Bangla - প্রেমের গল্প

অপেক্ষার ক্লাসঘর

Spread the love

কৌস্তভ রায়চৌধুরী


সকালের আলোর মতো

প্রতি শুক্রবার বিকেলে যোধপুর পার্কের একটু ভিতরের দিকে যে কোচিং সেন্টারটা, সেখানে একদল অভিভাবক এসে জড়ো হন। ঠিক চারটের দিকে একটা চাপা ব্যস্ততা ছড়িয়ে পড়ে — স্কুলব্যাগে ঠাসা স্বপ্ন, টিফিনের শেষটুকু গন্ধ, মায়েদের তাড়াহুড়ো করা চোখ, বাবাদের ফোনে নিমগ্ন মুখ। আমি অরিত্র, প্রতি শুক্রবারের মতোই আমার ছেলে অর্ককে নিয়ে এসেছি ক্লাসে বসাতে। আজকের দিনটা আলাদা ছিল না, আবার ছিলও।

সেই প্রথম দেখেছিলাম তাকে। একটা হালকা ধূসর রঙের তাঁতের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, চোখে মাটি ছোঁয়া দৃষ্টি। এমনভাবে দাঁড়ানো, যেন তিনি কারও জন্যে অপেক্ষা করছেন না—তবু অপেক্ষা তাঁর চারপাশে ছায়ার মতো জড়িয়ে। আমি সেদিনই প্রথম লক্ষ করলাম, কোচিং সেন্টারের বাইরে দাঁড়ানো লোকেদের মধ্যেও কখনও কখনও নৈঃশব্দ্য গল্প বলে।

তার মেয়েটির নাম ছিল অহনা—আমি পরে জেনেছি। আর তাঁর নাম—তখনো জানি না। আমি তখনও একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত বাবা, কর্মজীবনে ক্লান্ত, দাম্পত্যে স্থির। আমাদের সম্পর্কগুলো যেন নদীর মত, বহমান হলেও কিছু বাঁক আসে যেখানে জল স্থির হয়, যেন ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস ফেলে।

পরের সপ্তাহেও তিনি এলেন, ঠিক একই সময়ে। আমি একবার তাকালাম, তাকানো হয়েই গেল। তিনি তখন জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন, একটা ছোট খাতায় কিছু লিখছিলেন। আমার কৌতূহল যেন ওই খাতার পাতায় গিয়ে লেগেছিল। লিখছেন কী? চিঠি? কবিতা? নাকি নিছক টুকরো ভাবনা?

তৃতীয় শুক্রবারে আমাদের মধ্যে প্রথম কথা হয়। অর্কের চুল একটু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল, আমি ঠিক করছিলাম। তিনি এসে হালকা হেসে বললেন, “আপনার ছেলে খুব শান্ত। আমার মেয়েটা ওর পাশে বসে, বলে—ও সবসময় বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে।”

আমি হেসে বললাম, “আর আপনার মেয়েটা নিশ্চয় গল্প বলে?”

“না, ও আমার মতো। চুপচাপ।”

এই ‘আমার মতো’ শব্দদুটো আমার ভিতরে কোথাও নরম করে লাগল। যেন অনেকদিন পরে কেউ নিজের মতো করে ভাবছে—আমি অনেকদিন হয়তো নিজেকে এমন করে চিনে উঠিনি।

তারপর থেকে আমাদের কথা হওয়া শুরু হয়। খুব বেশি না, শুধু ছেলেমেয়েরা ক্লাসে থাকাকালীন সময়টুকু। কখনও বৃষ্টি দেখে, কখনও ঠান্ডা হাওয়ার মাঝে কফি হাতে, আবার কখনও নিঃশব্দে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা—এভাবেই জমে উঠছিল এক অদ্ভুত নিরবতা, যার মধ্যে কথা ছিল, কিন্তু চাহিদা ছিল না।

আমি জেনেছিলাম, তাঁর নাম শর্মিষ্ঠা। বয়স আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়। স্বামী বিদেশে, বছরে একবার দেখা হয়। সংসার আছে, অথচ নেই। কথার ফাঁকে মাঝে মাঝে তিনি বলতেন, “মানুষ কীভাবে এতখানি একা থাকে, অরিত্রবাবু?”

আমি উত্তর দিতাম না। শুধু বুঝতাম, আমিও একা।

আমাদের বন্ধুত্বের মতো কিছু একটা তৈরি হচ্ছিল, যেটা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমরা কোনোদিন ফোন নম্বর আদানপ্রদান করিনি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছিল না পরিচয়। তবুও প্রতি শুক্রবার বিকেল চারটেতে আমরা হাজির থাকতাম, যেন এটা আমাদের একান্ত সময়। যেন এই ক্লাসঘর শুধু বাচ্চাদের জন্য না, আমাদের অপেক্ষারও আশ্রয়।

তার সঙ্গে গল্প করতে করতে আমি নতুন করে অনুভব করছিলাম, একজীবনের প্রতিটি অভিমান, প্রতিটি স্বপ্ন আসলে মাটির নিচে বীজ হয়ে থাকে—কখনও কখনও কারও আলতো স্পর্শে সে অঙ্কুর গজায়।

এই সম্পর্ক পরকীয়া নয়। আবার বন্ধুত্ব বললেও কম বলা হয়। এখানে কোনো শরীর নেই, কোনো দাবি নেই। শুধু এক অদ্ভুত তৃষ্ণা, কারও সঙ্গে মনের আলোয় কথা বলার।

সেদিনের শেষ আলো যখন জানলার কাচে এসে পড়েছিল, শর্মিষ্ঠা বলেছিলেন, “ক্লাসঘরটা যেন ধীরে ধীরে একটা আশ্রয় হয়ে উঠছে।”

আমি মাথা হেলিয়ে বলেছিলাম, “হয়তো এই অপেক্ষাই আমাদের ক্লাস। যেখানে আমরা শেখার চেষ্টায় আছি—নিজেদের।”

এই ছিল শুরু।
শুধু অপেক্ষার ক্লাসঘরে দুজন মানুষ নিঃশব্দে বসে আছে, ভালোবাসার নাম না দিয়ে।

শব্দহীনতা কখনও কখনও সুর হয়

শর্মিষ্ঠা খুব বেশি কথা বলতেন না, কিন্তু তিনি যা বলতেন, তা যেন কোনও দীর্ঘ উপন্যাসের মতো গভীর হতো। তাঁর চোখে ছিল একধরনের অভ্যস্ত বিষণ্ণতা—যা তাকে ক্লান্ত নয়, বরং অনুচ্চারিত করে তুলত। আমি মাঝেমধ্যে লক্ষ্য করতাম, তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জানালার বাইরের পুকুরটায় চোখ রাখেন। যেন জল নয়, কোন হারিয়ে যাওয়া সময়ের প্রতিবিম্ব সেখানে খেলে যাচ্ছে।

একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনি এত মন দিয়ে কী দেখেন, জানালার বাইরে?”

তিনি হালকা হাসলেন। তারপর ধীরে বললেন, “সময়। সময় কীভাবে বদলায় সেটা। আগে এখানে গাছ কম ছিল, এখন ফুল ফুটেছে। আগে এই পুকুরে একটা লাল পালকের পাখি আসত। এখন আর আসে না।”

আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। সময়ের ক্ষুদ্রতম পরিবর্তনগুলি কেউ এত মন দিয়ে লক্ষ করে! আমি তো বরাবরই ছুটে চলেছি, ব্যস্ত থেকেছি, কিছুই খেয়াল করিনি—পাশ দিয়ে কত কিছু সরে গিয়েছে, হারিয়ে গিয়েছে।

“আপনি খেয়াল করেন সব?” আমি বিস্ময়ে বলেছিলাম।

“শুধু বাইরে নয়,” তিনি বললেন, “ভেতরেও।”

এই কথাটি আমায় থামিয়ে দিল। কারণ আমিও এখন নিজের ভিতরে কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম। একটা দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকা নীরবতা, যা কথা চাইছিল না, শুধু বোঝার কেউ চাইছিল।

শর্মিষ্ঠার সঙ্গে এই বোঝাপড়া ঠিক কোন নামের মধ্যে পড়ে, আমি জানতাম না। তবে এটুকু বুঝেছিলাম, সম্পর্ক শব্দে নয়, অনুভবে গড়ে ওঠে। আমরা একে অপরের সঙ্গে কোনও স্বীকারোক্তি ভাগ করিনি, কিন্তু আমাদের মাঝে যে নৈঃশব্দ্য ছিল, তার প্রতিটা তরঙ্গে একধরনের সুর বেজে চলেছিল—সেই সুর ছিল নিজের না-থাকা নিয়ে, হারিয়ে যাওয়া আবেগ নিয়ে, অথবা—হয়তো একধরনের অনুচ্চারিত ভালোবাসা নিয়ে।

একদিন কোচিং সেন্টারের ছাদে উঠেছিলাম আমরা, কারণ নিচে খুব ভিড়। শীতের বিকেল, একটু কুয়াশা। পেছনে ছিল উঁচু দেওয়াল, সামনে রেললাইন দেখা যায় দূরে। ছেলেমেয়েরা ক্লাসে, আমাদের হাতে আধঘণ্টা সময়।

তিনি বলেছিলেন, “আপনি কি কখনও কাউকে নিয়ে গান শোনেন?”

“মানে?”

“মানে এমন, যখন কোনও গান শুনে কারও মুখ মনে পড়ে। অথবা মন চায়—ইশ, ওকে যদি শোনাতে পারতাম!”

আমি একটু থেমে বলেছিলাম, “হ্যাঁ, ইদানীং আপনার জন্য হয়। একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে—‘তোমায় গান শোনাব।’ শুনবেন ?”

তিনি একটু হেসে বলেছিলেন, “শোনাবেন?”

“শোনাব।” আমি বলেছিলাম।

আমার মুঠোফোনে গানটা চালালাম। দুজন ছাদের এক কোণে বসে আছি। ঠাণ্ডা বাতাসে তাঁর আঁচল উড়ছিল, আর আমি গান চালিয়ে চুপ করে বসে ছিলাম। গান বাজছে—

“তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ

                ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া

             বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক

                 ওগো দুখজাগানিয়া ॥”

কোনও জিজ্ঞাসা নয়, কোনও নিশ্চিততাও নয়—শুধু এই মুহূর্তে, এই নীরবতা ভাগ করে নেওয়া।

তিনি চোখ বন্ধ করেছিলেন। এবং আমার মনে হল—এই মুহূর্তেই আমি তাঁকে সবচেয়ে ভালো বুঝেছি।

এই বুঝে ওঠা ঠিক প্রেম নয়, ঠিক বন্ধুত্ব নয়। এটা একধরনের সহাবস্থান—একটা অন্য মানুষের জীবনের ছায়ার পাশে হেঁটে চলা, তার রোদ্দুরটুকু ছুঁয়ে দেখা। কোনও দাবি ছাড়া, প্রত্যাশা ছাড়া। যেন দুটি ভিন্ন ভুবনের মানুষ একই সময়ে, একই ছাদে কিছুটা সময়ের জন্য পাশাপাশি।

সেদিন যাওয়ার সময়, শর্মিষ্ঠা হঠাৎ বললেন, “আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক?”

প্রশ্নটা অপ্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু অসম্ভব স্বাভাবিকভাবে উচ্চারিত।

আমি উত্তর দিলাম, “চেষ্টা করি… কিন্তু কিছু সম্পর্ক হয়তো ম্লান হয়ে যায় সময়ের সাথে। আপনাদের?”

তিনি বললেন, “উপস্থিতি আছে, কিন্তু উপস্থিতির অর্থ নেই।”

এই কথাটুকু শুনে আমার মনে হল, আমরা দুজনেই একা। কিন্তু সেই একাকীত্বের ভিতরও যদি কেউ থাকে, তাহলে তা একা থাকা নয়—তা একধরনের সাথ থাকা।

সেদিন থেকে আমি আর শর্মিষ্ঠা, প্রতি শুক্রবার শুধু অপেক্ষা করি না—আমরা অনুভব করি। আমরা একে অপরের মধ্যে এমন কিছু খুঁজি, যা আমরা আমাদের নিজের সংসারে পাইনি—মনোযোগ, শ্রদ্ধা, নিঃশব্দে ভালোবাসা।

এখন আর ক্লাসঘরের বাইরে শুধু দাঁড়িয়ে থাকা নয়, এ একধরনের সম্মিলিত নির্জনতা। যেখানে কেউ কারও দিকে তাকিয়ে কিছু বলে না, কিন্তু সব কিছুই বলা হয়ে যায়।

একটা সম্পর্কের সবচেয়ে গভীর দিক কখনও কখনও স্পর্শ নয়, কথা নয়—শুধু পাশে থাকা।

শর্মিষ্ঠা সেই পাশে থাকা মানুষ।

এক মুঠো জানলার আলো

সেই জানলাটা, যেটার ধারে শর্মিষ্ঠা দাঁড়াতেন প্রতি সপ্তাহে, একসময় আমারও অভ্যেস হয়ে গেল। জানলার ওপাশে ছিল একটা ছোট পুকুর, কয়েকটা অযত্নে বাড়তে থাকা গাছপালা, আর দূরে একটা অচেনা, অচল মন্দিরের শিখর। জানলার কাচে ধুলোর আস্তরণ ছিল, তবু রোদ্দুরটা যেন ঠিকমতো এসে পড়ত। আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম, মানুষের জীবনও বুঝি জানলার মতো—আংশিক পরিষ্কার, আংশিক ধুলোমলিন, তবু রোদের সন্ধান ফুরোয় না।

সেদিন বিকেলে শর্মিষ্ঠার হাতে ছিল একটা পাতলা বই—“অপ্রকাশিত চিঠি”। আমি বললাম, “চিঠি পাঠ করেন নাকি?”

তিনি বললেন, “লিখি। কিন্তু কাউকে পাঠাই না।”

এই কথা শুনে আমার বুক কেমন হু হু করে উঠল। যারা লেখে, কিন্তু কাউকে দেয় না—তাদের লেখা একরকম আত্মকথা হয়, একরকম মৌন ক্রন্দন। আমি জানতে চাইলাম, “সেই চিঠিগুলো কার জন্য?”

তিনি একটু থেমে বললেন, “আমি নিজেই জানি না। হয়তো তাদের জন্য, যারা আমার জীবনে আসেনি। অথবা যারা এসেও থাকেনি।”

তারপর একটু হেসে বললেন, “আপনি জানেন, কখনও কখনও আমি আপনাকে নিয়েও লিখি। যেমন ধরুন, আজ যদি আপনাকে কিছু বলতে চাই—আপনি শুনবেন কি?”

আমি চমকে উঠলাম, কিন্তু কিছু বললাম না। শুধু মাথা নাড়লাম।

তিনি বললেন, “আপনি আমার জীবনে একটা জানলার মতো এসেছেন। জানেন তো, জানলা খোলা থাকলে আলো আসে, কিন্তু দরজা খোলা থাকলে মানুষ আসে। আপনি দরজা নন। আপনাকে দিয়ে আমি আলো পাই, বাতাস পাই, সময় পাই। কিন্তু আমি জানি, আপনি চলে যাবেন না—আবার প্রবেশও করবেন না। আপনি থেকে যাবেন এই জানলার ধারে।”

আমার চোখ খানিকটা ভিজে উঠল। এরকম বিশুদ্ধ সংজ্ঞা আমি কোনোদিন শুনিনি। না প্রেম, না বন্ধুত্ব, না প্রণয়—এ এক ভিন্ন মাত্রা। আমি চুপ করে ছিলাম। কখনও কখনও, নিরবতাই শ্রদ্ধার সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়া।

আমাদের বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক, যাই বলা হোক না কেন, একটা অসময়ের মধ্যে গড়ে উঠছিল। দুজনেই পরিণত, সংসারী, দায়িত্বপূর্ণ মানুষ। অথচ, প্রতি শুক্রবার বিকেলে, এই একঘণ্টার জন্য আমরা হয়ে উঠতাম একে অপরের শ্রোতা, পাঠক, ও সহযাত্রী।

শর্মিষ্ঠা একদিন বলেছিলেন, “আপনি কি জানেন, অপেক্ষা কাকে বলে?”

আমি বলেছিলাম, “হয়তো কাউকে ভালোবাসার একটা ধরণ, যার কোনও দাবি নেই।”

তিনি মাথা হেলিয়ে বলেছিলেন, “হ্যাঁ, অপেক্ষা ভালোবাসার নিঃশব্দ প্রার্থনা।”

সেই কথা আমার ভিতর অনেকদিন ধরে রয়ে গেছে। আমি এখন বুঝি, ভালোবাসা মানে শুধু একসাথে থাকা নয়, বরং কারও জন্যে অপেক্ষা করাও একধরনের গভীর ভালোবাসা। আর এই ক্লাসঘর, এই জানলার ধারে দাঁড়ানো, এই একঘণ্টা—সবটাই যেন সেই অপেক্ষার চর্চা।

একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এই সম্পর্কটা কি আপনার কাছে যথেষ্ট?”

তিনি হাসলেন। সেই চেনা নির্ভুল হাসি, যেটা কোনও খুশির নয়, আবার কোনও দুঃখেরও নয়—একটা স্থিরতার।

“না যথেষ্ট নয়,” তিনি বললেন, “কিন্তু যা আছে, তা সুন্দর। আমি জানি, আপনার বাড়ি আছে, আপনার সংসার আছে, ঠিক যেমন আমার আছে। তবু আপনি আমাকে প্রতি শুক্রবার জানলার এই একফালি আলো দেন—সেটাই অনেক।”

আমি বুঝে গেলাম, আমরা যা চাই, তা সবসময় পাওয়া যায় না। কিন্তু যা পাই, তাকে যদি মায়া দিয়ে আঁকা যায়, তাহলে সেটাও একপ্রকার পূর্ণতা।

তারপর থেকে আমি আর শর্মিষ্ঠা একসাথে বসি না, পাশাপাশি দাঁড়াই না—আমরা আলাদা দাঁড়াই, কিন্তু জানি, একে অপরের পাশে আছি। সেই জানলার মতো—যেখানে আলো আসে, বাতাস আসে, ছায়াও আসে… কিন্তু কেউ ভেতরে ঢোকে না।

আমাদের সম্পর্কের ভাষা ওই জানলার আলোর মতো—নীরব, কোমল, অথচ দৃষ্টিগ্রাহ্য। যেন একটা অসমাপ্ত কবিতা, যার প্রতিটি স্তবক একে অপরকে ঘিরে—তবু না ছুঁয়ে।

একটি শীতল বিকেলের গল্প

শীতকাল যখন ঠিক আসবে আসবে করছে, তখন বিকেলগুলো যেন আরও একটু বেশি ধূসর হয়ে পড়ে। জানালার কাচে রোদ পড়ে না ঠিকমতো, বাতাসের মধ্যেও একটা থমথমে ভার থাকে। সেই শুক্রবারটাও ছিল এমনই এক বিকেল—আলো ছিল না, অথচ অন্ধকারও পুরোপুরি নামেনি। আমি যথারীতি কোচিং সেন্টারে পৌঁছেছিলাম, কিন্তু সেদিন মনটা একটু অস্থির ছিল। কাজের চাপ, একঘেয়ে সংসার, এবং একটা দুর্ভেদ্য নীরবতা আমাকে ভেতর থেকে খোঁচাচ্ছিল।

ক্লাসরুমের বাইরে এসে দাঁড়ালাম, জানালার ধারে। শর্মিষ্ঠাকে তখনও আসতে দেখিনি। আমি কিছুটা ব্যাকুল বোধ করছিলাম—সে কি আজ আসবে না? আমাদের অদ্ভুত রুটিনে যদি ছেদ পড়ে, তবে কি এই সম্পর্কটাও ঝরে যাবে কোনও শুকনো পাতার মতো?

অবশেষে, যখন মনে হচ্ছিল আর দেখা হবে না, ঠিক তখনই তিনি এলেন। একটা পাতলা গাঢ় নীল উলের শাল জড়ানো, হাতে সেই চিরচেনা নোটবই। তাঁর মুখে আজ যেন আরও বেশি নির্জনতা। আমাকে দেখে হালকা হাসলেন, কিন্তু সেই হাসির ভিতরে আজকের ঠাণ্ডার থেকেও বেশি শীত ছিল।

“আজ একটু দেরি হয়ে গেল,” বললেন তিনি।

আমি বললাম, “ভাবলাম আর আসবেন না।”

তিনি দাঁত কেটে একটু হেসে বললেন, “আসা না আসার মাঝে একটা সূক্ষ্ম সীমা আছে, জানেন তো? আমি যদি না আসি, আপনি হয়তো কিছুই বলবেন না। কিন্তু বুঝবেন। আবার যদি আসি, তাও কিছু না বলেই আপনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকবেন। এটাই তো আমাদের সম্পর্ক।”

আমি মাথা নুইয়ে বললাম, “হয়তো ঠিক বলেছেন।”

শীতের হালকা হাওয়ায় তাঁর শালের কোণা উড়ে এসে আমার হাতের ওপর পড়ল। তিনি অস্থির হয়ে সেটি ঠিক করে নিলেন, কিন্তু সেই মুহূর্তের ছোঁয়াটা যেন আমার হৃদয়ের গভীরে নেমে গিয়েছিল। আমি কোনওদিন তাঁকে স্পর্শ করিনি, কোনওদিন তাঁর চোখে চোখ রেখে কিছু বলিনি, তবু সেই মুহূর্তের সান্নিধ্য ছিল বহু ভালোবাসার কথার চেয়েও গভীর।

আমরা আজ একটু দূরে দাঁড়ালাম, কিচেনের ধারে, যেখানে একজন বুড়ো কাকু কফি বানাচ্ছিলেন স্লো কিটলিতে। আমি দুই কাপ চা আনালাম—একটা তাঁর জন্য, একটা নিজের জন্য।

তিনি বললেন, “কখনও কখনও আমি ভাবি, এই এক ঘণ্টার জন্যই কি আমি পুরো সপ্তাহ অপেক্ষা করি?”

আমি বললাম, “আমি তো নিশ্চিতভাবেই করি।”

তিনি চমকে তাকালেন। আমার মুখে এতো স্পষ্ট স্বীকারোক্তি ছিল না আগে কখনও। তাঁর চোখে একরকম কোমল আতঙ্ক খেলা করল, যেন এই সত্যটা শুনতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না—তবুও, এটা শোনার জন্যই যেন প্রতি সপ্তাহে এসে দাঁড়ান।

তিনি ধীরে বললেন, “আপনি জানেন তো, এটা সত্যি হলে খুব বিপজ্জনক?”

আমি বললাম, “জানি। কিন্তু বিপদ যে সবসময় আগুনে হয়, এমন তো নয়। কিছু বিপদ হয় বাতাসে—অদৃশ্য, নরম, অথচ কষ্টদায়ক।”

তাঁর চোখে জল জমল কি না, আমি দেখিনি। কিন্তু তিনি চোখ সরিয়ে নিলেন। জানালার কাচে তখন ধোঁয়া জমছিল। আমি বললাম, “এই কাচের ওপারেও আপনি আছেন। কাছেই, অথচ ধোঁয়ায় ঢাকা।”

তিনি মাথা নাড়লেন, “আপনি কি জানেন, অরিত্রবাবু, আমি কখনও আপনার মতো করে কারও সঙ্গে কথা বলিনি। এমনকি নিজের স্বামীর সঙ্গেও না। কখনও না।”

আমি শুনে স্তব্ধ হলাম। কত পুরোনো নিঃশব্দের ভার বয়ে বেড়ান তিনি? আমি হয়তো জানিই না, বা জানার অধিকারও আমার নেই। তবু আমি অনুভব করি সেই ভার, ঠিক যেমন নদীর ধারে দাঁড়ালে তার গভীরতা দেখা না গেলেও শ্রুতিমধুর ধ্বনি শোনা যায়।

তারপর হঠাৎ করেই কোচিংয়ের ঘণ্টা বাজল। আমাদের এই একঘণ্টার মুক্ত অঞ্চল আবার পরিণত হলো বাস্তবের কোলাহলে। ছেলেমেয়েরা ছুটে এল, অভিভাবকেরা ব্যস্ত মুখে ফোনে কথা বলছেন, কেউ কেউ স্কুলব্যাগ টেনে ধরছেন। আমরাও সেই ভিড়ে হারিয়ে গেলাম।

তবে যাওয়ার আগে, তিনি হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বললেন, “এই অপেক্ষাটা, অরিত্রবাবু, আপনি রাখবেন তো? যতদিন চলে, যতটা চলে?”

আমি কিছু না বলে মাথা নাড়লাম। আর কিছু বলার ছিল না। কিছু সম্পর্ককে শব্দে বাঁধা যায় না—তারা থাকে শুধু প্রতীক্ষার মতো, জানালার আলোয়, শীতের বিকেলের নিঃশব্দতায়।

নৈঃশব্দ্যের গন্ধ

সপ্তাহ কাটে, আবার ফিরে আসে শুক্রবার। এখন এদিনটার একটা নিজস্ব গন্ধ তৈরি হয়েছে আমার কাছে—হয়তো শীতের শুকনো পাতার গন্ধ, হয়তো অপেক্ষার। সেই গন্ধ আমি কেবল কোচিং সেন্টারের গেট পেরিয়েই টের পাই। জানি, শর্মিষ্ঠা থাকবেন, জানলার পাশে। কিন্তু আজকে আমি ইচ্ছে করেই একটু আগে পৌঁছে গেলাম। জানি না কেন, হয়তো আজকের বিকেলটা আরও একটু দীর্ঘ করে নিতে চেয়েছিলাম।

শর্মিষ্ঠা তখনো আসেননি। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই পরিচিত জানালার ধারে। বাইরে শিশিরে ভেজা গাছের পাতা, অল্প রোদের রেশ। পুকুরটার জলে দু-একটা শালিক ডানা ঝাপটাচ্ছিল। শহরের কোলাহলের মাঝে এমন নীরব দৃশ্য যেন অলৌকিক। হঠাৎ আমি টের পেলাম—এই মুহূর্তগুলো আমি শুধু নিজের জন্যে সংরক্ষণ করছি না, শর্মিষ্ঠার জন্যেও রেখে দিচ্ছি। যেন কোনও ছবি আঁকার আগে ক্যানভাসটা মুছে পরিষ্কার রাখা—যেন তিনি এসে বসবেন, এবং গল্প শুরু হবে।

অবশেষে তিনি এলেন। আজ তাঁর পরনে ছিল একটা মাটির রঙের কাশ্মীরি শাল, চোখে হালকা ক্লান্তি। হাঁটতে হাঁটতে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। কিছু বললেন না। কেবল দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি সেই নৈঃশব্দ্যের ভার টের পেলাম। সেটা বিরক্তির নয়, অবসাদের নয়—একটা গম্ভীর নিরবতা, যার গায়ে চুপ করে পড়ে থাকে অনেক অপ্রকাশিত বাক্য।

আমি নিজেই শুরু করলাম, “আপনি কি জানেন, নৈঃশব্দ্যেরও একটা নিজস্ব গন্ধ আছে?”

তিনি তাকালেন, প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে। আমি বললাম, “যেমন আজকের এই বিকেল—শব্দ কম, লোকজনের ভিড় কম, বাতাসে একটা নিস্তব্ধতা। আপনি দেখবেন, এই নিস্তব্ধতারও একটা গন্ধ আছে। যেন পুরোনো বইয়ের পাতায় লুকানো কোনও চিঠির মতো।”

তিনি হেসে ফেললেন। “আপনার ভাবনার ধরণটা অন্যরকম, অরিত্রবাবু। মাঝে মাঝে অবাক হই—আপনি এই সব অনুভব করেন কী করে?”

আমি কিছু না বলে তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে। তাঁর চোখে একটা অবাক হওয়ার শিশুসুলভতা ছিল, যা কোনো বড়দের মুখে থাকে না। সে চোখে ক্লান্তি ছিল, কিন্তু ক্লান্তির গভীরে বিশ্বাস। যেন তিনি বিশ্বাস করছেন, আমি তাঁর কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছি।

একটু পরে, তিনি নিজের নোটবুকটা বের করলেন। পাতাটা খুলে একটা পংক্তি পড়ে শোনালেন:
“নৈঃশব্দ্য আমার ঘরের জানালা—যেখানে আলো আসে, অথচ শব্দের অনুমতি নেই।”

আমি শুনে অভিভূত হলাম। বললাম, “এটা আপনি লিখেছেন?”

তিনি হালকা মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ। কয়েকদিন আগে। আপনি বলেছিলেন না, জানলা দিয়ে আলো আসে—সেই থেকে ভাবছিলাম।”

কী আশ্চর্যভাবে আমরা একে অপরের ভাবনার ভিতর ঢুকে পড়ছি। কোনও শারীরিক সংযোগ ছাড়াই, কোনও আনুষ্ঠানিকতাবিহীন, আমরা একে অপরের অন্তর্লোক ছুঁয়ে ফেলছি। শব্দ ছাড়া, দাবি ছাড়া।

তারপর হঠাৎ করেই তিনি বললেন, “আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মেয়ের স্কুলে একটা অনুষ্ঠান আছে।”

আমি বুঝলাম, এই এক ঘণ্টা আজ পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই শেষ হতে চলেছে। তবু কিছু একটা বলতে ইচ্ছে করছিল। বললাম, “আপনি জানেন, শর্মিষ্ঠাদি, এই ছোট ছোট সময়গুলো আমার জীবনে একরকম ব্যালান্স এনে দেয়। সপ্তাহের বাকি দিনগুলো যেমনই হোক, শুক্রবারটা আমায় বাঁচিয়ে রাখে।”

তিনি একটু থেমে বললেন, “আমিও। আমি খুব আলাদা হয়ে যাই শুক্রবারে। বাকি দিনগুলোতে আমি শুধুই মা, স্ত্রী, গৃহিণী—কিন্তু শুক্রবার আমি শুধু আমি। আপনার সঙ্গে সময় কাটালে নিজেকে ফিরে পাই।”

এই স্বীকারোক্তি শুনে আমি নিঃশব্দে মাথা নাড়লাম। বুঝলাম, আমরা দুজনেই একে অপরের জীবনের একটা ক্ষুদ্র, অথচ অত্যন্ত জরুরি ‘আমি’ ফিরে পাওয়ার অবলম্বন।

শর্মিষ্ঠা যাওয়ার আগে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো বললেন, “আপনি তো আছেন, তাই না?”

আমি বললাম, “থাকব। যতটা সম্ভব। যতটা চুপ করে থাকা যায়।”

তিনি হেসে বললেন, “আপনার এই চুপ করে থাকাটাই সবচেয়ে বড় কথা হয়ে দাঁড়ায় আমার কাছে।”

তারপর তিনি চলে গেলেন। আমি একা দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। জানালার বাইরের সেই পুকুরের জলে এবার আর পাখিরা ছিল না, কেবল কিছু ঢেউ। বাতাসে সেই গন্ধ—নৈঃশব্দ্যের। আমি চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলাম। কেউ যেন আমাকে আলতো করে ছুঁয়ে বলল, “এই না-থাকা, এই অপেক্ষা, এই নীরবতা—সবই একধরনের প্রেম।”

একটা চিঠি, যা কখনো পাঠানো হয়নি

সেই শীতের বিকেলের পর থেকে আমার দিনগুলো একটু অন্যরকম হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিনের কাজ, ঘর, অফিস, সংসার সব চলছিল নিজের ছন্দে, কিন্তু তার মধ্যেও যেন একটা অন্তর্গত ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল। যেন প্রতি দিনের ভিতরে একটা শুক্রবার লুকিয়ে আছে, একটা জানলা খোলা আছে, যার ধারে দাঁড়িয়ে কেউ অপেক্ষা করে—চুপচাপ।

তেমনই এক নির্জন দুপুরে আমি আমার আলমারির ড্রয়ারের ভেতর খুঁজে পেলাম একটা পুরনো চিঠি। চিঠিটা আমার হাতেই লেখা, কিন্তু ঠিকানার জায়গাটা ফাঁকা। তারিখ নেই, প্রাপক নেই। পড়তে পড়তে বুঝলাম—এই চিঠিটা আমি শর্মিষ্ঠার জন্যই লিখেছিলাম, হয়তো সেই প্রথম মাসগুলোর কোনও এক অব্যক্ত বিকেলে, যখন আমাদের সম্পর্কটা তখনো নামহীন।

চিঠিতে লিখেছিলাম—

“তুমি যেভাবে আমার পাশে দাঁড়াও, অথচ কোনও ছায়া ফেলো না, সেটা শুধু তুমি পারো। তোমার চুপ করে থাকা, তোমার চোখের দৃষ্টি, সবই যেন একধরনের আশ্রয়। জানি না, তুমি জানো কিনা, তুমি আমার মধ্যে একটা আলো জ্বেলে রেখেছো।
যখন পৃথিবীটা ঠান্ডা হয়ে আসে, আমি শুধু তোমার কথা ভাবি।
ভাবি, তুমি হয়তো এখন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছো।
চুপ করে।
কিন্তু সেই চুপ করে থাকাতেই যে কত শব্দ জমে থাকে, তুমি কি জানো?”

আমি চিঠিটা পড়ে শেষ করলাম, তারপর বহুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। আমার চারপাশে চলছিল আমার নিজের জীবন—স্ত্রীর ফোনে কথা বলা, অর্কর হোমওয়ার্কের জন্য চিৎকার, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা চাপা শব্দ। কিন্তু আমি তখন একটানা তাকিয়ে ছিলাম চিঠিটার দিকে। যেন এই অক্ষরগুলোর মাঝখানে আমি নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি। যেন এই না-পাঠানো চিঠিটাই আমার সত্যিকারের মুখ।

পরের শুক্রবারে, আমি ঠিক করলাম চিঠিটা নিয়ে যাব। কিন্তু দেব না। শুধু নিয়ে থাকব। নিজের ভিতরে একটা সাহস সঞ্চয় করে দেখব—এই অনুভবটা আরেকবার তাঁর চোখে পড়ে কি না।

শর্মিষ্ঠা যথারীতি এলেন, একটু হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে থাকা চুল, হালকা ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, আর চোখে সেই অদ্ভুত ক্লান্ত প্রশান্তি। আজ তিনি কথা কম বলছিলেন, কিন্তু উপস্থিত ছিলেন।

আমি চুপচাপ চিঠিটা পকেট থেকে বার করলাম, একটু উঁচু করে তাঁর সামনে ধরলাম। কিছু বললাম না।

তিনি অবাক হয়ে তাকালেন। তারপর চোখে এক ধরনের অস্থিরতা। “এটা কী?”

“তোমার জন্য লেখা। অনেক আগে। কিন্তু পাঠানো হয়নি।”

তিনি ধীরে হাত বাড়িয়ে নিলেন। কাগজটা ছুঁয়ে দেখলেন, পড়লেন না। শুধু বললেন, “পাঠাওনি কেন?”

“কারণ তখনো বুঝিনি, তুমি কে আমার জীবনে। আর এখন বুঝলেও… কিছু জিনিস হয়তো পাঠানোর নয়। শুধু থাকার।”

তিনি চোখে একরকম আবছা জল নিয়ে বললেন, “আমি অনেক চিঠি লিখি, যেগুলো কখনো পাঠাই না। আমার মনে হতো, কেউ বুঝবে না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, তুমি বুঝতে পারো।”

আমি বললাম, “তোমার শব্দগুলো আমি পড়ি না—অনুভব করি। তোমার নীরবতাকে আমি ভাষায় ফেলি না, আমি শুধু সেই নিঃশব্দের ভেতর হাঁটি।”

চিঠিটা আর ফেরত নিলাম না। রেখে দিলাম তাঁর কাছে। তিনি তা পড়লেন কি না, জানি না। কিন্তু তাঁর চোখে যে স্পর্শ আমি দেখেছিলাম, তা আমার চিঠির প্রতিটি লাইনের চেয়ে বেশি সজীব, বেশি নির্ভরযোগ্য।

সেদিন আমরা পাশাপাশি বসে ছিলাম—একটা ছোট বেঞ্চে। কোনও কথা বলিনি। মাঝে মাঝে দু-একটা শব্দ খসে পড়ছিল—‘আজ ঠান্ডা বেশি’, ‘ক্লাসটা একটু লম্বা হচ্ছে’—এইরকম। কিন্তু আমাদের নিঃশব্দতা এতটাই পূর্ণ ছিল যে, আমি বুঝতে পারছিলাম, শব্দ দিয়ে আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই।

এই সম্পর্কের নাম হয়তো কেউ কোনওদিন রাখবে না। আমরা নিজেরাও না। তবু একটা চিঠি, যেটা কখনো পাঠানো হয়নি, আমাদের মাঝে বয়ে নিয়ে চলল এক অনন্ত অনুরণন—যেটা ছুঁয়ে যায়, কিন্তু দাবি করে না।

চোখের পাতা ফেলার মুহূর্তে

শীতটা এবার বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। বিকেলের আলো পড়তে না পড়তেই অন্ধকার গড়িয়ে আসে কোচিং সেন্টারের গায়ে। জানালার কাচেও আজকাল কুয়াশার আড়াল থাকে, যেমন আমাদের দুজনের মধ্যেও একটা অদৃশ্য পর্দা—স্বচ্ছ অথচ ছোঁয়া যায় না। চিঠিটার পরে এক সপ্তাহ কেটে গেছে। আমি জানি না শর্মিষ্ঠা পড়েছেন কি না, বলবেন কি না। কিন্তু জানি, কিছু শব্দ একবার পড়া হয়ে গেলে, তা আর পুরনো থাকে না। তা একটা স্থায়ী স্তর তৈরি করে সম্পর্কের ভিতরে—যার উপর দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি।

আজও আমি সময়মতো এসে পৌঁছেছি। অরিত্র ক্লাসে গেছে, জানলার ধারে আমি দাঁড়িয়ে। সেদিন শর্মিষ্ঠার চোখে যা দেখেছিলাম—তাকে নাম দিতে পারিনি। ভালোবাসা নয়, ভয়ও নয়, কিন্তু এমন কিছু, যা চোখের পাতা ফেলার মুহূর্তে থেকে যায়। যেমন স্বপ্নের আগে ভাবনার শেষ রেখা।

তিনি এলেন। আজ তাঁর চোখে ক্লান্তির ছায়া বেশি। বললেন, “এই সপ্তাহটা একটু কঠিন গেছে।”

আমি বললাম না কিছু, শুধু তাকিয়ে রইলাম।

তিনি বললেন, “মেয়ের পরীক্ষার চাপ, অফিসের কাজ, স্বামীর ফোন… সব একসাথে যেন দম আটকে আসছিল। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি কি এখনও আছি? নাকি শুধু একটা চলমান যন্ত্র?”

আমি বললাম, “তুমি আছো। আর এই একঘণ্টার জন্য হলেও, তুমি কেবল তুমি।”

তিনি একটু হাসলেন। সেই হাসিতে কৃতজ্ঞতা ছিল, স্বস্তিও ছিল, আবার একটা বিষণ্ণ আত্মবিশ্বাসও। বললেন, “তুমি জানো, চিঠিটা আমি পড়েছি। কিন্তু পড়ার চেয়ে বেশি অনুভব করেছি।”

আমার গলা শুকিয়ে গেল। চিঠিটা আমার এতটা কিছুই ছিল না, ছিল কেবল কিছু সত্য, যা আমি বলতে সাহস করিনি মুখে।

তিনি বললেন, “তোমার চিঠির শেষ লাইনে ছিল—‘তুমি কি জানো?’ হ্যাঁ, আমি জানি। জানতাম না, যে জানি, তাও জানতাম না। কিন্তু এখন জানি।”

আমি চুপ করে রইলাম। চোখের পাতা ফেলার মতোই নরম হয়ে এলো সময়টা। আমরা দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, যেন কিছুই বলছি না, অথচ প্রতিটি নিঃশ্বাসে শব্দ জমে যাচ্ছে।

তিনি বললেন, “তোমার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কটা এখন কেমন?”

আমি একটু থেমে বললাম, “স্থির। দায়িত্বে গাঁথা, যেমন বাঁধা পড়ে থাকে সিঁড়ির ধাপে ধুলো। ঝাড়ি দিলেও আবার এসে বসে পড়ে। ভালোবাসা নেই বলব না, কিন্তু মুগ্ধতা নেই। কৌতূহল নেই। আমাদের মধ্যের আলো নিভে গেছে, তবু আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।”

তিনি মাথা নুইয়ে বললেন, “আমারও তাই। কিছু সম্পর্ক ঠিকভাবে ভাঙে না, আবার গড়েও না। শুধু থাকে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তবে কি আমরা ভুল করছি?”

তিনি চমকে তাকালেন। বললেন, “না। আমি ভাবি, যদি কোনো সম্পর্ক এমন হয়, যেখানে কেউ কারও কাছে কিছু চায় না, দাবি করে না, শুধু বোঝে—তাহলে সেটা ভুল হয় না। সেটা প্রয়োজন।”

আমার মনে হলো, আমরা দুজন এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে আমাদের ছায়াগুলো পরস্পরের গায়ে পড়ে, কিন্তু মিলিয়ে যায় না। আমরা চাইলেও এক হই না, আবার দূরও না। আমাদের সম্পর্কটা যেন সন্ধ্যার মতো—দিনের শেষে আলো আর অন্ধকারের সংমিশ্রণে গঠিত এক অপূর্ব ক্ষণ।

সেদিন শর্মিষ্ঠা বলেছিলেন, “আমার সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত হচ্ছে যখন তুমি কিছু না বলে তাকিয়ে থাকো। সেই দৃষ্টির মধ্যে আমি আমার সবচেয়ে সত্যিকারের রূপ দেখতে পাই।”

আমি বলেছিলাম, “কারণ আমি তোমায় কোনও রোল নির্ধারণ করে দেখি না। না স্ত্রী, না মা, না কর্মী। আমি দেখি একজন মানুষ, যার মধ্যে রয়েছে আলোকিত একাকীত্ব।”

তিনি তখন আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, যেভাবে শুধু মেঘভরা আকাশ দেখে কেউ জানে—বৃষ্টি আসবেই।

আমরা আজ আর কথা বলিনি। চুপচাপ ছিলাম। কিন্তু সেই নীরবতা এতই পূর্ণ ছিল যে, আমি বুঝলাম—কিছু কিছু মুহূর্ত চোখের পাতা ফেলার মতো। খুব ধীর, খুব কোমল, কিন্তু মনে গেঁথে যায় চিরদিনের মতো।

ভবিষ্যতের কোনও দিন

ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ। বসন্ত আসার কথা, অথচ হাওয়ায় এখনো শীতের ছায়া। গাছে পাতাঝরা থেমে গিয়েছে, কিন্তু নতুন কুঁড়ির গন্ধ এখনো জাগেনি। প্রকৃতির মাঝের এই সীমানা সময়টা যেন আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের মতো—না পুরোনো, না নতুন; না আগুন, না ছায়া; শুধু অপেক্ষা।

শর্মিষ্ঠা সেদিন একটু পরে এসেছিলেন। হাঁটুর ওপর নামা গাঢ় সবুজ মেখেলা-চাদর পরেছিলেন, হাতে সেই পুরনো চামড়ার ব্যাগ। চোখে ছিল ক্লান্তি, কিন্তু মুখে একরকম স্বস্তি, যেন দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পর কোনও নির্ভরতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।

“আজ আসার কথা ছিল না,” তিনি বললেন।

“তবে এসেছেন,” আমি জবাব দিলাম।

তিনি হালকা হাসলেন। “কারণ আমি ভয় পেয়েছিলাম, যদি আজ না আসি, তাহলে ভবিষ্যতের কোনও দিন আর না আসি। আমাদের এই এক ঘণ্টার সম্পর্কটা যদি একদিন ছিন্ন হয়ে যায়? যদি হঠাৎ করেই এই ক্লাসঘর আর না থাকে?”

আমি বললাম, “তাহলে তো এটা আরও জরুরি হয়ে যায়—আজকে থাকা।”

তিনি মাথা নাড়লেন। “তুমি জানো, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুব কম ভাবি। কারণ ভবিষ্যতের কোনও দিন নেই, যা এই এক ঘণ্টার মতো স্পষ্ট, এই অপেক্ষার মতো সত্য।”

সেদিন আমাদের কথাবার্তা ছিল বেশি, কিন্তু শব্দ ছিল কম। আমরা যেন ভাষাহীন আলোচনায় ব্যস্ত ছিলাম—চোখে চোখ রেখে, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মেলানোতে। তখনই তিনি বললেন, “তুমি কি কখনও ভেবেছো, আমাদের যদি আর দেখা না হয়?”

প্রশ্নটা ছিল অপ্রত্যাশিত, অথচ যুক্তিসঙ্গত।

আমি বললাম, “আমি অনেকবার ভেবেছি। ভাবি, যদি তুমি না আসো, আমি কি আবার এই জানালার ধারে দাঁড়াতে পারব? যদি শুক্রবারটা আর না আসে, আমি কি আবার সপ্তাহ গুনতে পারব?”

তিনি বললেন, “আমি মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে দেরি করে আসি, দেখি তুমি অপেক্ষা করছ কি না।”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম। তিনি বললেন, “না, এটা পরীক্ষা নয়। এটা আশ্বাস। আমি বুঝতে চাই, আমাদের এই সম্পর্কের ভিতরে কতখানি স্থিরতা আছে। আর প্রতিবারই দেখি, তুমি অপেক্ষা করছ। সেটা একটা আশ্বাস।”

আমার চোখে জল চলে এসেছিল। কিন্তু আমি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম, যেন জানালার বাইরের রোদই আমার চোখে পড়েছে।

তিনি বললেন, “তুমি জানো, আমার স্বামী এখন ভারতে ফিরে আসতে চায়। স্থায়ীভাবে। আমাদের পরিবার আবার নতুন করে শুরু হোক, সে চায় এমন। আমি কিছু বলিনি। শুধু ভাবছি।”

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। কণ্ঠ শুকিয়ে গিয়েছিল। এই সম্পর্কের নামহীনতার মধ্যে আজ একটা অনিশ্চয়তার ঢেউ উঠল। আমি কি প্রস্তুত ছিলাম এমন কোনও ভবিষ্যতের জন্য?

তিনি হঠাৎ হাত রাখলেন আমার হাতে। স্পর্শটা হালকা, প্রায় অপ্রকাশ্য। কিন্তু তাতে যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তা কোনও চুক্তির চেয়েও বেশি সত্য।

তিনি বললেন, “আমি যদি না আসি, তুমি জানবে—আমি থেকেছি। এই জানলার ধারে, এই নৈঃশব্দ্যে, প্রতিটা সন্ধ্যায়।”

আমি বললাম, “তুমি না এলেও, আমি দাঁড়িয়ে থাকব। কারণ কিছু সম্পর্ক শেষ হয় না, শুধু উপস্থিতি বদলে যায়।”

আমরা আজ কোনও বিদায় নিইনি। ভবিষ্যতের কোনও দিনের কথা বলেও আজকের দিনে ফিরে এসেছি। আমরা জানি না আগামী শুক্রবার কী হবে। কিন্তু এটুকু জানি, এই মুহূর্তটার ভিতরে যা আছে—তা এক জীবনের সমান।

যে চা কখনো ঠাণ্ডা হয় না

ফেব্রুয়ারির শেষ শুক্রবার। বাতাসে অদ্ভুত একটা তাপ আর শীতের মিশ্র গন্ধ। একটা ঋতু বিদায় নিচ্ছে, আরেকটা আসছে—একটা ছায়া গুটিয়ে নিচ্ছে তার চাদর, আরেকটা আলো নতুনভাবে ছড়াতে শুরু করেছে। এই সন্ধিক্ষণের সময়টাই যেন আমাদের দুজনের সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি।

আজ আমি কিছুটা আগে পৌঁছালাম। অভ্যাসে এখন আমার পা আপনাআপনি জানলার ধারে চলে যায়, যেন শরীর মনে রেখেছে সেই প্রিয় ঠিকানাটা। হাতে একটা কাগজের কাপ, তাতে ধোঁয়া ওঠা চা—সেই কাকুটোর কাছ থেকে যিনি রোজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে পানীয় বানান, যেন তিনিও আমাদের অভ্যস্ত সাক্ষী।

আমি জানি না আজ শর্মিষ্ঠা আসবেন কিনা। আগের সপ্তাহে তাঁর কথায় একটা অনিশ্চয়তার রেখা ছিল—স্বামী ফিরছেন, পরিবার ফের জোড়া লাগাতে চায়। তবু আমার মধ্যে একটা দৃঢ়তা ছিল, আজও আমি আসব, দাঁড়াব, অপেক্ষা করব। সম্পর্ক যদি সত্য হয়, সে ফিরে আসে না—সে থাকে, জায়গা বদলায় মাত্র।

ঠিক তখনই, যখন চায়ের শেষ চুমুকটা নিতে যাচ্ছিলাম, পিছন থেকে শর্মিষ্ঠার সেই চেনা কণ্ঠ—”আজ এক কাপ কম নিলে?”

আমি চমকে তাকালাম। এতটা চমক আমি অনেক দিন পাইনি। হেসে বললাম, “ভাবছিলাম, হয়তো আর আসবেন না।”

তিনি বললেন, “চা যদি কেউ অপেক্ষা করে রেখে দেয়, তা কখনো ঠাণ্ডা হয় না।”

আমার হৃদয়ে যেন একটা নরম আলো জ্বলে উঠল। আজ তাঁর পরনে ছিল খয়েরি কোট আর কালো চুড়িদার, গলায় একটা মাটির হার। চোখে ক্লান্তি নেই, বরং ছিল একধরনের পরিপক্ব প্রশান্তি। যেন অনেক কিছু ভেবে, ঝেড়ে, ফেলে এসেছেন—এখন যা আছে, তাই যথেষ্ট।

আমরা পাশাপাশি দাঁড়ালাম। আমি নতুন একটা চা নিয়ে এলাম—দুজনের জন্য। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আমরা চুমুক দিতে দিতে দেখছিলাম বাইরের গাছ, পুকুর, আর অদৃশ্য পাখিদের ওড়াউড়ি। কিছুই বলার ছিল না, আবার সব কিছুই যেন বলা হয়ে যাচ্ছিল।

একটু পর তিনি বললেন, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

আমি চুপ করে রইলাম।

তিনি বললেন, “স্বামী ফিরছেন। বাড়ির কথা ভাবতে হবে। পরিবার তো একটা কাঠামো, তাকে ভাঙতে নেই। মেয়েটার ভবিষ্যৎ, সুরক্ষা, সমাজ… সব কিছু একসাথে জড়িয়ে আছে।”

আমি মাথা নুইয়ে বললাম, “আমি জানতাম। এবং মানতেও পারি।”

তিনি বললেন, “কিন্তু আমি এ-ও জানি, এই জানলার ধারে তুমি আমার জীবনের সেই অংশ, যেটা কারো কাছে ব্যাখ্যা করা যাবে না, অথচ কোনওদিন অস্বীকার করাও যাবে না। তুমি আছো আমার প্রতিটি চিন্তার ভিতরে—যেমন কিছু চা, ঠাণ্ডা হয় না।”

আমি তাঁকে বললাম, “আমরা কেউই চাইনি এই সম্পর্ক হোক। তবু এটা তৈরি হয়েছে—অতি নিঃশব্দে, নির্জন আবহে। তাই হয়তো এর গুরুত্ব আরও বেশি।”

তিনি বললেন, “আমরা কেউ কাউকে পেতে চাইনি, শুধু বুঝতে চেয়েছিলাম। সেটা তো পাওয়ার চেয়েও বড়।”

আমরা চুপ করে থাকলাম। কিছু সম্পর্ক এমনই হয়—শেষ হয় না, থেমে যায়। আজকের এই চা, এই জানলার ধারে দাঁড়ানো, এই চোখে চোখ রাখা—সবটাই একধরনের সংরক্ষণ। জীবনের জন্য নয়, অনুভবের জন্য।

তিনি বললেন, “তুমি জানো, এই জানলা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। এমনকি এই চা-ও না।”

আমি বললাম, “আমিও। কারণ এই চা-টা, এই মুহূর্তটা, এই না-বলা কথাগুলোই আমার কাছে ভালোবাসা।”

সেদিন আর কোনও প্রতিশ্রুতি ছিল না, কোনো ভাঙনও না। আমরা দুজন দাঁড়িয়েছিলাম আমাদের সম্পর্কের শেষ বিন্দুতে—এক কাপ চা হাতে, আর প্রতিটি চুমুকে জমা করছিলাম যত্ন করে থাকা স্মৃতি।

তোমাকে লেখা শেষ বার্তা

মার্চের শুরুতে বসন্ত নামল ঠিকই, কিন্তু আমার মনে নামল একধরনের গুমরে থাকা নৈঃশব্দ্য। কোচিং সেন্টারে যাওয়া এখনো জারি, অর্ক ক্লাসে যায়, আমি জানলার ধারে দাঁড়াই। কিন্তু জানি, এখন আর প্রতি শুক্রবার সেই পরিচিত মুখটা আসবে না। শর্মিষ্ঠা তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি তাকে দোষ দিই না। শুধু বুঝে গেছি—সব সিদ্ধান্ত যুক্তিবোধে হয় না, কিছু সিদ্ধান্ত হয় বেঁচে থাকার অপরিহার্যতায়।

তবু প্রতি শুক্রবার আমি যাই। যেন প্রতিদিন জানালার ধারে একটি চিহ্ন রেখে যাই—তোমাকে ভুলিনি। হয়তো আশাহীন, হয়তো নিরর্থক, তবু সত্য।

সেদিন বিকেলে, অনেকদিন বাদে আমি লিখতে বসলাম। শর্মিষ্ঠার উদ্দেশে—একটি শেষ বার্তা। কাগজে কলমে নয়, মনের ক্যানভাসে। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই যেন সে লেখা আসছিল—এক নিঃশব্দ আত্মকথা, যার পাঠক একজনই।

“তুমি যখন চলে গেলে, আমি ভাঙিনি। কারণ আমি জানতাম, তুমি ভাঙতে আসোনি। তুমি এসেছিলে জোড়া দিতে—আমার সেই অংশটাকে, যেটা আমি বহু আগে হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজের ভিতরে।
তুমি এসেছিলে আলো হয়ে, অথচ দাবির ভাষা ছাড়াই। এসেছিলে শ্রোতা হয়ে, আমার অন্ধকার কথা গুলো শোনার জন্য।
তুমি বলেছিলে, চা যদি কেউ রেখে দেয়, ঠাণ্ডা হয় না।
তুমি জানো, আমি আজও সেই কাপ চায়ে চুমুক দেই।
তাতে ধোঁয়া নেই, তবু উষ্ণতা আছে।

তুমি চলে গেছো, ঠিক।
তবু আমি অপেক্ষা করি,
কোনো প্রত্যাবর্তনের জন্য নয়—
তোমার সেই চোখের ভাষার জন্য,
যেটা আমি এখনো মনের পর্দায় দেখতে পাই।
তুমি ফিরে এসো না।
কারণ আমরা যা ছিলাম, তার চেয়েও বেশি হয়ে উঠেছি—
দূরত্বে, নীরবতায়, স্মরণে।
এটাই আমাদের প্রেম।
নামহীন, শর্তহীন, চিরস্থায়ী।”

এই লেখাটা আমি কাউকে পাঠাব না। শর্মিষ্ঠাকেও না। কারণ এই লেখার প্রাপ্যতা পাঠানোর মধ্যে নয়, থাকার মধ্যে। যেমন তার উপস্থিতি—কথায় নয়, চুপ করে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা।

সেদিন সন্ধ্যায় আমি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম, চোখ বন্ধ করে। হঠাৎ অনুভব করলাম—একটা হাওয়া আমার কানের কাছে এসে বলল, “আমি আছি।” চোখ খুলে দেখলাম, কেউ নেই। জানালার ওপাশে একটা লাল পালকের পাখি বসেছে। সেই পাখিটার কথা শর্মিষ্ঠা বলেছিল একদিন—যেটা নাকি আগে আসত, এখন আর আসে না।

আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম। জানি না, এটা কাকতাল, না স্মৃতির ছায়া। তবে বুঝলাম, কেউ না থেকেও থেকে যেতে পারে। ঠিক যেমন শর্মিষ্ঠা।

আমাদের প্রেম চিঠির মতো নয়, পাঠানোর জন্য লেখা নয়। আমাদের প্রেম কবিতার মতো, উচ্চারণের অপেক্ষা না করে হৃদয়ে গেঁথে থাকা।

একদিন যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায়

এখন আর প্রতি শুক্রবার বিকেলটা আগের মতো হয় না। আমি এখনও কোচিং সেন্টারে যাই, অর্কর পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি, কিন্তু জানালার ধারে আর দাঁড়াই না। আমি জানি, সে জানালা এখন কেবল একটি পুরনো ফ্রেম—যেখানে আলো এসে পড়ে ঠিকই, কিন্তু কারও ছায়া পড়ে না। তবু কিছু কিছু অভ্যেস মানুষের ভেতরে স্থায়ী হয়ে যায়, যেমন কিছু স্মৃতি—না চাওয়া, না ফেলে দেওয়া, শুধু ‘থাকা’র মতো।

তবু আমি মাঝেমাঝে ভাবি—একদিন যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায়?

হ্যাঁ, এমনই কোনও অসময়ে। হয়তো রাস্তার এক কোণে, কোনও বইমেলায়, কিংবা কোনও ছুটির দিনে সুপারমার্কেটের পেছনের চুপচাপ আলিতে। আমরা একে অপরকে দেখব, প্রথমে থমকে যাব, তারপর হেসে ফেলব—কেননা স্মৃতি কখনও অচেনা হয় না।

আমি কল্পনা করি, সেদিন তার চোখে কী থাকবে? অপরাধবোধ? লজ্জা? না, আমি জানি—সে আসবে না কোনও গ্লানি নিয়ে। বরং চোখে থাকবে সেই চিরপরিচিত প্রশান্তি—যেটা কেবল তার জানালার ধারে দাঁড়ানো দৃষ্টিতে ছিল।

সে হয়তো বলবে, “কেমন আছো, অরিত্রবাবু?”

আমি হেসে বলব, “তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে, ভালোই।”

তাকে বলব না, আমি এখনো মাঝে মাঝে চিঠি লিখি, যদিও জানি সেগুলো পাঠানো হবে না। বলব না, আমি জানালার পাশে এখনো একফালি আলোর খোঁজ করি, যেটা তার কণ্ঠস্বরের মতো নিঃশব্দ, অথচ দাগ রেখে যায়। বলব না, কিছু গান আজও শুধু তার জন্য বাজাই—‘তোমায় গান শোনাব’, কিংবা ‘আকাশ আমায় ভালোবাসে’।

সে বলবে, “আজকাল আর লিখো না কিছু?”

আমি বলব, “লিখি, কিন্তু কেবল ভিতরে।”

সে একটু হেসে বলবে, “তুমি তো এমনই ছিলে—চুপচাপ ভিতরে বাঁচা মানুষ।”

আমাদের দেখা শেষ হবে। কেউ কাউকে ছোঁবে না। কেউ নম্বর চাইবে না, যোগাযোগ রাখার কথা বলবে না। আমাদের সম্পর্ক কখনো যোগাযোগে গড়ে ওঠেনি—তাই তার ভাঙনও হবে না কোনও ছিন্ন সংলাপে।

আমরা হেঁটে চলে যাব দুজন, আলাদা রাস্তায়। কিন্তু জানব, ওই মুহূর্তে, সেই হঠাৎ দেখার অভিজ্ঞতায়, একটা পুরনো গল্প নিজের নতুন পৃষ্ঠায় এসে ঠেকেছিল।

আমি হয়তো সেদিন ঘরে ফিরে আবার জানালার পাশে দাঁড়াব, একটা কাগজ তুলে লিখব—

“তোমাকে হঠাৎ দেখে মনে পড়ল, ভালোবাসা কখনো পুরনো হয় না।
তুমি চলে গেছো ঠিকই,
তবু কিছু চোখ চিরকাল একই ভাষায় তাকায়।
তোমার চোখ আজও সেই ভাষাতেই বলল—
‘আমি এসেছিলাম।’
এবং আমি আজও সেই উত্তরই দিই—
‘আমি এখনও আছি।’”

আমাদের ভালবাসা গল্পের মতো নয়, যেখানে শুরু-শেষ থাকে। এটা সময়ের মতো—চলতেই থাকে। হয়তো আমরা মিলিনি কখনও, কিন্তু একে অপরকে জানতাম, অনুভব করতাম, এবং সেই জানাটাই আমাদের সংজ্ঞা।

হ্যাঁ, একদিন যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায়, তাহলে আমি শুধু একবার তাকিয়ে বলব—

“তুমি যেমন ছিলে, তেমনই আছো।
শব্দহীন, অথচ স্পষ্ট।”

তোমার শহরের রাস্তাগুলো এখনো আমায় চেনে

এখন আর শর্মিষ্ঠার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। না ফোনে, না মেসেজে, না কোনও চিঠিতে। অথচ একটা শহর জুড়ে যেন এখনও তাঁর ছাপ পড়ে থাকে আমার চারপাশে—দেয়ালে, ট্রামের শব্দে, ফুটপাতের ছায়ায়, এমনকি হাওয়ার ধুলোর ভিতরেও। কিছু সম্পর্ক মানুষ রেখে যায় না—শহর রেখে দেয়।

কলকাতার এই শহরটা, যেটা আমাদের নীরব ভালবাসার সাক্ষী ছিল, এখনো মাঝে মাঝে আমায় থামিয়ে দাঁড় করায়। যেমন আজ—একটা বিকেলে, আমি হাঁটছিলাম গড়িয়াহাটের গলির ভিতর দিয়ে। একটা জানালার পাশে চোখ পড়ল—একটানা সূর্য পড়ছিল। হঠাৎ মনে হলো, এই মুহূর্তটা যেন কোথাও আগে দেখেছি। তারপর বুঝলাম—এই রকম আলো পড়ত সেই কোচিং সেন্টারের জানালায়, যেখানে আমরা এক ঘণ্টা করে ভালোবেসে ফেলতাম নীরবে।

একটা পুরনো কাফের সামনে দাঁড়ালাম। সেই চেনা কফির গন্ধ। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা কি এখনও আমাদের দু’কাপ চা মনে রেখেছে? আমি প্রশ্ন করিনি, শুধু একটা চা নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ালাম—যেখানে বসবার জায়গা নেই, তবু দাঁড়ানো যায়, স্মৃতি মেপে।

শর্মিষ্ঠা নেই, কিন্তু তাঁর পথগুলো আছে। যে পথে সে হেঁটেছে, সেই পথ আজও আমার পায়ে চেনা হয়ে উঠেছে। এই শহরের মোড়গুলো এখনও আমাকে মনে করিয়ে দেয় তার চশমার ফ্রেম, তার গলার হাসি, তার হালকা কাশ্মীরি শাল।

আমি এখন বুঝি, শর্মিষ্ঠা শুধু একজন মানুষ নয়, সে একটা সময়। এমন একটা ঋতু, যা ফিরে আসে না, কিন্তু চামড়ার ভিতরে ঢুকে থাকে। তার জন্য অপেক্ষা করি না আর, তবু প্রতিদিনের ভিতর দিয়ে সে আমার সাথেই চলে।

সেদিন বাসে বসে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ পাশের সিটে একটা ছোট্ট মেয়ে উঠে বসল, একটা বই হাতে—‘অপ্রকাশিত চিঠি’। আমি চমকে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম, “এই বইটা তুমি কোথায় পেলে?”

মেয়েটা বলল, “মা দিয়েছে। ওঁর খুব প্রিয়।”

আমি মাথা নিচু করলাম। শব্দগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ওই বইটা একদিন শর্মিষ্ঠার হাতেও ছিল। তাতে কি আমার চিঠিটা এখনও আছে?

সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম—ভালোবাসা অনেক সময় শরীর ছাড়িয়ে চলে যায় শহরের ভিতর। সে ফুটপাতে হেঁটে বেড়ায়, ট্রামের শব্দে ফেরে, বাসের জানালায় বসে থাকে। আর সেই শহরের পথ, জানলা, কফির কাপ—সবই তাকে বহন করে।

আমি এখন আর জানি না, শর্মিষ্ঠা কী করছেন। তাঁর স্বামী ফিরেছেন কিনা, তাঁদের সংসার কেমন চলছে। জানিও না। জানার প্রয়োজনও নেই। কারণ আমি এখন জানি, আমাদের যে অংশটা হারিয়ে গিয়েছিল, সেটা শহরের রাস্তাগুলো বয়ে নিয়ে চলেছে।

তুমি যেখানেই থাকো, শর্মিষ্ঠা, আমি জানি—এই শহর তোমার। এবং তুমি জানো—এই শহর এখনো আমায় চেনে, কারণ আমি ভালোবেসেছিলাম এমনভাবে, যেখানে উপস্থিতি ছাড়াও স্পর্শ থাকে।

তোমার শহরের রাস্তাগুলো এখনো আমার চেনে। আর সেই চিনে রাখাটাই তো প্রেমের সবচেয়ে নিঃশব্দ আশ্বাস।

শেষ ক্লাসের আগে

এপ্রিলের প্রথম শুক্রবার। কোচিং সেন্টারের বড় দেওয়ালে নতুন করে রঙ করা হয়েছে। ভিতরে কিছু বদল এসেছে—দুটো বেঞ্চ এদিক-ওদিক হয়েছে, জানালার পাশে রাখা ছোট ফুলদানিটা সরানো হয়েছে অন্যদিকে। একমাত্র যা বদলায়নি, তা হলো আমার আসা। প্রতি শুক্রবার আমি এখনও আসি। এবং জানি, আজ শেষ ক্লাস।

অর্কর টেস্ট সিরিজ শেষ, সামনে স্কুলের পরীক্ষা। আজকের পর থেকে আর এখানে আসার দরকার হবে না। আমি নিজেও জানি, এটাই আমারও শেষ আসা—এই জানালার ধারে, এই অপেক্ষার ঘরে।

আজ খুব নিরব ছিল পরিবেশ। বিকেলের আলো কেমন নিস্তেজ, যেন ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছে জানালার কাঠে। বাইরে গাছগুলো ফুলে ভরা, অথচ কোনও গন্ধ আসছে না। আমি বসে রইলাম, সেই পুরনো বেঞ্চে, যেখানে একসময় শর্মিষ্ঠা এসে পাশে দাঁড়াতেন, হঠাৎ বলে ফেলতেন কিছু পংক্তি, অথবা শুধুই নিরবতার ভিতরে হাত রাখতেন।

স্মৃতি ফিরে আসে না ঠিক, স্মৃতির ছায়া ফিরে আসে। আজ সেই ছায়ায় আমি ডুবে গেলাম।

আমি মনে করলাম—প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল, তিনি ধূসর তাঁতের শাড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি জানালার ধারে ছিলাম, আর আলো এসে পড়েছিল তাঁর চোখের নিচে। সেই আলোটা আজও আমার মনে রয়ে গেছে। তারপর আস্তে আস্তে, প্রতি শুক্রবার এক ঘণ্টা করে গড়ে উঠেছিল এমন এক সম্পর্ক, যেখানে কেউ কারও কাছে কিছু চায়নি। শুধুই ছিল বোঝার স্পর্শ।

তিনি বলতেন, “এই এক ঘণ্টা যেন আমার জীবনের বিরতি চিহ্ন।” আমি বলতাম, “এই অপেক্ষা-ই তো আমাদের গল্প।” সেই গল্প আজ শেষের দিকে।

চায়ের দোকানদাদু আজ আর চা দেয়নি নিজে থেকে। জিজ্ঞেস করলেন, “আজই শেষ?”

আমি মাথা নাড়লাম। “হয়তো। আপনি মনে রেখেছেন?”

তিনি হেসে বললেন, “এই চায়ের কাপগুলোও কিছু মুখ মনে রাখে।”

আমি চা নিলাম, ধোঁয়া উঠছে না তেমন, তবু উষ্ণতা আছে। চুমুক দিতে দিতে আমি একটা খাতা খুললাম, তাতে একটা পৃষ্ঠায় শুধু একটা লাইন লিখলাম—
“আমরা যে জানালার ধারে বসেছিলাম, সেটাও একরকম জীবন ছিল।”

আজ শর্মিষ্ঠা আসবেন না, জানি। হয়তো দূরে কোথাও, অন্য কোনও জানালার ধারে তিনিও বসে আছেন, আজকের দিনের কথা ভাবছেন। হয়তো তাঁর স্মৃতিতেও আমি একটা চা-কাপ হয়ে আছি, যেটা ঠাণ্ডা হয় না, কেবল একটু নিরব হয়।

চলতে চলতে আমি উঠে দাঁড়ালাম, চারপাশটা একবার শেষবারের মতো দেখে নিলাম। জানালার কাচে আমার প্রতিবিম্ব পড়ছে। একা। তবু পূর্ণ। কারণ আমি জানি, এই এক ঘণ্টাগুলো আমাকে বদলে দিয়েছে। আমি এখন আরও নরম, আরও গভীর, আরও নিঃশব্দ।

শেষ ক্লাস মানেই কি শেষ হয় সবকিছু? না। কিছু কিছু পাঠ আমরা বহন করি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এই সম্পর্ক, এই জানালার ধারে দাঁড়ানো, এই নিরবতা—সবই সেই পাঠ। কোনও সার্টিফিকেট নেই, কোনও নাম নেই। তবু এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষালয়।

আজ আমি যাচ্ছি, শূন্য হাতে। কিন্তু বুক ভরা একটা প্রাক্তনতার উষ্ণতা নিয়ে। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করলাম। মনে মনে বললাম—“তুমি না থেকেও আছো, এই ক্লাসঘরের প্রতিটি নিঃশ্বাসে।”

ভালোবাসা, নামহীন

কোচিং সেন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। জানালার ধারে আর কেউ দাঁড়ায় না। বেঞ্চগুলো তুলে রাখা হয়েছে একপাশে। চায়ের কাপে ধোঁয়া ওঠে না, চেনা কণ্ঠের কেউ আর চা চায় না। আমি এখন আর প্রতিদিন শুক্রবারের পথ ধরে হাঁটি না—তবু কখনও কখনও মন চুপিচুপি সেই রাস্তায় ঢুকে পড়ে। মনে পড়ে, এ পথে একটা জানালা ছিল, যার পাশেই আমার মন চুপ করে বসে থাকত।

এখন আমি অন্য জীবনযাপনে অভ্যস্ত। অফিস, সংসার, ছেলের পড়াশোনা, স্ত্রীর ব্যস্ততা—সব চলছে আগের মতো। তবু কোথাও একটা ছায়া লেগে থাকে প্রতিটি ঘরের কোণায়। ছায়া, যেটা আলো ঢোকার ঠিক আগেই পড়ে। ছায়া, যেটা একান্ত নিজস্ব।

সেই ছায়াটা শর্মিষ্ঠা।

ভালোবাসা শব্দটা আমাদের কারও মুখে কোনওদিন আসেনি। আমরা তাকে ডেকেছি ‘অপেক্ষা’, ‘নীরবতা’, ‘চা’, ‘জানালার আলো’—এইসব নামে। কেউ কাউকে বলেনি “ভালোবাসি”, অথচ যা ছিল, তা ওই শব্দের চেয়েও গভীর। আমরা নাম রাখিনি—কারণ আমরা জানতাম, নাম দিলে সম্পর্কটা সামাজিক হয়ে যায়, গৃহপালিত হয়। আর আমরা তাকে পোষ মানাইনি, বরং উড়তে দিয়েছিলাম।

এখন আমি জানি, ভালোবাসা মানেই পাশে থাকা নয়। ভালোবাসা মানে, এমন কেউ যার কথা হঠাৎ রাস্তায় ট্রামের ঘণ্টি শুনলে মনে পড়ে। কারও জন্য সেই গানটা আবার চালিয়ে দেওয়া—”তোমায় গান শোনাব”—যেখানে কেউ নেই, তবু সে থেকে যায়।

কিছু সম্পর্ক চিরকাল অসমাপ্ত থাকে। শেষ হয় না, কারণ শুরুটাই তো ছিল নৈঃশব্দ্যের ভিতর। আমরা দুজন জানতাম, একে অপরের জীবনে প্রবেশ করেছি অতিথির মতো—কোনও চাবি ছাড়া, কোনও দাবি ছাড়া। শুধু একখানি জানালা খুলে রেখে এসেছি, যাতে আলো ঢোকে, বাতাস চলাচল করে, মন একটু থামে।

অনেক বছর পরে, আমি হয়তো একদিন নিজের পুরনো ডায়েরি খুলে দেখব—সেই পাতাটা, যেখানে লেখা ছিল:

“তুমি এসেছিলে, অথচ ছুঁয়ে যাওনি।
তবু আমি জেনেছি—ভালোবাসা কখনও কখনও
শুধুই অপেক্ষা।
আর আমি সেই অপেক্ষার মানুষ।”

এটাই আমাদের গল্প। কোনও নায়ক-নায়িকা নেই, কোনও নাটক নেই, শুধু দুটো নিঃশব্দ আত্মা এক ঘণ্টার জানালার পাশে বসে থেকেছে কিছু সন্ধ্যাবেলা।

আমাদের ভালোবাসার নাম নেই। আর সেই নামহীনতাই ছিল তার গভীরতা।

শেষ

1000024289.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *