১
শহরের সেই দিনটি ছিল অদ্ভুত নীরবতায় ভরা। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছিল, চারপাশে যেন অচেনা অন্ধকার ঘনিয়ে উঠছিল। শশাঙ্ক তার ছোট্ট দর্জির দোকানে বসে সুঁই-সুতোর কাজে ডুবে ছিল, জানালার কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিল, আর মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি বাইরে ভৌতিক আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল। দোকানের চারদিকে কাপড়ের গন্ধ, কেটে রাখা কাপড়ের স্তূপ আর এক কোণে পুরোনো সেলাই মেশিনের শব্দ যেন একঘেয়েমির সুর তুলেছিল। হঠাৎ করেই দরজার ঘণ্টা টুং করে বাজল, আর শশাঙ্ক তাকিয়ে দেখল—এক অচেনা বয়স্কা মহিলা দোকানে প্রবেশ করছেন। তিনি লম্বা গড়নের, শরীর শুকনো, কিন্তু মুখে এমন এক দৃঢ়তা আর শীতলতা ছিল, যা প্রথম দর্শনেই ভয়ের স্রোত বইয়ে দিল। ভিজে যাওয়া শালের ভেতর থেকে তিনি এক লাল রঙের শাড়ি বের করলেন। শাড়িটা ছিল একেবারেই অন্যরকম—গাঢ় লালের ওপর সোনালি কারুকাজ, এত সূক্ষ্ম নকশা যে চোখ আটকে যায়। তবু, শাড়ির দিকে তাকালে শশাঙ্ক অনুভব করল বুকের ভেতর যেন হঠাৎ একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল, অস্বস্তি তৈরি হল। মহিলা ধীরে, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন—“এটা ঠিক করে দিন, নকশাটা যেন নষ্ট না হয়।” তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, যা আদেশের মতো শোনাল, অনুরোধ নয়।
শশাঙ্ক শাড়ি হাতে নিয়ে অবাক দৃষ্টিতে দেখল, কাপড়টা যেন অস্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা, যদিও দোকানের ভেতর গরম আর আর্দ্রতায় ভরা। সে চেষ্টা করল কথোপকথন শুরু করতে—“আপনি কোথা থেকে এলেন? এত সুন্দর কাপড় তো এখানে পাওয়া যায় না।” কিন্তু মহিলা শুধু একটি হালকা হাসি দিয়ে চুপ করে রইলেন। তার চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক, যেন অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আলোর মতো ছায়া ভেসে যাচ্ছে। শশাঙ্কের মনে হচ্ছিল, তিনি যেন দোকানে উপস্থিত আছেন অথচ সম্পূর্ণভাবে নেইও। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দোকানের ভেতর যেন এক চাপা নীরবতা তৈরি হল, সুঁই-সুতোর কাজও ধীরে থেমে গেল। অনিমেষ, দোকানের শিক্ষানবিশ, একবার তাকিয়ে মহিলাকে দেখে ভয়ে সরে গেল, যেন কোনও অজানা আতঙ্ক তার চোখে নেমে এসেছে। শশাঙ্ক আবার বলল—“কখন এসে নেবেন? কাল, না পরশু?” মহিলা এবার মাথা নেড়ে শুধু বললেন—“সময় এলে আমি নিজেই আসব।” সেই কথার মধ্যে এমন এক অস্পষ্টতা ছিল, যা শশাঙ্ককে আরও অস্থির করে তুলল। তিনি কোনও নাম বললেন না, কোনও ঠিকানা দিলেন না, কেবল শাড়িটা দিয়ে নীরবে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
দরজার ঘণ্টা আবার বাজল, আর বৃষ্টির ভেতর দিয়ে তিনি হারিয়ে গেলেন। শশাঙ্ক দৌড়ে জানালার ধারে গিয়ে দেখল, বাইরে কেবল কুয়াশা আর জলছাপ, মহিলার কোনও ছায়াও নেই। যেন তিনি কখনও এসেই ছিলেন না। দোকানে ফিরে এসে শাড়িটার দিকে তাকাতেই আবার বুকের ভেতর সেই শীতল স্রোত বয়ে গেল। সোনালি নকশাগুলো বিদ্যুতের আলোয় এক মুহূর্তের জন্য যেন নড়েচড়ে উঠল, যেন জীবন্ত। শশাঙ্ক চোখ মুছে আবার তাকাল—না, কিছুই নেই। কিন্তু মনের ভেতর সেই আতঙ্ক জমাট বাঁধতে শুরু করল। অনিমেষ ভয়ে ফিসফিস করে বলল—“দাদা, ওই মহিলার চোখে আমি যা দেখেছি, তা মানুষের চোখ নয়।” শশাঙ্ক কিছু বলল না, শুধু শাড়িটাকে ভাঁজ করে রাখল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে জানল—আজকের দিনটা তার জীবনে এক অদ্ভুত অন্ধকারের দরজা খুলে দিয়েছে। কে ছিল সেই মহিলা, কোথা থেকে এলেন, আর শাড়ির ভেতর লুকিয়ে আছে কোন গোপন রহস্য—তা তখনও কেউ জানত না, কিন্তু দোকানের চারপাশে যে ভৌতিক নিস্তব্ধতা নেমে এলো, তাতে শশাঙ্ক বুঝতে পারল—এ কেবল শুরু।
২
শাড়িটি দোকানের কোণে কাপড়ের স্তূপের ওপরে ভাঁজ করে রাখা ছিল, কিন্তু সেটি যেন নিজের উপস্থিতি বারবার জানান দিচ্ছিল। শশাঙ্ক প্রতিদিন দোকান খোলার সময় একবার সেই শাড়ির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যেত। কারুকাজ এত সূক্ষ্ম, সুতোগুলো এত নিখুঁতভাবে বোনা যে চোখ সরানো যায় না। তবে মায়া, শশাঙ্কের স্ত্রী, একেবারেই অন্যরকম অনুভব করছিলেন। তিনি প্রতিবার দোকানে গিয়ে দেখতেন, শাড়িটা যেন তাকিয়ে আছে, যেন শীতল স্রোত বইয়ে দিচ্ছে। এক রাতে তিনি শশাঙ্ককে বলেছিলেন—“শাড়িটা দোকান থেকে সরিয়ে ফেলো, ওটা এখানে রাখা ঠিক নয়।” শশাঙ্ক তখন হাসতে হাসতে বলেছিল, “তুমি অকারণে ভয় পাচ্ছ, কাপড় ছাড়া আর কিছুই তো নয়।” কিন্তু মায়া অনুভব করছিলেন, শাড়ির ভেতর লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত অশুভ উপস্থিতি। দোকানের ভেতরে বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছিল, আলো নিভু নিভু করত, আর অকারণে দেয়ালে ছায়া পড়ত। মায়া যতবার শাড়ির কাছে যেতেন, বুক ধড়ফড় করত, যেন কেউ অদৃশ্যভাবে তাকে দেখছে।
অনিমেষ, দোকানের শিক্ষানবিশ, ছিল কৌতূহলী স্বভাবের ছেলে। তার বয়স কম, তাই ভয় পাওয়ার বদলে অচেনা জিনিস তাকে টানত। এক বিকেলে শশাঙ্ক গ্রাহকের সঙ্গে ব্যস্ত, মায়া বাড়ি ফিরে গেছে, দোকানে শুধু অনিমেষ আর সেই লাল শাড়ি। বাইরের আকাশ কালো হয়ে এল, মেঘ গর্জন করছিল। হঠাৎ যেন শাড়ির ঝুমকির অংশটা আলোতে ঝিলমিল করে উঠল। অনিমেষ অবাক হয়ে এগিয়ে গেল, হাত বাড়াল, আর কাপড়টা ছুঁতেই তার শরীর কেঁপে উঠল। শাড়িটা ছিল বরফের মতো ঠান্ডা, অথচ ঘরের ভেতর ঘাম ঝরানো গরম। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো, কাপড়ের ভেতর যেন কারও ধুকপুক করা হৃদস্পন্দন লুকিয়ে আছে। সে ভয়ে হাত সরিয়ে নিলেও, কৌতূহল তাকে ছাড়ল না। একটু পর আবার ছুঁয়ে দেখল, আর এবার স্পষ্টভাবে অনুভব করল যেন শাড়ি ভেতর থেকে নিশ্বাস ফেলছে। সেদিন রাতে অনিমেষ ঘুমোতে পারেনি। ঘরের অন্ধকারে চোখ বন্ধ করলেই লাল রঙের ঝলকানি দেখতে পাচ্ছিল, আর জানালার বাইরে থেকে ভেসে আসছিল পায়ের শব্দ। সে চোখ খুলে দেখল, দেয়ালে এক লম্বা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে—একজন শাড়ি পরা নারী, যার মুখ দেখা যাচ্ছে না।
ভোর হওয়ার আগেই অনিমেষ দৌড়ে শশাঙ্কের বাড়িতে গিয়ে সব বলল। শশাঙ্ক প্রথমে তাকে বকাঝকা করে বলল—“তুই হ্যালুসিনেশন করেছিস।” কিন্তু মায়া ভেতরে ভেতরে ভয়ে কেঁপে উঠলেন, কারণ তিনিও আগের রাতে স্বপ্নে একই রকম এক নারীকে দেখেছেন—আগুনের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা লাল শাড়ি পরা এক মুখবিহীন ছায়া। শশাঙ্ক যদিও বিষয়টাকে অস্বীকার করে, তবু সেদিন দোকান খোলার সময় অদ্ভুত অস্বস্তি টের পেলেন। তিনি যখন সেলাই মেশিনে কাজ করছিলেন, তখন বারবার মনে হচ্ছিল যেন কেউ পেছন থেকে তাকিয়ে আছে। তিনি ঘুরে তাকালেন, দেখলেন—দোকানের কোণে শাড়িটা ঠিকঠাক ভাঁজ করা আছে, কিন্তু সোনালি নকশাগুলোতে যেন অদ্ভুত নড়াচড়া হচ্ছে। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল ছাদে, কিন্তু দোকানের ভেতর বাতাস নিস্তব্ধ। সেই অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল সবার মধ্যে। মায়া দোকানে এসে চুপচাপ শাড়িটার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন—“এটা আর কাপড় নেই, এটা কিছু অন্য জিনিস।” অনিমেষ ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও, ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিল—সে এখন এমন এক অভিশপ্ত খেলায় পা দিয়েছে, যেখান থেকে আর ফেরার পথ নেই। শাড়ি দোকানে পড়ে ছিল, কিন্তু তার অদৃশ্য প্রতীক্ষা যেন ক্রমেই ঘন হয়ে উঠছিল—কাকে বেছে নেবে, আর কাকে গ্রাস করবে, তা হয়তো সময়ই বলবে।
৩
রত্না দেবী ছিলেন শহরের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী পরিবারের গৃহিণী। তার সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের জন্য তিনি সমাজে পরিচিত ছিলেন, সবসময় দামি গহনা ও বিরল পোশাক পরতেন। একদিন তিনি শশাঙ্কের দোকানে এলেন নতুন শাড়ি খুঁজতে। দোকানের আলমারিতে ভাঁজ করে রাখা লাল শাড়িটি তার চোখে পড়তেই তিনি যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন। মায়া তখন দোকানে ছিলেন, তিনি শাড়ি দিতে দ্বিধা করছিলেন, কিন্তু রত্না দেবীর অনুরোধে শশাঙ্ক শাড়িটি হাতে তুলে দিলেন। কাপড়ের গাঢ় লাল আর সোনালি কারুকাজ রত্না দেবীকে এতটাই টেনেছিল যে তিনি আর অন্য কোনো শাড়ির দিকে তাকালেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দাম দিয়ে শাড়িটি কিনে নিলেন, বললেন—“এমন শাড়ি আমি জীবনে দেখিনি, আমার আগামী পূজার অনুষ্ঠানে আমি এটা পরব।” তার কথার ভেতর গর্বের সুর থাকলেও মায়ার বুকের ভেতর হঠাৎ অকারণ ভয় ঢুকে গেল। শাড়ি নিয়ে চলে যাওয়ার পর দোকানের ভেতর নেমে এলো চাপা নিস্তব্ধতা। অনিমেষ ধীরে ফিসফিস করে বলল—“ও শাড়ি কারও গায়ে যাওয়া উচিত হয়নি।” কিন্তু শশাঙ্ক মুখ বুজে রইলেন, কারণ তিনি জানতেন, একবার কাপড় বিক্রি হয়ে গেলে তা আর ফেরানো সম্ভব নয়।
প্রথম কয়েক দিন সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। রত্না দেবী সেই শাড়ি নিয়ে গর্ব করে সবার কাছে দেখাতেন, অতিথিদের সামনে বের করে আনতেন, আঙুল বুলিয়ে বলতেন—“এমন শাড়ি শুধু আমার মতো মানুষদেরই মানায়।” কিন্তু খুব শিগগিরই অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল। প্রথমে তার ঘরের আয়না বারবার ফেটে যাচ্ছিল। তারপর রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠে তিনি দেখতেন, আলমারির ভেতর থেকে লাল আলো ছড়িয়ে পড়ছে। চাকরানীরা বলত, রত্না দেবীর ঘরে রাতে এক অচেনা নারীর গলার স্বর শোনা যায়, কানে ফিসফিস করে কেউ যেন বলে—“এটা আমার… ফেরত দাও…”। কিন্তু এসবকে তিনি পাত্তা দেননি, মনে করলেন কেউ হয়তো ঈর্ষা করছে। তবে তার আচরণ বদলাতে শুরু করল। আগের মতো উচ্ছ্বসিত নয়, তিনি ক্রমশ নিরব হয়ে গেলেন। চোখের নিচে কালি জমল, খাওয়া-দাওয়া কমে গেল। এক রাতে চাকরানী দেখল, তিনি ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে শাড়ি পরে নিজেকেই চিৎকার করে বলছেন—“এটা আমার নয়… আমার নয়… তবু কেন ছাড়তে পারছি না!” সকাল হলে দেখা গেল, আয়নার কাঁচে লম্বা আঁচড়ের দাগ, যেন নখ দিয়ে কেউ আঁচড় কেটেছে। তার স্বামী ডাক্তার ডাকলেন, কিন্তু রত্না দেবী সবার সামনে হাসিমুখে বললেন—“আমি একদম ভালো আছি।” অথচ ভেতরে ভেতরে তিনি ভয়ঙ্কর আতঙ্কে ডুবে যাচ্ছিলেন।
অবশেষে সেই অমঙ্গল দিন এলো। পূজার অনুষ্ঠানে রত্না দেবী লাল শাড়ি পরে বেরোলেন। অতিথিদের ভিড়ে তিনি একেবারে আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন, সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু হঠাৎ তিনি থমকে দাঁড়ালেন, তার চোখ ফাঁকা হয়ে গেল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল। তিনি হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল শক্ত করে ধরে ফেললেন, যেন কেউ তা টানছে। চারদিকে হৈচৈ শুরু হল। তিনি হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। সবাই ছুটে গেলেন সাহায্য করতে, কিন্তু রত্না দেবীর মুখ থেকে তখন বের হলো এক ভয়ঙ্কর শেষ বাক্য—“এই শাড়ি যেন কেউ না পরে…”। তারপর তার নিঃশ্বাস থেমে গেল। ডাক্তাররা পরে বললেন, হঠাৎ হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে গেছে, কিন্তু যারা ঘটনাস্থলে ছিলেন তারা জানতেন, সেটা সাধারণ মৃত্যু নয়। তার চোখ খোলা ছিল, তাতে এমন আতঙ্ক জমে ছিল যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শাড়িটা তখনও তার দেহে জড়িয়ে ছিল, তবে সোনালি কারুকাজগুলো আর ঝলমল করছিল না, বরং নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। খবর শহরে ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু শশাঙ্কের দোকানের কথা কেউ জানল না। শুধু মায়া আর অনিমেষ জানত, এটাই ছিল অভিশপ্ত শাড়ির প্রথম মৃত্যু, আর এটা কেবল শুরু।
৪
বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে ভিজে থাকা শহরটিতে হঠাৎই যেন অদ্ভুত এক স্রোত বয়ে যেতে শুরু করল—রত্না দেবীর অকাল মৃত্যু আর তার শেষ বাক্যটি মানুষকে কাঁপিয়ে তুলল ভেতর থেকে। বাজারের আড্ডা, চায়ের দোকানের খালি চেয়ারে জমে ওঠা আলাপ, এমনকি অলস দুপুরে পাড়ার মহিলাদের কুলুপ ভাঙা কথাবার্তা—সব জায়গাতেই এখন ঘুরছে সেই এক গল্প, অভিশপ্ত লাল শাড়ির গল্প। কেউ বলছে, শাড়ির কাপড়ে নাকি রক্তের দাগ লুকোনো আছে, কেউ দাবি করছে, বয়স্কা মহিলাটিই নাকি ছিল কোনো তান্ত্রিকের আত্মা। গোপন গোপন ভয় মানুষের মধ্যে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল, যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে থাকা ধোঁয়া—দৃশ্যমান নয়, কিন্তু গলায় ঢুকে দম বন্ধ করে দিচ্ছে। শশাঙ্ক প্রতিদিন তার দোকানে বসে শুনতে পান গ্রাহকদের চাপা ফিসফাস, দেখতে পান তাদের কৌতূহলী অথচ ভীতসন্ত্রস্ত চোখ। কেউ আর শাড়ি ছুঁয়ে দেখতে সাহস পায় না, বরং পাশ কাটিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। শশাঙ্ক বারবার নিজেকে বোঝান—সবই কাকতালীয়, মানুষের কল্পনা মাত্র। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বুকের গভীরে এক ঠাণ্ডা স্রোত বইতে থাকে, যেটাকে অস্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে মায়ার অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে শুরু করল। প্রথমে তিনি শাড়ির দিকে তাকালেই অস্বস্তি অনুভব করতেন, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই অস্বস্তি দুঃস্বপ্নে রূপ নিতে লাগল। রাতের বেলায় তিনি জেগে ওঠেন হঠাৎই, ঘামে ভিজে সারা শরীর, আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে আগুনে মোড়ানো এক নারীর ছায়া। সেই নারীর মুখ অস্পষ্ট, কিন্তু চোখদুটো যেন ছাইয়ের ভেতর থেকে জ্বলে ওঠা লাল অঙ্গারের মতো—তীব্র, নির্মম, আর অচেনা ঘৃণায় পূর্ণ। মায়া বারবার শশাঙ্ককে বলেন এই স্বপ্নের কথা, কিন্তু শশাঙ্ক তাকে সান্ত্বনা দেন—“এ সবই তোমার মনের খেলা, এত ভেবো না।” অথচ তিনি নিজেও একা থাকলে শুনতে পান ঝুমকির ক্ষীণ আওয়াজ, যা শাড়ির কুঁচির ভেতর থেকে যেন ভেসে আসছে। সেই শব্দ কখনও এত কাছে আসে যে মনে হয় কেউ পেছন থেকে হেঁটে যাচ্ছে, আবার কখনও এত দূরে যে মনে হয় বাতাসেই মিলিয়ে গেছে। দোকানের শিক্ষানবিশ অনিমেষও কিছু বলতে চায়, কিন্তু সে যেন সাহস করে না। কেবল তার চোখে শশাঙ্ক দেখেন এক অদ্ভুত আতঙ্ক—যেন সে ইতিমধ্যেই কোনো ভিন্ন জগতে ঢুকে পড়েছে।
সময় যত এগোয়, ভয় ততই গাঢ় হয়ে শহরের ওপর ছায়া ফেলতে থাকে। মানুষ শশাঙ্ককে এড়িয়ে চলতে শুরু করে, দোকান একসময় গ্রাহকে ভরে থাকলেও এখন সেখানে এক ধরনের নিস্তব্ধতা নেমে আসে। খদ্দেররা ফিসফিস করে শাড়ির গল্প বলে, কেউ আবার শশাঙ্কের পরিবারকেও সন্দেহের চোখে দেখে। মায়ার মনে হয়, শহরটা যেন আস্তে আস্তে শাড়ির ভেতরকার অভিশাপে গ্রাস হয়ে যাচ্ছে। রত্না দেবীর মৃত্যু ছিল কেবল শুরু—এই শাড়ি তার রক্তাক্ত পথচলা শুরু করেছে। শশাঙ্ক যুক্তির আশ্রয় নিতে চান, কিন্তু রাত গভীর হলে, নিস্তব্ধতার ভেতর সেই ঝুমকির আওয়াজ আর আগুনে মোড়া নারীর চোখ তাকে ঘিরে ধরতে থাকে। মনে হয়, লাল শাড়ি যেন শ্বাস নিচ্ছে—দোকানের অন্ধকার কোনায়, এক অদৃশ্য জীবন্ত উপস্থিতি হয়ে। আর ঠিক তখনই শশাঙ্ক উপলব্ধি করেন—এটা কেবল ভয় নয়, বরং আসন্ন বিপদের অশুভ ইঙ্গিত।
৫
তনুজা ছিল এক প্রাণোচ্ছল, আধুনিক মেয়ে—শহরের কলেজপড়ুয়া, যার পরিচিতদের মধ্যে তিনি ফ্যাশন সচেতনতা আর আভিজাত্যের জন্য আলাদা জায়গা করে নিয়েছিলেন। রঙিন পোশাক, আধুনিক গয়না, আর নতুন ধাঁচের সাজসজ্জা নিয়ে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রায়শই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠত। একদিন সে শশাঙ্কের দোকানে আসে এবং দেখতে পায় সেই কুখ্যাত লাল শাড়িটি। চারপাশের লোকেরা চাপা স্বরে ফিসফিস করে সতর্ক করলেও, তনুজা তাদের একেবারেই পাত্তা দেয়নি। তার চোখে শাড়ির অদ্ভুত কারুকাজ যেন এক অচেনা মোহ ছড়িয়ে দিল—কাপড়ের গায়ে সূক্ষ্ম নকশার সুতোর টান যেন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, আর রক্তিম লাল রঙ তাকে মুগ্ধ করে তোলে। সে শাড়িটি স্রেফ কিনে নেয়নি, বরং দোকান থেকে ধার করে নিয়ে যায়—কারণ তার মনে হয়েছিল, সামনের সপ্তাহান্তে বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে এমন এক পোশাকই দরকার, যা তাকে সবার থেকে আলাদা করে তুলবে। শশাঙ্ক প্রথমে আপত্তি করলেও, শেষমেশ কিছু বলতে পারেননি। শুধু মনে হচ্ছিল, যেন নিজের হাত দিয়েই কাউকে আগুনের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
বিয়ের দিন সন্ধ্যায়, শহরের আলো ঝলমলে আসরে তনুজা প্রবেশ করে সেই লাল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে। সবাই যেন থমকে দাঁড়িয়ে তাকায়—শাড়ির রঙ এত গভীর, এত দপদপে যে চারপাশের আলো ম্লান হয়ে যায়। নারীরা কৌতূহল নিয়ে ফিসফিস করে, পুরুষদের চোখ আটকে যায় তার সাজের দিকে। তনুজা হাসিমুখে সবার প্রশংসা গ্রহণ করে, তার চোখে গর্বের ঝিলিক। কিন্তু তার দেহের অদৃশ্য ভেতরে তখন যেন অন্য কিছু ঘটছিল—কাপড়ের গায়ে অচেনা শীতলতা, মাঝে মাঝে হালকা কানে বাজতে থাকা ঝুমকির শব্দ, আর এক অদৃশ্য চাপা দমবন্ধ করা অনুভূতি। যদিও বাইরের কেউ তা টের পায়নি, তনুজা ভেতরে ভেতরে অস্থির হতে থাকে। সে বারবার হাত দিয়ে আঁচলটা সামলানোর চেষ্টা করছিল, যেন কাপড়টা নিজের ইচ্ছায় নড়ছে। কিন্তু অতিথিদের হাসি, গান, আর ঢাকঢোলের শব্দের ভিড়ে তার অস্বস্তির আভাস কেউ বুঝতে পারেনি। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর তনুজা বাড়ি ফেরে, আর সেই রাতেই ঘটল ভয়ঙ্কর ঘটনা—হঠাৎ তার ঘর থেকে চিৎকার শোনা যায়। প্রতিবেশীরা ছুটে এসে দেখে জানালার ফাঁক দিয়ে আগুনের লেলিহান শিখা ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, আগুনের উৎস কোথাও নেই—রান্নাঘর অক্ষত, বৈদ্যুতিক তার ঠিকঠাক, এমনকি মোমবাতি বা দেশলাই পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি। বরং তনুজার শরীর জ্বলছে, আর তার গায়ে আঁকড়ে ধরা সেই লাল শাড়ি নিজেই যেন আগুনে পরিণত হয়েছে।
পরদিন সকালে পুরো পাড়া স্তব্ধ হয়ে যায় এই মর্মান্তিক ঘটনায়। লোকেরা দলে দলে এসে দেখল—ঘরের ভেতর অর্ধেক জ্বলে যাওয়া আসবাব, পুড়ে যাওয়া দেওয়াল, আর ভস্মে পরিণত হওয়া এক তরুণীর দেহ। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের বিষয় ছিল, তনুজার দেহ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও শাড়ির কিছু অংশ অক্ষত থেকে গেছে। তার রঙ তখনও রক্তলাল, তার নকশা তখনও অদ্ভুতভাবে উজ্জ্বল, যেন আগুনের আঁচেও তাকে ছুঁতে পারেনি। প্রতিবেশীরা চাপা গলায় বলতে লাগল—এটা কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা নয়, শাড়িটা নিজেই আগুনের জন্ম দিয়েছে। কেউ কেউ দাবি করল, তারা নিজের চোখে দেখেছে—আগুন শুরু হওয়ার মুহূর্তে শাড়ির গায়ে ছায়ার মতো এক নারীর অবয়ব ভেসে উঠেছিল। শহরে ভয় আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল, রত্না দেবীর মৃত্যুর কথা মানুষ ভুলতে পারেনি, আর এখন তনুজার করুণ পরিণতি তাদের বিশ্বাসকে আরও শক্ত করল—এটা কেবল অভিশাপ, যার হাত থেকে বাঁচা অসম্ভব। শশাঙ্ক সেই খবর শুনে ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়লেন। তার দোকানের ভেতর লুকিয়ে থাকা শাড়ির জন্যই এ সব ঘটছে—এই উপলব্ধি যেন তাকে অসহায় করে তুলল। আর মায়া সেই রাতে আবার স্বপ্নে দেখলেন আগুনে মোড়া সেই নারীকে, যে এবার ফিসফিস করে বলছিল—“এটা কেবল শুরু…”
৬
ইনস্পেক্টর অজয় সেন ছিলেন শহরের এক অভিজ্ঞ ও কঠোর পুলিশ অফিসার। বয়স পঁয়ত্রিশের কোঠায়, গম্ভীর মুখ, সোজাসাপ্টা কথাবার্তা, আর যুক্তি দিয়ে সবকিছুর ব্যাখ্যা খোঁজার অভ্যাস তার চেহারার সঙ্গে যেন মিশে গিয়েছিল। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো তনুজার রহস্যময় মৃত্যুর তদন্তের, এবং প্রথম থেকেই তিনি বুঝে গেলেন—এটা কোনো সাধারণ অগ্নিকাণ্ড নয়। তনুজার ঘর পরিদর্শন করে তিনি লক্ষ করলেন, আগুনের কোনো প্রচলিত উৎস নেই—কোনো বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট নয়, রান্নাঘরে কোনো অসাবধানতা নয়, এমনকি দাহ্য পদার্থের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। অথচ একটি ঘরে ভেতর থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে একজন তরুণীকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। চারপাশের প্রতিবেশীরা একসঙ্গে প্রায় একই কথা বলছিল—“শাড়িটাই নিজে থেকে জ্বলে উঠেছিল।” অজয় প্রথমে বিরক্ত হয়ে উঠলেন, কারণ তিনি জানতেন মানুষের কল্পনা কতটা প্রবল হতে পারে। কিন্তু গভীরে কোথাও একটুখানি দ্বিধাও জন্ম নিচ্ছিল, কারণ প্রত্যেক সাক্ষী আলাদা হলেও তাদের বর্ণনা অদ্ভুতভাবে মিলে যাচ্ছিল। তিনি প্রমাণ খুঁজতে গিয়ে তনুজার দেহাবশেষ পরীক্ষা করলেন—চুল, চামড়া, পোশাক সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, কিন্তু লাল শাড়ির কয়েকটি অংশ প্রায় অক্ষত অবস্থায় পড়ে আছে। এই অস্বাভাবিক বিষয়টি তাকে শিহরিত করল, যদিও বাইরে থেকে তিনি গম্ভীর মুখে সহকর্মীদের কেবল লিখতে বললেন, “প্রমাণ হিসেবে সংগ্রহ করো।”
অজয়ের তদন্ত শুরু হলো মূলত গুজব ভাঙার উদ্দেশ্যে। তিনি স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেন এবং জানতে পারলেন, রত্না দেবীর মৃত্যুর সঙ্গেও সেই লাল শাড়ির যোগ রয়েছে। দুইটি মৃত্যু—একটি হঠাৎ শ্বাসরোধ হয়ে মারা যাওয়া গৃহিণী, আরেকটি আগুনে পুড়ে যাওয়া তরুণী—কীভাবে একই শাড়ির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে? যুক্তিবাদী মনের মানুষ হিসেবেই অজয় বুঝলেন, এখানে অবশ্যই কোনো অদৃশ্য ষড়যন্ত্র কাজ করছে। হয়তো কেউ ইচ্ছে করে শাড়িটিকে কেন্দ্র করে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে। হয়তো দর্জি শশাঙ্ক বা তার পরিবারের কোনো গোপন স্বার্থ আছে। কিন্তু আবার নিজের যুক্তিকে প্রশ্ন করতেও হলো—শশাঙ্ক কেন নিজে বিপদে পড়বেন? তখনই অজয় সরাসরি দর্জির দোকানে হাজির হলেন। শশাঙ্ক প্রথমে দ্বিধায় ভুগলেও শেষমেশ সব খুলে বললেন—কীভাবে বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় এক অচেনা বৃদ্ধা শাড়িটি সেলাইয়ের জন্য রেখে গিয়েছিল, আর তারপর আর ফিরে আসেনি। মায়ার দুঃস্বপ্নের কথা, অনিমেষের ছায়া দেখার কথা, সবই অজয়ের সামনে খুলে গেল। অজয় হাসি চেপে বললেন, “স্বপ্ন আর ছায়া দিয়ে কোনো প্রমাণ হয় না। আমাকে এই মহিলার খোঁজ এনে দিন, তাহলেই রহস্যের সমাধান হবে।” শশাঙ্ক অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “স্যার, তাকে তো আর কখনও দেখিনি…”
কিন্তু যুক্তি যতই কাজে লাগান না কেন, অজয়ের মনের মধ্যে এক অস্বস্তি জমতে শুরু করল। তিনি শাড়ির ইতিহাস খোঁজার জন্য স্থানীয় রেজিস্ট্রি অফিসে গেলেন, পুরোনো কেস ফাইল ঘাঁটলেন, এমনকি বাজারের প্রবীণ লোকদের সঙ্গে কথা বললেন। এক বৃদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী জানালেন, কয়েক দশক আগে শহরে নাকি এক তান্ত্রিক পরিবারের বাস ছিল, যারা লাল রঙের কাপড়কে রক্তবলির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করত। সে পরিবার হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায় এক ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডে। তাদের বাড়ির ভস্ম থেকে নাকি পাওয়া গিয়েছিল অর্ধেক জ্বলে যাওয়া এক লাল কাপড়, যার নকশা অদ্ভুতভাবে মিলছে আজকের সেই শাড়ির সঙ্গে। অজয় এই গল্পকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতে পারলেন না, কিন্তু তার যুক্তিবাদী মনেও হঠাৎ হালকা কাঁপুনি বয়ে গেল। রাতে বাড়ি ফিরে যখন সেই প্রমাণ হিসেবে রাখা শাড়ির টুকরোগুলো পরীক্ষা করছিলেন, হঠাৎই তিনি অনুভব করলেন যেন ঘরের ভেতরে কোথাও এক অচেনা ঝুমকির শব্দ বেজে উঠল। তিনি উঠে চারপাশ খুঁজলেন—কেউ নেই, কোনো কিছু নেই, শুধু নিস্তব্ধতা। কিন্তু শাড়ির টুকরোগুলোর লাল রঙ তখনও অদ্ভুতভাবে দীপ্ত হয়ে জ্বলছিল। অজয় সেন প্রথমবারের মতো নিজের যুক্তিবাদী বিশ্বাসকে প্রশ্ন করলেন—এই শাড়ি কি সত্যিই কেবল কাপড়, নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনো অচেনা অন্ধকার শক্তি?
৭
অজয় সেনের জন্য প্রতিটি তদন্তই ছিল যুক্তির ওপর দাঁড়ানো একটি সেতু—তথ্য, প্রমাণ, সাক্ষ্য এবং লজিক ছাড়া তিনি কিছুই বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু এবার সেই সেতুর তলায় প্রবল স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছিল অদ্ভুত কাহিনি, যা যুক্তির কাঠামোকে ভেঙে দিতে চাইছিল। কয়েকদিন ধরে তিনি পুরনো রেজিস্ট্রি অফিসে বসে ধুলো জমা কাগজপত্র ঘেঁটেছেন, ভাঙাচোরা ফাইলের পাতা উল্টেছেন। অবশেষে এক অচেনা নাম সামনে এলো—“শক্তিধর গোষ্ঠী”। এই নামটা প্রথম দেখেই তার মনে কাঁপুনি জাগাল। স্থানীয় ইতিহাসবিদদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পারলেন, শহরের প্রান্তে প্রায় শতবর্ষ আগে এক গোপন তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের বসতি ছিল। তারা দেবীর পূজা করত রক্তবলির মাধ্যমে, আর তাদের পূজার আসল প্রতীক ছিল লাল কাপড়—যার ওপর বিশেষ নকশা আঁকা হতো। সেই নকশা দেবীর ‘চক্ষু’ হিসেবে ধরা হতো, যার দিকে তাকালেই আত্মা কেঁপে উঠত। এক রাতে অগ্নিকাণ্ডে তাদের আস্তানা ধ্বংস হয়ে যায়, অনেকের মৃত্যু হয়, কিন্তু কারা বেঁচে গিয়েছিল তা আজও কেউ জানে না। অজয়ের সামনে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছিল—শাড়ির অদ্ভুত নকশাটা নিছক কারুকাজ নয়, বরং সেই হারিয়ে যাওয়া অভিশপ্ত গোষ্ঠীর চিহ্ন।
তিনি যত গভীরে খুঁজছিলেন, ততই রহস্য আরও অন্ধকার হয়ে উঠছিল। পুরনো সংবাদপত্রের কাটিংয়ে তিনি দেখলেন, অগ্নিকাণ্ডের কয়েকদিন আগে শহরে কয়েকজন মহিলার রহস্যময় মৃত্যু ঘটেছিল—সবাই লাল পোশাক পরা অবস্থায় মারা গিয়েছিল। আর সেই পোশাকের টুকরোগুলোও আগুনে টিকে ছিল। যেন লাল কাপড় আগুন শুষে নিয়েও বেঁচে থাকছে। অজয় এখন বুঝলেন, রত্না দেবী ও তনুজার মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং শতবর্ষ পুরনো অভিশাপেরই পুনরাবৃত্তি। কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেল—কে এই শাড়ি আবার শহরে ফিরিয়ে আনল? তখনই তার মনে পড়ল সেই রহস্যময় বৃদ্ধার কথা, যিনি শশাঙ্কের দোকানে শাড়িটি সেলাইয়ের জন্য দিয়েছিলেন। তিনি কি নিছক এক গ্রাহক ছিলেন, নাকি সত্যিই সেই গোষ্ঠীর শেষ উত্তরসূরি? যদি তাই হয়, তবে তিনি কি কেবল অভিশাপ ছড়িয়ে দিতে এসেছিলেন, নাকি কোনো অজানা উদ্দেশ্যে এই শহরে ফিরে এসেছেন? অজয়ের চোখের সামনে ইতিহাস আর বর্তমান একে অপরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, তিনি যেন এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের গভীরে ঢুকে পড়েছেন, যার শেষপ্রান্তে কী আছে তা তিনি জানেন না।
সেই রাতে বাড়ি ফেরার পর অজয় বসে বসে দলিলপত্রের কপি ঘাঁটছিলেন। ঘরের নিস্তব্ধতার মধ্যে তার মনে হচ্ছিল, যেন কেউ খুব কাছ থেকে তাকিয়ে আছে। জানালার বাইরে রাতের হাওয়া দুলছিল, কিন্তু অজয়ের বুকের ভেতর শিরশিরানি বেড়ে চলছিল। টেবিলে রাখা শাড়ির টুকরোটির দিকে তাকিয়ে তিনি হঠাৎই এক অদ্ভুত ভ্রমে পড়ে গেলেন—নকশার বাঁকানো রেখাগুলো যেন ধীরে ধীরে নড়ছে, জ্যান্ত চোখের মতো তার দিকে চেয়ে আছে। তিনি চোখ সরিয়ে নিতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। সেই মুহূর্তে তার কানে ভেসে এলো এক নারীকণ্ঠের মৃদু ফিসফিস—“আমরা শেষ হইনি… আমরা আবার ফিরব।” অজয় ঘামতে ঘামতে হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, বাতি জ্বালালেন, কিন্তু ঘর ছিল ফাঁকা। শুধু টেবিলে লাল কাপড়ের টুকরোটি তখনও অদ্ভুতভাবে দীপ্ত হয়ে জ্বলছিল। তিনি বুঝলেন, এবার তদন্ত আর কেবল যুক্তির সীমায় আটকে থাকবে না—এটা হয়ে উঠেছে এক যুদ্ধে নামার আহ্বান, যেখানে প্রতিপক্ষ কোনো মানুষ নয়, বরং শতবর্ষের অন্ধকার ইতিহাস থেকে উঠে আসা এক অদৃশ্য শক্তি।
৮
রাতটা ছিল ভীষণ অস্বাভাবিকভাবে নীরব। গ্রামের চারদিক অন্ধকারে ডুবে গেছে, কেবল দূরে শেয়ালের হাহাকার আর রাতপোকার ঝিঁঝিঁ শব্দ শোনা যাচ্ছিল। সেই রাতেই হঠাৎ খবর এলো—অনিমেষকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে দুপুরে দোকানে গিয়েছিল, তারপর থেকে আর ফিরে আসেনি। প্রথমে অনেকে ভেবেছিল হয়তো বন্ধুর বাড়ি বা কোথাও কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে, কিন্তু রাত গড়িয়েও তার দেখা না মেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। শশাঙ্ক দৌড়ে গেল দোকানের দিকে, আর অন্যদিকে মায়া ছুটলো উঠোনে। দোকানের ভেতরে ঢুকে শশাঙ্ক বুঝতে পারল কিছু একটা ভয়ংকর ঘটেছে—মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু পণ্যের বাক্স, একটা আয়না ফেটে গেছে, আর মেঝের ধুলোয় অস্পষ্টভাবে পায়ের ছাপ। সেই ছাপগুলো যেন হঠাৎ কোথাও মিলিয়ে গেছে, যেন মাঝ আকাশে মিলিয়ে গিয়েছে পদচিহ্নগুলো। শশাঙ্কের গলা শুকিয়ে এলো। ওদিকে মায়া অনুভব করছিল শরীরে এক অজানা চাপা যন্ত্রণা, বুকের ভেতর কেমন যেন আঁকড়ে ধরা ভয়ের ঠান্ডা হাত। ঠিক তখনই তার শরীরে দেখা গেল লম্বা আঁচড়ের দাগ—কারও নখ বা ধারালো কিছু দিয়ে করা, অথচ আশেপাশে কেউ নেই। তার চিৎকারে বাড়ির লোকজন ছুটে এলো। সবার চোখে আতঙ্ক, কানে শুধু শোনা যাচ্ছে ঘরের ভেতর থেকে আসা অদ্ভুত টোকা টোকা শব্দ, যেন কেউ দেয়ালে নখ দিয়ে ঘষে যাচ্ছে।
রাত গভীর হলে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে উঠল। দোকানের আয়নাটি হঠাৎ নিজে থেকেই আলো ছড়াতে লাগল। শশাঙ্ক দূর থেকে তাকিয়ে দেখল, আয়নার ভেতর এক লাল শাড়ি পরা নারী দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখদুটো রক্তলাল, ঠোঁটে অস্বাভাবিক হাসি, আর মুখ থেকে ঝরে পড়ছে ধোঁয়ার মতো শ্বাস। সে একবার তাকাতেই শশাঙ্কের বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরল, যেন হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসছে। আয়নার ভেতরকার নারী ধীরে ধীরে হাত বাড়াল, আর দোকানের ভেতরের বাতাস হিম হয়ে গেল। মেঝের কাগজপত্র উড়ে গিয়ে এক অদ্ভুত ঘূর্ণি তৈরি করল। মায়া দূরে থেকে দেখছিল সবকিছু—তার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে অদৃশ্য হাত দিয়ে। সেই নারীর প্রতিচ্ছবি থেকে কানে আসছিল শীতল ফিসফিসানি—”তোমাদের ঘর ছেড়ে দাও… নয়তো মৃত্যুই তোমাদের সঙ্গী হবে।” আশ্চর্যের বিষয়, বাইরের মানুষজন দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও আয়নায় সেই দৃশ্য কারও চোখে পড়ছিল না। কেবল শশাঙ্ক আর মায়াই দেখতে পাচ্ছিল সেই ভৌতিক প্রতিচ্ছবি। ভয় তাদের এমনভাবে চেপে ধরেছিল যে কণ্ঠে কোনও শব্দ আটকে যাচ্ছিল, যেন কেউ বুকের ওপর বসে তাদের শ্বাসরোধ করে দিচ্ছে।
পরের দিন ভোরের আলো ফুটতেই গ্রামের পরিবেশ আরও গুমোট হয়ে উঠল। অনিমেষের খোঁজ মেলেনি, তার গায়ের কাপড়খানাও কোথাও পাওয়া গেল না। গ্রামের বয়স্ক লোকেরা বলল, এ যেন মৃত্যুর ছায়া, যেটা একবার কারও ঘর আঁকড়ে ধরলে সহজে যায় না। মায়ার শরীরের আঁচড়গুলো আরও গাঢ় হয়ে উঠল, তার জ্বর এল এবং মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। আশ্চর্যের বিষয়, সে জ্ঞান ফিরে পেলেই বলছিল—”ওরা তাকিয়ে আছে, দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে।” শশাঙ্কের চোখে ঘুম নেই, মনের ভেতর ভয় আর অনিশ্চয়তা তাকে পাগলের মতো করে তুলছিল। দোকানে আর কেউ ঢুকতে চাইছিল না, কারণ রাতের পর রাত সেই আয়না থেকে শব্দ আসছিল—কখনও কর্কশ হাসি, কখনও আবার কান্নার শব্দ। গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক, লোকজন বলতে লাগল যে লাল শাড়ি পরা নারী আসলে এক অভিশপ্ত আত্মা, যে মৃত্যুর ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায় আর তার ছোঁয়ায় মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়। দিনভর মানুষজন মন্ত্র পড়তে লাগল, কেউ কেউ পণ্ডিত ডেকে আনার কথা বলল, কিন্তু রাত নামলেই চারপাশে অদ্ভুত হাহাকার ভর করত। শশাঙ্ক জানত, তাদের জীবনে এই ছায়া কেবল ভয় নয়, মৃত্যু হিসেবেই এসে ঘোরাঘুরি করছে—এক অদৃশ্য অভিশাপ, যেটা থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়।
৯
রাতটা যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল আসন্ন এক ভীষণ ঝড়ের মুখে। অনিমেষের নিখোঁজ হওয়ার পর শশাঙ্ক, মায়া আর অজয় বুঝে গিয়েছিল—শাড়িটাই সমস্ত অশুভ ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু। তাই তারা তিনজন মিলে এক জায়গায় বসে পরিকল্পনা করল, যেভাবেই হোক এই অভিশপ্ত শাড়ি ধ্বংস করতে হবে। প্রথমে তারা সিদ্ধান্ত নিল আগুনে পোড়াবে। উঠোনের মাঝখানে মাটির বড়ো চুল্লি বানিয়ে শাড়িটাকে সেখানে ছুঁড়ে দিল। কাঠকয়লার শিখা গরম হয়ে উঠল, চারপাশের বাতাসে পোড়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—শাড়িটা আগুনে গিয়েও অক্ষত রইল, যেন লাল সিল্কের ভাঁজগুলো আগুনকে উপহাস করছে। আগুন আরও বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ শশাঙ্কের হাত পুড়ে গেল, আর একই সঙ্গে শাড়ির আঁচল নড়তে লাগল নিজের মতো করে। ভয় পেয়ে তারা তাড়াতাড়ি আগুন নিভিয়ে ফেলল। এরপর সিদ্ধান্ত হলো জলে ডুবিয়ে দেওয়া হবে। গ্রামপুকুরের একেবারে মাঝখানে নিয়ে গিয়ে তারা শাড়িটাকে ডুবিয়ে দিল। কিন্তু জলে ডোবার বদলে শাড়িটা ভেসে উঠল, যেন তার ভেতরেই প্রাণ আছে। মায়া আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগল, “এ যে মানুষের মতো শ্বাস নিচ্ছে!” শেষ চেষ্টা হিসেবে অজয় একটা ধারালো দা এনে শাড়িটাকে টুকরো টুকরো করতে উদ্যত হলো। কিন্তু দা পড়তেই ধাতব শব্দ হলো, আর দা বেঁকে গেল, অথচ শাড়িতে কোনও দাগও পড়ল না। আতঙ্কে তারা বুঝল—এ কেবল কাপড় নয়, এ এক অভিশপ্ত অস্তিত্ব, যা সাধারণ উপায়ে ধ্বংস করা সম্ভব নয়।
তাদের এই ব্যর্থ প্রচেষ্টার মধ্যে হঠাৎই চারদিক কেমন যেন থমথমে হয়ে উঠল। বাতাস বইছিল না, অথচ গাছের ডালপালা দুলছিল। পুকুরের জলে ভাঁজ পড়ছিল নিজের থেকেই, আর দূরে শেয়ালের ডাক যেন থেমে গিয়ে অচেনা নারীকণ্ঠের হাহাকার ভেসে আসছিল। ঠিক তখনই আবার দেখা দিল সেই বয়স্কা মহিলা—চোখে শূন্য দৃষ্টি, গায়ের চাদর মাটিতে লটকে আছে, আর হাতে একটা শুকনো লাঠি। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বললেন, “যত চেষ্টা করো, শাড়িকে তোমরা ধ্বংস করতে পারবে না। ওর জন্মই হয়েছে বন্দি রাখার জন্য।” তিনজন একসঙ্গে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শশাঙ্ক ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রশ্ন করল, “এর মানে কী? কীভাবে মুক্তি পাব আমরা?” মহিলা নিঃশব্দে শাড়িটার দিকে ইশারা করে বললেন, “এই শাড়ি কেউ একবার পরে নিলে তার আত্মা আর শরীর আলাদা হয়ে যায়। শরীর বেঁচে থাকে কিছুটা সময়, কিন্তু আত্মা আটকে পড়ে এই কাপড়ের আঁচলে। সেই আত্মাগুলোর কান্না আর আর্তনাদই তোমরা শুনে এসেছো। আর আগুন, জল, লোহা—কোনও কিছুতেই এটা নষ্ট হবে না। কারণ এটা মানুষের হাতের জিনিস নয়, এটা এসেছে অন্য এক শক্তির দান হিসেবে।” মায়া কেঁপে উঠে চিৎকার করে বলল, “তাহলে অনিমেষও…?” মহিলার ফ্যাকাশে মুখে একরাশ শোকের ছাপ ফুটে উঠল। তিনি ধীরে মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, ও এখন বন্দি। তোমরা শুধু একটা পথেই এই শাড়ি থেকে মুক্তি পেতে পারো—যে শক্তি একে বেঁধেছে, তাকেই ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তার জন্য দরকার হবে ত্যাগ।”
মহিলার কথাগুলো শুনে তিনজনের শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। শশাঙ্ক দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কী ত্যাগ? আমরা কীভাবে ওকে ফিরিয়ে দেব?” মহিলা সোজাসুজি উত্তর দিলেন না, শুধু বললেন, “যে আত্মা শাড়ির ভেতর বন্দি, তাকে মুক্ত করতে হলে অন্য এক আত্মা স্বেচ্ছায় এর ভেতর প্রবেশ করতে হবে। তার মধ্যেই আছে শেষ মুখোমুখি হওয়ার শক্তি।” কথাটা শোনার পরই চারপাশের বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল, যেন অদৃশ্য কেউ তাদের নিঃশ্বাস গিলে নিচ্ছে। মায়া চোখ ভিজিয়ে তাকাল শশাঙ্কের দিকে, আর শশাঙ্ক তাকাল অজয়ের দিকে—তিনজনের মধ্যে যেন এক অদ্ভুত নিঃশব্দ বোঝাপড়া তৈরি হলো। তারা বুঝে গেল, এ লড়াই কেবল অভিশপ্ত শাড়ির সঙ্গে নয়, মৃত্যুর ছায়ার সঙ্গেও। আর এখানে জেতার মানে শুধু শাড়ি ধ্বংস করা নয়, বরং তাদের আত্মাদের মুক্তি দেওয়া। মহিলার গলা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে, কিন্তু তার চোখের কঠিন দৃষ্টি যেন শেষ বার্তাটা স্পষ্ট করে দিয়ে গেল—এখন আর পিছু হটার উপায় নেই, কারণ মৃত্যুর সঙ্গে শেষ মুখোমুখি শুরু হয়ে গেছে।
১০
রাতের আকাশে কালো মেঘ জমেছিল, চারপাশে এক শ্বাসরুদ্ধকর অন্ধকার নেমে এসেছে। শশাঙ্ক, মায়া আর অজয় বুঝতে পেরেছিল—শেষ লড়াই শুরু হয়ে গেছে, আর এ লড়াই থেকে কেউ হয়তো ফিরে আসবে না। শাড়িটা যেন নিজের ভেতরে অসংখ্য অশরীরীর আর্তনাদ বহন করছে; দোকানের প্রতিটি কোণ থেকে লাল আলো ছড়িয়ে পড়ছে, যেন আগুন ছাড়াই চারপাশ জ্বলছে। মায়া শশাঙ্ককে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগল, কিন্তু শশাঙ্কের চোখে তখন এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, এক অটল সংকল্প। সে জানত, অভিশাপের বোঝা আর বহন করা সম্ভব নয়। সে নীরবে অজয়ের দিকে তাকাল, আর অজয়ের চোখের ভেতরেও আতঙ্কের সঙ্গে মিশে ছিল একরাশ শ্রদ্ধা। শশাঙ্ক হাত বাড়িয়ে শাড়িটাকে তুলে নিল। মুহূর্তের মধ্যেই তার শরীর কেঁপে উঠল, যেন আগুন তার ভেতরেই জ্বলে উঠছে। শাড়িটা নিজের মতো করে তার শরীরের সঙ্গে মিশে যেতে চাইছিল, আঁকড়ে ধরছিল প্রতিটি অঙ্গ। কিন্তু শশাঙ্ক দাঁতে দাঁত চেপে চিৎকার করে উঠল—“আজ শেষ হবেই!” সে শাড়ি হাতে নিয়ে দোকানের পেছনের উঠোনে দৌড়ে গেল, যেখানে আগে ব্যর্থ হয়েছিল আগুনে পোড়াতে। এবার সে নিজের জীবন বাজি রাখল। কাঠকয়লার স্তূপে আগুন জ্বালিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল, শাড়িটাকে বুকে জড়িয়ে আগুনের মধ্যে ঢুকে গেল।
অগ্নিশিখা মুহূর্তেই আকাশছোঁয়া হয়ে উঠল। আগুনের তাপে বাতাস ভারী হয়ে গেল, আর চারপাশের সব শব্দ নিঃশেষ হয়ে গেল, কেবল ভেসে এলো এক নারীর দীর্ঘ, করুণ আর্তনাদ—যেন শাড়ির ভেতর বন্দি আত্মারা একসঙ্গে চিৎকার করে মুক্তি চাইছে। মায়া আর অজয় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের চোখের সামনে শশাঙ্কের দেহ আগুনে গলে যাচ্ছে, অথচ তার মুখে ছিল অদ্ভুত শান্তি, এক মুক্তির হাসি। সেই মুহূর্তে শাড়িটা শিখার ভেতর কাঁপতে কাঁপতে ধীরে ধীরে ভস্মীভূত হতে লাগল, তার লাল রঙ কালো ছাইয়ে পরিণত হলো। আশেপাশের গাছ, দেয়াল, এমনকি রাতের বাতাসও নিস্তব্ধ হয়ে গেল। যেন শহরের বুক থেকে এক অদৃশ্য অভিশাপ সরে গেল। আগুন নিভে গেলে কেবল ছাইয়ের স্তূপ পড়ে রইল, আর তার মাঝে শশাঙ্কের অর্ধদগ্ধ দেহ, মুখে অদ্ভুত প্রশান্তির ছাপ। মায়া হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, অজয়ের চোখে জল এসে গেল, কিন্তু একই সঙ্গে তারা অনুভব করল—এক ভীষণ ভার যেন হালকা হয়ে গেছে। সারা শহরে হঠাৎ নেমে এলো এক অদ্ভুত নীরবতা; কুকুরের ডাক নেই, পাখির শব্দ নেই, কেবল শূন্য নীরবতা। মানুষ জানল, এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে।
তবে সমাপ্তি কি সত্যিই এভাবেই শেষ হয়ে গেল? কয়েক মাস পরে, অন্য এক দূর শহরে, ব্যস্ত বাজারের ভিড়ের মাঝে এক অচেনা দোকানদার পুরনো কাপড়ের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ থমকে গেলেন। তার হাতে উঠে এলো এক অদ্ভুত নকশার লাল শাড়ি—অবিকল সেই শাড়ি, যে শাড়ি শহরটাকে তছনছ করেছিল। সূর্যের আলোয় শাড়িটার রঙ এমনভাবে ঝলমল করছিল, যেন তার ভাঁজে আবারও বন্দি আছে অশরীরীদের ছায়া। দোকানদারের চোখে কৌতূহল ঝলসে উঠল, আর সে মুচকি হেসে বলল, “এটা তো খুবই বিরল নকশা, বেশ দাম পাওয়া যাবে।” বাজারের কোলাহলের মধ্যে সেই মুহূর্তে কারও চোখে ধরা পড়ল না শাড়ির কিনারায় মৃদু ঝলসে ওঠা আগুনের রেখা, কিংবা কান পাতলে শোনা যাওয়া ক্ষীণ নারীকণ্ঠের চাপা আর্তনাদ। শহরের মানুষ জানল না, কোথাও দূরে আবার এক নতুন অভিশাপের বীজ বোনা হয়ে গেল। সমাপ্তি তাই সমাপ্তি নয়—বরং অশুভের চক্রের আরেকটি নতুন শুরু।
শেষ
				
	
	


