Bangla - সামাজিক গল্প

অরণ্যের ডায়েরি

Spread the love

অরিত্র বসু


পর্ব ১: শহরের রোদের মতো নয়

আমার নাম অরিত্র। কলকাতা শহরের বুক থেকে উঠে আসা, ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে একটা ছোট বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করি। বেঁচে থাকি ক্যাফেতে, পাতালরেলে, রেড ওয়াইনের আলোছায়ায়।
তবু, কখনো-কখনো একটা নির্জনতা আমাকে টানে, যেন নিজের ছায়াকেও চিনতে পারছি না এই ভিড়ে।

তাই অফিসের এক মাসের ছুটি পেয়েই আমি ঠিক করলাম – যাবো পুরুলিয়ার এক আদিবাসী গ্রামে। নাম – করমডি। সে নাম কেউ চেনে না। আর তার মানেই হয়তো শান্তি।

সেই গ্রামে যাবার আগে একমাত্র সম্বল ছিল কিছু পুরোনো গল্প – বাবা বলত, একসময় সে এখানে ক’মাস ছিল, ছাত্রজীবনে। “সেই লাল মাটির পথ দিয়ে হাঁটলে মনে হয় পৃথিবী অন্যরকম,” বলত বাবা।

ট্রেন থেকে নামার পর অজস্র রিকশাওলা, পাখা হাতে দারোয়ান, হোটেলের সাইনবোর্ডগুলো — সব ছিল শহরের অভ্যেসমতো। তারপর একটা জীপে করে চলে এলাম সেই গ্রামে — করমডি।

গ্রামের মুখেই একটা তালগাছ, তার নিচে এক প্রৌঢ় বসে বিড়ি খাচ্ছিল। চোখদুটো আশ্চর্য শীতল।
আমি বললাম, “আমি এখানে এক মাস থাকতে চাই, একটু নিঃশব্দ থাকতে। আপনি কি কিছু সাহায্য করতে পারবেন?”

তিনি উত্তর দিলেন না। বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে শুধু বললেন, “নির্জনতারে খুঁজলে, সে নিজেই খুঁজে নেয়।”

আমার থাকার ব্যবস্থা হলো একটি কুঁড়েঘরে। চালের ছাউনি, মাটির দেওয়াল, সামনে একটা ছোট পুকুর। রাতে কোনো আলো নেই, কেবল ঝিঁঝিঁর শব্দ আর দূরের জঙ্গলে শেয়ালের ডাকা।

রাতের আকাশ এত স্পষ্ট আগে কখনো দেখিনি। চাঁদ যেন নিজের ভাষায় কথা বলে, আর তার আলোয় ওই দূরের অরণ্য যেন চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।

সকালে উঠেই গ্রামের পথ ধরলাম। লালমাটি যেন পায়ের নিচে গান গায়।
একটা শিশু — খুব সম্ভবত পাঁচ-ছয় বছর বয়স — হাসতে হাসতে এগিয়ে এল।
বলল, “আপনি শহরের?”

আমি হাসলাম। “তুমি কী করে বুঝলে?”

সে বলল, “আপনার ঘড়ি আছে, আর পায়ের স্যান্ডেল চকচকে।”

সত্যি। শহরের মানুষ চট করে ধরা পড়ে যায় এখানকার চোখে।

তার নাম লাম্বো। সে বলে দিলো, আমি যেন মধু দিদার সঙ্গে দেখা করি — তিনিই এই গ্রামে শিক্ষার আলো এনেছিলেন।

মধু দিদা। বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি, তবু হাঁটার ভঙ্গিমায় আছে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা।
তিনি বললেন, “আপনি এক মাস থাকতে চান? তাহলে আপনাকে কেবল পর্যটকের মতো নয়, আমাদের মানুষ হয়ে থাকতে হবে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তা কীভাবে হয়?”

তিনি বললেন, “সকালবেলা জল আনতে যেতে হবে, বিকেলে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। আর মাঝে মাঝে জঙ্গলে যাওয়া — গাছ চিনতে, পাখির ডাক শিখতে।”

আমি বললাম, “আমি তো এসব পারি না।”

তিনি হেসে বললেন, “তাই তো শিখতে এসেছেন।”

রাতে ফিরে এসে আমি ডায়েরি লিখলাম।

“আজ যেন আমি প্রথমবার নিঃশব্দ শুনলাম। এই নিঃশব্দতা ভয় করে না, বরং বুকের ভেতর একধরনের গান তোলে। করমডি নামটা যেন আমার দেহের কোথাও একটা জায়গা নিয়ে নিয়েছে।”

ঘুম আসছিল না।

দূরের শিয়াল ডাকে। মনে হলো, শহরের একঘেয়ে রোদের চেয়ে এই অন্ধকার অনেক বেশি বাস্তব।

পর্ব ২: লালমাটির পাঠশালা

করমডির সকাল শুরু হয় একটা বিশেষ শব্দে—তালপাতার ঝাপট, বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে আলো ফোঁটার মতন এক নির্ভেজাল শান্তিতে। শহরের ফোনের অ্যালার্ম নয়, বরং কোনো পাখির ডাক, কোনো শিশুর হাঁকডাক, কোনো হাঁস-মুরগির চলাফেরার শব্দে ঘুম ভাঙে।

আমি উঠে পড়ি, যদিও ঘুম ভাঙলেও শরীরের অভ্যেস বলে দেয়—এ সময় শহরে আমি ঘুমোচ্ছিলাম। এখানে ঘুম ভাঙাটা আর ঘড়ির ব্যাপার নয়, রোদের সাথে রক্তের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

মধু দিদা বলেছিলেন, সকালে জল আনতে যেতে হবে। আমি হাঁড়ি হাতে সেই পুকুরের দিকে রওনা হলাম। আমার হাত সেদিকে অভ্যস্ত নয়, হাঁড়ি দুলে পড়তে পড়তে চলছি। পথেই দেখা হয়ে গেল এক নারীর সঙ্গে—দীঘল কেশ, কাঁধে আঁচল বাঁধা, চোখে জিজ্ঞাসা।

“নতুন এসেছেন?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ, এক মাসের জন্য এসেছি। জল আনতে চলেছি। বোধহয় হাড়ির ভার সামলাতে পারছি না ঠিক করে।”

তিনি হেসে ফেললেন। বললেন, “শহরের হাত কোমল হয়, এখানে একটু মোটা হতে হয়।”

আমার হঠাৎ মনে হলো, কথাটা যেন কেবল হাড়ির ভার নয়, জীবনের ভরের কথাও বলল।

ওনার নাম মাধবি। থাকেন গ্রামের দক্ষিণ কোণে। বললেন, পুকুরের পাশের ঘাটে গেলে তুলনামূলকভাবে জল পরিষ্কার থাকে। আমি ওঁর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের ঘাটে গেলাম।

হাঁড়ি ভর্তি জল নিয়ে ফেরার সময় সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল। শহরে জিমে যাওয়া মানুষও এই ভার টানতে অপারগ। মাধবি বললেন, “শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনের ভারও ভাগ হয়ে যায় জল টানতে টানতে।”

বিকেলবেলা গেলাম সেই পাঠশালায়, যেখানে মধু দিদা থাকেন। ছোট একটা টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর, মাটির মেঝে, দেওয়ালে কয়লার আঁকা ছবি—গাছ, পাখি, হাতি, ঢোল।

শিশুরা তখন সাদা কাপড় পরা, খালি পায়ে। লাম্বো ছুটে এল—আমার হাতে একটা পাতা গুঁজে দিল। পাতায় খুদে অক্ষরে লেখা—

“আপনি আমাদের সঙ্গে খেলবেন?”

আমি হেসে বললাম, “অবশ্যই খেলব। তবে আগে পড়াশোনা?”

তারা চিৎকার করে উঠল, “না! আগে খেলা, পরে পড়া!”

মধু দিদা হেসে বললেন, “ওরা যেমন শিখতে চায়, তেমন করে শেখাতে হয়। শহরের নিয়ম এখানে চলে না।”

আমি একটা চক হাতে নিয়ে বোর্ডে লিখলাম — “আমার নাম অরিত্র”। বললাম, “তোমাদের নামগুলোও আমাকে শেখাও।”

সবাই একে একে বলল — সোমরা, কাঞ্চি, লাম্বো, জয়রাম, কুরমী, মালা, মাধো… একেকটা নাম যেন মাটির গন্ধে মোড়া।

শিক্ষা এখানে যেন কেবল বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তারা ফুল চিনে, গাছ চেনে, পাখির ডাকে পথ চেনে, রোদ দেখে সময় বুঝে।

একটা সময় পর আমি হাঁপিয়ে উঠি। ওরা যেন ক্লান্ত হয় না—গান গায়, কবিতা বলে, জঙ্গল থেকে খুঁজি আনা পাথরের মধ্যে রঙ ঢেলে ছবি আঁকে।

মধু দিদা বললেন, “এই শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষা, অরিত্র। শহরে ওদের পাঠালে হারিয়ে যাবে। ওদের নিজের ভাষায় শেখাতে হয়। আমরা এখানে ওটাই করছি।”

আমি প্রথমবার বুঝতে পারি—আমার শিক্ষাদীক্ষা, শহরের সাহিত্য, শিল্প—এই শিশুদের সহজ দৃষ্টির সামনে কতটা নড়বড়ে। যেন একটা অন্য ভাষায় কথা বলছি আমরা।

এক শিশুর চোখে আমি আমার নিজের ছেলেবেলার ছায়া দেখতে পাই। সে বলল, “আপনি কি মা-বাবার সঙ্গে থাকেন?”

আমি বলি, “না, একা থাকি। বন্ধু আছে।”

সে বলল, “একা থাকা কি দুঃখের?”

আমি থমকে গেলাম। উত্তরটা খুঁজে পেলাম না তখনই। শুধু বললাম, “সেইজন্যই তো এখানে এসেছি। বুঝতে।”

সন্ধে ঘনিয়ে এলে আমি ফিরে এলাম নিজের কুঁড়েঘরে। রোদ তখন লাল হয়ে গেছে। পাহাড়ের গায়ে রঙ লেগে আছে। দূর থেকে ঢাক বাজছে—শোনা গেল কোনো অনুষ্ঠান হবে আজ রাতে।

আমি আবার ডায়েরি খুললাম—

“আজ এই শিশুদের চোখে, আমি নিজের ভেতর একটা প্রশ্ন দেখতে পেলাম—আমি কী শেখাতে এসেছি, না কি শিখতে? এই পাঠশালা যেন আমার নিজের প্রতিচ্ছবির সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। এখানকার শিশুদের হাসিতে, তাদের নিষ্পাপ কণ্ঠে আমি নিজের এক বিস্মৃত দিন খুঁজে পেলাম।”

ঘরের বাইরে তখন কুয়াশা নামে। একটানা ঢাকের শব্দ বাতাসে মিশে যায়।

আমি ঠিক করি—কাল সকালে যাব মধু দিদার সঙ্গে, আদিবাসী গ্রামের উৎসব দেখতে। শুনেছি সেখানে নাচ হয়, গান হয়, আর অরণ্য যেন তখন কথা বলে মানুষের সঙ্গে।

সেই অরণ্য, যা এতদিন কেবল ভূগোলের পাতায় ছিল, এখন হৃদয়ের গহীনে কিছু লিখে যাচ্ছে।

পর্ব ৩: জল, গান আর ধামসা-মাদল

সকালের হাওয়ায় একটা উৎসবের গন্ধ। করমডি যেন আজ একটু অন্যরকম জেগেছে।
মাটির গায়ে রঙ, গাছের পাতায় ঢেউ, শিশুর মুখে মুখে একটাই কথা— “আজ ধামসা-মাদল বাজবে!”

মধু দিদা বললেন, “আজ ফুলো ঝুমুরের উৎসব। মুলুকের মাঝখানে যে মাঠটা আছে, সেখানে সন্ধ্যাবেলা সবাই জড়ো হবে। আগে স্নান করে, পুজো দিয়ে, ফুল গেঁথে—তারপর নাচ।”

আমি বললাম, “এই উৎসব কি কেবল ধর্মীয়?”

তিনি হেসে উঠলেন, “তুমি শহরের মতো প্রশ্ন করো। এখানে উৎসব মানেই জীবন। জীবনের নৃত্য, তার ছন্দ, তার শ্রদ্ধা, তার গান। ধর্ম এখানে ঢোকে না, মানুষ ঢোকে। গাছ, নদী, প্রাণী, মাটি—সব ঢোকে।”

সকালের জল আনার পথেই আমি লক্ষ করলাম, সবাই আজ একটু বেশি সুন্দর। কচি মেয়েরা মাথায় ফুল বেঁধেছে, ছেলেরা গলায় বীণার মত বাঁশি ঝুলিয়েছে, আর বয়স্করাও চোখে মুখে একরকম দীপ্তি নিয়ে হেঁটে চলেছে।

মাধবি আজও আমার সঙ্গে গেলেন পুকুরঘাটে। তাঁর শাড়ি আজ গাঢ় নীল, আঁচলের প্রান্তে শালপাতার নকশা। তিনি বললেন, “আজ তুমি যদি দেখতে চাও, কেমন করে মাটি গান গায়, তাহলে মন খুলে থাকো। বিচার কোরো না কিছু।”

আমি কিছু বললাম না। শুধু তার চাহনিতে একটা অদ্ভুত অবচেতন আস্থা খুঁজে পেলাম।

জল আনতে আনতে এক বৃদ্ধা বললেন, “এই শহুরে মানুষটা কি আজও থাকবে?”
মাধবি মাথা নেড়ে বললেন, “থাকবে। ও বুঝতে চাইছে। বোঝার চেষ্টা করলে মাটি কথা বলে।”

দুপুরের খাবারটা সেরেই আমি রওনা হলাম গ্রামের মধ্যের মাঠে। ধামসা, মাদল, করতাল, আর বাঁশি—সব প্রস্তুত। চারপাশে পাতা দিয়ে ঘেরা মঞ্চ, মাঝখানে একচিলতে খোলা জমি—যেখানে হবে মূল নাচ।

মধু দিদা আমাকে এক কোণে বসতে বললেন। শিশুদের ভিড়ে আমি লুকিয়ে যাই। ওরা চিৎকার করে হাসে, কেউ আমার হাতে রঙের ছিটে দেয়, কেউ পায়ে ফুল বেঁধে দেয়। আমি আর শহরের মানুষ নই তখন। আমি সেই দলের এক নিঃশব্দ সদস্য।

বিকেলের আলো তখন সোনালি। গাছের পাতায় ফড়িঙের পাখা, বাতাসে আগরবাতির ধোঁয়া, আর মাটির ঘ্রাণে জেগে ওঠে আদিম স্মৃতি।

হঠাৎই বাজতে শুরু করে ধামসা। মাদলের ছন্দে জেগে ওঠে সেই জমি। একদল কিশোর-কিশোরী ফুলের মালা পরে, রঙিন পোশাকে নাচ শুরু করে। মুখে হাসি, হাতে মাটির নীল রঙ, কাঁধে সাদা কাপড়ের গামছা—তারা যেন ধরণীর ভাষা বলে চলেছে।

আমি অবাক হয়ে দেখি—এই নাচ, এই গান, এই শরীরের বাঁক—এ কেবল বিনোদন নয়, একধরনের প্রার্থনা। একে বলে জীবনের সম্মান।

মাধবি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ বললেন, “এই ছন্দের মধ্যে আমরা মাকে খুঁজি—মাটি-মা, নদী-মা, গাছ-মা। শহরের মানুষ যখন মা বলে, সে একটা ছবি বোঝে। আমরা মা বলতে মাটি বুঝি।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি এখানেই বড় হয়েছো?”

তিনি হেসে বললেন, “না। আমিও একসময় তোমার মতো শহরে ছিলাম। শান্তিনিকেতনে পড়েছি। তারপর কী এক আকর্ষণে ফিরে এলাম। এখানেই থাকি আজ দশ বছর।”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। শহরের মেয়ে, সুন্দর শিক্ষিত মুখ, বলিষ্ঠ কণ্ঠ—সে কেন ফিরে এল এই গ্রামে?

তিনি বললেন, “তখন সব কিছু পেয়ে গিয়েছিলাম—চাকরি, বন্ধুবান্ধব, মেলামেশা। তবু মনে হতো কিছু নেই। এক শূন্যতা রয়ে গেছে। বুঝলাম, শব্দের মধ্য দিয়ে কিছু পূর্ণ হয় না। তখন ফিরে এলাম—এই লাল মাটির কাছে।”

তার চোখে তখন অদ্ভুত আলো। মাদলের ছন্দ তখন তীব্র থেকে তীব্রতর। তার শব্দ বুকে কাঁপন তোলে।

আমি বললাম, “তুমি কি কখনো আবার ফিরে যেতে চাও শহরে?”

তিনি বললেন, “এই মাঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করো না এই প্রশ্ন। মাটি রাগ করবে।”

আমি হেসে ফেললাম। কিন্তু তার কথায় একটা অদ্ভুত ধ্রুবতা ছিল। আমি জানতাম, সে শহরের আলোতেও আলো দেখেছে, কিন্তু এই অন্ধকারের মধ্যেও সে একটি নতুন আলো খুঁজে পেয়েছে।

রাত গভীর হলো। নাচ চলল, গান চলল। তারপর মধু দিদা বললেন, “আজ একটি বিশেষ গান গাওয়া হবে। এটা সবসময় গাওয়া হয় না। আজ মাটির আশীর্বাদ চাইতে হবে, কারণ সামনে খরা আসতে পারে।”

সবাই চুপ। একটা মেয়ে এসে মাঝখানে দাঁড়াল। বয়স খুব বেশি নয়—মাথায় ফুল, গলায় সাদা মালা, গলায় মৃদু কণ্ঠের স্পষ্টতা।

সে গাইতে শুরু করল—

“ধরি মা, ধরো মাটি,
ভাঙিও না হৃদয়ের পাতি,
রোদ্দুরে ফাটে শস্যতল,
তুমি জল হও, তুমি ফল।”

আমি থেমে গেলাম। এই গান কেবল কৃষির নয়, কেবল প্রকৃতির নয়—এ গান আত্মার।

এই গান আমার শহরের গান নয়। কিন্তু জানি না কেন, আমার চোখ ভিজে গেল।

ফেরার সময় আমি মাধবিকে বললাম, “আজ অনেক কিছু শিখলাম। যে ভাষা শহরে শেখা যায় না, সে ভাষায় আজ আমি গান শুনলাম।”

তিনি থেমে বললেন, “এই গানের নাম জীবন। শুধু মনে রেখো, গান শোনা যায়, বোঝা যায় না সবসময়। বোঝার চেষ্টা না করে শুধু সুরের সঙ্গে হাঁটো।”

রাত গভীর। আমি কুঁড়েঘরে ফিরে এলাম।

আজ শব্দ আমার শত্রু নয়। আজ নিঃশব্দ আমাকে আলিঙ্গন করে।

আমি ডায়েরি খুলে লিখলাম—

“আজকের এই দিন, এই মাটির সঙ্গে আমার আত্মীয়তার সূচনা। উৎসব শুধু চোখের নয়, আত্মার এক বিপ্লব। এই ধামসা-মাদল শুধু ঢাকের মতো বাজেনি, আমার বুকের মধ্যেও বাজতে শুরু করেছে।”

চাঁদ উঠেছে। সে নিঃশব্দে বলে দিল—তুমি এখন অরণ্যের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছো।

পর্ব ৪: নদীর ভাষা

সকালের আলোটা আজ একটু বেশি নরম। করমডির আকাশে আজ মেঘ নেই, তবু বাতাসে একটা চাপা গুমোট ভাব। হাঁটতে বেরিয়েই বুঝলাম—বৃষ্টির গন্ধ নেই, কিন্তু অরণ্য আজ থেমে আছে।

মধু দিদা বললেন, “আজ নদীর দিকে যাওয়া যাবে। চলো, তোমায় একটা জায়গা দেখাই।”

আমার চোখে কৌতূহল। এই প্রথম কেউ আমাকে নদীর কথা বলল। আমি বললাম, “এখানে নদী আছে জানতাম না!”

তিনি বললেন, “তুমি শুধু শুনে এসেছো এই গ্রামটা জঙ্গলঘেরা, অথচ বোঝোনি—এই মাটি যতটা শুষ্ক, তার বুকের নিচে ততটাই জল আছে। সেই জল আসে পদ্মানীর দয়ায়।”

পদ্মানী। নদীর নাম শুনে মনে হলো, যেন কোনো পুরনো প্রেমিকা ডেকে নিচ্ছে।

আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। পায়ের নিচে শুকনো পাতা, ধুলোর ঘ্রাণ আর মাঝে মাঝে গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের থকথকে রোদ। কিছুটা পথ যাওয়ার পর সামনে খুলে গেল এক বিস্তৃত পাথরের নদীপথ—যেখানে জল এখন অল্প, কিন্তু তার গতির মধ্যে একটা অহংকার আছে।

মধু দিদা বললেন, “এই নদীর গায়ে বসেই আমার ছাত্রজীবন কেটেছে। এখানেই আমরা ভোরবেলা স্নান করতাম, গান গাইতাম। নদী ছিল আমাদের মা, আমাদের বন্ধু, আমাদের আয়না।”

আমি সেই পাথরের উপর বসে পড়লাম। জল খুব পরিষ্কার, এত পরিষ্কার যে নিজের মুখ দেখা যায়।

সামনে এক বৃদ্ধ বসেছিলেন, চামড়ায় কুঁচকানো বয়স, চোখে ধূসর চাহনি। তিনি আমাদের দেখেই বললেন, “আসছো বুঝি শহর থেকে?”

মধু দিদা বললেন, “এই ছেলেটা আমার অতিথি। অরিত্র নাম। খুব মন দিয়ে সবকিছু শুনছে।”

বৃদ্ধ একটুখানি হাসলেন। বললেন, “তাহলে একটা গল্প বলি। পদ্মানী নদীর গল্প।”

আমি উঠে গিয়ে তার পাশে বসলাম। গায়ে একটুও ঘ্রাণ নেই শহরের মতো পারফিউমের, কেবল মাটি আর চুলকতলার গন্ধ।

“অনেকদিন আগে, এই নদী ছিল দেবী। লোকেরা তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিত। বিশ্বাস করো না, আমি জানি।
তখন নদীর জল ফুলে উঠত, বর্ষায় সে চূড়ান্ত রূপে ধেয়ে আসত গ্রামের দিকে। তার সঙ্গে সঙ্গে আসত আশীর্বাদ। ধান ফলত, মাছ উঠত, মেয়েরা নদীর ধারে বসে গান গাইত।

কিন্তু একবার এমন হলো, কেউ এক কন্যাকে জোর করে নদীর জলে ফেলে দেয়। মেয়েটি ছিল নাচন গানের বড়ো প্রেমিকা, আর তার আত্মা নদীতে মিশে যায়।

তারপর থেকে এই নদীর স্রোত যখন জোরে বয়, কেউ কেউ বলে—রাতের বেলা মেয়েটির গান শোনা যায়।
সে বলে—‘আমি বেঁচে আছি এই জলে, ছুঁয়ে দেখো না, হৃদয় দিয়ে দেখো।’”

আমি থমকে গেলাম।

জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি কখনো শুনেছেন সেই গান?”

তিনি বললেন, “যারা মন দিয়ে শোনে, তারাই শোনে। আমি একবার শুনেছিলাম—বিয়ের আগে, যখন নদীর পাড়ে রাত কাটিয়েছিলাম একা। আজও ভুলতে পারিনি।”

তার চোখের নিচে নদীর ছায়া।

আমার মন হঠাৎ ভরে উঠল। এ নদী কেবল ভূগোলের জল নয়, ইতিহাসের, কল্পনার, এবং ভালোবাসারও জল।

মধু দিদা বললেন, “পদ্মানী আমাদের চেনা পৃথিবীর বাইরে একটা অদ্ভুত কাহিনির দুয়ার। এখানে যেমন পাথর, তেমনই ফুল। যেমন শোক, তেমনই আশ্বাস।”

আমি নিজের পায়ের আঙুল জলে ভিজিয়ে দেখি। হালকা ঠাণ্ডা। যেন কেউ আলতো ছুঁয়ে বলে, “এমন করে আমাকে ভুলে যেয়ো না।”

বৃদ্ধ আবার বললেন, “এখন নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। রোজকার ব্যবহার, নদীটার মান ভেঙে দিয়েছে। কেউ আর তাকে ‘মা’ বলে না, বলে ‘জলসঙ্কট’। তাই নদীও এখন চুপ হয়ে গেছে।”

আমি চুপ করে থাকলাম। শহরে আমরা নদী মানেই বুঝি ঘোলা জল, পলিথিন, আর চেপে বসা বিল্ডিং। আমরা নদীর গল্প ভুলে গেছি অনেক আগেই।

এখানে নদী যেন কবিতা, না বলা প্রেমপত্রের মতো।

ফিরে আসার পথে আমার মুখে কোনো কথা নেই। পেছনে পাথরের বুক দিয়ে বইছে জল, যেন কারো কান্নার মতো নীরব আর টানা।

মাধবি পাশে এসে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “তুমি ভাবছো, না?”

আমি বললাম, “এই নদীর গানের ভাষা জানলে আমি হয়তো কবি হয়ে যেতাম।”

তিনি থেমে বললেন, “তুমি যা লিখো, তা-ও তো একরকম নদী। শব্দ দিয়ে তুমি প্রবাহ গড়ো।”

আমি বললাম, “কিন্তু শহরে তো জল শুকিয়ে গেছে, শব্দও ফাঁপা।”

তিনি হাসলেন, “তাই তো এখানে আসা। নিজের ভেতরের নদীটাকে জাগাতে।”

সন্ধ্যেবেলা আমি ঘরে ফিরে ডায়েরি খুলে লিখলাম—

“আজ এক নদীর পাশে বসে বুঝলাম—প্রকৃতির প্রত্যেকটা উপাদান আমাদের মতোই স্মৃতিবাহী। পদ্মানী কেবল জল নয়, একটা কাহিনি, একটা নীরব প্রতিজ্ঞা।

আজ আমি নদীর দিকে তাকিয়ে আমার নিজের শূন্যতা বুঝতে পেরেছি। নদী যখন বয় না, মানুষও বয় না। আর নদীর ভাষা শোনার জন্য প্রথম শিখতে হয় চুপ থাকতে।

চুপ থাকা আজ নতুন শিক্ষা হয়ে উঠেছে আমার কাছে।”

রাতে আমি বাইরে এসে দাঁড়াই। আকাশে আজ অর্ধেক চাঁদ, গাছের পাতায় হালকা বাতাস। মনে হলো নদীর স্রোতের মধ্যে কোথাও একটি কণ্ঠ বলছে—

“আমি আছি, শুধু শুনতে শেখো। আমি গাই, তুমি বোঝো না।”

আমি চোখ বন্ধ করে থাকলাম।

আজ শব্দ নয়, নিঃশব্দ আমাকে নদীর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

পর্ব ৫: মাটির মানুষ, কাঁথার গল্প

সকালে উঠেই দেখি, দরজার বাইরে কেউ একটা পাতায় মুড়ে কিছু রেখে গেছে। খুলে দেখি—ভেতরে তিলের নাড়ু, কাঁচা হলুদ মাখানো কিছু পাতার ভাজা। পাশে হাতের লেখা—

“তুমি এখন আমাদের লোক। খালি পেটে বন দেখা যায় না। — ম”

আমি জানি কে রেখেছে। মাধবি।

তার ভাষা এমনই—কখনও সরাসরি কিছু বলে না, আকারে ইঙ্গিতে বলে, অরণ্যের মতো।

আমি মধু দিদার বাড়ির দিকে হাঁটলাম। পথে কিছু বয়স্কা নারী বসে সূর্য মুখ করে, পায়ের আঙুলে সূতা জড়িয়ে, হাতে কাঁথার কাজ করছিল। তাদের গলার নীচে গলায় গড়া মণিপোতা হাড়ের মালা, চোখে সূক্ষ্ম চাউনি।

একজন বললেন, “এই যে শহরের মানুষ, এ কেবল আমাদের দেখে যায়, শেখে না কিছু।”
আমি হেসে জবাব দিলাম, “আমাকে শেখাতে দিন।”
তারা হেসে বললেন, “তাহলে আজ বসো। সূঁচ ধরো, আঙুল কেটে গেলেও ভয় পেও না।”

আমার জীবনে এর আগে কখনও সূঁচ ধরি নাই, বা সুতো গাঁথিনি। কাঁথা তো কেবল শুনেছি—মা ঠাকুমা যখন ব্যবহার করত, তখন জানতাম এটা শীতের রক্ষাকবচ। কিন্তু এখানে কাঁথা কেবল বস্ত্র নয়, স্মৃতির ক্যানভাস।

এক বৃদ্ধা—নাম পিঁয়ারি—আমার পাশে বসে বললেন, “এই কাঁথা হলো আমার জীবনের গল্প। সূঁচ দিয়ে লিখি।”
আমি বললাম, “আপনার জীবনের গল্প?”
তিনি বললেন, “তোমরা যখন কাগজে লেখো, আমরা তখন কাপড়ে লিখি। যে কাপড় পুরনো হয়ে যায়, সে কাপড়ের উপরেই আমরা নতুন স্মৃতি সেলাই করি।”

তার হাতে একটা কাঁথা দেখালেন—পুরনো ব্লাউজ, ফাটা শাড়ির অংশ, ছেঁড়া ধুতি—সব কেটে সেলাই করে, যেন একটা জীবন্ত পটচিত্র। এক পাশে সাদা কাপড়ে সূক্ষ্ম নকশায় একটা মেয়ের ছবি—হাতে বালতি, পিঠে শিশুকে বেঁধে চলছে।

তিনি বললেন, “এই আমি। যখন বুড়ো হচ্ছিলাম, তখন ভেবেছিলাম, আমার কোনও ছবি নেই, স্মৃতি নেই—তাই নিজেকেই কাঁথায় তুলে ফেললাম।”

আমার গা শিউরে উঠল। এই যে প্রতিটি সেলাই—এ একেকটা পলক, একেকটা নিঃশ্বাস।
আমরা কেবল ক্যামেরায় স্মৃতি রাখি, এরা সূঁচ দিয়ে।

পিঁয়ারি বললেন, “তুমি যদি চাও, তোমাকেও কাঁথায় তুলে দেবো।”
আমি বললাম, “আমি কীভাবে থাকব সেই ছবিতে?”
তিনি বললেন, “তোমার হাতের ঘড়িটা, চোখের চাহনি, শহরের আঙুল—সব মনে রাখব। সূঁচ জানে এসব।”

মধু দিদা তখন এসে বললেন, “এই কাঁথা মেয়েদের আত্মজীবনী। এদের অনেকেই কোনোদিন লেখাপড়া শেখেনি। তবু যখন বিয়ের সময় কাঁথা দেয়, তখন তা কেবল বস্ত্র নয়, জীবনের আশীর্বাদ।”

আমি বললাম, “কখনো এসব শহরের বাজারে বিক্রি হয় না?”
তিনি বললেন, “হয় বটে, তবে কাঁথা তখন পণ্য হয়। এই কাঁথাগুলো কিন্তু কেবল বিক্রির জন্য নয়। এগুলো বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কাঁথা যখন বোনা হয়, তখন একজন মানুষ তার স্মৃতিকে গাঁথে। তুমি দেখো না—একেকটা সূঁচের ফোঁড় একেকটা গানের মত।”

আমি পিঁয়ারির কাঁথা নিয়ে একটা কোণে বসলাম। কাপড়ে হাত রাখলাম। মনে হলো কারো কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কাঁথার শরীর যেন উষ্ণ।

তারপর আমাকে একটা সূঁচ দিলেন। একটা ফালতু শাড়ির টুকরোতে সোজা সেলাই করতে বললেন। আমি অদ্ভুত রকম অপটু হাতে কয়েকটা টান দিলাম। সেলাই বাঁকা, সুতো টানছে, আঙুলে সূঁচ ফুটে গেল। আমি “উফ!” বলে চেঁচিয়ে উঠলাম।

সবাই হেসে উঠল।

মধু দিদা বললেন, “ব্যথা না পেলে কেউ কাঁথা বানাতে পারে না। যেমন ব্যথা না পেলে কবিতাও হয় না।”

আমার রক্তাক্ত আঙুলের দিকে তাকিয়ে মনে হল, এই কষ্টটুকুও একধরনের চিহ্ন—যা দিয়ে আমি গ্রামের একজন হয়ে উঠছি।

বিকেলবেলা সেই নারীরা আমাকে একটা গল্প শোনালেন

“অনেকদিন আগে, এক মেয়ে ছিল। সে প্রতিদিন নিজের জীবনের কষ্ট কাঁথায় বুনত।
একদিন সে মারা গেল। তার কাঁথা যখন তার মেয়েকে দেওয়া হলো, তখন সে দেখল কাঁথায় তার মায়ের কান্না, হাসি, স্বপ্ন সব বোনা।
সেই কাঁথা যখন ঢেকে রাখত বাচ্চাকে, তখন সে কেবল শরীর নয়, মায়ের আত্মাকেও ঢেকে রাখত।”

এই গল্পটা শুনে আমি চুপ করে গেলাম। কোনো ভাষা নেই তখন আমার মুখে।

রাতে ফিরে এসে আমি ডায়েরি লিখি—

“আজ প্রথমবার অনুভব করলাম, শিল্প শুধু প্রদর্শন নয়—এটা আত্মার অনুবাদ। এই কাঁথার মহিলারা হয়তো উচ্চশিক্ষা পায়নি, কিন্তু তারা এমন এক ভাষায় কথা বলে, যা আমি সারা জীবনেও আয়ত্ত করতে পারব না।

সূঁচের ছোঁয়ায়, ফাটাফাটা কাপড়ের গায়ে, জীবন এক আশ্চর্য গল্প হয়ে ওঠে।

আজ আমার আঙুলে রক্ত লেগেছে, আর আমার মনে হয়েছে—এই রক্তই হয়তো শিল্পীর প্রথম রঙ।”

ঘুমোতে যাওয়ার আগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি, দূরের গাছে কোনো পাখি ডাকে—নিস্তব্ধতাকে ভেঙে।

আমি নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করি—

আমি কি সত্যিই বোঝার চেষ্টা করছি, নাকি কেবল একটা অন্যরকম জীবন দেখে মুগ্ধ হচ্ছি?
এই নারীরা, যারা প্রতিদিন মাটি, জল, কাঁথা আর শিশুর কান্না নিয়ে লড়াই করে—তারা তো কেবল জীবিকা নয়, জীবন বানাচ্ছে সূঁচে সূঁচে।

আজ আমার মধ্যে এক অদ্ভুত রূপরেখা তৈরি হচ্ছে। যেন আমি একটা নতুন কাঁথার পাটে বসে আছি—শহর আর অরণ্য, শব্দ আর নিঃশব্দ, স্মৃতি আর ভবিষ্যৎ—সব মিলে তৈরি হচ্ছে এক নতুন মানুষ।

পর্ব ৬: শহরের মুখ, গ্রামের আয়না

মোবাইলটা বেশ কিছুদিন ধরে ঘুমিয়ে ছিল। এখানে এসে সিগন্যাল প্রায় ছিল না বললেই চলে। আর আমি নিজেও ইচ্ছে করেই ফোন থেকে দূরে ছিলাম—একটা কৃত্রিম নিঃশব্দতার মোহে।

কিন্তু সেদিন, দুপুরবেলা কুঁড়েঘরে বসে কাঁথার ছেঁড়া সুতোগুলো মেলাতে মেলাতে হঠাৎ ফোনটা কাঁপতে শুরু করল।

স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে:
“Rudra – Office”

আমার হৃদয়ের কোথাও যেন একটা পুরনো তালা খুলে গেল। সেই শহরের চেনা মুখ, ভরাট কণ্ঠ, কাগজের গন্ধ, প্রেজেন্টেশন স্লাইডের লেজার পয়েন্টার—সব ফিরে এল এক ঝটকায়।

আমি ধাক্কা খেয়ে ফোনটা ধরলাম।
— “হ্যাঁ, রুদ্র?”

ওর কণ্ঠ স্পষ্ট, চেনা, দৃঢ়:
— “অরিত্র, তুই কোথায়? তোর ছুটি তো আগেই শেষ হয়ে গেছে! আজ তিনদিন অফিসে আসিসনি, না কোনো মেল, না ফোন। সবাই তো চিন্তায় পড়ে গেছে!”

আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম,
— “রুদ্র, আমি একটা গ্রামে আছি—পুরুলিয়ায়। ছুটি বাড়াতে চেয়েছিলাম, কিন্তু… এখানে সিগন্যাল পাওয়া যায় না ঠিকঠাক।”

ওর স্বর কঠিন হলো,
— “তুই ঠিক আছিস তো? মানে… হঠাৎ এরকম করে উধাও হয়ে যাওয়াটা তো তোর স্বভাব নয়।”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
— “হয়তো স্বভাবটাই বদলে যাচ্ছে, রুদ্র।”

ও থেমে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
— “তুই কি ফিরবি না?”

প্রশ্নটা হালকা ছিল, কিন্তু বুকে ভারি লাগল। যেন শহর নিজে ফোন করেছে, তার মুখ হয়ে রুদ্র কথা বলছে।

ফোন কেটে দিয়ে আমি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। কুঁড়েঘরের চালের ফাঁক দিয়ে সূর্য ঢুকছে, বাইরে থেকে মুরগির ডাক, পাতার ভেজা হাওয়া। অথচ আমার ভিতরটা তীব্র এক টানাপোড়েনে ভরপুর।

একদিকে শহরের ডাক—কর্মজীবন, আরাম, নিরাপত্তা। আর একদিকে এই গ্রাম—যেখানে আমি প্রতিদিন নিজের ভেতরের জ্যামিতি মেলাতে শিখছি।

মাধবি সেই সময় এসে হাজির। হয়তো দূর থেকে দেখছিল সব। হাতে একটা কুমড়োর তরকারি, সঙ্গে ধোয়া ভাতের ঘ্রাণ। বলল, “আজ দুপুরে আমার সঙ্গে খাবে। একা খেলে মন ভার হয়।”

আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আজ আমার শহর ফোন করেছিল।”

সে চুপচাপ বসে পড়ল, বলল না কিছুই। একটুখানি বাটিতে তরকারি পরিবেশন করল, বলল, “খাও। তারপর বলো।”

আমি এক গ্রাস ভাত মুখে দিলাম। সত্যি কথা বলতে, এই কুমড়োর স্বাদ শহরের দামি রেস্টোরাঁর কোনও কিছুতেই মেলে না। এ কেবল খাদ্য নয়, আশ্বাস।

খাওয়া শেষে বললাম, “তারা বলছে ফিরে যেতে। অফিস, দায়বদ্ধতা… আমি বুঝতে পারছি না কী করব।”

মাধবি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
— “তুমি জানো, আমি একসময় কী করতাম?”

আমি বললাম, “তুমি তো শান্তিনিকেতনে পড়েছো, জানি।”

সে হেসে বলল,
— “আমি দিল্লিতে একটা প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করতাম। বড় বড় লেখকদের স্ক্রিপ্ট এডিট করতাম। জীবন চলছিল। তারপর একদিন… আচমকা বাবা মারা গেলেন। আমি ফিরে এলাম। ভেবেছিলাম কয়েকদিনের জন্য। কিন্তু সেই কয়েকদিন কখন যে গাছের পাতায় পাতায় ঘর বেঁধে গেল, বুঝতেই পারিনি।”

আমি চুপ করে থাকলাম।

সে আবার বলল,
— “শহর আমাদের শেখায়—কীভাবে ছুটতে হয়। আর এই গ্রাম শেখায়—কীভাবে থামতে হয়। তুমি যদি থামার সাহস পাও, তবে ঠিক বুঝবে কোনটায় তোমার আত্মা।”

আমি জানি না, কীভাবে এই কথাগুলো এমনভাবে আমার ভিতরে ঢুকে গেল। যেন কোনও ওষুধের মত, যা সরাসরি রক্তে কাজ করে।

বিকেলে আমি পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলাম। শিশুরা খেলছে, একজন বাঁশি বাজাচ্ছে, দূরে মাধবি দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে। দূর পাহাড়ের ছায়া ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে।

আমি ডায়েরি খুললাম—

“আজ শহর আমাকে তার মুখ দেখিয়েছে। কিন্তু এই গ্রাম, এই অরণ্য আমাকে আয়না দিয়েছে।

শহরের মুখ আমার পরিচিত, তবু নিষ্প্রাণ। গ্রামের আয়না আমার অচেনা, অথচ তীব্রভাবে জীবন্ত।

আমি কী ফিরব? ফিরলেও কি আগের মানুষ হয়ে উঠতে পারব? না কি এই মাটি আমার ভিতর এমন কিছু গেঁথে দিয়েছে, যা আর উপড়ানো যাবে না?”

আমি জানি, কিছু সিদ্ধান্ত পাথরের মতো—তুলতে গেলে হাত কেটে যায়।

রাতে মধু দিদা এসেছিলেন। হাতে একটা পুরনো খাতা দিলেন। বললেন,
— “তোমার ডায়েরির লেখা পড়ে আমি বুঝি তুমি শুধু পর্যটক নও, তুমি খোঁজ করছো। এই খাতাটা আমার বাবার লেখা। ওখানে করমডির অনেক পুরনো কথা আছে, গল্পের মত। রেখে দিচ্ছি তোমার কাছে। যদি ফিরে যাও, নিয়ে যেতে পারো।”

আমি চোখ তুলে তার দিকে তাকালাম। বললাম, “আপনি চান আমি চলে যাই?”

তিনি বললেন, “আমি চাই তুমি বোঝো। ফেরাও একরকম থাকা। এই অরণ্য তোমার ভেতরে থেকে যাবে, যদি তুমি সত্যি শুনে থাকো ওর ভাষা।”

রাতের দিকে অনেকক্ষণ চোখে ঘুম এল না। মনে হচ্ছিল, শহরের কংক্রিট, করমডির পাতা—সব একসাথে এক স্বপ্নে মিশে যাচ্ছে।

স্বপ্ন দেখলাম—আমি শহরের ভিড়ে হাঁটছি, কানে শুনতে পাচ্ছি বাঁশির সুর। আমার ব্যাগের ভেতর পিঁয়ারির কাঁথা, আর ডায়েরির পাতা উড়ে উড়ে শহরের আকাশে ওড়ে।

ঘুম থেকে উঠে জানলাম—এখনো কিছু ঠিক হয়নি। সিদ্ধান্ত তখনো অনির্ধারিত।

কিন্তু একটা কথা নিশ্চিত জানলাম—এই অরণ্যের আয়নায় আমি যে মুখ দেখেছি, তা আর শহরের আয়নায় খুঁজে পাব না।

পর্ব ৭: যে পাখি গান শেখায়

সকালের করমডি আজ অন্যরকম কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। গাছে গাছে কুজন, খোলা বাতাসে পাতার নড়াচড়া যেন অনুবাদ করছে কোনো অদৃশ্য বার্তা।

মধু দিদা এসে বললেন, “আজ পাহাড় পেরিয়ে একটু দূরে যেতে হবে। সাঁওতালি গানের একটা দল এসেছিল কাল রাতে। ওরা আবার রওনা দেবে দুপুরের দিকে। আগে যদি দেখা করতে চাও, এখনই সময়।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “গান শেখানো দল?”

তিনি বললেন, “ওরা শেখায় না, গায়। তুমি যদি শোনো, নিজের গান খুঁজে পাবে। এই গ্রামের মানুষরা বলে—ওরা ‘পাখি-মানুষ’, যাদের গলায় প্রকৃতির সুর থাকে।”

শব্দটা ‘পাখি-মানুষ’ আমার মনে গেঁথে গেল।
আমি প্রস্তুত হলাম। একটা ফাঁকা খাতাও নিয়ে নিলাম। কে জানে, কোন গান কোন পাতায় উড়ে বসবে।

পাহাড়ের ঢালু ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সঙ্গী হলো—মাধবি, ছোট্ট কাঞ্চি, আর একজন বালক—নাম চুঞো। তার কাঁধে একটা ছোট ঢোল, চোখে কেমন যেন দুষ্টু বুদ্ধির ঝিলিক।

চুঞো বলল, “ওরা গান গায় হাঁটতে হাঁটতে। বসে থাকে না। পাহাড় চড়তে চড়তেই সুর গড়ায়।”

আমার হাঁপ ধরে আসছিল। শহরের মানুষ, হাঁটার অভ্যাস নেই। তবু মাধবির দিকে তাকিয়ে একটু সাহস পেলাম। সে নিঃশব্দে হাঁটে, যেন বাতাসের সঙ্গেই চলেছে।

পাহাড় পেরিয়ে যখন একটা ছোট মেটে প্রান্তরে এসে পৌঁছলাম, সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল পাঁচজন পুরুষ আর তিনজন নারী। সবার গায়ে হালকা জামা, গলায় মালা, পায়ে বাঁধা নুপুর।

তারা কিছু বলেনি। কেবল মুচকি হাসল। একজন সামনে এগিয়ে এসে বলল,
— “তুমি কি শুনতে চাও?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ।”

তারা বলল, “তাহলে চোখ বন্ধ করো। কান খোলো না, হৃদয় খোলো।”

প্রথমে একটা ঢোল বাজল—আলতো, রূদ্ধ স্বরে। তারপর বাঁশি এল—একটা সরু ধারা, পাহাড়ের হাওয়ার মত। তারপরে গান।

না, এটা কোনো সাজানো সুর নয়। যেন পাখিরা গাইছে। যেন নদী গড়ায় শব্দে শব্দে। নারী ও পুরুষ কণ্ঠ একসাথে মিলে বলছে—

“আকাশ নামে পায়ে, পাতা ফোটে সুরে
হাওয়ায় গলে ভাষা, কানে নয়—হৃদয়ে চুরি।”

আমার চোখে জল এসে গেল। আমি জানতাম না গান এমনও হতে পারে—যেখানে কোনো ভাষা বোঝা যায় না, তবু মর্মে পৌঁছে যায়।

মাধবি পাশে বলল, “এই ভাষা তুমি জানো না, তবু চেনো। এটাই মাটির সুর।”

আমি ফিসফিস করে বললাম, “এরা কি নিজেদের গান লেখে?”

চুঞো বলল, “না। এ গান লেখা হয় না। এই গান জন্মায়—পাতার ফাঁকে, জলের তলায়, ধানের গন্ধে। কেউ কাগজে লেখে না, কেউ সংরক্ষণ করে না। এই গান একবার গাওয়া হয়, তারপর হারিয়ে যায়। যারা পায়, তারা শুধু মনে রাখে।”

আমি চুপ করে গেলাম। জানলাম, আমার খাতায় হয়তো কিছু লেখা হবে না আজ। কারণ এই গান ধরা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়।

একজন পুরুষ—মুখে রোদে পোড়া দাগ, চোখে তীব্র ঔজ্জ্বল্য—আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “তুমি শহর থেকে এসেছো। তোমার গান কোথায়?”

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। বললাম, “আমি কবিতা লিখি, গান নয়।”

সে বলল, “তাহলে সেই কবিতা পড়ে শোনাও, যেটা তুমি এখনো কাউকে শোনাওনি।”

আমি গলা খাঁকারি দিয়ে আমার ডায়েরি থেকে এক পৃষ্ঠা খুলে পড়তে শুরু করলাম—

“মাটি ছুঁয়ে ফেরা নয়,
মাটিতে মিলিয়ে যাওয়া চেয়েছিলাম।
বাঁশির সুরে নিজেকে খুঁজে পাইনি,
তবে ভুলে যেতে পেরেছি শব্দের আয়না।”

আমার কণ্ঠ কাঁপছিল। ভাবছিলাম, এরা তো বুঝবে না। এ ভাষা তো বাংলা। ওরা তো সাঁওতালি বোঝে।

কিন্তু সব মুখে নিরবতা। একজন মেয়ে—গলায় সাদা ফুলের মালা—বলল,
— “তুমি তো আমাদের কথা বলছো। ভাষা বদলে দিলেই তো গল্প বদলায় না।”

আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম।

গানের শেষে সবাই একটা বৃত্ত করে দাঁড়াল। একে একে সবাই ঘুরে ঘুরে বলছে নিজের নাম, আর এক লাইনের গান।

কাঞ্চি বলল, “তুমি বলো না কিছু, শুধু দাঁড়াও বৃত্তে। চোখ বন্ধ করো। তবেই তুমি শিখবে ‘পাখির গান’।“

আমি কিছু না বলেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। চুপচাপ।
কানে শুধু পায়ের আওয়াজ, ঢোলের নরম ঠোকা, আর দূরে কোথাও বাজছে বাঁশি।

হঠাৎ মনে হলো, আমার মাথার উপর দিয়ে একটা পাখি উড়ে গেল—কিন্তু কোনো শব্দ ছাড়ল না। কেবল তার ছায়া এসে পড়ল বুকের উপর।

মনে হলো, আমি গান শুনছি না—আমি নিজেই সেই গানের অংশ। আমি কণ্ঠ নই, আমি ছন্দ।

আমার ডায়েরির শব্দগুলো যেন একে একে উঠে এসে গান হতে চাইছে।

সন্ধে নামল পাহাড়ে। আকাশে আগুন রঙ, নিচে শাল গাছের ছায়া গাঢ়।
আমি হাঁটছি ফিরতি পথে—চুপচাপ, কিন্তু আমার ভিতরে গান বাজছে।

মাধবি বলল, “তুমি শিখে গেলে আজ। শুধু গান নয়, নিজেকে শোনার এক উপায়।”

আমি বললাম, “এই পাখিরা কবে আবার আসবে?”

সে বলল, “এরা আসেও না, যায়ও না। যদি মন চায়, আবার শুনবে। মন না চাইলে সুরও ফিরবে না।”

রাতে ডায়েরি লিখলাম—

“আজ কোনো ভাষায় লেখা হলো না। শুধু শুনলাম নিজের শ্বাসের ভিতর সুর গজাচ্ছে।
আমি বুঝলাম, সত্যিকারের গান কোথাও শেখা যায় না, শুধু মনে রাখা যায়।

এই সাঁওতালি দলের পাখিরা হয়তো মানুষ নয়। তারা মাটির ভাষা বলে, যার ছন্দে আমি নিজেকেই আবিষ্কার করলাম।”

আমি জানি না, শহরে ফিরে গেলে এই গান আমার ভিতরে বাজবে কিনা। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে আমি নিশ্চিত—একটা পাখি আমার কণ্ঠে গেয়ে গেছে তার গান।

পর্ব ৮: শেষ খামে লেখা চিঠি

বিকেলের করমডি আজ অন্য রকম নিস্তব্ধ। যেন কিছু বলতে চায়, অথচ চুপ করে আছে। মাটির রঙ আরও গাঢ়, পাখির ডাক বিরল, গাছের পাতায় বাতাস থমকে গেছে।

আমি কুঁড়েঘরের বারান্দায় বসে পায়ের কাছে মাটি ছুঁয়ে ভাবছিলাম, কাল সকালেই শহরে ফিরে যাবো।

রুদ্রের ফোনের পর থেকেই যেন সময় আবার হিসেব কষে দাঁড়াতে চাইছে আমার সামনে। করমডির নিরবতা যতই আমাকে গিলুক, শহরের কর্পোরেট ছায়া আর যান্ত্রিক নিয়ম যেন কাঁধে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে—“এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী নয়।”

মাধবি আজ সকাল থেকেই আমাকে এড়িয়ে চলছিল। হয়তো বুঝে ফেলেছে আমার মন কোথায় হাঁটছে।
অথবা, আমিই চোখ সরিয়ে নিচ্ছি তার দিক থেকে। হয়তো বিদায়ের আগে কিছু সম্পর্ককে নিরব রাখা জরুরি।

সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে একটা শিশু—চুঞো—দৌড়ে এলো।
হাতে একটা হলুদ খাম। নিঃশব্দে আমার হাতে দিয়ে ছুটে চলে গেল।

আমি অবাক হয়ে খামটা খুললাম।
ভিতরে এক চিরকুট। হাতে লেখা অদ্ভুত সুন্দর, বাঁকানো, সরল—

“অরণ্য কেবল বৃক্ষ আর নদী নয়,

তা এক স্মৃতির ক্ষেত্র।
তুমি এসেছিলে শব্দ নিয়ে,
ফিরে যাচ্ছো হয়তো সুর নিয়ে।

কিন্তু কিছু সুর জায়গা নেয় না গানে,
তারা শুধু মনের এক কোণে পাখি হয়ে বসে থাকে।

তুমি হয়তো ফিরবে শহরে,
হয়তো আবার সাজাবে সময়সূচি।
তবু যদি কখনো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে—
একটা ছোট গ্রাম, কাঁথায় বোনা জীবন,
আর এক পাখি যে গান শেখায়—

তখন বুঝে নিও, করমডি তোমার ভিতরেই রয়ে গেছে।

— ম”

আমি চুপ করে বসে রইলাম।

এই চিঠিতে কোনও আবেদন নেই, নেই অনুরোধ বা আহ্বান।
কেবল এক অদ্ভুত বিদায়—যার ভিতরে প্রেম নেই, অথচ ভালোবাসা মিশে আছে নিঃশব্দে।

আমি জানতাম এই ‘ম’ কে।
মাধবি।

তবে এখন সে কেবল একজন নারী নয়—সে এক পাহাড়ের মতো নীরবতা, নদীর মতো গতি, আর মাটির মতো গভীরতা।

চিঠি হাতে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। রাত নামছে। দূরে ধানের খেতে পোকার আওয়াজ, ঘরে ঘরে আলো, আর পেছনে গাছে উঠেছে আধা চাঁদ।

আমি হেঁটে হেঁটে চলে এলাম মধু দিদার ঘরের দিকে।
তিনি বারান্দায় বসে চায়ের কাপ হাতে ছিলেন।
আমার মুখ দেখেই বললেন, “পেয়ে গেছো, না?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ। উনি কিছু বললেন না আমাকে সোজাসুজি।”

তিনি হালকা হেসে বললেন, “সবাই তো সোজা কথায় কথা বলে না। অনেকেই বলে—চিঠিতে, গানে, অথবা নীরবতায়।”

আমি একটু থেমে বললাম, “আপনি চান আমি যাই?”

তিনি চোখ সরিয়ে চায়ের কাপের ভেতরে তাকালেন। তারপর বললেন,
— “আমি চাই তুমি শোনো তোমার ভিতরের মাটি কী বলছে। করমডি একটা গ্রাম নয়, এটা একটা উপলব্ধি। তুমি যদি সত্যিই বুঝে থাকো, কোথায় ফিরলে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তুমি নিজেই করমডি হয়ে ওঠো, শহরের মধ্যে দাঁড়িয়ে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু জীবন তো চালাতে হয়। চাকরি, দায়, পরিবার…”

তিনি বললেন, “সেটাই তো জীবন—অসীমের ভিতরে ক্ষুদ্রতা আর ক্ষুদ্রতার ভিতরে অসীমতা খুঁজে যাওয়া।”

রাতে মাধবি এল না।

আমি জানতাম, সে আসবে না। এটাই তার ভাষা—চুপ করে থেকে বলে দেওয়া।
আমি ডায়েরির শেষ পাতায় লিখলাম—

“একটা চিঠি আমার ভিতরটা বদলে দিল।
না, তাতে কোন ছবি ছিল না, প্রতিশ্রুতিও না।

তবু মনে হল, এই চিঠি কেবল বিদায়ের নয়—এ যেন এক স্বীকারোক্তি।

করমডি হয়তো আমাকে ধরে রাখতে চায় না,
কিন্তু সে চায় আমি তাকে ধরে রাখি।

আমি জানি না শহরে গিয়ে কী হবে।
জানি না, ফিরতে পারব কিনা।

কিন্তু আমি জানি, একটা ‘ম’ আমার ভিতরে এখন থেকেছে—
তার চিঠির শব্দে, নীরবতার সুরে,
আর এক পাখির গান হয়ে।”

সকালবেলা ট্রেন ধরার আগে আমি গ্রামের শেষ মাথায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মাটির ধুলো গায়ে লাগছে, সূর্য ধীরে ধীরে উঠছে।

পেছনে তাকালাম না।

কারণ জানতাম, কেউ দাঁড়িয়ে নেই বিদায় জানাতে।
এখানে কেউ ‘গুডবাই’ বলে না।

এখানে কেউ বিদায় নেয় না, শুধু রয়ে যায়—পাখির সুর, কাঁথার সূঁচ, নদীর গর্জন, আর একটি মনের নিঃশব্দ চিঠি হয়ে।

ট্রেন যখন পাহাড়ের বাঁকে ঢুকে গেল, আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি করমডি ছোট হয়ে যাচ্ছে।

তবে একটাই কথা মনে হচ্ছিল:

“আমি যাচ্ছি না, আমি বহন করছি।”

পর্ব ৯: শহরে করমডি

শহরের গন্ধ একেবারে আলাদা—বিজলির তারে পাকানো ক্লান্তি, গাড়ির হর্নে ভাঙা পাখির ডাক, কাঁচের জানালায় হাওয়ার প্রতিধ্বনি নেই।

আমি ফিরে এসেছি। হ্যাঁ, ফিরতে হয়েছিল। করমডি আমাকে বিদায় জানায়নি, তবু বুঝিয়ে দিয়েছিল—তোমার ভিতরে যা শুরু হয়েছে, তা আর থামবে না। এখন তুমি যেখানে যাবে, সেটা বয়ে নিয়ে যাবে নিজের মধ্যে।

অফিসের ডেস্কে ফিরে বসতেই রুদ্র কাঁধে চাপড় মেরে বলল,
— “ভালো ঘুরে এলি বোধহয়! চেহারা একেবারে শান্ত।”
আমি কৃত্রিম হেসে বললাম,
— “হ্যাঁ। অনেক কিছু শিখে এলাম।”

কিন্তু সেই শান্তির মুখোশ টিকল না বেশিক্ষণ।
ইমেল ইনবক্সে ৩৪৬টি নতুন বার্তা। ফাইল, প্রেজেন্টেশন, ক্লায়েন্ট রিভিউ, ডেডলাইন।

প্রথম দিনেই বুঝলাম, শহর কাউকে সময় দেয় না। এখানে মানুষ ‘তুলনামূলক ক্লান্ত’, ‘দ্রুত ঘুমহীন’, ‘পরিমিত অস্থির’।

একদিকে মনে হচ্ছিল, করমডির সেই নীরব নদী, পিঁয়ারির কাঁথা, মাধবির চোখের ভাষা সব ভুলে যাচ্ছি।
অন্যদিকে, ওসব যেন ভিতরে কোথাও বসে আছে। অফিসের কফির কাপ হাতে নিয়ে জানালার বাইরে তাকালেই, মনে হয় যেন দূরে কোথাও বাঁশি বাজছে।

রাতে ঘরে ফিরে আমি ডায়েরির খাতা খুলে বসি। করমডির সময়কার নোটগুলো, সেই চিঠি—সব এখন একরকম রূপান্তরের দলিল।

কিন্তু ভয় হচ্ছিল—এই ডায়েরি কি কেবল স্মৃতির? নাকি সেটা এখন আমার অস্তিত্বের অংশ?

একদিন খুব ভোরে, অফিসে যাওয়ার আগে হাঁটতে বের হলাম। শহরের এক কোণে, রাস্তায় এক বৃদ্ধা বসে টুকরো কাপড় সেলাই করছেন। আমি অবাক হয়ে দাঁড়ালাম।

ভদ্রমহিলা বললেন, “বাবু, পুরনো জামা দিয়ে কাঁথা বানাই। চাইলে দেখে যেও।”

আমি হঠাৎ বসে পড়লাম তার পাশে। তার হাতে ছিল পুরনো ধুতি, রঙচটা শাড়ি, আর কিছু ছেঁড়া গজকাপড়।
আমি বললাম, “আপনি শুধু বিক্রির জন্য বানান, না নিজের জন্যও?”

তিনি বললেন, “এইটুকু বয়সে কে আর নিজের জন্য কিছু বানায়? এখন শুধু অন্যের প্রয়োজন মেটাই।”

তার কাঁথা দেখে আমি বুঝলাম, এটা ঠিক পিঁয়ারির মতো নয়। তবু কোথাও যেন সেই আত্মার দাগ রয়ে গেছে।

বললাম, “আপনার মনে আছে, প্রথম কাঁথা কোনটা ছিল?”
তিনি থেমে বললেন, “মেয়ের জন্য বানিয়েছিলাম। তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় দিয়েছিলাম। তাতে লিখেছিলাম—‘যেখানেই থাকো, মায়ের ছায়া যেন সঙ্গে থাকে।’”

আমার গা শিউরে উঠল। মনে পড়ল করমডির সেই চিঠির শেষ লাইন—‘করমডি তোমার ভিতরেই রয়ে গেছে।’

সেদিন অফিসে ঢুকে প্রথম যে কাজটা করলাম, সেটা প্রেজেন্টেশন বানানো নয়।
আমি করমডির একটি ছবি প্রিন্ট করে ডেস্কে রাখলাম—সাদা শালের ওপরে বুনোট কাঁথা, আর পাশে একটি পাখির ছায়া।

রুদ্র এসে দেখে বলল,
— “ওটা কী?”
আমি বললাম,
— “একটা পাহাড়ের ছবি।”
সে বলল,
— “তুই পাহাড় থেকে ফিরেছিস, এখন আবার পাহাড়েই চলে যাচিস?”

আমি হেসে বললাম,
— “না, পাহাড় এখন আমার মধ্যেই আছে। আমি আর ফেরা মানুষ নই।”

একদিন সন্ধ্যেবেলা ছুটির পরে অফিসের কাছের এক লাইব্রেরিতে ঢুকলাম। সেখানে ‘লোকসংস্কৃতি ও বাংলার কাঁথা’ নামে একটা পুরনো বই খুঁজে পেলাম।

পাতা উলটে দেখি—তাতেও করমডির নাম নেই। কেউ কাঁথার সেই গভীরতা বোঝেনি, কেবল নকশার তালিকা করেছে।

আমি তখন ঠিক করলাম—আমি লিখব।

একটা বই, যা কেবল কাঁথা নয়, করমডির গল্প, সেই নদী, সেই গান, সেই চিঠি নিয়ে হবে।

বইয়ের নাম ভাবলাম: “অরণ্যের ভিতরের শহর”।

মাধবিকে লিখলাম একটা চিঠি। ডাকে নয়, ইমেইলেও নয়—হাতে লেখা চিঠি।

“মাধবি,

জানি তুমি কোনো উত্তর পাঠাবে না। তবু জানো, করমডি এখন আমার ভিতরের শহর হয়ে গেছে।

আমি শব্দে গাঁথছি সেই গল্প—যা তুমি একদিন আমাকে নিঃশব্দে বলে গিয়েছিলে।

অফিসের ডেস্কে এখনো তোমার চিঠি রাখা। অনেকেই দেখে, কিন্তু কেউ পড়ে না।

আমি এখন গান শুনি না, গাই না—তবে হাওয়ায় মাঝে মাঝে পাখির মতো এক শব্দ ভেসে আসে—যেটা তুমি একদিন শিখিয়ে দিলে।

আমি তোমার মতো নই, নীরব থাকতে পারি না। কিন্তু চেষ্টা করছি, অন্তত শিখতে।

করমডির পাখিরা এখনো কি গান গায়?”

চিঠির নিচে নাম দিলাম না।

শুধু লিখলাম:
“অরণ্যের এক শিষ্য”

রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি শহরের বাতাসে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ—না ওটা ধুলো নয়, যেন কোথাও থেকে শালপাতার গন্ধ উড়ে এসেছে।

তখনই বুঝলাম, করমডি কেবল জায়গা নয়।
ওটা এক মনোজগৎ, এক অভ্যন্তরীণ ভাষা—যা একবার শিখলে, চুপ থাকলেও তা বাজে তোমার ভিতরে।

আমি জানি, মাধবি হয়তো সেই চিঠির উত্তর দেবে না।
তবু আমি অপেক্ষা করব।
কারণ অরণ্যের মানুষেরা কখনো উত্তর দেয় না—তারা শুধু থেকে যায় হাওয়ার মত, কাঁথার বুনটে, আর অসমাপ্ত সুরে।

পর্ব ১০: একটা উৎসবের রাত

শহরের উৎসব একটু আলাদা—বিগ বাজে রাস্তার ফাঁকে, লাইটের ঝিলিক, মানুষের হাল্কা উল্লাস। অথচ আজ আমি মনে-মনেই সেই করমডির মাঠে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ধামসা-মাদলের ছন্দে রাত জেগেছিল।

অফিসে মাত্র ইমেল পাঠিয়ে ছুটি নিয়েছি—এক রাতে শ্বাস নিতে চাই, শহরের কংক্রিটের ভেতরেও যেন অরণ্যের নিঃশব্দর সুর খুঁজে পাব।
বহু দিনের পর অমন অনুভূতি—উৎসবের জন্য শহরেও আমার অপেক্ষা।

সন্ধ্যা নামতেই বেরিয়ে এলাম শহরের পুরানো বটগাছের তলায়, যেখানে একদল শিল্পি রাস্তার প্রদর্শনী করছে। পটভূমিতে বাজছে বেহালা, এবং মাঝখানে দোলা দিয়ে আলোর স্ট্রিং ঝুলানো হয়েছে, যেন শত শত নক্ষত্র একসঙ্গে নেচে উঠেছে।

আমি একটা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে শুধু তাকিয়ে আছি। চারপাশে জীবন কেবল ভিড় নয়—এখানেও যেন কোথাও কোথাও মাটির গন্ধ লুকিয়ে আছে। মুখে মুখে উৎসবের ফুল, হাতেও মাটির প্রদীপ; কিছু অচেনা, কিছু পরিচিত।

হঠাৎ চোখে পড়ল এক বয়স্কা নারী, যার হাতে মাটির প্রদীপ আর হাতে সূঁচ। ছেঁড়া শাড়ির সিলুয়েটে আজও তার চোখে দীপ্তি, পিঁয়ারির মতোই সেলাই করে চলেছে—কিন্তু এখানে, শহরের রাস্তার এক কোণে।

আমি কাছে এগিয়ে গিয়ে বলি,
— “মেগা উৎসবের রাত, আপনাকে এখানে কী আনে?”

সে চুপ করে হালকা হেসে বললেন,
— “আমি আমার গ্রাম থেকে এসেছি—প্রদীপ জ্বালাতে এবং স্মৃতি বুনতে। দেখছেন, শহরেও মাটির গল্প শোনে।”

আমি বুঝতে পারলাম, করমডির মাটি শুধু গ্রামের দখলে নেই; ওটা যেকোনও ক্ষণে, যেকোনও প্রেক্ষাপটে আবার সজীব হয়ে ওঠে।

একটু দূরে বড় একটা মঞ্চে শুরু হল নাচের প্রদর্শন। যুবক-যুবতীরা লাল পোশাক, মাথায় ফুল, হাত-মুখে রঙ; ঠিক করমডির ফুলো ঝুমুরের উৎসবের মতো। তারা নাচছে আধুনিক ছন্দে, তবে তাদের কদমের তালে মাটির চাপে কিছুর প্রতিধ্বনি আছে—মাঠের নরম মাটিতে ছাপ ফেলা পায়ের আওয়াজের স্মৃতি।

আমি তাকিয়ে দেখি, এই নাচেও যেন পিঁয়ারির কাঁথার সূঁচের মতো সূক্ষ্ম স্মৃতি ঢুকে আছে। প্রতিটি ভঙ্গি, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি ফোল্ডারে লুকানো অতীত—এখানেও আবার ফেরা।

মঞ্চের সামনে আমি ধীরে ধীরে তাল মেলাই; শহরের সঙ্গীত-উৎসবে আমার শরীরও সাড়া দেয়। এবং কঠিন মাটির মতো মনে হয়, মাটির গান যে সারাক্ষণ বাজে—শহরের মৃৎভাণ্ডারের ভেতর থেকেও গোঁফের নিচে আঁচতে থাকে সুর।

নাচ শেষ হয়ে গেলে হঠাৎ হঠাৎ বাজতে শুরু করে বাঁশি।
এ একটা হাওয়া-বাঁশি, সরু নরম, যেন পাহাড়ের বুকে ঢেউয়ের সুর।
শহরের আলোয় সেই বাঁশি যেন একটু ছড়িয়ে পড়ল—কানে নয়, মনে শুনলাম ঢেউয়ের এলোপাথাড়ি সুর।

আমি ছুটে গেলাম বাঁশি-বাদকটির কাছে। সে আমাকে চেনে না, তবু বুঝতে পেরেছিল ওর সুরে মাটির ছোঁয়া আছে।
বললাম,
— “এই বাঁশি কোথা থেকে শিখেছেন?”

সে হেসে বলল,
— “শিখিনি, শুনে গেছি—এক গ্রাম আছে, যেখানে পাখি মানুষের সুর আছে। সেখানে গিয়ে শোনালাম বায়ু-তরোয়ালের কথা।”

আমি মিটমিটে আলোয় ভেসে আসা বাঁশি শুনে ভাবলাম, সে গ্রামই তো আমার করমডি, আর ওই “পাখি-মানুষ” আজও গান শুনে শোনে নিজের মর্ম।

রাস্তায় ঘুরতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম—এক পরিবেশ-দলের স্টলে বিক্রি হচ্ছে মাটির প্রদীপ আর কাঁথার ছোট টুকরো। পেছনে লেখা—“লোকশিল্পের দিনে, মাটির প্রদীপ, স্মৃতির আলোয়”।

আমি একটা প্রদীপ কিনে নিলাম, হাতে নরম মাটির গন্ধ। পাশে ছোট-খাটো কাঁথার প্যাচও নিলাম—ঐ যে পিঁয়ারির নকশা: ফুল, নদীর ঢেউ, বাঁশি-বেদনার রেখা।

এই স্টলগুলো ঠিক যেমন করমডিতে, মাটির ভেতরে গড়ে ওঠা মানুষগুলো এবার শহরের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে।

রাত গভীর। আমি শহরের হোটেলের বারান্দায় বসে প্রদীপ জ্বালালাম। মাটির প্রদীপের আলোর নিচে প্রতিচ্ছবি—শহরের কাঁচ-স্টিল, এবং এক ধুলো-মাখা মনোজগৎ।

প্রদীপের আলো যখন নড়বড়ে নাচল, মনে পড়ে গেল করমডির রাতে ঝাঁপসা আলো। সেখানে আলো শুধু ব্যোমকেশ দিচ্ছিল না, বুকের ভেতরে অগ্রাহ্য ভোরের মোহ।

আমি পতাকা-আলোয় আরও একটু প্রস্থান করলাম—পুকুর ঘাট, প্রসাদ-दানের সারি, পিঁয়ারির সূঁচ, শিশুদের হাসি, মধু দিদার চোখ—সব একত্র মিলিয়ে শহরের বাটি ভরে নিল।

আমি ডায়েরি খুলে লেখালাম—

“শহরে আজ উৎসব।
মনে হয় করমডির রাতগুলো একসঙ্গে এসে বলছে—আমি আছি প্রতিটি আলোয়, প্রতিটি ছন্দে।
এখানে শহর বলছে, আমরা কোটি গানে মাটি হারিয়েছি।
করমডি বলছিল, গানের মধ্যে মাটি আছে, শুধু আপনাকে খুঁজে নিতে হবে।

আজ আমি জ্বালালাম মাটির প্রদীপ,
সেই প্রদীপ যা শহরের গলিতে এক অচেনা পাখি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।”

উৎসব শেষ। মানুষ ফিরছে, স্টল ভাঙছে, মঞ্চের আলো নিভে যাচ্ছে।
আমি হাতে মাটির প্রদীপ আর প্যাঁচ কাঁথা নিয়ে হাঁটছি ছন্নছাড়া রাস্তায়—কিন্তু মনে পড়ে, এ পথে আমারই করমডি।

রাতের ওই নিস্তব্ধতায় আমি বুঝলাম—মাটি, নদী, গান, সূঁচ, চিঠি—সব কিছু একসাথে একটা পরিবেশ, একটা অনুভূতি। শহর আর গ্রাম একসঙ্গে গান গায়, যখন আপনি সেই সুর শুনতে চান।

হোটেলে ফিরে ঢুকে বিছানায় পড়ে ভাবলাম—আমি কোথায় আছি?
শহরের কাজের তালিকায়? নাকি করমডির মাটিতে?
কিন্তু আজ বুঝলাম, আমি দুই জগতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি—নিজের মধ্যে।

আমি মেয়ের মতো কোণায় বসে ডায়েরি শেষ করলাম—

“শেষ কথা:
এই রাত্রে আমি পেলাম এক উৎসবের কথা,
যা শহরে আর গ্রামে একসঙ্গে বাজে—
যখন আপনি শুধু চোখ খুলে কথা শুনেন,
আর নিরব থেকে হৃদয়ে বাজতে দেন করমডির গান।”

এমনি করেই শেষ হলো আমার দশ পর্বের পথযাত্রা,

যেখানে মাটি, শব্দ, নিঃশব্দ, স্মৃতি আর আশা মিলিয়ে
একটি ‘অরণ্যের ডায়েরি’ হয়ে উঠল—
আমার নিজের ভিতরের শহর।

 

সমাপ্ত

1000025351.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *