Bangla - হাস্যকৌতুক

অফিসের ওঝা বাবু

Spread the love

রূপম মৈত্র


অধ্যায় ১: আগমন শুভ হউক

সকাল সাড়ে ন’টায় ‘Eastern Cloudwave Solutions’-এর রিসেপশনে এক নতুন মুখ। মাথায় টাক, কপালে লাল চন্দনের তিলক, হাতে রুদ্রাক্ষের মালা, কাঁধে একটি ছোট ব্যাগ, আর গলায় গামছার মতো হলুদ স্কার্ফ। নাম তপন কুমার ওঝা। ড্রয়িং-রুম থেকে উঠে আসা না-খাওয়া বাবাজীর মতো চেহারা দেখে রিসেপশনিস্ট জুয়েলী প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো ভুল করে কেউ পুরোহিত ডেকেছে অফিস পুজোর জন্য। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন শীটে নাম দেখে বুঝল, এ তো আজকের নতুন সিস্টেম অ্যাডমিন। “ওঝা বাবু?” বলে একটু হেসে ফেলেছিল সে, কারণ পদবি তো এমনই ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই জুয়েলী বুঝে গেল, এই তপন কুমার শুধু নামেই ওঝা নন—মনপ্রাণে তিনি একজন আধুনিক যুগের ‘সাইবার তান্ত্রিক’। প্রথম থেকেই শুরু—সে অফিসে ঢোকার সময় দরজার বাইরে এক হাত উপরে করে বলেছিল, “শুভ দিকদর্শন হোক! পশ্চিমে আজ শনির প্রভাব।” ঢোকার পরেই নিজের ডেস্কের চারপাশে তিনবার ঘুরে ধূপ ছিটিয়ে বলেছিল, “এখানে অনেক নেগেটিভ এনার্জি জমে আছে। আমি ক্লিন করে দিচ্ছি।” আইটি বিভাগের সহকর্মীরা, যারা তখন সকালের চা হাতে নিয়ে জাভাস্ক্রিপ্টে বসে হেঁচকির মতো কোড ফিক্স করছিল, তারা চুপ করে চেয়ে রইল। আর তাদের ঠিক পেছনে বসে থাকা ট্রেনি অর্চনা ফিসফিস করে বলল, “আমাদের আইটি ডিপার্টমেন্টে এখন সত্যিই ‘ডাইনামিক’ কিছু ঘটতে চলেছে।”

তপন কুমার নিজের ডেস্কে বসেই প্রথমে একটা ল্যাপটপ খুলে চালু করল, কিন্তু সেটি হ্যাং হয়ে গেল। অন্য কেউ হলে একবার রিস্টার্ট করে আবার চেষ্টা করত, কিন্তু ওঝা বাবু দাঁড়িয়ে গেলেন। দুই চোখ বন্ধ করে তিনবার “ওঁ রাউটারায় নমঃ” বলে জপ করল, তারপর গামছার কোণে রাখা এক বোতল গঙ্গাজল ব্যাগ থেকে বের করে কীবোর্ডে কয়েক ফোঁটা ছিটিয়ে বলল, “এখন ভেতরের কু-গ্রহ মুক্ত হবে।” ট্রেনি রাকেশ ওদিকে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, আমি একটু চেক করে দেখি RAM-টা ঠিক আছে কিনা।” কিন্তু তপনের দৃষ্টি রাকেশের জুতোর দিকে—“কালো জুতো মঙ্গলবারে? এই তো এর ফল। শুক্রের প্রভাব তীক্ষ্ণ, এই ভুল করলে যন্ত্র বিদ্রোহ করে।” এই নিয়ে অফিসে খিলখিল হাসি পড়ে যায়, কিন্তু তপন সিরিয়াস। লাঞ্চবক্স খুলে প্রথমে প্রসাদ খাওয়ায়, তারপর বসে নিজের ডেস্কের চার কোণে চট করে চারটে সাদা কাগজে “শ্রী শ্রী সার্ভারেশ্বর” লিখে রেখে দেয়। বস, দেবাশীষ বাবু, নিজের কেবিন থেকে তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখে ফাইলের পেছনে মুখ লুকিয়ে ফেলেন। “যতদিন না কেউ অর্ডার ক্যানসেল করছে, ততদিন ওকে চলতে দাও” বলে হাসলেন।

বিকেলের দিকে মেইন সার্ভারে একটু সমস্যার জন্য পুরো অফিসে ইন্টারনেট স্লো হয়ে যায়। টেক টিম তখন চটপট ব্যস্ত হয়ে যায় লগ চেকিং নিয়ে। কিন্তু তপন বাবু নিজের ডেস্ক থেকে ধীরে ধীরে উঠে এলেন, হাতে ছোট একটা তামার ঘণ্টা, সঙ্গে এক মোড়কে বাঁধা কাঁচা হলুদ। দাঁড়িয়ে বলল, “এই অফিসে এক অজানা ‘ডেটা-ভূত’ প্রবেশ করেছে, ওর নামই সম্ভবত ‘ল্যাগুরাস’। আমি এখন ওই প্রেতকে দূর করব।” সবার সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে তিনবার “ওঁ ইন্টরনেটায় নমঃ” বলে চিৎকার করল। ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ সার্ভার লাইন ঠিক হয়ে যায়, ইন্টারনেট আবার চলতে শুরু করে। পুরো অফিসে কেউ জানে না, ঠিক দশ মিনিট আগে ক্লিনিং স্টাফ ঝাড়ু দেওয়ার সময় প্লাগটা খসিয়ে দিয়েছিল, আবার লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই ‘দৈব-সামঞ্জস্য’ দেখে সহকর্মীরা তপনের দিকে তাকিয়ে শুধু বলে উঠল, “ওঝা বাবু জিন্দাবাদ!” সেই মুহূর্ত থেকেই অফিসে একটা নতুন ভাবমূর্তি তৈরি হল—একটা অংশ মজা পায়, একটা অংশ সন্দেহ করে, আর কিছু মানুষ… সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করে দিল। তপন কুমার, এক সাধারণ সিস্টেম অ্যাডমিন, অফিসের অলৌকিক ফিগারে রূপান্তরিত হতে শুরু করলেন—যার কাছ থেকে সমস্যার সমাধান চাওয়া মানেই ‘প্রেতের পথ থেকে প্রযুক্তির পথে যাত্রা’!

অধ্যায় ২: মাউসের মধ্যে ভূত

সকাল ন’টা কুড়ি মিনিটে অফিস খুলেছে। সবাই যখন ধীরে ধীরে ঢুকছে, তখন আইটি ডেস্কের এক কোণে অর্চনা বসে তার ডেস্কটপ চালু করে মাউস নাড়ানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু মাউস একেবারেই কাজ করছে না। সে ইঞ্জিনিয়ারদের মতো করে USB খুলে আবার লাগাল, টেবিল ঝাড়ল, প্যাড চেঞ্জ করল, কিন্তু তবুও কিছুই হলো না। ঠিক সেই সময় পাশে দিয়ে হাঁটছিল তপন কুমার ওঝা। হঠাৎ থেমে গেলেন, চোখ ছোট করে দেখে নিলেন অর্চনার ডেস্কের ওপর। বললেন, “কী হল, মা, হাত কাঁপছে বুঝি?” অর্চনা একটু হাসতে হাসতেই বলল, “না না, মাউসটাই কাজ করছে না।” তপন কুমার তখন চোখ গোল করে বললেন, “আরে! এটাতে তো পরিষ্কার করে প্রেতের ছায়া বসেছে। কাল সন্ধ্যাবেলায় পূর্ণিমা ছিল, আর তুমি নিশ্চয়ই তখন অফিসের লাইট না জ্বালিয়ে কাজ করছিলে, তাই না?” অর্চনা একটু চমকে উঠল, কারণ সত্যিই তো—কাল সে শেষ ট্রেন ধরার জন্য সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত লাইট নিভিয়েই বসেছিল। তপন বললেন, “এই সব অন্ধকারেই ওরা প্রবেশ করে, মেমোরি চিপে গিয়ে বসে পড়ে।” অর্চনা একটু থতমত খেয়ে বলল, “মাউসের মধ্যে মেমোরি?” তপন বললেন, “আজকাল সব কিছুতেই চেতনা আছে, মা! এই মাউসটা এখন তোমার হস্তরেখা পড়ে তোমার ভবিষ্যৎ বলে দিচ্ছে—এই যে কাজ করছে না, মানে এখন হাত চালানো নিষেধ। বিরতিতে একটু গঙ্গাজল এনে ছিটিয়ে নিও।”

এই ঘটনার পরে পুরো অফিসে একটা হালকা হাহাকার পড়ে যায়। অর্চনার ডেস্কে লোকে এসে মাউস দেখতে থাকে, যেন কোনো যাদু ঘটে গেছে। রাকেশ বলে, “দ্যাখো ভাই, মাউসটা তো আমি এক মাস আগে চেক করেছিলাম, তখন ঠিকঠাকই ছিল।” শুভ্র নামে এক জুনিয়র বলে, “ভাই, এইসব প্রেতভূতের কথা বলিস না, আমি রাতে ঘুমোতে পারি না।” আর সবার পেছনে বসে থাকা দেবলীনা একটা মিম বানিয়ে স্ল্যাক-এ পোস্ট করে: “When your mouse is haunted, but your KPI is scarier!” তপন কিন্তু সেসব দেখে বিশেষ কিছু না বলে নিজের ডেস্কে বসে রুদ্রাক্ষের মালা ঘোরাতে থাকে। ঠিক লাঞ্চের একটু আগে, সে হাতে একটা ছোট্ট কৌটো নিয়ে অর্চনার ডেস্কে আসে। কৌটো খুলে একধরনের লাল গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয় মাউসের চারপাশে। বলে, “এটা আসলে ‘ডাটা নিরোধক রেখা’, যেটা তৈরি হয়েছে হরিদ্বার থেকে আনা শুদ্ধ চন্দন, কাঁচা হলুদ আর চার ভোরের গরলতুলসী দিয়ে।” সবাই ফিসফিস করে, হাসে, কেউ কেউ ভিডিও তোলে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে, দশ মিনিটের মধ্যেই মাউসটা আবার কাজ করতে শুরু করে। কেউ বোঝে না, যে ট্রেনি রাকেশ আসলে লুকিয়ে ব্যাটারি চেঞ্জ করে দিয়েছে। তবে ওঝা বাবুর প্রভাব এতটাই ছড়িয়ে পড়ে, যে পরদিন সকালেই অর্চনার ডেস্কে এক গ্লাস গঙ্গাজল আর তুলসীপাতা নিয়ে হাজির হয় শুভ্র—“ভাই, আমার Excel খুলছে না, একটু আশীর্বাদ করো।”

এই ঘটনার পর তপনের নাম হয়ে যায় “USB ওঝা”। ক্যান্টিনে চা খেতে খেতেও এখন তাকে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, “স্যার, আমার মোবাইল চার্জ নিতে দেরি হচ্ছে, কোনো চক্র তো নয়?” তপন খুব গম্ভীর মুখে উত্তর দেন, “যেকোনো যন্ত্রের সাথেই মানবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। তুমি চার্জার ঢুকিয়ে দিলে কিন্তু সেটা সম্মতিসূচক শব্দ করছে না মানে তার অভিমান হয়েছে। একটু আদর করে কথা বলো, নিজে ঠিক হয়ে যাবে।” অফিসের বস, দেবাশীষ বাবু, তার এই বেলাগাম ভাব দেখে ভাবেন যে এবার বোধহয় কাজের গতি কমে যাবে। কিন্তু বিপরীত চিত্র—সহকর্মীরা রীতিমতো উজ্জীবিত! যারা আগে সারাদিন হেঁচকি তুলে বসে থাকত, তারাও মজা পেয়ে অফিসে আগেই চলে আসছে শুধু তপনের নতুন নতুন ব্যাখা শোনার জন্য। ওঝা বাবু যেখানেই যান, অফিসের একেকটা ডেস্ক যেন একেকটা পবিত্র যন্ত্রমন্দিরে পরিণত হয়। অথচ তার নিজের ডেস্কে এখনো Windows 7 চলছে, আর সে মনে করে এটি সবথেকে ‘সত্‌ চক্রবিশিষ্ট’ অপারেটিং সিস্টেম। এভাবেই তপন কুমার ধীরে ধীরে শুধুই এক IT কর্মচারী না থেকে অফিসের অলৌকিক কিংবদন্তি হয়ে উঠতে থাকে।

অধ্যায় ৩: জ্যোতিষ বনাম জাভাস্ক্রিপ্ট

সোমবার সকালটা একটু বেশি ব্যস্ত ছিল। ক্লায়েন্ট ডেলিভারির ডেডলাইন সামনে, আর সেই নিয়ে পুরো অফিস জাভাস্ক্রিপ্টের কোড নিয়ে টেনশনে। মিটিং রুমে বসে বসে সবাই বাগ ফিক্সিং, সিভিএস পুশ, সিপিই টেস্টিং—সবই করছে। কিন্তু এর মধ্যেই তপন কুমার ওঝা ঢুকে পড়ল একেবারে পুজোর থালার মতো একটা ট্রেতে জ্যোতিষশাস্ত্রের বই, দু’টো লাল কলম আর একটা ছড়া ধূপকাঠি নিয়ে। বলল, “আজ সোমবার, মঙ্গল ও চন্দ্র উভয়েই ষষ্ঠ ভাবে। এই অবস্থায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ কোড রান করালে ক্লায়েন্ট রিজেক্ট করবে। আগে গ্রহ স্থিতি দেখে নিন, তারপর API মারুন।” মিটিং রুমে থাকা শুভ্র প্রথমে ভেবেছিল এটা কোনো মজা। কিন্তু তপন তার এক্সেল শিট খুলে সবাইকে বলতে শুরু করল, কার জন্মতারে কোন গ্রহ বসে আছে, আজ কার ভাগ্যে ‘loop of misfortune’ আছে, আর কার data-binding-এর চক্রে আছে শনির দৃষ্টি। রাকেশ একেবারে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, কারণ তপন বলেছিল, “তোর আজকের কোড এরো দেবে কারণ তোর শনির রাশিফল আজ ‘সার্ভার ডাউন’ বলছে।”

দেবাশীষ বাবু মিটিং রুমে ঢুকে ব্যাপারটা দেখে গম্ভীর হয়ে যান। অফিসে একজন নতুন প্রজেক্ট ম্যানেজার আসছেন, আর এর মধ্যেই তার চোখে পড়ে, কীভাবে কোডিং টেবিলে কেউ someone’s Kundali ফেলে রেখেছে। বস বললেন, “তপনবাবু, আমরা এখানে প্রযুক্তির সঙ্গে কাজ করি, প্রাচীন পদ্ধতির সঙ্গে নয়।” কিন্তু তপন হাসি মুখে উত্তর দেয়, “স্যার, প্রযুক্তি হল মায়ার যন্ত্র। কিন্তু গ্রহ-নক্ষত্র আসল নিয়ামক। আপনি তো দেখছেনই, শুভ্রর মাউস সমস্যা, রাকেশের নেটওয়ার্ক ল্যাগ—সবই রাশি অনুযায়ী ঘটছে।” বস অসহায়ভাবে বলেন, “এইবার তাহলে একটা স্ক্রিপ্ট লেখো যেটা গ্রহ দেখে কোড পুশ করে।” পুরো অফিসে হাসির রোল পড়ে যায়। কিন্তু তপনের মুখে একটুও লজ্জা নেই। সে নিজের ডেস্কে ফিরে গিয়ে Excel-এ বানাতে শুরু করে “রাশিচক্র অনুযায়ী Debug Time Forecast” শিট। তাতে লেখা—“কর্কট রাশিরা দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে কোড পুশ করবেন না”, “বৃশ্চিক রাশিরা avoid nested loops today” ইত্যাদি।

এর মধ্যেই ঘটে গেল অদ্ভুত এক ঘটনা। বিকেলের দিকে হঠাৎ এক বড় ক্লায়েন্টের কোড ডেলিভারি আটকে গেল, কারণ একটা function পুরো সার্ভার ক্র্যাশ করে দিল। যাকে নিয়ে সবথেকে বেশি আশা ছিল, সেই দেবলীনার কোডেই ফাঁস ধরা পড়ল। বস রেগে আগুন। ঠিক তখনই তপন ওঝা বলল, “দেবলীনা বৃশ্চিক রাশি—আজ ওর avoid time ২:৩০ থেকে ৩:৪৫। ঠিক তখনই ও কোড পুশ করেছে।” সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু দেবলীনার মুখ কেমন যেন কুঁচকে গেল। সে হয়তো নিছক কাকতালীয় ভেবেই মেনে নিল। এরপর থেকে মজার ছলে হলেও সবাই ওঝা বাবুর “Debug Horoscope” খুঁজে দেখতে শুরু করল। একদিন অফিসে বসে অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “স্যার, যদি শনির সময়ে আমি কোড না লিখি, তাহলে কি প্রোডাক্টিভিটি কমবে না?” তপন বলল, “না মা, তুমি তখন documentation করো, এটা শনির প্রিয় কাজ। slow but steady.” ট্রেনি রাকেশ চুপচাপ সেই কথা লিখে রাখল তার নোটবুকে।

সন্ধ্যাবেলায়, পুরো অফিসে আলো ঝলমলে, কেউ ব্যাগ গোছাচ্ছে, কেউ টিফিন গুছোচ্ছে। তখন তপন কুমার জানাল, সে একটি নতুন ইনিশিয়েটিভ নিচ্ছে—“Code & Kundali” নামক এক ব্লগ শুরু করবে, যেখানে সে প্রতিদিন রাশি অনুযায়ী কোডিং উপদেশ দেবে। অফিসে আবার হাসির রোল উঠল। কিন্তু এই হাসির মধ্যেও যেন একটা হালকা মুগ্ধতা, একরকম বিনোদনের প্রয়োজন—যেটা তপন কুমার ওঝা বাবু অপূরণীয়ভাবে দিচ্ছেন। অফিসের অন্ধকার টেক করিডোরে দাঁড়িয়ে বস দেবাশীষ বাবু এক সহকর্মীকে বললেন, “এই লোকটা পাগল, কিন্তু কীভাবে যেন পুরো টিমকে বেঁধে রেখেছে।” আর তখনই তপন এক কোণে বসে একখানা চায়ের কাপ নিয়ে ফিসফিস করে বলছিলেন, “আগামী বৃহস্পতিবার চন্দ্রদোষ, যারা নতুন ব্রাঞ্চে যাচ্ছেন তারা সাবধানে থাকবেন। ওখানে Wi-Fi একেবারে শূন্যমুখী।”

অধ্যায় ৪: বসের বিভ্রান্তি

তাপস বাবু—Eastern Cloudwave Solutions-এর প্রজেক্ট ম্যানেজার—নতুন বস হিসেবে অফিসে যোগ দিয়েছেন সবে কয়েক সপ্তাহ হলো। সবকিছু বেশ গুছানো, পলিসি-কথা-প্রসেস মেনে চলা এই মানুষটি সোজা পথে বিশ্বাসী। কিন্তু এই অফিসে ঢুকে তিনি এক অদ্ভুত জগতে পড়েছেন, যেখানে সকালবেলা কেউ ধূপকাঠি জ্বালায়, কেউ Excel-এ গ্রহের হিসেব রাখে, আর কেউ মাউস কাজ না করলে বলে “কালো ছায়া লেগেছে!” প্রথমদিকে তাপস বাবু এসব মজা বলেই মেনে নিচ্ছিলেন। কিন্তু দিন যত যাচ্ছিল, তিনি বুঝতে পারছিলেন, পুরো অফিস যেন এক অলিখিত নিয়মে তপন কুমার ওঝার আধ্যাত্মিক মুদ্রাদণ্ড মেনে চলছে। একদিকে কোড রিভিউ, অন্যদিকে কুণ্ডলী রিভিউ; একদিকে ক্লায়েন্ট কল, অন্যদিকে জ্যোতিষ ব্যাখ্যা! কিন্তু তাপস বাবু নিজে ছিলেন পুরোদস্তুর যুক্তিবাদী—ডেটা ছাড়া বিশ্বাস করেন না কিছুতেই। “প্রমাণ দাও, তবেই মানব”—এই ছিল তার মূলমন্ত্র। সেই তিনিই একদিন নিজের চোখে এমন কিছু দেখলেন, যা তাকে নিজের যুক্তি নিয়েই সন্দেহে ফেলে দিল।

সেই বুধবার সকাল থেকেই তাপস বাবুর মাথাব্যথা হচ্ছিল। একাধিক মিটিং, পেন্ডিং ডেলিভারি, আর একটা অনবরত বেজে চলা গ্রুপ কল—সব মিলিয়ে মাথাটা যেন কেমন ভার হয়ে উঠছিল। কেবিনে বসে ঠাণ্ডা জল খাচ্ছিলেন, তখনই হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। তপন কুমার ওঝা ঢুকলেন হাতে ছোট একটি কাঁচের পাত্র, তাতে রাখা তুলসীপাতা, অল্প গঙ্গাজল, আর একটা ছোট তাবিজ। “বস, আজ আপনার চন্দ্র ও কেতু একসাথে ষষ্ঠ ঘরে প্রবেশ করেছে। তাই আপনার মাথায় চাপ পড়ছে।” তাপস বাবু প্রথমে কিছু বললেন না—মাথাব্যথা নিয়ে তান্ত্রিক ব্যাখ্যায় তার বিশ্বাস ছিল না। তপন পাত্রটা ডেস্কে রেখে বললেন, “এই গঙ্গাজলটা হাতে ছুঁয়ে ফেলুন, আর এটা”—তাবিজ দেখিয়ে—“ল্যাপটপ ব্যাগে রেখে দিন, আপনার মস্তিষ্ক চক্রের ভার হালকা হবে।” বস কিছু না বলে শুধু মৃদু হাসলেন, কিন্তু তপনের চোখে সেই আত্মবিশ্বাস, সেই বিশ্বাসে পূর্ণ ত্রাণকর্তার ভঙ্গি দেখে তিনি কিছুতেই “না” বলতে পারলেন না। নিজের ব্যাগের সাইড পকেটে তাবিজ রেখে দিলেন, নিছক ‘মান রেখে’ কাজটা করলেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, দুপুর নাগাদ তার মাথার ভার একটু কমে এল, মন হালকা লাগতে শুরু করল।

পরদিন সকালে অফিসে ঢুকে দেখলেন, তপন নিজের ডেস্কে বসে “প্রজেক্ট ম্যানেজারদের জন্য গ্রহ বিন্যাস” শিরোনামে কিছু টাইপ করছেন। তাপস বাবু হাসতে হাসতে বললেন, “তপনবাবু, কাল তো আপনি আমার headache-এর আগে থেকেই চন্দ্র-কেতুর কথা বলেছিলেন। আজ আবার কিছু দেখা যাচ্ছে?” তপন বললেন, “আজ আপনি একটু সতর্ক থাকবেন। বৃহস্পতিবারে বৃহস্পতি উত্তরের দিকে থাকলে ই-মেইল মিসকমিউনিকেশন হয়।” তাপস বাবু হেসে বলেন, “তাই বুঝি কাল দুপুরে ক্লায়েন্ট ইমেইলে ভুল ফাইল গেছিল!” সে মুহূর্তে কথাটা নিছক ঠাট্টা ছিল, কিন্তু ঠিক তিন ঘণ্টা পরে যখন জার্মান ক্লায়েন্টের রিপ্লাই আসে—“Incorrect attachment received”—তাপস বাবুর মুখে হালকা একটা বিস্ময় ফুটে ওঠে। তিনিই তো নিজে চেক করে পাঠিয়েছিলেন! অফিসের ভেতরে যেন নিঃশব্দে একটা রহস্য খেলে গেল—তপন যা বলছে, তার সবই কি নিছক কাকতাল, না কি এর পেছনে সত্যিই আছে অজানা কিছু?

এ ঘটনার পরে বস তপনের কাজ বন্ধ করেননি, বরং তাকে অফিসে ‘মেন্টাল ওয়েলনেস অ্যাম্বাসাডর’ বানানোর কথা ভাবেন। যদিও মুখে বলেন, “এসব তো শুধু মজা,” কিন্তু তপনের উপদেশ না শুনে এখন তিনি আর কোনো মেইল পাঠান না। এদিকে তপনও নিজের খাতায় বসের রাশিফল সংরক্ষণ করছেন, যাতে সময়মতো ‘সতর্কতা’ দিতে পারেন। অফিসে একটা অলিখিত নতুন নীতি চালু হয়েছে—“জাভাস্ক্রিপ্টের আগে জ্যোতিষ, পুশ করার আগে পুজো।” আর তাপস বাবু? তিনি এখনো যুক্তিবাদী, কিন্তু ডান পকেটে সেই ছোট তাবিজটা আজও গোপনে বহন করে চলেছেন।

অধ্যায় ৫: প্রিন্টার পূর্ণিমার পেনাল্টি

সকালের অফিস মানেই কিছু না কিছু ঝামেলা। কে হঠাৎ রাতেই ডেডলাইন বাড়িয়ে দিল, কার কোড আবার অটোপুশ হয়ে গেছে, কোন টিকিট QA থেকে ফিরল—এইসব নিয়েই আইটি টিমের সকালের শিফট শুরু হয়। কিন্তু আজকের সকালটা একটু বেশি নাটকীয় ছিল। অফিসের পুরো প্রিন্টার সিস্টেম কাজ করছে না। HR, Accounts, এমনকি Admin টিমের ফাইলও আটকে আছে। প্যানিক ছড়িয়ে পড়েছে এমনভাবে, যেন প্রিন্টার বন্ধ মানেই কাজ বন্ধ। দেবলীনা তিনবার চেস্ট করে হাল ছেড়ে বসে পড়েছে, রাকেশ পোর্টাল রিস্টার্ট করছে, আর অর্চনা তো বলেই ফেলল, “মনে হচ্ছে সার্ভারেই ভূতের বাসা!” ঠিক তখনই তপন কুমার ওঝা স্টোর রুম থেকে ধোঁয়া উড়িয়ে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বেরোলেন, হাতে একটি ছোটো ঝাঁটা, গলায় লাল গামছা। দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “এই মূহূর্তে এই প্রিন্টারে চন্দ্র-রাহুর প্রবল সংঘর্ষ চলছে। কাল পূর্ণিমা ছিল—আজ প্রভাব সর্বোচ্চ।” সবাই মনে করল, বুঝি আবার নতুন নাটক শুরু হলো, কিন্তু কেউ চুপ করেও রইল না।

তপনের হাতে ছিল একটি হলুদ পাতার ফাইল, যেখানে অফিসের প্রিন্টার ব্যবহারের লগ টাইম অনুযায়ী তার বানানো “গ্রহ দোষ বিশ্লেষণ চার্ট”। তিনি বললেন, “দেখুন, ঠিক যেই সময়ে ইস্যু শুরু হয়েছে, সেই মুহূর্তে সূর্য ও মঙ্গল একত্র হয়েছে দ্বাদশ ঘরে। এটা বিদ্যুৎ পরিবাহিত যন্ত্রের পক্ষে অশুভ।” তার কথার মাঝে কেউ কেউ হেসে ফেললেও, বস তাপস বাবু জানালেন, “আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি আপনার মতো করে একবার চেষ্টা করে দেখুন।” তখন তপন প্রিন্টারের সামনে ছোট করে ধূপকাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন—“ওঁ ইনকজেটায় নমঃ!” তারপর ধীরে ধীরে এক এক করে প্রিন্টার কভার খুললেন, যেন পুজোর ঢাকে ঢাক বাজিয়ে অন্ধকার থেকে আলো তোলার আচার চলছে। ঠিক তখনই ক্লিনিং স্টাফ রামু এসে বলল, “আরে বাবু, কাল ঝাড়ু দিতে গিয়ে প্রিন্টার পিছনের তার খুলে গেছিল, লাগিয়ে দিচ্ছি।” একটা ক্লিক, তারপর হঠাৎই প্রিন্টারের স্ক্রিনে সবুজ আলো জ্বলে উঠল, আর পরপর কাগজ বেরোতে শুরু করল। চারদিকে খুশির হালকা চিৎকার—যেন কোনও অলৌকিক মুহূর্তের সাক্ষী হল সবাই।

এই ঘটনার পর অফিসে তপনের সম্মান যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেল। প্রিন্টার ঠিক হয়েছে—তাতে তার প্রযুক্তিগত কোনো ভূমিকা না থাকলেও, টাইমিং আর বিশ্বাসের কাকতালীয় সমান্তরালতায় তিনি হয়ে উঠলেন “প্রিন্টিং সমস্যার প্রেততাড়ক”। Accounts টিমের এক সিনিয়র তো সিরিয়াসলি বলেই ফেলল, “আগামী মাসের স্যালারি স্লিপ যেন ওঝা বাবুর আশীর্বাদ নিয়ে প্রিন্ট হয়!” তপন নিজেও এই ‘সাফল্যে’ আত্মবিশ্বাসে ভরে উঠল। বিকেলে চা খেতে খেতে বলল, “এই সব যন্ত্র মানুষের মন বুঝে চলে। প্রিন্টারের মধ্যে আকারে ছোট হলেও আত্মা থাকে।” সবাই হেসে ফেললেও কেউ আর ওঝা বাবুর কথা একেবারে উড়িয়ে দেয় না। HR একটা নতুন নোটিশ দিল—“Print Request Before 12 PM on Full Moon Days”, যেটা কেউই জানে না ঠিক কাদের জন্য বানানো। অফিসে এখন এমন একটা পরিমণ্ডল—যেখানে জ্যোতিষ, তন্ত্র আর টেক একসাথে চলতে শুরু করেছে, এবং তার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন এক ওঝা—তপন কুমার, যিনি আসলে প্রিন্টারের কেবল ঢোকানো না ঢোকানোর ফাঁকে ফাঁকে ভবিষ্যৎও বলে দিচ্ছেন।

অধ্যায় ৬: হসপিটালিটিতে হানিমুন

ইস্টার্ন ক্লাউডওয়েভ সলিউশনস-এর কনফারেন্স রুমে আজ সাজসাজ রব। অর্চনার বিয়ে ঠিক হয়েছে, এবং লাঞ্চ ব্রেকে বসছে তার “Pre-Wedding Blessing Ceremony”—অফিস ভার্সনে। সবাই মিলে মিষ্টি এনেছে, বস তাপস বাবু অর্ডার করেছেন একগাদা পিৎজা আর রোল, আর আইটি টিম এনেছে একটা ছোট কেক যেখানে লেখা—“May Your Wi-Fi Always Connect!” তবে এই ঘরোয়া অফিস-সেলিব্রেশনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছেন কে জানো? হ্যাঁ, আমাদের তপন কুমার ওঝা বাবু। কারণ বিয়ের ডেট নির্বাচনটা যে তারই করা! অর্চনার মা কালীঘাট থেকে পণ্ডিত ডেকে এনেছিলেন, কিন্তু তিনি যখন বলেছিলেন, “আগামী মাসে মঙ্গল আছে, বিয়েটা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঠেলে দিন,” তখন অর্চনার মুখ কুঁচকে গিয়েছিল। ওদিকে তপন কুমার বললেন, “এই মাসের ১৪ তারিখ, শনিবার—একটা অসাধারণ যোগ। শুক্র পবিত্র, মঙ্গল অনুকূল, আর গ্রহের ভার্সন আপডেট হয়েছে সদ্য। সোনার সময়!” এবং অর্চনার মা আশ্চর্যজনকভাবে তপনের পরামর্শই মানেন। বিয়ের তারিখ ঠিক হয় তপনের ক্যালেন্ডার দেখে।

তবে বিয়ের পর সপ্তাহ পেরোতেই অফিসে ফিরে আসা অর্চনার মুখে শোনা গেল এক ভিন্ন গল্প। “স্যার, আপনি তো বলেছিলেন, এই তারিখ শুভ। কিন্তু বিয়ের দিন সন্ধ্যায় যখন শ্বশুরবাড়ির এলইডি বাতি ফেটে গেল, তখন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বলল, ‘এই তারিখে বিয়ে মানেই পবনদোষ’। তারপর আবার যেই আমি চা দিতে গেলাম, প্রেসার কুকার ফুটে মেঝেতে পড়ে যায়। শাশুড়ি বলল, আমি বুঝি নিজের গ্রহ সঙ্গে করে নিয়ে গেছি!” অফিসে হেসে পড়ে সবাই, কিন্তু তপন সিরিয়াস মুখে বললেন, “এই সবই হল চন্দ্রের কৌশল। আমি বিয়ের সময় বলেছিলাম, রাহুর ক্ষণ এড়িয়ে চলতে। তুমি নিশ্চয়ই সন্ধ্যাবেলায় লাইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলে?” অর্চনা একটু হেসে মাথা নাড়ল, কিন্তু মনে মনে ঠিক বুঝতে পারল না—এই লোকটা মজা করছে, না সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করে এসব।

তারপর ঘটল আরও মজার ঘটনা। তপন অফিসে নিজের ডেস্কে বসে ‘নবদম্পতির গ্রহ পুনর্মিলন বিশ্লেষণ’ তৈরি করল, যাতে বোঝানো হচ্ছে বিয়ের পর প্রথম ২১ দিন কী কী এড়াতে হবে—একসঙ্গে ফাইল আপলোড, একসাথে রাইড শেয়ার, আর একসাথে মেসেজে ‘OK’ লেখা। এসব দেখে শুভ্র আর দেবলীনা মিলে নতুন একটা গেম বানায়—“Grash-Tag”, যেখানে অফিসের প্রতিদিনকার ছোটখাটো ঘটনাকে জ্যোতিষ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হয়। প্রথমেই প্রশ্ন ছিল: “দেবলীনার মেইল তিনবার বাউন্স করল কেন?” উত্তর: “তার জন্মছকে বুধ দুর্বল।” পরের প্রশ্ন: “শুভ্রর কানেকশন বারবার ড্রপ হচ্ছিল কেন?” উত্তর: “সে শুক্রবার সাদা শার্ট পরেছিল, যা শনির বিরুদ্ধে।” মজার বিষয়, অফিসের প্রায় সবাই গেমটা খেলতে শুরু করে। আর তপন কুমার ওঝা? তিনি গম্ভীর মুখে বলেন, “দেখলেন তো, জ্যোতিষের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আমি এখন টেক গেমের মডেল হয়ে উঠেছি!”

এইসবের মাঝেই তপনের খ্যাতি আবার নতুন রূপ নেয়—এবার তিনি শুধু ‘টেকনোলজিক্যাল ওঝা’ নন, অফিসের ‘ম্যারিটাল অ্যাডভাইজর’ হিসেবেও খ্যাত। হঠাৎ একদিন দেখাই গেল, হিউম্যান রিসোর্সেস থেকে একজন এসে জিজ্ঞেস করছে, “স্যার, আমার বরের সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ ঝগড়া হচ্ছে। আপনি কি Birth Chart দেখে বলতে পারবেন, সমস্যা কোন গ্রহে?” তপন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “মা, আমি শুধু সফটওয়্যার আর গ্রহের হ্যাং নিয়ে কাজ করি—হার্ডওয়্যার ইস্যু আমি দেখি না।” আর এই সংলাপেই অফিসে হাসির ঝড় উঠল। তবে এসব ঘটনার মাঝেও একটা জিনিস নিশ্চিত—তপন কুমার এখন অফিসের পরামর্শদাতা, ভবিষ্যদ্বক্তা, হাল্কা বিনোদনের উৎস এবং মাঝে মাঝে, আশ্চর্যজনকভাবে, সঠিকও। আর Eastern Cloudwave Solutions? সেখানে এখন কোনো টিকিট রেজলভ হওয়ার আগেই দেখা হয়—আজ কে কোন গ্রহে দাঁড়িয়ে!

অধ্যায় ৬: হসপিটালিটিতে হানিমুন

ইস্টার্ন ক্লাউডওয়েভ সলিউশনস-এর কনফারেন্স রুমে আজ সাজসাজ রব। অর্চনার বিয়ে ঠিক হয়েছে, এবং লাঞ্চ ব্রেকে বসছে তার “Pre-Wedding Blessing Ceremony”—অফিস ভার্সনে। সবাই মিলে মিষ্টি এনেছে, বস তাপস বাবু অর্ডার করেছেন একগাদা পিৎজা আর রোল, আর আইটি টিম এনেছে একটা ছোট কেক যেখানে লেখা—“May Your Wi-Fi Always Connect!” তবে এই ঘরোয়া অফিস-সেলিব্রেশনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছেন কে জানো? হ্যাঁ, আমাদের তপন কুমার ওঝা বাবু। কারণ বিয়ের ডেট নির্বাচনটা যে তারই করা! অর্চনার মা কালীঘাট থেকে পণ্ডিত ডেকে এনেছিলেন, কিন্তু তিনি যখন বলেছিলেন, “আগামী মাসে মঙ্গল আছে, বিয়েটা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঠেলে দিন,” তখন অর্চনার মুখ কুঁচকে গিয়েছিল। ওদিকে তপন কুমার বললেন, “এই মাসের ১৪ তারিখ, শনিবার—একটা অসাধারণ যোগ। শুক্র পবিত্র, মঙ্গল অনুকূল, আর গ্রহের ভার্সন আপডেট হয়েছে সদ্য। সোনার সময়!” এবং অর্চনার মা আশ্চর্যজনকভাবে তপনের পরামর্শই মানেন। বিয়ের তারিখ ঠিক হয় তপনের ক্যালেন্ডার দেখে।

তবে বিয়ের পর সপ্তাহ পেরোতেই অফিসে ফিরে আসা অর্চনার মুখে শোনা গেল এক ভিন্ন গল্প। “স্যার, আপনি তো বলেছিলেন, এই তারিখ শুভ। কিন্তু বিয়ের দিন সন্ধ্যায় যখন শ্বশুরবাড়ির এলইডি বাতি ফেটে গেল, তখন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বলল, ‘এই তারিখে বিয়ে মানেই পবনদোষ’। তারপর আবার যেই আমি চা দিতে গেলাম, প্রেসার কুকার ফুটে মেঝেতে পড়ে যায়। শাশুড়ি বলল, আমি বুঝি নিজের গ্রহ সঙ্গে করে নিয়ে গেছি!” অফিসে হেসে পড়ে সবাই, কিন্তু তপন সিরিয়াস মুখে বললেন, “এই সবই হল চন্দ্রের কৌশল। আমি বিয়ের সময় বলেছিলাম, রাহুর ক্ষণ এড়িয়ে চলতে। তুমি নিশ্চয়ই সন্ধ্যাবেলায় লাইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলে?” অর্চনা একটু হেসে মাথা নাড়ল, কিন্তু মনে মনে ঠিক বুঝতে পারল না—এই লোকটা মজা করছে, না সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করে এসব।

তারপর ঘটল আরও মজার ঘটনা। তপন অফিসে নিজের ডেস্কে বসে ‘নবদম্পতির গ্রহ পুনর্মিলন বিশ্লেষণ’ তৈরি করল, যাতে বোঝানো হচ্ছে বিয়ের পর প্রথম ২১ দিন কী কী এড়াতে হবে—একসঙ্গে ফাইল আপলোড, একসাথে রাইড শেয়ার, আর একসাথে মেসেজে ‘OK’ লেখা। এসব দেখে শুভ্র আর দেবলীনা মিলে নতুন একটা গেম বানায়—“Grash-Tag”, যেখানে অফিসের প্রতিদিনকার ছোটখাটো ঘটনাকে জ্যোতিষ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হয়। প্রথমেই প্রশ্ন ছিল: “দেবলীনার মেইল তিনবার বাউন্স করল কেন?” উত্তর: “তার জন্মছকে বুধ দুর্বল।” পরের প্রশ্ন: “শুভ্রর কানেকশন বারবার ড্রপ হচ্ছিল কেন?” উত্তর: “সে শুক্রবার সাদা শার্ট পরেছিল, যা শনির বিরুদ্ধে।” মজার বিষয়, অফিসের প্রায় সবাই গেমটা খেলতে শুরু করে। আর তপন কুমার ওঝা? তিনি গম্ভীর মুখে বলেন, “দেখলেন তো, জ্যোতিষের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আমি এখন টেক গেমের মডেল হয়ে উঠেছি!”

এইসবের মাঝেই তপনের খ্যাতি আবার নতুন রূপ নেয়—এবার তিনি শুধু ‘টেকনোলজিক্যাল ওঝা’ নন, অফিসের ‘ম্যারিটাল অ্যাডভাইজর’ হিসেবেও খ্যাত। হঠাৎ একদিন দেখাই গেল, হিউম্যান রিসোর্সেস থেকে একজন এসে জিজ্ঞেস করছে, “স্যার, আমার বরের সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ ঝগড়া হচ্ছে। আপনি কি Birth Chart দেখে বলতে পারবেন, সমস্যা কোন গ্রহে?” তপন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “মা, আমি শুধু সফটওয়্যার আর গ্রহের হ্যাং নিয়ে কাজ করি—হার্ডওয়্যার ইস্যু আমি দেখি না।” আর এই সংলাপেই অফিসে হাসির ঝড় উঠল। তবে এসব ঘটনার মাঝেও একটা জিনিস নিশ্চিত—তপন কুমার এখন অফিসের পরামর্শদাতা, ভবিষ্যদ্বক্তা, হাল্কা বিনোদনের উৎস এবং মাঝে মাঝে, আশ্চর্যজনকভাবে, সঠিকও। আর Eastern Cloudwave Solutions? সেখানে এখন কোনো টিকিট রেজলভ হওয়ার আগেই দেখা হয়—আজ কে কোন গ্রহে দাঁড়িয়ে!

অধ্যায় ৭: ওঝা বনাম ওয়াই-ফাই

সপ্তাহের মাঝামাঝি বিকেলে অফিসে হঠাৎ করে ধীরগতির ইন্টারনেট নিয়ে সবেমাত্র চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিনের মতো কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল, কেউ ওয়েবসাইট খুলতে পারছে না, কোড পুশ আটকে যাচ্ছে, আর ভিডিও কনফারেন্সে ঝিঁঝিঁ শব্দের সঙ্গে লেগে আছে অবিরাম ফ্রিজিং। অফিসের পুরো দল একসাথে বসে নিজেদের ল্যাপটপ চেক করতে লাগল, কিন্তু সমস্যার সমাধান দূরের কথা, আরেকটু বেশি জটিল হয়ে উঠল পরিস্থিতি। রাকেশ, যিনি অফিসের আইটি টিমের তরুণ সদস্য, বেশিরভাগ টেকনিক্যাল স্টেপ চেক করে শেষ পর্যন্ত মাথা ঘামাতে থাকলেন।

তপন কুমার ওঝা, যিনি সবসময় প্রযুক্তির সঙ্গে অলৌকিক শক্তির মিশেলে সমস্যার সমাধান করেন, এবারও কিছু আলাদা করলেন। তাঁর হাতে ছিল এক জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় হাতা থেকে নাড়া একটি ছোট পেনড্রাইভ। এক হাতে ধূপকাঠি, অন্য হাতে পেনড্রাইভ নিয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, “এখানে স্পষ্টতই রাহুর প্রভাব আছে, ওয়াই-ফাই-তে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। এই জিনিসটা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছে।” সহকর্মীরা প্রথমে তপনের কথায় অবাক হলেও, লম্বা দিন ওয়াই-ফাইয়ের অবস্থা দেখে কেউ যেন তাকে ঠাট্টা করতেই পারল না। “ওঁ, ওঁ, সংযোগ রক্ষার্থে এই মন্ত্র পড়তে হবে!” বলেই তিনি ধূপ জ্বেলে, পেনড্রাইভের উপর থেকে চার বার বৃত্তাকারে হাত সরাতে লাগলেন।

রাকেশ তখন নীচু গলায় মৃদু বলল, “স্যার, আসলে রাউটারটা ওভারলোডেড। অনেক ল্যাপটপ একই সাথে কানেক্ট হয়েছে। একটু কম লোড দিলে সমস্যা থাকবে না।” কিন্তু তপন তখন মন্ত্রপঠনে এতটাই মনোযোগী হয়ে গিয়েছিলেন যে এই যুক্তিবাদী কথাগুলো শুনতে পাননি। তারপর অফিসের এক কোণে বসে থাকা শুভ্র দেখল, রাউটার থেকে একটি ক্যাবল খসে গেছে! দৌড়ে গিয়ে সেটি আবার ঠিক করল। আশ্চর্যজনকভাবে, সঙ্গে সঙ্গেই অফিসের Wi-Fi ফাস্ট হয়ে গেল। সবাই অবাক। কেউ বুঝল না, আসলে কী ঘটল—তপনের তন্ত্র নাকি রাকেশের ল্যান ক্যাবলের সংযোগ!

ওঝা বাবু শান্ত গলায় বললেন, “প্রকৃতি ও প্রযুক্তি এক নয়, কিন্তু চলতে হবে একসঙ্গে। আমার মন্ত্র আর তোমার ক্যাবল—এভাবেই টেকনোলজির জগত চলতে থাকে।” অফিসে এখন এই ঘটনা নিয়ে নতুন কৌতুক গড়ে উঠল। কেউ বলল, “ওঝা বাবুর মন্ত্রের সাথে আমাদের আইটি গাইয়ের হাতের কাজ মিলে গেলে ভালো।” আর কেউ হাসতে হাসতে বলল, “আগামী বার অফিসে ওঝা বাবুর সাথে রাকেশকে লিড হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হোক, টিম হবে ‘ওঝা-IT’। ”

এই ঘটনার পর থেকে তপন ওঝার প্রতি অফিসের ভালোবাসা আরো বেড়ে গেল। কেউ ফোনে সমস্যার কথা বললেই তাঁকে মজার ছলে জিজ্ঞেস করত, “স্যার, আজ কি গ্রহ পাল্টেছে? ওয়াই-ফাই আবার ধরা দিয়েছে?” আর তপন গম্ভীর মুখে হাসি দিয়ে বলতেন, “মহাজগতের শক্তি বুঝতে পারলে প্রযুক্তি চালানো সহজ।” আর অফিসের সবাই জানত, ওঝা বাবুর এক হাতের তন্ত্র আর অন্য হাতের টেকনোলজি, মিলেমিশে এই Eastern Cloudwave Solutions কে অন্য রকম করে তুলেছে।

অধ্যায় ৮: ক্লায়েন্ট কল আর ক্লান্তির ক্রুশ

সপ্তাহের শেষ দিন, অফিসে সবাই ক্লান্ত। ক্লায়েন্টদের লেগে থাকা চিঠি, শেষ মুহূর্তের রিভিউ আর একটানা কাজের চাপ এখন সবাইকে বেশ রোবট বানিয়ে দিয়েছে। আর সেই ক্লান্তি চোখে পড়ছে বস তাপস বাবুর মুখেও। ঠিক তখনই তপন কুমার ওঝা নিজের হাতে একটি ছোট্ট জবাবদিহি বই নিয়ে এলেন। বইয়ের মুখে লাল রঙের লেখা—“মনোবল বাড়ানোর মন্ত্রমালা”।

তপন বললেন, “বস, অফিসের মানসিক চাপ কমাতে এই মন্ত্রমালা খুব কাজে দেবে। প্রতিদিন সকালে পাঁচ মিনিট পড়বেন, তারপর কাজ শুরু করবেন। এতে ক্লায়েন্ট কল আর ক্লান্তি দুটোই হালকা হবে।” বস প্রথমে সন্দেহ করলেন, “তপনবাবু, আমার তো মনে হয় এইসব মন্ত্র আমার কাজের সাথে মানায় না।” তপন সরল চোখে বললেন, “স্যার, মানে এই নয় যে আমরা প্রযুক্তির সঙ্গেই আছি, মনের সঙ্গেও থাকতে হবে। কোড ভালো লিখতে হলে মন শান্ত থাকতে হবে।”

বছরের সবচেয়ে চাপের দিনেও তপন অফিসে এসে সবাইকে একটু হাসি উপহার দিতেন। তার মুখে ছিল এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস, যেন বলছেন, “প্রতিটি সমস্যার মধ্যে একটা সমাধান লুকিয়ে আছে—শুধু তার সন্ধান পেতে হবে।” বিকেলে একবার অফিসের সবাই মিলে চা খেতে বসে, শুভ্র হেসে বলল, “ওঝা বাবু, আপনার মন্ত্রমালা যদি আমাদের বাগ গুলোও ফিক্স করতে পারে, তাহলে তো বড় ব্যাপার!” সবাই হাসি দিল। তপন হাসতে হাসতে বললেন, “মন্ত্রমালা তো শুধু একটা গাইডলাইন, কাজের মধ্যেই আসল জাদু।”

সেদিনের শেষে বস তাপস বাবু নিজেও বুঝলেন, অফিসে শুধু প্রযুক্তি আর ডেটা চালাতে পারবে না—একটু মজা, একটু বিশ্বাস আর একটু আধ্যাত্মিকতা দরকার। আর সেই মিশেলে তপন কুমার ওঝা একেবারে নির্ভুলভাবে কাজ করছিলেন। অফিসের ক্লান্তির মাঝে এক নতুন আশার আলো জ্বালিয়ে দিতে, একজন ‘ওঝা বাবু’ প্রয়োজন। আর সেই ‘ওঝা বাবু’ ছিলেন তপন, যিনি প্রযুক্তির বাইরেও দেখতে পারতেন। আর তাই, Eastern Cloudwave Solutions শুধু একটা আইটি অফিস নয়, একটা ছোট্ট পরিবার হয়ে উঠেছিল, যেখানে একসঙ্গে কাজ আর হাসির জোয়ার বইত।

অধ্যায় ৯: অফলাইনে ওঝা, অনলাইনে কন্ট্রোল

সপ্তাহের শুরুতে অফিসে নতুন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়—ওয়েবক্যাম কল, ভার্চুয়াল মিটিং, আর Zoom ও Google Meet-এর মাঝে কাজ করার চাপ। কোভিড পরবর্তী সময়ে অফিসের অনেকেই কাজ করতে থাকলেন ঘরে বসে, কিন্তু Eastern Cloudwave Solutions-এর দলের সঙ্গে তপন কুমার ওঝার সংযোগ যেন কমে না। তিনি যদিও প্রযুক্তিতে এতটাই দক্ষ নন, তবে নিজের আধ্যাত্মিক দক্ষতা দিয়ে ভার্চুয়াল অফিসকে ‘অফিসিয়াল ওঝা’ হিসেবে চালিয়ে যাচ্ছেন।

একদিন অফিসে যখন ল্যাপটপের ক্যামেরা ঠিকঠাক কাজ করছিল না, সবাই হতাশ, তখন তপন বললেন, “ওঁ হ্রীং গ্রীং… আপনার কম্পিউটারের ক্যামেরা আজ ‘অন্ধকার মুণ্ডল’ অবস্থায় আছে। একটু পবিত্র গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিন, তারপর ব্যাকগ্রাউন্ড মুছে ফেলুন।” সবাই হাসল, কিন্তু চ্যালেঞ্জের কথা শুনে অফিসের প্রযুক্তিবিদ রাকেশ এসে বলল, “স্যার, আসলে ক্যামেরার ড্রাইভার আপডেট দরকার।” কিন্তু তপন তখনও বিশ্বাস করছিলেন তার মন্ত্রের শক্তিতে।

ঘরে বসে কাজ করার সময়, ভার্চুয়াল কলের মাঝে তপন মাঝে মাঝে মাইক্রোফোন বন্ধ করে রাখেন এবং হাত দিয়ে ধূপের মন্ত্র পাঠ করতে থাকেন, যেন রিমোট ডেস্কটপের বাইরে থেকে অফিসের মন ভালো রাখছেন। ভার্চুয়াল অফিসে তপনের উপস্থিতি যেন একটি “স্পিরিচুয়াল ফায়ারওয়াল” হয়ে দাঁড়ায়, যেটা সব ধরনের ডিজিটাল বিভ্রাট থেকে অফিসকে রক্ষা করে। সহকর্মীরা মজা করে বলেন, “তপনবাবু আছে বলে আমাদের Zoom আর Slack কাজ করে।” আর তপন হাসে, “যন্ত্রের পাশেও শক্তি আছে, সে শক্তিকে সম্মান করতে হয়।”

ভার্চুয়াল অফিসের এই সময়ে, Eastern Cloudwave Solutions অফিসের সবাই বুঝতে পারল—যতই ডিজিটাল হোক, মানুষের মাঝে মজা, বিশ্বাস আর আধ্যাত্মিকতা ছাড়া কাজ কখনোই সুষ্ঠু হয় না। আর এই বিশ্বাসের সঙ্গে অফিস চালাচ্ছেন তপন কুমার, যিনি অফলাইনে ‘ওঝা বাবু’, অনলাইনে ‘ডিজিটাল ডেটা ওঝা’। তার এই দুই জগতের মিলেই অফিসের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে আনন্দ আর সাফল্যের পথে।

অধ্যায় ১০: লগআউটের আগে আশীর্বাদ

Eastern Cloudwave Solutions-এর ক্যান্টিনে বিকেলের আলো পড়ে আছে জানালার কাঁচে। মিষ্টি হাওয়া বইছে, আর অফিসের পরিবেশও আজ একটু অন্যরকম। কারণ তপন কুমার ওঝা—অর্থাৎ সকলের প্রিয় “ওঝা বাবু”—অবশেষে অফিস ছাড়ছেন। তাঁর পাঁচ বছরের কর্মজীবন শেষ করে তিনি যাচ্ছেন শান্তিনিকেতনে, এক আশ্রমে, যেখানে প্রযুক্তি নেই, শুধু প্রকৃতি আছে। খবরটা শুনে পুরো অফিস চুপচাপ, যেন কেউ খুব প্রিয় একজনকে হারাতে বসেছে। অথচ যাঁকে নিয়ে এত হাসাহাসি, ঠাট্টা, বিশ্বাস আর সন্দেহ ছিল, তিনিই আজ অফিসের অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছেন।

তপনের বিদায় উপলক্ষে কনফারেন্স রুমে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। কেউ একটি পোস্টার বানিয়েছে: “You debugged our hearts.” কেউ আবার নিয়ে এসেছে এক খানা মাউস—যার তার কেটে তাতে বাঁধা হয়েছে এক লাল গামছা, ঠিক তপনের স্টাইলেই। দেবলীনা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “স্যার, আপনি না থাকলে আমার গ্রহের দোষ কে পরিষ্কার করবে?” অর্চনা চোখে জল নিয়ে বলে, “আমার বিয়ের ডেট, আমার প্রিন্টার, আমার প্রথম প্রমোশন—সবেতেই আপনি ছিলেন।” এমনকি বস তাপস বাবুও হাসিমুখে বললেন, “তপনবাবু, আমি তো আপনাকে প্রজেক্ট ম্যানেজার বানাতে চেয়েছিলাম—কোড না বোঝেন, কিন্তু মানুষ বোঝেন ভালো!”

তপন নিজের বিদায়বেলায় গম্ভীর গলায় বললেন, “যত প্রযুক্তি সামনে আসবে, তত মানুষ নিজের ভেতরের বিশ্বাস হারাতে থাকবে। আমি শুধু বলব, প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন অন্তর ফোনটা বন্ধ করে মন খুলে এক কাপ চা খান। যন্ত্রে নয়, মানুষের সঙ্গে সংযোগ রাখুন। তাহলেই প্রযুক্তিও আপনাকে বিশ্বাস করবে।” কেউ কেউ হেসে ফেলল, কেউ মাথা ঝাঁকাল। তারপর তপন একটা ছোট ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের সবার জন্য একটা ছোট আশীর্বাদ রেখে যাচ্ছি—জীবনে যতই ‘বাগ’ আসুক, তোমাদের ‘মনিটর’ যেন কখনো ব্লু-স্ক্রিন না দেখায়।”

তার বেরিয়ে যাওয়ার পর অফিসের জানালা দিয়ে হালকা রোদ এসে পড়ে তার ফাঁকা ডেস্কে। সেই ডেস্কের ওপর এখনো পড়ে আছে রুদ্রাক্ষের মালা, ছোট এক পেন্ড্রাইভ, আর একটি কাগজে লেখা—
“পৃথিবীতে যত সংকেত, তার বাইরেও কিছু স্পন্দন থাকে। তা বুঝতে হলে শুধু কান না, মন খোলা রাখতে হয়।”

তপনের অনুপস্থিতিতে অফিস আবার চলতে শুরু করে। ইন্টারনেট কখনো ধীর হয়ে যায়, প্রিন্টার মাঝে মাঝে কাজ করে না, ক্লায়েন্ট মেইল দেরিতে আসে। কিন্তু এসবের মাঝেও কেউ একজন গলা নামিয়ে বলে ওঠে, “আজ ওঝা বাবু থাকলে একটা গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলে হয়ত ঠিক হয়ে যেত!”
আর এভাবেই, Eastern Cloudwave Solutions-এর ইতিহাসে থেকে যায় এক ব্যতিক্রমী চরিত্র—তপন কুমার ওঝা, যিনি টেক সাপোর্টের চেয়ে অনেক বেশি ছিলেন—একজন বিশ্বাস নির্মাতা, একজন আধ্যাত্মিক সহকর্মী, আর একজন সত্যিকারের অফিসিয়াল “ওঝা বাবু”।

***

1000038738.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *