কুহেলি দত্ত
১
বসন্তের সেই দুপুরে, যখন পাতাঝরা শিমুল গাছের তলায় বাতাস হালকা রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছিল, মেঘলার জীবনে প্রথমবার ঢুকে পড়েছিল ঈশান। কলেজের নতুন ক্লাসরুমে যখন সবাই নিজেদের চেয়ারে বসে কেমন যেন অচেনা অস্বস্তিতে গুটিয়ে ছিল, তখন মেঘলার চোখ পড়ে এক ছেলেকে—লম্বা, শান্ত মুখ, চোখের ভেতরে কেমন এক গভীর দৃষ্টি, যেন বহু কথা জমে আছে সেখানে। ঈশানের পাশে বসেছিল মেঘলা, নিছক সিট খালি ছিল বলে, কিন্তু সেই সিট ভাগাভাগি করতে করতেই দুজনের ভেতরে জড়িয়ে গিয়েছিল এক অদৃশ্য সুতো, যেটা তারা প্রথমে টেরও পায়নি। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, দুজনে একসাথে ক্লাসে যেত, লাইব্রেরিতে বসে একে অপরের কবিতার খাতা দেখত, নদীর ধারে বসে রবি ঠাকুর পড়ত। ঈশান তার হাসি দিয়ে মেঘলার নিঃসঙ্গতা ঢেকে দিত, আর মেঘলা তার নীরব চোখে ঈশানকে বোঝার চেষ্টা করত। প্রেম শব্দটা কখন এলো, তা কেউ জানে না, কিন্তু একদিন বিকেলে ছায়াঘেরা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ঈশান বলেছিল, “তুই গেলে আমি কোথায় যাব বল তো?”—মেঘলা কিছু বলেনি, শুধু তার হাতটা একটু শক্ত করে ধরে রেখেছিল।
এই ভালোবাসা কোনো নাটকীয় উচ্চারণে জন্মায়নি, বরং প্রতিদিনের খুঁটিনাটি মুহূর্তে তারা একে অপরের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। মেঘলার কবিতার খাতার পিছনের পাতায় ঈশানের অদ্ভুত আঁকিবুঁকি, কিংবা ঈশানের নোটবুকের পাতায় মেঘলার নাম লেখা—এইসব ছোট ছোট ইঙ্গিতেই তারা ভালোবাসার গভীরে পৌঁছে গিয়েছিল। কলেজের শেষ বর্ষে এসে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল একসঙ্গে ভবিষ্যৎ গড়ার। ঈশান চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আর মেঘলা ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। সেই দিনগুলো ছিল উজ্জ্বল, নির্ভার, যেন তাদের চারপাশে কেবল আলো আর আশ্বাস। কিন্তু এই নির্ভার আলো-আশ্বাসের মাঝে একটা অদৃশ্য অন্ধকার যেন অপেক্ষা করছিল। একদিন, শহর থেকে একটু দূরের এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে যাচ্ছিল তারা। ঝড়ের আভাস ছিল আকাশে, কিন্তু তখনও তাদের মনে কোনো ভয় ছিল না। বাসে উঠেছিল দুজনে পাশাপাশি বসে, ঈশান বলছিল একটা নতুন কবিতার লাইন—“তুই যদি হারিয়ে যাস, আমি কি তোর স্মৃতির ভেতর বেঁচে থাকব?” মেঘলা হেসেছিল, তার উত্তর হয়নি।
বাস সেই রাতেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। হঠাৎ ব্রিজের কাছে এসে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। অনেকেই বেঁচে যায়, কিন্তু ঈশান আর ফিরে আসে না। মেঘলার জ্ঞান ফিরেছিল হাসপাতালের সাদা বিছানায়, মাথায় ব্যান্ডেজ আর বুকজুড়ে হাহাকার। ঈশানের মৃতদেহও তখন খুঁজে পাওয়া যায়নি—সে নিখোঁজ। পুলিশ জানিয়ে দেয়, হয়তো নদীর নিচে তলিয়ে গেছে। এই ‘হয়তো’-তেই আজও আটকে আছে মেঘলার শ্বাসপ্রশ্বাস। সেইদিনের পর থেকে সে আর কারো দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার ভাষা খুঁজে পায়নি। তার কবিতার খাতা বন্ধ হয়ে যায়, শুধু মাঝে মাঝে রাতে তার স্বপ্নে ফিরে আসে ঈশানের কণ্ঠ—”তুই যদি ফিরে দেখিস, আমি থাকব তোর পাশে… ঠিক যেমন ছিলাম।” সে বিশ্বাস করতে শেখে না, কিন্তু অপেক্ষা থামে না।
দশ বছর পেরিয়ে গেছে। বসন্ত এখনো আসে, শিমুল গাছে এখনো লাল রঙ ফোটে, কিন্তু মেঘলার হৃদয়ে কোনো রঙের অস্তিত্ব নেই। সে এখন শহরের পুরনো লাইব্রেরিতে কাজ করে, পাঠকদের বই দেয়, পুথির গন্ধ নেয়, আর মাঝে মাঝে পুরনো কবিতার খাতা খুলে ঈশানের সেই লেখা পাতাগুলো পড়ে—যেগুলো কখনো ছাপা হয়নি, কিন্তু তার আত্মার ভেতর রয়ে গেছে অক্ষরে অক্ষরে। একদিন, একটি হালকা রোদঝলমলে দুপুরে, যখন ছাদে বসে চা খাচ্ছিল, সে হঠাৎ নিচে তাকিয়ে দেখল এক যুবক লাইব্রেরির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটির চোখে কিছু ছিল—এক অদ্ভুত চেনা অভিব্যক্তি, একদম ঠিক সেই রকম, যেমন ঈশানের ছিল যখন সে মেঘলাকে প্রথম দেখেছিল। মেঘলার শরীর যেন হঠাৎ এক শীতল হাওয়ার ঝাপটায় কেঁপে উঠল। কেউ একজন ফিরে এসেছে—নাকি এ কেবল তার কল্পনার প্রতিধ্বনি?
২
সেই অপরাহ্নের রোদ, লাইব্রেরির পুরনো জানালার গ্লাস ভেদ করে যখন মেঘলার মুখে পড়ছিল, তখনও তার বুকের ভেতর হঠাৎ করে হালকা কাঁপন জেগেছিল। নীচে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে দেখতে পাচ্ছিল না একেবারে স্পষ্টভাবে—তবে তার চেহারার ছায়া, দাঁড়ানোর ভঙ্গি, এবং চোখের দিকে তাকানোর ভঙ্গিমা—সব যেন মেঘলাকে ধাক্কা মেরে নিয়ে গেল সেই পুরনো দিনগুলিতে। বুকের ভেতরে যে রুদ্ধ স্মৃতিগুলো সে এত বছর ধরে আটকে রেখেছে, সেগুলো যেন হঠাৎ জানলার কাঁচ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। সে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে, অজান্তেই। বুক ধড়ফড় করছিল, মনে হচ্ছিল—যদি এই কল্পনা হয়, যদি ভুল হয়, তাও দেখতে হবে, নিশ্চিত হতে হবে—কারণ ঈশানের মতো করে তাকানো মানুষ এই পৃথিবীতে আর কজন আছে?
নিচে এসে সে দেখে, ছেলেটি সত্যিই দাঁড়িয়ে, তার গায়ে হালকা বাদামি শার্ট, চোখে ক্লান্তি আর একরকম বেখেয়াল সৌম্যতা। মেঘলা তার দিকে তাকিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, ছেলেটি ভদ্রভাবে তাকায়, চোখ নামিয়ে আবার তাকায়। তারপর বলে, “দিদি, এই লাইব্রেরিতে কি পুরোনো বাংলার সাহিত্য আছে? আমি কিছু খুঁজছি—জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের সংগ্রহ।” কণ্ঠস্বরে কোনো অদ্ভুতত্ব নেই, তবুও মেঘলার ভেতরে রীতিমতো কাঁপুনি ধরে। এত বছর পর কেউ যদি একই কণ্ঠে প্রশ্ন করে—এ কি কাকতালীয়? সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “হ্যাঁ, আছে। ভিতরে আসুন।” ছেলেটি ভিতরে ঢুকে পড়ে বইয়ের তাকের দিকে, আর মেঘলা নিজের চেয়ারে বসে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। হঠাৎ যেন ভেতরের কিছু জমাট স্মৃতি গলে যেতে থাকে—একটা দৃশ্য ফিরে আসে মনে, যখন ঈশান বইয়ের তাক ঘেঁটে বের করছিল “শ্রেষ্ঠ কবিতা”, আর মেঘলা তাকিয়ে ছিল চুপচাপ।
ছেলেটি বই নিতে নিতে ঘুরে বলে, “আপনি কি এখানে অনেকদিন কাজ করছেন?” মেঘলা মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ, প্রায় আট বছর।” সে জিজ্ঞেস করে, “নতুন এসেছেন?” যুবক মাথা নাড়ে—“হ্যাঁ, আসলে পুরনো বাংলা সাহিত্য নিয়ে একটা গবেষণার কাজ করছি। তাই ভাবলাম কয়েক মাস এই শহরেই থাকব। শান্ত জায়গা, আর এই লাইব্রেরিটা তো দারুণ!” তার মুখে যেন এক ধরনের সহজ সৌম্যতা আছে, কোনো কৃত্রিম ভাব নেই। কিন্তু তার কথার ভেতর দিয়ে একটা অস্পষ্ট চেনা সুর বয়ে যায়—ঈশানের মতোই কিছু একটা… হয়তো তার হাসির প্রান্তে, অথবা চোখের কোনায়। মেঘলা নিজের ভেতর যুদ্ধ চালায়—এ কী মনের ভুল? নাকি… কিছুর ইঙ্গিত? নামটা জানার জন্য জিজ্ঞাসা করে, “আপনার নাম?” যুবক বলে, “রুদ্রজিৎ। তবে সবাই রুদ্র বলে।”
মেঘলার গলার স্বর কেঁপে যায় মুহূর্তে। রুদ্র। নামটা নতুন, মুখটা নতুন, তবুও তার প্রতিটি দৃষ্টিতে এমন কিছু আছে যা ব্যথার মত চেনা লাগে। রুদ্র যখন চলে যায় বই হাতে, তখন মেঘলা আবার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। বাতাসে বইয়ের পাতার গন্ধ ছড়িয়ে আছে, ঠিক যেমন ছড়িয়ে ছিল সেই দিনে, যেদিন প্রথম ঈশান বলেছিল—“বইয়ের পাতায় তুই থাকিস, বুঝলি?” তখন মেঘলা হেসেছিল, কিন্তু আজ তার মুখে হাসি নেই, কেবল এক তীব্র দ্বিধা। সে জানে, মানুষের মধ্যে মিল থাকতে পারে, চোখের ভাষা অনেক সময় মনের ভুল হতে পারে। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা বলে, কিছু মিল কেবল দৈব নয়, কিছু মিল ফিরে আসে—আবার কিছু কথা শুনতে হয়, যেগুলো চুপ করে থেকেও বলা হয়। আজ মেঘলার অপেক্ষা নতুন অর্থে জেগে উঠেছে, এবং সে জানে—রুদ্র আবার আসবে। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই, কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়াই, যেন কাউকে খুঁজতে এসেছে বহু জন্ম পরে।
৩
পরের দিন রুদ্র আবার আসে, একদম ঠিক সেই সময়টায় যখন লাইব্রেরির ছায়া দীর্ঘ হতে থাকে এবং মেঘলার ডেস্কের উপর নিঃশব্দে ধুলো জমে। ছেলেটির হাঁটার ছন্দ, দরজার পাশ দিয়ে সরে দাঁড়ানোর ভঙ্গি—এসব আজ যেন আরও স্পষ্ট করে জানান দেয় যে সে ঈশানের ছায়ার মধ্যেই ঢুকে পড়েছে। রুদ্র দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে এক মুহূর্ত, তারপর হাসে—একটা ছোট, চাপা হাসি—যেটা দেখেই মেঘলার বুকের ভেতর থেকে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। রুদ্র বলে, “দিদি, আপনি কি গতকাল একটা বই আলাদা করে রেখেছিলেন?” মেঘলা চমকে ওঠে—সে কি কোনো বই রেখেছিল? না, রাখেনি। তবুও মাথা নেড়ে বলে, “আচ্ছা, দেখে বলছি।” ভিতরের তাক ঘেঁটে কিছু একটা খুঁজে আনে, কিন্তু মনে মনে ভাবে—এই ছেলেটি কীভাবে যেন তার মনের ভিতরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। রুদ্র চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বলে, “এই লাইব্রেরিতে একটা গন্ধ আছে, জানেন? পুরোনো সময়ের, অদ্ভুত শান্ত, যেন কেউ এখানে আজও অপেক্ষা করছে।”
মেঘলা বুঝে যায়—এই মুহূর্তটি সাধারণ নয়। এমন সব কথা কেউ বলে না, যিনি সদ্য এসেছে, এবং কারো গল্প জানেন না। রুদ্র বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টায়, হঠাৎ একটি পাতায় থেমে যায়। চোখ নামিয়ে বলে, “এই কবিতাটা… কেমন যেন চেনা লাগে। আগে কোথাও পড়েছি বলে মনে হচ্ছে, অথচ মনে পড়ছে না ঠিক কোথায়।” মেঘলা বইয়ের দিকে তাকায়—জীবনানন্দের একটি বিখ্যাত কবিতা, যেটা ঈশান বারবার পড়ত, একবার তো মেঘলার জন্মদিনে নিজের হাতে কাগজে লিখে উপহার দিয়েছিল। রুদ্র কীভাবে তা মনে করল? এ কি নিছক সাহিত্যপ্রেমের টান, না কি স্মৃতির কোনও স্রোত অন্য জন্মে গিয়ে ধাক্কা মেরে এসেছে? মেঘলা চুপ করে থাকে। কিন্তু তার মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে যায়। এখন সে শুধু একজন লাইব্রেরিয়ান নয়, এখন সে একজন অনুসন্ধানী—সে খুঁজছে উত্তর, এমন এক প্রশ্নের যা সে নিজেকেই জিজ্ঞেস করতে ভয় পায়।
সন্ধের আলো নামতে থাকে। বাইরের রাস্তায় কাকের ডানায় দিন ঢেকে আসে। রুদ্র লাইব্রেরি ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু যাওয়ার আগে বলে, “একটা অদ্ভুত স্বপ্ন আমি বারবার দেখি—একটা নদীর পাড়, একজন মেয়ের মুখ, আর একটা ঝড়ের শব্দ। মনে হয় যেন আমি কোথাও ছিলাম, কাউকে হারিয়েছি, অথচ মনে পড়ে না কিছুই।” মেঘলা হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন নিজের চোখের জল লুকাতে চায়। এই স্বপ্ন তার খুব চেনা—ঈশানের মৃত্যুর আগের দিনও এই দৃশ্যগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছিল তার মনে। মেঘলা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছে, আর রুদ্র ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়, তার ছায়া মিলিয়ে যায় গোধূলির লালচে আলোয়। বাতাসে তখনও তার গলার প্রতিধ্বনি ভেসে থাকে—ঝড়, নদীর পাড়, হারিয়ে যাওয়া মুখ—এ সবই যেন ফিরে আসে আবার।
সেই রাতে মেঘলা ঘুমাতে পারে না। তার ঘরে ঈশানের পুরনো কিছু চিঠি আছে, যেগুলো সে পড়ে না বহু বছর ধরে। কিন্তু আজ, সে একটার পর একটা চিঠি খুলে বসে। এক চিঠিতে ঈশান লিখেছিল, “তুই যদি আমার আগে চলে যাস, আমি অপেক্ষা করব ঠিক নদীর ধারে। আর যদি আমি আগে চলে যাই, জানবি—তোর অপেক্ষায় আমি জন্ম নেব।” চোখে জল চলে আসে মেঘলার, সে চিঠিটা বুকের কাছে চেপে ধরে অনেকক্ষণ বসে থাকে। তারপর জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখে, আকাশে চাঁদের পাশে একলা একটা তারা জ্বলছে। সে নিজের মনকে বলে—এই যা ঘটছে, তা হয়তো কাকতালীয়। কিন্তু হৃদয়ের গভীরতম জায়গা থেকে একটা কণ্ঠস্বর বলে—না, কিছুই কাকতালীয় নয়। ঈশান ফিরে এসেছে। অন্য নামে, অন্য চেহারায়, কিন্তু একই আত্মা নিয়ে। মেঘলা জানে, গল্প এখনো শেষ হয়নি—শুধু একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে।
৪
পরদিন সকালে মেঘলা খুব তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর এক অদ্ভুত হালকা অনুভব ছিল তার ভেতরে, যেন বুকের মধ্যে জমে থাকা কুয়াশা একটু পাতলা হয়েছে। সে জানে না এটা রুদ্রর জন্য, নাকি সেই পুরনো স্বপ্নের জন্য, যা গতরাতে আবার ফিরে এসেছিল—ঝড়, নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়ামূর্তি, আর তার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হাত। মেঘলা ধীরে ধীরে নিজের পড়ার ঘরে ঢুকে, খাটের নিচে রাখা একটা পুরনো কাঠের বাক্স টেনে আনে। বহু বছর আগে এই বাক্সেই সে লুকিয়ে রেখেছিল ঈশানের চিঠি, ছবি, কবিতার খাতা—সব স্মৃতির ধুলোঢাকা দলিল। বাক্স খুলতেই এক ঝাঁক পুরনো কাগজের গন্ধ বাতাসে ভেসে ওঠে, যেন বহুদিনের ঘুম ভেঙে কিছু শব্দ জেগে উঠতে চায়। সে ধীরে ধীরে একটার পর একটা কাগজ খুলে পড়ে—ঈশানের হাতের লেখা, কিছু অসমাপ্ত কবিতা, কিছু টুকরো টুকরো অনুভব—যেগুলো আজও এতটাই জীবন্ত যে মেঘলার চোখ ছলছল করে ওঠে।
একটি পুরনো খয়েরি মলাটের ডায়েরি, যেখানে ঈশান মাঝেমধ্যে নিজের কবিতাগুলো লিখত, সেটা খুলতেই প্রথম পাতায় দেখা যায় একটা লাইন—”আমি ফিরে আসব, ঠিক তোর ছায়ার পাশে দাঁড়িয়ে।” মেঘলা থমকে যায়। লাইনটা যেন রুদ্র বলেছিল, অথবা কোনো এক বিকেলে লাইব্রেরির জানালার পাশ দিয়ে চলে যেতে যেতে মেঘলা শুনেছিল এমন কিছু। এই ডায়েরির লাইন আর রুদ্রর মুখের শব্দ কীভাবে এক হল? পাতাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে এক জায়গায় এসে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা পাতায়, ঈশানের অসমাপ্ত কবিতার ঠিক নিচে, ছোট করে লেখা—“মেঘ, যদি আমি একদিন ভুলে যাই নিজেকে, তুই কি আমায় চিনবি?” এই প্রশ্নটা যেন বুকের ভিতর সরে গিয়ে কোথাও লেগে থাকে। আজ রুদ্রের চোখে যে খোঁজ ছিল, সেই একই প্রশ্ন কি ঈশান রেখে গিয়েছিল তার লেখায়?
সন্ধে নাগাদ লাইব্রেরিতে বসে এইসব ভাবছিল মেঘলা। সে নিজেই আজ নিজের ভিতরকে অচেনা লাগছে। একদিকে বাস্তব—রুদ্র একজন নতুন মানুষ, সাহিত্যপ্রেমী, গবেষণার কাজে এসেছে, কিছু অদ্ভুত অভ্যাস কিংবা মিল থাকা কেবলই কাকতালীয়। কিন্তু অন্যদিকে হৃদয়ের আরেকটা কণ্ঠস্বর—যেটা যুক্তির বাইরে, সে বলছে এই মিলগুলো খুব গাঢ়, খুব গভীর। রুদ্র আজকেও লাইব্রেরিতে এসেছে, চুপচাপ একটি বই নিয়ে ছায়ার নিচে বসে আছে। অনেকক্ষণ পর মেঘলা এগিয়ে গিয়ে বলে, “তোমার স্বপ্নটা কেমন? সেই নদীটা কেমন দেখতে?” রুদ্র চোখ তুলে তাকায়। তার চোখে ধোঁয়াশার মতো বিস্ময়, অথচ আশ্চর্যভাবে শান্ত। সে বলে, “সবচেয়ে আশ্চর্য হলো… নদীটার পাশে একটা ছোট বেঞ্চ আছে, আর একজন মেয়ে বসে থাকে। আমি তার মুখ দেখতে পাই না, কিন্তু আমি জানি… ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে।” মেঘলা হাসে না, কাঁদেও না, শুধু মাথা নিচু করে বলে, “হয়তো দেখেছ…”
সেদিন মেঘলা রুদ্রকে ঈশানের একটা কবিতা পড়ে শোনায়, কিন্তু বলে না যে এটা ঈশানের লেখা। কবিতাটি এমন—“আলোর নিচে যাদের ছায়া হয়, আমি তাদের ভালোবাসি / কারণ তারা চলে যায় না, শুধু রূপ বদলায়।” রুদ্র গভীর মনোযোগে শুনে, কবিতার শেষে বলে ওঠে, “এই কবিতাটা আমার খুব চেনা লাগছে। কোথায় যেন পড়েছি বা শুনেছি আগে। হয়তো কোনো স্বপ্নে।” মেঘলার শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে, কারণ এই কবিতার সেই শেষ লাইনটা ঈশান লিখেছিল এক দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ আগে। সে বুঝে যায়, কাকতালীয় বলে কিছু হয়তো সত্যিই নেই। কিছু কিছু ভালোবাসা হয়তো শব্দ হয়ে ফিরে আসে, কখনো মুখ বদলে, কখনো নাম বদলে, কিন্তু আত্মা বদলায় না। মেঘলা জানে, উত্তর সে আজও পায়নি, কিন্তু তার হৃদয় এখন আর একা নয়—তার প্রতিধ্বনি ফিরে এসেছে, এক নতুন চেহারার প্রতিচ্ছবিতে।
৫
শিউলির ঘুম আজ ভাঙে আগেভাগেই। জানালার বাইরে শিউলি ফুলের গন্ধে ভরে আছে গোটা আঙিনা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে, ভোরের কুয়াশা ভেদ করে দেখা যায় দূরের গাছপালা—সবকিছু যেন নিঃশব্দে কিছু বলতে চাইছে আজ। আজ সেই দিন, যেদিন শিউলি সেই যুবককে আবার দেখতে পাবে—সে কথা দিয়েছিল। স্কুলের ছুটির পর সেই পুকুরপাড়ে, যেখানে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। সকালটা যায় গৃহস্থালির কাজ আর অস্থির অপেক্ষার মাঝে। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই অচেনা চেনা মুখ, চোখের ভাষা, সেই নামহীন টান। বিকেলের দিকে, একটা হালকা নীল সালোয়ার পরে সে বেরোয়, বুকের ভেতর ধুকপুক ধ্বনি নিয়ে। পুকুরপাড়ে পৌঁছে দেখে ছায়া পড়া জলরাশিতে খেলে যাচ্ছে রোদের রঙ। বেঞ্চে বসে সে অপেক্ষা করতে থাকে। মিনিট কাটে, আধঘণ্টা যায়, কিন্তু কেউ আসে না। হঠাৎ সে অনুভব করে, তার ঠিক পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে—শব্দ না করে নিঃশ্বাস ফেলছে যেন তার ছায়ার সঙ্গে মিশে। সে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়। সেই যুবক—আবার ঠিক তার সামনে।
আজকের আলোয় ছেলেটিকে আরও স্পষ্ট দেখায়। তার গায়ের রঙ হালকা শ্যামলা, মুখে অদ্ভুত শান্তি। চোখ দুটি যেন অতীতের ঝড়-জলের সাক্ষী। “তুমি ঠিক সময়েই এসেছো,” বলে শিউলি হালকা হাসে। যুবক মৃদু কণ্ঠে বলে, “তুমি ঠিক সেই রকমই আছো, যেমন ছিলে সেইসব স্বপ্নে।” শিউলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “স্বপ্নে?” যুবক তখন এক অদ্ভুত কথা বলে, “তোমার নাম শিউলি, তুমি ছোটবেলায় খুব কাঁদতে, যখন গাছে পাখি মরত। তোমার প্রিয় রঙ ছিল নীল, আর তুমি বলেছিলে—যদি কখনও হারিয়ে যাও, তবে শিউলি গাছের নিচেই খুঁজে পাবে তোমায়।” শিউলি স্তব্ধ হয়ে যায়। এত কিছু কি করে জানে এই ছেলেটি? এতো তার শৌনকের কথাগুলো! ঠিক এমনই বলত সে—হাসতে হাসতে, আদর করে। কিন্তু এই যুবক তো তাকে চেনে না, অন্তত নামেই তো নতুন পরিচয় দিল। তাহলে কি এও কোনো প্রহেলিকা? নাকি সত্যিই শৌনক ফিরে এসেছে অন্য নামে, অন্য চেহারায়?
পুকুরপাড়ের বাতাস যেন ভারী হয়ে আসে। শিউলি যুবকের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি কে? সত্যি করে বলো। আমি আর এই খেলার ভেতর থাকতে পারছি না।” যুবক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “আমার নাম এখন সায়ন। আমি জানি না কেন তুমি আমার এত পরিচিত লাগো। কিন্তু আমি যতবার ঘুমোতে যাই, স্বপ্নে তোমার মুখ দেখি। সেই স্কুল, সেই পুকুরপাড়—সব যেন মনে পড়ে যায়। আমি জানি না কেন এগুলো মনে পড়ে, অথচ বাস্তবে কখনও আসিনি এসব জায়গায়।” শিউলি এবার অনুভব করে তার শরীরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। সে বলে, “তুমি শোন না, এক সময় আমি একজনকে ভালোবেসেছিলাম। নাম ছিল শৌনক। দুর্ঘটনায় হারিয়ে যায়। কিন্তু আজ, এত বছর পর, তুমি এসে সবকিছু ওলটপালট করে দিলে।” সায়ন চোখ নামিয়ে চুপ করে যায়। বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ বাড়তে থাকে। একটা শালিক পাখি পাশের গাছ থেকে ডেকে ওঠে—সেই পুরোনো ডাকে। যেন প্রকৃতি নিজেই সাক্ষী দিচ্ছে এই পুনর্মিলনের।
সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে আসে। শিউলি আর সায়ন দুজনে পাশাপাশি হাঁটে—নীরবে, অথচ প্রতিটি পায়ে জমে থাকে ইতিহাসের স্পর্শ। পথ চলতে চলতে শিউলি হঠাৎ থেমে যায়। “তুমি কি বিশ্বাস করো পুনর্জন্মে?” সে জিজ্ঞেস করে। সায়ন কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দেয়, “আমি কিছুই জানতাম না এতদিন। কিন্তু আজ তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়—হয়তো সত্যিই কিছু থেকে যায়। মনের গহীনে। আত্মার ভেতরে।” শিউলির চোখে জল এসে যায়, কিন্তু সে কিছু বলে না। কেবল মনে মনে বলে ওঠে, “তবুও অপেক্ষা করেছিলাম”—হয়তো এ কারণেই। রাত গভীর হয়। দুই ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় গাছের আড়ালে, যেন প্রকৃতি আবার লিখে দেয় এক অজানা প্রেমকথা—শুরু হচ্ছে এক নতুন অধ্যায়, পুরোনো পরিচয়ের আবছা ছায়ায়।
৬
অপর্নার জীবনে ফাল্গুন এসেছে, কিন্তু হাওয়া যেন উল্টো বইছে। কাজের ফাঁকে চোখ রাখছে বারান্দার দিকে, যেন সেই চেনা ছায়া ফিরে আসবে। তিন মাস হতে চলল, অমিত আর কোনও খোঁজ দেয়নি। ফোন বন্ধ, মেসেজের জবাব নেই, এমনকি সেই হস্টেলের বন্ধুরাও জানে না সে কোথায়। অপর্ণার বুকের ভেতরে জমে থাকা আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে—সেই পুরনো অতীত আবার কি তার বর্তমান হয়ে উঠতে চাইছে? একদিন বিকেলে, রোদের আলোয় যখন শহর গা ধুয়ে নিচ্ছিল, তখনই সে দেখতে পেল সেই চেনা ফিগারটি দূর থেকে আসছে। পাজামা-পাঞ্জাবিতে অমিত নয়, বরং কেউ যেন তার ছায়ার মতো, অথচ তার চেয়েও বেশি সত্যি। অচেনা চোখে চেনা দৃষ্টি, অজানা হাঁটায় চেনা ছন্দ—অপর্ণা মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেল কোন শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আছে সে।
অপরিচিত যুবকটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলল, “আপনি অপর্ণা?” কণ্ঠস্বরও যেন কোথা থেকে চেনা লাগে। অপর্ণা একটু দ্বিধা নিয়ে মাথা নাড়ল। “আমি তপোব্রত,” সে বলল, “এই শহরে নতুন এসেছি। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে—এই প্রথম দেখা নয়।” অপর্ণা ঠোঁটের কোণে এক চাপা হাসি চেপে রাখে। “আপনার চোখ দুটো খুব চেনা লাগছে,” সে বলে। তপোব্রত সামান্য হেসে বলল, “অনেকেই এমনটা বলেন।” কথোপকথনটা এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ হলো না। তারা হাঁটতে শুরু করল একসঙ্গে, যেন বহুদিনের পরিচিত। ফুচকার দোকান থেকে শুরু করে কলেজের লনে গড়ানো দুপুর পর্যন্ত, অপর্ণা বুঝতে পারল সে আবার ভালোবাসতে শুরু করেছে। অথচ একটা ভয় তাকে তাড়া করে ফিরছে—এই ছেলেটি কি শুধুই একজন অপরিচিত মানুষ, নাকি হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকের ছদ্মবেশ?
এরপরের দিনগুলো যেন গড়িয়ে চলল স্বপ্ন আর বিভ্রমের মাঝে। তপোব্রত অপর্ণাকে প্রতিদিন দেখা করতে চায়, কিন্তু কোথা থেকে যেন একটা পর্দা টেনে দেয় অপর্ণার মনের মধ্যে। তপোব্রতের চোখের গভীরতা, হাঁটার ধরন, এমনকি তার কথা বলার ভঙ্গি—সবই যেন অমিতের সঙ্গে ভয়ানক মিল খুঁজে পায় অপর্ণা। কিন্তু অমিত তো মারা গিয়েছিল দুর্ঘটনায়, নিজের চোখে দেখেছিল সে সেই শেষযাত্রা। তবে তপোব্রত কীভাবে এত মিল এনে দেয়? একদিন সাহস করে সে জিজ্ঞাসা করল, “তোমার কখনও মনে হয় না, তুমি আগেও এমন কিছু অনুভব করেছ?” তপোব্রত উত্তর দিল, “হ্যাঁ। মাঝে মাঝে মনে হয়, এই শহর, এই রাস্তা, এমনকি তোমার মুখ—সব কোথাও দেখা হয়ে গেছে আগে।” অপর্ণা ঠোঁট কামড়ে ধরে, যেন একটা অদৃশ্য দুঃস্বপ্ন ফিরে আসছে। সে বুঝতে পারছে, তার জীবনে হয়তো শুধু সময়ের বাঁক নয়, জন্মের বাঁকও বদলে যাচ্ছে।
চিত্রটি সম্পূর্ণ হতে সময় লাগল না। এক সন্ধ্যায়, তপোব্রত অপর্ণাকে নিয়ে গেল এক পুরনো রেলস্টেশনের ধারে, যেখানে কুয়াশার ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকে সময়ের জমাট স্মৃতি। সেখানে দাঁড়িয়ে তপোব্রত হঠাৎ বলে উঠল, “আমি জানি, তুমি প্রতিদিন এইখানে অপেক্ষা করেছিলে। আমি আসিনি, কারণ আমি যেতে পারিনি।” অপর্ণার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। “কী বলতে চাইছ?”—তার কণ্ঠ কাঁপছে। তপোব্রত চোখ তুলে বলে, “আমি অমিত ছিলাম, অপর্ণা। সেই দিন, দুর্ঘটনায় আমার শরীর মারা গেল ঠিকই, কিন্তু আত্মা নয়। আমি ফিরে এসেছি, শুধু তোমার কাছে, শুধুই তোমার জন্য।” অপর্ণার চোখে জল আসে না, ভয় আসে না—শুধু এক ধরনের মুক্তি বয়ে যায় শরীরজুড়ে। সে জানে, ভালোবাসা কখনও মরে না, শুধুমাত্র রূপ বদলায়। আর তবুও, অপর্ণা অপেক্ষা করে—তবুও অপেক্ষা…
৭
ঋতুপর্ণা অনেক দিন পর আবার নদীর ঘাটে আসেন। সেই পুরনো ঘাট—যেখানে প্রতিদিন বিকেলে সে আর অনির্বাণ একসাথে বসত, দু’জনে চুপচাপ নদীর ঢেউ শুনত। কিন্তু আজকে এখানে দাঁড়িয়ে, তার মনে হল যেন অতীতের ছায়া এখনও ভেসে বেড়ায় নদীর বুকের উপর। ঘাটের ধাপে বসে সে চুপ করে তাকিয়ে রইল জলের দিকে, আর সেই মুহূর্তেই তার পাশে এসে দাঁড়াল সৌরদীপ। হালকা হাওয়ায় ওর শার্টের আঁচল উড়ছিল, চোখে গভীর বিষণ্ণতা। “তুমি কেন বারবার এই জায়গাটায় আসো?” প্রশ্ন করল ছেলেটি, তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত কোমলতা। ঋতুপর্ণা চমকে তাকাল, সৌরদীপের চোখে এক অজানা আবেগ, যা তাকে স্মরণ করিয়ে দিল অনির্বাণের গভীর দৃষ্টিকে। “কারণ এখানে আমার অতীত লুকিয়ে আছে,” মৃদু স্বরে বলল সে। সৌরদীপ কিছু বলল না, শুধু পাশে বসে পড়ল। তারা দু’জনেই চুপ, শুধু জলের শব্দ, আর পাখিদের ডাক মিশে তৈরি করল এক অদ্ভুত নীরবতার ভাষা।
একটা ছোট্ট ছেলেকে তারা নদীর ধার দিয়ে দৌঁড়াতে দেখল, ছেলেটার হাতে ছিল একটা নৌকার খেলনা। ঋতুপর্ণা হঠাৎ আবেগে কেঁপে উঠল—এই দৃশ্যটা যেন সে কোথাও দেখেছে, যেন এই ছেলেটা কে, কোথায়, কবে—সব ভুলে গেলেও এই মুহূর্তটা তাকে সময়ের এক ফাঁকে নিয়ে চলে গেল। হঠাৎ সে সৌরদীপের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি কখনও এমন কিছু অনুভব করো, যা তুমি বোঝাতে পারো না? যেন একটা অতীত তোমার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলে?” সৌরদীপ একটু সময় নিয়ে বলল, “আমি প্রায়ই স্বপ্নে দেখি একটা ঘাট, এক মেয়েকে দেখি যার মুখ সবসময় ঝাপসা থাকে, কিন্তু তার চোখে আমি বেদনার আকাশ দেখি।” ঋতুপর্ণার হৃদয় এক ঝটকায় কেঁপে উঠল, যেন সৌরদীপ অজান্তেই তার পুরনো প্রেমের কোনও অনুভব করে ফেলেছে। কিন্তু সে নিশ্চুপ রইল, শুধু নদীর দিকে তাকিয়ে রইল, কারণ তার ভেতরে তখন এক অদ্ভুত ঘূর্ণি চলছিল।
রাতের দিকে যখন ঋতুপর্ণা বাড়ি ফিরল, তখন তার মায়ের ঘরে আলো জ্বলছিল। সে দেখল মা একটা পুরনো অ্যালবাম খুলে বসে আছেন, আর এক পৃষ্ঠায় অনির্বাণের ছবি। ছবির পাশেই একটা চিঠি রাখা ছিল—যেটা অনির্বাণের লেখা বলে মনে করা হয়, যেটা দুর্ঘটনার কিছুদিন আগে সে পাঠিয়েছিল। চিঠিটা পড়তে পড়তে মা হঠাৎ বললেন, “তোর বাবা তখন বলেছিল, এই ছেলেটা শুধু তোর প্রেমিক না, যেন তোদের দু’জনের মধ্যকার একটা আত্মিক যোগ আছে।” ঋতুপর্ণা সেই চিঠি হাতে তুলে নিল। সেখানে লেখা ছিল, “আমি জানি না কেন, কিন্তু আমার মনে হয় আমি তোকে শুধু এই জন্মে নয়, আরও অনেক জন্ম ধরেই খুঁজছি। যদি কখনও আমি না থাকি, তবুও জানবি—আমি তোকে খুঁজব, অন্য কোনও রূপে, অন্য কোনও সময়েও।” চোখ ভিজে উঠল ঋতুপর্ণার, আর সৌরদীপের চোখের দিকে তাকালে সেই একই অদৃশ্য টান টের পায় সে বারবার।
পরদিন সকালে সে সাহস করে সৌরদীপকে ডেকে বলল, “চলো, আমি তোমায় একটা জায়গা দেখাতে চাই।” তারা চলে গেল সেই পুরনো মন্দিরে, যেখানে অনির্বাণ আর সে একবার প্রতিজ্ঞা করেছিল—যে তারা একসাথে থাকবে, যেকোনও সময়, যেকোনও জন্মে। সৌরদীপ চুপচাপ চারপাশ দেখছিল, আর হঠাৎ সে বলল, “এই জায়গাটায় আমি আগে কখনও আসিনি, অথচ কেন জানি না, সবকিছু চেনা চেনা লাগছে। যেন আমি এখানে কিছু হারিয়ে এসেছি।” ঋতুপর্ণা তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “হয়তো তুমি কিছু হারাওনি, বরং ফিরে পেতে এসেছো।” সৌরদীপ স্তব্ধ হয়ে গেল, তার দৃষ্টিতে কুয়াশার মতো আবছা হয়ে থাকা স্মৃতিগুলো যেন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল। আর সেই মুহূর্তে, মন্দিরের ঘণ্টা বেজে উঠল—তাদের অতীত আর বর্তমান এক অদ্ভুত সমান্তরালে এসে মিলল, আর অদৃশ্য সেই টান আরও গভীর হয়ে রইল তাদের মাঝে।
৮
ভোরবেলার ঝিরঝিরে হাওয়ায় আকাশ ছিল নরম কুয়াশায় মোড়া, যেন প্রকৃতিও নিঃশব্দে কিছু বলতে চাইছে। ঈশান আজ সকাল থেকে একটু অস্থির, যেন কোথাও কিছু একটা ছুটে যাচ্ছে হাতের মুঠো থেকে। অনুরাধা আবার সেই পুরনো কাঠের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, যেটা গ্রামের পুরনো লাইব্রেরির দোতলায় অনেক বছর আগে থেকে বন্ধ পড়ে আছে। “এই জানালার ওপারে কোনও একদিন আমি কিছু একটা শুনেছিলাম,” বলেছিল অনুরাধা হঠাৎই, চোখের পলক না ফেলে। ঈশান চমকে ওঠে, কারণ এই জানালাটা ঘিরে একটা পুরনো কাহিনি শোনা যায়, যেখানে কেউ একজন সেই জানালার পেছনে হারিয়ে গিয়েছিল। অনুরাধার স্মৃতিতে হয়তো এখন সেই অতীতের ছায়া ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে, আর ঈশান বুঝে ফেলেছে—যতই সে লুকাক, সত্যি তার ভিতরে একটা অন্য সময়ের ছায়া নিয়ে এসেছে।
সন্ধেবেলায় তারা একসাথে গেল সেই জানালাটার কাছে। রোদের আলো পড়ে জানালার ধাতব দন্ড গুলো একধরনের অদ্ভুত ছায়া ফেলছিলো দেওয়ালে। ঈশান ধীরে ধীরে হ্যান্ডেলটা ধরল, কিন্তু সে জানত এটা খোলার কোনও মানে হয় না—এত বছর ধরে সেটা বন্ধ পড়ে আছে। তবুও আশ্চর্যের বিষয়, জানালাটা একটুও কষ্ট না দিয়ে খুলে গেল, যেন তাদেরই জন্য অপেক্ষায় ছিল। ভিতরে পুরনো কাঠের ধুলোমাখা একটা ঘর, দেয়ালে একটুকরো ফ্রেম ঝুলছে—মাঝে নেই কোনও ছবি, শুধু শূন্যতা। অনুরাধার চোখ হঠাৎই ভিজে উঠল, কারণ সে বুঝতে পারছে—এখানেই কোনও এক জন্মে, হয়তো কোনও শেষ না বলা কথা থেকে গিয়েছিল। ঈশান কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। এই মুহূর্তটা শুধুই অনুরাধার। জানালার বাইরে তখন ধীরে ধীরে নামছে সন্ধ্যা, আর ভিতরে যেন পুরনো এক সুর বাজছে, যা কেবল দু’জনেই শুনতে পাচ্ছে।
সে রাতে অনুরাধা আবার সেই স্বপ্নটা দেখল। স্বপ্নে সে দাঁড়িয়ে এক মেঘলা মাঠের মাঝে, সামনে সেই একই যুবক—অথচ মুখটা পরিস্কার নয়। কেবল চোখদুটো যেন কোনও অতল গহ্বরে টেনে নিচ্ছে। এবার যুবকটি বলল, “তুই ভুলে গেছিস আমাকে, কিন্তু আমি তো সেই প্রতিজ্ঞার অপেক্ষাতেই আছি।” ঘুম ভেঙে অনুরাধা উঠে বসে, বুকের ভিতর এক অজানা চাপা ভয়। ঈশান তখন ঘরের অন্যপাশে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে, বাইরে তাকিয়ে আছে নিঃশব্দে। অনুরাধা হেঁটে এসে তার পাশে দাঁড়ায়, হাত রাখে তার কাঁধে, কিন্তু ঈশান কিছু বলে না। কেবল এক ঝলক চাহনিতে যেন বুঝিয়ে দেয়—তার ভিতরে এমন কিছু আছে যা এখনও প্রকাশ পায়নি।
পরদিন গ্রামের এক বৃদ্ধ মহিলার সঙ্গে দেখা হয় অনুরাধার, যিনি বললেন, “তুই তপতী না? সেই যে দুর্ঘটনায় হারিয়ে গিয়েছিল তোর বর, বছর দশেক আগে? ঠিক এই জানালার ওপারেই তো দেখা গিয়েছিল শেষবার।” অনুরাধা শিউরে ওঠে—তপতী? সে তো কখনও এই নাম শোনেনি! কিন্তু বৃদ্ধার চোখে ছিল একরাশ নিশ্চয়তা। ঈশান তখন পাশে দাঁড়িয়ে, মুখে অদ্ভুত শান্তি, কিন্তু চোখে গভীর দহন। তখনই যেন সব কিছু অদ্ভুতভাবে জুড়ে যেতে থাকে অনুরাধার মনের মধ্যে। সে বুঝতে পারে, এই জানালা শুধু কাঁচে ঘেরা এক কাঠামো নয়, এটি এক সময়ের প্রবেশদ্বার, যার ভেতর দিয়ে প্রেম, প্রতিজ্ঞা, এবং পুনর্জন্মের ইতিহাস এক অদৃশ্য সুরে আজও বাজে। সেই সুর এখনও থামেনি—শুধু অপেক্ষা করছে এক নতুন অর্থে পূর্ণ হওয়ার।
৯
শহরের বাইরে, এক নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনুরাধা এবং ঈশান চুপচাপ থাকলো। রোদের তেজ কিছুটা কমেছে, কিন্তু বিকেলের আবছা আলো যেন তাদের সম্পর্কের এক অদৃশ্য দাগকে আরও স্পষ্ট করে তুলছিল। এতদিন, তারা দু’জনেই চুপচাপ নিজেদের মধ্যে অনেক কিছু আড়াল করে রেখেছিল। কিন্তু আজ, মনে হচ্ছিল তারা একে অপরের দিকে তাকালে, তাদের মাঝে দীর্ঘদিনের অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলো একে একে উন্মোচিত হতে শুরু করেছে। ঈশান ধীরে ধীরে বলল, “আমাদের এই পথ যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে বের করতে হবে। কিছু শূন্যতা পূর্ণ করতে হবে।” অনুরাধা থমকে দাঁড়িয়ে, তার চোখে এক অদ্ভুত ভয় ছিল। “কী ধরনের প্রশ্ন?” তার কণ্ঠ ছিল আশঙ্কিত। ঈশান এক মুহূর্ত চুপ থাকার পর, বলল, “এত বছর পর কেন আবার ফিরে আসলাম? তুমি কেন আমাকে খুঁজে পেলে?”
অন্যদিকে, অনুরাধা যেন কিছুতেই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত ছিল না। তার মনের গহীনে অনেক কিছু চাপা পড়ে ছিল, যেগুলো আজ বারবার কেঁপে উঠছে। “আমি জানি না,” সে বলল, “তুমি কীভাবে ফিরে এলে, কীভাবে আবার আমাদের পথ এক হয়ে গেল, তাও জানি না। তবে এটুকু জানি, আমি এক সময়ে তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে, কিন্তু তুমি ফিরে আসবে, আমি জানতাম।” ঈশান হাসল, কিন্তু হাসির মধ্যে একধরনের দুঃখ ছিল, যেন কিছু হারিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল সে। “তুমি কি জানো, আমি ফিরে আসার জন্য নিজেকে কখনও প্রস্তুত করিনি? কখনও ভাবিনি যে এতটা সময় পরে আবার সব কিছু ফিরে পাবো। কিন্তু আমি জানি, কোথাও একটা দ্যুতি ছিল, যা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।”
দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে এক ছোট্ট নদীর কাছে পৌঁছাল। নদী ছিল শান্ত, তার স্রোত যেন তাদের সমস্ত গল্পের ভেতর এক অনাবিষ্কৃত ধ্বনি ছিল। কিছু সময় চুপচাপ নদীর ধারে বসে রইলো তারা। ঈশান বলল, “তুমি যদি জানতে, যে আমাদের মিলনটা কেবল এই জন্মেই নয়, আরও অনেক জন্মে ঘটেছে—তাহলে কি তুমি আমাকে গ্রহণ করতে পাড়বে?” অনুরাধা ঈশানের দিকে তাকিয়ে, এক গভীর অনুভবের মাঝে ডুবে গিয়েছিল। এক মুহূর্তে মনে হলো, এই পৃথিবী, এই সম্পর্ক—সব কিছু যেন পরিস্কার হয়ে গেল। “এটা আমি জানি না, ঈশান,” সে বলল, “তবে আমার মনে হয়, আমাদের পথ এক হয়ে যাবে, যদিও আমাদের একে অপরকে হাজারবার হারাতে হবে।”
বিকেলের দিকে তারা আবার উঠে দাঁড়াল। এখন, সেই পুরনো প্রশ্নগুলো আর ভয়গুলো যেন সরে যেতে শুরু করেছে। অনুরাধার মনে হচ্ছিল, ঈশান আর সে দু’জন একই নদীর স্রোতের মতো—কখনও মৃদু, কখনও অপ্রতিরোধ্য, কিন্তু সব সময় এক স্রোতে চলতে চলতে তাদের মিলন হবে। ঈশান ধীরে ধীরে বলেন, “আমরা একে অপরের জন্য তৈরি, কিন্তু আমাদের যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। খুব কাছেই কোথাও একটি দরজা আছে, যা খুললে আমাদের আত্মার আসল পরিচয় পাওয়া যাবে। কিন্তু সেটা আমরা এখনও খুঁজে পাইনি।”
তারা হাঁটতে শুরু করল, কিছু দূর গিয়ে শহরের দিকে ফিরে দেখতে দেখতে, অনুরাধা অনুভব করল—যতই দূরে চলে যাক, ঈশান তার পাশে থাকবে, আর তার সঙ্গেই সে সেই অচেনা পথে চলবে। হয়তো এখনো পুরোপুরি জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু এই পথেই তাদের মানে আর উদ্দেশ্য উন্মোচিত হবে—ধীরে ধীরে, সময়ের স্রোতে মিলিয়ে যাবে সমস্ত দ্বিধা।
১০
অরণ্যের ধারে বৃষ্টিভেজা পথ ধরে হেঁটে চলেছে তিশা, তার চোখে এখন আর অশ্রুর কোনো চিহ্ন নেই—শুধু এক নিঃশব্দ প্রত্যাশা, যেন জীবন তার সামনে একটি উত্তর রাখতে চলেছে বহু বছরের প্রশ্নের। পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে অরিত্র, যার চোখে যেন শতাব্দীর গোপন কথা জমে আছে, এবং সে জানে, আজ যদি কথা না বলে, তবে আর কোনোদিন বলা হবে না। সে এগিয়ে এসে ধীরে তিশার কাঁধে হাত রাখে, তিশা চমকে তাকায়, কিন্তু এবার আর সে পিছু হটে না। অরিত্রর চোখে তাকিয়ে সে শুধায়, “তুমি কে? তুমি কি অরিত্র?” যুবক একটু থেমে বলে, “আমি তাকে চিনতাম… হয়তো ছিলামও… কিন্তু আমি এখন নতুন কেউ, নতুন শরীরে, নতুন জীবনে, তবে সেই ভালোবাসা, সেটা তো আমার ভেতরেই ছিল, আছে…” তার কণ্ঠে কাঁপুনি, কিন্তু বিশ্বাস দৃঢ়। তিশা বোঝে, সে এবার সত্যের মুখোমুখি।
বাঁশবনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা দুই মানুষ, এক অলৌকিক অনুভূতির মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। তারা আর শব্দ ব্যবহার করে না, শুধু চোখে চোখ রেখে বুঝে নেয়, সময় কীভাবে তাদের ঘুরিয়ে এনেছে একই মোহনায়। অরিত্র বলল, “আমি জানি না কীভাবে বোঝাব, তবে তোমার হাতের সেই ছোট আঁচিলটা, তুমি একদিন বলেছিলে—যে মানুষ সেটা চেনে, সে তোমার অন্তর চেনে। আমি চিনি, তিশা।” তিশার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না, শুধু দীর্ঘশ্বাসে গলে যায় তার সমস্ত সন্দেহ। তার ভেতরের মেয়েটি, যে আজও সেই কলেজের বেঞ্চে বসে প্রেমিকের অপেক্ষায়, আজ যেন উঠে দাঁড়িয়ে আসে এবং সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে, সমস্ত ব্যথা, অভিমান, আর দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়ে ফেলে অনন্তে। মুহূর্তটা যেন সময়ের গায়ে দাগ কেটে দেয়, আর আকাশে ছড়িয়ে পড়ে এক শুদ্ধ প্রেমের গন্ধ।
পরে, শহরে ফিরে তারা বসে পুরনো মসজিদের পেছনের সেই চায়ের দোকানে, যেখানে একদিন ঝড়ের রাতে তারা আশ্রয় নিয়েছিল কলেজের সময়। দোকানদার এখনো সেই মানুষ, চিনে ফেলে তিশাকে। “ওই ছেলে কোথায়?” সে শুধায়, আর তিশা একটু হেসে বলে, “এই তো, ফিরে এসেছে।” অরিত্র সামনে বসে থাকা কাপ থেকে চায়ের ধোঁয়া দেখতে দেখতে বলে, “তুমি জানো, মৃত্যু সবকিছু শেষ করে না। কোনো কিছু যদি হৃদয়ে সত্য হয়ে থাকে, তবে সে ফিরবেই, কোনো না কোনো রূপে।” তিশা হাত বাড়িয়ে তার আঙুল ছুঁয়ে দেয়, যেন বিশ্বাস করে নিচ্ছে বাস্তবতার বাইরে যে কিছু সত্য থাকতে পারে, ভালোবাসা নামক আশ্চর্য এক শক্তি সেই সময় আর মৃত্যুর সীমা ছাপিয়ে এসে আবার জুড়ে দেয় ভেঙে যাওয়া হৃদয়দুটি।
শেষ বিকেলের আলোয় দুজন হেঁটে যায় গঙ্গার ধারে। বাতাসে এখনো ভিজে পাতা আর কাঁচা মাটির গন্ধ। তিশা থেমে বলে, “তবুও অপেক্ষা করেছিলাম, জানো?” অরিত্র হাসে, “জানি। তোমার সেই অপেক্ষাই হয়তো আমায় ফিরিয়ে এনেছে। হয়তো সেটাই ছিল পুনর্জন্মের কারণ।” তারা আর কোনো প্রশ্ন করে না, কোনো যুক্তি খোঁজে না। কারণ এই প্রেম যুক্তির ধার ধারে না। এই প্রেম শুধু বিশ্বাসে গড়া—যেখানে সময় মুছে যায়, শুধু থেকে যায় দুটি হৃদয়ের শব্দহীন প্রতিশ্রুতি, ‘তবুও অপেক্ষা।’
___




