অদ্বৈত মুখার্জি
পর্ব ১ : ফিরে আসা রাত
শান্তিপুর গ্রামের মানুষ আজও ভরসা করে না ওই অন্ধকারমাখা গলিটা পেরোতে। গলির শেষে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙাচোরা জমিদারবাড়িটা যেন এক অদৃশ্য ছায়ার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দিনের বেলা দূর থেকে দেখলেও বুকের ভেতর কেমন চাপা ভয় জমে ওঠে। রাত হলে তো কথাই নেই—নিশ্চুপ নীল অন্ধকারে বাড়িটার ভাঙা চূড়ার ওপর কাক ডেকে ওঠে, কখনো ঝোপের আড়াল থেকে শেয়ালের চোখ জ্বলে ওঠে, আর হাওয়ায় ভেসে আসে এমন এক অজানা গন্ধ, যেটা মানুষে মানুষে ছড়িয়ে দেয় আতঙ্কের গল্প।
এই বাড়িরই মালিক ছিল এককালে রাজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী—শান্তিপুরের জমিদার। গাঢ় লাল রঙের ইট, ঝলমলে ঝাড়বাতি, আর অন্দরমহলে গজল-ঠুমরির আসর—সবই ছিল। কিন্তু সেই জৌলুস মুছে গেছে বহু বছর। কীভাবে? এ নিয়ে নানা গল্প আছে। কেউ বলে, জমিদারের লোভে ভিটেমাটি হারিয়ে এক দুঃস্থ পরিবার অভিশাপ দিয়েছিল। কেউ বলে, তারই স্ত্রী নিখোঁজ হয়েছিল এক পূর্ণিমা রাতে, আর তখন থেকেই অদ্ভুত ঘটনা শুরু। সত্যি কী, তা কেউ জানে না।
অর্ণব আর তন্ময়—দুজনেই কলেজপড়ুয়া, বয়স কেবল কুড়ির কাছাকাছি। গ্রামের গল্প তাদের ছোটবেলা থেকে শোনানো হয়েছে, কিন্তু তারা কেউই বিশ্বাস করে না। ভূত-প্রেতকে তারা রূপকথা ভেবে হেসে উড়িয়ে দেয়। সেই কৌতূহল থেকেই ঠিক করল, অমাবস্যার রাতেই গিয়ে দেখা যাবে, এত ভয়ের কী আছে ওই বাড়িতে।
অমাবস্যার রাতে গ্রাম একেবারে অন্ধকারে ঢেকে যায়। টিমটিম করে জ্বলা দু-একটা কেরোসিন লণ্ঠন ছাড়া আর কোনো আলো থাকে না। দূরে পুকুরের ধারে ব্যাঙ ডাকতে থাকে, মাঝে মাঝে কুকুর হেঁকে ওঠে। এমন রাতে গ্রামের ভেতরকার লোকেরাও আগে আগে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।
সেই রাতেই, হাতে ছোট্ট টর্চ আর ব্যাকপ্যাকে রাখা দেশলাই আর মোমবাতি নিয়ে বের হল অর্ণব আর তন্ময়। তাদের পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল কাঁচা রাস্তার ধুলোয়, মাঝে মাঝে পায়ের নিচে ভাঙা কাঁচ বা শুকনো ডাল চাপা পড়ে কটমট শব্দ তুলছিল।
গলির কাছে পৌঁছেই অর্ণব হেসে বলল,
—শোন, ভুত যদি সত্যি থাকে, তাহলে আজই ধরা পড়বে।
তন্ময় একটু গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,
—হুঁ, আর যদি কিছু না-ই হয়, তাহলে অন্তত চিরতরে প্রমাণ হয়ে যাবে, ভূত বলে কিছু নেই।
কিন্তু কথার দৃঢ়তা যতই থাকুক, গলির ভেতরে পা রাখতেই তাদের বুকের ভেতর একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল। গলির দুই পাশে ঝোপঝাড় এতটাই ঘন হয়ে উঠেছিল যে চাঁদের আলোও পৌঁছতে পারছিল না। বাতাসে শুকনো পাতার ঘষাঘষির শব্দ, আর দূরে অজানা পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে নিস্তব্ধতা ভেঙে যাচ্ছিল।
তারা যখন বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল, তখন এক মুহূর্তের জন্য যেন সময় থেমে গেল। বিশাল ফটকটা ভাঙা, লোহার গেট মরচে ধরে লালচে হয়ে গেছে। গেটের ওপর দিয়ে মান্দার গাছের শেকড় ঝুলে পড়েছে, আর ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে এক শূন্য দালান।
তন্ময় টর্চ জ্বালিয়ে বলল,
—চল, ভেতরে ঢুকি।
অর্ণব গেট ঠেলতেই কটকট শব্দ করে সেটা আধখানা খুলে গেল। সেই শব্দ যেন পুরো গ্রাম জুড়ে প্রতিধ্বনি তুলল। দুজনেই গলা শুকিয়ে আসা সত্ত্বেও ভেতরে পা রাখল।
অন্দরমহলে ঢুকেই টের পাওয়া গেল একটা অদ্ভুত গন্ধ—শুকনো গোলাপের মতো, অথচ তার সঙ্গে মিশে আছে স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালের দুর্গন্ধ। মেঝেতে ঝরে পড়া পাতার ওপর তাদের পদশব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। দেওয়ালে ঝোলানো ভাঙা প্রতিকৃতি, কোথাও জমিদারের মুখ, কোথাও জমিদারানির। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, টর্চের আলো পড়তেই মনে হচ্ছিল ছবিগুলোর চোখ যেন ঝিলিক দিয়ে উঠছে।
অর্ণব জোর করে হেসে উঠল,
—ভয় পাচ্ছিস নাকি? এটা কেবল আলো-ছায়ার খেলা।
তন্ময় ঠোঁট কামড়ে কিছু না বলে সিঁড়ির দিকে এগোল। ভাঙাচোরা কাঠের সিঁড়ি চাপা শব্দ তুলছিল। উপরে উঠতেই হঠাৎ নিচ থেকে দরজা বন্ধ হওয়ার জোরালো শব্দ ভেসে এল। তারা দুজনেই একসঙ্গে তাকাল একে অপরের দিকে।
—কে দরজা বন্ধ করল? —অর্ণব ফিসফিস করে বলল।
কোনো উত্তর এল না। কেবল দূরে থেকে একটা মৃদু শব্দ—মনে হচ্ছিল যেন কেউ পায়ের গোড়ালি টেনে টেনে হাঁটছে। শিকল ঘষার মতো কর্কশ আওয়াজ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল তাদের দিকে।
তন্ময়ের হাত কেঁপে উঠল।
—অর্ণব… এটা মানুষ নয়।
অর্ণব কিছু বলার আগেই হাওয়ার ঝাপটা এসে টর্চটা নিভিয়ে দিল। হঠাৎ চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল। নিস্তব্ধতার ভেতরে ফিসফিস করে উঠল এক অচেনা গলা—
“কে… আমার ঘুম ভাঙালে?”
দুজনেই জমে গেল জায়গাতেই।
পর্ব ২ : দরজার ওপাশে
অন্ধকারে দুজনের নিশ্বাস যেন একসঙ্গে দম আটকে আসছিল। গলা শুকনো, বুকের ভেতর ধড়ফড় শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। অর্ণব মরিয়া হয়ে টর্চটা চাপতে লাগল, কিন্তু আলো আর জ্বলেনি। এদিকে করিডরের দিক থেকে আসছিল সেই টেনে হাঁটার শব্দ, শিকল ঘষার কর্কশ আওয়াজে সিঁড়ি কেঁপে উঠছিল যেন।
তন্ময় ফিসফিস করে বলল,
—এটা… এটা কেউ করছে? নাকি—
অর্ণব তাকে থামিয়ে বলল,
—চুপ থাক! বেশি শব্দ করিস না।
কিন্তু শব্দটা থামল না। বরং কাছে চলে আসছিল ধীরে ধীরে, যেন অদৃশ্য কেউ নিঃশব্দে তাদের চারপাশ ঘিরে ফেলছে। ভাঙা জানালা দিয়ে রাতের কালো হাওয়া ঢুকে পড়ছিল, তার সঙ্গে মিশে ছিল অচেনা এক গন্ধ—কেউ বলবে শুকনো লাশের, কেউ বলবে পুরোনো ধূপের।
হঠাৎ এক মুহূর্তে সামনের দেয়ালের কোণ থেকে জ্বলজ্বলে চোখ দেখা গেল। দুটো নয়, চারটে নয়—একসঙ্গে অনেকগুলো। যেন আঁধারের মধ্যে নিঃশব্দ দর্শক বসে আছে। চোখগুলো নড়ছিল না, কেবল তাকিয়ে ছিল তাদের দিকে।
তন্ময়ের গলা কেঁপে উঠল,
—অর্ণব… আমি মনে করি, ফিরে যাই।
অর্ণব সাহস জোগাতে বলল,
—না, আমরা সত্যিটা জানব।
কথাটা শেষ হতে না হতেই উপরের তলার কাঠের মেঝে হঠাৎ কেঁপে উঠল। যেন ভারি কিছু একসঙ্গে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাতাস আরও ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
ওই সময়ই অর্ণব আর তন্ময় শুনতে পেল এক চাপা হাসি—না পুরুষের, না নারীর। গলার ভেতর দিয়ে টেনে আনা, কর্কশ অথচ অদ্ভুত আকর্ষণীয়। হাসিটা থেমে গিয়ে ধীরে ধীরে পরিণত হল কথায়।
“তোমরা… অবশেষে এসেছ।”
তারা দুজনেই একসঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু নিচে এসে দেখল, যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিল, সেটা বন্ধ। কাঠের দরজাটা লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছে। অর্ণব দুহাত দিয়ে ধাক্কা মারল, তন্ময় কাঁধ দিয়ে আঘাত করল—কিন্তু দরজা নড়ল না। বাইরে গ্রামের কুকুরের ডাক স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল, অথচ কোনোভাবেই বেরোনো সম্ভব হচ্ছিল না।
হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে শব্দ এল। যেন কেউ ধীরে ধীরে দরজার গায়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। তারপর থেমে গেল। আবার শুরু হল টোকা—ঠক… ঠক… ঠক।
তন্ময়ের দাঁত কাঁপতে কাঁপতে বেরোল,
—কে… কে ওখানে?
অচেনা গলা উত্তর দিল,
“আমি… যে তোমাদের খুঁজছিল এতদিন।”
তারপর হঠাৎ দরজার ফাঁক দিয়ে শীতল বাতাস ঢুকে গেল ঘরে। সেই সঙ্গে মোমবাতি জ্বেলে রাখা ব্যাগটা নিজে থেকেই উলটে গেল। দেশলাইয়ের কাঠিগুলো ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।
অর্ণব ঝুঁকে পড়তেই মেঝের ওপর লালচে দাগ দেখতে পেল। প্রথমে মনে হল রঙের দাগ, পরে স্পষ্ট হল—ওটা শুকনো রক্তের ছাপ। আর সেই ছাপ যেন ধীরে ধীরে তৈরি করছে একটা শব্দ—“থেকো।”
তাদের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
কিন্তু তার পরেই অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। দরজার ভেতরের দিক থেকে খটখট শব্দ করে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করল। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কে আছে—তা অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিল না। শুধু ঠান্ডা হাওয়া এসে তাদের গায়ের ওপর বয়ে যাচ্ছিল, আর সেই সঙ্গে ভেসে আসছিল একটা পুরোনো সুগন্ধি—যেন কোনো রমণী একসময় এখানে ঘুমোত।
অর্ণব আর তন্ময় দাঁড়িয়ে রইল থমকে, বুকের ভেতর কেবল একটাই প্রশ্ন—দরজার ওপাশে কে?
পর্ব ৩ : চোখ যে নড়ে ওঠে
দরজাটা আধখোলা, কিন্তু বাইরে কোনো মানুষ দেখা গেল না। অন্ধকার যেন আরও ঘন হয়ে উঠল, যেন কালি মাখানো আকাশ থেকে ঝরে পড়েছে ঘরের ভেতরে। অর্ণব টর্চের বোতাম চাপতে লাগল, হঠাৎ টর্চে হালকা আলো জ্বলে উঠল—দমে দমে, নিভে যেতে যেতে। সেই ম্লান আলোয় দেখা গেল করিডরের দেয়ালে ঝোলানো প্রতিকৃতি। জমিদার, জমিদারানি, তাদের সন্তানসন্ততি—সবাই আঁকা সেই ছবিগুলো অদ্ভুতভাবে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে।
প্রথমে মনে হল মনের ভুল। কিন্তু হঠাৎই প্রতিটি চোখ নড়ে উঠল ধীরে ধীরে, যেন ছবির মানুষগুলো হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। চোখের ভেতরে কালো জলের মতো ঝিলিক, কোথাও আবার লালচে আভা।
তন্ময়ের বুক শুকনো হয়ে এল। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
—অর্ণব, আমি… আমি শপথ করে বলছি, ওরা তাকাচ্ছে।
অর্ণব সাহস জোগাতে বলল,
—না, এ সব অপটিক্যাল ইলিউশন। আলো ছায়ার খেলা।
কিন্তু কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে এক ছবির নারী—সম্ভবত জমিদারানির প্রতিকৃতি—মুখের কোণে হাসি ফুটিয়ে দিল। নিঃশব্দ, অথচ স্পষ্ট হাসি। আর তার চোখের ভেতর থেকে ঝরে পড়ল লালচে দাগ, যেন রক্ত ঝরছে কাগজের ভেতর থেকে।
ঘরের বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে গেল। এক অচেনা গন্ধে ভরে উঠল চারপাশ—শুকনো কফিন, পুরোনো ধূপ আর পোড়া কাঠের মিশ্র গন্ধ। টর্চের আলো আবার নিভে গেল। চারপাশ নিস্তব্ধ, কেবল দূরে কোথাও মশারির ভেতরে ঘুমন্ত শিশুর মতো হালকা কান্নার শব্দ।
তন্ময় দাঁড়িয়েই কেঁপে উঠল।
—কে কাঁদছে? এখানে তো কেউ নেই!
অর্ণব গলা শক্ত করে বলল,
—চল, উপরে যাই। হয়তো কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে।
তারা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই কাঠের ধাপগুলো গোঙানির মতো শব্দ তুলল। একসময় মেঝেতে পৌঁছতেই দেখা গেল এক লম্বা করিডর—দুই পাশে বন্ধ দরজা, আর মাঝখানে ধুলোমাখা কার্পেট। সেই কার্পেটের ওপর যেন শুকনো দাগ ছোপ ছোপ ছড়িয়ে আছে। তন্ময় নিচু হয়ে তাকাল—দাগগুলো আসলে রক্ত, শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে।
হঠাৎ সামনের দরজাগুলোর মধ্যে একটার ফাঁক দিয়ে আলো বেরোতে শুরু করল। আলোটা অস্বাভাবিক—না প্রদীপ, না টর্চ, না আগুন। বরং ফ্যাকাশে নীল আলো, যেন চাঁদের আলো জমে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
তারা দুজনেই দ্বিধায় পড়ল। কিন্তু কৌতূহল ভয়কে ছাড়িয়ে গেল। ধীরে ধীরে দরজাটা ঠেলে খুলতেই দেখা গেল—এক ফাঁকা ঘর। ঘরের মাঝখানে একটা পুরোনো দোলনা চেয়ার, সেটি আস্তে আস্তে দুলছে, অথচ সেখানে কেউ বসে নেই।
দোলনার ওপরে রাখা ছিল এক আয়না। আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছিল না অর্ণব বা তন্ময়ের মুখ, বরং দেখা যাচ্ছিল এক অপরিচিত রমণী। গাঢ় লাল শাড়ি, কপালে সিঁদুর, চোখ লালচে দীপ্তি নিয়ে জ্বলছে।
তিনি ধীরে ধীরে আয়নার ভেতর থেকে ফিসফিস করে উঠলেন—
“তোমরা আমার ঘর ভেঙে ঢুকেছ। এখন আর বেরোতে পারবে না।”
তখনই হাওয়ার ঝাপটা এসে দরজাটা জোরে বন্ধ হয়ে গেল। ঘর অন্ধকারে ঢেকে গেল। আয়নার ভেতরের চোখদুটো নড়ে উঠল, যেন তাদের গিলে ফেলতে চাইছে।
তন্ময় কেঁপে উঠে অর্ণবের হাত চেপে ধরল। অর্ণব এক নিঃশ্বাসে বুঝল—এখন তারা সত্যিই ফেঁসে গেছে।
পর্ব ৪ : মালকিনের ছায়া
ঘরটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নিস্তব্ধতা ভর করে রইল। কেবল দোলনা চেয়ারের কড়কড় শব্দ, আর আয়নার ভেতরের লালচে আলোতে তাদের শ্বাসকষ্ট বেড়ে চলল। অর্ণব সাহস করে এগিয়ে গেল আয়নার সামনে, কিন্তু তার মুখ প্রতিফলিত হল না। সেখানে দেখা গেল সেই একই রমণী—চোখ লাল, ঠোঁটে হালকা হাসি, কিন্তু সেই হাসিতে ছিল অদ্ভুত শূন্যতা।
তিনি ধীরে ধীরে হাত তুললেন। আয়নার ভেতর থেকে হাত বেরিয়ে আসছে যেন! ঠান্ডা আঙুলগুলো অর্ণবের দিকে বাড়তে লাগল। তন্ময় চিৎকার করে বলল,
—পিছিয়ে যা! ও স্পর্শ করলে কিছু একটা হবে!
অর্ণব ঘাবড়ে গিয়ে পেছনে সরে গেল। তখনই হঠাৎ আলো নিভে গেল। কেবল চারপাশে শোনা গেল এক অদৃশ্য সুর—পুরোনো ঠুমরির মতো, অথচ তার সঙ্গে মিশে ছিল বেদনার হাহাকার।
অন্ধকারের ভেতর ভেসে এল ফিসফিসানি—
“আমি এই বাড়ির মালকিন। নাম আমার মাধবীলতা। এই ঘরেই আমাকে মেরেছিল… আমারই স্বামী।”
তন্ময় হতভম্ব হয়ে অর্ণবের দিকে তাকাল।
—সে আবার কেন?
ফিসফিসানি আরও স্পষ্ট হল।
“জমিদার আমার প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছিল। এক পূর্ণিমা রাতে এই ঘরেই গলা টিপে মেরেছিল আমাকে। তারপর থেকে আমি বেরোতে পারিনি। এই বাড়িটাই আমার শিকল।”
তারপর যেন হঠাৎই ঠান্ডা হাওয়া এসে দুজনকে ঘিরে ধরল। তন্ময়ের কাঁধে কেউ বরফের মতো হাত রাখল। তন্ময় পিছন ফিরে চিৎকার করে উঠল—কেউ নেই, অথচ চাপটা স্পষ্ট।
আবার সেই সুর ভেসে এল, এবার অনেক কাছে।
“তোমরা আমাকে মুক্তি দাও… না হলে তুমিই থাকো আমার সঙ্গে।”
ঘরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। দেয়ালের প্রতিকৃতিগুলো একসঙ্গে কাঁদতে লাগল যেন। ফ্রেম থেকে বেরিয়ে আসছিল কালচে জল, মেঝেতে ঝরে পড়ছিল লালচে ছোপ হয়ে।
অর্ণব মরিয়া হয়ে দরজার দিকে ধাক্কা মারতে লাগল। দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল নিজে থেকেই। কিন্তু করিডরে আলো ছিল না, কেবল অসংখ্য ছায়া দাঁড়িয়ে ছিল সারি সারি। ছায়াগুলো মানুষের মতো, কিন্তু মুখ নেই। তারা ধীরে ধীরে ফিসফিস করতে লাগল একসঙ্গে—
“থেকে যাও… থেকে যাও…”
তন্ময় আর অর্ণব দুজনেই দৌড়ে নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে। কিন্তু যতই নামছিল, সিঁড়ির শেষ আসছিল না। তারা ঘুরে ঘুরে নিচে নামছিল, অথচ জায়গাটা যেন এক গোলকধাঁধা হয়ে গেছে।
ঠিক তখনই সিঁড়ির এক ধাপে দাঁড়িয়ে দেখা দিল সেই রমণী—মাধবীলতা। রক্তরঙ শাড়ি, চুল খোলা, চোখ লাল দীপ্তিতে জ্বলছে। কিন্তু মুখে ছিল অদ্ভুত শান্তি।
তিনি হাত বাড়িয়ে বললেন,
“তোমরা যদি আমাকে মুক্তি না দাও, তবে আমার সঙ্গেই থেকে যাবে।”
তার ছায়া তখন ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে ধরছিল।
পর্ব ৫ : আটকে পড়া
অর্ণব আর তন্ময় সিঁড়ির ধাপে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মাধবীলতার ছায়া ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছিল, যেন অন্ধকারের শিকল হয়ে তাদের হাত-পা বেঁধে ফেলছে। অর্ণব মরিয়া হয়ে ব্যাগ থেকে দেশলাই কাঠি বের করে আগুন ধরাতে চেষ্টা করল। কাঁপা হাতে কাঠিটা ঘষতেই ক্ষণিকের জন্য একটা শিখা জ্বলে উঠল। সেই আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল—মাধবীলতার পায়ের কোনো ছায়া নেই। তিনি বাতাসে ভেসে আছেন, অথচ উপস্থিতিটা এত প্রবল যে ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে উঠছিল।
তন্ময় হাঁপাতে হাঁপাতে ফিসফিস করল,
—আমরা ফেঁসে গেছি, অর্ণব… বেরোনোর কোনো রাস্তা নেই।
ঠিক তখনই দেয়ালের ভেতর থেকে কর্কশ শব্দ শোনা গেল, যেন ভেতরে লোহার শিকল টানা হচ্ছে। সিঁড়ির নিচ থেকে ভেসে এল এক অদ্ভুত কণ্ঠস্বর—মৃদু অথচ ভয়াল,
“তোমরা এখানে এসেছ… মানে তোমরা আমারও। ফিরে যাওয়া নেই।”
অর্ণব বুক শক্ত করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল, তন্ময় তার পিছু পিছু। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার—যতই তারা নিচে নামছিল, নিচতলায় পৌঁছনো যাচ্ছিল না। সিঁড়িগুলো বারবার ঘুরে তাদের আবার একই জায়গায় ফিরিয়ে আনছিল। যেন বাড়িটা নিজেই এক গোলকধাঁধা, যেখান থেকে মুক্তি নেই।
একসময় তারা ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল। দেয়ালের প্রতিকৃতিগুলো আবার জীবন্ত চোখে তাকিয়ে আছে, কারও চোখে ভিজে জল, কারও চোখে অগ্নিদৃষ্টি। হঠাৎ এক ফ্রেম ভেঙে মেঝেতে পড়ে গেল। কাঁচের ভাঙা টুকরোতে দেখা গেল তাদের নিজেদের প্রতিফলন—কিন্তু সেই প্রতিফলনে তারা মৃত। ঠোঁট নীল, চোখ ফাঁকা, মুখে আতঙ্কের ছাপ।
তন্ময়ের হাঁটু কেঁপে উঠল।
—আমাদেরও কি ওরা টেনে নেবে ওদের দলে?
অর্ণব গলা শুকনো হয়ে গেলেও বলল,
—না, নিশ্চয়ই কোনো পথ আছে। এখানে একটা রহস্য লুকিয়ে আছে।
কিন্তু কথা শেষ করার আগেই হাওয়ার ঝাপটা এসে সব মোমবাতি নিভিয়ে দিল। চারপাশে হঠাৎ অন্ধকার আর শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। সেই অন্ধকারের মধ্যে মাধবীলতার গলা আরও কাছে ভেসে এল—
“তোমরা বুঝতেই পারছ না। এই বাড়িতে একবার ঢুকলে, আর বেরোনো যায় না। আমার মতোই আটকে পড়ো সবাই।”
তখনই মেঝে ফেটে একটা গোপন ফাঁক দেখা দিল। ভেতর থেকে উঠল এক শ্বাসরুদ্ধকর দুর্গন্ধ। মনে হচ্ছিল, বহু বছর আগে পচে যাওয়া দেহ এখনো কবরের ভেতর থেকে গুমরে উঠছে।
অর্ণব টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল সিঁড়ির নিচে নেমে যাচ্ছে একটা গোপন পথ। সেই পথের দেয়ালে শুকনো হাতের ছাপ—কোনোটা বড়, কোনোটা ছোট, যেন অসংখ্য মানুষ ওই পথ দিয়ে যেতে গিয়ে চিৎকার করে হাত বাড়িয়েছিল।
তন্ময় ভয়ে থরথর করে বলল,
—ওই পথে গেলে হয়তো আর ফেরাই হবে না।
অর্ণব দাঁত চেপে উত্তর দিল,
—কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলেও মৃত্যু নিশ্চিত। চল, নামতে হবে।
দুজনেই ধীরে ধীরে ফাঁক দিয়ে নামতে শুরু করল। ভেতরে যতই ঢুকছিল, ততই শব্দ আসছিল—কারও গোঙানি, কারও চাপা কান্না, আর কর্কশ ফিসফিসানি—
“তোমরা এখন আমাদের মতো।”
অন্ধকারের মধ্যে তারা স্পষ্ট বুঝল—তারা সত্যিই আর মুক্ত নয়। জমিদারবাড়ি তাদের গ্রাস করেছে।
পর্ব ৬ : পুরোনো কাহিনি
গোপন পথের অন্ধকারে যত নিচে নামছিল অর্ণব আর তন্ময়, বাতাস তত ভারী হয়ে উঠছিল। টর্চের ক্ষীণ আলোয় দেখা যাচ্ছিল ভিজে শ্যাওলা জমা দেওয়াল, আর দেওয়ালের গায়ে গায়ে হাতের ছাপ যেন এখনও ভিজে রক্তে লেখা। নিচে নামতেই একটা ছোট্ট ঘর চোখে পড়ল। ঘরটা গোলাকার, চারপাশে গম্বুজের মতো ছাদ, মাঝখানে ভাঙা কাঠের টেবিল। টেবিলের ওপরে ছড়িয়ে আছে কিছু পুরোনো কাগজ, হলদে হয়ে যাওয়া ডায়েরি আর ভাঙা পালকের কলম।
তন্ময় কাঁপা গলায় বলল,
—এগুলো জমিদারের?
অর্ণব ডায়েরিটার ওপর আলো ফেলল। কভারে লেখা—“রাজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, ১৮৮৪”। দুজনে দম আটকে পাতা উল্টে পড়তে শুরু করল। প্রথম দিককার পাতায় জমিদারের শৌখিন জীবনযাত্রার বর্ণনা—মহল, আসর, জমিদারানির প্রতি টান। কিন্তু যত পাতা উল্টোতে লাগল, লেখাগুলো তত অন্ধকার হয়ে উঠল।
এক জায়গায় লেখা—
“মাধবীলতা আমার প্রতি অনুগত নয়। ওর চোখে অন্য কারও ছায়া দেখি। বিশ্বাসঘাতকতা আমি সহ্য করব না। আজ রাতে পূর্ণিমায় ওকে শাস্তি দেব।”
তারপরের পাতাগুলো রক্তে ভেজা, অনেকটা লেখা মুছে গেছে। কেবল একটা বাক্য স্পষ্ট—
“ও আর বেঁচে নেই। কিন্তু কেন যেন তার চোখ আজও আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।”
তন্ময়ের হাত থেকে ডায়েরি ফসকে মাটিতে পড়ল। দুজনেই বুঝতে পারল, সত্যিটা ভয়ঙ্কর। জমিদার নিজের হাতে খুন করেছিল মাধবীলতাকে, সন্দেহের বশে। আর সেই রক্তে ভেজা অভিশাপ জমে গেছে পুরো বাড়িতে।
হঠাৎই ঘর কেঁপে উঠল। দেওয়ালের ফাঁক থেকে ভেসে এল নারীকণ্ঠ—
“আমি বিশ্বাসঘাতক ছিলাম না। তবুও আমাকে মেরেছিল। তাই আজও আমি শান্তি পাই না।”
অর্ণব টর্চ ঘোরাতেই দেখা গেল, দেওয়ালের গায়ে ছায়া ভেসে উঠছে। এক নারী, গলায় ক্ষতচিহ্ন, চোখে অদ্ভুত যন্ত্রণা। তিনি ধীরে ধীরে টেবিলের ওপরে ভেসে এলেন।
—তোমরা আমার কথা জানলে, এখন আমার দুঃখও বইতে হবে।
দুজনের পায়ের নিচে মাটি ফেটে যেতে লাগল। ভেতর থেকে উঠছিল গুমরে ওঠা কান্নার শব্দ। যেন কত শত আত্মা একসঙ্গে চিৎকার করছে।
তন্ময় চেঁচিয়ে উঠল,
—আমরা কিছু করিনি! কেন আমাদের ধরে রাখছ?
মাধবীলতার ছায়া কাছে এসে বলল,
—কারণ, এই বাড়ি তার পাপ লুকিয়ে রাখতে কাউকেই ছাড়ে না। জমিদারের মতো তুমিও আটকে যাবে, যতক্ষণ না রক্তের হিসেব মেটে।
অর্ণব মরিয়া হয়ে বলল,
—হিসেব মানে কী?
গলাটা কেঁপে উঠল, কিন্তু উত্তর এল স্পষ্ট—
—যে রক্ত ঝরেছিল, তার প্রতিশোধ চাই। আমার অস্থি এই বাড়ির শবঘরে চাপা আছে। খুঁজে বের করো। আমাকে মুক্তি দাও, নইলে তোমাদেরও কবর হবে এই বাড়িতেই।
অর্ণব আর তন্ময় একে অপরের দিকে তাকাল। তারা বুঝল, সামনে আরও গভীর অন্ধকার অপেক্ষা করছে।
পর্ব ৭ : শবঘর
ডায়েরির পাতায় জমে থাকা রক্তমাখা সত্যি যেন এখনও ভিজে ছিল। অর্ণব আর তন্ময়ের চোখে সেই লেখা প্রতিফলিত হয়ে অন্ধকার আরও গভীর হয়ে উঠছিল। মাধবীলতার ফিসফিসানি তাদের কানে বাজছিল বারবার—“আমার অস্থি খুঁজে বের করো… শবঘরে… শবঘরে।”
তারা গোপন কক্ষ থেকে বেরোল। সরু পথ ধরে এগোতে লাগল। দেয়ালের ভেতর থেকে আসছিল চাপা শ্বাস, মাঝে মাঝে গোঙানির শব্দ। টর্চের আলো একটুও দূরে ছড়াচ্ছিল না, যেন আলোও ভয়ে জমে আছে। হঠাৎ করিডরের শেষে লোহার দরজা চোখে পড়ল। দরজায় মরচে ধরা তালা, কিন্তু তালার গায়ে শুকনো রক্তের দাগ স্পষ্ট।
অর্ণব কাঁধে ধাক্কা দিতেই তালাটা নিজের থেকেই খুলে গেল। দরজার ওপাশে যে দৃশ্যটা ছিল, তাতে তন্ময় চিৎকার করে ওঠার উপক্রম করল।
ঘরটা লম্বাটে, অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে। মাঝখানে পাথরের তৈরি চারকোণা কফিন, তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে শুকনো ফুল, পচা কাপড়ের টুকরো আর লালচে মাটি। বাতাসে এমন এক গন্ধ, যেন মৃত্যু এখনও পচে যাচ্ছে।
তন্ময় কাঁপতে কাঁপতে বলল,
—এখানেই… মাধবীলতার দেহ লুকোনো হয়েছিল?
অর্ণব টর্চ ফেলল কফিনের ওপরে। ভারী ঢাকনা ফাঁক হয়ে আছে সামান্য। ভেতর থেকে যেন শীতল বাতাস বেরিয়ে আসছিল। তারা দুজনেই মিলে ঢাকনাটা ঠেলে সরাতেই ভেতরের দৃশ্য পরিষ্কার হল।
ভেতরে অর্ধেক পচে যাওয়া হাড়গোড় ছড়িয়ে আছে। একটা শাড়ির ছেঁড়া আঁচল এখনও গায়ে লেপ্টে আছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল মাথার খুলি—চোখের গহ্বর যেন এখনও জ্বলজ্বল করছে, দাঁত বের করে হেসে উঠছে।
ঠিক তখনই ঘরের চারপাশে কোলাহল শুরু হল। অসংখ্য ছায়া যেন দেয়াল থেকে বেরিয়ে এল। তাদের মুখ নেই, কেবল কালো ফাঁকা গহ্বর। সবাই একসঙ্গে ফিসফিস করতে লাগল—
“আমরা ওর সঙ্গে মরেছিলাম… জমিদারের পাপে। আমাদেরও মুক্তি দাও…”
মাধবীলতার ছায়া কফিনের ওপরে ভেসে উঠল। এবার তার চোখে কান্না, ঠোঁটে ব্যথার রেখা।
—“আমার রক্ত এ বাড়িকে অভিশপ্ত করেছে। যতদিন আমার অস্থি মাটির নিচে চাপা, ততদিন কেউ মুক্ত নয়। আমাকে মুক্তি দাও।”
অর্ণব বুক শক্ত করে বলল,
—কীভাবে?
ছায়াটা ধীরে ধীরে ফিসফিস করে উঠল—
—“আমাকে আলো দাও। আগুনই পারে এই শিকল ছিঁড়তে।”
তন্ময় আতঙ্কে পিছিয়ে গেল।
—আগুন ধরাতে হবে? কিন্তু তাহলে পুরো বাড়িটাই…
অর্ণবের গলা কঠিন হয়ে উঠল।
—হয় আমরা ওকে মুক্তি দিই, নয়তো এখানেই আটকে যাই।
হাওয়ার ঝাপটা এসে মোমবাতিগুলো নিভিয়ে দিল। কফিনের চারপাশে ছায়াগুলো নড়ে উঠল। ঘরটা যেন শবঘরের বদলে জীবন্ত নরক হয়ে উঠেছে।
তারা বুঝল—এখন থেকে প্রতিটি মুহূর্তই মৃত্যুর খেলা।
পর্ব ৮ : রক্তের দেয়াল
শবঘরের ভেতর হাওয়া হঠাৎ ঘূর্ণির মতো বইতে শুরু করল। অর্ণব আর তন্ময়ের টর্চ নিভে গেল এক ঝাপটায়। কফিনের হাড়গোড় কেঁপে উঠল যেন, ঠকঠক শব্দ তুলে। দেয়ালের গা বেয়ে ধীরে ধীরে গড়িয়ে নামতে লাগল কালচে তরল—দূর থেকে মনে হচ্ছিল জল, কিন্তু গন্ধ নাকে আসতেই বোঝা গেল সেটা রক্ত।
তন্ময় কাঁপা গলায় বলল,
—এটা… এভাবে আসছে কেন?
অর্ণব কোনো উত্তর দিতে পারল না। চারদিকে তাকিয়ে দেখল, দেয়ালের ভেতর থেকে ফুটে উঠছে ছোপ ছোপ চিহ্ন—কখনো হাতের ছাপ, কখনো পায়ের। তারপরই দেখা গেল কিছু লেখা ভেসে উঠছে, যেন কারও আঙুল রক্তে ভিজিয়ে লিখছে।
লেখাটা প্রথমে ঝাপসা ছিল। তারপর স্পষ্ট হল—
“বিশ্বাসঘাতকতা নয়—খুন।”
ঘরের ভেতর হাহাকার শুরু হল। নারীর গলা, শিশুর কান্না, পুরুষের আর্তনাদ মিশে এক অদ্ভুত কোলাহল। মনে হচ্ছিল পুরো বাড়ির দেয়ালগুলো বেঁচে উঠেছে, আর তারা নিজেদের যন্ত্রণা উগরে দিচ্ছে।
তন্ময় কান চেপে ধরল দুহাতে।
—থামাও! আমি পারছি না!
অর্ণব দাঁত চেপে বলল,
—এগুলো আমাদের ভয় দেখানোর জন্য নয়। এগুলো সত্যি। জমিদার শুধু মাধবীলতাকেই খুন করেনি, আরও অনেককে মেরেছে। হয়তো চাকর-বাকর, হয়তো তার বিরোধীরা। তাই এত আত্মা বন্দি হয়ে আছে।
ঠিক তখনই এক দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল। ভেতরে আলো জ্বলছিল—কিন্তু সেই আলো অদ্ভুত লালচে, যেন ভোরের সূর্যের নয়, তাজা রক্তের আভা। দুজনেই ধীরে ধীরে এগোল।
ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল বিশাল দেওয়ালজোড়া চিত্রকর্ম। সেখানে অঙ্কিত এক ভোজসভা—জমিদার বসে আছে সোনার সিংহাসনে, চারপাশে নর্তকী, মদের পাত্র, আর সশস্ত্র প্রহরী। কিন্তু ছবির নিচে রক্ত জমে আছে পুরু স্তরে। টর্চের আলো পড়তেই নর্তকীদের মুখ বদলে গেল। একে একে সবাই গলাকাটা মৃতদেহে পরিণত হল, চোখ শূন্য হয়ে গেল।
হঠাৎ এক নর্তকীর প্রতিকৃতি ভেঙে বেরিয়ে এল কালো তরল, যেন দেয়াল নিজেই রক্তে ভিজে যাচ্ছে। তরলটা মেঝে দিয়ে গড়িয়ে এসে অর্ণবের জুতোর পাতা ভিজিয়ে দিল। অর্ণব পিছিয়ে এল আঁতকে উঠে।
তারপরেই ছবির মাঝখানে থাকা জমিদারের চোখ নড়ল। ছবির ভেতর থেকে গম্ভীর গলা ভেসে এল—
“আমার ছিল অধিকার। যাদের মেরেছি, শাস্তির জন্যই মেরেছি।”
তন্ময় চেঁচিয়ে উঠল,
—তুমি খুনি! তোমার জন্যই এতগুলো আত্মা আটকে আছে!
ছবির চোখে তখন অদ্ভুত দীপ্তি। গলা আবার ভেসে এল—
“আমার রক্ত মাটির সঙ্গে মিশেছে। তোমরা আমার পাপ মুছতে পারবে না।”
সেই মুহূর্তে পুরো দেওয়াল ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। করিডরে একে একে ছায়াগুলো হাজির হল—তাদের কণ্ঠে অভিশাপ,
“আমাদের মুক্তি দাও… না হলে তুমিও থাকো।”
অর্ণব মরিয়া হয়ে ব্যাগ থেকে মোমবাতি আর দেশলাই বের করল। সে ফিসফিস করে বলল,
—আগুন ছাড়া এখানে মুক্তি নেই।
তন্ময় আতঙ্কে পেছনে সরে গেল।
—কিন্তু আগুন দিলে আমরা নিজেরাও পুড়ে মরব!
অর্ণবের চোখে তখন এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।
—হয়তো মৃত্যু আমাদেরই হবে, কিন্তু অন্তত অভিশাপ ভাঙবে।
দেওয়াল থেকে তখন লালস্রোত নেমে আসছিল প্রবল বৃষ্টির মতো। ঘর রক্তে ভিজে যাচ্ছিল। তারা বুঝল—এখন আর পালাবার রাস্তা নেই।
পর্ব ৯ : দ্বন্দ্ব
রক্তে ভিজে যাওয়া ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল অর্ণব আর তন্ময়, বুক ধড়ফড় করছে যেন ভেঙে বেরিয়ে আসবে। চারপাশে অসংখ্য ছায়ামূর্তি, মুখবিহীন আত্মারা ঘিরে ধরেছে তাদের। অন্ধকারে ফিসফিসানি প্রতিধ্বনির মতো বাজছিল—
“থেকে যাও… থেকে যাও…”
কফিনের ওপরে ভেসে ওঠা মাধবীলতার ছায়া এবার আরও স্পষ্ট। রক্তরঙ শাড়ি, চুল খোলা, চোখে দহন—তবু ঠোঁটে যেন কাতর মিনতি।
—“আমাকে মুক্তি দাও… না হলে তোমাদেরও যেতে হবে।”
অর্ণব দাঁত চেপে দেশলাই জ্বালাল। ক্ষণিকের আলোয় তার মুখে দেখা গেল অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা। সে তন্ময়ের দিকে তাকাল—
—আমরা যদি আগুন না দিই, এ বাড়ি আমাদের গিলে ফেলবে।
—কিন্তু আগুন দিলে আমরাও পুড়ে মরব! —তন্ময়ের গলা কাঁপছিল।
অর্ণব শান্ত গলায় বলল,
—কখনও কখনও বাঁচতে হলে মরার ভয়কে জয় করতে হয়।
এই কথার মধ্যেই হঠাৎ বাড়ি কেঁপে উঠল। দেয়াল ফেটে বেরিয়ে এল জমিদারের ছায়া—উচ্চকায়, কালো, চোখে আগুনের মতো দীপ্তি। তার গলা বজ্রের মতো গর্জে উঠল—
“আমি এই বাড়ির প্রভু! আমার অনুমতি ছাড়া কেউ মুক্তি পাবে না। ও আমার স্ত্রী ছিল, আমার সম্পত্তি। এখনো সে আমারই!”
তন্ময় আঁতকে উঠে বলল,
—ওই দানবই তো আসল অভিশাপ!
মাধবীলতার ছায়া তখন চেঁচিয়ে উঠল—
—“না! আমি বন্দি হয়ে আছি ওর হাতে। আমাকে রক্ত নয়, আগুনই মুক্তি দিতে পারে।”
জমিদারের ছায়া ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগোতে লাগল। প্রতিটি পদক্ষেপে মাটি কেঁপে উঠছিল। আত্মারা হাহাকার করে উঠল, কেউ কাঁদছিল, কেউ আর্তনাদ করছিল।
অর্ণব মোমবাতিতে দেশলাই ধরাল। ছোট্ট শিখা কেঁপে উঠতেই জমিদারের গলা আরও গর্জে উঠল—
“সাহস করিস না! এ আগুন তোমাকেই ভস্ম করবে।”
তন্ময় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
—অর্ণব, আমি পারব না! আমি মরতে চাই না!
অর্ণব তার কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল,
—তুই বাঁচতে চাইলে পালিয়ে যা। কিন্তু আমি এ বাড়িকে অভিশাপমুক্ত না করে ফিরব না।
কথা শেষ হওয়ার আগেই জমিদারের ছায়া তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঘর অন্ধকারে ভরে গেল। অর্ণব তখন মোমবাতির শিখা ছুঁড়ে দিল কফিনের শুকনো কাপড়ের ওপর। আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।
চারপাশে আত্মাদের হাহাকার যেন আরও প্রবল হল। মাধবীলতার ছায়া হঠাৎ আগুনে দাঁড়িয়ে হাত দুটো ছড়িয়ে দিল—চোখে জল, ঠোঁটে মুক্তির হাসি।
কিন্তু জমিদারের ছায়া গর্জে উঠল—
“না! এটা আমার বাড়ি! কেউ আমার হাত থেকে পালাতে পারবে না!”
এবার এক অসম্ভব দ্বন্দ্ব শুরু হল। আগুনের শিখা বাড়ছে, জমিদারের ছায়া সেই শিখা নেভাতে ঝাঁপাচ্ছে, আর মাধবীলতার আত্মা আগুনে দাঁড়িয়ে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
অর্ণব আর তন্ময় মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেখছিল—এ লড়াই কেবল অতৃপ্ত আত্মার নয়, এ লড়াই মুক্তি আর বন্দিত্বের।
তাদেরও সিদ্ধান্ত নিতে হবে—কোন দিকে দাঁড়াবে তারা?
পর্ব ১০ : অন্তিম ডাক
আগুনের শিখা শবঘরের ভেতর হুহু করে ছড়িয়ে পড়ছিল। কাঠের কফিন ভস্ম হয়ে যাচ্ছিল, আর তার সঙ্গে মাধবীলতার আত্মা যেন আগুনের মাঝেই দীপ্ত হয়ে উঠছিল। মুখে আর্তনাদ নেই, চোখে ভয় নেই—বরং দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পাওয়া মুক্তির আলো।
জমিদারের ছায়া গর্জে উঠল, বজ্রের মতো আওয়াজে ঘর কেঁপে গেল—
“না! আমি কাউকে মুক্তি দেব না। যতদিন এই বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ততদিন আমার রাজত্ব চলবে।”
সে হাত বাড়িয়ে মাধবীলতার আগুনে ভরা ছায়াকে টেনে নিতে চাইলো। কিন্তু আগুন তার হাত ছুঁতেই গর্জে উঠল। ছায়াটা ধীরে ধীরে কুঁকড়ে যেতে লাগল, ভস্ম হয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। তবু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জমিদারের চোখে জ্বলছিল লোভ আর আধিপত্য।
মাধবীলতা আগুনের ভেতর থেকে অর্ণব আর তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন—
“ধন্যবাদ… তোমরা আমায় বাঁচালে।”
তারপর তিনি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন, শিখার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের অন্ধকারে যেন মিলিয়ে গেলেন। আত্মারা হাহাকার বন্ধ করে দিল। একে একে ছায়াগুলো ফিকে হয়ে গেল, যেন কারও বাঁধন ছিঁড়ে তারা মুক্তি পেল।
কিন্তু জমিদারের ছায়া শেষ পর্যন্ত চিৎকার করে উঠল—
“আমি ফিরব! যতদিন রক্ত মাটিতে, আমি বেঁচে থাকব!”
তার গলা নিভে গেল আগুনের ভেতরে, আর পুরো ঘর কেঁপে উঠল। দেওয়াল ভেঙে পড়ছিল, ছাদ থেকে ধুলো ঝরছিল। অর্ণব তন্ময়ের হাত ধরে দৌড় শুরু করল। সরু করিডর পেরিয়ে তারা অন্ধকার পথ ধরে দৌড়ে চলল। মাথার ওপর ছাদ ভাঙছে, মাটি ফেটে যাচ্ছে, তবু তারা দৌড় থামাল না।
অবশেষে একটা ভাঙা দরজা ঠেলে বাইরে বেরোতেই তারা দেখল—সকাল হয়ে গেছে। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে, গ্রাম ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। জমিদারবাড়ির ভেতরের আগুন যেন বাইরের আকাশকেও লাল করে দিয়েছে।
তন্ময় হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল।
—আমরা… বেঁচে গেছি?
অর্ণব শ্বাস নিতে নিতে চারপাশ দেখল। আগুন ধীরে ধীরে থেমে আসছে, কিন্তু বাড়িটার ভেতর থেকে আসছিল এক শেষ চাপা আওয়াজ—
“ফিরব… আবার ফিরব…”
তারা দুজনেই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল ভাঙা জমিদারবাড়ির দিকে। মাধবীলতা মুক্তি পেয়েছেন, আত্মারা শান্তি পেয়েছে, কিন্তু জমিদারের ছায়া কি সত্যিই নিভে গেছে?
হাওয়ার ঝাপটা এসে তাদের গায়ে ছুঁয়ে গেল। সেই হাওয়ায় ভেসে এলো এক নারীকণ্ঠ—
“ধন্যবাদ…”
আর তার পরপরই দূরে কাক ডাকল তিনবার, যেন কোনো অশরীরী এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অর্ণব তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
—শেষ হয়েছে… না কি এ কেবল শুরু?
দুজনের চোখে ভয়ের সঙ্গে মিশে গেল প্রশ্নচিহ্ন। জমিদারবাড়ি দাঁড়িয়ে রইল অর্ধভাঙা, ছাইয়ের গন্ধে ভিজে। আর বাতাসে মিলিয়ে গেল সেই অন্তিম ডাক।
সমাপ্তি




