সায়ন চক্রবর্তী
রবিবারের বিকেলটা এই গ্রামে যেন আলাদা আলোয় ঝলমল করে, সূর্যটা নদীর পাড়ে গড়িয়ে যেতে যেতে এমন এক নরম রঙ ছড়িয়ে দেয় যে হাঁসফাঁস করা সপ্তাহের ধুলোও মুহূর্তে থিতিয়ে আসে, আর সেই সময়েই শুরু হয় স্কুলবাড়ির বারান্দায় গানের আসর; হেডস্যার নিজের হাতে টাঙানো লণ্ঠনের নিচে মাদুর পাতা, ধুলো ধূসর কলাপাতায় রাখা গরম চা, কাঁচের গেলাসে তুলে দেওয়া মুড়ি-চানা, সরল অথচ শৌখিন এই আড্ডাটাই সৌম্যের সপ্তাহজুড়ে বেঁচে থাকার প্রাণবায়ু, যেহেতু সে জানে সোমবার থেকে আবার অঙ্কের ক-খ, ইংরেজির সরল বাক্য, ছাত্রদের টিফিনের গন্ধ আর খাতা পরীক্ষা—এই সব মিলিয়ে চার দেওয়ালের নীরসতা তাকে চেপে ধরবে; অথচ আজকের রবিবারটা অন্য রকম, কারণ সামনের বারান্দার শেষ মাথায়, শিউলি গাছটার তলায়, সাদা শাড়ির নীচে নীল পাড়, আলগা খোঁপায় শাদা ফুল গুঁজে, একটা অচেনা মহিলা এসে বসেছেন, মুখখানি বারান্দার ছায়ায় ঢেকে থাকলেও কণ্ঠস্বরটা গা ছমছম করে ওঠার মতো শান্ত, যেন নদী তার রাত্রির ধ্যান ভেঙে ভোরের আগে এক দফা শ্বাস নিল; কারুর নাম জানা নেই, কেউ বলে ও-ই তো রূপা, বিধবা, বাঁশবাগানের পাশের ভাঙা বাড়িটা যেখানে সন্ধ্যা হলে কুয়াশার মতো নীরবতা নেমে আসে, তার এক কোণে সে থাকে, সকালে শাপলা কুড়োয়, বিকেলে অন্যের ঘরে কাজ করে, আর রাতে নাকি গান করে; এইসব আলগা ফিসফাস সৌম্যের কানে আগেও এসেছিল, কিন্তু তাকে দেখার পর আজ কথাগুলো একেবারে দেহ পেল, বৃষ্টির আগের বাতাস যেমন হঠাৎ গন্ধে ভিজে ওঠে, তেমন। সৌম্য চায়ের গেলাসটা ধরা ডান হাতে আর বাঁ হাতে তাল মিলিয়ে বসে ছিল, যখন হেডস্যার হালকা কাশিটা দিয়ে বললেন, “আজ নতুন কণ্ঠ শুনব, সবাই চুপ করে শুনো, গানের মধ্যে কোনো হট্টগোল চলবে না।” এই বলেই তিনি চোখের ইশারায় রূপাকে ডাকলেন। রূপা মাথা একটু নোয়াল, তারপর দুই হাঁটু জোড়া করে বসে, আঁচলটাকে গলার কাছে নরম ভাঁজে গুঁজে, চোখদুটো এদিক-ওদিক না করে সোজা সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে যেন একটা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল; তার গলা থেকে যখন প্রথম সুরটা বেরোল—“ওরে নীলডুমুরের বনে, মেঘ এল রে…”—তখন বারান্দার মশার গুণগুণ থেমে গেল, খয়েরি দেয়ালে ঘোরাঘুরি করা গিরগিটেও থাবা থেমে তাকিয়ে রইল, সৌম্যের শিরা-উপশিরায় কেমন এক থিরথিরে কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল; সুরটা আবহমান, কোনো দরবারি রাগের শাখা-পাতা যেন গ্রামের ধুলোয় বসে গেছে, তবু তাতে শহুরে গাম্ভীর্য নয়, আছে খাটের একপাশে বসা মেয়ের নরম স্বর, যে রাতে শিশুকে শুইয়ে দিতে দিতে নিজের জীবনের সুতো ধীরেধীরে খুলে ফেলে। গানটা শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলল, “বিধবা মেয়েমানুষ, গান গাইতে এসেছে, বেগম আখতারের মতো ভাব!” সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন ধমক দিল, “চুপ করিস তো, গলা শুনলি না? ঈশ্বরের নাম আছে গলায়।” সৌম্য চুপ করে রইল, কিন্তু তার ভিতরটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল, যেভাবে বছরে একবার পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্রের অঙ্কগুলো হঠাৎ করে নতুন নতুন নিয়ম দেখায়; সে ভাবল, এ কণ্ঠস্বরটা কোথায় রাখবে? খাতার কোন পাতায়? ডায়েরির কোন পাতায়? নাকি ভোরের ঘুমের ভেতর? দ্বিতীয় গানটা যখন রূপা শুরু করল, তখন তার চোখে একটু ঝিলিক ফুটে উঠল, যেন দূরে নদীর বুকে সন্ধ্যার প্রথম তারা দেখা দিল; “বাঁশির সুরে ডেকো না, মনভুলানো পথ, যাই যদি তবে ফিরব কেমনে”—সুরটা এবার চিকন, মিষ্টি, কিন্তু ফুটন্ত দুধের মতো সামান্যই অবহেলায় উপচে পড়ে যাওয়ার ভয়; সৌম্য নিজের সামলে বসে, তালটা ঠিক রাখে, কিন্তু তার মস্তিষ্কে তখন কেবল একটাই দৃশ্য ঘুরছে—শিউলি গাছের তলায় বসে থাকা ওই মেয়েটি, যে নিজের জীবনের সমস্ত শুকনো পাতাগুলো গান দিয়ে এক এক করে তুলে নিয়ে বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছে, যেন কারও ঘরে গিয়ে কারও মেজাজ খারাপ না করে, আবার নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার আগে একটু নিশ্বাস নেয়। গান শেষ হলে হেডস্যার মৃদু হাততালি দিলেন, সবাই অনুসরণ করল, কেউ কেউ “আরে বাহ!” বলে উঠল; রূপা তখন মাথা নিচু করে আঁচলের প্রান্তটা আঙুলে পাকিয়ে বসে রইল, যেন এসব প্রশংসা তাকে বিব্রত করছে; সৌম্য এমন সময় উঠে গিয়ে একটা গেলাস জল এগিয়ে দিল—“খান, গলা ভিজিয়ে নিন,” তার নিজের গলায় এমন এক কম্পন যে সে নিজেই টের পায়। রূপা একবার সৌম্যের দিকে তাকাল, সেই তাকানোতে লজ্জা নেই, আছে একটা সৎ ধন্যবাদ, আর খুব গভীরে একটা বয়সহীন ক্লান্তি; “ধন্যবাদ,” বলেই সে জলটা ছোট ছোট চুমুকে খেল। এই ছোট্ট মুহূর্তটাতেই সৌম্য বুঝল, এ মেয়েটা গানের বাইরে খুব বেশি কথা বলে না, তার কথাগুলো বোধহয় সুরের মধ্যে মরিচের মতো গুঁড়ো হয়ে মিশে গেছে। আড্ডা ছুটল, কেউ রাগ ইয়ামনে গেল, কেউ ভাটিয়ালি, কেউ ভাওয়াইয়া, কিন্তু সৌম্যের মধ্যে একটা পর্দা নেমে গেল, সে যেন দূর থেকে দেখতে লাগল সবকিছু, যেমন সিনেমায় হঠাৎ ক্যামেরা দূরে সরে যায় আর শহরটাকে ছোট করে দেয়; চোখে বারবার ভেসে ওঠে রূপার হাত—পাতলা, শিরা ফুটে থাকা, কিন্তু শক্ত, খুপরি-ঘরে পৃথিবী টেনে নেওয়ার মতো শক্ত; সেসব হাতে নিশ্চয়ই একসময় শাখা ছিল, শাঁখা-নোয়া নেই এখন, তবু আঙুলে গান আটকে থাকে। আড্ডা গুটিয়ে এলে হেডস্যার রূপাকে ডেকে বললেন, “তুমি যদি চাও, রবিবারে নিয়ম করে এসে দুটো গান গাইবে, আমরা সম্মানস্বরূপ কিছু তুলে দিতে পারি,” রূপা শান্ত গলায় বলল, “আমি পয়সার জন্য গান গাই না স্যার, তবু আসব, যদি কেউ মনে না করে আমি…,” বাকিটা সে গিলে ফেলল; হেডস্যার মাথা নেড়ে বললেন, “এখানে কেউ কারও বিরুদ্ধে নয়, আমরা কেবল সুর ভালোবাসি।” এইখানে দাঁড়িয়ে সৌম্য প্রথমবার নিজের ভিতরে একটা সিদ্ধান্ত শোনে—ও রবিবারে যতটা না গান শুনতে বাসনা করে, তার চেয়েও বেশি রূপাকে দেখার দিকে ঝোঁকে; সে সঙ্গে সঙ্গে লজ্জা পায়, নিজের এই অনুভূতিটাকে একটা শালপাতায় মুড়ে নিজের বুকপকেটে গুঁজে রাখে। বাড়ি ফেরার সময় অভিনব এক নরম বাতাস বইছিল, কাঁচা আমের গন্ধ, ভেজা মাটির টান, দূরে দূরে কুকুর ডাকছে; বাঁশবাগানের ধার দিয়ে যেতে যেতে সৌম্য একটু থামল, অচেনা পথে যেমন এক পা রাখার আগে মাটি টিপে দেখে, তেমন; রাত তখন পাকতে শুরু করেছে, বাঁশপাতাগুলো অন্ধকারে ফিসফিস করে, আর সেই ফিসফিসের মধ্যে হঠাৎ আবার ভেসে এল একটা সুর—“ও নদীরে, আবার যদি ডাকে তুই, বলিস আমি আছি,” সৌম্য থমকে দাঁড়াল, দেখল ভাঙা বাড়িটার চাল টিনের, দরজায় কঞ্চি, জানলার চৌকাঠে কালি; দরজা আধখোলা, ভেতরে একটা ক্ষীণ আলো, হয়তো প্রদীপ, সেখানে ছায়া পড়ে কারও হাত ওঠানামা করছে, হাতলাঙল দিয়ে যেন সুর কাটছে; সৌম্য এক পা এগিয়ে আবার থামল, এই প্রথমবার বুঝল, কোনো মানুষের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আর তার জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একই সঙ্গে ভীষণ সহজ এবং ভীষণ কঠিন; সে ফিরে গেল, ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল, আগামীকাল স্কুলে ক্লাস টু-র ছেলেমেয়েদের কবিতা পড়াতে হবে—“আজি এ বসন্তে মানসী, মন যে কেন দূরে যায়,” সে হেসে উঠল, নিজেরই এক অচেনা সুরে, ভাবল, তার মন যে কোথায় যায় আজকাল, কে জানে। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মশারির ভেতর শুয়ে যখন সৌম্য ডায়েরি খুলল, তখন পৃষ্ঠার ওপরেই শিউলি ফুল গড়িয়ে পড়েছিল; স্কুলের মাঠ থেকে ফেরার পথে গাছটা নড়িয়ে সে দু-একটা কুড়িয়ে এনেছিল, কোনো আহামরি কারণ ছাড়াই; সে লিখল—“রবিবার, আজ এক কণ্ঠ শুনলাম, যা ধুলোকে সোনা করে দেয়, রূপা নাম, বিধবা; কেউ কেউ চোখ পাকিয়েছে, আমি চুপ ছিলাম; আমার ভিতরে একটা আগুন জ্বলছে, কারও দোষ নেই, আগুনটা যেন আলোর মতো, পোড়ায় না, শুধু দেখায়; আগামী রবিবারও সে আসবে কি?” ডায়েরির পাতাটা বন্ধ করে সে লাইট নেভাল, কিন্তু ঘুম এল না—জানালার বাইরে দূরে কোথাও বাঁশপাতার ঝিরঝিরে শব্দে সুরের প্রতিধ্বনি; সে ফিসফিস করে বলল, “সুর, থাকিস, পালিয়ে যাস না,” তারপর শ্বাস টেনে নিল, যেন সুরটাকে বুকের মধ্যে জায়গা দিল। এরই মধ্যে গ্রামে খবর ছড়িয়ে গেল, “হেডস্যারের আড্ডায় এখন এক বিধবা গান করে,” বাজারে শাক তুলতে গিয়েই কানাঘুষো, পুকুরঘাটের সিঁড়িতে বসে থাকা কিশোরেরা তামাশা করে, পাড়ার দু-একজন ধার্মিক মানুষ দূর থেকে তাকায় ধোঁয়াশা সন্দেহে; আর একদল—চা-সিগারেটের দোকানে নিয়ম করে বসা সেই গুটিকয়—হাসির ফাঁকে অশালীন ইশারা করে; সৌম্য জানে, এসবের বিরুদ্ধে গলা ওঠাতে হয় কাকে, কাকে নয়; সে হেডস্যারকে একদিন আলগোছে বলল, “মানুষ কী বলে বলুক, আমরা কি আড্ডা বন্ধ করব?” হেডস্যার তখন দাড়ি চুলকে বললেন, “সুরের আড্ডা বন্ধ হয় না সহজে, তবে সুরের সঙ্গে সাহসও লাগে, তুই পারবি?” সৌম্য খানিকটা লজ্জা পেয়ে মাথা নোয়ায়, চোখে অল্প জেদও ওঠে; সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে, আগামী রবিবার একটাও অশালীন শব্দ উঠতে দেবে না; আড্ডার দরজায় দাঁড়িয়ে, যারা তামাশা করতে আসে, তাদেরকে তিনি নিজের ক্লাসের মতোই শাসন করবেন, নম্র কিন্তু দৃঢ়। সেই রাতে শোবার আগে সৌম্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে, আকাশে আধখানা চাঁদ, নিচে খেতের ধানবাতাস সোনালি; দূরে কোথাও আবার এক মুহূর্তের জন্য সুর ভেসে আসে, খুব ক্ষীণ, যেন বাতাসের পাতলা ধারে; তার মনে হল, জীবনে এমন এক সময় এসে গেছে, যাকে কোনো বইয়ের পাতায় শেখানো যায় না—এটা হয়তো প্রেম, হয়তো না-ও; কিন্তু এটা নিশ্চিত, এ এমন এক টান, যার ভেতর দিয়ে মানুষ নিজেকে নতুন করে চিনে নেয়; আর সেই চিনে নেওয়ার প্রথম পা বাড়ানোটা হয়তো রবিবারের আড্ডাতেই; আগামী রবিবারে দেখা হবে—এই প্রত্যাশা নিয়েই সৌম্য চোখ বন্ধ করল, আর অন্ধকারে দেখল শিউলি গাছের ছায়া লম্বা হয়ে রূপার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন তাকে পাহারা দিচ্ছে।
সপ্তাহের দিনগুলো সৌম্যের কাছে এতদিন কেবল দায়সারা কাজের মতোই ছিল—সকালে ঘুম থেকে উঠে ছেলেমেয়েদের হইচই সামলে পাঠশালায় ঢোকা, দুপুরে খিচুড়ি আর ডালের গন্ধ, বিকেলে খাতা পরীক্ষা করতে করতে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসা, তারপর সন্ধ্যায় একাকিত্বের ভারে গুম হয়ে যাওয়া। কিন্তু রূপার গান শোনার পর থেকেই সময় যেন তার কাছে অন্য রকম হয়ে উঠল। সোমবারের প্রথম পিরিয়ডেই সে খেয়াল করল, ছাত্রদের গলার আওয়াজ তাকে বিরক্ত করছে না, বরং একেকটা স্বর যেন অদৃশ্যভাবে সেই সুরের দিকে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মধ্যাহ্নভোজের ঘন কোলাহল—লোহার থালায় চামচের ঠকঠক শব্দ, আলুর তরকারির ঝাঁঝ, খেলতে থাকা বাচ্চাদের হাসি—সব মিলিয়েও তার কানে বারবার ফিরে আসছে সেই রবিবার সন্ধ্যার কণ্ঠ, যা ধুলোকে সোনায় পরিণত করেছিল।
বুধবার বিকেলে স্কুল ছুটি হতেই সৌম্য একা হাঁটতে বেরোল। গ্রামের পথ, বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে আলো-অন্ধকার খেলা করছে। হাঁটতে হাঁটতে সে বাঁশবাগানের ধার ঘেঁষে ভাঙা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। জানলার শিকগুলো মরচে ধরা, দেয়ালে চুন ওঠা দাগ, তবুও কোথাও যেন এক অদৃশ্য আলো মিশে আছে। দরজা আধখোলা, ভেতরে নিস্তব্ধতা। সৌম্য একবার দরজার চৌকাঠ ছুঁয়ে দেখল, তারপর হাত সরিয়ে নিল—একটা অদ্ভুত সংকোচ তাকে থামিয়ে দিল। সে ভেবেছিল হয়তো ভেতর থেকে রূপার গান ভেসে আসবে, কিন্তু কেবল হালকা কাঠবিড়ালির ছুটোছুটি আর শুকনো পাতার খসখস শব্দই শোনা গেল। ঠিক তখনই পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধা, শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল মুছে, গম্ভীর গলায় বললেন,
“ওখানে দাঁড়াইও না বাবা, মানুষের গোপন দুঃখে উঁকি মারা ঠিক নয়।”
সৌম্য চমকে উঠল। বৃদ্ধা এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, “ওই মেয়ে একা থাকে, বিধবা। গানের গলা আছে বটে, কিন্তু তার জীবনটা খুব কষ্টের। সকলে যা বলে সব শোনো না, তবে ওর কাছে গেলে সমাজ তোমাকেও আঙুল তুলতে দেরি করবে না।”
সৌম্য মাথা নেড়ে চলে এল। মনে হলো কারও গোপন ঘরে হঠাৎ ঢুকে পড়ার মতোই অপরাধ করছে। কিন্তু নিজের ভিতরে একটা জেদ তৈরি হয়ে গেল—কোনো মানুষের দুঃখের পাশে দাঁড়ানো যদি অপরাধ হয়, তবে সেই অপরাধে সে আনন্দেই জড়িয়ে পড়বে।
শনিবার সন্ধ্যায় সৌম্য খাতা পরীক্ষা করছিল। হঠাৎ বাইরে হাওয়ার দমকে জানলার পর্দা উড়ে গেল, আর কানে এল দূর থেকে ভেসে আসা এক সুর—“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।” শব্দটা এত ক্ষীণ, তবুও স্পষ্ট, যেন রূপার গলার ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই হাঁটছিলেন। সৌম্যের মনে হল, এই গানটা কেবল গ্রামের জন্য নয়, কেবল হেডস্যারের আড্ডার জন্যও নয়—এ গান তার নিজের জন্য। সে শিউলি ফুলের গন্ধ মেখে শুয়ে থাকল, ভাবল, আগামী রবিবার সে রূপার সঙ্গে কথা বলবে, সামনাসামনি, নিছক এক শ্রোতা হয়ে নয়।
অবশেষে এল রবিবার। বারান্দায় মাদুর পাতা, লণ্ঠন জ্বলা, চারদিক চায়ের গন্ধ। লোকজন গুটিগুটি করে বসছে। সৌম্য আজ একটু আগে এসে কোণের দিকের জায়গা দখল করল, যাতে রূপার গান শোনার সময় তার মুখের প্রতিটি ভাঁজ স্পষ্ট দেখা যায়। হেডস্যার হাসিমুখে সবাইকে স্বাগত জানালেন। আড্ডা জমতে না জমতেই রূপা ঢুকল—একই সাদা শাড়ি, গলায় একটুকরো সস্তা কাঁচের হার, চোখে হালকা ক্লান্তি, কিন্তু তবু সেই অব্যক্ত দীপ্তি।
সুর শুরু হলো। প্রথম গানটা ছিল ভাটিয়ালি—“ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পুণ্যবতী।” রূপার কণ্ঠে সুরটা কেবল নদীর ওপারে ভেসে গেল না, যেন প্রতিটি মানুষের ভিতরে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসকে জাগিয়ে তুলল। গানের শেষে সবাই হাততালি দিল। সৌম্যও দিল, কিন্তু তার হাত যেন কাঁপছিল, হৃদয় থেকে কোনো কিছু বেরিয়ে আসতে চাইছে, অথচ মুখে আটকে গেছে।
গান শেষে রূপা বারান্দার পাশে গিয়ে বসে পড়ল। সৌম্য সাহস করে এগিয়ে গেল।
“আজকের গানটা… ভিন্ন লাগল,” সে বলল।
রূপা মাথা তুলে তাকাল। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু ঠোঁটে মৃদু হাসি।
“গান তো এক, কেবল মানুষে মানুষে আলাদা হয়ে যায়,” সে শান্ত গলায় বলল।
“কিন্তু আপনার গলায় যেন দুঃখটা আলো হয়ে ওঠে,” সৌম্য অন্যমনস্কভাবে বলে ফেলল।
রূপা এক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর হালকা হেসে বলল, “দুঃখ যদি গান হয়ে ওঠে, তবে সে-ই তো আমার বেঁচে থাকা।”
এই সংক্ষিপ্ত কথোপকথনেই সৌম্যের বুক ভরে গেল। মনে হল, কোনো চিরকালীন দুঃখের ভিতরেও এক চারা গাছ জন্ম নিচ্ছে। সে বুঝল, এই সম্পর্কের শুরুটা খুবই নীরব, তবু গভীর।
আড্ডা গুটিয়ে এলে সৌম্য বাইরে বেরিয়ে এল। আকাশে সেদিন পূর্ণিমার চাঁদ, সাদা আলোয় ভেসে যাচ্ছে গ্রামের পথ। শিউলি গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে সে মনে মনে বলল—
“অবেলার ফুলও ফোটে, কেবল তা দেখবার চোখ চাই।”
সোমবার সকালটা অদ্ভুতভাবে সৌম্যর কাছে হালকা লাগছিল। অন্যান্য দিনগুলোর মতো ছাত্রছাত্রীদের হট্টগোল, ভাঙা বেঞ্চে আঁকিবুঁকি, টিফিনের সময়ের ঠেলাঠেলি—সবই ছিল, তবু সে যেন ভেসে বেড়াচ্ছিল অন্য এক আলোয়। গতকালের সেই অল্প কথাগুলো, রূপার গলার নীরব শক্তি, চোখের শান্ত অথচ অনড় দৃষ্টি—সব মিলিয়ে সৌম্য মনে মনে নতুন এক পৃথিবী গড়ে তুলেছিল।
তবু সমাজ তার স্বভাবমতোই পিছপা হলো না। মঙ্গলবার দুপুরে চায়ের দোকানে বসে শিক্ষকরা কথা বলছিলেন। কেউ একজন হঠাৎ ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
“শুনলাম সৌম্যদা নাকি বিধবার গান শুনতে গিয়ে একটু বেশি মন দিচ্ছেন?”
দোকানদারও হেসে উঠল, “এই বয়সে প্রেমকাহিনি নাকি আবার শুরু হচ্ছে?”
সৌম্যের বুকের ভেতর লজ্জা আর রাগ মিশে এক অদ্ভুত আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু সে কোনো প্রতিবাদ করল না। চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“গান শুনতে প্রেম লাগে না, শুধু কান লাগে।”
তবুও সে বুঝে গেল—এই গ্রামকে পাল্টানো সহজ নয়।
বুধবার স্কুল শেষে সৌম্য বাড়ি ফিরছিল। পথটা বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে যায়। আচমকা শুনতে পেল একটা পরিচিত সুর—খুব ক্ষীণ, তবুও স্পষ্ট। সে থমকে দাঁড়াল। রূপার কণ্ঠ ভেসে আসছে—“একি লাবণ্য পূর্ণ প্রাণ, প্রাণে প্রাণে দোলা দিয়ে যায়।” সে বুঝল, রূপা একা বসেই গান করছে। সাহস সঞ্চয় করে ভাঙা বাড়িটার দিকে এগোল। দরজাটা খোলা। ভেতরে মাটির প্রদীপ জ্বলছে, ছোট্ট ঘর, খাটের পাশে কিছু শিউলি ছড়িয়ে আছে। রূপা চেয়ারের ওপর বসে গান গাইছে, চোখ বন্ধ।
সৌম্য থমকে দাঁড়াল, তারপর আলতো গলায় ডাকল,
“রূপা দি…”
গান থেমে গেল। রূপা চোখ মেলে তাকাল। বিস্ময়ের সঙ্গে সামান্য শঙ্কা মিশে আছে তার চোখে।
“আপনি এখানে?”
“ক্ষমা করবেন,” সৌম্য বলল, “গানের সুরে পা চলে এল। আপনার গলা… মনে হয় যেন ঈশ্বরের কাছ থেকে ধার করে গাইছেন।”
রূপা একটু ম্লান হেসে বলল, “ঈশ্বর যদি সত্যিই কিছু দিয়ে থাকেন, তবে তা হয়তো দুঃখ। গানটা কেবল সেই দুঃখের ভাঙা টুকরো।”
সৌম্য ভিতরে বসার জায়গা পেল না, দরজার চৌকাঠেই দাঁড়িয়ে রইল।
“আপনি একা থাকেন?” সে প্রশ্ন করল।
রূপা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। একাকীত্বই আমার সঙ্গী।”
“তবু রবিবারে সবাইকে গান শোনান কেন?”
“কারণ একাকীত্ব যদি কেবল নিজের মধ্যে আটকে রাখি, তবে তা বিষ হয়ে যায়। গান গাইলে অন্তত অন্যের মধ্যে আলো ছড়িয়ে দেয়।”
সৌম্যর বুক ভরে উঠল। এত সহজ অথচ এত গভীর কথা সে আগে শোনেনি। সে মনে মনে ঠিক করল—যতই সমাজ বলুক, সে এই মেয়েটির পাশে দাঁড়াবে।
সেদিন রাতে সৌম্য ডায়েরিতে লিখল—
“আজ রূপার ঘরে গেলাম। সে বলল দুঃখকে যদি আটকে রাখি তবে তা বিষ হয়। আমি ভাবছি, তবে কি আমার নিজের ভেতরকার নীরব প্রেমও একদিন বিষ হয়ে উঠবে? নাকি তাকে আলোর মতো ছড়িয়ে দিতে হবে?”
শুক্রবার হেডস্যার হঠাৎ সৌম্যকে ডাকলেন।
“শুনছি লোকজন নানা কথা বলছে। তুমি রূপার সঙ্গে বেশি মিশছ নাকি?”
সৌম্য শান্ত স্বরে বলল, “স্যার, আমি কেবল গানকে ভালোবাসি। আর রূপার গলা সেই গানকে জীবন্ত করে তোলে।”
হেডস্যার চোখ মুছলেন, মৃদু হেসে বললেন, “আমি জানি, তোমার মন পরিষ্কার। কিন্তু গ্রামের সমাজকে তো একদিনে বদলানো যায় না। সাবধানে থেকো।”
রবিবার আবার আসর বসল। এবার রূপা গাইল—“আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।” গানের শেষে সৌম্য তার দিকে তাকাল। দুজনের চোখে এক অদ্ভুত আলো মিলল, যেন তারা নিঃশব্দে একে অপরের কাছে প্রতিজ্ঞা করল—সমাজ যতই বাঁধা দিক, এই আলোর টান ভাঙবে না।
সৌম্যের মনে হলো—
অবেলার ফুল ফোটার সময় এসে গেছে।
গ্রামে খবর ছড়াতে দেরি হলো না। হাটে-ঘাটে, পুকুরের ধারে, এমনকি স্কুলের মাঠেও কানাঘুষো শোনা গেল—“সৌম্য মাস্টার নাকি বিধবার সঙ্গে খুব বেশি মেশামেশি করছে।” লোকের চোখ সবসময়ই কৌতূহলী, আর কৌতূহলের আড়ালে লুকিয়ে থাকে তির। কেউ সরাসরি কিছু বলত না, কিন্তু অদ্ভুত সব ইঙ্গিতময় হাসি আর কটাক্ষ সৌম্যকে বারবার আঘাত করত।
তবু রবিবার এলে তার পা আবার বারান্দার দিকে টেনে নিত। সেদিন রূপা গাইল—
“আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনেতে, জীবনধারা বাহিয়া যায়।”
সুরের ভেতর এমন এক বেদনা ছিল যে সবাই নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইল। গান শেষে সৌম্য তার দিকে তাকাল। রূপার চোখে জল চিকচিক করছিল। কেউ দেখেনি, কিন্তু সৌম্যর চোখে সেই ঝিলিক ধরা পড়ল।
আড্ডা শেষ হলে সৌম্য বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। রূপা বেরোলে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে বলল,
“আপনি কাঁদলেন?”
রূপা হালকা হেসে বলল, “সব গান তো আনন্দ আনে না। কখনও কখনও গানই কান্নাকে জায়গা দেয়।”
“কিন্তু কান্না লুকিয়ে রাখবেন না,” সৌম্য বলল, “কেউ না থাকলে অন্তত আমাকে বলতে পারেন।”
রূপা এক মুহূর্ত থেমে তার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে ছিল অবিশ্বাস, কৃতজ্ঞতা আর এক অদ্ভুত ভয়।
“আপনি জানেন না, এসব কথা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে।”
“ভালোবাসার কথাগুলো কি কখনও বিপজ্জনক হয়?”—সৌম্যের গলা অজান্তেই কেঁপে উঠল।
রূপা চমকে গেল। তারপর খুব ধীরে বলল,
“ভালোবাসা হয়তো পবিত্র, কিন্তু সমাজ তাকে পাপ বানিয়ে দেয়। আমি যে পথ পেরিয়ে এসেছি, সেখানে আরেকটা আঘাত আমি নিতে পারব না।”
সৌম্য কোনো উত্তর দিতে পারল না। শুধু শিউলি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে দেখল, রূপা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তার মনে হলো, সমাজ যেন এক বিশাল দেয়াল, আর সেই দেয়ালের ফাঁক দিয়ে তারা একে অপরকে দেখতে পাচ্ছে—কিন্তু হাত বাড়াতে পারছে না।
পরদিন স্কুলে সৌম্য লক্ষ্য করল, কিছু সহকর্মী তার সঙ্গে চোখাচোখি এড়াচ্ছে। ছাত্ররাও ফিসফিস করছে। দুপুরে টিফিনে হেডস্যার তাকে ডেকে নিলেন।
“সৌম্য, তোমার মন আমি বুঝি। কিন্তু গ্রামের মানুষ গুজবকে সত্যি বানাতে ওস্তাদ। তোমার সতর্ক থাকা উচিত।”
সৌম্য নীরবে মাথা নোয়াল। ভিতরে কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—তাহলে কি ভালোবাসা মানে কেবলই লুকোনো?
শুক্রবার বিকেলে বৃষ্টি নামল। স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার পরেও সৌম্য বাড়ি ফেরেনি। শিউলি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে সে ভাবছিল রূপার কথা। ঠিক তখনই পিছন থেকে গলার শব্দ এল—
“এভাবে ভিজে দাঁড়িয়ে থাকলে জ্বর হবে।”
চমকে উঠে দেখল রূপা। সে-ও ভিজে গেছে, কিন্তু চোখে ছিল অদ্ভুত কোমলতা। সৌম্য হাসল, বলল,
“জ্বর হলে সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার মতো গলার গান না শুনে বাঁচা যায় না।”
রূপা তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর খুব ধীরে বলল,
“আপনি যদি সত্যিই পাশে দাঁড়াতে চান, তবে ভয় পেতে নেই। আমি ভয় পাই, কিন্তু আপনি যেন না পান।”
সেদিন রাতে সৌম্য ডায়েরিতে লিখল—
“আজ রূপা আমাকে প্রথমবার নিজের ভয় স্বীকার করল। হয়তো এই স্বীকারোক্তিই আমাদের প্রেমের শুরু। অবেলার ফুল ফোটার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি।”
রবিবার আবার এলো। তবে এই রবিবারটা অন্য রকম। আড্ডা শুরু হতেই কয়েকজন অচেনা লোক এসে কোণের দিকে বসে পড়ল। তাদের চোখে ছিল একরাশ কৌতূহল আর গোপন কটাক্ষ। সৌম্য প্রথমেই বুঝতে পারল—আজকে রূপাকে সহজে গান গাইতে দেওয়া হবে না। হেডস্যার চোখ মেলে সবার দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, “আজ রূপা গাইবে।”
রূপা সামনে এল। গলা ভিজিয়ে নিল এক গ্লাস জলে, তারপর চোখ বন্ধ করে শুরু করল—
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখনি তো আমায়।”
সুরটা বাতাসের ভেতর এমনভাবে ভেসে গেল যেন প্রত্যেকে নিজের বুকের অন্দরমহলে গিয়ে সেই গানকে খুঁজে পেল। তবু পেছন দিক থেকে কেউ ব্যঙ্গ করে বলল,
“বিধবার মুখে প্রেমের গান! কী আশ্চর্য!”
এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো। রূপার চোখ কেঁপে উঠল। সে থেমে গেল।
ঠিক তখনই সৌম্য উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“যে গান ঈশ্বরের সৃষ্টিকে জাগিয়ে তোলে, তাকে নিয়ে ঠাট্টা করা পাপ। যদি শুনতে না চান, তবে চলে যান। এখানে কেবল সুরের জন্য জায়গা।”
তার গলায় ছিল দৃঢ়তা। লোকগুলো একটু হাসাহাসি করে বেরিয়ে গেল। রূপা আবার গাইতে শুরু করল, এবার কণ্ঠে আগের চেয়েও বেশি শক্তি—
“তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম।”
গান শেষে সবাই হাততালি দিল। রূপা চোখ নামিয়ে ফেলল, কিন্তু তার ঠোঁটে ফুটে উঠল এক ম্লান অথচ কৃতজ্ঞ হাসি।
আড্ডা গুটিয়ে গেলে সৌম্য বাইরে দাঁড়াল। রূপা আসতেই সে বলল,
“আপনাকে কেউ আর থামাতে পারবে না। যতক্ষণ আমি আছি।”
রূপা একটু থেমে নরম গলায় বলল,
“আপনি জানেন না, আজ যা হলো, তাতে আপনার শত্রু বাড়ল। তবু কেন এতটা সাহস করলেন?”
“কারণ আপনার গান ছাড়া আমার জীবন কেবল খাতা আর ধুলোয় ভরা। আপনি গান গাইলে আমি বেঁচে উঠি। এই সত্যকে রক্ষা করতে যদি শত্রু বাড়ে, তবে তা মেনে নেব।”
রূপা তাকিয়ে রইল। তার চোখে জল চিকচিক করছিল, কিন্তু সেই জলের আড়ালে ফুটে উঠেছিল দীর্ঘদিনের দমিয়ে রাখা আলো।
“আপনি বুঝতেই পারছেন না, আপনি আমার জীবনে কী করছেন,” সে বলল, “আমি ভেবেছিলাম আমার গান কেবল আমার দুঃখকে সামলাবে। আজ মনে হচ্ছে, তা হয়তো কারও বাঁচার কারণ হতে পারে।”
দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। শিউলি গাছের ফুল ঝরছিল, বাতাসে সোনালি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল। হঠাৎ মনে হলো, এই নিস্তব্ধতার ভেতরেই তাদের ভালোবাসা প্রথমবার স্পষ্ট হয়ে উঠল।
সেদিন রাতে সৌম্য ডায়েরিতে লিখল—
“আজ আমি রূপাকে রক্ষা করলাম, কিন্তু আসলে সে-ই আমাকে রক্ষা করছে। অবেলার ফুল শুধু ফোটে না, আলোও ছড়ায়। আমি তার আলোয় নিজেকে চিনে নিচ্ছি।”
পরের সপ্তাহে গ্রামে গুজবের ঝড় আরও বেড়ে গেল। বাজারে চা খেতে বসলে ফিসফিস শব্দ কানে আসত—“সৌম্য মাস্টার এখন বিধবার কবলে পড়েছে।” কিশোর ছেলেরা রাস্তায় দেখা হলে গান গাইতে গাইতে ব্যঙ্গ করত, “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে…”। সৌম্য প্রথমে রাগে গা গরম করত, পরে বুঝল—সমাজের কানে যুক্তি পৌঁছায় না, সেখানে শুধু আওয়াজই গর্জে ওঠে।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে একেবারেই ভেঙে পড়েনি। বরং রবিবার আসার আগ পর্যন্ত দিনগুলো তার কাছে যেন প্রস্তুতির মতো লাগত। প্রতি ক্লাসে সে ছাত্রদের বোঝাত—গান মানে শুধু শব্দ নয়, গান মানে আত্মার আর্তি। ছাত্ররা অবাক হয়ে তাকাত; হয়তো তারা তখনও বোঝে না, কিন্তু সৌম্যর বিশ্বাস ছিল—একদিন এই কথাই তাদের বাঁচার শক্তি হবে।
শনিবার বিকেলে বৃষ্টি নামল। স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার পর সৌম্য হাঁটতে হাঁটতে আবার রূপার ভাঙা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা আধখোলা। ভিতরে আলো জ্বলছে। কাঁপা গলায় সে ডাক দিল—
“রূপা দি, আছেন?”
ভেতর থেকে গলার সাড়া এল—
“এসো।”
সৌম্য ভিতরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখল, ছোট্ট ঘরটায় অল্প কিছু আসবাব, কিন্তু অদ্ভুতভাবে গুছোনো। খাটের মাথায় রাখা ছোট্ট মাটির প্রদীপ, পাশে একখানা শিউলি ফুলের মালা শুকিয়ে গেছে। রূপা মাটির ওপর বসে কাঁথার ওপর সুতো ছিঁড়ছিল, যেন পুরোনো জামা মেরামত করছে। তার মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।
“আপনি গান করছেন না?” সৌম্য জিজ্ঞেস করল।
“গান সবসময় আসে না,” রূপা শান্ত গলায় বলল। “কখনও আসে, কখনও আসে না। যেমন ভালোবাসা—সবসময় প্রকাশ পায় না, তবু থেকে যায়।”
সৌম্যের বুক কেঁপে উঠল।
“আপনি ভালোবাসার কথা বললেন… আমি কি ভুল শুনলাম?”
রূপা একটু থেমে মাথা নিচু করল। তারপর খুব ধীরে বলল,
“আমি ভালোবাসতে ভয় পাই। সমাজ যেমন পাপের ছাপ এঁকে দিয়েছে, তেমনই ভয় ঢুকিয়েছে আমার রক্তে। কিন্তু আপনার চোখে যখন দেখি, মনে হয় ভয়টা কিছুটা হলেও সরে যায়।”
সৌম্য এগিয়ে এসে বলল,
“আপনি যদি ভয় পান, আমি থাকব। আমি ভয় পাব না। আপনি শুধু গান গাইবেন। বাকিটা আমি সামলাব।”
রূপা তাকাল তার দিকে। চোখে একরাশ অশ্রু জমল, কিন্তু ঠোঁটে ফুটল এমন এক হাসি যা অনেকদিন কেউ দেখেনি।
“আপনি জানেন, এই গ্রামে এসব বলা মানে যুদ্ধ ঘোষণা করা?”
সৌম্য দৃঢ় গলায় উত্তর দিল,
“তাহলে যুদ্ধই হোক। সুর আর ভালোবাসা যদি পাপ হয়, আমি সেই পাপকে বেছে নেব।”
রবিবারের আসরে রূপা সেই সপ্তাহে গাইল—
“যদি প্রেম দিলে না হায়, তবে বেঁচে থাকার কী দায়।”
পুরো বারান্দা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গান শেষে সৌম্যের দিকে তাকিয়ে সে একবার হাসল। সেই হাসি যেন অঘোষিত স্বীকৃতি।
সেদিন রাতে সৌম্য ডায়েরিতে লিখল—
“আজ রূপার চোখে দেখলাম ভয়ের ভিতরে জন্ম নেওয়া সাহস। অবেলার ফুল কেবল ফুটছে না, শিকড়ও ছড়িয়ে দিচ্ছে।”
গ্রামের বাতাসে চাপা এক অস্থিরতা জমছিল। যত রবিবার পেরিয়ে যাচ্ছিল, রূপার গান যেন নতুন রঙ পাচ্ছিল, আর সেই সঙ্গে বাড়ছিল গুজবের আগুন। আড্ডার বাইরে দাঁড়িয়ে কয়েকজন মাঝেমধ্যে কটূ মন্তব্য ছুঁড়ে দিত—“মাস্টারমশাই, গান শোনাতে এত উৎসাহ কেন?” আবার কেউ বা হেসে বলত, “রবিবারের আসরে এখন প্রেমের পাঠও শুরু হয়েছে বোধহয়!”
সৌম্য প্রথমে এসব উপেক্ষা করত, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারল এই ফিসফাস রূপার গলাকেও স্পর্শ করছে। এক রবিবারে গান গাওয়ার সময় তার গলায় হঠাৎ কম্পন ধরা পড়ল। গান শেষ করে সে চুপ করে বসে রইল, লোকজন হাততালি দিলেও তার চোখের কোণে জল জমে উঠল।
আড্ডা গুটিয়ে যাওয়ার পর সৌম্য বাইরে এসে অপেক্ষা করছিল। রূপা ধীরে ধীরে বেরোল, চোখ নিচু।
“আজ আপনার গলা কেঁপে গেল কেন?” সৌম্য জিজ্ঞেস করল।
রূপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“মানুষের কথা গানকেও বিষিয়ে দেয়। মনে হয়, এই আড্ডাটাও একদিন আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে।”
সৌম্য দৃঢ় গলায় বলল,
“যতদিন আমি আছি, কেউ আপনার গান কেড়ে নিতে পারবে না। আপনি গান গাইবেন, আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে পাহারা দেব।”
রূপা তাকিয়ে রইল, তার চোখে তখন ভয় আর আলো একসঙ্গে মিশে ছিল।
“আপনি জানেন না, এর ফল কী হতে পারে।”
“ফল যাই হোক,” সৌম্য উত্তর দিল, “আমি পিছিয়ে আসব না। আপনার কণ্ঠই আমার জীবন।”
পরের দিনই ঘটনা ঘটল। স্কুলে হঠাৎ কয়েকজন অভিভাবক এসে হেডস্যারের কাছে অভিযোগ তুলল—
“আমাদের বাচ্চাদের শিক্ষক যদি বিধবার সঙ্গে এমন সম্পর্ক রাখেন, তবে আমরা কাকে বিশ্বাস করব?”
হেডস্যার সৌম্যকে ডেকে পাঠালেন। তার মুখে কঠোরতা, কিন্তু চোখে মমতা।
“তুমি জানো আমি তোমার পাশে আছি। কিন্তু সমাজ সবসময় যুক্তি মানে না। সাবধানে থেকো। নিজের মর্যাদা যেন নষ্ট না হয়।”
সৌম্য নীরবে মাথা নোয়াল। ভিতরে একটা ঝড় বইতে লাগল।
বিকেলে সে আবার রূপার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজা আধখোলা। রূপা মাটির প্রদীপ জ্বালাচ্ছিল। আলো তার মুখে পড়ে এক অদ্ভুত আভা তৈরি করেছিল।
“আজ স্কুলে আমার নামে অভিযোগ উঠেছে,” সৌম্য বলল।
রূপা থমকে গেল।
“আমি তো বলেছিলাম, এ পথ বিপজ্জনক।”
“বিপদ থাকুক,” সৌম্য বলল, “কিন্তু আমি তো আপনার গান ছাড়া বাঁচতে পারব না।”
রূপার চোখে তখন জল। কিন্তু সেই জলের মধ্যেই জ্বলছিল এমন এক দীপ্তি, যা সমাজের কোনো দোষারোপ নিভিয়ে দিতে পারে না।
“আপনি যদি সত্যিই পাশে থাকেন, তবে আমি গান ছাড়ব না। যতই গুজব হোক।”
সেদিন রাতে সৌম্য ডায়েরিতে লিখল—
“আজ রূপার চোখে প্রথমবার ভয়কে হারানোর শক্তি দেখলাম। অবেলার ফুল ফুটেছে, আর এখন সে ঝড় সামলাতে প্রস্তুত।”
গ্রামের মধ্যে গুজবের ঢেউ আরও জোরালো হয়ে উঠল। পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে বসে কিছু লোক মুখ টিপে হেসে বলল—“রবিবার মানেই এখন প্রেমের আসর।” আবার কেউ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল—“মাস্টারমশাইকে বুঝি বিধবা বশ করেছে।” এসব কথার মধ্যে বিষ ছিল, আর সেই বিষ ধীরে ধীরে বাতাসে মিশে যাচ্ছিল।
কিন্তু রবিবারের আসরে অন্য ছবি। সেদিন রূপা গাইল—
“আমার সকল দুঃখের প্রিয় সঙ্গী তুমি।”
সুরে ছিল না ভয়ের ছায়া, বরং ছিল অদম্য শক্তি। বারান্দায় বসে থাকা সকলেই মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। সৌম্যের বুক ভরে উঠল। সে বুঝল, রূপা তার ভয় পেরিয়ে যাচ্ছে।
আড্ডা শেষ হলে সৌম্য বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। রূপা এগিয়ে এলে সে নরম গলায় বলল,
“আজ আপনি ভয় ছাড়াই গান গাইলেন।”
রূপা মৃদু হাসল।
“ভয় এখনো আছে। কিন্তু আপনার চোখে তাকালে মনে হয়, ভয়টাকে আমি পেরোতে পারি।”
ঠিক তখনই গ্রামের এক বয়স্ক মানুষ, নাম হরিদাস কাকা, হেঁটে এসে দাঁড়ালেন। চোখে কড়া দৃষ্টি।
“সৌম্য, তুমি ভালো ছেলে। কিন্তু সমাজের নিয়ম ভাঙতে যেও না। বিধবার সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা ভালো চোখে দেখবে না কেউ।”
সৌম্য শান্ত স্বরে বলল,
“কাকা, আমি কেবল গানকে ভালোবাসি। আর যদি সমাজে গান গাওয়া অপরাধ হয়, তবে সেই অপরাধ আমি স্বীকার করব।”
হরিদাস কাকা মাথা নেড়ে চলে গেলেন। রূপার চোখে তখন ভয় আবার ফিরে এল।
“দেখলেন? তারা সহজে ছাড়বে না।”
সৌম্য দৃঢ় গলায় উত্তর দিল,
“তারা যতই বাঁধা দিক, আমি আপনার গানকে রক্ষা করব।”
সেদিন রাতে হঠাৎ ঝড় উঠল। বাঁশঝাড় কাঁপতে লাগল, জানালার কাঁচ ঠকঠক করতে লাগল। সৌম্য শুয়ে ছিল, কিন্তু ঘুম আসছিল না। মনে হচ্ছিল, রূপার ভাঙা বাড়ির চাল এই ঝড়ে টিকবে তো?
সকালে তাড়াহুড়ো করে সে সেখানে ছুটে গেল। দেখল চালের কিছু অংশ উড়ে গেছে, মাটিতে ভিজে শিউলি ফুল ছড়িয়ে আছে। রূপা ভেতরে বসে ভাঙা প্রদীপের পাশে কাপড় শুকোচ্ছিল। তাকে দেখে সৌম্যের বুক হুহু করে উঠল।
“কাল রাতটা কেমন কাটালেন?”
রূপা মৃদু হেসে বলল,
“ঝড় তো আমার জীবনে নতুন নয়। আমি টিকে গেছি।”
সৌম্য এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়াল।
“এবার একা টিকতে হবে না। আমি আছি।”
রূপা তার হাতের দিকে চেয়ে রইল, তারপর আলতো করে নিজের আঙুল রাখল। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সমস্ত ঝড় থেমে গেছে।
সেদিন রাতে সৌম্য ডায়েরিতে লিখল—
“আজ প্রথমবার রূপার হাত ধরলাম। সেই স্পর্শে আমি শুনলাম—অবেলার ফুল ঝড়েও টিকে থাকে।”
ঝড়ের রাতের পর থেকে গ্রামের কটাক্ষ আরও তীব্র হলো। হাটে লোকজন ফিসফিস করত, “সৌম্য মাস্টারকে তো আমরা ভেবেছিলাম ভদ্রলোক, অথচ বিধবার ঘরে হাত ধরা পর্যন্ত গড়িয়েছে।” আবার কারও কণ্ঠে ব্যঙ্গ—“গান শোনার অজুহাতে প্রেম তো অনেকেই করে, মাস্টারমশাইও তার ব্যতিক্রম নয়।”
সৌম্য এসব শুনেও থামল না। বরং তার ভেতরে অদ্ভুত এক জেদ জন্ম নিল। সে প্রতিদিন রূপার সঙ্গে দেখা করত না, তবে প্রতি রবিবার যেন নতুন করে জন্ম নিত। আসরে সে বসত সবসময় প্রথম সারিতে। রূপার গান শুনে মনে হতো, মানুষের সমস্ত বিদ্বেষকে সুর গিলে নিচ্ছে, কেবল আলো ফিরিয়ে দিচ্ছে।
এক রবিবারে রূপা গাইল—
“মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বৈঠা দেব না।”
তার গলায় যে আর্তি ছিল, তা শুধু গানের জন্য নয়। যেন সে জীবনের ভারও গলিয়ে দিচ্ছিল সুরে। গান শেষে সবাই হাততালি দিলেও সৌম্যর চোখে জল জমল।
আড্ডা গুটিয়ে গেলে বাইরে এসে সে বলল,
“আপনি কেন বারবার গানেই নিজের দুঃখ ঢেলে দেন?”
রূপা শান্ত গলায় উত্তর দিল,
“কারণ অন্য কোথাও রাখার জায়গা নেই। গানই আমার আশ্রয়।”
“আমিও তো থাকতে পারি আশ্রয় হয়ে,” সৌম্য হঠাৎ বলে ফেলল।
রূপা চমকে তাকাল। চোখে ভয়ের ছায়া, কিন্তু সেই ভয়ের ফাঁক দিয়ে ঝলমল করছিল এক অদ্ভুত আলো।
“আপনি বুঝতে পারছেন না, এসব কথা কত বড় দায় ডেকে আনতে পারে।”
“আমি সব বুঝে বলছি। আপনার পাশে না থাকলে আমার জীবন অর্থহীন।”
রূপা কিছু বলল না। কেবল শিউলি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রইল। বাতাসে ফুল ঝরছিল। মনে হচ্ছিল, তাদের নীরবতার মধ্যে এক অঘোষিত প্রতিশ্রুতি গড়ে উঠছে।
পরদিন স্কুলে হঠাৎ গ্রামসভা ডাকা হলো। কয়েকজন প্রভাবশালী লোক একত্র হয়ে ঘোষণা করল—
“এই আড্ডায় আর কোনো বিধবা গান গাইবে না। সমাজের নিয়ম ভাঙা চলবে না।”
সংবাদটা শুনে সৌম্যর বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠল। সে হেডস্যারের ঘরে গিয়ে বলল,
“স্যার, এটা অন্যায়। গানের কোনো ধর্ম হয় না, কোনো সামাজিক বাঁধন হয় না। ওর কণ্ঠ থামিয়ে দেওয়া মানে আমাদের প্রাণ থামিয়ে দেওয়া।”
হেডস্যার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“আমি তোমার সঙ্গে একমত, সৌম্য। কিন্তু গ্রাম যখন একসঙ্গে রায় দেয়, তখন একা দাঁড়ানো কঠিন।”
“তাহলে আমি একাই দাঁড়াব,” সৌম্য বলল। তার চোখে তখন এমন এক দীপ্তি ফুটে উঠেছিল যা সাধারণ শিক্ষক সৌম্যের সঙ্গে মানায় না।
সেদিন রাতে সৌম্য ডায়েরিতে লিখল—
“আজ শুনলাম, রূপার গান থামিয়ে দিতে চায় সমাজ। কিন্তু আমি জানি, অবেলার ফুলকে কেউ মুছে দিতে পারে না। কাল থেকে লড়াই শুরু।”
গ্রামসভার সিদ্ধান্ত সারা গ্রামজুড়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে ছড়িয়ে পড়ল—রূপা আর রবিবারের আসরে গান গাইতে পারবে না। অনেকেই খুশি হলো, অনেকে স্বস্তি পেল—“একটা কলঙ্ক শেষ হলো।” কিন্তু সৌম্যর ভেতরটা তখন অগ্নিগিরির মতো ফুঁসছিল।
শনিবার রাতে সে ডায়েরি খুলে লিখল—
“কাল রবিবার। ওরা যদি গান থামিয়ে দেয়, তবে আমার বেঁচে থাকার কারণও থেমে যাবে। আমি একা দাঁড়াব, যত বাধা আসুক।”
রবিবার সন্ধ্যায় সবাই আড্ডার বারান্দায় জড়ো হলো। আজকের আবহ ছিল অদ্ভুত—কেউ আগ্রহী, কেউ কৌতূহলী, আবার কেউ ব্যঙ্গের চোখে তাকিয়ে আছে। রূপা কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল, মুখে নিস্তব্ধতা। হেডস্যার মৃদু কাশলেন, বললেন,
“আজ আসর শুরু করব আমরা, তবে…”
এর মধ্যেই সৌম্য হঠাৎ উঠে দাঁড়াল।
“আজ গান হবে। যিনি আমাদের প্রাণে আলো দেন, তাকে থামানো যাবে না।”
ভিড়ের ভেতর গুঞ্জন উঠল। কয়েকজন চিৎকার করে বলল,
“এটা সমাজ মেনে নেবে না!”
সৌম্য দৃঢ় গলায় বলল,
“গান যদি সমাজের শত্রু হয়, তবে আমি সেই সমাজের বাইরে দাঁড়াব।”
রূপা স্তম্ভিত হয়ে তাকাল তার দিকে। চোখে ভয় আর আলো একসঙ্গে। হেডস্যার শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“গান থামানো যায় না। যদি রূপা গাইতে চায়, তবে সে গাইবে।”
রূপা ধীরে ধীরে সামনে এল। তার গলা কাঁপছিল, কিন্তু চোখে ছিল এক অদম্য দীপ্তি। তারপর সে গাইল—
“আমার সকল ভালোবাসা, তুমি নিলে কাড়ি।”
সুরে ছিল না ভয়, ছিল মুক্তির আহ্বান। পুরো বারান্দা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। লোকজন যারা ঠাট্টা করত, তারাও স্তব্ধ হয়ে গেল।
গান শেষে রূপা থেমে দাঁড়াল। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে কারও হাততালি শোনা গেল। তারপর একে একে সবাই হাততালি দিতে লাগল। কারও মুখে দ্বিধা, কারও চোখে লজ্জা, তবু সুরের জোরে সমাজের দেয়াল ভেঙে পড়তে শুরু করল।
সৌম্য এগিয়ে গিয়ে রূপার হাত ধরল। প্রকাশ্যে, সবার সামনে।
“আজ থেকে আর ভয় নয়। তুমি গান গাইবে, আর আমি তোমার পাশে থাকব।”
রূপার চোখে জল ভরে উঠল। সে ফিসফিস করে বলল,
“সমাজ কি মেনে নেবে?”
সৌম্য হাসল,
“অবেলার ফুলকে কেউ আটকাতে পারে না। ফুল ফোটার সময় হলে, সে ফোটবেই।”
সেদিন রাতে গ্রামে নতুন আলো নামল। লোকজন অনেক কথা বলল, অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিল, কিন্তু বারান্দার আড্ডায় গান চলল আগের মতোই। আর সেই গানেই সবাই বুঝতে পারল—ভালোবাসা আর সুরকে কোনো নিয়ম বেঁধে রাখতে পারে না।
ডায়েরির শেষ পাতায় সৌম্য লিখল—
“আজ অবেলার ফুল ফুটল। এ ফুলের গন্ধে আমি বাঁচব, আর সেই গন্ধে রূপাও বাঁচবে। সমাজ যাই বলুক, গান আর ভালোবাসা চিরন্তন।”
শেষ