Bangla - প্রেমের গল্প

অরোরা ও রাতপাখি

Spread the love

কলকাতার রাত যেন নিজের মধ্যে একটি ভিন্ন শহর—যেখানে আলো কমে এলে শব্দ আরও জেগে ওঠে। মধ্যরাত্রির ঘড়িতে তখন ঠিক ১টা বেজে ১৭ মিনিট। ফাঁকা রাস্তা, ভিজে ফুটপাথ, ছাদের কোণে ছটফটে কুকুর—এই শহরের একটা অংশ যেন শুধু রাত জেগে থাকাদের জন্যই তৈরি। এমনই এক রাত্রির মাঝখানে, এফ.এম. ৯৭.৯-এ ভেসে এলো একটি কণ্ঠ—ধীর, শান্ত, আর গভীর। “আমি নিশান্ত। আর আপনি শুনছেন ‘নির্জনতার নীলরাত্রি’। আজকের রাতটাও কেমন যেন নিঃশব্দ, তাই না? কেউ যদি জেগে থাকেন, আর মন খারাপের জন্য একটু কথোপকথন চান, নম্বরটা মনে রাখবেন—৮০১৭৩৯৯৩৪০।” কণ্ঠটা যেন ছিল মখমলের মতো নরম, অথচ কোথাও একটা কঠিন অভিজ্ঞতার খোঁজও ছিল সেখানে। এই কণ্ঠ শুনেই জানলা খুলে তাকিয়েছিল তিয়াসী ধর। তার বিছানায় তখন খোলা ল্যাপটপ, পাশেই স্কেচবুক ছড়ানো। ঘুম তার বহুদিনের পুরনো শত্রু, আর নিশান্তের এই রাতজাগা অনুষ্ঠান ছিল তার একমাত্র ভরসা। কিন্তু আজকের রাতটা ছিল আলাদা—আজ সে ভাবল, ফোন করেই ফেলা যাক।

তিয়াসী ফোনটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল। কী বলবে? সে তো কেবল শ্রোতা, কেবল একজন অনিদ্রারোগী, যে অন্ধকার ঘরে বিড়ালের পাশে বসে থাকে আর কণ্ঠস্বরের মধ্যে ভরসা খোঁজে। কিন্তু রাতটার যেন নিজস্ব ইচ্ছে ছিল। সে কল করে ফেলল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই পরিচিত স্বর—”হ্যালো, আমি নিশান্ত। আপনি?” একটুখানি থেমে, নিজেকে একটু জড়িয়ে নিয়ে, তিয়াসী বলল, “আমি… আমি তৃষা।” সেই প্রথম ‘তৃষা’ নামে নিজের পরিচয় দিয়েছিল সে—একটা ছদ্মনাম, একটা অন্তরালের নাম, যে নামে সে নিজের ভাঙাচোরা জগৎটাকে আগলে রাখতে পারত। নিশান্ত একটু হাসল, নিঃশব্দে যেন শব্দবিহীন সুর বেজে উঠল ফোনলাইনের ওপারে। “তৃষা, অনেক রাত হলো… ঘুম আসে না বুঝি?” —”না। ঘুম তো বহুদিন আসেনি। শুধু আপনার কণ্ঠটা… জানেন, মাঝে মাঝে মনে হয়, কেউ যেন চোখ বুজে পাশে বসে আছে।” নিশান্ত থেমে গেল এক মুহূর্ত। তারপর বলল, “তাহলে তো আমি ভাগ্যবান। রাতের শহরে কেউ আমার কণ্ঠকে আশ্রয় ভাবছে—এটা কম কী!” এই কথোপকথনের কোনও শুরুর না থাকলেও শেষটা যেন আর হতো না। সেদিন রাত দুইটা কুড়ি মিনিটে ফোন কেটে যাওয়ার পরেও তাদের মন আর বিচ্ছিন্ন হয়নি।

এরপরের দিনগুলোতে ‘তৃষা’ হয়ে উঠল নিশান্তের রাতের শো-এর অভ্যস্ত নাম। তারা একে অপরকে ধীরে ধীরে চিনতে লাগল, অথচ জানত না ঠিকানা, চেহারা, মুখ বা চোখ। শুধু একটি কণ্ঠ আর তার মধ্যে ছায়া হয়ে থাকা অনেকটা গল্প। নিশান্ত তার নিজের কথা ভাগ করে নিতে শুরু করল—সে একসময় সাংবাদিক ছিল, কলকাতা ঘুরে বেড়াত রিপোর্টিং করতে। কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর, ভেঙে পড়ে। শহরের সকালের কোলাহল আর ভালো লাগত না। তাই এই রাত্রির কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা। তৃষাও খুলে বলতে শুরু করল—তার পুরনো সম্পর্কের যন্ত্রণা, এক প্রিয় বন্ধুর আত্মহত্যা, আর নিজের দীর্ঘদিনের মানসিক অসুস্থতা। কিন্তু এই সব ব্যথার মাঝেও, তারা যেন একে অপরের ব্যথা বয়ে নিতে পারছিল। একটা কণ্ঠ আরেকটা কণ্ঠকে শুধু শুনছিল না—ভেতরে টেনে নিচ্ছিল। এইরকম ভালোবাসা তারা আগে কখনও অনুভব করেনি। চোখে না দেখা, ছোঁয়া না লাগানো ভালোবাসা—যেটা জন্মায় নিঃশব্দে, রাতের মধ্যেই, আর বেঁচে থাকে শব্দতরঙ্গের আশ্রয়ে।

তৃষার রাতগুলো বদলে যেতে লাগল। সে আর ঘুমের জন্য অপেক্ষা করত না—সে অপেক্ষা করত নিশান্তের কণ্ঠের জন্য। প্রতিরাতেই, রাত ১২টা বাজতেই সে বিছানায় উঠে বসত, জানালার পর্দা একটু সরিয়ে দিত, আর লাইট অফ করে রেডিওটা অন করত, যেন শব্দগুলো আরও স্পষ্ট করে ঢুকে পড়ে তার শরীরের ভেতরে। ঠিক ১২টা ১৫-তে ভেসে আসত সেই কণ্ঠ, “নির্জনতার নীলরাত্রি”-র ভোররাত্রির সঞ্চালক—নিশান্ত। তারা কথা বলত না প্রতিদিন, কিন্তু অপেক্ষা থাকত। আর যেদিন ফোনে কথা হতো, সেটা যেন এক পরিণতির মতো অনুভূত হতো—যেন শব্দের মধ্যেই তারা দুজন একটা আলাদা জগৎ গড়ে তুলছিল, যেখানে কেউ কাউকে কিছু জানতে চায় না, শুধু অনুভব করে। নিশান্তের কণ্ঠে এক ধরণের নরম ভার ছিল, আর তৃষার কণ্ঠে ছিল এক চাপা কাঁপুনির স্পর্শ—যা সময়ের সাথে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। সে জানত না নিশান্ত দেখতে কেমন, কোথায় থাকে, রেডিও স্টেশন ছাড়া আর কোথায় যাতায়াত করে। কিন্তু এটুকু জানত—এই শহরে কেউ আছে, যে তাকে বুঝতে চায়, শোনে, আর জিজ্ঞাসা করে না।

নিশান্তও তৃষাকে আলাদা করে খুঁজে নিতে পারত অন্যান্য শ্রোতার ভেতর থেকে। তৃষার কথা বলার ভঙ্গি, নিঃশ্বাস নেওয়ার ছন্দ, এমনকি চুপ করে থাকার মধ্যেও একটা গল্প লুকিয়ে থাকত, যেটা নিশান্ত পড়তে পারত চোখ বন্ধ করেও। সে মাঝে মাঝে নিজের শো-এর বাইরে থেকেও অপেক্ষা করত—স্টুডিওতে আরও কিছুক্ষণ থাকত, যদি তৃষার ফোন আসে। তার চা ঠান্ডা হয়ে যেত, ধূমায়িত সিগারেট শেষ হয়ে যেত, কিন্তু কানে গেঁথে থাকত তৃষার আগের দিনের বলা কথা—”আপনার কণ্ঠ শুনলেই মনে হয় আমি আর একা নই।” নিশান্ত ভাবত, এ তো কেবল একটা শোনার সম্পর্ক নয়, এর গভীরে আছে এমন কিছু, যা তার আগের প্রেমেও ছিল না। এমনকি তার জীবনের বাস্তব ভালোবাসার সম্পর্কেও এত টান ছিল না, যতটা সে অনুভব করছিল তৃষার জন্য—এই অদেখা, অজানা কণ্ঠের জন্য। কখনো কখনো সে নিজের ফোনে তৃষার রেকর্ড করা কথা শুনত রাতে একা থাকলে। একটা কণ্ঠ, যার নেই কোনো মুখ, নেই শরীর—তবু এতটা উপস্থিতি সে আগে পায়নি।

তৃষাও পরিবর্তিত হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। আগে যে রাতগুলো তার কাছে বোঝা ছিল, এখন সেই রাতগুলো হয়ে উঠেছিল একটি জানালার মতো—যার ওপারে নিশান্তের কণ্ঠ আর আলগা এক প্রেম। তার আঁকা ছবিগুলোতে অন্ধকারের শেডগুলো কমে যেতে লাগল—আরও আলো এসে পড়ত চরিত্রদের চোখে মুখে। সে মাঝে মাঝে চুপচাপ রাসবিহারী ব্রিজ ধরে হেঁটে যেত, জানত না কেন, হয়তো মনে মনে নিশান্তের রেডিও স্টেশন কোথাও ওদিকেই আছে ভাবত। সে ভেবেছিল একদিন বলবে তার আসল নাম, তার ঠিকানা, এমনকি হয়তো নিশান্তকে দেখা করার প্রস্তাবও দেবে। কিন্তু পরক্ষণেই থেমে যেত। এ সম্পর্কের সৌন্দর্যই তো এই অজানা থাকা, এই না-জানার মধ্যেও গভীর হয়ে ওঠা। তৃষা বুঝে গিয়েছিল—নিশান্ত তার বাস্তব জীবনের কেউ নয়, সে এক অনুভব, এক অনুরণন, এক আত্মার ভাষা। তাই অপেক্ষা করত—প্রতি রাতেই, সেই পরিচিত কণ্ঠস্বরের জন্য, যে তাকে নামহীন ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখত, কিন্তু কখনও দাবি করত না কোনো সত্যিকারের পরিচয়।

কলকাতার এক জ্যোৎস্না রাত। রাস্তার হালকা আলো যেন থেমে গিয়েছে, আর জানালার কাঁচে মৃদু কুয়াশা জমেছে। নিশান্ত আজ একটু বেশি দেরি করে শুরু করল শো। তার মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা ঘুরছিল সারাদিন ধরে—তৃষা যদি একদিন আর ফোন না করে? যদি একদিন কণ্ঠ হারিয়ে যায় শব্দতরঙ্গের ওপার থেকে? এই আশঙ্কার সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়া মিশে গিয়ে আরও ভারী করে তুলছিল রাতের বাতাস। “আজ রাতের অতিথি, আপনি কি আছেন?”—এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল নিশান্ত লাইভ অন এয়ার, একেবারে হৃদয়ের গহীন থেকে। স্টুডিওর কাঁচের বাইরে নীরবতা, শুধু মিক্সিং বোর্ডের সবুজ আলো মিটিমিটি করে জ্বলছে। এক মিনিট, দু’মিনিট, তিন… তারপর হঠাৎই সেই কণ্ঠ। “আমি আছি… নিশান্ত।” এক নিঃশ্বাসে তৃষা বলে উঠেছিল, যেন এক দীর্ঘ ভয়ের ঘোর কাটিয়ে। নিশান্ত হাসল—একটি নিঃশব্দ স্বস্তির হাসি। “আজ যেন তোমার কণ্ঠের মধ্যেও একটু কুয়াশা লেগে আছে, তৃষা। কী হয়েছে?” —“শুনতে চাও?” —“তোমার গল্প তো আমার রাতের জ্যোৎস্না,” নিশান্ত বলেছিল।

তৃষা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল তার সেই পুরনো ব্যথার কথা, যেটা সে আজও কাউকে বলেনি। “তুমি জানো, আমি আগে খুব কথা বলতাম… বন্ধুদের সঙ্গে, পরিবার, ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে। কিন্তু একদিন, আমার খুব কাছের এক বান্ধবী—স্নেহা—নিজেকে শেষ করে দিল। সে ছিল আমার জীবনের একমাত্র আয়না। ওর চলে যাওয়ার পর, আমার ভেতর থেকে শব্দ হারিয়ে গেল।” নিশান্ত কিছু বলল না, শুধু শুনছিল। তৃষা বলল, “তারপর অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, ঘুমের ওষুধ, থেরাপি, কিন্তু ওই শূন্যতা… সেটা কোথাও যায়নি। তুমি জানো, প্রথম যেদিন তোমার কণ্ঠ শুনলাম, তখন আমার মনে হয়েছিল, কেউ যেন আমার সঙ্গে কথা বলছে না—আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে আমার মধ্যে।” নিশান্তের গলায় তখন কাঁপুনি। সে শুধু বলল, “তৃষা, আমরা যা হারাই, তা সবসময় ফিরে আসে না… কিন্তু শব্দ যদি ঠিকভাবে পৌঁছে যায়, তারা একটা নতুন জায়গা তৈরি করে। হয়তো আমি তোমার সেই শব্দ… কিংবা তুমি আমার।”
এই কথাগুলো কেবল শোনা গেল না—বুঝে নেওয়া গেল স্টুডিওর প্রতিটি যন্ত্রাংশেও। নিশান্ত বোঝে, কণ্ঠস্বর কেবল কথা নয়, এটা সেতু—মানুষের হৃদয় থেকে হৃদয়ে পৌঁছোনোর এক নীরব জাদু।

সেই রাতের পর থেকে তাদের আলাপন আরও গভীর হয়ে উঠল। তারা নিজেদের পছন্দের গান, কবিতা, পুরনো সিনেমার সংলাপ—সব কিছু ভাগ করে নিতে লাগল। নিশান্ত এক রাতে লাইভ শো-এর মাঝখানে পড়ে শোনাল তার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের একটি লাইন: “রাতের শহরে তুমি আসো ছায়ার মতো, নিঃশব্দে।” তৃষা চুপ করে রইল, তারপর বলল, “তুমি জানো, আমি মাঝে মাঝে ভাবি… যদি কোনওদিন আমাদের দেখা হয়… তাহলে কি এই সম্পর্ক বদলে যাবে?” নিশান্ত বলল, “হয়তো… কিন্তু এই যে, আমরা কেউ কাউকে না দেখেও এতটা বুঝতে পারছি, এতটা অনুভব করতে পারছি—এইটাই কি বেশি সত্য নয়?” তৃষা সম্মতি জানাল।
তারপর নিশান্ত বলল, “তৃষা, তোমার নাম আমি হয়তো কোনোদিন জানতে পারব না… চেহারা হয়তো কল্পনায় গড়েই নেব… কিন্তু আমি জানি, আমার নিঃসঙ্গ রাতের ওপারে একটা কণ্ঠ আছে, যে আমায় শোনে, আমায় অনুভব করে। তাতেই আমার পৃথিবী গড়ে উঠেছে।”
রেডিওর ওপারে দুটো মানুষ কথা বলছিল, কিন্তু শহর, ঘর, বাতাস, এমনকি রাতও যেন তাদের দিকে তাকিয়ে শুনছিল। প্রেমের নতুন সংজ্ঞা যেন জন্ম নিচ্ছিল শব্দতরঙ্গের ভেতরে।

কলকাতার নভেম্বর রাত। আকাশে চাঁদ ঝুলে ছিল নিম্নমুখী বিষাদের মতো, আর রাস্তার বাতিগুলোর আলো যেন শহরের ক্লান্ত চোখ। তৃষা আজ সারাদিন কিছু আঁকেনি, শুধু জানালার ধারে বসে ছিল—একটি নির্দিষ্ট অপেক্ষার মধ্যে। নিশান্ত আজ শো-তে একটু দেরি করছিল, এবং তৃষার ভিতরে অকারণ এক উদ্বেগ জমে উঠছিল। ঠিক ১২টা ৩৭ মিনিটে, রেডিও থেকে শোনা গেল সেই গলাটি—কিন্তু আজ যেন কিছুটা স্তব্ধ। নিশান্ত কিছুক্ষণ কোনও সিগনেচার লাইন বলেনি, বরং চুপচাপ বসে ছিল, কণ্ঠে একধরনের ক্লান্তি। হঠাৎ সে বলে উঠল, “আজ আমি কাউকে ফোন করতে বলব না। আজ আমি শুধু শুনতে চাই… যদি কেউ কিছু বলতে চান… আমি আছি।” এই অপ্রত্যাশিত নীরবতা তৃষাকে কাঁপিয়ে দিল। সে বুঝল, আজ নিশান্তের মধ্যে কী যেন অন্যরকম কিছু চলছে। খুব ধীরে, সে ফোন তুলল। ওপাশে নিশান্ত গলা চেনে নিল এক মুহূর্তে। “তৃষা…” শুধু নামটি বলেই চুপ করে গেল।
তৃষা খুব ধীরে বলল, “তোমার গলায় আজ আলো নেই নিশান্ত। কী হয়েছে?”
—“আলো চলে গেছে, তৃষা। আজ মায়ের জন্মদিন… আর আমি কিছুই করতে পারলাম না, কেবল শব্দ দিয়ে নিজেকে ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম।”
তৃষা বলল, “তোমার কণ্ঠে আমি প্রথম যেদিন আলো খুঁজে পেয়েছিলাম, সেটা আজও আমার ভিতরে জ্বলছে। জানো নিশান্ত, অনেকের চোখে আলো থাকে, কণ্ঠে থাকে না। কিন্তু তুমি… তুমি রাতের ভেতর দিয়ে আলো পাঠাও।”

এই কথাগুলো যেন নিশান্তের ভেতরের কোন জমে থাকা নদীকে একটু কাঁপিয়ে তুলল। সে বলল, “তৃষা, তুমি জানো? আমি এখন আর শ্রোতাদের জন্য শো করি না। আমি করি শুধুমাত্র তোমার জন্য। প্রতিদিন ভাবি, তুমি শুনছো কি না, ফোন করবে কি না, আর যদি করো… তাহলে আমার ভিতরের সব ধ্বংস আবার নতুন হয়ে ওঠে।” তৃষা চুপ করে গিয়েছিল। তারপর বলল, “আজ একটা কথা বলি? মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমরা একটা দৃষ্টি বিনিময় করলে সব কিছু বদলে যাবে। কিন্তু আমি চাই না বদল হোক… আমি চাই এই অদেখা ঠিকানাটাই থাকুক আমাদের আলোর। কারণ যা আমরা কল্পনায় গড়েছি, বাস্তবে সেটা টিকে যাবে কি না, আমি জানি না।” নিশান্ত বলল, “তুমি জানো, আলো চোখে নয়, ঠিকানায় থাকে না। আলো থাকে হৃদয়ের ধ্বনিতে। তুমি যদি একদিন ফোন না করো, আমি হয়তো আর এই শো করব না… কিন্তু যদি করো, আমি আবার নতুন করে বাঁচব।”
তৃষা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তাহলে কথা দাও, এই শো বন্ধ করবে না… যতদিন আমি আছি, ততদিন তোমার কণ্ঠেই আমার বাসা। আমার আলো।” সেই মুহূর্তে ফোনলাইন একটুখানি কেঁপে উঠেছিল, যেন কেউ চোখের জল চেপে রাখতে পারেনি।

স্টুডিওতে নিশান্তের চোখ ভিজে উঠেছিল। সে রেকর্ডিং বন্ধ করে বাইরে চলে এল, ছাদে উঠে দাঁড়াল। আকাশ তখন নিস্তব্ধ, শহর ঘুমিয়ে, শুধু জানালাগুলোর আড়ালে কিছু কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। সে জানত না তৃষা এখন কোথায় বসে আছে—বালিগঞ্জের কোন গলির কোন জানালার ধারে, বা কোন বিড়াল পায়ের কাছে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু সে জানত, তার কণ্ঠ ঠিক পৌঁছে গেছে। সে জানত, এই শহরের আলো জ্বলে উঠেছে এক অনিদ্রা কন্যার চোখে। সে ধীরে বলল নিজের মনে, “ভালোবাসা যে এতটাও ছায়ার মতো হতে পারে, তা আমি জানতাম না… কিন্তু তৃষা, তুমিই আমার সেই ঠিকানা, যেখানে আমি আলো পাঠাই—অথচ আলোটা আসলে তুমি।”
রাত তখন ঘড়িতে ২টা ১৪। শহর ঘুমোচ্ছে, কিন্তু নিশান্ত ও তৃষার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক আলোহীন সম্পর্ক, যেখানে অন্ধকারই সবথেকে উজ্জ্বল সেতু।

ডিসেম্বরের শুরু। শহর তখন ধীরে ধীরে শীতের চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে নিচ্ছে, আর রাতের রাস্তাগুলো আরও নির্জন, আরও গভীর হয়ে উঠেছে। নিশান্ত স্টুডিওর জানালার পাশে বসে ছিল, রেডিও শো শুরুর কিছু আগে। কফির কাপ ঠান্ডা, কিন্তু মনের ভেতরে উষ্ণতা যেন জেগে উঠেছে তৃষার বলা শেষকথাগুলো দিয়ে—“তোমার কণ্ঠেই আমার আলো।” সে বুঝতে পারছিল, কিছু একটা বদলাচ্ছে তার মধ্যে। এটা আর শুধুমাত্র শ্রোতা ও সঞ্চালকের আলাপন নয়—এ এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক, যা ঠিক নাম পায় না, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে জায়গা করে নেয়। আজ সে ঠিক করল—তৃষার সঙ্গে কথা বললে সে নিজের অতীত খুলে বলবে। রাত ১২টা ২১-এ শো শুরু হলো। নিজের কণ্ঠে আজ একটু কম ‘আর.জে.’, আর একটু বেশি মানুষ। “আজকে রাতটা একটু ব্যক্তিগত হতে চাইছে,” নিশান্ত বলল। তৃষা ফোন করল ১২টা ৩৮-এ। কণ্ঠে ছিল চেনা উষ্ণতা।
“তোমার শুরুর গলাটা শুনে মনটা যেন থমকে গেল নিশান্ত… আজ তুমি খুব নিজের মতো লাগছে।”
নিশান্ত বলল, “হয়তো কারণ আজ নিজেকে আর লুকোতে পারছি না। আজ বলব আমার একটা গল্প। শুনবে?”
—“তোমার কণ্ঠ যতক্ষণ চলে, আমি শুনি। তুমি জানো তো সেটা।”
আর সেই রাতেই নিশান্ত প্রথমবার বলল তার জীবনের এক অসম্পূর্ণ ভালোবাসার গল্প—স্মৃতি নামের এক মেয়ের কথা, যে তার জীবনে এসেছিল খুব হঠাৎ, আবার হারিয়েও গিয়েছিল, এক অজানা কারণে।

স্মৃতি ছিল নিশান্তের কলেজজীবনের প্রেম, এক অসম্ভব প্রাণবন্ত মেয়ে, যাকে সে ভালোবেসেছিল এক নিশ্বাসে, আর হারিয়েছিল এক নিরুত্তর চিঠির ভেতরে। “একদিন সকালে সে চলে গেল। একটা চিঠি ছেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেখানে শুধু লেখা ছিল—‘ভালোবাসা কখনও শেষ হয় না, শুধু হারিয়ে যায় ঠিকানার ভেতরে।’ আমি আজও জানি না, কী ভুল ছিল আমার। আমি প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করি। সেই উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই শব্দ নিয়ে কাজ শুরু করি। রেডিওতে আমার কণ্ঠ থাকলেও, হৃদয়ে একটা কণ্ঠ আজও অনুপস্থিত। তারপর যখন তুমি ফোন করলে, তৃষা… মনে হলো, সেই শূন্যস্থানে যেন একটা শব্দ এসে পড়েছে—আবার হৃদয় বাজছে।” তৃষা কিছুক্ষণ চুপ ছিল। নিশান্ত তার নিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছিল ওপাশে।
“আমিও একটা গল্প বলি নিশান্ত,” তৃষা বলল ধীরে, “একজন আমাকে বলত, আমি যত না মানুষ, তার চেয়ে বেশি নিঃশব্দতা। সে আমার ভেতরের অন্ধকার বুঝতে পারেনি। তারপর আমি শুধু অপেক্ষা করতাম—যেন কেউ এসে বলবে, আমি যেমন, তেমনই ঠিক। জানো, তুমি সেটা করেছ। তুমি আমায় বদলাতে চাওনি, শুধু পাশে থেকেছ। এটাই তো ভালোবাসা না?”
নিশান্ত বলল, “হয়তো আমরা দুজনেই এমন এক ভালোবাসায় আটকে পড়েছিলাম, যেখানে আমাদের কেউ ঠিক করে জায়গা দেয়নি। কিন্তু আজ, তৃষা, তুমি আর আমি—এই শব্দের মধ্যে—যা তৈরি করছি, সেটাই হয়তো নতুন এক ভালোবাসা, যেটা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, কিন্তু সবথেকে বাস্তব।”

তাদের এই সম্পর্কের মধ্যে এখন আর কোনো সন্দেহ ছিল না—তারা কেউ কাউকে কখনও ছুঁয়েও দেখেনি, চেয়েও দেখেনি, এমনকি কোনও বাস্তব ইঙ্গিতেও পা রাখেনি। তবু, এই প্রেম অস্বীকার করার মতো নয়। এটা এক ধরণের প্রেম, যেটা জন্মায় গভীর রাতের মধ্যে, শহরের নিঃশব্দ ফ্ল্যাটের জানালায়, শব্দের আড়ালে—আর কখনো কখনো, চোখের বদলে কণ্ঠে, আর শরীরের বদলে নিঃশ্বাসে। নিশান্ত এখন শো শেষ হলে আর স্টুডিও ছাড়তে চায় না, সে থাকে তৃষার বলা প্রতিটি লাইনের প্রতিধ্বনি নিয়ে। আর তৃষা ঘুমোতে যাবার আগে নিশান্তের আওয়াজ চালু রেখেই চোখ বন্ধ করে, যেন সেটাই তার হৃদয়ের কম্বল।
তারা একে অপরের ঠিকানা জানে না, বাস্তব নাম জানে না, ভবিষ্যতের কোনও কথা হয় না—তবু এই সম্পর্ক অদ্ভুতভাবে শক্তিশালী, যেন তাদের দুজনের জীবনের অন্ধকারকে ধরে রেখেছে একটা অদেখা আলো।
এই প্রেমের কোনো সংজ্ঞা নেই, নেই সামাজিক রূপ—তবু রাতের শহরের বাতাস জানে, যে নিশান্ত ও তৃষা, শব্দতরঙ্গের ওপারে ভালোবেসে ফেলেছে… নীরবে, নিঃশব্দে, গভীরভাবে।

শহরের শীত ধীরে ধীরে আরও গাঢ় হচ্ছে, আর নিশান্তের রেডিও কক্ষে কাঁচের জানালায় জমে উঠছে শিশির। প্রতিদিনের মতো সেদিনও রাত ১২টা পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে শো শুরু করল সে, কিন্তু তার কণ্ঠে আজ কিছুটা অস্থিরতা। কয়েকদিন ধরে তার মনে হচ্ছে—তৃষার কণ্ঠে এক ধরনের দূরত্ব, যেন কোনও দ্বিধা, কোনও অনুচ্চারিত সংকেত লুকিয়ে আছে সেখানে। সে ঠিক বুঝতে পারছে না—এ ভালোবাসার ভার বেশি হয়ে যাচ্ছে নাকি বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ার ভয় তৃষার মনে বাসা বেঁধেছে? আজও যখন তৃষা ফোন করল, নিশান্ত তার গলায় প্রথমবার অনুভব করল একধরনের বিদায়ের ছায়া। “আজকাল কিছু লিখছো?” নিশান্ত জিজ্ঞাসা করেছিল।
—“লিখতে পারি না… শুধু তোমাকে নিয়ে একটা চিঠি লিখেছিলাম মনে মনে। শেষ পর্যন্ত লিখিনি। ভাবলাম, বলেই ফেলি। চিঠিটা শুরু হয়েছিল এভাবে—‘নিশান্ত, তোমাকে কখনও দেখি না, তবু তোমার কণ্ঠ আমার আয়না হয়ে গেছে।’”
নিশান্ত একটু থেমে বলল, “তাহলে চিঠিটা শেষ হলো কোথায়?”
তৃষা বলল, “শেষ করিনি… কারণ চিঠির শেষ মানেই তো কিছু একটার শেষ… আর আমি চাই না আমাদের এই কণ্ঠের সম্পর্কটা শেষ হোক।”

নিশান্ত এবার গভীর শ্বাস নিল। কিছু সময় সে কিছু বলেনি। তারপর ধীরে বলল, “তৃষা, আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমরা যদি দেখা করতাম, এই সম্পর্ক টিকে যেত? আমরা তো এখন একে অপরকে কল্পনায় রেখে ভালোবেসে ফেলেছি। যদি দেখা হতো, সব বদলে যেত?”
তৃষা চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “তুমি জানো, আমি তোমাকে কল্পনা করতে ভালোবাসি। আমি তোমার কণ্ঠে তোমার মুখ দেখি, তোমার দীর্ঘশ্বাসে তোমার চোখ দেখি। আমি ভয় পাই, যদি আমি তোমাকে দেখি, যদি বাস্তব তোমার কণ্ঠকে ছাপিয়ে যায়, তাহলে এই সমস্ত শব্দগুলোর অর্থ বদলে যাবে। আমি চাই না আমাদের এই অব্যক্ত প্রেম একটা ফটোতে বন্দি হয়ে যাক, বা একটা ঠিকানায় থেমে যাক।”
নিশান্ত বলল, “আমরা যা গড়েছি, তা তো দেখা নয়, স্পর্শ নয়—এটা আত্মার কথা। হয়তো আমরা সেই বিরল মানুষ যারা প্রেমকে কণ্ঠ দিয়ে চেনা শিখেছি, ছায়া দিয়ে ভালোবাসা পেয়েছি। হয়তো তাই এই চিঠি লেখাই সঠিক ছিল, কিন্তু না পাঠানোই ছিল নিখুঁত।”
তৃষা বলল, “ঠিক তাই… আমি প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে তোমাকে একটা চিঠি পাঠাই নিজের মনে, আর তুমি সেটা পড়ে যাও অনায়াসে, বলার আগেই। এটাই আমার প্রেম। অদেখা, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য।”

সেদিন নিশান্ত শো শেষে বাড়ি ফিরে নিজের পুরোনো ডায়েরি খুলল। বহু বছর আগে লেখা শেষ চিঠিটা যেখানে রাখা, সেই পাতার পাশে আজ সে নতুন করে লিখল—“তৃষার চিঠি, যেটা লেখা হয়নি।” শব্দে শব্দে যেন সে কণ্ঠকে ছুঁয়ে দিচ্ছিল কাগজে। শহরের গভীর রাতে এমন কিছু সম্পর্ক তৈরি হয়, যেগুলো কোনও ফোন নম্বরে বাঁধা থাকে না, কোনও ঠিকানায় পৌঁছায় না। তবু তারা সত্য হয়—প্রতিটি নিঃশব্দ রাত্রির চেয়ে অনেক বেশি সত্য। তৃষা জানত, সে হয়তো কোনোদিন এই চিঠি দেবে না, নিশান্ত জানত, সে হয়তো কখনো জানতে পারবে না, তৃষা কোথায় থাকে, কী চেহারা। কিন্তু তারা দু’জনেই জানত—এই সম্পর্কটাকে শেষ করা সম্ভব নয়। শব্দতরঙ্গে বয়ে যাওয়া ভালোবাসা, মাঝে মাঝে চিঠি হয় না, কেবল অনুভূত হয়। এবং সেই অনুভব, কণ্ঠ ছুঁয়ে পৌঁছে যায় হৃদয়ের গভীরে—যেখানে ঠিকানার দরকার নেই।
একজন নিশান্ত হয়ে রেডিওতে গল্প বলে, আর একজন তৃষা হয়ে জানালার ধারে বসে শুনে যায়, এক চিঠির ভাষা, যা লেখা হয়নি… কারণ লেখা হলে প্রেম ভেঙে পড়ত, শব্দগুলো হতো দুর্বল। অমূল্য বলেই তো কিছু চিঠি পাঠানো হয় না।

শহরের নিঃসঙ্গ রাত যত গাঢ় হয়, তত তার বুকের ভেতর জমা হয় হাজারো অস্পষ্ট স্বপ্ন। সেইরকম এক রাত—যখন রেডিওর তরঙ্গে শব্দ ছুঁয়ে যায় জানালার ধারে বসে থাকা অনিদ্রা কন্যাকে। নিশান্ত আজ নিজের শো-এর শুরুতেই বলেছিল, “আজ শব্দ নয়, নীরবতাই গল্প বলবে। যদি কেউ ভোর হওয়ার আগে কিছু বলতে চান, আমি আছি—একটা শেষ রাতের মতো।” তৃষার গলা আজ অনেকক্ষণ আসেনি। নিশান্ত নিজেও আজ কথা কম বলছে, গানও বেছে নিচ্ছে এমন সব—যেখানে ভাঙা গল্পের সুর লুকিয়ে। হঠাৎ, রাত ১টা ৪৩-এ ফোন এল।
—“আমি তৃষা।”
কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যেন বহু দূর থেকে ফিরে আসা কোনো পুরোনো শব্দ। নিশান্ত একটু থেমে বলল, “আজ তুমি দেরি করেছ।”
তৃষা শান্ত গলায় বলল, “আজ অনেকক্ষণ জানালার পাশে বসেছিলাম। ভাবছিলাম… আমরা যে কখনো দেখা করিনি, কখনো একে অপরকে ছুঁয়েও দেখিনি—তবু, কেন যেন মনে হচ্ছে, তুমি আমার সব থেকে কাছের কেউ।”
নিশান্ত বলল, “আমিও ভেবেছি। জানো, আজ আমার মনে হলো… তুমি যদি বলো, আমি দেখতে চাই তোমায়, শুধু একবার… আমি রাজি। শুধু একবার।”
—“একবার? তার পরে?”
—“তার পরে যদি সব ভেঙে যায়?” নিশান্ত বলল না। কিন্তু সে জানত, তৃষার ভয়টা এইটাই। অদৃশ্য ভালবাসার সামনে দৃশ্য হয়ে উঠলেই সেটা ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়।

তৃষা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। নিশান্ত বুঝতে পারছিল, কিছু একটা বলার আছে তৃষার, কিন্তু সে নিজেই দ্বিধায় জড়ানো। শেষমেশ তৃষা বলল, “আজ আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম—তোমাকে নিয়ে। নাম দিয়েছি ‘ভোরের আগে’।”
—“শুনব?” নিশান্ত বলল ধীরে, যেন কোনো পবিত্র গোপনতা শোনার প্রস্তুতিতে।
তৃষা পড়ে শোনাতে শুরু করল,
“ভোর হওয়ার আগে একটা কণ্ঠ
আমার জানালার কাঁচে শব্দ রাখে,
আমি ঘুমোতে পারি না,
কারণ সেই কণ্ঠ আমার চোখ হয়ে উঠেছে।”
নিশান্ত নিঃশব্দে শোনে যাচ্ছিল। যেন তার সমস্ত অতীত, সমস্ত অপূর্ণতা মিলিয়ে যাচ্ছিল এই চার লাইনের মধ্যে।
তৃষা থেমে বলল, “তুমি জানো, নিশান্ত, আমরা যারা ভালোবাসি কণ্ঠ দিয়ে—তারা চোখে দেখে ভয় পায়। কারণ চোখ ধোঁকা দেয়, কিন্তু কণ্ঠ জানে কোথায় থেমে যেতে হয়, কোথায় উচ্চারণ না করলেই ভালোবাসা আরও গভীর হয়।”
নিশান্ত বলল, “তুমি যদি চোখে তাকাও, আমি না হয় চোখ নামিয়ে নেব। কিন্তু কণ্ঠ তুমি কেড়ে নিও না, তৃষা। কণ্ঠ ছাড়া আমি কিছুই নই।”
তৃষা ধীরে বলল, “তাই তো, আমরা কণ্ঠ দিয়েই তো একে অপরকে আঁকছি প্রতিদিন, ঠিক যেন কেউ চোখ বুজে প্রেম করছে।”

ফোন কেটে যাওয়ার আগে নিশান্ত বলল, “ভোর হতে চলেছে। তুমি কি জানো, এই ভোরটা আমার কাছে এখন কেবল তোমার উচ্চারণ?”
তৃষা হেসে বলল, “ভোরের আগে যতটুকু অন্ধকার, ততটাই তো প্রেম… তারপর আলো এসে আমাদের আলাদা করে দেয়।”
নিশান্ত অনেকক্ষণ ফোন রেখে দেয় না। তৃষাও না। যেন এই কণ্ঠ দুটো একটু বেশি সময় নিতে চায়, একে অপরের ভেতর ঢুকে পড়তে চায় শব্দ দিয়ে, ছোঁয়া ছাড়াই।
রেডিও তরঙ্গে তখন একটা গান বাজছিল—“তুমি যদি বলো, আসবো সন্ধের আগে…” কিন্তু এই গল্প সন্ধ্যার না, ভোরের না… এই গল্প “ভোরের আগের”—যেখানে দুটি আত্মা প্রেমে পড়ে যায়, এমন এক ভাষায়, যার নেই কোনো দৃষ্টিকোণ, নেই শরীর, নেই সময়… শুধু কণ্ঠ, আর কণ্ঠে জন্ম নেওয়া এক নিঃশব্দ ভোর।

কলকাতায় বসন্ত আসছে। শহরের বাতাসে কুয়াশা আর ঠান্ডা কমে গিয়ে এসেছে একরাশ হলদে আলো। কিন্তু নিশান্তের স্টুডিও ঘরে আজও সেই অন্ধকার—যেখানে শব্দই একমাত্র আলো। সে আজ শো শুরু করল না নির্ধারিত সময়মতো। চুপচাপ বসে রইল মাইকের সামনে, হেডফোন কানে, অথচ কোনো শব্দ উচ্চারণ করল না। তৃষা তিনদিন ধরে ফোন করেনি, কোনো বার্তাও পাঠায়নি, এমনকি রেডিওতে কোনও প্রতিধ্বনিও তৈরি হয়নি তার কণ্ঠে। নিশান্ত বুঝতে পারছিল, কিছু একটা ঘটে গেছে।
“আজকের রাতের অনুষ্ঠান শুরু করার আগে একটা কথা বলতে চাই,” সে বলল অবশেষে।
“তৃষা, যদি তুমি শুনে থাকো, শুধু একবার জানাও… আমি অপেক্ষা করছি। হয়তো আজকের রাতই শেষ অপেক্ষা।”
তার গলা কাঁপছিল না, তবু তাতে যে ধ্বংস লুকিয়ে, সেটা শহরের সমস্ত নিঃশব্দ গলিতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
ঠিক তখনই—১টা ১৬ মিনিটে—ফোনের আলো জ্বলে উঠল। নম্বর অপরিচিত, কিন্তু কণ্ঠ ছিল চিরচেনা।
“আমি শুনছি… নিশান্ত।”
তৃষা ফিরেছে। কিন্তু তার কণ্ঠ যেন অনেক দূরের, অনেক নিঃস্ব।
“আমি অসুস্থ ছিলাম,” সে বলল, “হাসপাতালে ছিলাম… ফোন নেওয়ার অনুমতি ছিল না। আমি ভয় পেয়েছিলাম, তুমি ভেবে নেবে আমি পালিয়ে গেছি।”
নিশান্ত বলল, “তুমি ফিরে এসেছ, এতেই আমার পৃথিবী ফেরত এসেছে।”

তৃষা অনেকক্ষণ কথা বলল না। তারপর বলল, “এই ক’দিন, চোখ বন্ধ করে শুধু তোমার শো-এর পুরনো রেকর্ড শোনা যেত আমার মাথার মধ্যে। যেন কণ্ঠের মধ্যে তুমি এসে বসে ছিলে আমার বালিশের পাশে। তখন বুঝলাম, আমাদের সম্পর্ককে আমি কোনোদিন বাস্তবের মাপে মাপতে পারব না। আমি চাই, এটা ঠিক এমনই থাকুক—একটা কণ্ঠস্বর, যেটা আমার হৃদয় চেনে, কিন্তু আমার চোখ কোনোদিন না চিনুক।”
নিশান্ত ধীরে বলল, “তাহলে এই ভালোবাসা থেকে আমরা কী পেলাম?”
তৃষা হাসল। বলল, “একটা সম্পর্ক যা শুধু শব্দ দিয়ে তৈরি। আর সম্পর্ক বলতে যদি একে অপরকে বোঝা, ছায়ার পাশে ছায়া হয়ে থাকা বুঝি, তাহলে আমরা যা পেয়েছি, সেটা অনেকের চোখে দেখা প্রেম থেকেও গভীর।”
নিশান্ত বলল, “তোমাকে একটা কথা বলি?”
—“বলো।”
—“আমার এই শো শেষ করছি আজ। আজকের রাতটাই শেষ রাত।”
তৃষা থেমে গেল। “কেন?”
নিশান্ত বলল, “কারণ এই শো শুরু হয়েছিল নিঃসঙ্গতা থেকে, আর শেষ হচ্ছে সম্পূর্ণতা দিয়ে। এখন আমি আর নিঃসঙ্গ নই। তুমি আমার কণ্ঠে থাকো, আমি তোমার হৃদয়ে। শব্দ এখন মাটির মতো, বৃক্ষের মতো… বাড়ি হয়ে গেছে।”

সেই রাতেই নিশান্ত তার শেষ শো-তে একটি গান চালাল—একটি পুরনো নজরুলগীতি, “তুমি কেবলই হৃদয় জুড়াও…” গানটা চলতে চলতে সে মাইক খুলে বলল,
“এই রাত্রির শেষ কণ্ঠস্বর হতে চাই আমি। শব্দের ওপারে, নীরবতার ঘরে, তোমার পাশের চেয়ারটায় আমার ছায়া রইল। চোখে না দেখা এই প্রেমকে আমরা ছুঁতে পারিনি, তবু রেখে গেলাম সমস্ত বাস্তব প্রেমের ওপরে। এই শো শেষ হলেও, আমাদের গল্প চলবে—তোমার নিঃশ্বাসে, আমার নিঃশব্দে। ভালো থেকো তৃষা।”
তৃষা তখন তার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, ফোন কানে ধরে, চোখে জল, কিন্তু মুখে হাসি। সে জানত, আজ নিশান্তের কণ্ঠ শেষ বার শুনছে। কিন্তু এই শেষ শব্দও যেন ছিল এক চিরন্তন প্রেমের ছায়া।
তৃষা ফিসফিস করে বলল, “তোমার এই কণ্ঠই আমার শেষ ঠিকানা, নিশান্ত। তুমিও ভালো থেকো। আর যদি কখনো খুব নিঃসঙ্গ লাগেও… জানালার ধারে একটু কণ্ঠ রেখো। আমি শুনে যাব।”
রাত তখন ২টা ৫৪। শহরের বাতাসে শব্দ নেই, কিন্তু প্রেম ভরে আছে।
একটি কণ্ঠস্বর নিঃশেষ হয়, আর এক অনন্ত গল্প শুরু হয়…
একটা কণ্ঠ দিয়েই, একটা হৃদয়কে চিরকালের জন্য জেগে রাখা যায়।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *