Bangla - প্রেমের গল্প

অপ্রকাশিত ভালোবাসা

Spread the love

ঋতম ঘোষ


এক

নতুন অফিসে প্রথম দিনটা যেন এক অচেনা জগতে প্রবেশ করার মতো ছিল। ভোরবেলা থেকেই অদ্ভুত এক উত্তেজনা আর ভয় কাজ করছিল মনে। বাসা থেকে বেরোনোর সময় মায়ের কণ্ঠে আশীর্বাদ শোনার পরও মনে হচ্ছিল, কিছু একটা বদলাতে চলেছে জীবনের ছন্দে। লিফট থেকে নেমে যখন বিশাল কাচের দরজার সামনে দাঁড়ালাম, তখন দেখলাম ভেতরে ব্যস্ততার সমুদ্র বইছে। প্রত্যেকেই নিজের কাজে নিমগ্ন, কম্পিউটারের কিবোর্ডে আঙুলের শব্দ, ফোন কলের তাড়া, আর মাঝে মাঝে সহকর্মীদের হালকা কথাবার্তা—সব মিলিয়ে এক আলাদা পরিবেশ। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই ডেস্ক দেখিয়ে দেওয়া হলো, আর তখনই তার সঙ্গে প্রথম দেখা। খুব সাধারণ চেহারা, তবে চোখের দৃষ্টি ভিন্নরকম—শান্ত, গভীর, আর যেন কিছু বলতে চায় অথচ থেমে যায়। অফিসের ভিড়ের মধ্যেও তার উপস্থিতি আলাদা করে অনুভব করা যাচ্ছিল, কিন্তু তখনও বুঝিনি, এই মানুষটিই একদিন আমার হৃদয়ের গোপন গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে।
দিনের কাজ শুরু হতেই বোঝা গেল নতুন দায়িত্ব সহজ হবে না। চারপাশে অভিজ্ঞ সহকর্মীরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, ফাইল ঘাঁটছেন, ক্লায়েন্ট কল সামলাচ্ছেন, আর আমি বসে শিখছি নিয়মকানুন। মাঝে মাঝে তিনি সাহায্য করছিলেন, খুব সংক্ষিপ্তভাবে, তবে যথেষ্ট স্পষ্ট করে। তার ভেতরে কোনো বাড়তি গম্ভীরতা ছিল না, আবার অতিরিক্ত মেলামেশার প্রবণতাও চোখে পড়েনি। যেন এক অদ্ভুত ভারসাম্য বজায় রেখে চলেন। দুপুরে ক্যান্টিনে গিয়ে সবাই মিলে বসার সময় তাকেই প্রথমবার হাসতে দেখলাম। সেই হাসি ছিল অনাড়ম্বর, তবে মনে গেঁথে যাওয়ার মতো উষ্ণ। মনে হলো, এত ভিড়ের মধ্যেও এমন কাউকে পাওয়া গেল, যে অন্তত নির্ভরযোগ্য। সেই মুহূর্তে আমি হয়তো কেবল একজন নতুন সহকর্মী হিসেবেই তাকে দেখছিলাম, কিন্তু তার নীরব আচরণে কোথাও যেন একটা অদৃশ্য স্রোত তৈরি হচ্ছিল, যা ভবিষ্যতের গল্পের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
দিনের শেষে কাজ শেষ করে যখন সবাই বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন একা দাঁড়িয়ে ছিলাম নতুন এই পরিবেশটা একটু গুছিয়ে নেবার জন্য। কাগজপত্র গুছিয়ে ডেস্ক ছাড়ার মুহূর্তে তাকেই আবার দেখতে পেলাম। তিনিও হয়তো বেরোতে যাচ্ছিলেন, তবে চোখের কোণে ক্লান্তির ছাপ নিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেলেন, হয়তো ভাবলেন অপ্রয়োজনীয় হবে। কিন্তু সেই মুহূর্তটা যেন অদ্ভুতভাবে মনের ভেতর গেঁথে রইল। প্রথম দিনের সব ভিড়, কাজের চাপ, নতুন অভিজ্ঞতার ভেতরও মনে হচ্ছিল, তার সঙ্গে দেখা হওয়াটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। জানতাম না, এই নিঃশব্দ পরিচয়ের মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে এক অনুচ্চারিত কাহিনি, যা ধীরে ধীরে গড়ে তুলবে অপ্রকাশিত ভালোবাসার আখ্যান।
দুই
দ্বিতীয় দিনের সকালটা আগের মতো অচেনা আর অস্বস্তিকর ছিল না। অফিসে প্রবেশ করার সময় মনে হচ্ছিল, পরিবেশটা ধীরে ধীরে নিজের হয়ে উঠছে। সহকর্মীদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর ডেস্কে বসতেই বুঝলাম আজ কাজের চাপ আরও বেশি। কয়েকটি নতুন প্রজেক্ট হাতে এসেছে, আর বস সরাসরি সবাইকে কাজ ভাগ করে দিয়েছেন। ব্যস্ততার মধ্যেই চোখ চলে গেল পাশের ডেস্কে, যেখানে তিনি শান্তভাবে বসে ছিলেন। নীরবতার ভেতরেও তার ভেতরে এক ধরনের স্থিরতা ছিল, যা চারপাশের তাড়াহুড়োর স্রোতকে যেন ঠেকিয়ে দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে আমার চোখ পড়ে যাচ্ছিল তার দিকে, আর প্রতিবারই মনে হচ্ছিল, কোনো এক অজানা শক্তি যেন আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তবে সেই টান স্বীকার করার সাহস ছিল না, শুধু নীরবে নিজের ভেতরে রেখে দিলাম।
সেদিন দুপুরের লাঞ্চে কিছুটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। অফিস ক্যান্টিনে সবাই মিলে বসা হয়, কিন্তু আজ পাশেই জায়গা হলো তার। একেবারেই হালকা কথোপকথন শুরু হয়েছিল—কাজের চাপ, ক্যান্টিনের খাবার নিয়ে ছোটখাটো ঠাট্টা, আর মাঝে মাঝে অন্য সহকর্মীদের যোগদান। তার কণ্ঠে ছিল ভদ্রতা, তবে একেবারেই নিস্তেজ নয়; বরং একরকম পরিমিত আন্তরিকতা। আমি প্রথমবার বুঝতে পারলাম, তিনি শুধু শান্ত নন, ভেতরে এক ধরনের গভীরতা আছে, যা প্রকাশ করতে তিনি তাড়াহুড়ো করেন না। তার ছোট ছোট হাসি, মাঝেমধ্যে দৃষ্টির বিনিময়, সবকিছুতেই যেন এক অদ্ভুত টান ছিল। লাঞ্চের টেবিল ছাড়ার সময় মনে হচ্ছিল, এই আলাপচারিতা হয়তো তুচ্ছ, কিন্তু আমার ভেতরে অজানা এক সঞ্চার ঘটিয়ে দিয়েছে।
দিন শেষে যখন সবাই একে একে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন অল্প কিছু কাজ বাকি থাকায় আমিও থেকে গেলাম। অফিস প্রায় ফাঁকা হয়ে এলে দেখলাম, তিনিও এখনও আছেন। নীরব কক্ষে দুজনের আলাদা আলাদা ডেস্কে কাজ করার মুহূর্তটা যেন কোনো সিনেমার দৃশ্য হয়ে উঠল। বাতাসে চাপা নিস্তব্ধতা, কম্পিউটারের কিবোর্ডের শব্দ, আর মাঝে মাঝে কাগজ উল্টানোর আওয়াজ—সব মিলিয়ে অদ্ভুত আবহ। হঠাৎ তিনি উঠে এসে আমার ডেস্কে কিছু ফাইল দিলেন, হালকা কণ্ঠে বললেন, “এগুলো আগামীকাল কাজে লাগবে।” খুব সাধারণ একটি বাক্য, কিন্তু তার কণ্ঠে এক ধরনের আন্তরিক উষ্ণতা ছিল। আমি কিছু বলার আগেই তিনি চলে গেলেন, তবে সেই মুহূর্তটিই যেন দীর্ঘ সময় ধরে মনে থেকে গেল। দ্বিতীয় দিনের শেষে আমি বুঝলাম, আমাদের নীরবতার ভেতরেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে এক অদৃশ্য সেতুবন্ধন, যা হয়তো একদিন গল্প হয়ে যাবে।
তিন
তৃতীয় দিনে অফিসের পরিবেশটা আর আগের মতো অচেনা লাগছিল না। এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল সবকিছু, আর সহকর্মীদের সঙ্গেও কিছুটা খোলামেলা ভাব তৈরি হয়েছিল। তবে অদ্ভুতভাবে আমার মন সবসময় তাকেই খুঁজে ফিরছিল। সকালে প্রবেশ করার সময় দরজার ভেতর দিয়ে ঢুকতেই চোখ চলে গেল তার ডেস্কে—শান্তভাবে কম্পিউটারে কাজ করছে, চারপাশের ভিড়ের মধ্যে একদম আলাদা এক স্থিরতা। আমিও নিজের ডেস্কে গিয়ে কাজ শুরু করলাম, কিন্তু মনের ভেতর যেন অকারণ অস্থিরতা। বারবার মনে হচ্ছিল, তাকে একটু কথা বলি, কিছু বলি, অথচ আবার ভয় করছিল অপ্রয়োজনীয় মনে হবে। দিন যত এগোচ্ছিল, ততই বুঝতে পারছিলাম, এই নীরব টান অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কাজের ভিড়ের মধ্যেও অদ্ভুতভাবে তার উপস্থিতি চারপাশের পরিবেশকে অন্যরকম করে দিচ্ছিল।
দুপুরের খাবারের সময়টা এদিন ভিন্নরকম ছিল। সহকর্মীরা হঠাৎ বাইরে খেতে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন, সবাই রাজি হয়ে গেল। একটি ছোট রেস্টুরেন্টে একসাথে বসে হাসি-ঠাট্টার মধ্যে দিন কাটল। টেবিলের অপরপ্রান্তে বসে তিনি খুব একটা কথা বলছিলেন না, তবে মাঝে মাঝে মন্তব্য করছিলেন, যা সবাইকে হাসিয়ে তুলছিল। সেই হাসির ভেতরেই ছিল এক ধরনের পরিমিত বুদ্ধিমত্তা, যা অন্যদের মতো অকারণ কথা না বলে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে প্রকাশ পায়। আমি একেবারেই অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ছিলাম, যেন চুপচাপ তাকে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। খাবারের টেবিলের মাঝেই হালকা এক মুহূর্ত এলো, যখন আমাদের চোখ একবারে মিলল। কয়েক সেকেন্ডের সেই দৃষ্টি যেন অনেক অজানা কথা বলে দিল, অথচ বাইরে থেকে মনে হচ্ছিল খুবই সাধারণ। সেই মুহূর্তে বুঝলাম, ভেতরে ভেতরে আমাদের নীরব যোগাযোগ আরও গভীর হয়ে উঠছে।
অফিসে ফিরে কাজের চাপ আবার শুরু হলো, কিন্তু মনটা বারবার সরে যাচ্ছিল অন্যদিকে। বিকেলের দিকে হঠাৎ একটি ফাইলে ভুল হয়ে গেল আমার। আতঙ্কে ভরে গেলাম, কারণ বস সেটা লক্ষ্য করলে ভালো হতো না। ঠিক তখনই তিনিই এসে ফাইলটা হাতে নিয়ে শান্তভাবে ভুলটা ঠিক করে দিলেন। চোখে-মুখে কোনো বিরক্তির ছাপ ছিল না, বরং অদ্ভুত এক নিশ্চিন্ত ভাব। শুধু বললেন, “এমন ভুল হলে ভয় পেও না, সবাই করে।” সেই বাক্যটুকু যেন মনের ভেতর একরকম সাহস এনে দিল। কাজের দিনের শেষে যখন সবাই বেরিয়ে যাচ্ছিল, আমিও হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে এক অদৃশ্য সখ্যতা গড়ে উঠছে। হয়তো এখনও সেটা বন্ধুত্বের নামেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি বুঝতে পারছিলাম, এই সখ্যতা একদিন অনেক গভীর কিছুতে রূপ নেবে।
চার
চতুর্থ দিনে অফিসে পৌঁছে মনে হচ্ছিল পরিবেশটা এখন অনেকটা নিজের হয়ে গেছে। সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল না, কাজের ছন্দও কিছুটা আয়ত্তে এসেছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি যেন দিন দিন বাড়ছিল—যখনই তাকে দেখি, মনে হয় পৃথিবীর শব্দ থেমে গেছে। তার নীরবতা, তার কাজের প্রতি মনোযোগ, আর মাঝে মাঝে হালকা হাসি—সবকিছুতেই অদ্ভুত এক টান আছে। আজ সকালে বস হঠাৎ করে নতুন একটি প্রজেক্টের দায়িত্ব দিলেন, যেখানে আমার সঙ্গে তাকেও রাখতে হবে। এই খবর শুনেই বুকের ভেতর হালকা দোলা লাগল, যদিও বাইরের মুখে কিছু প্রকাশ করিনি। একসাথে কাজ করার সুযোগ মানে আরও কাছ থেকে তাকে জানার সুযোগ, কিন্তু সেইসাথে ভয়ও ছিল—যদি অতিরিক্ত কিছু প্রকাশ হয়ে যায়!
প্রজেক্টের প্রথম মিটিং-এ আমরা একসাথে বসে কাজের পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করলাম। তিনি খুব শান্তভাবে বিশ্লেষণ করছিলেন, কোথায় কী করতে হবে, কোন সময়সীমায় শেষ করা দরকার, আর কোন ফাইলগুলো আগে সাজানো জরুরি। আমি মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্য করছিলাম, কতটা মনোযোগী আর দক্ষভাবে তিনি কাজ সামলাচ্ছেন। মাঝে মাঝে আমার ভুল হলে তিনি ধৈর্য ধরে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, একটুও বিরক্ত হচ্ছিলেন না। তার এই ভদ্রতা আর আন্তরিকতা যেন আমাকে আরও টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। একসময় খেয়াল করলাম, আমি আর কাজের দিকে ততটা মন দিচ্ছি না, বরং তার কথাবার্তা আর দৃষ্টি লক্ষ্য করছি বেশি। আমার নিজেরই অজান্তে ভেতরে ভেতরে অনুভূতির বীজ বোনা শুরু হয়ে গেছে, যদিও মুখে স্বীকার করার সাহস নেই।
দিনের শেষে কাজের চাপ কমে এলে আমরা দুজন একসাথে ফাইল গুছাচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ করেই অফিসে বিদ্যুৎ চলে গেল, কয়েক মিনিটের জন্য পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। জরুরি লাইট জ্বলে উঠলেও পরিবেশটা অদ্ভুত নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার ঘরে যখন দুজন পাশাপাশি বসেছিলাম, মনে হচ্ছিল সময় থেমে গেছে। খুব সাধারণ একটি মুহূর্ত, কিন্তু আমার কাছে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা। সেই ক্ষণিক নীরবতার ভেতরে আমি বুঝতে পারলাম, আমার হৃদয়ে যে অনুভূতি জমছে, তা আর অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তবু মুখে কিছুই বললাম না। আলো ফিরে এলে সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল, আমরা কাজ শেষ করে বেরিয়ে এলাম। বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, আমি যে নীরব ভালোবাসায় ডুবে যাচ্ছি, সেটি এখন থেকেই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় গোপন রহস্য হয়ে উঠছে।
পাঁচ
পঞ্চম দিনের সকাল থেকেই অফিসে এক ভিন্ন আবহ ছিল। সহকর্মীদের কথোপকথন, করিডোরের ফিসফাস, আর ক্যান্টিনে জমে ওঠা গুঞ্জনে একটা বিষয় স্পষ্ট—কেউ একজন হয়তো খুব শিগগিরই এই অফিস ছাড়তে চলেছেন। প্রথমে গুজব বলে মনে হলেও ধীরে ধীরে বোঝা গেল খবরটা সত্যি। দুপুর নাগাদ যখন বস মিটিং ডাকলেন, তখনই জানলাম, অন্য কোনো কোম্পানি থেকে নতুন অফার এসেছে এবং আমাদের টিমের একজন সহকর্মী খুব শিগগিরই বিদায় নেবেন। মিটিং রুমে বসে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম, কে হতে পারে সেই মানুষ? হঠাৎ করেই আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল—সেই নামটি ঘোষিত হলো, যেটা আমি একেবারেই শুনতে চাইনি। হ্যাঁ, তিনিই অন্য একটি চাকরির অফার গ্রহণ করেছেন এবং শিগগিরই আমাদের অফিস ছেড়ে চলে যাবেন। মুহূর্তেই যেন চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো, অথচ বাইরে থেকে আমি কোনোভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করিনি।
সারা দিন কাজ করার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু মন যেন স্থির হচ্ছিল না। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এই অফিসের প্রতিটি ভিড়, প্রতিটি নীরবতা, প্রতিটি মুহূর্ত আর কখনো আগের মতো থাকবে না। বারবার মনে হচ্ছিল, তাকে হারিয়ে ফেলব, অথচ তার কাছে কখনোই স্বীকার করতে পারিনি আমার অনুভূতি। বিকেলের দিকে যখন ক্যান্টিনে একসাথে বসে খাচ্ছিলাম, তখন সহকর্মীরা মজা করে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছিল। তিনি শান্তভাবে সবার শুভেচ্ছা গ্রহণ করছিলেন, মুখে হালকা হাসি ছিল, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে একটা অদৃশ্য ক্লান্তি আমি যেন টের পাচ্ছিলাম। তার সেই হাসি দেখে আমার ভেতরটা আরও ভেঙে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যদি এখনই তাকে কিছু বলতে পারতাম! কিন্তু চারপাশে এত মানুষ, এত আনুষ্ঠানিকতা—সবকিছু মিলিয়ে সাহসটা যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিল।
দিন শেষে আমি একা বসে ছিলাম আমার ডেস্কে। সবাই ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেছে, অথচ আমার মনে হচ্ছিল, এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। আসলে কাজের অজুহাতেই আমি থেকে গিয়েছিলাম, শুধু এই আশায় যে হয়তো সে-ও থাকবে। সত্যিই তাই হলো। কিছুক্ষণ পর তাকেও দেখলাম, সে নীরবে ডেস্ক গুছাচ্ছিল। এক মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হলো আমাদের, কিন্তু দুজনের কেউই কিছু বললাম না। তার সেই চেনা নীরবতা, আমার অজানা অস্থিরতা—সব মিলিয়ে যেন বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। আমি জানতাম, এখন না বললে হয়তো আর কখনোই বলা হবে না, কিন্তু তবু জিহ্বা যেন অবশ হয়ে গেল। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল মাথায়—কীভাবে বলব, কীভাবে জানাব আমার ভেতরের কথাগুলো? সময় যে ফুরিয়ে আসছে, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
ছয়
ষষ্ঠ দিনে অফিসে ঢুকতেই অনুভব করলাম, পরিবেশে অদ্ভুত এক পরিবর্তন এসেছে। সহকর্মীরা আগের মতো স্বাভাবিক থাকলেও তাদের চোখেমুখে একটা কৌতূহল ছিল, যা সবটাই ঘুরছিল তার বিদায়কে কেন্দ্র করে। ডেস্কে বসে কাজ করার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু মন বারবার সরে যাচ্ছিল। তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি পদক্ষেপ যেন আমার চোখে ধরা দিচ্ছিল আরও তীক্ষ্ণভাবে। হঠাৎ করেই মনে হচ্ছিল, এতদিন যেসব মুহূর্ত অবহেলায় কেটে গেছে, সেগুলোই আসলে আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ছিল। আর কয়েকদিন পর সে চলে যাবে, আর আমি থেকে যাব শূন্য হয়ে। সহকর্মীরা মাঝে মাঝে বিদায়ের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করছিল—কে কী উপহার দেবে, কিভাবে বিদায়ী অনুষ্ঠান সাজানো হবে—এসব শুনতে শুনতে বুকটা কেমন যেন ভারী হয়ে উঠছিল।
সেই দিন দুপুরে ক্যান্টিনে সবাই যখন আড্ডা দিচ্ছিল, আমি অনেকটা চুপচাপ বসেছিলাম। অন্যরা হাসছিল, গল্প করছিল, কিন্তু আমি শুধু তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। সে চেষ্টা করছিল স্বাভাবিক থাকার, কিন্তু তার মুখের ভেতরেও যেন এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা লুকিয়ে ছিল। হয়তো সে-ও বুঝতে পারছিল, এই পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে যাওয়া সহজ হবে না। আমাদের চোখ একবার মিলেছিল, আর সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, দুজনেই একই অনুভূতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যদিও কেউই কিছু বলছি না। খাবার শেষ হওয়ার পর সে যখন উঠে গেল, আমার ভেতরে হঠাৎ করে ভয় ঢুকে গেল—এই নীরবতা যদি কখনো ভেঙেই না যায়? যদি আমার ভালোবাসা চিরকাল অপ্রকাশিত থেকে যায়?
দিনের শেষে অফিস প্রায় ফাঁকা হয়ে এলো। আমি ইচ্ছে করেই কিছু ফাইল ধরে রেখেছিলাম, যাতে বেরোতে দেরি হয়। ঠিক তখনই তাকেও দেখলাম, সে এখনও কাজ করছে। অফিসের ফাঁকা করিডোরে কেবল আমাদের দুজনের উপস্থিতি যেন আলাদা এক পরিবেশ তৈরি করেছিল। বাইরে বৃষ্টি নামছিল, জানালার কাচে টুপটাপ শব্দ হচ্ছিল, আর ঘরের ভেতর নীরবতা আরও ঘনীভূত হচ্ছিল। আমি এক মুহূর্ত ভেবেছিলাম, এখনই বলে দিই সবকিছু। কিন্তু ঠোঁট পর্যন্ত আসা শব্দগুলো আবার গিলে নিলাম। হয়তো ভয় করছিলাম, তার চোখে অস্বস্তি দেখব। অথচ ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারছিলাম, সময় আমাদের হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে মনে হচ্ছিল, এই দ্বিধা যদি না কাটাই, তবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস হয়ে থাকবে—একটা ভালোবাসা, যা কখনোই উচ্চারণ করা হলো না।
সাত
সপ্তম দিন সকাল থেকেই মনটা অদ্ভুত এক টানাপোড়েনে ভরপুর ছিল। অফিসে ঢোকার আগে বারবার নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলাম—আজ আর দ্বিধা করব না, আজই বলব সব কথা। কিন্তু ডেস্কে বসে তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বুকের ভেতর অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। সে আগের মতোই শান্তভাবে কাজ করছিল, মুখে হালকা হাসি, কিন্তু আমি জানতাম সেই হাসির আড়ালে বিদায়ের চাপা বেদনা লুকানো আছে। পুরো দিনটা এক ধরনের অস্বস্তি আর অস্থিরতার ভেতর দিয়ে কেটে যাচ্ছিল। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, যদি আজ না বলি, তাহলে হয়তো আর কোনোদিনও বলা হবে না। অথচ আবার ভয় হচ্ছিল, যদি আমার কথায় আমাদের বন্ধুত্বটাই ভেঙে যায়! এই দ্বন্দ্বেই দিনটা বারবার ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিল।
দুপুরে লাঞ্চে সবাই মিলে ক্যান্টিনে গেলেও আমি যেন অন্য এক জগতে ছিলাম। সহকর্মীরা হাসছিল, আড্ডা দিচ্ছিল, বিদায়ের পরিকল্পনা নিয়েও ব্যস্ত ছিল, কিন্তু আমার ভেতরে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—কীভাবে বলব? বারবার ভেবেছিলাম, সরাসরি একদিনের মতো বলব, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।” কিন্তু যখন তার চোখের দিকে তাকাই, তখন মনে হয় হয়তো সে অবাক হয়ে যাবে, হয়তো অস্বস্তিতে পড়বে, আর সেই ভাবনা আমাকে থামিয়ে দিচ্ছিল। লাঞ্চের টেবিলে সে একবার আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল, আর আমি বুঝলাম, এত সহজ একটা হাসির পেছনেও আমি অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পাই। কিন্তু এই শান্তি তো আর চিরকাল থাকবে না—সে চলে যাবে, আমি থেকে যাব শূন্যতায়।
বিকেলের দিকে কাজের চাপ কিছুটা কমে এলো। আমি সুযোগ খুঁজছিলাম, যদি একান্তে তাকে পাওয়া যায়। ঠিক তখনই বাইরে হালকা বৃষ্টি নামতে শুরু করল, আর অফিসের জানালায় ফোঁটা ফোঁটা শব্দ হচ্ছিল। পরিবেশটা যেন আরও আবেগঘন হয়ে উঠল। অফিস ফাঁকা হওয়ার পর একসময় আমরা দুজনই রয়ে গেলাম। আমি সাহস সঞ্চয় করে তার ডেস্কের দিকে হাঁটলাম, কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলাম, সে মনোযোগ দিয়ে কিছু লিখছে। সেই দৃশ্য দেখে আবার দ্বিধা আমাকে গ্রাস করল—এমন মনোযোগী মুহূর্তে কীভাবে বলব? শেষ পর্যন্ত আবার চুপ করে ফিরে এলাম নিজের জায়গায়। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে মনে হচ্ছিল, আমি এক অদ্ভুত গোলকধাঁধায় আটকে গেছি—একদিকে গভীর ভালোবাসা, অন্যদিকে ভয় আর দ্বিধা। রাতভর ঘুম আসেনি, শুধু একটা চিন্তা ঘুরছিল মাথায়—সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, আর আমি এখনও নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারিনি।
আট
অষ্টম দিনের সকাল থেকেই অফিসজুড়ে ছিল এক বিশেষ আবহ। সবাই যেন স্বাভাবিক কাজের ফাঁকেই ব্যস্ত ছিল বিদায়ের আয়োজন নিয়ে। কোথাও কেকের অর্ডার দেওয়া হচ্ছে, কোথাও উপহারের তালিকা তৈরি হচ্ছে, আবার কেউ কেউ তাকে ঘিরে ছবি তুলছে স্মৃতি ধরে রাখার জন্য। চারপাশের এই কোলাহলের ভেতরে আমি যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় বন্দি হয়ে গিয়েছিলাম। ডেস্কে বসে কাজ করার চেষ্টা করলেও মন বারবার সরে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝেই তাকিয়ে দেখছিলাম—সে সহকর্মীদের সঙ্গে হাসছে, কথা বলছে, কিন্তু তার চোখে চাপা বিষণ্ণতার ছাপ আমি পরিষ্কার দেখছিলাম। হয়তো সে নিজেও অনুভব করছে, পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে যাওয়া সহজ নয়। অথচ আমি দাঁড়িয়ে আছি এক অদৃশ্য সীমারেখায়—একপাশে আমার গভীর ভালোবাসা, অন্যপাশে অদম্য দ্বিধা।
দুপুরে ক্যান্টিনে যখন সবাই একসাথে বসল, তখনও আলোচনা ঘুরল বিদায় ঘিরে। অনেকে মজা করে বলছিল, “আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছ, পরে যেন ভুলে যেও না।” সে হেসে বলছিল, “ভোলা কি এত সহজ?” তার হাসির আড়ালে লুকানো বিষণ্ণতা আমার বুককে আরও ভারী করে তুলছিল। খাবারের টেবিলে বসে আমি একেবারে চুপ করে ছিলাম, শুধু শুনছিলাম অন্যদের কথাবার্তা। একবার সে আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল, আর আমার মনে হলো—এই হাসিটুকুই হয়তো শেষবারের মতো আমার জন্য থাকবে। মুহূর্তটা ধরে রাখতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। লাঞ্চ শেষে সবাই মিলে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছিল, আর আমি নীরবে অনুভব করছিলাম—সময় ফুরিয়ে আসছে, আমার মনের কথা বলার মুহূর্তটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
দিনের শেষে যখন বিদায় অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল, অফিসের প্রতিটি কোণ আলোকিত হয়ে উঠেছিল। টেবিলে কেক সাজানো হলো, উপহার হাতে তুলে দেওয়া হলো, আর চারপাশে হাসি-ঠাট্টার মধ্যেও এক ধরনের আবেগ ছড়িয়ে পড়ল। সে সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল, স্মৃতির কথা বলছিল, আর সহকর্মীরা তাকে ঘিরে ছবি তুলছিল। আমি এক কোণে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলাম, মুখে হাসি ধরে রাখলেও ভেতরে যেন এক ঝড় বইছিল। এই আনন্দমুখর বিদায়ের মাঝেই আমার বুকের ভেতর কেবল একটাই প্রশ্ন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—আজ কি বলব? নাকি চিরকাল নীরব থাকব? অনুষ্ঠান শেষে যখন সবাই ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছিল, আমি বুঝলাম, আগামীকাল আর কোনো সুযোগ থাকবে না। যদি কিছু বলতেই হয়, তবে এখনই। কিন্তু সেই মুহূর্তে সাহসটা আবার কোথায় যেন হারিয়ে গেল, আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম নীরবে, যেন এক অদৃশ্য যন্ত্রণার ভার কাঁধে চাপিয়ে।
নয়
নবম দিনের সকালটা অন্য সব দিনের চেয়ে অনেক বেশি ভারী ছিল। অফিসে ঢোকার মুহূর্তেই অনুভব করলাম, আজকের দিনটাই তার শেষ দিন এখানে। করিডোরে সবাই তাকে ঘিরে ব্যস্ত, কেউ ছবি তুলছে, কেউ শুভকামনা জানাচ্ছে, কেউ আবার আড্ডা দিতে চাইছে শেষবারের মতো। আমি দূর থেকে সবকিছু দেখছিলাম, অথচ মনে হচ্ছিল, আমার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। ডেস্কে বসে কাগজপত্র ছুঁয়ে থাকলেও কাজের প্রতি কোনো মনোযোগ ছিল না। শুধু ভাবছিলাম, এতোদিনের চাপা অনুভূতি যদি আজও না বলি, তবে তা চিরকাল অপ্রকাশিতই থেকে যাবে। আমার নীরব ভালোবাসার গল্পের সমাপ্তি হবে কোনো শুরু ছাড়াই। এই অস্থিরতা আমাকে সারাক্ষণ গ্রাস করে রেখেছিল।
দুপুর নাগাদ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। কনফারেন্স রুমে সবাই জড়ো হলো, কেক কাটা হলো, স্মৃতি ভাগ করে নেওয়া হলো। সহকর্মীরা একে একে তাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল, আর সে হেসে প্রত্যেককে ধন্যবাদ দিচ্ছিল। আমি একেবারে পিছনের দিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যেন নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মনে হচ্ছিল, আর নয়—আজই সময়। অনুষ্ঠান শেষে যখন সবাই ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল, আমি সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলাম তার কাছে। কণ্ঠ শুকনো হয়ে আসছিল, তবু কোনোভাবে বলতে পারলাম, “তোমার সঙ্গে হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না, তাই একটা কথা না বললেই নয়।” সে অবাক চোখে তাকাল আমার দিকে, মুখে মৃদু বিস্ময়, যেন ভাবছে আমি কী বলতে যাচ্ছি।
আমার বুকের ভেতর তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। বহুদিনের অপ্রকাশিত অনুভূতি এক মুহূর্তে ঠেলে উঠে এলো ঠোঁটের কাছে। আমি ধীরে ধীরে বললাম, “আমি তোমাকে শুধু সহকর্মী হিসেবে দেখি নি কখনো, অনেকদিন ধরে তোমাকে নিঃশব্দে ভালোবেসে এসেছি।” কথাটা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হচ্ছিল, পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তার চোখে বিস্ময় আর নীরব আবেগের মিশ্রণ। কোনো উত্তর দিল না সঙ্গে সঙ্গে, শুধু চোখের কোণে হালকা আর্দ্রতা আর ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। সেই মুহূর্তে আমি বুঝলাম, হয়তো আমার ভালোবাসা স্বীকৃতি পেল কি না, সেটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, বহুদিনের নিঃশব্দ যন্ত্রণার অবসান হলো আজ। আমি আমার হৃদয়ের কথা বলে ফেলেছি, আর সেই সাহসটাই হয়ে উঠল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় মুক্তি।
দশ
দশম দিনের সকালটা একেবারেই ভিন্ন অনুভূতি নিয়ে এলো। আগের দিন আমি আমার মনের কথা বলে ফেলেছি, আর সেই সাহসী মুহূর্ত যেন এখনও বুকের ভেতর ধ্বনিত হচ্ছিল। অফিসে প্রবেশ করার সময় থেকেই বুঝতে পারছিলাম, আজ তাকে শেষবারের মতো এই জায়গায় দেখব। সহকর্মীরা ব্যস্ত ছিল বিদায়ের শেষ প্রস্তুতিতে, কেউ উপহার গুছাচ্ছে, কেউ আবার ছবির অ্যালবাম তৈরি করছে। আমি নিঃশব্দে নিজের ডেস্কে বসেছিলাম, কিন্তু চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল তার দিকে। মনে হচ্ছিল, প্রতিটি সেকেন্ড ধরে রাখতে চাই, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি হাসি যেন মনের খাতায় জমা রাখতে চাই। আমার ভেতরে অদ্ভুত এক প্রশান্তি আর অস্থিরতা একসাথে কাজ করছিল—প্রশান্তি এই কারণে যে আমি অবশেষে আমার হৃদয়ের কথা বলে ফেলেছি, আর অস্থিরতা এই কারণে যে জানি না সে কীভাবে গ্রহণ করেছে আমার অনুভূতি।
বিকেলের দিকে সবাই একসাথে তাকে বিদায় জানাতে জড়ো হলো। করিডোর জুড়ে হাসি-কান্নার মিশ্রিত আবেগ, আলিঙ্গন আর শুভকামনায় ভরে উঠল পরিবেশ। সে একে একে সবার সঙ্গে কথা বলছিল, ধন্যবাদ জানাচ্ছিল, আর তার চোখেমুখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল বিচ্ছেদের ভার। হঠাৎ সে আমার দিকে এগিয়ে এলো। চারপাশে ভিড় থাকলেও আমার মনে হচ্ছিল, যেন পৃথিবীতে আমরা শুধু দুজন। সে নীরবে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল, “তোমার কথাগুলো ভুলিনি। হয়তো এই মুহূর্তে কোনো উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু জেনে রেখো, তোমার কথাগুলো আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।” আমি কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি, শুধু নিঃশব্দে হাসলাম। সেই ছোট্ট উত্তরই যেন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি হয়ে উঠল।
অবশেষে সে সবার বিদায় নিয়ে করিডোর দিয়ে বাইরে চলে গেল। দরজার ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমার বুকের ভেতর অদ্ভুত শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু সেই শূন্যতার ভেতরেও এক ধরনের শান্তি ছিল। জানতাম, হয়তো আর কখনো দেখা হবে না, হয়তো হবে—ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কিন্তু এই অনিশ্চয়তার ভেতরেও আমার ভালোবাসা আর অপ্রকাশিত রইল না। আমি আমার হৃদয়ের কথা জানিয়েছি, আর সেটাই হয়ে উঠল আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। ভালোবাসা মিলনের হোক বা বিরহের, তার আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে সাহসী স্বীকারোক্তিতে। আর সেই স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়েই আমার জীবনের সবচেয়ে নিঃশব্দ গল্প সম্পূর্ণ হলো—“অপ্রকাশিত ভালোবাসা।”
সমাপ্ত 

1000066254.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *