Bangla - তন্ত্র

অমাবস্যার পঞ্চতত্ত্ব

Spread the love

অভ্র মিত্র


অধ্যায় ১: অমাবস্যার আগে

শ্যামনগর—পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এক নিঃস্তব্ধ গ্রাম, যেখানে রাত নামে আগেভাগেই আর কুকুর ডাকে না। চারদিকে যেন অদৃশ্য কিছু চেপে বসে, হাওয়া নিঃশব্দ হয়, আর মাটির ঘরের জানালার কাঁচে প্রতিফলিত হয় না কোনও আলো। অমাবস্যা ঘনিয়ে এলে গ্রামের জীবন থমকে যায়, শিশুদের মুখে হাঁসি থাকে না, আর মায়েরা বাচ্চাদের চোখে কাজল পরে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, যেন অজানা কিছু চোখে না পড়ে। শতবর্ষ আগের কথা, এক চণ্ডীপাঠের মঞ্চে নাকি অদ্ভুত এক যজ্ঞ হয়েছিল, যেখান থেকে এক আগুন উঠে পুরো মন্দির গ্রাস করে নেয়। তখন থেকেই চণ্ডীমণ্ডপ ধ্বংসপ্রাপ্ত, আর ওই দিনটিকেই অনেকে গ্রাম ইতিহাসের বিভীষিকা বলে চিহ্নিত করে। সময় এগিয়ে চললেও, শ্যামনগরের ইতিহাস বদলায়নি, বরং মানুষের বিশ্বাস গভীর হয়েছে যে, গ্রামটার নিচে কিছু চাপা পড়ে আছে—কিছু যা একদিন আবার জাগবে। এবার সেই অমাবস্যা সামনে আসতেই গ্রামের মোড়ল খগেন হাজরা এক অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করলেন—গ্রামের মাঝখানে প্রাচীন বটগাছের গায়ে আঁকা পাঁচটি রহস্যময় চিহ্ন, প্রতিটি একেকটি উপাদানের প্রতীক: মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ। তিনি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারেন, পুরনো কিছু আবার ফিরে আসছে, হয়তো সেই নিষিদ্ধ যজ্ঞের চক্রটি আবার ঘুরছে।

এরপর থেকেই শ্যামনগরে একের পর এক অচেনা মানুষ ঢুকতে থাকে। প্রথমজন ছিলেন ভূমিকা, এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি, যার গায়ের ধুলো ও কাঁধের থলি দেখে বোঝা যায়—সে কোনো সাধু নয়, বরং মাটি নিয়ে কাজ করে এমন কেউ, হয়তো মৃত্তিকা-জ্ঞ। সে গ্রামের এক প্রান্তে ধ্বংসপ্রাপ্ত পোড়া বাড়িটিকে নিজের ঘর বানায় এবং দিনের বেলায় মাটির গায়ে কান পেতে শোনে—যেন মাটি কিছু বলছে তাকে। এরপর আসে জলেশ্বরী, এক রহস্যময় নারী, যার চোখ কাঁপছে জলের মতো, অথচ তার শরীরে কোনও জলের ছোঁয়া নেই, সে যেন জলের ছায়া। সে পুকুরঘাটে বসে থাকে, হাত ডুবিয়ে রাখে জলে, আর গ্রামের মেয়েরা বলে—ওর ছায়া দেখা যায় না! তৃতীয় ব্যক্তি বাতাসচরণ, আসেন এক ঝড়ের রাতে; তার চলাফেরা এতটা হালকা যে মনে হয় সে হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে। তার গলা থেকে আসে অদ্ভুত শব্দ—না ঠিক কথা, না ঠিক সুর, বরং হাওয়ার ভাষা। এরপর আসে অগ্নিদেব, যাঁর চোখে আগুন, কণ্ঠে উচ্চারণহীন মন্ত্র, এবং পা রাখেন চণ্ডীমণ্ডপের ধ্বংসাবশেষে। তিনি সেখানে রাতভর আগুন জ্বালিয়ে বসে থাকেন, আর ভোরবেলা দেখা যায় মন্দিরের গায়ে নতুন দাগ—যেন আগুন কিছু লিখে রেখে গেছে। পঞ্চম ব্যক্তি তখনো আসেননি, কিন্তু তার উপস্থিতি সবাই টের পাচ্ছে—গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে আছে, পুকুরের জল এক অদ্ভুত নীল রঙ নিয়েছে, আর মৃত খেতমজুরদের কবরের মাটি উঠে আসছে নিজে থেকেই।

এরই মধ্যে গ্রামের সবচেয়ে সাধারণ, কিন্তু অদ্ভুত শিশু বুদ্দু, রাতের পর রাত স্বপ্নে দেখতে থাকে এক মুখ—না ছেলে, না মেয়ে—যে বলছে, “তুই আসবি না? আমাদের সময় হয়ে গেছে।” বুদ্দুর মা প্রথমে ভয় পেয়ে পুরোহিত ডাকে, কিন্তু পুরোহিত নিজেই কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠেন—“এই ছেলের চোখে আগুনও পড়ে না, জলও শুকায় না, এ ঠিক সাধারণ নয়।” গ্রামের প্রবীণ নারীরা খেয়াল করে, বুদ্দুর জন্ম হয়েছিল এক ঝড়জলঘেরা অমাবস্যার রাতে, আর তার শরীরে জন্মদাগ রয়েছে পঞ্চভূতের প্রতীক নিয়ে। এক ভোরে বুদ্দু উঠে বলে, “আজ ওরা আমার নাম জানবে,” আর সেই দিনই গ্রামের আকাশ কালো হতে হতে এক বিন্দু আলো ছাড়াই ঢেকে যায়। পঞ্চতত্ত্বের আগন্তুকেরা তখন চণ্ডীমণ্ডপে একে একে জড়ো হতে শুরু করে—তাদের চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি, যেন অপেক্ষা শেষ। সেই মুহূর্তে গ্রামের প্রান্তে এক পাগল বৃদ্ধ, যিনি দীর্ঘদিন ধরে কথা বলেন না, হঠাৎ বলে ওঠেন—“ষষ্ঠ জন এলেই যজ্ঞ শুরু হবে… আর শ্যামনগর আর কখনো আগের মতো থাকবে না।” অমাবস্যা এখন আর শুধু এক রাত নয়—এ এক চূড়ান্ত পরীক্ষার ক্ষণ, যখন ইতিহাস, বিশ্বাস আর প্রকৃতি মিলে তৈরী করবে এক অচেনা ভবিষ্যৎ।

অধ্যায় ২: ভূমির স্পর্শ

শ্যামনগরের মাটি যেন ওই দিন থেকেই অন্য রকম আচরণ করতে শুরু করে, যেদিন প্রথম আগন্তুক হিসেবে গ্রামের প্রান্তে পা রাখেন একজন নীরব মানুষ—ভূমিকা। কেউ তার আসার খবর জানতো না, কেউ ডাকেনি তাকে, অথচ ঠিক দুপুরের প্রখর রোদে হঠাৎ তাকে দেখা যায় পোড়া বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে হেঁটে আসতে। গায়ে ধুলোমলিন ধুতি, কাঁধে এক পুরনো কাপড়ে মোড়া থলি, মুখে কোনো কথা নেই—শুধু চোখে স্থিরতা, আর হাতে এক মুঠো শুকনো মাটি। গ্রামের কৌতূহলী যুবকরা দূর থেকে তাকায়, কিন্তু কেউ সাহস করে সামনে আসে না। ভূমিকা মাটিতে বসে পড়েন, দু’হাতের তালু দিয়ে গুঁড়ো মাটি ঘষে, তারপর গাল ছুঁয়ে বলেন, “এখানে কান্না চাপা আছে… শোকে ভেজা স্তব্ধতা।” তার কথাগুলো শুনে গ্রামের গৃহস্থ নারীরা দরজার আড়াল থেকে তাকিয়ে থাকেন, কারণ ভূমিকা যেদিকে তাকান, সেদিকের গাছপালায় পাতাও নড়ে না, যেন প্রকৃতি শ্বাস রোধ করে আছে তার সামনে।

সন্ধ্যের আগে ভূমিকা আশ্রয় নেন গ্রামের পুরনো পোড়া বাড়িটিতে, যেটি একসময় ছিল জমিদারের কাচারিঘর। বাড়িটি বহুদিন পরিত্যক্ত, জঞ্জাল জমে থাকা, কিন্তু ভূমিকা তাতে ঢুকে পড়ে ঘরটিকে মাটি দিয়ে গেড়ে বসেন, ঠিক যেন শিকড় গাড়ছেন। তিন দিন পর দেখা যায়, বাড়ির ভাঙা দেয়ালে টিকটিকি কিংবা ব্যাঙ নেই, বরং উঠোনে অদ্ভুত গাছ জন্মেছে, যার পাতা রক্তজবার মতো লালচে। কেউ জানে না তিনি ঘুমান কি না, কারণ রাতে তার ঘর থেকে অতি মৃদু শব্দ শোনা যায়—মাটির নিচে ঘষাঘষির মতো কিছু। চতুর্থ দিনে গ্রামের পুরনো কবরস্থান এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় ভূমিকা থেমে দাঁড়ান, মাটির উপরে হাত রাখেন, এবং বলেন, “একটা অনাঘ্রাত দেহ এখানেই চাপা পড়ে আছে… শিশু বয়সেই বলি দেওয়া হয়েছিল। মাটি আজও গিলে নিতে পারেনি।” এই কথা শুনে অনেকে হাসে, কেউ ভয় পায়, কিন্তু গ্রামের বৃদ্ধ পণ্ডিত বলরাম চট্টোপাধ্যায় নীরবে মাথা নিচু করেন, কারণ তিনিই জানেন এক শতাব্দী আগে চণ্ডীমণ্ডপে তন্ত্রসিদ্ধির জন্য একটি বালকের বলির কথা।

তারপর থেকে গ্রামের কিছু খেতমজুর লক্ষ্য করে, তাদের জমির মাটি নরম হয়ে গেছে, আর চাষের সময় হাত গেলে ওঠে প্রাচীন মৃৎপাত্র, পুড়ন্ত ছাই কিংবা অজানা ধাতুর টুকরো। ভূমিকা কারো সঙ্গে কথা বলেন না, তবে মাঝে মাঝে একটি ছোট ছেলে—বুদ্দু—তার কাছে আসে, আর ভূমিকা তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে, “তুই কি জানিস, তোর পায়ের নিচে কী আছে?” বুদ্দু ভয় না পেয়ে মাথা নাড়ে—“ওরা ডাকে… আমি শুইলে দেখি।” এরপর ভূমিকা নিজ হাতে মাটি খুঁড়ে বার করে আনেন এক কালো পাথর, যার গায়ে রয়েছে ত্রিভুজের মধ্যে একটি চোখ আঁকা—গ্রামে এমন চিহ্ন আগে কেউ দেখেনি। সেই রাতেই ভূমিকার ঘরের চারপাশে শুরু হয় কাঁপুনি, যেন মাটি নিশ্বাস নিচ্ছে। সেই সময় গ্রামের আকাশে তারা থাকে না, শুধু এক ধরনের কম্পন অনুভূত হয়, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু শরীর জানে। এরপর ভূমিকা তার চারপাশে মাটি দিয়ে একটি গোলবৃত্ত আঁকেন, যার মাঝখানে বুদ্ধুকে বসিয়ে বলেন, “তুই জানিস না, তুইই গোপন বীজ… এই যজ্ঞের শিকড়।” আর সেই প্রথমবার গ্রামের মাটির নীচ থেকে ভেসে আসে একটি দীর্ঘশ্বাস, যেন অতীত নিজেই জেগে উঠেছে।

অধ্যায় ৩: জলের ঢেউ

জলেশ্বরীর আগমন হয় এক নিঃশব্দ সন্ধ্যায়, যখন গ্রামের আকাশে ঝরার পূর্বাভাস নেই অথচ বাতাসে ভেজা গন্ধ ঘুরতে শুরু করেছে। পুকুরপাড়ের পাশে হঠাৎ দেখা যায় তাকে—নীলাভ শাড়িতে মোড়া এক রহস্যময়ী নারী, যার চুল ভেজা, অথচ চারপাশে কোথাও বৃষ্টি হয়নি। তার চোখ যেন কাঁপছে তরল অশ্রুজলে, এবং তাকানোর মধ্যে এমন এক গভীরতা যে কারো চোখ আটকে গেলে সহজে ছাড়া পায় না। গ্রামের বউঝিরা যখন পুকুরে কলসি নিয়ে নামছিল, তখনই প্রথম লক্ষ্য করে জলেশ্বরীকে—সে বসে আছে পুকুরের সিঁড়িতে, এক হাতে জলে হাত ঘুরিয়ে বৃত্ত আঁকছে। তার ছায়া জলে পড়ে না, পা ছোঁয়ায় না জলে স্পন্দন, অথচ পুকুরের মাঝখানে জলের ঢেউ অকারণে ঘূর্ণি বাঁধছে। গ্রামের এক বয়স্ক মহিলা বলল, “এই মেয়েটাকে আমি যেন দেখেছি অনেক বছর আগে… একবার, যখন বন্যায় গ্রামের গলি গলি প্লাবিত হয়েছিল।” অন্যরা সন্দেহে কপালে ভাঁজ ফেলে, কারণ সে কথা ছিল পঁচিশ বছর আগের, যখন ওই মহিলা নিজেই ছিল কিশোরী।

জলেশ্বরী কথা বলেন না, কিন্তু তার উপস্থিতি এক ধরনের টান তৈরি করে—বিশেষ করে নারীদের মনে। কয়েকজন গৃহবধূ নিজের অজান্তেই তার দিকে হাঁটতে শুরু করে, কেউ কেউ চোখে জল নিয়ে ফেরে, আর রাতে তাদের ঘুমের মাঝে শোনা যায় অজানা গান—যেন ঢেউয়ের তালে তালে একটি কণ্ঠ কাঁদছে। জলেশ্বরীর আশেপাশে শিশুদের দুধ মুখ শুকিয়ে যায়, কিন্তু তারা কান্না করে না, বরং স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকেই। বুদ্দু, গ্রামের সেই স্বপ্নদর্শী শিশু, একদিন রাতে গিয়ে দাঁড়ায় জলেশ্বরীর সামনে, আর হঠাৎ বলে ওঠে, “তুমি নদীর মেয়ে? মা বলে নদীর নিচে ঘুমায় অনেকে, যারা ফিরে আসে না।” জলেশ্বরী তখন প্রথমবার তার দিকে তাকিয়ে অতি মৃদু হাসেন, এবং বুদ্দুর কপালে একটি আঙুল ছুঁয়ে দেন—পরদিন সকালে দেখা যায়, বুদ্দু তার বিছানায় অঙ্কন করেছে জলভরা এক পদ্ম, যার মধ্যখানে পঞ্চতল চক্র।

তাঁর আগমনের সপ্তাহখানেক পরেই ঘটে অদ্ভুত ঘটনা—পুকুরের জল একরাত্রে ঘন নীল হয়ে ওঠে, এবং ভোরবেলা দেখা যায়, সব মাছ একসাথে ঘুরছে নিরব বৃত্তে। পুকুরপাড়ের পাথরের ঘাটে জল ছুঁয়ে ওঠে এক শীতলতা, যা গ্রীষ্মের মধ্যেও হাড়ে কাঁপন ধরায়। এক বিধবা মহিলা, যিনি বহু বছর পুকুরঘাটে আসেন না, হঠাৎ জলেশ্বরীর পাশে এসে বসে বলেন, “আমি ভুলে গেছি কাঁদতে, তুমি আমায় মনে করিয়ে দিলে।” জলেশ্বরী কোনো উত্তর না দিয়ে তার কাঁধে জলভেজা হাত রাখেন, আর সেই মহিলার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে এমন একটি নাম—যা এই গ্রামে বহু বছর উচ্চারিত হয়নি, কারণ সেই নামের মেয়েটি এক বৃষ্টির রাতে পুকুরে ডুবে গিয়েছিল, কিন্তু দেহ পাওয়া যায়নি। গ্রামের পুরুষেরা তখন ভয় পেতে শুরু করে, কারণ তারা অনুভব করে, জলেশ্বরীর আগমন শুধু জলের প্রতিনিধিত্ব নয়, বরং জলেই লুকিয়ে থাকা ইতিহাসকে তুলে আনার আয়োজন। চণ্ডীমণ্ডপের পেছনের ছোট্ট কুয়োটি, যেটিকে ‘শুকনো’ বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল বহু বছর, হঠাৎ এক রাতে কানায় কানায় জলভর্তি হয়ে ওঠে। এবং সেই জলের তলায় দেখা যায়—একটা অর্ধেক ডোবা মুখ, চোখ খুলে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আর তখনই, সেই গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় শোনা যায় জলেশ্বরীর স্বর—“মুক্তি আসবে, কিন্তু প্রথমে ভেজাতে হবে তারা যারা শুকিয়ে গেছে।”

অধ্যায় ৪: আকাশের প্রতীক

অমাবস্যার রাতটা যেন আজ আরও ঘনিয়ে উঠেছে, শাসপুরের আকাশে কোনো চাঁদের রেখাও নেই, যেন সমস্ত দিগন্ত ঢেকে আছে অদৃশ্য এক অন্ধকারে। সেই অন্ধকারের বুক চিরে, গ্রামের বাইরে ধানের খেতের ধার ধরে একটি ধূসর পোশাক পরা বৃদ্ধ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। মাথার উপরে হাত দুটো জোড় করে সে যেন কিছু বহন করছে—একটি ধাতব মণ্ডল যার গায়ে খোদাই করা জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক চিহ্ন, একপ্রকার প্রাচীন তান্ত্রিক যন্ত্র, যাকে বলা হয় ‘আকাশবিন্দু’। তার চোখদুটো অস্বাভাবিকভাবে স্থির, যেন সে কোনো দিকেই তাকাচ্ছে না—তবু সব কিছুই দেখতে পাচ্ছে। এই লোকটি হলো শেষ আগত, পঞ্চম উপাদানের ধারক—আকাশ। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে শুধু দর্শক—তার উপস্থিতি যেন সমগ্র ঘটনার ব্যাকরণ বদলে দিতে চলেছে। গ্রামে প্রবেশ করার সময় পেছনের আকাশ বিদ্যুৎচমকে এক মুহূর্তের জন্য আলোকিত হয়, আর তৎক্ষণাৎ চারপাশে বাতাস থেমে যায়। গাছের পাতাও নড়ছে না, পাখির ডাক বন্ধ। কাকের দল উড়ে যায় উল্টো দিকে, আর গ্রামের প্রান্তে থাকা শ্মশান থেকে শোনা যায় এক অদ্ভুত মৃদু গুঞ্জন।

যজ্ঞস্থলে তখন জমে উঠেছে অশরীরী উত্তাপ। চারজন আগেই হাজির—মাটির ধারক কৃষ্ণা, জলের ধারক জয়ন্তী, আগুনের ধারক ভৃগু এবং বায়ুর ধারক নির্ভীক। তারা এখন ত্রিভুজাকারে বসে আছে, মাঝখানে জ্বলছে কুণ্ড। আগুনের আভায় তাদের মুখগুলো যেন ক্রমশ বিকৃত হয়ে উঠছে, আর প্রতিটির সামনে রাখা উপাদান স্পন্দিত হতে শুরু করেছে। ঠিক তখনই পঞ্চম ব্যক্তি এসে উপস্থিত হয়। আকাশের প্রতিনিধিকে দেখে বাকিরা একবারের জন্য মাথা নোয়ায়, এবং মুহূর্তেই শুরু হয় মন্ত্রোচ্চারণ। “নমো আকাশতত্ত্বায়, নিরাকারায়, সর্বব্যাপিনে…”—এই ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের মধ্যে সূক্ষ্মভাবে বদল আসে। মাটির উপাদান কাঁপে, জলের পাত্রে ঢেউ ওঠে, আগুন আরও উজ্জ্বল হয়, বায়ু কুণ্ডের চারপাশে ঘূর্ণায়মান হয় আর আকাশের যন্ত্র থেকে নির্গত হয় একটি অদৃশ্য কম্পন, যা প্রত্যেকের দেহে পৌঁছায়। সেই মুহূর্তে, আকাশের ধাতব যন্ত্রটা নিজের আকৃতি বদলাতে শুরু করে, এবং তার কেন্দ্রে ফুটে ওঠে একটি ত্রিমাত্রিক চিহ্ন—যা এই পঞ্চতত্ত্বের বন্ধনকে সম্পূর্ণ করে। তবু ত্রুটি থেকে যায়—কারণ ষষ্ঠ তত্ত্ব এখনও অধরা। তাদের চারপাশে জমতে থাকে ঘন কুয়াশা, কুন্ডের আগুন এখন ধোঁয়া নয়, যেন ছায়া নির্গত করছে। একজন চিৎকার করে ওঠে, “সে আসছে… ঘুমের ভিতর… আমাদের দিকে!”

সেই রাতেই, গ্রামের এক প্রান্তে, ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরে ঘুমিয়ে থাকা ছেলে বালু আচমকা জেগে ওঠে। ঘর্মাক্ত, স্তম্ভিত সে বিছানায় বসে পড়ে। স্বপ্নে সে দেখেছে এক বিশাল বৃক্ষ, যার শিকড় অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে আর ডালে ঝুলছে পাঁচটি মুখ—যাদের একটির মুখ স্পষ্ট তার নিজের! বালুর ঘরের মাটিতে হঠাৎ ছায়া নেমে আসে, অথচ জানালা খোলা নেই। বাইরের কুকুর হঠাৎ ডেকে ওঠে, তারপর সব শান্ত। বালু জানে না কেন, কিন্তু তার বুকের ভিতর এখন কাঁপুনি। এক রহস্যময় আহ্বান যেন তার অন্তরে ধ্বনিত হচ্ছে—”এসো… তোমার সময় হয়েছে…”। সেই আহ্বান, সেই পঞ্চম মানুষটি, সেই আকাশের কম্পন—সবকিছুর কেন্দ্রে সেই বালু, যার অস্তিত্ব এখনও তার নিজের কাছেও পরিষ্কার নয়। কিন্তু এক জিনিস নিশ্চিত—যজ্ঞ শুরু হয়েছে, পাঁচটি উপাদান একত্রিত, ষষ্ঠ তত্ত্ব আসন্ন… এবং অমাবস্যার এই যাত্রা আর ফেরার নয়।

অধ্যায় ৫: বায়ুর সংকেত

রাত্রি তখন গা ছমছমে নীরবতায় ঢাকা। পঞ্চম ব্যক্তি, যে ‘বায়ু’ উপাদানের ধারক, তার আবির্ভাব হল গ্রামের দক্ষিণ দিকের শুকনো খেতের ধারে। তার চেহারা যেন হাওয়ারই প্রতিমূর্তি—চুল এলোমেলো, চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা, আর গায়ে ধুলো-ধূসরিত বস্ত্র যেন বহু দূরের পথ হেঁটে এসেছে। গ্রামের প্রবীণতম মানুষ রঘুনাথ পণ্ডিত বলেন, “এই রকম বাতাস আমি এর আগে কোনো অমাবস্যায় টের পাইনি… যেন কিছুর পূর্বাভাস।” সে রাতে হঠাৎ করেই গ্রামের শিশুরা জ্বর নিয়ে কাঁপতে শুরু করে, কিছু ঘরবাড়ির দরজা অনায়াসে খুলে যায়—যা তালা দেওয়া ছিল দিনের আলোয়। বায়ু তার শ্বাসে আনে অস্থিরতা, গাছের পাতা কাঁপে এমনভাবে যেন কেউ অস্পষ্ট ভাষায় কিছু বলছে। পঞ্চতত্ত্বের বাকিরা, যজ্ঞের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, টের পায় বায়ু তাদের সঙ্গে যুক্ত হলে যেন পরিপূর্ণতা কাছাকাছি চলে এসেছে।

এই বায়ু ধারকটির নাম কেউ জানে না, কিন্তু লোকেরা তাকে ‘উড়ন্ত সাধু’ নামে ডাকে, কারণ সে কথা কম বলে, কিন্তু যেখানে প্রয়োজন সেখানে হাওয়ার মতো হাজির হয়। গ্রামের মাঝি গোবিন্দ পাল তাকে একবার দুধ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, সে তা বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছিল এবং দুধটি নিরুদ্দেশ হয়েছিল এক ঝলক বাতাসের মধ্যে। গ্রামের পুরাতন শ্মশানঘাটে সেই রাতে শোনা যায় এক নারীর কান্না, অথচ সেখানে কেউ ছিল না। বায়ুর ছোঁয়ায় খুলে পড়ে যায় পুরোনো কুলুঙ্গির আলপনা, এবং সেই স্থান থেকে বেরিয়ে আসে এক শতাব্দী পুরনো কবজ—যেটি কোনো এক সময় তান্ত্রিক রুদ্রনাথ তার চরণতলে পুঁতে রেখেছিল, বলেছিল, “যদি কখনো পাঁচ উপাদান একত্র হয়, আমার সত্তা ফিরিয়ে দেবে এক নব রূপে।” গ্রামের লোকেরা তখন থেকেই ভীত, কারণ এই বায়ু শুধু নিঃশব্দ বয়ে যায় না, সে ইতিহাসের স্তব্ধতা ভেঙে দেয়।

যজ্ঞস্থলের চারপাশে তখন পাল্টে যাচ্ছে বাতাবরণ। আগুনের রঙ গাঢ় হচ্ছে, জল তীব্রভাবে কাঁপছে, মাটি ফেটে উঠছে ছোট ছোট রেখায়, আর আকাশে রাত্রির কালো ঢাকছে আরও বেশি করে সবকিছু। শুধু বায়ু ঘুরছে এক নিরবিচারে, আর তার সঙ্গে ভেসে আসছে অতীতের স্বর—বাচ্চার হাসি, নারীর চিৎকার, বৃদ্ধের দীর্ঘশ্বাস। পঞ্চতত্ত্বের ধারকরা বুঝে যায়—এখন তাদের অপেক্ষা শুধু ষষ্ঠ ব্যক্তিটির জন্য, যে স্বপ্নের মধ্য দিয়ে আসবে, এবং যার হাতে নির্ভর করছে যজ্ঞের প্রকৃত উদ্দেশ্য—মুক্তি, না কি মহাবিপর্যয়। বায়ুর উপস্থিতি যেন সেই অপেক্ষার সময়টাকে আরও অসহনীয় করে তোলে, কারণ হাওয়া তো কখনো চুপ করে বসে থাকে না—সে ঘুরে বেড়ায়, গন্ধ নিয়ে আসে, ইতিহাসের ছায়া নিয়ে আসে, আর নিয়ে আসে সেই প্রশ্ন—যদি এই সব কিছু পূর্বনির্ধারিত হয়, তবে ষষ্ঠ জন কে?

অধ্যায় ৬: আকাশের নীরবতা

বহুদিন পর মেঘমল্লার গ্রামের উপর আকাশ এত স্পষ্ট ছিল—একটি অমাবস্যার রাত, যেখানে চাঁদের অনুপস্থিতি এক নীরব অথচ গভীর ছায়া ফেলে রেখেছিল সব কিছুর উপর। সেই নিঃসঙ্গ নক্ষত্রহীন আকাশের নিচে, গ্রামের প্রান্তে পরিত্যক্ত এক খামারবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল পাঁচজন আগন্তুক, প্রতিটি উপাদান বহনকারী তাদের নির্ধারিত জায়গায়। রুদ্র তার মাটির পাত্র নিয়ে পূর্বদিকে, নীলা তার জলের কাঁসার কলস নিয়ে পশ্চিমে, আগ্নিশ তার মাটির প্রদীপ সহ দক্ষিণে, বায়ন তার ঝোলানো বেলুন আর হাওয়ায় ওড়া চাদর নিয়ে উত্তরে, আর পঞ্চম জন—একজন বৃদ্ধ অন্ধলোক, যার কপালে আঁকা ছিল নীল রঙের চিহ্ন, দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন্দ্রে, আকাশের প্রতিনিধিত্ব করে। সে ছিল এক অদ্ভুত মানুষ—যার চোখ ছিল না, অথচ সে সব কিছু দেখতে পেত। তার নাম কারো জানা ছিল না, সে কেবল নিজেকে বলত “শূন্য”, এবং তার দেহের স্পন্দনে যেন ভেসে আসত অচেনা গ্রহের নিঃশব্দ ভাষা। তাদের পঞ্চতত্ত্বের যজ্ঞ শুরু হবার কিছুক্ষণ আগেই আকাশ যেন গভীরতর নীরব হয়ে পড়েছিল—না কোনো পাখির ডাক, না কোনো পোকামাকড়ের শব্দ। চারদিকের প্রকৃতি যেন একটি প্রশ্বাস ধরে বসে ছিল, সেই একটি মুহূর্তের অপেক্ষায়, যেটা কেবলমাত্র ষষ্ঠ জনের উপস্থিতিতে পূর্ণতা পেতে পারে।

শূন্য ধীরে ধীরে তার দুই হাত তুলে বলল, “সময় এসেছে। কিন্তু আমরা পাঁচজন পূর্ণতা নই। আমাদের মাঝখানে একটি স্বপ্ন আজো জীবন্ত হয়নি। শূন্যতা সম্পূর্ণ হয় সেই স্বপ্নদ্রষ্টার আগমনে।” তার কণ্ঠস্বর যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল, অথচ কোনো ঠোঁট নড়ছিল না। অন্যরা, পূর্ব-পরিকল্পিত মতো, একে একে তাদের উপাদান তুলে ধরল আগুনের চারপাশে। হঠাৎ করে বাতাস ভারী হয়ে উঠল, যেন বহুবছরের জমে থাকা স্মৃতি এক মুহূর্তে বুদ্বুদ হয়ে ফুটে উঠল। সেই মুহূর্তে, খামারবাড়ির পেছনের পাথরের পথ ধরে ছুটে এল একটি ছেলে—দীপ্ত, যার স্বপ্নে কয়েক রাত ধরে ঘুরে ফিরে এসেছে এই পঞ্চজনের মুখ, এই খামারবাড়ির নিঃসঙ্গ আলো, আর এক অচেনা ভাষায় উচ্চারিত একটি শব্দ—”আত্মভূমি”। সে দমবন্ধ করা হাওয়াকে ছেদ করে সামনে এসে দাঁড়াতেই শূন্যের কণ্ঠ ভেসে এল, “এলো সে, যার মধ্যে রয়েছে পাঁচ উপাদানের ছায়া। এখন পূর্ণ হবে যজ্ঞ। এখন উন্মোচিত হবে ‘বিন্দু’।” দীপ্ত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে, তার শরীরের ভেতর যেন তড়িত্স্পন্দনের মত কিছু প্রবাহিত হচ্ছিল, এবং হঠাৎ সে বুঝতে পারল—তার জন্ম, তার স্মৃতি, তার বিস্মরণ—সবই যেন তৈরি হয়েছে এই একটি রাতের জন্য।

শূন্য তাকে কাছে ডাকল। দীপ্ত এগিয়ে যেতেই পাঁচ উপাদান একসঙ্গে ঘিরে ফেলল তাকে—জল, বায়ু, মাটি, আগুন আর অদৃশ্য আকাশের সুর। এই পাঁচটি উপাদান মিলে গঠন করল এক জ্যামিতিক চক্র, যার কেন্দ্রবিন্দুতে দীপ্ত দাঁড়িয়ে। হঠাৎ তার কপালে জ্বলে উঠল একটি অদ্ভুত ত্রিকোণ, যেন সে নিজেই এক প্রতিসরণ হয়ে উঠেছে, এক যোগসূত্র যা অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝে একটি ফাটলের দরজা খুলে দিতে পারে। সেই ত্রিকোণ থেকে এক তীব্র আলোকরশ্মি উঠে গেল আকাশের দিকে, যেখান থেকে ধীরে ধীরে নেমে এল কুয়াশার মত এক ছায়াময় সত্ত্বা। পঞ্চতত্ত্বের প্রতিটি বাহক তখন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, যেন তাদের সত্ত্বা সঁপে দিল এই নবআগত সত্ত্বার কাছে। দীপ্তর মুখে তখন উচ্চারিত হল এক পুরনো মন্ত্র—যা সে কখনো শেখেনি, অথচ তার হৃদয় জানত সেই ভাষা। আকাশ নিঃশব্দ ছিল, কিন্তু সেই নিঃশব্দতাই ছিল সবচেয়ে কর্কশ ধ্বনি। দীপ্তর শিরা উপশিরায় তখন বয়ে যাচ্ছিল এক অভূতপূর্ব আলো, এক চেতনাবোধ যা শুধু বলছিল—“একবার যে খোলে, সে দরজা আর বন্ধ হয় না।”

রাত্রি গভীরতর হচ্ছিল। আকাশের অন্ধকার চাদরে ঢাকা পড়ে গিয়েছে চাঁদের কোনো চিহ্ন, যেন অমাবস্যা নিজেই নেমে এসেছে পৃথিবীতে। পাঁচতত্ত্বের যাত্রীরা জড়ো হয়েছিল গ্রামসংলগ্ন কালীদহের ধারে, যেখানে এক মৃতপ্রায় নদী নিঃশব্দে বয়ে চলে। আকাশের নিচে পাতালে যেন কোনো কিছুর ডাক শোনা যাচ্ছিল—অন্তহীন ধ্বনি, যার অর্থ বোঝা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায় হাড়ের মধ্যে। গায়ের লোম দাঁড় করানো সেই শব্দে কেউ কিছু বলছিল না, কেবল চোখের ভাষায় আদানপ্রদান চলছিল। কৃপাত্তয়া তার মাটির থলে খুলে রাখল এক বেদীর উপর, পঞ্চত্বত্ব অনুযায়ী বাকিরাও তাদের উপাদান সামনে রেখে একে একে বৃত্ত সম্পূর্ণ করল। হঠাৎ, নিঃশব্দেই সেখানে এসে দাঁড়াল পাণ্ডু, যেন বাতাসে ভেসে এসেছে সে। কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল অদ্ভুত—কোনো চেতনা নেই তাতে, কেবল অতল শূন্যতা। শ্রীভোলা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ধীরে বলল, “তুই কি প্রস্তুত?” পাণ্ডু চুপ করে মাথা নাড়ল। তার কপালে সেই অদ্ভুত চিহ্নটি আগের থেকে আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে—কোনো গোপন তন্ত্রের চিহ্ন যা এই জগতের নয়। সবাই বুঝল, সময় এসেছে।

যজ্ঞ শুরু হল। শঙ্কার মতো ধ্বনি তুললেন কৃপাত্তয়া। তার কণ্ঠে ছিল দীর্ঘ শ্লোক, যা শোনা যায় না সাধারণ কানে, অনুভব করতে হয়। গন্ধবাতাসে ছড়িয়ে পড়ল তিলধূপের গন্ধ আর নারকেল তেলের ধোঁয়া। ধরণী, যার জলপাত্রে নীলচে বুদবুদ উঠছিল, আস্তে করে এক ফোঁটা করে জল ছিটাল পাণ্ডুর কপালে, গলায়, আর বুকে। আগুন ততক্ষণে রুদ্রনারায়ণের আগুনে ঘি পড়ে জ্বলছে, ছায়াগুলো নড়ে উঠছে তার আলোয়। শ্রীভোলা এক মন্ত্রপূত বাতাসের বাঁশি বাজাল—তাতে প্রকৃতির আওয়াজ থেমে গেল, যেন গাছেরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। তারপরে আকাশচারিণী চোখ বুজে উচ্চারণ করল সপ্তলোকের প্রবেশদ্বার খোলার প্রাচীন মন্ত্র, যেটি শুধু স্বপ্নে আসে, বাস্তবে কখনও নয়। ঠিক সেই মুহূর্তে, পাণ্ডুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল এক শ্বাসরুদ্ধ করা আর্তনাদ। বাতাস ভারী হয়ে উঠল। পাণ্ডুর গা থেকে উঠল কালো ধোঁয়া—একটি ছায়ামূর্তি, যার মুখ নেই, শুধু অন্ধকারে গড়া অবয়ব, আর দুটো জ্বলন্ত চোখ। সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও পাণ্ডু ধীরে ধীরে পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করল, যেন কেউ তাকে টানছে, টেনে নিয়ে যাচ্ছে পাতালের দিকে। ঠিক তখন, শ্রীভোলা তার সামনে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠল, “তুমি একা যেতে পারবে না, তোমার ভিতরে সে আছে!” আর সেই মুহূর্তেই, সব আলো নিভে গেল, আগুন নিভে গিয়ে চারদিক অন্ধকারে ডুবে গেল। একটি নিঃশব্দ অন্ধকার যেন গ্রাস করল সবকিছু। কেউ জানল না, কে কাকে নিয়ে চলে গেল—পাণ্ডু? না সেই ছায়া?

অন্ধকার কেটে গেলে দেখা গেল শুধু কৃপাত্তয়া একা দাঁড়িয়ে আছেন যজ্ঞস্থলে। চারদিক শুনশান, বাকি কেউ নেই—না ধরণী, না রুদ্রনারায়ণ, না শ্রীভোলা, না আকাশচারিণী। বাতাস ভারী, আর পাণ্ডুর মাটিতে পড়ে থাকা খালি গায়ের দাগগুলো থেকে ধোঁয়া উঠছে। তিনি ধীরে ধীরে মাটির পাত্রটিকে তুলে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মুখে একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল। “শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তাই হয়েছে।” তারপর হঠাৎ করে আকাশ বিদ্যুৎ চমকালো, আর অদৃশ্য দূর থেকে শোনা গেল এক নারীমন্ত্রপাঠ—যেন ষষ্ঠ জন উপস্থিত হয়েছে… স্বপ্ন ভেঙে বাস্তব হয়ে উঠেছে।

অধ্যায় ৮: মহাযজ্ঞ

গ্রামের আকাশ যেন চিরকাল অন্ধকারেই ডুবে গেছে। রাতের আঁধার এমনভাবে চেপে বসেছে, যেন সূর্য আর কখনও উদিত হবে না। বটগাছের তলায় পঞ্চতত্ত্বের ধারকরা দাঁড়িয়ে, সামনে জ্বলছে এক অলৌকিক যজ্ঞের আগুন—নীলাভ, লেলিহান, এবং জীবন্ত। মাটির ধারক বিষ্ণু মালাকার মন্ত্রপাঠে নিমগ্ন, তার কণ্ঠস্বর যেন পাথরের গায়ে আগুনের রেখা কাটছে। জলের ধারক ললিতা মণ্ডল জলধারার ন্যায় নীরব, কিন্তু তার দৃষ্টিতে যেন সমুদ্রের ডুংগুর মতো কিছু একটার প্রত্যাশা। বায়ুর ধারক কবিরাজ বিনয় ঘোষ ফুঁ দিয়ে বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সুগন্ধি ধোঁয়া, যা ধীরে ধীরে যজ্ঞস্থলের চারদিকে ঘূর্ণি পাকিয়ে উঠছে। আগুনের ধারক অগ্নিবেশ, মন্ত্রোচ্চারণে অগ্নিস্ফুলিঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছেন তেজ। আর আকাশের ধারক, রহস্যময় নারী কমলা, উপরের দিকে মুখ তুলে যেন অপেক্ষা করছেন সেই ষষ্ঠ শক্তির আত্মপ্রকাশের।

হঠাৎই যজ্ঞের আগুনের মধ্যে এক ধূসর দেহ ভেসে ওঠে। এটি কোনও মানুষের অবয়ব নয়, বরং স্বপ্ন থেকে উঠে আসা এক অজ্ঞাত সত্তা। পঞ্চতত্ত্বের ধারকরা থমকে যায়, সময় যেন আটকে পড়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য। এই স্বচ্ছ সত্তার মুখ নেই, চোখ নেই, কিন্তু সেই চোখহীন দৃষ্টির সামনে সবাই নিঃশব্দ। কমলা ধীরে ধীরে সেই সত্তার সামনে এগিয়ে এসে মাথা নত করে। সে বলে, “আমরা তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি যদি গ্রহণ করো, তবে শুরু হোক যজ্ঞের শেষ অধ্যায়।” সত্তা কিছু না বলেই ভেসে আসে যজ্ঞবেদির উপর, আর ঠিক তখনই এক প্রবল শব্দে আকাশ ফেটে যেন বজ্রপাত নেমে আসে। আলো-আঁধারির মাঝে স্পষ্ট হয়—এই ষষ্ঠ ব্যক্তি, এই স্বপ্নসত্তা, আসলে শুভঙ্কর! সেই নিখোঁজ ছেলেটি, যে গ্রামের বাইরে পাহাড়ি ধ্বংসাবশেষে ঘুমিয়ে ছিল। কেউ জানে না সে কীভাবে পৌঁছল, কীভাবে এই ঐন্দ্রজালিক যজ্ঞের কেন্দ্রস্থলে তার আত্মা আহ্বান করা হল।

সেই মুহূর্তেই যজ্ঞের আগুন এক নতুন রূপ নেয়। আগুন এখন আর আগুন নয়—তা যেন একটি জীবন্ত ক্যানভাস, যেখানে গ্রামের শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাস, তন্ত্রসাধনার নিষিদ্ধ পদ্ধতি, মানুষের নিষ্কৃতি ও ধ্বংস একসাথে প্রতিফলিত হচ্ছে। মাটি উঠে এসে মানুষের পায়ে জড়িয়ে ধরে, জল পৃষ্ঠদেশ থেকে উড়ে আকাশের দিকে উঠে যায়, বাতাস ঘূর্ণায়মান চক্রে বদলে যায় শব্দে, আগুন ছড়িয়ে পড়ে আকাশের কিনারায়, আর আকাশ নিজেই ছায়াপথের দরজা খুলে দেয়। সেই মুহূর্তে, পাঁচজন ধারক নিজেদের ভেতরের শক্তিকে মুক্ত করে দেয় ষষ্ঠ জনের মধ্যে, শুভঙ্কর হয়ে ওঠে এক পুতুল, যার মাধ্যমে শেষ যজ্ঞ সম্পন্ন হবে। শুভঙ্করের দেহ উঠে যায় আকাশপথে, গুঞ্জরিত হয় শেষ মন্ত্র—”পঞ্চতত্ত্বে স্থিতি হোক, অমাবস্যায় মুক্তি হোক।” আর ঠিক তখনই সবকিছু থেমে যায়—যজ্ঞ, মন্ত্র, আলো, শব্দ। গ্রামের ওপর এক নিঃসীম নিস্তব্ধতা নেমে আসে, আর সেই নৈঃশব্দ্যে জন্ম নেয় এক নতুন ভোর—যেখানে আর কোনও প্রেত নেই, কোনও অভিশাপ নেই, শুধু একটা প্রশ্ন—পঞ্চতত্ত্ব কি সত্যিই পরিপূর্ণ হল, নাকি নতুন করে আবার চক্র শুরু হবে?

অধ্যায় ৯: নিশির শ্বাসে আকাশের ছায়া

আকাশের উপাদানটি বহনকারী সেই দুর্লভ ঋষিপুরুষ, যাঁকে লোকেরা “ব্যোমদর্শী” নামে জানে, অবশেষে পঞ্চতত্ত্বের সঙ্গে একত্রিত হলেন। গায়ে ছাইমাখা, অন্ধ চোখের মতো শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সেই মানুষটির মুখে একটি কথাও ছিল না, কিন্তু তাঁর উপস্থিতিতেই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল গোটা গ্রাম। সেই রাতে আকাশটা ছিল তারাভরা, অথচ চাঁদ ছিল না—অমাবস্যা। দূরে শ্মশানঘাট থেকে ধোঁয়া উঠছিল, যেন কোনো অদৃশ্য শবদাহ চলছে। ব্যোমদর্শীর সঙ্গে দেখা হতেই মাটি, জল, আগুন ও বায়ুর বাহকরা একত্রিত হয়ে দাঁড়ালেন নিষিদ্ধ বটবৃক্ষের তলায়, যেখানে মাটির নিচে ঘুমিয়ে ছিল প্রাচীন এক তান্ত্রিক সীলমোহর। গায়ে গায়ে যেন কেঁপে উঠল চারপাশ—গাছের পাতায় বাতাস থেমে গেল, পেঁচা ডাক বন্ধ করল, কুকুরেরা কান গুটিয়ে বসে রইল। ব্যোমদর্শী শুধু একবার মাথা নোয়ালেন—আর সেই মুহূর্তেই আকাশে গর্জন করে উঠল বিদ্যুৎ, অথচ বৃষ্টি নেই। যেন পঞ্চতত্ত্বে আহ্বান জানানো হল ষষ্ঠ জনের।

দীপালি সেই সময় ঘুমাচ্ছিল না, যদিও চোখ বন্ধ ছিল। তিনদিন ধরে স্বপ্নের মধ্যে এক রহস্যময় পাণ্ডুলিপি তাঁর সামনে উন্মোচিত হচ্ছিল—যেখানে লেখা ছিল “ষষ্ঠজন” কে। সে নিজেও জানত না যে সে-ই সেই যোগসূত্র। সিঁদুররঙা ঘরে পিতলের বাতি নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীর যেন শীতল হতে লাগল। বাইরের মাটির ঘ্রাণ, আকাশের নিঃশব্দতা, বায়ুর হালকা কাঁপন—সব একসঙ্গে এসে যেন ঢুকে পড়ল তাঁর মনে। তিনি ধীরে ধীরে উঠলেন, চুল এলোমেলো, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নিজের অজান্তেই পা চালিয়ে চললেন গ্রামের শেষ প্রান্তে, যেখানে নিষিদ্ধ তান্ত্রিক বটবৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে হাজার বছর ধরে। বাকি পাঁচজন তাঁর আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যেন পূর্ব নির্ধারিত ছিল সব। ব্যোমদর্শী তখন মাটিতে বসে, চোখ মুদে, ঠোঁটে একটি ত্রিচক্র মন্ত্র—”ঐং ক্ষৌম্ উগ্রং।” দীপালি সামনে এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ বাতাসে এক বিশাল চাপড় লাগল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাঁকে স্বীকার করে নিচ্ছে।

আরম্ভ হল যজ্ঞ। পাঁচটি উপাদান একটি একটি করে স্থাপন করা হল উত্তর-পূর্ব-কোণ-অনুসারে, আর দীপালি সেই কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়ালেন—একজন রক্তমাংসের মাধ্যিকা, যার শরীর হয়ে উঠল বাহক। যজ্ঞ শুরু হতেই বাতাসে গন্ধ ছড়াতে লাগল ধূপ, গন্ধক আর তাজা কাঁচা মাটি। আগুন জ্বলে উঠল তাম্রযন্ত্রে, আর তার ভাষা যেন অন্য কোনো জগতের। ব্যোমদর্শীর কণ্ঠ তখন প্রবল—”যে আসবে, সে এখনই আসবে। সে মুক্তি কিংবা মহাবিপর্যয় বয়ে আনবে।” ঠিক সেই মুহূর্তে, একটা শব্দ হল—দূরের শ্মশানঘাট থেকে ধেয়ে এল এক কুয়াশা, যার মধ্যে দেখা গেল একটি শিশু আকৃতি, যার মাথা ভরা ধুলো, মুখে কোনও চিহ্ন নেই—না চোখ, না মুখ, না চিবুক—শুধু এক ধূসর শূন্যতা। দীপালি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলেন নিঃশব্দে। এ কি স্বপ্ন? না কি এ-ই প্রকৃত ষষ্ঠ উপাদান—শূন্যতা?

চণ্ডীর মন্ত্র ধ্বনিত হচ্ছিল, সেই গুঞ্জন যেন আকাশকে ছুঁয়ে দিচ্ছিল। গোটা গ্রাম থমকে দাঁড়িয়েছে, বটতলার বৃত্তের ভিতরে যে যজ্ঞমণ্ডপ স্থাপন করা হয়েছে, তার চারদিকে পাঁচজন—ভূমিসাধক কুটিনাথ, জলসাধিকা বাসবী, অগ্নিসাধক উগ্রেশ, বায়ুসাধক নির্ঝর এবং আকাশসাধক তেজস্বিনী—তাদের অবস্থানে বসে, মন্ত্রপাঠে লিপ্ত। আগুনের শিখায় মুখ তাদের কখনও জ্বলজ্বল করছে, কখনও অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। আর কেন্দ্রে—এক শূন্য স্থান, যেখানে এখনও এসে পৌঁছায়নি ষষ্ঠ ব্যক্তি, যার উপর নির্ভর করছে যজ্ঞের পূর্ণতা। হঠাৎ সেই শূন্যস্থান পূর্ণ হল, যেন বাতাস হালকা কাঁপতে লাগল—প্রবেশ করলেন রুদ্র, এক বিভ্রান্ত, কিন্তু চেতনার মধ্যে জাগ্রত তরুণ, যার স্বপ্ন তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তাঁর চোখের সামনে খুলে গেল এক অলীক দৃশ্য, যেখানে পঞ্চতত্ত্ব তাকে সঙ্গ দিচ্ছে, এবং যজ্ঞমণ্ডপ তাকে আহ্বান করছে কেন্দ্রে বসতে। তন্ত্রমতে, ষষ্ঠ জনের আত্মা শুদ্ধ ও নিরপেক্ষ হলে যজ্ঞ মুক্তি দেবে, নচেৎ বিপর্যয় অনিবার্য। রুদ্রকে ডাকা হল—তাঁর চেতনাকে পরীক্ষা করে দেখা হবে, তাঁর হৃদয়ে আলো আছে কিনা, সেটা বুঝে নেওয়া হবে।

রুদ্র ধীরে ধীরে কেন্দ্রে এসে বসলেন। পাঁচজন তান্ত্রিক তাঁদের তেজ, তাঁদের উপাদান তাঁর চারপাশে আবর্তিত করতে লাগলেন। বাসবীর জল যেন হিমালয়ের গঙ্গাধারার মতো নেমে এল রুদ্রের দিকে, কুটিনাথের মাটি যেন তাঁকে আবৃত করল মাতৃস্নেহে। আগুনের তাপে রুদ্রের চিত্ত জ্বলে উঠল, বায়ুর ছোঁয়ায় শীতল প্রশান্তি নামল, এবং তেজস্বিনীর আকাশ-আভা তাঁকে অন্য এক স্তরে নিয়ে গেল। সেই মুহূর্তে, রুদ্রের ভিতরে খুলে গেল এক জাগতিক ও অতিজাগতিক স্মৃতির দরজা—সে দেখতে পেল নিজের শৈশব, ভুল, ক্ষমা, আশা, আকাঙ্ক্ষা আর প্রেম। সমস্ত অনুভূতি এক এক করে উন্মোচিত হল, এবং অবশেষে—যে সত্যটি সে এতদিন অস্বীকার করেছিল, তা স্বীকার করে ফেলল। সে নিঃস্বার্থ, কিন্তু রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে বসে আছেন কেন্দ্রে, যজ্ঞের অগ্নি যেন বুঝে ফেলেছে—সে ত্যাগ করেছে, সে গ্রহণ করেনি। যজ্ঞের শিখা হঠাৎ দ্বিগুণ উচ্চতায় উঠল, পঞ্চতত্ত্ব একত্রিত হয়ে এক সুষুম্না প্রবাহ তৈরি করল—আকাশ ছুঁয়ে চলল সেই আলো।

মুহূর্তের মধ্যেই গ্রামে এক নিঃশব্দ বিস্ফোরণ, তারপর গভীর নীরবতা। বটতলার বৃত্ত ধীরে ধীরে অদৃশ্য হল, পাঁচজন তান্ত্রিক উঠে দাঁড়ালেন। তাঁদের চোখে প্রশান্তি—তাঁরা জানেন, রুদ্রের চেতনা মুক্তি এনেছে। গ্রাম যেন নবজন্ম পেল। মৃত গাছের কাণ্ডে নতুন কুঁড়ি, শুকিয়ে যাওয়া কুয়োর জলে বুদবুদ, পশুদের চোখে প্রশান্তি। রুদ্র উঠে দাঁড়ালেন, যেন অন্য এক মানুষ। পাঁচ সাধক তাঁকে অভিবাদন জানালেন—তিনি এখন ‘অমৃতসূত্রধার’, যিনি যজ্ঞকে পূর্ণতা দিলেন। তবে তাদের কাজ এখানেই শেষ নয়। পঞ্চতত্ত্ব আবার ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীতে—নতুন সংকেত, নতুন যজ্ঞ, নতুন প্রান্তরে। রুদ্র জানেন, এ ছিল সূচনা মাত্র। অমাবস্যার রাতে সূচনা হল আলোর পথে, আর এক নতুন যুগের। উপাখ্যান শেষ হলেও তন্ত্র চলমান। চেতনার আগুন কখনও নিভে না।

সমাপ্ত

1000044050.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *