অমিত ধর
১
সকালবেলার ট্রেন থেকে নেমে দলটি যখন বিষ্ণুপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা রাখল, তখনো শহরের আকাশে ছিল কুয়াশার হালকা চাদর। শীতের সকালের সেই আর্দ্র ও শীতল বাতাসের মধ্যে দূরে কোথাও বাজছিল মন্দিরের ঘণ্টা, যা মিলেমিশে এক ধরনের মিষ্টি শান্তি এনে দিচ্ছিল মনকে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিল ধূসর কুয়াশার আচ্ছাদন, আর তার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছিল লাল ইটের প্রাচীন টেরাকোটা মন্দিরের মাথা, যেন ইতিহাসের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। অরিজিৎ কাঁধের ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে মুহূর্তগুলো ধরে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল—কুয়াশার মধ্যে উঁকি মারা শিখর, প্রাচীন অলঙ্করণে ভরা মন্দিরের দেওয়াল, আর সকালের হাটে আসা মানুষের ভিড়। প্রিয়া নোটবুক খুলে চারপাশের দৃশ্য লিখে রাখছিল—মাটির গন্ধ, শালপাতার ঠোঙায় রাখা মিষ্টি, আর দূর থেকে ভেসে আসা বাঁশির সুর। সৌম্যদীপ ততক্ষণে ক্যামেরার লেন্স লাগিয়ে ভিডিও রেকর্ডিং শুরু করে দিয়েছে, সেই ফ্রেমে ধরা পড়ছে এক রঙিন সকাল, যেখানে ইতিহাস আর বর্তমান মিলেমিশে একাকার।
তারা রিকশা করে রওনা দিল বিষ্ণুপুরের প্রাচীন মন্দির চত্বরে। রাস্তার দুই ধারে তখন ছোট দোকান সাজানো হচ্ছে—কেউ বাঁশের ঝুড়ি, কেউ শালপাতার থালা, কেউবা লাল মাটির হাড়ি বিক্রি করছে। মৈত্রেয়ী, যিনি এই শহরেরই মেয়ে, পথ দেখাতে দেখাতে দলের সবার জন্য গল্প বলতে শুরু করলেন—মল্লরাজাদের শাসনকালের কথা, যখন বিষ্ণুপুর শুধু একটি শহর ছিল না, বরং ছিল এক রাজ্যের গৌরবময় রাজধানী। তিনি বলছিলেন কীভাবে মল্লরাজারা দুর্গ, মন্দির ও গোপন সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিলেন, আর কীভাবে এখানকার টেরাকোটা শিল্প সেই সময়ে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। হেঁটে যাওয়ার পথে তারা পৌঁছল শ্যামরায় মন্দিরের সামনে, যেখানে লাল ইটের খোদাইয়ের মধ্যে যুদ্ধের দৃশ্য, কৃষিকাজ, নৃত্য আর দেবদেবীর মূর্তি জীবন্ত হয়ে আছে। অরিজিৎ যত ছবি তুলছিল, তার চোখে যেন ভেসে উঠছিল শতাব্দী আগের জনজীবনের প্রতিচ্ছবি।
প্রাচীন মন্দিরের চত্বর পেরিয়ে তারা ঢুকে পড়ল গায়ের হাটে। হাটের ভেতর ঢুকতেই চোখে পড়ল নানা রঙের কাপড়, মাটির বাসন, বাঁশের তৈরি খেলনা, আর ঝুড়ি ভরা শাকসবজি। ঠেলাগাড়িতে বসে এক বৃদ্ধ বিক্রি করছেন ‘বালুচরি’ শাড়ি—যার নকশায় এখনো দেখা যায় পুরাণের কাহিনি। প্রিয়া এগিয়ে গিয়ে তাঁর সাথে কথা বললেন, জানলেন কীভাবে এই শাড়িগুলো এখনও প্রাচীন পদ্ধতিতে বোনা হয়। সৌম্যদীপ সেই আলাপচারিতা ভিডিওতে ধরে রাখল—যেখানে দেখা যাচ্ছে বৃদ্ধের কুঁচকে যাওয়া হাত, আর আঙুলের ছোঁয়ায় বোনা হচ্ছে রঙিন সুতোয় একেকটি কাহিনি। মৈত্রেয়ী কাছাকাছি একটি মিষ্টির দোকান থেকে দলকে নিয়ে এলেন ‘মদনমোহন মিষ্টি’ খাওয়াতে। শীতের সকালের সেই গরম গরম মিষ্টি মুখে দিয়েই অরিজিৎ হেসে বলল, “এই স্বাদ আমি আমার লেখায় বোঝাতে পারব না, ছবি দিয়ে ধরতে হবে।”
দিনের আলো ধীরে ধীরে তেজ বাড়াতে থাকলেও বিষ্ণুপুর তখনো কুয়াশার আবরণে ঢাকা, আর সেই আবরণের ভেতরে দলটি যেন সময়ের এক অন্য মাত্রায় হাঁটছিল। মৈত্রেয়ীর গল্প বলার ভঙ্গি, প্রিয়ার মনোযোগী নোট নেওয়া, সৌম্যদীপের ক্যামেরার ফোকাস আর অরিজিতের ছবি তোলার তাড়াহুড়ো—সবকিছু মিলিয়ে এক রঙিন সকাল গড়ে উঠল। মন্দিরের দেওয়ালে পড়া সকালের আলোয় খোদাইয়ের ছায়াগুলো লম্বা হয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল, যেন অতীতের কোনো দৃশ্য এখনও বর্তমানের মধ্যে বেঁচে আছে। তারা জানত, এই শহরের প্রাচীন সৌন্দর্য ও সংস্কৃতি কেবল তাদের যাত্রার শুরু, সামনে অপেক্ষা করছে পাহাড়ের পথ, অরণ্যের গোপন রহস্য, আর ঝর্ণার স্নিগ্ধ সুর। কিন্তু সেই মুহূর্তে, বিষ্ণুপুরের প্রভাত তাদের মনে এমন এক ছাপ রেখে গেল, যা যাত্রার শেষ দিন পর্যন্ত ভোলার নয়।
২
সকালবেলার হালকা রোদে বিষ্ণুপুরের অলিগলিতে দলটি হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল এক পুরনো মৃৎশিল্পীদের গ্রামে। রাস্তার ধারে সারি সারি কুঁড়েঘর, যার সামনে শুকোতে রাখা আছে নানা আকারের হাঁড়ি, কলস, প্রদীপ আর গাছের টব। লাল মাটির গন্ধে ভরে গেছে বাতাস, মাঝে মাঝে ভাঁটির ধোঁয়া উড়ে এসে কুয়াশার সাথে মিশে যাচ্ছে। মৈত্রেয়ী সবাইকে জানালেন, এই গ্রাম শত শত বছর ধরে টেরাকোটা ও মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত—যে শিল্পকলা একসময় মল্লরাজাদের দুর্গ ও মন্দির শোভিত করত। অরিজিৎ ক্যামেরায় বন্দি করছিল সেই লালচে রঙের সৌন্দর্য—চাকার উপর ঘুরতে থাকা মাটির দলা, শিল্পীর আঙুলের ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে রূপ নিতে থাকা কলস, আর পাশে বসা শিশুদের বিস্মিত চোখ। প্রিয়া তার নোটে লিখছিল প্রতিটি খুঁটিনাটি—শিল্পীদের হাতের গতি, আগুনের তাপ, মাটির নরম সুরভি—যেন লিখিত শব্দের মধ্যে এই দৃশ্য চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।
গ্রামের একপ্রান্তে, একটি পুরনো অশ্বত্থগাছের ছায়ায় বসে ছিলেন প্রায় সত্তরের কাছাকাছি বয়সী এক মৃৎশিল্পী। তাঁর হাতের চামড়া রোদে পোড়া, আঙুলে মাটির ধুলো, চোখে এক গভীর শান্তি। সৌম্যদীপ ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে গেল, আর মৈত্রেয়ী ভদ্রলোকের সাথে কথা শুরু করলেন। গল্প বলতে বলতে শিল্পী ধীরে ধীরে এমন এক রহস্যের ইঙ্গিত দিলেন, যা দলের প্রত্যেকের কৌতূহল জাগিয়ে তুলল। তিনি বললেন, বহু বছর আগে, তাঁর ঠাকুরদা একবার মৃৎপণ্য নিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশের এক গ্রামে গিয়েছিলেন। সেখানে পাহাড়ের ঘন অরণ্যের ভেতর নাকি আছে এক প্রাচীন মন্দির, যার গায়ে টেরাকোটা খোদাই মল্লরাজাদের সময়ের চেয়েও পুরোনো। কিন্তু সেই মন্দির এখন প্রায় কেউই দেখে না—পথ হারিয়ে গেছে, আর যারা খুঁজতে গেছে, বেশিরভাগই ফিরে এসেছে শুধু গল্প নিয়ে। শিল্পীর কণ্ঠে ছিল একধরনের গোপন সুর, যেন তিনি নিজেও জানেন না পুরো সত্যি, তবু মনে মনে বিশ্বাস করেন মন্দিরটির অস্তিত্বে।
অরিজিৎ আর প্রিয়া চোখাচোখি করে হাসল—তাদের চোখে স্পষ্ট ঝলক দেখা গেল নতুন এক অভিযানের আগ্রহের। সৌম্যদীপ ক্যামেরা বন্ধ করে চুপচাপ বসে শুনছিলেন, কিন্তু তাঁর মুখে এমন এক ভাব ফুটে উঠল, যা বোঝাচ্ছিল তিনি ইতিমধ্যেই এই গল্পটিকে ভিডিওর মূল সূত্র হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন। মৈত্রেয়ী শিল্পীর কাছে মন্দিরের পথ, আশপাশের দৃশ্য, আর কোনো চিহ্ন মনে আছে কিনা, সব জিজ্ঞেস করলেন। শিল্পী ধীরে ধীরে কিছু পুরনো স্মৃতি টেনে আনলেন—একটি শুকনো নদীর তীর, মহুয়া গাছের সারি, আর পাহাড়ের পাদদেশে একটি ছোট পাথরের সিঁড়ি, যা বনের ভেতরে মিলিয়ে যায়। কথা শেষ হলে তিনি শুধু বললেন, “তোমরা যদি যাও, মনে রেখো, ওখানে রাত কাটানোর সাহস খুব কম মানুষের আছে।” এই শেষ বাক্যটি যেন হাওয়ায় ঝুলে রইল, আর কুয়াশার ভেতরে মিলিয়ে গেল গ্রামের শব্দ।
সন্ধের দিকে দলটি আবার শহরে ফিরে এল, কিন্তু তাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রইল সেই রহস্যময় মন্দির। বিষ্ণুপুরের মিষ্টির দোকানে বসে গরম চা আর কচুরি খেতে খেতে তারা পরিকল্পনা করতে শুরু করল—ট্রেকের রুট, যাত্রার সময়, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। প্রিয়া মানচিত্র খুলে অযোধ্যা পাহাড়ের আশেপাশের অঞ্চল খুঁজছিলেন, অরিজিৎ নোট করছিল সম্ভাব্য ছবি তোলার স্থান, আর সৌম্যদীপ ভাবছিলেন কিভাবে এই যাত্রাটিকে একটি ডকুমেন্টারি আকারে সাজানো যায়। মৈত্রেয়ী সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা হয়তো শুধু ট্রেকের জন্য যাচ্ছিলাম, কিন্তু এখন আমাদের কাছে আরও বড় এক কারণ আছে।” সেই মুহূর্তে সবাই জানল, এই হারিয়ে যাওয়া মন্দিরের রহস্যই হতে চলেছে তাদের যাত্রার আসল প্রেরণা—একটি গল্প, যা হয়তো প্রমাণ করবে, অতীত কখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায় না, কেবল অপেক্ষা করে সঠিক মানুষের খোঁজ পাওয়ার জন্য।
৩
ট্রেন ও বাসের পথ পেরিয়ে, সকালে বিষ্ণুপুরের কোলাহল ছেড়ে দলটি অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে রওনা দিল। শহরের শেষ প্রান্ত পেরোতেই রাস্তার দুই ধারে খুলে গেল ধানক্ষেতের সবুজ বিস্তার—হাওয়ায় ঢেউ খাওয়া ধানের শিষ যেন প্রকৃতির এক অন্তহীন সাগর। মাঝে মাঝে গ্রামের পথ দিয়ে হাঁসের সারি পার হচ্ছিল, তাদের ডাক মিশে যাচ্ছিল সকালের বাতাসে। অরিজিৎ হাঁটার মাঝেই ক্যামেরা তুলে ধরছিল সেই নৈসর্গিক দৃশ্য—গরুর গাড়ি ধীরে ধীরে চলেছে, তার পেছনে গ্রামের শিশু দৌড়াচ্ছে, দূরে খড়ের গাদা সাজানো। প্রিয়া নোটে লিখে নিচ্ছিল প্রতিটি গন্ধ, শব্দ, আর রঙের বর্ণনা, যেন শব্দ দিয়ে এই ভ্রমণকে চিত্রে রূপ দেওয়া যায়। সৌম্যদীপ ভিডিওতে ধরে রাখছিল পথের সুর—পাখির ডাক, চাকার শব্দ, আর মানুষের হাসি। মৈত্রেয়ী হাঁটতে হাঁটতে দলকে জানাচ্ছিলেন পাহাড়ি অঞ্চলের ইতিহাস ও স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা, যা ভ্রমণের প্রেক্ষাপটকে আরও গভীর করছিল।
মধ্যাহ্নের আগে দল পৌঁছল এক শাল-মহুয়ার বনের শুরুতে, যেখানে তাদের সাথে যোগ দিল রতন—স্থানীয় এক তরুণ, যিনি পাহাড়ি পথের অন্দরের অন্দরের গল্প জানেন। রতনের কাঁধে বাঁশের ঝোলা, হাতে মাচাঙ লাঠি, চোখে সহজ-সরল হাসি। তিনি পথ দেখাতে দেখাতে বনজীবন নিয়ে গল্প শুরু করলেন—কোন গাছের ছাল দিয়ে জ্বর সারানো যায়, কোন ফুল দিয়ে রঙ বানানো হয়, আর কোন নদীর পানি কখনো শুকোয় না। হাঁটতে হাঁটতে তারা দেখল বনের ভেতরে ছোট ছোট ঝরনা, যেখানে ঠান্ডা জল পাথরের উপর নেমে এসে সাদা ফেনা তৈরি করেছে। অরিজিৎ সেই দৃশ্য ফ্রেমে বন্দি করতে গিয়ে প্রায় হাঁটার গতি ভুলে গেল, আর প্রিয়া লিখল—“এই বন শুধু গাছের সমষ্টি নয়, এটি এক জীবন্ত সত্তা, যেখানে প্রতিটি গন্ধ, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া একে অপরের সাথে কথা বলে।” রতন তাদের দেখাল মহুয়া ফুলের নরম সোনালি রঙ, যা গাছের নিচে কার্পেটের মতো ছড়িয়ে আছে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো, আর পথ আরও উঁচুতে উঠতে লাগল। পায়ের নিচের মাটি ক্রমে কঠিন পাথরে পরিণত হচ্ছিল, আর চারপাশে ধীরে ধীরে গাছের ঘনত্ব বাড়ছিল। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছিল সরু নদী বা খালের উপর বাঁশের সাঁকো, যেখান দিয়ে একে একে সবাই পার হচ্ছিল। সৌম্যদীপ ক্যামেরায় সেই মুহূর্তগুলো ধরে রাখছিল, যেখানে দলের সদস্যরা একে অপরকে হাত বাড়িয়ে সাহায্য করছে—যেন যাত্রার এই প্রথম চড়াই তাদের বন্ধনকেও আরও দৃঢ় করে তুলছে। রতন মাঝে মাঝে থেমে দূরের পাহাড়ের দিকে ইশারা করত, “ওইদিকে আছে বড় ঝরনা, তবে এখন নয়, কাল দুপুরে আমরা ওখানে পৌঁছব।” আলো ধীরে ধীরে কমে আসছিল, আর বাতাসে শীতের ছোঁয়া আরও স্পষ্ট হচ্ছিল। দল বুঝতে পারল, রাতের জন্য শিবির খোঁজার সময় হয়ে এসেছে।
অবশেষে তারা পৌঁছল এক খোলা মাঠে, চারপাশে শাল গাছের প্রাচীরের মতো বেষ্টনী। রতন বলল, এখানেই রাত কাটানো যাবে—জল কাছেই আছে, আর মাটিও সমান। সবাই মিলে কাঠ জোগাড় করে আগুন জ্বালাল, আর আগুনের উষ্ণতা দ্রুত ঠান্ডা বাতাসকে সরিয়ে দিল। মৈত্রেয়ী ব্যাগ থেকে বের করলেন শুকনো খাবার, প্রিয়া গরম চায়ের ব্যবস্থা করলেন, আর অরিজিৎ আগুনের পাশে বসে হাত গরম করছিল। রতন বনের পুরনো গান গাইল—তার গলায় ছিল এক অদ্ভুত মাটির গন্ধ, যা রাতের নীরবতার সাথে মিশে গিয়ে অরণ্যকে আরও গভীর করল। সৌম্যদীপ সেই মুহূর্ত ক্যামেরায় ধরে রাখল—আগুনের লাল আলোতে আলোকিত মুখগুলো, হাসি, গল্প, আর গানের সুর। আকাশে অসংখ্য তারার নিচে, প্রথম চড়াইয়ের শেষে, দলের মনে হলো তারা কেবল পাহাড়ের দিকে এগোচ্ছে না, বরং অজানা এক গল্পের গভীরে প্রবেশ করছে।
৪
সকালের আলো যখন শালবনের ফাঁক দিয়ে নরম সোনালি ছায়া ফেলছিল, দলটি আবার পথ ধরল রতনের পেছনে। রাতের ঠান্ডা এখনো হাওয়ায় রয়ে গেছে, কিন্তু সূর্যের কিরণ ক্রমে উষ্ণতা আনছিল। প্রথম এক ঘণ্টা পথ ছিল সরু, উঁচু-নিচু ঢালে ভরা, মাঝে মাঝে শেকড়-বেরোনো গাছের নিচ দিয়ে পার হতে হচ্ছিল। পাখিদের ডাক, পাতার মর্মর আর দূরের জলধারার ফিসফিসানি মিলেমিশে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করেছিল। রতন হঠাৎ থেমে বলল, “শুনছো? ওই যে জল পড়ার শব্দ—ওটাই ঝর্ণা।” মুহূর্তেই দলের ভেতর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে শব্দটা আরও স্পষ্ট হতে লাগল, যেন পাহাড়ি বাতাস জলের উল্লাস বয়ে আনছে। কিছুক্ষণ পর, বন হঠাৎ সরু হয়ে গিয়ে খুলে গেল, আর তারা দাঁড়াল এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সামনে—একটি সাদা-ফেনা-ঢাকা পাহাড়ি ঝর্ণা, প্রায় বিশ-তিরিশ ফুট উঁচু থেকে পাথরের উপর গড়িয়ে নেমে আসছে, চারপাশে মস-ঢাকা পাথর আর রোদের আলোয় রংধনুর ঝলক।
ঝর্ণার ধারে পৌঁছেই সবাই কিছুক্ষণ থেমে গেল, যেন এই দৃশ্য চোখে ভরে নিতে চায়। অরিজিৎ হাঁটু গেড়ে বসে ক্যামেরায় ঝর্ণার প্রতিটি কোণ বন্দি করছিল—জলের ছিটে, পাথরের ফাঁকে জন্মানো ছোট গাছ, আর ঝর্ণার পাদদেশে তৈরি হওয়া স্বচ্ছ জলাশয়। প্রিয়া পাশের একটি সরু পথ ধরে এগিয়ে গেল, যেখানে দেখতে পেল স্থানীয় গ্রামের কয়েকজন নারী রঙিন শাড়ি পরে জলের ধারে বসে আছে। তারা হাসিমুখে প্রিয়াকে ডাকল, আর কথা বলতে বলতে জানাল—এই ঝর্ণা তাদের কাছে শুধু পানির উৎস নয়, এটি এক পবিত্র স্থান। প্রতি পূর্ণিমায় তারা এখানে এসে স্নান করে, গাছের গোড়ায় ফুল দেয়, আর জলের ধারে বসে গান গায়। তাদের বিশ্বাস, এই ঝর্ণার জল দুঃখ ধুয়ে দেয়, আর নতুন শক্তি দেয়। প্রিয়া তাদের এই আচার-অনুষ্ঠানের বর্ণনা মনোযোগ দিয়ে লিখে নিল, আর মৈত্রেয়ী সেই গল্প শুনে বললেন, “এমন বিশ্বাসই তো পাহাড়ের সাথে মানুষের অটুট সম্পর্ক তৈরি করে।”
সৌম্যদীপ ইতিমধ্যেই ড্রোন ক্যামেরা আকাশে উড়িয়েছে। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিল পাখির চোখে ধরা পড়া ঝর্ণা—উঁচু থেকে নেমে আসা জলরাশি, চারপাশে সবুজ বন, আর দূরে পাহাড়ের নীলাভ রেখা। বাতাসে ড্রোনের হালকা গুঞ্জন ঝর্ণার গর্জনের সাথে মিশে যাচ্ছিল, কিন্তু তাতে প্রকৃতির মহিমা একটুও কমেনি। রতন ঝর্ণার পাদদেশে দাঁড়িয়ে জলের কণায় ভিজে বলছিল, “এই ঝর্ণার ওপারের জঙ্গল দিয়ে গেলে একটা পুরনো গুহা আছে, তবে সেখানে খুব কম মানুষ যায়।” দলটি একে অপরের দিকে তাকাল—এ যেন আরেকটি সম্ভাব্য সূত্র, হয়তো সেই হারিয়ে যাওয়া মন্দিরের রহস্যের সাথে জড়িত। প্রিয়া উত্তেজিত হয়ে নোটে লিখল, “প্রত্যেকটি পথ নতুন গল্পের ইঙ্গিত দেয়, আর এই গল্পগুলোই আমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।”
বিকেলের আলো যখন ধীরে ধীরে নরম হয়ে এলো, দলটি ঝর্ণার ধারে বসে বিশ্রাম নিল। আগুন জ্বালানোর দরকার ছিল না—জলের ধারে বাতাসে ছিল একপ্রকার শীতল শান্তি। রতন স্থানীয় গান গাইল, যার সুরে যেন পাহাড়ের প্রতিধ্বনি মিশে গেল। অরিজিৎ শেষবারের মতো ক্যামেরা প্যাক করছিল, সৌম্যদীপ ড্রোন নামিয়ে ডেটা সেভ করছিল, আর প্রিয়া গাছের গুঁড়িতে বসে শেষ নোটগুলো লিখে নিচ্ছিল। মৈত্রেয়ী বললেন, “প্রকৃতির সাথে এই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলোই ভ্রমণের আসল পুরস্কার।” ঝর্ণার অবিরাম শব্দের নিচে সেই কথাগুলো যেন চিরস্থায়ী হয়ে রইল, আর আকাশে ভেসে উঠল হাজারো তারা, যেন উপরে থেকেও তারা এই যাত্রার সাক্ষী হতে চাইছে। সেই রাতে সবাই বুঝল—এই পাহাড়ের পথে প্রতিটি পদক্ষেপ শুধু গন্তব্যের দিকে নয়, বরং এক অদৃশ্য কাহিনির কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছে।
৫
ভোরের আলো ফোটার আগেই ঝর্ণার ধারে শেষবারের মতো জল মুখে ছুঁয়ে দলটি রতনের সাথে নতুন পথে যাত্রা শুরু করল। শুরুতেই বন যেন তাদেরকে নিজের ভেতরে গিলে নিল—ঘন বাঁশঝাড়, উঁচু শাল-সেগুন গাছ, আর নিচে স্যাতসেঁতে মাটি। বাতাসে ছিল ভিজে পাতার গন্ধ, যা প্রতিটি শ্বাসে অরণ্যের গভীরতা অনুভব করাচ্ছিল। মাঝে মাঝে পথের ধারে দেখা যাচ্ছিল বুনো ফুলের দল—নীল, হলুদ, আর লাল, যেন জঙ্গলের ভেতরও প্রকৃতি রঙের উত্সবে মেতেছে। অরিজিৎ ফিসফিস করে বলল, “এটা যেন কোনো চিত্রশিল্পীর ক্যানভাসে পা রাখা।” প্রিয়া হাঁটতে হাঁটতে প্রতিটি গন্ধ আর রঙের বিবরণ লিখছিল, সৌম্যদীপ সেই দৃশ্য ভিডিওতে বন্দি করছিল, আর মৈত্রেয়ী দলের গতি সামলে গল্প শোনাচ্ছিলেন—কোন ফুলকে গ্রামের মানুষ ‘জ্যোতিফুল’ বলে, কোন গাছের ছাল দিয়ে রোগ সারানো হয়। হাঁটতে হাঁটতে তারা অনুভব করছিল, প্রতিটি পদক্ষেপে তারা সভ্যতার কোলাহল থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে।
একসময় পথের ধারা বদলে গেল—বাঁশঝাড় এতটাই ঘন হয়ে উঠল যে সূর্যের আলো কেবল ফোঁটা ফোঁটা এসে পড়ছিল মাটিতে। পাখিদের ডাকও বদলে গেল, আর কোথাও এক অদ্ভুত স্তব্ধতা নেমে এলো। রতন থেমে চারদিক দেখল, যেন সে কিছু যাচাই করছে। দলটি বুঝতে পারল, তারা আগের মতো সুস্পষ্ট পথে নেই। অরিজিৎ বলল, “আমরা কি ঠিক পথে আছি?” রতন কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিল, “পথ আছে, কিন্তু আমরা সঠিক দিক হারিয়ে ফেলেছি।” এই কথায় মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো, শুধু পাতা ভাঙার শব্দ আর দূরে কোনো অজানা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। প্রিয়ার চোখে একটু উৎকণ্ঠা দেখা দিল, কিন্তু মৈত্রেয়ী শান্ত কণ্ঠে বললেন, “জঙ্গলে পথ হারানো মানেই শেষ নয়, বরং প্রকৃতিকে আরও মন দিয়ে দেখা শুরু।” রতন ব্যাগ থেকে বের করল একটি পুরনো কম্পাস, যার কাঁটা দক্ষিণ-পশ্চিমে স্থির হয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে দিক নির্ধারণ করল, তারপর বলল, “এই দিকেই চলতে হবে, প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটলেই আমরা মূল পথে পৌঁছে যাব।”
নতুন দিক ধরে হাঁটার সময় দলের চোখে পড়ল কিছু বিশেষ দৃশ্য, যা হয়তো তারা মূল পথে পেলে দেখতেই পেত না। একটি বড় গাছের গুঁড়িতে জন্মেছে বিরল অর্কিড, যার গোলাপি-সাদা পাপড়ি হাওয়ায় দুলছিল। পাশে এক ছোট্ট জলা, যেখানে নীলচে প্রজাপতির ঝাঁক জল চুমছিল। সৌম্যদীপ এই দৃশ্য ড্রোনে ধারণ করতে চাইল, কিন্তু ঘন গাছপালা বাধা দিচ্ছিল, তাই সে মাটিতেই ক্যামেরা সেট করে মুহূর্তটি ধরে রাখল। রতন হাঁটতে হাঁটতে বলছিল, “এই জঙ্গলের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ফুল, এমনকি প্রতিটি নীরবতা—সবকিছু একসাথে অরণ্যের নিশ্বাস গঠন করে। যদি মন দিয়ে শোন, তুমি তা অনুভব করতে পারবে।” সত্যিই, বাতাসে এক অদ্ভুত ছন্দ ছিল—পাতার খসখসানি, বাঁশের কঞ্চির ঠোকাঠুকি, দূরের জলধারার মৃদু গুঞ্জন—যেন এক বিশাল, জীবন্ত অর্কেস্ট্রা। প্রিয়া নোটে লিখল, “অরণ্যের নিশ্বাস কেবল শব্দ নয়, এটি এক অব্যক্ত গল্প, যা আমরা পদে পদে পড়ছি।”
অবশেষে ঘন জঙ্গল কিছুটা ফাঁকা হতে লাগল, আর সূর্যের আলো বড় বড় ফালি হয়ে মাটিতে পড়তে লাগল। একসময় তারা এসে পৌঁছল এক খোলা জায়গায়, যেখানে পুরনো শিকারি পথের চিহ্ন পাওয়া গেল। রতন হাসল, “এই পথ ধরলেই আমরা কালকের গুহার কাছে পৌঁছে যাব।” দলের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি নেমে এলো—পথ হারানোর ছোট্ট আতঙ্ক মিলিয়ে গেল, বদলে এলো নতুন কৌতূহল। সবাই কিছুক্ষণ বসে পানি খেল, আর মৈত্রেয়ী বললেন, “আজকের দিন আমাদের শিখিয়েছে, ভুল পথে গিয়েও সঠিক জায়গায় পৌঁছানো যায়—যদি আমরা ধৈর্য রাখি আর দিক খুঁজে নিতে শিখি।” আকাশে তখন বিকেলের আলো সোনালি হয়ে উঠছে, পাখিরা বাসায় ফিরছে, আর দূরে পাহাড়ের গায়ে লালচে ছায়া পড়ছে। দলটি আবার রওনা দিল, কিন্তু এবার তাদের মনে এক নতুন শক্তি—অরণ্যের নিশ্বাসকে সঙ্গী করে তারা প্রস্তুত অজানা গুহার রহস্য উন্মোচনের জন্য।
৬
পাহাড়ি পথ বেয়ে দুপুরের দিকে যখন দলটি গন্তব্যে পৌঁছল, তখন সূর্যের আলো একেবারে সোনালি হয়ে গ্রামটিকে আচ্ছাদিত করেছে। পাহাড়ের ঢালে সাজানো বাঁশের বাড়িগুলো, ছাউনি করা ছাদ, আর চারপাশে লাল মাটির উঠোনে শুকোতে দেওয়া শাকপাতা—সব মিলিয়ে দৃশ্যটা যেন কোনও গ্রামীণ চিত্রকর্মের মতো। দূরে থেকেই শোনা যাচ্ছিল বাঁশির সুর, যা পাহাড়ি হাওয়ার সঙ্গে মিলেমিশে এক অদ্ভুত মাধুর্য তৈরি করছিল। গ্রামপ্রধান রতনকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন, সঙ্গে কয়েকজন তরুণ-তরুণী। তারা দলটিকে স্বাগত জানাল উষ্ণ অভ্যর্থনায়, হাতে দিল জংলি ফুলের মালা। গ্রামের শিশুদের কৌতূহলী চোখে অচেনা অতিথিদের দেখার আনন্দ ছিল স্পষ্ট। মৈত্রেয়ী চারপাশে তাকিয়ে ধীরে বললেন, “এই গ্রামটা যেন সময়ের বাইরে, এখানে প্রতিটি মুহূর্ত ধীরে বইছে।” প্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে নোটবুকে লিখে নিল এই অনুভূতির কথা, কারণ এমন মুহূর্ত গল্পের ভিত তৈরি করে দেয়।
দলটিকে গ্রামের মাঝের খোলা প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হলো, যেখানে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন কয়েকজন যুবক। বাঁশের তৈরি এই বাঁশির সুর ছিল মৃদু, কিন্তু তাতে ছিল পাহাড়ের ঢেউ, জঙ্গলের নিশ্বাস, আর ঝর্ণার ফিসফিসানি। মেয়েরা রঙিন পাটের শাড়ি পরে, মাথায় ফুল গুঁজে নাচ শুরু করল—তাদের পায়ের তাল বাঁশির তালে মিলছিল নিখুঁতভাবে। অরিজিৎ মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে এই দৃশ্য ধরে রাখছিল, কিন্তু মাঝে মাঝে শুধু চোখ দিয়ে উপভোগ করছিল সেই নৃত্যের ছন্দ। প্রিয়া একটু লজ্জা পেয়েও মৈত্রেয়ীর হাত ধরে নাচের বৃত্তে ঢুকে পড়ল। গ্রামের এক বৃদ্ধা ধীরে ধীরে প্রিয়ার পায়ের তাল ঠিক করে দিলেন, যেন তিনি নিজের নাতনিকে শিখাচ্ছেন। মৈত্রেয়ী তাল মেলাতে মেলাতে গাইলেন গ্রামের শেখানো লোকগানের প্রথম লাইন, যা শুনে সবাই হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল। সেই মুহূর্তে অতিথি আর গ্রামবাসীর ফারাক মুছে গেল, সবাই এক সুরে বাঁধা পড়ল।
নাচ-গানের পর সবাইকে বসতে বলা হলো, আর শুরু হলো পাহাড়ি খাবারের আয়োজন। বাঁশের তৈরি থালায় সাজানো ছিল গরম ভাত, পাহাড়ি সবজি, বুনো মাশরুমের ঝোল, আর কাঁঠালের বিচি দিয়ে তৈরি তরকারি। সঙ্গে ছিল বাঁশের কঞ্চিতে পরিবেশিত তাজা লালচে রঙের মহুয়া ফুলের রস, যা ঠান্ডা করে রাখা হয়েছিল পাহাড়ি ঝর্ণার জলে। সৌম্যদীপ ড্রোন প্যাক করে বসেছিল দলের সঙ্গে, আর প্রথম চুমুকেই বলল, “এ যেন মিষ্টি আর ফুলের গন্ধ একসঙ্গে।” খাবারের মাঝে গ্রামের বৃদ্ধরা গল্প শোনালেন—কীভাবে এই গ্রাম প্রাচীন মন্দিরের সাথে বাণিজ্য করত, আর বর্ষার সময় নদীর স্রোত কেমন বদলে যায়। অরিজিৎ একে একে এই গল্পগুলো লিখে রাখছিল, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছিল যাতে আরও বিশদ তথ্য মেলে। সে বুঝে গিয়েছিল, এই গ্রাম শুধু পথের একটি বিরতি নয়—এটি হয়তো তাদের সেই হারিয়ে যাওয়া মন্দিরের রহস্যের একটি কড়ি।
বিকেলের শেষ আলো পাহাড়ের চূড়ায় পড়তে শুরু করলে দলটি গ্রামপ্রধানের সাথে উঁচু একটা ঢিবিতে উঠল। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছিল পুরো গ্রাম—ছোট ছোট ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে রান্নাঘর থেকে, গরু-ছাগল ফিরছে ঘরে, আর দূরে পাহাড়ের গায়ে লাল-সোনালি ছায়া পড়ছে। রতন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, যেন এই দৃশ্য তার নিজের হৃদয়ের অংশ। মৈত্রেয়ী বললেন, “আজকের দিনটা আমাদের শিখিয়েছে, মানুষের গান আর গল্পই পাহাড়কে জীবন্ত রাখে।” প্রিয়া হাসিমুখে মাথা নাড়ল, অরিজিৎ আকাশের রঙ দেখে নতুন গল্পের সূচনা লিখতে শুরু করল, আর সৌম্যদীপ ক্যামেরা নামিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকল—কারণ কিছু মুহূর্ত কেবল চোখের জন্য, লেন্সের জন্য নয়। সেই রাতে তারা গ্রামেই থেকে গেল, বাঁশের খাটে শুয়ে শুনল রাতের বাঁশির সুর আর ঝিঁঝিঁর ডাক—যেন পাহাড় নিজেই তাদের স্বপ্নে গল্প শুনিয়ে দিল।
৭
রাত নেমে এসেছে ধীরে ধীরে, যেন পাহাড়ের চারপাশে কালো মখমলের পর্দা টেনে দিয়েছে প্রকৃতি। গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে, জঙ্গলের ধারে দলটি বসেছে বড় বড় পাথরের চারপাশে, মাঝখানে রতন শুকনো ডালপালা জড়ো করে আগুন জ্বালিয়েছে। প্রথমে ছিল কেবল ধোঁয়ার সরু সুতোর মতো রেখা, তারপর রতনের নিপুণ ফুঁ আর কাঠের খসখস শব্দে আগুন ধীরে ধীরে লালচে আভা ছড়িয়ে দিল চারদিকে। আগুনের তাপে মুখগুলো সোনালি-কমলা হয়ে উঠল, আর পেছনে জঙ্গল থেকে ভেসে আসছিল নিশাচর পোকামাকড়ের সুর। মৈত্রেয়ী কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে নরম গলায় একটি পুরনো পাহাড়ি গান ধরলেন, যার সুরে ছিল বেদনার সঙ্গে আশার মিশ্রণ। প্রিয়া তার নোটবুক বন্ধ করে শুধু চোখ মেলে শোনার সিদ্ধান্ত নিল—কারণ কিছু মুহূর্ত লিখে রাখা যায় না, কেবল অনুভব করতে হয়। অরিজিৎ ক্যামেরা নামিয়ে রাখল, মনে হলো সে আজ কেবল একজন শ্রোতা হতে চায়, একজন গল্পের অংশগ্রহণকারী।
গান শেষ হতেই সৌম্যদীপ হেসে উঠে বলল, “এখন সময় গল্পের।” তার কণ্ঠে ছিল এমন এক দুষ্টু উচ্ছ্বাস, যা সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে চনমনে করে দিল। সে শুরু করল তার ভ্রমণের সময় ঘটে যাওয়া এক মজার ঘটনা—কীভাবে পাহাড়ি পথে হঠাৎ এক বুনো ছাগল তার ব্যাগের ভেতর ঢুকে বিস্কুট চুরি করেছিল। সে সেই ঘটনা এত মজার ভঙ্গিতে বলল যে, রতন পর্যন্ত হেসে ফেলল, আর প্রিয়ার চোখে জল চলে এল হাসতে হাসতে। মাঝেমধ্যে সে গল্পে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি যোগ করছিল—যেমন ছাগল নাকি তার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল—যা শুনে মৈত্রেয়ী বললেন, “তুমি যদি গল্প লিখতে শুরু করো, আমি প্রথম পাঠক হব।” হাসির রেশে রাতটা কিছুটা হালকা হয়ে উঠল, জঙ্গলের গভীর নীরবতাও যেন দূরে সরে গেল। সবাই অনুভব করল, আগুন কেবল তাপ দেয় না—এটি মনকে উজ্জ্বল করে তোলে।
হাসি থামার পর রতন ধীরে ধীরে বলল, “এখন তোমাদের আমি একটা পুরনো কিংবদন্তি শোনাবো।” তার কণ্ঠ নিচু হয়ে এলো, চোখে এক ধরনের দূরের দৃষ্টি, যেন সে নিজেই সময়ের পেছনে ফিরে যাচ্ছে। “অনেক বছর আগে,” সে শুরু করল, “এই পাহাড়ের গভীরে ছিল এক বিশাল মন্দির। মন্দিরে ছিল তামার তৈরি বিশাল ঘণ্টা, যা দিনে পূজার সময় বাজত। কিন্তু একদিন, গ্রামের সবাই অদৃশ্য হয়ে গেল, মন্দিরও হারিয়ে গেল ঘন জঙ্গলের আড়ালে। বলা হয়, তখন থেকে আর কেউ মন্দির খুঁজে পায়নি। তবে, আজও রাতের গভীরে, যখন জঙ্গল ঘুমিয়ে যায়, তখন সেই ঘণ্টার শব্দ শোনা যায়—ধীর, গভীর, আর বেদনাময়।” আগুনের আলো রতনের মুখে তখন লাল-সোনালি ছায়া ফেলছিল, আর তার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিল গল্পের রহস্য। প্রিয়া এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস আটকে শুনছিল, অরিজিৎ হাতের আঙুলে ক্যামেরার বোতাম চেপে রেখেছিল, যেন এই কণ্ঠ আর মুহূর্ত চিরকালের জন্য ধরে রাখতে চায়।
রতনের কথা শেষ হতেই কিছুক্ষণ নীরবতা নেমে এলো। সবাই আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন সেই লাল-কমলা শিখাগুলো কোনো প্রাচীন স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। জঙ্গলের দিক থেকে আসা হাওয়ায় পাতা খসখস করছিল, আর দূরে কোথাও একটা পাখি হঠাৎ ডেকে উঠল, যা মুহূর্তের জন্য সবাইকে চমকে দিল। মৈত্রেয়ী ফিসফিস করে বললেন, “হয়তো ঘণ্টার শব্দ সত্যিই আছে, হয়তো সেটা কেবল পাহাড়ের নিশ্বাস।” প্রিয়া তার নোটবুকে বড় করে লিখল—“রাতের বেলায় ঘণ্টা বাজে”—আর মনে মনে ঠিক করল, এই লাইন দিয়ে সে তাদের ট্রেকের গল্প শুরু করবে। সৌম্যদীপ এবার আর মজা করল না, বরং আগুনে কাঠ ছুঁড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। সেই রাতে তারা আগুনের পাশে অনেকক্ষণ বসে ছিল—কেউ কথা বলছিল না, শুধু আগুনের কটমট শব্দ আর জঙ্গলের ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, পাহাড় তাদের ঘিরে ধরে আছে, আর তার গভীরে সত্যিই লুকিয়ে আছে সেই ভুলে যাওয়া মন্দিরের রহস্য।
৮
ভোরের প্রথম আলো পাহাড়ের চূড়ার উপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়তেই দলটির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। রতন সবার জন্য বাঁশের লাঠি প্রস্তুত করছিল, কারণ সামনে অপেক্ষা করছে এক কঠিন পথ—যেখানে শুধু হাঁটা নয়, মাঝে মাঝে হাত-পা দিয়ে বেয়ে উঠতেও হবে। কিংবদন্তির গল্প তাদের ভেতরে এক অদৃশ্য উত্তেজনা জাগিয়ে তুলেছে। প্রিয়া ব্যাকপ্যাক গুছাতে গিয়ে নোটবুকের প্রথম পাতায় আগুনের ধারে লেখা লাইনটি দেখল—“রাতের বেলায় ঘণ্টা বাজে”—আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এই যাত্রার শেষ অধ্যায় সে লিখবে সেই ঘণ্টার উৎসের গল্প দিয়ে। রওনা হওয়ার সময় জঙ্গলের হাওয়ায় ভেসে আসছিল অদ্ভুত এক গন্ধ—মাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে মিশে ছিল বুনো ফুলের সুগন্ধ, যা মনে হচ্ছিল পাহাড় তাদের কাছে টেনে নিচ্ছে। প্রথম কয়েক কিলোমিটার তুলনামূলক সহজ ছিল—ধানক্ষেতের কিনারা, পাথুরে সরু রাস্তা, আর মাঝেমধ্যে ছোট্ট ঝোপঝাড় পেরোনো। কিন্তু ধীরে ধীরে পথ ঢালু হতে শুরু করল, আর পাথরের সিঁড়ির মতো গঠিত খাড়া শিলাখণ্ড তাদের সামনে এক নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করল।
শিলাখণ্ডের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল সরু এক ঝর্ণাধারা, যার ঠান্ডা জল হাত-মুখে ছুঁইয়ে সবাই কিছুটা সতেজ হয়ে নিল। রতন বলল, “এই জল পাহাড়ের অনেক উঁচু থেকে আসে, কিন্তু মন্দিরের কাছের গোপন ঝর্ণার সঙ্গে এর যোগ আছে কি না, তা আমি জানি না।” দলের ভেতরে তখন এক ধরণের কৌতূহল ছড়িয়ে পড়েছে—যেন প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের রহস্যের আরও কাছে নিয়ে যাচ্ছে। সৌম্যদীপ মাঝে মাঝে থেমে পাহাড়ের ঢালের ভিডিও নিচ্ছিল, যাতে ভবিষ্যতে পথের নকশা বোঝা যায়। অরিজিৎ ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ থেমে বলল, “এই জায়গাটা যেন অনেক পুরনো কোনো কিছুর সাক্ষী।” সত্যিই, কিছু শিলার গায়ে শ্যাওলা আর লতাপাতার আড়ালে অদ্ভুত খোদাই দেখা যাচ্ছিল—যেন মানুষের হাতের কাজ, কিন্তু সময়ের ধুলোয় ঢাকা পড়ে গেছে। মৈত্রেয়ী একে দেখে বললেন, “এগুলো হয়তো প্রাচীন মন্দিরের দিকনির্দেশ ছিল।” রতন মৃদু মাথা নাড়ল, কিন্তু কিছু বলল না, শুধু চোখে বোঝা গেল সে কিছু মনে করছে।
দুপুরের দিকে তারা এক ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে পৌঁছল, যা মাত্র কয়েকটি বাঁশের ঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে। এখানে মানুষের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে—শুধু এক বৃদ্ধ কাঠের চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন। তার মুখে সময়ের রেখা আর চোখে এমন এক গভীরতা ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি এই পাহাড়ের প্রতিটি গল্প জানেন। প্রিয়া তার সঙ্গে আলাপ শুরু করল, আর অল্প সময়েই জানতে পারল সেই বৃদ্ধ একসময় শিকারি ছিলেন, আর পাহাড়ের প্রায় প্রতিটি কোণ তার চেনা। মন্দিরের কথা উঠতেই বৃদ্ধের চোখে এক ঝিলিক দেখা দিল, তারপর তিনি ধীরে বললেন, “হ্যাঁ, আমি শুনেছি। মন্দিরের কাছেই আছে এক ঝর্ণা, যা মানচিত্রে নেই। তার জল কখনো শুকায় না, আর চাঁদের আলোয় তার ধারা সাদা রুপোর মতো ঝলমল করে।” তিনি ইশারায় এক দিক দেখালেন, যেখানে পাহাড়ের গায়ে ঘন জঙ্গল নেমে এসেছে। “ওই পথে গেলে সাবধানে যেও,” তিনি বললেন, “কারণ সেই ঝর্ণা যেমন সুন্দর, তেমনই বিপজ্জনক।” প্রিয়া এই কথা নোট করল, কিন্তু মনের ভেতরে এক ধরনের টান অনুভব করল—যেন গোপন ঝর্ণাই মন্দিরের রহস্যের চাবিকাঠি।
গ্রাম ছেড়ে তারা আবার পথ ধরল, আর এবার পথ আরও খাড়া ও বিপজ্জনক হয়ে উঠল। চারপাশে ঘন গাছ, যার ডালপালা এত ঘন যে সূর্যের আলো প্রায় ঢুকতেই পারছে না। পায়ের নিচে পড়ে থাকা শুকনো পাতার খসখস শব্দ, আর দূরে কোথাও বাঁদরের চিৎকার—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর সতর্কতার পরিবেশ তৈরি করল। মাঝে মাঝে তারা একে অপরকে টেনে তুলছিল, কারণ শিলাগুলো পিচ্ছিল আর কিছু জায়গায় ফাটলের ফাঁকে গভীর খাদ দেখা যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে রতন বলল, “যদি সত্যিই ওই ঝর্ণা থাকে, তবে আমরা আজ রাতের মধ্যে তার কাছে পৌঁছে যেতে পারব।” প্রিয়া এই কথা শুনে নিজের মনেই বলল, “তাহলে আমরা হয়তো ঘণ্টার শব্দের কাছেও পৌঁছে যাব।” সন্ধ্যার আগেই তারা পাহাড়ের এমন এক স্থানে এসে দাঁড়াল, যেখান থেকে দূরে জলধারার মৃদু শব্দ ভেসে আসছিল। সবাই থমকে দাঁড়াল, মুখে নিঃশব্দ প্রত্যাশা—হয়তো এটাই সেই গোপন ঝর্ণার স্রোত, যা হারানো মন্দিরের পথে তাদের প্রথম চিহ্ন। পাহাড় যেন নিজেই নিশ্বাস আটকে রেখেছে, অপেক্ষা করছে কেউ তার বুকে লুকানো ইতিহাস উদঘাটন করুক।
৯
সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে না হতেই পাহাড়ের ঢালে বয়ে আসা জলের শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। প্রথমে তা মনে হচ্ছিল একেবারে সাধারণ কোনও ঝরনা, কিন্তু যতই তারা কাছে গেল, শব্দ যেন গভীরতর, অনুরণিত—যেন পাথরের গায়ে কোথাও অদৃশ্য ঘণ্টাধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলছে। দলটি ঘন জঙ্গল ভেদ করে এগোতে থাকল, আর হঠাৎ করেই গাছের সারি ফাঁকা হয়ে একটি খোলা জায়গা চোখে পড়ল। সেখানে, শ্যাওলা ও লতায় ঢেকে থাকা এক প্রাচীন কাঠামো দাঁড়িয়ে ছিল—অর্ধেক ধ্বংস, তবু টেরাকোটা খোদাইগুলো যেন সময়কে অগ্রাহ্য করে টিকে আছে। মন্দিরের দেওয়ালে রাজা, রানি, যোদ্ধা, আর নৃত্যশিল্পীর মূর্তি খোদাই করা, যাদের চোখ এখনো যেন জীবন্ত। রোদে ঝিলমিল করা শিলাগুলোর ফাঁক দিয়ে হাওয়ার সঙ্গে মিশে আসছিল এক তীব্র মাটির গন্ধ। মৈত্রেয়ী স্তম্ভের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, “মল্লরাজাদের শেষ নিঃশ্বাসও হয়তো এখানে লুকিয়ে আছে।” সৌম্যদীপ ড্রোন আকাশে উড়িয়ে পুরো প্রাচীন স্থাপনাটিকে ওপর থেকে ধারণ করতে লাগল, যেন সেই ধ্বংসস্তূপের গায়ে খোদাই হয়ে থাকা হাজার বছরের কাহিনি বন্দি করে আনা যায়।
মন্দিরের ঠিক পেছনেই ছিল সেই কিংবদন্তির গোপন ঝর্ণা। কোনও মানচিত্রে নেই, কোনও সাইনবোর্ডে নাম লেখা নেই—শুধু পাথরের ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসা ক্রিস্টাল স্বচ্ছ জলধারা, যা ঢাল বেয়ে নেমে গিয়ে ছোট্ট একটি পুকুরে মিলিয়ে যায়। দুপুরের আলোতে ঝর্ণার ধারা এমনভাবে ঝিকিমিকি করছিল যে সত্যিই মনে হচ্ছিল যেন তরল রুপো ঢালছে আকাশ থেকে। প্রিয়া ঝর্ণার ধারে গিয়ে দেখল, কিছু স্থানীয় নারী পায়ের কাছে ফুল রেখে প্রার্থনা করছে—সম্ভবত কোনও আদি বিশ্বাসের অংশ, যা বাইরের দুনিয়া ভুলে গেছে। রতন ব্যাখ্যা করল, “এই জলকে অনেকে পবিত্র মনে করে, এখানে উৎসবের দিন গোপনে পূজা হয়। কিন্তু কালের স্রোতে এ জায়গা মানুষের চোখ এড়িয়ে গেছে।” অরিজিৎ সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিল, এই মন্দির ও ঝর্ণা হবে তার পরবর্তী ফিচার স্টোরির মূল বিষয়—কারণ এখানে ইতিহাস, কিংবদন্তি, আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক সুতোয় বাঁধা।
দলটি কিছুক্ষণ ঝর্ণার ধারে বসে রইল—কেউ জলের শব্দ শুনছিল, কেউ আবার নিজের মতো ছবি তুলছিল বা নোট নিচ্ছিল। কিন্তু সবার মনে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যা আগে কোথাও তারা অনুভব করেনি। হঠাৎ করেই দূরে পাহাড়ের গায়ে মেঘ জমে গিয়ে আকাশ ম্লান হয়ে এল। গাছের ফাঁক দিয়ে হাওয়ার গতি বাড়তে লাগল, আর ঝর্ণার ধারা যেন আরও তীব্র সুর তুলল। সৌম্যদীপ ক্যামেরায় মুহূর্তটি ধারণ করতে করতে বলল, “এটা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, এটা সময়ের সঙ্গীত।” মৈত্রেয়ী হালকা হেসে উত্তর দিল, “হয়তো সেই ঘণ্টাধ্বনির সুরই এখনো বয়ে চলেছে।” রতন তখন মন্দিরের এক পাশে দাঁড়িয়ে অচেনা দিকের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন সে জানে এই পাহাড়ে আরও কিছু রহস্য আছে যা এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি।
বিকেলের আলো যখন ম্লান হতে শুরু করল, দলটি মন্দির ও ঝর্ণার কাছে শেষবারের মতো কিছুক্ষণ কাটিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। অরিজিৎ ঝর্ণার ধার থেকে কিছু ছবি তুলল, যা তার ভবিষ্যৎ আর্টিকেলের প্রাণ হবে। প্রিয়া নোটবুকে লিখল—“আজ আমরা শুধু একটি জায়গা খুঁজে পাইনি, আমরা সময়ের বুকে লুকিয়ে থাকা এক অনুভূতিকে ছুঁয়ে এসেছি।” মৈত্রেয়ী মন্দিরের দেওয়ালে হাত রেখে নীরবে প্রণাম করল, সৌম্যদীপ ক্যামেরা গুটিয়ে ব্যাকপ্যাকে রাখল, আর রতন সবার আগে পথ ধরল। পাহাড়ি বাতাসে তখনও ভাসছিল জলের শব্দ—একটা নিরবচ্ছিন্ন সুর, যা যেন বলছিল, রহস্যের শেষ এখনো আসেনি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে নামতে তারা অনুভব করল, এই অভিজ্ঞতা শুধু একটি ট্রেক নয়—এ ছিল এক যাত্রা, যেখানে প্রকৃতি, ইতিহাস ও মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন একাকার হয়ে গেছে।
১০
রাতের আঁধার ধীরে ধীরে সরতে শুরু করল, আর প্রথম আলোর রেখা এসে ছুঁল অযোধ্যা পাহাড়ের শীর্ষকে। ঠান্ডা বাতাসে ভেসে আসছিল গাছের পাতার মৃদু খসখস শব্দ, পাখিরা যেন রাতের দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে একসাথে গান ধরল। দলটি আগের রাতে শীর্ষের কাছাকাছি এক সমতল জায়গায় তাঁবু ফেলেছিল, আর এখন, ভোরের আলো ফুটতেই তারা বেরিয়ে দাঁড়াল চারপাশের বিস্তৃত দৃশ্যের সামনে। দূরে, ধানক্ষেতের সবুজ প্যাচ, তার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা লাল মাটির গ্রামগুলো, শাল-মহুয়ার বন আর আঁকাবাঁকা নদী—সবই যেন ক্যানভাসে তুলি দিয়ে আঁকা এক শিল্পীর সৃষ্টি। আকাশে তখন হালকা কমলা আর সোনালি রঙের খেলা, আর সেই রঙ পাহাড়ের গায়ে গায়ে গলে পড়ছে। অরিজিৎ কাঁধে ক্যামেরা তুলে একের পর এক ছবি তুলতে লাগল, যেন এই মুহূর্তের প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি রঙ, প্রতিটি আলো চিরদিনের জন্য ধরে রাখতে চায়।
মৈত্রেয়ী ধীরে ধীরে পাহাড়ের কিনারার দিকে এগিয়ে গেল। দূরে বিস্তৃত দিগন্তের দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিল, এই পুরো যাত্রা যেন একটাই গল্প—যা টেরাকোটা মন্দিরের প্রভাতে শুরু হয়ে পৌঁছে গেছে অরণ্যের গভীর রহস্য আর গোপন ঝর্ণার অলৌকিকতার ভেতর দিয়ে, শেষমেশ এখানে, আকাশ আর পৃথিবীর মিলনস্থলে। প্রিয়া নিজের নোটবুক খুলে কয়েকটি শব্দ লিখল—“প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল নতুন এক আবিষ্কার।” সৌম্যদীপ পাশের পাথরে বসে আগের রাতের গল্প, হাসি, আর গানগুলো মনে করতে লাগল। রতন পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে ইশারা করে বলল, “ওই যে গ্রামটা দেখছ, সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল আমার প্রথম ট্রেক।” তার কণ্ঠে ছিল এক ধরনের গর্ব আর আবেগ, কারণ সে জানত এই পাহাড়, এই বন, এই পথ—সবই তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সূর্য যখন একটু উঁচুতে উঠল, আলো ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছড়িয়ে পড়ল। বাতাসে ভেসে আসছিল সজীব মাটির গন্ধ, আর মাঝে মাঝে দূরের গ্রামের মানুষের সকালের ডাক। দলটির ক্লান্তি তখনো শরীরে রয়ে গেছে, কিন্তু তাদের চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি—যেন এই দীর্ঘ যাত্রা তাদের প্রত্যেককে বদলে দিয়েছে। অরিজিৎ ভাবছিল, এই ট্রেকের অভিজ্ঞতা শুধু একটি আর্টিকেল বা ছবি নয়, বরং এমন কিছু যা শব্দের বাইরে। মৈত্রেয়ী বুঝছিল, এই পথচলা তাকে শুধু ইতিহাস নয়, মানুষের আন্তরিকতাও শিখিয়েছে। প্রিয়ার মনে হচ্ছিল, প্রতিটি ছোট্ট মুহূর্ত—হাটের গন্ধ, বনপথের আলোছায়া, ঝর্ণার সুর—সবই এখন তার ভেতরে বাসা বেঁধে আছে। সৌম্যদীপ ক্যামেরায় শেষ কয়েকটি ভিডিও শট নিল, হয়তো জানত এগুলোই হবে তার ডকুমেন্টারির ক্লাইম্যাক্স।
যখন তারা পাহাড়ের চূড়া থেকে নামার প্রস্তুতি নিল, তখন চারপাশের দৃশ্য যেন শেষবারের মতো তাদের মনে গেঁথে দিতে চাইছিল প্রতিটি রঙ আর সুর। রতন হাসিমুখে বলল, “পাহাড়ে আসা মানে শুধু চড়াই নয়, নামার পথও মনে রাখা।” এই কথায় যেন এক গভীর তাৎপর্য লুকিয়ে ছিল—যেমন জীবনে চূড়ান্ত অভিজ্ঞতার পরও ফিরতে হয় নিজের দৈনন্দিনে, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা থেকে যায় হৃদয়ের গভীরে। তারা ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল, পিছনে ফেলে গেল সেই সোনালি প্রভাত, কিন্তু বয়ে নিয়ে গেল এমন এক যাত্রার গল্প, যা প্রত্যেকে নিজের মতো করে মনে রাখবে। কারও কাছে এটা হবে অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, কারও কাছে ইতিহাসের, কারও কাছে বন্ধুত্বের, আর কারও কাছে—এক অবিরাম পথের ডাকে সাড়া দেওয়ার স্মৃতি।
***