Bangla - রহস্য গল্প

অরণ্যের ওপারে

Spread the love

প্রিয়াঙ্কা অধিকারী


পর্ব ১

কলকাতার অফিসপাড়ায় ব্যস্ত সপ্তাহগুলো পেরিয়ে চার বন্ধু—সুমিত, অর্ণব, তনয় আর নিলয়—একসাথে ছুটি নিয়ে উত্তরবঙ্গের এক অজানা জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওদের মধ্যে সুমিত একটু বেশিই ঘুরে বেড়ায়, ভৌতিক আর অ্যাডভেঞ্চার গল্পে তার দারুণ আগ্রহ। অর্ণব ছিল দলটার প্ল্যানার, সবকিছু গুছিয়ে রাখতে ভালোবাসে। তনয় একটু চুপচাপ, কিন্তু দরকার হলে ওর মাথা ঠান্ডা থাকে। আর নিলয়? ও হল হাসির রসদ, দলটাকে চাঙা রাখে সবসময়।

ওরা গন্তব্য হিসেবে বেছে নেয় ‘দূর্গাপুর ফরেস্ট রেঞ্জ’—এই নামটা এতটা পরিচিত না হলেও নেট ঘাঁটতে গিয়ে সুমিত একটা পুরনো ব্লগে তার উল্লেখ পেয়েছিল। ব্লগের লেখক এক ব্রিটিশ অভিযাত্রী, যার কথায় নাকি এই জঙ্গলে একটা ‘হারানো সোনার শহর’-এর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বাকিরা এই গল্প শুনে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু সুমিতের চোখ জ্বলছিল কৌতূহলে।

ট্রেন ধরে ওরা পৌঁছায় নিউ মাল জংশন। সেখান থেকে একটা ভাড়া করা জিপে প্রায় দুই ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে ওরা পৌঁছায় সেই জায়গায়, যেখানে রাস্তা শেষ হয়ে যায়। তার পরের পথ হাঁটতে হবে। গাইড হিসেবে সঙ্গী হয় বীরু দা—এক স্থানীয় আদিবাসী, যে পাহাড় আর জঙ্গলের ভাষা বোঝে। সঙ্গ নিয়ে একটা ক্যাম্পিং ব্যাগ, দুটো টেন্ট, শুকনো খাবার, একটা কম্পাস আর সুমিতের পুরনো ম্যাপ।

জঙ্গলে ঢোকার আগে ওদের চোখে মুখে উৎসাহ, পাখিদের ডাক আর পাতার ফাঁকে রোদের খেলা যেন একটা অন্য জগতের দরজা খুলে দেয়। দিনের বেলায় হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা ছোটো ঝর্নার ধারে ক্যাম্প করে, সেখানেই রাতে থাকতে হবে।

সন্ধ্যার পর তনয় একটা আগুন জ্বালায়, আর সবাই গোল হয়ে বসে। সুমিত আবার সেই ব্রিটিশ ব্লগটার গল্প বলে—”লেখাটা বলছে এই জঙ্গলে এক সময় ছিল ‘রুধিরগড়’ নামের এক গোপন জনপদ, যেখানে সোনার মূর্তি ছিল। ব্রিটিশরা খুঁজে পায়নি, কারণ আদিবাসীরা জায়গাটা রক্ষা করত তুকতাক দিয়ে।”

নিলয় বলে, “তুই আবার সিরিয়াসলি এইসব বিশ্বাস করিস?”

সুমিত হাসে, “বিশ্বাস না থাকলে এই জঙ্গলে আসতাম কেন?”

অর্ণব টর্চ জ্বালিয়ে দেখে নেয় আশপাশে কিছু অদ্ভুত নেই তো, তারপর বলে, “গল্প শোনার জন্য এসেছি ঠিকই, তবে সাবধানে থাকতে হবে। এই জঙ্গল কিন্তু সাধারণ না।”

বীরু দা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর বলে, “রুধিরগড়-এর নাম আমরা ছোটোবেলায় শুনেছি। আমাদের দাদুরা বলতেন, সন্ধ্যার পর ওইদিকে গেলে পেছনে কারো ছায়া পড়ে না, শুধু বাতাসের ফিসফাস শোনা যায়।”

তনয় ফিসফিস করে বলে, “মানে… ভূত?”

বীরু দা হাসে না, চোখ মেলে চায় আগুনের দিকে—“ভূত না, পাহারাদার। সোনার পাহারাদার।”

হঠাৎ করে বাতাসে একটা ঠান্ডা ধাক্কা লাগে, আগুন একটু নেভে, আর পাতা কাঁপে একটু বেশি। সব্বাই চুপচাপ। যেন কিছু একটা ঠিকঠাক নেই।

পরদিন সকালবেলা উঠে ওরা হাঁটা শুরু করে সেই ম্যাপের দিক নির্দেশ মেনে। জঙ্গলের ভিতর বেশ অগম্য পথ, কাঁটা গাছ, ছোটো ছোটো খাল, নাম না জানা পোকামাকড় আর অদ্ভুত গন্ধে ভরা পথ। মাঝে মাঝে গাছের গুঁড়িতে কিছু আঁকিবুঁকি চোখে পড়ে, যেমন ধনুকের চিহ্ন, বা চোখের মতন কিছু, যেটা ওদের চেনা ভাষায় বোঝা যায় না।

তিন ঘণ্টা হাঁটার পর ওরা পৌঁছায় একটা পাথরের চূড়ার কাছে, যেখান থেকে মনে হয় পুরো জঙ্গল দেখা যায়। সেখানে এক পাশে ছড়ানো আছে ভাঙা পাথরের টুকরো, আর মাঝখানে একটা গোলাকার পাথরের মণ্ডপ। পাথরের ওপর একটা দাগ খোদাই করা—একটা সূর্য, তার নিচে তিনটে তীর।

সুমিত ম্যাপটা মেলে ধরে, আর বলে, “এই চিহ্নটা এখানে আছে! আমাদের ঠিক পথে চলেছি। সামনে একটা পুরনো টানেল থাকার কথা—গাছ আর পাথরের নিচে ঢাকা।”

নিলয় একটু অবিশ্বাস নিয়ে বলে, “তুই কি বলতে চাইছিস এই জায়গার নিচে কিছু লুকিয়ে আছে?”

অর্ণব বলে, “হতেই পারে। আসল প্রশ্ন হল—আমরা কি সেটা খুঁজে পেতে চাই?”

তনয় এক ঝলকে ওদের দিকে তাকায়। আগের উত্তেজনা আর নিরীহ মজা বদলে যাচ্ছে এক অজানা উত্তাপ আর অদ্ভুত ভয়েতে। চার বন্ধু একসাথে এক পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে এক নতুন রহস্যের পথ খুলছে। কেউ জানে না সামনে কী অপেক্ষা করছে, শুধু জানে—ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়।

পর্ব ২

পাথরের গোল মণ্ডপের পাশে দাঁড়িয়ে চারজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। বাতাস যেন খানিকটা থমকে গেছে, দূরে বাঁশঝাড়ের ফাঁকে কিছু একটা নড়ে উঠল, আবার থেমে গেল। সুমিত পাথরের দাগে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলল, “এই সূর্য আর তীরগুলোর মানে আছে। সূর্য বলছে সময় বা দিক, আর তীর মানে হয়তো চলার পথ।” সে ম্যাপটা খুলে আবার মিলিয়ে দেখে, “দেখো, ম্যাপে এখানে বলা আছে ‘সান পাথ ফলোস থ্রি অ্যারোজ’। মানে সূর্য যখন তিনটা তীরের দিকে ছায়া ফেলবে, তখন সঠিক পথ দেখাবে।”

অর্ণব ঘড়ি দেখে, “এখন সকাল দশটা। সূর্য একটু ওপরে উঠলে ছায়ার দিক বোঝা যাবে।” ওরা অপেক্ষা করতে থাকে। এই সময়টা যেন ঘন হয়ে আসে। একেকটা পাখির ডাক যেন বেশি তীক্ষ্ণ লাগে, পাতার খসখস যেন গোপন কিছু বলছে।

অবশেষে সূর্যের ছায়া একটা নির্দিষ্ট কোণ বরাবর পড়ে তিনটে তীরের দিকেই। ওরা চারজন ওই ছায়ার রেখা মেনে কিছুটা সামনে এগিয়ে যায়। প্রায় দশ পা হেঁটে হঠাৎ তনয় থেমে যায়। সে বলে, “এই জায়গাটা একটু অন্যরকম না? মাটিটা আলগা মনে হচ্ছে।”

নিলয় এক হাঁটু মুড়ে বসে, হাত দিয়ে মাটি খোঁচাতে খোঁচাতে বলে, “সত্যি! এখানে কেউ যেন ইচ্ছে করে মাটি ঢেকে রেখেছে।”

বীরু দা ওদের কাছে এসে বলে, “এই ধরনের জায়গা আমরা বলি ‘গোপন বীজ’। এর নিচে কিছু একটা লুকানো থাকে।”

তাড়াতাড়ি সবাই হাতে হাত লাগায়। মাটি সরাতে সরাতে একটা পাথরের ঢাকনা বেরিয়ে আসে, যেটার গায়ে সেই একই সূর্যের চিহ্ন খোদাই করা। ঢাকনাটা বেশ ভারি, একসাথে ধাক্কা দিয়ে কোনোভাবে সরানো যায়। নিচে নেমে গেছে পাথরের সিঁড়ি, অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে, আর একটা ঠান্ডা হাওয়া বেয়ে উঠছে ওপরে।

তনয় নিঃশ্বাস আটকে বলল, “এই জায়গায় মানুষ আসেনি বহু বছর।”

সুমিত টর্চটা জ্বালিয়ে বলে, “চলো, এবার নিচে নামা যাক। কিন্তু সাবধানে। কারা যেন ইচ্ছে করে এটা গোপন রেখেছিল, তার মানে কিছু একটা ছিল, বা এখনও আছে।”

এক একজন করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকে। দেওয়ালে জল চুঁইয়ে পড়ছে, কোথাও কোথাও অজানা ছত্রাকের গন্ধ, আর মাঝে মাঝে দেওয়ালে খোদাই করা ছবি—একটা নগর, যোদ্ধারা সোনার বর্ম পরে দাঁড়িয়ে আছে, একটা অদ্ভুত রত্নমণ্ডিত সিংহাসন। ছবিগুলো ধুলো আর শ্যাওলার নিচে ঢাকা থাকলেও স্পষ্ট বোঝা যায়, এই জায়গাটা সাধারণ নয়।

প্রায় কুড়ি ধাপ নিচে নামার পর ওরা পৌঁছে যায় একটা ছোটো গুহার মুখে। ভেতরটা সাইলেন্ট, যেন শব্দ ঢুকতেই চায় না। ঠিক মাঝখানে একটা বেদি, আর তার ওপর বসানো একটা পাথরের বাক্স। বাক্সের মুখে মোটা শিকল বাঁধা আর তার গায়ে খোদাই করা ভাষা—ওরা চেনে না, কিন্তু তার নিচে ছোটো করে ইংরেজিতে লেখা—

“Only the true seeker, with no greed, may open this box.”

নিলয় ফিসফিস করে, “মানে যারা লোভী নয়, তারাই এটা খোলার অধিকারী।”

অর্ণব বলে, “তবে কি এটা কোনো ফাঁদ? খুললেই বিপদ?”

সুমিত বলে, “দেখো, সব রহস্যের পেছনে ভয় থাকে। কিন্তু আমরা যদি না খুলি, তবে এই পথ আসা বৃথা।”

তনয় বেদির চারদিকে ঘুরে দেখে, “এই শিকলটা খুলতে একটা বিশেষ প্যাটার্ন দরকার, হয়তো কোনো গোপন ছাঁচ বা চাবি।”

হঠাৎ বীরু দা বলে ওঠে, “এই বাক্স আমি দেখেছি, অনেকদিন আগে, এক বৃদ্ধ আমাদের গ্রামে বলেছিল—‘যে বাক্স পাহাড়ের নিচে ঘুমায়, তার ভেতরে সময় বন্দি।’ আমি বিশ্বাস করিনি, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে…”

সুমিত ধীরে ধীরে শিকলের গায়ে হাত বোলায়। হঠাৎ একটা শব্দ হয়—“ক্লিক!” যেন শিকলের কোথাও একটা লুকোনো ছাঁচে আঙুল পড়েছে।

তারপর ধীরে ধীরে বাক্সটা খুলে যায়।

ভেতরে রাখা একটা কাপড়ে মোড়া বস্তু। খোলার পর দেখা যায়, একটা ছোটো কাঠের মূর্তি—এক সিংহের মাথা, গায়ে রক্তরঙা আভা, আর তার চোখে সোনার খণ্ড। আর তার নিচে লেখা একটা ছেঁড়া কাগজ, যাতে অর্ধেক মানচিত্র আঁকা আর অর্ধেক কিছু ছেঁড়া বাক্য—

“…the key lies beyond the river of silence… beware the Red Gate…”

চার বন্ধু বাক্সের দিকে তাকিয়ে বোঝে, এটা কেবল শুরু। একটা মানচিত্রের টুকরো, একটা মূর্তি আর অজানা শব্দ—“রেড গেট”—এই সব কিছু মিলিয়ে একটা আরও গভীর রহস্যের পথে তাদের নিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ ওপর থেকে একটা শব্দ আসে—পাতা কাঁপছে, যেন কেউ বা কিছু নামছে সিঁড়ি দিয়ে…

পর্ব ৩

সিঁড়ি থেকে ভেসে আসা পাতার খসখস শব্দে চার বন্ধুর হৃদস্পন্দন থমকে যায়। গুহার অন্ধকারে কেবল সুমিতের টর্চের আলো, যা বাক্সের মূর্তির ওপর পড়ে রয়েছে—সিংহমুখ, সোনার চোখ, আর কাগজের ছেঁড়া মানচিত্র। তনয় নিঃশব্দে ইশারা করে টর্চটা বন্ধ করতে, অন্ধকার যেন একমাত্র আশ্রয়। আলো নিভতেই অর্নব কাঁপা গলায় ফিসফিস করে, “ওটা কে?”

সবাই চুপ। একমাত্র শোনা যায় সেই ধীর গতির পায়ের আওয়াজ, যেন কেউ ভারি বুট পরে নামছে। শ্বাস বন্ধ করে ওরা অপেক্ষা করে, প্রতিটা মুহূর্ত যেন বিশাল দীর্ঘ হয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ সেই আওয়াজ থেমে যায়। কেউ একজন দাঁড়িয়ে, সিঁড়ির একেবারে শেষ ধাপে।

নিলয় মুখ চেপে ধরে, যেন ভেতর থেকে কোনো শব্দ বের না হয়ে যায়। সুমিত আস্তে করে মূর্তিটা কাপড় জড়িয়ে ব্যাগে ঢোকায়, আর বাক্সটা আবার সাবধানে বন্ধ করে দেয়। ঠিক তখনই একটা চেঁচানো গলার শব্দ—“কে আছিস নিচে? জানি তোকে!”

ওরা থমকে যায়। গলার স্বর পুরুষের, কিন্তু কেমন যেন কর্কশ, যেন বহু বছর ধরে কারও গলা চিরে গেছে। বীরু দা ফিসফিস করে বলে, “এ গলা আমি চিনি না। এ আমাদের গ্রামের কেউ নয়। কিন্তু শুনেছি… পাহাড়ে যে লোক রাত নামার পর কথা বলে, তার চোখ থাকে না।”

এই মুহূর্তে কোনো ভয় আর যুক্তির জায়গা রাখে না। অর্ণব চট করে বলে, “পেছনের পথ খুঁজতে হবে। এখান থেকে বেরোতেই হবে।” ওরা চারজনে টর্চ জ্বালিয়ে গুহার অন্য প্রান্তে খোঁজ করতে থাকে, যেখানে দেওয়ালে অদ্ভুত সব চিহ্ন আঁকা ছিল—যোদ্ধা, আগুন, আর একটা লাল দরজা। ঠিক সেই দেওয়ালের নিচে একপাশে মাটির স্তর একটু ঢেউখেলানো, যেন কারও পায়ের চাপে গোপন রাস্তা তৈরির চিহ্ন।

তনয় মাটি সরাতেই বেরিয়ে আসে একটা সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ। নিলয় বলে, “যাই হোক, এই পথ হয়তো বাইরের দিকে নিয়ে যাবে। অন্তত ওপরে যে এসেছে, তার সঙ্গে দেখা করতে চাই না।”

সুমিত সবার আগে ঢোকে, তারপর একে একে সবাই। পেছন থেকে সেই কর্কশ গলা আবার বলে ওঠে—“তুমি যদি মূর্তি নিয়ে থাকো, তাহলে শাস্তি হবে। ওই রক্তের সিংহ পাহারা দেয় রেড গেট। ফিরে যাও!”

কিন্তু ওরা আর থামে না। গুহার ভেতরকার সেই গোপন সুড়ঙ্গ স্যাঁতসেঁতে, আঁকাবাঁকা আর ভয়ানক ঘুটঘুটে অন্ধকার। টর্চের আলোয় দেখা যায় দেওয়ালের গায়ে আঁকা আরেকটা দৃশ্য—একটা লাল দরজা, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সিংহমুখো মানুষরূপী প্রাণী। আর তার নিচে লেখা অদ্ভুত এক উল্টোপথ ভাষা, যার কিছু অংশ পড়ে বোঝা যায়—“Only when four truths meet, the door opens.”

তনয় বলে, “চারটে সত্য… এর মানে আমরা চারজন? চারজনের আলাদা কিছু জানা দরকার রেড গেট খুলতে?”

সুমিত কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে মানচিত্রের ছেঁড়া টুকরোটা খুলে। যেখানে লেখা ছিল “Beyond the river of silence”—তার পাশে ছোট করে আঁকা একটা জলস্রোত, আর তার ওপারে একটা ত্রিভুজ আকৃতির পাহাড়, তার গায়ে লাল চিহ্ন।

নিলয় হঠাৎ মুখ নিচু করে দেয়ালে কিছু আঁকা দেখতে পায়। সেখানে একটা নদীর ছবি, যার জলে কোনো ঢেউ নেই। তার নিচে তীর দিয়ে পথ দেখানো, আর শেষে আবার সেই লাল দরজা। অর্ণব বলে, “এই সুড়ঙ্গ হয়তো আমাদের সেই নদীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।”

ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর ওরা বেরোয় জঙ্গলের আরেকপাশে। সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সামনেই এক নির্জন নদী—চওড়া, কিন্তু সম্পূর্ণ নিস্তরঙ্গ, যেন তার গতি নেই। পাখি নেই, মাছ নেই, শব্দ নেই। বায়ুও থমকে থাকা এক রহস্যময় নীরবতা।

সুমিত ফিসফিস করে বলে, “এটাই ‘রিভার অফ সাইলেন্স’। এটা পার হতে হবে।”

বীরু দা পিছন থেকে বলে, “এই নদী পার হলে আর ফেরা যায় না, এমন কথা আমরা শুনেছি। অনেক আদিবাসী প্রবেশ করে আর ফেরেনি।”

অর্ণব গম্ভীর গলায় বলে, “আমরা এখন এমন এক দরজার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যার ওপারে শুধু ভয় নয়, হয়তো ইতিহাস আছে, কিংবা মৃত্যু।”

তবু চারজন জুতো খুলে নদীতে পা রাখে। জল ঠান্ডা, কিন্তু কোনো টান নেই। বুক অবধি গিয়ে ধীরে ধীরে সাঁতরে ওপারে ওঠে তারা। ওপাশের ঘন জঙ্গলে ঢুকতেই হঠাৎ এক ঝলক আলো—আর তার মধ্যে দেখা যায় দূরে একটা বিশাল গেট। রক্তরঙা দরজা, তার মাথায় সিংহমুখ খোদাই করা। আর তার নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষ—না, হয়তো মানুষ নয়।

তার গায়ে লাল বর্ম, চোখে সোনার ছায়া। সে চুপ করে চারজনকে দেখে। আর চারজন থেমে দাঁড়িয়ে, হাওয়ার মধ্যেও একটা অদ্ভুত ফিসফাস ভেসে আসে—

“তোমরা কি প্রস্তুত? সত্য বলার সাহস আছে?”

পর্ব ৪

চারজন দাঁড়িয়ে পড়ে লাল দরজার মুখোমুখি। বিশাল গেটের দুপাশে খাঁজকাটা পাথরের স্তম্ভ, যার মাথায় আগুন জ্বলছে—কিন্তু বাতাস নেই, তবুও শিখাগুলো নড়ছে না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই সিংহমুখো বর্মধারী প্রাণীটিকে দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়, যেন তার চোখ সোজা অন্তর্যামীতে ঢুকে যায়। ভয় নয়, বরং এক তীব্র সত্য চাপ দিয়ে বসে, যাকে অস্বীকার করা যায় না।

সে ধীরে ধীরে বলে ওঠে, “প্রবেশের আগে প্রত্যেকে একবার করে নিজের ‘সত্য’ বলবে—যা কাউকে কখনও বলেনি। যদি সে সত্য হৃদয়ের গভীর থেকে আসে, তবে এই দরজা খুলবে। যদি মিথ্যে বলে, তবে দরজা থেকে বেরিয়ে আসবে আগুন। একবার সুযোগ।”

চারজন একে অপরের দিকে তাকায়। জঙ্গলের গাঢ় নীরবতার ভেতর যেন ঘড়ির কাঁটার শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। প্রথমে অর্ণব এগিয়ে আসে। গলা শুকিয়ে এসেছে, তবু সে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি ছোটোবেলায় আমার ভাইয়ের সামনে একটা জিনিস ভেঙে ফেলেছিলাম, আর দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়েছিলাম। মা তাকে তিন দিন কথা বলেনি। আমি আজও সেটা বলিনি কাউকে।”

দরজার নিচে থাকা পাথরের গায়ে হালকা এক কম্পন হয়, যেন শ্বাস নিচ্ছে। কিন্তু আগুন বেরোয় না। সিংহমুখ বলে, “সত্য। পরবর্তী?”

তনয় এগোয়, চোখ নামিয়ে বলে, “আমি এখনকার কাজটা ভালোবাসি না। আমি অনেকবার অফিসের জরুরি রিপোর্ট ভুল করে ফেলে দিয়েছি, জানিয়ে দিইনি কাউকে, সব সময় অভিনয় করেছি যেন সব ঠিক আছে। আমি ভীতু। আমি ব্যর্থতাকে ভয় পাই।”

আবার সেই পাথরের গায়ে কম্পন। শিখা শান্ত থাকে। এবার সুমিত সামনে যায়। তার মুখে দ্বিধা, কিন্তু গলায় সুর স্পষ্ট, “আমি প্রেম করেছি এমন একজনের সঙ্গে, যার প্রেমিক ছিল আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। ওকে কোনোদিন বলিনি। আমি জানতাম এটা ভুল, তবু থামতে পারিনি।”

এইবার দরজার পেছনে একটা গর্জনের মতো আওয়াজ হয়, যেন কোথাও থেকে পাথর ঘষে যাচ্ছে। আগুনের রঙ গাঢ় হয়, কিন্তু বেরোয় না। অবশেষে, নিলয় সামনে আসে। সে একদম দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, চোখ বন্ধ করে বলে, “আমি বাবার মৃত্যুর সময় বাড়িতে ছিলাম, কিন্তু আমি ইচ্ছে করে ওঁর পাশে যাইনি। আমি ভয় পেয়েছিলাম। সবাই ভাবে আমি সময়মতো পৌঁছাতে পারিনি, কিন্তু আসলে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কাঁদছিলাম, ভিতরে যাইনি। এটা আমি আজও কাউকে বলিনি।”

এবার দরজার সিংহমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আলো ঝলকে ওঠে পুরো জঙ্গল। গেটের মুখ খুলতে থাকে ধীরে ধীরে, একটা গম্ভীর শব্দে। ভেতরে অন্ধকার সুড়ঙ্গ, যার শেষে এক নিস্তব্ধ আলো দেখা যায়, ঠিক যেন সূর্যের ছায়া নিচে নামছে।

সিংহমুখ বলল, “তোমরা চারজন পথের উপযুক্ত। কিন্তু ভেতরে যা আছে, তা কেবল সাহস নয়—বুদ্ধি, বিশ্বাস আর আত্মত্যাগও চাইবে।”

ওরা একে একে ভেতরে ঢোকে। দরজা পেছনে আবার বন্ধ হয়ে যায়। এখন তারা এক নতুন জগতে—এখানে দেয়ালে আগুন জ্বলছে, প্রতিটা ঘরে একেকটা ধাঁধা, একেকটা ফাঁদ।

প্রথম ঘরে ঢুকতেই দেখা যায় একটা দেয়ালে লেখা—

“One must choose the weight of truth. Pick the right stone to pass.”

ঘরের মাঝে রাখা আছে পাঁচটা পাথর। দেখতে একইরকম, কিন্তু নিচে লেখা—Hope, Fear, Love, Greed, Regret.

সুমিত ফিসফিস করে, “এই পাথরের ওজন আলাদা? নাকি এদের নামের গুরুত্ব?”

তনয় এগিয়ে গিয়ে ‘Greed’ লেখা পাথর তুলতেই ঘর কেঁপে ওঠে, ছাদ থেকে ধুলো ঝরতে থাকে। সে তাড়াতাড়ি সেটা নামিয়ে দেয়। অর্ণব এবার ‘Fear’ তুলতেই দেয়ালের পাশ থেকে একটা গহ্বর খুলে যায়। একটা সিঁড়ি বেরিয়ে আসে। নিলয় মৃদু হাসে, “ভয়ের ভার নেওয়া মানে নিজেকে চিনে নেওয়া।”

তারা নিচে নামে। প্রতিটা ঘর তাদের ভেতরের কিছুটা উল্টে দেয়—মনে করিয়ে দেয় তারা কারা, আর কতটা ভাঙলে সত্যি পৌঁছানো যায়। অবশেষে তারা এসে পড়ে এক বিশাল ঘরে, যার ঠিক মাঝখানে রাখা আছে একটা পাথরের চক্র। আর তার গায়ে খোদাই করা লিপিতে লেখা—

“যে চক্র ভাঙবে, সেই পাবে সময়ের দরজা খোলার চাবি। কিন্তু ভাঙার অর্থ নিজেকে হারানোও হতে পারে।”

চারজন এবার একে অপরের চোখে চোখ রাখে। এই চক্র যদি ভাঙতে হয়, তবে কাকে আত্মত্যাগ করতে হবে?

পর্ব ৫

চারজনের মাথার ওপর ঝুলে থাকা আগুনের আলো আর পাথরের চক্রের নীরব উপস্থিতি ঘরটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। চক্রটা যেন কেবল পাথর নয়, তার গায়ে যেন সময় জমে আছে, আর চারদিকের দেওয়ালে খোদাই—অদ্ভুত সব প্রতীক, যেমন ঘড়ির কাঁটা, সূর্য অস্তমিত হচ্ছে, নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, মানুষের মুখ গলে ছায়া হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে একটা চাপা অস্থিরতা ঘরের বাতাসে জমে উঠেছে।

অর্ণব নিচু গলায় বলল, “চক্র ভাঙলে সময়ের দরজা খুলবে, কিন্তু কেউ হয়তো হারিয়ে যাবে। এর মানে কি আমাদের কাউকে…?”

তনয় ধীরে ধীরে চক্রের চারপাশে হাঁটতে থাকে। তার চোখে ঘোর, সে যেন দেওয়ালের প্রতিটি খোদাই দেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। তারপর হঠাৎ বলে ওঠে, “দেখো, এই চক্রটা চার ভাগে ভাগ করা, প্রতিটা অংশে একেকটা প্রতীক—জল, আগুন, বাতাস আর ছায়া। এই চারটাই আমাদের প্রতিটা মানুষের প্রতিচ্ছবি। যদি একটা অংশ ভাঙো, পুরো চক্র ভাঙবে না, কেবল ভেতরের সময় খুলে যাবে।”

নিলয় বলে, “মানে আমাদের মধ্যে একজনকে নিজের প্রতীক বেছে নিতে হবে আর সেটা ভাঙতে হবে। আর সেটা করতে হবে পুরো মন থেকে। না হলে এটা প্রতিক্রিয়া দেবে।”

বীরু দা বলে, “তবে কি এই চক্র নিজের আত্মা দিয়ে খোলা যায়?”

সুমিত সামনে এগিয়ে চক্রটার এক পাশে হাত রাখে, যেখানে আগুনের চিহ্ন আঁকা। সে কিছু সময় চুপ থেকে বলে, “আমার ভেতরে সবসময় রাগ ছিল। সবকিছু আগুনে জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করত—নিজেকেও, অন্যকেও। আমি এই আগুন ভাঙতে পারি। কারণ আমি জানি, ভেতরের আগুন না নিভলে বাইরে আলো পাওয়া যায় না।”

সে চক্রের আগুন-চিহ্নে চাপ দিতেই একটা শব্দ হয়—“খট”। চারপাশে অদ্ভুত ঝিরঝিরে বাতাস বইতে শুরু করে, পাথরের চক্র ফাটল ধরে। কিন্তু ঠিক তখনই ঘরের একপাশ থেকে বেরিয়ে আসে ধাতব অঙ্গুলির মতো একজোড়া হাত—ছায়ার ভেতর থেকে।

তনয় চেঁচিয়ে ওঠে, “সাবধান! এটা ফাঁদ!”

হাতগুলো সুমিতের দিকে ধেয়ে আসে, কিন্তু ঠিক তখনই অর্ণব নিজের দিক থেকে বাতাসের চিহ্নে হাত রাখে, “আমি ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করি না, বরং ও-ই আমায় চালায়। আমি বাতাস ভাঙব, কারণ আমি জানি, হাওয়ার মতো ভয় থাকে না—তবুও থাকে। আমি আজ ভয়কে ভাঙতে চাই।”

বাতাসের চিহ্নে সে চাপ দিতেই একধরণের হালকা কুয়াশা ঘরটা ঢেকে ফেলে, আর সেই অন্ধকার হাতগুলো মিলিয়ে যায় বাতাসে। এবার চক্রের দুই অংশ ভাঙা।

তনয় এগিয়ে এসে ‘জল’-এর পাশে দাঁড়ায়। “আমার মধ্যে ছিল অভিমান—ধারাস্রোতের মতো, যা অন্যকে ভাসিয়ে দেয়। সেই জল বহু সম্পর্ক ডুবিয়েছে। আমি এই জল ভাঙতে চাই।”

চাপ দিতেই দেওয়ালের নিচে থেকে জল গড়িয়ে এসে চক্রটাকে ছুঁয়ে ফিরে যায়। এখন কেবল বাকি ছায়া।

নিলয় কিছুক্ষণ নীরব থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, “আমি ছায়া। আমি সবসময় পিছনে থেকেছি। আমি যা করিনি, তাই আমাকে সংজ্ঞায়িত করেছে। কিন্তু আমি এবার নিজের ছায়াকে ভাঙতে চাই—নিজেকে দেখতে চাই সম্পূর্ণ আলোয়।”

সে ছায়ার চিহ্নে চাপ দিতেই চক্রটা বিকট শব্দে ফেটে যায়, আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা ছোট, গোল ধাতব বস্তু। সেটা বাতাসে ভেসে উঠে গিয়ে দেয়ালের এক বিশেষ গহ্বরে বসে যায়।

পরমুহূর্তেই ঘরটা কেঁপে ওঠে। সামনে খুলে যায় এক সুড়ঙ্গ—আরও গাঢ়, আরও নিচের দিকে নামা পথ। তার গায়ে ঝুলছে অদ্ভুত লণ্ঠন, আর দূর থেকে ভেসে আসছে একটা ছায়াময় সুর—যেন অনেকগুলো কণ্ঠ একসাথে বলছে, “তোমরা সত্যি এসেছো? তবে প্রস্তুত হও… শেষ খেলা শুরু হল।”

সুমিত পেছন ফিরে একবার চারপাশে তাকায়, “যত গভীরে যাচ্ছি, আমি ততটাই নিজেকে চিনছি। এই গুপ্তধন শুধু সোনা নয়। এটা আমাদের আত্মার পরত খোলার যাত্রা।”

ওরা চারজনে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সেই সুড়ঙ্গের গভীরে। দেয়ালে আঁকা এখন শুধুই একটা দৃশ্য—একটা বিশাল সিংহাসন, যার একপাশে সোনার অস্ত্র, আর অন্য পাশে সময়ের ঘড়ি থেমে আছে।

আর তার নিচে লেখা—“শুধু সে-ই বসতে পারে, যে নিজের মৃত্যু মেনে নেয়।”

পর্ব ৬

তলিয়ে যাওয়া সেই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় এসে দাঁড়াতেই চার বন্ধুর সামনে খুলে গেল এক বিশাল গম্বুজঘর। মাথার ওপরে উঁচু ছাদ, যেখানে হাজারো ছোট ছোট গর্ত দিয়ে ছেঁকে পড়ে সূর্যের আলোর মতো এক নীলচে আলো। ঘরের মাঝখানে সোনালি ধাতুর তৈরি এক বিশাল সিংহাসন, তার পাশে রাখা কালো পাথরের ঘড়ি—যার কাঁটা থেমে আছে ঠিক তিনটেয়। ঘড়ির নিচে লেখা—“Moment of Death.”

দেয়ালের গায়ে আঁকা এক দৃশ্য: চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে এক চূড়ার কিনারায়, আর নিচে অন্ধকার খাদ। সিংহাসনের নিচে ছোট একটা পাথরের ফলক, যাতে খোদাই করা—

“যে বসবে, সে নিজেকে ভুলবে। যে ভুলবে, সে খুঁজে পাবে। কিন্তু যে ফিরে আসবে, তার চিহ্ন থাকবে না।”

নিলয় আস্তে বলে, “এই সিংহাসন যেন আত্মবলির প্রতীক। কিন্তু যদি কেউ বসে, সে কি মারা যাবে? নাকি ভুলে যাবে সে কে?”

তনয় পিছনে পায়চারি করে। চোখেমুখে অস্থিরতা। “এটা যদি পরীক্ষাও হয়, তাহলে পরিণামটা স্থায়ী। এ পথ আর ফেরার নয়। কিন্তু গুপ্তধন? সেটাও কি এই মৃত্যু জানার পথেই লুকিয়ে আছে?”

সুমিত নিচু গলায় বলে, “তবে হয়তো মৃত্যু মানে শরীরের শেষ নয়। হয়তো আমাদের ‘আগের সত্তা’ মারা যাবে—ভুলে যেতে হবে আমরা কে ছিলাম, কী করতাম, কোন দুঃখ বয়ে এনেছি। তারপর হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে সত্যিকারের গুপ্তধন।”

অর্ণব সামনে এগিয়ে সিংহাসনের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সে চুপ করে তাকিয়ে থাকে কালো ঘড়িটার দিকে। তারপর আস্তে বলে, “আমার সবসময় মনে হত আমি নিজের জীবনে বসে আছি, সিংহাসনে। কিন্তু আসলে আমি পালিয়ে বেড়িয়েছি। নিজের ব্যর্থতা, ভুল সিদ্ধান্ত, ভালোবাসার ক্ষতি থেকে। আমি যদি আজ এই সিংহাসনে বসি, হয়তো আমি প্রথমবার নিজের সামনে দাঁড়াবো। মৃত্যু মানে যদি নিজের মিথ্যা সত্তাকে হত্যা হয়, তবে আমি সেটা মেনে নিতে প্রস্তুত।”

কেউ তাকে থামায় না। অর্ণব ধীরে ধীরে উঠে বসে সিংহাসনে। মুহূর্তেই ঘরের সব আলো নিভে যায়। ঘড়ির কাঁটা হঠাৎ নড়তে শুরু করে—টিক… টিক… টিক…

এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে বয়ে যায়। দেওয়ালের আঁকা মানুষের মুখগুলো হঠাৎ পাল্টে গিয়ে হয়ে যায় সিংহ-মুখ। ঘড়ির কাঁটা গিয়ে থামে ঠিক ৩:১৫-তে। আর তখনই সিংহাসনের নিচে মেঝে ফেটে গিয়ে ওপরে উঠে আসে এক বাক্স। প্রাচীন কাঠের, তামার পাতায় মোড়া। অর্ণব নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়, তার চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা, মুখে কোনো চেনা অভিব্যক্তি নেই।

তনয় ফিসফিস করে, “ওর চেহারা এক, কিন্তু কিছু যেন বদলে গেছে। অর্ণব, তুই ঠিক আছিস?”

সে মাথা নাড়ে। “আমি ঠিক আছি। কিন্তু আমি জানি না আমি কে। আমি কেবল জানি, এই বাক্সটা আমাদের জন্য।”

নিলয় তাড়াতাড়ি বাক্সটা খোলে। ভেতরে একটা ভাঁজ করা কাগজ, আর তলার দিকে রাখা চারটা ছোট ধাতব খিলি। কাগজে লেখা—

“চতুর্ভুজ তৈরি করো, রক্তের বিনিময়ে খুলবে মূল দরজা।”

সুমিত বিস্ময়ে বলে, “এই চারটে খিলি আমাদেরই জন্য। আমাদের রক্ত দিতে হবে? কোথায়?”

ঠিক তখনই ঘরের একপাশে মাটি নেমে গিয়ে বেরিয়ে আসে আরেক গোপন দরজা। তার গায়ে আঁকা চারটি চিহ্ন—পানি, আগুন, বাতাস ও ছায়া। প্রত্যেক চিহ্নের নিচে ছোট এক ফোঁটা রক্ত রাখার জায়গা।

তনয় নিঃশব্দে নিজের আঙুলে কাটে, রক্ত ফোঁটায় দেয় পানির চিহ্নে। তারপরে একে একে সবাই নিজের অংশে রক্ত দেয়। দরজাটা ধীরে ধীরে খুলতে থাকে—ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক নীলাভ আলো, আর সেই সঙ্গে এক মিষ্টি গন্ধ, যেন পুরনো ফুল, কুয়াশা আর সময় মিশে এক অদ্ভুত ঘ্রাণ।

ওরা চারজন ভেতরে ঢোকে। পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

এই নতুন কক্ষে কোনো সোনা নেই, কোনো মণিমাণিক্য নেই। আছে কেবল এক বিশাল আয়না, যার সামনে একটা সাদা পাথরের মঞ্চ। আয়নার গায়ে লেখা—

“এটাই গুপ্তধন—নিজেকে দেখা, চেনা, ভাঙা ও গড়া। যাকে এটা বোঝায়, সেই ফিরে যেতে পারে। বাকিরা রয়ে যাবে চিরকাল।”

সুমিত ধীরে ধীরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নায় সে দেখে না তার বর্তমান মুখ, বরং দেখতে পায় তার শৈশবের মুখ, তার ভুলগুলো, তার ভয়, তার গোপন ইচ্ছেগুলো। চোখ ভিজে আসে।

তনয় এগিয়ে এসে দেখে এক ভিন্ন মুখ—তার বাবার, যার সঙ্গে বহুদিন কথা হয়নি। সে দাঁড়িয়ে কাঁদে। আর আয়নার পেছনে তখন একটা পথ খুলে যায়—একটা ঘাসে ঢাকা উজ্জ্বল পথ, যেন সময়ের বাইরে কোথাও।

নিলয় ফিসফিস করে, “এটাই কি মুক্তি? এই তো সেই গুপ্তধন—নিজেকে চিনে ফেরা?”

অর্ণব হালকা হাসে। “হয়তো। কিন্তু আমি ফিরতে পারি না। আমি তো জানি না আমি কে।”

তবে কেউ তাকে ফেলে রেখে যেতে চায় না।

আর ঠিক তখনই পেছনের দেয়াল থেকে এক কণ্ঠ ভেসে আসে—

“সবাই ফিরতে পারবে, যদি একে স্বীকার করো। যদি কেউ ভুলে যেতে চায়, তাকেও ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কেননা প্রত্যাবর্তনের দরজা খুলে যায় বোঝার মুহূর্তে।”

আর সে মুহূর্তেই আয়নার চারপাশে আলো জ্বলে ওঠে। পথ খুলে যায়।

চার বন্ধু ধীরে ধীরে সেই আলোয় পা রাখে, পিছনে রেখে আসে রহস্যময় দরজা, মৃত্যুর ছায়া আর নিজেকে ভেঙে গড়ার রক্তাক্ত যাত্রা।

তারা জানে না ঠিক কোথায় ফিরছে। শুধু জানে—এবার ফিরছে সম্পূর্ণ হয়ে।

পর্ব ৭

আলোয় পা দেওয়ার মুহূর্তে চারজন অনুভব করে যেন শরীরটা হালকা হয়ে যাচ্ছে, মাটির টান নেই, সময়ের চিহ্ন নেই। তারা যেন ভাসছে—কোনো বাস্তব জগতে নয়, কোনো স্বপ্নেও নয়। এটা সেই মধ্যবর্তী জগৎ, যেখানে ফেরা আর না-ফেরার মাঝখানে মানুষ নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পেছনে যখন দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়, সামনে আর কোনো রাস্তা দেখা যায় না। শুধু কুয়াশা, ছড়িয়ে থাকা আলো, আর একটা অদৃশ্য শক্তির টান।

তনয় প্রথমে কথা বলে, “আমরা এখন কোথায়? এটা কি স্বপ্ন, না মরণকালীন হ্যালুসিনেশন?”

সুমিত বলে, “না… এটা একটা ফাঁক—একটা সময়চক্রের বাইরে থাকা করিডোর। কিছু একটা শেষ হয়েছে, কিছু শুরু হচ্ছে।”

হঠাৎ চারপাশের কুয়াশা কেটে গিয়ে উঁকি দেয় পরিচিত এক দৃশ্য—ওদের ছোটবেলার স্কুল মাঠ, ধুলোমাখা ফুটবল, পুরোনো ছেঁড়া ব্যাগ, টিফিন বক্সের গন্ধ। কিন্তু সবটাই যেন হঠাৎই বুদ্বুদের মতো ভেঙে যায়। আবার ভেসে ওঠে এক দৃশ্য—তনয়ের মায়ের ক্যানসারে কষ্ট পাওয়ার দিনগুলো, সুমিতের ঘরের কোণে বসে গান লেখা কিন্তু কাউকে না শোনানোর মুহূর্ত, নিলয়ের জীবনের প্রথম ভালোবাসা ভেঙে যাওয়ার মুহূর্ত, অর্ণবের বাবার মুখ ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে…

এই পথ যেন শুধু আলো নয়, মনে করিয়ে দিচ্ছে তারা কী ফেলে এসেছে, কী ভুলে গিয়েছিল, আর কী পালিয়ে বেড়াচ্ছিল।

নিলয় দাঁড়িয়ে পড়ে। “এই যে এতদিন আমরা ভাবতাম, গুপ্তধন মানে সোনা, টাকা, কিম্বা কোনো গোপন ধনরত্ন। কিন্তু আসলে যা পাওয়া গেছে তা হল সময়। নিজেকে ফিরে পাওয়ার সময়।”

ঠিক তখনি সামনে এক ফাটল তৈরি হয়—একটা সময়-দরজা, যেটা কেবল একবারই খুলবে বলে মনে হয়। দরজার ওপাশে ঝাঁঝালো গন্ধ, গরম বাতাস, আর দূরে ভেসে আসে বাঘের ডাকে ঘেরা এক অরণ্য… তারা বুঝে যায়, ওরা ফিরে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের সেই জঙ্গলে, সেই জায়গাতেই যেখানে ওরা হারিয়ে গিয়েছিল।

দরজা দিয়ে হঠাৎ ছিটকে পড়ে সবাই মাটিতে—ধুলো, পাতা, আর ধীরে ধীরে ফিরে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। আবার সেই পরিচিত বন, সেই পুরোনো গাছ, আর সামনের দিকে বাঁধানো পথ, যেটা পাহাড়ি গ্রামে নিয়ে যায়।

তারা উঠে বসে। প্রথমেই ওদের চোখে পড়ে—ওই জায়গাটা, যেখানে তারা মাটি খুঁড়ে সেই সুড়ঙ্গ পেয়েছিল—এখন সেখানে কিছু নেই। খালি সমতল জমি, ঘাসে ঢাকা। কোনো গর্ত নেই, কোনো চিহ্ন নেই, এমনকি ওদের নিজের পায়ের ছাপও নেই।

তনয় ফিসফিস করে, “আমরা কি স্বপ্নে ছিলাম?”

সুমিত বলে, “স্বপ্নে কেউ রক্ত দেয় না, কেউ নিজের পরিচয় হারায় না। এটা সত্যি ছিল, কিন্তু পৃথিবী সেটা মুছে দিয়েছে। হয়তো কারণ, এটা সবাই জানার কথা না।”

নিলয় তার ব্যাগ থেকে সেই ছোট বাক্সটা বার করে। ওরা অবাক হয়—ব্যাগে এটা রয়ে গেছে! কিন্তু এখন সেটা খোলা, খিলি নেই, কাগজ নেই। শুধু ভিতরে একটা ছোট আয়না। আর আয়নার মধ্যে ওরা দেখে—চারজন দাঁড়িয়ে আছে ঠিক এই মুহূর্তে, কিন্তু পেছনের ছায়াগুলো পাল্টে গেছে। আগের মতো তারা নিজেদের ক্ষয়ে যাওয়া, দুঃখে ভরা অবয়ব নয়—বরং এখন একটা স্থিরতা, আত্মবিশ্বাস আর অদ্ভুত শান্তি আছে সেই ছায়ায়।

বীরু দার ফোনে তখন বাজে সিগন্যাল। আশ্চর্যজনকভাবে সেটাও কাজ করছে আবার। চারদিকে শব্দ ফিরেছে—পাখির ডানা ঝাপটানো, ঝিরি ঝিরি হাওয়ার শব্দ, একটা ভোরের গন্ধ।

তারা ধীরে ধীরে হেঁটে যায় গ্রামের দিকে। রাস্তার মাথায় পেয়ে যায় সেই পরিচিত জিপ। ড্রাইভার অবাক হয়ে বলে, “আপনারা এতদিন কোথায় ছিলেন? আমি তো ভাবলাম ফিরে আসবেন না!”

তারা চুপ করে থাকে। কারও মুখে কোনো উত্তর নেই।

গাড়িতে উঠে বসে, সবাই জানে এই ট্রিপ কখনো ‘ঘুরতে যাওয়া’ ছিল না। এটা ছিল নিজেদের গোপন মানসিক অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া, আর শেষে একটা নতুন জন্ম পাওয়া।

গাড়ি ধীরে ধীরে চলতে থাকে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে নিচের দিকে। কেউ কিছু বলে না। কিন্তু প্রত্যেকের ভেতরে বাজতে থাকে একটাই কথা—

“তুমি যদি নিজেকে খুঁজতে পারো, তবেই সে গুপ্তধনের অধিকারী।”

পেছনে রয়ে যায় সেই অরণ্য, সেই দরজা, আর সেই চক্র… যা হয়তো আবার একদিন খুলবে, কাউকে ডাকবে—কোনো নতুন যাত্রার জন্য।

পর্ব ৮

ফিরে আসার পর তিন দিন কেটে গেছে। তারা সবাই নিজেদের ঘরে ফিরেছে, তবে ঘুম হয়নি এক রাতও। চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে যায় সেই ঘরটা—সিংহাসন, আয়না, মৃত্যু জানার ঘড়ি। একটা তীব্র অস্বস্তি, যেন কিছু রেখে এসেছে সেখানে, যা এখনও ফিরে চায়।

তনয় নিজের রেকর্ডার অন করে বলে, “জার্নাল ডে থ্রি। ফিরে এসেছি, কিন্তু যেন কিছু একটা ভুলে গেছি। কিছু টুকরো মনে পড়ে, কিছুটা ধোঁয়াশা। আয়নার সেই প্রতিবিম্বটা মাথা থেকে যাচ্ছে না।”

তারপর সে দেখে খাতার পাতায় একা একা আঁকা হয়ে যাচ্ছে সেই চিহ্নগুলো—পানি, আগুন, ছায়া, বাতাস। কে আঁকছে, কিভাবে হচ্ছে, বোঝে না।

অর্ণব তখন শহরের এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করছে। ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে শুধু বলেন, “তুমি বলছো তুমি ভুলে গেছো তুমি কে? কিন্তু তুমি জানো কি, এই রোগটা আমাদের মস্তিষ্ক নয়, আত্মায় বাসা বাঁধে? নিজেকে হারানো মানে স্মৃতি নয়, তা সত্ত্বার গভীর থেকে হারিয়ে যাওয়া। তুমি ঠিক এমনভাবে বলছো, যেভাবে কিছু মৃত মানুষ নিজেদের পরিচয় ভুলে শবদেহের মতো ঘোরে।”

অর্ণব বাড়ি ফিরে আয়নায় মুখ দেখে। আয়নাটা কুয়াশায় ঢাকা, যেন কিছু একটা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে—এক ছায়া, চোখে লাল আভা। সে জানে, সে একা নয়।

সুমিত কলকাতায় ফিরে গানের রেকর্ডিং বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আর গান ওঠে না মুখে, কেবল এক ধরণের আওয়াজ—মাটির নিচ থেকে আসা কণ্ঠস্বর। এক রাতে সে ফোন তোলে তনয়কে—“ভাই, আমাদের কিছু রেখে আসা হয়নি, কিছু আমাদের সঙ্গে এসেছে। আয়নার ওই পেছনের আলো, ওই ভয়ানক ছায়া… ওটা এখন আমার পাশে হাঁটে।”

নিলয়, যাকে সবসময় সবচেয়ে যুক্তিবাদী মনে হতো, এখন নিজের ঘরের দেয়ালে আঁকছে সুড়ঙ্গের মানচিত্র, অজান্তেই। তাকে প্রশ্ন করলে বলে, “আমি জানি, আমরা যেখান থেকে ফিরেছি, সেটা একটা চক্র। এটা শেষ নয়। চতুর্থ রাস্তাটা এখনও খোলা, আর কিছু ফেরেনি… কিছু আসছে।”

তখনই তারা চারজন একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়—আবার দেখা করতে হবে, আবার ফিরতে হবে সেই জায়গায়, বা অন্তত খুঁজে বের করতে হবে এটা কী।

তারা ফের যায় সেই উত্তরবঙ্গের গ্রামে। এবার গন্তব্য—ভাগিরথীর ধারে একটা পুরনো ভগ্নপ্রায় রাজার বাড়ি, যা গ্রামের লোকেরা “ছায়ার মহল” বলে ডাকে।

স্থানীয়রা বলে, “ওখানে একসময় অনেক গবেষক গিয়েছিল। সবাই পাগল হয়ে ফিরেছিল বা ফেরেইনি। কেউ বলে, নিচে একটা পাথরের কক্ষ আছে, যেখানে সময় দাঁড়িয়ে থাকে। কারো মতে সেখানে শোনা যায় নিজের ভবিষ্যতের আওয়াজ।”

তারা চারজন রাতের বেলা ঢোকে সেই বাড়ির ভেতর। মেঝে কাঠের, পুরোনো আসবাব, চারপাশে শ্যাওলার গন্ধ। সিঁড়ির নিচে এক ফাটল, একদম যেন আগের সেই সুড়ঙ্গের মতো। কিন্তু এটা নতুন, আগে ছিল না।

তারা নামতে শুরু করে—নিচে নামলে বাতাস ভারী হয়ে যায়, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। চারপাশে দেওয়ালে আঁকা সেই চিহ্নগুলো আবার ফিরে আসে। এইবার যেন সেগুলো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

অর্ণব থেমে গিয়ে বলে, “আমরা মনে করেছিলাম, শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে তখন শুরু হয়েছিল।”

সুমিত দেয়ালে হাত রেখে বলে, “এই জায়গা বাঁচে। এটা একটা জীবন্ত ঘর। আর আমাদের মনে রেখেছে।”

নিলয় সামনে ইশারা করে, “ওই দেখো—ওই আয়নাটা… আবার!”

হ্যাঁ, আবার সেই আয়না। কিন্তু এবার তার মধ্যে শুধু প্রতিচ্ছবি নয়, এক দরজা। ভেতরে দেখা যায় একটা গুহা, তার মধ্যে বসে আছে চারটা ছায়ামূর্তি—ঠিক তাদের মতো দেখতে, কিন্তু চোখে খালি শূন্যতা। তারা তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে, যেন জানে কারা আসছে।

তনয় ফিসফিস করে বলে, “এটা যদি ছায়ার প্রতিবিম্ব হয়, তাহলে হয়তো আমরা নিজের কুৎসিত রূপের সামনে দাঁড়াচ্ছি। এই আয়নাটা দরজা… যার ওপারে শুধু সত্যি। নিজেদের সত্যি।”

ঠিক সেই মুহূর্তে দেয়ালের মধ্যে থাকা কালের ঘড়ি আবার বাজে—টিক… টিক…

এই বার ওরা জানে, শেষটা এখনও আসেনি।

পর্ব ৯

দেয়ালে টিক টিক শব্দ যত জোরে বাজে, তাদের হৃদস্পন্দনও তত গাঢ় হতে থাকে। অন্ধকার ঘরটায় চারজনের ছায়া যেন আলোর চেয়ে বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে, দেয়ালে লম্বা হয়ে কাঁপছে, যেন তারা নিজেরাই এখন আর নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণে নেই। আয়নার ভেতরের সেই চারটি ছায়ামূর্তির চোখ জ্বলজ্বল করছে লাল আভায়, যেন দৃষ্টি গেঁথে আছে আয়নার এপারে থাকা বাস্তব চার বন্ধুর দিকে।

তনয় ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় আয়নার দিকে, তার মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। সে বলে, “এটা যদি আমাদের ভিতরের দিক হয়—আমাদের ছায়া সত্তা—তাহলে আমরা কখনোই মুক্ত না। কারণ ছায়া সবসময় থেকে যায়, আলো নিভে গেলেও। প্রশ্ন হল—আমরা সেই ছায়ার সামনে দাঁড়াতে পারব কি?”

সুমিত হাত বাড়িয়ে আয়নার গায়ে ছুঁতেই মুহূর্তে একটা ঝাঁকুনির মতো অনুভব হয়—পিছনে নয়, সামনে! তারা সবাই পড়ে যায়, যেন মাধ্যাকর্ষণ হঠাৎ ভেঙে গেছে, আয়নার ভেতরে টেনে নিচ্ছে সবাইকে। এক আলো, এক চাপা আর্তনাদ, আর তারপর… নিঃশব্দতা।

চোখ খুলতেই তারা দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক সেই আয়নার ভেতরের গুহার মধ্যে। সামনে বসে থাকা চারটি ছায়ামূর্তি উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু তারা কথা বলে না—তারা কেবল অনুকরণ করে।

তনয় এক পা এগোলে তার ছায়া-মূর্তিটাও এগোয়। সুমিত হাসে, ছায়ামূর্তিটাও হাসে। কিন্তু সেই হাসিতে তীব্র বিদ্রূপ, যেন আসল মুখ নয়, বরং মুখোশ।

নিলয় বলল, “এটা একটা পরীক্ষা। যদি আমরা নিজের ছায়ার মুখোমুখি হয়ে স্থির থাকতে পারি, যদি ভয় না পাই, যদি সরে না যাই—তবে হয়তো আমরা মুক্তি পাব। নয়তো ওরাই জায়গা নেবে আমাদের।”

অর্ণব এবার সাহস করে এগিয়ে যায় নিজের ছায়ার দিকে। মুখোমুখি দাঁড়ায়, গভীরভাবে তাকায় নিজের চোখে। কিন্তু চোখে নেই কোনো চেনা আত্মা। ছায়া তখন বলে ওঠে, প্রথমবারের মতো কথা—

“তুই আমায় ত্যাগ করেছিস। তোর ভেতরের ব্যর্থতা, তোর লোভ, তোর সবকিছু আমি। তোকে ছাড়া আমি নেই, আবার তুই ছাড়া আমি সম্পূর্ণ। আমাকে গ্রহণ কর—তাহলে মুক্তি।”

অর্ণব ধীরে ধীরে তার ছায়ার হাত ধরে। চোখ বুজে ফেলে। মুহূর্তে এক ঝলক তীব্র আলো, আর ছায়ামূর্তিটা মিলিয়ে যায়। শুধু পড়ে থাকে এক ধুলিমাখা আয়না-টুকরো।

তনয় এবার একই ভাবে এগিয়ে যায়। তার ছায়া বলে, “তুই সবসময় পালিয়ে গেছিস, মায়ের মৃত্যুর পর তোকে কেউ জোর করে দাঁড়াতে বলেনি—তুই নিজেই হাঁটিস না। তোকে যা ভারী লাগে, আমিই তা বয়ে চলেছি। আমাকে গ্রহণ কর, তবেই হাঁটতে পারবি।”

তনয় নিঃশব্দে মাথা নোয়ায়। তার চোখে অশ্রু। সে কেবল বলে, “আমি তোকে চিনি।” ছায়া মিলিয়ে যায়।

এক এক করে সুমিত ও নিলয়ও নিজের ছায়ার মুখোমুখি হয়, নিজের ব্যর্থতা, দুঃখ, লুকোনো ইচ্ছা ও অহংকারকে মেনে নেয়। প্রত্যেকে যখন গ্রহণ করে নিজের ‘অন্ধকার’, তখনই সেই ছায়ামূর্তিগুলো মিলিয়ে যায়, আর গুহার মধ্যে খোলে একটা সাদা দরজা—অদ্ভুতভাবে পরিচিত।

তারা হেঁটে ঢোকে সেই দরজা দিয়ে—আর ফের সেই পুরোনো ঘর, সেই প্রথম সিংহাসন ঘর। কিন্তু এবার ঘরটা খালি। সিংহাসন নেই, কালো ঘড়ি নেই। দেওয়ালের চিত্র অদৃশ্য, শুধু একটাই বাক্য লেখা—

“তোরা যারা নিজের ছায়াকে চেনলি, তোদের আর কোনো দরজা দরকার নেই।”

ঘরের মাঝখানে পড়ে থাকে একটা ধাতব বাক্স। এবার সত্যিকারের গুপ্তধন? তারা খুলে দেখে—ভেতরে চারটা জিনিস:

১. তনয়ের জন্য একটা পুরোনো কাঁসার হাতঘড়ি—তার বাবার দেওয়া, যা সে ভেবেছিল হারিয়ে গেছে।
২. সুমিতের স্কুলের ডায়েরি, যাতে লেখা ছিল তার প্রথম গান।
৩. নিলয়ের প্রাচীন মানচিত্র, যার ওপর লেখা: “সব পথ একেই নিয়ে যায়।”
৪. আর অর্ণবের জন্য একটা আয়না—যেখানে প্রথমবার সে দেখতে পায় নিজের মুখ, কিন্তু চোখে ভয় নয়, বিশ্বাস।

তারা বুঝে যায়, সত্যিকারের গুপ্তধন কোনো বস্তু নয়। এটা এমন কিছু যা তারা একসময় হারিয়ে ফেলেছিল—নিজের সঙ্গে সম্পর্ক, নিজের অতীতের গুরুত্ব, নিজের মনের সাহস।

তারা ধীরে ধীরে পেছনের দরজাটা দিয়ে বেরোয়, প্রথমবারের মতো সূর্যের আলোয় ভেজে পুরো শরীর, বুকটা হালকা লাগে।

তবে যাওয়ার সময়, দেওয়ালের এক কোণে ঝাপসা হয়ে লেখা দেখা যায়—

“ছায়া সবসময় রয়ে যায়। কিন্তু যারা তাকে আপন করে, তারা অন্ধকারেও পথ খুঁজে পায়।”

পর্ব ১০

আলোয় ফিরে আসার পরও মনের ভিতর যেন এক অদৃশ্য দরজা খোলা থেকে যায়। চারজনের চোখে এখন আর সেই আগের কৌতূহল, বিভ্রান্তি বা ভয় নেই—আছে গভীর এক নিশ্চিন্ততা। তারা জানে তারা আর আগের মানুষ নয়।

তিন মাস কেটে যায়। তনয় এখন নিজের ক্যামেরা নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত জায়গায় গিয়ে মানুষকে, প্রকৃতিকে তুলে ধরে—তাকে এখন আর লাইট বা শট ঠিক করতে হয় না, কারণ সে নিজেকে খুঁজে নিয়েছে, তার চোখ এখন সত্য দেখাতে জানে।

সুমিত তার পুরোনো ডায়েরি নিয়ে গান লিখে, গায়, আবার মানুষ শুনছে, কান্না করছে, বুক ভরে প্রশংসা করছে। সে এখন নিজের কণ্ঠে বিশ্বাস রাখে, কারণ সে জানে, নিজের ভেতর যে ছায়া ছিল, সেটা ভয় নয়—গভীরতা।

নিলয় এখন ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করে, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে যোগ দিয়েছে। সে মানুষের ভুলে যাওয়া ইতিহাস খোঁজে, শুধু মৃত শহর নয়—মৃত সত্তাকেও খোঁজে, কারণ সে জানে সব হারিয়ে যাওয়া জিনিস ধ্বংস নয়—অনুসন্ধানের প্রহেলিকা।

অর্ণব নিজের বাবার সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছে, সম্পর্ক গড়ছে নতুন করে। সে এখন মানুষকে সাহায্য করে নিজের মানসিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে—সাইকোলজির ছাত্র, ভবিষ্যতের পথিক।

তাদের গল্প কাউকে বলা হয়নি। কারো কাছেই নয়। কেউ জানে না উত্তরবঙ্গের এক গভীর জঙ্গলে চার বন্ধু একবার সময়, সত্য আর ছায়ার দেশে হারিয়ে গিয়েছিল।

তবে যেটা তারা জানে, সেটা হলো—এই পৃথিবীর বাস্তব বলয়ের বাইরে, ছায়ার গভীরে আছে এক দরজা, যেটা তখনই খোলে, যখন তুমি নিজের সত্যিটা দেখতে চাও। আর যদি দেখতে সাহস থাকে, তাহলেই তুমি সেই দরজা দিয়ে পেরোতে পারো।

তারপর একদিন, এক ভোরবেলা তনয়ের ফোনে একটা ছবি আসে—কোনো নম্বর নেই, কোনো নাম নেই। শুধু ছবি—একটা দরজা, নীল রঙের, অরণ্যের ভেতর দাঁড়িয়ে। দরজার নিচে লেখা—“শেষবারের মতো?”

তনয় ছবি পাঠিয়ে দেয় বাকিদের। আর ঠিক এক ঘণ্টার মাথায়, চারজন আবার এক জায়গায়। তারা কোনো কথা বলে না, কেবল একটা গভীর হাসি মুখে, যেন জানে—এই গল্পের কোনো শেষ নেই।

তারা রওনা দেয়।

জিপ চলে যায় আবার সেই পথ দিয়ে—পাহাড়ি ধুলোমাখা রাস্তা, বাঁক ঘুরে সূর্যের আলো ফেটে পড়ছে গাছের পাতার ফাঁকে।

একসময় এসে দাঁড়ায় সেই জায়গায়—যেখানে প্রথম খুঁজে পেয়েছিল সেই গর্ত, সেই সুড়ঙ্গ, সেই প্রথম দরজা।

এখন সেখানে শুধু দাঁড়িয়ে আছে একটা নীল দরজা—মাঝখানে সাদা ধাতুর হাতল। দরজার গায়ে কেবল একটিই বাক্য—

“এবার তুমি জানো, কী নিয়ে ফিরবে।”

তারা একে একে দরজার দিকে এগোয়।

আর যখন দরজাটা খুলে যায়…

তখন আর গল্প থাকে না—শুধু শুরু।

শেষ

1000017597.jpg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *