অলীক ছায়ার ঘর
রোজকার আলোচ্য বিষয়ের বাইরে
কলকাতার একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট, বালিগঞ্জের গলিতে। জানালার পাশে বসে শিউলি তাকিয়ে থাকে একঘেয়ে আকাশের দিকে। মেঘ জমেছে, কিন্তু বৃষ্টি আসে না। যেমন তার জীবনে জমেছে ক্লান্তি, কিন্তু উপশম নেই।
দশ বছর হয়ে গেল বিয়ের। রঞ্জনের সঙ্গে একসময় প্রেম ছিল, হাতে হাত রেখে সিনেমা দেখা, ট্রামে চেপে লেকের ধারে হাওয়া খাওয়া। এখন সেইসব স্মৃতি যেন পুরোনো কাপড়—আছে, কিন্তু ব্যবহার হয় না।
রুটিনে বেঁধে গেছে জীবন। সকালে উঠে রান্না, অফিস, বিকেলে ফিরে টিভির আওয়াজ, রাতে নিঃশব্দ বিছানা।
রঞ্জন বলে,
— “আজ আবার টিফিনে ঝোল কম ছিল।”
শিউলি মৃদু হেসে বলে,
— “তুমি তো এমনিতেও কম খাও।”
এই রকম সংলাপে গড়ে ওঠে ওদের প্রতিদিন। কথা আছে, তবু কোথাও যেন চুপচাপ শূন্যতা জমে।
একদিন অফিসে এল নতুন একজন—সৃজন। বয়সে কিছুটা ছোট, চেহারায় খুব চটকদার কিছু নেই, কিন্তু চোখদুটো অদ্ভুতরকম গভীর। যেমন করে সে তাকায়, তেমন করে কেউ তাকায় না আর।
দুপুরে ক্যান্টিনে বসে শিউলি প্রথম আলাপ করে সৃজনের সঙ্গে। কথায় কথায় বোঝা যায়, বই পড়ে, গান শোনে, রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসে।
সেদিন চা খেতে খেতে শিউলি বলে,
— “তোমার চোখে কিছু আছে। ঠিক যেন বুঝতে পারো কে কী বলতে চায়।”
সৃজন একটু হেসে বলে,
— “আমি শুনি। এই সময় মানুষ কথা বলে অনেক, শোনে কম।”
এই একটা বাক্য শিউলির মনে এমনভাবে ধাক্কা দেয়, যেন কেউ তার দীর্ঘদিনের জমে থাকা কষ্টগুলো বুঝে ফেলেছে।
রাত্রে বাড়ি ফিরে সে খেয়াল করে, আজ রঞ্জনের সঙ্গে একটাও ব্যক্তিগত কথা হয়নি। শুধু খাবার, অফিস, গ্যাস বিল—এই সব জরুরি তথ্য আদানপ্রদান।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে রঞ্জন বলে,
— “কাল টিফিনে একটু ভেজা চপ দিও, ভালো লাগছিল।”
শিউলি জানে, সে টিফিনের কথা মনে রাখবে। কিন্তু মনে রাখবে না আজকের সকাল, বিকেল কিংবা তার হাসির অর্থ।
মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ আসে সৃজনের একটা মেসেজ—
“আজ তোমার চোখে খুব কথা ছিল, তুমি চুপ ছিলে কেন?”
শিউলি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে।
তারপর টাইপ করে—
“সব কথা তো মুখে বলা যায় না। কেউ বুঝলে তবেই বলা হয়।”
সেই রাতে ঘুম আসে না সহজে।
জানালার কাচে জমে থাকা শিশিরের দিকে তাকিয়ে সে ভাবতে থাকে—কারও সঙ্গে হয়তো সত্যিই কথা বলা যায়, শুধু চোখে চোখ রেখে।
আর সেই প্রথম সন্ধ্যায় শিউলি বুঝতে পারে—জীবন কেবল একফালি সংসার না, মাঝে মাঝে দরকার হয় একফোঁটা বোঝাপড়ার।
প্রথমবার কাঁপলো ভিতরটা
সপ্তাহখানেক কেটে যায়। সৃজন আর শিউলির মধ্যে কথাবার্তা বাড়তে থাকে। অফিসে বসে কখনও ক্লায়েন্ট প্রেজেন্টেশনের ফাঁকে, কখনও ক্যান্টিনে রোদমাখা দুপুরে দুটো চায়ের কাপের পাশে জমে ওঠে গল্প। কথা হয় সিনেমা নিয়ে, সাহিত্যের চরিত্র নিয়ে, আবার নিঃশব্দ শূন্যতা নিয়েও।
একদিন ছুটির দুপুরে, সবাই যখন ছুটির খোশগল্পে ব্যস্ত, সৃজন বলে,
— “চলো, একটা নতুন জায়গায় যাই। এখানে বড্ড শব্দ।”
শিউলি একটু হকচকিয়ে যায়, তারপর জিজ্ঞেস করে,
— “কোথায়?”
— “কাছেই। এক ছাদবাগান ক্যাফে। শান্ত, বইয়ের গন্ধ পাওয়া যায়।”
শিউলি ভাবে, ঠিক বা ভুল নিয়ে ভাবার সময় এই জীবনে কবে পেয়েছে? শুধু অনুভবে ডুবে গিয়ে বলে—“চলো।”
ক্যাফেটা সত্যিই চমৎকার। ছাদের ওপরে বাঁশের ছাউনিতে সাজানো কয়েকটা টেবিল, কোণে কোণে বইয়ের তাক, আর ফাঁকে ফাঁকে ঝোলানো বাতির আলো। সেই আলোয় সৃজনের মুখটাও যেন অন্যরকম লাগে।
তারা বসে। সৃজন তাকিয়ে থাকে শিউলির দিকে কিছুক্ষণ।
— “তুমি জানো, তোমার চোখে একটা ভীষণ চেনা বিষণ্নতা আছে?”
শিউলি অবাক হয়। হাসে।
— “সবাই শুধু বলে আমি হাসি না। তুমি প্রথম বললে, বিষণ্নতা আছে।”
সৃজন বলে না কিছু, শুধু হাতে তুলে দেয় একটা বই—জয় গোস্বামীর কবিতাসংকলন।
একটা পাতা খুলে পড়ে শোনায়:
“তুমি জানো, আমি কী ভয় পাই?
ভালোবাসা নয়—ভালোবাসার পেছনের নিঃসঙ্গতাটাই সবচেয়ে ভয় পাই।”
এই চারটি লাইন যেন শিউলির ভিতরের পর্দা ছিঁড়ে দেয়।
সে বুঝতে পারে, এই মানুষটা শুধু কথা বলেনি, সে তাকে পড়েছে। যেমন করে কেউ ডায়েরি পড়ে রাতের বেলায়।
চা ঠান্ডা হয়ে আসে। আলো নেমে আসে ক্যাফের কোণে। তারা ওঠে। সৃজন কোনো কথা না বলে একবার হালকা করে শিউলির হাত ছুঁয়ে দেয়—শুধু এক মুহূর্ত।
শিউলি চমকে ওঠে, কিন্তু হাত সরায় না।
এই স্পর্শে নেই কোনো লোভ, কোনো মালিকানা। শুধু একরকম নিশ্চয়তা—”আমি আছি, আমি শুনি, আমি বুঝি।”
রাত্রে বিছানায় শুয়ে শিউলি অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকে। পাশেই রঞ্জনের নিঃশব্দ ঘুম, টিকটিকির ডাক, আর মাঝেমধ্যে বাইরের গাড়ির শব্দ।
কিন্তু শিউলির মনে বাজে কবিতার সেই চার লাইন। আর মনে পড়ে সেই এক মুহূর্তের স্পর্শ।
ভেতরের জমে থাকা কষ্ট হঠাৎ এক ফোঁটা উষ্ণ হয়ে গলে যেতে চায়।
সে ভাবে—ভালোবাসা আবার আসে?
না, শুধু মনে হয় আসছে?
নীল আলোয় গল্পগুলো গাঢ় হয়
শিউলির জীবনে একটা ছায়া নেমে এসেছে, কিন্তু সেটা গা ছমছমে নয়—শান্ত, কোমল, উষ্ণ। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার মধ্যে এখন একরকম আগ্রহ, যেমন ক্লাস সেভেনের স্কুলে প্রথম প্রেমিকের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় হত।
সৃজন আর শিউলি অফিসে একসঙ্গে চা খায়, প্রেজেন্টেশনের পর খুদে মন্তব্যে হাসে, কখনও শুধু চোখে চোখ রেখে বোঝে, “আজ ভালো লাগছে না।”
তারা নিজেদের ঘিরে একটা অদৃশ্য বলয় তৈরি করে—যেখানে আর কেউ ঢুকতে পারে না।
একদিন, হঠাৎ করে অফিসে ঘোষণা হয়—পরদিন একটা জরুরি মিটিং বাতিল। ফলে একটা ফাঁকা দুপুর।
সৃজন বলে,
— “চলো, একটা জায়গায় নিয়ে যাই। যেখানে কথার চেয়ে নীরবতাই বেশি দামি।”
রবীন্দ্র সরোবর। শীতের দুপুর, পাতাঝরা গাছের ছায়া, চারপাশে নীল আকাশের প্রতিবিম্ব।
তারা হাঁটে ধীরে ধীরে, একসঙ্গে—কিন্তু হাতে হাত নয়। শুধু পায়ের ছায়া গায়ে পড়ে।
একটা নির্জন বেঞ্চে বসে সৃজন হঠাৎ করে বলে,
— “তুমি জানো, আমি বহুদিন কারো সঙ্গে বসে চুপ থাকতে পারিনি।”
শিউলি মৃদু হেসে বলে,
— “তোমার সঙ্গে চুপ থাকাও অনেক কথা বলে।”
হঠাৎ করেই, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই, সৃজন তার হাতটা ধরে ফেলে।
ধরা বললে ভুল হবে, যেন ছুঁয়ে দেখে সে সত্যি আছে কিনা।
শিউলি কেঁপে ওঠে প্রথমে, কিন্তু হাতটা সরায় না।
এই স্পর্শে কোনো জোর নেই, দাবি নেই।
এটা ঠিক যেন এমন এক ভাষা, যা মুখে নয়, হাতে লেখা হয়।
সেই মুহূর্তে শিউলি বুঝে যায়—সে এক নিষিদ্ধ পথ বেছে নিচ্ছে।
তবু তার ভিতরের ঘরে একটা আলো জ্বলে ওঠে—আলো, যা তার বহুদিনের অন্ধকারের সঙ্গে কথা বলে।
রাত্রে ফিরে শিউলি চুপচাপ বসে থাকে বারান্দায়।
রঞ্জন তখন ঘরে বসে নিউজ দেখছে।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে শিউলি ভাবে, মেসেজ করবে কি না।
তার আগেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে—
সৃজন: “তোমার হাতের উষ্ণতা এখনও আমার আঙুলে লেগে আছে।”
শিউলি শুধু উত্তর দেয়—
“এই উষ্ণতা বহুদিন পর অনুভব করলাম।”
তারা জানে না কোথায় যাচ্ছে এই গল্প, কী নাম হবে এই সম্পর্কে।
তবে এটুকু বোঝে—এই পথের ধারে তারা দুজন, নীরবতাকে আশ্রয় করে হাঁটছে।
পালানোর অভ্যেস
শিউলির প্রতিদিনের জীবন এখন যেন দুটি জগতে বিভক্ত। একদিকে সংসারের চেনা রুটিন—রঞ্জনের একঘেয়ে চাহনি, খাওয়া-দাওয়া-চুপচাপ রাত; আর অন্যদিকে এক নতুন আলোয় ভরা অচেনা পথ—সৃজনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া অনুভব, চায়ের কাপের পাশে জমা হওয়া চুপচাপ কথাগুলো।
এখন শিউলি অফিস যাওয়ার আগে একটু বেশি সময় নেয় আয়নার সামনে।
একটা হালকা কাজ করা শাড়ি, সামান্য কাজল, হালকা লিপস্টিক—এসব যেন কারও জন্য না হয়েও, কারো নজরের অপেক্ষায়।
একদিন সে অফিসে নিয়ে যায় তার নিজের হাতে বানানো লুচি-আলুর দম। ছোট বক্সে, শুধু সৃজনের জন্য।
সৃজন খেতে খেতেই বলে,
— “তোমার রান্নায় একটা ঘরের গন্ধ আছে।”
শিউলি চমকে ওঠে।
— “ঘরের গন্ধটা তো অনেকদিন কেউ খুঁজে পায়নি।”
সেই দিন থেকে শিউলির মধ্যে এক নতুন অভ্যেস গড়ে ওঠে—ছোট ছোট যত্নে, ছোট ছোট খেয়ালে সে সৃজনের জন্য বাঁচে।
রাতের ঘুমের ফাঁকে ফাঁকে ফোনে এক লাইন করে কথা, কবিতার ছবি, কিংবা নিঃশব্দ ইমোজির ভেতর গোপন আদানপ্রদান।
তবে সেই আনন্দের ভিতরেও একটা অপরাধবোধ ক্রমশ জমে।
রঞ্জনের মুখ মনে পড়ে, তার উদাস চোখ, আর নিস্তরঙ্গ ভরসা।
সে ভাবে—সে কি ভুল করছে?
কিন্তু সেই ভাবনার মধ্যে সৃজন একটা মেসেজ পাঠায়—
“তুমি থাকলে আমি একটু সহজ হয়ে যাই।”
শিউলি উত্তর দেয়—
“তোমার সঙ্গে থাকলে আমি নিজেকে ভুলে যাই। আবার নিজেকে ফিরে পাই।”
সেই দ্বন্দ্ব, সেই চুপিচুপি কথা, সেই দুপুরে দেখা বা অকারণে ফোন করা—সবকিছুই একধরনের পালানো।
না, স্বামীকে ঠকানোর পালানো নয়।
এ একরকম নিজেকে আগলে রাখার চেষ্টা।
যেখানে শিউলি কোনো স্ত্রী নয়, কোনো কর্তব্য নয়—সে শুধুই মানুষ।
তবে সমাজ কি তা বোঝে?
পাশের সহকর্মীরা যখন সৃজন আর শিউলির দিকে একটু বেশি নজর দেয়, শিউলি একটু সতর্ক হয়।
একদিন এক কলিগ বলে বসে—
— “তোমাদের কেমিস্ট্রি কিন্তু অফিশিয়ালি দৃশ্যমান হয়ে গেছে।”
শিউলি হাসে, কিছু বলে না। ভিতরে এক অজানা কাঁপুনি।
তবে সৃজন বলে—
— “সবাই জানলে কী হবে? আমি তো জানি, আমার সবটুকু তুমি।”
শিউলি কিছু বলতে পারে না, কিন্তু মনে মনে ভাবে—
এই ‘সবটুকু’র দাবি কি তার কাছে সত্যিই স্বস্তির?
না, এও কি নতুন এক বন্ধন?
যখন ভালোবাসাও দম আটকায়
একদিন অফিস শেষে সৃজন হঠাৎ বলে বসে—
— “শিউলি, তুমি রঞ্জনের সঙ্গে আর কতদিন এভাবে থাকবে?”
শিউলি চুপ করে থাকে।
সৃজন আবার বলে,
— “তোমার সঙ্গে প্রতিটা মুহূর্ত আমি ভাগ করে নিতে চাই। শুধু গোপনে নয়—পূর্ণভাবে, প্রকাশ্যে।”
শিউলি এবার মুখ তুলে তাকায়।
— “তুমি কি বলতে চাইছো আমি রঞ্জনকে ছেড়ে দিই?”
— “হ্যাঁ। আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি।”
এই কথাগুলো শিউলিকে যেন এক চমকে দেয়।
তাকে আজ অবধি কেউ এমন সরাসরি দাবি করেনি।
সে চেয়েছিল একটু নিরাপত্তা, কিছু বোঝা, কেউ একজন যে শুনবে।
কিন্তু এখন? সৃজন একটা ভবিষ্যৎ চায়—একটা স্থায়ী পরিচয়, যেখানে সে প্রেমিক নয়, স্বামী হবে।
শিউলি জানে, ভালোবাসা কখনও কখনও খুব ভারী হয়ে ওঠে।
একটা সম্পর্ক শুরু হয় হাওয়ার মতো হালকা হয়ে, তারপর ধীরে ধীরে ঘন হয়ে ওঠে।
এখন সৃজন তাকে ভালোবাসার নামে নতুন এক শৃঙ্খলে বাঁধতে চাইছে।
সে ভাবে—তবে কি এই সম্পর্কও আবার নিয়মে ঢুকে পড়বে?
ভালোবাসা কি কখনও কেবল নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা হয়ে থাকতে পারে না?
সেদিন রাতে শিউলি রঞ্জনের পাশে শুয়ে, অনেকদিন পর প্রশ্ন করে—
— “তোমার কি কখনও মনে হয় আমাদের মাঝে কিছু নেই?”
রঞ্জন বিরক্ত হয়, চোখ না তুলে বলে,
— “সবকিছু কি প্রতিদিন ভাবতে হয়? জীবনটা কি সিনেমা নাকি?”
এই উত্তরটা শিউলি আগেও পেয়েছে, কিন্তু আজ যেন আরও বেশি খালি লাগে।
সে বুঝে যায়, এই মানুষটা তার একঘেয়েমির অংশ হয়ে গেছে।
তবে তার মানে কি সে সৃজনের দেওয়া নতুন সম্পর্ককে বেছে নেবে?
শিউলি জানে না।
সে শুধু জানে, সে আর কোনো শিকল চায় না।
ভালোবাসা যদি স্বাধীনতা না দেয়, তবে সে ভালোবাসা তার দরকার নেই।
পরদিন সকালে সৃজন আবার প্রশ্ন তোলে—
— “আমরা কবে একসঙ্গে হব?”
শিউলি বলে না কিছু। শুধু বলে—
— “একসঙ্গে থাকা মানেই কি ভালোবাসা বাঁচে?”
সৃজন স্তব্ধ হয়ে যায়।
শিউলি বুঝে যায়—এ সম্পর্কেও ভাঙন আসছে।
কিন্তু এবার আর ভয় করে না।
ভালোবাসা যদি দাবির নাম হয়, তবে তার কাছে নিঃশব্দ অভ্যন্তরীণ ভালোবাসাই শ্রেয়।
যে রাত ভোর হতে চায় না
সপ্তাহটা কেটে যায় ভারী নীরবতায়।
শিউলি আর সৃজনের মধ্যে কথাবার্তা হয় ঠিকই, তবে সেই সহজস্বভাব, নির্ভার ভঙ্গিমা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে।
শব্দের ফাঁকে ঢুকে পড়ে দাবি, চাহিদা, ভবিষ্যতের চিন্তা।
এক শুক্রবার বিকেলে সৃজন ফোন করে—
— “তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য একটা শহর ছেড়ে আসতেও পারি।”
শিউলি চুপ করে থাকে।
সৃজন তখন বলে,
— “চলো না, একদিন কোথাও যাই। খুব দূরে নয়, শুধু একটু নির্জনে।”
পরদিন তারা চলে যায় শহরের প্রান্তে, গঙ্গার ধার ঘেঁষে ছোট্ট একটি রিসর্টে।
নাম ‘আকাশপাতা’।
পাহাড়ঘেরা, পাখির ডাক, আর নরম হাওয়া। চারদিকে একটা অদ্ভুত শান্তি।
বিকেলের আলোয় ঘরের বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে সৃজন বলে—
— “তোমাকে আমি একটা ঘরের মতো ভাবি। নিরাপদ, মৃদু, উষ্ণ। তুমি যদি সঙ্গে থাকো, আমি বাকি জীবন আর কিছু চাই না।”
শিউলি মুখ ফিরিয়ে তাকায়।
— “তুমি কি সত্যিই জানো তুমি কী চাইছো? নাকি তোমার চাওয়াটাও একটা অনুভূতির পাল্টা দাবি?”
সৃজন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
— “আমি চাই শুধু তুমি থাকো। সেইভাবে, যেভাবে থাকলে আর লুকোতে হবে না।”
সেই রাতে, রিসর্টের ঘরে, শিউলি আর সৃজন একে অপরের আরও কাছাকাছি আসে।
শরীরের মধ্যেও যেন জমে থাকা দুঃখের বরফ গলে যায়।
তবে তার চেয়েও বেশি কিছু হয়—একটা দীর্ঘ নিরবতা, যেখানে কেউ কাউকে অধিকার করে না, শুধু অনুভব করে।
রাত গভীর হয়। বাতাস ভারী হয়ে আসে।
চাঁদের আলোয় শিউলি দেখে সৃজন ঘুমিয়ে পড়েছে।
সে জানে, এই মুহূর্তই চিরকাল থাকবে না।
ভোর হতেই তারা ফিরে যাবে নিজ নিজ জীবনে—দায়িত্ব, প্রশ্ন, হিসেবের খাতা।
শিউলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবে—এই রাত কি সে ধরে রাখতে পারত?
একটি রাত, যা কোনো নাম চায় না, কোনো সম্পর্ক নয়, শুধু এক নির্ভেজাল সত্যি।
সেই সত্যি, যা সকালে উঠে বালিশে দেখা যায় না।
সেই সত্যি, যা মনে থেকে যায় এক অদৃশ্য গন্ধের মতো।
রোদের নিচে নিজেকে দেখা
রবিবারের সকাল।
কলকাতার আকাশে আজ ধোঁয়ামেঘ নেই, কুয়াশা নেই, কেবল একটা পরিষ্কার রোদ—যেমন শিউলির ভিতরে জমা হওয়া কুয়াশাও এক এক করে সরে গেছে।
ছাদের টবে গাঁদার ফুল ফুটেছে।
শিউলি সেই ফুলে পানি দেয়, আঙুল দিয়ে পাপড়ি ছুঁয়ে দেখে।
এই ছোঁয়া কারও নয়, শুধুই নিজের জন্য।
মোবাইলটা আজ অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল।
হঠাৎ স্ক্রিনে সৃজনের মেসেজ ভেসে ওঠে—
“তুমি ভালো তো?”
শিউলি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেই মেসেজে।
আগে হলে হয়তো চোখ ভিজে উঠত, হয়তো হাত কাঁপত, অথবা একটা দীর্ঘ উত্তর টাইপ করত।
কিন্তু আজ শুধু টাইপ করে—
“ভালো নেই। কিন্তু নিজেকে আর হারাতে চাই না।”
মেসেজ পাঠিয়ে সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে যায়।
তার মনে হয়—ভালোবাসা ছিল, সেটাকে অস্বীকার করার কিছু নেই।
সে যে ভুল পথে গিয়েছিল, তা-ও নয়।
কিন্তু সঠিক সময়ে সরে আসাটাও একধরনের ভালোবাসা।
রঞ্জন চা বানিয়ে নিয়ে আসে।
দুজন পাশাপাশি বসে।
কোনো কথা হয় না, তবু একটা স্বস্তি কাজ করে—এই মুহূর্তে কেউ কারও কাছ থেকে কিছু চায় না।
শিউলি ভাবতে থাকে—এই তো জীবন।
সব সম্পর্ক শেষ হয় না ‘তোমাকে ভালোবাসি’ দিয়ে।
কিছু সম্পর্ক শেষ হয় একটা নিরব সম্মতির মধ্য দিয়ে—যেখানে কেউ কারো উপর রাগ করে না, কিন্তু আর পাশে থাকে না।
রোদের আলো তার কপালে এসে পড়ে।
সে চোখ বন্ধ করে রোদের উষ্ণতা অনুভব করে।
এই আলো নিষিদ্ধ নয়, লুকানো নয়।
এই আলোয় দাঁড়িয়ে সে বোঝে—সে আর ছায়ার মধ্যে নেই।
সে এখন নিজের গল্পের লেখক, নিজের পরিণতির নির্মাতা।
শেষ