অভিষেক মজুমদার
অধ্যায় ১:
সুন্দরবনের প্রান্তসীমায় ছোট্ট গ্রাম কুয়াখালির ভোরবেলা আর পাঁচটা দিনের মতো নয়। সেই সকালটায় বাতাসে যেন অদ্ভুত গন্ধ, নদীর জলে অশান্ত ঢেউ, আর আকাশে পাখিদের ডাকেও এক অজানা আশঙ্কার সুর মিশে ছিল। অদ্বৈত ঘাটের ধারে দাঁড়িয়ে দূরের জঙ্গলের দিকটা দেখছিল, চোখে ছিল স্বপ্ন আর মনে দুরু দুরু কাঁপন। সোনার নদীর গল্প শোনা সেই রাতের পর থেকে তার মনের মধ্যে যেন লুকিয়ে থাকা অজানা সাহস বেরিয়ে এসেছিল। লালু, কৃষ্ণ, চিনু আর শিবু—চারজন মিলে অদ্বৈতের সঙ্গে রাতভর আলোচনা করে ঠিক করেছে, এবার তাদের যাত্রা শুরু হবে। বুড়ো হরিপদ মৎস্যজীবী, যে কিনা প্রায় অন্ধ আর সর্বক্ষণ মদ খেয়ে থাকে, সেই মানুষটাই আগুনের ধারে বসে সেদিন রাতে সোনার নদীর কাহিনী শোনায়। সোনা ঝলমল করে সেই নদীতে, কিন্তু কেউ ফিরতে পারে না সেখান থেকে—এই ছিল তার গল্পের মূল কথা। কিন্তু যুবক মন লোভের কথা শুনে অন্ধ হয়ে যায়, আর সেই লোভের টানে তারা যে এতো বড়ো ঝুঁকি নিতে চলেছে, তা তারা নিজেরাও তখন টের পায়নি।
যাত্রা শুরুর দিন সকালে গ্রামের ঘাটে ভিড় লেগে গেল। গ্রামের বুড়োরা মৃদু মাথা নাড়ল, আর মহিলারা চোখে জল নিয়ে প্রার্থনা করল। তাদের নৌকা ছিল সাধারণ কাঠের তৈরি, মাঝেমধ্যেই ফাটা জায়গাগুলো পাটকাঠি আর রেজিন দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। নৌকার মধ্যে ত্রিশূল, মাছ ধরার জাল, কিছু শুকনো খাবার আর এক বোতল কেরোসিন রাখা হয়েছে রাতের আঁধারে আগুন জ্বালানোর জন্য। অদ্বৈতের মা তাকে আশীর্বাদ করে বলল, “লাল সুতোর বাধন রেখিস বাপ, নদীর দেবীকে রাগাস না।” অদ্বৈত মাথা নোয়ালো, কিন্তু লালু ফিসফিসিয়ে বলল, “সোনা আসবে আমাদের হাতে মা, অভিশাপ নয়।” সকালটা অদ্ভুত রোদেলা আর অন্ধকারের মিশ্রণে তৈরি ছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই জানিয়ে দিচ্ছে এই অভিযানের পরিণতি সহজ হবে না। নদী যাত্রা শুরু হল, আর তাদের নৌকা ঢেউয়ের তালে তালে দূরে হারিয়ে যেতে লাগল।
প্রথম দিনের যাত্রা ছিল শান্তির। নদীর জল তখন মধুর বয়ে যাচ্ছিল, আর চারপাশের গাছপালা এক স্বপ্নিল আবরণ তৈরি করছিল তাদের জন্য। সূর্য যখন মাথার উপর, তখন তাদের নৌকা ঢুকল এক সরু খালে। পাখিদের ডাক, কাঁকড়ার খোলস ফাটার শব্দ, আর হাওয়ার মৃদু সুর তাদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছিল। লালু আর শিবু নৌকার পেছনে বসে গান ধরল, “ও নদীর সোনার ধারা, কে নেবে তোর সোনা?” হঠাৎ দূর থেকে দেখা গেল এক বুনো হাতির পালের ছায়া নদীর জলে পড়েছে। কৃষ্ণ কাঁপা গলায় বলল, “ওই দ্যাখো, প্রকৃতি আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছে কি?” অদ্বৈত তখনও নির্ভীক, সে জানে এই অভিযান শুধু সোনার জন্য নয়, সে নিজের সাহস প্রমাণ করতে চায় সেই বুড়ো হরিপদ আর গোটা গ্রামের কাছে। তারা নৌকা বাওয়ার গতি বাড়ায় আর মনের মধ্যে শুরু হয় এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর ভয়ের মিশ্র সুর।
বিকেলের দিকে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করল। ঝড়ের পূর্বাভাস বুঝে তারা খালের ধারে এক উঁচু চরে নৌকা বেঁধে বসে পড়ল। আগুন জ্বালিয়ে তারা শুকনো খাবার খেতে বসে, আর সেই সময় বুড়ো হরিপদের গল্পের কথা মনে পড়ে যায় সবার। লালু তখনও হাসে আর বলে, “দ্যাখো, কাল সকালেই সোনার নদী পেয়ে যাব।” কিন্তু কৃষ্ণ চুপ থাকে, কারণ তার মনে পড়ছে সেই অভিশাপের কথা—যারা সোনার লোভে গিয়েছিল, তারা আর ফিরে আসেনি। রাতের আঁধার নেমে এলে দূরের জঙ্গল থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যায়, আর নদীর জলে চাঁদের আলো পড়ে সোনালি রূপ ধারণ করে। সবাই মনে মনে ভাবে, এ কি সোনার নদীর ছায়া? নাকি প্রকৃতির এক নিষ্ঠুর খেলা? অদ্বৈতের চোখে ঘুম আসে না; সে নদীর জলরেখার দিকে চেয়ে থাকে, আর ভাবে, আগামীকাল কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
অধ্যায় ২:
ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই সুন্দরবনের অজানা নদীপথ ধরে অদ্বৈত, লালু, কৃষ্ণ, চিনু আর শিবুর নৌকা বয়ে চলল। নদীর জল যেন সেদিন অন্যরকম এক গল্প বলছিল। হালকা কুয়াশার চাদর ঢাকা পড়েছিল চারপাশে, আর তার ফাঁক দিয়ে সূর্যের রোদ সোনালি রেখার মতো পড়ছিল নদীর গায়ে। নৌকায় বসে অদ্বৈত অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল, এই অভিযান সহজ হবে না। বাতাসে লবণের গন্ধ, নদীর জলে শেওলার আস্তরণ, আর দূরের গাছের ফাঁক দিয়ে বুনো বাঁদরের ডাক মিলেমিশে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করেছিল। সকালটা শান্ত মনে হলেও নৌকার পেছনে দূর থেকে ভেসে আসছিল ঢেউয়ের গর্জন, যেন প্রকৃতি তাদেরকে তার গোপন রহস্যের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। শিবু মাছ ধরার জালটা পরীক্ষা করতে করতে ফিসফিস করে বলল, “কী জানি, সত্যিই যদি সোনার নদী থাকে?” লালু চোখ মিটমিটিয়ে বলল, “যদি থাকে, তাহলে আমরা আজ ভাগ্যবান হব। সোনা নিয়ে ফিরব, আর গ্রামে ইতিহাস হয়ে যাব।” কথাগুলো শুনে কৃষ্ণের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল, সে নীরবে চারপাশটা নজর রাখছিল, কারণ তার মনে পড়ছিল বুড়ো হরিপদের সতর্কবার্তা।
নৌকা বয়ে চলল সরু খালের ভিতর দিয়ে, যেখানে আকাশটা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে গাছের শাখা আর পাতার ছায়ায়। মাঝে মাঝে জল সরীসৃপের ছোঁ মাটির কাদা আর জলে ফেনার আকারে দেখা যাচ্ছিল। অদ্বৈতের মনেও এক অজানা শঙ্কা বাসা বাঁধছিল, কিন্তু সে তা মুখ ফুটে বলল না। দুপুরের দিকে তারা একটি প্রশস্ত নদীতে পৌঁছায়, যেখানে নদীর বুক চিরে বয়ে চলা স্রোত যেন তাদের নৌকাটিকে খেলনার মতো নাচিয়ে তুলছিল। পাখিরা হঠাৎ করেই নীরব হয়ে যায়, আর নদীর জলও যেন থমকে যায় কিছু সময়ের জন্য। চিনু সেই মুহূর্তে বলে ওঠে, “দেখো ভাইরা, নদীর জলও যেন কিছু বলতে চাইছে।” হঠাৎ করেই আকাশে ঘন মেঘে ঢেকে যায় সূর্য, আর এক ফোঁটা বৃষ্টি নৌকার পাটাতনে পড়ে টুক করে শব্দ করে ওঠে। সেই বৃষ্টির ফোঁটা যেন তাদের যাত্রার জন্য আশীর্বাদ বা অভিশাপের পূর্বলক্ষণ ছিল।
বিকেল গড়িয়ে এলে নদীর ধারে এক খোলা চরে তারা নৌকা বেঁধে থামে। চরের মাটি নরম, কিন্তু ভেজা। তারা আগুন জ্বালায় কেরোসিন ছিটিয়ে, আর তার চারপাশে বসে শুকনো খাবার আর জল খায়। শিবু জাল ঠিকঠাক করছে, লালু নদীর জলে হাত ডুবিয়ে সোনার খোঁজে অকারণ ঢেউ দেখার চেষ্টা করছে। অদ্বৈত চুপ করে বসে থাকে, চোখ স্থির নদীর দূর প্রান্তে। কৃষ্ণ তখন নরম গলায় বলে, “আমরা যেন নদীর দেবীর ক্রোধ না ডেকে আনি। আমরা শুধু মানুষ, প্রকৃতি অনেক বড়।” রাত নেমে আসতে নদীর জল কালো চাদরের মতো চারপাশ ঢেকে নিল। দূরের জঙ্গল থেকে শিয়ালের ডাক, বুনো পাখির ডানা ঝাপটার শব্দ, আর জলের উপর বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে রাতটা ভয় আর রহস্যে ভরা হয়ে উঠল। সেই রাতে কারও ঘুম এল না, তারা জানে না সামনে কী অপেক্ষা করছে।
রাতের শেষ প্রহরে আচমকা নদীর স্রোত বাড়তে শুরু করে। নৌকা দোল খেতে থাকে, আর বাতাসের গতি বেড়ে যায়। লালু উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “দ্যাখো দ্যাখো, জলের মধ্যে আলোর রেখা!” অদ্বৈত হুঁশিয়ার করে বসতে বলে, কারণ নদীর জলে চাঁদের আলো পড়ে সে আলো তৈরি হতে পারে। কিন্তু লালুর চোখে তখন লোভের ঝিলিক, সে যেন ঠিক করে ফেলে যে এই আলোর দিকেই যেতে হবে। সেই রাতে তারা অনুভব করল নদী শুধু এক জলধারা নয়, সে জীবন্ত, সে তার রহস্যে মানুষকে টানে, আর সে লোভের ফাঁদে মানুষকে আটকে ফেলে। তাদের নৌকা নতুন করে আবার যাত্রা শুরু করল, অজানা গন্তব্যের দিকে, যেখানে হয়তো সোনার নদীর গল্প সত্যি হয়ে উঠবে, নয়তো হবে এক নতুন ট্র্যাজেডির শুরু।
অধ্যায় ৩:
সকালবেলা সূর্যের আলো ফোটার আগে নদীর জলরেখা ধূসর কুয়াশায় ঢেকে যায়। অদ্বৈত আর তার সঙ্গীরা চুপ করে নৌকার পাটাতনে বসে সেই দৃশ্য দেখছিল। কুয়াশার চাদরের মধ্যে নদী যেন অচেনা হয়ে গিয়েছিল, যেন তারা অন্য এক জগতে এসে পৌঁছেছে। জল আর কুয়াশার মিশেলে তৈরি ধূসর পরিবেশে শোনা যাচ্ছিল দূরের মদনটাক পাখির ডাক আর অজানা প্রাণীর গর্জন। লালু ফিসফিস করে বলল, “এই নদীটা কেমন অদ্ভুত লাগছে না ভাইরা? ঠিক যেন স্বপ্নের মতো।” কৃষ্ণ গম্ভীর গলায় উত্তর দিল, “এটা স্বপ্ন নয় লালু, প্রকৃতির এক অজানা রূপ। সাবধান থাকতে হবে।” চিনু জলে হাত ডুবিয়ে কিছু একটা স্পর্শ করার চেষ্টা করল, কিন্তু শেওলা আর শীতল জলে সে হাত সরিয়ে নিল। অদ্বৈত চারপাশে নজর রেখে ভাবছিল, এই নদী কি সত্যিই সেই সোনার নদী? নাকি প্রকৃতির এক নতুন খেলা? নৌকার দিক ঠিক রাখতে গিয়ে তারা টের পেল, নদীর স্রোত আজ অন্যরকম। নীরব আর ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অজানার দিকে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হল, কিন্তু কুয়াশা কাটল না। তারা বুঝতে পারছিল না, সূর্য কোন দিকে আছে। নদীর দুপাশের গাছপালা আর জঙ্গল কুয়াশার চাদরে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ তারা দেখতে পেল, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ভগ্নপ্রায় নৌকা। সেই নৌকার গায়ে অদ্ভুত খোদাই করা চিহ্ন, যা কোনো ভাষার লেখা নয়, বরং প্রতীকী চিত্র। ত্রিকোণ, গোলক আর সাপের মতো আঁকিবুকি করা চিহ্নগুলো দেখে শিবু বলল, “এগুলো কেমন অশরীরী লাগে না?” অদ্বৈত নৌকাটা কাছ থেকে দেখার জন্য নৌকা ঘুরিয়ে কাছে নিয়ে গেল। সেই নৌকায় মানুষের চিহ্ন নেই, কিন্তু নৌকার মেঝেতে শুকনো রক্তের দাগ আর ছিঁড়ে যাওয়া জালের টুকরো পাওয়া গেল। বাতাস যেন হঠাৎ থেমে গেল, আর নদীর জলও নীরব হয়ে গেল সেই মুহূর্তে। লালু অস্থির গলায় বলল, “এখান থেকে চল আমরা, ভালো লাগছে না।” কিন্তু অদ্বৈতের মনে রহস্য আর লোভ একসঙ্গে কাজ করছিল। সে বুঝতে চাইছিল, এই নৌকা কি আগের কোনো অভিযাত্রীদের, যারা সোনার নদীর খোঁজে এসে হারিয়ে গেছে?
বিকেলের দিকে হাওয়া বদলাতে শুরু করল। কুয়াশা ধীরে ধীরে পাতলা হতে থাকল, আর নদীর জল ধূসর থেকে গাঢ় নীল রঙ নিল। পাখিরা আবার ডাকতে শুরু করল, আর গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের কিরণ এসে পড়ল নদীর বুকে। সেই আলো নদীর জলে পড়ে সোনালি ঝিলিক তৈরি করল। চিনু সেই আলো দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “দ্যাখো দ্যাখো, সোনার নদী!” কিন্তু অদ্বৈত সাবধান করল, “এটা শুধু সূর্যের আলো পড়ার খেলা, সোনা নয়।” লালু তবু চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে লাগল, নৌকার তলায় সোনার ভান্ডার রয়েছে। শিবু আর কৃষ্ণ চেষ্টা করছিল নৌকার গতি ঠিক রাখতে, কারণ স্রোত যেন হঠাৎ করেই জোরে বয়ে যেতে শুরু করল। নদীর বুক চিরে সেই স্রোত নৌকাকে টেনে নিয়ে চলছিল এক অজানা গহ্বরে।
রাত নামার আগেই তারা ঠিক করল চরের ধারে নৌকা বেঁধে রাত কাটাবে। আগুন জ্বালানো হল, কিন্তু কারও মুখে কোনো গল্প নেই সেদিন। কুয়াশা আর সেই পরিত্যক্ত নৌকার স্মৃতি তাদের মনে আতঙ্কের রেখা এঁকে দিয়েছিল। দূরের জঙ্গল থেকে হঠাৎ হরিণের ডাক আর বুনো শুয়োরের গর্জন শোনা গেল। নদীর জলে চাঁদের আলো পড়ে আবার এক সোনালি রঙের ছায়া তৈরি করল। সেই রাতে অদ্বৈত চুপ করে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকল, আর ভাবল—সোনার নদীর খোঁজে যে যাত্রা শুরু হয়েছে, তা হয়তো সহজে শেষ হবে না। প্রকৃতি তাদের দিকে তার ধূসর ছায়া ফেলতে শুরু করেছে।
অধ্যায় ৪:
পরদিন সকালটা যেন এক নতুন ভয়ের বার্তা নিয়ে এলো। চরের ধারে নদীর জল থমকে গিয়েছিল, আর দূরের গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল অদ্ভুত সব ছায়া। অদ্বৈত, লালু, কৃষ্ণ, চিনু আর শিবু নৌকা ছেড়ে পাড়ে এসে দাঁড়াল। অরণ্যের গাঢ় সবুজ অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হালকা বাতাস বইছিল, আর সেই বাতাসে মিশে ছিল শেওলা আর মাটির গন্ধ। অদ্বৈত বলল, “এখান দিয়ে এগোতে হবে, নদী এখানে থেমে গেছে।” লালু দ্বিধা নিয়ে বলল, “নদীর থেমে যাওয়া কি ভালো লক্ষণ?” কিন্তু অদ্বৈতের চোখে তখনও ছিল সেই একই লোভ আর রহস্যময় আকর্ষণ। তারা নৌকা বেঁধে পায়ে হেঁটে অরণ্যের দিকে পা বাড়াল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো খুব কমই নিচে পৌঁছাচ্ছিল, আর সেই অন্ধকারে তাদের প্রত্যেক পা ফেলার শব্দ যেন গর্জনের মতো শোনাচ্ছিল।
যত ভেতরে তারা অরণ্যে ঢুকতে থাকল, তত চারপাশের পরিবেশ বদলাতে লাগল। পাখিদের ডাক থেমে গেল, বাতাসও যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ দূরের গাছে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এক শিয়ালের দল। তারা একবার তাকিয়ে থাকল, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল। শিবু কাঁপা গলায় বলল, “এটা কি কোনো অশুভ লক্ষণ?” কৃষ্ণ মৃদু স্বরে উত্তর দিল, “প্রকৃতি আমাদের সতর্ক করছে।” কিন্তু লালু হেসে বলল, “সতর্কতা নয়, এটা শুধু অরণ্যের খেলা।” তারা এগিয়ে যেতে থাকল, আর তখনই গাছের গুঁড়ির পাশে মাটিতে পড়ে থাকা এক ভাঙা কাঠের বাক্সের সন্ধান পেল। সেই বাক্সে ছিল কিছু পুরনো পাথর, শুকনো রক্তের দাগ আর এক অজানা প্রতীক আঁকা লাল কাপড়। অদ্বৈত কাপড়টা হাতে নিয়ে অনুভব করল, যেন সেই প্রতীকে লুকিয়ে আছে এক অভিশাপের গল্প।
দুপুরের দিকে হাওয়া বদলাতে শুরু করল। আকাশে ঘন মেঘ জমে অরণ্যটা আরো অন্ধকার হয়ে উঠল। বজ্রধ্বনির মতো শব্দ হতে লাগল দূরে। তারা ঠিক করল, অরণ্যের ভেতরেই এক গাছের নীচে আশ্রয় নেবে। আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করলেও বাতাসের ধাক্কায় তা নেভে যেতে লাগল। শিবু আর চিনু কাঠ জোগাড় করতে গেল, আর অদ্বৈত সেই লাল কাপড়ের প্রতীকটা নিয়ে বসে থাকল। হঠাৎ দূরের গাছের আড়াল থেকে দেখা গেল এক অশরীরী ছায়া, যেটা মানুষের মতোই দেখাচ্ছিল। সবাই স্থির হয়ে গেল, কেবল বাতাস আর ঝড়ের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। ছায়াটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, আর অরণ্য যেন আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। লালু তখন বলল, “দেখলে? এ অরণ্য অভিশপ্ত।” কৃষ্ণ বলল, “প্রকৃতি আমাদের ফিরিয়ে দিতে চাইছে।” কিন্তু অদ্বৈত জানে, সে আর ফিরে যাবে না। সোনার নদীর খোঁজে সে যা খুশি সহ্য করতে প্রস্তুত।
রাত নামতে অরণ্যের সেই অজানা অভিশাপের ছায়া যেন আরও ঘনিয়ে এলো। ঝিঁঝিঁর ডাক, বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ আর অজানা জন্তুর গর্জনে রাতটা বিভীষিকার হয়ে উঠল। অদ্বৈত চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে নদীর রহস্য উদঘাটন করেই ফিরবে, আর সেই সোনার নদীকে খুঁজে বের করবেই। রাতের আঁধারে জোনাকিরা যেন তাদের পথ দেখানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু প্রকৃতির সেই অরণ্য যেন প্রতিটি পদক্ষেপে অভিশাপের ছায়া মেলে ধরেছিল।
অধ্যায় ৫:
অরণ্যের সেই বিভীষিকাময় রাত কাটিয়ে ভোর হতেই অদ্বৈত ও তার সঙ্গীরা নতুন করে নদীর দিকে পা বাড়াল। অরণ্যের কালো ছায়া আর ভয়াবহ নিস্তব্ধতা ফেলে তারা যখন নদীর পাড়ে পৌঁছাল, তখন প্রথম প্রহরের আলো নদীর জলে সোনালি আভা ছড়িয়ে দিয়েছিল। নদী যেন তাদের স্বাগত জানাচ্ছে এক নতুন সুরের মাধ্যমে। বাতাসে অদ্ভুত এক সঙ্গীত ভেসে আসছিল, যা নদীর ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে মিশে এক মোহময় পরিবেশ তৈরি করেছিল। লালু অবাক হয়ে বলল, “এই সুর কি তুমি শুনছ অদ্বৈত?” অদ্বৈত মৃদু হেসে উত্তর দিল, “হ্যাঁ লালু, নদী যেন আমাদের ডাকছে।” সেই সুরে মিশে ছিল অজানা এক আকর্ষণ, যা তাদের ক্লান্তি ভুলিয়ে আবার নৌকায় চড়তে প্ররোচিত করল। কৃষ্ণ সাবধান করল, “সুর সবসময় মায়ার হতে পারে, সাবধানে চল।” শিবু আর চিনু নৌকার দড়ি খুলল, আর তারা আবার বয়ে চলল সেই রহস্যময় নদীর বুকে।
নদীর স্রোত ধীরে ধীরে তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছিল এক অজানা পথে। চারপাশের গাছপালা আর অরণ্য তাদের দূর থেকে বিদায় জানাচ্ছিল, আর নদীর পাড়ে বুনো ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল হালকা বাতাসে। সেই সুর যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। নদীর ঢেউয়ের আড়ালে কোথা থেকে যেন এক নারীকণ্ঠ ভেসে এল, যার সুরে ছিল বিষাদ আর আহ্বান দুই-ই। লালু কাঁপা গলায় বলল, “এ তো নদীর দেবীর গান, না অদ্বৈত?” অদ্বৈতের গলায় জেদ ঝরে পড়ল, “যা-ই হোক, আমরা থামব না।” তারা নদীর বুকে এগিয়ে চলল, আর নদীর সঙ্গীত যেন আরও গভীর আর বেদনাময় হয়ে উঠল। স্রোত তীব্র হতে থাকল, আর নৌকা দুলতে শুরু করল নদীর ঢেউয়ের তালে। সেই সুর যেন তাদের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল, আর প্রত্যেকের মনে এক অজানা শঙ্কা জন্মাল।
দুপুরের দিকে নদীর দুই পাড় ঘন অরণ্যে ঢেকে গেল, আর সূর্যের আলো নদীর বুকে পড়ে অদ্ভুত সোনালি-ধূসর ছায়া তৈরি করল। সেই ছায়ার মধ্যে দিয়ে তারা দেখতে পেল দূরের এক বালুচর, যেখানে নদীর জলে চাঁদের মতো আলো ঝলমল করছিল। শিবু বলল, “ওই দেখো, ওই তো সোনার নদী!” কিন্তু কৃষ্ণ বলল, “না, এটা মায়া, প্রকৃতির খেলা।” লালু তবু নৌকা বালুচরের দিকে চালাতে লাগল। হঠাৎই নদীর গান যেন থেমে গেল, আর বাতাস নিস্তব্ধ হয়ে গেল। চারপাশে নেমে এল এক ভয়ানক নীরবতা, যা নদীর সঙ্গীতের থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর মনে হল। নৌকা বালুচরের কাছে এসে থামল, আর তারা নামল বালুর চরে। বালু নরম আর সোনালি রঙের, যা সূর্যের আলোয় চকচক করছিল, কিন্তু স্পর্শে বোঝা গেল সোনা নয়, মাটি মাত্র।
রাত নামার আগে নদীর গান আবার ভেসে এল দূরের অন্ধকার থেকে। এবার সেই সুরে কেবল আহ্বান নয়, ছিল এক অজানা হুমকি। অদ্বৈত চুপ করে বসে থাকল বালুচরের মাটিতে, আর ভাবল, নদীর এই গান কি তাদের আরও গভীর বিপদের দিকে টেনে নিচ্ছে? নাকি সোনার নদীর রহস্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে? রাতের আঁধারে নদী আবারও বয়ে চলল, আর সেই সুর যেন তাদের স্বপ্নেও ভেসে এল, নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে তাদের অন্তরকে নাড়া দিয়ে গেল।
অধ্যায় ৬:
বালুচরের সোনালি মাটিতে দাঁড়িয়ে অদ্বৈত আর তার সঙ্গীরা যেন এক আশ্চর্য জগতে এসে পৌঁছেছিল। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু নদীর নরম ঢেউ বালুচরের কিনারায় আছড়ে পড়ছিল। দূরের অরণ্য অন্ধকারের চাদরে ঢাকা পড়তে শুরু করেছিল, আর আকাশে সূর্যের শেষ আলো ম্লান হয়ে গিয়েছিল। বালুচরের মাটি নরম আর চকচকে হলেও তা স্পর্শ করলেই বোঝা যাচ্ছিল, এটা সোনা নয়, কেবল সূর্যের আলোর প্রতিফলন। লালু হতাশ হয়ে বলল, “সবই ধোঁকা! এতদূর এসে কি আমরা কিছুই পাব না?” অদ্বৈত গম্ভীর গলায় বলল, “ধৈর্য ধরো, রহস্য সবসময় চোখের সামনে থাকে না।” তারা বালুচরে পা ফেলতে ফেলতে এগোতে থাকল, আর হঠাৎ শিবু মাটিতে অদ্ভুত এক দাগ দেখতে পেল। সেই দাগগুলো ছিল বৃত্তাকারে আঁকা, যেন কেউ এই বালুচরে কোনো প্রাচীন চিহ্ন রেখে গেছে।
রাতের অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে বালুচরের রহস্যময়তা আরও বাড়তে থাকল। হালকা হাওয়ায় বালির কণাগুলো যেন নাচতে শুরু করল, আর তাদের চারপাশে এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল—মৃদু সিসকির মতো। কৃষ্ণ শিস দিয়ে বলল, “এটা কি নদীর গান, না অন্য কিছু?” চিনু মাটিতে বসে বালির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “দেখ, এই বালুতে কি লুকিয়ে আছে কিছু?” হঠাৎই তার আঙুলে ঠেকে গেল এক শক্ত বস্তু। অদ্বৈত তাড়াতাড়ি কাছে এসে সেই জায়গাটা খুঁড়তে শুরু করল। কিছুটা বালু সরাতেই বেরিয়ে এলো এক পুরনো পিতলের পাত্র, যার গায়ে খোদাই করা ছিল অজানা প্রতীক আর লতা-পাতার নকশা। সেই পাত্র খুলতেই দেখা গেল শুকনো মাটি আর কয়েকটি কালো পাথর। শিবু হতাশ গলায় বলল, “এও কি সোনার নদীর ইশারা?” অদ্বৈত পাত্রের গায়ের নকশা গভীর মনোযোগে দেখতে দেখতে বলল, “এই নকশায় লুকিয়ে আছে কোনো দিকনির্দেশ, আমরা খুঁজে বের করব।”
বালুচরের বুকে জোনাকিরা ছড়িয়ে পড়ল, আর সেই আলোয় রহস্যময় নকশাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। অদ্বৈত মাটিতে বসে সেই পাত্র আর প্রতীকগুলো বিশ্লেষণ করতে লাগল, আর লালু আর কৃষ্ণ চারপাশে নজর রেখে পাহারা দিতে লাগল। রাতের বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসছিল, আর দূরের জঙ্গল থেকে শোনা যাচ্ছিল বন্য জন্তুর ডাক। বালুচরের বালির নিচে কোথাও যেন নদীর স্রোতের গুঞ্জন লুকিয়ে ছিল, যা সেই রাতে আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। অদ্বৈত মনে মনে ভাবছিল, এই বালুচর শুধু নদীর মোহনা নয়, সোনার নদীর রহস্যের দ্বারও বটে। শিবু বলল, “আমরা কি রাতটা এখানে থাকব?” অদ্বৈত মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, এখানেই আছে সেই উত্তর, যা আমরা খুঁজছি।” তারা আগুন জ্বালিয়ে বসল বালুচরের এক প্রান্তে, আর নদীর ঢেউয়ের সাথে সেই অদ্ভুত সিসকির সুর মিশে এক ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করল।
ভোরের আলো ফোটার আগে বালুচরের বুকে হঠাৎ বাতাসের গতি বেড়ে গেল, আর বালুর কণা উড়তে উড়তে আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। সেই আলো-অন্ধকারে অদ্বৈত বুঝতে পারল, নদীর গান, বালুচরের প্রতীক আর সেই পিতলের পাত্র—সব মিলিয়ে এক নতুন রহস্যের দিকনির্দেশ করছে। সে সিদ্ধান্ত নিল, তারা এই বালুচর থেকে আরেকটু ভেতরে নদীর মূল স্রোতের দিকে এগোবে। সোনার নদীর গল্প কি নিছক মায়া? নাকি এই বালুচর সেই মায়ার প্রথম পর্দা? অদ্বৈতের চোখে তখন জেদ আর আশার ঝলক, আর সেই সঙ্গে প্রকৃতির গভীর রহস্য উদঘাটনের আকাঙ্ক্ষা।
অধ্যায় ৭:
ভোরের আলো আসার সঙ্গে সঙ্গে নদীর বুকে নতুন এক দৃশ্যের জন্ম হল। বালুচর পেরিয়ে তারা যখন নৌকায় উঠে নদীর মূল স্রোতের দিকে এগিয়ে চলল, তখন চারপাশের প্রকৃতি যেন এক নতুন রূপ ধারণ করল। নদীর জল ছিল ক্রমশ গাঢ় নীল, আর ঢেউগুলো অজানা ভাষায় তাদেরকে ডাকছিল। বাতাসে ভেসে আসছিল নদীর ভেজা মাটির গন্ধ, যা তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল, তারা কেবল সম্পদের জন্য নয়, বরং এক অজানা সত্যের খোঁজে নেমেছে। অদ্বৈতের চোখে তখন আগুনের মতো জেদ, আর সঙ্গীরা তার সেই জেদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নদীর বুকে ছুটছিল। নৌকা নদীর স্রোতের তালে দুলতে দুলতে যেন এক সুরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল, আর সেই সুরে ছিল নদীর প্রাচীন ইতিহাসের গুঞ্জন। শিবু কাঁপা গলায় বলল, “এই নদী যেন আমাদের কোথাও টেনে নিয়ে যাচ্ছে।” লালু জবাব দিল, “যেখানে গিয়ে হয়তো আমরা আর ফিরতে পারব না।”
নদীর স্রোত ধীরে ধীরে আরও বেগবান হতে লাগল। দুই পাড়ের অরণ্য ঘন হয়ে নদীর দিকেই ঝুঁকে পড়েছিল, আর সূর্যের আলোও ঢেউয়ের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছিল। অদ্বৈত নৌকার পাটাতনে দাঁড়িয়ে দূরের দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকল। সেখানে কোথাও এক বালুময় দ্বীপ চোখে পড়ল, যেটা নীল জলরাশির মধ্যে সোনার মতো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করছিল। কৃষ্ণ বলল, “ওই তো আমাদের গন্তব্য!” কিন্তু অদ্বৈত জানত, স্রোতের এই অদ্ভুত টান তাদের শুধু দ্বীপের দিকে নয়, আরও গভীর কোনো বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই নদীর স্রোত এমন বেগে বইতে শুরু করল যে নৌকা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে লাগল। ঢেউগুলো যেন একে একে নৌকার উপর আছড়ে পড়তে লাগল, আর সেই ঢেউয়ের তালে ভেসে এল সেই অজানা নারীকণ্ঠের গান। লালু চিৎকার করে বলল, “সাবধান! নদীর অভিশাপ!”
তারা প্রাণপণ চেষ্টা করল নৌকা সামলাতে, কিন্তু নদীর স্রোত এতটাই তীব্র হয়ে উঠল যে নৌকা তাদের ইচ্ছার বাইরে স্রোতের সঙ্গে ভেসে যেতে লাগল। চারপাশে জল আর ঢেউয়ের গর্জন ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। সেই গর্জনের মাঝে নদীর গান যেন মিশে এক ভয়ঙ্কর সুর তৈরি করল, যা তাদের মনের গভীরে আতঙ্কের সঞ্চার করল। শিবু আর চিনু নৌকার দড়ি আঁকড়ে ধরল, লালু দাঁড় টেনে নৌকাকে স্রোতের বাইরে আনার চেষ্টা করল, কিন্তু নদীর শক্তি মানুষের শক্তিকে তুচ্ছ করে দিল। হঠাৎই সেই সোনালি দ্বীপের সামনে পৌঁছে গেল নৌকা, আর নদীর স্রোত যেন হঠাৎ থেমে গেল। চারপাশের নিস্তব্ধতা এতটাই প্রকট হয়ে উঠল যে তারা নিজেদের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দও শুনতে পেল। অদ্বৈত নেমে পড়ল দ্বীপের বালুর বুকে, আর অনুভব করল সেই বালিতে লুকিয়ে আছে বহু যুগের গোপন কথা।
রাত ঘনিয়ে এলো, আর নদীর স্রোতের সেই ডাক যেন আরও গভীর হয়ে উঠল। দ্বীপের বালিতে বসে অদ্বৈত ভাবতে লাগল, নদী কেন তাদের এখানে নিয়ে এলো? সেই নারীকণ্ঠের গান কেন তাদের তাড়া করে চলেছে? নদীর স্রোত কি কেবল প্রাকৃতিক শক্তি, নাকি এতে লুকিয়ে আছে কোনো প্রাচীন অভিশাপের ইঙ্গিত? শিবু বলল, “আমরা কি এখানেই রাত কাটাব?” অদ্বৈত মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, এই দ্বীপেই হয়তো আছে সেই সোনার নদীর শেষ রহস্য।” তারা আগুন জ্বালিয়ে বসে পড়ল, আর নদীর ঢেউয়ের গর্জনের মাঝে আবার ভেসে এল সেই প্রাচীন সুর, যা তাদের স্বপ্নেও তাড়া করবে।
অধ্যায় ৮:
দ্বীপের নিস্তব্ধতা ভেদ করে রাতের অন্ধকারে নদীর ঢেউয়ের শব্দ যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। অদ্বৈত আর তার সঙ্গীরা আগুনের চারপাশে বসে সেই ঢেউয়ের গর্জনের মধ্যে এক অজানা শঙ্কা অনুভব করল। আকাশে মেঘের ছায়া চাঁদের আলোকে ঢেকে দিচ্ছিল, আর সেই অন্ধকার দ্বীপের রহস্যময়তাকে বাড়িয়ে তুলছিল আরও কয়েকগুণ। হঠাৎ বালির মধ্যে থেকে শোনা গেল এক অদ্ভুত ফিসফিসানি, যা যেন বালুর কণার মধ্য দিয়ে বয়ে আসছিল। লালু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “দেখছ অদ্বৈত? এই দ্বীপে কিছু আছে!” অদ্বৈত মাটিতে হাত বুলিয়ে সেই শব্দের উৎস খুঁজতে লাগল। বালির নিচ থেকে বেরিয়ে এলো এক ভাঙা মূর্তি, যার মুখ ছিল বিকৃত, আর চোখে যেন অভিশাপের ছায়া লেগে ছিল। শিবু হঠাৎ চিৎকার করে বলল, “এটা সেই নদীর অভিশপ্ত রক্ষক!” তাদের চারপাশের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠল, আর নদীর গর্জন মিলিয়ে গেল সেই ফিসফিসানির মধ্যে।
সকালের প্রথম আলোতে দ্বীপের আসল চেহারা উন্মোচিত হতে শুরু করল। বালির নিচে লুকিয়ে ছিল বহু প্রাচীন ভাঙা কাঠামো, পাথরের টুকরো আর অজানা ভাষায় খোদাই করা প্রতীক। অদ্বৈত সেই প্রতীকগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করতে লাগল, আর কৃষ্ণ বলল, “এ দ্বীপ কি তবে কোনো প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ?” লালু ঘোরের মধ্যে বলল, “তাহলে সোনার নদী কি এই দ্বীপের নিচেই?” শিবু দ্বীপের এক প্রান্তে গিয়ে দেখতে পেল এক প্রাচীন কূপের মতো গর্ত, যার মুখ বালিতে প্রায় ঢেকে গেছে। অদ্বৈত আর সবাই ছুটে গেল সেই কূপের কাছে। কূপের গা ঘেঁষে লতাপাতা আর মাটির স্তর সরিয়ে তারা দেখতে পেল সেই কূপের গায়েও খোদাই করা সেই অভিশপ্ত প্রতীক। অদ্বৈত বুঝতে পারল, দ্বীপ শুধু কোনো প্রাকৃতিক গঠন নয়, বরং এক প্রাচীন অভিশাপের নিদর্শন।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বীপের বাতাস গরম আর ভারী হতে লাগল। নদীর স্রোত যেন দ্বীপের চারপাশ ঘিরে এক অদৃশ্য ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করল। নৌকা নিরাপদ দূরত্বে বাঁধা থাকলেও ঢেউয়ের ধাক্কায় তা দুলতে লাগল। অদ্বৈত আর তার সঙ্গীরা কূপের ভেতর দেখল অন্ধকারে ঢেকে থাকা এক অজানা গভীরতা। লালু বলল, “আমরা কি তবে নামব এখানে?” অদ্বৈত কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “যা হোক না কেন, এই কূপই আমাদের উত্তর দেবে।” তারা রশি আর বেঁধে নামার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। সেই সময় দূরের অরণ্য থেকে ভেসে এলো সেই নারীকণ্ঠের গান, যা নদীর স্রোতের সাথে মিশে দ্বীপের বাতাসকে আরও আতঙ্কিত করে তুলল। শিবু কাঁপা গলায় বলল, “অদ্বৈত, আমরা কি ভুল করছি?” অদ্বৈতের চোখে তখন শুধুই জেদ আর সত্যের খোঁজের তৃষ্ণা।
সন্ধ্যা নামার সময় তারা কূপের মুখে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদের আলো নদীর জলে প্রতিফলিত হয়ে সোনার নদীর স্বপ্ন মনে করিয়ে দিচ্ছিল। সেই কূপের অন্ধকার যেন তাদের আহ্বান করছিল এক অনন্ত অজানার দিকে। অদ্বৈত প্রথমে রশি ধরে নামতে শুরু করল, তার পিছু পিছু নামল শিবু আর কৃষ্ণ। লালু আর চিনু ওপরে থেকে রশি সামলাতে লাগল। কূপের ভেতরের দেওয়ালে হাত বোলাতে বোলাতে অদ্বৈত অনুভব করল সেই প্রাচীন কালের স্পর্শ। নিচে নেমেই তারা অনুভব করল শীতল বাতাস আর অদ্ভুত গন্ধ, যা এক লুপ্ত কালের ইতিহাস বয়ে আনছিল। সেই মুহূর্তে তারা জানত না, এই কূপই তাদের নিয়ে যাবে সোনার নদীর আসল রহস্যের দ্বারপ্রান্তে।
অধ্যায় ৯:
কূপের ভেতর নামার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের অন্ধকার যেন আরও ঘন হয়ে উঠল। অদ্বৈত, শিবু আর কৃষ্ণ ধীরে ধীরে নিচে নামছিল রশি বেয়ে, আর ওপরে লালু আর চিনু রশি ধরে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল। কূপের দেওয়াল ছিল ভেজা আর শ্যাওলায় ঢাকা, আর মাঝে মাঝে হাত বোলানোর সময় তারা অনুভব করছিল কিছু অজানা খোদাই। অদ্বৈত হাতের স্পর্শে সেই খোদাইয়ের রেখাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিল, আর তার মনে হচ্ছিল, এই খোদাই কোনো মানচিত্রের মতো। বাতাসের ঠাণ্ডা আর সেই অজানা গন্ধ এক অদ্ভুত শিহরণ সৃষ্টি করছিল তাদের শরীরে। কূপের তলায় পৌঁছে অদ্বৈত মাটিতে নেমে চারপাশে হাতড়ে দেখতে লাগল। নিচের মাটি ছিল নরম, যেন বহু বছর ধরে মানুষের পা পড়েনি সেখানে। কূপের ভেতর ভেসে আসছিল নদীর জলের হালকা গুঞ্জন, আর সেই গুঞ্জনের সাথে মিশে যাচ্ছিল সেই নারীকণ্ঠের গান।
কূপের নিচে অদ্বৈত আর শিবু আবিষ্কার করল এক সরু সুড়ঙ্গের মুখ। সেই সুড়ঙ্গের দেওয়ালও ভেজা আর শ্যাওলায় ঢাকা ছিল। কৃষ্ণ টর্চের আলো ফেলে দেখল দেওয়ালের গায়ে আঁকা অজানা প্রতীক। অদ্বৈত সেই প্রতীকগুলো পরীক্ষা করে বলল, “এখানেই লুকিয়ে আছে সেই নদীর রহস্যের চাবিকাঠি।” সুড়ঙ্গের ভেতর পা ফেলতেই তারা টের পেল মাটি কাঁপছে, যেন নিচ থেকে কোনো শক্তি তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে সাড়া দিচ্ছে। শিবু শ্বাসরোধ করে বলল, “এই সুড়ঙ্গ কি সোজা নদীর দিকে নিয়ে যাবে?” অদ্বৈত মাথা নাড়ল, “হয়তো নদী, হয়তো সোনার নদীর সেই মূল উৎস।” তারা ধীরে ধীরে সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে পড়ল, আর পিছনে সেই কূপের মুখ এক অজানা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল।
সুড়ঙ্গের ভেতরে হেঁটে চলতে চলতে তারা অনুভব করল, প্রতিটি ধাপেই সময় যেন থেমে যাচ্ছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা আর সেই গানের সুরে মিলিয়ে এক প্রাচীন ইতিহাসের ছায়া যেন ভেসে উঠছিল তাদের মনে। দেওয়ালের নকশাগুলো ক্রমেই স্পষ্ট হতে শুরু করল, আর সেই নকশায় দেখা গেল নদীর ছবি, জাহাজের প্রতীক আর কিছু অজানা প্রাণীর চিহ্ন। অদ্বৈত বোঝার চেষ্টা করছিল, এই প্রতীকগুলো কী গল্প বলছে। হঠাৎ সুড়ঙ্গের এক প্রান্তে এসে তারা দেখতে পেল এক বিশাল পাথরের দরজা, যার গায়ে খোদাই করা ছিল সেই অভিশপ্ত নারীর মুখচ্ছবি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অদ্বৈত বলল, “এই দরজার ওপারেই হয়তো লুকিয়ে আছে সোনার নদীর আসল রহস্য।” শিবু আর কৃষ্ণ দরজার দিকে হাত বাড়াতেই দরজা অদ্ভুতভাবে নিজে থেকেই খুলতে শুরু করল, আর এক শীতল বাতাস বেরিয়ে এসে তাদের শিহরিত করে তুলল।
দরজা পেরিয়ে তারা প্রবেশ করল এক বিশাল গুহায়, যেখানে নদীর জল ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে। সেই জল সোনালি আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল টর্চের আলোতে। গুহার ভেতর দিয়ে নদীর সেই স্রোত বয়ে চলছিল এক অজানা গন্তব্যের দিকে। অদ্বৈত বিস্মিত হয়ে বলল, “এটাই তো সোনার নদী!” কিন্তু সেই নদীর জল স্পর্শ করতেই অদ্বৈতের মনে হল, যেন কোনো অজানা শক্তি তাকে টেনে নিচ্ছে। শিবু আর কৃষ্ণ তাড়াতাড়ি তাকে ধরে টেনে তুলল। নদীর ঢেউয়ে সেই নারীকণ্ঠের গান আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল, আর সেই গানে মিশে যাচ্ছিল গুহার প্রতিটি স্তম্ভের প্রতিধ্বনি। তারা বুঝতে পারল, এই নদী কেবল সম্পদের প্রতীক নয়, বরং এক প্রাচীন অভিশাপ আর রহস্যের পাথেয়, যা তাদের ভাগ্য চিরকাল বদলে দেবে।
অধ্যায় ১০:
গুহার সেই সোনালি নদীর সামনে দাঁড়িয়ে অদ্বৈত, শিবু আর কৃষ্ণ নিজেদের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল স্পষ্টভাবে। গুহার ছাদ থেকে জলের ফোঁটা পড়ছিল নদীর বুকে, আর সেই ফোঁটার আওয়াজ যেন আরও গম্ভীর হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। অদ্বৈত নদীর জল স্পর্শ করে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে এই নদীর আসল সত্য জানতে পারবেই। শিবু বলল, “এ নদী আমাদের ডেকে আনছে, কিন্তু তার শেষ কোথায়?” কৃষ্ণ টর্চের আলো ফেলে দেখতে পেল নদীর ওপারে এক সরু পাথরের সেতু, যা গুহার অন্য প্রান্তে হারিয়ে যাচ্ছে। অদ্বৈত সাহস করে সেই সেতুর দিকে এগিয়ে গেল, পেছনে শিবু আর কৃষ্ণও তার সঙ্গে হাঁটল। সেতুর নিচ দিয়ে সোনালি জলের ঢেউ বয়ে চলছিল, আর ঢেউয়ের শব্দে যেন নদীর অতীত ইতিহাস ভেসে আসছিল মনে।
সেতু পার হয়ে তারা পৌঁছাল গুহার এক বিশাল প্রকোষ্ঠে। সেখানে নদী মিশে যাচ্ছিল এক গহ্বরের মধ্যে, আর সেই গহ্বরের মুখে খোদাই করা ছিল সেই অভিশপ্ত নারীর ছবি, যাকে ঘিরে এতকাল গল্প শোনা গেছে সুন্দরবনের গ্রামে গ্রামে। অদ্বৈত সেই খোদাইয়ের উপর হাত বোলাতে বোলাতে অনুভব করল এক শীতল স্রোত, যা তার শিরায় শিরায় কাঁপন ধরিয়ে দিল। শিবু ভয়ে ফিসফিস করে বলল, “এই নদী কি আসলে মৃত্যু ডেকে আনে?” কৃষ্ণ উত্তর দিল, “হয়তো, বা হয়তো মুক্তি।” গুহার সেই গহ্বরের ভেতর থেকে এক অজানা আলো বেরিয়ে আসছিল, যা সোনালি নদীর জলে মিশে এক অদ্ভুত দীপ্তি তৈরি করছিল। তারা বুঝল, সেই আলো আর নদী মিলে তৈরি করছে এক প্রাচীন শক্তির প্রবাহ, যা বহু যুগ ধরে লুকিয়ে আছে এই অজানা জগতের অন্তরালে।
অদ্বৈত সাহস করে গহ্বরের মুখের দিকে এগোল। সেই মুহূর্তে নদীর স্রোত হঠাৎ বেগবান হয়ে উঠল, আর সেই নারীকণ্ঠের গান এত স্পষ্ট হয়ে উঠল যে মনে হল, নদী যেন কথা বলছে তাদের সঙ্গে। “ফিরে যাও… ফিরলে বাঁচবে…,” সেই সুর বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল গুহার প্রতিটি কোণে। শিবু আর কৃষ্ণ থমকে দাঁড়াল, কিন্তু অদ্বৈত সামনে এগোল। তার মনে হচ্ছিল, সে যদি একবার নদীর মূল উৎসে পৌঁছাতে পারে, তাহলে হয়তো সে সেই অভিশাপ ভাঙতে পারবে। গহ্বরের মুখে দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেল নদীর জল সেখানে এক বৃত্তাকারে ঘুরছে, আর সেই বৃত্তের মাঝখানে ভেসে আছে এক সোনালি মূর্তি, যা হয়তো সেই নদীর দেবীর প্রতীক। অদ্বৈত হাত বাড়াল সেই মূর্তির দিকে, কিন্তু মুহূর্তেই নদীর স্রোত তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে শিবু আর কৃষ্ণ ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ধরে ফেলল। তিনজনের সেই লড়াই যেন নদীর শক্তির সঙ্গে মানুষের লড়াই হয়ে উঠল।
শেষমেশ তারা একসঙ্গে নদীর তীরে ফিরে এলো। সেই নারীকণ্ঠের গান মিলিয়ে গেল দূরের স্রোতে। অদ্বৈত মূর্তির দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে বুঝল, নদী তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, কারণ সেই নদীর রহস্য আর অভিশাপ মিলেমিশে এক অমোঘ সত্য হয়ে আছে চিরকাল। গুহা থেকে বেরিয়ে তারা দেখল আকাশ ফেটে আলো বেরিয়েছে, আর নদীর স্রোত শান্ত হয়ে গেছে। সেই সোনালি নদী তাদের মনে রয়ে গেল এক স্বপ্নের মতো, যা তারা স্পর্শ করতে পারল না, কিন্তু যেটা চিরকাল তাদের অন্তরে বাজতে থাকবে। সুন্দরবনের সেই গহীন নদীর বুকে তারা ফিরে চলল, মনে ভরে গেল সাহস, লোভ আর প্রকৃতির শক্তির এক অভিজ্ঞতায়। সোনার নদী তাদের জীবন বদলে দিল চিরদিনের জন্য।
-**-




