নন্দিতা রায় শর্মা
এক
গ্রামের ঘর-বাড়ির বারান্দায়, চায়ের দোকানের মাচায়, এমনকি পুকুরের ধারে বসে গল্প করা বৃদ্ধাদের মুখে—সবখানে কালীপাহাড়ের কাহিনি ঘোরে। অন্ধকার নেমে এলে পাহাড়ের ঝোপঝাড়ের মধ্যে চিৎকার এবং অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায় বলে তারা বলে। কেউ বলে, অমাবস্যার রাতে এখানে অঘোরী সাধনা হয়; কুচক্রী মানুষেরা গোপন মন্ত্রপাঠ করে এমন কাজ করে যা সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। আরেকটু বাড়িয়ে বলা হয়, যারা পাহাড়ের অজপাশে গিয়ে রাত কাটায়, তারা কখনও ফেরে না, বা ফেরে এক অদ্ভুত পরিবর্তিত রূপে। শিশুদের চোখে কল্পনার আঁধার নেমে আসে, কিন্তু বয়সে বড়রা নিজেদের কষ্ট এবং বাস্তবতার সঙ্গে সেই কাহিনিকে মেলাতে চায়। অভীক এই সব গল্পকে হাস্যকর এবং অযৌক্তিক মনে করে। সে বিশ্বাস করে না যে কোনও পাহাড়ে এমন অশুভ শক্তি লুকিয়ে থাকতে পারে। তার কাছে এগুলো শুধুই গ্রামের মানুষের অতিরঞ্জিত গল্প, যা কৌতূহল এবং ভয়ের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে। তবে বন্ধুদের সঙ্গে মজা করার জন্য, সেই কল্পিত ভয়ের গল্পের পেছনে কিছুটা চ্যালেঞ্জ অনুভব করতে শুরু করে। সে মনে করে, “একবার দেখলে বোঝা যাবে, সবই মিথ্যা।”
অভীক এবং তার কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে পরিকল্পনা শুরু হয়। রাতের বেলায় কালীপাহাড়ের দিকে যাত্রা করার বিষয়টি আলোচনা হয়, হাসি-ঠাট্টা এবং গল্পের অতিরঞ্জিত নাটকীয়তা দিয়ে। তারা একে অপরকে ভয় দেখানোর জন্য নানা পরিকল্পনা করে। কেউ বলে, “যদি পাহাড়ের কাদা ও ঝোপঝাড়ে কেউ লুকিয়ে থাকে, তাহলে তার সঙ্গে কেমন হবে?” আরেকজন যুক্তি দেয়, “এই সব কেবল মানুষ নিজের ভয়ে বানানো গল্প। কেউ হারিয়ে যাবে না।” এই আলাপচারিতায় ভয়ের এবং উত্তেজনার মিশ্রণ ধীরে ধীরে তাদের মনকে আগ্রহী করে তোলে। অভীক যদিও প্রথমে উক্ত পরিকল্পনাকে সহজভাবে গ্রহণ করে, কিন্তু মনে রাখতে থাকে যে পাহাড়ের রাত এবং অন্ধকারের রহস্য ভেতরে কোথাও একটা অজানা উত্তেজনা জাগায়। প্রস্তুতির সময় তারা লণ্ঠন, ফ্ল্যাশলাইট, এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে যায়। কেউ কল্পনায় অশুভ চেহারার ছবি আঁকে, কেউ আবার পাহাড়ের গাছপালার অদ্ভুত ছায়া এবং আওয়াজের কথা মনে করে। রাতের পরিকল্পনা যেন এক ধরণের খেলাধুলা এবং ভয়ানক চ্যালেঞ্জের মধ্যে মিলিত হয়।
শেষপর্যন্ত, অমাবস্যার রাত আসে। গ্রামে হালকা কুয়াশা, দূরে দূরে যান্ত্রিক আওয়াজ, আর গ্রামের লোকের অদ্ভুত দৃষ্টির মাঝে তারা চুপচাপ বেরিয়ে পড়ে। পাহাড়ের পথের চারপাশে অন্ধকারে সবকিছু রহস্যময় লাগে; ঝোপঝাড়ের শব্দ, পাখির অদ্ভুত ডাক, আর হাওয়ার ফিসফিস তাদেরকে আরও চাঞ্চল্যকর মনে হয়। অভীক শুরুতেই ভয়ের কোন চিহ্ন দেখায় না, কিন্তু ধীরে ধীরে পাহাড়ের নিঃশব্দতা এবং রহস্যময় পরিবেশ তার মনকে হালকা ঘাবড়ে দেয়। বন্ধুরা তাকে ধমকায়, হেসে চ্যালেঞ্জ করে, কিন্তু অভীকের মধ্যে একটা অনির্বচনীয় উত্তেজনা জন্মায়। তারা পাহাড়ের গোপন পথে হাঁটে, গল্পের অতিরঞ্জিত রহস্যের মাঝেই নিজেদেরকে পরীক্ষা করতে থাকে।
দুই
অভীক সকালে উঠে তার বন্ধুদের সঙ্গে বসে কালীপাহাড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। সে প্রথমেই সবাইকে বোঝায়, কেবল তাদের মজা এবং উত্তেজনার জন্য এই যাত্রা, কিছু অদ্ভুত বা ভয়ংকর ঘটবে না। মেহুল, বিজয় এবং পূর্ণিমা অবিলম্বে উচ্ছ্বাস দেখায়, কিন্তু সায়নী একটু দ্বিধান্বিত থাকে। সে ছোটবেলা থেকে এই পাহাড়ের গল্প শুনে বড় হয়েছে। তার মনে আছে কিভাবে গ্রামের বৃদ্ধরা অমাবস্যার রাতে পাহাড়ের অন্ধকারে অশরীরী শক্তি এবং অদ্ভুত ঘটনা নিয়ে গল্প বলত। সে জানে, কিছু মানুষ হারিয়ে গিয়েছে, আবার কেউ ফিরে এসেছে কিন্তু তাদের চেহারা বা আচরণ সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। তাই সায়নী প্রথমে রাজি হয় না। অভীক তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, বলে, “সবই গ্রামবাসীর অতিরঞ্জিত গল্প। আমরা শুধু দেখতে যাব, ভয় দেখানোর জন্য। কিছুই হবে না।”
ধীরে ধীরে সায়নী বন্ধুদের চাপে রাজি হয়। সে জানে, এই বন্ধুত্বের মাঝে সাহস দেখানো এবং একসাথে মজা করার আনন্দও আছে। পূর্ণিমা, মেহুল এবং বিজয় সবাই একসাথে পরিকল্পনা ঠিক করার জন্য উচ্ছ্বাসিত। তারা ঠিক করে, অমাবস্যার রাতে পাহাড়ে গিয়ে লুকিয়ে তান্ত্রিককে ভয় দেখাবে। কেউ কেউ লণ্ঠন, ফ্ল্যাশলাইট এবং অন্যান্য সরঞ্জামের পরিকল্পনা করে। বিজয় বলে, “আমরা যদি নির্ভয়ে থাকি, তান্ত্রিক বা পাহাড়ের কোনো রহস্য আমাদের কিছু করতে পারবে না।” মেহুল একথায় যোগ করে, “ঠিক আছে, তবে আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। পাহাড়ের পথে হঠাৎ কিছু ঘটতে পারে।” প্রত্যেকেই তাদের ভয় এবং উত্তেজনা মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করে।
পরিকল্পনা শুধু সরঞ্জাম এবং পথনির্ধারণে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তারা কৌশলও ঠিক করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, কেউ পাহাড়ের আগে লুকিয়ে থাকবে এবং কেউ তাকিয়ে থাকবে, যাতে যদি কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে, তারা একে অপরকে সাহায্য করতে পারে। পূর্ণিমা নিজে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিজের ভয়কে কাবু করার জন্য। সায়নী অন্তরের ভয়ের সঙ্গে লড়াই করে, কিন্তু অভীকের সাহস এবং বন্ধুত্বের কারণে নিজেকে তৈরি করে। তারা রাতের অন্ধকারে একসাথে থাকার প্রয়োজনীয়তা বোঝে, কারণ ভয় শুধু পাহাড় নয়, প্রায়ই তাদের মনে নিজেরই ঘোর তৈরি করে। এই অংশে পাঠককে ধীরে ধীরে শিখানো হয়, কিভাবে সাহস, বন্ধুত্ব এবং কৌতূহল একসাথে মিলিত হলে ভয়কে সামলানো সম্ভব। শেষপর্যায়ে তারা রাতে যাবার চূড়ান্ত পরিকল্পনা ঠিক করে। অমাবস্যার রাতটি সবার জন্য উত্তেজনা এবং রহস্যের মিশ্রণ নিয়ে আসে। তারা ঠিক করে, পাহাড়ের কোন পথ ধরে চলবে, কোথায় লুকিয়ে থাকবে এবং কিভাবে তান্ত্রিককে ভয় দেখাবে। এই অধ্যায়ে একটি সূক্ষ্ম ভয় এবং উত্তেজনার বীজ রোপিত হয়।
তিন
অমাবস্যার রাত গ্রামকে এক অদ্ভুত নীরবতার অন্তরালে ঢেকে দেয়। চারপাশে ঘন কুয়াশা নেমে আসে, এমনকি দূরের বাতাসের আওয়াজও যেন হালকা করে যায়। গ্রামের মাটির পথ ঘুরে ঘুরে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, আর কেবল ধীরে ধীরে হাওয়ার ফিসফিস এবং দূরের পুকুরের জলধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। পাহাড়ের দূরত্ব থেকে হালকা মশালের আলো ঝলমল করে, যা অদ্ভুতভাবে রহস্যময় দৃশ্য তৈরি করে। অভীক, মেহুল, বিজয়, সায়নী এবং পূর্ণিমা পাঁচ বন্ধু ধীরে ধীরে এবং গোপনে পাহাড়ের দিকে রওনা হয়। তাদের পায়ের শব্দ অতি সংবেদনশীল রাতের মধ্যে আরও স্পষ্ট শোনা যায়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মনে ভয় এবং উত্তেজনার এক মিশ্র অনুভূতি অনুভব করে। পূর্ণিমার মন বিশেষভাবে ভয়ভীত। সে প্রায় প্রতিটি ঝোপঝাড়ের শব্দে ভয়ে চমকে ওঠে, কিন্তু বন্ধুদের চোখে সাহস দেখলে নিজেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করে।
পথিমধ্যে তাদের সামনে একাধিক অজানা দৃশ্য উপস্থিত হয়। রাতের অন্ধকারে ঝোপঝাড় এবং গাছপালার ছায়া অদ্ভুত রূপ নেয়। হঠাৎ একটি কুকুর হাউমাউ করে ওঠে, তার ঘনিষ্ঠ এবং ভয়ানক আওয়াজ পাহাড়ের নিরিবিলি পরিবেশে প্রতিধ্বনিত হয়। বন্ধুরা এক মুহূর্তে থমকে যায়, তাদের হৃদস্পন্দন দ্রুত বেগ পায়। বাতাসে অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, যেমন কোন অজানা মধু এবং কিছু পোড়া বস্তু মিশ্রিত। অভীক চেষ্টা করে সবাইকে শান্ত রাখার, বলে, “ভয় দেখলে কিছু হবে না, এগুলো সবই প্রকৃতির খেলা।” কিন্তু সেই অজানা গন্ধ, কুকুরের হাউমাউ এবং অন্ধকারের চাপ সব মিলিয়ে তাদের মনে অদ্ভুত উত্তেজনা এবং ভয় জন্মায়। মেহুল হাসিমুখে তাদের উৎসাহিত করে, কিন্তু তার চোখে অজানা অস্থিরতা লুকানো থাকে। পথ চলার সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদেরকে পাহাড়ের রহস্যময় পরিবেশে এক নতুন স্তরে খুঁজে পায়, যেখানে কৌতূহল এবং ভয়ের মিশ্রণ তাদের চালিত করে।
শেষপর্যায়ে, তারা পাহাড়ের গভীরে পৌঁছায়। মশালের আলো অন্ধকারে হালকা নাচতে থাকে, আর ঝোপঝাড়ের ছায়া অদ্ভুত চেহারা নেয়। পূর্ণিমা মাঝে মাঝে থেমে যায়, যেন ভয়ের কুয়াশা তাকে আটকাচ্ছে। সায়নী, যা শুরুতে ভীত ছিল, এখন কিছুটা সাহসী হয়ে ওঠে, কিন্তু তার চোখে এখনও অজানা আতঙ্ক লুকানো। অভীক এবং অন্যান্যরা তাদের বন্ধুত্বের মাধ্যমে সাহস দেখায়, তবে রাতের গভীরতা এবং অমাবস্যার অন্ধকার তাদেরকে একটি অদ্ভুত সীমার মধ্যে নিয়ে আসে, যেখানে বাস্তব এবং কল্পনার মধ্যে পার্থক্য ধূসর হয়ে যায়। বাতাসে ভেসে আসা অদ্ভুত গন্ধ, কুকুরের হঠাৎ আওয়াজ এবং পাহাড়ের অজানা নিঃশ্বাস—সব মিলিয়ে এই রাতকে এক অদ্ভুত এবং রহস্যময় অভিজ্ঞতা হিসেবে পাঠকের সামনে উপস্থিত করে।
চার
পাহাড়ের অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে তারা গুহার মুখের কাছে পৌঁছায়। চারপাশে কেবল অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, আর কোথাও যেন অশরীরী চোখের উপস্থিতি অনুভূত হচ্ছে। হঠাৎ তারা দেখে, গুহার ভিতরে একজন অঘোরী তান্ত্রিক ছাই মেখে বসে মন্ত্রপাঠ করছে। তার চোখে অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, আর মুখে অপ্রকাশ্য এক ধরণের উদ্দীপনা। চারপাশে ছড়িয়ে আছে মশাল, যেগুলি হালকা আলো ছড়িয়ে দেয়, কিন্তু সেই আলোও গুহার অন্ধকারকে পুরোপুরি কাটাতে পারে না। কঙ্কাল, রক্তমাখা পাত্র এবং অদ্ভুত প্রতীকগুলো দেখে বন্ধুরা প্রথমে মনে করে, “ওরা হয়তো নাটক করছে।” অভীক এবং বিজয় একে দেখেও নিজের সাহস দেখাতে চায়, এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মনে করে, “সবই হয়তো কেবল একটা অভিনয়।” কিন্তু সায়নী, যার ছোটবেলা থেকে এই পাহাড়ের গল্প জানা, স্পষ্টভাবে অনুভব করে যে এখানে কোনো অশুভ শক্তি জেগে উঠেছে। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়, চোখ বড় হয়ে যায়, আর একটি অনির্বচনীয় শীতল শিহরন তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
অভীক ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে চায়, বিজয় তার পেছনে থাকে, কিন্তু সায়নী হঠাৎ চিৎকার করে বলে, “এখানে কেবল নাটক নয়, কিছু আরও ভয়ঙ্কর চলছে।” তার কণ্ঠস্বর ভয়ে কেঁপে উঠেছে, আর বন্ধুরা এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। তান্ত্রিকের মন্ত্রপাঠের আওয়াজ হালকা সুরে বাতাসে মিশে যায়, যেন পাহাড়ের প্রতিটি কোণ থেকে ফিসফিস করছে। হঠাৎ মশালের আলো flicker করে, আর ছায়া অদ্ভুতভাবে নাচতে থাকে। অভীক চেষ্টা করে সাহস দেখানোর, কিন্তু সায়নী অনুভব করে, এই অন্ধকার শুধু চোখে নয়, মনে ভয় জন্মাচ্ছে। বন্ধুরা বুঝতে পারে, যে তারা এমন একটি রহস্যের সামনে দাঁড়িয়েছে যা তাদের কল্পনার সীমার বাইরে। পাহাড়ের এই অংশ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ছায়া তাদেরকে সতর্ক করছে।
শেষপর্যায়ে, বন্ধুরা একসাথে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে। অভীক এবং বিজয় কিছুটা সাহসী হয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু সায়নী তাদের হাত ধরে থামায়। গুহার ভেতরের অন্ধকার, তান্ত্রিকের অদ্ভুত উপস্থিতি, রক্তমাখা পাত্র এবং কঙ্কাল—সব মিলিয়ে এক অশুভ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বাতাসে ভেসে আসা অদ্ভুত গন্ধ এবং মন্ত্রপাঠের আওয়াজ তাদের মনকে অচেতনভাবে কেঁপে দেয়। এই মুহূর্তে তারা বুঝতে পারে, তাদের ভয় কেবল কল্পনার নয়, বাস্তবেই এখানে অশুভ শক্তি জেগে উঠেছে। পাঠক এই অধ্যায়ে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে, যে পাহাড়ের অন্ধকার, তান্ত্রিকের উপস্থিতি এবং অজানা শক্তির মিলন তাদেরকে এক অদ্ভুত এবং ভয়ানক অভিজ্ঞতার মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সাহস, কৌতূহল এবং বন্ধুত্বই তাদের একমাত্র আশ্রয়।
পাঁচ
তান্ত্রিকের গলা থেকে এক অদ্ভুত শব্দ বের হতে থাকে, যা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে ভিন্নরকম কম্পন ছড়িয়ে দেয়। তার চোখ লাল হয়ে ওঠে, যেন ভিতরের অশুভ শক্তি প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। প্রত্যেক শব্দ যেন পাহাড়ের প্রতিটি কোণকে কেঁপে দিচ্ছে, আর বন্ধুরা একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। অভীক, বিজয়, পূর্ণিমা, মেহুল, এবং সায়নী—সবার মনে ভয় এবং উত্তেজনা মিলিত হয়ে অদ্ভুত এক সংবেদন তৈরি করে। তারা প্রথমে মনে করে, হয়তো তান্ত্রিক নাটক করছে, কিন্তু চোখের সেই উজ্জ্বল লাল আলো এবং বাতাসে বেড়ানো শক্তির অনুভূতি তাদের মিথ্যা ভেবেও শিউরে উঠতে বাধ্য করে। পাহাড়ের অন্ধকার যেন আরও গভীর হয়ে যায়, আর মশালের আলোর কম্পন হারিয়ে যায়, যা তাদের চারপাশের দৃশ্যকে আরও রহস্যময় করে তোলে।
হঠাৎই, বাতাস কেঁপে ওঠে, গাছপালার ছায়া অদ্ভুতভাবে নাচতে শুরু করে, এবং মশালগুলো নিজেরাই নিভে যায়। তারা এক মুহূর্তের জন্য সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢাকা পড়ে। কালো ধোঁয়া চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, যা চোখে দৃশ্যমান না হলেও মনকে আতঙ্কিত করে। বন্ধুরা একে অপরের দিকে তাকায়, হাসাহাসি এবং মজা এক মুহূর্তের মধ্যে ভয়ঙ্কর সাড়া দিয়ে যায়। পূর্ণিমা হঠাৎ চিৎকার করে, আর সায়নী শক্তভাবে বন্ধুর হাত ধরে দাঁড়ায়। অভীক চেষ্টা করে ধৈর্য ধরে থাকার, কিন্তু তার কণ্ঠেও কম্পন থাকে। বিজয় সাহস দেখাতে চায়, কিন্তু তার চোখে ভয় প্রকাশ পায়। তান্ত্রিকের মন্ত্রপাঠের প্রতিটি শব্দ যেন বন্ধুরা অনুভব করতে পারে, তাদের মনে গভীর আতঙ্ক এবং অবিশ্বাসের সংমিশ্রণ তৈরি করে।
শেষপর্যায়ে, বন্ধুরা বুঝতে পারে, তারা এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে কেবল কৌতূহল বা সাহসই যথেষ্ট নয়। বাতাসের কাঁপন, ধোঁয়া, নিভে যাওয়া মশাল, এবং তান্ত্রিকের লাল চোখ—সব মিলিয়ে একটি অশুভ শক্তি তাদের চারপাশে ঘিরে ফেলে। তাদের হাসি-ঠাট্টা এখন বিলীন হয়ে গেছে, ভয় তাদের দমনে নেমেছে। সায়নী স্পষ্টভাবে অনুভব করে যে এখানে কোনো অশুভ শক্তি কাজ করছে, যা তাদেরকে স্বাভাবিক জীবন থেকে দূরে টেনে নিয়ে গেছে।
ছয়
ধোঁয়ার মধ্য থেকে হঠাৎই একটি অদ্ভুত কালো আভা জন্ম নেয়। এটি কোনো জীবন্ত সত্তার মতো নয়, কিন্তু তার উপস্থিতি এতটাই প্রখর যে চারপাশের বাতাসে একটি অদ্ভুত চাপ সৃষ্টি করে। বন্ধুরা প্রথমে একে উপেক্ষা করার চেষ্টা করে, মনে করে হয়তো চোখের ভ্রান্তি বা ধোঁয়ার খেলা। কিন্তু কালো আভা কেবল স্থির থাকে না; এটি ধীরে ধীরে তাদের চারপাশে প্রসারিত হয়, আর কণ্ঠ ছাড়াই ফিসফিস করে শব্দ, “একজনের প্রাণ চাই, তাহলেই বাকিরা বাঁচবে।” শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধুরা স্থবির হয়ে যায়। অভীক, যে এতক্ষণ সাহস দেখাতে চেষ্টা করছিল, তার শরীর কেঁপে ওঠে। বিজয় কিছু বলতে চায়, কিন্তু শব্দ গলায় আটকে যায়। সায়নী বুঝতে পারে, যে এটি কোনো সাধারণ ভূত বা তান্ত্রিকের খেলা নয়; এখানে একটি বাস্তব, অশুভ শক্তি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বাতাসের ফিসফিস, কালো আভার নড়াচড়া, এবং অন্ধকারের চাপ—সব মিলিয়ে তাদের মনে এক অনির্বচনীয় আতঙ্ক তৈরি করে।
পূর্ণিমার মন ভেঙে যায়। সে হঠাৎ কেঁদে ফেলে, তার কান্না রাতের অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হয়। মেহুল বারবার বলে, “আমরা ফিরে যাই, দয়া করে। ফিরে যাই।” কিন্তু পাহাড়ের অন্ধকার এবং কালো আভার উপস্থিতি তাদের চলা বন্ধ করে দেয়। অভীক চেষ্টা করে তার বন্ধুরা একত্রে সাহস দেখাবে, কিন্তু তার নিজের মনও অশান্ত। বিজয়ও অভীককে চুপ করে সাহায্য করতে চেষ্টা করে, কিন্তু নিজের ভয় তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে দেয় না। সায়নী শান্ত থাকার চেষ্টা করে, তবে তার চোখে আতঙ্কের ছায়া স্পষ্ট। কালো আভা ধীরে ধীরে তাদের চারপাশে ঘুরতে থাকে, যেন তাদের ভয়কে আরও গভীর করে। বাতাসে ভেসে আসা শব্দ এবং ধোঁয়ার অদ্ভুত ঘনত্ব তাদের বাস্তবতা এবং কল্পনার মধ্যে বিভ্রান্ত করে, এমন এক অবস্থায় যেখানে প্রত্যেকটা পদক্ষেপকে ভয় অনির্ধারিত করে তোলে।
শেষপর্যায়ে বন্ধুরা একে অপরের হাত ধরে দাঁড়ায়, কিন্তু তাদের ভয় তাদেরকে শীতল আতঙ্কে আটকে দেয়। কালো আভার ফিসফিস এবং অশুভ উপস্থিতি স্পষ্টভাবে বোঝাচ্ছে যে, এখানে কোনো প্রতারণা নেই—এই শক্তি বাস্তব এবং মারাত্মক। তারা বুঝতে পারে যে, কেবল সাহস এবং বন্ধুত্বই তাদের রক্ষা করতে পারে, কিন্তু সেটাও যথেষ্ট নাও হতে পারে। পূর্ণিমা কাঁদতে থাকে, মেহুল বারবার পুনরায় ফিরে যাওয়ার প্রার্থনা করে, আর অভীক এবং সায়নী একে অপরকে সাহস দেখানোর চেষ্টা করে।
সাত
কালো আভার ধোঁয়া এবং অশুভ শক্তির আবহের মধ্যে বন্ধুরা ধীরে ধীরে মানসিক চাপের মুখোমুখি হয়। প্রত্যেকের চোখে ভয়, হৃদয়ে অশান্তি, আর হাতের কাছে কোনো নিরাপত্তার ছায়া নেই। হঠাৎ বিজয় বলতে শুরু করে, “যে এই যাত্রার পরিকল্পনা করেছে, তাকেই বলি দেওয়া হোক। অন্যরা বাঁচুক।” এই কথা শুনে সবাইকে চুপচাপ হতবাক হয়ে যায়। অভীক, যে এতক্ষণ সাহস দেখাতে চেষ্টা করছে, সে বুঝতে পারে যে বন্ধুরা তার ওপর দোষ চাপাতে শুরু করেছে। তার গলার শব্দ বন্ধ হয়ে আসে, চোখের সামনে অন্ধকার আরও গভীর হয়ে ওঠে। সে নিজেকে বোঝাতে চায়, “সবই তো শুধু মজা করার পরিকল্পনা ছিল।” কিন্তু পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
সায়নী অভীকের পক্ষে দাঁড়ায়। সে বলে, “এটা শুধুই অভীকের পরিকল্পনা, কিন্তু আমরা সবাই একসাথে এখানে এসেছি। একে দোষ দেওয়া ঠিক নয়।” তবে তার নিজের ভয় তাকে দ্বিধায় ফেলে। সে বুঝতে পারে, যে এই অশুভ শক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুধু সাহস দেখানোই যথেষ্ট নয়; বাঁচার জন্য যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়াও প্রয়োজন। সায়নী নিজের ভিতরের ভয় এবং বন্ধুত্বের দায়বোধের মধ্যে লড়াই করে। সে অভীককে শান্ত রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু একই সঙ্গে নিজের মনকে বিশ্বাস করতে পারছে না যে তারা নিরাপদে ফিরতে পারবে।
মেহুল পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। সে চাইছে বন্ধুদের ছেড়ে চলে না যেতে, কিন্তু বাঁচার লোভ এবং আতঙ্কে চুপ থাকে। সে অভীকের দিকে তাকায়, সায়নীকে দেখে, কিন্তু কোনো শব্দ বলতে পারে না। তার দৃষ্টি বন্ধুরা একে অপরের দিকে তাকানো অবস্থায় মিলিত হয়, যেন প্রত্যেকে নিজের ভয়কে অন্যের উপর চাপাচ্ছে। পূর্ণিমা কাঁদতে থাকে, তার কান্না বাতাসে ভেসে যায়, আর বন্ধুরা তার কষ্ট অনুভব করতে পারে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্বের বন্ধন দুর্বল হয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ অশুভ শক্তি যেন তাদের মনকে আরও বিভ্রান্ত করে, এবং তারা একে অপরের মধ্যে বিশ্বাস হারাতে থাকে।
শেষপর্যায়ে, অভীক, সায়নী, বিজয়, মেহুল এবং পূর্ণিমা—সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে থাকলেও একে অপরের ওপর সন্দেহ এবং ভয় কাজ করছে। বিজয়ের সিদ্ধান্ত তাদের বন্ধুত্বকে শিথিল করে, এবং প্রত্যেকের ভেতরে এক অদৃশ্য দ্বন্দ্ব তৈরি হয়—ভয় বনাম সাহস, বন্ধুত্ব বনাম বাঁচার লোভ। এই অধ্যায়ে পাঠক স্পষ্টভাবে দেখতে পায়, যে অমাবস্যার রাত, অন্ধকারের ধোঁয়া, এবং অশুভ শক্তি কেবল বাহ্যিক নয়; তারা বন্ধুত্ব, বিশ্বাস এবং মানসিক শক্তিকেও পরীক্ষা করছে।
আট
পাহাড়ের গুহার অন্ধকার আরও গভীর হয়ে আসে। তান্ত্রিক ক্রমশ তার মন্ত্রোচ্চারণ বাড়িয়ে দেয়, আর ধোঁয়া ঘন হতে থাকে। বাতাস কেঁপে ওঠে, মশালগুলোর আলো ধীরে ধীরে নিভে যায়, আর চারপাশে কেবল কালো ছায়ামূর্তি ঘিরে ধরে। বন্ধুরা একে অপরের দিকে তাকায়, চোখে আতঙ্কের প্রতিফলন স্পষ্ট। তাদের মন ভয় এবং হতাশায় ভরে ওঠে, কারণ এই মুহূর্তে তারা বুঝতে পারে, যে খেলাধুলা আর গল্প নয়—এখানে প্রকৃত অশুভ শক্তি কাজ করছে। অভীক সাহস দেখানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তার ভয় তাকে প্রায় নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসেছে। বিজয় চিৎকার করতে চায়, কিন্তু শব্দ গলায় আটকে যায়। সায়নী এবং মেহুল একে অপরের হাত ধরে দাঁড়ায়, তাদের হৃদপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুত এবং অপ্রতিসাম।
হঠাৎ, পূর্ণিমার গায়ে অদৃশ্য আঁচড় পড়ে। সে চিৎকার করতে থাকে, আর তার চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে রক্ত ঝরে। বন্ধুরা হঠাৎ রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে, যে অশুভ শক্তি কেবল ভয় দেখাচ্ছে না, বাস্তবে তাদের জীবনকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। মাটিতে পড়া রক্ত, অদৃশ্য আঁচড়, আর ধোঁয়ার মধ্যে ছায়ামূর্তিগুলোর নাচ—সব মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর চিত্র তৈরি করে। অভীক অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে পড়ে যায়—সাহস দেখানো কি বাঁচার চেষ্টা করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, নাকি রক্ষার জন্য প্রতিক্রিয়া নেওয়া উচিত? বিজয় আতঙ্কিত, সায়নী নিজের ভয়কে কাবু করতে চায়, আর মেহুল চুপচাপ ভয়ে জমে থাকে, যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে।
শেষপর্যায়ে, বন্ধুরা একবারে বুঝতে পারে, এই রাতের অন্ধকারে, এই অশুভ শক্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে তাদের মধ্যে কাউকে ত্যাগ করতে হবে। কেউ না মরলে, কেউ না আত্মসমর্পণ করলে এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি নেই। বন্ধুত্ব, সাহস এবং কৌতূহল—এবার আর কোনো কাজে আসে না; শুধুমাত্র বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানোই তাদের একমাত্র সম্ভাবনা। পাঠক স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে যে, পাহাড়ের অন্ধকার, তান্ত্রিকের মন্ত্র, কালো আভা এবং রক্তের আহ্বান—সব মিলিয়ে বন্ধুরা এমন এক চরম পরিস্থিতির মুখোমুখি, যেখানে তাদের একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, সাহস এবং বেঁচে থাকার ইচ্ছা চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা হচ্ছে।
নয়
পাহাড়ের গুহার অন্ধকার ক্রমশ তাদের চারপাশে চাপিয়ে আসে। ধোঁয়া ঘন, বাতাস কেঁপে ওঠে, আর তান্ত্রিক ক্রমশ আরও জোরে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। বন্ধুরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে, নিজের ভয়ের সঙ্গে লড়ছে, এবং জানে যে অশুভ শক্তি শুধু হুমকি নয়, বাস্তব বিপদ। চরম মুহূর্তে অভীক সিদ্ধান্ত নেয়—সে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে যাতে বাকি বন্ধুরা বাঁচতে পারে। তার মন স্থির, হৃদয় সাহসী, এবং সে ধীরে ধীরে অশুভ শক্তির দিকে এগিয়ে যায়। তার চোখে এক অদ্ভুত শান্তি এবং দৃঢ়তা, যা বন্ধুরা আগেও দেখেনি। সে জানে, এই আত্মত্যাগই একমাত্র উপায় তাদের সবার জীবন রক্ষার। সে ধীরে ধীরে কণ্ঠস্বরহীন প্রার্থনা করে, যেন তার সাহস অশুভ শক্তির সামনে জ্বলে উঠুক।
কিন্তু ঠিক তখনই, বিজয় হঠাৎ ধাক্কা মারে এবং অভীককে সামনে ঠেলে দেয়। অভীক স্তব্ধ হয়ে যায়, তার চোখে বিস্ময় এবং হতাশার ছাপ স্পষ্ট। সায়নী চিৎকার করে ওঠে, তার ভয় এবং বিভ্রান্তি একসাথে মিশে। বিজয়ের আচরণ তাদের বন্ধুত্বের ওপর প্রশ্ন তুলে দেয়—সে কি সত্যিই বাঁচতে চায় নাকি ভয়ের কারণে প্রতারণা করেছে? কালো শক্তি সঙ্গে সঙ্গে অভীর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যেন সে এই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে। পুরো গুহা যেন এক মুহূর্তে স্থবির হয়ে যায়, বাতাসে কেবল অশুভ নিঃশ্বাস এবং ছায়ামূর্তির নড়াচড়া অনুভূত হয়। বন্ধুরা বুঝতে পারে, যে তাদের মধ্যে দ্বিধা, ভয়, এবং প্রতারণার ছায়া অশুভ শক্তির শক্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
হঠাৎ মেহুল আত্মসমর্পণ না করে এগিয়ে আসে। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে অভীককে ঢেকে রাখে, যেন নিজেকে বলি দেওয়ার মাধ্যমে বন্ধুকে রক্ষা করছে। কালো শক্তি সঙ্গে সঙ্গে মেহুলের দিকে আঘাত হানতে চায়, আর মেহুল শেষ পর্যন্ত বলি হয়। তার আত্মত্যাগ বন্ধুরা দেখেছে, এবং অভীক ও সায়নীকে গভীর শোক এবং আতঙ্কে আবদ্ধ করে। এই মুহূর্তে বন্ধুরা বুঝতে পারে, যে সাহস, বন্ধুত্ব এবং আত্মত্যাগ—সবই চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা হচ্ছে।
দশ
অমাবস্যার রাতের আতঙ্ক শেষে, ধীরে ধীরে ভোরের আলো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। পাহাড়ের অন্ধকার এবং কালো ধোঁয়া ম্লান হয়ে আসে, আর গুহার ভেতরের অশুভ শক্তি অদৃশ্য হয়ে যায়। তান্ত্রিকের মন্ত্রোচ্চারণও থমকে যায়, যেন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে। চারপাশে নীরবতা এসে ভোরের শীতল হাওয়ার সঙ্গে মিলিত হয়, আর বন্ধুরা সেই অন্ধকার এবং আতঙ্কের অভিজ্ঞতা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। অভীক, সায়নী, বিজয় এবং পূর্ণিমা এখন পাহাড়ের গুহা থেকে নামছে, তাদের হৃদয় এখনও কেঁপে ওঠে, মন অতীত রাতের ভয়ঙ্কর স্মৃতিতে বন্দী। প্রত্যেকটি পায়ের ধাপ যেন তাদের মনে অমাবস্যার রাতের প্রতিধ্বনি নিয়ে আসে—মশালের নিভে যাওয়া আলো, ধোঁয়ার মধ্যে দেখা কালো আভা, তান্ত্রিকের লাল চোখ, এবং মেহুলের আত্মত্যাগের দৃশ্য। তাদের মধ্যে কেউই উচ্চস্বরে কথা বলতে পারে না, শুধু চুপচাপ একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে, চোখে মিশ্র অনুভূতি—শোক, ভয়, এবং অজানা প্রশান্তি।
পাহাড়ের পাথুরে পথ ধরে তারা নেমে আসছে, আর চারপাশের প্রকৃতি যেন শান্ত হয়ে গেছে। পাখির কণ্ঠ এবং দূরের হাওয়ার ফিসফিস তাদের মনকে সামান্য শান্তি দিচ্ছে। কিন্তু মনে অদ্ভুত ভার অনুভূত হচ্ছে—মেহুল আর তাদের সঙ্গে নেই। তার আত্মত্যাগের স্মৃতি প্রত্যেকের মনে গভীর ছাপ ফেলে। অভীক নিজেকে দোষারোপ করার চেষ্টা করে, যদিও সায়নী তাকে ধীরভাবে থামিয়ে দিয়ে বোঝায়, “এটা আমাদের মধ্যে নয়, এটি ওই অশুভ শক্তির খেলা।” বিজয় এবং পূর্ণিমা চুপচাপ হাঁটছে, কিন্তু মনে থাকে সেই ভয়ঙ্কর চরম মুহূর্তের স্মৃতি, যখন মৃত্যুর ছায়া তাদের চারপাশে ঘিরে রেখেছিল। ভোরের আলো আসলেও, রাতের অভিজ্ঞতা তাদের হৃদয় এবং মনে চিরস্থায়ীভাবে লিপ্ত হয়ে আছে।
গ্রামে ফিরে, তারা সবাই নীরব থাকে। পরিবার ও গ্রামের সাধারণ জীবন যেন তাদের জন্য অন্য এক জগৎ, যেখানে সেই রাতের আতঙ্ক, ভয় এবং বন্ধুত্বের পরীক্ষা অদৃশ্য হয়ে গেছে। তবে প্রত্যেকে জানে, যে বন্ধুত্ব, ভয়, এবং মৃত্যুর সীমারেখা তারা চিরদিনের জন্য পার হয়ে এসেছে। অভীক, সায়নী, বিজয় এবং পূর্ণিমা প্রত্যেকেই অন্তরের গভীরে মেহুলের আত্মত্যাগকে স্মরণ করছে, যা তাদের মানসিক এবং আত্মিকভাবে পরিবর্তিত করেছে। তারা বুঝতে পারে, যে সাহস, বন্ধুত্ব, আত্মত্যাগ এবং অশুভ শক্তির মোকাবিলা—এই অভিজ্ঞতা তাদের জীবনের অংশ হয়ে থাকবে চিরকাল। ভোরের আলো যেমন অন্ধকারকে দূর করে, তেমনি তাদের মনে সেই রাতের শিক্ষা, স্মৃতি এবং অম্লান ভয় এক অদৃশ্য ছাপ ফেলে, যা কখনো ম্লান হবে না।
শেষ




