Bangla - রহস্য গল্প

অরণ্যের গোপন মানচিত্র

Spread the love

ঋত্বিক দাশগুপ্ত


পর্ব ১ : হারিয়ে যাওয়া ডায়েরি

কোলকাতার পুরোনো উত্তর শহরের ভাঙাচোরা গলির ভেতর এক নিস্তব্ধ বিকেলে অরিন্দম দত্ত নিজের বাবার কাঠের আলমারিটা খুলে বসেছিল। ধুলো জমে থাকা পুরোনো কাগজ, শুকনো কালির দাগ, আর অচেনা হিজিবিজি আঁকায় ভর্তি খাতাগুলো সবসময়ই তাকে টানত। বাবা ছিলেন একসময়ের ভ্রমণপিপাসু, যিনি চাকরি আর সংসারের চাপে সেই টানকে গুছিয়ে রেখেছিলেন আলমারির অন্ধকারে। বাবার মৃত্যুর দু’বছর পরেও অরিন্দম প্রায়ই এই আলমারিটা খুঁজে খুঁজে দেখত, যেন কোথাও লুকিয়ে আছে বাবার জীবনের অজানা কোনো গল্প।

সেই বিকেলেই তার চোখে পড়ল চামড়ার মলাট বাঁধানো এক ডায়েরি। হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলো ছুঁয়ে অরিন্দমের শরীরে কেমন এক অদ্ভুত শিহরণ জাগল। প্রথম পাতায় লেখা ছিল— ১৯৮৫, ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে শুরু হয়েছিল আমার অনুসন্ধান। যদি কেউ কখনও এই ডায়েরিটা খুঁজে পায়, জেনে রাখো— সব রহস্য মানচিত্রে নয়, মানুষের ভিতরেও থাকে।”

অরিন্দম থমকে গেল। ঝাড়গ্রামের জঙ্গল! সে ছোটবেলা থেকেই শুনেছে, বাবা নাকি একবার কোন অজানা অভিযানে গিয়েছিলেন কিন্তু ফিরে এসে আর কিছু বলেননি। তখন শুধু পরিবারকে বলেছিলেন, “ভ্রমণটা বৃথা গেল।” কিন্তু ডায়েরির পাতায় লেখা কাহিনি যেন একেবারেই অন্য রকম।

ডায়েরির পাতা উল্টাতেই বেরিয়ে এল এক অদ্ভুত হাতের আঁকা মানচিত্র। কাগজে কালি ফ্যাকাশে হয়ে গেলেও বোঝা যায় পাহাড়, নদী, আর ঘন অরণ্যের চিহ্ন কাটা আছে। পাশে লেখা— শালবনের গভীরে লুকোনো আছে যে জিনিস, তা খুঁজে বের করলে ইতিহাস বদলাবে।”

অরিন্দমের বুক ধকধক করতে লাগল। এ কি শুধুই এক বৃদ্ধ ভ্রমণপিপাসুর কল্পনা, না সত্যিই কোনো গোপন রহস্য?

সে রাতেই অরিন্দম বসে পড়ল ডায়েরি পড়তে। প্রতিটি পাতায় বাবার হাতে আঁকা বর্ণনা— শালগাছের নিচে অদ্ভুত পাথরের বেদি, জঙ্গলের ভেতর অচেনা শব্দ, অদৃশ্য শিকারির উপস্থিতি। এক জায়গায় লেখা— আমি জানি আমাকে অনুসরণ করছে কেউ। যদি আমি ফিরতে না পারি, এই ডায়েরিই হবে আমার উত্তরাধিকার।”

ডায়েরি পড়তে পড়তে অরিন্দমের মনে হল, এই শব্দগুলো শুধু গল্প নয়, এক ধরনের ইঙ্গিত। বাবার অচেনা চোখের দৃষ্টি, যা ছোটবেলায় এতবার দেখেছে, হয়তো এই রহস্যেরই অংশ ছিল।

কিন্তু রহস্যের ভেতর ঢুকতে গেলে তাকে একা যাওয়া যাবে না। অরিন্দমের মনে পড়ল শৈশবের বন্ধু রোহন আর মেঘলার কথা। রোহন পেশায় সাংবাদিক, সবসময় নতুন কিছু খোঁজে, আর মেঘলা ইতিহাসের ছাত্রী— প্রাচীন মানচিত্র, শিলালিপি নিয়ে তার আগ্রহ অপরিসীম। যদি তারা একসঙ্গে মিলে এই ডায়েরির রহস্য উন্মোচন করতে চায়, তবে হয়তো সত্যিই পাওয়া যাবে বাবার খুঁজে না পাওয়া উত্তর।

পরদিন সন্ধ্যায় কলেজ স্ট্রিটের এক চায়ের দোকানে অরিন্দম ডায়েরিটা নিয়ে হাজির হল। রোহন সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বলল, “তুই কি বলতে চাইছিস, তোর বাবা আসলে কোনো গুপ্তধন বা অচেনা সভ্যতার খোঁজে বেরিয়েছিল?”

মেঘলা সতর্ক চোখে মানচিত্রটা দেখছিল। সে বলল, “এটা সাধারণ মানচিত্র নয়। দেখ, নদীর বাঁকের পাশে যে প্রতীকটা আছে, এটা প্রাচীন শবর উপজাতির টোটেম চিহ্ন। বইয়ে পড়েছিলাম, তারা বিশ্বাস করত জঙ্গলের গভীরে আত্মারা পাহারা দেয়।”

অরিন্দম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “তোমরা যদি আমার সঙ্গে যেতেই চাও, তাহলে কাল থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। ডায়েরির তারিখ আর লেখার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বাবা জঙ্গলের কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়েছিলেন। হয়তো এখনও সেই চিহ্নগুলো আছে।”

রোহন উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “আমি আছি। তবে একটা শর্ত— আমি এই অভিযানের নথি রাখব। একদিন এই গল্প ছাপা হবে প্রথম পাতায়।”

মেঘলা হাসল। “আমি আছি, কিন্তু আমি এই মানচিত্রটা ভালো করে গবেষণা করতে চাই। যদি সত্যিই এখানে কোনো অচেনা ইতিহাস লুকিয়ে থাকে, তবে সেটাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার।”

তিনজনের চোখে তখন জ্বলছিল অদম্য কৌতূহল। অরিন্দম হঠাৎ বাবার কথা মনে করল— সব রহস্য মানচিত্রে নয়, মানুষের ভিতরেও থাকে।” মনে হল, হয়তো সত্যিই এ এক যাত্রার ডাক।

সেই রাতে অরিন্দম ঘরে ফিরে ব্যাগ গোছাতে লাগল। টর্চ, কম্পাস, ক্যামেরা, কিছু শুকনো খাবার আর বাবার পুরোনো ডায়েরি। জানালার বাইরে পূর্ণিমার আলোয় ভেসে যাচ্ছিল শহর। মনে হচ্ছিল অদৃশ্য এক হাত তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে শালবনের গভীরে।

ঘুম আসেনি সেদিন। বারবার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তাকে দেখছে। ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা একটি লাইন মনে পড়ল— যদি কেউ সত্যিই এই পথে পা বাড়ায়, তবে জেনে রাখো— অনুসন্ধান শুধু ধনসম্পদের জন্য নয়, আত্মারও।”

ভোরে অরিন্দম প্রস্তুত। সামনে অপেক্ষা করছে অজানা এক অভিযান, যা হয়তো বদলে দেবে তার জীবন।

পর্ব ২ : অদ্ভুত মানচিত্রের রহস্য

ট্রেনের কামরায় বসে তিনজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল— অরিন্দম, রোহন আর মেঘলা। ঝাড়গ্রামের উদ্দেশে ভোরবেলা তারা হাওড়া থেকে ছেড়ে এসেছে। কামরার জানালার বাইরে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল দৃশ্য— শহরের কংক্রিট থেকে ধীরে ধীরে সবুজ মাঠ, ছোট গ্রাম, আর দূরে পাহাড়ের রেখা। ডায়েরির মানচিত্র আরেকবার খুলে টেবিলের ওপর রাখল অরিন্দম।

মেঘলা চোখ ছোট করে মানচিত্রটা দেখছিল। সে বলল, “দেখ, নদীর বাঁকটা খুব স্পষ্ট করে আঁকা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আধুনিক মানচিত্রে এই নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই।”

রোহন হেসে বলল, “মানে ভূগোল বইয়ের বাইরে এক অদৃশ্য নদী? এ তো একেবারে রোমাঞ্চকর খবর।”

অরিন্দম গম্ভীরভাবে বলল, “বাবার ডায়েরিতে লেখা আছে— জলধারা যার স্রোত কেউ জানে না, সেই নদীই নিয়ে যাবে বনের অন্তরে।’ আমি ভাবছি, হয়তো কোনো শুকিয়ে যাওয়া পুরোনো নদী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি কেন এটা এত গোপন রেখেছিলেন?”

মেঘলা নিজের ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করে কিছু নোট দেখাল। “আমি রাতে খুঁজছিলাম। শবর উপজাতি নিয়ে কিছু গবেষণাপত্রে পড়লাম, তারা বিশ্বাস করত জঙ্গলের গভীরে এক আত্মা পাহারা দেয়। মানচিত্রে যে প্রতীকটা আছে, সেটা তাদের টোটেম। এর মানে হতে পারে, তোমার বাবা সেই উপজাতির কোনো চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলেন।”

রোহন বলল, “তাহলে আমাদের শুধু ভূগোল নয়, লোককথাও বুঝতে হবে। সাংবাদিকতার গন্ধ পাচ্ছি।”

ট্রেন ঝাড়গ্রাম পৌঁছাল দুপুরে। ছোট্ট স্টেশন, লালচে মাটি, আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শালগাছ। গরম হাওয়ায় গায়ে ঘাম জমে গেল। তারা তিনজন ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এল। রোহন মজা করে বলল, “আসল অভিযাত্রীরা এভাবেই তো শুরু করে— ঘামে ভিজে, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে।”

স্টেশন থেকে বেরিয়েই তারা একটা জিপ ভাড়া করল। চালক গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলল, “কোথায় যাবেন?”

অরিন্দম বলল, “শালবনের দিকে। একটু ভেতরে।”

চালক ভুরু কুঁচকে তাকাল। “সেদিকে খুব কম মানুষ যায়। রাতে তো প্রায় কেউই থাকে না। অনেক কথা শোনা যায়— বাঘ, হাতি, আবার ভূতপ্রেতের গল্প।”

রোহন হেসে উঠল, “গল্পই তো আমাদের টানে। তাই তো যাচ্ছি।”

জিপ ছুটল ধুলো উড়িয়ে। শহরের শব্দ মিলিয়ে গেল, কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর বাতাসের শব্দ। পথে মেঘলা বারবার মানচিত্রটা মেলাচ্ছিল। “দেখো, এই রাস্তার বাঁকটা একদম মিলে যাচ্ছে মানচিত্রের আঁকার সঙ্গে। মানে মানচিত্র সত্যিই ভুয়া নয়।”

অরিন্দমের বুকের ভেতর কেমন ধড়ফড় করছিল। যেন বাবার হাত ধরেই এগোচ্ছে সে।

বিকেল গড়িয়ে আসতেই তারা পৌঁছাল এক নির্জন গ্রামে। কুঁড়েঘর, কাদামাটির রাস্তা, গবাদি পশুর ডাক। গ্রামের প্রবীণ এক ব্যক্তি তাদের দেখে এগিয়ে এলেন। তার চোখে বিস্ময়, আর ভেতরে চাপা সতর্কতা।

অরিন্দম ভদ্রভাবে বলল, “আমরা বাইরে থেকে এসেছি। এই বনের ভেতরটা একটু ঘুরতে চাই। শুনেছি এখানে কিছু প্রাচীন চিহ্ন আছে।”

বৃদ্ধ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “চিহ্ন তো আছে। কিন্তু সেগুলো সবার জন্য নয়। যারা খুঁজতে যায়, সবাই আর ফেরে না।”

মেঘলা কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী জানেন? মানচিত্রে এই প্রতীকটা—” সে কাগজটা বাড়িয়ে দিল।

বৃদ্ধের চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। “এটা শবরদের টোটেম। আমাদের দাদু-ঠাকুর্দারা বলতেন, ওই প্রতীক মানে বনের রক্ষক। জঙ্গলের গভীরে যে পাথরের বেদি আছে, সেখানে যাওয়া মানেই অভিশাপ ডেকে আনা।”

রোহন অবিশ্বাসী গলায় বলল, “অভিশাপ বলে কিছু নেই কাকা। সবই কুসংস্কার।”

কিন্তু অরিন্দম লক্ষ্য করল, বৃদ্ধের চোখে ভয়ের ছায়া। সে আর কিছু না বলে তাদেরকে গ্রামে থাকার পরামর্শ দিল।

রাতে তারা গ্রামে একটা কুঁড়েঘরে আশ্রয় পেল। আলোর ব্যবস্থা ম্লান কেরোসিন ল্যাম্পে। চারপাশে নিস্তব্ধতা। অরিন্দম ডায়েরি খুলে পড়তে লাগল। বাবার লেখা এক জায়গায় লেখা— বনের গভীরে আমি এক পাথরের বেদি দেখেছি। বেদির চারদিকে টোটেম চিহ্ন। বুঝতে পারিনি এর অর্থ। কিন্তু কেউ আমাকে অনুসরণ করছিল।”

অরিন্দমের মনে হল, বাবার ছায়া যেন চারপাশে ঘুরছে। সে ফিসফিস করে বলল, “আমি এসেছি, বাবা। এবার আমি শেষ করব তোমার অসমাপ্ত যাত্রা।”

রাত যত গভীর হচ্ছিল, বাইরে শিয়ালের ডাক, ঝিঁঝিঁর শব্দ আরও স্পষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ যেন অদ্ভুত শব্দ এল— যেন কেউ কাঠের মেঝেতে হেঁটে যাচ্ছে। মেঘলা আতঙ্কিত হয়ে বলল, “শুনলে?”

রোহন ল্যাম্প তুলে দরজা খুলে বাইরে তাকাল। অন্ধকারে শুধু গাছের ছায়া। কিন্তু অরিন্দম পরিষ্কার শুনতে পেল— কারও ফিসফিসানি, যেন অচেনা ভাষা।

কিছুক্ষণ পর সব আবার স্বাভাবিক। তারা ভেতরে ফিরে এল, কিন্তু ঘুম আর এল না। অরিন্দম বারবার মানচিত্রটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল, কাল তাদের কী অপেক্ষা করছে।

সকালে বৃদ্ধ তাদের জন্য ভাত আর ডাল রেঁধে দিলেন। বিদায়ের সময় বললেন, “যদি সত্যিই যাও, তবে সাবধান থেকো। বনের ভেতর শুধু পশু নয়, মানুষেরও ফাঁদ আছে।”

জিপ ছেড়ে তারা পায়ে হেঁটে ঢুকে গেল শালবনের ভেতর। সূর্যের আলো গাছের মাথায় আটকে গিয়ে মাটিতে পৌঁছোতে পারছিল না। চারদিকে ঘন অন্ধকার, শ্যাওলা, আর অদ্ভুত নীরবতা। মনে হচ্ছিল বনের বুকেই সময় থেমে আছে।

হঠাৎ মেঘলা থেমে গেল। আঙুল দিয়ে দেখাল— একটা গাছের গায়ে খোদাই করা প্রতীক, যা মানচিত্রের টোটেমের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

অরিন্দমের বুক কেঁপে উঠল। বাবার লেখা সত্যি! মানচিত্র শুধু কল্পনা নয়।

কিন্তু ঠিক তখনই হাওয়ার সঙ্গে ভেসে এল অদ্ভুত বাঁশির সুর। তারা তিনজন একে অপরের দিকে তাকাল। কারা আছে এই জঙ্গলে? কে বাজাচ্ছে সেই সুর?

অরিন্দম মনে মনে বলল— “আমাদের যাত্রা শুরু হলো।”

পর্ব ৩ : যাত্রার শুরু

বাঁশির সুর যত এগোতে লাগল, তিনজনের বুকের ভেতর ততই কেঁপে উঠছিল অদ্ভুত ভয় আর কৌতূহল মিশ্রিত ঢেউয়ে। অরণ্যের গভীরে এমন সুর কে বাজাতে পারে? অরিন্দম হাতের মুঠোয় মানচিত্রটা শক্ত করে ধরল। তার মনে হচ্ছিল, এই সুরই হয়তো তাদের সঠিক পথে নিয়ে যাচ্ছে, আবার এটাও হতে পারে— কোনো অদৃশ্য ফাঁদ।

“চলো,” মেঘলা ফিসফিস করে বলল, তার চোখে আতঙ্ক আর উচ্ছ্বাস একসঙ্গে। “মানচিত্রে যে প্রতীকগুলো আছে, হয়তো সেই বেদির দিকেই এগোতে হবে।”

রোহন ঠোঁট কামড়ে ধরল। “কিন্তু যদি কেউ ইচ্ছে করেই আমাদের ভয় দেখাতে চায়? তুমি জানোই তো, এসব জায়গায় পাচারকারীর আনাগোনা থাকে।”

অরিন্দম থেমে গেল। সে গভীর নিশ্বাস নিয়ে বলল, “আমাদের বাবার ডায়েরির ওপর ভরসা রাখতে হবে। ও বলেছিলেন, মানচিত্রই পথ দেখাবে।”

তিনজন আবার হাঁটা শুরু করল। গাছের মাথার ফাঁক দিয়ে আলো কম ঢুকছিল, ফলে চারপাশটা আরও অন্ধকার হয়ে উঠছিল। দূরে কোথাও পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ, আবার কোথাও শুকনো পাতার ওপর হালকা চাপা পায়ের আওয়াজ। তারা প্রত্যেকেই জানত, এই অরণ্য শুধু পশুপাখির নয়— আরও কিছু আছে এখানে।

হাঁটতে হাঁটতে প্রায় এক ঘণ্টা পর তারা পৌঁছাল এক অদ্ভুত জায়গায়। চারদিকে শালগাছ ঘিরে, মাঝখানে এক খোলা প্রান্তর। প্রান্তরের মাঝখানে পাথরের তৈরি একটা কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে— যেন প্রাচীন কোনো বেদি। তার চারপাশে টোটেম প্রতীক খোদাই করা।

মেঘলা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এটাই বাবা যেটার কথা লিখেছিলেন!”

অরিন্দম ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। পাথরের ওপর হাত রাখতেই ঠান্ডা অনুভূতি তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, শিলার ভেতর থেকে কোনো অদৃশ্য শক্তি বেরোচ্ছে। সে হঠাৎ শুনতে পেল বাবার কণ্ঠস্বর— সাবধান থেকো, অরণ্য তোমাকে গ্রহণ করবে না, পরীক্ষা নেবে।”

সে চমকে উঠল। রোহন অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কী হলো?”

অরিন্দম কিছু না বলে ডায়েরির পাতাটা মেলল। সেখানে লেখা— বেদির তলায় রয়েছে আসল মানচিত্র, কিন্তু খোলার আগে মনে রেখো— প্রতিটি পদক্ষেপের মাশুল দিতে হয়।”

তারা তিনজন মিলিত প্রচেষ্টায় বেদির এক কোণ সরাতে লাগল। ভারী পাথর নড়তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক লোহার বাক্স। ধুলো মুছে দেখা গেল, বাক্সের গায়েও খোদাই করা প্রতীক।

“খুলি?” রোহন উৎকণ্ঠায় জিজ্ঞেস করল।

অরিন্দম মাথা নাড়ল। তালাটা মরচে ধরে গিয়েছিল। রোহন পকেট নাইফ বের করে কসরত করতে লাগল। খানিক পর টং করে খুলে গেল। ভেতরে গোটানো কাপড়ে মোড়া এক প্যাকেট। সেটা খুলতেই বেরিয়ে এল চামড়ার তৈরি এক পাণ্ডুলিপি।

মেঘলা সাবধানে খুলল। ভেতরে হাতে আঁকা আরও বিস্তারিত মানচিত্র। তাতে শুধু নদী আর পাহাড় নয়, এক গোপন সুড়ঙ্গের দিকও দেখানো আছে। পাশে লেখা কয়েকটি লাইন— যে নদী চোখে দেখা যায় না, তার তলদেশেই লুকিয়ে আছে রহস্য। অরণ্যের হৃদয়ে পৌঁছতে হলে পেরোতে হবে মৃত্যুর দ্বার।”

তাদের শরীর শিরশির করে উঠল। মৃত্যুর দ্বার মানে কী?

ঠিক তখনই আবার শোনা গেল সেই বাঁশির সুর। এবার অনেক কাছ থেকে। তিনজন হকচকিয়ে চারদিকে তাকাল। গাছের ফাঁক দিয়ে এক ছায়ামূর্তি যেন নড়ে উঠল। রোহন চিৎকার করে উঠল, “কে ওখানে?”

কোনো উত্তর নেই। কেবল সুরটা হঠাৎ থেমে গেল। তারপর নিস্তব্ধতা।

অরিন্দম বলল, “চল, আর দেরি করা যাবে না। কেউ আমাদের অনুসরণ করছে।”

তারা দ্রুত মানচিত্র দেখে এগোতে লাগল। পথটা ক্রমশ দুর্গম হয়ে উঠছিল। কাদা, কাঁটা, ঝোপঝাড়— সব পেরিয়ে তারা এগোল। একসময় সামনে এল নদীর ধারে। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার, নদী একেবারে শুকনো। কেবল বালুর চর আর পাথরের স্তূপ।

“এটাই সেই অদৃশ্য নদী,” মেঘলা ফিসফিস করে বলল।

অরিন্দম পাণ্ডুলিপি মিলিয়ে দেখল। সত্যিই, শুকনো নদীর তলদেশই দেখানো আছে মানচিত্রে। সেখানে এক বিন্দু চিহ্ন আঁকা— মৃত্যুর দ্বার।

তারা নদীর তলদেশে নামল। হঠাৎ কোথাও থেকে তীব্র হাওয়া বইতে লাগল। বালুর ভেতর থেকে যেন ফিসফিস আওয়াজ উঠছে। মেঘলা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এটা স্বাভাবিক নয়।”

ঠিক তখনই নদীর মাঝখানে পাথরের ঢিপির নিচে এক ফাটল দেখা গেল। মনে হচ্ছিল, ভেতরে যাওয়ার একটা পথ আছে।

রোহন বলল, “এটাই হয়তো সেই সুড়ঙ্গ।”

অরিন্দম এগিয়ে গিয়ে দেখল, সত্যিই ভেতরে অন্ধকার সুড়ঙ্গ। সে টর্চ জ্বালাল। আলোর রেখা ভেতরে ঢুকে গেল, কিন্তু শেষ দেখা গেল না।

“যদি ঢুকি, হয়তো আর ফেরা হবে না,” মেঘলা আতঙ্কে বলল।

অরিন্দম দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমরা এসেছি রহস্যের খোঁজে। যদি এখানেই গোপন ইতিহাস থাকে, তবে আমাদের ঢুকতেই হবে।”

তারা তিনজন একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে সুড়ঙ্গে নামল। অন্ধকার তাদের গ্রাস করল। শুধু টর্চের আলোয় ভেজা দেওয়ালের শ্যাওলা আর টপ টপ করে পড়া পানির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

ভেতরে ঢুকতেই অনুভব করল, চারপাশে বাতাস ঠান্ডা হয়ে গেছে। দেয়ালে অদ্ভুত প্রতীক খোদাই করা। কিছু প্রতীক মানুষের চোখ, কিছু আবার পশুর দাঁত। যেন কারও নজর তাদের ওপর।

হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দ। তারা তিনজন একসঙ্গে ঘুরে তাকাল। টর্চের আলোয় কেউ নেই। কিন্তু নিঃসন্দেহে কেউ অনুসরণ করছে।

অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, বাবার সেই কথা সত্যি— কেউ আমাকে অনুসরণ করছিল।” এবার তারাও একই অভিজ্ঞতা পাচ্ছে।

হঠাৎ রোহন থেমে গেল। দেয়ালের গায়ে রক্তের মতো লাল দাগ। কাছে গিয়ে দেখা গেল, সেটা আসলে কোনো রং নয়— কারও হাতের ছাপ, যা শুকিয়ে গেছে বহু আগে।

মেঘলা ফিসফিস করে বলল, “এটা কি সত্যিই কোনো আত্মার চিহ্ন, নাকি আগে কেউ ঢুকেছিল?”

সামনে এগোতেই তারা পৌঁছাল এক বিশাল গহ্বরের কিনারে। টর্চের আলো নিচে ফেলতেই দেখা গেল, অনেক নিচে কালো জলের পুকুর। পাশে এক সরু সেতু— কাঠ আর দড়ি দিয়ে তৈরি।

অরিন্দম মানচিত্র মিলিয়ে বলল, “এটাই মৃত্যুর দ্বার।”

তিনজনের চোখে তখন আতঙ্ক আর রোমাঞ্চ একসঙ্গে। পেছনে ফেরা যায় না, সামনে এগোনো মানেই অজানা বিপদ।

রোহন কণ্ঠ শুকিয়ে গিয়ে বলল, “চলো, ঝুঁকি নিতেই হবে।”

অরিন্দম প্রথম পা রাখল দড়ির সেতুতে। কাঁপতে কাঁপতে সেতু দুলছিল। নিচে অন্ধকার জলের গর্জন। তারা একে একে এগোতে লাগল।

কিন্তু মাঝপথে হঠাৎ সেই বাঁশির সুর আবার বাজতে শুরু করল। এবার এত জোরে যে মনে হচ্ছিল গুহার ভেতর প্রতিধ্বনি হচ্ছে।

সেতু দুলতে লাগল প্রবলভাবে। তিনজন প্রাণপণে ভারসাম্য রাখতে চেষ্টা করল। মেঘলা চিৎকার করে উঠল, “আমাদের ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে কেউ!”

অরিন্দম দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমরা পার হবই।”

সামনে অপেক্ষা করছে অরণ্যের গভীরতম রহস্য।

পর্ব ৪ : পাহাড়ের পাদদেশে অচেনা বিপদ

দড়ির সেতুর উপর দাঁড়িয়ে তিনজনের মনে হচ্ছিল সময় থেমে গেছে। নিচে গহ্বরের কালো জলে শুধু টর্চের আলো কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল। প্রতিটি পা ফেলতে গিয়ে তারা অনুভব করছিল মৃত্যু তাদের নিঃশ্বাসের দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে।

অরিন্দম দৃঢ় ভঙ্গিতে সামনে এগোল, রোহন আর মেঘলা তার পিছনেই। বাঁশির সুর ক্রমশ প্রবল হচ্ছিল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাদের মনোবল ভাঙতে চাইছে। সেতু দুলছিল, দড়ি কড়মড় শব্দ করছিল, তবু তারা মরিয়া হয়ে পা ফেলল। অবশেষে সেতুর অপর প্রান্তে এসে পৌঁছে তিনজন একসঙ্গে নিঃশ্বাস ফেলল।

অপর প্রান্ত থেকে বেরিয়ে এল সরু অন্ধকার সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় দেখা গেল ক্ষীণ আলো। বাইরে পা রাখতেই তারা হকচকিয়ে গেল। সামনে এক অদ্ভুত দৃশ্য— আকাশে লাল আভা, চারদিকে পাথরের পাহাড়, আর পাহাড়ের গায়ে ঝরনার মতো স্রোত পড়ছে। এই জায়গাটা যেন অন্য এক জগত।

“এটা কোথায় এলাম আমরা?” মেঘলার কণ্ঠ কেঁপে উঠল।

অরিন্দম মানচিত্র বের করে মিলিয়ে দেখল। “বাবার ডায়েরিতে লেখা ছিল, অরণ্যের হৃদয়ে পৌঁছে যাবে পাহাড়ের পাদদেশে।’ আমি মনে করি আমরা ঠিক জায়গায় এসেছি।”

তারা পাহাড়ের দিকে এগোতে শুরু করল। চারপাশে বাতাস ভারী হয়ে আসছিল, অদ্ভুত এক গন্ধ ভাসছিল— কাঁচা মাটি আর পশুর গন্ধ মিশ্রিত। হঠাৎ রোহন থেমে বলল, “শোনো, কোনো শব্দ পাচ্ছ?”

অরিন্দম কান পেতে শুনল। দূরে ড্রামের মতো শব্দ হচ্ছে, যেন কেউ কোনো অনুষ্ঠান করছে। মেঘলার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। “হয়তো উপজাতিরা…”

তারা সাবধানে এগোতে লাগল। একসময় পাহাড়ের গুহার সামনে পৌঁছে গেল। গুহার ভেতর থেকে আলো ঝলমল করছে। তিনজন লুকিয়ে বসে ভিতরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করল।

গুহার ভেতর আগুন জ্বলছে, চারপাশে কয়েকজন মানুষ অদ্ভুত সাজে নাচছে। শরীরে রঙ, মুখে ভয়ঙ্কর মুখোশ। হাতে হাতে ড্রাম। তাদের আওয়াজে গুহার দেওয়াল কেঁপে উঠছিল।

রোহন ফিসফিস করে বলল, “এরা কারা? আধুনিক যুগে এমন উপজাতি টিকে আছে?”

মেঘলা ভয়ে ফিসফিস করল, “এরা নিশ্চয়ই শবরদের উত্তরসূরি। বাবার মানচিত্রে যে টোটেম ছিল, দেখো, ওরা গলায় ঝুলিয়েছে।”

হঠাৎ গুহার ভেতরকার একজন হাত উঁচিয়ে কোনো মন্ত্র উচ্চারণ করল। তারপর তারা সবাই একসঙ্গে সুর মিলিয়ে বাঁশি বাজাতে শুরু করল। বাঁশির সুরে যেন পাহাড় কেঁপে উঠল।

অরিন্দমের চোখে ভেসে উঠল বাবার লেখা সেই লাইন— বাঁশির সুরে পাহারা দেয়া হয়।” সে বুঝল, এতদিন যে সুর তারা শুনছিল, তা এই গোষ্ঠীরই। তারা পাহাড় আর গোপন মানচিত্র পাহারা দিচ্ছে।

কিন্তু ঠিক তখনই একটা কড়মড় শব্দে ভেঙে গেল মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। রোহনের পায়ের নিচে শুকনো ডাল ভেঙে গেল। গুহার ভেতরকার মুখোশধারীরা থেমে গেল। কয়েক জোড়া চোখ ঘুরে এল তাদের দিকে।

“দৌড়াও!” অরিন্দম চিৎকার করে উঠল।

তারা তিনজন পাহাড়ের উল্টোদিকে দৌড়ে পালাতে লাগল। পিছনে শোনা যাচ্ছিল তীব্র বাঁশির সুর আর মানুষের চিৎকার। গাছের ফাঁক দিয়ে দৌড়তে গিয়ে কাঁটা আঁচড় কাটছিল, কিন্তু তারা থামল না।

অবশেষে এক ঝর্ণার ধারে এসে দাঁড়াল। জলের শব্দ এত জোরে যে পিছু ধাওয়া করা লোকজনের শব্দ বোঝা গেল না। রোহন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ওরা আমাদের মেরে ফেলত!”

মেঘলা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এরা কেবল উপজাতি নয়, এরা পাহারাদার। এরা কাউকে রহস্যের কাছে যেতে দেবে না।”

অরিন্দম ডায়েরি খুলে আবার পড়ল। বাবার লেখা— যদি উপজাতিদের চোখে পড়, মনে রেখো তারা শুধু রক্ষক নয়, সত্য লুকিয়ে রাখার শপথ নিয়েছে।”

তারা বুঝল, আসল বিপদ তো এখনই শুরু হয়েছে।

ঝর্ণার ধারে কিছুটা শান্তি পেয়ে তারা মানচিত্র বের করে দেখল। তাতে স্পষ্ট করে আঁকা— পাহাড়ের বুক চিরে এক গোপন পথ। কিন্তু সেই পথ পাহারা দিচ্ছে উপজাতিরাই।

মেঘলা চিন্তিত গলায় বলল, “তাহলে কী করব? সরাসরি গেলে ওরা আমাদের ধরে ফেলবে।”

রোহন দাঁত চেপে বলল, “আমরা সাংবাদিকতার মাঠে শিখেছি, তথ্য লুকিয়ে রাখা যায় না। যেভাবেই হোক আমাদের যেতে হবে।”

অরিন্দম ধীরে বলল, “কিন্তু মনে রেখো, এ অভিযান শুধু কৌতূহলের জন্য নয়। বাবার উত্তরাধিকার আমাদের কাঁধে। যদি সত্যিই ইতিহাস বদলানোর মতো কিছু লুকিয়ে থাকে, তবে সেটা বের করতেই হবে।”

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে তারা ঝর্ণার পাশে ছোট এক গুহায় আশ্রয় নিল। মশাল জ্বালিয়ে তারা ভেতরে বসে পরিকল্পনা করল।

মেঘলা মানচিত্রে আঙুল দিয়ে দেখাল, “এখানে একটা ফাঁকা অংশ আছে। মনে হচ্ছে পাহাড়ের অন্য পাশে প্রবেশপথ থাকতে পারে। আমরা যদি ওটা খুঁজে পাই, তাহলে উপজাতিদের চোখ এড়িয়ে ঢুকতে পারব।”

রোহন হেসে বলল, “তুই না থাকলে আমরা বোধহয় অনেক আগেই মরতাম।”

অরিন্দম বাইরে তাকিয়ে দেখল, পাহাড়ের মাথায় তখন চাঁদের আলো পড়ছে। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, ছায়ার ভেতরে কেউ তাদের দেখছে। বাবার সেই কথা যেন আবার কানে বাজল— কেউ আমাকে অনুসরণ করছে।”

রাতের অন্ধকারে হঠাৎ আবার সেই বাঁশির সুর ভেসে এল, এবার যেন আরও কাছে। মেঘলা আঁতকে উঠল। অরিন্দম হাত তুলে তাদের চুপ থাকতে বলল। সুরটা গুহার মুখে এসে থেমে গেল। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, তারপর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

“ওরা জানে আমরা এখানে আছি,” অরিন্দম বলল। “আগামীকাল ভোরেই বেরোতে হবে।”

তারা তিনজন সারা রাত প্রায় ঘুমোতে পারল না। বাইরে মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছিল অচেনা পদশব্দ।

ভোরের আলো ফুটতেই তারা পাহাড়ের গায়ে অন্য পথ খুঁজতে বেরোল। শালবনের ফাঁক গলে তারা পাথুরে ঢালে উঠতে লাগল। উঠতে উঠতে এক জায়গায় থমকে গেল। দেয়ালে খোদাই করা প্রতীক— আবার সেই টোটেম।

কিন্তু এবার প্রতীকের নিচে লাল রঙে লেখা কিছু অক্ষর। মেঘলা পড়ে শোনাল, “যে আসবে, সে ফিরবে না।

তাদের শরীর শিউরে উঠল।

ঠিক তখনই ওপর থেকে গড়িয়ে এল একটা বড় পাথর। তারা তিনজন প্রাণপণে সরে গেল। পাথর ধাক্কা মেরে নিচে গড়িয়ে গেল। তারা মাথা তুলে তাকাতেই দেখল— পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে দু’জন মুখোশধারী, হাতে বর্শা।

রোহন গর্জে উঠল, “এবার আমাদের লড়তেই হবে!”

অরিন্দম মনে মনে বুঝল, এ লড়াই শুধু বাঁচার জন্য নয়, রহস্য উন্মোচনের জন্যও। পাহাড়ের পাদদেশেই শুরু হলো নতুন বিপদ, যার সামনে দাঁড়িয়ে তারা এখন ভাগ্যের পরীক্ষা দিতে চলেছে।

 

পর্ব ৫ : অরণ্যের অন্ধকারে

মুখোশধারী দু’জন পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে বর্শা উঁচিয়ে ছিল। ভোরের আলো তাদের ছায়াকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল। অরিন্দম, রোহন আর মেঘলা নিচ থেকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল— এরা পাহাড়ের পাহারাদার, যারা কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিতে রাজি নয়।

পাথর গড়িয়ে নামার পরপরই তারা তিনজন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। রোহন গলা নামিয়ে বলল, “এরা যদি নামতে শুরু করে, আমাদের আর পালাবার পথ থাকবে না।”

অরিন্দম মানচিত্র খুলে দেখল। পাশের সরু একটি গিরিখাত এঁকেছে বাবা। হয়তো সেটাই তাদের বিকল্প পথ। “চলো,” সে ফিসফিস করে বলল, “গিরিখাত দিয়ে ঢুকতে হবে। ওরা যতক্ষণ পাহাড়ের চূড়ায় আছে, আমরা ততক্ষণ এদিক দিয়ে সরে যাব।”

তারা তিনজন নিচু হয়ে গিরিখাতের দিকে এগোল। গাছের শিকড় আর শুকনো পাতার মধ্যে দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে হঠাৎ মেঘলার পা পিছলে গেল। সে এক চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। শব্দ শুনে পাহাড়ের মাথা থেকে মুখোশধারীরা গর্জন করে উঠল।

“দৌড়াও!” অরিন্দম চিৎকার করল।

তারা গিরিখাতের ভেতর ঢুকে পড়ল। সরু পথটা আঁকাবাঁকা হয়ে বনের গভীরে নেমে যাচ্ছিল। সূর্যের আলো ঢুকতে পারছিল না, ভেতরে অদ্ভুত অন্ধকার। বাতাস ভারী আর আর্দ্র, যেন শতাব্দী ধরে কেউ এখানে আসেনি।

চলতে চলতে হঠাৎ তাদের সামনে দেখা গেল এক বিশাল গাছ। গাছটার গায়ে অসংখ্য প্রতীক খোদাই করা। মানুষের মুখ, পশুর দাঁত, সূর্য আর চাঁদের চিহ্ন। মেঘলা হাত বুলিয়ে বলল, “এগুলো ইতিহাসের দলিল। এগুলো শবর উপজাতির চিহ্ন, যাদের কথা আমরা বইতে পড়েছি। কিন্তু এত অক্ষত অবস্থায় আমি কোথাও দেখিনি।”

অরিন্দম ডায়েরি খুলে মিলিয়ে দেখল। বাবা লিখেছিলেন— অরণ্যের অন্ধকারে বিশাল এক বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে, যা সব রহস্যের কেন্দ্র। তার চারপাশেই শুরু হয় পরীক্ষা।”

“মানে এখনই আমাদের পরীক্ষা শুরু?” রোহন দাঁত চেপে বলল।

ঠিক তখনই গাছের ফাঁক দিয়ে ভেসে এল সেই বাঁশির সুর। এবার এত ভয়ঙ্কর, যেন হাড়ের ভেতর দিয়ে কেটে যাচ্ছে। চারপাশ থেকে ভেসে এল পশুর গর্জন, মানুষের ফিসফিসানি। অন্ধকার যেন ঘনিয়ে আসছিল।

হঠাৎ গাছের গোড়ায় মাটি ফেটে উঠল। সেখান থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল কালো পোশাক পরা তিনজন মুখোশধারী। হাতে লম্বা বর্শা, চোখে অগ্নিদৃষ্টি। তারা কোনো কথা বলল না, শুধু বৃত্ত তৈরি করে দাঁড়িয়ে রইল।

মেঘলা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এরা আমাদের যেতে দেবে না।”

অরিন্দম দৃঢ়ভাবে বলল, “আমাদের লড়াই করতেই হবে। এটাই বাবার লেখা পরীক্ষা।”

তিনজন মুখোশধারী এগিয়ে এল। অরিন্দম ঝোপ থেকে একটা মোটা ডাল ভেঙে নিল। রোহন পকেট নাইফ বের করল। মেঘলা ভয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু তার চোখে তখনও দৃঢ়তা।

লড়াই শুরু হলো। প্রথম মুখোশধারী বর্শা চালিয়ে অরিন্দমের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অরিন্দম ডাল দিয়ে ঠেকিয়ে দিল, প্রচণ্ড শব্দে লোহার সঙ্গে কাঠের সংঘর্ষ হলো। রোহন আরেকজনের আক্রমণ সামলাল, তার নাইফ দিয়ে বর্শার আঘাত সরিয়ে দিল।

তৃতীয় মুখোশধারী মেঘলার দিকে ছুটে এল। মেঘলা আতঙ্কে একটা পাথর তুলে ছুঁড়ে মারল। পাথরটা মুখোশে লাগতেই সে দুলে উঠল। সুযোগ বুঝে অরিন্দম ডাল দিয়ে আঘাত করল। মুখোশ ফেটে গেল, ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক তরুণের মুখ।

তিনজনই স্তব্ধ। মুখোশের আড়ালে এরা সাধারণ মানুষই!

তরুণটা গর্জন করে উঠল, কিন্তু রোহন তার হাত চেপে ধরল। অন্য দুজনও লড়াই থামাল। মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এল।

অরিন্দম শান্ত গলায় বলল, “আমরা শত্রু নই। আমরা কেবল সত্য খুঁজতে এসেছি। আমাদের বাবা এই মানচিত্রের খোঁজ করেছিলেন। তোমরা কেন লুকিয়ে রাখছ?”

কিন্তু তারা কোনো উত্তর দিল না। শুধু বাঁশির সুর আবার বাজতে শুরু করল, এবার আরও দূর থেকে। মুখোশধারীরা একে অপরের দিকে তাকাল, তারপর হঠাৎ ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল অরণ্যের ভেতর।

তিনজন হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে রইল। রোহন বলল, “এরা মানুষ, ভূত নয়। কিন্তু কার নির্দেশে এরা পাহারা দিচ্ছে?”

অরিন্দম মানচিত্র বের করে বলল, “আমাদের থামানোই ওদের কাজ। কিন্তু রহস্য এখানেই শেষ নয়।”

তারা আবার হাঁটা শুরু করল। অন্ধকার আরও ঘনিয়ে আসছিল। গিরিখাতের ভেতর বাতাসে ভেসে আসছিল অদ্ভুত গন্ধ— ধোঁয়া আর ছত্রাকের মিশ্রণ। দূরে কোথাও মশালের আলো জ্বলজ্বল করছিল।

মেঘলা সতর্ক গলায় বলল, “কেউ আছে ওখানে।”

তারা আলো অনুসরণ করতে লাগল। কাছে গিয়ে দেখল, গিরিখাতের দেয়ালে খোদাই করা এক বিশাল দরজা। দরজার সামনে কয়েকজন মুখোশধারী মশাল হাতে পাহারা দিচ্ছে। দরজার ওপরে লেখা প্রতীক— আগুন, নদী আর একটি চোখ।

মেঘলা শ্বাস আটকে বলল, “এটাই সেই গোপন প্রবেশপথ। বাবার মানচিত্রে ছিল। কিন্তু এর ভেতরে কী আছে?”

অরিন্দমের বুক ধকধক করতে লাগল। বাবার লেখা শেষ লাইন মনে পড়ল— দরজার ওপারে যে অন্ধকার, তা শুধু সত্য নয়, মৃত্যুকেও বহন করে।”

তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অরণ্যের গভীরতম অন্ধকার। যদি ভেতরে ঢোকে, তবে হয়তো সত্যিই আর ফেরা হবে না।

রোহন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এখন আর পিছু হটার উপায় নেই।”

অরিন্দম ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। তিনজনের চোখে তখন একই আলো— ভয় আর সাহসের মিশ্রণ।

গিরিখাতের অন্ধকার যেন তাদের গ্রাস করছিল, আর রহস্যের দরজা সামনে ক্রমশ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল।

 

পর্ব ৬ : অদৃশ্য শিকারি

গিরিখাতের সেই বিশাল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনজনের বুক ধকধক করছিল। পাহারাদার মুখোশধারীরা মশাল হাতে দাঁড়িয়ে, চোখ তাদের ওপর নিবদ্ধ। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সময় যেন থেমে গিয়েছিল। তারপর অরিন্দম গভীর নিশ্বাস নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “যদি এগোতেই হয়, এখনই সময়।”

কিন্তু সরাসরি হামলা করা বোকামি হবে। তারা ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে লক্ষ্য করছিল পাহারাদারদের নড়াচড়া। কয়েক মিনিট পর পাহারাদাররা একে একে দরজার ভেতরে ঢুকে গেল। বাইরের প্রহরা ফাঁকা হয়ে রইল।

“চলো,” রোহন ইশারা করল।

তারা নিঃশব্দে এগিয়ে দরজার কাছে পৌঁছল। দরজার গায়ে হাত বোলাতেই অরিন্দম বুঝল, এ পাথর নয়, কোনো ধাতব মিশ্রণ— শত বছরেও ক্ষয় হয়নি। প্রতীকের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল রাখতেই দরজাটা কড়মড় করে খুলে গেল। অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে এল, যেন মৃত্যুর নিঃশ্বাস।

তিনজন ভেতরে ঢুকল। দরজাটা আবার নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকারে তারা টর্চ জ্বালাল। ভেতরের দেওয়ালে অদ্ভুত আঁকিবুকি, মানুষের আর পশুর হাড় ঝোলানো, আর পাথরের খুঁটিতে শুকনো রক্তের দাগ।

মেঘলা আতঙ্কে বলল, “এটা কোনো প্রাচীন মন্দির, নাকি হত্যাক্ষেত্র?”

অরিন্দম ডায়েরির পাতা উল্টে দেখল। বাবা লিখেছিলেন— দরজার ওপারে রয়েছে অদৃশ্য শিকারি। তাকে না হারালে রহস্য উন্মোচন সম্ভব নয়।”

অদৃশ্য শিকারি! শব্দটা পড়েই তিনজনের শরীর শিরশির করে উঠল।

সুড়ঙ্গ পেরিয়ে তারা পৌঁছল এক বিশাল প্রাঙ্গণে। ছাদের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়ছিল। চারদিকে ভাঙাচোরা মূর্তি, কিছু মানুষের, কিছু অদ্ভুত প্রাণীর। মাটিতে শুকনো হাড় ছড়িয়ে আছে।

ঠিক তখনই কানে এল অদ্ভুত শব্দ— টুপ… টুপ… যেন কোথাও থেকে জল পড়ছে। কিন্তু মাটিতে জল নেই।

হঠাৎ রোহন থেমে গেল। “শোনো,” সে ফিসফিস করে বলল, “আমাদের ছাড়া আরেকটা নিঃশ্বাস চলছে।”

তিনজন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল। হ্যাঁ, ঠিকই। যেন কেউ অন্ধকারে হাঁটছে। কিন্তু আলো ফেলতেই কিছুই নেই।

মেঘলা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এটাই কি অদৃশ্য শিকারি?”

অরিন্দম পকেট থেকে বাবার পুরোনো কম্পাসটা বের করল। কম্পাসের কাঁটা অদ্ভুতভাবে ঘুরতে লাগল, একদিকে স্থির হলো না। যেন কোনো অচেনা শক্তি তাকে টানছে।

হঠাৎই ভীষণ হাওয়া বইতে লাগল। মশাল নিভে গেল, টর্চের আলো কাঁপতে লাগল। অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরোল এক তীব্র গর্জন। অরিন্দম ছায়ার মতো কিছু নড়তে দেখল, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা গেল না।

গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে হাড়ের স্তূপ নড়ে উঠল। হাড়গুলো যেন নিজেরাই নাচতে শুরু করল। রোহন চিৎকার করে উঠল, “দৌড়াও!”

তারা দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু অদৃশ্য শিকারি যেন তাদের ছায়ার মতো অনুসরণ করছিল। কোথাও কোনো দেহ নেই, কেবল আঘাতের শব্দ, বাতাসে ছুরি চালানোর মতো হঠাৎ হঠাৎ ঝাপটা। অরিন্দমের গায়ে আঁচড় লাগল, যেন অদৃশ্য নখর টেনে গেছে।

মেঘলা কেঁদে উঠল, “এটা মানুষ নয়!”

অরিন্দম মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল। ডায়েরির লাইন মনে পড়ল— অদৃশ্য শিকারি কেবল আলোয় ধরা দেয়।”

সে চিৎকার করে বলল, “টর্চ একসঙ্গে ওদিকে ধরো!”

তারা তিনজন একসঙ্গে আলো ফেলল সামনে। আলো পড়তেই হঠাৎ অন্ধকারে আবছা আকার ফুটে উঠল— বিশাল দেহ, লম্বা হাত, চোখে আগুনের মতো আলো। এক মুহূর্তের জন্যই দেখা গেল, তারপর আবার মিলিয়ে গেল।

“দেখেছ?” অরিন্দম হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। “এটাই শিকারি।”

শিকারি আবার গর্জন করল। এবার সে সামনে ঝাঁপিয়ে এল। তিনজন টর্চের আলো ঘোরাতে লাগল, প্রতিবারই অল্পক্ষণ তার আকার ফুটে উঠছিল। বিশাল দাঁত, নখর, পশু আর মানুষের মিশ্রিত অবয়ব।

রোহন নাইফ বের করে দাঁড়াল। “আসুক, এবার পালাব না।”

শিকারি এক ঝাপটা দিল। রোহন সরে গিয়ে নাইফ চালাল। আলোয় মুহূর্তের জন্য দেখা গেল তার গায়ে দাগ কেটে গেল, রক্ত নয়, কালো ধোঁয়া বেরোল।

অরিন্দম ডায়েরির আরেক লাইন মনে করল— শিকারিকে হারানো যায় আগুনে।”

সে দ্রুত মশাল জ্বালাতে লাগল। মেঘলা শুকনো কাঠ আর কাপড় এনে দিল। মশাল জ্বলতেই শিকারি ভয়ঙ্কর গর্জন করে পিছিয়ে গেল। তার দেহে আগুনের আলো পড়তেই কালো ধোঁয়া উঠল।

অরিন্দম মশাল উঁচিয়ে সামনে এগোল। শিকারি পিছু হটছিল, গর্জন করছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল। অবশেষে এক প্রবল চিৎকার করে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। চারপাশে আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল।

তারা তিনজন হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ল। রোহনের হাত কেটে গিয়েছিল, মেঘলার চোখে ভয় জমে ছিল।

অরিন্দম নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমরা শিকারিকে পরাজিত করেছি। এবার সামনে এগোতে হবে।”

তারা প্রাঙ্গণের এক কোণে দেখতে পেল আরেকটা দরজা। দরজার গায়ে প্রতীক— নদী আর পাখির ডানা। মেঘলা বলল, “মানচিত্রে পরের গন্তব্য হলো গোপন নদী।”

তারা দরজা ঠেলে খুলল। সামনে দেখা গেল এক দীর্ঘ সুড়ঙ্গ, যা অন্ধকার ভেদ করে দূরে চলে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে মেঘলা ধীরে বলল, “অদৃশ্য শিকারি কি সত্যিই কোনো প্রাণী ছিল, নাকি উপজাতির অভিশাপের রূপ?”

অরিন্দম উত্তর দিল না। তার মনে হচ্ছিল, এই অন্ধকার শুধু জীব নয়, মানুষের ভেতরের ভয়কেও শিকার করে।

তারা এগোতে লাগল। অনেকক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ টর্চের আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠল স্বচ্ছ জল। সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে বেরিয়ে এল বিশাল ভূগর্ভস্থ নদীর তীরে।

জল নীলাভ আলো ছড়াচ্ছিল, যেন নিজেই জ্বলছে। নদীর তীরে শিলায় খোদাই করা আছে অগণিত প্রতীক, আর দূরে এক গুহার ভেতর থেকে ভেসে আসছে অদ্ভুত সুর।

অরিন্দম মৃদু স্বরে বলল, “এটাই সেই গোপন নদী।”

তিনজন দাঁড়িয়ে রইল। সামনে আবারও এক নতুন অধ্যায়, অরণ্যের আরও গভীর রহস্য।

পর্ব ৭ : গোপন নদীর তীরে

অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে যে দৃশ্য তিনজনের চোখের সামনে খুলে গেল, তা যেন কোনো রূপকথার জগৎ। ভূগর্ভস্থ নদীটি নিজে থেকেই আলো ছড়াচ্ছিল। নীলাভ জ্যোতিতে পানির ঢেউ ঝলমল করছিল, যেন চাঁদের আলোকে নিজের ভেতর বন্দি করে রেখেছে। নদীর চারপাশে পাথরের দেয়াল, তার গায়ে খোদাই করা অসংখ্য প্রতীক— সূর্য, চাঁদ, পাখি, নদী, আর মানুষের হাত জোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গি।

“এটা অসম্ভব,” মেঘলার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। “এই নদী ভূগর্ভে লুকানো, অথচ এর অস্তিত্ব ইতিহাসে কোথাও নেই।”

অরিন্দম ধীরে ধীরে জলের কাছে গিয়ে হাত ডুবিয়ে দিল। জল ঠান্ডা, কিন্তু অদ্ভুতভাবে স্পন্দিত। যেন নদী নিজেই শ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎই পানির ভেতর থেকে ফিসফিস আওয়াজ ভেসে এল। শব্দগুলো স্পষ্ট নয়, কিন্তু শুনতে লাগছিল মানুষের মতো।

রোহন পিছিয়ে গেল। “এই জায়গাটা ঠিক নয়। নদী যদি কথা বলে, তবে সেটা জীবন্ত।”

অরিন্দম মাথা নাড়ল। “এটাই বাবার ডায়েরিতে লেখা ছিল— যে নদী চোখে দেখা যায় না, তার তলদেশেই লুকিয়ে আছে রহস্য।’ আমাদের ওই তলদেশেই নামতে হবে।”

কিন্তু নামার আগে দরকার ছিল সাহস আর পরিকল্পনা। নদীর তীরে তারা তিনজন বসে পড়ল। চারপাশে অদ্ভুত নীরবতা। শুধু দূরের গুহা থেকে ভেসে আসছিল বাঁশির মায়াবী সুর।

মেঘলা মানচিত্র মেলল। “এখানে স্পষ্ট লেখা আছে— নদীর ওপারে একটা দ্বীপ আছে। সেই দ্বীপেই আছে প্রাচীন গুহা, যেখানে আসল উত্তর লুকিয়ে আছে।”

রোহন কপালে হাত চাপড়ে বলল, “কিন্তু আমরা ওপারে যাব কীভাবে? নৌকা তো নেই।”

অরিন্দম আলো ফেলে নদীর তীর ঘুরে দেখতে লাগল। কিছুদূরে একটা কাঠের পুরোনো ভেলা ভেসে আছে। মনে হচ্ছিল বহু বছর আগে কেউ এখানে রেখে গেছে। ভেলাটা কাদা আর শ্যাওলায় ঢেকে গিয়েছে, তবু ভাসার মতো শক্ত আছে।

“এটাই আমাদের ভরসা,” অরিন্দম বলল।

তারা ভেলাটা নদীর জলে নামাল। নদী যেন এক অদ্ভুত শক্তিতে ভরপুর। ভেলা নামতেই জল ঢেউ তুলে উঠল। অরিন্দম, রোহন আর মেঘলা একসঙ্গে তাতে চেপে বসল। হাতে লম্বা কাঠের খুঁটি নিয়ে অরিন্দম ঠেলে দিল।

ভেলা ধীরে ধীরে নদীর মাঝখানে ভেসে চলল। চারপাশে আলো ঝলমল করছিল, কিন্তু সেই আলোতে শান্তি ছিল না— বরং এক অদ্ভুত ভয়।

হঠাৎ নদীর নিচ থেকে গুড়গুড় শব্দ উঠল। ভেলা দুলতে শুরু করল। মেঘলা আঁকড়ে ধরল অরিন্দমকে। “কিছু একটা উঠছে!”

জল ফুঁড়ে ওপরে এল বিশাল মাছের মতো এক প্রাণী। তার চোখ আগুনের মতো, দাঁত ধারালো। অদ্ভুত গর্জন করে সে ভেলার চারপাশে ঘুরতে লাগল।

রোহন দাঁত চেপে নাইফ বের করল। “এবার মরার লড়াই।”

প্রাণীটা হঠাৎ লেজ চালিয়ে ভেলায় আঘাত করল। ভেলা দুলে উঠল, তারা প্রায় জলে পড়ে যাচ্ছিল। অরিন্দম কাঠের খুঁটি দিয়ে প্রাণীটার মাথায় আঘাত করল। প্রাণীটা চেঁচিয়ে আবার জলে ডুব দিল।

কিন্তু অদৃশ্য থাকল না। নিচ থেকে ভেলার তলা আঁচড়াতে লাগল। কাঠ কেঁপে উঠছিল। মেঘলা চিৎকার করে উঠল, “ও আমাদের ডুবিয়ে দেবে!”

ঠিক তখনই অরিন্দমের মনে পড়ল বাবার ডায়েরির লাইন— নদীর রক্ষককে শান্ত করতে হলে আলো দাও।”

সে দ্রুত ব্যাগ থেকে মশাল বের করল। ভিজে যাওয়া সত্ত্বেও শুকনো কাপড় মুড়িয়ে আগুন ধরাল। মশাল জ্বলে উঠতেই সে নদীর ওপর তুলে ধরল।

অদ্ভুতভাবে প্রাণীটা থেমে গেল। আলোয় তার চোখ সঙ্কুচিত হয়ে গেল। সে গর্জন করে দূরে সরে গেল, তারপর ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ভেলা আবার শান্তভাবে ভেসে চলল। তিনজন হাঁপাতে লাগল, কিন্তু প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল।

অবশেষে তারা পৌঁছল নদীর ওপারের দ্বীপে। দ্বীপ ছোট হলেও চারপাশে শিলার দেয়াল আর গাছপালা ঘিরে। মাঝখানে অদ্ভুত এক গুহার মুখ। গুহার ওপরে খোদাই করা প্রতীক— পাখির ডানা মেলে ধরা।

“এটাই,” মেঘলা ফিসফিস করে বলল। “এখানেই আছে আসল রহস্য।”

তারা গুহার ভেতরে ঢুকল। ভিতরে ঠান্ডা আর ভেজা গন্ধ। টর্চের আলোয় দেখা গেল দেওয়ালে অদ্ভুত চিত্রকলা। মানুষ আগুন জ্বালাচ্ছে, পশুর সঙ্গে লড়াই করছে, আর কোনো অচেনা প্রতীক পূজা করছে।

কিছুটা ভেতরে যেতেই দেখা গেল এক বিশাল কক্ষ। মাঝখানে পাথরের বেদি, তার ওপরে রাখা ধুলো জমা এক বাক্স। বাক্সের চারপাশে টোটেম প্রতীক খোদাই করা।

অরিন্দম ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। বাক্সে হাত রাখতেই ঠান্ডা স্রোত তার শরীরে ছড়িয়ে গেল। সে মনে মনে বাবাকে ডাকল।

হঠাৎ বাক্স থেকে অদ্ভুত শব্দ উঠল, যেন ভিতরে কিছু নড়ছে। তারা ভয়ে পিছিয়ে গেল। বাক্সটা কড়মড় শব্দ করে নিজে থেকেই খুলে গেল।

ভেতরে ছিল একখানা প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। চামড়ার পাতায় লেখা অচেনা অক্ষর, পাশে আঁকা প্রতীক। মেঘলা কাঁপতে কাঁপতে বলল, “এটা তো শবর ভাষার মতো। কিন্তু এত পুরোনো কোনো লেখা আমি কোথাও দেখিনি।”

অরিন্দমের চোখে জল এসে গেল। “বাবা এটাই খুঁজছিলেন।”

কিন্তু ঠিক তখনই গুহার বাইরে থেকে শোনা গেল বাঁশির সুর। এবার এত কাছ থেকে যে গুহা কেঁপে উঠল।

রোহন দাঁত চেপে বলল, “ওরা চলে এসেছে।”

তিনজন বাক্সটা নিয়ে পালাতে চাইছিল, কিন্তু গুহার মুখ আটকাল মুখোশধারীরা। মশালের আলোয় তাদের চোখ জ্বলছিল। সামনে দাঁড়াল এক লম্বা মানুষ, মুখোশে রঙ করা সূর্য আর আগুন।

সে গভীর কণ্ঠে বলল, “তোমরা নিষিদ্ধ জিনিস স্পর্শ করেছ। এই ভূমি তোমাদের ক্ষমা করবে না।”

অরিন্দম বুক চিতিয়ে দাঁড়াল। “এটা সত্য, আর সত্য লুকিয়ে রাখা যায় না।”

মুখোশধারী হেসে উঠল, তার হাসি গুহার ভেতর প্রতিধ্বনি হলো। “তাহলে দেখো, সত্য কেমন করে মৃত্যু নিয়ে আসে।”

গুহার ভেতর তখন অন্ধকার আর আলো মিশে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিতে চলেছে।

 

পর্ব ৮ : বিস্মৃত গুহার ভেতর

গুহার ভেতর তখন মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধতা। মশালের আলো কেঁপে কেঁপে উঠছিল, আর তার আলোয় প্রতিফলিত হচ্ছিল মুখোশধারীদের চোখের আগুন। মাঝখানে দাঁড়িয়ে অরিন্দম, হাতে শক্ত করে ধরা সেই প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। মেঘলা আর রোহন দুই পাশে, টর্চ আর ছোট অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত।

সামনের লম্বা মানুষটি— সূর্য আঁকা মুখোশে ঢাকা মুখ— ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। তার গলায় অদ্ভুত কণ্ঠস্বর, যেন বহু মানুষের সুর মিশে আছে একসঙ্গে।
“এই গুহা হলো শবরদের শেষ আশ্রয়। এই পাণ্ডুলিপি তাদের উত্তরাধিকার। তোমরা বহিরাগত, তোমাদের এখানে থাকার অধিকার নেই।”

অরিন্দম দৃঢ় গলায় বলল, “আমরা সত্যের খোঁজে এসেছি। এই ইতিহাস শুধু তোমাদের নয়, সমগ্র মানবজাতির। এটা লুকিয়ে রাখলে ভবিষ্যৎ অন্ধকারেই থেকে যাবে।”

মুখোশধারী হেসে উঠল, তার হাসি গুহার ভেতর প্রতিধ্বনি হয়ে কাঁপিয়ে দিল। তারপর হঠাৎ বাঁশির সুর বেজে উঠল। বাকিরা একসঙ্গে মশাল উঁচিয়ে চক্রাকারে তাদের ঘিরে ফেলল।

রোহন দাঁত চেপে বলল, “ওরা আমাদের ছেড়ে কথা বলবে না।”

মেঘলা কাঁপলেও বুক চিতিয়ে দাঁড়াল। তার চোখ পাণ্ডুলিপির দিকে নিবদ্ধ। সে ফিসফিস করে বলল, “বাবার ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা ছিল— যদি গুহার দরজা খোলো, তবে ভেতরের আলোই হবে তোমার রক্ষক।’ আমাদের আলো জ্বালাতেই হবে।”

অরিন্দম মশালটা উঁচিয়ে ধরল। “আলো জিতবেই।”

ঠিক তখনই মুখোশধারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। লড়াই শুরু হলো।

বর্শা ঝলসে উঠল, মশালের আগুনে ধাতুর ঝলক চোখ ধাঁধিয়ে দিল। অরিন্দম মশাল ঘুরিয়ে প্রতিপক্ষকে দূরে ঠেলল। রোহন নাইফ চালিয়ে আক্রমণ ঠেকাল, মেঘলা পাথর ছুড়ে মারল। তাদের লড়াই ছিল মরিয়া, কিন্তু মুখোশধারীরা সংখ্যায় অনেক।

হঠাৎ গুহার দেওয়ালে টর্চের আলো পড়তেই দেখা গেল অদ্ভুত এক চিত্রকলা— সূর্যের ভেতর থেকে উঠে আসছে পাখি, যার ডানা আলো ছড়াচ্ছে। মেঘলা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “ওটাই চিহ্ন! আলোই মুক্তির প্রতীক।”

অরিন্দম চিত্রটার সামনে মশাল ধরে দিল। আশ্চর্যজনকভাবে মশাল থেকে আলো বেরিয়ে গিয়ে চিত্রের প্রতীকে মিশে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই গুহার ভেতর ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পড়ল।

আলো পড়তেই মুখোশধারীরা চিৎকার করে চোখ ঢাকল। তাদের শরীর কাঁপতে লাগল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের গ্রাস করছে। সূর্য আঁকা মুখোশধারী পেছনে হোঁচট খেল। তার মুখোশ ফেটে গেল, ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বয়স্ক এক মানুষ। চোখে ভয় আর দুঃখ।

সে কাঁপা গলায় বলল, “আমরা… শবরদের শেষ উত্তরসূরি। আমাদের দায়িত্ব এই জ্ঞান পাহারা দেওয়া। বহিরাগতদের জন্য এটা নয়। কারণ এই জ্ঞানের সঙ্গে অভিশাপ জড়িয়ে আছে।”

অরিন্দম এগিয়ে গিয়ে বলল, “কিন্তু জ্ঞান কখনো অভিশাপ হতে পারে না। তোমরা যদি এটা লুকিয়ে রাখো, তবে ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”

বৃদ্ধ নিঃশ্বাস ফেলে বসে পড়ল। বাকিরা ধীরে ধীরে গুহা ছেড়ে চলে গেল, যেন আলো তাদের শক্তি কেড়ে নিয়েছে।

গুহার ভেতর আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল।

তিনজন এগিয়ে গেল বেদির কাছে। পাণ্ডুলিপির চারপাশে আরও কিছু জিনিস ছিল— পাথরের ফলক, মাটির পাত্রে শুকনো ভেষজ, আর একখানা ছোট লোহার বাক্স। বাক্স খুলতেই দেখা গেল ভেতরে সোনালি পাতার মতো পাতলা ধাতব ফলক, তাতে খোদাই করা চিহ্ন।

মেঘলা বিস্ময়ে বলল, “এগুলো তো জ্যোতির্বিজ্ঞানের মানচিত্র! তারাদের অবস্থান, চাঁদের কলা, এমনকি সূর্যগ্রহণের পূর্বাভাসও লেখা আছে।”

রোহন হাঁ করে তাকাল। “মানে কয়েকশ বছর আগেই এরা এমন জ্ঞান অর্জন করেছিল?”

অরিন্দমের চোখ ভিজে গেল। “বাবা এটাই খুঁজছিলেন। কিন্তু তিনি একা পেরে উঠতে পারেননি।”

গুহার দেয়ালে আরও কিছু লেখা ছিল। মেঘলা তা পড়ার চেষ্টা করল। “এখানে লেখা আছে— আমরা জ্ঞানকে লুকিয়ে রাখি, কারণ মানুষ তাকে অপব্যবহার করবে। কিন্তু যারা হৃদয়ে আলো নিয়ে আসবে, তারাই এই জ্ঞান পাবে।’

তাদের মনে হলো, সত্যিই এ এক অমূল্য আবিষ্কার। কিন্তু এর সঙ্গে ভয়ঙ্কর দায়িত্বও আছে।

ঠিক তখনই গুহার ভেতর হাওয়া বইতে লাগল। আলো নিভে যেতে লাগল। দূরে আবার ভেসে এল বাঁশির সুর। তিনজন আতঙ্কে একে অপরের দিকে তাকাল।

মেঘলা ফিসফিস করে বলল, “তাহলে সব শেষ হয়নি।”

অরিন্দম মাথা নাড়ল। “না। এ সুর মানে আমাদের অনুসরণ এখনও চলছে।”

গুহার গভীর অন্ধকার থেকে ছায়ার মতো কিছু বেরিয়ে এল। এবার মুখোশধারী নয়, অন্য কিছু। মানুষের অবয়ব, কিন্তু চোখ নেই, মুখ নেই। অদৃশ্য শিকারির মতোই তাদের শরীর ধোঁয়াটে।

রোহন দাঁত চেপে বলল, “আবার নতুন বিপদ।”

তারা বুঝতে পারল, এই গুহা শুধু জ্ঞানের ভাণ্ডার নয়, এক ভয়ঙ্কর কারাগারও। অদৃশ্য শিকারিরা এখানেই বন্দি, আর বাঁশির সুরেই তারা মুক্তি পায়।

অরিন্দম মশাল উঁচিয়ে বলল, “আলোই আমাদের একমাত্র অস্ত্র।”

তারা তিনজন মশাল আর টর্চ একসঙ্গে জ্বালিয়ে দিল। আলো ছড়িয়ে পড়তেই ছায়াগুলো সরে গেল, গর্জন করে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। কিন্তু তাদের প্রতিধ্বনি এখনও কানে বাজছিল।

গুহার গভীরে তারা আরও এগোতে লাগল। একসময় পৌঁছল এক গোলাকার কক্ষে। মাঝখানে শিলালিপি, তার চারপাশে অগ্নিদীপ। সেই লিপিতে লেখা ছিল— যে এই পথ পাড়ি দেবে, তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না।”

অরিন্দম পাণ্ডুলিপি শক্ত করে ধরে বলল, “আমরা আর আগের মতো নেইই। আমরা এই পথ বেছে নিয়েছি।”

কক্ষের ওপারে আরেকটা দরজা ছিল। দরজায় খোদাই করা প্রতীক— আগুনের ওপরে ভাঙা শৃঙ্খল।

মেঘলা শ্বাস আটকে বলল, “এটা মুক্তির প্রতীক। হয়তো এর ওপারেই শেষ উত্তর।”

কিন্তু দরজার চারপাশে ছায়া ঘুরছিল। বাঁশির সুর আরও তীব্র হয়ে উঠল।

অরিন্দম ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে খুলল। ভেতরে যে অন্ধকার, তা যেন আলোককেও গ্রাস করছে। তবু তাদের আর পিছু হটার উপায় নেই।

তিনজন দরজা পেরিয়ে প্রবেশ করল বিস্মৃত গুহার গভীরে, যেখানে লুকিয়ে আছে শেষ সত্য, শেষ বিশ্বাসঘাতকতা।

পর্ব ৯ : বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া

দরজা পেরিয়েই তারা ঢুকে পড়ল এক বিশাল গুহাকক্ষে। ভেতরে এত অন্ধকার যে মশালের আলোও যেন কেঁপে উঠছিল। বাতাস ভারী, গন্ধে ভরা শ্যাওলা আর পুরোনো রক্তের দাগ। কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক পাথরের স্তম্ভ, তার গায়ে খোদাই করা প্রতীক— মানুষের মুখ, অর্ধেক আলোয় ভরা, অর্ধেক অন্ধকারে।

মেঘলা স্তম্ভের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এটা বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক। মানচিত্রে এটার উল্লেখ ছিল— আলো আর অন্ধকারের মাঝেই জন্ম নেয় বিশ্বাসঘাতকতা।’

অরিন্দমের বুক কেঁপে উঠল। বাবার ডায়েরির সেই কথাগুলো হঠাৎ মনে পড়ে গেল। যাত্রার শেষের দিকে সবচেয়ে বড় বিপদ বাহিরে নয়, ভেতরে থাকে।”

রোহন মশাল ঘুরিয়ে চারপাশ দেখছিল। “এই জায়গাটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে আমাদের কেউ দেখছে।”

ঠিক তখনই গুহার দেয়াল কেঁপে উঠল। অন্ধকারের মধ্যে ছায়ারা নড়তে শুরু করল। বাঁশির সুর আবার শোনা গেল, এবার এত কাছ থেকে যে তাদের কানে শিরশিরে ব্যথা হচ্ছিল।

হঠাৎ ছায়ার ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে এল। মুখোশ নেই, মানুষ। মশালের আলোয় দেখা গেল— সে আর কেউ নয়, রোহন!

অরিন্দম আর মেঘলা স্তম্ভিত।

“তুমি?” অরিন্দম চিৎকার করে উঠল। “কীভাবে এখানে?”

কিন্তু তারপরেই বুঝতে পারল, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোহন একেবারে অচল। সে নিজেই বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। সামনে দাঁড়ানো ছায়ামূর্তিটা আসলে রোহনের মতো দেখতে।

ডপেলগ্যাঙ্গার।

অন্ধকারের সৃষ্টি, যারা মানুষের প্রতিচ্ছবি ধরে বিশ্বাসঘাতকতা সৃষ্টি করে।

অরিন্দমের মনে পড়ল বাবার সেই সতর্কবাণী— অন্ধকার তোমার প্রিয়জনের মুখ নিয়ে তোমাকে ভাঙতে চাইবে।”

ছায়ার রোহন ঠান্ডা গলায় বলল, “তুমি ভাবছো তুমি সত্য খুঁজছো, অরিন্দম। আসলে তুমি তোমার বাবার মতোই মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছো। এই যাত্রা বৃথা।”

মেঘলা কাঁপতে কাঁপতে অরিন্দমের হাত চেপে ধরল। “ওকে বিশ্বাস কোরো না।”

কিন্তু আসল রোহন তখন ভয় আর রাগে কাঁপছিল। “ওরা আমার রূপ নিয়ে এসেছে… মানে এরা আমাকে ভেঙে ফেলতে চাইছে।”

ছায়ার রোহন হেসে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে বর্শার মতো এক অদ্ভুত অস্ত্র তৈরি করল হাত থেকে। সেটা ঝলসে উঠল আগুনের মতো আলোয়।

অরিন্দম মশাল উঁচিয়ে ধরল। আলো পড়তেই ছায়ামূর্তিটা কেঁপে উঠল, কিন্তু মিলিয়ে গেল না। বরং আরও শক্ত হয়ে উঠল।

তখনই গুহার অন্য দিক থেকে আরেকজন বেরিয়ে এল— এবার মেঘলার অবয়ব। মুখে ঠান্ডা হাসি, চোখে অদ্ভুত শূন্যতা।

“অরিন্দম,” সে কণ্ঠ নকল করে বলল, “তুমি জানো আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। আমি এখানে শুধু গবেষণার জন্য এসেছি, তোমার বাবার জন্য নয়।”

মেঘলা চেঁচিয়ে উঠল, “না! ও আমি নই!”

অরিন্দমের মাথা ঘুরে যাচ্ছিল। চারপাশে নিজের সঙ্গীদের প্রতিচ্ছবি দেখে মনে হচ্ছিল সত্যিই কাকে বিশ্বাস করবে আর কাকে করবে না।

হঠাৎ ছায়ার মেঘলা ঝাঁপিয়ে পড়ল। অরিন্দম মশাল দিয়ে ঠেকাল, তবু তার নখরে আঁচড় লেগে গেল কাঁধে। ব্যথায় সে গর্জে উঠল।

রোহন দাঁত চেপে তার ছায়ার সামনে দাঁড়াল। “তুই যতই আমার মতো হ, আমি জানি আমি তোর মতো কাপুরুষ নই।” সে ঝাঁপিয়ে পড়ল নাইফ নিয়ে। দু’জনের লড়াই শুরু হলো। ছায়া শক্তিশালী হলেও রোহনের দৃঢ়তা তাকে হারাতে দিল না। অবশেষে আলোয় নাইফ ঝলসে উঠল, ছায়ার বুক চিরে গেল, আর কালো ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেল।

অরিন্দম আর মেঘলা একসঙ্গে ছায়ার মেঘলার ওপর আক্রমণ করল। আলো আর মশালের আগুনে সে চিৎকার করে গলে গেল।

গুহার ভেতর আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল। শুধু মাঝখানে পাথরের স্তম্ভ দাঁড়িয়ে রইল, তার গায়ে প্রতীকের আলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

অরিন্দম হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এটাই বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া। অদৃশ্য নয়, আমাদের ভেতরের ভয় আর সন্দেহ।”

মেঘলা চোখ মুছল। “আমরা যদি একে অপরকে বিশ্বাস না করতাম, তবে এখানেই শেষ হয়ে যেত সব।”

রোহন কণ্ঠ শুকিয়ে বলল, “তাহলে বাবার সতর্কবাণী সত্যি— শেষ পরীক্ষাটা আমাদের ভেতরেই।”

কিছুক্ষণ তারা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর অরিন্দম স্তম্ভের গায়ে হাত রাখল। মুহূর্তেই প্রতীকের ভেতর থেকে আলো বেরিয়ে এলো। আলো গুহার অন্ধকার কেটে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। স্তম্ভ ধীরে ধীরে ফেটে গেল, ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আরেকটা ছোট বাক্স।

বাক্স খুলতেই দেখা গেল সোনালি ধাতব ফলক, তাতে খোদাই করা রহস্যময় চিহ্ন। আরেকটা পাণ্ডুলিপিও ছিল, যাতে প্রাচীন ভাষায় লেখা।

মেঘলা ফিসফিস করে বলল, “এটাই চূড়ান্ত উত্তর।”

কিন্তু ঠিক তখনই আবার বাঁশির সুর ভেসে এল। এবার এত তীব্র যে আলো কেঁপে উঠল।

গুহার অন্য প্রান্ত থেকে সূর্য আঁকা মুখোশধারী আবার বেরিয়ে এল। এবার তার মুখে বিকৃত হাসি। “তোমরা ভাবছো সব পেয়ে গেছো? না। সত্য কেবল আলোতে নয়, অন্ধকারেও লুকিয়ে থাকে। আর তোমাদের ভেতরেই আছে বিশ্বাসঘাতকতা।”

অরিন্দম দাঁড়িয়ে রইল, চোখে আগুনের মতো দৃঢ়তা। “না। আমাদের ভেতরে আলো আছে। তোমরা যতই অন্ধকার ছড়াও, আমরা হারাব না।”

মুখোশধারী হেসে উঠল। “তাহলে এসো, শেষ দ্বন্দ্ব হোক।”

গুহার ভেতর তখন যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিল। আলো আর অন্ধকার, বিশ্বাস আর বিশ্বাসঘাতকতার লড়াই শুরু হলো।

পর্ব ১০ : শেষ দ্বন্দ্ব মুক্তি

গুহার ভেতর অগ্নিদগ্ধ যুদ্ধক্ষেত্রের মতো হয়ে উঠেছিল। মশালের আলোয় মুখোশধারী সূর্য-মানব দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে দাউ দাউ আগুনের ঝিলিক। বাঁশির সুরে গুহার দেওয়াল কেঁপে উঠছিল, প্রতিধ্বনি হচ্ছিল মানুষের আর পশুর গর্জনের মতো। চারদিকে ছায়ারা নড়ে উঠছিল, যেন অন্ধকার নিজেই শত্রু।

অরিন্দম বুক সোজা করে এগিয়ে গেল। হাতে মশাল, অন্য হাতে বাবার ডায়েরি আর পাণ্ডুলিপি। তার চোখে ভয় নেই, শুধু দৃঢ়তা। “তুমি যতই অন্ধকার ছড়াও, সত্যকে আর লুকিয়ে রাখতে পারবে না।”

মুখোশধারী হেসে উঠল, কণ্ঠ গর্জন করে উঠল, “সত্য? সত্য মানুষের পক্ষে সহ্য করা যায় না। জ্ঞান মানেই ধ্বংস। তাই আমরা একে পাহারা দিই।”

মেঘলা এগিয়ে এল। “কিন্তু জ্ঞান যদি আলোকে আটকায়, তবে সেটাই সবচেয়ে বড় অভিশাপ।” তার কণ্ঠে কম্পন থাকলেও চোখে জ্বলছিল আগুন।

রোহন দাঁত চেপে নাইফ হাতে সামনে দাঁড়াল। “আমরা অনেক দূর এসেছি। এবার আর পিছোতে পারব না।”

তখনই মুখোশধারী বাঁশি ঠোঁটে তুলল। সুর বেরোতেই গুহার অন্ধকার থেকে ছায়ারা একে একে বেরিয়ে এলো। মানুষের অবয়ব, কিন্তু চোখ নেই, মুখ নেই। তারা তিনজনকে ঘিরে ফেলল।

অরিন্দম মনে পড়ল বাবার ডায়েরির শেষ লাইন— আলোই একমাত্র মুক্তি। যদি শেষ দ্বন্দ্বে পৌঁছাও, তবে আলো ভাগ করে নাও।”

সে চিৎকার করে বলল, “সব আলো একসঙ্গে জ্বালাও!”

তারা তিনজন মশাল, টর্চ আর শুকনো কাপড়ে বানানো আগুন একসঙ্গে জ্বালিয়ে তুলল। মুহূর্তে আলো ঝলসে উঠল, গুহার অন্ধকার কেটে গেল। ছায়াগুলো কেঁপে উঠল, ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেল।

মুখোশধারী এক গর্জনে বাঁশি ফেলে দিল। তার দেহে আগুনের আলো পড়তেই মুখোশ ফেটে গেল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক বৃদ্ধ মুখ। ক্লান্ত, ক্ষয়িষ্ণু, কিন্তু চোখে এখনও ক্রোধ।

সে চেঁচিয়ে উঠল, “তোমরা বুঝতে পারছো না। এই জ্ঞান মানুষের হাতে গেলে সর্বনাশ ঘটবে!”

অরিন্দম শান্ত গলায় বলল, “আমাদের ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। মানুষ ভয় পেলেও আলো খুঁজবে। তুমি যদি বিশ্বাসঘাতকতার ছায়া দেখাও, আমরা বিশ্বাসে দাঁড়াব।”

বৃদ্ধ হোঁচট খেয়ে স্তম্ভের সামনে পড়ে গেল। তার চোখে জল এসে গেল। “আমরা শবরদের শেষ উত্তরসূরি। শতাব্দী ধরে এই জ্ঞান পাহারা দিয়ে এসেছি। অনেক বহিরাগত এসেছিল, তারা লোভে পাগল হয়েছিল। তাই আমরা সবাইকে হত্যা করেছি।”

মেঘলা নিঃশ্বাস আটকে বলল, “কিন্তু আমরা লোভী নই। আমরা খুঁজছি উত্তর।”

বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “হয়তো সময় এসেছে এই দায়ভার ছেড়ে দেওয়ার। যদি তোমরা সত্যিই আলো বহন করতে পারো…”

তার কণ্ঠ মিলিয়ে গেল। বৃদ্ধ ধীরে ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মুখোশ ভেঙে টুকরো হয়ে গেল।

গুহার ভেতরে নিস্তব্ধতা নেমে এল। শুধু মাঝখানের স্তম্ভ থেকে এক অদ্ভুত আলো বেরিয়ে আসছিল। আলো ধীরে ধীরে পাণ্ডুলিপি আর ধাতব ফলকের দিকে ছড়িয়ে পড়ল। প্রতীকগুলো জ্বলজ্বল করতে শুরু করল, যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে।

মেঘলা বিস্ময়ে বলল, “এগুলো তারার মানচিত্র! এগুলো দিয়ে আকাশের রহস্য বোঝা যাবে।”

রোহন উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, “এই খবর ছড়িয়ে দিলে পুরো পৃথিবী কেঁপে উঠবে।”

অরিন্দম কিন্তু চুপ করে রইল। তার চোখে ভেসে উঠছিল বাবার মুখ। যদি তুমি সত্য খুঁজে পাও, তবে মনে রেখো, তা শুধু তোমার নয়, সবার।”

সে পাণ্ডুলিপি বুকে চেপে বলল, “আমরা এই জ্ঞান লুকাব না, কিন্তু অপব্যবহারও হতে দেব না। আমাদের দায়িত্ব হবে আলো ভাগ করে দেওয়া, ভয় নয়।”

তিনজন স্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে শপথ নিল। তারপর গুহার বাইরে বেরোতে শুরু করল।

কিন্তু বাইরে এসে দেখল, নদীর তীরে আবার সেই প্রাণী ভেসে উঠেছে। চোখ লালচে, দাঁত ধারালো। কিন্তু এবার তার দৃষ্টিতে আক্রমণাত্মক ভয় নেই, বরং শান্ত। মনে হচ্ছিল আলো তাকে শান্ত করেছে। প্রাণীটা ধীরে ধীরে নদীর গভীরে মিলিয়ে গেল।

ভেলায় চেপে তারা আবার নদী পার হলো। এবার আর বাঁশির সুর শোনা গেল না। বরং নদীর জল শান্তভাবে পথ দেখাল।

গিরিখাত পেরিয়ে, পাহাড়ের পথ ধরে, তারা অবশেষে বনের বাইরে এসে দাঁড়াল। আকাশ তখন ভোরের আলোয় ভরে উঠছে। সূর্য উঠেছে, আর সেই আলো তাদের মুখে পড়ছে।

মেঘলা মৃদু হাসল। “আমরা পেরেছি।”

রোহন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু আমাদের দায়িত্ব এখন শুরু হলো।”

অরিন্দম বাবার ডায়েরি মুঠো করে ধরল। তার চোখ ভিজে উঠল, কিন্তু মুখে শান্তি। “বাবা, তোমার অসমাপ্ত যাত্রা আমি শেষ করেছি।”

তিনজন শহরে ফিরে এল। সংবাদপত্র, গবেষণাগার, বিশ্ববিদ্যালয়— সবাই জানতে চাইল কী আবিষ্কার করেছে তারা। রোহন লিখল এক বিস্তৃত প্রতিবেদন, কিন্তু তাতে পাণ্ডুলিপির সমস্ত তথ্য প্রকাশ করল না। সে লিখল, অরণ্যের গভীরে আমরা খুঁজে পেয়েছি মানুষের প্রাচীন জ্ঞানের অমোঘ প্রমাণ। কিন্তু সব উত্তর এখনই দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ এই জ্ঞানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর দায়িত্ব।”

মেঘলা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শুরু করল। সে প্রমাণ করল, প্রাচীন শবররা শুধু উপজাতি নয়, তারা জ্যোতির্বিজ্ঞান আর ঔষধবিদ্যায় অগ্রগামী ছিল।

অরিন্দম বাবার ডায়েরি আর নতুন পাণ্ডুলিপি একত্রে রেখে লিখল নিজের বই— অরণ্যের গোপন মানচিত্র”। বইয়ের শেষে সে লিখল, আলো আর অন্ধকার দুটোই মানুষের ভেতরে থাকে। কিন্তু যিনি আলো বেছে নেন, তিনিই মুক্তি পান।”

বই প্রকাশের পর বিশ্বজুড়ে আলোড়ন পড়ল। মানুষ নতুন করে ভাবতে শুরু করল— ইতিহাস শুধু লিপিবদ্ধ নয়, তা অরণ্যের গভীরেও লুকিয়ে থাকে।

অরিন্দম জানত, লড়াই শেষ নয়। কিন্তু অন্তত প্রথমবারের মতো সে অনুভব করল, বাবার আত্মা এখন শান্ত।

বনের গভীরে, সেই বিস্মৃত গুহার মধ্যে, এখনও হয়তো বাঁশির প্রতিধ্বনি ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু আলো ছড়িয়ে পড়েছে। এবং আলোই জয়লাভ করেছে।

***

WhatsApp-Image-2025-09-01-at-5.11.24-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *