Bangla - প্রেমের গল্প

অভিমান, কফি ও আমি

Spread the love

সুমনা বসাক


(এক)

নয়না সাহা প্রথম দিন অফিসে ঢুকেই একটু থমকে গিয়েছিল। ছিমছাম ফ্লোর, ছায়াঘেরা আলো, আর প্রফেশনাল পোশাকের নিচে অসংখ্য অভিব্যক্তি চাপা দিয়ে রাখা মুখগুলো যেন তার দিকে তাকিয়ে ছিল না—তবু এক অদৃশ্য মানদণ্ডে তাকে মেপে নিচ্ছিল। লাল পাথরের আধুনিক বিল্ডিংয়ের পঞ্চম তলায় “সিগমা ইনফোটেক”-এর কনটেন্ট বিভাগে সে সদ্য জয়েন করেছে একজন জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করে সদ্য পাশ করা একটা মেয়ে, যার চোখে কিছুটা দৃষ্টির সংকোচ, কিছুটা আবেগ আর কিছুটা “আমি পারব তো?” ধরনের সংশয়। টিমের এক সিনিয়র—তিথি ঘোষ—তার ডেস্ক অবধি পৌঁছে দিয়ে হালকা করে বলল, “এই অফিসে বেশি কথা না বলাই ভালো। কাজ ঠিক থাকলেই সবাই আপনাকে পছন্দ করবে।” নয়না একটা শুকনো হাসি দিয়ে বসে পড়ল, ডেস্কে তখনও নিজের নামের লেবেল লাগেনি। কাচের দেয়ালের ওপারে যারা বসে, তাদের চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে রাখা নীরবতা যেন নিজেই কাজের শব্দগুলো শুষে নিচ্ছিল। সেই নিঃশব্দ পরিবেশে একমাত্র চলমান শব্দ ছিল ক্লিক-ক্লিক করে চলা কিবোর্ড আর গুঞ্জনহীন এয়ার কন্ডিশনের মৃদু নিশ্বাস। ঠিক তখনই, সকাল সাড়ে দশটার দিকে, একটা কাপে ধোঁয়া ওঠা কফি এসে পড়ল তার ডেস্কে—কেউ কিছু না বলে রেখে গেল, এমনভাবে যেন সেটাই নিয়ম। নয়না অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, একজন সুপুরুষ, গম্ভীর মুখের, চোখে বুদ্ধিমত্তার ছায়া—কোটপরা এক ব্যক্তি, সামান্য ঝুঁকে কফিটা রেখে মাথা হেলিয়ে এগিয়ে গেলেন নিজের ডেস্কের দিকে। কারো সঙ্গে কথা নয়, হাসিও নয়। “কে উনি?” – নয়না তিথিকে জিজ্ঞেস করল। তিথি চোখ দিয়ে দেখিয়ে বলল, “সৌরভ মুখার্জি—আমাদের সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার। ও কফি বানায় নিজে, আর কাকে কাকে দেয়, সেটা কারোর জানার দরকার নেই।” নয়নার তখন একটাই ভাবনা—সে তো কফি খায় না, তাও আবার কালো কফি! কিন্তু কাপ থেকে আসা সেই ধোঁয়ার ঘ্রাণে যেন কিছু একটা ছিল, অচেনা অথচ টান ধরানো।

প্রথম দিন পেরিয়ে গেল, পরদিন সকালেও ঠিক একই সময়ে আবার সেই ধোঁয়াওঠা কালো কফি এসে হাজির হল নয়নার ডেস্কে। সৌরভ মুখার্জি এসে রেখে গেলেন, কিছু বললেন না। তৃতীয় দিনও একই ঘটনা। নয়না প্রথমে বিরক্ত হয়েছিল, ভাবছিল এটা নিশ্চয়ই কোনো ভুল কিংবা হঠাৎ পাওয়া সিনিয়রের করুণা। কিন্তু চতুর্থ দিনে সে কফির কাপটা হাতে তুলেই দেখল, ফেনার গায়ে লেখা সামান্য দাগ—‘S’ অক্ষরটা যেন কফির ঢেউয়ে গা ভাসিয়েছে। তার বুকের মধ্যে একটা কৌতূহলের স্পন্দন শুরু হল, এমন এক অনুভব যা সে আগে কোনো অফিস-ঘণ্টার শুরুতে পায়নি। তিথি তো মজা করে বলেই ফেলল, “তুই তো তোর জ্যাঠামশাইকে প্রেমে পড়বি দেখছি!” নয়না হেসে উড়িয়ে দিল, কিন্তু কফির স্বাদ তাকে এখন আর বিরক্ত করে না, বরং সে ধীরে ধীরে মুখ লাগিয়ে খেতে শুরু করল। প্রথম ক’দিন ছিল তেতো, তারপর স্বাদ বদলাতে শুরু করল। কোনোদিন কম কড়া, কোনোদিন হালকা গন্ধে দারচিনির ইঙ্গিত, আবার কোনোদিন এত নিঃসাড় কফি যে মনে হয় যেন বলা হচ্ছে, “আজ শুধু থেকো, কথা না বললেও চলবে।” নয়না বুঝতে পারছিল না, এটা কি নিছক সদয় অভ্যেস, নাকি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে কোনো নিরব সংলাপ, যেটা কফির কাপ দিয়ে শুরু হলেও শেষ কোথায় হবে জানা নেই। সৌরভ কখনও তার চোখে চোখ রাখেন না, এমনকি ফ্লোরে দেখা হলেও নীরব মাথা নোয়ানো ছাড়া আর কোনো অভিব্যক্তি দেখান না, অথচ এই কালো কফির মধ্যে এক অনুচ্চারিত অনুভব জমে উঠছে—নয়নার অফিসজীবনের প্রথম রহস্যময় সম্পর্ক।

একদিন তিথি যখন ছুটিতে, নয়না একা বসে কাজ করছিল। দুপুর গড়িয়ে গেলে হঠাৎ ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণ। কেউ কিছু না বলে একে একে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নয়না তখন মাথা নিচু করে একটা রিপোর্ট শেষ করার চেষ্টা করছিল। ঠিক সেই সময় সৌরভ এসে দাঁড়াল তার টেবিলের পাশে, হাতে সেই এক কাপ কফি—তবে এবার কাপটা রেখে না গিয়ে কিছু বললেন, খুব নিচু স্বরে, যেন নিজের কাছেই কথা বলছেন, “তুমি কি জানো, এই কফিটা আসলে তেতো নয়… এটা শোনার মতো?” নয়না প্রথমবার তার চোখে চোখ রাখল। গাঢ় বাদামি চোখ, চোখের নিচে ক্লান্তির রেখা, আর গলার নিচে জমে থাকা অপ্রকাশিত কিছু বলার ইচ্ছা। সে কিছু বলল না, শুধু মাথা নাড়ল। সৌরভ হাসলেন না, কিন্তু তার চোখে এক আলতো প্রশ্রয় ফুটে উঠল—কফির মতোই, একবারে স্পষ্ট নয়, তবু অনুভবযোগ্য। সেদিন কফির স্বাদ ছিল অন্যরকম, হালকা ঝাঁজ, হালকা নরমতা, যেন শব্দহীন কোনো কবিতা। নয়না বুঝে গেল, এই গল্পটা কেবল অফিস বা কফি পর্যন্ত থেমে থাকবে না। এটা হতে চলেছে এমন এক সম্পর্ক, যেখানে কোনো সংজ্ঞা নেই, কোনো প্রেমের প্রতিজ্ঞাও নয়—শুধু প্রতিদিনের চুপচাপ উপস্থিতি, এক কাপ কালো কফির মধ্যে মিশে থাকা একটুখানি আত্মা, আর তাতে গলে যাওয়া নীরব ভালোবাসার শব্দ।

(দুই)

প্রতিদিন সকাল সাড়ে দশটা যেন নয়নার জীবনে এক নতুন অর্থ নিয়ে হাজির হয়—এক কাপ কালো কফির ধোঁয়া আর সৌরভ মুখার্জির চুপচাপ উপস্থিতি যেন দিনে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় মন থিতু হওয়ার জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে। অফিস নামক যান্ত্রিকতার ভেতরেও একটা অদৃশ্য উষ্ণতা জমা হতে থাকে, যা শুধু নয়নার ডেস্কের কোণায় নয়, তার মনেরও নির্জন কোনো কোণায় নড়ে ওঠে। তিথি মাঝে মাঝে বলত, “তুই যদি একদিন না যাস, দেখবি কফির কাপটা ফাঁকা পড়ে থাকবে।” আর নয়না হেসে বলত, “তা যদি হয়, বুঝবি এটা কেবল অভ্যেস নয়।” কিন্তু সে নিজেই বুঝতে পারছিল, কফির স্বাদ শুধু জিভে নয়, মনেও ছাপ ফেলছে। একদিন সে সাহস করে নিজের ফ্লাস্কে করে একটা কফি বানিয়ে আনে—হালকা চিনিযুক্ত, দুধের ছোঁয়া—সৌরভের রুচির ঠিক উল্টো। দুপুরে কাজের ফাঁকে সে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে রাখে সৌরভের ডেস্কে সেই ফ্লাস্ক, একটি ছোট্ট স্টিকি নোটে লেখে—”আজ আমিও চেষ্টা করলাম তোমার মতো কিছু শেখার। স্বাদ কেমন?” তারপর সরে আসে। পুরো বিকেলটা নয়নার চোখ শুধু ঘড়ির কাঁটায় ঘুরতে থাকে, বারবার মন ছুটে যায় তার ডেস্ক থেকে কিছু দূরের একটি কোণে, যেখানে সৌরভ কিবোর্ডে টাইপ করছে নিশ্চুপভাবে। সে কোনো জবাব দেয় না, নোট ফেরত আসে না, এমনকি কৃতজ্ঞতা সূচক ছোট্ট হাসিও না। কিন্তু সেইদিন সন্ধ্যায় যখন সবাই অফিস ছাড়ে, নয়না দেখে ফ্লাস্কটা নিঃশব্দে তার ডেস্কে ফিরে এসেছে, তাতে লেখা একটিমাত্র শব্দ—”শিখছি।” শুধু এই এক শব্দে নয়নার ভেতর যেন এক সমুদ্র আলোড়িত হয়, কারণ এটা শুধু উত্তর নয়, এক নীরব সম্মতি—সম্পর্কের, সাহচর্যের, এমনকি একভাবে অনুভবের।

এরপর থেকে কফির স্বাদ একটু একটু করে বদলাতে থাকে। কখনও ঝাঁঝালো, কখনও মসৃণ। নয়না বুঝতে শিখে গেছে যে এই কাপগুলো কেবল কফির বাহক নয়, এগুলো সৌরভের প্রতিদিনকার মনের অবস্থার ইঙ্গিত। কোনোদিন যদি কফির কাপটা আসে একটু দেরিতে, নয়নার মন অস্থির হয়ে ওঠে। আর যদি কফির কাপের পাশে পড়ে থাকে একটা কাগজের রুটিন, নয়না বুঝে যায়—আজ সৌরভ ব্যস্ত, কিন্তু ভুলে যায়নি। একটা নিরব যোগাযোগ তৈরি হয়েছে, যেখানে শব্দ নেই, অথচ সব বলা হয়ে যায়। এক সন্ধ্যায় নয়না সাহস করে তার ডেস্কে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি সবসময় একাই কফি খান?” সৌরভ মাথা নাড়ল, বলল না কিছু, শুধু বলল, “খাওয়ার সাথী থাকলেও, স্বাদ নিজের মতো খুঁজে নিতে হয়।” নয়নার মনে হল, এই মানুষটা কোনো বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে—একটা কফিশপের কোণে বসে থাকা কবি, যিনি কোনোদিন প্রকাশ করেননি নিজের লেখা, শুধু কাউকে কফির স্বাদ দিয়ে বুঝিয়েছেন তার অনুভব। তিথির মুখ তখন লেগেই থাকে খিলখিলে হাসিতে, “তোর প্রেম কিন্তু ইন্টারনেটের বাইরে হচ্ছে! ভাব! এমনও হয়!”

একদিন অফিসের করিডোরে হঠাৎ নয়না সৌরভকে দেখে বলল, “একটা কথা বলব?” সৌরভ তাকাল, চুপচাপ। নয়না বলল, “আপনার কফি খেতে খেতে এখন আমি কফি খাওয়া শিখে গেছি। কিন্তু আপনি কখনো জিজ্ঞেস করেননি আমি আদৌ কফি পছন্দ করি কিনা।” সৌরভ একটু থেমে বলল, “আমি জিজ্ঞেস করতে চাইনি, কারণ তুমি পছন্দ করো কিনা সেটা জানলে, হয়তো দেওয়া বন্ধ করে দিতাম।” নয়নার ঠোঁটে এক ফালি হাসি ফুটে উঠল, “তাহলে দিতেন না?” সৌরভ তখন একটা অদ্ভুত হাসি দিল, যা তার মুখে প্রথমবার দেখা গেল—এক ধরনের ভারহীন, সত্যিকারের অভিব্যক্তি—বলল, “তুমি তো জানো, কিছু কিছু অভ্যেস শুরু হয় নিজের জন্য, শেষ হয় অন্য কাউকে দিয়ে।” নয়না কোনো উত্তর দিল না, শুধু পাশে রাখা কাপটা হাতে তুলে বলল, “আজকেরটা অনেকটা তোমার মতো—চুপচাপ, অথচ প্রভাবশালী।” সৌরভ চোখ সরিয়ে নিল, কিন্তু তার মুখে সেই নিরব হাসি রয়ে গেল, যেন কফির কাপেই জমে থাকা এক চুমুক জীবন। সেই মুহূর্তে নয়নার মনে হল, অফিসের প্রতিদিনকার একঘেয়েমি আর বাইরের ব্যস্ত শহরের ট্রাফিকের মধ্যে, একটা জায়গা আছে—যেখানে এক কাপ কালো কফি শুধু পানীয় নয়, সম্পর্কের একমাত্র ভাষা। আর সে ভাষা, ধীরে ধীরে তারা দুজনেই শিখছে—প্রতিদিন একটু করে।

(তিন)

সকালের আকাশটা আজ একটু ধূসর, জানালার বাইরে কুয়াশার মতো ছড়ানো হালকা মেঘ। নয়না অফিসে ঢুকেই টের পেল আজকের সকালটা একটু বেশি নীরব, যেন শব্দেরা অপেক্ষা করছে কফির ধোঁয়া উঠা পর্যন্ত। ডেস্কে বসতেই সে কৌতূহলের সঙ্গে চারপাশ দেখে, আর ঠিক সময়মতো সেই পরিচিত ধোঁয়া ওঠা কাপটি এসে পৌঁছায়। কিন্তু আজকের কাপে একটু ভিন্নতা—মাথার ওপরে একটা ছোট্ট হলুদ পোস্ট-ইট লেগে আছে, লেখা রয়েছে শুধু—”আজ তুমি কি মনে রেখে কফি খাবে?” নয়নার বুকের মধ্যে যেন একটু থেমে যায় সব শব্দ। এই তো প্রথমবার, সৌরভ তার কাছে কোনো প্রশ্ন রাখল, তাও আবার এত অলৌকিকভাবে ব্যক্তিগত। সে ধীরে ধীরে কফির কাপটা হাতে তোলে, নিঃশ্বাস নিয়ে চুমুক দেয়। স্বাদটা অন্যরকম—গাঢ় কিন্তু হালকা চিনির ছোঁয়া, যেন মনে রাখার মতো কিছু একটা আসছে সামনে। অফিসের সারাদিনটা আজ তার জন্য অন্যরকম কেটে যায়। রিপোর্ট লিখতে লিখতে তার মনে পড়ে বাবার হাত ধরে প্রথম স্কুলে যাওয়া, কলেজের লাস্ট ডে তে বন্ধুরা মিলে শেষবার মাঠে বসে আড্ডা দেওয়া, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির করিডোরে সেই ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকা মুহূর্ত—যার নামটা আজ ভুলে গেছে সে। সৌরভ মুখার্জি কি বুঝতে পারছেন না, এই মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কত স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে? হয়তো বা এই কফি শুধুই তার নিজের মনের দরজা খোলার চাবি।

বিকেলে হঠাৎ প্রিন্টার রুমে দেখা হয় সৌরভ আর নয়নার। কাগজ বেরিয়ে আসার শব্দের ফাঁকে নয়না বলেই ফেলে, “আজকের কফিটা একদম ‘মেমোরি ব্লেন্ড’-এর মতো লাগছে।” সৌরভ চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, “মেমোরি ব্লেন্ড?” নয়না হেসে বলে, “হ্যাঁ… যেমন স্বাদ নিলে পুরোনো কিছু মনে পড়ে যায়।” সৌরভ মাথা নাড়িয়ে বলেন, “তোমার স্মৃতিতে যদি আমি ঢুকতে পারতাম, তাহলে হয়তো কফির স্বাদ আরও নিখুঁত হত।” নয়না একটু চমকে যায়, কিন্তু শব্দগুলো গায়ে গায়ে গড়িয়ে পড়ে তার মধ্যে—এক চিমটে বিস্ময়, এক চুমুক লজ্জা আর একটু ইচ্ছের খেলা। তারপর সে হেসে বলে, “তাহলে কাল থেকে আপনার দায়িত্ব শুধু কফি নয়, স্মৃতি গুলেও দেওয়া।” সৌরভ কিছু বলেন না, শুধু চলে যাওয়ার সময় বলে, “স্মৃতি গুলতে জানলে, কেউ আর একা থাকে না।” নয়না বুঝতে পারে, এই মানুষটি প্রতিদিন একটু করে তাকে এমন এক জগতে নিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে শব্দ না বললেও সব বোঝা যায়, শুধু একটা কফির কাপে ভেসে থাকা আলো-ছায়ার খেলা দিয়ে। সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে সে নিজের ডায়েরিতে লেখে—”আমি আজকাল কফির মধ্যে ছবি দেখি। যিনি দিয়ে যান, তিনিও হয়তো জানেন না, তাঁর প্রতিদিনের এই অভ্যেস কীভাবে আমার ভেতরের গোপন ঘরগুলো আলোকিত করে।”

পরদিন সকালটা আরও বিস্ময় নিয়ে আসে। নয়নার ডেস্কে কফির পাশে পড়ে থাকে একটা ছোট খাম। খাম খুলতেই সে দেখে, একটা সাদা কাগজে আঁকা একটি পেন্সিল স্কেচ—একটি মেয়ে, জানালার পাশে বসে কফির কাপ হাতে, চোখ তার বাইরে তাকানো, চুলের রেখা উড়ছে হাওয়ায়। নিচে লেখা—”তোমাকে আমি এমন দেখি।” নয়না মুহূর্তে থেমে যায়। এ কি স্বপ্ন? সে চারপাশে তাকায়, কেউ কিছু বলছে না, সবাই কাজে ব্যস্ত। কিন্তু তার ভেতরে আজ একটা ঝড় চলছে। সে বোঝে, এই সম্পর্ক আর শুধু কফির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা শিল্পে পৌঁছেছে—যেখানে কফি শুধু একটি বাহন, আসলে যা পৌঁছে গেছে গভীর অনুভবের স্তরে। নয়নার চোখ ছলছল করে ওঠে, জানে না কেন, শুধু মনে হয়—কখনও কখনও চুপচাপ থেকে যাওয়া পুরুষেরা হয়ত সবচেয়ে গভীর ভাষা জানে, শব্দ না বলেও যাঁরা প্রেম বোঝাতে পারেন, এক কাপ কালো কফির ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে।

(চার)

নয়নার মাথার মধ্যে সারা দিন যেন ঝিরঝির করে চলেছে সেই পেন্সিল স্কেচটা। অফিসের অন্য সবাই কাজের ফাঁকে ফোন দেখছে, চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিচ্ছে, কেউ মিটিং রুমে ঢুকছে আবার কেউ বেরোচ্ছে—সব যেন আগের মতোই। শুধু নয়নার জন্য পৃথিবীটা একটু ধীর হয়েছে, একটু গাঢ় হয়েছে রঙে, যেন সৌরভ মুখার্জির আঁকা সেই রেখাগুলো তার বাস্তবকে স্পর্শ করে গেছে। এতটা নিখুঁতভাবে কেউ তাকে কখনও দেখে নি—চোখের দিকে তাকিয়ে অনুভব আঁকা, এ যেন ছবি নয়, একটা ব্যাখ্যা। সে অফিসে ঢোকার পর সৌরভের দিকে তাকায়, কিন্তু আজ তিনি চুপচাপ নিজের ডেস্কেই, কোনো অতিরিক্ত হাসি বা ভঙ্গিমা নেই, যেন কিছু হয়নি। কিন্তু এই নিঃশব্দ ভঙ্গিতেই যে শব্দের চেয়েও বড় ভাষা লুকিয়ে থাকে, সেটা নয়না বুঝে গেছে। দুপুরের দিকে সাহস করে সে ছোট্ট একটা কাগজে লেখে—”এই ছবির গল্প শুনতে চাই একদিন।” তারপর সেটি মুড়িয়ে কফির খালি কাপের নিচে রেখে আসে সৌরভের ডেস্কে। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন সে নিজের ডেস্কে ফিরে আসে, দেখে কফির নতুন কাপ এসে দাঁড়িয়ে আছে যথারীতি, আর তার পাশে পড়ে আছে একটি কাগজ—তাতে লেখা, “ছবির গল্প ততদিনই সুন্দর, যতদিন তা বলা হয়নি। বললেই হয়তো রঙ ফিকে হয়ে যাবে। তুমি শুধু দেখে যাও, আমি আঁকতে থাকি।” নয়নার বুকের ভেতর যেন হালকা কাঁপন, অভিমানে নয়—অদ্ভুত এক সম্মতির কাঁপন, যেন প্রেম বলে কিছু শুরু হয়নি ঠিকই, কিন্তু শেষও হয়নি কিছু, কেবল প্রতিদিন একটু একটু করে তৈরি হচ্ছে এক ভেতরের আশ্রয়।

এরপর কিছু দিন একরকম যায়। কফির স্বাদ মাঝেমধ্যে বদলায়—কখনো তেঁতো, কখনো হালকা নোনতা, আবার কখনো দারচিনির ইঙ্গিতে পূর্ণ। নয়নার মন এখন এমনই হয়ে গেছে যে সে শুধু স্বাদে নয়, গন্ধে বুঝে ফেলে আজ সৌরভ কেমন মুডে আছেন। সে নিজেও একদিন নিজের হাতে কফি বানিয়ে সৌরভের টেবিলে দিয়ে আসে—তাতে একটা ছোট্ট প্লাস্টিক চামচ দিয়ে আঁকা একটা হৃদয়ের চিহ্ন, আর নিচে পোস্ট-ইটে লেখে, “আজ আমিও কিছু আঁকতে চাইলাম।” সৌরভ সেই কফির দিকে তাকিয়ে কিচ্ছু বলে না, শুধু গভীরভাবে দেখে, তারপরে নয়নার দিকে না তাকিয়ে নিজের ডেস্কে চলে যায়। পরদিন নয়নার ডেস্কে কফির কাপের পাশে একটা ছোট ক্যানভাস পড়ে থাকে—তাতে অ্যাক্রেলিকে আঁকা কফির কাপ, তার ওপরে এক জোড়া চোখ, নিচে লেখা—”এত সহজে আঁকো না, নয়তো হারিয়ে ফেলবে গভীরতা।” নয়না সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ, এরপর সে মাথা নিচু করে কফিতে চুমুক দেয়, এবং তার জিভে, গালে, গলার নিচে জমে থাকা এক অচেনা অনুভব বিস্তার করে—এই সম্পর্ক ঠিক প্রেম নয়, ঠিক বন্ধুত্ব নয়, ঠিক কাজের অফিস-শিষ্টতা নয়, তবু এর মধ্যেই সবচেয়ে বেশি বলার ছিল। সে বুঝে ফেলে, সৌরভ যেভাবে কথা না বলে কফির মাধ্যমে সংলাপ তৈরি করেন, তেমন ভাষা কেউ তাকে শেখায়নি আগে—এই ভাষা শেখার জন্য সাহস দরকার, সময় দরকার, আর দরকার প্রতিদিন এক কাপ ধোঁয়া ওঠা অপেক্ষা।

শুক্রবারের শেষ বিকেলে, অফিস যখন ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, তখন নয়না সৌরভের ডেস্কে গিয়ে দাঁড়ায়। কফির কাপ তখনও ঠান্ডা হয়নি। সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “আপনি যদি ছবি আঁকেন, আমি যদি কফি বানাই—তবে কি এই গল্পের শেষ আমরা দুজনেই লিখছি?” সৌরভ একটু চমকে তাকায়, তারপর মৃদু হেসে বলে, “শেষ লিখতে হলে শুরু মানতে হয়, নয়না। আমরা কি শুরু করেছি?” নয়না চুপ করে থাকে। এই প্রথম সে কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, এবং যাওয়ার আগে বলে, “হয়তো আমরা শুরু করিনি, কিন্তু প্রতিদিন এক কাপ কফি দিয়ে আমরা কিছু না কিছু বলেই যাচ্ছি। একদিন না একদিন তো সেই শব্দগুলো জোরে বলতে হবে, নয়?” তারপর সে হাসে, কিন্তু চোখে জল এসে যায়। আর তার পেছনে সৌরভ মুখার্জির চোখে সেই পুরনো চেনা বিষণ্ণতা আবার ঘনীভূত হয়, তবে এবার তার মধ্যে একটু আলোর রেখা মিশে আছে—এক কাপ কফির রঙে ছাওয়া, এক সম্পর্কের শুরু না হওয়া, অথচ শেষ না হওয়ার প্রতিজ্ঞা।

(পাঁচ)

সোমবার সকালটা ছিল অস্বাভাবিক শান্ত। অফিসের করিডোরে কেউ তাড়াহুড়ো করছে না, কেউ কাউকে ডেকে কিছু জিজ্ঞেসও করছে না। যেন সময় নিজের ঘড়ি ফেলে দিয়ে ধীর গতিতে হাঁটছে। নয়না সাহা সময়মতো অফিসে ঢোকে, কিন্তু আজ একটা অদ্ভুত অস্বস্তি ঘিরে আছে তাকে। আজ ডেস্কে কফির কাপ নেই। কালো সেই ধোঁয়া ওঠা নিরব চিহ্ন—আজ অনুপস্থিত। সে বোঝে না কেন, কোনো মেইল নেই, কোনো নোট নেই, এমনকি কোনো আঁকা ছবিও নয়। প্রথমে ভাবে হয়তো ভুলে গেছেন সৌরভ, বা খুব ব্যস্ত। কিন্তু যখন ঘড়ি এগিয়ে যায়, আর সৌরভের ডেস্ক খালি পড়ে থাকে, তখন সে টের পায়—আজ তার অভ্যেসের ভেতর কেউ ছেদ ফেলেছে। তিথি এসে জানায়, “সৌরভ দা ছুটি নিয়েছেন দু’দিনের জন্য, বললেন ব্যক্তিগত কারণে। কেউ জানে না আসলে কী হয়েছে।” নয়নার বুকের ভেতর একধরনের ভারী শব্দ বেজে ওঠে—ঠিক কফির ফেনার নিচে গাঢ় স্তরের মতো। সে বুঝতে পারে, সে সৌরভকে খুঁজে পাচ্ছে কেবল একজন সহকর্মী হিসেবে নয়, একজন অপেক্ষিত অনুভব হিসেবে। সে সারাটা দিন নিজের কাজেও ঠিক মন বসাতে পারে না। বারবার কাগজে দাগ কাটে, আবার মুছে দেয়। যেন কফির অভ্যেস ছাড়িয়ে কিছু একটার অনুপস্থিতি তাকে গ্রাস করছে, যেটার ভাষা হয়তো তার জানা নেই, কিন্তু অনুভব তার চেনা হয়ে গেছে।

দুপুরের পর একসময় সে বেরিয়ে আসে অফিস বিল্ডিং থেকে, সামনের কফি শপে গিয়ে বসে—যেখানে সে আগে কখনও যায়নি। একটা কড়া এসপ্রেসো অর্ডার করে, ভাবতে থাকে—সৌরভ কি বুঝতে পেরেছেন তার এই প্রতিদিনের ছোট ছোট প্রতিক্রিয়াগুলো? সেই হৃদয়ের চিহ্ন দেওয়া চামচ, সেই লেখা নোট, সেই সরাসরি প্রশ্ন… সব কি পৌঁছেছে ঠিকঠাক? নাকি এই কফির কাপটা শুধু তার দিক থেকেই পূর্ণ ছিল? উত্তর সে পায় না। কফির কাপ ঠোঁটে নিয়ে চুমুক দেয়, স্বাদ খুব তেতো, মনেও লাগে যেন নিজেকে জিজ্ঞেস করছে—এই স্বাদ কি শুধুই সৌরভের কারণে সহ্যযোগ্য ছিল? ততক্ষণে বিকেল ঘনিয়ে এসেছে, নয়না অফিসে ফিরে যায়, ডেস্কে বসে, কাজ করার চেষ্টা করে। হঠাৎ সে দেখে, ডেস্কের ডানদিকে রাখা ছোট্ট পেন স্ট্যান্ডে গোঁজা একটা কাগজ—কারও অজান্তে রেখে যাওয়া। খুলে দেখে, সাদা কাগজে আঁকা একটি চিত্র—দুটি কফির কাপ, একটির ধোঁয়া ওপরে উঠছে, অন্যটির কাপ ফাঁকা, কিন্তু তার পাশ দিয়ে বেড়ে উঠেছে একটি ছোট্ট গাছ। নিচে লেখা—”যখন কফি না থাকে, তখনও কিছু জন্ম নেয়।” নয়নার চোখ ভিজে আসে, সে জানে না এটি রেখে গেছে কে, কিন্তু তার অন্তর বলে—এই ভাষা তার খুব চেনা।

পরদিন সকালে সৌরভ ফিরে আসেন অফিসে। মুখে ক্লান্তি, চোখে অপরাধবোধ, আর হাঁটায় একধরনের নিরুত্তাপ কুণ্ঠা। নয়না তাকে দেখে, কিন্তু কিছু বলে না। সৌরভ তার ডেস্কে যায়, কাজ শুরু করে, কোনো দৃষ্টিপাত নয়নার দিকে নয়। এক ঘণ্টা পর নয়নার ডেস্কে ফের সেই ধোঁয়া ওঠা কাপ, তবে আজ একটু ভারি, একটু বেশি গাঢ়, যেন কোনো জবাব দেওয়ার চেষ্টায় তৈরি। কাপের নিচে রাখা ছোট কাগজে লেখা—”আমি জানি আমি কিছু না বলে চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু প্রতিদিন কথা না বলেও যাদের অভ্যেস হয়ে যায়, তাদের না থাকাটা অনেক বেশি শব্দ করে। তুমি যদি এখনো কফি খাও, আমি এখনো বানাবো। কিন্তু এবার চাই শুধু কাপ নয়, দুটো চেয়ারে বসে একসাথে খাওয়া হোক।” নয়নার চোখ থেকে নীরব জল গড়িয়ে পড়ে। সে কিছু না বলেও সেই কফির কাপটা তুলে নেয়, চুমুক দেয়, আর কাগজটা ভাঁজ করে নিজের ডায়েরিতে রাখে—প্রেমের প্রথম প্রাপ্তি হিসেবে। আর জানালার ওপারে, সূর্যরশ্মি ছুঁয়ে যায় সেই কফির কাপের ধোঁয়া—যেটা আর শুধু অভ্যেস নয়, হয়ে উঠেছে এক নীরব প্রতিজ্ঞার ধোঁয়া।

(ছয়)

সপ্তাহের শেষ দিন। শুক্রবারের বিকেল মানেই অফিস একটু হালকা মেজাজে থাকে। তিথি হাসতে হাসতে বলে, “আজ সবাই একটু হালকা হচ্ছে, আর তুই তো এমনিতেই কফিতে ভেসে যাচ্ছিস।” নয়না হেসে ফেলে, কিন্তু তার হাসিতে লুকানো থাকে সেই অদ্ভুত উত্তেজনা—আজ সৌরভ মুখার্জি প্রথমবার একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, একসাথে বসে কফি খাওয়ার। কোনো ক্যান্টিন, কোনো কনফারেন্স রুম নয়, একেবারে অফিসের বাইরে, সাধারণ এক রোডসাইড কফি শপে। “খুব ভালো জায়গা না, কিন্তু কফিটা খাঁটি,”—সৌরভ বলেছিলেন সকালে, আর নয়না শুধুই বলেছিল, “ঠিক আছে, তবে কাপটা টেবিল নয়, হাতে নিয়ে খেতে হবে।” দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই দু’জন বেরিয়ে আসে। শহরের ট্র্যাফিক, শব্দ, বাসের হর্ণ আর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভেজা কুকুরগুলোর মাঝেও আজকের বিকেলে তাদের মধ্যে কোনো শব্দ নেই। কফি শপটা একেবারে সাধারণ—লাল রঙের স্টিলের চেয়ার, প্লাস্টিকের কাপ, আর ভেতরে ঢোকার সময় একটা কাঁচের জানালায় লেখা—”গরম কফির চেয়ে ভালো কিছু নেই!” সৌরভ একটা মোড়া টেনে দেয় নয়নার জন্য, তারপর নিজেও বসে। দোকানদার এসে দু’কাপ স্পেশাল ফিল্টার কফি রেখে যায়—তাতে দুধ আর চিনি আছে, ঠিক নয়নার পছন্দমতো। নয়না চমকে ওঠে, “আপনি কি মনে রেখেছেন?” সৌরভ হাসেন না, শুধু বলেন, “সবকিছু বলা হয় না, মনে রাখাই বড় কথা।”

প্রথমবার নয়না খেয়াল করে, কফির কাপ হাতে সৌরভ অনেক বেশি মানবিক, অনেক কম ‘ম্যানেজার’। তার চোখে আজ কোনো দায়িত্বের ছায়া নেই, বরং কিছুটা পরিণত শালীনতা—যেখানে অনুভব সোজাসুজি বেরিয়ে আসে না, কিন্তু হালকা হাসির ফাঁকে ঠাঁই করে নেয়। তারা দুইজন চুপচাপ কফি খায়। না, প্রেমিক-প্রেমিকার মতো নয়, বরং দুইজন শব্দহীন পাঠক, যারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টায়—একটি পৃষ্ঠা তাদের গত তিন মাসের, যেখানে কফি, নোট, স্কেচ, না বলা সংলাপ জমা হয়েছে। নয়না জিজ্ঞেস করে, “আপনার কি কখনও মনে হয়, এই কফির কাপটা ছাড়াও আমরা কথা বলতে পারতাম?” সৌরভ সামান্য থেমে বলে, “পারতাম, কিন্তু তাতে এতটা সত্যি হত না।” নয়না মৃদু হাসে, তার চুল ভেসে আসে কপালের উপর, সৌরভের চোখ অল্প সময়ের জন্য সেখানেই আটকে যায়। তারপরে বলেন, “আমি এই দোকানে অনেক দিন ধরে আসি, কিন্তু প্রথমবার কারো সঙ্গে ভাগ করে খাচ্ছি।” নয়না একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলে, “আমিও আজ প্রথমবার মনে করলাম, প্রেম আসলে চেনা শব্দে নয়, অভ্যেসের চেনা রুটিনে গাঁথা থাকে।”

ফেরার পথে সৌরভ আর নয়না পাশাপাশি হাঁটে—দুই হাত আলাদা, কিন্তু পায়ের ছন্দ এক। শহরের বাতাসে তখন হালকা গন্ধ—চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া বৃদ্ধের, কাগজে মোড়া ফুলের গন্ধ, আর একটু সামান্য বৃষ্টির আশ্বাস। নয়না হঠাৎ বলে ফেলে, “আপনি কি কখনও ভয় পান?” সৌরভ থেমে বলে, “ভয়… যখন কেউ অভ্যেস হয়ে যায়, তখন তার অনুপস্থিতির ভয়টা সবচেয়ে বেশি।” নয়নার বুকের মধ্যে যেন বাজ পড়ে। সে বুঝে ফেলে—এই মানুষটির নীরবতা ছিল না বলার ব্যর্থতা নয়, বরং বললে সম্পর্ক হয়তো হারিয়ে যেত, তাই না বলেই সে সম্পর্কটা ধরে রেখেছে। দুজনেই অফিসের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, আর সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, সৌরভ বলল, “কাল থেকে আমি চিনি দেব না, তুমি নিজে ঠিক করে নিও। আমি শুধু কফি দিতেই থাকব।” নয়না মাথা নাড়ল, আর মনে মনে বলল—এই তো ভালোবাসা, যেখানে কেউ মাপঝোক করে দেয় না, শুধু প্রতিদিন এক কাপের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দেয়—“আমি আছি, ঠিক যেমন তুমি চাও।” এবং সেই মুহূর্তে, নয়নার মনে হল, এই কফির কাপটা আর কালো নেই, এতে মিশে গেছে কিছু নরম আলো, আর কিছু মিষ্টি চুপচাপ প্রেম।

(সাত)

বৃষ্টি নামছে হালকা করে, জানালার কাঁচে বিন্দু বিন্দু জল জমছে, আর অফিস ফ্লোরে একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধ নীরবতা ছড়িয়ে আছে। নয়না সাহা ডেস্কে বসে আছেন, হাতে সেই প্রতিদিনকার কালো কফির কাপ। কিন্তু আজকের কাপটা ঠিক আগের মতো নয়—আজ কোনো নোট নেই, কোনো চিত্র নেই, শুধু কফি, নিঃশব্দে, নিজস্ব উষ্ণতা নিয়ে হাজির। গত কয়েকদিন ধরে সৌরভ মুখার্জির মধ্যে এক পরিবর্তন লক্ষ করছে নয়না। আগে যেভাবে নোট লিখে দিতেন, হালকা চোখের ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতেন কিছু, তা নেই। অফিসে কথাও কমে গেছে, এমনকি কফি শপেও আর যাওয়া হয়নি একসাথে। তিথি মজা করে বলেছিল, “তোমাদের কফির প্রেম বুঝি ঠান্ডা হয়ে গেছে?” নয়না হেসেছিল, কিন্তু তার ভেতরে একটা চিন্তার কুয়াশা জমেছে। হয়তো কিছু বলার সময় এসেছে, কিংবা হয়তো সৌরভ কিছু লুকোচ্ছেন। সেই ভাবনার ভেতরেও নয়না প্রতিদিনের মতো কফিতে চুমুক দেয়, যেন অভ্যেসের নামে হৃদয়ের খালি অংশটা ঢেকে রাখছে।

এক বিকেলে সাহস করে নয়না সৌরভের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, কোনো অজুহাত ছাড়াই। সৌরভ তার দিকে তাকায়, চমকে না গিয়ে শুধু চোখে একটু অবাকির ছায়া রাখেন। নয়না সরাসরি বলে, “এই কফিটা কি এখনো মানে রাখে?” সৌরভ একটু থেমে বলেন, “তুমি কী বোঝাতে চাইছো?” নয়না ধীরে বলে, “আগে কফির সঙ্গে একটা স্পর্শ থাকত, একটা ভাষা ছিল। এখন মনে হয়, শুধু অভ্যেস হয়ে গেছে।” সৌরভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “সবকিছু যখন অভ্যেস হয়ে যায়, তখন সেটা অনেকটা ভালোবাসার মতোই হয়, নয় কি? কফি যেমন সকালে চাই, তেমনই তোমার একটা উপস্থিতিও আমি খুঁজি। আমি হয়তো বদলে গেছি, কিন্তু সেটা তোমাকে হারাতে নয়, তোমাকে মেনে নেওয়ার জন্য।” নয়নার মুখে কোনো উত্তর থাকে না, শুধু ঠোঁটে জমে থাকা কফির মতো এক চুমুক চুপ করে পড়ে থাকে কথার গায়ে। সে বুঝে যায়, এই সম্পর্ক এখন আর নতুন নয়, এখন এটা একটা ঘরের মতো—যেখানে কেউ দরজা খোলে না, কিন্তু জানালা সবসময় খোলা থাকে আলো আসার জন্য।

সন্ধ্যার দিকে নয়না নিজের ডেস্কে ফিরে এসে খেয়াল করে, আজকের কফির কাপের নিচে এক পুরনো ধরণের ছোট্ট পত্র। খুলে দেখে লেখা—”তুমি যে অভ্যেস হয়ে গেছো, সেটা কখন বুঝলাম জানো? যেদিন তুমি একদিন আসোনি, আমি কফি বানাইনি। কফি বানানোর ইচ্ছেই জাগেনি।” নয়নার চোখ ছলছল করে ওঠে। অভ্যেস হয়ে যাওয়া মানেই ভালোবাসা শেষ হয়ে যাওয়া নয়—বরং সেই ভালোবাসা এতটাই শিকড় গেড়েছে, যা এখন আর দেখানোর কিছু নয়, শুধু অনুভব করলেই হয়। সেই রাতে নয়না নিজের রুমে বসে কফি বানায়—নিজের মতো, সৌরভের মতো করে, কালো, গাঢ়, একটুও চিনি ছাড়া। আর নিজেই নিজের জন্য লেখে, “আমি যদি কখনো অভ্যেস হয়ে যাই, আমাকেও ভুলে যেও না। কারণ অভ্যেস ভাঙে না, অভ্যেস শুধু নিজেকে অন্যরকম ভালোবাসায় রূপ দেয়।”

(আট)

বিকেলের শেষ আলো যেন একটু বেশি রঙ ছড়িয়েছে আজ, অফিসের জানালার কাচ দিয়ে ঢুকে পড়ছে সোনালি আভা। নয়না ডেস্কে বসে আছে, একহাতে কফির কাপ, অন্য হাতে ছোট্ট একটা স্কেচ—সেই প্রথম দেওয়া ছবিটার কপি, যা সে নিজের ডায়েরির পেছনের পকেটে রেখে দিয়েছিল, আর কখনও কারও দেখায়নি। আজ হঠাৎ তার ইচ্ছে হয়েছে সেটা বার করে দেখে। সৌরভ আজকাল আগের মতো নেই, কফি ঠিক সময়মতো এলেও, যেন সেই পুরোনো ছন্দটা হারিয়ে গেছে। তারা কথা বলেনি গত এক সপ্তাহে, শুধু নীরব কাপ, এবং কোনো নোট নেই। এমনই এক সম্পর্ক, যেখানে অভিমানটা চুপ করে থাকে, অভিযোগগুলো ভেসে ওঠে না, শুধু মনের ভেতর বুদবুদের মতো জমে ওঠে। তিথি আজ মজা করে বলেছে, “তোর আর সৌরভ দার কফি ব্রেকআপ নাকি?” নয়না হেসেছিল, কিন্তু উত্তর দেয়নি। কারণ, যা ছিল তার নাম রাখা হয়নি কখনও, তাই ভাঙা না বলাও যায় না। শুধু একটা অনুভব ছিল, আর আজ সেই অনুভবটা হালকা হয়ে গেছে, যেন কাপ থেকে ধোঁয়া আর উঠছে না।

সন্ধ্যার কিছু আগে সৌরভ এসে দাঁড়ায় নয়নার ডেস্কে। তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে একটা মৃদু চেষ্টা—যা বলার সাহস এখনো সে খুঁজে পায়নি। নয়না চমকে তাকায়, এরপর চুপ করে বলে, “আজ কফির কাপ নেই কেন?” সৌরভ একটু কুণ্ঠিত স্বরে বলে, “ভাবছিলাম, আজ তুমি বানাবে।” নয়না বিস্মিত হয়, এমন আবদার সে কখনও করেনি আগে। সে মাথা নাড়িয়ে বলে, “ঠিক আছে, আজ আমি বানাচ্ছি, তবে আজ তোমাকে সঙ্গে বসতে হবে। দূর থেকে নয়, একই টেবিলে।” তারা দুজন অফিসের ছোট্ট কিচেনেট ঘরে গিয়ে বসে—চুপচাপ, একসাথে। নয়না কফির কাপে দুধ, চিনির মাত্রা ঠিক করে, আর সৌরভ তার পাশে বসে, চোখে একরাশ অপরাধবোধ আর অদ্ভুত প্রশ্রয়। নয়না চুপ করে বলে, “তুমি কি জানো, আমি প্রতিদিন ভাবতাম তুমি হয়তো কিছু একটা বলবে—কোনো নাম, কোনো স্বীকৃতি, কোনো অর্থ। কিন্তু তুমি কিছু বলোনি। আর আমি অপেক্ষা করতে করতে একটা নাম খুঁজেই ফেলেছি—এই সম্পর্কের নাম ‘শব্দহীন অভ্যেস’।” সৌরভ একটু নিচু গলায় বলে, “আমি বলিনি, কারণ ভয় পেয়েছিলাম। যদি বলি, আর সবকিছু বদলে যায়?” নয়না চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “সবকিছু আগেও বদলেছে, কিন্তু আমাদের কফির স্বাদ তো বদলায়নি।”

এই প্রথম, সেই ছোট্ট কিচেনেট ঘরের নিঃশব্দটায় সৌরভ নয়নার দিকে তাকায় একেবারে গভীরভাবে, আর বলে, “আমি প্রতিদিন চাইতাম তুমি বুঝো, আমি কফিতে যা দিই, তা আসলে অনুভব। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম, না বলা জিনিসগুলো অনেক সময় হারিয়ে যায়। তাই আজ বলছি—আমি তোমাকে ভালোবাসি, নয়না। কফির মতো, অভ্যেসের মতো, প্রতিদিনের মতো।” নয়নার চোখে জল আসে না, শুধু সে মাথা নিচু করে ধীরে চুমুক দেয় সেই কফিতে। এবার কফির স্বাদ একটু নোনতা, হয়তো চোখের কোণ থেকে পড়ে যাওয়া নীরব অশ্রুর জন্য। সে বলে, “এতদিনে তুমি বললে। আর আজ আমি চিনি ছাড়াই কফি খেতে রাজি।” তারা দুজন চুপ করে বসে থাকে, কোনো ছবি নেই, কোনো স্কেচ নেই, শুধু একটা কাপ—দুজনের হাতে একসাথে ধরা, এবং সেই কাপের গা থেকে ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে ধীর গতিতে, এক অতল ভালোবাসার সাক্ষ্য হয়ে।

(নয়)

সেই ছোট্ট স্বীকারোক্তির পর নয়না আর সৌরভের মধ্যে কোনো দৃশ্যত পরিবর্তন আসেনি—অন্তত বাইরে থেকে দেখলে কেউ বুঝবে না, তারা একে অপরকে ভালোবাসে। অফিসে তাদের ব্যবহারে কোনো অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা নেই, কফির কাপ আসে প্রতিদিন ঠিক সময়মতো, কিন্তু এবার তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন এক স্তর—দুই চুমুকের মাঝে চোখে চোখ রাখা, ছোট্ট হাসি, অথবা শুধু নীরব বসে থাকা। আর তাদের কফি এখন আর কেবল ‘ব্ল্যাক’ নয়, বরং প্রতিদিন একটু করে বদলাচ্ছে স্বাদ, কখনো হালকা দারচিনি, কখনো মিষ্টি এলাচ, কখনো আবার আগের মতো গাঢ় নিরবতা। কেউ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে না কিছু, তিথি পর্যন্ত কিছু বলার সাহস করে না। তবে মাঝে মাঝে সে হেসে বলে, “তোমাদের মধ্যে একটা ধোঁয়া-ধোঁয়া সম্পর্ক আছে, যেটা কেবল গন্ধেই বোঝা যায়!” নয়না হেসে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু জানে, সেই ধোঁয়ার মধ্যে যে উষ্ণতা, তা স্রেফ কফির নয়, তা একটি নিঃশব্দ, গভীর প্রেমের।

একদিন অফিসে একটি হঠাৎ জরুরি মিটিং হয়। ঘোষিত হয়—সৌরভ মুখার্জিকে একটি নতুন প্রজেক্টের জন্য দিল্লি ট্রান্সফার করা হচ্ছে ছ’মাসের জন্য। ঘরটা মুহূর্তে নিঃশব্দ হয়ে যায়। নয়না কিছু বলে না, মাথা নিচু করে বসে থাকে। মিটিং শেষ হওয়ার পর সবাই তাকে শুভেচ্ছা জানায়, কেউ কেউ ছবি তোলে, কেউ ব্যাচে লেখা তাঁর নামের পাশে ‘Excellence’ বসিয়ে দেয়। সৌরভ শুধু মৃদু হাসেন, কোনো উচ্ছ্বাস নয়, কোনো ঘোষণা নয়। নয়না কাঁপা গলায় শুধায়, “তুমি যাচ্ছো?” সৌরভ ধীরে মাথা নাড়েন, “হ্যাঁ, দায়িত্ব বলছে যেতে হবে।” নয়না তার কাপের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। বিকেলে সে এক কাপ কফি বানিয়ে রেখে দেয় সৌরভের ডেস্কে, কাপের গায়ে লেখা—“দায়িত্ব বুঝি অভ্যেসকে টপকে যায়?”

পরদিন সকালে নয়না দেখে, নিজের ডেস্কে এক কাপ কফি রাখা, তার পাশে একটি ছোট খাম। খাম খুলে দেখে, সেই প্রথম স্কেচের পেছনে সৌরভের হাতের লেখা—“তুমি যদি অভ্যেস হও, আমি সব দায়িত্ব ভুলে যেতে পারি। কিন্তু ভালোবাসা কখনো কাউকে আটকে রাখে না, বরং তাকে শক্ত করে দেয় অপেক্ষা করার জন্য।” নয়না চোখ বন্ধ করে ফেলে। সে জানে, এই ভালোবাসার কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো প্রমাণ নেই, কোনো উৎসব নেই—আছে শুধু প্রতিদিন একটু একটু করে সয়ে আসা অনুভব। সে নিজেই প্রথমবার সৌরভের ডেস্কে গিয়ে বলে, “ছ’মাস পর ফিরে এসো। আমি প্রতিদিন একটা কাপ রেখে যাবো তোমার জন্য। যদি কোনোদিন দরজা খোলা পেয়ে যাও, বুঝবে আমি এখনো অপেক্ষা করছি।” সৌরভ মৃদু হাসে, চোখে জমে থাকা জলটা সামলে নিয়ে বলে, “আর তুমি? আমার জন্য কী রেখে যাবে?” নয়না একটু থেমে বলে, “একটা কফির গন্ধ। সেটা তোমাকে সব জায়গায় খুঁজে নেবে।”

সেদিন সন্ধ্যায়, সৌরভ অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নয়নার ডেস্কে চেয়ে একটা শেষবারের মতো দেখে নেয়—যেখানে একটি কফির কাপ রাখা, পাশে খালি চামচ, আর ডায়রির খোলা পাতায় লেখা—“ভালোবাসা শুধু বলা হয় না, সেটাকে প্রতিদিন বানিয়ে যেতে হয়। এক কাপ করে, চিনি ছাড়া, অভ্যেস দিয়ে।”

(দশ)

শীতকাল পড়ে এসেছে, কলকাতার সকালে একটা ঘন কুয়াশার চাদর। নয়না সাহা নিজের ডেস্কে বসে প্রতিদিনের মতোই কফির কাপ তৈরি করে রাখে, কাপটা রেখে দেয় ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে একসময় সৌরভ বসতেন। ছ’মাস কেটে গেছে। প্রথম দিকের ক’টা দিন অপেক্ষা ছিল উত্তেজনায় ভরা—ফোনে কথা, ছোট্ট ই-মেইল, আর মাঝেমধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে স্কেচ পাঠানো। কিন্তু ধীরে ধীরে কথা কমেছে। সৌরভ ব্যস্ত—নতুন প্রজেক্ট, নতুন টিম, নতুন শহর। নয়না তা বুঝতে পারে। কিন্তু তার অপেক্ষার রুটিন বদলায়নি—প্রতিদিন এক কাপ কফি রেখে দেয়, কোনোদিন লেখে কিছু, কোনোদিন চুপ করে বসে থাকে শুধু। এই অভ্যেসটাই যেন তার ভালোবাসার জবাব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিথি একদিন বলে, “তুই কি পাগল? ছ’মাস ধরে প্রতিদিন এক কাপ করে ফেলে দিস?” নয়না মৃদু হেসে বলে, “ফেলা নয়, এটা রাখা। যেমন মানুষ কাউকে মনে রেখে দেয়, ঠিক তেমনই।” সেই উত্তরের ভেতরে যে কতখানি বিশ্বাস লুকিয়ে ছিল, সেটা কেউ বুঝতে পারেনি। একদিন সে নিজের ডায়েরিতে লেখে—“কখনো কখনো ফিরে আসাটাই প্রমাণ নয়, অপেক্ষা করাটাও ভালোবাসার একমাত্র শব্দ হতে পারে।”

অফিসে আজ একটু আলাদা আবহ। সামনে নতুন বছর আসছে, সবাই ব্যস্ত সাজগোজে, রুম ডেকোরেশনে, রং-বেরঙের লাইটে। নয়না তেমন কিছুতে নেই, সে শুধু নিজের ডেস্কে চুপ করে বসে, এক কাপ কফি বানায়, আর কাপের নিচে ছোট্ট একটা সাদা কাগজ রেখে দেয়—“আজও রেখেছি। যদি কোনোদিন হঠাৎ ফিরে আসো।” আর ঠিক তখনই, জানালার পাশ দিয়ে কেউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। নয়না মুখ তোলে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন—সৌরভ মুখার্জি। ছ’মাসের ক্লান্তি, কিন্তু চোখে সেই একই উষ্ণতা, ঠোঁটে সেই পুরনো লাজুক হাসি। নয়না স্তব্ধ হয়ে যায়। সৌরভ এগিয়ে এসে ধীরে বলে, “কফির গন্ধটা এখানেই ছিল। দিল্লিতে কোথাও পেলাম না। তাই চলে এলাম, শুধু এই কাপটার কাছে ফিরে।”

নয়না কিছু বলে না। তার চোখে জল গড়ায় না, মুখে হাসি জমে না—শুধু সে ধীরে কাপটা সৌরভের দিকে বাড়িয়ে দেয়। সৌরভ কফির চুমুক দিয়ে বলেন, “চিনি দাওনি?” নয়না চোখে চোখ রেখে বলে, “চিনি ছাড়া ভালোবাসাটাই সবচেয়ে সত্যি, মনে নেই?” সেই মুহূর্তে চারপাশের আলো, কোলাহল, কাগজের তুড়ি, আর মিউজিকের শব্দ মিলিয়ে যায় পেছনে। সামনে থাকে কেবল এক কাপ কালো কফি, দু’জন মানুষ, আর তাদের মধ্যে অজস্র না বলা কথার ধোঁয়া—যা ছড়িয়ে পড়ে জানালার বাইরে, শহরের আকাশজুড়ে।

শেষ

1000032843.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *