Bangla - রহস্য গল্প

অভিশপ্ত গয়নাগুলি

Spread the love

অধ্যায় ১: রাজবাড়ির ধনভাণ্ডার

রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের চারপাশে বিকেলের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। হাওয়ার সাথে সাথে মলিন দেওয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে শুকনো পাতা উড়ে এসে জমছে, যেন সময়ের স্তূপে চাপা পড়া একেকটি স্মৃতি। বহুদিন ধরে গ্রামবাসীর কাছে এই রাজবাড়িকে ঘিরে নানা গল্প প্রচলিত—কেউ বলে এখানে নাকি রাতে অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে, আবার কেউ বলে রাজপরিবারের অশান্ত আত্মারা এখনও ঘুরে বেড়ায়। এসব কাহিনি শুনে অনেকে ভয়ে পা বাড়ায় না, কিন্তু নায়ক/নায়িকা ভেতরে এক ধরনের রহস্যময় টান অনুভব করে। আজ সেই টানেই সে প্রবেশ করেছে পুরনো রাজবাড়ির গা ছমছমে করিডোরে। ভাঙা ছাদের ফাঁক দিয়ে সূর্যের শেষ আলো ঢুকে পড়ছে, আর অচেনা আঁধারের সাথে মিলেমিশে তৈরি করছে এক অদ্ভুত পরিবেশ। প্রতিটি পদক্ষেপে ভাঙা টালি ও ধুলোমাখা ইটের কড়মড় শব্দ শোনা যাচ্ছে, আর সেই শব্দ যেন অজান্তেই সাহস আর ভয়কে একসাথে বাড়িয়ে তুলছে। করিডোরের শেষে একখানা কাঠের দরজা অর্ধেক ভাঙা অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল, তবুও যেন তার ভিতর লুকিয়ে আছে কোনো অচেনা ইশারা। কৌতূহল তাকে থামতে দেয়নি, দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই অচেনা এক গন্ধে ভরে উঠল চারদিক—পুরনো কাঠ, ধুলো আর লুকানো কালের গোপন রহস্যের গন্ধ।

ভেতরে ঢুকেই প্রথমেই চোখে পড়ল, দেয়ালের গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে পড়েছে এবং তার ফাঁকে ফাঁকে পুরনো শৈলীর কারুকাজ এখনও টিকে আছে। মনে হচ্ছিল, বহু বছর আগে এখানে রাজপরিবারের হাসি, উৎসব আর আলোর ঝলকানি ঘুরে বেড়াতো। ঘরের মেঝেতে নরম ধুলো জমে আছে, তাতে পা ফেললেই যেন ভেসে উঠছে একেকটি অজানা ইতিহাসের ছাপ। হঠাৎই তার চোখে পড়ে দেয়ালের কোণে খাড়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের একটি খোদাই করা স্তম্ভ। অন্য সবকিছু থেকে আলাদা লাগছিল সেটাকে—মনে হচ্ছিল, এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে কিছু। কাছে গিয়ে স্তম্ভটা ছুঁতেই অদ্ভুতভাবে একপাশে দুলে উঠল, আর তার নিচ থেকে ফাঁকা জায়গা দেখা গেল। বুক ধকধক করতে লাগল, কিন্তু কৌতূহল ভয়কে জয় করল। সে হাত বাড়িয়ে নিচের অন্ধকার ফাঁকটা একটু সরাতেই হঠাৎ মেঝের ওপরকার এক টালি সরে গিয়ে উন্মুক্ত হলো এক সংকীর্ণ সিঁড়ি। নিচে নামার পথ যেন বছরের পর বছর অদেখা অবস্থায় লুকিয়ে ছিল। ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে সতর্কভাবে সে নিচে নামতে শুরু করল, প্রতিটি ধাপ যেন আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অতীতের অজানা রহস্যের দিকে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল, কিন্তু ভেতর থেকে হালকা এক ঝলকানি আলো চোখে পড়তেই বুকের ভেতর নতুন এক উত্তেজনা জেগে উঠল।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতেই সামনে এক গোপন কক্ষ উন্মোচিত হলো। দেয়ালের গায়ে মশালের পুরনো দাগ, আর মেঝেতে ছড়িয়ে আছে কিছু ভাঙা মাটির কলস। কিন্তু কক্ষের একদম মাঝখানে রাখা ছিল এক অদ্ভুত জিনিস—একটি গাঢ় লাল মখমলের বাক্স। তার ওপর জড়ানো সোনালি নকশা এতটাই স্পষ্ট যে মনে হচ্ছিল যেন কালকেই কেউ সাজিয়ে রেখেছে। বাক্সটির সামনে দাঁড়িয়ে তার গা শিরশির করে উঠল, কারণ আশেপাশের সব নিস্তব্ধতা হঠাৎ আরও গভীর হয়ে এলো। সাহস করে বাক্সটি খোলার মুহূর্তে কক্ষজুড়ে যেন বাতাস ভারী হয়ে উঠল। ঢাকনা উঠতেই চোখ ঝলসে গেল—ভেতরে সাজানো আছে একগুচ্ছ গয়না, যার প্রতিটি পাথর ও সোনার কারুকাজ রঙিন আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল, রাজপরিবারের বহুদিনের ধনভাণ্ডার এখানেই লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, পৃথিবীর চোখ থেকে গোপন করে। প্রতিটি অলঙ্কার যেন কথা বলতে চাইছে, জানাতে চাইছে তাদের দীর্ঘশ্বাসে ভরা ইতিহাস। নায়ক/নায়িকা বাক্সের ভেতর হাত বাড়াতেই তার মনে হলো, এ শুধু সোনা-রূপার গয়না নয়, বরং অগণিত অজানা গল্পের চাবিকাঠি, যা রাজবাড়ির পতনের সাথে সাথে সময়ের আঁধারে চাপা পড়ে ছিল। সেই মুহূর্তে স্পষ্ট হলো, এই আবিষ্কার শুধু একটি গোপন কক্ষের রহস্য নয়, বরং এক নতুন যাত্রার শুরু, যা তাকে নিয়ে যাবে অতীত আর বর্তমানের অদ্ভুত এক সেতুবন্ধনের দিকে।

অধ্যায় ২: অদ্ভুত ঝলকানি

গয়নাগুলোর ঝলকানির সাথে সাথে চারপাশের পরিবেশ হঠাৎই বদলে গেল। যেন কক্ষের বাতাস ভারী হয়ে জমাট বাঁধছিল, অথচ তার মাঝেই এক অদ্ভুত শীতলতা ভেসে বেড়াচ্ছিল। নায়ক/নায়িকা যখন প্রথমবার হাত বাড়িয়ে মখমলের বাক্স থেকে একটি নেকলেস তুলল, তখনই শরীর বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। মনে হলো, মেঝে থেকে উঠে আসা ঠান্ডা বাতাস তাকে ঘিরে ধরেছে, ঠিক যেন কোনো অদৃশ্য হাত তাকে স্পর্শ করছে। মশালের কালো দাগ আঁকা দেয়ালগুলো হঠাৎ কেঁপে উঠল, আর প্রতিটি পাথরের কারুকাজ থেকে ক্ষীণ আলোকরেখা ছড়িয়ে পড়ল। গয়নার পাথরগুলো যেন আর নিস্তব্ধ নেই; বরং তারা নিজেরাই আলো ছড়াতে শুরু করেছে। এই আলো সাধারণ কোনো ঝলকানি নয়, বরং একধরনের জীবন্ত দীপ্তি, যা চারপাশের অন্ধকারকে কেটে এক অচেনা রঙে রাঙিয়ে তুলছিল। আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গেলেও স্পষ্ট হলো, প্রতিটি গয়না যেন একেকটি চাবির মতো—যা খুলে দিতে পারে অজানা ইতিহাসের গোপন দরজা। ঠান্ডা বাতাসের সাথে সেই আলো মিলে গিয়ে কক্ষের মধ্যে এক অতিপ্রাকৃত পরিবেশ তৈরি করল, যা ভয়ের সাথে সাথে কৌতূহলও জাগিয়ে তুলল।

আলো বাড়তে বাড়তে যেন কক্ষের দেয়ালের ভেতর লুকিয়ে থাকা ছবি আঁকতে শুরু করল। ম্লান আলোয় ভেসে উঠল কিছু অচেনা দৃশ্য—রাজপরিবারের উৎসব, রাজকন্যার শোভাযাত্রা, যোদ্ধাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা, আবার কোথাও ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডে রাজবাড়ির পতন। নায়ক/নায়িকা বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে দেখল, প্রতিটি অলঙ্কারের আলোকরেখা যেন তাকে এই দৃশ্যগুলো উপহার দিচ্ছে, ঠিক যেন অতীতের ক্ষণিক জানালা খুলে গেছে। গলার নেকলেসের পাথর থেকে ভেসে আসা আলোয় দেখা গেল এক তরুণী, রাজকীয় সাজে, কিন্তু তার চোখে ভেসে উঠছে অশান্তি ও অশ্রু। অন্য এক গয়নার আভায় দেখা গেল রাজা, মুখে গম্ভীর ভাব, হাতে রাজদণ্ড, কিন্তু তার চারপাশে ষড়যন্ত্রকারীদের ছায়া ঘুরছে। এগুলো যেন নিছক ভ্রম নয়, বরং সত্যি ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি, যা সময়ের গভীর থেকে উঠে এসে নতুন করে কথা বলতে চাইছে। প্রতিটি ঝলকানি যেন রাজবাড়ির ধ্বংসের পেছনের গল্পের টুকরো টুকরো ছবি দেখাচ্ছিল, আর নায়ক/নায়িকার ভেতরে দারুণ এক অনুভূতি তৈরি করছিল—যেন সে একসাথে অতীত ও বর্তমানের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসের ঠান্ডা শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু সেই ভয়ের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ, এক ডাক, যা উপেক্ষা করা অসম্ভব।

অবশেষে বাক্সের ভেতরে থাকা সব গয়নার আলো মিলেমিশে পুরো কক্ষটাকে আলোকিত করে তুলল। মনে হচ্ছিল, চারপাশের অন্ধকারকে সরিয়ে এক অচেনা সূর্যোদয় ঘটছে, যার আলোতে লুকানো ইতিহাস প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। কিন্তু আলো যত বেড়ে উঠছিল, ততই কক্ষের দেয়ালগুলোতে অচেনা লেখা, অদ্ভুত চিহ্ন আর গোপন সংকেত ফুটে উঠছিল। এগুলো দেখতে প্রাচীন মন্ত্রের মতো, যেগুলো বুঝে ওঠা সহজ নয়। নায়ক/নায়িকা কাছে গিয়ে স্পর্শ করতেই চিহ্নগুলো জ্বলে উঠল, আর একধরনের শীতল শিহরণ তার শরীর ভেদ করে গেল। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সে যেন এই কক্ষের অংশ হয়ে গেছে, আর তার হাতে ধরা গয়নাগুলো শুধুই অলঙ্কার নয়—বরং রাজবাড়ির হারানো কাহিনি ফিরিয়ে আনার শক্তি। ঠান্ডা বাতাস তখন আরও তীব্র হয়ে উঠল, যেন কক্ষের অদৃশ্য প্রহরীরা তার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। চোখের সামনে ঝলসে ওঠা আলো আর কানে ভেসে আসা ক্ষীণ শব্দ মিলেমিশে তৈরি করছিল এক ভয়ংকর অথচ মায়াবী সুর, যা তাকে টেনে নিচ্ছিল অজানা যাত্রার দিকে। সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারল—এই গয়নাগুলো কেবল ধনসম্পদ নয়, এরা এক অদ্ভুত শক্তির বাহক, আর তাদের হাতে নিয়ে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে এক ভয়ংকর রহস্যের কেন্দ্রে, যেখান থেকে ফেরার পথ হয়তো আর সহজ হবে না।

অধ্যায় ৩: প্রথম বিপদ

রাজবাড়ির গোপন কক্ষ থেকে ধনভাণ্ডারের খবর বাইরে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। গ্রাম ছোট হলেও মানুষের কৌতূহল ছিল প্রবল; কে কখন কীভাবে ভেতরে প্রবেশ করল, তা নিয়ে নানারকম জল্পনা শুরু হয়ে গেল। নায়ক/নায়িকা চেষ্টাও করেছিল বিষয়টা গোপন রাখতে, কিন্তু ভাগ্যের নিয়মেই গোপন কথাগুলো কখনও গোপন থাকে না। গ্রামের এক ধনী ব্যবসায়ী, যিনি সবসময় অমূল্য জিনিস সংগ্রহ করার নেশায় মত্ত থাকেন, গয়নার কথা শুনেই অস্থির হয়ে উঠলেন। লোভ তার চোখে এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে তিনি নায়ক/নায়িকাকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজি করালেন অন্তত একটি গয়না তাকে হাতে দেওয়ার জন্য। গোপনে সেই ব্যবসায়ী এক নেকলেস সংগ্রহ করে নিলেন, আর তারপর থেকেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল। প্রথম দিনেই তাকে দেখা গেল অকারণে অসুস্থ হয়ে পড়তে; তার চারপাশের বাতাস যেন ঠান্ডা হয়ে আসছিল। লোকজন প্রথমে বিষয়টিকে সাধারণ অসুস্থতা বলে ভেবেছিল, কিন্তু দ্বিতীয় দিনে ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করল।

সেই দিন সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ খবর এলো—ব্যবসায়ীর উপর ভয়ংকর দুর্ঘটনা নেমে এসেছে। ঘোড়ার গাড়িতে করে শহরে যাওয়ার সময় হঠাৎ গাড়ি উল্টে যায়, অথচ আশ্চর্যের বিষয়, চালক বা ঘোড়া কিছু হয়নি, কেবল ব্যবসায়ী গুরুতরভাবে আহত হয়ে পড়ে আছেন। তার শরীরে গভীর ক্ষতচিহ্ন, মাথায় আঘাত, আর মুখমণ্ডলে এক অদ্ভুত ভয়ের ছাপ জমে গিয়েছিল, যেন তিনি কিছু ভীষণ অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখেছেন। দুর্ঘটনার খবর শুনে গ্রাম কেঁপে উঠল; সবাই একসাথে কানাঘুষা শুরু করল যে এ সবই রাজবাড়ির অভিশাপ। যারা শুনেছিল যে ব্যবসায়ীর কাছে রাজবাড়ির গয়না আছে, তারা নিশ্চিত হলো—এই অলঙ্কারগুলোর সাথে কোনো না কোনো শয়তানি শক্তি জড়িয়ে আছে। গ্রাম্য চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বাজারের কোণায় কোণায় গুঞ্জন উঠল, “গয়না যার কাছে যায়, অঘটন ঘটে তার সঙ্গেই।” কেউ কেউ বলল, এই গয়নাগুলো আসলে প্রাচীন মন্ত্রে বাঁধা, যাতে লোভী বা অনুচিত হাতে পড়লেই বিপদ ঘটে। আর এই কাহিনি শুনে ভয়ে অনেকেই রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের কাছেও যাওয়া বন্ধ করে দিল।

নায়ক/নায়িকা খবর শুনে গভীর দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। একদিকে মনে হচ্ছিল, সত্যিই কি গয়নাগুলো অভিশপ্ত? অন্যদিকে নিজের চোখে দেখা সেই আলো, ঝলকানি আর অদ্ভুত ফিসফিসানি তাকে বোঝাচ্ছিল যে এগুলো নিছক অলঙ্কার নয়, বরং এক রহস্যময় শক্তির বাহক। ব্যবসায়ীর দুর্ঘটনা যেন প্রমাণ করে দিল যে এই শক্তি খেলাচ্ছলে ব্যবহার করার নয়। রাতের অন্ধকারে, যখন চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে আসছিল, নায়ক/নায়িকা ভাবতে লাগল—এই গয়নাগুলোকে নিরাপদে রাখার দায়িত্ব কি তার নিজের নয়? কিন্তু একইসাথে মনে হচ্ছিল, এই রহস্যের গভীরে না গেলে হয়তো অভিশাপ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়বে। ব্যবসায়ীর চিৎকার, তার রক্তাক্ত শরীর আর চোখে জমে থাকা আতঙ্কের দৃশ্য যেন ভেসে উঠছিল প্রতি মুহূর্তে। সে অনুভব করল, এ শুধু প্রথম বিপদ, যার শুরু মাত্র হলো। এর পরের অধ্যায়ে হয়তো আরও ভয়ংকর ঘটনা অপেক্ষা করছে, আর তার হাতেই হয়তো সেই অশুভ শক্তিকে থামানোর বা মুক্ত করার চাবিকাঠি।

অধ্যায় ৪: লোককথার ইঙ্গিত

ব্যবসায়ীর দুর্ঘটনার খবর গ্রামে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার পর, এক অদ্ভুত ভয়ের আবহ তৈরি হলো। কারও চোখে চোখে পড়লেই আলোচনা শুরু হয়, আর সেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু একটাই—রাজবাড়ির ধনভাণ্ডার। এমনকি যেসব মানুষ আগে এসব নিয়ে হাসাহাসি করত, তারাও এখন নিঃশব্দ হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল আতঙ্কিত দৃষ্টিতে। এই অস্বস্তিকর পরিবেশের মাঝে নায়ক/নায়িকা সিদ্ধান্ত নিল প্রবীণদের সাথে কথা বলার। গ্রামের বটতলায় বসে থাকা সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধেরা প্রথমে চুপ ছিলেন, কিন্তু তার অস্থির মুখ দেখে ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলেন। একজন কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “তুই যেটা দেখেছিস, ওটা নিছক ধন নয়। এটার পেছনে রক্তের ইতিহাস আছে।” আরেকজন যোগ করলেন, “রাজবাড়ির রানী শেষ নিঃশ্বাসে বলেছিলেন—যে এই ধন স্পর্শ করবে, তার জীবন শোচনীয় হবে।” কথাগুলো শোনার পর চারপাশে গভীর নীরবতা নেমে এলো, যেন পুরনো অভিশাপের ছায়া আবার জেগে উঠেছে। নায়ক/নায়িকার বুকের ভেতর শীতল স্রোত বয়ে গেল, কারণ সে জানত—এখন আর এড়ানোর পথ নেই, গয়নার সাথে তার নিজের সম্পর্ক অটুট হয়ে গেছে।

প্রবীণদের কথার ভেতরে লুকিয়ে ছিল বহু প্রাচীন কাহিনি। তারা জানালেন, রাজবাড়ির শেষ যুগে রানী ছিলেন এক দৃঢ়চেতা অথচ বেদনাময় চরিত্র। বলা হয়, রাজা ধীরে ধীরে রাজকার্যের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে খেলনা হয়ে উঠেছিলেন। রাজকীয় ভোজসভায় হাসি থাকলেও রানীর চোখে সবসময় অশান্তির ছাপ ছিল। কেউ কেউ বলেন, রানী জানতেন তাঁর চারপাশে মৃত্যুর ছায়া ঘনিয়ে আসছে, আর প্রাসাদের ভেতরে বিশ্বাসঘাতকতা রক্তাক্ত পরিণতি ডেকে আনবে। শেষমেশ যখন বিদ্রোহীরা রাজবাড়িতে আগুন ধরায়, রানী পালিয়ে বাঁচার সুযোগ পেয়েও তা নিলেন না। বরং মৃত্যুর আগে তিনি ধনভাণ্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে অভিশাপ উচ্চারণ করেন—“এ ধন যার হাতে পড়বে, তার জীবন অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে, সুখে বাঁচার সুযোগ তার থাকবে না।” এই অভিশাপের কথা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গ্রামবাসী লোককথার আকারে বয়ে এনেছে। কেউ কেউ বিশ্বাস করে, রানীর অস্থির আত্মা এখনও রাজবাড়ির দেয়ালের মাঝে ঘুরে বেড়ায়, আর তার ধনকে রক্ষা করে।

নায়ক/নায়িকা চুপচাপ সব শুনছিল, কিন্তু তার ভেতরে যুদ্ধ শুরু হলো। একদিকে, প্রবীণদের কথায় ভয়ের শীতল ছায়া জমে উঠল; মনে হচ্ছিল, সত্যিই হয়তো রানীর অভিশাপ জীবন্ত হয়ে আছে। অন্যদিকে, সে নিজ চোখে দেখেছে গয়নাগুলোর অদ্ভুত আলো, শুনেছে অজানা ফিসফিসানি—এসব যেন তাকে বলছিল যে এখানে কেবল অভিশাপ নয়, বরং কোনো গুপ্ত ইতিহাসও লুকিয়ে আছে। অভিশাপ হয়তো সত্যি, কিন্তু তার সাথে যুক্ত রয়েছে কোনো অমীমাংসিত রহস্য, যা না খুঁজে বের করলে বিপদ থামবে না। প্রবীণরা বিদায়ী সুরে বললেন, “তুই যদি গয়নাগুলো হাতে নিয়েই থাকিস, তবে সাবধানে চল। কারণ প্রতিটি মুহূর্ত থেকে বিপদ তোকে তাড়া করবে।” এই সতর্কবাণী যেন বাতাসে ঝুলে রইল, আর নায়ক/নায়িকার হৃদয়ে গভীরভাবে বাজল। সে বুঝতে পারল, লোককথার এই ইঙ্গিত শুধু অতীতের গল্প নয়, বরং ভবিষ্যতের সতর্কবার্তাও। আর সেই মুহূর্তে তার মনে স্থির হলো—যে করেই হোক, রাজবাড়ির গোপন ইতিহাস উন্মোচন করতে হবে, না হলে এই অভিশাপের শিকল কেবল তাকে নয়, পুরো গ্রামকে গ্রাস করবে।

অধ্যায় ৫: রহস্যের নথি

রাতের গভীর নীরবতায় রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষে ফের পা বাড়াল নায়ক/নায়িকা। চারদিকে ঝিঁঝিঁর ডাক আর বাতাসের ফাঁকে ভাঙাচোরা দেওয়ালের কড়মড় শব্দে পরিবেশ আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। গয়নার আলো, প্রবীণদের সতর্কবাণী আর অভিশাপের গল্প তাকে বিচলিত করলেও এক অদৃশ্য টান তাকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিল। গোপন কক্ষের ভেতর ঢুকতেই হালকা ধুলোমাখা গন্ধ নাকে এল। চারদিকে ঘুরে ঘুরে সে খুঁজছিল কোনো প্রমাণ, এমন কিছু যা রানীর কাহিনি আর অভিশাপের সাথে গয়নার সম্পর্কের রহস্য উন্মোচন করতে পারে। হঠাৎই নজরে পড়ল দেয়ালের এক কোণে ভাঙা আলমারির মতো কিছু, যার দরজা আধখোলা। ভেতরে হাত ঢোকাতেই আঙুলে ঠেকল চামড়ায় বাঁধানো পুরনো একখানা ডায়েরি। মলাট এতটাই জীর্ণ যে মনে হচ্ছিল স্পর্শ করলেই ভেঙে যাবে। বুক ধুকপুক করতে করতে সে ডায়েরি বের করে এনে মেঝেতে বসে পড়ল, আর বাতাসে ঝুলতে থাকা ইতিহাস যেন ধীরে ধীরে পাতার ভাঁজ খুলে সামনে এসে দাঁড়াল।

ডায়েরির প্রথম দিককার পাতাগুলোতে রানীর ব্যক্তিগত জীবনের কথা লেখা ছিল—একজন নারী হিসেবে তার আশা-আকাঙ্ক্ষা, সন্তানদের প্রতি স্নেহ, আর প্রাসাদের জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের বর্ণনা। কিন্তু যত এগোতে লাগল, পাতার ভাষা ততটাই অস্থির হয়ে উঠতে থাকল। সেখানে ফুটে উঠল বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি—রাজা তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মন্ত্রী ও সেনাপতির প্রতি অন্ধ বিশ্বাস করতেন, অথচ সেই বিশ্বাসই হয়ে উঠেছিল ধ্বংসের মূল কারণ। রানী লিখেছেন কিভাবে সেই মন্ত্রীরা গোপনে বিদেশি শত্রুর সাথে যোগসাজশ করছিল, আর রাজাকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তিনি বর্ণনা করেছেন তার অসহায়ত্বের মুহূর্তগুলো, যেখানে তিনি বারবার রাজাকে সতর্ক করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে চায়নি। ডায়েরির পাতায় পাতায় ভেসে উঠল অশ্রুভেজা শব্দ, আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা ব্যথার ইতিহাস—“আমি জানি, এই প্রাসাদের শেষ শিখা নিভে যাবে অচিরেই।” এক জায়গায় স্পষ্টভাবে তিনি লিখেছেন, যদি ধনভাণ্ডার কোনোদিন বিশ্বাসঘাতকের হাতে যায়, তবে সেই ধন তাদের সর্বনাশ ডেকে আনবে। এখান থেকেই হয়তো অভিশাপের সূত্রপাত।

শেষ দিকের পাতাগুলো ছিল সবচেয়ে শিহরণ জাগানো। সেখানে রানী তার শেষ রাতের অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন—বিদ্রোহীদের আগুনে যখন রাজবাড়ি জ্বলছিল, তখন তিনি ধনভাণ্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “আমার স্বামী মিথ্যে বন্ধুত্বে অন্ধ হয়ে গেছে, প্রাসাদের প্রতিটি স্তম্ভে আজ প্রতারণার ছায়া। আমি এই ধন রেখে যাচ্ছি না উত্তরাধিকারীদের জন্য, বরং সময়ের জন্য, যাতে ভবিষ্যৎ বুঝতে পারে কিভাবে লোভ আর বিশ্বাসঘাতকতা এক রাজ্যের পতন ডেকে আনে।” শেষ কয়েকটি লাইন প্রায় অস্পষ্ট হলেও স্পষ্ট হলো তার অভিশপ্ত প্রতিজ্ঞা—যে এই ধন স্পর্শ করবে, তার জীবনে নামবে অন্ধকার। নায়ক/নায়িকা প্রতিটি শব্দ পড়তে পড়তে বুঝতে পারল, রানীর অভিশাপ নিছক কুসংস্কার নয়, বরং শোক, রাগ আর প্রতারণার বিরুদ্ধে তার চূড়ান্ত ঘোষণা। ডায়েরি বন্ধ করার পর চারপাশের নীরবতা আরও ঘন হয়ে এলো। মনে হলো, রাজবাড়ির ধ্বংসস্তূপের ভেতরে শুধু গয়নাই নয়, বরং এক নারীর যন্ত্রণাভরা আত্মা এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে। আর এই নথি হাতে আসা মানেই—নায়ক/নায়িকার সামনে এখন অপেক্ষা করছে আরও ভয়ংকর সত্য উন্মোচনের পথ।

অধ্যায় ৬: অভিশাপের ছায়া

ডায়েরির পাতাগুলো পড়ার পর থেকে নায়ক/নায়িকার ভেতরে অস্থিরতা থামছিল না। যেন প্রতিটি শব্দ তার শরীরের রক্তে মিশে গিয়েছে, প্রতিটি বাক্য তাকে ঘিরে ফেলেছে অদৃশ্য জালে। প্রথম রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়েই সেই অদ্ভুত অনুভূতি শুরু হলো। জানলার বাইরে চাঁদের আলোয় চারপাশ শান্ত মনে হলেও, ঘরের ভেতরে অচেনা ভারী আবহ ছড়িয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করতে না করতেই মনে হলো, কোথাও থেকে ক্ষীণ কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। স্বপ্ন নাকি বাস্তব—সে বুঝতে পারছিল না। একসময় স্পষ্ট হলো সেই শব্দ রানীর, যিনি ডায়েরির পাতায় নিজের শেষ দিনের বেদনা লিখে গিয়েছিলেন। কাঁপা কণ্ঠে তিনি বারবার বলছিলেন, “আমার ধন… আমার প্রতারণা… আমার অভিশাপ।” নায়ক/নায়িকা ঘুম ভেঙে উঠে বসে দেখল, ঘরের এক কোণে ছায়ার মতো কিছু নড়ছে। বাতাসে অদ্ভুত ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়েছে, আর প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল যেন কেউ অদৃশ্য চোখে তাকিয়ে আছে। বুক ধুকপুক করতে লাগল, কিন্তু কৌতূহল তাকে ভীতির মাঝেই স্থির থাকতে বাধ্য করল।

এরপর থেকে প্রতিদিন রাতেই এমন অদ্ভুত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে লাগল। কখনও স্বপ্নে দেখা যেত রানী অশ্রুভেজা চোখে দাঁড়িয়ে আছেন, চারপাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘুরছে, আর তার ঠোঁট নড়ছে কোনো প্রাচীন মন্ত্রের মতো। আবার কখনও হঠাৎ বিছানার পাশে ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যেত, অথচ চারপাশে কেউ নেই। এক রাতে জানলার কাচে ছায়া নড়ছিল—দূর থেকে যেন রাজকীয় অলঙ্কার পরা এক নারীর প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছিল। নায়ক/নায়িকা কাছে গিয়ে তাকাতেই প্রতিচ্ছবিটি মিলিয়ে গেল, কিন্তু কাচে রয়ে গেল কুয়াশার মতো কিছু চিহ্ন, যেন কেউ হাত রেখে গিয়েছে। এমনকি দিনের বেলায়ও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে শুরু করল। দরজা হঠাৎ নিজে থেকে খুলে যাওয়া, বাতাসে মোমবাতি নিভে যাওয়া, কিংবা ভেতরে ভেতরে অচেনা ফিসফিসানি শোনা—সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল রানীর অভিশাপ তাকে ঘিরে ধরছে ধীরে ধীরে। গয়নার বাক্স, ডায়েরির পাতাগুলো, আর প্রাসাদের ভেতরকার স্মৃতি—সব মিলে এক অজানা শক্তির ছায়া তার জীবনে প্রবেশ করেছে।

এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো একদিকে তাকে ভীত করলেও, অন্যদিকে রানীর বেদনার কণ্ঠ তাকে নাড়া দিচ্ছিল গভীরভাবে। মনে হচ্ছিল, রানী শুধু অভিশাপই দিয়ে যাননি, বরং তাঁর কান্নার ভেতরে কোনো অমীমাংসিত রহস্যের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। প্রতিটি স্বপ্নের শেষে তিনি এক অদ্ভুত দৃষ্টি ছুড়ে দিতেন, যেন বলতে চাইছেন—“সত্যিটা খুঁজে বের কর।” নায়ক/নায়িকার মনে হলো, এই অভিশাপ নিছক মৃত্যুভয় নয়, বরং বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসকে নতুন করে জানানোর এক অদৃশ্য প্রয়াস। তবু ভয়ের ছায়া কাটানো সহজ হলো না। রাত যতই গভীর হতো, ছায়াগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠত, আর কান্নার শব্দ যেন তার বুকের ভেতর আঘাত করত। প্রতিটি ভোরে সূর্যের আলোয় সব মিলিয়ে গেলেও, শরীর ও মনে অস্বস্তি থেকে যেত। তখন সে উপলব্ধি করল—রানীর আত্মা কেবল প্রাসাদেই আবদ্ধ নেই, বরং এখন তার জীবনেও প্রবেশ করেছে। অভিশাপের ছায়া তাকে ছাড়বে না, যতক্ষণ না সে অতীতের পর্দা সরিয়ে সত্যিটা প্রকাশ করতে পারে। আর এভাবেই সে বুঝল, এই যাত্রা এখন আর কেবল কৌতূহল নয়, বরং এক ভয়ংকর দায়, যার থেকে সে পিছু হটার সুযোগ আর নেই।

অধ্যায় ৭: গোপন বংশপরম্পরা

নায়ক/নায়িকার চারপাশে অদ্ভুত ঘটনাগুলো যখন ক্রমশ ঘনীভূত হতে লাগল, তখন সে সিদ্ধান্ত নিল রহস্যের গভীরে যাওয়ার। শুধু ভয় আর অভিশাপের গল্প শুনে আর চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। তাই সে গ্রামে থাকা পুরনো দলিলপত্র খুঁজে দেখা শুরু করল। স্থানীয় পুরোহিত ও প্রবীণদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, রাজপরিবারের ইতিহাস অনেকটাই হারিয়ে গেছে আগুন আর বিশ্বাসঘাতকতার ভেতরে। তবে গ্রামসংলগ্ন মন্দিরের একটি কক্ষে কিছু রেকর্ড এখনও অক্ষত আছে। রাতভর ধুলো-মাখা পুঁথি, মলিন দলিল আর পুরনো খতিয়ান ঘাঁটতে ঘাঁটতে এক আশ্চর্য তথ্য সামনে এলো। এক অচেনা বংশলিপিতে লেখা ছিল—বিদ্রোহের রাতে রাজপরিবারের এক কনিষ্ঠ সন্তান অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিল, যাকে গ্রামবাসীরা গোপনে লুকিয়ে রাখে। সেই শিশুটি ধীরে ধীরে নতুন নাম-পরিচয়ে বড় হয়, এবং তার রক্তধারা টিকে যায় সাধারণ গ্রামীণ জীবনের মধ্যেই। নায়ক/নায়িকা স্তব্ধ হয়ে গেল যখন আবিষ্কার করল, সেই বংশপরম্পরার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তার নিজের পরিবারের নাম ও পরিচয়।

প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি সে। কিন্তু একে একে মিল খুঁজে বের করতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখল, তার ঠাকুরদা যেসব পুরনো গল্প বলতেন—যেখানে রাজকীয় প্রতীক, অচেনা রীতি আর ম্লান স্মৃতির ছায়া পাওয়া যেত—সবই আসলে সেই প্রাচীন বংশের শেষ চিহ্ন। তার পরিবার বহুদিন ধরেই রাজপরিবারের উত্তরসূরি, অথচ এই সত্য গোপন ছিল সময়ের ধুলোয় চাপা পড়ে। মন্দিরের পুরোহিত কণ্ঠ নীচু করে বললেন, “তুমি শুধু একজন সাধারণ মানুষ নও। তোমার রক্তে সেই রাজবংশের ছাপ বহন করছে। তাই এই গয়নাগুলো তোমাকে ডাকছে। এরা অন্যের হাতে ধ্বংস ডেকে আনে, কিন্তু তোমার রক্তে তাদের প্রকৃত সাড়া লুকিয়ে আছে।” কথাগুলো শুনে নায়ক/নায়িকার বুক কেঁপে উঠল। হঠাৎই এতদিনের অস্বস্তি ও রহস্য এক নতুন আলোয় পরিষ্কার হতে লাগল। গয়নার ঝলকানি, রানীর স্বপ্নে কান্না, অভিশাপের ছায়া—সব যেন রক্তের বন্ধনে বাঁধা। সে বুঝতে পারল, এ আর নিছক কাকতালীয় ঘটনা নয়; বরং সে-ই সেই উত্তরসূরি, যাকে নিয়েই এই রহস্যের নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে।

এই আবিষ্কার তাকে নতুন দ্বন্দ্বে ফেলল। একদিকে, সে অনুভব করছিল এক ধরনের গর্ব—যে তার রক্তে রাজপরিবারের ইতিহাস বহমান, যে ইতিহাস শক্তি, গৌরব আর সংস্কৃতির প্রতীক। কিন্তু অন্যদিকে ভয়ানক বোঝাও এসে চাপল তার কাঁধে। কারণ রানীর ডায়েরি স্পষ্ট করে দিয়েছে, ধনভাণ্ডার অভিশপ্ত; বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রতারণার রক্ত সেখানে মিশে আছে। এখন যদি তার পরিবারই প্রকৃত উত্তরসূরি হয়, তবে সেই অভিশাপ কাটানোর দায়ও তার ওপর বর্তায়। সে আর পালাতে পারবে না। গয়নাগুলো শুধু সম্পদ নয়, বরং রক্তের পরীক্ষাও। যদি সে ব্যর্থ হয়, তবে কেবল নিজের নয়, পুরো গ্রামকেও গ্রাস করবে এই অশুভ ছায়া। নীরব রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে নায়ক/নায়িকা তখন বুঝতে পারল—তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ এখন থেকে এই গোপন বংশপরম্পরা ও অভিশপ্ত ধনের রহস্য উন্মোচনের সঙ্গে বাঁধা থাকবে। এই অদৃশ্য শিকল ভাঙার জন্যই তাকে এগোতে হবে, যত ভয়, যত অন্ধকারই সামনে আসুক না কেন।

অধ্যায় ৮: অভিশপ্ত রাত

পূর্ণিমার আলোয় স্নাত গ্রাম যেন এক অদ্ভুত রহস্যে ঢেকে ছিল। আকাশে ঝলমলে চাঁদ, কিন্তু তার সাদা আলো যেন অস্বাভাবিকভাবে ঠান্ডা আর শীতল। নায়ক/নায়িকা রাজবাড়ির গোপন কক্ষে রাখা গয়নার বাক্সটির সামনে বসেছিল, ডায়েরির প্রতিটি শব্দ তার মনে গেঁথে আছে। সে জানত এই রাত অন্য সব রাতের মতো নয়। গোপন বংশপরম্পরার সত্য জানার পর থেকে যেন চারপাশের আবহাওয়া তাকে অদৃশ্যভাবে ঘিরে রেখেছে। ঠিক মধ্যরাতে হঠাৎ মখমলের বাক্সের ঢাকনা নিজে থেকেই কেঁপে উঠল। নায়ক/নায়িকা আতঙ্কে তাকিয়ে দেখল, বাক্সের ভেতরের প্রতিটি গয়না একে একে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। প্রথমে ক্ষীণ আলোকরেখা, তারপর তীব্র ঝলকানি—এমন আলো যা কক্ষের প্রতিটি ইট, প্রতিটি কোণায় প্রতিফলিত হয়ে অস্বাভাবিক দীপ্তি ছড়াল। আলোর সাথে সাথে বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ উঠল, যেন শত অদৃশ্য আত্মা একসাথে হাহাকার করছে। হঠাৎ ঘরের জানলা দপদপ করে খুলে গেল, ঠান্ডা বাতাসে মশাল নিভে গেল, আর চারদিকে অন্ধকারের সাথে সেই ভয়ংকর ঝলকানি মিলে এক অদ্ভুত দৃশ্য তৈরি করল।

গয়নার আলো যত তীব্র হচ্ছিল, ততই আশেপাশের পরিবেশ ভয়ংকর হয়ে উঠছিল। হঠাৎ কক্ষের কোণে রাখা ভাঙাচোরা আসবাবপত্র নিজে থেকেই নড়তে শুরু করল। আলমারির দরজা জোরে আছড়ে পড়ল, দেওয়াল থেকে পুরনো প্রতিকৃতি মাটিতে ভেঙে পড়ল, আর কাচের জানলাগুলো একে একে ফেটে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। চারদিকে শুধু ভাঙচুর আর কোলাহলের শব্দ, অথচ কক্ষে আর কেউ নেই। নায়ক/নায়িকা আতঙ্কে পিছিয়ে এলেও অনুভব করল, এই তাণ্ডবের মাঝেই এক নারীকণ্ঠ ভেসে আসছে। ক্ষীণ, কিন্তু বেদনাভরা কান্না—যা তার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোতের মতো বইতে লাগল। হঠাৎই মনে হলো, রানীর আত্মা উপস্থিত, এবং তিনি তার বেদনা জানাতে চাইছেন। গয়নার আলোতে এক ঝলক প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল—মাথায় মুকুট, গলায় রত্নখচিত হার, কিন্তু চোখে শুধুই অশ্রু। প্রতিটি কাচ ভাঙার শব্দের সাথে তার কণ্ঠ যেন জড়িয়ে যাচ্ছিল, “আমায় মুক্ত করো… আমায় মুক্তি দাও…”।

এই অভিশপ্ত রাত নায়ক/নায়িকাকে বুঝিয়ে দিল, রানীর আত্মা এখনও বন্দি। তার প্রতিশোধের অভিশাপ শুধু ধনকে নয়, পুরো প্রাসাদকেও আঁকড়ে ধরে আছে। গয়নার আলো ও ভাঙচুরের ভয়াবহতা আসলে সেই আত্মার অশান্তি, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুক্তির পথ খুঁজছে। নায়ক/নায়িকা দেখল, বাক্সের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত প্রতীক উঁকি দিচ্ছে, যা আগে চোখে পড়েনি। মনে হলো, এই প্রতীকই হয়তো রানীর শেষ বার্তা, মুক্তির চাবিকাঠি। কিন্তু আলো যত বাড়ছিল, বিপদও ততই ঘনিয়ে আসছিল। জানলার ফাঁক দিয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়ায় কক্ষের ভেতর যেন মৃত্যু-নৃত্য শুরু হলো। মোমবাতি নিভে গেলেও গয়নার আলোয় ঘর ভরে উঠল আতঙ্কে। নায়ক/নায়িকার বুক ধড়ফড় করতে লাগল, তবু সে বুঝল—এই রাত কেবল ভয় দেখানোর নয়, বরং সতর্কবার্তা। রানীর আত্মা মুক্তি চাইছে, আর সেই মুক্তির দায়িত্ব এখন তার কাঁধেই এসে পড়েছে। ভয়, ভাঙচুর আর মৃত্যুর ছায়ার মাঝেই সে উপলব্ধি করল, সময় ফুরিয়ে আসছে। যদি রহস্য উন্মোচন না করা যায়, তবে অভিশাপের ছায়া শুধু তার নয়, পুরো গ্রামকে গ্রাস করবে।

অধ্যায় ৯: মুক্তির আচার

অভিশপ্ত রাতের ভয়াবহতার পর নায়ক/নায়িকার মন এক মুহূর্তের জন্যও শান্ত থাকল না। রানীর কান্না, ভাঙচুরের শব্দ আর গয়নাগুলোর অদ্ভুত ঝলকানি তাকে যেন ক্রমাগত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল—সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তাই সে আবার ছুটে গেল গ্রামের পুরনো মন্দিরে, যেখানে শত শত বছরের ইতিহাস দলিলের মতো সংরক্ষিত আছে। ধুলোমাখা পুঁথি, পোড়া পাতার গন্ধ আর অচেনা লিপির ভিড়ে এক রাত কাটিয়ে দিল সে। একের পর এক অক্ষর ডিকোড করতে করতে অবশেষে সামনে এলো এক রহস্যময় বর্ণনা। তাতে বলা হয়েছিল, রাজবংশের পতনের সময় রানীর অভিশাপ মন্ত্রের মতো ধনে বাঁধা হয়ে যায়, আর সেই অভিশাপ ভাঙার একমাত্র উপায় হলো মুক্তির আচার সম্পন্ন করা। কিন্তু আচার এত সহজ নয়—একজনকে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস বিসর্জন দিতে হবে, আর সেই বিসর্জনই হবে আত্মার মুক্তির দরজা খোলার চাবি। নায়ক/নায়িকা দীর্ঘক্ষণ নীরবে বসে রইল। চোখের সামনে ভেসে উঠল রানীর মুখ, তার কান্না, তার অসহায় লেখা, আর গ্রামবাসীর ভয়ের ছায়া। অভিশাপ ভাঙা জরুরি, কিন্তু নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস বিসর্জন দেওয়ার শর্ত তাকে শিহরিত করে তুলল।

পুঁথিতে আচার সম্পন্ন করার বিস্তারিত বর্ণনা ছিল। পূর্ণিমার রাতেই এই আচার করা সম্ভব, কারণ চাঁদের আলো আত্মাদের আবদ্ধ শিকল দুর্বল করে দেয়। রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের কেন্দ্রে, যেখানে একসময় রাজসিংহাসন ছিল, সেখানে গয়নাগুলো মখমলের বাক্সসহ রাখতে হবে। চারপাশে অগ্নিবৃত্ত তৈরি করে প্রাচীন মন্ত্র পাঠ করতে হবে। সেই সময়ে যার রক্তে রাজবংশের ধারা বহমান, তার কাছ থেকেই চাই বিসর্জন। বিসর্জন মানে কেবল রক্ত নয়, বরং হৃদয়ের গভীর থেকে কোনো প্রিয় জিনিস, যা আত্মাকে তুষ্ট করবে। নায়ক/নায়িকা বুঝল, পুঁথিতে লেখা প্রতিটি শব্দ তার জন্যই, কারণ বংশপরম্পরার সত্য সে-ই এখন জানে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেল—তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কী? চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ল শৈশবের স্মৃতি, পরিবারের হাসি, মায়ের দেওয়া একটি পুরনো লকেট, যা সবসময় তার গলায় ঝুলে থাকে। এ লকেটই ছিল তার শেকড়ের প্রতীক, তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। বুক কেঁপে উঠল এই ভেবে—আচার সম্পন্ন করতে হলে কি তবে তাকে এই লকেট বিসর্জন দিতে হবে?

রাতের আকাশে ম্লান আলো ছড়িয়ে পড়ছিল, আর সময় দ্রুত ঘনিয়ে আসছিল। নায়ক/নায়িকার মনে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠল। যদি সে আচার না করে, তবে অভিশাপ থেকে যাবে, গ্রাম একের পর এক দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত হবে। কিন্তু যদি আচার করে প্রিয় জিনিস বিসর্জন দেয়, তবে সে হারাবে তার হৃদয়ের গভীরতম সঙ্গীকে। পুঁথির শেষ পাতায় রানীর হাতের লেখা মতো এক সতর্কবার্তা ছিল—“বিসর্জন ছাড়া মুক্তি নেই, মুক্তি ছাড়া শান্তি নেই।” সে বুঝল, রানীর আত্মা মুক্তি চায়, আর সেই মুক্তির মূল্য দিতে হবে তাকে। চাঁদ আকাশে উঁচু হয়ে উঠছিল, বাতাসে আবার ভেসে আসছিল কান্নার প্রতিধ্বনি। নায়ক/নায়িকার চোখে জল ভরে গেল, কিন্তু তার ভেতরে ধীরে ধীরে দৃঢ়তা জন্ম নিতে লাগল। সে জানল, অভিশাপ ভাঙতে হলে তাকে নিজের প্রিয় জিনিস বিসর্জন দিতেই হবে। আর সেই বিসর্জন হয়তো শুধু রানীর মুক্তিই দেবে না, বরং তার নিজের জীবনের অর্থকেও নতুন আলোয় ভরিয়ে তুলবে।

অধ্যায় ১০: সমাপ্তির আলো

পূর্ণিমার রাত আবার গ্রামকে সাদা আভায় ঢেকে দিল। আকাশে ঝলমলে চাঁদ, কিন্তু সেই আলোতে এবার ভয় নয়—একটি অনিবার্য সিদ্ধান্তের ভার নেমে এল নায়ক/নায়িকার হৃদয়ে। রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের কেন্দ্রস্থলে, যেখানে একসময় সোনালী সিংহাসন দাঁড়িয়ে থাকত, সেখানে সে মখমলের বাক্সে গয়নাগুলি সাজিয়ে রাখল। চারপাশে শুকনো কাঠ ও তেলের প্রদীপ দিয়ে অগ্নিবৃত্ত তৈরি করল, যেন আগুনের শিখা বৃত্তবন্দি করে রেখেছে সেই অভিশপ্ত ধনকে। ঠান্ডা বাতাস বইছিল, দূরে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছিল, আর রাতের অন্ধকারে গ্রাম যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছিল। পুঁথিতে লেখা মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করল নায়ক/নায়িকা। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে গয়নাগুলির পাথরগুলো তীব্র আলো ছড়াতে লাগল, যেন শেষবারের মতো তারা সমস্ত শক্তি প্রকাশ করছে। হঠাৎই আকাশে বজ্রপাতের মতো গর্জন হলো, বাতাসের ঝাপটা অগ্নিশিখাকে দুলিয়ে দিল, আর চারপাশের দেয়াল কেঁপে উঠল। তবু নায়ক/নায়িকা থামল না। তার চোখ গড়িয়ে পড়ছিল জল, বুকের ভেতর কেঁপে উঠছিল আবেগ, কিন্তু হাতের মুঠোয় ধরা ছিল মায়ের দেওয়া সেই পুরনো লকেট—তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস, যা বিসর্জন দেওয়ার জন্যই আজ প্রস্তুত।

যখন মন্ত্রোচ্চারণ শেষ পর্যায়ে পৌঁছাল, তখন গয়নাগুলির আলো এত তীব্র হলো যে চোখ খোলা রাখা দুষ্কর হয়ে উঠল। নায়ক/নায়িকা লকেটটি বুকে চেপে ধরল, শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে আকাশের দিকে তাকাল। ঠিক তখনই সে অনুভব করল—রানীর আত্মা তার চারপাশে ঘুরছে, অদৃশ্য ছায়া যেন তাকে ঘিরে রেখেছে। বাতাসে কান্নার প্রতিধ্বনি মিলিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে এক বেদনাভরা দীর্ঘশ্বাসে রূপ নিল। হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা শক্তি দিয়ে নায়ক/নায়িকা লকেটটিকে আগুনের বৃত্তে ছুড়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে আগুন শিখরে পৌঁছাল, আর তার তাপে গয়নাগুলির আলো ক্রমশ ম্লান হতে শুরু করল। হঠাৎ আকাশ জুড়ে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এল—না ছিল বজ্রপাত, না ছিল হাহাকার। আগুনের ভেতর থেকে ভেসে উঠল রানীর ক্ষীণ প্রতিচ্ছবি, চোখে অশ্রু নয়, বরং শান্তির দীপ্তি। তিনি নীরবে হাতজোড় করে প্রণাম জানালেন, যেন শতাব্দীর বেদনা শেষে মুক্তি পেয়েছেন। এক মুহূর্তেই প্রতিচ্ছবি মিলিয়ে গেল, আর বাতাসে ভেসে এল এক প্রশান্ত স্রোত, যা কেবল নায়ক/নায়িকা নয়, পুরো ধ্বংসপ্রাসাদকেও ছুঁয়ে দিল।

গয়নাগুলির আলো তখন নিভে গেছে। মখমলের বাক্স নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে, আর তার ভেতরের রত্নগুলো অচেনা, প্রাণহীন পাথরের মতো হয়ে গেছে। তাদের ঝলকানি, রহস্য আর অভিশপ্ত শক্তি চিরতরে নিঃশেষ হয়েছে। নায়ক/নায়িকা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, বুক ভরে এল দুঃখ আর স্বস্তির মিশ্র অনুভূতিতে। সে জানে, আজ সে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হারিয়েছে, কিন্তু তার বিনিময়ে মুক্তি পেয়েছে এক নিরপরাধ আত্মা, আর রক্ষা পেয়েছে সমগ্র গ্রাম। রাজবাড়ির ভাঙা দেয়ালগুলো যেন হালকা নিশ্বাস ফেলল, অন্ধকারের চাপ সরে গিয়ে পূর্ণিমার আলোয় জেগে উঠল শান্ত পরিবেশ। গ্রামবাসীরা যখন সকালে ধ্বংসাবশেষে এসে নায়ক/নায়িকাকে পেল, তারা দেখল তার মুখে এক অবর্ণনীয় প্রশান্তি। সেই দিন থেকে কেউ আর গয়নাগুলিকে ছুঁতে সাহস করেনি, কারণ সেগুলো হয়ে গেছে নিছক স্মৃতি—অতীতের ছায়া। অভিশাপ ভাঙা গেছে, কিন্তু মূল্য চিরকাল মনে করিয়ে দেবে যে মুক্তি কখনো সহজে আসে না। নায়ক/নায়িকা জানল, তার বিসর্জন শুধু রানীর আত্মাকেই শান্তি দেয়নি, বরং তার নিজের বংশধারাকেও অভিশাপের শিকল থেকে মুক্ত করেছে। পূর্ণিমার আলোয় ধীরে ধীরে ভোর নামতে থাকল, আর তার সঙ্গে জন্ম নিল এক নতুন সূচনা।

***

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *