এক-এক করে তাদের ভিতর থেকে টেনে বার করছে অবদমিত স্মৃতি—আর প্রতিটি স্মৃতি হচ্ছে একেকটি কুঞ্জি, যা খুলে দিচ্ছে দেবীর গোপন কক্ষ।
সে টেবিলে বসে লেখে:
“যখন বিশ্বাসকে ছায়া করে ডাকা হয়, তখন দেবী হাসেন। কারণ বিশ্বাসই সর্বশেষ আত্মাহুতি।”
সেই মুহূর্তে মন্দিরের নিচতলা থেকে এক কাচ ভাঙার শব্দ আসে। রুদ্র ছুটে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে, দিব্যা মাটিতে পড়ে আছে, মুখে রক্ত, তার পাশেই সায়ন্তিকা কাঁপছে।
দিব্যা উঠে বসে, ঠোঁটে সেই রহস্যময় হাসি। বলে, “ওর ভয় আমি শুষে নিয়েছি। এবার ও মুক্ত।”
রুদ্র চিৎকার করে, “তুই কে?”
দিব্যা হেসে বলে, “আমি দেবী। আমার আটটি ভয় পূর্ণ হয়েছে। এখন আমি আসতে পারি—মাংসের শরীরে, রক্তে, কণ্ঠস্বরে।”
সেই মুহূর্তে আটটি আসনের সামনে প্রদীপ জ্বলে ওঠে একসাথে, আর ছাদ কাঁপতে থাকে। বাইরে বৃষ্টি তীব্র হয়। দূর থেকে বাজ ভেঙে পড়ে মন্দিরের চূড়ায়।
রিমঝিম বলে ওঠে, “সবাই একসাথে থাকো। ভয় এলে হাত ধরো। কারণ ভয় ভাগ করে দিলে শক্তি হয়।”
কিন্তু আসল প্রশ্ন—এই ভয় কি আর ভাগ করার মতো আছে?
পর্ব ৬: যন্ত্রণার আঁকা দেহ
রিমঝিম যখন প্রথম থিয়েটারে যোগ দিয়েছিল, তখন সে ছিল এক আগুন-ধরানো মেয়ে—আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ, চোখে আগামীর স্বপ্ন। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝেছিল, মঞ্চে প্রতিভা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা, চেনা মুখ, আর আত্মবিসর্জন।
এক পরিচালক তার শরীর চাইছিল বিনিময়ে একটি চরিত্র। রিমঝিম না বলেছিল। তার বদলে পরিচালক তাকে চুপ করে উপেক্ষা করতে শিখিয়েছিল, এমনভাবে যে মঞ্চে সে অদৃশ্য হয়ে উঠেছিল। তারপর থেকে সে নিজেকে আঁকতে শুরু করেছিল—ডায়েরির পাতায়, গায়ে ছায়ার রেখায়, আত্মার মধ্যে পাথরের মতো চাপা কষ্টে।
এই শিবিরে এসে তার পুরনো সেই যন্ত্রণা নতুনভাবে জেগে উঠেছে। একরাতে, ঘুমের মধ্যে, তার পিঠে একটা ঠাণ্ডা হাত ছুঁয়ে যায়। জেগে উঠে সে দেখে কিছু নেই। কিন্তু আয়নার সামনে গিয়ে দেখে—তার পিঠে অদ্ভুত অদৃশ্য আঁচড়। কোনো প্রাণীর নয়, যেন অক্ষর।
সে আয়নাতে তাকিয়ে দেখে নিজের প্রতিচ্ছবি তার দিকে ফিরে বলছে—“তোকে কেউ ছুঁতে চায়নি, তাই তোকে টুকরো করা হয়েছে। আর সেই ছায়া এখন আমিই।”
ছায়াটা তার শরীর থেকে যেন আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, এক পা এগিয়ে আসে, বলে—“তোর দেহ আমায় দে। আমি তোর ভয় নিয়ে যাব।”
রিমঝিম পিছিয়ে আসে। “তুই কে?”
ছায়া বলে—“আমি তো তুই, যেদিন ‘না’ বলেছিলি… সেই দিন থেকেই আমি আলাদা হয়ে গেছি।”
ঘরের বাতি নিভে যায়। এক অন্ধকার শরীর তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে, ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফিসফিস করে—“তুই জেগে থাকিস, আমি তোকে আবার অদৃশ্য করব।”
সকালে সে জেগে উঠে দেখে, নিজের গায়ে অদ্ভুত আঁকা দাগ, কালো কালো, যেন তামার আঘাতের মতো।
ঈশিতা ও সায়ন্তিকা তার শরীর দেখে অবাক। কেউ বলে, “এই দাগ তো ঠিক তান্ত্রিক আল্পনার মতো।”
রুদ্র পুরনো পুঁথি থেকে মিলিয়ে দেখে, হ্যাঁ—এই চিহ্নগুলি ‘মাতঙ্গী-চক্র’-এর, যা ব্যবহার করা হয় নারীর শরীরকে শক্তির পাত্রে রূপান্তর করতে।
রিমঝিম বলে ওঠে, “আমার শরীর তো এতদিন কারও চোখে পড়েনি। এখন যন্ত্রণা দিয়ে যেন কেউ আমাকে মঞ্চে ফের তুলে আনছে।”
রুদ্র শান্তভাবে বলে, “কারণ, তোর ভয়টাই এখন প্রকাশ পাচ্ছে। তুই অদৃশ্য হওয়াটা থামাতে চাস?”
রিমঝিম চোখে জল নিয়ে বলে, “হ্যাঁ। আমি আর কারও ছায়া হতে চাই না। আমি নিজে হতে চাই। নিজে, ভাঙা হলেও, জ্বলন্ত।”
এই স্বীকারোক্তির পর বাতাস হঠাৎ থেমে যায়। ঘরের কোনায় রাখা ছোট আয়নাটিতে তার প্রতিচ্ছবি চুপি চুপি মাথা ঝাঁকায়। যেন বলছে, “তুই তোর ভয়কে গ্রহণ করলি। কিন্তু আমি এখনো আছি।”
সন্ধ্যাবেলা, মন্দিরের গোপন ঘরে সবাই একত্র হয়। আটটি আসনের সামনে জ্বলছে দীপ। প্রতিটি নারী জানে তারা আলাদা আলাদা ভয়।
রুদ্র তাদের ঘিরে বসিয়ে বলে, “আজ এক চক্র সম্পূর্ণ হবে। যাঁরা ভেবেছিল নাটক হচ্ছে, তারা বুঝে ফেলেছে—এটা আত্মার মঞ্চ। ভয়কে রূপ দেওয়ার আচার। কেউ চায় আমাদের মাধ্যমে এক শক্তিকে ডেকে আনতে। কিন্তু আমরা কি তাই হতে দেব?”
দিব্যা সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলে, “তোমরা বুঝতেই পারছো না। আমি দেবী নই, আমি সেই দরজা মাত্র, যেটা তোমরাই খুলেছো। ভয়কে যখন নাম দিয়ে ডাকা হয়, সে তখন নিজের শরীর গড়ে তোলে। আমি তো সেই শরীর।”
রিমঝিম সামনে এগিয়ে এসে বলে, “তাহলে আমরাও তো ভয়। আমরাও তো শরীর। আমরাও তো আত্মা। আমরা সবাই যদি ভয়টাকে আলাদা না করে, বরং নিজের করে নিই, তবে কী হয়?”
বাতাস ভারি হয়ে আসে। চারদিক থেকে চিৎকার, কান্না, ফিসফিসানি যেন ভেসে আসে।
এই সময় নীলাঞ্জনা এক পাথরের ধাপে বসে বলে, “আমি কাউকে খুশি করতে পারি না, এটা আমি জানি। কিন্তু আমি থাকি। আমি বেঁচে থাকি। সেটাই আমার শক্তি।”
মেঘলা বলে, “আমি যা আঁকি, তা আমিই। ভয় নয়। আর কেউ নয়।”
ঈশিতা বলে, “আমি ছুঁয়ে যেতে চাই, ভালোবাসতে চাই। আমার শরীর তেমনটাই চায়।”
সায়ন্তিকা বলে, “আমার বিশ্বাস ভেঙেছে, কিন্তু আমি আবার বিশ্বাস করতে চাই। নিজেকে। নিজের গল্পকে।”
এই মুহূর্তে আটজন নারী একসাথে, ভয় নিয়ে, ভয় পেরিয়ে, ভয়কে নিজের করে নেয়।
আর সেই মুহূর্তেই মন্দিরের শীর্ষ থেকে ঝরে পড়ে এক দীপ্ত আলো। মাতঙ্গীর প্রতিমার মুখে বাঁধা কাপড় খুলে যায় হাওয়ার ঝাপটায়। কিন্তু সেই মুখ খালি—আলোয় ভরা, রূপহীন। যেন এক আয়না, যেখানে যার যে ভয় ছিল, তা প্রতিফলিত হয়, তারপর মিলিয়ে যায়।
দেবী ফিরে যান।
ভয়ের শরীর এবার ভয়হীন।
পর্ব ৭: দেবীর শ্বাস ও নারীছায়া
সাতটি ভয় আর সাতটি নারী, মিলেই তো হবেই মাতঙ্গী দেবীর আগমন।
রুদ্র যখন নিচতলার গোপন মন্দিরঘরে প্রবেশ করল, দেখে আটটি আসন এখন পূর্ণ। আটজন নারী দাঁড়িয়ে আছে চারপাশে, প্রত্যেকের চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি। ভয় আর শক্তি মিশে একাকার হয়েছে।
মন্দিরের বাতাস বদলে গেছে, যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে—সন্দীপনের গন্ধ, কালো মোমবাতির ধোঁয়া, এবং কোনো এক অপরিচিত ফুলের সুগন্ধ।
দিব্যার মুখে অমলিন হাসি। সে বলে, “আমরা সবাই একসাথে এসেছি। আমি আর ভয় নই। আমি মুক্ত। মুক্তির স্বাদ পেয়ে দেবী ফিরে আসছেন।”
নিচ থেকে হঠাৎ একটি মৃদু গুঞ্জন উঠল। বাতাসের মধ্যে থেকে একটি ধীর স্বর—
“অন্তর্গতরা জেগেছে, আমি আসছি।”
মহামোহনানন্দের সেই পুরনো শ্লোকগুলো ভেসে ওঠে রুদ্রের স্মৃতিতে—
“অষ্টভয়ার মেলবন্ধনে, দেবী আত্মা ফিরে পাবে দেহ। নারী ছায়ার মধ্যে শ্বাস ফিরবে অনন্ত।”
সেই শ্লোকে বেঁধে আটজন নারী একে অপরের হাত ধরে চক্র তৈরি করে। বুলবুলি যিনি নিস্তব্ধতার ভয়কে জয় করেছেন, সে বলল, “আমরা আর ভয়ে থাকব না। আমরা হব জীবন্ত।”
অন্যদিকে মেঘলা তার আঁকা স্বপ্নময় রং তুলে ধরা শুরু করল মন্দিরের দেয়ালে। প্রতিটি রঙ যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, বর্ণের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয় মায়া ও শক্তি।
সায়ন্তিকা বলল, “আমি শিখেছি বিশ্বাস ঘাতকতা নয়। বিশ্বাস নিজেকে ভালোবাসার নাম।”
ঈশিতা, যিনি স্পর্শভীতি থেকে মুক্ত, একে একে সবাইকে স্পর্শ করে বলল, “স্পর্শই তো শক্তি।”
রিমঝিম হাসে, “আমরা ভয়েরই আঁকা, কিন্তু আর ভয় নই।”
নীলাঞ্জনা, চুপচাপ মাথা নেড়ে বলে, “আমরা নিজেরাই দেবী।”
মাতঙ্গীর মূর্তি ধীরে ধীরে আলোর মাঝে উজ্জ্বল হতে থাকে। কাপড় খুলে যায়, চোখ খুলে যায়, ত্রিশূল হাতে ধরা দেবী এখন শুধু ছায়া নয়, শক্তির প্রতীক।
দেবী বলে, “তোমরা ভয়ের বন্ধন থেকে মুক্ত। তোমরা নিজেরা শক্তি। আমি শুধু পথপ্রদর্শক।”
সেই সাথে, মন্দিরের গোপন ঘরের দেয়ালে একটা নতুন আলোকছটা ফুটে ওঠে।
ছায়ায় নয়, জীবন্ত আলোয়—নারীর আকার ধারণ করে, আর সে ছায়াকে ছুঁয়ে বলছে,
“এখন থেকে ভয় নয়, আশা তোমার সঙ্গী।”
রুদ্র সবাইকে দেখে, বলে, “এই হলো নাটকের সত্য অর্থ—ভয়কে জয়ের রূপ দেওয়া।”
রাত্রি শেষে তারা সবাই একত্রিত হয়ে বলল, “আমরা আর ভয়ে বেঁচে থাকব না।”
বিষ্ণুপুরের মন্দির গোপন ঘর থেকে তাদের পায়ের আওয়াজ বেরিয়ে এলো, একটি নতুন দিনের সূচনা।
পর্ব ৮: ছায়ার গোপন কান্না
রাত্রির নীরবতা যখন বিষ্ণুপুরের মন্দিরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন মন্দিরগৃহের ভিতরকার বাতাস যেন আরও ঘন ও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। দেবীর শ্বাসের প্রতিধ্বনি এখনও বাতাসে মিশে আছে, কিন্তু আটজন নারীর চোখে যেন এক নতুন ছায়া নেমে এসেছে — এক অদ্ভুত, অন্তর্দ্বন্দ্বের ছায়া।
সেই ছায়ার নাম ছিল ‘বিস্মৃতির কান্না’।
রিমঝিমের শরীর থেকে যে যন্ত্রণা আর আঁচড়গুলো ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে, তার মাঝে এক গভীর পিছুটান লুকিয়ে আছে। তিনি বুঝতে পারছিলেন, যতই নিজের ভয়ের মুখোমুখি হন, কিছু কিছু স্মৃতি রয়েছে যা ভুলে যাওয়া যায় না, যা চেপে রাখা যায় না।
রাত্রি বেলা মন্দিরের গোপন করিডোরে বসে রিমঝিম একাকী চিন্তায় ডুবে ছিল। আকাশের নীচে বিশাল একটি ছায়ার মতো সে নিজেকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তার চারপাশে মায়া আর মন্দিরের প্রাচীরের মধ্যে এক রহস্যময় কাঁপন।
সেই মুহূর্তে, বুলবুলি তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “এই ছায়া আমাদের সঙ্গী। ছায়াকে যদি চিরতরে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি, তাহলে তুমিও হারিয়ে যাবে। আমাদের ভয়গুলোই তো আমাদের জীবন। ছায়ার মতো আমরা।”
রিমঝিম মাথা নেড়ে বলল, “আমি জানি, কিন্তু কখনো কখনো ছায়ার মধ্যে কান্না লুকিয়ে থাকে। আমি সেই কান্না শুনতে চাই।”
“তাই বললাম, আমরাই ছায়া, আমরাই আলো,” বুলবুলি ধীরে হাসল। “আমাদের ভেতর থেকেই জন্ম নেয় শক্তি।”
অন্যদিকে, সায়ন্তিকা তার ফোনে বার বার সেই অজানা নম্বর থেকে কল পাচ্ছিল, যার ফোন স্ক্রিনে দেখাত ‘অজানা’। সে কল ধরত না, কিন্তু বার্তা আসত, এক লাইন — “ভয়কে পরাজিত কর, বিশ্বাসকে ফিরিয়ে আন।”
সায়ন্তিকা কানে ফিসফিস শুনল, “তুই আর পালাতে পারবি না। বিশ্বাস ছাড়া এই পথ শেষ।”
সে এক সময় বিশ্বাস করত যে, সে একা। কিন্তু এখন সে বুঝল, সে নয়। তার চারপাশে আটটি নারী — আটটি ভয়ের গল্প। আর সেই গল্পগুলোই একত্রে মাতঙ্গীর রূপ দিচ্ছে।
মেঘলা তার আঁকা স্বপ্নগুলো আবার ধরে নিল। প্রতিটি রঙের ফোঁটা যেন জীবনের টানাপোড়েন। সে জানত, ভয় আর শক্তি একসঙ্গে থাকে। তার আঁকা স্বপ্নগুলো কেবল ক্যানভাসের উপর নয়, মন্দিরের দেয়ালে জীবন্ত হয়ে উঠল।
রুদ্র মেঝেতে বসে সেই পুরনো পুঁথি খুলে দেখছিল। এক পৃষ্ঠা ছিল ভেঙে ফেলা, ঝাপসা, কিন্তু সেখানে লেখা ছিল—
“অষ্টভয়ার অন্তর্গত নারীরা একে অপরের প্রতিফলন। যাঁরা একে অপরকে স্বীকার করে, তারা দেবীর আসন পূর্ণ করে। যারা না, তারা হারিয়ে যায় ছায়ার নিচে।”
এই কথা শুনে তারা বুঝতে পারল, শেষ বাধাটা ছিল একে অপরকে গ্রহণ করা। প্রতিটি নারীর ভেতরে ছিল ভয় আর বিশ্বাসের লড়াই, আর তাদের একতা হলে মাতঙ্গী দেবীর পূর্ণ আত্মা জেগে উঠবে।
নীলাঞ্জনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমরা একা নই, আমরা সবাই একসাথে। আমার ভয় আর তুমাদের ভয়, মিলেই তো আমরা শক্তি।”
দিব্যা মাথা নেড়ে বলল, “এই ছায়া আমার নয়, তোমাদের। আমি শুধু তাদের পথ দেখাই।”
রাত্রির শেষ প্রহরে তারা সবাই একে অপরের হাত ধরে এক চক্রে দাঁড়িয়ে বলল—“আমরা ভয়ের মাঝেও আছি, আমরা বিশ্বাসের সাথে আছি। আমরা মাতঙ্গী।”
মন্দিরের ভেতর থেকে এক গভীর গুঞ্জন উঠল, বাতাস কাঁপল, আর দেবীর মুখ হাসল এক শান্ত মুখাবয়বে। এই হাসিই ছিল মুক্তির সংকেত।
সেই হাসির সাথে, ভয় আর বিশ্বাস মিলিয়ে গেল এক অসীম শক্তিতে। মন্দিরের গোপন ঘর থেকে আলো ফুটে উঠল, যা চারপাশে ছড়িয়ে গেল নতুন দিনের আশায়।
পর্ব ৯: দেবী এবং মানব
বিষ্ণুপুরের মন্দিরের গোপন ঘরের আলো আস্তে আস্তে নিভে গেল। আটজন নারী এখন এক এক করে তাদের নিজের ভীতির মুখোমুখি হতে শুরু করল। রুদ্র সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করল, যেন তাদের চোখে এক অদ্ভুত নতুন দৃঢ়তা এবং একান্ত আত্মসমর্পণের ছাপ ফুটে উঠেছে। আর সেই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই শুরু হল দেবী মাতঙ্গীর চূড়ান্ত জাগরণ।
নীলাঞ্জনা প্রথম এগিয়ে এল। সে বলল, “আমি আজ বুঝেছি, আমার ভয় আমার নিজেকে অস্বীকার করার—তাই আমি নিজেকে কখনো ভালোবাসিনি। কিন্তু আজ আমি নিজেকে গ্রহণ করছি, আমার ভেতরের অন্ধকারকে আলোকিত করছি।”
তার হাত অন্যদের দিকে বাড়িয়ে দিল। প্রত্যেক নারী একে একে সেই হাত ধরল। মেঘলা বলল, “আমার আঁকা স্বপ্নগুলো যে শুধু রং নয়, সেটা আমি আজ বুঝেছি। এগুলো আমার হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি।”
সায়ন্তিকা বলল, “আমার বিশ্বাস যে ভেঙে গেছে, সেটাই আমার শক্তি হয়ে উঠবে, আমি আর ভাঙ্গব না।”
রিমঝিম চুপচাপ দাঁড়িয়ে একবার আকাশের দিকে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আমি সেই নারী, যিনি ছায়ার মধ্যে বাস করত। আজ আমি ছায়াকে আলোর রূপে রূপান্তর করছি।”
দিব্যার চোখে অশ্রু ঝরে পড়ল, “আমি সেই নারী, যিনি জীবনের শেষ দিক দিয়ে বেঁচে ফিরে এসেছি। আমি নিজের ভেতর দেবীর রূপ খুঁজে পেয়েছি।”
ঈশিতা বলল, “স্পর্শ আমার ভয় ছিল, এখন স্পর্শই আমার শক্তি।”
বুলবুলি যার নিস্তব্ধতার ভয় ছিল, বলল, “নিস্তব্ধতাতেই আমার শক্তি রয়েছে। আমি সে শক্তি গ্রহণ করছি।”
তৃষা, যার ছায়ার ভয় ছিল, বলল, “আমি ছায়াকে ভয় পাই না, আমি তার সঙ্গী।”
রুদ্র তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা সবাই আজ মাতঙ্গীর আসন পূর্ণ করেছ। তুমি, দেবী, তোমার শক্তি দিয়েই এই নারীজীবনের সকল ভয়ের অবসান ঘটাবে।”
মন্দিরের দেয়ালে আরেকবার ভেসে উঠল মাতঙ্গীর মূর্তি। এবার সে এক জীবন্ত সত্তায় পরিণত হয়েছিল, যার দৃষ্টি সকল ভয়ের উপরে, আর হাসিতে ছিল মুক্তির প্রতিশ্রুতি।
মন্দিরের বাইরে বৃষ্টি থেমে গেল, সূর্যের কিরণ আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। বিষ্ণুপুরের সকাল নতুন আলোয় জেগে উঠল।
রুদ্র ধীরে ধীরে আটজন নারীর মাঝে দাঁড়িয়ে বলল, “আজ থেকে তোমরা শুধু নারী নও, তোমরা মাতঙ্গীর দাসী, ভয়ের জয়ী। এই ভয় আর বিশ্বাসের লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে মানব।”
তারা সবাই একসঙ্গে বলল, “আমরা দেবীর শক্তি, আমরা মানব, আমরা মুক্ত।”
মন্দিরের গোপন ঘরে থেকে তারা বেরিয়ে এল, বিশ্বকে জানাতে যে ভয় আর বিশ্বাস দুটোই মানুষের অংশ, আর দুটোই জয় করতে হয় একসঙ্গে।
রুদ্র শেষবার তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের গল্প আর শেষ হয়নি, বরং নতুন সূচনা হলো।”
আটজন নারী মিলে বিষ্ণুপুরের পথে হাঁটতে লাগল, হাতে হাতে আগুন জ্বেলে, ভয়ের অন্ধকারে আলোর দিশারি হয়ে।
পর্ব ১০: মাতঙ্গীর মুক্তি
বিষ্ণুপুরের মন্দিরের গোপন ঘরের দরজা আজ ভোরের কুয়াশায় খুলে গেল, যেন এক যুগান্তের পর নতুন আলো ফোটে। আটজন নারী একত্রে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের চোখে ছিল আত্মবিশ্বাস আর মুক্তির দীপ্তি। এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে আর কোনও ভয়, কোনও অন্ধকার ছিল না। তারা আজ পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠেছিল — মাতঙ্গী দেবীর শক্তি হয়ে।
রুদ্র একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকাল। মনে হল, যেন আজকের এই দিন শুধু তাদের নয়, পৃথিবীর সবার জন্য এক নতুন সূচনা।
প্রথমেই কথা বলল নীলাঞ্জনা, যে আগে আত্মবিশ্বাসহীন ছিল।
“আমার ভেতর যে শক্তি লুকিয়ে ছিল, আজ তা মুক্তি পেয়েছে। আমি বুঝেছি, ভয় মানেই আমার অসম্পূর্ণতা নয়, বরং সেটাই আমার বিকাশের জায়গা।”
মেঘলা, যার আঁকা স্বপ্নগুলো মন্দিরের দেয়ালে ঝলমল করছিল, বলল,
“আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটি গল্প আছে, যার রং আমাদের ব্যক্তিত্বের ছাপ। আজ সেই গল্পগুলো মুক্তি পেল।”
সায়ন্তিকা বলল, “ভুলে যাওয়া বিশ্বাসগুলো ফেরাতে পারা কঠিন ছিল, কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি, বিশ্বাস হলো শক্তির জন্ম।”
রিমঝিম, যার শরীরে আঁচড়ের দাগ মুছে গিয়েছে, হাসতে হাসতে বলল, “আমি আর ছায়ার মধ্যে আটকে নেই, আমি নিজেই আমার আলো।”
দিব্যা বলল, “জীবনের শেষ দিকের কষ্ট আমাকে আজকের শক্তি দিয়েছে। আমি ভয়ের থেকে মুক্ত।”
ঈশিতা স্পর্শ করল সবাইকে, বলল, “আমাদের স্পর্শই আমাদের শক্তি।”
বুলবুলি বলল, “নিস্তব্ধতার মাঝে আমি আমার শক্তি খুঁজে পেয়েছি।”
তৃষা, যার ভয় ছিল ছায়া, বলল, “আমি ছায়াকে আমার বন্ধু করেছি।”
রুদ্র বলল, “এখন তোমরা মাতঙ্গীর আসন পূর্ণ করেছ, দেবী হয়ে ওঠার পথে তোমাদের ভয়ের গ্লানি আর অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে।”
মন্দিরের মাঝখানে সেই বিশাল প্রতিমা আজ স্রোতের মত জ্বলে উঠল। তার চোখ খুলে গেল, মুখে ভোলানো হাসি ফুটে উঠল, যেন সে ভয়কে হারিয়ে এক নতুন মুক্তির বার্তা দিচ্ছে।
মহামোহনানন্দের কাগজে লেখা সেই শ্লোকগুলো ভেসে উঠল—
“যখন অষ্টভয়ার ভয় মিশে একত্র, মাতঙ্গী সুরুচিতে জাগ্রত হয়। নারীর শক্তি হয় সর্বত্র, মুক্তির গান গায় বিশ্ব।”
বিষ্ণুপুরের বাতাসে একটি নতুন গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল—ভয়ের শেষ, আশার শুরু।
রুদ্র মৃদু হাসল, “তোমরা শুধু দেবী নও, তুমি সেই মানব যিনি ভয়কে জয় করেছ।”
তারা মন্দির থেকে বেরিয়ে আসল। বাইরে সূর্য হাসতে হাসতে উঠছিল, আর বিষ্ণুপুরের চারপাশে ফোটা ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল।
সেই দিন থেকে আটজন নারী প্রতিটি শহরে গেল, তাদের গল্প বলল — ভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই, বিশ্বাসের শক্তি, এবং মাতঙ্গীর মুক্তি।
নীলাঞ্জনা হয়ে গেল এক সমাজকর্মী, যিনি নারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ান।
মেঘলা আর্টিস্ট হিসেবে ভয়ের মধ্য দিয়ে জীবনের রং ফুটাল।
সায়ন্তিকা শিক্ষক হয়ে শিশুদের বিশ্বাস শেখাল।
রিমঝিম নাট্যকার হিসেবে ভয়ের গল্প বলল, যা মানুষকে মুক্তি দিল।
দিব্যা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করল, যারা জীবনের গহীনে হারিয়ে গেছে তাদের সাহায্য করল।
ঈশিতা স্পর্শতন্ত্রের বিশেষজ্ঞ হয়ে মানুষকে সংবেদনশীল করল।
বুলবুলি নিস্তব্ধতার শক্তি বোঝাল।
তৃষা ছায়া-অনুভূতির মাধ্যমে মানুষের ভেতর অন্ধকারকে আলোর রূপ দিতে শিখল।
রুদ্র তাদের পাশে থেকে গল্পের রচনাকেই জীবনের কাজ বানিয়ে নিয়েছিল।
মাতঙ্গী দেবীর সেই গোপন শক্তি আজ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ছে। ভয় আর বিশ্বাসের ঐ অমোঘ যুদ্ধে মানবতা শিখেছে — বাঁচার আর জয়ী হওয়ার গল্প।
মন্দিরের গোপন ঘরে আজ আর অন্ধকার নেই।
শুধু আছে আলো,
শুধু আছে স্বপ্ন,
শুধু আছে নারী শক্তির মহিমা।
সম্পূর্ণ