রাজীব ঘোষ
অধ্যায় ১
শীতের ভোর নেমেছে পাহাড়ি গ্রামে, কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারপাশের ঘন অরণ্য, পাথুরে পথ আর ছোট ছোট টিনের ছাউনি ঘেরা ঘরগুলো। স্কুলের খোলা উঠোনে শিশিরে ভিজে থাকা বেঞ্চগুলো যেন নিস্তব্ধতার চেয়ে বেশি কিছু বলছে না। এই সময়েই অমিতাভ মুখোপাধ্যায় ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে পড়ে গ্রামের প্রান্তের সেই পুরনো পাথরের রাস্তা ধরে, যেটা সোজা গিয়ে মিশেছে অরণ্যের ভেতরে। সকাল সকাল এমন হাঁটা তার বহুদিনের অভ্যাস; একাকী এই পথ চলা যেন তার জীবনের একমাত্র নির্ভেজাল শান্তির সময়। মাথায় উলের টুপি, গায়ে লাল-কালো চেকের শাল জড়ানো, কাঁধে চামড়ার পুরনো ব্যাগ। গ্রামের মানুষেরা জানে, স্যার একটু একা থাকতে ভালোবাসেন, বই আর অরণ্যের নিস্তব্ধতার মধ্যে। কিন্তু আজকের সকালটা অন্যরকম, অরণ্যের ভিতরটা যেন অদ্ভুতভাবে ডাকছে তাকে—একটা চাপা টান, অজানা আকর্ষণ, যেটা না শুনে পারা যায় না। পাথুরে রাস্তাটা শেষ হতে না হতেই শুরু হলো পাতাঝরা গাছের গন্ধ, ভিজে মাটি আর শীতের কুয়াশায় ঢাকা আর্দ্রতা। অমিতাভ গভীর নিশ্বাস টেনে নিলেন, অনুভব করলেন সেই অদৃশ্য টানটাকে—যা তাকে অরণ্যের আরও গভীরে টেনে নিচ্ছে।
গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়লো দুপুর গড়াতেই—অমিতাভ স্যার স্কুলে যাননি, বাড়িতেও ফেরেননি। প্রথমে কাবেরী ভেবেছিলেন, হয়তো কোন পুরনো বন্ধুর কাছে গেছেন, অথবা বাজারে আছেন; কিন্তু রোদ পড়ে গিয়েছে, অন্ধকার নেমেছে, তবুও তার দেখা নেই। গ্রামের লোকেরা দল বেঁধে খোঁজ শুরু করল, টর্চ নিয়ে ঢুকলো অরণ্যের ভেতর। কোথাও স্যারের চিহ্ন নেই—না ভাঙা ডাল, না পায়ের ছাপ, না পড়ে থাকা ব্যাগ। বনমালী ওঝা, যিনি অরণ্যের রহস্য আর ইতিহাস জানেন, নীরবে বললেন, “অরণ্য কাউকে ডাকলে মানুষ ফেরে না সহজে।” সেই রাতটা কাবেরীর জন্য নরকসম ছিল—শীতের কামড়, অজানা আশঙ্কা আর গলার কাছে জমে থাকা কান্না। ঈশানও সেদিন রাতে কিছু না খেয়ে বসে রইল স্যারের জন্য; স্যার যে তার কাছে শুধুই শিক্ষক নয়, তার নিজের জীবনের এক টুকরো আলো।
এভাবে কেটে গেল একদিন, দু’দিন, তারপর এক সপ্তাহ। গ্রামের মানুষেরা মনে মনে ভাবতে শুরু করল, হয়তো আর ফেরানো যাবে না তাকে, হয়তো অরণ্য তাকে গ্রাস করেছে। কিন্তু ঠিক তখনই, সপ্তম দিনের ভোরবেলায়, কুয়াশার পর্দা ঠেলে গ্রামের রাস্তার দিকে ভেসে এল অমিতাভের অবয়ব—ম্লান মুখ, রক্তশূন্য চোখ, ধুলো-মাটি লেগে থাকা কাপড়। কেউ প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না যে এ সত্যিই সেই মানুষ, যিনি এক সপ্তাহ আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন। তার হাঁটায় যেন অদ্ভুত ভার, নিঃশ্বাসে অজানা কষ্ট। কাবেরী ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে এক মুহূর্ত থমকে গেল—স্বামীর চোখের সেই দৃষ্টি দেখে। সেটাতে চিনতে পারল না তার চিরচেনা মানুষটিকে। গ্রামের লোকেরা তাকে ঘিরে ধরল, জিজ্ঞাসা করল কোথায় ছিলেন, কী হয়েছে। অমিতাভ আস্তে আস্তে ফিসফিস করে বলল, “আমি একা আসিনি… আমি কাউকে এনেছি সঙ্গে।” কাবেরীর বুক কেঁপে উঠল; গ্রামের বাতাসও যেন হঠাৎ ভারী হয়ে এল, অরণ্যের গভীর থেকে কে যেন চুপিচুপি হাসল।
অধ্যায় ২
অমিতাভের এই রহস্যময় ফিরে আসা যেন পুরো গ্রামকে অদৃশ্য এক অশরীরী ছায়ায় ঢেকে দিল, সকাল থেকেই মানুষের চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অস্বস্তি আর অজানা কৌতূহল। কাবেরী স্বামীর হাত ধরে তাকে ঘরে নিয়ে এল, কিন্তু প্রথম স্পর্শেই টের পেল, এই মানুষটা তার চেনা অমিতাভ নয়; তার হাতের ত্বক শুকনো, শীতল, আর সেই স্পর্শে যেন এক ধরনের শূন্যতা আছে, যা একেবারে হাড়ের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দেয়। অমিতাভ চুপচাপ ঘরে ঢুকে জানলার ধারে দাঁড়ালেন, কুয়াশায় ঢাকা অরণ্যের দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন, যেন কারো প্রতীক্ষায় আছেন। কাবেরী তাকে গরম জল আর চা দিল, জিজ্ঞাসা করল কোথায় ছিলেন, কী হয়েছিল—কিন্তু তিনি শুধু ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, গলার স্বর প্রায় শোনাই যায় না, “তুই বুঝবি না… আমি একা আসিনি… ও আমার সাথেই এসেছে।” এই কথায় কাবেরীর বুকের ভেতর কেমন জমে গেল, সে সাহস করে জিজ্ঞাসা করল “কে?”—কিন্তু স্বামী উত্তর দিল না, শুধু ফিসফিস করে অজানা ভাষায় কিছু বলল, যেটা কাবেরী বুঝতে পারল না। সেই রাতে কাবেরী অন্ধকারে শুয়ে অনুভব করল, অমিতাভ নিঃশ্বাস ফেলছে না যেন, শুধু চোখ বড় বড় করে জানলার দিকে চেয়ে আছে, আর মাঝে মাঝে ফিসফিস করছে কারো সাথে, অথচ সেই ঘরে ছাড়া তাদের দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই।
স্কুলের উঠোনে তখনও কোলাহল কমেনি, কিন্তু ছাত্ররা যেন আর আগের মতো স্বস্তিতে নেই; তারা চুপচাপ ফিসফিস করে বলে—স্যার নাকি অরণ্য থেকে ফেরার পর বদলে গিয়েছেন। ঈশান, যে স্যারের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র, সে লক্ষ করে স্যার আর আগের মতো হাসেন না, চোখে-মুখে যেন সবসময় এক অজানা ভয় লুকিয়ে আছে। পড়ানোর ফাঁকে স্যার হঠাৎ পেছন ফিরে তাকান, যেন কারো উপস্থিতি অনুভব করেন, আবার একদৃষ্টিতে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে থাকেন দীর্ঘ সময়। একদিন ছুটির পর ঈশান সাহস করে জিজ্ঞাসা করল, “স্যার, অরণ্যে কী দেখেছেন?” অমিতাভ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন, তারপর ফিসফিস করে বললেন, “তুমি শুনতে পাবে না, দেখতে পাবে না… ও পাশে আছে, কিন্তু তোমরা কেউ দেখতে পারবে না।” সেই কথার পর ঈশানের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল, সে স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝল, সেই চোখের গভীরে আর আগের স্যার নেই—সেখানে আছে এক শূন্যতা, এক অন্ধকার, যা তার শৈশবের সরল মনকে ভয় দেখায়। ঈশান সেদিন রাতে ঘুমোতে পারল না, জানালার বাইরে অরণ্যের দিকের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ভাবল, সত্যিই কি কারো ছায়া ঘোরাফেরা করছে?
এদিকে গ্রামের মানুষজনও বুঝতে পারল, কিছু একটা অদ্ভুত ঘটছে। বনমালী ওঝা, যিনি জীবনের প্রায় সবটাই এই অরণ্যের গল্প, ছায়া আর নিঃশব্দ রহস্যের মধ্যে কাটিয়েছেন, তিনি বললেন, “ও একা ফেরেনি, অরণ্য কাউকে ফেরায় না শূন্য হাতে।” কাবেরী তার কথায় সান্ত্বনা খুঁজতে চাইল, কিন্তু ওঝার চোখের দৃষ্টি দেখে সে বুঝতে পারল, এ কোনো সাধারণ মানুষ ফেরার গল্প নয়। রাতের বেলায় বাড়ির উঠোনে হাওয়া থেমে যায়, জানলার কাচে অজানা ছায়া ভেসে ওঠে, আর কাবেরীর মনে হয়, অমিতাভ শুধু নয়, কেউ বা কিছু আরও সেই অন্ধকার থেকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একরাতে কাবেরী স্বামীর ফিসফিসানি স্পষ্ট শুনতে পেল, “আমি তোকে এনেছি… আমি তোকে ছাড়তে পারি না…” কিন্তু কাবেরীর সামনে তখনও শুধু অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তার মনে এক অজানা স্রোত বইতে লাগল—এই মানুষটা কি আদৌ তার অমিতাভ, নাকি শুধু একটা খোলস, যার মধ্যে এখন অরণ্যের কোনো অজানা ছায়া বাসা বেঁধেছে?
অধ্যায় ৩
সকালের আলো যখন পাহাড়ি গ্রামের কুয়াশার চাদর সরিয়ে ফেলে, তখনো অমিতাভের চোখে সেই অজানা শূন্যতা স্পষ্ট থাকে, যেন এক সপ্তাহের অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার পর তার ভেতরের কিছু চিরতরে নিঃশেষ হয়ে গেছে। স্কুলে ফিরে গিয়েও তার মধ্যে সেই অদ্ভুত বদলটা টের পায় সবাই—যেমন হঠাৎ ক্লাসের মধ্যে চুপ করে যাওয়া, ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে অচেনা চোখে দেখা, বা হঠাৎই দূর অরণ্যের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকা। একদিন রোদের দুপুরে, ক্লাসের মধ্যে হিন্দি ব্যাকরণের বই খোলা অবস্থায় হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল, তারপর ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকালেন, আর ফিসফিস করে বললেন, “তুই আছিস তো? আমি তোকে ভুলিনি…” ছাত্ররা ভয়ে চুপচাপ বসে রইল, কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করল না। ঈশান সেই মুহূর্তে লক্ষ্য করল, স্যারের চোখের কোণ দিয়ে অজানা আতঙ্ক ঝরে পড়ছে—যেন অমিতাভ মুখোপাধ্যায় একা নয়, বরং তার ভেতরে আরেকজন আছে, যে তাকে কথা বলতে বাধ্য করছে। সেইদিন বিকেলে স্কুল ছুটি হবার পর ঈশান সাহস করে স্যারের পিছু নিল, আর দেখল স্যার ধীরে ধীরে স্কুলের পেছনের অরণ্যের দিকে এগিয়ে চলেছেন, যেন কোনো অদৃশ্য টানে তাড়া পাচ্ছেন, আর সেই টানই তাকে টেনে নিচ্ছে সেই গহীন অন্ধকারে।
অরণ্যের ভেতরে ঢুকে ঈশানও যেন অনুভব করল অজানা একটা চাপা কোলাহল—যেন গাছের পাতার ফাঁকে, বাতাসের দোলায়, কোথাও কিছু আছে, যেটা কেবল চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভবে স্পষ্ট। স্যার থামলেন এক জায়গায়, যেখানে পুরনো পাথরের ভাঙা দেয়াল আর শিকড়ে জড়ানো ছোট্ট এক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে; মাথার উপরে গাছের ডালগুলো এমনভাবে ছায়া ফেলেছে, যেন সূর্যের আলোও সেখানে ঢোকে না। ঈশান দূর থেকে দেখল, স্যার মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের কাছে বসে পড়লেন, মাটির দিকে তাকিয়ে অজানা ভাষায় ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলেন, আর মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছেন—যেন কারো কথার উত্তর দিচ্ছেন। সেই দৃশ্য দেখে ঈশানের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল; সে ঠিক বুঝতে পারল না স্যারের সামনে সত্যিই কেউ আছে কি না, কিন্তু তার মনে হল, বাতাসে যেন আরও একজোড়া নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, খুব ক্ষীণ, তবু খুব স্পষ্ট। কিছুক্ষণ পরে স্যার ধীরে ধীরে মাথা তুলে বললেন, “আমি কথা রাখব… আমি কথা রাখব…”—এই কথা বলেই আবার চুপ হয়ে গেলেন, আর ঈশানকে একবারও দেখলেন না, যেন তার পাশ দিয়ে কেউ বা কিছু হেঁটে চলে গেল, যাকে কেবল অরণ্যের নীরবতা ছাড়া কেউ স্বাগত জানায় না।
ঈশান কাঁপা পায়ে বাড়ি ফিরে সেই রাতটা নির্ঘুম কাটাল, আর বারবার সেই ছায়ার কথা ভাবল—যেটা সে দেখেনি, কিন্তু অনুভব করেছিল। পরের দিন সকালে সেই গল্প বলল বনমালী ওঝাকে, যার চোখের দৃষ্টি তখনও অরণ্যের গভীর রহস্যে ডুবে থাকে। বনমালী চুপ করে শুনে বলল, “ছেলের চোখ মিথ্যে বলে না… ও একা নেই।” সেই কথা শুনে ঈশানের বুকটা আরও ভারী হয়ে গেল, আর বনমালী ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে বলল, “অরণ্য কাউকে ফেরায় না খালি হাতে; ওরা সঙ্গে করে কিছু নিয়ে আসে, যার ছায়া আমাদের মধ্যেই ঘোরে।” সেই সন্ধ্যায় কাবেরী যখন অমিতাভের চোখে তাকাল, তখনও দেখল সেই অচেনা অন্ধকার, আর টের পেল, যেই মানুষটাকে সে এত বছর ধরে চিনত, সে আর আগের মতো নেই—তার ভেতরে বাস করছে অরণ্য থেকে আসা কোনো অজানা সত্তা, যা কেবল নিশ্ছিদ্র নীরবতার মধ্যেই কথা বলে, আর তাদের জীবনের চারপাশে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায়।
অধ্যায় ৪
রাতের অন্ধকার যখন পাহাড়ি গ্রামের ঘরগুলোর মধ্যে নামতে শুরু করে, তখন কাবেরীর মনেও নেমে আসে আরও গভীর এক অন্ধকার—যেটা কেবল বাইরে দেখা যায় না, অনুভবে টের পাওয়া যায়। অমিতাভ সন্ধ্যাবেলায় বসে থাকে জানলার ধারে, অরণ্যের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আর ফিসফিস করে এমন সব কথা বলে যা কাবেরীর কানে স্পষ্ট শোনা যায় না, কিন্তু তার গায়ে কাঁটা দেয়। কাবেরী কখনও কখনও চুপিচুপি স্বামীর কাছে গিয়ে বসে, সাহস করে হাত রাখে তার কাঁধে, আর সেই মুহূর্তেই টের পায় তার গা শীতল, নিঃশ্বাস ভারী, যেন বুকে কোনো অদৃশ্য বোঝা চেপে আছে। একদিন রাতে কাবেরী দেখল, অমিতাভ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, ঘুমের ঘোরে নয়, জেগে থেকে কারো সাথে কথা বলছে, চোখে সেই অজানা ছায়ার দিকে তাকিয়ে; সে বলছে, “আমি কথা দিয়েছি… আমি ভুলতে পারব না… তুই তো জানিস…”—আর সেই ফিসফিসানিতে এমন কিছু ছিল, যা কাবেরীর মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোতের মতো বয়ে গেল। সে ভয় আর কৌতূহলের মধ্যে ছটফট করতে করতে শুধু ভাবল—কে এই ‘তুই’, যার কথা তার স্বামী অরণ্য থেকে ফিরে আসার পর থেকে বারবার বলছে? সেই রাতে সে ঘুমোতে পারল না, আর জানলার বাইরে অন্ধকার অরণ্যের দিকে তাকিয়ে ভাবল, সত্যিই কি কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, নাকি এটা তার মনের ভুল?
পরদিন সকালে কাবেরী গিয়ে দেখা করল বনমালী ওঝার সঙ্গে। বনমালী ধীরে ধীরে বলল, “মেয়েটি, তোর স্বামী কিছু নিয়ে ফিরেছে অরণ্য থেকে… অরণ্য খালি হাতে কাউকে ফেরায় না।” কাবেরীর গলা শুকিয়ে এল, সে জিজ্ঞাসা করল, “কী নিয়ে ফিরেছে?”—বনমালী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ছায়া… যার রূপ তুই দেখবি না, কিন্তু তোর চারপাশে তার ছায়া থাকবে।” কাবেরী চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে চাইল সেই ছায়ার উপস্থিতি, আর টের পেল, সত্যিই কোথাও একটুখানি ঠান্ডা হাওয়ার মতো কিছুর উপস্থিতি রয়েছে, যেটা কেবল অনুভবে ধরা দেয়, চোখে নয়। সেই সন্ধ্যায় অমিতাভ স্কুল থেকে ফিরে খুব ক্লান্ত মুখে বসে থাকল, কিছু না খেয়ে; কাবেরী তাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কার কথা বলছ?”—অমিতাভ আস্তে বলল, “তুই বুঝবি না, কাবেরী… ও আমায় ডাকছে… আমি ওকে কথা দিয়েছি…” কাবেরীর মনে হল, তার স্বামীর কণ্ঠস্বরের ভেতর আরেকজনের ছায়া মিশে আছে, আর সেই ছায়া দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে, যেটা তার চিরচেনা অমিতাভের কণ্ঠস্বরকে অচেনা করে তুলছে।
ঈশানও দূর থেকে স্যারের এই বদলটা অনুভব করছিল; স্কুলের পর সে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে হঠাৎই চুপ করে দাঁড়িয়ে যায়, কারণ দেখতে পায় স্যার মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে কারো দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে—কিন্তু ওখানে কেউ নেই। ঈশান ভয়ে দৌড়ে চলে যায়, আর সন্ধ্যায় গিয়ে বনমালী ওঝাকে সব বলে। বনমালী গভীর চোখে তাকিয়ে বলল, “ছেলেটা, তোর স্যার আর একা নেই… ওর সঙ্গে কেউ এসেছে, যাকে তুই দেখতে পাবি না।” সেই রাতে কাবেরী, ঈশান আর বনমালী তিনজনেই আলাদা আলাদা ঘরে, আলাদা আলাদা বিছানায় শুয়ে থেকেও এক অজানা অশরীরী উপস্থিতি অনুভব করল—যেন অরণ্যের ছায়া ওদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নিঃশব্দে, ধীরে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে স্পষ্টভাবে। আর দূরের অরণ্য যেন ফিসফিস করে বলে উঠল—“আমি এসেছি…”—যা রাতের নীরবতার থেকেও বেশি স্পষ্ট, আর আতঙ্কের থেকেও বেশি বাস্তব।
অধ্যায় ৫
শীতের সেই ভোরগুলোতে গ্রামের উপরে নামা কুয়াশা যেন আগের চেয়ে ঘন হয়ে আসতে লাগল, আর অরণ্যের দিকের বাতাস বয়ে আনতে লাগল এমন এক গন্ধ, যা কেবল ভয়ে নয়, অজানা স্মৃতির মতো মনে পড়িয়ে দেয় শূন্যতা আর অভিশাপের কথা। অমিতাভ স্কুলে গেলেও আগের মতো ক্লাস নিত না, তার চোখ বারবার অরণ্যের দিকে চলে যেত, মাঝেমধ্যে হঠাৎ থমকে গিয়ে নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়ত, যেন কারো নির্দেশ মেনে চলে। একদিন দুপুরে ছাত্রদের চমকে দিয়ে স্যার হঠাৎ বই বন্ধ করে দাঁড়ালেন, ক্লাসরুমের এক কোণে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “তুই এসেছিস?” সেই দিকে তাকিয়ে কারো উপস্থিতি অনুভব করলেও ছাত্ররা কিচ্ছু দেখতে পেল না, কেবল নিস্তব্ধতা আর থমথমে একটা অচেনা ভয় টের পেল। ঈশান চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দেখল স্যারের চোখ জলে ভিজে গেছে, সেই চোখে এমন এক ধরনের শূন্যতা আর অস্বস্তি, যা জীবিত মানুষের চোখে সহজে দেখা যায় না। ক্লাস ছুটির পর ঈশান ভয়ে ভয়ে বাইরে বেরোল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল স্যারের পাশে আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে, অদৃশ্য, নিঃশব্দ—কিন্তু তবু উপস্থিত।
সেই দিন সন্ধ্যায় কাবেরী আবার স্বামীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল, তার গলায় আগের মতো স্নেহ আর শঙ্কা মিলিয়ে। সে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো? কে ও?” অমিতাভ স্তব্ধ চোখে কাবেরীর দিকে তাকাল, সেই দৃষ্টি যেন simultaneously খুব কাছে থেকেও অসীম দূরের, আর ফিসফিস করে বলল, “ও আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল… আমি কথা দিয়েছি… ওকে আমি ছাড়তে পারব না…” কাবেরীর কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “কে?” কিন্তু উত্তর এল না, কেবল নিঃশ্বাসে শোনা গেল, “তুই দেখবিই না… ও আছে…” সেই রাতটা কাবেরীর কাছে নিছক এক রাত নয়, যেন লম্বা একটা অন্ধকারের স্রোত, যার শেষ নেই; অন্ধকার ঘরের এক কোণ থেকে অজানা কিছুর শীতল দৃষ্টি অনুভব করল, আর টের পেল, শুধু স্বামী নয়, তাদের জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে এমন কিছু, যা কোনো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় নিঃশ্বাসের মধ্যে, দেয়ালের ছায়ায়, এমনকি নিজের ভাবনার ভেতরেও। জানলার কাঁচে মাঝে মাঝে কুয়াশার ভেতর অদ্ভুত ছায়া ভেসে উঠত, আর সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে কাবেরীর বুক ধড়ফড় করত—সেখানে কি কেউ দাঁড়িয়ে আছে? নাকি এ কেবল তার ভয়ের সৃষ্টি?
পরের দিন ভোরবেলা ঈশান ছুটে গেল বনমালী ওঝার কাছে, যিনি অরণ্যের গল্প জানেন আর অন্ধকারের ভাষা বোঝেন। সব শুনে বনমালী চোখ বুজে বলল, “অরণ্যের ডাক কেবল ডাক নয়… ওরা যে আসে, তারা ছায়া হয়ে থাকে, মানুষের ভিতরে কথা বলে, আর মানুষের মনকে খালি করে ফেলে…” ঈশানের চোখ ভয়ে বড় হয়ে গেল, সে ফিসফিস করে বলল, “স্যার কি এখন আর আগের মতো নেই?” বনমালী চুপ করে মাথা নাড়ল, “নেই… আর হয়তো কখনও হবে না…” সেই রাতের পর থেকে গ্রামের মানুষের চোখে স্পষ্ট দেখা গেল, অরণ্যের কুয়াশা আগের চেয়ে ঘন হচ্ছে, পাখির ডাক থেমে যাচ্ছে, আর বাতাসের শিরশির শব্দের মধ্যে কারো ফিসফাস শোনা যাচ্ছে—যেন অরণ্য কেবল একজনকে নয়, পুরো গ্রামকেই নিজের ছায়ার মধ্যে টেনে নিচ্ছে, ধীরে, অদৃশ্য হাত বাড়িয়ে।
অধ্যায় ৬
সন্ধ্যা নামার আগেই অরণ্যের দিকের আকাশ যেন আরও গাঢ় হয়ে আসে, মেঘের ফাঁক গলে নামা ম্লান আলোতে গ্রামের পথগুলোকে মনে হয় অদ্ভুত অচেনা, আর কাবেরীর মনে হয় এই অচেনা অন্ধকারের ভেতরেই যেন লুকিয়ে আছে সেই ছায়া, যার অস্তিত্ব কেউ দেখতে পায় না অথচ সবাই অনুভব করে। অমিতাভ তখন একা বসে থাকে জানলার ধারে, চোখে সেই অসীম শূন্যতা, ঠোঁটে ফিসফিসানি, আর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম; কখনও তার দৃষ্টি স্থির হয় গ্রামের সীমানা পেরিয়ে অরণ্যের দিকে, যেন কারো সঙ্গে চোখাচোখি করছে, এমন কারো সাথে যে কেবল তাকেই দেখা যায়। একদিন রাতে কাবেরী স্বামীর কণ্ঠে স্পষ্ট শুনল, “আমি তোকে ছেড়ে যেতে পারি না… তুই আমায় ছেড়ে যাসনি… আমি কথা রাখব…” আর সেই স্বরের গভীরে এমন এক অদ্ভুত কষ্ট আর অচেনা উন্মাদনা মিশে ছিল, যা কাবেরীর বুকের মধ্যে হাওয়ার মতো কেঁপে উঠল; সে বুঝতে পারল, যাকে নিয়ে অমিতাভ ফিসফিস করছে, সে কেবল কোনো স্মৃতি নয়, সেই উপস্থিতি এখনো এখানে, এই ঘরের মধ্যেই নিঃশ্বাস ফেলছে, দেয়ালের ছায়ায় লুকিয়ে তাকিয়ে আছে।
ঈশানও সেই বদলের সাক্ষী, স্কুলের মাঠে বা রাস্তায় যখনই স্যারের চোখের দিকে তাকায়, সে বুঝতে পারে এই চোখ সেই স্যারের নয়, যিনি তাকে গল্প শুনিয়ে হাসাতেন, বরং এই চোখের গভীরে আছে এক অচেনা অন্ধকার, যেটা কারো জন্যও বন্ধ নয়; একদিন স্যার খোলা মাঠের মধ্যে হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলল, “তুই আমার পাশেই আছিস, তাই না? আমি জানি…” ঈশান ভয়ে পিছিয়ে গেল, চারপাশে তাকাল, অথচ কারো দেখা পেল না—তবু মনে হল, গাছের ছায়ার ফাঁকে, বাতাসের ঢেউয়ে, সেই ‘কেউ’ আসলেই আছে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে, শুনছে, আর অদৃশ্য আঙুলের ইশারায় স্যারের মনকে টানছে। সেই রাতেই ঈশান ছুটে গেল বনমালী ওঝার কাছে, কাঁপা গলায় বলল, “ও কি সত্যিই আছে?” বনমালী নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করল, মুখের রেখা শক্ত হয়ে গেল, আর বলল, “ও আছে… কিন্তু ওকে তাড়ানো যায় না, ও চলে যায় নিজেই… আর যদি ওকে ডেকে আনা হয়, তাহলে ওকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না…”
গ্রামের বাতাসে তখনও ছড়িয়ে থাকে এক চাপা শিহরণ, রাতের বেলায় জানলার কাচে লেগে থাকা কুয়াশার ফোঁটাগুলো যেন ভেতর থেকে কারো নিঃশ্বাসে জমে থাকে, আর কাবেরীর মনে হয় অমিতাভের ফিসফিসের উত্তর কেউ সত্যিই দিচ্ছে, যদিও সেই উত্তর কেবল নিস্তব্ধতায় লুকানো থাকে। একদিন রাতে সে স্বামীর পাশে বসে কাঁপা গলায় বলল, “তোমার সঙ্গে কে এসেছে?” অমিতাভ চোখ তুলে তাকাল, সেই চোখে শুধু অন্ধকারের ছায়া আর ক্লান্তি, আর আস্তে বলল, “তুই দেখবি না… ও আমার সঙ্গে আছে… ও আমাকে ডাকছে…” এই কথায় কাবেরীর শরীরের রক্ত জমে গেল, কারণ সেই ফিসফিসানির মধ্যে স্পষ্ট টের পেল আরও একটুখানি নিঃশ্বাসের শব্দ, যেটা স্বামীর নয়, বরং কারো অদৃশ্য, শীতল, অরণ্য থেকে আসা নিঃশ্বাস, যা শুধু শোনার নয়, মন থেকে অনুভব করার মতো। আর সেই মুহূর্তেই কাবেরীর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, তাদের জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়া এই ছায়া আর কোনো কল্পনা নয়—এ এক অদৃশ্য অথচ জীবন্ত উপস্থিতি, যা অরণ্যের নীরব ডাকের মতোই গভীর, ধীরে, নিঃশব্দে সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে।
অধ্যায় ৭
সেই রাতের পর থেকে কাবেরীর ঘুম আর আসেনি, চোখের পাতা বন্ধ করলেই মনে হত অন্ধকারের ভেতর থেকে দুটো অদৃশ্য চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে, আর নিঃশ্বাসে মিশে থাকা সেই অচেনা শীতলতা যেন তাকে স্পর্শ করে চলে যাচ্ছে বারবার। সকাল হলেই সে নিজেকে বুঝিয়ে নিত যে সবটাই কল্পনা, তবু অমিতাভের চোখের দিকে তাকানোর সাহস পেত না; স্বামীর চোখে ছিল এমন এক শূন্যতা আর অজানা আত্মবিসর্জনের ছাপ, যা দেখে মনে হত এই মানুষটিকে সে আর কোনোদিনও চিনতে পারবে না। এক সকালে অমিতাভ নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি তোকে কথা দিয়েছি… আমি কথা রাখব… তুই ভয় পাস না…” আর কাবেরীর গলা শুকিয়ে এল, কারণ সে স্পষ্ট শুনতে পেল ফিসফিসানির পর যেন কেউ উত্তর দিল—খুব ক্ষীণ, বাতাসের মতো—যেটা কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর নয়, কিন্তু তবু তার ভেতরে ঢুকে বুকের মধ্যে কাঁপন ধরিয়ে দিল। সেই মুহূর্তে কাবেরী বুঝল, এ শুধু ছায়া নয়, এ এমন এক অস্তিত্ব যাকে দূর থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায় না; অমিতাভ তাকে ডেকে এনেছে, আর এখন সে তাদের ঘরের মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে, দেয়ালের ফাঁকে, বাতাসের ঢেউয়ে, আর রাতের নিস্তব্ধতার ভেতর।
ঈশানও স্কুলের আঙিনায় টের পেল সেই অদ্ভুত পরিবর্তন; স্যার ক্লাসের মধ্যে বই খুলে তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু চোখের দৃষ্টি কাগজের অক্ষরের ভেতর দিয়ে অনেক দূরের কোনো অজানা স্থানে চলে যায়, মুখে ফিসফিস করে বলেন, “আমি তো আছি… তুই শুধু আমার পাশে থাক…” ছাত্ররা ভয়ে চুপ করে বসে থাকে, কারণ তারা বুঝতে পারে, স্যারের এই কথা তাদের জন্য নয়, বরং এমন কারো জন্য, যাকে তারা কেউ দেখতে পায় না। একদিন ছুটির পর ঈশান সাহস করে স্যারের কাছে গিয়ে বলল, “স্যার, ও কি এখনো আছে?” অমিতাভের চোখ হঠাৎ বড় হয়ে গেল, কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “তুই দেখতে পাবি না… কিন্তু ও ছেড়ে যায়নি…” সেই মুহূর্তে ঈশানের মনে হল, স্যারের পাশে সত্যিই কেউ দাঁড়িয়ে আছে, অদৃশ্য, নিঃশব্দ, কিন্তু এতই উপস্থিত যে ঈশান একপলকের জন্যও শ্বাস নিতে ভুলে গেল। সেই রাতে ঈশান ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরল, আর জানলার ফাঁক দিয়ে অরণ্যের দিকের অন্ধকারের মধ্যে দেখল—শীতের কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুত এক ছায়া, যে নড়ছে না, শুধু তাকিয়ে আছে গ্রামটার দিকে।
বনমালী ওঝা তখনও গ্রামের প্রান্তের ছোট্ট কুঁড়েঘরে বসে রাতের আঁধারে চোখ বন্ধ করে কিছু শোনা বা বোঝার চেষ্টা করছে; তার ঠোঁটে ভাঙা ভাঙা মন্ত্র, আর কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। একদিন কাবেরী আর ঈশান একসাথে গিয়ে দাঁড়াল ওঝার সামনে, কাঁপা গলায় বলল, “আমরা কী করতে পারি?” বনমালী চোখ খুলে ধীরে বলল, “এ এমন এক ছায়া, যাকে তাড়ানো যায় না… ও নিজের ইচ্ছেতেই আসে আর যায়… শুধু একটুকু সাবধান—ভয় দেখাবি না, ডাকবি না… শুধু চুপচাপ থাকতে শিখ… কারণ ও অরণ্যের ডাক নিয়ে এসেছে, আর সেই ডাক যে একবার শোনে, সে আর আগের মতো থাকে না…” সেই কথা শুনে কাবেরীর বুকের মধ্যে হাওয়ার মতো কেঁপে উঠল এক অজানা শীতলতা; সে বুঝতে পারল, হয়তো কোনোদিনই স্বামীকে আর ফেরত পাবে না, আর অমিতাভ যাকে অরণ্য থেকে এনেছে, সে এখন তাদের সাথেই থাকবে, চোখের আড়ালে, নিঃশ্বাসের ফাঁকে, আর তাদের জীবনকে অদৃশ্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, যতদিন না অরণ্য তাকে আবার ফিরিয়ে নেয় নিজের অন্ধকারের মধ্যে।
অধ্যায় ৮
রাত গভীর হলেই গ্রামের উপরে যেন আরও ঘন হয়ে নামে অরণ্যের নিস্তব্ধতা, আর সেই নীরবতায় কাবেরীর মনে হয় সে স্পষ্ট শুনতে পায় অমিতাভের ফিসফিসানির জবাব—একটা কণ্ঠস্বর, যেটা বাতাসের মধ্যে ভেসে আসে, অথচ শব্দের মতো নয়, বরং বুকের গভীরে কাঁপন তুলতে থাকা অনুভূতির মতো। সেই কণ্ঠস্বরের ভাষা বোঝা যায় না, তবু বোঝা যায় তার অর্থ: “আমি আছি… আমি কখনোই যাইনি…” এক রাতে অমিতাভ হঠাৎ জেগে উঠে দরজা খুলে বাইরে চলে গেল, আর কাবেরী চুপিচুপি পিছু নিল; দেখতে পেল অমিতাভ দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির উঠোনে, অরণ্যের দিকের অন্ধকারের দিকে হাত বাড়িয়ে বলছে, “তুই আসিস… আমি ভয় পাই না…” আর সেই হাত বাড়ানোর ভঙ্গিতে এমন এক অজানা আরাধনা আর আত্মসমর্পণ ছিল, যা কাবেরীর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোতের মতো নেমে গেল। হাওয়ার ঝাপটায় কুয়াশা নড়ে উঠল, আর কাবেরীর মনে হল, সেই কুয়াশার ভেতরেই দাঁড়িয়ে আছে সেই অদৃশ্য সত্তা, যে অমিতাভকে ছেড়ে যায়নি—দেখা যায় না, তবু অনুভব করা যায়, নিঃশ্বাসে, ছায়ায়, আর শীতল বাতাসের স্পর্শে।
পরদিন সকালে অমিতাভ আর স্কুলে গেল না; শুধু জানলার ধারে বসে রইল, অরণ্যের দিকে চেয়ে। কাবেরী জিজ্ঞাসা করল, “তুমি ওখানে কী দেখ?” অমিতাভ ধীরে উত্তর দিল, “যা তুই কখনো দেখবি না… কিন্তু আমি দেখেছি… আমি ওকে ভুলতে পারি না…” সেই কথার মধ্যে এমন এক দুঃখ আর অদ্ভুত মায়া ছিল, যা কাবেরীর চোখে জল এনে দিল, অথচ সেই মায়া মানুষের জন্য নয়, বরং সেই অদৃশ্য ছায়ার জন্য, যাকে অমিতাভ অরণ্য থেকে নিয়ে এসেছে। ঈশানও সেইদিন বিকেলে স্যারের বাড়ির পাশে গিয়ে দেখল স্যার একাই বসে আছে, আর একপাশে এমনভাবে তাকিয়ে আছে, যেন সেখানে সত্যিই কেউ বসে আছে; মাঝে মাঝে হেসে বলছে, “তুই ঠিক বলেছিস… ওরা বোঝে না…” ঈশানের বুকের মধ্যে গুমোট ভয়ের মতো জমে রইল সেই অনুভব—স্যারের পাশে হয়তো কেউ সত্যিই আছে, যাকে সে দেখতে পায় না, কিন্তু স্যার দেখছে, আর তার সঙ্গে কথা বলছে, এমন স্বাভাবিকভাবে, যেমন কেউ জীবিত প্রিয়জনের সঙ্গে বলে।
রাতের অন্ধকার তখন আর শুধু অন্ধকার নয়, যেন সেই ছায়ার বসবাসের জায়গা হয়ে গেছে; বাতাস নিস্তব্ধ হয়ে এলে শোনা যায় নিঃশ্বাসের মতো হাওয়ার শব্দ, আর কাবেরীর মনে হয় সেই নিশ্বাস ঠিক তার কানের কাছে, স্পর্শ করছে তার চুল, ঠোঁট, আর ফিসফিস করে বলছে, “ভয় পাস না… আমি তো আছি…” বনমালী ওঝার কথাগুলো তখন কাবেরীর মনে ঘুরতে থাকে—“ও চলে যাবে নিজের ইচ্ছেতেই… তাড়াতে গেলেই ও রাগ করবে…” আর কাবেরী জানে, সেই অদৃশ্য উপস্থিতির রাগ মানে শুধু অমিতাভ নয়, তাদের পুরো জীবনকেই গ্রাস করা। তাই সে আর কোনো প্রশ্ন করে না, কোনো উত্তর খোঁজে না; শুধু বসে থাকে, শোনে অমিতাভের ফিসফিসানি, আর অনুভব করে সেই শীতল ছায়ার অদৃশ্য স্পর্শ—যেটা রাতের আঁধারে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আর মনে করিয়ে দেয়, অরণ্যের ডাক যে একবার শোনে, সে আর কোনোদিনও একা থাকে না।
অধ্যায় ৯
শীতের রাতগুলো তখন আর নিছক ঠান্ডা রাত নয়, বরং অদৃশ্য ছায়ার আনাগোনায় পূর্ণ এক প্রহর হয়ে উঠেছিল; কাবেরীর চোখে ঘুম আসত না, আর অমিতাভ তখন জানলার পাশে বসে এক দৃষ্টিতে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে থাকত, যেন অন্ধকারের গভীরে লুকিয়ে থাকা কাউকে দেখে। একদিন গভীর রাতে কাবেরী স্পষ্ট শুনতে পেল, অমিতাভ একটানা বলছে, “আমি কথা রাখব… তুই ভয় পাবি না… আমি তোকে ছেড়ে যাব না…” সেই ফিসফিসানি শুনে কাবেরীর মনে হল, স্বামীর গলায় আর নিজের মানুষের সেই চিরচেনা সুর নেই; আছে কেবল এক অদ্ভুত অনুরাগ, এক ধরনের আত্মসমর্পণ যা কোনো জীবিত মানুষের প্রতি নয়, বরং সেই অদৃশ্য সত্তার প্রতি যাকে অমিতাভ অরণ্য থেকে নিয়ে এসেছে। সেই রাতের পর কাবেরী বুঝল, অমিতাভের ভেতর আর কেউ আছে, এক অদৃশ্য সঙ্গী, যে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে; আর সেই বন্ধন কারো চোখে দেখা যায় না, কেবল অনুভবে বোঝা যায়, নিঃশ্বাসের গভীরতা আর চোখের দৃষ্টির শূন্যতায়।
ঈশানও অনুভব করল, স্যার আর আগের মতো নেই; একদিন বিকেলে স্যার তাকে ডেকে বলল, “তুই ভয় পাস না… সব ঠিক আছে… তুই শুধু ভুলে যা যা দেখেছিস…” ঈশান ভয়ে মাথা নাড়ল, কিন্তু তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, “স্যার, ও কি এখনো আছে?” অমিতাভের চোখে তখন এক অদ্ভুত শীতল আলো জ্বলল, আর ধীরে বলল, “ও তো আমারই অংশ এখন… তুই দেখিস না, তাতে কী আসে যায়…” সেই কথায় ঈশান বুঝে গেল, স্যার যে মানুষ ছিলেন, সেই মানুষ আর নেই—বেঁচে আছে কেবল তার শরীর, আর সেই শরীরের ভেতর লুকিয়ে আছে অরণ্যের অজানা ছায়া। স্কুলের অন্য ছাত্ররাও বুঝতে পারছিল, স্যার কখনো একা হাঁটেন না, মাঝেমধ্যে একপাশে তাকিয়ে হাসেন, কথা বলেন, আবার থেমে যান; অথচ সেই পাশে কারো দেখা যায় না, কেবল হাওয়ার গায়ে স্পর্শের মতো টের পাওয়া যায় এক অদৃশ্য সঙ্গীর উপস্থিতি।
বনমালী ওঝা একদিন কাবেরীকে ডেকে বলল, “মেয়েটি, অরণ্যের ডাক কারো পক্ষে থামানো যায় না… তুই চেষ্টা করিস না, তাতে সর্বনাশ হবে…” কাবেরীর চোখ ভিজে এল, সে ফিসফিস করে বলল, “তাহলে কী করব?” বনমালী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুই শুধু পাশে থাক, ভয় না পেয়ে… ও যদি কখনো ছেড়ে যেতে চায়, তখনই যাবে… তাড়ানোর চেষ্টা করবি না…” সেই রাতে কাবেরী স্বামীর পাশে বসে অন্ধকারে চুপচাপ কাঁদল, আর জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল অরণ্যের অন্ধকারের মধ্যে একটা ছায়া, যেটা ধীরে ধীরে মিলে গেল কুয়াশায়; তবু তার বুকের ভেতর সেই ছায়ার স্পর্শ লেগে রইল, আর সে বুঝল, তাদের জীবনে এই অদৃশ্য উপস্থিতি এখন নিতান্তই সত্যি—যা ছাড়তে চাইলেও আর ছাড়া যায় না।
অধ্যায় ১০
দিনের আলোতেও অমিতাভের চোখে সেই ছায়ার ছাপ স্পষ্ট, আর গ্রামের মানুষও বুঝতে শিখল—এই মানুষ আর একা নেই, তার পাশে এক অদৃশ্য সঙ্গী আছে, যার উপস্থিতি কেবল অনুভবে ধরা দেয়। একদিন সকালের দিকে অমিতাভ হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে জানলার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুই আসছিস? আমি তৈরি…” আর সেই কথার মধ্যেই এমন এক স্বস্তি আর বেদনার মিশ্রণ ছিল, যেন অনেক দিনের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে। কাবেরী ভয়ে ছুটে গিয়ে স্বামীর হাত ধরল, কিন্তু অমিতাভ ধীরে হাত সরিয়ে দিলেন, আর চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন; বাতাসের মধ্যে যেন আরও কারো নিঃশ্বাস মিশে গেল, আর সেই নিঃশ্বাস শীতল, নিস্তব্ধ, অথচ জীবন্ত। হাওয়ার মধ্যে অদ্ভুত কুয়াশা ঘুরে উঠল, আর সেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে কাবেরীর মনে হল, সত্যিই কারো ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে অমিতাভের দিকে, আর অমিতাভ নিঃশব্দে সেই ছায়াকে আলিঙ্গন করল।
সেই মুহূর্তে কাবেরীর চোখের সামনে দিয়ে যেন অনেক স্মৃতি ভেসে গেল—যেন একসাথে সব হারিয়ে যাচ্ছে, আর কিছুই করা সম্ভব নয়। অমিতাভ ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়লেন, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল, আর ঠোঁটে ফিসফিস করে শেষবারের মতো বললেন, “আমি কথা রেখেছি…” তারপর তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল, আর সেই চোখে অদ্ভুত এক শান্তির ছাপ ফুটে উঠল—যেন বহুদিনের যন্ত্রণা আর টানাপোড়েনের অবসান। কাবেরী কাঁপা হাতে স্বামীর মুখ ছুঁয়ে দেখল, তার শরীরটা ঠান্ডা হয়ে এসেছে, আর চারপাশের বাতাস নিস্তব্ধ, তবু মনে হচ্ছে সেই অদৃশ্য ছায়া এখনো কাছেই আছে—যে অপেক্ষা করেছিল, আর শেষমেশ অমিতাভকে নিয়ে গেল অরণ্যের সেই অজানা গভীরে।
গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া নামল, কিন্তু কেবল কাবেরী জানত সত্যিকারের কাহিনি—যে এই মৃত্যু কেবল শরীরের নয়, বরং সেই অরণ্যের অদৃশ্য ছায়ার কাছে চিরন্তন আত্মসমর্পণ। ঈশান আর বনমালী ওঝা মিলে অমিতাভের সৎকার করল, আর সেই রাতে কাবেরী একা জানলার ধারে বসে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তোমাকে আর দেখা যাবে না… তবু তুমি আছো…” হাওয়ার ঢেউয়ে জানলার পর্দা নড়ে উঠল, আর এক মুহূর্তের জন্য কাবেরীর মনে হল অমিতাভের নিঃশ্বাসের স্পর্শ এখনো আছে তার গালে, নরম, শীতল, আর চিরকালীন; আর অরণ্যের অন্ধকারে যেন সেই অদৃশ্য ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, রেখে গেল কেবল নিস্তব্ধতা আর অরণ্যের সেই অনন্ত ডাক—যা একবার শোনা মানেই আর কোনোদিনও একা থাকা যায় না।
বছরখানেক কেটে গেছে, তবু অরণ্যের সেই ডাক আজও কাবেরীর জীবনে রয়ে গেছে অদৃশ্য ছায়ার মতো—যাকে চোখে দেখা যায় না, তবু অনুভবে বোঝা যায় নিঃশ্বাসের ফাঁকে, নিশ্ছিদ্র নীরবতায়। অমিতাভের মৃত্যুর পরও কাবেরী মাঝে মাঝে গভীর রাতে জানলার কাছে বসে থাকেন, আর অরণ্যের দিকে তাকিয়ে অনুভব করেন, যেন কোথাও থেকে এখনও সেই চেনা ফিসফিসানি ভেসে আসে—“আমি আছি… তুই একা নোস…”। গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে এই গল্প ভুলতে শুরু করেছে, স্কুলে নতুন শিক্ষক এসেছে, ঈশান বড় হয়েছে, কিন্তু কাবেরীর জীবনে সেই শূন্যতা আর অরণ্যের ছায়া রয়ে গেছে, অমিতাভের মতোই চিরস্থায়ী। রাতের গভীরে, যখন বাতাস থমকে যায়, কুয়াশা ঘন হয়ে ওঠে, তখন কাবেরীর মনে হয়, অরণ্যের অন্ধকারের মধ্যে এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেই অদৃশ্য সঙ্গী—যাকে অমিতাভ নিয়ে এসেছিলেন, আর যে আজও তাদের স্মৃতি আর নিঃশ্বাসে বেঁচে আছে; কারণ অরণ্যের ডাক একবার যাকে ছুঁয়ে যায়, তাকে আর কোনোদিন পুরোপুরি ছাড়ে না।
সমাপ্ত