Bangla - হাস্যকৌতুক

অফিসের চা-ওয়ালা ও আধুনিক অ্যাপ

Spread the love

প্ৰদ্যুম্ন মুখার্জী


পিন্টু, কলকাতার এক অফিসের পুরোনো চা-ওয়ালা, প্রতিদিন সকাল ন’টার আগে হাজির হয় অফিসের গেটে। হাতে তার স্টিলের ট্রে, তাতে ফ্লাস্কভরা গরম দুধ-চা, কাঁচের গ্লাস, আর সাথে একপাশে রাখা ছোট্ট কৌটোতে বিস্কুট। অফিসের ভেতর ঢুকেই সে সবার নাম ধরে ডাকতে শুরু করে—“মনীশদা, চা খাবেন তো?”, “তৃণাদি, এক গ্লাস দুধ-চা দেবো?”—যেন প্রত্যেকটা কর্মচারীর স্বাদ আর মুড সে মুখস্থ করে রেখেছে। পিন্টুর হাসিমাখা মুখ আর সহজ কথা বলার ভঙ্গিতে অফিসের সবার সঙ্গে তার এক আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কেউ নতুন জয়েন করলে প্রথমেই তাদের হাতে গরম গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলে দিত—“চা না খেলে অফিসের কাজ একটুও চলবে না।” এইভাবে বছর কেটে গেছে, আর পিন্টুর দিন শুরু হয় আর শেষ হয় শুধু চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে অফিসে ঘুরে বেড়ানো আর সবার সঙ্গে মিষ্টি সম্পর্ক বজায় রাখার মধ্যে। কিন্তু এই একঘেয়ে রুটিনের মধ্যেই মাঝে মাঝে পিন্টুর মনে হতো—সে কি শুধুই চা-ওয়ালা হয়ে থাকবে? জীবনে আর কিছু নতুন করা সম্ভব নয়?

একদিন দুপুরে, অফিসে লাঞ্চ ব্রেকের পর কর্মীরা গল্প করছিল। অরূপ, যে অফিসের সবচেয়ে হাসিখুশি ছেলে, হঠাৎ ঠাট্টা করে বলে উঠল—“আরে পিন্টুদা, তুমি তো প্রতিদিন এত দৌড়াও, এবার একটা অ্যাপ বানিয়ে ফেলো না? সবাই মোবাইল থেকে অর্ডার দেবে, তুমি শুধু নোটিফিকেশন পাবে। তখন তো তোমারও আধুনিক যুগে নাম হবে—চা-ওয়ালা থেকে হয়ে যাবে Tea-স্টার্টআপ ফাউন্ডার।” কথাটা শুনে অফিস জুড়ে হো হো করে হাসি পড়ে গেল। দেবদীপ, সিরিয়াস কর্মী হলেও হেসে ফেলল। মণীশ বসু একটু বিরক্ত মুখে বললেন—“আবার এসব বাজে আইডিয়া দিও না, পিন্টু তো জানে না মোবাইলেই অ্যাপ ডাউনলোড করতে হয় কীভাবে।” কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বাকিদের কাছে হয়তো এটা ছিল নিছক মজা, কিন্তু পিন্টুর মাথায় সেটা গভীরভাবে গেঁথে গেল। সেই দিন অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সে সারাক্ষণ ভাবতে লাগল—“আমি কেন পারবো না? এত মানুষ অ্যাপ বানায়, আমি যদি একটাও না পারি, তবে আমার এই চা-ওয়ালার জীবনই বৃথা।” রিকশার ঝাঁকুনির মাঝেও তার চোখে যেন নতুন এক জেদ জ্বলে উঠল।

রাতের খাবারের পর পিন্টু নিজের মেয়েকে ডাকল, যে কলেজে পড়ে। সে মোবাইল আর কম্পিউটার নিয়ে বেশ চটপটে। পিন্টু ধীর গলায় বলল—“বাবলি, শোন তো, আমি যদি একটা অ্যাপ বানাই, যেখানে সবাই মোবাইল থেকে চা অর্ডার করবে, সেটা কি সম্ভব?” মেয়ে অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকাল—“তুমি অ্যাপ বানাবে? তুমি তো গুগলপ্লে খুলতেও জানো না।” পিন্টু একটু লজ্জা পেয়ে বলল—“জানি না ঠিকই, কিন্তু শিখতে তো পারি। আমাকে শিখিয়ে দাও না।” বাবলির মনে হলো—বাবা সত্যিই সিরিয়াস। সে মজা করে বলল—“ঠিক আছে, তুমি অ্যাপ বানাও, আমি তোমাকে বেটা টেস্টার হবো।” সেই রাতেই বাবলি তাকে দেখাল ইউটিউবের টিউটোরিয়াল, দেখাল কীভাবে মোবাইল অ্যাপ তৈরি হয়, আর কোথায় কনফিগার করতে হয়। যদিও কিছুই পুরোপুরি বুঝতে পারল না পিন্টু, কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝল—এটা অসম্ভব কিছু নয়। সেই মুহূর্তে তার বুকের ভেতর কেমন এক রোমাঞ্চ জেগে উঠল। চা-ওয়ালার জীবনেও যে স্বপ্নের জগৎ থাকতে পারে, সেটা সে আগে জানত না। আর ঠিক তখনই পিন্টু সিদ্ধান্ত নিল—সে নিজের অ্যাপ বানাবেই, নাম রাখবে TeaQuick 2.5। পরের দিন সকালে যখন সে আবার অফিসে ট্রে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তখন তার চোখেমুখে অন্য রকম উজ্জ্বলতা দেখা গেল। কর্মীরা সেটা টের পেলেও কিছু বুঝতে পারল না, কিন্তু পিন্টু জানল—তার জীবনের নতুন গল্প সেদিনই শুরু হয়ে গেছে।

পরের দিন সকাল থেকেই পিন্টুর ভেতর অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছিল। সাধারণত সে অফিসে ঢুকেই একে একে চা বিলোতে থাকে, কিন্তু এদিন তার চোখ যেন বারবার খুঁজছিল এক নির্দিষ্ট মানুষকে—তৃণা। তৃণা অফিসের আইটি সাপোর্ট স্টাফ, বয়স কম, চশমা পরা, সবসময় ল্যাপটপ বা কম্পিউটার স্ক্রিনে ডুবে থাকা তার অভ্যাস। পিন্টুর কাছে তৃণা ছিল যেন কোনো জাদুকরী মানুষ, যে কম্পিউটারের ভেতর দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলে। দুপুরবেলা যখন তৃণা ক্যাফেটেরিয়ার কোণে বসে কফি খাচ্ছিল, পিন্টু সাহস করে এগিয়ে গেল। মাথায় টুকটাক শব্দ সাজিয়ে রেখেছিল, কিন্তু সামনে দাঁড়াতেই যেন সব মিলিয়ে গেল। একরকম হকচকিয়ে সে বলল—“তৃণাদি, একটু কথা ছিল।” তৃণা অবাক হয়ে তাকাল, চা-ওয়ালা পিন্টু কখনও এরকমভাবে তাকে আলাদা করে ডাকে নি। পিন্টু অস্বস্তি ভরা কণ্ঠে বলল—“আপনি তো এসব কম্পিউটারের কাজ জানেন, আমি ভাবছি একটা অ্যাপ বানাবো।” তৃণা প্রথমে ভেবেছিল হয়তো সে ভুল শুনেছে। তাই হেসে বলল—“অ্যাপ? মানে মোবাইল অ্যাপ? তুমি?” চারপাশে যারা বসেছিল তারাও হাসাহাসি শুরু করল। কিন্তু পিন্টু এবার দৃঢ় গলায় বলল—“হ্যাঁ, আমি। TeaQuick 2.5 নাম দেবো। সবাই মোবাইল থেকে অর্ডার দেবে, আমি শুধু ট্রে হাতে পৌঁছে দেবো।” তার চোখে এমন এক অদ্ভুত বিশ্বাস ছিল যে তৃণা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। পরে হাসিমুখে বলল—“ঠিক আছে, চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? তবে এটা সহজ কাজ নয়, বুঝেছো?”

সেই দিন থেকেই শুরু হলো এক অদ্ভুত শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তৃণা পিন্টুকে মৌলিক বিষয়গুলো শেখাতে শুরু করল। প্রথম দিনেই বোঝাল—অ্যাপ বানাতে হলে আগে একটা সিম্পল ডিজাইন দরকার। “অ্যাপটা দেখতে কেমন হবে? কোথায় অর্ডার বোতাম থাকবে? কীভাবে মেনু সাজানো হবে? এগুলো ঠিক করতে হবে,” বলল সে। পিন্টু তখন কাগজ-কলমে আঁকতে শুরু করল—গ্লাসের ছবি, ফ্লাস্কের ছবি, পাশে লিখে দিল “চা ১০ টাকা”, “কফি ১৫ টাকা”। তার আঁকিবুকি দেখে তৃণা হেসে বলল—“এগুলো কিন্তু আসল ডিজাইন নয়, তবে আইডিয়া দিতে কাজে লাগবে।” পরের কয়েকদিন সে দেখাল কিভাবে ফ্রি অনলাইন অ্যাপ-বিল্ডার দিয়ে বেসিক অ্যাপ তৈরি করা যায়। পিন্টু চোখ বড় বড় করে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করল, যদিও টার্মগুলো যেমন—ইন্টারফেস, ডেটাবেস, ইউজার অথেনটিকেশন—সব তার মাথার ওপর দিয়ে গেল। তবুও সে হাল ছাড়ল না। প্রতিদিন কাজ শেষে বাড়ি গিয়ে বাবলির সঙ্গে বসে নোটস লিখে রাখত, যাতে কিছু ভুলে না যায়। মাঝে মাঝে মজা করে বলত—“চায়ের ফ্লাস্কে তো চা রাখি, এবার অ্যাপে রাখব প্রযুক্তির ফ্লাস্ক।” তৃণা এই আন্তরিকতা দেখে অবাক হতো। আগে সে ভাবত পিন্টু হয়তো কৌতুক করার জন্য এসব বলছে, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝল, এ মানুষটা সত্যিই নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখছে।

দু’সপ্তাহের মধ্যেই একটা প্রাথমিক রূপ পেল TeaQuick 2.5। অ্যাপ খুললেই সামনে আসত পিন্টুর আঁকা লোগো—একটা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, নিচে ছোট করে লেখা TeaQuick 2.5 – আপনার হাতের মুঠোয় চা। তৃণা যদিও বারবার বলেছিল ট্যাগলাইনটা পেশাদার নয়, তবুও পিন্টুর জেদে সেটা রয়ে গেল। মেনুতে দুটো অপশন—“চা” আর “কফি”—সিলেক্ট করলেই নোটিফিকেশন যেত পিন্টুর ফোনে। প্রথম দিন ট্রায়াল রান হলো অফিসের কয়েকজন কর্মীর মধ্যে। অরূপ ইচ্ছে করে কফি অর্ডার করল, আর মিনিট পাঁচেক পর পিন্টু হাজির হলো গরম চা নিয়ে। সবাই হেসে খুন, তৃণা লজ্জায় মাথা চুলকোল। কিন্তু পিন্টুর মুখে কোনো অস্বস্তি ছিল না, বরং গর্ব—“দেখো, অ্যাপের অর্ডার এসেছে আর আমি সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে গেছি।” তৃণা তখন বুঝল, প্রযুক্তিগতভাবে হয়তো এখনও অনেক ত্রুটি আছে, কিন্তু এই চা-ওয়ালার ভেতরে যে আত্মবিশ্বাস, তা কোনো বই থেকে শেখানো যায় না। সে নিজেই মজা করে বলল—“ঠিক আছে, এই অ্যাপের নাম তাহলে সত্যিই TeaQuick 2.5। নাম শুনলেই বোঝা যায়, এখানে সবকিছু একটু ভুলভাল কিন্তু মজার।” সেই মুহূর্ত থেকে তৃণাও পুরোপুরি জড়িয়ে গেল এই প্রজেক্টে। কারণ, পিন্টুর সেই নিষ্পাপ বিশ্বাস তাকে মনে করিয়ে দিল—স্বপ্ন দেখার কোনো বয়স বা পেশা নেই।

অফিসের দুপুরবেলা, ফাইলের বোঝা আর মিটিংয়ের চাপের মাঝখানে সবাই একটুখানি আরাম খুঁজছিল। টেবিলের কোণে ফোন চার্জে দেওয়া, কেউ হেডফোন কানে গুঁজে গান শুনছে, কেউবা ক্যান্টিন থেকে কিনে আনা সামোসা খাচ্ছে। এই সময়ে অফিসের সবচেয়ে দুষ্টু স্বভাবের কর্মী অরূপ হঠাৎ দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল—“আজ আমি পিন্টুদার অ্যাপ টেস্ট করব!” সবাই একসঙ্গে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। কদিন ধরেই TeaQuick 2.5 নিয়ে নানা কানাঘুষো চলছে, কিন্তু এখনো কেউ আসলে খুব একটা সিরিয়াস হয়ে চেষ্টা করেনি। অরূপ একেবারে মজা করার মুডে মোবাইলটা হাতে তুলে নিল। সে অ্যাপ খুলে চোখ কুঁচকে পড়ল মেনু—সামনে বড় করে লেখা চা আর কফি। ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে সে বলল—“দেখি, এই অ্যাপ কতটা আধুনিক!” তারপর সবার সামনে ইচ্ছে করে কফি বাটনে ট্যাপ করল। সঙ্গে সঙ্গে তার স্ক্রিনে ভেসে উঠল—আপনার অর্ডার গ্রহণ করা হলো। TeaQuick 2.5 ধন্যবাদ জানাচ্ছে। অফিসের ভেতর ছোটখাটো কৌতূহল ছড়িয়ে পড়ল। সবাই কানে কানে বলাবলি করতে লাগল—“আসলে কী হবে?”, “দেখি তো সত্যিই কফি আসে কিনা।” দেবদীপ গম্ভীর মুখে বলল—“এই প্রথম টেস্ট, আমি বাজি ধরছি কিছু গোলমাল হবেই।” আর মণীশ বসু দূর থেকে চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন, মুখে হালকা অবিশ্বাসের ছাপ।

পাঁচ মিনিটও কাটেনি, হঠাৎ করিডোরে পিন্টুর ভেসে আসা হাঁক শোনা গেল—“কফি এসে গেছে, কফি!” সবার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। অরূপ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় দেখা দিল পিন্টু, হাতে চকচকে স্টিলের ট্রে, তাতে ছোট ছোট কাঁচের গ্লাসে গরম ধোঁয়া ওঠা তরল। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে উঁকি মারল। কিন্তু ট্রে হাতে এগিয়ে এসে পিন্টু গম্ভীর গলায় ঘোষণা করল—“এই নাও তোমার কফি অর্ডার।” অরূপ প্রথম গ্লাসটা হাতে নিয়েই চমকে উঠল—এটা তো কফি নয়, একেবারে খাঁটি দুধ-চা! উপরে ঘন দুধের ফেনা জমে আছে, গন্ধে ভেসে আসছে আদা আর এলাচের ঝাঁজ। সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। অরূপ নাটকীয় ভঙ্গিতে গ্লাস উঁচিয়ে বলল—“বাহ! আধুনিক অ্যাপের কফি মানেই আসলে পিন্টুদার চা।” হাসির রোল উঠল পুরো অফিসে। তৃণা মুখে হাত দিয়ে বসে পড়ল, কারণ সে জানত, কোডিংয়ের কোথাও নিশ্চয়ই গণ্ডগোল হয়ে গেছে। কিন্তু পিন্টুর মুখে কোনো অস্বস্তি ছিল না। বরং গর্বের সঙ্গে বলল—“অর্ডার দিয়েছ, আমি পৌঁছে দিয়েছি, এটাই তো আসল কথা!”

পরের কয়েক মিনিট অফিসের পরিবেশ একেবারে হেসে খুন হয়ে গেল। দেবদীপ, যে সাধারণত সবসময় সিরিয়াস থাকে, সেও এবার হেসে ফেলল। কেউ বলল—“অ্যাপটা আসলে মানুষকে কফির বদলে চায়ের ভক্ত বানানোর জন্য তৈরি।” আরেকজন বলল—“TeaQuick 2.5 নামটা বদলে দিয়ে Tea-Only করলে ভালো হবে।” মণীশ বসু যদিও প্রথমে একটু বিরক্ত মুখ করলেন, কিন্তু পরে তাকেও হালকা হাসতে দেখা গেল। তৃণা আবার গম্ভীরভাবে বলল—“দেখো, ভুল হতেই পারে, এটা তো ট্রায়াল ভার্সন। আমি কোড ঠিক করে দেবো।” কিন্তু সবাই মজা করে তাকে টোকা মারতে লাগল—“না না, ঠিক কোরো না, এই মজাটাই থাকুক।” পিন্টু সেদিন বুঝল, হয়তো অ্যাপ এখনও নিখুঁত হয়নি, তবুও এটা অফিসের মানুষের কাছে এক নতুন বিনোদনের উৎস হয়ে উঠছে। তার চোখে-মুখে ফুটে উঠল অন্যরকম তৃপ্তি। সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় তার মনে হচ্ছিল—“প্রথম অর্ডার সফল। কফি না এলেও হাসি এসেছে, আর হাসি এনে দেওয়াই তো আসল জয়।”

অফিসের একদম ভদ্র, শান্ত স্বভাবের মানুষ মণীশ বসু। সবাই জানে, উনি হিসেবপত্রে অতি খুঁতখুঁতে—এক টাকার হেরফের হলেও চোখ এড়িয়ে যায় না। সেদিন লাঞ্চের পর একটু জমিয়ে চা খাওয়ার জন্য তিনি অ্যাপ খুললেন। “TeaQuick 2.5″ এখন অফিসে একেবারে জনপ্রিয়; কৌতুক আর খুনসুটির মধ্যেও সবাই প্রতিদিন অন্তত একবার ব্যবহার করে। মণীশ বাবুর অভ্যাস—অর্ডার দেওয়ার আগে প্রতিটি অপশন ভালো করে দেখে নেওয়া। তিনি দেখলেন, অপশনগুলো—”চা”, “দুধ চা”, “কফি”। তিনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে টিক দিলেন “চা” তে, তারপর কনফার্ম বাটনে চাপ দিলেন। কয়েক মিনিট পরই পিন্টু ট্রে হাতে হাজির। গরম ধোঁয়া ওঠা চা, সঙ্গে স্যালুট দেওয়া হাসি—“স্যার, আপনার অর্ডার।” মণীশ বাবু খুশি হলেন, গম্ভীর মুখে চায়ের প্রথম চুমুক খেলেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে চায়ের স্বাদ মিলিয়ে গেল তার মুখের রঙে। কারণ, ট্রের পাশেই রাখা রসিদে চোখ পড়তেই তার চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গেল। সেখানে স্পষ্ট লেখা—“চা : ১০ টাকা, অটোভাড়া : ৪০ টাকা, মোট : ৫০ টাকা।”

“এই কী ব্যাপার পিন্টু?” মণীশ বাবুর গলা কাঁপা-কাঁপা, আশেপাশে যারা বসে তারা ইতিমধ্যেই গুঞ্জন শুরু করেছে। অনেকে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, কেউ মোবাইল হাতে ভিডিও তুলতে চাইছে। পিন্টু কিন্তু ভ্রূক্ষেপও করল না। একেবারে সিরিয়াস মুখে বলল, “স্যার, এটা সিস্টেমের আপডেট। TeaQuick 2.5 এখন ডাইনামিক বিলিং ব্যবহার করে। আপনি যখন চা অর্ডার দিলেন, তখন ধরে নেওয়া হয়েছে চা নিয়ে আসার জন্য আমার ট্রান্সপোর্ট খরচও অ্যাড হবে। তাই চায়ের সঙ্গে অটোভাড়া যোগ হয়েছে।” কথাটা শুনে হাসির রোল পড়ে গেল অফিসজুড়ে। অরূপ, যে গতবার কফি অর্ডার করে চা পেয়েছিল, সে তো টেবিল চাপড়ে হাসছে। তৃণা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবছে—“আমি তো ওকে শুধু বেসিক অ্যাপ শেখালাম, এ আবার কী নতুন কাণ্ড করল!” মণীশ বাবু লজ্জা আর রাগের মাঝখানে দুলতে থাকলেন। তিনি বললেন, “চায়ের জন্য অটোভাড়া? এ তো ভীষণ অন্যায়।” পিন্টু একটুও বিচলিত না হয়ে উত্তর দিল, “স্যার, এটাই ফিউচার। ক্যাব ভাড়া যেমন সার্জ প্রাইস হয়, TeaQuick-এও এখন সার্জ আপডেট চালু হয়েছে।”

এই ঘটনার পর থেকে অফিসের চায়ের সময় যেন উৎসব হয়ে গেল। সবাই নতুন করে অ্যাপ খোলার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে চাইছে—আজ আবার বিলের মধ্যে কী কী অদ্ভুত চার্জ ঢুকে যাবে! কেউ দেখে—“চা ১০ টাকা, সঙ্গে ওয়াই-ফাই চার্জ ৫ টাকা।” কেউ দেখে—“চা ১০ টাকা, কিন্তু বিলের সঙ্গে ‘আবেগ ফি’ ২০ টাকা যোগ হয়েছে।” কর্মীরা একদিকে বিরক্ত হলেও অন্যদিকে মজা পাচ্ছে। কারণ প্রতিটি অর্ডার যেন এক নতুন রসিকতার খোরাক। মণীশ বাবু অবশ্য পরে সেদিন পুরো অফিসে ঘোষণা করেন—“আমি আর TeaQuick 2.5 ব্যবহার করব না। খোলা খাতায় অর্ডার লিখে দেব।” কিন্তু এর মধ্যেই TeaQuick অফিসের হাস্যরসের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। পিন্টুর সেই সোজাসাপ্টা, গম্ভীর ব্যাখ্যা, আর বিলের কারসাজি—সব মিলিয়ে পুরো অফিসে এমন এক মজা জমে উঠেছে, যা প্রতিদিনের একঘেয়ে কাজের ভিড়ে সবার কাছে একপ্রকার বিনোদন হয়ে উঠেছে।

সকালে অফিস শুরু হতেই TeaQuick 2.5–এর নোটিফিকেশন সবার মোবাইলে ঝমঝমিয়ে উঠল—“আজকের নতুন মেনু চেক করুন!” অফিসের কর্মীরা যেহেতু প্রতিদিনই পিন্টুর নতুন নতুন কারসাজি দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে, তাই সবাই আগ্রহ ভরে অ্যাপ খুলল। আর খুলতেই হেসে খুন। সেখানে দেখা যাচ্ছে—“চা + চপ = কফি।” কেউই বুঝতে পারল না, এটা আবার কীরকম সমীকরণ! মেনুতে আবার আলাদা করে লেখা আছে—“গ্রিন টি = লেবু-চা + খুচরো টাকা ফেরত নয়।” মানে গ্রিন টি চাইলে লেবু-চা পাবেন, আর বাকি টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না। আরও কিছু অদ্ভুত এন্ট্রি ছিল—“দুধ চা = দুধ + গরম জল – চা পাতি,” কিংবা “কালো চা = ব্ল্যাক কফির কাজ চালানো।” অফিসের পরিবেশ এক মুহূর্তেই কৌতুকময় হয়ে উঠল। লাঞ্চ টাইমের আগে থেকেই সবাই অ্যাপ ঘেঁটে মেনুর স্ক্রিনশট একে অপরকে পাঠাতে লাগল, কেউ আবার ফেসবুকে পোস্ট করে লিখল—“আজকের সেরা মেনু কারসাজি।”

প্রথমে সবাই ভাবল, হয়তো এটা পিন্টুর ভুল, বা কোডিংয়ের গণ্ডগোল। কিন্তু যখন পিন্টুকে ডেকে প্রশ্ন করা হল, তখন সে সোজা মুখে বলল, “স্যার, মেনু সবসময় একই থাকলে কাস্টমাররা বোর হয়ে যায়। তাই আমি ভ্যারিয়েবল মেনু চালু করেছি। আজ থেকে TeaQuick 2.5–এ প্রতিদিন থাকবে সারপ্রাইজ কম্বিনেশন।” অফিস একেবারে হাততালি দিয়ে উঠল। অরূপ তখনই মজা করে বলল, “তাহলে কালকে হয়তো দেখব—‘চা + বোঝাপড়া = বেতন বৃদ্ধি!’” কর্মীরা একদিকে বিরক্ত হলেও মজাটা গোপন রাখতে পারল না। কেউ কেউ ইচ্ছে করেই অর্ডার দিল—দেখা যাক, ‘চা + চপ = কফি’ অর্ডার করলে আসলে কী আসে! ফলাফল, টেবিলে হাজির হল গরম ধোঁয়া ওঠা চা, সঙ্গে দুইটা কাঁচা সিঙ্গাড়া, আর পিন্টুর গম্ভীর ঘোষণা—“স্যার, কফি আপাতত স্টকে নেই। তবে এটা কফির চেয়েও ভালো।” আরেকজন গ্রিন টি অর্ডার দিল। তার হাতে ট্রে দিয়ে পিন্টু বলল—“এই নিন লেবু-চা। খুচরো ফেরত চাইলে নতুন আপডেট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”

এই ভুলভাল মেনু অফিসকে আরও জমজমাট করে তুলল। কেউ মজা করে বলছে—“TeaQuick তো এখন আসলেই ক্যাফে হয়ে গেছে।” কেউ আবার মন্তব্য করল—“এভাবে চললে অফিসের ক্যান্টিনই বন্ধ হয়ে যাবে।” সবচেয়ে বেশি মজা পাচ্ছে আইটি বিভাগের তৃণা। কারণ পিন্টুর এইসব অদ্ভুত লজিক্যাল সমীকরণগুলো আসলে অ্যাপের কোডে সে কোনোদিন শেখায়নি। তাই ও নিশ্চিত, এসব পিন্টুর নিজের কল্পনার ফসল। কর্মীরা একে অপরকে ঠাট্টা করতে শুরু করল—“চা অর্ডার দিলে পিন্টু আমাদের ফিলোসফি সার্ভ করছে।” আর এই হাসি-ঠাট্টার মধ্যে কাজের চাপও যেন কিছুটা হালকা হয়ে গেল। একঘেয়ে মিটিং, বিরক্তিকর টার্গেটের চাপ—সবকিছুর মাঝেই TeaQuick–এর আজব মেনু সবাইকে এক অন্য রকম আনন্দ দিল। পিন্টুর চোখে সেই সাফল্যের ঝিলিক স্পষ্ট—তার অ্যাপ অফিসে শুধু চা পৌঁছে দিচ্ছে না, হাসিও বিলি করছে। আর সেটাই তাকে সবচেয়ে বেশি গর্বিত করছে।

অফিসের অন্যতম সিরিয়াস কর্মী দেবদীপ। সে কাজে ভীষণ মনোযোগী, আর বাকি সবকিছু নিয়ে একেবারেই ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না। অন্যরা যেখানে পিন্টুর TeaQuick 2.5–এর আজব কাণ্ডে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে, সেখানে দেবদীপ মুখ গম্ভীর করে বলে—“এ সবই সময় নষ্ট করার ফন্দি। অফিসে এসে কাজ করাই আসল।” তাই সে দীর্ঘদিন ধরে অ্যাপ ব্যবহার এড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একদিন সকালের ব্যস্ত সময়ে, ডেস্ক ছেড়ে বাইরে গিয়ে চা আনার মতো সময় তার ছিল না। বাধ্য হয়ে ফোনে TeaQuick খুলে প্রথমবারের মতো অর্ডার দিল। সে ভেবেছিল, সিস্টেম নিয়ে যতই হাসাহাসি হোক না কেন, অন্তত এক কাপ গরম গ্রিন টি তো পাওয়া যাবে। কিন্তু ভাগ্য যেন ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে পরীক্ষা নিতে চাইল। স্ক্রিনে গ্রিন টি অপশনের নিচে লেখা ছিল—“গ্রিন টি = লেবু-চা + খুচরো টাকা ফেরত নয়।” দেবদীপ সেই লেখার দিকে তেমন খেয়াল করল না, শুধু ট্যাপ করে অর্ডার দিল। কিছুক্ষণ পরেই পিন্টু ট্রে হাতে হাজির। ট্রের ওপর রাখা কাপ দেখে দেবদীপের ভুরু কুঁচকে গেল। চায়ের রঙ দেখে বোঝাই যাচ্ছে—এটা গ্রিন টি নয়। সে রাগ চেপে বলল, “পিন্টু, আমি গ্রিন টি চেয়েছিলাম, এটা তো লেবু-চা!” পিন্টু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল, “স্যার, আজকের মেনুতে গ্রিন টি মানেই লেবু-চা। আপডেটটা তো পড়েননি নাকি?” চারপাশে সহকর্মীরা হাসতে শুরু করল।

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দেবদীপ তখনও কাপটা হাতে নিয়ে টেবিলে রাখল। অফিসের পরিবেশে হইচই শুরু হয়ে গেছে। কেউ বলছে—“দেখিস না, এবার গ্রিন টি’তে চপও এসে যাবে।” আর কেউ আবার মজা করে যোগ করল—“দেবদীপদা, এক কাপ চায়ের জন্য ক্যান্টিনে মিছিল ডাকুন।” ঠিক সেই সময়েই দেবদীপ বিলের দিকে চোখ ফেলল। এবং দেখল—“লেবু-চা : ১৫ টাকা, ফাইল প্রিন্টিং চার্জ : ৩০ টাকা, মোট : ৪৫ টাকা।” মুহূর্তের মধ্যে তার গম্ভীর মুখের রঙ পাল্টে গেল। সে চেঁচিয়ে উঠল—“এইটা কী পিন্টু! চায়ের সঙ্গে ফাইল প্রিন্টিং চার্জ কিসের?” পিন্টু এবারও সম্পূর্ণ নির্বিকার গলায় বলল, “স্যার, TeaQuick 2.5 এখন মাল্টি-সার্ভিস সিস্টেমে চলে গেছে। আপনি অফিসে কাজ করেন, তাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফাইল প্রিন্টিং সার্ভিসও বিলের সঙ্গে অ্যাড হয়ে গেছে। এটা অটো ইন্টিগ্রেশন।” আশপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা আর হেসে থামাতে পারল না। টেবিল চাপড়ে, চেয়ার ছেড়ে সবাই হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল। অরূপ বলল—“দেবদীপদা, এতদিনে আপনিও TeaQuick–এর ফাঁদে পড়লেন!”

প্রথমে দেবদীপ রাগে গর্জে উঠলেও, চারপাশে সহকর্মীদের সেই অট্টহাসি ধীরে ধীরে তার নিজের মনকেও নরম করে দিল। সে বুঝল, আসলে TeaQuick 2.5–এর এইসব ভুলভাল সিস্টেমই অফিসের সবার জন্য হাসির খোরাক। প্রতিদিনের কাজের চাপ, মিটিং, টার্গেট—এসবের ভিড়ে এই হাসির মুহূর্তগুলো সবাইকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। দেবদীপ কাপটা ঠোঁটে নিয়ে এক চুমুক খেল, তারপর মাথা নাড়ল। নিজের অজান্তেই তার মুখে একরকম হালকা হাসি ফুটে উঠল। বলল—“ঠিক আছে, গ্রিন টি না হয়ে লেবু-চা হোক, কিন্তু প্রিন্টিং চার্জটা অফিস অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নিও।” এই কথায় আবারও অফিসজুড়ে হাসির রোল পড়ে গেল। সবাই একবাক্যে মানল—দেবদীপও অবশেষে TeaQuick–এর মজার খেলায় হেরে গিয়ে হাসল। আর পিন্টু? তার চোখে তখন স্পষ্ট গর্ব—কারণ তার অ্যাপ কেবল চা পৌঁছে দিচ্ছে না, এমনকি সবচেয়ে গম্ভীর কর্মীকেও হাসাতে বাধ্য করছে।

অফিসে পিন্টুর TeaQuick 2.5 এখন সবার কাছে রোজকার হাসির ডোজ হয়ে উঠেছে। কিন্তু পাশাপাশি অনেকের বিরক্তিও বাড়ছে—বিশেষ করে যখন অর্ডারের বিলের সঙ্গে অটোভাড়া, ফাইল প্রিন্টিং চার্জ বা “আবেগ ফি” যোগ হয়ে যাচ্ছে। তাই একদিন তৃণা সিদ্ধান্ত নিল, এবার অ্যাপটা সে নিজেই আপডেট করবে। আসলে পিন্টুকে প্রথমবার সাহায্য করেছিল বলে আজকাল সব সমস্যার দায়ও তার ওপর এসে পড়ে। দুপুরে লাঞ্চের পর অফিসের নিরিবিলি একটা কোণে বসে ল্যাপটপ খুলে সে কোড ঘাঁটতে লাগল। তার উদ্দেশ্য সহজ—অ্যাপটাকে স্থিতিশীল করা, যাতে চা অর্ডার দিলে সত্যিই শুধু চা-ই আসে, বাড়তি কোনো নাটক না হয়। সে লজিক্যাল অ্যালগরিদম ঠিক করল, বিল জেনারেটরের লুপও আবার তৈরি করল। কাজ শেষ হলে সে পিন্টুকে ডেকে বলল, “দ্যাখো, আমি অ্যাপটা নতুন করে আপডেট করেছি। এবার আর কোনো বাড়তি চার্জ বা আজব মেনু থাকবে না।” পিন্টু মুখে হ্যাঁ-হুঁ করলেও তার চোখে সেই চেনা দুষ্টু ঝিলিক জ্বলছিল। কারণ, তৃণা না দেখার সুযোগে সে আগেই কোডের ভেতরে নিজের মতো করে কিছু লাইন ঢুকিয়ে দিয়েছে।

সন্ধ্যায় অফিসে সবাই আবার TeaQuick ব্যবহার শুরু করল। প্রথম অর্ডার দিলেন অরূপ। ফোনে কনফার্ম বাটন টিপতেই হঠাৎ পুরো মোবাইল কেঁপে উঠল আর সাউন্ড বেজে উঠল—“চা আসছে, হাসতে থাকুন!” সবার চমক ভরে গেল, তারপর মুহূর্তেই হাসির রোল। পাশের টেবিলে বসা দেবদীপ হেসে বলল—“এইবার তো অফিসে কল সেন্টার খোলা গেছে!” দ্বিতীয় অর্ডার দিলেন মণীশ বসু। তার ফোন থেকেও একই সাউন্ড বেরোল, একেবারে গম্ভীর ভঙ্গিতে—“চা আসছে, হাসতে থাকুন!” তিনি বিরক্ত হয়ে ফোনটা টেবিলে ছুঁড়ে রাখলেন, কিন্তু আশেপাশের সবাই এত হেসে ফেলল যে তাকেও মুখ চেপে হাসি সামলাতে হল। এরপর তো যা হওয়ার তাই হলো—যে-ই অর্ডার দিচ্ছে, সবার মোবাইল একসঙ্গে হইচই করে উঠছে এই একটাই ডায়লগে। অফিসের ভেতরটা তখন যেন মজার কোনো রেডিও শো চলছে। কেউ কেউ আবার ইচ্ছে করেই বারবার অর্ডার দিয়ে চারপাশে হাসির ঢেউ তুলতে লাগল।

তৃণা প্রথমে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। সে ভেবেছিল এবার অন্তত অ্যাপটা সোজাসাপ্টা কাজ করবে, কিন্তু আবার নতুন কাণ্ড। সে পিন্টুকে জিজ্ঞেস করল—“তুই কি কোডে হাত দিয়েছিস?” পিন্টু গম্ভীর ভঙ্গিতে উত্তর দিল, “না স্যার, এটা তো মোটিভেশনাল আপডেট। অফিসের সবাই হাসলে কাজের চাপ কমবে। তাই অ্যাপ এখন নিজে থেকেই হাসি বিলি করছে।” কথাটা শুনে তৃণা রাগে কপালে হাত চাপল, কিন্তু বাকিরা হাততালি দিয়ে উঠল। কারণ সত্যিই, এই সাউন্ড অফিসের একঘেয়েমি ভেঙে দিয়েছিল। কেউ প্রেজেন্টেশন বানাতে বানাতে বিরক্ত হয়ে হেসে ফেলছে, কেউ ডেডলাইনের চিন্তা ভুলে অর্ডার করছে শুধু ওই ডায়লগ শোনার জন্য। শেষমেশ তৃণাও মুচকি হেসে ফেলল। বুঝল, পিন্টুর মতো মানুষকে দিয়ে কোনোদিন স্ট্যান্ডার্ড সফটওয়্যার বানানো যাবে না। তার অ্যাপ মানেই সারপ্রাইজ, মানেই অফিসের প্রতিদিনের হাসির খোরাক। আর সেই মুহূর্তে TeaQuick 2.5 কেবল এক অ্যাপ নয়, অফিস সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠল।

কিছুদিন আগেও TeaQuick 2.5–কে নিয়ে কর্মীরা কপালে ভাঁজ ফেলত—চায়ের জায়গায় কফি আসে, বিলের সঙ্গে অটোভাড়া বা প্রিন্টিং চার্জ যোগ হয়, আবার মেনুতে থাকে এমন সব সমীকরণ যা বোঝাই যায় না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অ্যাপ তাদের কাছে একেবারে আলাদা মাত্রা পেয়ে গেল। এখন আর কেউ TeaQuick–কে চা আনার অ্যাপ বলে ভাবে না, বরং এটাকে তারা ভাবে অফিসের ফ্রি এন্টারটেইনমেন্ট সিস্টেম। সকাল দশটায় কাজ শুরু হতেই কেউ না কেউ ফোন খুলে অ্যাপে ঢোকে, শুধু এটা দেখার জন্য—আজকে আবার নতুন কী পাগলামি ঢুকেছে মেনুতে। কেউ অর্ডার দিলেই সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল থেকে ভেসে ওঠে সেই বিখ্যাত ডায়লগ—“চা আসছে, হাসতে থাকুন!” আর এই একটিই বাক্য অফিসকে মুহূর্তে উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে তোলে। টেবিলের ওপর ফাইল ছড়িয়ে থাকা অবস্থাতেও কেউ হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে, কেউ আবার কপাল চেপে বলছে—“পিন্টু একদিন এই অফিসটাই স্ট্যান্ড-আপ কমেডি ক্লাবে পরিণত করবে।”

ধীরে ধীরে TeaQuick 2.5 অফিসের কাজের চাপকেও হালকা করে দিল। আগে যেখানে দুপুরের পর কাজের ক্লান্তি অফিসের পরিবেশ ভারী করে তুলত, সেখানে এখন এক কাপ চা অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে মজা শুরু হয়ে যায়। কেউ ইচ্ছে করে চারবার টানা অর্ডার দিল, যাতে চারদিকে একই সাউন্ড বাজে। ফলাফল, পুরো ফ্লোর যেন একসঙ্গে হাসিতে গর্জে উঠল। কেউ আবার ফেসবুকে লাইভ করে দেখাতে লাগল—“আমাদের অফিসের TeaQuick কমেডি শো।” অন্য অফিসের বন্ধুরাও সেই ভিডিও দেখে মজা পাচ্ছে। এভাবেই TeaQuick এখন অফিসের লোকাল সেলিব্রিটি হয়ে গেছে। এমনকি ক্লায়েন্ট মিটিংয়ের সময়ও এক-আধটা অর্ডার দিয়ে মুড হালকা করা হচ্ছে। ক্লায়েন্টরা অবাক হয়ে বলছে—“এ কীরকম অফিস! এখানে তো চা-ওয়ালা প্রযুক্তি দিয়ে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি চালাচ্ছে!” পিন্টু অবশ্য এসব শুনে একেবারেই নির্লিপ্ত, সে ভাবে—“যতক্ষণ সবাই হাসছে, ততক্ষণ আমার অ্যাপ সফল।”

এখন TeaQuick ব্যবহার করা মানে কেবল চা পাওয়া নয়, বরং অফিসে একটু ফুর্তি আনা। তৃণা, যে একসময় কোড নিয়ে মাথা ঘামাত, সেও এখন মজা পাচ্ছে। মণীশ বসু, যিনি প্রথমে কড়া গলায় হিসেব চাইতেন, তিনিও এখন মাঝে মাঝে বিল হাতে নিয়ে হেসে বলেন—“আবার দেখি আজ নতুন কী চার্জ এল।” এমনকি গম্ভীর দেবদীপ, যে সবকিছুকে সময় নষ্ট মনে করত, সেও মাঝে মাঝে কফির অর্ডার দিয়ে ট্রের সঙ্গে আসা সারপ্রাইজ উপভোগ করে। ধীরে ধীরে TeaQuick 2.5 অফিস সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে, এমন এক বিনোদন যা কোনো খরচ ছাড়াই সবাইকে আনন্দ দেয়। অফিসের করিডর দিয়ে হাঁটতে গেলে শোনা যায়—“চা আসছে, হাসতে থাকুন!”—এই স্লোগান যেন সবাইকে এক করে দেয়, অফিসের চাপ আর সিরিয়াসনেস ভেঙে মুহূর্তেই জায়গা করে নেয় এক ঝলক হাসি।

অফিসে TeaQuick 2.5 নিয়ে হাসাহাসি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে ম্যানেজার মণীশ বসু প্রথমদিকে ভেবেছিলেন, এটা আসলে কাজের ক্ষতি করছে। প্রতিদিনই দেখা যায় কর্মীরা এক কাপ চা অর্ডারের অজুহাতে কাজ ফেলে হইচই করছে। তিনি কয়েকবার চুপিসারে পর্যবেক্ষণ করেছেন, কিন্তু শেষমেশ বুঝলেন, এই অ্যাপ আসলে অফিসের মন ভালো রাখার ওষুধ। তবে তার ভেতরে একটা কৌতূহলও কাজ করছিল—সত্যিই কি TeaQuick এতটাই আজব, নাকি কর্মীরা মজা করে গল্প বানায়? তাই একদিন দুপুরবেলা, যখন সবাই কাজে ব্যস্ত, তিনি গোপনে নিজের ফোনে অ্যাপ খুললেন। যত্ন করে মেনু স্ক্রল করলেন। প্রথমেই চোখে পড়ল—“চা + চপ = কফি।” তিনি ভুরু কুঁচকে হেসে ফেললেন। তারপর দেখলেন গ্রিন টি অপশনের পাশে লেখা আছে—“গ্রিন টি = লেবু-চা + খুচরো টাকা ফেরত নয়।” মেনুর অদ্ভুত লজিক দেখে তার মনে হল, কর্মীরা মোটেও বাড়িয়ে কিছু বলে না। তিনি মনে মনে ভাবলেন—“চল, দেখি তাহলে কফি অর্ডার করলে আসলে কী আসে।” নিঃশব্দে অর্ডার বাটন চাপলেন।

কিছুক্ষণ পর পিন্টু ট্রে হাতে হাজির। তার চোখে-মুখে সেই চেনা রহস্যময় হাসি। ট্রে নামিয়ে রাখতেই মণীশ বসু দেখলেন—কফির বদলে গরম লেবু-চা! তিনি হতবাক হয়ে কাপটা হাতে নিলেন, আর বাকি কর্মীরা একে একে খেয়াল করল দৃশ্যটা। সবাই চাপা হাসি চেপে বসে রইল। মণীশ বসু প্রথমে কড়া গলায় বললেন, “এটা কী ব্যাপার পিন্টু? আমি কফি চেয়েছিলাম।” পিন্টু একেবারে সিরিয়াস মুখে উত্তর দিল, “স্যার, আজকের আপডেটে কফি মানেই লেবু-চা। এতে স্বাস্থ্য ভালো থাকে, কোম্পানির প্রোডাক্টিভিটিও বাড়ে।” সবাই তখন আর চুপ থাকতে পারল না, একসঙ্গে হেসে উঠল। মণীশ বসু ভুরু কুঁচকে বিলের দিকে তাকালেন। আর সেখানে লেখা—“লেবু-চা ১৫ টাকা + ডেলিভারি চার্জ—হাওড়া মেইল ভাড়া ৬০ টাকা = মোট ৭৫ টাকা।” বিল দেখে প্রথমে তিনি স্তম্ভিত হলেন, তারপর তার মুখ থেকেও অনিচ্ছাসত্ত্বে হেসে বেরিয়ে এল এক ফোটা শব্দ—“হাহা!”

সেই হাসিটাই অফিসে বজ্রপাতের মতো ছড়িয়ে পড়ল। কর্মীরা অবাক হয়ে দেখল, তাদের কড়া ম্যানেজার অবশেষে TeaQuick–এর ফাঁদে হেসে ফেলেছেন। কেউ বলল—“বাহ, এবার তো সিস্টেম পুরো সফল!” অন্য কেউ যোগ করল—“স্যার, আপনিও যখন হেসে ফেললেন, তখন TeaQuick–এর জয় নিশ্চিত।” মণীশ বসু প্রথমে অস্বীকার করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু শেষমেশ নিজেও মজা পেতে শুরু করলেন। তিনি এক চুমুক লেবু-চা খেলেন আর হেসে বললেন, “ঠিক আছে, TeaQuick যদিও ব্যবসায়িক অ্যাপ নয়, তবে এটা আমাদের অফিসের এন্টারটেইনমেন্ট ডিপার্টমেন্ট।” পিন্টু গর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল, যেন তার অ্যাপের আসল সাফল্য এই স্বীকৃতিতেই। সেই দিন থেকে TeaQuick আর কেবল কর্মীদের বিনোদন নয়, বরং ম্যানেজারেরও প্রিয় খেলার অংশ হয়ে উঠল। পুরো অফিস একসঙ্গে বুঝল—হাসি-তামাশার মধ্যেই লুকিয়ে আছে কাজের চাপ কমানোর আসল শক্তি।

১০

অফিসের প্রতিদিনের ব্যস্ততা, ক্লান্তি আর চাপা গুমোট পরিবেশের মধ্যে এক অদ্ভুত রঙিন আলোর মতো জায়গা করে নিল পিন্টু। তার TeaQuick 2.5 অ্যাপের অসংখ্য ভুলভাল, অদ্ভুত ও প্রায়শই হাস্যকর বৈশিষ্ট্যগুলো অফিসের কর্মীদের বিরক্ত করার বদলে তাদের আনন্দ এনে দিল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মিটিং, ফাইল, রিপোর্ট, ডেডলাইন আর ক্লায়েন্টের চাপা ধমকের ভেতরে পিন্টুর ছোট্ট এক কাপ চা আর তার সঙ্গে আসা মজার কারসাজি যেন সবার একমাত্র নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ হয়ে উঠল। আগে যে অফিসটা নিছক কাজ আর স্রেফ রুটিনের বন্দি ঘর বলে মনে হতো, সেখানে এখন প্রতিদিন কিছু না কিছু ঘটনার প্রত্যাশা থাকত—আজ কে কী অর্ডার দেবে আর তার বদলে কী আজব ফলাফল আসবে, সেটা জানার উত্তেজনা যেন সবার চোখেমুখে খেলে যেত। পিন্টু নিজেও জানত, তার কোডিং জ্ঞানে যতই ফাঁকফোকর থাক, সে আসলে এমন কিছু বানিয়ে ফেলেছে, যা অফিসকে নতুন করে বাঁচিয়েছে। আর এই উপলব্ধিই তাকে ভেতরে ভেতরে এক অদৃশ্য গর্বে ভরিয়ে তুলেছিল।

দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের কাছে পিন্টু হয়ে উঠল নিছক একজন চা-ওয়ালা নয়, বরং অফিসের প্রাণকেন্দ্র। মণীশ বসুর মতো কঠোর ম্যানেজারও এখন মাঝে মাঝে মুচকি হেসে TeaQuick 2.5 থেকে অর্ডার দিতেন, কারণ জানতেন—এর ফলে এমন এক ফলাফল আসবে, যা সবার মধ্যে হইচই ফেলে দেবে। দেবদীপ, যে একসময় ভীষণ সিরিয়াস আর চটে যাওয়া স্বভাবের কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিল, সেও এখন আর বিরক্ত হতো না। বরং অনেক সময় ইচ্ছে করেই “গ্রিন টি” অর্ডার দিত, দেখে কী ধরনের উদ্ভট বিল বা মেনু বেরোয়। আর অরূপের মতো দুষ্টুমি প্রিয় কর্মীরা তো নিয়মিত অ্যাপের সঙ্গে খেলত। অফিসের সবাই ধীরে ধীরে বুঝে গেল—পিন্টু আসলে কেবল চা সরবরাহ করছে না, বরং তাদের দিনগুলোকে হাসিতে ভরিয়ে দিচ্ছে। অফিসের মধ্যে সম্পর্কগুলোও বদলাতে শুরু করল। আগে যারা একে অপরের সঙ্গে বেশি কথা বলত না, তারা এখন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে TeaQuick-এর অদ্ভুত মেনু আর হাস্যকর ডেলিভারি চার্জ নিয়ে আড্ডা দিত। কাজের চাপের মাঝেও এই মজার মুহূর্তগুলো সবাইকে আরও কাছে টেনে আনছিল।

অবশেষে সবাই মনে মনে এক অদ্ভুত সত্য উপলব্ধি করল—পিন্টুর অ্যাপ যতই প্রযুক্তিগত দিক থেকে ব্যর্থ হোক না কেন, এর মূল উদ্দেশ্য ঠিকই সফল হয়েছে। TeaQuick 2.5 অফিসের ভেতরকার চাপ, উদ্বেগ আর ক্লান্তিকে ভেঙে দিয়ে এক নতুন আনন্দের জায়গা তৈরি করেছে। মানুষ বুঝল—হাসি কখনো নিছক বিলাসিতা নয়, বরং অফিসের কঠিন যন্ত্রণা থেকে বাঁচার এক অমূল্য ওষুধ। পিন্টু, যে আগে ছিল কেবল এক সাধারণ চা-ওয়ালা, এখন সবার প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছে। তার আন্তরিকতা, বোকাসোকা কোডিং আর অফুরন্ত হাসির ভাণ্ডার অফিসের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে গেল। সবাই একসঙ্গে বলল—“TeaQuick হয়তো আমাদের কফি দিতে পারে না, গ্রিন টি-কে লেবু-চা বানিয়ে ফেলে, আর ডেলিভারি চার্জে ট্রেনভাড়া লিখে দেয়, কিন্তু এটাই আমাদের দিনের সেরা সফটওয়্যার।” পিন্টুর জয় হলো, কারণ সে দেখিয়ে দিল—প্রযুক্তি না হয় ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু একজন মানুষের আন্তরিকতা আর হাসি কখনোই হার মানে না। অফিসের প্রতিদিনের ধূসর রুটিন ভেঙে রঙিন হয়ে উঠল, আর সেই রঙের নাম—পিন্টু আর তার TeaQuick 2.5।

***

1000062752.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *