Bangla - ভ্রমণ - রহস্য গল্প

অরুণাচলের অরণ্যে

Spread the love

প্রবীর দাস


কলকাতার ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ফোটেনি। শহরের ব্যস্ততা, ট্রামের ঘণ্টা, চায়ের দোকানের ধোঁয়া—সবকিছু যেন এক অচেনা বিষণ্ণতার আবরণে ঢাকা। অনিরুদ্ধ ব্যাগ গুছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। সে জানে, এ যাত্রা শুধু পাহাড় দেখার ভ্রমণ নয়, বরং এক অদৃশ্য টানের সাড়া দেওয়া। কতদিন ধরেই যেন তার বুকের ভেতর ফিসফিস করে চলেছে কোনো অচেনা সুর—“আয়, চলে আয়, পাহাড়ের ডাক শুনে।” ডায়েরি আর কলম, ক্যামেরা আর কয়েকটা বই—এই নিয়েই তার সম্বল। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সে খেয়াল করে, চারপাশের লোকেরা তাদের নিজস্ব গন্তব্যে ব্যস্ত। অথচ তার গন্তব্য কোনো শহর নয়, কোনো চেনা জায়গা নয়—বরং অরুণাচলের অরণ্য, যেখানে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আছে প্রাচীন মঠ, আর উপজাতিরা বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের রহস্যময় রীতি। ট্রেনের বাঁশি বাজতেই বুকের ভেতর অদ্ভুত এক ধাক্কা লাগে, মনে হয় যেন পরিচিত পৃথিবীকে বিদায় জানাচ্ছে। ডায়েরির প্রথম পাতায় সে লিখে রাখে—“অরুণিমা, আমি চললাম। জানি না এই পথ কোথায় নিয়ে যাবে, কিন্তু তোমার সঙ্গ ছাড়া এই যাত্রা অসম্পূর্ণ।” অরুণিমার নাম লেখা মানেই যেন তার উপস্থিতি সঙ্গে রাখা, যদিও সে জানে অরুণিমা কেবল স্মৃতির ভেতরেই আছে।

ট্রেন যখন শহর পেরিয়ে ধীরে ধীরে গতি বাড়ায়, জানলার বাইরের দৃশ্য বদলে যেতে থাকে। ভোরের আলোয় ভেসে ওঠা ভাঙাচোরা বাড়ি, ছোট্ট মাঠ, আঁকাবাঁকা গ্রাম—সব মিলিয়ে যেন অন্য এক পৃথিবীতে ঢুকে পড়ছে অনিরুদ্ধ। প্রতিটি দৃশ্য সে মনে মনে অরুণিমাকে শোনায়, যেন সে পাশের সিটেই বসে আছে। তাদের শৈশব একসঙ্গেই কেটেছে—একই স্কুল, একই পাড়ার পুজো, আর একসঙ্গে ভেসে যাওয়া স্বপ্ন। অরুণিমা নেই বহু বছর, কিন্তু তার অনুপস্থিতি যেন কখনও পুরোপুরি অনুপস্থিত হয়নি। তাই তো প্রতিটি ভ্রমণে অনিরুদ্ধ তাকে লিখে জানায়—আজ কী দেখল, কী শুনল, কী অনুভব করল। পাহাড়ের কথা উঠলেই অরুণিমার চোখ দুটো ভেসে ওঠে—সে বলত, “কোনোদিন তাওয়াং গেলে আমাকে নিয়েই যেও।” আজ অদ্ভুতভাবে সেই কথার টানেই হয়তো অনিরুদ্ধ রওনা দিয়েছে। সে ভাবে, হয়তো পাহাড়ে গিয়ে সত্যিই কিছু খুঁজে পাবে—অরুণিমার স্মৃতির ভেতরে লুকানো উত্তর, কিংবা এমন কিছু, যা মানুষের বোধের বাইরে।

যাত্রা যত এগোয়, ততই অনিরুদ্ধর মধ্যে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। সে জানে না কী অপেক্ষা করছে তার জন্য। তবে তার ভেতর এক ধরনের আশ্বাসও কাজ করে—যেন কোনো অদৃশ্য হাত তাকে টেনে নিয়ে চলেছে। ট্রেন থেকে নামার পর বাসযাত্রা, তারপর পাহাড়ি পথ। প্রতিটি ধাপই যেন পরীক্ষা। বাসের জানালা দিয়ে সে দেখে, হিমালয়ের প্রথম ধূসর ছায়া আকাশের কোণে ভেসে উঠছে। দূরে মেঘ গড়িয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে পাহাড়ি ঝর্ণার শব্দ কানে আসে। চারপাশের অচেনা মানুষ, তাদের কথাবার্তা, হেসে ওঠা—সবই তাকে মনে করিয়ে দেয়, সে নিজের পরিচিত জগতের বাইরে চলে এসেছে। এ জায়গায় কেউ তাকে চেনে না, কেউ তার অতীত জানে না। এখানে সে কেবল একজন ভ্রমণকারী, এক ডায়েরি হাতে মানুষ, যে পাহাড়ের ডাক শুনে এসেছে। ডায়েরির পাতায় সে লিখে রাখে—“অরুণিমা, তুমি কি এই মেঘের ভেতর লুকিয়ে আছো? আমি তোমার ছায়া খুঁজছি প্রতিটি ঝর্ণার শব্দে, প্রতিটি বাতাসের ঝাপটায়।”

রাত নামার আগে যখন প্রথম পাহাড়ি ছোট্ট স্টপেজে বাস থামে, অনিরুদ্ধ নেমে দাঁড়ায়। শীতল বাতাস তাকে ঘিরে ধরে, আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে। শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, এখানে এক অদ্ভুত নীরবতা। দূরে একটা পাহাড়ি নদীর গর্জন শোনা যায়, তার সঙ্গে মিশে আছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। অনিরুদ্ধর মনে হয়, সত্যিই কি অরণ্যের আত্মারা তার আগমনের অপেক্ষা করছিল? হঠাৎই বুকের ভেতর ভরে ওঠে এক অচেনা ভয় আর আনন্দের মিশ্র অনুভূতি। ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে সে আবার লেখে—“আমি চলে এসেছি তোমার চাওয়া জায়গায়, অরুণিমা। হয়তো এ পথ সহজ হবে না, কিন্তু আমি জানি তুমি আমার পাশে আছো। হয়তো তুমি অদৃশ্য, কিন্তু প্রতিটি পাহাড়ি হাওয়া তোমার উপস্থিতি মনে করিয়ে দেবে।” এইভাবেই শুরু হলো অনিরুদ্ধর অদ্ভুত যাত্রা—একটি যাত্রা, যা কেবল পাহাড় আর প্রকৃতি নয়, বরং তার নিজের স্মৃতি, শূন্যতা আর রহস্যের সঙ্গে লড়াই করারও আরেক নাম।

সকালের কুয়াশা তখনও পুরোপুরি কাটেনি, পাহাড়ের ঢালে ঢালে ছড়িয়ে আছে ধোঁয়ার মতো সাদা আবরণ। বাস ছেড়ে দেওয়ার পর অনিরুদ্ধকে ছোট্ট এক জিপগাড়িতে তুলে দেওয়া হলো, যা তাকে তাওয়াং-এর দিকে নিয়ে যাবে। চালকের মুখে হাসি থাকলেও চোখে ছিল পাহাড়ি সতর্কতা—প্রতিটি বাঁকেই মৃত্যু লুকিয়ে থাকে, প্রতিটি ঢালেই আছে ভয়ংকর খাদের সম্ভাবনা। গাড়ির জানালা দিয়ে অনিরুদ্ধ তাকিয়ে দেখে নিচে গড়িয়ে চলা নদী, পাহাড়ি বনের মধ্যে মাঝে মাঝে কাঠের তৈরি ছোট্ট গ্রাম, আর দূরে মেঘের ভেতর হারিয়ে যাওয়া পথ। একসময় গাড়ি থামে এক দোকানের সামনে, যেখানে চা আর শুকনো মোমো বিক্রি হচ্ছিল। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় লোবসাং দর্জের। বয়সে তিরিশের কাছাকাছি, খাটো চেহারা, পরনে মোটা জ্যাকেট, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে নানা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। দোকানদারই পরিচয় করিয়ে দেয়—“লোবসাং তোমার গাইড হবে, তাওয়াং-এর পথ আর মঠের কাহিনি তার চেয়ে ভালো কেউ বলতে পারবে না।” অনিরুদ্ধ কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যায়, আর প্রথম দেখাতেই বুঝতে পারে এই মানুষটির চোখে এক ধরনের অদ্ভুত গভীরতা আছে, যা পাহাড়ের মতোই শান্ত অথচ রহস্যময়।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করে, অনিরুদ্ধ আর লোবসাং পাশাপাশি বসে। প্রথমে কিছুক্ষণ নীরবতা, কেবল রাস্তার আঁকাবাঁকা শব্দ আর চাকার সঙ্গে পাথরের সংঘর্ষের টকটক আওয়াজ। তারপর ধীরে ধীরে লোবসাং কথা শুরু করে। সে পাহাড়ের গল্প বলে—কীভাবে এই অরণ্যকে তারা “জীবন্ত আত্মা” মনে করে, কীভাবে প্রতিটি ঝর্ণা, প্রতিটি পাথর, প্রতিটি গাছের মধ্যে আত্মার উপস্থিতি আছে। অনিরুদ্ধ শুনে মুগ্ধ হয়, আবার কিছুটা শঙ্কিতও হয়। লোবসাং বলে, “তুমি জানো, বাইরে থেকে আসা মানুষদের জন্য এ পথ সবসময় খোলা নয়। যারা সম্মান দেখায় না, পাহাড় তাদের গ্রহণ করে না। তারা হারিয়ে যায় কুয়াশার ভেতর, আর ফিরে আসে না।” অনিরুদ্ধ প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেও লোবসাং-এর কণ্ঠের দৃঢ়তা তাকে থমকে দেয়। পাহাড়ি রাস্তা যত ওপরে উঠছে, ততই মনে হচ্ছে এই নীরবতা আর কুয়াশার ভেতর সত্যিই কোনো অচেনা শক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনিরুদ্ধ ডায়েরি বের করে লিখে নেয়—“অরুণিমা, হয়তো সত্যিই পাহাড়ের ভেতর কিছু আছে। লোবসাং-এর চোখে ভয় নেই, আছে বিশ্বাস। আর আমার মধ্যে কেবল অদ্ভুত টান।”

বিকেলের দিকে গাড়ি যখন এক খোলা জায়গায় থামে, দূরে দেখা যায় আকাশ ছুঁতে চাওয়া চূড়ার সারি। সেখানে দাঁড়িয়ে লোবসাং অনিরুদ্ধকে একটা লোককথা শোনায়। অনেক দিন আগে নাকি এক ভিক্ষু এই পথে যাত্রা করছিলেন, তিনি আত্মাদের অসম্মান করেছিলেন, ফলে অরণ্য তাকে গ্রাস করে নেয়। পরে স্থানীয়রা রাতের বেলা পাহাড়ের ঢাল থেকে তার প্রার্থনার সুর শুনতে পায়—একটি সুর যা আর কখনো শেষ হয়নি। লোবসাং থেমে গাঢ় দৃষ্টিতে অনিরুদ্ধকে বলে, “তুমি যদি রাতে এই সুর শোনো, ভয় পাবে না। এটা পরীক্ষা। যদি ভয় দেখাও, আত্মারা তোমাকে আর ফেরার পথ দেখাবে না।” অনিরুদ্ধের বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে, যদিও বাইরে থেকে শান্ত থাকার চেষ্টা করে। সে জানে না লোবসাং-এর এই গল্প কতটা বাস্তব, কিন্তু পাহাড়ি বাতাসে আর তার কণ্ঠে এমন কিছু আছে যা মনের ভেতরে গভীর অস্থিরতা তৈরি করে। দূরের মেঘের ফাঁক দিয়ে লালচে আলো ঝরে পড়ছে, যেন আকাশ নিজেই তার কথার সত্যতা প্রমাণ করছে। অনিরুদ্ধ বুঝতে পারে, এই যাত্রা শুধু পাহাড় দেখার নয়—এটা এক অচেনা পরীক্ষার শুরু।

রাত নামার আগে তারা পৌঁছে যায় এক ছোট্ট পাহাড়ি সরাইখানায়। কাঠের তৈরি ঘর, জানালার বাইরে হিমশীতল হাওয়া, আর আকাশে অসংখ্য তারার আলো। ভেতরে চুল্লিতে আগুন জ্বলছে, পাশে বসে লোবসাং তাকে গরম সূপ খেতে দেয়। অনিরুদ্ধ ডায়েরি খুলে আবার লিখতে শুরু করে—“আজ লোবসাং-এর গল্প শুনলাম। অরুণিমা, তুমি থাকলে হয়তো হেসে বলতে—‘এ সব লোককথা, সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই।’ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এ সব কেবল গল্প নয়। পাহাড় আসলে কিছু বলতে চাইছে। আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু অনুভব করছি।” আগুনের আলোয় লোবসাং-এর মুখে ছায়া-আলো খেলা করে, তার চোখে অদ্ভুত ঝিলিক দেখা যায়। বাইরে ঝড়ো হাওয়া উঠছে, খড়মড় করে জানালা কেঁপে উঠছে। অনিরুদ্ধর বুকের ভেতর কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খায়—সে কি সত্যিই অরণ্যের আত্মাদের পরীক্ষার দিকে এগিয়ে চলেছে, নাকি কেবল লোককথার ভেতর হারিয়ে যাচ্ছে? এই দোটানার মধ্যেই তার যাত্রা তাওয়াং-এর দিকে আরও গভীর, আরও অচেনা অরণ্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

তাওয়াং-এর মঠে পৌঁছনোর মুহূর্তটিই অনিরুদ্ধর মনে গভীর ছাপ ফেলে। পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বিশাল কাঠামো, যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাহারা দিয়ে চলেছে অরণ্য আর মেঘকে। সাদা প্রাচীরের গায়ে আঁকা রঙিন প্রতীক, বিশাল দরজার সামনে ঝোলানো প্রার্থনার পতাকা বাতাসে দুলছে, আর তাদের শব্দে ভেসে আসছে অদৃশ্য প্রার্থনার সুর। মঠের ভেতরে প্রবেশ করতেই অনিরুদ্ধ অনুভব করে অন্য এক জগতে এসে পড়েছে। করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে সে শুনতে পায় মৃদু মন্ত্রোচ্চারণ, কোথাও একদল ভিক্ষু একসঙ্গে বসে ধ্যান করছে। তাদের চোখে কোনো উতলা ভাব নেই, বরং যেন প্রকৃতি ও আত্মার সঙ্গে এক হয়ে আছে। অনিরুদ্ধ মনে মনে ভাবে—এখানে নিশ্চয়ই সময়ের হিসাব অন্য রকম। বাইরে পাহাড়ে যেমন দিন-রাতের পালাবদল হয়, ভেতরে তেমনি অনন্ত নীরবতা বিরাজ করছে। লোবসাং তাকে এক কক্ষে নিয়ে যায়, যেখানে তাকে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাঠের ছোট্ট বিছানা, জানালা দিয়ে দেখা যায় মেঘ আর দূরের উপত্যকা। অনিরুদ্ধ বুঝতে পারে, এ যাত্রার একটি নতুন অধ্যায় শুরু হলো—যেখানে কেবল চোখে দেখা নয়, আত্মার ভেতর দিয়েও কিছু উপলব্ধি করতে হবে।

সন্ধ্যা নামতেই লোবসাং তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় প্রবীণ ভিক্ষু রিনচেনের সঙ্গে। লম্বা সাদা দাড়ি, শান্ত মুখ, গভীর দৃষ্টির ভেতরে যেন লুকিয়ে আছে অজস্র অভিজ্ঞতা। অনিরুদ্ধ প্রণাম জানালে ভিক্ষু ধীরে মাথা নাড়েন। দীর্ঘক্ষণ নীরব থাকার পর তিনি বলেন, “তুমি পাহাড়ের ডাক শুনে এসেছো, তাই না?” অনিরুদ্ধ বিস্মিত হয়—লোকটা কীভাবে তার মনে থাকা অদৃশ্য টানটা চিনতে পারলেন! রিনচেন হালকা হাসেন, তারপর এক অদ্ভুত কথা বলেন, “এই মঠে একটি প্রাচীন পান্ডুলিপি আছে, যা আমরা বহিরাগতকে দেখাই না। তবে হয়তো তোমার যাত্রার সঙ্গে তার কোনো যোগ আছে।” অনিরুদ্ধ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভিক্ষু চুপ করে যান। তার শান্ত মুখে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যে, মনে হয় কোনো অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বাণী করে ফেললেন। অনিরুদ্ধর বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরে যায়। সে ভাবে—অরুণিমাকে যদি সবটা বলতে পারত! ডায়েরি খুলে সে দ্রুত লিখে ফেলে—“আজ রিনচেন নামের এক ভিক্ষুর সঙ্গে দেখা হলো। তিনি এমন এক পান্ডুলিপির কথা বললেন, যা বাইরে কাউকে দেখানো হয় না। আমি বুঝতে পারছি না কেন তিনি আমাকে তার ইঙ্গিত দিলেন। তুমি থাকলে হয়তো বলতাে—‘এটা কাকতালীয় নয়, তোমার জন্যই নির্ধারিত।’”

রাত নামলে মঠের পরিবেশ আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে। আকাশে চাঁদ উঠে গেছে, কিন্তু ঘন কুয়াশা মাঝে মাঝে সব ঢেকে দিচ্ছে। মঠের ভেতরে মৃদু আলোর প্রদীপ জ্বলছে, আর নীরবতার ভেতর হঠাৎ হঠাৎ ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে। সেই শব্দ যেন হিমশীতল বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত সুর সৃষ্টি করছে। অনিরুদ্ধ বিছানায় শুয়ে প্রথমে চেষ্টা করছিল চোখ বন্ধ করতে, কিন্তু ঘণ্টার শব্দ বারবার তাকে জাগিয়ে রাখে। হঠাৎ সে শুনতে পায় ফিসফিস করার মতো একটি আওয়াজ। প্রথমে মনে হলো হয়তো বাতাসের শব্দ, কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে—এ যেন কারও কণ্ঠস্বর। ফিসফিসটি স্পষ্ট নয়, তবে যেন তাকে ডাকছে। বুকের ভেতর কাঁপুনি জাগে, সে উঠে বসে জানালা খোলে। বাইরে কেবল কুয়াশা আর দূরে পাহাড়ের ছায়া। তবু মনে হয় কুয়াশার ভেতর অদৃশ্য মুখ লুকিয়ে আছে, তারা কথা বলছে—কেবল শব্দে নয়, অনুভূতিতে। অনিরুদ্ধর মাথায় হঠাৎ অরুণিমার নাম ভেসে ওঠে। সে যেন শুনতে পায়—“অনিরুদ্ধ, ভয় পেও না, এ শুধু শুরু।” তার হাত কাঁপতে থাকে, তবু ডায়েরি খুলে লিখে ফেলে—“আমি আজ রাতে ফিসফিস শুনলাম। এটা কি সত্যিই আত্মাদের পরীক্ষা, নাকি আমারই বিভ্রম?”

রাত যত গভীর হয়, আওয়াজ তত স্পষ্ট হয়। ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে মিশে গিয়ে ফিসফিসগুলো যেন ছন্দ তৈরি করে। কখনো মনে হয় প্রার্থনার মতো, আবার কখনো মনে হয় সতর্কবার্তা। অনিরুদ্ধ জানে না কী করবে। সে লোবসাংকে ডাকতে চায়, কিন্তু ভেতরে এক অদ্ভুত শক্তি তাকে থামিয়ে দেয়। মনে হয়—এ অভিজ্ঞতা কেবল তারই হওয়ার কথা। অবশেষে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে, আর স্বপ্নে সে দেখতে পায় এক পুরনো হলঘরে বসে আছেন রিনচেন, তার সামনে খোলা আছে এক প্রাচীন পান্ডুলিপি। সেই পাতায় অদ্ভুত প্রতীক, যা সে আগে কখনও দেখেনি। স্বপ্নে রিনচেন ফিসফিস করে বলে উঠলেন—“উত্তর খুঁজতে হলে ভয় ত্যাগ করতে হবে।” ঘুম ভেঙে গেলে অনিরুদ্ধ দেখে ভোর হয়ে গেছে, জানালার বাইরে নতুন দিনের আলো ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু তার বুকের ভেতর কাঁপুনি তখনও থামেনি। সে বুঝতে পারে, তাওয়াং মঠ তাকে কেবল আশ্রয় দেয়নি, বরং তার যাত্রাকে আরও গভীর রহস্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর এখন সে আর ফিরে যেতে পারবে না—কারণ এই নীরবতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে সেই অদৃশ্য উত্তর, যার খোঁজে সে যাত্রা শুরু করেছিল।

তাওয়াং মঠের দ্বিতীয় দিন সকালে লোবসাং অনিরুদ্ধকে নিয়ে যায় মঠের ভেতরের এক পুরোনো অংশে, যেখানে সাধারণত ভ্রমণকারীদের প্রবেশাধিকার নেই। সংকীর্ণ করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনিরুদ্ধ লক্ষ্য করে দেয়ালের রঙ অনেক জায়গায় উঠে গেছে, কাঠের বিমে সময়ের ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট। বাতাসে পুরনো কাঠ আর ধূপের গন্ধ মিশে আছে, যা যেন অতীতের স্মৃতিকে জীবন্ত করে তোলে। হঠাৎ লোবসাং থেমে গিয়ে দেয়ালের এক কোণে আঙুল রাখে। অনিরুদ্ধ কাছে গিয়ে দেখে, সেখানে খোদাই করা আছে কয়েকটি অদ্ভুত চিহ্ন—কেউ হয়তো সহজে বুঝতে পারবে না, কিন্তু গভীরভাবে তাকালে মনে হয় এগুলো কোনো মানচিত্রের খণ্ডাংশ। বাঁকানো রেখা, সূক্ষ্ম প্রতীক আর এক কোণে একটি বৃত্ত—যেন কোনো পথ বা গোপন জায়গার ইঙ্গিত। অনিরুদ্ধ বিস্মিত হয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় এক অচেনা রহস্য হঠাৎ তার সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। সে হাত বাড়িয়ে ছুঁতেই এক অদ্ভুত ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায় শরীর জুড়ে, যেন এই দেয়াল বহুদিন ধরে কোনো গোপন কথা জমিয়ে রেখেছে।

লোবসাং নিচু স্বরে বলে, “আমাদের পূর্বপুরুষরা বিশ্বাস করতেন, এই চিহ্নগুলো কেবল মানচিত্র নয়—এগুলো হলো অরণ্যের আত্মাদের ভাষা। যে বুঝতে পারবে, সে-ই খুঁজে পাবে পথ।” অনিরুদ্ধ বিস্ময়ের সঙ্গে শুনে, আর মনে পড়ে গত রাতের ফিসফিসানি আর রিনচেন ভিক্ষুর কথাগুলো। যেন সবকিছু ধীরে ধীরে একে অপরের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু লোবসাং সতর্ক করে দেয়, “এ কথা প্রকাশ্যে বলবে না। অনেক ভিক্ষু এখনো মনে করেন এগুলো বহিরাগতকে দেখানো উচিত নয়।” ঠিক সেই মুহূর্তে করিডোরে নরম পায়ের শব্দ শোনা যায়। রিনচেন ভিক্ষু এসে দাঁড়ান, তার শান্ত চোখে অদ্ভুত ঝিলিক। তিনি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর মৃদু হাসেন। অনিরুদ্ধ সাহস করে জিজ্ঞেস করে, “এটা কি সত্যিই কোনো মানচিত্র?” রিনচেন সরাসরি উত্তর দেন না, বরং গভীর কণ্ঠে বলেন, “সব উত্তর তোমার ডায়েরিতে থাকবে, যদি তুমি সত্যিই শোনার ক্ষমতা রাখো।” এই উত্তর যেন আরও বেশি বিভ্রান্ত করে অনিরুদ্ধকে।

দুপুরে তারা মঠের প্রাঙ্গণে ফিরে আসে। অনিরুদ্ধ বসে থাকে এক কোণে, তার চোখের সামনে প্রার্থনায় ব্যস্ত ভিক্ষুরা, আর তার কানে বাজতে থাকে রিনচেনের অস্পষ্ট উত্তর। সে ডায়েরি খুলে লিখে ফেলে—“অরুণিমা, আজ এমন কিছু দেখলাম যা হয়তো ইতিহাসকেও পাল্টে দিতে পারে। কিন্তু রিনচেন আমাকে কেবল ইঙ্গিত দিলেন, সরাসরি কিছু বললেন না। যেন তিনি চাইছেন আমি নিজেই পথ খুঁজে পাই। কেন তিনি এমন করছেন? আমি কি সত্যিই সেই পথের যোগ্য?” হঠাৎ তার মনে হলো, হয়তো গত রাতের ফিসফিসানি আর এই দেয়ালের চিহ্ন একই সূত্রের অংশ। যদি সত্যিই কোনো মানচিত্র হয়, তবে তা কোথায় নিয়ে যাবে? অরণ্যের গভীরে? নাকি পাহাড়ের অতল গহ্বরে? এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে অজানা, কিন্তু কৌতূহল ও ভয় একসঙ্গে তার বুকের ভেতর ঢেউ তোলে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে মঠের প্রাঙ্গণ আবার মন্ত্রোচ্চারণে ভরে ওঠে। লোবসাং পাশে এসে বসে, মুখে গুরুগম্ভীর ভাব। সে ধীরে বলে, “তুমি হয়তো ভাবছো সবকিছু কেবল কাকতালীয়, কিন্তু পাহাড় কখনো কাকতালীয় কিছু করে না। যদি তোমাকে এই চিহ্ন দেখানো হয়ে থাকে, তবে এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।” অনিরুদ্ধ কিছু বলতে চায়, কিন্তু শব্দ খুঁজে পায় না। তার ভেতরে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে। রাত নেমে আসার পর আবার ঘণ্টাধ্বনি বাজতে শুরু করে, আর তার সঙ্গে যেন অদৃশ্য ফিসফিসানিও ভেসে ওঠে। অনিরুদ্ধ মনে মনে শপথ করে নেয়, যতই বিপদ আসুক, সে এই রহস্যের পেছনের সত্য খুঁজে বের করবে। তার মনে হয়, এই দেয়ালের চিহ্নগুলো শুধু মানচিত্র নয়—এগুলো হয়তো অরণ্যের আত্মাদের রেখে যাওয়া বার্তা, যা তাকে নিয়ে যাবে এক অজানা গন্তব্যে। রিনচেন ভিক্ষু হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে পুরোটা বলছেন না, কারণ পথটা তাকে একাই খুঁজে নিতে হবে। এই উপলব্ধি তার বুকের ভেতর ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক প্রবল উত্তেজনাও জাগিয়ে তোলে—কারণ সে জানে, যাত্রার আসল রহস্য কেবল শুরু হয়েছে।

তাওয়াং মঠের নীরবতা পেছনে ফেলে অনিরুদ্ধর গাড়ি যখন আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা নামতে শুরু করে, তার ভেতরে যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হয়। মঠের ঘণ্টাধ্বনি, ফিসফিসানি, আর দেয়ালের চিহ্ন—সবকিছুই এখনো তার মন জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সামনে অপেক্ষা করছে নতুন গন্তব্য—জিরো ভ্যালি, যার নাম শুনলেই যেন রহস্যময় সবুজের সমুদ্র ভেসে ওঠে চোখে। গাড়ির জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যায় আকাশছোঁয়া দেবদারু, কুয়াশার পর্দায় ঢাকা পাহাড়ি গ্রাম, আর দূরে নদীর সরু ধারা রুপোর মতো ঝলমল করছে। ঠিক তখনই গাড়ির এক কোণে বসা তরুণীকে লক্ষ্য করে অনিরুদ্ধ। গাঢ় নীল শাল জড়ানো, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে আঁকিবুঁকি ভর্তি একটি খাতা—যেন পাহাড়ি নীরবতার ভেতর সে একা নিজের জগতে ডুবে আছে। হঠাৎ অনিরুদ্ধর চোখ আটকে যায় খাতার পাতায়, যেখানে আঁকা আছে কিছু প্রতীক আর লিখে রাখা অদ্ভুত নোট।

গাড়ি এক মোড়ে দাঁড়াতেই পরিচয় হয় দু’জনের। মেয়েটি নিজেকে পরিচয় করায়—“আমার নাম তানিয়া শীতল। আমি মূলত নৃতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করছি, আর এখন জিরো ভ্যালির উপজাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করছি।” অনিরুদ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে—এমন কারও সঙ্গে দেখা হবে, তা ভাবেনি। তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, অথচ চোখে লুকানো কৌতূহল। আলাপ বাড়তে থাকলে জানা যায়, তানিয়া বহুদিন ধরে স্থানীয় উপজাতিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। তাদের আচার, উৎসব, গান, নৃত্য, এমনকি অরণ্যের আত্মা নিয়ে লোকবিশ্বাস—সবকিছু নিয়েই তার আগ্রহ। কিন্তু যখন অনিরুদ্ধ খাতার পাতার কথা তুলতে চায়, তানিয়া একটু গম্ভীর হয়ে ওঠে। হালকা হেসে বলে, “এগুলো কেবল গবেষণার নোট, অন্য কাউকে দেখানোর মতো নয়।” তার এই সঙ্কোচ অনিরুদ্ধকে আরও কৌতূহলী করে তোলে। মনে হয় খাতার পাতায় কেবল গবেষণা নয়, আছে এমন কিছু, যা গোপন থাকার জন্যই লেখা।

যাত্রা যত এগোয়, পাহাড়ি পথ তত বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া সড়ক, গভীর খাদ, আর হঠাৎ হঠাৎ ভেসে আসা ঠাণ্ডা বাতাস যেন যাত্রীদের পরীক্ষা নিচ্ছে। এই সময় তানিয়া একটি গল্প শোনায়। সে বলে, “জিরো ভ্যালির উপজাতিরা বিশ্বাস করে, প্রত্যেক ভ্রমণকারীকে অরণ্য প্রথমে যাচাই করে নেয়। যদি মন পবিত্র হয়, তবে অরণ্য তাকে আশীর্বাদ দেয়; আর যদি উদ্দেশ্য খারাপ হয়, তবে সে কখনো গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না।” অনিরুদ্ধ শিউরে ওঠে—কারণ এই গল্প যেন হুবহু লোবসাংয়ের বলা কথার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। মনে হয়, অরণ্যের ডাক আসলেই আছে, আর তা বিভিন্ন মানুষ ভিন্নভাবে উপলব্ধি করছে। তানিয়ার কথার ভেতর লুকিয়ে থাকে একধরনের সতর্কবার্তা, অথচ তার কণ্ঠে কোনো ভয়ের ছায়া নেই। বরং যেন গবেষকের দৃষ্টিতে সে ঘটনাগুলোকে দেখছে। অনিরুদ্ধর ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব কাজ করে—সে কি কেবল গবেষক, নাকি এই রহস্যেরও কোনো অংশ?

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, গাড়ি যখন এক উঁচু মোড় দিয়ে নামতে থাকে, দূরে দেখা যায় ঘন সবুজ উপত্যকা—জিরো ভ্যালি। পাহাড়ের কোলে নরম আলোয় ঢাকা সেই দৃশ্য যেন স্বপ্নের মতো। অনিরুদ্ধ অনুভব করে, এ যাত্রা তাকে কেবল নতুন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে না, বরং এক অচেনা নিয়তির দিকে টেনে নিচ্ছে। পাশে বসা তানিয়া তখনও খাতার পাতায় কিছু লিখছে, যেন হঠাৎ মনে পড়া কোনো গোপন কথা নোট করে রাখছে। অনিরুদ্ধ এক মুহূর্তের জন্য তাকে লক্ষ্য করে ভাবে—এই মেয়েটি কি কেবল গবেষক, নাকি তার খাতার পাতায় লুকিয়ে আছে সেই রহস্য, যার সূত্র সে খুঁজছে গত কয়েকদিন ধরে? অরুণিমার কথা মনে পড়ে যায়—সে যেন ফিসফিস করে বলছে, “সাবধান অনিরুদ্ধ, প্রতিটি সাক্ষাৎ কেবল কাকতালীয় নয়।” বুকের ভেতর অস্থিরতা জমে ওঠে, কিন্তু তার সঙ্গে এক অদ্ভুত টানও তৈরি হয়। কারণ সে বুঝতে পারে, জিরো ভ্যালির যাত্রায় তানিয়া শীতল হয়তো এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চলেছে, আর সেই খাতা হতে পারে তার রহস্যের আসল চাবিকাঠি।

জিরো ভ্যালির সবুজ বিস্তীর্ণ প্রান্তরে পা রাখতেই অনিরুদ্ধর মনে হলো, সে যেন এক অচেনা জগতে এসে পড়েছে। চারপাশে ধাপে ধাপে সাজানো ধানক্ষেত, দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা সরু ঝরনা, আর তার মাঝখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঁশ আর কাঠের ঘরগুলো যেন সময়ের গভীরতা থেকে উঠে এসেছে। হালকা কুয়াশা উপত্যকার বুকে ভেসে আছে, আর তার মধ্যেই দেখা গেল আপাতানি উপজাতির মানুষদের চলাফেরা। তাদের পোশাকে প্রকৃতির রঙ, মুখে ছাপ ফেলা গল্প, আর চুলের খোঁপায় ফুল কিংবা অলঙ্কার বাঁধা। অনিরুদ্ধ আর তানিয়া দু’জনেই বিস্ময়ে ভরে যায়। তারা যেন দু’জন গবেষক নয়, বরং দূরের দুই ভ্রমণকারী, যাদের সামনে হঠাৎ এক জীবন্ত ইতিহাস খুলে গেছে। ঠিক তখনই তাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধা মহিলা, বয়স কমপক্ষে সত্তর, হয়তো আরও বেশি। তার মুখে বয়সের গভীর রেখা, কিন্তু চোখে এক তীক্ষ্ণ দীপ্তি। অনিরুদ্ধর দৃষ্টি আটকে যায় তার নাকে—দুটি বড় ট্যাটু আর কালো রঙের অলঙ্কার গাঁথা আছে, যা যেন এক অদ্ভুত আচার-অনুষ্ঠানের ছাপ বহন করছে।

বৃদ্ধা তাদের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলেন, “তোমরা বাইরের মানুষ, তবু পাহাড় তোমাদের এখানে এনেছে।” তার কণ্ঠে ছিল না কোনো শীতলতা, বরং এক ধরনের স্থিরতা যা অনিরুদ্ধকে কাঁপিয়ে দিল। তানিয়া তাকে সম্মান জানিয়ে উপজাতীয় ভাষায় কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করল, আর মহিলা মাথা নেড়ে মৃদু হেসে সাড়া দিলেন। অনিরুদ্ধ বুঝল, তানিয়া আগে থেকেই তাদের ভাষা শিখে রেখেছে—একজন গবেষক হিসেবে তার প্রস্তুতি নিখুঁত। কিন্তু বৃদ্ধা মহিলার পরবর্তী কথা যেন বাতাসকে আরও ভারী করে তোলে। তিনি ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন, “অরণ্যের আত্মারা আজ তোমাদের দেখছে।” অনিরুদ্ধর বুক কেঁপে ওঠে। এ কথাগুলো যেন হুবহু লোবসাংয়ের মুখে শোনা লোককথার প্রতিধ্বনি। তানিয়া চুপ করে তার খাতায় কিছু নোট নিল, কিন্তু তার আঙুল কেঁপে উঠছিল। মনে হলো, গবেষক তানিয়ার ভেতরেও অদৃশ্য ভয়ের রেখা টানল এই ভবিষ্যদ্বাণী। অনিরুদ্ধর মনে হতে লাগল, পাহাড় সত্যিই প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের নজরে রাখছে।

তারা বৃদ্ধার সঙ্গে কিছুক্ষণ বসে কথা বলল। তিনি জানালেন, নাকের ট্যাটু একসময় উপজাতির নারীরা গর্বের সঙ্গে করাতেন, যেন তারা নিজেদের পরিচয় অরণ্যের আত্মাদের সামনে প্রকাশ করতে পারে। অলঙ্কারের প্রতীকও কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং পাহাড়ি দেবতাদের সঙ্গে সংযোগের চিহ্ন। অনিরুদ্ধ বিস্ময়ে শুনতে লাগল, মনে হলো প্রতিটি রীতি যেন কেবল সংস্কৃতি নয়, বরং কোনো গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা বাইরের মানুষের চোখে ধরা পড়ে না। বৃদ্ধা একসময় আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত স্বরে প্রার্থনা করলেন। তার চোখে জল চিকচিক করছিল, যেন তিনি এমন কিছু দেখছেন যা অন্যদের চোখে অদৃশ্য। অনিরুদ্ধের শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে অনুভব করল, পাহাড়ের নিস্তব্ধতা আর কুয়াশার ভেতর অদৃশ্য দৃষ্টি লুকিয়ে আছে, যা তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ করছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলে, অনিরুদ্ধ আর তানিয়া গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে এল। দূরে পাহাড়ি আকাশে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছিল, যেন সূর্যাস্তও আজ রহস্যময় আবহ তৈরি করতে চায়। গাড়িতে ওঠার আগে অনিরুদ্ধ শেষবার বৃদ্ধার দিকে তাকাল। তিনি তখনও দাঁড়িয়ে আছেন, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেন বিদায় জানাচ্ছেন না, বরং সতর্ক করছেন। অনিরুদ্ধর কানে এখনো বাজছে তার সেই বাক্য—“অরণ্যের আত্মারা আজ তোমাদের দেখছে।” হঠাৎ মনে হলো, এ যাত্রা কেবল ভ্রমণ নয়; এ এক আহ্বান, যার পেছনে লুকিয়ে আছে অজানা কোনো সত্য। সে ডায়েরি খুলে লিখল—“অরুণিমা, আজ একজন আপাতানি বৃদ্ধা আমাকে এমন কথা বললেন, যা আমার হৃদয়ের গভীরকে কাঁপিয়ে দিল। আমি জানি না আমরা কী খুঁজে পাব, কিন্তু বুঝতে পারছি অরণ্য সত্যিই আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখছে। আমি কি সত্যিই প্রস্তুত সেই পরীক্ষার জন্য?” বাতাসে বয়ে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া যেন তার প্রশ্নের উত্তর দিল না, বরং তাকে আরও বেশি অস্থির করে তুলল। আর সেই মুহূর্তে অনিরুদ্ধ জানল, রহস্যের অরণ্যে তাদের যাত্রা আরও ঘনিয়ে উঠছে।

জিরো ভ্যালির আকাশে যখন কালো মেঘ ভেসে উঠল, তখনই গ্রামজুড়ে শুরু হলো উৎসবের প্রস্তুতি। চারদিক থেকে মানুষজন এসে জড়ো হতে লাগল খোলা মাঠে, যেখানে মাঝখানে বড় কাঠের খুঁটি পুঁতে তার চারপাশে আগুন জ্বালানো হলো। আপাতানি উপজাতির ছেলেরা বাঁশের বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে, আর মেয়েরা রঙিন পোশাকে সাজছে। বাতাসে ভেসে আসছে ধোঁয়ার গন্ধ, মিশে যাচ্ছে পাহাড়ি ফুলের মিষ্টি সুবাসে। অনিরুদ্ধর মনে হলো, এই গ্রাম যেন হঠাৎ এক জাদুকরী মঞ্চে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো ভূমিকা পালন করছে। তানিয়া ব্যস্ত ছিল তার খাতায় নোট নিতে, কিন্তু চোখে বোঝা যাচ্ছিল, এই উৎসব তারও মনের গভীরে আলোড়ন তুলছে। আর অনিরুদ্ধ, যে এখনো বৃদ্ধার সেই কথায় কাঁপছিল—“অরণ্যের আত্মারা আজ তোমাদের দেখছে”—সে অনিশ্চিত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে যাচ্ছিল।

রাত নামতেই উৎসব পূর্ণতায় পৌঁছল। ঢোলের তালে তালে শুরু হলো উপজাতির নাচ, আগুনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে তারা হাততালি দিচ্ছে, গান গাইছে পাহাড়ি ভাষায়। আগুনের আলোতে তাদের মুখমণ্ডল রহস্যময় হয়ে উঠেছে—কখনো হাসি, কখনো কঠিন ভ্রুকুটি, যেন তারা কেবল নাচছে না, বরং আত্মাদের সঙ্গে কোনো গোপন সংলাপে লিপ্ত। অনিরুদ্ধর চোখ এক মুহূর্তের জন্য স্থির হলো আগুনের ভেতর ছায়ার মতো নড়াচড়া দেখতে। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো ধোঁয়ার খেলা, কিন্তু ধীরে ধীরে তার বুকের ভেতর অদ্ভুত শীতলতা ছড়িয়ে গেল। মনে হলো, আগুনের আলোয় শুধু মানুষই নাচছে না—অরণ্যের ভেতর থেকেও কেউ বা কিছু তাকিয়ে আছে। সে তানিয়ার কানে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি দেখছ, ওদিকে কিছু নড়ছে?” তানিয়া তার দিকে একঝলক তাকাল, তারপর মৃদু স্বরে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, এ সময় উপজাতিরা বিশ্বাস করে আত্মারা এসে গ্রামকে রক্ষা করে। তারা চোখে দেখা যায় না, তবে যারা মন দিয়ে দেখে, তারা ছায়ার আভাস পেতে পারে।”

অনিরুদ্ধর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। ঢোলের শব্দ তখন আরও জোরে বাজছিল, আর চারপাশে আগুনের ঝলকানি ছড়িয়ে পড়ছিল। ছায়াগুলোকে এখন সে স্পষ্ট দেখছিল—কেউ যেন বন থেকে এগিয়ে আসছে, আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তাদের কোনো রূপ নেই, শুধু নড়াচড়া আর উপস্থিতির চাপ। সে হঠাৎ বুঝতে পারল, আত্মাদের গল্প হয়তো কেবল কল্পকথা নয়। তার মনে হলো, সেই বৃদ্ধা মহিলার সতর্কবার্তা আজ বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তানিয়া তখনও ঠাণ্ডা মাথায় খাতায় কিছু লিখে চলেছে, যেন তার কাছে ঘটনাটি গবেষণার বিষয়। কিন্তু অনিরুদ্ধ বুঝল, এর ভেতর কেবল গবেষণা নেই, আছে অরণ্যের গভীরতর পরীক্ষা। সে নিজের ভেতর এক অদৃশ্য চাপ অনুভব করল—মনে হলো, সত্যিই আত্মারা তার হৃদয় যাচাই করছে। তার উদ্দেশ্য কি সৎ? নাকি সে কেবল অরণ্যের রহস্য শিকার করতে এসেছে? এই প্রশ্ন তাকে ছিন্নভিন্ন করে তুলল।

রাত যত গভীর হলো, আগুনের শিখা তত উঁচু হয়ে উঠল, আর ছায়াগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উপজাতির মানুষজন তখন একসঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ করছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করছে। অনিরুদ্ধ অনুভব করল, তার চোখের সামনে বাস্তব আর অলৌকিকতার সীমারেখা ভেঙে যাচ্ছে। ঢোল, গান, আগুন, আর সেই ছায়ারা মিলে যেন এক অদ্ভুত পরীক্ষার মঞ্চ তৈরি করেছে। সে তাকিয়ে দেখল, তানিয়ার চোখও আগুনে স্থির, আর তার ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠেছে। মনে হলো, সে আগেই জানত আজ রাতে কী হতে চলেছে। অনিরুদ্ধের হাত ঘামে ভিজে উঠল। সেই মুহূর্তে তার ভেতর দিয়ে ভেসে গেল অরুণিমার কণ্ঠ—“তুমি কি প্রস্তুত, অনিরুদ্ধ?” সে মাথা নিচু করল, জানত না কার জন্য এই পরীক্ষা, কিন্তু নিশ্চিত ছিল—অরণ্যের আত্মারা সত্যিই আজ রাতেই তাকে দেখছে। আর তার যাত্রার মোড় ঘুরে গেছে এমন এক অজানা পথে, যেখানে ফিরে আসার নিশ্চয়তা নেই।

রাতের উৎসব শেষ হয়ে গ্রাম নিস্তব্ধ হলে, অনিরুদ্ধ আর তানিয়া ফিরে এল একটি বাঁশের তৈরি ছোট ঘরে, যেখানে তারা আপাতানি গ্রামে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। চারপাশে শুধু জোনাকির ক্ষুদ্র আলো, দূরে পাহাড়ের অন্ধকার সীমানায় মাঝে মাঝে ভেসে আসছে রাতের পাখির ডাক। অনিরুদ্ধর মন তখনো ছায়ার মতো নড়াচড়া করা অদৃশ্য আত্মাদের উপস্থিতিতে আবদ্ধ। সে চাইছিল ডায়েরিতে কিছু লিখে নিজের ভেতরের অস্থিরতা হালকা করতে, কিন্তু তার চোখ তখন বারবার ঘুরে যাচ্ছিল তানিয়ার দিকে। মেয়েটি বিছানায় বসে তার খাতা খুলে রেখেছে, যেটি সে সারাদিন ধরে নোট নিচ্ছিল। অনিরুদ্ধ ভেবেছিল সেই নোট কেবল গবেষণার কাজ, উপজাতীয় রীতি আর লোককথার বর্ণনা। কিন্তু আজ রাতে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে তানিয়ার চোখে যে অদ্ভুত আলোর ঝলক সে দেখেছিল, তার পর থেকে মনে হচ্ছে এই খাতার ভেতরে হয়তো আরও কিছু আছে। একসময় তানিয়া খাতা খোলা রেখে একটু বাইরে বের হলো পানি আনতে। তখনই অনিরুদ্ধর কৌতূহল আর দ্বিধা একসঙ্গে তার ভেতরে লড়াই শুরু করল। অবশেষে সে খাতার পাতাগুলো উল্টে দেখতে শুরু করল।

পাতার পর পাতা জুড়ে আঁকিবুকি, উপজাতির ভাষায় কিছু শব্দ, কিছু ছবি—সবকিছু যেন সাধারণ নোটবুকের মতোই লাগছিল প্রথমে। কিন্তু হঠাৎ এক পাতায় এসে অনিরুদ্ধর চোখ আটকে গেল। পাতার মাঝখানে একটি অদ্ভুত নকশা আঁকা ছিল। দেখতে এক ধরনের মানচিত্র, যেখানে কয়েকটি বাঁকানো লাইন, গোলচিহ্ন আর প্রতীকের ছাপ। অনিরুদ্ধর চোখের সামনে ভেসে উঠল তাওয়াং মঠের সেই প্রাচীন দেয়াল, যেখানে লোবসাং তাকে অদ্ভুত চিহ্ন দেখিয়েছিল। দু’টো ছবিকে একসঙ্গে মেলাতে গিয়ে তার বুকের ভেতর হঠাৎ ধক করে উঠল। এটা নিছক কাকতালীয় নয়—তানিয়ার খাতার নকশা আর মঠের দেয়ালের অর্ধেক মানচিত্র যেন একে অপরকে পূর্ণ করছে। অনিরুদ্ধ নিঃশ্বাস বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। যেন বহুদিন ধরে ছড়িয়ে থাকা দুটি ধাঁধার টুকরো আজ হঠাৎ এসে এক হয়ে গেল। তার মাথার ভেতরে অদ্ভুত আলোড়ন শুরু হলো—তাওয়াং আর জিরো ভ্যালি, এই দুই ভিন্ন জায়গার রহস্য আসলে একই সূত্রে বাঁধা।

ঠিক তখনই তানিয়া ফিরে এল। তার চোখে কোনো বিস্ময় ছিল না, বরং অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা নিশ্চয়তা। অনিরুদ্ধ কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তানিয়া তার হাত থেকে খাতাটা ধীরে টেনে নিল। মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “তুমি ঠিকই ভেবেছ, এই নকশা সাধারণ আঁকিবুকি নয়। আমি চেয়েছিলাম না কেউ এগুলো এখনই দেখুক।” তার কণ্ঠে ভয়ের কোনো চিহ্ন ছিল না, বরং এমন এক দৃঢ়তা, যা অনিরুদ্ধকে আরও বিভ্রান্ত করে দিল। তানিয়া ব্যাখ্যা করল, বহু বছর ধরে উপজাতিরা বিশ্বাস করে তাওয়াং মঠের প্রাচীন পান্ডুলিপি আর জিরো ভ্যালির আচার আসলে একই উৎস থেকে জন্ম নিয়েছে। খাতার পাতায় সে যেসব নকশা লিখে রেখেছে, সেগুলো উপজাতীয় গল্প থেকে সংগ্রহ করা প্রতীক, যা একত্র করলে পাওয়া যায় সম্পূর্ণ মানচিত্র। আর সেই মানচিত্র নির্দেশ করে পাহাড়ের গভীরে লুকানো কোনো রহস্যের দিকে। অনিরুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে শুনছিল, মনে হচ্ছিল তানিয়া শুধু গবেষক নন—তিনি নিজেও এই রহস্যের অংশ।

রাত আরও গভীর হলে অনিরুদ্ধ বাইরে এসে দাঁড়াল। আকাশে অসংখ্য তারা ঝিকমিক করছে, আর দূরে অরণ্যের অন্ধকারে যেন কোনো নীরব চোখ তাকিয়ে আছে। তার মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—যদি সত্যিই এই মানচিত্র বাস্তব হয়, তবে এর শেষপ্রান্তে কী লুকিয়ে আছে? সে জানত না উত্তর কী, কিন্তু অন্তর থেকে অনুভব করছিল, যাত্রার পথ এখন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। কারণ রহস্য যত গভীর হয়, আত্মাদের পরীক্ষা তত কঠিন হয়। তানিয়া এসে তার পাশে দাঁড়াল, খাতাটা বুকে চেপে ধরে বলল, “তুমি যদি চাও, আমরা এখানেই থেমে যেতে পারি। এই মানচিত্র অনুসরণ করা মানে এমন পথে পা রাখা, যেখান থেকে হয়তো ফেরা সম্ভব হবে না।” অনিরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ফেরা যদি না-ই হয়, তবু উত্তর খুঁজে না পাওয়া আরও ভয়ঙ্কর।” তাদের দু’জনের চোখে মিলল এক নীরব প্রতিজ্ঞা। পাহাড়, অরণ্য, মঠ আর উপত্যকা—সবকিছু যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা, আর সেই সুতোর টানেই তাদের যাত্রা এগোচ্ছে অনিবার্য গন্তব্যের দিকে।

ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়তেই অনিরুদ্ধ, তানিয়া, লোবসাং আর বৃদ্ধা মহিলাটি প্রস্তুত হল পাহাড়ি অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করার জন্য। আকাশ তখনো কুয়াশার সাদা পর্দায় ঢেকে, পাহাড়ের মাথা শুধু অল্প অল্প ফুটে উঠছে। আপাতানি গ্রামের লোকজন তাদের বিদায় জানাল নীরব দৃষ্টিতে, যেন সবাই জানে এই যাত্রা আর পাঁচটা ভ্রমণের মতো নয়—এটি এক পরীক্ষার পথ। লোবসাং হাতে একটি বাঁশি আর দড়ি নিয়েছিল, যেন অরণ্যের আঁকাবাঁকা পথ না হারিয়ে ফেলা যায়। বৃদ্ধা মহিলার মুখে তখনও সেই ভবিষ্যদ্বাণীমূলক দৃঢ়তা—“অরণ্যের আত্মারা সবকিছু দেখে।” অনিরুদ্ধর কানে বাজতে লাগল সেই কথা, আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল রিনচেন ভিক্ষুর দেওয়া মন্ত্র। তখনই তার বুকের ভেতরে অদ্ভুত শীতল স্রোত বয়ে গেল, যেন মন্ত্রটি কেবল শব্দ নয়, বরং পাহাড়ি আত্মাদের সঙ্গে এক অদৃশ্য সেতু। তারা যখন প্রথম বাঁশবনের ভেতর ঢুকল, তখনই চারপাশে গাঢ় অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল, এমনকি সকালের সূর্যালোকও সেই ঘন সবুজ পাতার ফাঁক গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারছিল না।

অরণ্যের গভীরে যত এগোতে লাগল, অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসতে শুরু করল। কখনো পাখির অচেনা ডাক, কখনো বা শুকনো বাঁশের কাণ্ড হঠাৎ ভেঙে পড়ার শব্দ। কিন্তু তার মাঝেই অনিরুদ্ধর মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তাদের পেছনে পা ফেলে আসছে। সে কয়েকবার ঘুরে তাকাল, কিন্তু দেখতে পেল কেবল অসংখ্য বাঁশের ডগা বাতাসে দুলছে। লোবসাং যেন সব বুঝতে পারছিল, সে মৃদু গলায় বলল, “এই অরণ্য কেবল চোখে দেখা যায় না, কান আর হৃদয় দিয়েও শুনতে হয়। এখানে আত্মারা ভ্রমণকারীদের শক্তি যাচাই করে।” অনিরুদ্ধর শরীর কেঁপে উঠল। তানিয়া পাশে হাঁটছিল খাতা বুকে চেপে ধরে, তার মুখে কোনো ভয়ের ছাপ ছিল না, বরং এক ধরনের একাগ্রতা। মনে হচ্ছিল, এই রহস্যময় শব্দ তার কাছে নতুন কিছু নয়, বরং সে জানত একদিন এই যাত্রা তাকে এখানেই নিয়ে আসবে। বৃদ্ধা মহিলাটি হাঁটার সময় মৃদু স্বরে কিছু বুজরুকির মতো শব্দ উচ্চারণ করছিলেন, হয়তো কোনো প্রাচীন প্রার্থনা, যা আত্মাদের প্রশমিত করার জন্য বলা হয়।

একসময় পথ এতটাই সরু হয়ে গেল যে চারজনকে এক লাইনে হাঁটতে হলো। বাঁশের গায়ে বারবার শরীর ঘষে যাচ্ছিল, আর বাতাসে ভেসে আসছিল স্যাঁতসেঁতে মাটির গন্ধ। হঠাৎ করেই কোথাও থেকে ভেসে এল এক অদ্ভুত হাহাকারের মতো শব্দ, যেন গভীর অরণ্যের ভেতর থেকে কেউ ডাকছে। অনিরুদ্ধর বুক কেঁপে উঠল। সে শুনতে পাচ্ছিল সেই ডাকের ভেতর চাপা এক বেদনা, এক আকুতি, আবার সেইসঙ্গে ভয়ও। তার কানে তখনই বাজতে শুরু করল রিনচেন ভিক্ষুর দেওয়া মন্ত্র। শব্দগুলো যেন নিজেরাই মনে ভেসে উঠছিল, অনিরুদ্ধ উচ্চারণ না করলেও বুকের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। মন্ত্রের সুর সেই হাহাকারকে কিছুটা দূরে ঠেলে দিল, যেন অরণ্যের অদৃশ্য ছায়ারা আপাতত পিছু হটল। লোবসাং মাথা নেড়ে বলল, “এই মন্ত্র পাহাড়ের পুরোনো ভিক্ষুরা আত্মাদের শান্ত করতে ব্যবহার করত। তুমি সেটা মনে রেখেছ, তাই আত্মারা তোমাকে গ্রহণ করছে।” অনিরুদ্ধ বুঝতে পারছিল না এটি আশীর্বাদ নাকি আরও বড় পরীক্ষা, কিন্তু অন্তরের গভীরে সে অনুভব করল, আজ সে এক নতুন স্তরে পৌঁছেছে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে তারা পৌঁছল অরণ্যের এমন এক স্থানে, যেখানে বাঁশগুলো হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গিয়ে খোলা জায়গা তৈরি করেছে। মাঝখানে ছিল এক পাথরের বেদি, যার ওপর অদ্ভুত প্রতীক খোদাই করা। বৃদ্ধা সেখানে গিয়ে হাত রাখলেন, আর মৃদু স্বরে বললেন, “এখানেই মানচিত্রের প্রথম সংকেত লুকানো আছে।” অনিরুদ্ধ আর তানিয়া বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। সেই প্রতীকগুলোর কিছু তারা আগেই দেখেছিল—তাওয়াং মঠের দেয়ালে, আবার তানিয়ার খাতার পাতাতেও। মনে হচ্ছিল সবকিছু যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা, আর সেই সুতো তাদের টেনে এনেছে এই অরণ্যের গভীরে। বাতাসে আবার ভেসে আসছিল সেই ডাক, এবার আর কেবল ভয় নয়, বরং আহ্বান। যেন অরণ্য নিজেই তাদের স্বাগত জানাচ্ছে, আবার সতর্কও করছে। অনিরুদ্ধ গভীর নিশ্বাস ফেলল। সে বুঝল, যাত্রার পথ এখন আরও বিপজ্জনক, আরও অনিবার্য। কারণ একবার অরণ্যের গভীর ডাক শুনে ফেললে, আর ফিরে যাওয়ার পথ থাকে না।

১০

অরণ্যের ভেতর দীর্ঘ পথ পেরিয়ে, অদ্ভুত শব্দ আর অজানা ভয়ের সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে তারা পৌঁছল এক লুকানো গুহার সামনে। পাহাড়ের পাথর গায়ে শ্যাওলার আস্তরণ, মুখবন্ধ যেন অর্ধেক চাপা দেওয়া, এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেন প্রকৃতিই তাকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। লোবসাং সামনে এসে কুণ্ডলিত বাঁশির সুরে কোনো এক সঙ্কেত বাজাল, আর বৃদ্ধা মহিলাটি মাটিতে হাত রেখে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন। ধীরে ধীরে গুহার ভেতর থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বেরোতে লাগল, সঙ্গে অদ্ভুত এক সুর—যেন ভেতরে শত শত বছরের নিদ্রা ভাঙল। অনিরুদ্ধর বুকের ভেতর ধকধক করতে লাগল। গুহার ভেতরে ঢুকে তারা দেখতে পেল প্রাচীন প্রতীক দিয়ে সাজানো দেয়াল, যেন ইতিহাসের পাতায় পাথরে খোদাই হয়ে আছে। কেন্দ্রে রাখা এক বেদির ওপর ছড়িয়ে আছে সেই মানচিত্রের পূর্ণ রূপ—যেটি মিলে গেছে তাওয়াং মঠের দেয়াল আর তানিয়ার খাতার অঙ্কনের সঙ্গে। অনিরুদ্ধ অনুভব করল, এতদিনের রহস্য একে একে উন্মোচিত হচ্ছে, তবুও এর গভীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে নতুন অন্ধকার খুলে যাচ্ছে।

মানচিত্রের প্রতিটি রেখা যেন একেকটি পথ দেখাচ্ছে, কিন্তু গন্তব্য ছিল একই—এক আচারস্থল, যেখানে প্রাচীন উপজাতিরা বিশ্বাস করত তারা আত্মাদের সঙ্গে মিলিত হয়। লোবসাং ধীরে ধীরে সেই প্রতীকগুলোর ব্যাখ্যা করছিল, তার কণ্ঠে ভেসে আসছিল এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা আর ভীতি। সে বলল, “এটি কেবল মানচিত্র নয়, বরং যাত্রাপথ। যারা আত্মার সঙ্গে মিলন ঘটাতে চায়, তাদের এই পথ ধরে যেতে হয়। প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি প্রতীক আসলে একটি পরীক্ষা।” তানিয়া তার খাতা মেলে ধরল, আর অনিরুদ্ধ দেখল সেই নকশার সঙ্গে একেবারে মিলে যাচ্ছে বেদির খোদাই। মুহূর্তে সব যেন স্পষ্ট হয়ে গেল—তাওয়াং মঠ, আপাতানি গ্রাম, বাঁশের অরণ্য—সব মিলিয়ে আসলে এক পূর্ণ রহস্যপথ, যা যুগ যুগ ধরে অদৃশ্য আত্মাদের সঙ্গে মানুষের সেতুবন্ধন ঘটিয়েছে। অনিরুদ্ধর চোখে হঠাৎ ভেসে উঠল অরুণিমার মুখ। যেন সে দূর থেকে ডাকছে, আবার কাছে এসে ফিসফিস করছে। এ কি কেবল স্মৃতি, নাকি অরণ্যের আত্মা সত্যিই তার রূপে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে?

গুহার ভেতর নীরবতা হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল। অনিরুদ্ধ তার ডায়েরি খুলল, আর বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল—পাতার ফাঁক দিয়ে যেন অরুণিমার হাতের লেখা ফুটে উঠছে। সেই অক্ষরগুলো তার লেখা নয়, কিন্তু অনুভব করল এগুলো অচেনা নয়। সেখানে লেখা ছিল, “প্রতিটি যাত্রা শেষ হয় না। কিছু পথ কেবল আত্মার ভেতরে বেঁচে থাকে।” অনিরুদ্ধর চোখ ভিজে উঠল। সে অনুভব করছিল, অরুণিমা এই পুরো যাত্রায় তার সঙ্গে ছিল—কখনো স্মৃতি হয়ে, কখনো অদৃশ্য উপস্থিতি হয়ে। তানিয়া আর লোবসাং বিস্ময়ে তার দিকে তাকালেও, অনিরুদ্ধর ভেতরে তখন আর দ্বন্দ্ব ছিল না। সে বুঝে গিয়েছিল, আত্মা আর স্মৃতির মধ্যে যে বিভাজন আমরা করি, তা হয়তো এক মায়া। গুহার দেয়াল থেকে তখনও ভেসে আসছিল প্রতিধ্বনি—কোনো পুরোনো প্রার্থনার মতো, কোনো অদৃশ্য কণ্ঠের মতো।

যাত্রা শেষ হলেও রহস্যের উত্তর পুরোপুরি মেলেনি। গুহার অন্ধকার যেন তাদের মনে খোলা প্রশ্ন রেখে দিল। আত্মারা কি সত্যিই তাদের দেখেছিল? অরুণিমা কি শুধুই অনিরুদ্ধর স্মৃতিতে বেঁচে আছে, নাকি সত্যিই অরণ্যের গভীরে আত্মারূপে সঙ্গ দিয়েছে? অনিরুদ্ধ ডায়েরির পাতায় শেষ কয়েকটি লাইন লিখল—“এই পাহাড়, এই অরণ্য, এই পথ—সবকিছু যেন আমাকে মনে করিয়ে দেয়, জীবন কেবল গন্তব্য নয়, যাত্রাই আসল রহস্য।” গুহার বাইরে তখন আকাশে মেঘ সরে গিয়ে তারার ভিড় নেমে এসেছে। তাদের চারজনের চোখে মিলল এক নীরব প্রতিজ্ঞা—রহস্য হয়তো শেষ হয়নি, বরং এখান থেকেই শুরু। গল্প যেন খোলা প্রশ্ন হয়ে বাতাসে ভেসে রইল, যার উত্তর হয়তো শুধু আত্মারাই জানে।

শেষ

1000061352.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *