Bangla - রহস্য গল্প

অলিখিত

Spread the love

সায়ন্তনী দে


চিঠির তারিখ

ছোট ছোট অক্ষরে লেখা, হাতের লেখা যেন পুরনো স্কুলের বাংলা খাতা থেকে উঠে এসেছে—নির্ভুল, অথচ কেমন যেন কাঁপা কাঁপা। অনুরাধা চিঠিটা পড়ছিলো তৃতীয়বার, চশমার কাঁচে হালকা ঘাম জমে উঠেছে।
“তারিখ— ১২ই জুন, ২০২৫।
স্থান— দক্ষিণ কলকাতা, যাদবপুরের গলির মাথায়।
সময়— রাত ১:১৫।
একটি সাদা স্কুটিতে চড়ে যে যুবক ফিরছে, সে জানে না, আজই তার শেষ রাত। ঠিক তার বাড়ির পাঁচ নম্বর ল্যাম্পপোস্টের কাছে তাকে ছুরি মারা হবে।”
ডা. অনুরাধা ঘোষ চিঠিটা নামিয়ে রাখলেন। ইরা সেন তখন তাঁর চেম্বারের কাঠের চেয়ারে বসে আছে, কাঁধ পর্যন্ত খোলা সাদা কুর্তির গায়ে আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে। মেয়েটির মুখে ভয় নেই, বরং যেন কোনো অভ্যস্ত ক্লান্তি।
“তুমি বলছো, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এরকম একটা চিঠি পাও?”
ইরা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। আমি জানি না ওগুলো কে রেখে যায়। আমি ঘুম থেকে উঠেই দেখি, বিছানার পাশে থাকে। আমি কিছুই শুনি না, কিছু টের পাই না।”
“আর তুমি নিজেই লিখে ফেলো, ভুলে যাওনি তো?”
“তাও ভেবেছিলাম। একবার ভিডিও ক্যামেরা চালু রেখে ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু ক্যামেরা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মাঝরাতে। ব্যাটারি ছিল পুরনো, আমি ধরেছিলাম, সেটা কারণ। কিন্তু পরদিন আবার চিঠি এল।”
অনুরাধা এবার থেমে গেলেন। এটা কোনো সাধারণ ডিলিউশন নয়, যদি চিঠির কথা সত্য হয়। সমস্যাটা হলো, এই মেয়ে যে খুনের কথা বলেছে, তা তিন দিন আগে হুবহু ঘটেছে—যাদবপুর থানা এলাকায়, এক কলেজ পড়ুয়া, রাত একটা নাগাদ, সাদা স্কুটিতে বাড়ি ফিরছিলো, আর তখনই…
অনুরাধা গভীরভাবে চিঠির শব্দগুলো দেখে যাচ্ছিলেন। না, এটা কোনো সংবাদপত্র থেকে কাটা লেখা নয়, হ্যান্ডরিটেন। কালি শুকিয়ে গিয়েছে, ঘ্রাণটা যেন পুরনো কাগজের।
“তুমি কখন থেকে এই চিঠিগুলো পাচ্ছো, ইরা?”
“দু’মাস হল প্রায়। প্রথমে ছোটখাটো তথ্য ছিল, হারিয়ে যাওয়া বিড়াল, অদ্ভুত স্বপ্ন। পরে হঠাৎ করে একদিন একটা মেয়ে ট্রেনে পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনা লিখে এসেছিল চিঠিতে। তার তিনদিন পর, ঠিক তেমনটাই ঘটলো।”
“তুমি কি কাউকে বলেছো এ কথা?”
“না। আপনি প্রথম।”
অনুরাধা জানতেন, কলকাতার পুরনো রাস্তাগুলোর ফাঁকে এমন অনেক গল্প লুকিয়ে থাকে, কিন্তু বাস্তব আর বিভ্রমের মাঝের দাগ যখন মুছে যেতে থাকে, তখনই সবচাইতে বিপদ হয়।
“তুমি কি আগে কখনও কাউন্সেলিং করিয়েছো?”
“না, তবে মা বলতেন, আমি ছোট থেকেই একটু অন্যরকম।”
“মানে?”
“যেমন… আমি কিছু কিছু জিনিস আগে থেকে বুঝতাম। হয়তো কে ফোন করবে, বা কে কাঁদবে আজ। ছোট ছোট জিনিস। কিন্তু কখনও এত বড় কিছু নয়। এই চিঠিগুলো… এটা যেন কারও ডায়েরি, কেউ জানে ভবিষ্যৎ।”
“তুমি চিঠিগুলো রেখে দিয়েছো?”
ইরা ব্যাগ থেকে একটা মোটা খাম বের করল। প্রায় বিশটা চিঠি, সাদা পাতায় হাতে লেখা। ডা. অনুরাধা খুঁটিয়ে দেখলেন—তারিখ, স্থান, সময় সব কিছু অত্যন্ত নির্দিষ্ট, যেন একজন সাংবাদিক বা পুলিশ রিপোর্টারের মতো বিস্তারিত।
একটা চিঠিতে লেখা—
“তারিখ— ৪ঠা জুন, ২০২৫।
স্থান— বালিগঞ্জ ফাঁড়ির পাশে, অরুণাভ সেন রোড।
সময়— সন্ধে ৭টা।
একটি গায়ের রঙে চাপা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। তার মুখ থাকবে চেপে ধরা। রাস্তায় কেউ দাঁড়াবে না। কারণ ওই সময় পাশেই বাজবে বিয়ের সানাই।”
এই ঘটনা অনুরাধা মনে করতে পারলেন। মাত্র এক সপ্তাহ আগে খবর হয়েছিল, বালিগঞ্জ থেকে এক গৃহপরিচারিকা নিখোঁজ, সন্দেহভাজন কেউ নেই, কোনো ক্যামেরা নেই। চিঠির বিবরণ মিলে যাচ্ছে।
“ইরা,” অনুরাধা এবার একটু নিচু গলায় বললেন, “তুমি কি নিজে এসব ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত?”
“না! আমি তো বাসা থেকেই বেরই হই না প্রায়। সারাদিন ছবি আঁকি, মায়ের জিনিসপত্র গোছাই। আমি কাউকে চিনি না।”
“তবে চিঠিগুলো কে লিখছে? কার জন্যে?”
“সেটাই তো বুঝতে পারছি না। কিছু চিঠি এমন ঘটনা নিয়ে যা ঘটে ওঠেনি, কিন্তু পরে হয়। আর কিছু আবার শুধু লেখা থাকে, কিন্তু তার পরে কোনো খবর পাই না। মনে হয়, হয়তো কিছু আটকে দেওয়া গেছে। কারো ভবিষ্যৎ বদলানো গেছে।”
“তুমি কি ভেবেছো, এগুলো শুধু তোমার হাতেই আসে? আর কেউ পায় না?”
“হ্যাঁ… আমি কখনো খুঁজে পাই না এদের কোনো উৎস। কাগজটা পর্যন্ত আলাদা রকমের। যেন কোথাও ছাপা হয়নি। কোথাও নেই, কেবল আমার ঘরে।”
অনুরাধা এবার বুঝলেন, বিষয়টা শুধুই সাইকিয়াট্রিক না। কিংবা শুধুই নয়—এখানে কিছু বাস্তব হঠাৎ মিলে যাচ্ছে, আর সেটা জটিল করে তুলছে মেয়েটির মানসিক অবস্থা। হয়তো, কেউ এই মেয়েটিকে ব্যবহার করছে? না কি ইরার ভেতরেই আছে একজন অন্য কেউ?
বাইরে তখন সন্ধে নামছে, গড়িয়াহাটের ট্র্যাফিক হর্ণ অনুরাধার চেম্বার অবধি এসে পৌঁছোয়।
“তুমি চাইলে, আমি কয়েকদিন তোমার বাড়িতে যেয়ে দেখতে পারি। তুমি যেমন বলছো, তাতে আমার নিজের দেখা দরকার।”
ইরা একটু কেঁপে উঠলো। “আপনি… আসবেন? আমার বাড়ি?”
“হ্যাঁ। তুমি ঠিক বললে, তাহলে তো সেখানেই ক্লু আছে। যদি না তুমি নিজেই লেখো, তাহলে বুঝতে হবে কে দিচ্ছে। ক্যামেরা, পর্যবেক্ষণ, হয়তো কোনো ট্রিগার—সব খুঁজে দেখা দরকার।”
ইরা হালকা হাসলো, “ঠিক আছে। কাল সকালেই আসুন। আমি ঠিকানা লিখে দিচ্ছি।”
অনুরাধা মাথা নাড়লেন।
কিন্তু তাঁর মনে একটাই প্রশ্ন তখন ঘুরছিল—
কাল সকালে ইরা কি আবারও একটি নতুন চিঠি পাবে?
আর যদি পায়… তাতে কি লেখা থাকবে?
চোখের সামনে

দক্ষিণ কলকাতার অরণ্য দত্ত রোড, একটা তিনতলা পুরনো বাড়ি। লোহার গেট অর্ধেকটা খোলা, মাথার ওপরে শাল গাছের ছায়া, গেটের নিচে মেঠো ধুলোর আস্তরণ। সকাল আটটা বাজে তখন, ডা. অনুরাধা ঘোষ নিজের ছোট গাড়িটা বাইরে পার্ক করে গেট ঠেলে ঢুকলেন।
ইরা নিচেই দাঁড়িয়ে ছিল—সাদা সালোয়ার কামিজ, চোখে ঘুম ঘুম ভাব। কিন্তু গালদুটো লাল, যেন রক্ত কোনো উত্তেজনায় দৌড়েছে।
“চিঠি এসেছে?”
অনুরাধার প্রশ্নে ইরা একটু মাথা নাড়ল।
“হ্যাঁ, ঘুম ভাঙতেই দেখি, বালিশের পাশে রাখা।”
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই একটা পুরনো কলকাতার ঘ্রাণ। কাঠের মেঝে, দেয়ালে কালো-সাদা ফ্রেমের পুরনো ফটো, একটা ম্লান আলোয় ভরা হলঘর। ইরার মা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন, তারপর থেকে ই একা থাকে এই বিশাল ফ্ল্যাটে।
“কোথায় রেখেছো চিঠিটা?”
“এখানে।”
সে এগিয়ে দিলো পাতলা কাগজে লেখা চিঠিটা। অনুরাধা হাতে তুলে দেখলেন—আজকের তারিখ, আবারও সেই ছোট অক্ষর, আবারও এক ভবিষ্যৎ ঘোষণা।
“তারিখ— ১লা জুলাই, ২০২৫।
স্থান— হাজরা মোড়, বাস স্ট্যান্ড।
সময়— দুপুর ২:৪৫।
এক নারী তার বাম কানে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। সে জানে না, তার ঠিক পেছনে দাঁড়ানো লোকটির কোমরের মধ্যে বাঁধানো ছুরি। আঘাত হবে একবারে, নিঃশব্দে, কিন্তু রক্ত ছিটকে পড়বে সিগনাল বোর্ডে। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারবে না।”
অনুরাধার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। সময় ছিল মাত্র ছ’ঘণ্টা দূরে।
“তুমি কি চেনো এ জায়গাটা?”
“আমি মাঝে মাঝে সেদিকে যাই। কিন্তু ওরকম কাউকে চিনি না।”
“চলো, তোমার ঘরটা দেখি।”
ইরার ঘরটা বাড়ির পেছনের দিকে। জানালার পাশে একটা কাঠের ড্রেসিং টেবিল, সাদা পর্দার ফাঁকে সূর্যরশ্মি এসে পড়েছে বিছানার এক কোণে। বিছানার পাশেই রাখা চিঠিটা, একেবারে গদির প্রান্তে।
“তুমি কোথায় ঘুমাও?”
“বাম পাশে মুখ করে।”
“আর চিঠিটা থাকে ঠিক এই জায়গায়?”
“হ্যাঁ। যেন কেউ রাখে নিঃশব্দে। আমি ঘুম ভাঙলে দেখি।”
অনুরাধা চারপাশে ঘুরে দেখলেন। জানালাটা ভিতর থেকে বন্ধ। দরজাও ভিতর থেকে লাগানো ছিল। কোনো লুকোনো প্রবেশপথ নেই।
“তুমি রাতে ঘুমোবার আগে দরজা বন্ধ করো তো?”
“হ্যাঁ। আমি খুব সাবধানে থাকি।”
অনুরাধা একটা ছোট ক্যামেরা বের করলেন।
“আজ রাতে আমি এখানে একটা ইনফ্রারেড ক্যামেরা বসাতে চাই। যদি কেউ এসে চিঠি রাখে, আমরা বুঝতে পারব।”
ইরা একমত হলো।
তারা দুপুর অবধি বসে চিঠিগুলোকে আলাদা আলাদা করে সাজাল—তারিখ অনুযায়ী, এবং কোনটা ঘটেছে আর কোনটা হয়নি তা চিহ্নিত করে। এখন পর্যন্ত ২১টা চিঠির মধ্যে ১৩টি ঘটনায় কলকাতা পুলিশের রিপোর্ট মেলে, বাকি ৮টি নিখোঁজ, অসম্পূর্ণ, অথবা ভবিষ্যতের।
“তুমি কখনো স্বপ্নে কিছু দেখো?”
“হ্যাঁ। প্রায়ই। কিন্তু সেগুলো এতো এলোমেলো হয়… আমি বুঝতে পারি না কোনটা বাস্তব, কোনটা ঘুম।”
“তোমার মা কেমন ছিলেন?”
“খুব চুপচাপ। কিছু লুকিয়ে রাখতেন মনে হতো। একটা পুরনো কাঠের বাক্স ছিল, যা কখনো খুলতে দিতেন না। মা মারা যাওয়ার পর আমি সেটা খুঁজি, কিন্তু পাইনি।”
“তুমি কি চিঠিগুলোর সঙ্গে তোমার মায়ের কোনো সম্পর্ক ভাবো?”
“আমি জানি না। তবে মা’র মৃত্যুর পর থেকেই শুরু হয়েছে এই সব।”
ঘড়ির কাঁটা তখন ২:৩০। হাজরা মোড়ের ঘটনা চিঠিতে লেখা ছিল—মাত্র ১৫ মিনিট বাকি।
অনুরাধা চুপচাপ ব্যাগ তুলে বললেন, “চলো, আমরা যাচ্ছি। হয়তো কিছুই ঘটবে না। কিন্তু দেখতে হবে।”
________________________________________
দুপুরের গরমে হাজরা মোড় তখন গনগনে, বাস স্ট্যান্ডে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, কেউ ফোনে, কেউ ছায়া খুঁজে নিচ্ছে।
২:৪৩।
একজন মহিলা এল, বাম কানে ফোন। সাদা শাড়ি পরা, পরিপাটি। তার পিছনে দাঁড়ালো এক যুবক—মাথায় টুপি, কোমর ঝুলানো ব্যাগ।
২:৪৫।
কোনো কিছু ঘটলো না।
২:46—মহিলা ধীরে হেঁটে দূরে চলে গেলেন। যুবক অন্যদিকে।
ইরা তাকিয়ে রইল অনুরাধার দিকে, কিছুটা ত্রস্ত হয়ে।
“মিথ্যে হল?”
অনুরাধা কাঁধ উঁচিয়ে বললেন, “হয়তো কেউ আটকেছে, হয়তো ভবিষ্যৎ বদলে গেছে।”
কিন্তু তখনই মোড়ের ঠিক উল্টো দিকে হট্টগোল—একজন বয়স্ক মানুষ হঠাৎ হাঁটুতে পড়ে গেছে, রক্তে ভিজে যাচ্ছে জামা।
“ওখানে কী হলো?”
অনুরাধা দৌড়ে গেলেন। না, ছুরি নয়, হার্ট অ্যাটাক, পড়ে গিয়ে মাথা ফেটেছে।
তবে ইরার চোখে তখন কিছু অন্য জিনিস—সে তাকিয়ে আছে সিগনাল বোর্ডের দিকে।
একটু আগেই একদলা রক্ত ছিটকে সেখানে লেগেছিল।
অনুরাধার গলা শুকিয়ে গেল।
“এই ঘটনা, পুরোপুরি না হলেও, আংশিক মিলে গেছে।”
ইরা ফিসফিস করে বলল,
“তাহলে কি কেউ জানে, আমরা এখানে এসেছি?”

অন্তর্হান

বিকেলে ফিরে এসে ইরা যেন একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে ঢুকে দরজাটা ভিতর থেকে আটকে দিল, তারপর চুপচাপ জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বসল বিছানায়। অনুরাধা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। এই মেয়েটার চোখে আজ একটা অদ্ভুত দৃষ্টি—না ভয়, না বিস্ময়—একটা নিঃশব্দ প্রস্তুতির মতো, যেন কোনো কিছু অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে।
“তুমি ঠিক আছো?”
ইরা মাথা নাড়ল। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
“আপনি বিশ্বাস করেন, ভবিষ্যৎ আগে থেকে জানা যায়?”
অনুরাধা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
“আমি বিশ্বাস করি, মানুষের মস্তিষ্ক অনেক জটিল। কখনও কখনও, যেটা আমরা অন্তর্দৃষ্টি বলি, সেটা হয়তো তথ্যের গভীর কোনো প্রক্রিয়া। কিন্তু তুমি যা বলছো, সেটা তার থেকেও অদ্ভুত। এটা যেন… ভবিষ্যতের কোনো ডায়েরি।”
“আপনি থাকবেন আজ রাতে?”
“হ্যাঁ। আমি আমার ক্যামেরাটা বসাবো তোমার ঘরে। কোনো শব্দ, আলো, নাড়া—সব রেকর্ড হবে।”
রাত নামতে না নামতেই ইরা ঘরের এক কোণে একটা পুরনো কাঠের বাক্স টেনে আনল। ধুলোমাখা, চাবির ছিটেফোঁটাও নেই।
“এইটা মায়ের পুরনো ট্রাঙ্ক। ও জীবিত থাকতে কখনো খুলতে দেয়নি। মৃত্যুর পর আমি এটা খুঁজছিলাম—আজ সকালে রান্নাঘরের পেছনের তাক ভাঙতে গিয়ে বের হলো।”
অনুরাধার বুকের ভেতরটা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে এলো। এটাই কি সেই অলিখিত সূত্র?
বাক্সের মুখ খুলতেই একটা পুরনো ঘ্রাণ ভেসে এল—কাঠ, ন্যাপথলিন, আর পুরোনো কাগজের গন্ধ। ভিতরে ছিল কিছু হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠিপত্র, ছবি, একটা হাতঘড়ি, আর একটি খয়েরি কাপড়ের পুঁটলি।
ইরা পুঁটলিটা খুলতেই বের হল কয়েকটা ভাঁজ করা কাগজ।
“চিঠি?”
অনুরাধা বললেন।
“হ্যাঁ… কিন্তু এর লেখাটা… উল্টো দিকে।”
চিঠিগুলো আয়নার সামনে ধরতেই বোঝা গেল—সেগুলো আয়নার প্রতিবিম্বে পরিষ্কারভাবে লেখা। একটাতে লেখা:
“তারিখ— ১৭ই এপ্রিল, ২০০২।
স্থান— বেহালা, দক্ষিণ কলকাতা।
একজন কিশোরী প্রথমবার অনুভব করবে কিছুর উপস্থিতি। তার নাম ইরা।”
অনুরাধা গা ছমছম করে উঠলেন।
“তুমি তখন কত বছরের?”
“ছয়।”
একটি আয়নালিপিতে লেখা চিঠিতে আরো কিছু লাইন ছিল, যেগুলোকে ইরা জোর করে পড়ে ফেলল—
“সে যেন এক নীরব বার্তাবাহক। তার মধ্য দিয়ে যাত্রা করবে অন্য এক জগতের ভাষা। সে জানবে না কার কথা বলছে, তবে জানবে কী ঘটবে। তার হাত, তার ঘুম, তার মুখ হবে শুধু একটি জানালা।”
অনুরাধা ধীরে ধীরে বললেন,
“তোমার মা কি কখনো কিছু বলতেন? কোনো বিশ্বাস, কোনো গোপন কথা?”
“না, কিন্তু আমি জানতাম, মা সব সময় কিছুকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। হয়তো নিজের মধ্যেই ভয় ছিল ওঁর।”
“এই চিঠিগুলো কীভাবে সম্ভব? কার লেখা?”
“যদি আমার মা লিখে থাকেন… তবে ও জানতেন আমি কী হতে চলেছি। কিন্তু কেন?”
রাত তখন গভীর। অনুরাধা ক্যামেরাটা সেট করলেন ইরার মাথার পাশে, বিছানার ঠিক উপর দিয়ে তাক করে। একটা লাল আলো শুধু জ্বলছে ক্যামেরার গায়ে—রেকর্ডিং চালু।
“ঘুমানোর আগে কিছু খাবে?”
“না, আমি আজ কিছু খেতে পারবো না। শুধু ঘুমাতে চাই।”
অনুরাধা ডানদিকে বিছানার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে রইলেন। ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। ১২টা বেজে চল্লিশ। ইরার নিঃশ্বাস গভীর হতে শুরু করেছে।
ঠিক ১:১৩ মিনিটে, ঘরে হঠাৎ একটা শীতল বাতাস বইলো। জানালা ছিল বন্ধ, দরজা সিল করা।
অনুরাধা চমকে উঠে ক্যামেরার ডিসপ্লে-তে চোখ রাখলেন।
১:১৪
ইরার মাথার পাশে বিছানায় আস্তে করে একটা কাগজ যেন ভেসে পড়ল।
কোনো হাত দেখা গেল না।
কোনো ছায়া নয়।
কেবল হাওয়ায় যেন অদৃশ্য কেউ রেখে গেল পাতাটা।
১:15
ইরা একটু নড়ে উঠলো ঘুমের মধ্যে। অনুরাধা উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন।
চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখে গা কাঁপতে লাগল—
“তারিখ— ২রা জুলাই, ২০২৫।
স্থান— দক্ষিণ শহরতলির একটি রেল স্টেশন।
সময়— সকাল ৬:২০।
এক তরুণী ট্রেন ধরতে যাবে, কিন্তু পৌঁছাবে না। কেউ একজন আগে থেকে জানবে সে কোথায় থামবে। কেউ একজন অপেক্ষা করছে—শুধু তার জন্য।”
চিঠির নিচে আরেকটা লাইন—
“এইবার তুমি দেখবে। নিজেই। সামনে দাঁড়িয়ে।”

ঘুমভাঙা স্টেশন

সকাল ৫:৪৫। অন্ধকার আর আলো তখন ধীরে ধীরে একে অন্যকে গিলে খাচ্ছে। স্টেশন ঘুমভাঙা শহরের মতো নিস্তব্ধ—চায়ের কুলার উঠতে শুরু করেছে, পাখিরা ব্যস্ত হয়ে উঠছে রেল লাইনের পাশের ঝোপে। দক্ষিণ শহরতলির ‘নবদীপ স্টেশন’—একটা ছোট, উপেক্ষিত প্ল্যাটফর্ম, যেখানে দিনটা শুরু হয় নিঃশব্দে, কেউ কিছু খেয়াল করে না।
ইরা আর অনুরাধা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল প্ল্যাটফর্মের মাঝ বরাবর। ইরার মুখ শুকনো, চোখ লাল। সারারাত ও ঘুমোতে পারেনি, কেবল তাকিয়ে থেকেছে দেয়ালের দিকে—যেখানে কোনও লেখা নেই, অথচ কিছু একটা যেন বারবার উঠতে চাইছে।
“সময় ৬:২০।”
অনুরাধা ঘড়ি দেখে বলল।
“আমরা এখন অপেক্ষা করি।”
চারপাশে আরও কয়েকজন লোক এসেছে—কেউ টিফিন ক্যারিয়ার হাতে, কেউ ঘুমচোখে। এক বৃদ্ধ লোক চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে হেঁচকি দিচ্ছেন, দূরে একজন মহিলা রোদে মুখ ঢাকা দিয়ে বসে আছেন, পা দুলিয়ে।
“তুমি কখনও এখানে এসেছো?”
“না। কিন্তু নামটা চিঠিতে পড়েই চিনতে পেরেছিলাম। জানি না কেন, মনে হচ্ছিল আমি জায়গাটা জানি।”
৬:১৮
একটা লোকাল ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে ঢুকছে স্টেশনে। হালকা ভিড়, কেউ উঠে পড়ছে, কেউ নামছে। ইরা তাকিয়ে আছে একটা বিশেষ দিকের দিকে—প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্ত, যেখানে একটা ছোট বেঞ্চে একটা ছায়ামূর্তি বসে আছে।
“ওই লোকটা… ওর মুখটা আমি চিনি।”
“কে?”
“ও আমার বাবার মতো দেখতে। কিন্তু আমার বাবা তো… আমি আট বছর বয়সে ওঁকে হারিয়েছি। একটা অটো অ্যাকসিডেন্টে।”
অনুরাধা তাকিয়ে রইলেন। দূর থেকে যাকে দেখাচ্ছে, তার মুখটা আজকের ভোরে যেন অদ্ভুতভাবে ঝাপসা। চশমা পরে আছে, পাঞ্জাবি পরা। লোকটা যেন খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে।
“তুমি নিশ্চিত?”
“হ্যাঁ… ওর ঘাড়ের বাঁদিকে একটা কাটা দাগ ছিল। আমি স্পষ্ট দেখলাম।”
ইরা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। তার পায়ের আওয়াজ স্টেশনের কংক্রিটের ওপরে ধ্বনিত হচ্ছে। লোকটা চেয়ারে বসে রইল, মাথা নীচু, চোখ বইয়ে। ইরা ঠিক সামনে এসে দাঁড়াল।
“বাবা?”
লোকটা বই থেকে মুখ তুলল না। শুধু ধীরে ধীরে বইয়ের পাতা বন্ধ করল, তারপর দাঁড়িয়ে একটা দৃষ্টি দিল—তীক্ষ্ণ, অথচ শূন্য।
“তুমি যদি ইরা হও… তবে তুমি বুঝবে, আমি কে।”
কন্ঠটা কাঁপা, ধীর, কিন্তু শব্দগুলো এমনভাবে গেঁথে আছে, যেন বহু বছর আগে বলা হয়েছিল।
ইরা কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“তুমি কি… আমার বাবা?”
“আমি একজন বার্তাবাহক। যাকে তুমি একসময় চিনতে পারতে, এখন সে তোমার মধ্যেই আছে।”
অনুরাধা দৌড়ে এল, কিন্তু ঠিক তখনই লোকটা মাথা নিচু করে পেছন ঘুরে হাঁটতে শুরু করল।
“দাঁড়াও!” অনুরাধা চেঁচিয়ে উঠলেন।
কিন্তু ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল, ভিড় নামল, আর সেই লোকটা এক ঝলকে অদৃশ্য হয়ে গেল—কোথায় গেল, কেউ দেখল না।
ইরা স্তব্ধ। মুখে কোনো রক্ত নেই। শুধু বলল,
“আমার মনে হচ্ছে… আমি জানি কোথায় যেতে হবে এবার।”
________________________________________
সন্ধ্যায় অনুরাধা ক্যামেরার ফুটেজ রিভিউ করছিলেন ইরার ঘরে। চিঠির আবির্ভাবটা ক্যামেরায় স্পষ্ট ধরা পড়েছে—কোনো হাত নেই, কোনো পা নেই, কিন্তু ঘরের বাতাস যেন একটা কেন্দ্রবিন্দুর দিক থেকে হঠাৎ ঘূর্ণন তুলেছে।
চিঠির পাতাটা যেন উপরের হাওয়ায় কয়েক সেকেন্ড ভেসে থেকে ধীরে ধীরে বিছানায় নেমে আসে।
এই ভিডিও যে কাউকে দেখালে বিশ্বাস করবে না।
“এটা কোনো মানুষের কাজ নয়,” অনুরাধা বললেন।
“তাহলে কি?”
“হয়তো এটা এমন কিছু, যা আমাদের সময়বোধের বাইরের কোনো স্তরে কাজ করছে। সময় এখানে রেখা নয়, গোল। ঘটনাগুলো ফিরে ফিরে আসে।”
ইরা বলল, “আপনি কি জানেন, আমার মায়ের একটা দিনলিপি ছিল?”
“তুমি খুঁজে পেয়েছো?”
“না। কিন্তু আজ স্টেশন থেকে ফিরে এসে রান্নাঘরের তাকের ওপরে একটা পুরনো ফাইল পেয়েছি।”
তারা দুজন ফাইলটা খুলল। ভিতরে কিছু পাতলা পাতায় অদ্ভুত স্ক্রিপ্টে লেখা। বাংলা, কিন্তু পুরনো ফর্মে, এমনভাবে লেখা যা বাংলা ও সংস্কৃতের মাঝামাঝি।
একটি পাতায় লেখা ছিল—
“যে ভবিষ্যৎ দেখে, সে তা নিজে বয়ে বেড়ায়। সে জানে, কিন্তু পালাতে পারে না। ভবিষ্যৎ তার দেহে লেখা থাকে। চিঠির ভাষা তার রক্তে।”
“এই লেখা কে লিখেছে?”
“আমার মা, হয়তো তার মা। আমি জানি না।”
অনুরাধা চুপ করে গেলেন। তিনি জানতেন, এখানে একটা ইতিহাস লুকিয়ে আছে—একটা উত্তরাধিকার, যা শুধু রক্তে নয়, মনেও বয়ে চলে।
এবং তখনই ঘরে টেবিলের ওপরে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল। ইরার ফোন।
অজানা নম্বর।
ইরা কল ধরল।
কোনো কথা নেই।
শুধু একটা গলা—
“কাল তুমি যাবে যেখানে, সেখানেই প্রথম চিঠিটা লেখা হয়েছিল।”

প্রথম চিঠি

বাড়িটা দক্ষিণ কলকাতার প্রান্তে—একটা ধ্বংসপ্রায় পাড়ায়, যেখানে আধা-ভাঙা বাড়ির পাশে ছোট ছোট গাছ উঠে এসেছে ছাদ ভেদ করে, দেওয়ালে শ্যাওলা জমেছে, আর দরজাগুলো খোলা থাকলেও তাতে কেউ আর ঢোকে না। ঠিক এমনই এক ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে ইরা আর অনুরাধা, হাতে সেই পুরনো খামের কপি, যেখানে প্রথম চিঠির ‘স্থান’ হিসেবে উল্লেখ ছিল—”ব্রজবিহারী সরণির একতলা, সিঁড়ির বাঁ দিকে, পুরনো কাঠের ঘর।”
“তুমি এখানে আগে এসেছিলে?”
“না। এই জায়গাটা আমি কোনোদিন দেখিনি। কিন্তু… আজ খুব পরিচিত লাগছে। যেন কোথাও, কোনো একটা স্বপ্নে আমি এখানে হাঁটেছি।”
বাড়িটার সদর দরজা চেপে খুলে গেল। ভেতরে এক অদ্ভুত নীরবতা, যেন শব্দও জমে আছে বাতাসের কোণে। প্রথম ঘরটাতে একটা পুরনো সোফা, অর্ধেক ছেঁড়া ক্যালেন্ডার, আর দেওয়ালে লেখা কিছু লাল কালি দিয়ে আঁকা শব্দ—
“আমরা যারা দেখি, তারা কখনো পুরোটা বলতে পারি না। ভাষা হারিয়ে যায়। কেবল থেকে যায় তারিখ।”
অনুরাধা এগিয়ে গিয়ে আলতো করে দেওয়ালে হাত রাখলেন।
“এই লেখাটা… এটা কোনো অদৃশ্য রোগের মতো। বারবার ফিরে আসে। বারবার ছায়ার মতো লেগে থাকে।”
ইরা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সিঁড়ির বাঁদিকে। সেখানে একটা অর্ধ-বন্ধ কাঠের দরজা। চাবির দরকার পড়ল না—একটা মৃদু ঠেলা দিলে দরজাটা খোলে, ধুলোয় ভরা ঘর, মাঝখানে একটা পুরনো টেবিল আর তার ওপর রাখা কিছু পত্রপত্রিকা, এবং একটা ভাঁজ করা কাগজ।
চিঠি।
হাতে তুলে নিতেই বোঝা গেল, এটা সেই প্রথম চিঠি—সেই ভবিষ্যতের যাত্রা যার শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে।
“তারিখ— ১৪ই জুন, ১৯৯৮।
স্থান— এই ঘর।
এক নারী আজ প্রথম জানবে নিজের ভাগ্য। সে জানবে, তার কন্যা একজন বাহক হবে। সময় তার মাধ্যমে কথা বলবে। সে লিখবে না, তবু লেখা হয়ে যাবে।”
ইরার ঠোঁট শুকিয়ে এল।
“১৯৯৮… আমার জন্মের ঠিক এক বছর আগে।”
“মানে এটা তোমার মায়ের লেখা?”
“হয়তো। অথবা… আমার জন্মকে ঘিরে কিছু অন্যরকমের উপলব্ধি তার হয়েছিল। আমি জানি না। কিন্তু এই ঘরটা… মনে হচ্ছে আমি এখানেই কখনো দাঁড়িয়েছিলাম।”
ঘরের ঠিক বিপরীত দেওয়ালে ছোট একটা আয়না ঝুলছিল। ধুলোতে ঢাকা, তবু আয়নায় একটা প্রতিফলন পরিষ্কার—ইরার মুখ, কিন্তু তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একজন।
ইরা ফিরে তাকালো—কেউ নেই।
“আপনি কি দেখলেন?”
অনুরাধা মাথা নাড়লেন।
“না, কিন্তু তুমি যেন কিছু অনুভব করলে।”
“ওটা আমার মা হতে পারে।”
তারা ঘরের ভেতর বসে পড়ল মেঝের ওপর। দেয়ালের কোণায় একটা কাঠের বাক্স, সেখানে কয়েকটি পুরনো বাংলা উপন্যাস, আর একটা চিঠির দলা কাগজ। খুলে দেখা গেল—এতদিন ধরে ইরা যেসব চিঠি পেয়ে এসেছে, তার পুরনো কিছু কপি এখানে আগেই লেখা ছিল।
“মানে এই বাড়িতে কেউ এই চিঠিগুলো লিখে গেছে?”
“অথবা… ভবিষ্যৎ লিখে গেছে, কেবল কাগজে নয়, এই দেওয়ালে, এই বাতাসে। সময় এখানে বাঁক খেয়েছে।”
অনুরাধা জানতেন, এ কেবল ভবিষ্যৎ বলার খেলা নয়—এ এমন এক বার্তা যা বাহকের হাতেও পুরোপুরি নিজের থাকে না। ইরা এখন কেবল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না, তার শরীর হয়ে উঠছে সেই অদৃশ্য ভাষার বাহন।
ঠিক তখনই ইরার মোবাইল বেজে উঠল। স্ক্রিনে কিছু লেখা নেই, শুধু “UNKNOWN NUMBER”।
ধীরে ধীরে ইরা ফোনটা কানে দিল।
কণ্ঠস্বরটা খুব শান্ত।
“তুমি ফিরে যাবে আজ, ঠিক সন্ধ্যে ৭টায়। চিঠিটা তখনও থাকবে না। কিন্তু জানালার পাশে থাকবে একটি সিলিন্ডার, যার ঢাকনার নিচে লুকানো থাকবে আগামী তিনটি চিঠি। তুমি বুঝবে না কে রাখল, কিন্তু সেগুলো তোমারই ভাষায় লেখা।”
“তুমি কে?” ইরা জিজ্ঞেস করল।
“আমি সেই যিনি জানি, তুমি এখন আর প্রশ্ন করবে না। শুধু এগোবে, কারণ তোমার চোখে এখন শুধু লেখা নয়, সময়ের ছায়াও আঁকা হতে শুরু করেছে।”
কল কেটে গেল।
অনুরাধা বললেন, “চলো, আমরা ফিরি। যেটা তুমি দেখলে, সেটা যদি সত্যি হয়, তবে পরের ধাপটা তোমার জন্য খুব কঠিন হতে চলেছে।”
ইরা চোখ বন্ধ করে বলল,
“আমি প্রস্তুত।”

ছায়ার নিচে ভাষা

সন্ধে সাতটা বাজতেই ইরা ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল নিঃশব্দে। অন্ধকারের ছায়া ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে ঘরের মেঝেতে, যেন একটা পুরনো চিত্রকাব্য একেকটা রেখায় আঁকা হচ্ছে। বাতাসে হালকা ঠান্ডা, জানালার গা ঘেঁষে একটা ফড়িং বসেছিল, আর সিলিংয়ের কোণায় ছায়া একটু একটু করে ভারী হচ্ছিল।
ডা. অনুরাধা চুপচাপ ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে, মনে মনে ক্যামেরার ব্যাটারি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কিন্তু আজ ক্যামেরা নয়, আজ অপেক্ষা ছিল সেই অদৃশ্য মুহূর্তটার, যেখানে বাস্তব আর অবাস্তব একে অপরকে ছুঁয়ে যায়।
ইরা জানালার কাঠের নিচে হাঁটু গেড়ে বসল। কাঠের ফ্রেমের এক কোণে পুরনো রঙ খসে পড়েছে, নিচে মাটি। হাত দিয়ে ধুলো সরাতেই চুপি চুপি উঠে এলো একটা ধাতব সিলিন্ডার—পুরনো, কিন্তু ঢাকনাটা পরিষ্কার, যেন সদ্য খোলা।
“এটা কি আগেও ছিল?”
অনুরাধা জিজ্ঞেস করলেন।
“হয়তো ছিল… হয়তো কোনোভাবেই আমাকে বোঝানো হচ্ছিল, আজ সন্ধ্যাতেই এটা খোলার সময়।”
সিলিন্ডার খুলতেই তিনটে ভাঁজ করা কাগজ। সবগুলোতেই পরিচিত সেই হাতের লেখা—নির্ভুল, কাঁপা, কিন্তু নিঁখুত।
প্রথম চিঠি—
“তারিখ— ৫ই জুলাই, ২০২৫।
স্থান— পার্ক সার্কাস, গলি নম্বর ১২।
এক কিশোরী হারিয়ে যাবে স্কুল থেকে ফেরার পথে। তার খোঁজ চলবে সাতদিন। কিন্তু কোনো সন্ধান মিলবে না, কারণ সে হারায়নি। তাকে রাখা হয়েছে, সে-ই চেয়েছিল হারিয়ে যেতে।”
দ্বিতীয় চিঠি—
“তারিখ— ৬ই জুলাই, ২০২৫।
স্থান— হাওড়া ব্রিজ, দক্ষিণ প্রান্ত।
এক যুবক ঝাঁপ দেবে, কিন্তু মৃতদেহ পাওয়া যাবে না। কারণ সে ডুববে না। সে পালাবে—কারণ তার পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে জীবিত নয়, আর তাকে খুঁজছে না পুলিশ, খুঁজছে সময়।”
তৃতীয় চিঠি—
“তারিখ— ৭ই জুলাই, ২০২৫।
স্থান— ইরার নিজের ঘর।
সময়— রাত ৩:১২।
একটি লেখা নিজে নিজেই উঠবে দেয়ালে। কেউ ছোঁবে না, কেউ জানবে না কিভাবে। সেই লেখার ভাষা হবে এমন এক ভাষা, যা আর কেউ পড়ে না, কিন্তু ইরা তা বুঝবে—কারণ সে এখন শুধু চিঠির বাহক নয়, সে হয়ে উঠছে নিজের অতীতের লেখক।”
অনুরাধা শিউরে উঠলেন।
“তুমি কি নিশ্চিত, এটা তোমার লেখা নয়?”
“আমি জানি না। হয়তো আমি ঘুমের মধ্যে লিখি, হয়তো সময় আমার শরীর ব্যবহার করে। কিন্তু আমি জানি—এই ভাষা আমি বুঝতে শুরু করেছি।”
“তুমি বলতে চাও, এই লেখা শুধু ভবিষ্যৎ বলে না—এ তোমার ভেতরকার কোনো ইতিহাসকেও বদলে দিচ্ছে?”
“হ্যাঁ। আমি এখন বুঝতে পারছি, মায়ের সেই চিঠিগুলো কেবল পূর্বাভাস ছিল না। সেগুলো ছিল এক প্রাচীন চুক্তির অংশ। আমি হয়তো জন্মের সময় থেকেই চিহ্নিত ছিলাম।”
“চুক্তি?”
“ভাষার সঙ্গে। যে ভাষা মানুষের নয়, কিন্তু মানুষ যখন তা ধরতে পারে, তখন সে শুধু পাঠক নয়, হয়ে ওঠে স্রষ্টা।”
সেই রাতে ইরা দরজার খিল তুলে রেখে ঘুমাল। ঘরে আলো নিভে গেছে, কিন্তু জানালার বাইরে একটা অদ্ভুত ঝিকিমিকি আলো ছড়াতে লাগল, যেন দূরে কোথাও বাজ পড়ছে, অথচ শব্দ নেই।
ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে… ৩:১০… ৩:১১…
৩:১২
দেয়ালের সাদা রঙের ওপর হঠাৎ করে ফুটে উঠল এক দাগ, তারপর আরেকটা, যেন কেউ অদৃশ্য হাতে অক্ষর আঁকছে। শব্দ নেই, কালি নেই—শুধু অন্ধকারের ভিতর থেকে ভেসে উঠছে অক্ষর।
অনুরাধা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন।
লিখা হচ্ছে—
“শব্দ দিয়ে শুরু হয়েছিল সব, কিন্তু শব্দ দিয়েই শেষ হবে না। যার ভেতর সময় লেখে, তার মুখ চুপ থাকে। সে শুধু ছায়া দেখে, আর ছায়ার নিচে জন্ম নেয় ভাষা।”
ইরা উঠে বসেছে তখন। তার মুখে অভিব্যক্তি নেই, কেবল গভীর শ্বাস, যেন সে নিজেই সেই ভাষা এখন বুঝে ফেলেছে।
“তুমি… বুঝতে পারছো?”
অনুরাধা জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ। এবার আমি জানি, পরবর্তী চিঠিগুলো আমি নিজেই লিখব। আর আমি জানি, কেন।”
“তুমি লিখবে?”
“হ্যাঁ। আমার হাত দিয়ে, কিন্তু আমার নিয়ন্ত্রণে নয়।”
অনুরাধা জানতেন, এবার কোনো চিকিৎসা, কোনো ব্যাখ্যা চলবে না। এটা যে স্তরে কাজ করছে, তা কোনো থেরাপি বোঝে না—এ ভাষা ও বাস্তবের মাঝখানে জন্মানো এক গোপন ব্রহ্মপত্র।
চিঠির ওই তিনটি তারিখের প্রতিটি ইরা আগেভাগেই দেখতে পাবে, কিন্তু এখন সে শুধু পাঠক নয়, ভবিষ্যতের নিজের শরীর।
আর তখনই, দরজার নিচ দিয়ে একটা নতুন চিঠি সরে এল—চুপচাপ, কুয়াশার মতো।
ইরা হাতে তুলে দেখল—চিঠিতে কিছু লেখা নেই। কেবল একটি লাইন—
“শেষ তিনটি দিন। তারপর লেখা থেমে যাবে। শুধু থাকবে তুমি।”

শেষ তিন দিন

পৃথিবীর সবথেকে গভীর নীরবতা ঠিক কখন শুরু হয়? যখন ভবিষ্যৎ আর অতীত একে অপরকে চেনে না। আর বর্তমান কেবল একজনকে জানে—যে ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে চিঠি পড়ে, অথচ জানে না কে লিখেছে, জানে না কেন তার হাত কাঁপে, শুধু জানে—এই লেখাগুলো আর কিছু নয়, তার শরীরের গভীরে জন্ম নেওয়া শব্দ।
ইরার সেই প্রথম দিন। চিঠির লেখা থামার আগে শেষ তিনটি দিন শুরু হয়ে গেছে।
প্রথম দিন—
চিঠি এল সকাল ৭:০৫-এ।
দেয়ালের ফাঁক দিয়ে সেঁটে গেল বিছানার কোণে।
“তারিখ— ৮ই জুলাই, ২০২৫।
স্থান— কলেজ স্ট্রিট, বইয়ের গলি।
এক বৃদ্ধ লোক একটি বই খুঁজবে, যা সে কখনো কিনতে পারেনি। সেই বইয়ের মধ্যে থাকবে একটি পুরনো চিঠি, যেটি তার নিজের হাতে লেখা, অথচ সে লিখেছে ১৯৫৭ সালে।
চিঠিটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে মারা যাবে—হৃদয়ের এক বিস্ফোরণে।”
ইরা আর অনুরাধা গাড়িতে উঠে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছালেন বেলা ১১টা নাগাদ। বৃষ্টির পরে রাস্তা ভিজে, দোকানদাররা পলিথিন মুছছেন, একটা চায়ের কাপে রং চা ফুটছে।
ঠিক গলির শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ। ধূসর পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা, হাতে কাঁপা কাঁপা একটা তালিকা। এক দোকানদারের সঙ্গে কথা বলছেন—
“ওই ১৯৫৭ সালের সংস্করণটা আছে কি?”
দোকানদার বলল, “জানি না দাদা, একবার দেখুন।”
বৃদ্ধ নিজের হাতে একটা বই টেনে নিলেন। খুললেন। একটা হলদেটে চিঠি ফোঁটা ফোঁটা ছেঁড়া পাতার ভিতরে।
ইরা এগিয়ে এল।
বৃদ্ধ চিঠিটা তুলে নিলেন, ঠোঁট কাঁপছে।
তারপর হঠাৎ এক মুহূর্তে, চিঠি হাত থেকে ফেলে দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন। নিঃশব্দে, এক ঝটকায়।
দোকানদার চেঁচিয়ে উঠল, “দাদা? কী হলো?”
লোকটার মুখ থমথমে।
চোখ খোলা, কিন্তু প্রাণ নেই।
চিঠিটা মেঝেতে।
ইরা হাতে নিল।
লেখা—
“আমার নাম নবারুণ ঘোষ। আজ ১৫ই জুলাই, ১৯৫৭। যদি আমি বাঁচি, আমি ফিরে আসব এই বইয়ের মধ্যে। যদি না আসি, জানবে—আমি জানতাম, কেউ একদিন এই চিঠি খুঁজবে। আমি নিজেই।”
ইরা ফিসফিস করে বলল,
“এটা… মৃত্যুর ভবিষ্যৎ নয়, সময়ের পূর্ণচক্র।”

দ্বিতীয় দিন—
৯ই জুলাই, ২০২৫
চিঠি এল ভোর ৪টেয়।
“এই দিন ইরার সামনে দাঁড়াবে এক অদৃশ্য পুরুষ, যার কোনো ছায়া নেই। সে বলবে, ‘তোমার ভাষা এখন আমার।’ এরপর সে হারিয়ে যাবে। কিন্তু তার রেখে যাওয়া একটি বাক্য—যেটি কেউ বুঝবে না, শুধু ইরা ছাড়া।”
সারাদিন কেটে গেল নিস্তরঙ্গ। বিকেল সাড়ে পাঁচটায়, রাসবিহারীর এক পুরনো পান দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে ইরা হঠাৎ টের পেল, কেউ পেছনে আছে।
ঘুরে তাকাল—কেউ নেই।
তবে দোকানের ঠিক পাশের দেওয়ালে একটি লেখা দেখা গেল, যেটা কয়েক মিনিট আগেও ছিল না।
“ভাষা ছিল আমার, এখন তুমি। আমি ছায়াহীন। আমিই পৃষ্ঠলিপি।”
অনুরাধা বুঝলেন, এ বার্তা কোনো জীবিত মানুষের নয়—এ ভাষা লিখছে নিজেই নিজেকে, যেন ইরার শরীরের বাইরে তৈরি হচ্ছে এক অলিখিত সত্তা।

তৃতীয় দিন—
১০ই জুলাই, ২০২৫
সকাল থেকেই ইরার শরীর কাঁপছিল। জ্বর নেই, অথচ রক্তচাপ কম, চোখ ঘোলা।
চিঠি আসেনি।
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা, রাত আটটা—তবু কিছু এল না।
অনুরাধা ভাবছিলেন, তবে কি চিঠির ভবিষ্যৎ এবার থেমে গেল?
কিন্তু তখনই ইরা উঠে দাঁড়াল।
চোখ বন্ধ, পায়ের আওয়াজ নেই।
সে গিয়ে দাঁড়াল দেয়ালের সামনে।
চোখ খুলল—দৃষ্টিহীন।
তারপর হাত দিয়ে দেয়ালে লিখতে শুরু করল।
কোনো কালি নেই, কিন্তু আঙুলের ঘষায় ফুটে উঠল অক্ষর।
“শেষ চিঠি লিখছে আমি নয়। সময় নিজে।”
“এইবার শুরু হবে অনুরাধার অধ্যায়।”
অনুরাধার গা ছমছম করে উঠল।
সে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি কি এখনো ইরা?”
ইরা ঘুরে তাকাল।
চোখদুটি জ্বলছে যেন কাচের মতো—আলো পড়ে তার ভিতর দিয়ে আরেকটা কিছু দেখা যাচ্ছে।
সে বলল,
“তুমি তো জানো না, তুমি নিজেও ছিলে চিঠির মধ্যে। তুমি সেই পাঠক, যে একদিন লেখক হবে। সময় এবার তোমার মধ্যে দিয়ে লিখবে।”

অনুরাধার অধ্যায়

চিঠিটা আজ প্রথম অনুরাধার নামে এসেছে। ঠিক সেই ছোট খামে, যা এতদিন ইরার বালিশের পাশে রেখে যাওয়া হত। কিন্তু আজ ভোর ছ’টায়, অনুরাধা নিজের দরজার নিচে খসখস শব্দে জেগে ওঠে। প্রথমে কিছু বুঝতে পারেননি। তারপর নীচু হয়ে দেখেন—একটা সাদা কাগজ সরে আছে দোরগোড়ায়।
খামটা খুলে দেখেন—তার নিজের নাম।
ডা. অনুরাধা ঘোষ
তারিখ— ১১ই জুলাই, ২০২৫
স্থান— গড়িয়াহাট চৌমাথা
সময়— দুপুর ১২টা ৩৪
“একজন নারী দাঁড়িয়ে থাকবে চা স্টলের পাশে, হলুদ ছাতার নিচে। সে জানে না, তাকে কেউ অনুসরণ করছে। সে একবার ঘুরে দেখবে, কিন্তু কিছু বুঝবে না। তুমি ওকে দেখতে পাবে, কিন্তু ও তোমাকে চিনবে না। ওর গলায় থাকবে একটি পেনডেন্ট—যার ভেতরে আছে চিঠির উৎসের চাবি।”
অনুরাধা চুপ করে বসে রইলেন। চিঠিটা ঝাঁপসা দেখাচ্ছে না, কল্পনাও নয়। ঠিক সেই স্টাইল, ভাষা, ছাঁদ—যেটা ইরা এতদিন ধরে পাচ্ছিল।
কিন্তু ইরা?
সে নিখোঁজ।
রাত তিনটায় যখন অনুরাধা ঘুম ভেঙে উঠে জল খেতে গিয়েছিলেন, দেখেন ইরার বিছানা খালি। ঘরের দরজা খোলা। কোনো শব্দ নেই। মোবাইল রেখে গেছে, ব্যাগটাও না।
শুধু জানালার পাশে একটা ছোট্ট কাগজে লেখা—
“আমি যাচ্ছি, কারণ এবার লেখাটা থেমে গেছে। এবার সময় চাইছে অন্য শরীর। তুমি বুঝবে, আমি ঠিক কোথায়।”

দুপুর ১২টা ২০।
অনুরাধা দাঁড়িয়ে আছেন গড়িয়াহাটের মোড়ে। মাথার ওপরে তীব্র রোদ, ট্রাফিকের হর্ণ, স্টলে ভিড়। চা-এর কাপে এলাচের ঘ্রাণ ভাসছে। হলুদ ছাতার নিচে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে—লম্বা চুল, সবুজ জামা, চোখে সানগ্লাস।
চিঠির কথা মতো ঠিক এই মুহূর্তে…
১২:৩৪
মহিলা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আকাশে, তারপর মোবাইল বের করে কিছু খোঁজার ভান করল। আরেকটা দিক তাকিয়ে দেখল, কেউ নেই।
অনুরাধা ওর গলার দিকে তাকালেন—সত্যি, একটা পেনডেন্ট ঝুলছে, গোল, নীল রঙা পাথর বসানো।
তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন।
“এক্সকিউজ মি… আপনি কি একটু সময় দেবেন?”
মহিলা তাকালেন, মুখে হালকা বিস্ময়।
“আমাকে আপনি চেনেন?”
“না… মানে, আমি হয়তো… আপনাকে কোথাও দেখেছি। এই পেনডেন্টটা খুব সুন্দর।”
মহিলা হেসে বললেন,
“এটা আমার দিদিমার। ওঁর কাছ থেকে পেয়েছি। পুরনো একটা ট্রাঙ্কে পাওয়া গিয়েছিল—তাতে নাকি একগুচ্ছ চিঠি ছিল। খুব অদ্ভুত কেস ছিল সেটা।”
অনুরাধার গলা শুকিয়ে গেল।
“আপনার দিদিমার নাম কি ইরা সেন?”
মহিলা থমকে গেলেন।
“আপনি কিভাবে জানলেন? আমি ওঁকে কখনো দেখিনি। ওঁর কথা শুধু মা বলতেন। মা-ই এই পেনডেন্টটা দিয়েছিলেন। আপনি কে?”
অনুরাধা যেন সময়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলেন।
এই মহিলা, যার বয়স তিরিশের কাছাকাছি, ইরার রক্তের someone—এক উত্তরসূরি।
তবে তাহলে… এখন কি বছর ২০৫০?
“আপনার নাম?”
“আমি রাহা সেন। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে এসব চিঠিপত্র আর খুঁজিনি। তবে কিছুদিন ধরে স্বপ্নে একটা ঘর দেখি… যেখানে দেয়ালে লেখা হয়, কিন্তু কেউ লিখছে না।”

সেদিন সন্ধ্যায় অনুরাধা ফিরে এসে দেখে, তাঁর ডেস্কে রাখা আছে আরও একটা চিঠি।
কিন্তু এবার কোনো খাম নেই।
সরাসরি কাগজ।
“ভাষার শেষ অধ্যায় শুরু হলো। তুমি দেখবে না লেখা, তুমি হবে লেখা। তোমার শরীরই এখন সময়ের কালি।”
চিঠির নিচে হস্তাক্ষর—

একটা ইংরেজি হরফ।
ই-র মানে ইরা?
না কি ইন্টারমিডিয়েট—a medium?
অনুরাধা ঘুমাতে পারেন না সেদিন।
রাত ৩টা ১২ মিনিটে, দেওয়ালের গায়ে কালি ওঠে আবার।
“শেষ দুই অধ্যায়। এরপর চুপচাপ সব নিঃশেষ।”

নির্বাক শব্দ

চুপচাপ শব্দেরা কখনো হারায় না। তারা থেকে যায়—দেয়ালের ফাটলে, দরজার কবজিতে, বাতাসের ভাঁজে। শুধু তাদের উচ্চারণের জন্য দরকার হয় একজন বহনকারী—একজন যার শরীর, নিঃশ্বাস, অথবা হৃদয় হয়ে ওঠে সময়ের কণ্ঠস্বর। ইরার পরে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আজ রাহা। আর অনুরাধা—সে এখন কেবল সাক্ষী নয়, নিজেও সেই স্তরে পৌঁছে গেছে, যেখানে লেখা হয় না—জেগে ওঠে।
সকালবেলা রাহা অনুরাধার ক্লিনিকে এসে বলল,
“গত রাতে একটা শব্দ ঘোরাফেরা করছিল আমার মাথার ভেতর। আমি লিখিনি, উচ্চারণ করিনি, কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার খাতার ভেতরে লেখা—’শূন্যতা’।”
অনুরাধা থমকে গেলেন।
“কোনো নির্দিষ্ট অক্ষরে লেখা?”
“হ্যাঁ। পুরনো বাংলা হরফে। এমন অক্ষর যা আমি আগে কখনও লিখিনি।”
অনুরাধা জানতেন, এটা কেবল একটা শব্দ নয়।
এটা একটা চিহ্ন।
তাঁর নিজের ঘরেও গত রাতে দেয়ালে ফুটে উঠেছিল সেই এক অক্ষর।
“শূন্যতা”—যা সময়কে গিলে নেয়, আর ফিরিয়ে দেয় অক্ষরহীন এক কাহিনি।
“রাহা,” অনুরাধা বললেন, “তুমি কি জানো ইরা ঠিক কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল?”
রাহা চুপ করে রইল। তারপর ধীরে বলল,
“মা বলত, ও চলে গিয়েছিল এক ‘ভাষাহীন জগতে’। যেখানে শব্দ লেখা হয় না, কিন্তু প্রতিধ্বনি থেকে যায়। মা একবার বলেছিল—’তুমি যদি কখনও শব্দ বুঝে ফেলো, তবে তুমি নিজেই হয়ে যাবে শেষ চিঠির পাঠক। তখন তুমি শুধু জানবে না ভবিষ্যৎ, তুমি হয়ে যাবে ভবিষ্যৎ’।”
অনুরাধা ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।
“চলো, আমরা একটা জায়গায় যাব। যেখানে শেষ চিঠির ছায়া পড়ে ছিল। যেখানে সব লেখা থেমে গিয়েছিল।”
________________________________________
বিকেলে তাঁরা ফিরে গেলেন সেই পুরনো বাড়িতে—ব্রজবিহারী সরণির ধ্বংসপ্রায় কাঠের ঘর।
তিন বছর আগে ইরার প্রথম চিঠি এসেছিল এখান থেকেই।
ঘরটা এবার অনেক বেশি খালি। দেয়াল ন্যাড়া, মেঝে ধুলোহীন, জানালায় রোদের রেখা পড়ে আছে কাঁপা কাঁপা।
রাহা হঠাৎ থেমে গেল।
তার চোখ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক কোণের দিকে।
“এই জায়গাটা আমি আমার স্বপ্নে দেখেছি।”
সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, মাটি ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলল—
“এখানে কেউ ছিল। এক নারী, যাঁর মুখ স্পষ্ট না, কিন্তু হাতে ধরা ছিল চিঠির গুচ্ছ। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—‘তুমি এসেছো শব্দ ফেরাতে।’”
অনুরাধা সেই মুহূর্তে কাঁপতে কাঁপতে সামনে এগিয়ে গেলেন। দেয়ালের একটা পাটাতনে হঠাৎ একটা শব্দ হল—ঠক।
একটা আলগা কাঠের খণ্ড সরিয়ে তাঁরা পেলেন একটা ছোট লোহার বাক্স।
ভেতরে কিছু নেই, শুধু একটা পাতলা রোল করা কাগজ।
রাহা সেটা খুলে ধরল।
লেখা—
“এই হল শেষ চিঠি। এরপর আর কেউ পাবে না। কারণ চিঠির ভাষা এবার শরীরের ভেতরে, লেখার বাইরের এক স্তরে পৌঁছে যাবে।
যারা জানে, তারা আর লিখে না। যারা বোঝে, তারা চুপ করে যায়।
এবার নীরবতা লিখবে। আর শব্দ হবে তার ছায়া।”
অনুরাধা চোখ বুজলেন।
“তাহলে এটা একটা উত্তরাধিকার ছিল। একটা বহমান ভাষা, যেটা শরীর থেকে শরীরে, ঘর থেকে ঘরে, চিঠি থেকে নীরবতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এবং শেষমেশ, এই রূপান্তর একজনকে লেখক বানিয়েছে, যিনি কখনও কলম ধরেননি।”
রাহা তখন দেয়ালের এক কোণে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি জানো না, আমি এখন শুধু লেখক না—আমি ভাষার শেষ পথ। এবার যা লেখা হবে, তা আমার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে যাবে।”
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
দেয়ালে হঠাৎ ছায়া নড়ল, তাতে ফুটে উঠল একটা মুখ।
ইরার মুখ।
সে চুপচাপ তাকিয়ে আছে রাহার দিকে।
মুখে একটুও অভিব্যক্তি নেই।
তার ঠোঁট নড়ছে না, তবু ঘরে একটা শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে—
“শেষ অধ্যায়। প্রস্তুত হও।”

শেষ চিঠি

সেই রাতে কোনো চিঠি আসেনি।
না জানালার ফাঁক দিয়ে, না দরজার নিচে, না বিছানার পাশে নিঃশব্দে রাখা পাতায়।
কিন্তু ঘরের ভিতর শব্দ ছিল—অভ্যস্ত শব্দ নয়, অনুচ্চারিত এক গুঞ্জন, যেন দেয়ালের নীচে, মেঝের ভাঁজে, বাতাসের রন্ধ্রে কেউ চুপ করে পড়ে নিচ্ছে এমন কিছু যা ভাষায় লেখা যায় না।
রাহা আর অনুরাধা পাশাপাশি বসে ছিল বিছানায়, মাঝখানে রাখা ছিল সেই শেষ কাগজখণ্ড—যেটা বলেছিল, “এবার নীরবতা লিখবে”।
“তুমি কী অনুভব করছো?”
অনুরাধা জিজ্ঞেস করলেন।
রাহা চুপ করে তাকিয়ে রইল দেয়ালের দিকে।
“আমার শরীরের ভিতরে কিছু একটা ধীরে ধীরে সরছে। যেমন একটা নদী বরফ ঢাকা থাকে, কিন্তু নিচে স্রোত থাকে—তেমন। আমি বুঝতে পারছি, ভাষা এবার আমার ভিতরেই জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু শব্দ নেই। অনুভব আছে।”
অনুরাধা জানতেন—এই অনুভবই এখন ‘লিখন’। এই শব্দহীনতার মধ্যেই তৈরি হচ্ছে সেই শেষ বার্তা।
রাত ৩:১২।
সময়টা যেন আজও ফিরে আসে প্রতিটি মোচড়ে।
ঠিক তখনই জানালার বাইরে একটা ঝড়ের দমকা আসলো না থেকেও। বাতাসের স্রোতে আলো নিভে গেল।
ঘরজোড়া আঁধারে রাহা উঠে দাঁড়াল।
তার মুখে কোনো ভীতির রেখা নেই।
তার চোখ জ্বলছে না, শুধু স্থির।
সে এক ধাপ এগিয়ে দেয়ালের সামনে দাঁড়াল।
তার মুখ খুলল না, তবু ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে একসাথে উঠতে লাগল একটাই শব্দ—
“আমি লিখি না, আমি ঘটে যাই।”
একটি একটি করে অক্ষর দেয়ালের ওপরে ফুটে উঠতে লাগল—
না রং দিয়ে, না হাত দিয়ে, কেবল সময়ের ঘাম জমে থাকা অদৃশ্য কালি দিয়ে।
“শেষ চিঠি কেউ পড়বে না। কারণ তা আর কাগজে লেখা নয়।
শেষ চিঠি বোঝে না কেউ। কারণ তা ভাষা নয়, অনুভব।
শেষ চিঠি পাবে না কেউ। কারণ তা এক শরীর থেকে আরেক শরীরে সরে যায়।
যখন কেউ সত্যি পড়ে ফেলে নিজের শরীর—তখনই সে হয়ে ওঠে সেই চিঠি।”
অনুরাধা দাঁড়িয়ে গেলেন।
রাহা তখন অদ্ভুতভাবে নিঃস্তব্ধ।
তার মুখে হাসি নেই, দুঃখ নেই, শুধু এক স্বাভাবিক নিষ্পাপ নির্লিপ্ততা—যেমন থাকে শিশুর চোখে, অথবা মৃত্যুর মুখে।
তারপর সে ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরল।
বলল,
“আমি যাচ্ছি।
তোমার মতো একজনকে পেয়ে ভাষা আবার নতুন এক শরীর খুঁজবে।”
“তুমি কোথায় যাবে?”
“যেখানে কোনো শব্দ নেই, তবু সব লেখা থাকে।”
রাহা দরজা খুলে বাইরে পা রাখল।
রাতটা তখন থেমে নেই, শুধু শব্দহীন।
এক মুহূর্ত পরে দরজা বন্ধ হল।
অনুরাধা বুঝলেন—এটাই শেষ চিঠি।
এটাই অলিখিতের অন্তিম অধ্যায়।

পরদিন সকালবেলা, ইরা সেনের নামে যে পুরনো কেস ফাইল ছিল পুলিশ রেকর্ডে, তাতে লেখা হল—Status: Closed।
কারণ ইরা নামে আর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে তার পেনডেন্ট আজও আছে—এক জাদুঘরে রাখা, নাম নেই, ব্যাখ্যা নেই—শুধু একটা কাচের বাক্সের নিচে ছোট করে লেখা আছে:
“The Letter That Was Never Written”

শেষ

WhatsApp-Image-2025-08-01-at-4.13.56-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *