দেবযানী ভট্টাচার্য
এক
বীরভূমের প্রত্যন্ত এক গ্রামে অবস্থিত অরুণপুকুর—চারপাশে শাল, মহুয়া, আর শিমুল গাছে ঘেরা এক নিঝুম জলাশয়, যেটিকে ঘিরে রয়েছে শত গল্প, শত কানাঘুষো। দিনের বেলায় সেটি যেন নিরীহ; গ্রামের মহিলারা সেখানে জল তোলে, শিশুরা খেলে। কিন্তু সূর্য ঢলে যাওয়ার পর সেই পুকুরের ঘাট কেমন যেন থমকে যায়। পাখিরা উড়ে যায় অন্য দিকে, কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠলেও কিছুক্ষণ পরেই চুপ করে যায়। গ্রামের মানুষ বলে—“ওই সময় কেউ যেও না ঘাটের দিকে, মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকে জলে।” এই গল্পে সৌরভ মুখোপাধ্যায়, গ্রামের হাইস্কুলের ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র, আদৌ বিশ্বাস করে না। বিজ্ঞান, লজিক, নিউরোলজি, আর ইউটিউব ডকুমেন্টারির উপর দাঁড়ানো তার যুক্তিনির্ভর জগতে ভূতের কোনও স্থান নেই। সে ভাবে—”মানুষ ভয় পায়, কারণ তারা বোঝে না। আর না বোঝা মানেই অলৌকিক ভাবা—এটাই তো কুসংস্কার।”
তাই এক সন্ধ্যায়, বিদ্যালয় থেকে ফিরে, সৌর তার বন্ধু সাম্যর হাতে একটা ছোট ক্যামেরা দিয়ে বলে, “চল, প্রমাণ করি ওরা যা ভাবছে সেটা আসলে ইলিউশন, বা হ্যালুসিনেশন—হয়তো জলাশয়ে রিফ্লেকশনের খেলা, কিংবা মাইগ্রেন ইফেক্ট।” সাম্য প্রথমে একটু আপত্তি করলেও শেষে রাজি হয়। তারা দুই বন্ধু ছোট ট্রিপড, হেড টর্চ আর ক্যামেরা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছায় অরুণপুকুরের ঘাটে। সূর্য একেবারে অস্ত যাওয়ার মুখে, ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে। পুকুরের জলের ওপর একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন হাওয়া সেখানেও থমকে গেছে। সাম্য ড্রোন ছাড়ার প্রস্তুতি নেয় আর সৌর ট্রিপড সেট করতে থাকে। “এইবার যদি কেউ দেখে, বুঝে নেবে এটা কিছুই না—খালি দৃষ্টিভ্রম,” সৌর বলে। ঠিক সেই সময়, সাম্যর চোখ পড়ে ঘাটের ওপারে—পানির ওপর এক ফাঁকা দাঁড়ানো ছায়া। প্রথমে মনে হয় একটা গাছের প্রতিচ্ছবি, কিন্তু তার হাত… নাড়ছে।
সৌর ধীরে ধীরে ক্যামেরার লেন্স ঘোরায়, আর ফোকাস করে ছায়ার দিকে। জলের ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী—সাদা জামা, ভিজে চুল, আর ফ্যাকাশে চেহারা। সৌর বলে, “দ্যাখো—এটা কনট্রাস্টের খেলা।” কিন্তু সেই কিশোরী মুখ ঘোরায়—আর তারা দেখে, মুখটাই নেই। শুধু একটা গভীর, ফাঁকা গহ্বর, যেখান থেকে নিঃশ্বাসের শব্দের মতো এক অদ্ভুত গর্জন ভেসে আসে। সাম্য চিৎকার করে উঠে—“সৌর! দৌড়া!” কিন্তু সৌর একপলক তাকিয়ে থাকে—তার বিজ্ঞান, যুক্তি সব যেন তখন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সে দেখতে পায়—মেয়েটির দুটি হাত ধীরে ধীরে তার দিকে বাড়ছে… না, তার শরীর ছুঁতে নয়, যেন তার ভেতরের কিছু কাঁদছে তাকে কিছু বোঝাতে, চিৎকার করতে চাইছে, অথচ কোনও শব্দ নেই। হঠাৎ করে ক্যামেরা বন্ধ হয়ে যায়। বাতাস হিম হয়ে ওঠে। আর তারা বুঝতে পারে—যে সত্যকে তারা প্রমাণ করতে এসেছিল, সেই সত্য যুক্তির বাইরে, সময়ের বাইরে, এবং ভয়াবহভাবে জীবন্ত।
দুই
গ্রামে ফিরেও সৌর আর সাম্য কিছুতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না সেই মুখহীন কিশোরীর ছায়াকে। সাম্য বারবার বলতে থাকে, “আমি ঠিক দেখেছি—ওর মুখ ছিল না, মুখের জায়গায় একটা অন্ধকার গহ্বর, যেন কিছু টানছে।” সৌর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “হতে পারে অপটিক্যাল ইলিউশন, আমাদের চোখ প্রতিফলনের ভুল ধরেছে।” কিন্তু কথাটা নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার ঘরে ফিরে সে নিজের ক্যামেরার ফুটেজ খুলে বসে—কিন্তু অবাক হয়ে দেখে, ক্যামেরা জাস্ট সেই মুহূর্তে হ্যাং করেছে যখন কিশোরীটা তাদের দিকে তাকিয়েছিল। একটা ঝিরঝিরে স্ক্রিন, বিকৃত শব্দ—আর তারপর শুধু কালো। বারবার রিওয়াইন্ড করে দেখতে গিয়ে সৌর বুঝতে পারে—সেই জায়গার ঠিক আগের ফ্রেমেও মেয়েটা ছিল না, আবার পরের দিকে নেই। সে যেন শুধু ক্যামেরার চোখের বাইরের জন্যই উপস্থিত ছিল, যেন সেই অস্তিত্ব তার যুক্তির বাইরে। আর এখানেই সৌরের মাথার ভিতরটা যেন কাঁপতে শুরু করে—তবুও সে নিজেকে বোঝায়, “বিজ্ঞান এক দিনে সব ব্যাখ্যা দিতে পারে না, তাই বলে অতিপ্রাকৃত ভাবলে হবে না।”
পরদিন স্কুলে যাবার পথে সৌর সিদ্ধান্ত নেয়, সে পুরনো লোকদের কাছ থেকে পুকুরের ইতিহাস খুঁজে বের করবে। স্কুল ছুটির পর সে সোজা যায় শঙ্কর কাকুর কাছে—পুকুরঘাটের পুরোনো কেয়ারটেকার, যিনি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ঘাটে আছেন। শঙ্কর কাকু একসময় অনেক কথা বলতেন, কিন্তু কয়েক বছর ধরে যেন চুপচাপ হয়ে গেছেন। সৌর বলে, “কাকু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব—সত্যি করে বলবেন, ওই ঘাটে কি আগে কেউ মারা গিয়েছিল?” শঙ্কর প্রথমে চুপ করে থাকে, তারপর চোখ সরিয়ে কাঁপা গলায় বলে, “তুই যে সময়ের ছেলে, তোমার সামনে বললেই হবে না। ওই মেয়েটা আজও কিছু বলতে চায়, কিন্তু মুখ নেই বলে বলতে পারে না।” সৌরের গা কাঁটা দেয়। শঙ্কর কাকু উঠে গিয়ে পুরনো একটা ট্রাংক থেকে বের করে একটা হলদেটে রঙের কাগজ—১৯৯৯ সালের একটি সংবাদপত্রের কাটা অংশ। শিরোনাম: “স্কুলগামী কিশোরী নিখোঁজ—অরুণপুকুরে শেষবার দেখা গিয়েছিল।” মেয়েটির নাম ছিল অরুণা দত্ত, বয়স পনেরো। সে এক সন্ধ্যায় প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হয়, আর তার চিহ্ন কখনো মেলেনি।
সৌরের মাথায় তখন একটার পর একটা প্রশ্ন ঘুরতে থাকে। অরুণপুকুরের নাম কি তাহলে এই মেয়ের নাম থেকেই এসেছে? সে কি সত্যিই মারা গেছে, না তাকে কেউ ঠেলে দিয়েছে ওই মৃত্যুর দিকে? আর কেনই বা সে মুখহীন? রাত বাড়তেই সৌর আর ঘুমোতে পারে না। তার টেবিলের ওপর রাখা ক্যামেরার স্ক্রিন যেন নিজে নিজেই খুলে যায়। সে দেখে—স্ক্রিনে শুধু জলের টলমল দৃশ্য, আর এক মুহূর্তের জন্য যেন একটি হাত স্ক্রিনের ওপর ছায়া ফেলে। সৌর বুঝতে পারে, কেবল যুক্তি দিয়ে এ রহস্যের জট খোলা যাবে না। তাকে ঢুকতে হবে অতীতের ভিতরে—যেখানে মুখহীনতার পেছনে লুকিয়ে আছে এক অপমান, এক কান্না, এক অসমাপ্ত সত্য।
তিন
পরদিন সকালে সৌর স্কুলে গেলেও মন পড়ে রইল অরুণা দত্ত নামের সেই মেয়েটির ফেলে যাওয়া ধোঁয়াশায়। ক্লাসে তার সামনে রাখা পদার্থবিজ্ঞানের বইয়ের অক্ষরগুলো যেন অকারণে ঝাপসা হয়ে আসছিল, আর পেছন থেকে কানে বাজছিল সেই নিঃশব্দ কান্নার ধ্বনি—যা সে আগের রাতে শুনেনি, কিন্তু এখন যেন অনুভব করছে। ছুটির ঘণ্টা বাজতেই সে সোজা চলে যায় স্কুলের লাইব্রেরিতে, খোঁজে পুরনো গ্রামের ইতিহাস, নিখোঁজ কেসের খবর। কিন্তু সরকারি কোনো রেকর্ডে অরুণা দত্তের নাম নেই—যেন সে কোনোদিন ছিলই না। লাইব্রেরিয়ান ঠাকুরদা তাকে বলে, “এইসব বাচ্চাদের গল্প পড়ার চাইতে ভালো, স্কুলের পরীক্ষার পড়াশোনা কর। ওই অরুণার গল্পে ঢুকলে তুই হারিয়ে যাবি।” কিন্তু সৌর থামে না। সে জানে, এই মেয়ে একদিন ছিল, হঠাৎ গায়েব হয়নি—তাকে নিশ্চয় কেউ চেয়েছিল মুছে ফেলতে। হঠাৎ তার মাথায় আসে—গ্রামের পুরনো পোস্ট অফিসের পাশে আছে এক পুরোনো সরকারি রেকর্ডরুম। সেখানে হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে।
দুপুরের দিকে সৌর সেই রেকর্ডরুমে পৌঁছায়, ধুলো জমা এক অন্ধকার ঘর, যেখানে পুরনো কাগজের গন্ধ আর ভাঙা জানালায় ঝুলে থাকা মাকড়সার জাল ছাড়া কিছু নেই। ঘণ্টাখানেক খোঁজার পর তার হাতে উঠে আসে ২০০০ সালের একটি অজানা কেস ফাইল—“অরুণা দত্ত, অভিযোগ: নিখোঁজ। তদন্তকারী: এসআই ভবতোষ নন্দী।” ফাইলে লেখা ছিল, মেয়েটি শেষবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে দেখা গিয়েছিল স্কুল ইউনিফর্ম পরে পুকুরঘাটের দিকে হেঁটে যেতে। তবে পুলিশের সন্দেহ ছিল, সে হয়তো কারও সঙ্গে পালিয়ে গেছে। কোনও জোরালো প্রমাণ না থাকায় কেস বন্ধ করে দেওয়া হয় এক সপ্তাহের মধ্যে। আরও একটি কথা সৌরকে আঁতকে তোলে—রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মেয়েটির চরিত্র ‘অস্বাভাবিক রকম স্বাধীনচেতা’। এই একটি শব্দেই যেন সব বোঝা যায়। হয়তো সমাজের চোখে ‘স্বাধীন’ হওয়াটাই তার অপরাধ ছিল, হয়তো কেউ তাকে চুপ করিয়ে দিতে চেয়েছিল চিরতরে।
সন্ধ্যা নামতেই সৌর আবার যায় ঘাটের দিকে, এবার একা। সাম্য তাকে আটকাতে চেয়েছিল, কিন্তু সৌর বলে, “আমি সত্যিটা জানতেই এসেছি। ভয় পেলে চলবে না।” সে হাতে নেয় পুরনো টেপ রেকর্ডার, ক্যামেরা আর মোবাইল। পুকুরঘাটের বাতাস যেন আরও ভারী, আর জলের গা ছমছমে চমক। হঠাৎ একটা ঢেউ ওঠে, আর জলের মাঝখানে আবার ভেসে ওঠে সেই কিশোরী। এবার তার চেহারায় একটা পরিবর্তন আছে—তার মুখ নেই, কিন্তু সেই গহ্বরের ভেতর থেকে যেন কেউ ফিসফিস করে বলছে, “আমাকে ভুলে যেও না…” সৌর নিঃশব্দে বলে, “তুমি কি অরুণা দত্ত? আমি তোমার সত্যিটা খুঁজছি।” আর তখনই হাওয়ার বেগে তার দিকে ছুটে আসে এক সাদা আলো, যেন জল থেকে আলো ফেটে বেরোল। সৌর চোখ বন্ধ করে ফেলে—আবার যখন খোলে, দেখে ঘাটে সে একা নয়। কারও ছায়া পড়ে আছে ঠিক তার পেছনে।
চার
সৌরের চোখ খোলার পর সে বুঝতে পারে, পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী—তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু চোখে একটি অদ্ভুত বিষাদ। হঠাৎ আলো নিভে যায় চারদিকে, আর সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে বলে ওঠে, “তুমি আমাকে শুনছো, তাই আমি এখন কথা বলতে পারি।” কিন্তু কণ্ঠস্বরটা যেন শীতল, আর এক অদ্ভুত প্রতিধ্বনি তার পেছনে ছড়িয়ে পড়ছে, যেন ঘাটের চারদিকে বহু কণ্ঠ একসঙ্গে ফিসফিস করছে। সৌর বোঝে—এই মুহূর্তে সে কেবল বাস্তবেই নেই, বরং কোনও অতল ছায়াজগতের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি এবার জলের মধ্যে হেঁটে আসে তার কাছে, পায়ের নিচে জল ছুঁয়ে যাচ্ছে না, শুধু স্পর্শহীন ছায়া। সৌর জিজ্ঞেস করে, “তুমি অরুণা দত্ত?” ছায়া মাথা নাড়ায়, তারপর সেই ফাঁকা মুখ থেকে একটিমাত্র শব্দ ভেসে আসে—”আসামি…” সৌর স্তব্ধ হয়ে যায়। সে ভাবেনি, প্রেতাত্মা তাকে কোন অপরাধীর কথা বলবে। মেয়েটি আবার বলে, “তারা জানত, আমি যদি বাঁচি… আমি বলব সত্যিটা। তারা ভয় পেত আমার কণ্ঠস্বরকে… তাই মুখটাই কেড়ে নিল।”
এতক্ষণে সৌরের শরীর হিম হয়ে আসে। সে বুঝে যায়, কেবল মুখের গহ্বর না, এই আত্মা আসলে ন্যায়ের আকুতি। সে পেছনে ঘুরে দেখে, সেই ঘাটে দুধারে দাঁড়িয়ে আছে আরও কিছু ছায়া—কেউ ম্লান পোশাকে, কেউ শিশু, কেউ বৃদ্ধা—সবাই মুখহীন। তারা যেন প্রত্যেকে চিরকাল নিঃশব্দে কিছু বলতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। অরুণা তখন বলে, “আমার খাতা পাওয়া গিয়েছিল, পড়েছিলে?” সৌর মাথা নাড়ায়। “আমার খাতায় সব লেখা ছিল—কারা আমাকে হুমকি দিত, কে আমাকে পুকুরপাড়ে ডেকেছিল। কিন্তু তারা সেই পাতাগুলো ছিঁড়ে দিয়েছিল, প্রমাণ মুছে ফেলেছিল।” হঠাৎ পুকুরের এক কোণে যেন আগুন জ্বলে ওঠে—আর সৌর দেখে, সেই আগুনে একটা ছায়ামূর্তি, যার হাতে স্কুলব্যাগ আর খাতা পুড়ে যাচ্ছে। সে বুঝে যায়—কারও চেষ্টায় সব প্রমাণ ধ্বংস করা হয়েছিল, এবং গ্রামের মানুষ নিশ্চুপ থেকেছিল।
ঘটনাটি দেখে সৌর আর নিজেকে সামলাতে পারে না। চোখে জল চলে আসে, মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “তোমার সত্যিটা আমি খুঁজব, আমি প্রমাণ করব তুমি শুধু গল্প নও। তুমি ছিলে, এবং অন্যায়ভাবে তোমার কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়েছিল।” অরুণা একটিবার এগিয়ে আসে, তার হাত ছুঁয়ে যায় সৌরের গাল—এক অদ্ভুত ঠান্ডা কিন্তু মায়াবী স্পর্শ। তখনই হঠাৎ সব আলো নিভে যায়, চারদিক অন্ধকার। সৌর পড়ে যায়, চোখ খুলতে না খুলতেই দেখে—সকালের আলো। সে পড়ে আছে পুকুরঘাটে, একা। পাশে পড়ে রয়েছে তার ক্যামেরা, মোবাইল, আর সেই পুরনো কাগজটা—যেটা শঙ্কর কাকুর কাছ থেকে পেয়েছিল। কাগজের কোণায় কেউ যেন পেন্সিল দিয়ে লিখে রেখেছে—“খাতা খোঁজো। আমি আজও অপেক্ষায়।”
পাঁচ
সকালের রোদ পুকুরঘাটের নিস্তব্ধ জলে পড়লেও সৌরের মনে যেন একটা গা-ছমছমে ঠাণ্ডা লেগে আছে। সে ধীরে ধীরে উঠে বসে, চারপাশে তাকায়—পুকুর যেন একেবারে নিষ্পাপ, আগের রাতের ছায়া যেন কোনোদিন ছিলই না। কিন্তু হাতে ধরা কাগজের কোণায় অরুণা’র সেই হাতে লেখা বার্তা দেখে তার মনে হয়, “না, এটা স্বপ্ন নয়। এটা সত্যি।” খাতার কথা ভেবে সে ফিরে যায় শঙ্কর কাকুর বাড়িতে। শঙ্কর তাকে দেখে চুপ করে থাকে, চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই ওকে দেখেছিস… তাই তো?” সৌর বলে, “সে বলেছে তার খাতা হারিয়ে গেছে—সেই খাতায় ছিল সব প্রমাণ, যার কারণে ওকে… চিরতরে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল।” শঙ্কর এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “ওর মা বহুদিন আগে একদিন আমার কাছে এসে বলেছিল, অরুণা ডায়েরি লেখে। কিন্তু মেয়েটা নিখোঁজ হওয়ার পর বাড়ির লোকেরাও আর সেই খাতা খুঁজে পায়নি। কেউ বলত—ওই খাতা নাকি স্কুলের হেডস্যার নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন।” এই কথায় সৌরের মনের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে যায়—তার স্কুলের স্যার, নবকুমার বসু, যিনি আজও হেডস্যার, সেই সময়েই স্কুলে ছিলেন।
সেই দিনই দুপুরে সৌর গিয়ে দাঁড়ায় নবকুমার স্যারের ঘরের সামনে। দরজা বন্ধ, কিন্তু জানলার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়—স্যার পুরনো আলমারির ফাইল ঘাঁটছেন। সৌর সাহস করে দরজায় নক করে। “কি ব্যাপার?” স্যার রুক্ষ গলায় বলেন। সৌর শান্তভাবে বলে, “স্যার, আমি একটা পুরনো কেস নিয়ে জানার চেষ্টা করছি। ২০০০ সালের অরুণা দত্ত নামের এক মেয়ের কথা।” নবকুমার স্যারের মুখের রেখায় এক অদ্ভুত টান পড়ে, চোখে এক মুহূর্তের জন্য আতঙ্ক। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, “সেই কেস তো বন্ধ হয়ে গেছে বহুদিন। ভুলে যাও।” সৌর প্রশ্ন করে, “আপনি কি জানেন অরুণা একটা খাতা লিখত?” স্যার তখন চুপ করে যান। ঠিক তখনই পিছনের আলমারি থেকে একটা পুরনো খাতা মাটিতে পড়ে যায়—যার মলাটে অক্ষরে লেখা: “অরুণা – আমার সত্যি কথাগুলো।” সৌর ঝুঁকে পড়ে খাতাটা তুলে নেয়। স্যার উঠে এসে খাতা নিতে চাইলে সৌর পিছিয়ে যায়। “স্যার, আপনি এটা এতদিন রেখে দিয়েছিলেন কেন?” নবকুমার বসু এবার কাঁপা গলায় বলেন, “ও মেয়ে… বেশি প্রশ্ন করত। আমি ওকে সাবধান করেছিলাম, কিন্তু সে… একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চেয়েছিল।” সৌর স্তব্ধ হয়ে যায়।
অরুণা সেই খাতায় লিখেছিল—স্কুলের এক শিক্ষক, প্রবাল মুখার্জী, বারবার তাকে বিরক্ত করত। একদিন সে প্রতিবাদ করে, এবং তখনই তাকে হুমকি দেওয়া হয়, যেন মুখ বন্ধ রাখে। সে ভয় পায় না, বরং সাহস করে হেডস্যারের কাছে যেতে চায়। আর ঠিক তার পরদিন সন্ধ্যেয় সে নিখোঁজ হয়। নবকুমার স্যার সেই খাতা পেয়ে তাকে লুকিয়ে রাখেন, কারণ স্কুলের বদনাম হতে পারত, এবং প্রভাবশালী এক অভিভাবক ছিলেন প্রবাল বাবু। সৌর খাতাটি হাতে নিয়ে ভাবে, “এই সত্যিটাই চেয়েছিল অরুণা। যেন কেউ একদিন তার হয়ে কথা বলে।” ঘাটে ফিরে গিয়ে সে সেই খাতাটি অরুণপুকুরের সামনে খুলে পড়ে—আর ঠিক সেই সময়, পুকুরের জলে যেন একটি মুখ ভেসে ওঠে—এই প্রথম, অরুণা’র মুখ। তার চোখে জল, কিন্তু মুখে প্রশান্তি। তারপর ধীরে ধীরে সে মিলিয়ে যায় জলের গভীরে, যেন বলছে—“তুমি আমার মুখ হয়ে উঠলে… এবার আমি যেতে পারি।”
ছয়
সৌরের হাতে অরুণা দত্তের পুরনো ডায়রিটা যেন এখন কেবল এক খাতা নয়—এ যেন এক কিশোরীর আত্মা, এক চাপা কান্না, এক অসমাপ্ত জবানবন্দি। সেই রাতে পুকুরঘাটে যখন অরুণা তার মুখসহ ভেসে উঠেছিল, সৌর বুঝেছিল—এটি ছিল একরকম মুক্তি, কিন্তু একই সঙ্গে এক আহ্বানও। ঘরে ফিরে সে খাতার পাতাগুলো আরও ভালো করে পড়ে। প্রতিটি পৃষ্ঠায় রয়েছে ভয়, অপমান, প্রতিবাদ, এবং আত্মবিশ্বাসের ছাপ—যেখানে অরুণা একদিকে লিখছে ক্লাসের ঘটনা, অন্যদিকে নিজের ভেতরের যুদ্ধ। “আমি মুখ বন্ধ করব না”, “আমি জানি আমি একা”—এই বাক্যগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে সৌরের সামনে। পরদিন সকালেই সে স্কুলে গিয়ে সাম্যর সঙ্গে কথা বলে। সাম্য প্রথমে ভয় পায়—“তুই জানিস, এই কেস নিয়ে তুই যাদের নাম নিচ্ছিস তারা এখনো সমাজে প্রভাবশালী।” কিন্তু সৌর চুপ থাকে না। সে বলে, “ভয় পেলে আরেকটা অরুণা তৈরি হবে। আমি চাই, অরুণাদের যেন আর মুখ না কাটা পড়ে।”
সৌর সেই খাতার কিছু স্ক্যান করে, অরুণার ঘটনার একটি বিবরণ লেখে, এবং স্থানীয় এক অনলাইন নিউজ পোর্টালের কাছে পাঠায়। প্রথমে কেউ পাত্তা দেয় না, কিন্তু যখন খাতার হাতে লেখা পৃষ্ঠাগুলো সামনে আসে, মানুষের মনে চঞ্চলতা দেখা দেয়। ‘অরুণপুকুরের কিশোরী আত্মহত্যা করেনি, তাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল’—এই শিরোনামে এক প্রতিবেদন ভাইরাল হয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার হয় অরুণা’র ডায়েরির পাতা। স্থানীয় প্রশাসন চাপে পড়ে পুনরায় তদন্তের ঘোষণা দেয়, এবং প্রবাল মুখার্জীর নামে পুরনো অভিযোগ খুঁজে বের করে। নবকুমার বসুর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সৌরকে থানায় ডাকা হয়, সে নিজের ক্যামেরা ফুটেজ, খাতা, শঙ্কর কাকুর বিবৃতি—all কিছু দেয়। সাম্য তার বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়ায়। শঙ্কর কাকুও প্রথমবার খোলামেলা সাক্ষ্য দেন—কীভাবে তারা সব জানতেন, কিন্তু মুখ বন্ধ রাখতে হয়েছিল ভয় আর চাপের কারণে। সেই চাপ এবার আর টিকে না।
আরও চমক আসে যখন অরুণা’র মা, যিনি দীর্ঘদিন ধরে নীরব ছিলেন, প্রথমবারের মতো সংবাদমাধ্যমে বলেন—“আমার মেয়ের মুখ হয়তো তারা মুছে দিতে পেরেছিল, কিন্তু আজ ও ফিরে এসেছে—এই খাতার পাতায়, এই ছেলেটির কণ্ঠে।” অরুণার নামে স্কুলে একটি মেমোরিয়াল লাইব্রেরি খোলার দাবি ওঠে, এবং অনেকেই এখন তাকে সাহসী বলছে, যে অন্যায়কে না বলে লড়েছিল। সৌর পুকুরঘাটে শেষবারের মতো আসে এক সন্ধ্যায়, হাতে সেই খাতা নিয়ে। এবার সে একা নয়—পেছনে স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক, গ্রামের মানুষ, এবং অরুণা’র মা। পুকুরে কিছুই নেই, কিন্তু সৌর জানে, সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেই জল একদিন সাক্ষী ছিল এক ভয়াবহ নিঃশব্দতার। সৌর ধীরে ধীরে খাতাটা পুকুরপাড়ের ঘাটে রেখে বলে—“তুমি আর একা নও, অরুণা। এবার তোমার গলার আওয়াজ আমরা।” তখন বাতাস বইতে শুরু করে, হঠাৎ পুকুরের জলে এক ঝিলিক আলো পড়ে—আর সেই আলোয় এক মুহূর্তের জন্য দেখা যায় অরুণা’র হাসিমুখ। এবার সে মুখহীন নয়।
সাত
গ্রামে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন অনুভূত হতে থাকে অরুণা’র ডায়েরি প্রকাশের পর। মানুষজন যারা এতদিন মুখ ঘুরিয়ে ছিল, যারা ভয় দেখিয়ে সত্যিটাকে চেপে রাখত, তাদের গলায় এবার দ্বিধা, চোখে সংকোচ। কেউ বলে, “ওই মেয়েটা ঠিকই করেছিল, আমরা ভয়ে মুখ খুলিনি”, কেউ আবার ছায়ার মতো নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে যায়। কিন্তু সৌর জানে, কেবল সত্য প্রকাশ করলেই সব শেষ হয় না—সেই সত্যকে সম্মান জানাতে হয়, তার চিহ্ন রাখতে হয় যেন ভুলগুলো আবার না ঘটে। তাই সে স্থানীয় ক্লাবের সঙ্গে মিলে আয়োজন করে একটি সন্ধ্যা: “স্মৃতির আলোকবর্ণ”—অরুণা ও অন্য মুখহীন আত্মাদের উদ্দেশে একটি শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান। সেই দিন ঘাটের চারপাশে সাজানো হয় প্রদীপ, মোমবাতি আর পুরনো ছবির প্রতিরূপ—অরুণা’র হাতে আঁকা ফুল, তার ডায়েরির লাইনগুলো, আর কিছু খালি ক্যানভাস। ক্যানভাসে লেখা থাকে, “যারা বলতে পারেনি, তারা আজো আমাদের ভেতরেই বাঁচে।”
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে গ্রামবাসীরা আসতে শুরু করে—বয়স্কা মহিলারা, স্কুলের ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিকরা, এমনকি সেই পুলিশ অফিসারও যিনি একসময় কেস বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শঙ্কর কাকু একটি ছোট বক্তৃতায় বলেন, “ভয় আর অপরাধ যদি একসাথে চলে, তাহলে ইতিহাস মুখহীন হয়ে যায়। আজ আমরা তাকে মুখ দিচ্ছি।” এরপর সবাই একে একে অরুণা’র ডায়েরির পাতা থেকে কয়েকটি লাইন পড়ে শোনায়। সৌর আর সাম্য মিলেই একটি প্রজেক্টর বসিয়ে দেখায় পুকুরঘাটের ফুটেজ, যেখানে দেখা যায়—অরুণা’র সেই ছায়া, সেই অলৌকিক স্পন্দন। দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ স্তব্ধ হয়ে যায়, কেউ কেঁদে ফেলে। আর তখনই, নিস্তব্ধতার মধ্যে ভেসে আসে এক ফিসফিস শব্দ—জলের গা ঘেঁষে একটা ঠাণ্ডা বাতাস চলে যায়। সৌর জানে, অরুণা এখানে আছে, উপস্থিত আছে, এই সম্মান আর আলোয় সে খুঁজে পেয়েছে তার শান্তি।
অনুষ্ঠানের শেষে, সৌর একটি খালি খাতা নিয়ে উপস্থিত সবার কাছ থেকে একটি করে লাইন লেখায়—‘কোন সত্যিটা তারা বলতে চায়, কিন্তু সাহস হয়নি’। কেউ লেখে—“আমিও একদিন চুপ ছিলাম, আর এখন নিজেকেই ক্ষমা করতে পারি না”, কেউ লেখে—“আমার মেয়ের গল্প অরুণা’র মতোই, কিন্তু সে হারিয়ে যায়নি, তার মুখ আমি রক্ষা করব।” খাতা ভর্তি হয় শূন্য মুখের স্বীকারোক্তিতে। সেই খাতা রাখা হয় নতুনভাবে গড়া “অরুণা স্মারক ঘরে”—পুকুরঘাটের পাশে একটি ছোট ঘর, যেখানে থাকবে অরুণা’র ডায়েরির প্রতিলিপি, তার আঁকা ছবি, আর সেই খালি ক্যানভাসগুলো। পুকুরঘাট আর অলৌকিক নয়—এখন তা এক নীরব প্রতিজ্ঞার স্থান, যেখানে ভয় নয়, মুখহীনতা নয়—শব্দের সাহস বাঁচে। সৌর জানে, অরুণা চলে গেছে, শান্তিতে—কিন্তু তার মুখ এখন অনেকের মুখে ছড়িয়ে আছে।
আট
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অরুণপুকুরের গল্প কেবল একটি গ্রামীণ ভূতের উপাখ্যান থাকেনি—তা হয়ে উঠেছে এক আত্মস্মরণের প্রতীক, এক প্রতিবাদের উৎস। স্কুলে এখন অরুণা’র নাম নেয় সবাই সম্মানের সঙ্গে। একদা যাকে অপবাদ দিয়ে ভুলে যেতে চেয়েছিল সমাজ, তাকেই এখন উদাহরণ হিসেবে সামনে আনা হয়। সৌর কখনো ভাবেনি, এক সন্ধ্যায় যুক্তির বশে সে যে পথ বেছে নিয়েছিল, তা তাকে এমন এক অতল গভীর সত্যের সামনে দাঁড় করাবে, যেখানে যুক্তির চেয়ে বড় হয়ে উঠবে অনুভব। সময়ের সাথে সে বড় হয়, কলেজে উঠে যায়, শহরে চলে আসে। কিন্তু পুকুরঘাট, অরুণা, সেই গহ্বরমুখ—সবই থেকে যায় মনের ভিতর। একদিন সন্ধ্যাবেলায়, যখন শহরের ব্যস্ততা তাকে ক্লান্ত করে তোলে, সে পুরোনো ব্যাগ থেকে বের করে অরুণা’র সেই খাতার কপি। প্রতিটি লেখা এখনও যেন স্পন্দিত। “আমার ভয় নেই”, “আমাকে চুপ করিয়ে দেবে না”, “আমি মুখ হয়ে উঠব”—এই শব্দগুলো এখন তার নিজস্ব মন্ত্র।
একটা সময় আসে, যখন সৌর একটি প্রতিবাদমূলক লেখার জন্য জাতীয় স্বীকৃতি পায়—’যাদের মুখ কাটা হয়েছিল, আমি তাদের মুখ’ শীর্ষক প্রবন্ধে সে তুলে ধরে অরুণা’র কথা। সাংবাদিক সম্মেলনে কেউ প্রশ্ন করে, “আপনার সাহস কি অলৌকিক থেকে এসেছে?” সৌর হেসে বলে, “না, একটা কিশোরীর ভাঙা খাতার পাতা থেকেই।” তারপর সে বলে, “ভূত আমাদের শুধু ভয় দেখায় না, তারা আমাদের না বলা কথাগুলো বলিয়ে নেয়। অরুণা একটা ভূত ছিল না, সে ছিল সমাজের ফাঁকা জায়গায় আটকে পড়া এক শব্দ।” সেই বক্তৃতার ভিডিও ভাইরাল হয়, আর দেশজুড়ে অনেকেই নিজেদের ‘অরুণা’র গল্প বলতে শুরু করে—কে কার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেনি, কে কতবার নিজেকে মুখহীন মনে করেছে। এই গল্প শহর ছাপিয়ে পৌঁছে যায় রাষ্ট্রীয় মঞ্চে—পড়াশোনার পাঠ্যবইয়ে যোগ হয় একটি নতুন অধ্যায়: “ভয় নয়, সত্যই মুখ”।
বছর পাঁচেক পর, সৌর ফের আসে গ্রামে—বীরভূমের সেই অরুণপুকুর ঘাটে। পুকুর আগের মতোই শান্ত, কিন্তু এবার তার চারপাশে একটা স্থায়ী কাঠামো, ছোটো একটি মেমোরিয়াল হল ঘর। দেয়ালে আঁকা অরুণা’র মুখ, সেই যে একদিন পুকুর থেকে ভেসে উঠেছিল—হাসি লেগে থাকা শান্ত এক কিশোরী মুখ, যার চোখে প্রতিজ্ঞা, আর ঠোঁটে অব্যক্ত কৃতজ্ঞতা। সৌর ধীরে ধীরে ঘাটে নামে, হাতে একটি নতুন খাতা—এই খাতায় নতুন প্রজন্ম তাদের ভয় আর প্রতিরোধের গল্প লিখবে। আর তখনই, ঠিক সূর্যাস্তের আগ মুহূর্তে, পুকুরের জলে পড়ে একরঙা আলো, আর সৌর দেখে জলের উপর একটা মুখ ভেসে আছে—না, ভয়ংকর নয়, অপার্থিব নয়—বরং যেন সে হাসছে। সেই হাসিতে ধ্বনি নেই, কিন্তু প্রতিধ্বনি আছে—যেখানে এক সময় অন্ধকার মুখ ছিল, আজ সেখানে আলো, আর সেই আলোই মুখ হয়ে উঠেছে।
নয়
বছর পাঁচেক আগের সেই ছেলেটা—যে যুক্তির খোঁজে অরুণপুকুরে পা রেখেছিল, আজ সে হয়ে উঠেছে অন্য এক আলোয় আলোকিত মানুষ। সৌর জানে, সে কেবল অরুণা’র মুখ হয়নি, হয়েছে হাজারো নিঃশব্দ মুখের প্রতিনিধি। তার গলা এখন বহু মুখের ভাষা, যারা কথা বলতে পারেনি, বা পারলেও কেউ শোনেনি। সে যখন অরুণপুকুরে ফিরে আসে, তার হাতে ছিল সেই নতুন খাতা—একটি খাতা যেটাতে লেখা হবে শুধুমাত্র সেই গল্পগুলো, যেগুলো কখনো উচ্চারিত হয়নি। স্কুলের ছেলেমেয়েরা, গ্রামের মহিলারা, এমনকি প্রতিবেশী গ্রামের কয়েকজন তরুণ-তরুণী এসে সেই খাতায় নিজেদের ভয়, অপমান, প্রতিবাদের কথা লিখে যায়। এক নারী লেখে, “আমি যখন ছোট ছিলাম, আমাকেও বলা হয়েছিল মুখ বন্ধ রাখতে। আমি আজ অরুণা’র নাম করে বলছি—না, এবার আমি বলব।” সেই খাতা অরুণা স্মারক ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো হয়, প্রতিটি পাতায় অশ্রু আর সাহসের ছাপ।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয় গ্রামের ইতিহাসে। প্রতিবছর অরুণা স্মরণে আয়োজন হয় ‘শব্দ উৎসব’—একটি সন্ধ্যা যেখানে কেউ বক্তৃতা দেয় না, বরং নিজের লেখা পড়ে শোনায়। কেউ কবিতা লেখে, কেউ স্মৃতিচারণা করে, কেউ গান গায়। সেই অনুষ্ঠানে সৌর বসে থাকে সামনের সারিতে, মাথা নিচু করে শোনে প্রতিটি শব্দ। এইসব কণ্ঠের ভেতর সে যেন আবার শুনতে পায় সেই প্রথম সন্ধ্যার পুকুরের ফিসফিস—যেখানে মুখ ছিল না, কিন্তু ছিল বেদনাবিধুর কণ্ঠস্বর। এক সন্ধ্যায়, উৎসবের মাঝেই, সৌর হঠাৎ অনুভব করে—পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সে ধীরে ঘাড় ঘোরায়, আর দেখে—একটি কিশোরী, সাদা জামা, কাঁধে বইয়ের ব্যাগ, মুখে এক অচেনা প্রশান্ত হাসি। চোখের পলকে মেয়েটি হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যায়, কিন্তু তার চোখে ছিল চেনা কৃতজ্ঞতা। সৌর বুঝে নেয়—অরুণা এসেছে, আজো আসে, প্রতিবার, যখন কেউ সাহস করে কথা বলে।
শহরে ফিরে যাওয়ার আগের দিন, সৌর অরুণাপুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে, স্মারক ঘরের তালা খুলে বসে নিজের খাতাটি। সে এবার নিজেও লিখে—”আমার মুখ আজ শুধু আমার নয়, আমার গলায় এখন অরুণা, শিলা, ফাতেমা, অজানা রূপা, আর নাম না জানা লক্ষ মেয়ের কান্না, যারা সাহস জোগায়।” তারপর সে খাতা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে আসে। রাত তখন গভীর। ঘাটের ধারে বসে, পুকুরে চাঁদের আলো পড়ে একটা ঢেউ তোলে, আর সেই ঢেউয়ের মাঝে—সৌর দেখে, অরুণা হাঁটছে জলের উপর দিয়ে, ধীরে, শান্ত, মুখে আলো, হাতে খাতা। এই প্রথম, মুখহীন নয়। কথা বলে না, কিন্তু তার চোখ বলে—“আমার গল্প শেষ, কারণ তুমি শুরু করেছ।” সৌরের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল, আর ঠিক সেই সময়, পুকুরের জলে পড়ে এক ঝলক হাওয়া—শীতল, মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট। মুখহীনতার সেই অভিশাপ এবার ভেঙেছে।
দশ
সময় কেটে যায়, কিন্তু অরুণপুকুরের জলের ঢেউয়ে এখনও যেন থেকে যায় সেই কিশোরী মুখের প্রতিচ্ছবি—যে একদিন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কাঁদত, আজ সে আলোয় ভেসে আসে। সৌর এখন শহরে গবেষণায় ব্যস্ত, নারীর অধিকার নিয়ে লেখালিখি করে, ছাত্রদের শেখায়—ভয়ের সঙ্গে লড়াই করতে হয় যুক্তি আর সহানুভূতির হাত ধরে। তার বাড়ির ডেস্কের ওপর এখনও রাখা সেই অরুণার খাতার কপি, আর পাশে ছোট্ট একটা ফ্রেমে সেই ছবিটা—অরুণার মুখ, পুকুরঘাটের জলের প্রতিচ্ছবিতে দেখা শেষ মুহূর্তের হাসি। একদিন তার ইনবক্সে আসে একটা চিঠি—এক অচেনা কিশোরী লিখেছে, “আমি মুখহীন বোধ করতাম, কিন্তু তোমার লেখা পড়ে সাহস পেয়েছি বলার।” সে বোঝে, মুখহীনতা কেবল অতীতের নয়, তা এখনও বর্তমান—কিন্তু একবার কেউ যদি মুখ হয়ে দাঁড়ায়, আরও হাজার মুখ কথা বলতে শেখে।
গ্রামে সৌরের তৈরি করা “অরুণা স্মারক ঘর” এখন কেবল স্মৃতির কেন্দ্র নয়, হয়ে উঠেছে শিক্ষা আর সাহসের স্থায়ী মঞ্চ। পাশের প্রজেক্টরে নিয়মিত দেখানো হয় অরুণা’র ডায়েরির পাতা, পড়ানো হয় তাঁর লেখা কবিতাগুলি, আর নতুন কিশোর-কিশোরীরা সেখানে আসে নিজেদের কথা লিখতে। যাদের কখনো কেউ শোনেনি, এখন তাদের লেখা পাঠ্য হয়। একদিন সৌর আবার ফিরে আসে অরুণপুকুরে, এবার একদল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে, যারা গ্রামে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে এসেছে। সৌর তাদের বলে, “এই ঘাটে একদিন আমি এসেছিলাম যুক্তির খোঁজে, পেয়েছিলাম অনুভব। যে সত্য নিজের মুখ হারায়, সে মুখ অন্য কেউ হয়ে ওঠে।” সেইদিন সন্ধ্যায় ঘাটে প্রদীপ জ্বালানো হয়—কোনও আত্মা শান্তি পাক বলে নয়, বরং মনে করিয়ে দিতে যে, আমরা মুখ বন্ধ রাখলে অরুণারা হারিয়ে যায়।
শেষবারের মতো সৌর যখন পুকুরের কিনারায় দাঁড়ায়, চারপাশে নিঃশব্দ, কিন্তু ভয় নয়—আছে একধরনের শান্তি, একধরনের দায়িত্ব। সে পুকুরের জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে, আর হঠাৎ সেই জলরেখায় পাশে আরেকটি মুখ—অরুণা। এবার সে কথা বলে, শব্দ ছাড়াই—”এখানে আর কেউ হারিয়ে যায় না, কারণ তুমি মুখ দিয়েছো।” সৌরের চোখ ভিজে ওঠে, সে জানে—তাকে যারা বিশ্বাস করেছিল, তাদের কাছে সে ঋণী। সে নিজের ব্যাগ থেকে বার করে একটি নতুন খাতা রেখে যায় ঘাটের মাটিতে। প্রথম পাতায় সে লেখে—“এইখানে মুখ খোলা যাবে। ভয় নেই।” তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে যায়, পেছনে রেখে যায় পুকুর, আলো, আর এক মুখহীন আত্মার শান্ত মলিন হাসি। অরুণার গল্প শেষ হয় না, কারণ প্রতিটি না-বলা গল্প, প্রতিটি চাপা কান্না, আজ এখানে এসে মুখ খুঁজে পায়।
***