Bangla - প্রেমের গল্প

অফিসের পরে

Spread the love

সুলগ্না দেব


এক

অফিসের ব্যস্ত সময়টা যেন এক অদৃশ্য স্রোত, যেখানে প্রতিটি মানুষ ভেসে চলে তার নিজস্ব দায়-দায়িত্ব, টার্গেট আর ডেডলাইনের ভেতর দিয়ে। শহরের এক নামী বহুজাতিক কোম্পানির করিডর দিয়ে প্রতিদিনের মতো হাঁটছিলেন অরিত্র সেন—ত্রিশোর্ধ্ব বয়সী, ফরমাল শার্ট-প্যান্টে মোড়া এক নির্লিপ্ত মুখ, হাতে কফির কাপ আর চোখে চশমা। তার অভ্যাসই হলো কাজ ছাড়া অন্য কিছুতে না জড়ানো; সম্পর্ক, হাসি, বা ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব—সব যেন সময়ের বাইরে রাখা কোনো বইয়ের পাতার মতো। অপরদিকে মেঘলা দত্ত, ক্রিয়েটিভ টিমের প্রাণবন্ত এক মেয়ে, যার হাসি অফিসে একধরনের হাওয়ার মতো ছড়িয়ে থাকে। সহকর্মীরা তাকে সহজেই মিশুক বলে জানে, তবে খুব কম মানুষই বোঝে তার ভেতরে জমে থাকা অতীতের ব্যথার স্তরগুলো। দু’জনেই একই অফিসে বছরের পর বছর কাজ করলেও এ পর্যন্ত তাদের যোগাযোগ সীমিত ছিল মেইল, মিটিং আর ফাইল শেয়ারিংয়ের মধ্যে। হয়তো কোনো প্রজেক্ট নিয়ে ছোটখাটো আলাপ, অথবা করিডরে হালকা সৌজন্য বিনিময়—তাতেই সীমাবদ্ধ।

সেদিন বিকেলটা অন্য দিনের মতোই শুরু হলেও ভিন্নভাবে শেষ হতে চলেছিল। বড় প্রজেক্টের প্রেজেন্টেশন শেষ করতে গিয়ে সবাইকে দেরি হয়ে যায়, আর শেষ মিটিং শেষে যখন টিম মেম্বাররা ধীরে ধীরে চলে গেল, তখন অরিত্র আর মেঘলাই থেকে গেল করিডরের এক প্রান্তে। লিফট ডাকতে গিয়ে দেখা গেল—তাদের দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই। দু’জনেই ভেতরে ঢুকল, এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। লিফট নামতে শুরু করতেই হঠাৎ এক ঝাঁকুনির পর থেমে গেল মাঝপথে। আলো নিভে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য আঁধার নামল, তারপর জরুরি লাইট জ্বলে উঠল—ম্লান, হলদেটে, আর অস্বস্তিকর। মেঘলা প্রথমে হালকা চিৎকার করে উঠেছিল, তারপর নিজেকে সামলে নিল, আর অরিত্র অস্বাভাবিক শান্ত গলায় বলল, “ভয় পাবেন না, হয়তো একটু টেকনিক্যাল সমস্যা।” কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারও বুক ধড়ফড় করছিল—সমস্যা প্রযুক্তির নয়, সমস্যাটা ছিল এই হঠাৎ তৈরি হওয়া ঘনিষ্ঠ পরিস্থিতি, যা সে আগে কখনো কল্পনাও করেনি। দু’জন মানুষের মধ্যে নীরবতা অনেকসময় কথার চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আর সেদিন সেই সংকীর্ণ লিফটের ভেতর ঠিক সেটাই ঘটছিল।

মিনিটগুলো যেন দীর্ঘ হতে লাগল। লিফটের ভেতরে শুধু হালকা যান্ত্রিক গুঞ্জন আর দু’জনের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। মেঘলা ঠান্ডা ধাতব দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখে একধরনের নার্ভাস ঝিলিক, অথচ একইসাথে কৌতূহলও। অরিত্র পকেট থেকে ফোন বের করে সিগন্যাল খোঁজার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সিগন্যালের বদলে চোখ চলে যাচ্ছিল মেঘলার দিকে—যেন প্রথমবার তাকে নতুন করে দেখছে। মেঘলার চুলের গোছা হালকা আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, তার কপালে ছোট্ট এক বিন্দু ঘাম জমে ছিল, যা তাকে অরিত্রর চোখে আরও বাস্তব, আরও কাছের করে তুলছিল। দু’জনেই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল, আবার এড়িয়েও যাচ্ছিল—এক অদ্ভুত টানাপোড়েন, এক অস্বস্তি মিশ্রিত টান। হয়তো বাইরে থেকে কেউ দেখলে এটিকে নিছক এক দুর্ঘটনা বলেই মনে করত, কিন্তু তাদের ভেতরে কিছু যেন নিঃশব্দে বদলে যাচ্ছিল। সেই নীরবতাই হয়ে উঠল তাদের প্রথম ব্যক্তিগত আলাপের দরজা—যেখানে শব্দ কম, কিন্তু অনুভূতি অনেক গভীর। সেই রাতের লিফট আটকে পড়া ঘটনা হয়তো কয়েক মিনিটই স্থায়ী হয়েছিল, কিন্তু তাদের মনে রেখে গেল এক অচেনা ছায়া, যা অফিসের আলো-ছায়ার আড়ালে নতুন সম্পর্কের জন্ম দিচ্ছিল।

দুই

শহরের ব্যস্ততম রাস্তাগুলো থেকে যখন ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় কমতে শুরু করে, তখনও উঁচু কাঁচঘেরা অফিস ভবনের ভেতর আলো জ্বলছিল। সেই আলোয় ভেসে থাকা করিডরের এক কোণে নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছিল দু’জন—অরিত্র আর মেঘলা। বড় প্রজেক্টের ডেডলাইন ঘনিয়ে আসায় অন্য সহকর্মীরা কাজ গুছিয়ে অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে, কিন্তু এই দু’জনকে বসে থাকতে হলো রাত পর্যন্ত। কাগজের স্তূপ, কম্পিউটারের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা গ্রাফ আর রিপোর্টের ভিড়ে সময় কখন গড়িয়ে যাচ্ছে টেরই পাওয়া যাচ্ছিল না। মাঝে মাঝে ফোন বেজে উঠলেও দু’জনেই অগ্রাহ্য করে কাজে মন দিচ্ছিল। কিন্তু এর মাঝেই ক্লান্তি এসে যখন আঘাত করে, তখন তাদের চোখ একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়, আর সেই মুহূর্তে কথার দরজা খুলে যায়। অরিত্র ফাইলের ফাঁকে জিজ্ঞেস করে, “কফি খাবেন? আমি বানিয়ে আনি।” মেঘলা হালকা হেসে উত্তর দেয়, “আপনি কফি বানাতে জানেন নাকি?” প্রশ্নটা মজার ছলে করা হলেও অরিত্রর মুখে দীর্ঘদিন পর একচিলতে হাসি ফুটে ওঠে। সেই ছোট্ট মুহূর্তেই কাজের চাপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক ধরণের হালকা বাতাস, যা অফিসের নিস্তব্ধ রাতটাকে একটু উষ্ণ করে তোলে।

তাদের মধ্যে আলাপ শুরু হয় খুব সাধারণ বিষয় দিয়ে—কাজের চাপ, ক্লায়েন্টের অবাস্তব ডিমান্ড, কিংবা সহকর্মীদের মজার ঘটনা। ধীরে ধীরে সেই আলাপ সরে আসে ব্যক্তিগত জীবনের দিকে। মেঘলা জানায় সে একা থাকে, রান্না করার সময় পায় না বলে প্রায়ই বাইরে খায়। অরিত্র জানায়, সে একা থাকার অভ্যস্ত, বাসায় ফেরার পর টিভি চালিয়ে বা বই খুলে সময় কাটায়। কথার ভেতরে ভেতরে যেন দু’জনের অজানা দিকগুলো একে অপরের কাছে উন্মোচিত হতে থাকে। মেঘলা হালকা বিরক্তির সুরে বলে ওঠে, “শহরে এত ভিড় অথচ মানুষজন এত একা হয়ে যায়, না? সবকিছু আছে, কিন্তু কারও সঙ্গে ভাগ করার মতো সময় নেই।” কথাটা শুনে অরিত্র চুপ করে যায়, যেন নিজের জীবনের নিঃসঙ্গতাকে আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে। সে মৃদুস্বরে শুধু বলে, “হ্যাঁ, একেবারেই ঠিক বলেছেন।” এই একটুকু বাক্যেই বোঝা যায়, ভেতরে ভেতরে তারা একই শূন্যতার সঙ্গী, শুধু এতদিন জানত না। ক্লান্ত চোখে একে অপরকে দেখা, একই কফির কাপ থেকে পালা করে চুমুক দেওয়া—এগুলো হয়তো সামান্য ঘটনাই, কিন্তু তাদের মধ্যে অদৃশ্য সুতো বুনে দিচ্ছিল, যা বাইরের চোখে ধরা পড়ছিল না।

রাত যখন অনেক গভীর হয়, অফিস ভবনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যায় শহরের আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে, রাস্তায় গাড়ির শব্দও কমে এসেছে। চারপাশের এই নীরবতা যেন আরও কাছে টেনে আনছিল তাদের। মেঘলা টেবিলে ভর দিয়ে হেলান দিয়ে বসেছিল, আর অরিত্র তাকিয়ে ছিল তার আঙুলের ডগায় ধরা কফির মগটার দিকে। সেই ছোট্ট দৃশ্যও তার কাছে অদ্ভুতভাবে আকর্ষণীয় লাগছিল, যদিও সে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছিল। তারা দু’জনেই জানত, এই আলাপ কেবল সহকর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর মধ্যে অন্যরকম এক উষ্ণতা জন্ম নিচ্ছে, যা হয়তো প্রকাশ করা যায় না সহজে। মেঘলা হঠাৎ হেসে বলে ওঠে, “আমাদের দু’জনকে বোধহয় অফিসের রাতের প্রহরী বানিয়ে রাখা উচিত। বাকিরা সব গায়েব।” কথাটা শুনে অরিত্র আবারও মৃদু হেসে ফেলে, আর বুঝতে পারে, এই মেয়ে তার মধ্যে যে দীর্ঘদিনের নির্লিপ্ততা জমে ছিল, তার গায়ে প্রথম ফাটল ধরিয়েছে। সেই রাত, সেই কাজের চাপ, আর কফির উষ্ণতা—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবেশ তৈরি হয়, যেখানে তারা দু’জনেই বুঝতে পারে, একে অপরের উপস্থিতি এখন আর কেবল পেশাদার নয়, বরং জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে নিঃশব্দ সঙ্গ।

তিন

দিনের আলো যখন নিভে আসছিল, শহরের কোলাহল ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল দূরে, তখনও অফিসের ক্যান্টিনে আলো জ্বলছিল এক কোণে। সেদিন কাজের চাপ কম থাকায় অন্য সবাই দ্রুত বাড়ি ফিরে গেছে, কিন্তু মেঘলা যেন ইচ্ছে করেই থেকে গিয়েছিল। ট্রেতে অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপ, তার পাশে রাখা নুডলস ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। চোখের সামনে তাকিয়ে থাকলেও সে যেন কোথাও নেই, ভেসে আছে অন্য কোনো জগতে। অরিত্র যখন ক্যান্টিনে ঢোকে, প্রথমে তাকে খেয়াল করেনি, কিন্তু তারপর চোখ মেলে তাকাতেই হঠাৎ চোখে ভেসে উঠল অশ্রুর চিকচিক আলো। সেই মুহূর্তে মেঘলা যেন খুব ভঙ্গুর দেখাচ্ছিল, অফিসের প্রাণবন্ত মেয়েটির বদলে যেন একাকিত্বে ভাঙা এক মানুষ। অরিত্র থেমে যায়, তার ভেতরে একধরনের দ্বিধা কাজ করে—কথা বলবে কি বলবে না। এতদিন তারা ছোটখাটো হাসি-মশকরা করেছে, কফি শেয়ার করেছে, কিন্তু এমন সংবেদনশীল মুহূর্তে তাকে কাছে যাওয়া কি ঠিক হবে? কিন্তু সেই দ্বিধা বেশিক্ষণ টিকল না। সে চুপচাপ বসে পড়ে মেঘলার সামনে, মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে, “সব ঠিক আছে তো?”—একটা সাধারণ প্রশ্ন, কিন্তু সেই প্রশ্নেই যেন বরফ গলতে শুরু করল।

মেঘলা প্রথমে কিছু বলে না, শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে কাপের কিনারা নিয়ে খেলতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে ভাঙা কণ্ঠে বলতে শুরু করে—কিভাবে তার বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল, কিভাবে বিশ্বাসঘাতকতা তাকে ভিতর থেকে শূন্য করে দিয়েছিল। বাইরে থেকে শক্ত, স্বাধীন, হাসিখুশি যে মেয়েটি সবাই দেখে, তার আড়ালে আসলে ছিল গভীর আঘাতের চিহ্ন। সে বলে, “মানুষ যখন খুব কাছের কাউকে হারায়, তখনও বোঝা যায় না—কোনটা বেশি কষ্টকর, তার চলে যাওয়া, নাকি তার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা।” অরিত্র স্তব্ধ হয়ে শোনে। তার ভেতরে হঠাৎ এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পায়—সে-ও তো অনেকদিন ধরে একা, সম্পর্ক নিয়ে ভয় আর অনিশ্চয়তায় বেঁচে আছে। হয়তো তার কাহিনী ভিন্ন, কিন্তু সেই শূন্যতার অনুভূতি একেবারে একই। হঠাৎ সে নিজের নিঃসঙ্গতার কথা মনে করতে শুরু করে—অন্ধকার ঘর, ডাইনিং টেবিলে একা খাওয়ার নিস্তব্ধতা, আর রাতের পর রাত বইয়ের পাতায় ডুবে থেকে সময় কাটানো। চোখে ভাসতে থাকে তার মায়ের বারবার বলা কথা—“একলা থাকা মানে শক্ত হওয়া নয়, সেটা মানে ভেতরে ভেতরে খালি হয়ে যাওয়া।” মেঘলার চোখে জল দেখে অরিত্রর বুকের ভেতর চাপা দেওয়া সমস্ত আবেগ যেন জেগে ওঠে।

তাদের দু’জনের কথোপকথন ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে। মেঘলা বলে, সে এখন কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে পারে না, আবার একইসাথে ভয় পায় যে এই ভাঙা জীবন নিয়ে কতদূর একা চলতে পারবে। অরিত্র নীরবে মাথা নাড়ে, যেন নিজের ভেতরেও সেই একই প্রশ্ন প্রতিধ্বনি হচ্ছে। ক্যান্টিনের আলো তখন প্রায় আধো অন্ধকারে ঢেকে গেছে, কর্মচারীরা দরজা বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবুও দু’জন বসে থাকে—কারও মধ্যে নেই তাড়াহুড়ো, বরং একধরনের স্বস্তি। যেন বহুদিন পর কেউ তাদের ভেতরের কথা শুনছে, বিচার করছে না, শুধু পাশে বসে আছে। অরিত্র হালকা স্বরে বলে, “হয়তো আমরা দু’জনেই সেই মানুষগুলো, যারা বাইরের ভিড়ের মাঝেও একা হয়ে গেছি।” কথাটা শুনে মেঘলার ঠোঁটে হালকা কাঁপুনি আসে, কিন্তু চোখে জল মুছে একটুখানি হাসিও ফুটে ওঠে। সেই মুহূর্তে তারা দু’জনই বুঝে যায়, এই সম্পর্ক আর কেবল পেশাদার নয়। এটা নিঃসঙ্গতার ফাঁকফোকর ভরাট করার এক চেষ্টা, এক অদ্ভুত মিলন যেখানে কষ্ট ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে এক নীরব আশ্বাস। হয়তো এটা এখনও প্রেম নয়, কিন্তু সেই পথে এগোনোর প্রথম ধাপ।

চার

সেদিন অফিসে কাজ শেষ হতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। বাইরের আকাশে কুয়াশা নেমে এসেছে, আর ঠান্ডা হাওয়ায় শহরের আলো যেন আরও ঝাপসা হয়ে উঠেছে। মেঘলা অফিসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, রাস্তায় একটা গাড়ি পাবার অপেক্ষায়। কিন্তু এত রাতে ফাঁকা রাস্তায় ট্যাক্সি কিংবা রাইডশেয়ার পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। ঠিক তখনই অরিত্র গাড়ি পার্কিং থেকে বেরিয়ে এসে তাকে দেখে থেমে গেল। সামান্য দ্বিধা সত্ত্বেও এগিয়ে গিয়ে বলল, “চলুন, আমি আপনাকে নামিয়ে দিই। এত রাতে একা দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ না।” মেঘলা প্রথমে হালকা আপত্তি জানালেও অরিত্রর গলায় যে আন্তরিকতা ছিল, সেটা এড়ানো সম্ভব হলো না। দু’জনেই গাড়িতে উঠে পড়ল। ভেতরে নীরবতা নেমে এলো প্রথমে, শুধু গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ আর বাইরের আলো-অন্ধকার মিলিয়ে চলা শহরের দৃশ্য। সেই নীরবতার মধ্যেই অদ্ভুত এক অস্বস্তি আবারও জন্ম নিল, কিন্তু এবার সেটা আগের মতো কেবল অস্বস্তি নয়—এর সঙ্গে মিশে ছিল এক ধরণের কৌতূহল, একে অপরের ভেতরকে জানার আকাঙ্ক্ষা।

গাড়ির ভেতরে আলো নিভু নিভু, ড্যাশবোর্ডে শুধু হালকা কমলা রঙের আভা। মেঘলা জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ বলে উঠল, “এই শহরে যত আলো দেখি, ততই মনে হয় মানুষগুলো আরও একা হয়ে যাচ্ছে।” অরিত্র তার দিকে একবার তাকাল, তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিল, “হয়তো আলো যত বেশি হয়, অন্ধকারও তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।” মেঘলা চমকে তাকাল, যেন অরিত্রর উত্তর তার ভেতরের কথাই বলে দিল। আলাপ সেখান থেকেই শুরু হয়—কিভাবে দু’জনেই একাকিত্বের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে, কিভাবে চারপাশের মানুষজন হাসিমুখে চলাফেরা করলেও ভিতরে ভেতরে ভাঙা থাকে। মেঘলা ধীরে ধীরে নিজের অতীতের কষ্টের কথা খুলে বলে, এবার কোনো কান্না নয়, বরং শান্ত গলায়, যেন কারও বিশ্বাসে ভর করে একটু হালকা হতে চায়। অরিত্রও জানাল তার নিঃসঙ্গ জীবনের গল্প, কিভাবে দিন শেষে ঘরে ফিরে সবকিছু নির্জীব মনে হয়। দু’জনেই বুঝতে পারে, তারা একে অপরের সামনে কোনো মুখোশ পরে নেই। এই উন্মুক্ততা যেন তাদের সম্পর্কের ভেতরে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করল। অরিত্র গাড়ি চালাচ্ছিল, কিন্তু তার মনোযোগ বারবার চলে যাচ্ছিল মেঘলার দিকে—সে কতটা শক্ত অথচ ভেতরে কতটা ভঙ্গুর, সেই উপলব্ধি তার ভেতরে এক অচেনা মমতা জাগাচ্ছিল।

যখন গাড়ি মেঘলার বাড়ির সামনে এসে থামল, তখন রাত আরও গভীর। চারপাশ নিস্তব্ধ, বাতাসে ঠান্ডার ছোঁয়া। মেঘলা গাড়ি থেকে নামার আগে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর মৃদু স্বরে বলল, “আজ যদি আপনি না থাকতেন, হয়তো আমি আরও একবার ভেতরে ভেতরে হারিয়ে যেতাম। ধন্যবাদ, অরিত্র।” তার চোখে কোনো জল ছিল না, কিন্তু কণ্ঠে এক অদ্ভুত কৃতজ্ঞতা আর ভরসা স্পষ্ট। অরিত্র কিছুক্ষণ দ্বিধায় থেকে বলল, “ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। আপনি চাইলে… যখনই প্রয়োজন, আমি থাকব।” কথাটা বলেই সে বুঝল, এটি শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং সত্যিই তার মনের কথা। মেঘলা একবার গভীরভাবে তার দিকে তাকাল, যেন সেই চোখের ভেতর লুকিয়ে থাকা সততা যাচাই করতে চাইছে। তারপর হালকা হেসে দরজা খুলে নামল। বিদায়ের মুহূর্তে সেই হাসি অরিত্রর ভেতরে অন্যরকম উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল। সেদিন রাতে তারা আলাদা পথে গেলেও, দু’জনেই বুঝে গেল—প্রথমবারের মতো তারা একে অপরের প্রতি বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। সেই বিশ্বাস এখনও প্রেম নয়, কিন্তু প্রেমের বীজ নিঃশব্দে অঙ্কুরিত হয়ে উঠছে তাদের ভেতরে।

পাঁচ

অফিসের বার্ষিক পার্টি সেদিন যেন অন্যরকম ছিল। চারপাশে ঝলমলে আলো, সাজানো টেবিল, মৃদু সুরে বাজতে থাকা সংগীত, আর সহকর্মীদের হাসি-ঠাট্টা—সব মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত আবহ। মেঘলা গাঢ় নীল শাড়ি পরে এসেছিল, সাথে হালকা গয়না; তার উপস্থিতি যেন চারপাশের আলোকে ম্লান করে দিয়েছিল। অরিত্র, সাধারণত যাকে সবার মধ্যে খুব বেশি চোখে পড়ে না, সেদিন কালো ব্লেজার পরে এসে অদ্ভুতভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। দু’জনেই একে অপরকে কয়েকবার লক্ষ্য করেছিল, কিন্তু সেই দৃষ্টি আবার দ্রুত এড়িয়ে গিয়েছিল, যেন কেউ টের পেয়ে যাবে বলে ভেতরে ভেতরে সঙ্কোচ ছিল। পার্টি এগোতে এগোতে সবাই যখন মজা করতে শুরু করল, ডান্স ফ্লোরে নেমে এলো অনেকেই। প্রথমে অরিত্র নাচতে চাইছিল না, কিন্তু সহকর্মীদের জোরাজুরিতে গিয়ে দাঁড়াতেই এক অদ্ভুত মুহূর্ত তৈরি হলো। মেঘলা ইতিমধ্যেই ফ্লোরে ছিল, আর সুরের তালে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ তাদের চোখ একসাথে আটকে গেল।

সেই মুহূর্তে যেন চারপাশের ভিড় মিলিয়ে গেল, সঙ্গীত থেমে গিয়ে শুধু হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। অরিত্রর হাত অজান্তেই এগিয়ে গেল মেঘলার দিকে, আর মেঘলা হালকা দ্বিধা নিয়েও হাত রাখল তার হাতে। ভিড়ের মধ্যে তাদের এই সাধারণ স্পর্শে যে বৈদ্যুতিক স্রোত বয়ে গেল, তা দু’জনের কাছেই অস্বীকার করা কঠিন হয়ে উঠল। নাচের ভেতরকার দূরত্বটা ধীরে ধীরে কমে এল—কেউ টের পায়নি, কিন্তু তাদের ভেতরের অস্বস্তি মিশ্রিত আকর্ষণ এক অদৃশ্য সুতার মতো টেনে আনছিল কাছাকাছি। মেঘলার চুল হালকা বাতাসে উড়ে এসে অরিত্রর কাঁধ ছুঁয়ে গেল, আর সেই মুহূর্তেই তার মনে হলো, এ দৃশ্য হয়তো চিরকাল মনে থেকে যাবে। চোখের ভাষায় যেন তারা এমন কিছু বলছিল যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না—হয়তো এ এক অজানা প্রতিশ্রুতি, হয়তো কেবলই আকাঙ্ক্ষা। তবে সত্য এটাই, সেই মুহূর্তে তারা কেউ আর আগের মতো নির্লিপ্ত থাকতে পারল না।

নাচ শেষ হলে দু’জনেই দ্রুত আলাদা হয়ে গেল, যেন কিছু হয়নি। বাইরে থেকে সহকর্মীরা হাসি-ঠাট্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, কারও নজরে কিছু পড়েনি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অরিত্র আর মেঘলা দু’জনেরই শ্বাস ভারী হয়ে উঠেছিল। মেঘলা ভেবেছিল, সে এতদিন তার হৃদয়কে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, কিন্তু সেই এক রাতের অদৃশ্য টান তাকে ভেঙে দিতে বসেছে। অরিত্রও নিজেকে প্রশ্ন করছিল—এটা কি কেবল এক মুহূর্তের মায়া, নাকি সত্যিই মেঘলার প্রতি এক অপ্রকাশিত অনুভূতির জন্ম হয়েছে? পার্টি চলতে থাকে, হাসি আর সংগীত ভরে তোলে হলঘর, কিন্তু তাদের দু’জনের ভেতরে চলতে থাকে এক নীরব দ্বন্দ্ব। তারা যেন জানত, এই আকর্ষণ অস্বীকার করা যতই কঠিন হবে, ততই তাকে গোপনে বয়ে বেড়াতে হবে। আর সেই গোপন টানই ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর অজানার দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে শুরু করল।

ছয়

সেদিন রাতটা যেন শুরু থেকেই অদ্ভুত ছিল। অফিসে প্রজেক্ট জমা দেওয়ার কাজ শেষ হতে হতে প্রায় রাত বারোটা বেজে গেল। অফিস ফাঁকা হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই, শুধু অরিত্র আর মেঘলা শেষ মুহূর্তের এডিট দেখে বেরোল। মেঘলার মনে পড়ল, একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল অরিত্রর বাসায় ফেলে রাখা আছে, যেটা আগামীকাল সকালে জমা না দিলে সমস্যা হতে পারে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা দু’জন একসাথে তার ফ্ল্যাটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। শহরের রাস্তাগুলো তখন প্রায় জনমানবহীন, স্ট্রিট লাইটের নিচে দীর্ঘ ছায়া তৈরি হচ্ছিল। গাড়িতে ওঠার পর দু’জনই ক্লান্ত ছিল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে স্বস্তিও পাচ্ছিল—যেন ব্যস্ত দিনের পর এই নিস্তব্ধ সময় তাদের একান্তে কথা বলার সুযোগ এনে দিয়েছে। তবে কারও মুখে বিশেষ কথা বের হচ্ছিল না। ফ্ল্যাটে পৌঁছে ফাইল বের করে নেওয়ার পর মেঘলা বলল, “চলুন, এবার ফিরি।” কিন্তু তখনই যেন ভাগ্য অন্য কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিল। কেয়ারটেকার ভুলে বাইরে থেকে প্রধান দরজায় তালা লাগিয়ে ফেলেছিল, আর তারা ভেতরে আটকা পড়ে গেল।

প্রথমে বিষয়টা হালকা রসিকতার মতো মনে হয়েছিল। মেঘলা হেসে বলেছিল, “মনে হচ্ছে আজ আমাদের গেস্টহাউস এটাই।” অরিত্রও হাসল, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল, এটা আসলেই রাতভর আটকে থাকার মতো অবস্থা। ফোন করে কেয়ারটেকারকে পাওয়া গেল না, আশপাশও এতটাই নির্জন যে কাউকে ডাকার সুযোগ নেই। তারা দু’জনেই লিভিং রুমে বসে পড়ল, একধরনের অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। অরিত্র কিছুক্ষণের জন্য রান্নাঘরে গিয়ে কফি বানিয়ে আনল, যেন পরিস্থিতি হালকা করা যায়। দু’জনেই ধোঁয়া ওঠা কাপ হাতে বসে ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে যে অদৃশ্য টান জন্ম নিয়েছিল এতদিনে, তা যেন এই নির্জন রাতের নীরবতায় আরও ঘন হয়ে উঠছিল। মেঘলা জানালার পাশে গিয়ে বাইরে তাকাল—অন্ধকার আকাশ, দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলো আর ফাঁকা রাস্তায় ভেসে আসা ঠান্ডা হাওয়া। হঠাৎ বলল, “কখনও কখনও মনে হয়, জীবনও কি এমন নয়? আমরা ভেতরে আটকে থাকি, বাইরে আলো থাকলেও সেটা আমাদের কাছে পৌঁছায় না।” অরিত্র পাশে গিয়ে দাঁড়াল, দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে। সে কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিই যেন অজানা সান্ত্বনা হয়ে উঠল।

সময় গড়াতে রাত আরও গভীর হলো। তারা দু’জনই লিভিং রুমের সোফায় বসে গল্প করতে শুরু করল—প্রথমে অফিস নিয়ে, তারপর ধীরে ধীরে একে অপরের ব্যক্তিগত জীবনের গল্পে চলে গেল। মেঘলা বলল, তার ভাঙা সম্পর্কের পর থেকে সে কখনও ভাবেনি এত রাতে কারও ফ্ল্যাটে আটকা পড়বে, আর তাতে কোনো ভয় বা অস্বস্তি কাজ করবে না। অরিত্র মৃদু হেসে জবাব দিল, “হয়তো কারণ আপনি জানেন, আমি আপনাকে কখনও অস্বস্তিতে ফেলব না।” সেই কথাটা শুনে মেঘলার চোখে ভরসার ছায়া নেমে এলো। তারা বুঝতে পারছিল, এই আটকে পড়া মুহূর্তই হয়তো তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক সেতু তৈরি করছে। বাইরের তালা তখনও লক, কিন্তু তাদের ভেতরে যে দূরত্ব এতদিন ধরে জমে ছিল, সেটা যেন আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। অরিত্র হালকা স্বরে বলল, “কখনও কখনও মনে হয়, এমন মুহূর্তই আমাদের জানায়—আমরা আসলে কার সঙ্গে নিরাপদ বোধ করি।” মেঘলা কোনো উত্তর দিল না, শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। সেই দৃষ্টি, সেই নীরবতা, আর সেই নির্জন রাত—সব মিলিয়ে তাদের ভেতরে জন্ম নিল এক গভীর, অপ্রকাশিত অনুভূতি। তারা জানত, এই রাতের আটকে পড়া শুধু কাকতাল নয়, বরং তাদের সম্পর্কের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা।

সাত

রাত তখন গভীরতর। অরিত্রর ফ্ল্যাটে দু’জনেই ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসেছিল, যেন সময় এগোচ্ছেই না। হঠাৎ করেই পুরো ঘর অন্ধকারে ডুবে গেল—বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। বাইরে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোও ফ্ল্যাটের ভেতর আসতে পারছিল না, তাই চারদিক হয়ে উঠল নিস্তব্ধ ও অচেনা। মেঘলা প্রথমে হালকা ভড়কে উঠলেও অরিত্র রান্নাঘর থেকে একটি মোমবাতি বের করে এনে টেবিলে রাখল। মোমবাতির হলদেটে আলোয় ঘরটা এক অদ্ভুত আবহ পেল—আলো আর ছায়ার মিশ্রণে তাদের মুখ দু’টো যেন আগের চেয়ে আরও কাছে চলে এলো। এই নীরব পরিবেশে বাইরের পৃথিবী যেন হারিয়ে গেল, রইল শুধু তারা দু’জন আর সেই মোমবাতির শিখা। অরিত্রর মনে হলো, হয়তো এমন মুহূর্তের জন্যই জীবনের এত আয়োজন, যেখানে সময় থেমে গিয়ে মানুষ ভেতরের সত্যগুলো খুঁজে পায়। মেঘলা ধীরে ধীরে সোফায় সোজা হয়ে বসল, তার চোখে সেই আলো পড়ে ঝিলিক দিচ্ছিল। সে ফিসফিস করে বলল, “জানো, আমার ভেতরে একটা ভয় সবসময় কাজ করে—কেউ যদি সত্যিই আমাকে বুঝতে না পারে?” অরিত্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কি তুমি কাউকে সত্যি করে তোমার কথা বলেছো কোনোদিন?” মেঘলা মাথা নেড়ে না বলল।

আলাপ সেখান থেকেই শুরু হলো। মেঘলা তার ভাঙা সম্পর্কের কথা খোলাখুলি বলতে শুরু করল—কিভাবে প্রতিশ্রুতি ভেঙে হঠাৎ সবকিছু ভেঙে পড়েছিল, কিভাবে মানুষটিকে ভালোবেসেও হারাতে হয়েছিল। সে স্বীকার করল, ভেতরে ভেতরে সে এখনও ভয় পায়—আবার কাউকে বিশ্বাস করলে যদি সেই মানুষও ছেড়ে চলে যায়? মোমবাতির আলোয় তার চোখে জল চিকচিক করছিল, কিন্তু এবার সে কান্না চাপেনি। অরিত্র তার দিকে তাকিয়ে রইল গভীর মনোযোগে, যেন মেঘলার প্রতিটি শব্দ সে নিজের ভেতরে গেঁথে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে সে নিজেও খুলে বলল নিজের কথা—একাকী জীবন, বন্ধুর অভাব, বাবা-মায়ের দূরত্ব, আর নিজের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই। সে ধীরে ধীরে মেঘলাকে বলল, “আমি সবসময় ভেবেছি, আমি কারও কাছে যথেষ্ট হব না। হয়তো সেই কারণেই কারও কাছে সত্যিটা বলিনি।” এই স্বীকারোক্তি দু’জনকেই আরও কাছে টেনে আনল। মেঘলা প্রথমবার অনুভব করল, তারা দু’জনই ভেতরে ভেতরে ভাঙা, কিন্তু সেই ভাঙনই তাদের এক করেছে।

কথোপকথনের মাঝে অরিত্রর হাত অজান্তেই মেঘলার হাত ছুঁয়ে গেল। তারা দু’জনই থমকে গেল এক মুহূর্ত, কিন্তু কেউ হাত সরাল না। বরং ধীরে ধীরে তারা হাতগুলো শক্ত করে ধরল—যেন অন্ধকারে একে অপরকে আশ্বাস দিচ্ছে। মোমবাতির আলোয় সেই দৃশ্য ছিল নিস্তব্ধ অথচ অদ্ভুত শক্তিশালী। এই প্রথম তারা অনুভব করল, সম্পর্ক কেবল আকর্ষণ বা নিঃসঙ্গতার ফাঁকফোকর নয়—এখানে জন্ম নিচ্ছে এক গভীর বিশ্বাস, এক অদৃশ্য প্রতিশ্রুতি। বাইরের তালা এখনও লক করা, কিন্তু মনে হচ্ছিল তাদের ভেতরের দরজা খুলে গেছে। দীর্ঘক্ষণ তারা কোনো কথা বলল না, শুধু হাত ধরে বসে রইল, যেন একে অপরের ভেতরে আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে। সেই রাতের অন্ধকারে, মোমবাতির কাঁপা আলোয়, তারা প্রথমবার স্বীকার করল—সব ভয়, সব অতীতের ক্ষত সত্ত্বেও তারা একে অপরকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হচ্ছে। রাত যত এগোল, ততই তারা বুঝল, খোলা দরজা আসলে বাইরের নয়, বরং তাদের হৃদয়ের ভেতরেই খুলে গেছে।

আট

রাত তখন প্রায় নিস্তব্ধতার গভীরতম স্তরে পৌঁছে গেছে। বাইরে কেবল মাঝে মাঝে হালকা হাওয়া জানালার কাঁচে আঘাত করছিল, আর ভেতরে মোমবাতির নরম আলো কাঁপছিল হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। অরিত্র ও মেঘলা তখনও সোফায় পাশাপাশি বসে ছিল, কিন্তু তাদের হাত ধরা অবস্থাটা যেন অন্যরকম হয়ে উঠেছিল—প্রথমে আশ্রয় ছিল, পরে হয়ে গেল অদ্ভুত এক আকর্ষণের সেতু। চোখে চোখ পড়লেই যেন তারা দু’জন একে অপরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল, আর সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যা এতদিন কেউ কারও কাছে প্রকাশ করেনি। মেঘলা ধীরে ধীরে অরিত্রর কাঁধে মাথা রাখল—একটা ছোট্ট মুহূর্ত, কিন্তু সেই মুহূর্তেই যেন সব সীমারেখা মুছে যেতে শুরু করল। অরিত্রর মনে হচ্ছিল, এতদিন ধরে ভেতরে জমে থাকা নিঃসঙ্গতা, ভাঙা বিশ্বাস, সমস্ত অশান্তি যেন মেঘলার এই সামান্য স্পর্শেই মিলিয়ে যাচ্ছে। মোমবাতির হলদেটে আভায় তাদের ছায়া একে অপরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল, ঠিক যেমন তাদের ভেতরের আবেগগুলো তখন মিশে যাচ্ছিল এক স্রোতে।

আলাপ যেন ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতায় পরিণত হলো। অরিত্রর চোখ মেঘলার ঠোঁটে আটকে যাচ্ছিল বারবার, কিন্তু সে কিছু বলছিল না। মেঘলাও বুঝতে পারছিল, তাদের মধ্যে যা ঘটছে তা কেবল বন্ধুত্ব বা একান্ত আশ্রয় নয়—এটা আরও গভীর, আরও তীব্র কিছু। মুহূর্তটা ছিল অদ্ভুতভাবে নীরব অথচ পূর্ণ শব্দে ভরা—শ্বাসের শব্দ, হৃদস্পন্দনের তাল, আর অদৃশ্য টান। মেঘলা প্রথমে সামান্য দ্বিধায় ছিল, কিন্তু একসময় যখন অরিত্র তার মুখের কাছে এগিয়ে এল, তখন সে আর পিছিয়ে গেল না। দু’জনের ঠোঁট যখন মিলল, তখন মনে হলো সমস্ত ভাঙা বিশ্বাস আর ভয়ের দেয়াল ভেঙে পড়ল একসাথে। সেই চুম্বন ছিল না শুধু শারীরিক—এটা ছিল এক গভীর স্বীকারোক্তি, একে অপরের প্রতি নিঃশব্দে বলা একটি প্রতিশ্রুতি। ধীরে ধীরে তারা কাছাকাছি আসতে লাগল, একে অপরের স্পর্শে খুঁজে পেল নিরাপত্তা, উষ্ণতা আর সেই তীব্র অনুভূতি যা এতদিন অস্বীকার করার চেষ্টা করছিল।

রাত যত গভীর হচ্ছিল, তাদের সম্পর্ক ততই নতুন এক রূপ নিচ্ছিল। তারা বুঝতে পারছিল, এটা কোনো আকস্মিক দুর্বলতা নয়—এটা এমন কিছু যা অনেকদিন ধরে ভেতরে ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল, শুধু আজ রাতেই তার পূর্ণতা পেল। একে অপরের কাছে তারা উন্মুক্ত হয়ে গেল, শারীরিক ঘনিষ্ঠতার ভেতর দিয়ে তারা খুঁজে পেল সেই ভালোবাসা যা কথায় প্রকাশ করা যায় না। বাইরের তালা তখনও লক করা ছিল, কিন্তু তাদের ভেতরের সব বাধা ভেঙে গেছে। অরিত্রর কাছে মেঘলার প্রতিটি নিশ্বাস হয়ে উঠল সান্ত্বনা, আর মেঘলার কাছে অরিত্রর প্রতিটি স্পর্শ হয়ে উঠল আশ্রয়। রাতের সেই দীর্ঘ মুহূর্তগুলোতে তারা প্রথমবার সত্যি করে অনুভব করল—তাদের সম্পর্ক কেবল সহকর্মীর সীমায় আটকে নেই, কেবল বন্ধুত্ব বা আকর্ষণ নয়, বরং এমন এক বন্ধন যা ভবিষ্যতকে নতুনভাবে গড়ে দিতে পারে। আর ভোরের আলো যখন আসবে, তারা দু’জন জানবে—একটি রাতই তাদের জীবনকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে।

নয়

ভোরের প্রথম আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, কিন্তু ঘরের ভেতরটা তখনও নিস্তব্ধ। মোমবাতি অনেক আগেই নিভে গেছে, আর রাতের দীর্ঘ আবেগঘন সময় যেন মিলিয়ে গিয়ে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছে। অরিত্রর চোখ খুলতেই প্রথমে সে বুঝতে পারল না সে কোথায় আছে, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই গত রাতের প্রতিটি দৃশ্য ফিরে এলো। মেঘলা তখনও পাশেই বসে ছিল, তার মুখে গভীর ক্লান্তি, কিন্তু সেইসাথে এমন এক শান্তি, যা অরিত্র আগে কখনও দেখেনি। মুহূর্তের জন্য মনে হলো এই রাত যেন কোনো স্বপ্ন ছিল, যা তারা দু’জন মিলে বুনেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বাইরে তালার শব্দ শোনা গেল—কেয়ারটেকার দরজা খুলে দিচ্ছে। তালা খোলার শব্দ যেন হঠাৎই তাদের কল্পনার জগৎ থেকে ছুঁড়ে ফেলল বাস্তবতার কঠিন মাটিতে। মেঘলা তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল, চোখে স্পষ্ট ছিল অস্বস্তি, আর অরিত্রর ভেতরেও তখন দ্বিধা আর প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। রাতের সমস্ত ঘনিষ্ঠতা, সেই স্পর্শ, সেই আস্থা—সবকিছু যেন সকালবেলার আলোয় অন্যরকম রূপ নিতে শুরু করল।

অফিসে যাওয়ার পথে দু’জনের ভেতরেই এক অদ্ভুত চুপচাপ ভাব কাজ করছিল। বাইরে থেকে তারা একেবারে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিল, যেন কিছুই ঘটেনি। মেঘলা ব্যস্ত ভান করে ফোনে স্ক্রল করছিল, অরিত্র গাড়ি চালাচ্ছিল নীরবভাবে। দু’জনের কারও মুখে কোনো বাড়তি কথা নেই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে উথালপাথাল হচ্ছিল আবেগ। অফিসে পৌঁছানোর পর আরও জটিল হয়ে উঠল পরিস্থিতি। সহকর্মীরা হাসি-ঠাট্টা করছিল, গত রাতের কাজের কথা বলছিল, কিন্তু অরিত্র আর মেঘলা চেষ্টা করছিল এমনভাবে আচরণ করতে যেন তাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। অথচ চোখে চোখ পড়লেই যেন পুরো শরীর শিহরে উঠছিল—হঠাৎ করেই মনে পড়ে যাচ্ছিল রাতের মোমবাতির আলো, হাত ধরা, চুম্বন, আর সীমা পেরোনো সেই মুহূর্তগুলো। এই স্মৃতিগুলো তারা যতই চাপা দিতে চাইছিল, ততই যেন ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে উঠছিল। মাঝে মাঝে কথাবার্তার ফাঁকে চোখাচোখি হতেই দু’জনেই দ্রুত অন্যদিকে তাকিয়ে যাচ্ছিল, যেন কেউ টের না পায়। কিন্তু ভেতরের অস্বস্তি যে সহজে সামাল দেওয়া যায় না, সেটা তখনই তারা দু’জন বুঝতে পারছিল।

দিন গড়াতেই সেই অস্বস্তি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। মেঘলা কাজের টেবিলে বসে বারবার মনোযোগ হারাচ্ছিল, কাগজে চোখ রাখলেও মনে বারবার ফিরে যাচ্ছিল রাতের প্রতিটি দৃশ্য। অরিত্রও মিটিংয়ে কথা বলার সময় মাঝে মাঝে থমকে যাচ্ছিল, যেন কিছু মনে পড়ে গিয়েছে। ভেতরে তারা দু’জনেই বুঝছিল, আগের মতো আর সবকিছু রাখা সম্ভব নয়, কিন্তু কীভাবে সামলাবে সেটাই ছিল বড় প্রশ্ন। বাইরের পৃথিবী, অফিসের আনুষ্ঠানিকতা, সহকর্মীদের দৃষ্টি—সবকিছু মিলিয়ে তারা দু’জন যেন হঠাৎ এক অদ্ভুত দ্বিধার মধ্যে আটকে পড়েছিল। রাতের আবেগ কি সত্যিই তাদের জীবনের অংশ হবে, নাকি সেটা শুধু একটি ভুল যা গোপন রাখা দরকার? এই দ্বন্দ্বে তারা নীরব থাকতে থাকতেই অফিসের দিন শেষ হয়ে এল। কিন্তু গভীরে, প্রত্যেকটা চোখাচোখির মুহূর্তে তারা জানত—গত রাতকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়, আর সেই অস্বস্তিই এখন তাদের নতুন বাস্তবতা।

দশ

অফিসের ব্যস্ত দিনগুলো আবারও একই ছন্দে চলতে শুরু করেছিল, কিন্তু অরিত্র আর মেঘলার ভেতরের ছন্দ আর আগের মতো ছিল না। রাতের সেই ঘটনার পর থেকে প্রতিদিন তাদের ভেতরে চলছিল এক অদৃশ্য টানাপোড়েন—একদিকে ভয়, অন্যদিকে একে অপরের প্রতি গভীর আকর্ষণ। মেঘলা বারবার ভাবছিল, যদি সহকর্মীরা কিছু আঁচ করে ফেলে তবে কী হবে? যদি এই সম্পর্ক প্রকাশ পায় তবে অফিসে তাদের অবস্থান, ক্যারিয়ার, এমনকি ব্যক্তিগত মর্যাদাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়? অন্যদিকে অরিত্রও বুঝতে পারছিল, এভাবে চুপচাপ থাকা সম্ভব নয়; মেঘলার প্রতি তার অনুভূতি আর শুধু গোপন আকর্ষণ নয়, বরং জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া এক বন্ধন। তারা দু’জনেই স্বাভাবিক থাকার ভান করছিল, কিন্তু যখনই একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে পারত, তখনই সেই মুখোশ খুলে যেত। এক বিকেলে অফিসের ক্যান্টিনে বসে হঠাৎ অরিত্র ধীর গলায় বলল—“এভাবে আর কতদিন লুকোতে পারব বলো তো?” মেঘলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিল, “জানি না, কিন্তু লুকিয়ে থাকলে আমরা নিজেরাই ভেঙে যাব।” তাদের কথোপকথন হয়তো বাইরে থেকে সাধারণ মনে হচ্ছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সেটাই ছিল এক বিশাল সিদ্ধান্তের সূচনা।

ধীরে ধীরে তারা দু’জনই উপলব্ধি করতে লাগল, সম্পর্কটা শুধু লুকিয়ে রাখার মতো কিছু নয়। প্রতিদিনের অফিস, কাজের চাপ, সহকর্মীদের সঙ্গে ব্যস্ততা—সবকিছুর মাঝেও তাদের ভেতরের আবেগ আরও গভীর হয়ে উঠছিল। মেঘলা ভেবেছিল, হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অনুভূতি ম্লান হয়ে যাবে, কিন্তু আসলে উল্টোটাই হচ্ছিল। অরিত্রর সঙ্গে তার কথা না হলে দিনটা অসম্পূর্ণ মনে হতো, আর অরিত্রও প্রতিটি মূহূর্তে মেঘলার উপস্থিতি চাইতে শুরু করেছিল। তবে ভয়ও ছিল প্রবল। তাদের সম্পর্ক যদি প্রকাশ্যে আসে তবে কী হবে? অফিসে মানুষ কি তাদের নিয়ে ফিসফাস শুরু করবে? কাজের জায়গায় পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠবে না তো? এ প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল দু’জনের ভেতরেই। কিন্তু যতই তারা ভেবেছিল লুকিয়ে রাখা নিরাপদ, ততই বুঝতে পেরেছিল সেই গোপনীয়তা আসলে তাদের ভেতরেই ফাটল ধরাচ্ছে। একদিন বাসায় ফেরার পথে গাড়ির ভেতরে মেঘলা হঠাৎ বলল, “ভয় হচ্ছে, অরিত্র… কিন্তু ভয় পেয়েও আমি চাই না এই সম্পর্কটাকে অস্বীকার করতে।” অরিত্র তার হাত ধরে শান্তভাবে বলল, “ভয়টা থাকবে, কিন্তু আমরা যদি একসাথে থাকি, তাহলে হয়তো সবকিছুই সামলাতে পারব।” সেই কথাগুলো শুনে মেঘলার চোখ ভিজে উঠেছিল, আর তার ভেতরে যেন নতুন এক সাহস জন্ম নিল।

অবশেষে এক সন্ধ্যায়, কাজ শেষ হওয়ার পর তারা দু’জন সিদ্ধান্তে পৌঁছাল। অফিসের রুটিন জীবন আর বাইরের দুনিয়ার রীতিনীতি ভেবে তারা সম্পর্ককে অস্বীকার করবে না। হ্যাঁ, ঝুঁকি আছে, কথা উঠবে, সন্দেহের দৃষ্টি আসবে—কিন্তু গোপন রাখলে সম্পর্কটাই ভেঙে পড়বে। তারা ঠিক করল, ভয়কে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোবে। হয়তো একদিন সহকর্মীরা টের পাবে, হয়তো কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলবে, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। তাদের কাছে এখন সবচেয়ে জরুরি হলো নিজেদের প্রতি সত্য থাকা। সেদিন অরিত্র মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলল, “গত রাত আমাদের জীবন পাল্টে দিয়েছে। আমরা যদি এই সম্পর্কটা অস্বীকার করি, তবে নিজেদের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকব।” মেঘলা ধীরে মাথা নেড়ে উত্তর দিল, “তাহলে চল, ভয়টাকে ছাপিয়ে যাই।” সেই মুহূর্তেই যেন তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো—একটা অধ্যায়, যেখানে লুকোনো নেই, আছে স্বচ্ছ স্বীকারোক্তি। “অফিসের পরে” তারা শুধু দু’জনের গোপন কাহিনি নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এক সম্পর্কের নাম হয়ে দাঁড়াল। তারা জানত সামনে ঝড় আসবে, কিন্তু সেই ঝড়ের ভেতর দিয়েই তারা গড়ে তুলবে নিজেদের নতুন দুনিয়া—যেখানে ভোরের আলো আর অস্বস্তি নয়, বরং থাকবে একসাথে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

সমাপ্ত

1000058690.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *