শান্তিলাল হেমব্রম
অধ্যায় ১:
পাহাড়-জঙ্গলঘেরা শালপাতা গ্রামটি যেন সারা পৃথিবীর喧 noise থেকে দূরে প্রকৃতির বুকে গড়ে ওঠা এক শান্ত আশ্রম। গ্রামের চারপাশে শাল, মহুয়া, পলাশ আর অজানা অসংখ্য লতাগুল্মের সমারোহ, যেন এক স্বপ্নলোকের দরজা খুলে বসেছে। ভোরবেলা কুয়াশা যখন আস্তে আস্তে পাতার কোণে গুটিয়ে যায়, তখনই জঙ্গলের বুক চিরে সূর্যের আলো ঝরে পড়ে, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই বনের মধ্যে এক অদ্ভুত সজীবতা অনুভূত হয়। পাখির কলকাকলি, ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক, বুনো প্রাণীর দূরের ডাক — এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে প্রতিটি সকাল নতুন হয়ে ওঠে। এই গ্রামেরই এক কুঁড়েঘরে থাকে রূপসী — শ্যামলা, কঠিন মুখাবয়বের এক যুবতী, যার চোখে স্পষ্ট দৃঢ়তার রেখা। তার জন্ম এই অরণ্যের কোলে, আর শৈশব কেটেছে এই বনের প্রতিটি পথ, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাখির সঙ্গে। বাবা ছিলেন এক কাঠুরে, মা গৃহিণী। ছোটবেলাতেই বাবা-মা দুজনেই এক মারণরোগে মারা গেলে রূপসী কাকিমার কাছে মানুষ হয়। কিন্তু এই কাকিমাও ছিলেন দরিদ্র, তার সংসারে অভাব লেগেই থাকত। তাই শৈশব থেকে রূপসীর সঙ্গী হয়ে ওঠে অরণ্য। শাল, পিয়াল, মহুয়ার গন্ধে ভরা বনভূমির প্রতিটি ঝরনা, প্রতিটি গাছ তার আশ্রয় হয়ে ওঠে। প্রতিদিন সকালবেলায় সে জঙ্গলের দিকে পা বাড়ায়, কাঁধে একটি ছোট্ট ঝুলি, যেখানে রাখা থাকে কুড়োনো মহুয়ার ফুল, শালপাতা আর কয়েকটি তুচ্ছ জিনিস। রূপসীর চোখে এই বন যেন তার নিজের মা, তার রক্ষক। বনের প্রতিটি প্রাণী তার কাছে প্রিয়, সে বনের মধুমাছির মতো একনিষ্ঠ ও সতর্ক, আর সেই অরণ্যই তার জীবনযাত্রার একমাত্র অবলম্বন। রূপসী কখনও পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে বসে থাকে, কখনও নদীর পাড়ে বসে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে — যেন প্রকৃতির বুকে নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পায়।
শালপাতা গ্রামের জীবনযাত্রা বড়ই সরল, অথচ বেঁচে থাকা কঠিন। কয়েক বিঘা জমি, যা বর্ষায় ভিজে যায়, শীতে ফেটে যায়, আর গ্রীষ্মে হয়ে ওঠে পাথরের মতো কঠিন। গ্রামের মানুষগুলো মূলত কাঠ কেটে, লতাপাতা কুড়িয়ে, মধু সংগ্রহ করে বা পাহাড়ি ঝরনার জল ধরে চাষাবাদ করে কোনও মতে দিন গুজরান করে। শিশুরা ছুটে বেড়ায়, মহিলারা জলে যায়, পুরুষেরা কুঠার কাঁধে করে পাহাড়ে যায় কাঠ আনতে। কিন্তু এই সরল জীবনের উপর মাঝেমাঝেই নেমে আসে এক অজানা অশুভ ছায়া — বহিরাগত কিছু লোকের আনাগোনা শুরু হয়। তারা আসে শহরের চাকরির লোভ দেখিয়ে, আসে সুন্দরী মেয়েদের শহরে বড় কাজ পাইয়ে দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি নিয়ে। গ্রামের অনেকেই এই লোভে পড়ে মেয়েদের পাঠিয়ে দেয় দূরের অজানা শহরে। কিন্তু বেশির ভাগই আর ফেরে না। রূপসী ছোট থেকেই এই ঘটনা দেখে বড় হয়েছে। সে দেখেছে কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, কত বাবা রাতভর মেয়ের জন্য চোখের জল ফেলেছেন। অথচ গ্রামের মানুষ এতটাই সহজ-সরল যে প্রতিবার নতুন করে প্রতারণার শিকার হতে বাধ্য হয়েছে। রূপসীর কিশোর বয়সে সেই স্মৃতি আরও তীক্ষ্ণ হয়ে বসে আছে, যখন তার নিজের কাকিমার মেয়েকেও এইভাবে শহরে কাজের কথা বলে নিয়ে গিয়ে ফেরা যায়নি। সেই দিন থেকেই রূপসী ঠিক করেছিল — এই অরণ্যের কোল থেকে আর কোনও মেয়েকে হারাতে দেবে না সে। অরণ্যের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাখি, প্রতিটি পাথর যেন তাকে এই শপথের কথা মনে করিয়ে দেয়। সন্ধ্যা নামলে যখন শালপাতা গ্রাম সুনসান হয়, তখন রূপসী নদীর পাড়ে বসে চাঁদের আলোয় জঙ্গলের ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর অরণ্যকে মনে মনে বলে — “তুমি ডাক দাও অরণ্য-মা, আমি শুনব।”
এক রাতে, যখন বনের মধ্যে নিশুতি নেমে এসেছে, কুয়াশায় ঢাকা পথ, দূরে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে, তখন রূপসী অনুভব করল এক অদ্ভুত অস্থিরতা। মনে হচ্ছিল, অরণ্য যেন সত্যিই তাকে ডাকছে, ফিসফিস করে কানে কানে বলছে — “আমার বুক কেটে শত্রুরা আসছে, কন্যা, উঠে দাঁড়া।” সে ধীরে ধীরে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল, নরম পায়ে বনপথে এগিয়ে চলল। অরণ্যের গা বেয়ে বয়ে চলা হাওয়া তার কানে গোপন বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে — দূরে কোথাও মানুষের অচেনা শব্দ, পায়ের ধ্বনি, ভাঙা শাখার শব্দ। রূপসী ছায়ার মতো বনের গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেল। সে স্পষ্ট দেখতে পেল — দুই-তিনজন অচেনা পুরুষ লোক গ্রামে ঢোকার রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, হাতে লাঠি, কাঁধে বস্তা, আর মুখে গম্ভীর চাউনি। রূপসীর বুকের মধ্যে তখন ঢাকের মতো আওয়াজ হচ্ছে। সে জানে, এরা কারা। এরা সেই শিকারির দল, যারা রাতের অন্ধকারে মেয়েদের ফাঁদে ফেলে ধরে নিয়ে যায়। সেই রাতেই সে শপথ নিল — এদেরকে ঠেকাতে হবে, নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও। অরণ্য তার সহায়। গগন, তার ছেলেবেলার বন্ধু, সেই রাতেই রূপসীর পাশে এসে দাঁড়াল। গগনের চোখেও আগুন। দু’জনেই জানল, এক নতুন লড়াই শুরু হয়েছে। আর সেই লড়াইয়ের শুরু হল অরণ্যের বুকে, চাঁদের আলোয় ভিজে থাকা শালপাতার ঘ্রাণ মেখে।
অধ্যায় ২:
সেই রাতের পর শালপাতা গ্রামের আকাশে যেন অজানা এক অশান্তি নেমে আসে। ভোরবেলার হালকা কুয়াশা আর পাখির কলতানেও যেন সেই অশুভ ছায়ার প্রতিফলন দেখা যায়। গ্রামের মানুষজন মুখে কিছু না বললেও চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। কারও মুখে ফিসফাস — “কাল রাতের অন্ধকারে কেউ এসেছে।” আবার কেউ গলা নামিয়ে বলে — “নতুন করে যেন লোভের জাল ফেলছে কেউ।” রূপসীর মন তখন বিক্ষিপ্ত। সে জানে, গত রাতের সেই অচেনা পুরুষদের পায়ের ছাপ, ভাঙা ডালের চিহ্ন, বনের নিরবতা ভেঙে যাওয়ার শব্দ — সবই এক অশুভ বার্তা বহন করছে। সে বুঝতে পারে, এই বার বার আসা বহিরাগতরা সহজেই থেমে যাবে না। তারা আবার আসবে, আর বারবার ছলচাতুরিতে ফাঁদ পেতে নেবে গ্রামের সহজ সরল মানুষদের। সকালে গগন রূপসীর সাথে দেখা করতে আসে। তার চোখে আতঙ্ক আর রাগের ছাপ। গগন জানায় যে সে রাতের বেলা পাহাড়ের গা দিয়ে দূর থেকে দেখেছে কিছু অচেনা লোক গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছিল। রূপসী স্থির সিদ্ধান্ত নেয় — এই বনের বুক চিরে প্রবেশ করা শিকারিরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, অরণ্যের ডাক সে উপেক্ষা করবে না। বনের গাছপালা, প্রাণীজগৎ — সবকিছু যেন তাকে সেই মুহূর্তে বলছিল, “এই অরণ্য তোমার, এর মেয়েরা তোমার, তাদের বাঁচাও।” রূপসীর মনে হয়েছিল, প্রকৃতি নিজেই যেন তার হাত ধরে পথ দেখাতে চায়।
সেই দিন দুপুরের দিকে গ্রামের ময়দানে হট্টগোল শুরু হয়। বিনোদ সর্দার — গ্রামের এক প্রভাবশালী লোক, যাকে সবাই বাহ্যত সম্মান করে, কিন্তু যার চোখেমুখে লোভ আর কপটতার ছাপ স্পষ্ট, সে সবার সামনে দাঁড়িয়ে নতুন খবর দেয়। সে জানায় — “কলকাতা থেকে কিছু ভালোমানুষ এসেছে, মেয়েদের জন্য শহরে কাজের ব্যবস্থা করতে। তারা সরকার অনুমোদিত সংস্থা। গ্রামের মেয়েদের ভবিষ্যৎ গড়ার এই সুযোগ হাতছাড়া করো না।” গ্রামের কিছু বয়স্ক মানুষ সন্দেহের চোখে চায়, কেউ কেউ আবার লোভে পড়ে যায়। রূপসীর বুক কেঁপে ওঠে। সে বোঝে, এই কথাগুলো মিথ্যা। বহিরাগতদের সেই অশুভ ছায়া আবার গ্রাম ঘিরে ধরছে। সে সামনে এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে —
রূপসী: “বিনোদ কাকা, এর আগে যে মেয়েগুলোকে শহরে পাঠানো হলো, তারা ফিরে এলো কই? কিসের কাজ? কিসের স্বপ্ন? এটা ফাঁদ। গ্রামের বোনেদের বিক্রি কোরো না।”
বিনোদের মুখ কঠিন হয়ে যায়। সে বলে —
বিনোদ: “তুই কি বড্ড বড় কথা বলিস রূপসী? তোর বয়স হয়েছে যে এভাবে গ্রামের মানুষকে শিখিয়ে দিবি?”
গ্রামের মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ে। কেউ রূপসীর কথায় সাহস পায়, কেউ আবার বিনোদের কথায় ভয় পায়। সেই দিন সন্ধ্যায় রূপসী একা বনের পথে হাঁটতে থাকে। আকাশে চাঁদ উঠে এসেছে, জঙ্গলের ছায়া দীর্ঘ হতে হতে যেন তার বুকের ব্যথা আরও ভারি করে তোলে। রূপসী বুঝতে পারে, এই লড়াই সহজ হবে না। বিনোদের মতো মুখোশধারীরা ভেতরে ভেতরে এই শিকারিদের সহযোগী। অরণ্যের অন্ধকারে সে শপথ করে — “আমি এই ছায়াদের ভাঙব। অরণ্যের বুকে শিকারিদের আর ছায়া পড়তে দেব না।”
সেই রাতেই রূপসী পাহাড়ের পেছন দিকের এক গোপন পথ ধরে গগনকে নিয়ে বনের আরও গভীরে চলে যায়। তারা দুজনেই অনেক দূরে এক ভাঙা পাথরের মন্দিরের কাছে অচেনা লোকেদের ছায়ামূর্তি দেখতে পায়। তাদের কানে আসে গোপন আলোচনা — কিছু মানুষকে তারা ফাঁদে ফেলে শহরে পাঠানোর নতুন ছক করছে। রূপসী আর গগন নিঃশব্দে ফিরে আসে, কিন্তু সেই রাতেই তাদের মনে পোক্ত হয়, এবার কিছু করতে হবে। অরণ্য তখন নিঝুম, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন অরণ্য নিজেই তাদের সাথে প্রতিজ্ঞা করে — “আমি তোমাদের পাশে আছি।” সেই রাতে রূপসী ঘুমায় না। সে তীর, ছুরি, শালপাতা দিয়ে তৈরি ফাঁদ তৈরি করতে বসে যায়। অরণ্যের পাতার ফাঁকে চাঁদের আলো তার কপালে এসে পড়ে, আর বাতাস যেন ফিসফিস করে বলে — “তুমি সাড়া দাও, কন্যা। অরণ্য ডাকছে।” শালপাতার ঘ্রাণে ভিজে থাকা সেই রাতেই শালপাতা গ্রামের ইতিহাসে নতুন এক লড়াইয়ের সূচনা হয়।
অধ্যায় ৩:
রাতের নিকষ অন্ধকারে শালপাতার ঘ্রাণ মিশে আছে হালকা শীতল হাওয়ায়। চাঁদের আলো লুকিয়ে পড়েছে মেঘের আড়ালে। অরণ্যের বুকের গভীরে, শাল, মহুয়া আর পলাশ গাছের ছায়া ঘন হয়ে এসেছে। সেই ঘন অরণ্যের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে চলেছে রূপসী আর গগন। পা ফেলার শব্দও যেন অরণ্য গিলে ফেলছে। তাদের চোখে তীব্র সতর্কতা, মুখে দৃঢ় সংকল্প। পাহাড়ি পথ ধরে অনেকটা হেঁটে তারা এসে পড়ল এক জায়গায় যেখানে শাল গাছের আড়ালে কিছু ঝোপঝাড়, আর দূরে ভাঙা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। সেই জায়গাটা এতটাই নির্জন, দিনের আলোতেও কেউ ওদিকে পা বাড়ায় না। আর রাতের অন্ধকারে সেখানে আসা মানে সাহসিকতার চূড়ান্ত পরীক্ষা।
গগন ফিসফিসিয়ে বলে,
গগন: “রূপসী, এদিকে আসা ঠিক হচ্ছে তো? যদি শিকারিরা আমাদের টের পায়?”
রূপসী: (চোখে আগুন জ্বলে ওঠে) “ভয় পাস না গগন। এই অরণ্য আমাদের সাথেই আছে। শিকারিরা জানে না, বনের মাটি আমাদের পথ দেখাবে।”
তারা গাছের আড়ালে বসে দূরে চোখ রাখে। কিছুক্ষণ পরই দেখা যায় মোমবাতির মতো ম্লান আলো, শোনা যায় চাপা গলার কথাবার্তা। বাতাসে ভেসে আসে কিছু শব্দ —
“মেয়েগুলোকে কাল রাতেই বের করতে হবে… বিনোদ সব ঠিক করে রেখেছে…”
“জঙ্গলের পেছন দিক দিয়ে যাবে, পুলিশ টের পাবে না।”
রূপসীর সারা শরীরে কাঁপন ধরে। সে গগনের হাত চেপে ধরে বলে,
রূপসী: “দেখলি? এরা এবার সত্যিই গ্রাম খালি করবে। আমাদের আজ রাতেই ফাঁদ পাততে হবে।”
গগন থমথমে মুখে সম্মতি জানায়। তারা নিঃশব্দে পিছিয়ে আসে, আর অরণ্যের ভেতর দিয়ে অন্য পথে ছুটে যায় ফাঁদ তৈরি করার জন্য।
রূপসী জানে, এই অরণ্য তার স্কুল, তার শিক্ষক। ছোটবেলায় সে শিখেছে কিভাবে শিকারিরা ফাঁদ পাতে, কিভাবে বুনো শূকর ধরার জন্য গর্ত খোঁড়া হয়, কিভাবে শালপাতা দিয়ে ছদ্মবেশ তৈরি হয়। গগনের সাহায্যে তারা বনের শেকড়, কাঁটা লতা, শুকনো পাতা ব্যবহার করে একের পর এক ফাঁদ তৈরি করতে থাকে। শালপাতা দিয়ে গর্ত ঢেকে রাখা হয়, যাতে পা দিলেই পড়ে যায়। শুকনো কাঁটা ছড়িয়ে দেওয়া হয় সেই পথের চারপাশে, যেখানে শিকারিরা হেঁটে যাবে।
সেই অন্ধকার রাতের বুকে অরণ্যের নিস্তব্ধতা আর দুই যুবক-যুবতীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ মিশে একাকার হয়ে যায়। একসময় শোনা যায় পায়ের শব্দ। শিকারিরা এসে পড়ছে। প্রথম ফাঁদে পা পড়তেই ঝোপের আড়াল থেকে শোনা যায় হঠাৎ এক আর্তনাদ —
“আহ! কে রে এভাবে ফাঁদ পেতে রাখল?”
রূপসী ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। হাতে তীর-ধনুক। চাঁদের আলোয় তার মুখ যেন এক যুদ্ধিনার মতো দীপ্ত হয়ে ওঠে। গগন এক লাঠি হাতে পাশে দাঁড়ায়। শিকারি পালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু পা আহত হয়ে পড়ে যায়। রূপসী কাছে গিয়ে তীরের ডগা তার ঘাড়ে ধরে বলে —
রূপসী: “কী করতে এসেছিলি বল? কারা আছে তোর সাথে?”
আতঙ্কিত শিকারি সব কথা বলতে থাকে — কিভাবে তারা বিনোদের ইশারায় এসেছে, কিভাবে শহরে মেয়েদের বিক্রি করে টাকা কামাবে।
শিকারি গিয়ে পড়ে অরণ্যের বুকের ভেতর। বনের গাছপালা, পাথর, কাঁটার ঝোপ যেন শিকারিকে আটকে দেয়। রূপসী তার মুখোশ খুলে দেখে — এক বহিরাগত চক্রের চেনা মুখ। তারা শিকারিকে বেঁধে রাখে। তারপর রাতভর তারা ফাঁদ বাড়াতে থাকে। বনের বুক জুড়ে যেন অদৃশ্য লড়াই শুরু হয়। আর সেই লড়াইয়ে অরণ্য তার সন্তানদের রক্ষা করতে রূপসীর পাশে দাঁড়ায়।
অধ্যায় ৪:
শালপাতা গ্রামের আকাশে যেন অশুভ অন্ধকার নেমে এসেছিল সেই রাতটায়; অরণ্য বুকের মধ্যে সঞ্চিত নিস্তব্ধতা যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল, বাতাস থেমে গিয়েছিল, আর শালগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোও যেন লজ্জায় নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছিল মেঘের আড়ালে, আর সেই নিস্তব্ধতায় দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল শিয়ালের ডাক, ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে সঙ্গীত আর অদৃশ্য বিপদের পদধ্বনি, যা প্রতিটি সতর্ক প্রাণীর শিরায় শিরায় আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছিল; গ্রামের মানুষগুলো মণ্ডপের চারপাশে ছোট ছোট দলে জড়ো হয়ে উদ্বিগ্ন চোখে একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল, আর তাদের সেই চোখে ছিল প্রশ্ন, আশঙ্কা, আর চরম অনিশ্চয়তা, কেননা তারা ইতিমধ্যেই জানত যে গত রাতে শিকারি ধরা পড়েছে অরণ্যের বুকের ফাঁদে, আর সেই খবরে যেন বাতাসে শত্রুতার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল; বিনোদ সর্দার, যে এতকাল মুখোশ পরে গ্রামের ভরসার আশ্রয় হয়ে ছিল, সেই মুখোশের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যার জাল বুনছিল—গলায় ভরসার মিথ্যা সুরে বলছিল, “গ্রামের মানুষজন, অযথা ভয় পেয়ো না, এই অশান্তি অরণ্যের গুজব মাত্র, আমরা যে কাজের ব্যবস্থা করছি শহরের ভালোমানুষদের সঙ্গে, তাতে তোমাদের মেয়েদের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে, এই ফাঁদ-টাঁদ পাতার গল্প সবই কিছু বেপরোয়া ছেলেমেয়ের খেয়ালখুশি, গ্রামটাকে অশান্ত করার ষড়যন্ত্র”—তবু তার কণ্ঠের ওই কৃত্রিম কোমলতা গ্রামবাসীর অনেকের কানেই ফাটল ধরা বাঁশির মতো বেজে উঠছিল; আর ঠিক তখনই অন্ধকারের বুক চিরে রূপসী এগিয়ে এল, তার কণ্ঠে বজ্রনিনাদ, মুখে অরণ্যের জেদ আর শপথের দীপ্তি, সে বলল, “তোমার মুখোশ খুলে ফেলো বিনোদ সর্দার, শহরের লোকের নাম করে যে শিকারিরা এসেছে, তাদের চক্রান্ত অরণ্য জানে, আমি জানি, এই গ্রামের মেয়েরা কারও শিকার হবে না, যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি, অরণ্যের কন্যারা অরণ্যের বুকেই থাকবে”—তার ওই কথা শোনার পর জনতার মধ্যে দ্বন্দ্বের বাতাস বয়ে গেল, কেউ রূপসীর কথায় আশ্বাস পেল, কেউ বিনোদের প্রলোভনে নিজের মনের দুর্বলতাকে লুকিয়ে রাখল, আর সেই রাতেই যেন অরণ্যের নিস্তব্ধতা ভেঙে ছিঁড়ে পড়ল এক মায়ের আর্তনাদে—মালতির মা, যার কিশোরী মেয়ে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, তার বুকফাটা কান্না বনের শালপাতা গাছের ডালে ডালে প্রতিধ্বনি তুলল; রূপসীর চোখে ঘুম নেই, সে গগনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অরণ্যের বুকের গহীনে, শাল আর মহুয়ার গাছের ছায়া তার শরীরকে ঢেকে রাখছিল, তারা নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে চলল, বাতাস কানে ফিসফিসিয়ে শোনাল অশুভ ছায়ার কথা, দূরে দেখা গেল ম্লান আগুনের আভা, শোনা গেল শিকারিদের ফিসফাস—“মেয়েটাকে তোল, বেশি দেরি হলে বিপদ হবে, বিনোদ সব বন্দোবস্ত করেছে”, সেই দৃশ্য দেখে রূপসীর বুকের রক্ত গরম হয়ে উঠল, চোখ দুটো অরণ্যের আগুনে দীপ্ত হল, সে তীর ছুঁড়ে মারল, তীর গিয়ে লাগল এক শিকারির হাতে, হঠাৎ বনের বুক জেগে উঠল—পাখিরা ডানা ঝাপটাল, শিয়ালের ডাক জোরাল হল, গগন লাঠি হাতে পাশে দাঁড়াল, আর শিকারিরা হকচকিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে অরণ্যের কাঁটাঝোপ, শেকড় আর পাথরের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ল, মালতিকে তারা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অরণ্যের অন্ধকারে হারিয়ে গেল; রূপসী দৌড়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে কাঁপতে থাকা মালতিকে বুকে জড়িয়ে ধরল, আর সেই মুহূর্তে চাঁদের আলোয় ভিজে থাকা শালপাতা গাছের ছায়ায় যেন অরণ্যের মা আশীর্বাদের হাত বাড়িয়ে দিল; ভোরের আলো ফুটল, কিন্তু শালপাতা গ্রামের আকাশ থেকে অশান্তির মেঘ সরে গেল না, বিনোদের চক্রান্ত ফাঁস হলেও তার ক্ষমতার জাল টিকে থাকল, গ্রামে দুই দলে ভাগ হয়ে গেল মানুষ—এক দল রূপসীর পাশে এসে দাঁড়াল, অন্য দল লোভ আর ভয়ে বিনোদের আশ্রয়ে থেকে গেল; রূপসী তখন স্থির করল যে রাতের অন্ধকারের লড়াই যথেষ্ট নয়, দিনের আলোতেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, সে গ্রামের যুবকদের ডাকল, বোঝাল যে অরণ্যের ডাক শোনা মানে নিজেদের অস্তিত্বকে বাঁচানো, শালগাছের ছায়া, মহুয়ার মিষ্টি গন্ধ, পলাশের লাল আগুন শুধু সৌন্দর্য নয়, এরা তাদের রক্ষাকবচ, তারা দিনভর অরণ্যের ভেতরে ফাঁদ তৈরি করতে লাগল—পাথরের ব্যারিকেড, লতার ফাঁদ, শালপাতা দিয়ে ঢাকা গর্ত, শুকনো কাঁটার বেষ্টনী, আর অরণ্যের প্রতিটি গাছ যেন নিঃশব্দে তাদের সাথে শপথ নিল, সেই রাতে আবার শিকারিরা এল, কিন্তু এবার অরণ্য জেগে ছিল, একের পর এক ফাঁদে তারা ধরা পড়ল, অরণ্যের বুক থেকে তীর ছুটে গিয়ে শিকারিদের রক্তে মিশে গেল, গগন আর রূপসী শালপাতা গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে শিকারিদের বেঁধে ফেলল, আর শালপাতা গ্রামের আকাশে রাতের অন্ধকার ভেদ করে ভোরের নতুন সূর্যরশ্মি জানান দিল—এই লড়াই শেষ নয়, এই অরণ্য আর তার সন্তানেরা লড়বে যতক্ষণ শ্বাস আছে, যতক্ষণ অরণ্য বাঁচে।
অধ্যায় ৬:
সেই রক্তাক্ত যুদ্ধের রাত পেরিয়ে শালপাতা গ্রামে যখন নতুন সূর্যের আলো ফুটল, তখন বনের বুক জুড়ে ছড়িয়ে ছিল ধোঁয়ার গন্ধ, ভাঙা পাথর, লতাজালের টুকরো আর শিকারিদের পড়ে থাকা জিনিসপত্রের ছিটেফোঁটা, আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল রূপসী—মাটির ধুলোয় মাখা মুখ, চোখে আগুনের মতো জেদ, সে জানত এই লড়াইয়ের শেষ এখানেই নয়, বিনোদের মতো মানুষ আর শিকারিরা নতুন করে জাল বুনবে, শহরের বড় বড় দালালরা আরও বড় চক্র নিয়ে অরণ্যের বুক চিরে ঢুকতে চাইবে, আর তাই এই লড়াইয়ের শিকড় আরও গভীরে পুঁতে দিতে হবে, সেই ভাবনা মাথায় নিয়ে সে গগন, কেলো, ভোলা আর গ্রামের বাকি যুবক-যুবতীদের ডেকে শালগাছের বড় চাতালে একত্র করল, শালপাতা, মহুয়া আর পলাশের গাছের ছায়ায় বসে তারা শপথ নিল—“যতক্ষণ শ্বাস আছে, অরণ্যের প্রতিটি শিকড়কে রক্ষা করব, শিকারিদের হাত থেকে মেয়েদের বাঁচাব, বিনোদের মতো বেইমানদের মুখোশ খুলে দেব”, আর সেই শপথের সাক্ষী রইল অরণ্যের বাতাস, শালপাতার পাতার মৃদু কাঁপন, পাখিরা দূর থেকে ডেকে উঠল, যেন তারা সেই শপথের বার্তা নিয়ে বনের প্রান্ত থেকে প্রান্তে ছড়িয়ে দিল, তারপর রূপসী ও তার সঙ্গীরা বেরিয়ে পড়ল বনের গহীনে শিকারিদের মূল ঘাঁটির সন্ধানে, ঝোপঝাড়, কাঁটাঝোপ, শিকড় আর পাথরের গড়ন তাদের পথ দেখাল, দিনভর তারা বনের লুকানো গুহা, ভাঙা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, শিকড়ে ঢাকা পুরোনো কুয়ার পাড় চষে ফেলল, আর সন্ধ্যার আগে খুঁজে বের করল এক গোপন আস্তানা যেখানে শিকারিরা দিনের আলোয় লুকিয়ে থাকে, সেই জায়গায় পা রেখে রূপসীর চোখ আরও কঠিন হয়ে উঠল, সে গগনকে বলল—“দেখ, এদের শেষ চক্রটা এখানেই লুকিয়ে আছে, এবার আমরা বনের প্রতিটি গাছ, শিকড়, পাথর আর লতা নিয়ে এদের ঘিরে ফেলব, যেন পালানোর রাস্তা না থাকে”, গগন সম্মতি জানিয়ে লাঠি শক্ত করে ধরল, কেলো হাতে পাথর তুলল, ভোলা ছুরি বের করল, আর অরণ্যের বাতাস যেন তাদের পাশে এসে ফিসফিসিয়ে বলল—‘আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি’, সেই রাতেই রূপসীর দল ছড়িয়ে পড়ল বনের চারপাশে, ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে শিকারিদের গোপন আস্তানার দিকে নজর রাখল, বিনোদ দূর থেকে শহরের দালালদের নিয়ে এসে অরণ্যের বুক চিরে ঢোকার চেষ্টা করল, কিন্তু বনের অন্ধকারে রূপসীর ছায়া আর অরণ্যের প্রতিটি লতা শিকড় হয়ে উঠল প্রতিরোধের অস্ত্র, শিকারিরা অন্ধকারে হকচকিয়ে দৌড়াতে গিয়ে পড়ল কাঁটার জালে, শালপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফাঁদে আটকে গেল, রূপসী ধনুক টেনে তীর ছুঁড়ল এক শিকারির পায়ে, আর তখন অরণ্য যেন বিজয়গাথা গাইতে শুরু করল—ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ, শিয়ালের ডাক, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ মিলে তৈরি হল এক বুনো যুদ্ধসঙ্গীত, বিনোদের মুখ থেকে মুখোশ খুলে গেল, তার চোখে ভয় আর লজ্জা মিশিয়ে সে পড়ে গেল রূপসীর পায়ে, আর সেই ভোরে শালপাতা গ্রামের মানুষজন প্রথমবার দেখল কীভাবে অরণ্য আর তার সন্তান একসঙ্গে লড়ে শিকারি আর বিশ্বাসঘাতকদের হারাতে পারে, রূপসী তখন গ্রামের মেয়েদের হাত ধরে শপথ নিল—“এই অরণ্যের বুক আমরা বাঁচিয়ে রাখব, যতদিন বাঁচব, শিকারিদের হাত যেন আর আমাদের কন্যাদের ছুঁতে না পারে”, আর শালপাতা গাছের পাতা সেই শপথের সাক্ষী হয়ে ঝরে পড়ল অরণ্যের মাটিতে।
অধ্যায় ৭:
শালপাতা গ্রামের বুকে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছিল, শালগাছের পাতায় সূর্যের কিরণ ঝলমল করছিল, কিন্তু রূপসীর চোখে সেই আলো পৌঁছায়নি; তার চোখে তখনও আগুনের শিখা জ্বলছিল, কেননা সে জানত অরণ্যের বুক থেকে শিকারি আর বিনোদের মতো বিশ্বাসঘাতকদের হটানো গেলেও লড়াই শেষ হয়নি, লড়াইয়ের আসল শত্রু শহরের সেই দালালরা, যারা টাকার লোভে অরণ্যের কন্যাদের বিক্রি করে দেয়, অরণ্যের শাল, মহুয়া আর পলাশ গাছের বুক চিরে লুট করে নিয়ে যায় সবুজ, তাই রূপসী ঠিক করল এবার তার লড়াই পৌঁছাবে শহরের বুক পর্যন্ত; গগন, কেলো, ভোলা আর কয়েকজন যুবককে সঙ্গে নিয়ে সে পা বাড়াল শহরের দিকে যাওয়া কাঁচা পথ ধরে, শালপাতা গাছের ছায়া থেকে বিদায় নিল, আর বনের বাতাস যেন ফিসফিসিয়ে বলল—“ফিরে এসো বিজয়ী হয়ে, কন্যা”; সেই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে রূপসীর চোখে ভেসে উঠছিল অরণ্যের ফেলে যাওয়া রাতের রক্তাক্ত স্মৃতি, আর পেছনে শোনা যাচ্ছিল গ্রামের মায়েদের আশীর্বাদের কণ্ঠস্বর; শহরে পৌঁছে তারা প্রথমে লুকিয়ে নজর রাখল সেই বড় বাড়িগুলোর দিকে যেখানে বিনোদের মতো দালালরা গিয়ে শহরের দালালদের খবর দেয়, তারা এক ঝুপড়ি চায়ের দোকানে বসে শহরের মানুষের কথাবার্তা শুনল—“আজ ওই শালপাতা গ্রামের মেয়েগুলো আসার কথা ছিল, কী জানি কেন খবর নেই”, “বড় বাবুরা খুব ক্ষ্যাপা”, এই কথা শুনে রূপসীর মনের ভেতর জেদ আরও পোক্ত হল, সে বুঝল শহরের বুকেই শিকড় ছড়িয়ে আছে এই চক্রের, রাতের অন্ধকারে তারা গিয়ে পৌঁছাল সেই বড় বাড়ির কাছে যেটা শহরের সবচেয়ে কুখ্যাত দালালের ঘাঁটি বলে পরিচিত, গগন আর কেলো পেছনের গলি দিয়ে ঢুকে জানালার ফাঁক দিয়ে নজর রাখল, আর রূপসী গাছের ছায়ায় লুকিয়ে দেখল কেমন করে বড় বড় বাবু আর দালালরা অরণ্যের মেয়েদের তালিকা তৈরি করছে, কাকে কত দামে বেচা হবে তার হিসাব কষছে, সেই দৃশ্য দেখে রূপসীর বুকের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল, সে গগনকে ইশারা করল, গগন পাথর ছুঁড়ে জানালার কাঁচ ভেঙে দিল, ভেতরে হুলুস্থুল পড়ে গেল, দালালরা ছুটে বেরিয়ে এলো, আর রূপসী আর তার সঙ্গীরা তাড়া করল, শহরের গলি ধরে দালালরা পালানোর চেষ্টা করল কিন্তু রূপসীর দলের পাথর, লাঠি আর তীর-ধনুকের সামনে তারা টিকতে পারল না, শহরের মানুষ জানল এই প্রথম অরণ্যের কন্যারা শহরের বুকেও লড়াই করতে নেমেছে, দালালদের কয়েকজন ধরা পড়ল, পুলিশ এসে তদের গ্রেফতার করল, আর রূপসী দাঁড়িয়ে থেকে দেখল কিভাবে শহরের মানুষ ধীরে ধীরে তাদের লড়াইকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করল, তারপর রূপসী শপথ নিল—“এ লড়াই থামবে না, অরণ্যের ডাক শুধু অরণ্যের ভেতর নয়, শহরের বুকে বুকে ছড়িয়ে পড়বে, যতদিন শিকারি আর লোভী দালালরা অরণ্যের দিকে নজর রাখবে, ততদিন আমরা লড়ব, আমরা বাঁচব, আমরা বাঁচাবো”, আর সেই সময় ভোরের আলো শহরের দেওয়ালে পড়ে এক নতুন সূর্যের আগমনের আভাস দিল।
অধ্যায় ৮:
শহরের বুক থেকে যখন রূপসী আর তার সঙ্গীরা ফিরে এল শালপাতা গ্রামের মাটিতে, তখন অরণ্যের বাতাস যেন ক্লান্ত বিজয়ীর শ্বাসে ভরপুর, শালগাছের পাতাগুলো হাওয়ায় মৃদু নেচে তাদের স্বাগত জানাল, কিন্তু রূপসীর মুখে ছিল না কোনো বিজয়ের হাসি, কারণ সে জানত এই লড়াইয়ের শেষ হয়নি, সে জানত শহরের দালালরা, শিকারিরা, আর তাদের পেছনের বড় বড় পুঁজিপতিরা একজোট হয়ে এবার অরণ্যকে শেষ করার ষড়যন্ত্র করছে, তার বুকের শাল, মহুয়া, পলাশ, অজস্র গাছপালা কেটে সাবাড় করে সেই জায়গায় কারখানা, খনি আর চুন কারখানা বসানোর ছক কষছে; রাতের অন্ধকারে যখন পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে পড়ে, রূপসী গগন আর কেলোকে সঙ্গে নিয়ে বনের গহীনে বেরিয়ে পড়ে, দূরে পাহাড়ের পাদদেশে দেখা যায় দালালদের আসা-যাওয়া, বিশাল ট্রাক, মেশিনের গর্জন, তারা বুঝতে পারে অরণ্যের বুকের নিচে লুকিয়ে থাকা খনিজ সম্পদের দিকে শিকারিদের লোভের নজর পড়েছে, আর সেই লোভ মেটাতে তারা অরণ্যকেই শেষ করতে পিছপা হবে না; রূপসীর বুকের ভেতর তখন আগুন জ্বলে ওঠে, সে শপথ করে —“যতদিন শ্বাস আছে, অরণ্যের শেষ শিকড়টিও শিকারির হাত থেকে রক্ষা করব”, সে গ্রামের মানুষজনকে ডাকে, বোঝায় —“অরণ্য শুধু গাছ নয়, অরণ্য আমাদের মা, আমাদের অস্তিত্ব, যদি অরণ্য না থাকে, আমরা থাকব না”, গ্রামের মায়েরা, যুবক-যুবতীরা একত্র হয়, শালগাছের চাতালে দাঁড়িয়ে শপথ নেয়, রাতের নিস্তব্ধতায় সেই শপথের আওয়াজ বনের শালপাতা, মহুয়া আর পলাশের ডালে ডালে প্রতিধ্বনিত হয়; ঠিক তখনই এক কালরাত্রি নেমে আসে, শিকারিরা বিশাল লরি নিয়ে অরণ্যের বুক চিরে ঢুকে পড়ে, মেশিনের গর্জনে বনের প্রাণীরা ছুটোছুটি শুরু করে, শালগাছের শিকড় কেটে পড়ে যায় মাটিতে, অরণ্যের বুক কেঁপে ওঠে, বাতাসে ভেসে আসে ধুলোর ঝড়, সেই রাতের আঁধারে রূপসী, গগন আর তাদের সঙ্গীরা লড়াই শুরু করে — পাথর ছোঁড়ে, লতাজাল দিয়ে গাড়ির চাকা আটকায়, তীর-ধনুক নিয়ে শিকারিদের দিকে ধেয়ে যায়, শিকারিরা গুলি চালায়, অরণ্যের শিকড় রক্তে ভিজে যায়, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধ, কিন্তু রূপসীর চোখে ভয় নেই, তার চোখে শুধু অরণ্যের কান্না, তার ধনুকের তীর এক শিকারির হাতে বিঁধে যায়, গগনের লাঠির বাড়ি আর কেলোর পাথরের আঘাতে শিকারিরা দিশেহারা হয়ে পড়ে, কিন্তু তাদের পেছনে রয়েছে শহরের বড় বড় পুঁজিপতিরা, তারা পুলিশের ছত্রছায়ায় এসে পড়ে অরণ্যের বুকে, রূপসী তখন শপথ করে—“আমরা শুধু তীর-ধনুক নয়, বনের প্রতিটি গাছ, শিকড়, পাথরকে অস্ত্র বানাব, আমাদের লড়াই শুধু শিকারিদের সঙ্গে নয়, শহরের লোভের বিরুদ্ধে, এই অরণ্যের প্রতিটি প্রাণকে বাঁচাতে হবে”; সেই রাতের শেষে শালপাতা গ্রামে নতুন ভোর নামে না, নামে এক অজানা আশঙ্কার সকাল, অরণ্যের বুক রক্তাক্ত, শালপাতার গাছের ছায়া যেন কাঁদছে, আর রূপসী দাঁড়িয়ে আছে শালগাছের চাতালে, চোখে অশ্রু আর অগ্নিশপথের দীপ্তি নিয়ে।
অধ্যায় ৯:
যেদিন অরণ্যের বুক ছিঁড়ে শিকারিদের লরি, মেশিন আর বারুদের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল, সেদিনই অরণ্য যেন চিরঘুম থেকে জেগে উঠল, শাল, মহুয়া, পলাশ গাছের শিকড়ের ভেতর দিয়ে যে রক্তের স্রোত বয়ে যায়, সেই স্রোতে যেন জাগরণ বেজে উঠল, আর রূপসীর চোখে সেই জাগরণের প্রতিফলন দেখা গেল—তার চোখে ছিল প্রতিশোধের আগুন, শপথের দীপ্তি আর অরণ্যের প্রাণের ডাক, সে গগন, কেলো, ভোলা আর শালপাতা গ্রামের সমস্ত মানুষকে নিয়ে শালগাছের চাতালে দাঁড়াল, তার কণ্ঠে বজ্রনিনাদ—“শোনো! আজ থেকে আমরা শুধু মানুষ নই, অরণ্যের সন্তান, আজ থেকে এই অরণ্যের প্রতিটি শাল, মহুয়া, পলাশ, কাঁটা-লতা আমাদের ভাই-বোন, বন্ধুর মতো রক্তে রক্ত মিশিয়ে লড়বে, শিকারিদের হাত থেকে মায়ের বুক রক্ষা করবে”—তার সেই আহ্বান শুনে অরণ্যের বাতাস যেন হুঙ্কার তুলল, শালপাতা গাছের পাতা ঝরে পড়ে মাটিতে বিক্ষোভের মতো ছড়িয়ে পড়ল, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে, শিয়ালের আর্তনাদে, পাখিদের ডানার শব্দে অরণ্য এক অদৃশ্য যুদ্ধসঙ্গীত রচনা করে ফেলল; সেই রাতে রূপসীর নেতৃত্বে শুরু হল অরণ্যের বিদ্রোহ—গ্রামের যুবক-যুবতীরা গাছের শিকড়, কাঁটার ঝোপ দিয়ে অরণ্যের ভেতরে ফাঁদ তৈরি করল, শুকনো মহুয়া পাতা জড়ো করে শিকারিদের মেশিনের কাছে আগুন ধরিয়ে দিল, পাথরের ব্যারিকেড বানিয়ে লরির রাস্তা বন্ধ করে দিল, বনের প্রতিটি শেকড় যেন শিকারিদের পায়ের কাছে ফাঁস হয়ে উঠল, পলাশ গাছের লাল ফুল মাটিতে ঝরে যুদ্ধের রক্তের আভা ছড়িয়ে দিল, সেই রাতের আঁধারে শিকারিরা আর শহরের দালালরা পুলিশের ছত্রছায়ায় অরণ্যে ঢোকার চেষ্টা করল, কিন্তু অরণ্য যেন তাদের দিকে তাণ্ডব নেমে আসা ঝড়ের মতো ধেয়ে গেল, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, কাঁটার খসখসানি, লতার ফাঁস, শালগাছের ভাঙা ডাল ঝড়ের মতো পড়ে শিকারিদের পথ রোধ করল, রূপসীর ধনুকের তীর অন্ধকার ছেদ করে শিকারিদের বুকে বিঁধে গেল, গগনের লাঠির আঘাতে এক শিকারি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, কেলোর পাথর ছুটে এসে লরির কাচ ভাঙল, শিকারিরা আতঙ্কিত হয়ে গুলি ছুঁড়ল, কিন্তু অরণ্যের ঘন লতা, শালগাছের মোটা কাণ্ড তাদের আড়াল দিল, সেই রাতে অরণ্য আর রূপসীর দল মিলে শিকারিদের পরাস্ত করল, পুলিশের সঙ্গে আসা দালালরা পিছু হটে পালাতে বাধ্য হল, গ্রামের মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে শালপাতার ঘেরাটোপে আশ্রয় নিল, শালগাছের পাতায় পাতায় বাতাসে বয়ে গেল রক্ত আর প্রতিশোধের গন্ধ, আর ভোরের আলো ফুটে উঠল অরণ্যের বুক জুড়ে বিজয়ের প্রতিশ্রুতি নিয়ে; রূপসী তখন শপথ করল—“এই বিদ্রোহ শেষ নয়, যতক্ষণ অরণ্যের বুক বেঁচে আছে, যতক্ষণ এই শালপাতা গ্রামে প্রাণ আছে, ততক্ষণ শিকারি আর লোভী শহরের মানুষ অরণ্যের বুকে পা রাখতে পারবে না”, আর শালপাতা গাছের ছায়া সেই শপথের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিঃশব্দে, বাতাসে ভেসে গেল অরণ্যের বিদ্রোহের গান।
অধ্যায় ১০: অরণ্যের জয়
—
সেই ভোরের আলো যখন শালপাতা গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে শালপাতা গ্রামের মাটিতে পড়ল, তখন অরণ্যের বুক জুড়ে বিজয়ের শ্বাস বইতে লাগল, বাতাসে মিশে ছিল আগের রাতের বিদ্রোহের বারুদের গন্ধ, রক্তের লাল দাগ আর ভাঙা পাথর, কাঁটার ঝোপ আর লতার ফাঁসের ছড়িয়ে থাকা দাগ—যা ছিল অরণ্যের লড়াইয়ের ইতিহাসের সাক্ষী, আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল রূপসী, চোখে জেদ আর মুখে ক্লান্তির ছায়া, কিন্তু বুকে ছিল শান্তির এক অজানা অনুভূতি, কারণ সে জানত এই অরণ্য রক্ষা পেয়েছে শিকারিরা, দালালরা আর লোভী পুঁজিপতিদের হাত থেকে; সেই রাতের শেষে যখন শিকারিরা, পুলিশের ছত্রছায়ায় থাকা দালালরা আর শহরের লোভী মানুষরা অরণ্যের বুক থেকে পিছু হটে পালিয়ে গিয়েছিল, তখন অরণ্য যেন নিজের সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ জানিয়েছিল, শালগাছের ছায়া নেমে এসেছিল রূপসীর মাথার উপর, পলাশের লাল ফুল ঝরে পড়েছিল বিজয়ের রক্তরঙ আভা হয়ে, আর মহুয়ার গন্ধ মিশে গিয়েছিল বাতাসে; রূপসী তখন গ্রামের মানুষজনকে নিয়ে শালগাছের চাতালে দাঁড়াল, তার কণ্ঠে গর্জন—“আজ আমাদের লড়াই শেষ নয়, আমাদের লড়াই শুরু হয়েছে অরণ্যকে বাঁচানোর শপথ নিয়ে, এই অরণ্যের প্রতিটি শালগাছ, মহুয়া গাছ, পলাশের ডাল, কাঁটার ঝোপ, লতার ফাঁস, পাখি, শিয়াল, হরিণ সবাই আমাদের আত্মা, আমরা ওদের রক্ষা করব, যতক্ষণ শ্বাস আছে, আমরা এই অরণ্যের রক্ত, আমরা এই অরণ্যের আত্মা”, তার সেই কথায় গ্রামের মানুষজন, বাচ্চা থেকে বুড়ো পর্যন্ত একসঙ্গে শপথ নিল—“অরণ্য আমাদের মা, অরণ্যকে বাঁচাতে জীবনও দিতে পিছপা হব না”, সেই শপথের আওয়াজ শালগাছের ডাল থেকে মহুয়ার পাতা পর্যন্ত বয়ে গেল, বাতাসে ভেসে গেল অরণ্যের জয়ের গান, আর সেই জয়ের সাক্ষী রইল ভাঙা ব্যারিকেড, শিকারিদের ফেলে যাওয়া লরি আর গুলি, লতার ফাঁস, পাথরের ব্যারিকেড, শালগাছের কাণ্ডে লেগে থাকা শিকারিদের রক্তের ছাপ; সেই দিন বিকেলে শহরের বড় বড় কাগজে খবর ছাপা হল—“শালপাতা গ্রামের অরণ্যের বিদ্রোহ, শিকারিদের লাঞ্ছনা, অরণ্যের সন্তানদের বিজয়”, শহরের মানুষ বিস্মিত হয়ে জানল কীভাবে অরণ্যের বুকের মানুষ আর প্রকৃতি একসঙ্গে লড়ে শিকারি আর লোভী মানুষের লালসা থামিয়ে দিয়েছে, আর সেই খবর পড়ে আরও দূরের মানুষও অরণ্যের রক্ষায় এগিয়ে আসতে শুরু করল, রূপসীর লড়াই হয়ে উঠল এক প্রতীক, অরণ্য বাঁচানোর মন্ত্র, আর শালপাতা গ্রামের বাতাসে ভেসে যেতে লাগল সেই মন্ত্র—“অরণ্য বাঁচলে আমরা বাঁচব, অরণ্য বাঁচলে জীবন বাঁচবে”, রূপসী তখন বনের শালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ধনুক তীর নামিয়ে রাখল, হাত দিয়ে শালগাছের গুঁড়িতে স্পর্শ করে কপাল ঠেকাল, আর শালপাতা গাছের ছায়া যেন তার মাথায় আশীর্বাদের হাত রাখল, শিয়াল ডেকে উঠল বিজয়ের সুরে, পাখিরা ডানার ঝাপটায় গাইতে লাগল অরণ্যের জয়ের গান, আর শালপাতা গ্রামের আকাশে নামল শান্তির নীল আলোর মেলা।
—
				
	

	


