রূপালী রায়
১
গ্রামের এক কোণায় এক প্রাচীন মেলা বসেছিল, যেখানে সারা গ্রাম ও আশেপাশের অঞ্চলের লোকজন একত্রিত হয়েছিল। বাতাসে মিষ্টি রঙিন কাগজের ঝলকানি আর মিষ্টির গন্ধ মিশে গিয়েছিল। চারপাশে হইহই করে চলছিল হাসি-আলাপ, এবং কিছু কিছু ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে বলছিল তাদের যাদু-গল্প। এখানে ছিল কিছু পুরনো কাঠের খেলনা, ঝুলন্ত লাইট, আর সুরম্য ছোট ছোট দোকান। নির্বাণ, যার জীবনে এমন অনুষ্ঠান ছিল কিছুটা বিরক্তির, সে মেলাতে আসতে বাধ্য হয়েছিল। তার পিতা, একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, আশা করেছিলেন যে, তার ছেলে গ্রামের রাজনৈতিক গুরুদের সঙ্গে মেলামেশা করবে। কিন্তু নির্বাণ একা ছিল, এবং তার মনে কিছুই ছিল না, শুধু ছিল এক অজানা আকর্ষণ যা তাকে এখানে আসতে বাধ্য করেছিল। যখন সে মেলাতে পৌঁছেছিল, এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা অপর্ণার দিকে তার চোখ পড়ল। অপর্ণা ছিল একটি সাধারণ গ্রামীণ মেয়ে, তবে তার চোখে কিছু ছিল যা নির্বাণের মনে গভীরভাবে ধ্বনি তুলল। তার মুখাবয়ব ছিল যেন, প্যাশন এবং আত্মবিশ্বাসের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। অপর্ণা তখন মেলার একটি স্টলে দাঁড়িয়ে একটি পুরনো বই হাতে নিয়ে পড়ছিল, আর তার মুখের একদম পাশে ছিল স্নিগ্ধ আলো। নির্বাণ যেন তাতেই আটকে গিয়েছিল। তার মধ্যে কিছু ছিল, যেন অপর্ণা একটি রহস্য, একটি অজানা পৃথিবী, যার দিকে সে কখনও তাকায়নি। মেলাতে নিত্যদিনের যে অস্থিরতা ছিল, তা এক মুহূর্তে বিলীন হয়ে গিয়েছিল, আর নির্বাণ জানত না, কেন সে এত আকৃষ্ট হচ্ছে অপর্ণার দিকে।
এদিনের সন্ধ্যাটি, যেদিন তার জীবনের এই অজানা যাত্রা শুরু হয়েছিল, সে কখনোই ভাবতে পারেনি। অপর্ণার সঙ্গে তার প্রথম কথা বলা ছিল যেন এক ছোট্ট গল্পের শুরু, তবে একটি গল্প যা অজানাকে জয় করার এবং আত্মবিশ্বাসের এক নতুন রূপ গড়ার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। প্রথমেই, অপর্ণা নির্বাণের কাছে তার বইটি ফিরিয়ে দেয় এবং হালকা হেসে বলে, “এটা একদিন আমি শেষ করব, কিন্তু এখন, আমি কিছুক্ষণের জন্য আপনাকে জানার সুযোগ দিব।” নির্বাণ সেদিন প্রথম বুঝতে পারে, অপর্ণা এমন এক মানুষ, যে নিজেকে সবসময় প্রশ্ন করে, যাকে জানলে তার হৃদয় আরও এক ধাপ খোলাখুলি হবে। অপর্ণার কথায়, তার মধ্যে এক অদ্ভুত মিষ্টি তীব্রতা ছিল, যা নির্বাণের ভেতর কিছুটা অস্থিরতা তৈরি করেছিল। তার সাথে কথা বলার পর, নির্বাণ অনুভব করে, যে তার জীবনে এরকম কিছু হবে, যা সে কখনো আশা করেনি। অপর্ণার কথার মাঝে ছিল এক ধরনের সাহসিকতা, যা নির্বাণকে এক অজানা পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিল।
এদিনের পর, মেলার শেষে নির্বাণ একা বাড়ি ফিরছিল। তার মাথার ভেতর অপর্ণার কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে জানত, মেলা এমন কিছু সাদামাটা ব্যাপার ছিল না, বরং এটি তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা ছিল। কিন্তু সেই রাতের পর, গ্রাম এবং তার পরিবারের মধ্যে থাকা প্রচলিত নিয়ম ও প্রত্যাশার বিরুদ্ধে তার কিছু অনুচিত প্রশ্ন শুরু হয়েছিল। নির্বাণ অনুভব করেছিল যে, অপর্ণা তার জীবনে আসার পর, তার নিজের পৃথিবী আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে এমন কিছু ছিল, যা তাকে তার পূর্ব পরিচিত গ্রাম্য জীবন থেকে বেরিয়ে যেতে প্ররোচিত করছিল। সে বুঝতে পারছিল না যে, এই সম্পর্কের মধ্যে কী ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে, কিন্তু তার মন সে দিন বুঝেছিল যে অপর্ণার প্রতি তার আকর্ষণ আর কিছু নয়, বরং তার নিজের সীমাবদ্ধতা ও সমাজের গণ্ডি ভেঙে নতুন এক পথের সন্ধান। একদিকে তার নিজস্ব পরিবার, সমাজ এবং গ্রাম, অন্যদিকে অপর্ণা—এই দ্বন্দ্ব তার মনে ক্রমেই বাড়তে শুরু করল। তবে নির্বাণ জানত, জীবনের এই যাত্রায় কিছু না কিছু বেছে নিতে হবে, আর অপর্ণা তার জীবনের সেই অজানা পথের দিশারি হতে পারে।
২
গ্রাম থেকে বাড়ি ফেরার পর নির্বাণের মনে ছিল অপর্ণার প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ, যা তাকে শান্ত থাকতে দিচ্ছিল না। মেলাতে প্রথম দেখা, তার পরের দিনের চিন্তা—এই অনুভূতি অবিরত তার মাথায় ঘুরছিল। কিছুদিনের মধ্যে, অপর্ণা ও নির্বাণের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এক সন্ধ্যায়, গ্রামে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, যেখানে নির্বাণের বাবা তাকে যেতে বলেছিল, তবে নির্বাণের মন ছিল অন্য দিকে। সেই দিন সে নিজেকে অপর্ণার সঙ্গে এক নির্জন জায়গায় পেতে চেয়েছিল। গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে, একটি পুরনো তালগাছের তলায় তারা একে অপরকে অপেক্ষা করতে বলেছিল। সেখানে, তারা একে অপরের সঙ্গে জীবনের শুদ্ধ ও অকপট কথা ভাগ করে নিতে চায়, যেখানে ছিল না কোনো ভীতি, কোনো সমাজের চাপ।
অপর্ণা তার জীবনের শৈশবকালীন স্মৃতির কথা বলে, যেখানে গ্রামের নিয়মকানুনের মধ্যে বেড়ে ওঠা তাকে কখনও কখনও অস্বস্তিতে ফেলত। তার মা-মনে মনে তাকে সব সময়ই শিখিয়েছিলেন, “পৃথিবী তোমাকে তোমার জায়গা দেখাবে, কিন্তু তুমি যদি তা মানতে না চাও, তবে তুমি নিজের পৃথিবী গড়ো।” অপর্ণা মনে করত, যে কোনো পরিস্থিতিতে সে নিজেকে অটুট রাখবে এবং সমাজের শর্তগুলোর বাইরে গিয়ে জীবনের স্বাদ নেবে। নির্বাণ তার সঙ্গে একমত হয়েছিল, কিন্তু সে জানত, তাদের মধ্যে একটি বড় অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে—একটি এমন পৃথিবী, যেখানে তাদের সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য নয়।
একদিন রাতে, যখন গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে ছিল, নির্বাণ ও অপর্ণা একে অপরকে জানাতে চেয়েছিল তাদের হৃদয়ের গভীরতা। গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে, অপর্ণা তাকে একটি পুরনো বাড়ির সামনে নিয়ে গিয়েছিল—একটি abandoned জমিদারবাড়ি, যেখানে দিনের বেলা কেউ আসত না। সে বাড়িটি রাতের অন্ধকারে নতুন কিছু অনুভব করছিল। অপর্ণা নির্বাণকে জানাল, এই বাড়িটি সে বহুবার দেখেছে, কিন্তু আজকের রাতেই তার কাছে এই বাড়িটি বিশেষ হয়ে উঠেছে। “এখানে কেউ থাকে না, নির্বাণ,” অপর্ণা বলল, “তবে এই বাড়ির অন্ধকারে, আমি কিছু পেতে চাই—আমাদের পৃথিবী, যেখানে তোমরা এবং আমি একসঙ্গে থাকতে পারব।” নির্বাণ তখন বুঝতে পারে, অপর্ণা যে সাহসিকতা নিয়ে তার কথা বলছিল, তা শুধু একটি জীবনের সত্য, যা তারা একে অপরের মধ্যে আবিষ্কার করতে চায়।
তারা গভীর রাতে কথা বলছিল, যখন একদিকে বাতাসের সুরের সাথে কিছু গুমোট শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অপর্ণার চোখে তখন এক ধরনের তীব্রতা ছিল, যেন সে কোনো অন্ধকার শক্তির সম্মুখীন। নির্বাণ তখন মনে মনে অনুভব করল, যে তাদের সম্পর্কের পথ একদিকে সুপ্রশস্ত হতে পারে, তবে অন্যদিকে, এখানে ভয় ও অনিশ্চয়তার এক অদৃশ্য বলয়ও রয়েছে। “যদি আমরা একসঙ্গে এই পৃথিবীতে চলতে চাই, তবে আমাদের একে অপরকে বিশ্বাস করতে হবে,” অপর্ণা বলল, তার চোখে এক অজানা শূন্যতার কষ্ট। নির্বাণ জানত, তাদের মধ্যে কিছু ছিল যা অন্যদের কাছে সম্ভব ছিল না, এবং সেই কারণেই তাদের সম্পর্ক এত অদ্ভুত ও গভীর হয়ে উঠেছিল।
রাত গভীর হয়ে আসছিল, এবং গ্রাম থেকে দূরে, এক শীতল বাতাসে তারা একে অপরকে আরও কাছে টানছিল। অপর্ণা তখন বলল, “এখানে, আমরা যদি একসঙ্গে থাকি, তবে আমরা আমাদের নিজের পৃথিবী তৈরি করব, যেখানে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম থাকবে না, শুধুমাত্র আমরা এবং আমাদের ভালোবাসা।” নির্বাণ, যার মনে সমাজের প্রত্যাশার ভার ছিল, সে অনুভব করছিল যে এই মুহূর্তে তার হৃদয়ের মধ্যে এক নতুন শক্তি জেগে উঠছে। অপর্ণার কথা শুনে, সে শপথ করেছিল, সে এখন যেভাবে চাইবে, সেইভাবে জীবন কাটাতে চাইবে, তার পরিণতি কিছুই হোক না কেন।
এই রাতেই, নির্বাণ বুঝতে পারে যে, অপর্ণা শুধু একটি মেয়ে নয়, বরং তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের সূচনা। পরদিন সকালে, সব কিছুই বদলে যাবে—গ্রামের প্রত্যাশা, পারিবারিক শর্ত, এবং সমাজের চোখে তাদের সম্পর্কের নতুন অর্থ। তবে নির্বাণ জানত, যে সম্পর্ক শুরু হয়েছিল অন্ধকারের মধ্যে, তা এখন আলোয় পরিণত হতে চলেছে।
৩
গ্রামের যে অন্ধকার রাতে নির্বাণ এবং অপর্ণার সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে উঠেছিল, সেই রাতের পর থেকেই নির্বাণের জীবন এক নতুন দিশায় চলতে শুরু করেছিল। তার মন একদিকে অপর্ণার প্রতি আকর্ষণে ভরা, অন্যদিকে তার পরিবারের প্রত্যাশা এবং তার পিতার কঠোর শাসনের চাপ বেড়ে যাচ্ছিল। নির্বাণ জানত, অপর্ণার প্রতি তার অনুভূতি কোনও সাধারণ সম্পর্কের কথা নয়; এটি তার জীবনের নতুন পথ, যা সমাজের গণ্ডি ছড়িয়ে তাকে এক অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। তবে, এই সম্পর্কের মূল্য তাকে যে অন্ধকার পথ দিয়ে যেতে হবে, তা তাকে তার নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করছিল।
একদিন, নির্বাণের বাবা তাকে একান্তে ডাকেন। বয়সের ভার এবং গ্রামের রাজনৈতিক চাপের মধ্যে তিনি একজন গুরুতর পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত, যার প্রভাব সমাজের প্রত্যেকটি কোণায় ছিল। “নির্বাণ, তুমি জানো কি, আমাদের পরিবারের মর্যাদা কী?” তার বাবা শুরু করেন, যেন কোনো অনিবার্য দিক থেকে বিষয়টি খুলতে চান। নির্বাণ বুঝতে পারছিল, তার পিতা কোনওভাবে তার জীবন পরিবর্তন করতে চান, বিশেষ করে তার সম্পর্ক নিয়ে। “এটা শুধুই সম্পর্ক নয়, ছেলে,” তার বাবা বলেন, “এটা আমাদের পরিবারের সম্মান। তুমি যদি এসব আধুনিক ঝামেলায় জড়াও, তাহলে পুরো পরিবার শত্রুদের মধ্যে পড়বে। তুমি জানো না, অপর্ণা তোমার জন্য ঠিক নয়।” তার পিতার কথাগুলি তীরের মতো শোনা যাচ্ছিল, প্রত্যেকটি শব্দ যেন নির্বাণের হৃদয়ে গর্ত করে নিচ্ছিল।
নির্বাণ তখন অনুভব করল, তার পিতা শুধু তাকে নিজের সুরক্ষায় আটকে রাখতে চান, বরং তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপকে তার পরিবারের অপ্রকাশিত নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে চান। নির্বাণ জানত, সে যদি তার পিতার প্রত্যাশা পূরণ করতে চায়, তবে তাকে অপর্ণাকে ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু তার হৃদয় তার পিতার কথা শোনার পরও অপর্ণার প্রতি আগের মতোই দৃঢ় ছিল। এই দ্বন্দ্ব তার মধ্যে অবিরত তোলপাড় সৃষ্টি করছিল। তার পিতা তার উপরে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছিল, এমনকি তার ভবিষ্যতের কথা ভাবেও, যখন নির্বাণ নিজেকে এবং অপর্ণাকে বাঁচানোর জন্য একটি নতুন পথ খুঁজছিল। “তুমি যদি অপর্ণাকে ভালোবাসো, তবে তুমি আমাদের পরিবারের সম্মান বিকৃত করবে।” তার বাবা আরও বলেন, যেন প্রতিটি শব্দের মধ্যে শাস্তির ভয় রয়েছে।
নির্বাণ এখন এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ছিল। তার মন একটি দিক থেকে অপর্ণাকে চায়, কিন্তু আরেকটি দিক থেকে তার পিতার প্রত্যাশা এবং কর্তব্যের ভার তাকে ভর করছে। সে জানত, তার পিতা তাকে কখনো অপর্ণাকে গ্রহণ করতে দেবে না, কারণ পিতার ধারণা ছিল, এই সম্পর্ক শুধুই তার নিজের সুখের কথা, যা পুরো পরিবারের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। নির্বাণ এক দৃষ্টিতে ভাবল, “এটা কি আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারব? এই সব চাপ সত্ত্বেও কি আমি অপর্ণার প্রতি আমার ভালোবাসা ধরে রাখতে পারব?”
তবে, নির্বাণ জানত, তাকে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অপর্ণার সঙ্গেই তার ভবিষ্যত, নাকি তার পরিবারের ধারাবাহিকতার প্রতি নির্ভরশীলতা? এই প্রশ্ন তাকে গভীরভাবে দোলা দিতে শুরু করেছিল। একদিকে তার বাবার কঠিন হুকুম, অন্যদিকে অপর্ণার মুক্তিযুদ্ধের মতো আত্মবিশ্বাস—দ্বন্দ্বের এই ঝড় তার মধ্যে ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছিল। প্রতিদিনের কথা ছিল না, তবে পিতার সঙ্গে চুপচাপ খুনসুটির সেই দিনগুলো তাকে ক্রমেই চিরকালীন এক সংকটে পরিণত করছিল।
অপরদিকে, অপর্ণা তাকে বারবার সাহস জুগিয়ে যাচ্ছিল। “তুমি যদি সত্যিকারের সুখ চাও, তবে তুমি তোমার জীবন নিজেই বেছে নাও, নির্বাণ। পৃথিবী তোমাকে শেখাবে, তবে তুমি যদি নিজে থেকে কিছু করতে চাও, তবে তোমার ভয় পেলে চলবে না।” অপর্ণার এই কথা নির্বাণের মনে অদৃশ্য এক আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তবে পিতার অনুকম্পা আর সামাজিক প্রত্যাশার প্রতি তার অঙ্গীকার তাকে অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছিল।
এভাবে, একটি বড় সংকট শুরু হয়ে যায় নির্বাণের জীবনে, যেখানে তাকে নিজের ভেতরের আত্মবিশ্বাস এবং পরিবারের সম্পর্কের প্রতি দায়বদ্ধতার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। তার পিতা তাকে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে হুমকি দিতে থাকলে, নির্বাণ আরও একবার ভাবতে শুরু করল—কীভাবে সে একে অপরকে জয় করবে, অথবা তা কিভাবে সব কিছু ত্যাগ করে জীবনটাকে পুনঃনির্মাণ করবে।
৪
নির্বাণের পরিবার এবং পিতার সঙ্গে সম্পর্কের দ্বন্দ্বে যখন সে নিজেকে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিল, তখন অপর্ণার জীবনে একটি নতুন চাপ আসে। গ্রামে তিনি কিছুটা আলাদা ছিলেন, একজন যুবতী যে সমাজের নিয়ম ও প্রত্যাশার বাইরে চিন্তা করে। অপর্ণার মায়ের সঙ্গে সম্পর্কও ততটাই জটিল ছিল। তার মা, শ্রীমতী সুকন্যা, ছিলেন একজন আস্থা এবং বিশ্বাসের প্রতীক, কিন্তু গ্রামীণ সমাজের প্রতি তার একটা গভীর শ্রদ্ধা এবং এক ধরনের ভয় ছিল, যা তাকে তার মেয়ে অপর্ণার স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে কখনোই পুরোপুরি মেনে নিতে দিত না। সুকন্যা একটি রক্ষণশীল মনোভাবের অধিকারিণী ছিলেন, যার জন্য তার মেয়ে অপর্ণার আধুনিকতা ও সাহসিকতা ছিল এক চ্যালেঞ্জ।
সুকন্যা জানতেন যে, অপর্ণা নিজের মতো করে জীবন কাটাতে চায়, কিন্তু তার নিজের মধ্যে ছিল এক ধরনের অবিচল বিশ্বাস, যে তার মেয়ে সমাজের প্রথা অনুসরণ না করলে কোনো ভবিষ্যত তৈরি করতে পারবে না। “তুমি কী ভাবছো অপর্ণা? এইভাবে চলতে থাকলে আমাদের গ্রাম তোমাকে গ্রহণ করবে না,” শ্রীমতী সুকন্যা একদিন তার মেয়ে অপর্ণাকে বলেছিলেন, যখন অপর্ণা তাকে নির্বাণের সঙ্গে সম্পর্কের কথা খুলে বলেছিল। সুকন্যা অপর্ণার সিদ্ধান্তে কিছুটা বিভ্রান্ত ছিল, এবং তার মধ্যে ছিল এক ধরনের উদ্বেগ, কারণ সে জানতো, গ্রামের নিয়মকানুন মেনে চলা যে কোনো তরুণীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। “তুমি জানো না, মেয়েটি আমাদের সম্পর্কের জন্য কতটা সমস্যা তৈরি করতে পারে,” সুকন্যা বলেন, তার মেয়ে অপর্ণাকে সমঝানোর চেষ্টা করতে।
অপর্ণা, যিনি সবসময় স্বাধীনভাবে চিন্তা করে এবং তার নিজের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, সে মনে করত যে, সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মধ্যে কোনো ভুল নেই। “মা, আমি জানি তুমি আমার জন্য সেরা চাও, কিন্তু আমি আমার জীবন নিজের মতো করে চালাতে চাই,” অপর্ণা সুকন্যাকে বুঝিয়ে বলেন। “আমার মধ্যে একটি শক্তি আছে, যা আমাকে আমি হয়ে থাকতে শেখায়।” কিন্তু সুকন্যা তার মেয়ে অপর্ণার চোখে যে গভীর উদ্বেগ দেখতে পেতেন, তা তাকে স্তব্ধ করে দিত। সুকন্যা জানতেন, পৃথিবীকে মোকাবেলা করতে হলে, একে অপরকে সহ্য করতে হয়, এবং অপর্ণার মতো একজন স্বাধীন মনের মেয়ে সমাজের অঙ্গীকারে গিয়ে নিজের চিন্তাভাবনাকে জড়াতে পারবে না।
এছাড়া, অপর্ণার মায়ের মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব ছিল। তিনি নিজের জীবনে কখনও স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারেননি, এবং তিনি জানতেন যে, সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী তার নিজের জীবন বাঁচানোই ছিল তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত। অপর্ণা যে জীবন যাপন করতে চায়, তার মা মনে করতেন সেটা বিপজ্জনক হতে পারে। “তুমি কি সত্যিই জানো, অপর্ণা, যে এই সম্পর্কের ফল কী হতে পারে?” সুকন্যা তার মেয়ে অপর্ণাকে কঠোরভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন। “যদি তুমি এই সম্পর্কের প্রতি এতটাই আগ্রহী হও, তাহলে তুমি কীভাবে আমাদের পরিবারকে সমাজে সম্মানজনক অবস্থানে রাখতে পারবে?” তার মা অপর্ণার প্রতি যে উদ্বেগ ছিল, তা সে অস্বীকার করতে পারেনি।
তবে, অপর্ণা জানত যে, তার মা তার ভালো চায়, এবং তাকে কখনোই কোনো খারাপ পথের দিকে যেতে দেখতে চান না। সুকন্যা তার মেয়ে অপর্ণার বুদ্ধি এবং স্বাধীনতার প্রতি সম্মান রেখেছিলেন, তবে কখনও কখনও তিনি মনে করতেন, সেই স্বাধীনতার বিনিময়ে কিছু মূল্য রয়েছে। তবে একদিন, অপর্ণা তার মাকে বলেছিল, “মা, তুমি আমাকে বুঝতে চেষ্টা করো, আমি কি চাইছি, আমি যা ভাবছি, তা আমারই সিদ্ধান্ত। তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করো, তবে আমাকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দাও।”
তবে সুকন্যা বুঝতে পারেন, তার মেয়ে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। প্রতিদিনের নিত্যযাত্রায় যখন অপর্ণা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করেছিল, তখন সুকন্যা তাকে শাসন করতে চাইতেন না। তবে, তিনি জানতেন যে, অপর্ণার জীবনের এই নতুন অধ্যায়ে তাকে সহায়তা করার কোনো উপায় নেই, যদিও সুকন্যার মন ছিল তার মেয়ে থেকে দূরে। অপর্ণা জানত, তার মা তাকে ভালোবাসেন, তবে তার স্বাধীন চিন্তা এবং সিদ্ধান্তের প্রতি মায়ের সমর্থন দেওয়া কঠিন ছিল।
এভাবে, অপর্ণার মা সুকন্যা তাকে কিছুটা ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যদিও সেই সিদ্ধান্ত মনের মধ্যে অজানা ক্ষোভ রেখে গিয়েছিল। তবে, সুকন্যার মনের ভেতরে একটি নতুন আশা জন্ম নেয়, যে হয়তো তার মেয়ে একদিন নিজের জীবনের সত্যিকারের পথ খুঁজে পাবে। অপর্ণা বুঝতে পারল যে, তার মায়ের ভালোবাসা সত্ত্বেও, তাকে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এবং সেই সিদ্ধান্তই তার জীবনের নতুন সূচনা হতে চলেছে।
৫
নির্বাণ এবং অপর্ণার সম্পর্কের গভীরতা বেড়েই চলছিল, কিন্তু তাদের প্রেমের পথে একের পর এক প্রতিবন্ধকতা আসছিল। গ্রাম এবং তার সামাজিক কাঠামো তাদের জন্য কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। যখন সম্পর্কের কথা আর কেউ জানত না, তখনও কিছু বিষয় একে অপরের মধ্যে গোপন রাখা সম্ভব ছিল। কিন্তু যখন তাদের মধ্যে আবেগ আরও প্রবল হতে শুরু করে, তখন পারিবারিক ও সামাজিক জটিলতাগুলি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আসে। গ্রামের কঠোর নিয়ম-কানুন, পুরনো মূল্যবোধ, আর একে অপরকে প্রতিনিয়ত নজর রাখা—এই সব কিছুই তাদের প্রেমের পক্ষে বিপদজনক হয়ে উঠছিল।
গ্রামের এক পরিসরে, যেখানে মানুষের মুখাবধি ছিল, নির্বাণ ও অপর্ণার সম্পর্ক ছিল এক বিস্ময়। “দ্যুতি,” গ্রামে সবথেকে প্রবীণ পুরুষ, একটি লোক যা আসলেই গ্রামে একমাত্র সমঝদার ছিল, একদিন নির্বাণকে নিজের কাছে ডাকল। “তুমি কি জানো, নির্বাণ, তোমার এই সম্পর্ক শুধু তোমার জীবনের জন্য নয়, আমাদের গ্রামের জন্যও এক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে?” দ্যুতি এক মৃদু ভয়ে বলেছিল, “গ্রামের নেতারা, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, কেউই তোমাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না। তোমাদের প্রেমের পক্ষে গ্রাম চলতে পারবে না।” নির্বাণ তখন বুঝতে পারে, যে সমাজের প্রত্যাশা এবং তার পারিবারিক দায়িত্বের চাপ একদিন এমনই রূপ নেবে, যে তারা কিছুতেই একে অপরকে দেবে না।
তবে, অপর্ণা তার সিদ্ধান্তে স্থির ছিল। “যতই তাদের মনে তীব্র প্রতিবন্ধকতা থাকুক, আমি তোমার সাথে থাকবো, নির্বাণ,” অপর্ণা নির্বাণকে শান্তভাবে বলেছিল। কিন্তু গ্রাম যখন তাদের সম্পর্কে জানতে পারে, তখন সমস্যা আরও বড় হয়ে যায়। “অপর্ণা, তোমার মা জানেন কি?” নির্বাণ একদিন অপর্ণাকে জিজ্ঞেস করেছিল। “হ্যাঁ, তবে মা চুপ করে থাকেন, কারণ তিনি জানেন এই সম্পর্কটি কেবল আমার জন্য নয়, সমাজের জন্যও বিপদজনক। কিন্তু তিনি জানেন, আমি আর সবার মতো থাকব না,” অপর্ণা উত্তর দিয়েছিল। “তবে একদিন, আমাদের সিদ্ধান্তকে তারা মেনে নেবে,” অপর্ণা সেই দিন বলেছিল, যার মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস ছিল।
তাদের সম্পর্কের খবর যখন গ্রামের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন সমাজের কিছু অংশ তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিছু গ্রামবাসী, বিশেষ করে পুরনো মনোভাবাপন্নেরা, এই সম্পর্ককে ভ্রষ্ট মনে করতে শুরু করেন। “এটা শুধু অপসংস্কৃতি,” কেউ বলেছিল, “এরা নিজেদের মানসিকতা হারিয়ে ফেলছে।” অপরদিকে, গ্রামটির বড় পুরোহিত, যিনি সাধারণত ধর্মীয় ব্যাপারে গ্রামবাসীদের পিছু পিছু চলতেন, তাকে এই সম্পর্ক সমর্থন করা যায় না বলে জানিয়ে দেন। “এটা আমাদের সমাজের জন্য এক ধ্বংসাত্মক পথ,” তিনি বলেন, “তাদের মতো সম্পর্ক সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।”
নির্বাণ এবং অপর্ণা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে গ্রামীণ প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করতে থাকেন। নির্বাণের জন্য এটা এক কঠিন সময় ছিল, কারণ তার নিজ পরিবারও চাপ সৃষ্টি করছিল। তার বাবা, যিনি এখনো অপর্ণার সাথে সম্পর্কের বিরোধী ছিলেন, তাকে আবার সতর্ক করলেন। “তুমি এই পথে গেলে, পরিবারকে সম্মান করতে পারবে না,” নির্বাণের বাবা বলেছিলেন। “তুমি যদি অপর্ণাকে বেছে নাও, তবে তোমার ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যাবে।”
অপর্ণার জন্যও এই সময় ছিল যন্ত্রণা। তার মা শ্রীমতী সুকন্যা, যিনি স্বাভাবিকভাবেই তার জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে তাকে পরামর্শ দিতে চাইতেন, এখন তাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, “তুমি যদি এই সম্পর্কটা অব্যাহত রাখো, তবে তুমি আমাদের পরিবারের সম্মান নষ্ট করবে। সমাজ তোমাকে কখনোই গ্রহণ করবে না।” অপর্ণা জানত, তার মায়ের কথায় কিছুটা সত্যতা আছে, কিন্তু সে কখনোই মনে করেনি যে সে তার জীবনের পছন্দের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দিবে। “মা, আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো,” অপর্ণা একদিন বলেছিল, “তবে আমি আমার জীবন আমার মতো করে বাঁচতে চাই।”
গ্রামের মধ্যে চলতে থাকা এই সংঘর্ষ এবং প্রতিবন্ধকতার মধ্যে, নির্বাণ ও অপর্ণা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের সম্পর্কের প্রতি দৃঢ় ছিলেন। তারা জানত, এই প্রেমের জন্য তাদের অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হতে পারে, তবে তাতে তারা ভয় পায়নি। সমাজের বাধা, পারিবারিক চাপ, এবং গ্রামের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে তাদের সম্পর্ক এগিয়ে যেতে থাকে, এক ধরনের সাহসিকতার সঙ্গে।
এই অধ্যায়ে, নির্বাণ এবং অপর্ণার সম্পর্ক গ্রামীণ সমাজের অচল নিয়ম এবং সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে, তাদের প্রেম কেবল নিজেদের সম্পর্কের বিষয় নয়, বরং এক আন্দোলন—সমাজের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ।
৬
গ্রামের প্রতিবন্ধকতা, পরিবারের প্রত্যাশা, এবং সমাজের চোখে তাদের সম্পর্ক এক অসম্ভব সংগ্রাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নির্বাণ এবং অপর্ণার প্রেম শুধুই এক আদর্শ বা রোমান্টিক অনুভূতি নয়, এটি হয়ে উঠেছিল এক যুদ্ধ—নিজের বিশ্বাস, নিজেদের সত্তা এবং নিজেদের সম্পর্ককে সমাজের নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে অক্ষুণ্ন রাখার সংগ্রাম। এই যুদ্ধ প্রতিদিনই তাদের মনোযোগকে চুরমার করে দিচ্ছিল, তবে তারা একে অপরের সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আগ বাড়িয়ে চলতে থাকল। তাদের কাছে জীবন ছিল আরেকটি লড়াই—যেখানে তারা একে অপরকে উদ্ধার করতে চেয়েছিল, কিন্তু এ পথে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল।
একদিন, অপর্ণা যখন বাড়ি ফিরছিল, তখন তার মা তাকে ডেকে বললেন, “তুমি জানো, অপর্ণা, তোমার সম্পর্ক শুধু তোমার নয়, আমাদের গ্রাম ও পরিবারের সম্মানও নষ্ট করতে যাচ্ছে। তোমার বাবা অনেকদিন ধরেই এই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন, কিন্তু তুমি কিছুই শুনছ না।” অপর্ণা জানত, তার মা তাকে ভালোবাসেন, কিন্তু এই সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি কেবল মায়া এবং উদ্বেগই প্রকাশ করছেন। “মা, আমি তোমাকে বলছি, আমি তোমার সম্মান নষ্ট করতে চাই না। কিন্তু আমি যে মানুষকে ভালোবাসি, তার সঙ্গে থাকতে হবে। আমি আমার জীবন নিজের মতো কাটাতে চাই, অন্যের প্রথা এবং ধারায় নয়।” অপর্ণার এই দৃঢ় সুর তার মাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল, তবে সুকন্যা তাকে চুপ করে থাকতে বললেন, কারণ তিনি জানতেন, অপর্ণার আত্মবিশ্বাস এই মুহূর্তে টলানো যাবে না।
নির্বাণের অবস্থা ছিল আরও জটিল। তার পরিবার এবং সমাজের দ্বিধান্বিত প্রত্যাশা তাকে মাঝেমধ্যেই বিভ্রান্ত করছিল। তার বাবা, যিনি গ্রামে একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্ব, তাকে একের পর এক সতর্ক করছিলেন, “যদি তুমি এই সম্পর্ককে অব্যাহত রাখো, তবে মনে রেখো, তোমার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। অপর্ণা তোমার জন্য সঠিক নয়।” নির্বাণ জানত, তার বাবা যা বলছেন, তা হয়তো বাস্তবতার সঙ্গে মেলে, কিন্তু তার হৃদয় ও আত্মা বলছিল অন্য কিছু। “আমি জানি, বাবা, আপনি যা বলছেন তা আপনার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, কিন্তু আমি যা অনুভব করছি, তা আমার নিজস্ব পথ। আমি অপর্ণাকে ভালোবাসি, এবং আমার জীবন তাকে ছাড়া অগোছালো।” তার পিতা নির্বাণের এই সাহসিকতা দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন, তবে তিনি জানতেন যে, তার ছেলের এই সিদ্ধান্ত তাকে পরিবার ও সমাজের অন্ধকার পথে নিয়ে যেতে পারে।
এই সংকটের মধ্যে, অপর্ণা এবং নির্বাণ একে অপরকে এক মস্ত বড় সিদ্ধান্ত নিতে বলছিলেন। অপর্ণা তাকে একদিন বলেছিল, “যতই আমাদের বাধা আসুক, নির্বাণ, আমি তোমার সাথে রয়েছি। সমাজ কি বলবে, তার থেকে বেশি আমি জানি, আমার হৃদয় কোথায় স্থির রয়েছে। আমাদের জন্য, সম্পর্কের মানে হলো একে অপরকে সাহস দেয়া, সহ্য করা, আর ভালোবাসা—আমরা যে সমাজের মধ্য দিয়ে চলছি, তা আমাদের ঠিক পথের বাধা হতে পারে না।” অপর্ণার এই কথাগুলি নির্বাণের জন্য একটি নতুন শক্তির সূচনা হয়ে দাঁড়াল। সে জানত, যদি তারা একে অপরের পাশে থাকে, তবে এই সংগ্রাম একদিন সমাপ্ত হবে—তবে এর জন্য তারা সমাজের এবং পরিবারের বাঁধা কাটিয়ে উঠতে হবে।
অপর্ণার সাহস এবং নির্বাণের দৃঢ়তা একদিন তাদের গ্রামকে বাধ্য করেছিল। তাদের সম্পর্কের বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছিল, তারা একসময় তাদের দৃঢ় মনোভাব এবং সত্যিকারের ভালোবাসা দেখে থেমে গিয়েছিল। গ্রামে কিছুটা বদলাও এসেছিল, যদিও তা ধীরে ধীরে। গ্রামবাসীরা বুঝতে শুরু করেছিল, যে প্রেম এবং সম্পর্ক শুধু বাহ্যিক আচরণ নয়, এটি অন্তরের অনুভূতি এবং মানসিকতার ব্যাপার। অপর্ণা এবং নির্বাণ তাদের সম্পর্কের মাধ্যমে এই বার্তাটি পৌঁছে দেয়, যে সমাজের অচল দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হতে পারে যদি দুজন মানুষ একে অপরকে সত্যিকারের ভালোবাসা এবং সম্মান দিয়ে সাহায্য করে।
তবে এই সংগ্রাম সহজ ছিল না। একদিন, যখন অপর্ণা বাড়ি ফিরছিল, তার মা তাকে বলেছিলেন, “তুমি কি জানো, অপর্ণা, তোমার সিদ্ধান্ত আমাদের পরিবারের জন্য কতটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে? কিন্তু আমি জানি, তুমি যদি সত্যিই এই সম্পর্কের মধ্যে সুখী হও, তবে আমি তোমার পাশে আছি।” অপর্ণার চোখে এক দাগ দাগ হয়ে ওঠে—মায়ের সেই কষ্ট এবং সহানুভূতি। “মা, আমি জানি, এটা সহজ নয়। কিন্তু আমি জানি, আমি যে পথে হাঁটছি, সেটি আমার জন্য সঠিক।”
নির্বাণ এবং অপর্ণার সম্পর্কের এই কঠিন সময়ে, তারা বুঝতে পেরেছিল, যে প্রকৃত ভালোবাসা শুধু আত্মবিশ্বাস, সাহস এবং কঠিন সংগ্রাম নয়, বরং নিজের সত্যিকার অস্তিত্বকে সমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইও বটে। তারা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে শিখতে থাকল, এবং তাদের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করল। সমাজের একদিকে শিরশ্ছেদকারী প্রতিবন্ধকতা, আর অন্যদিকে তাদের প্রেম—এই দুটি উপাদান একে অপরকে অসম্ভবের মতো শক্তিশালী করে তুলেছিল।
৭
নির্বাণ এবং অপর্ণার জীবন এক কঠিন মোড়ে পৌঁছেছিল, যেখানে তারা জানত, তাদের সম্পর্ক একেবারে ভিন্ন এক দিশায় নিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম ও সমাজের পক্ষ থেকে, তাদের সম্পর্ক ছিল এক অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিপজ্জনক ঘটনা, তবে তাদের বিশ্বাস ছিল, সত্যিকারের ভালোবাসা সমাজের নিয়ম ও চাহিদার ওপরে। অপর্ণা এবং নির্বাণ অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাদের সম্পর্ককে আর লুকানো যাবে না, তাদের পরিবার এবং গ্রামকে একে অপরের সাথের সত্যিকার সম্পর্ক সম্পর্কে জানাতে হবে। তবে, এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তাদের সামনে যে বিপদ অপেক্ষা করছিল, তা ছিল অনেক বড়। তাদের মনে এক প্রশ্ন ছিল, “তাদের এই সম্পর্ক, তাদের পরিবার এবং গ্রামের জন্য কতটা মূল্যবান হতে পারে?”
একদিন, অপর্ণা নির্বাণের কাছে এসে বলেছিল, “নির্বাণ, আমরা যদি একে অপরকে সত্যিই ভালোবাসি, তবে আমাদের সমাজের বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে। আজকের দিনে আমাদের সম্পর্ক প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু আমি জানি, এটাই আমাদের জন্য এক নতুন যাত্রা। আমি তোমার পাশে আছি, তবে যদি আমাদের সম্পর্কের কারণে গ্রামে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা হারাতে হয়, তাহলে আমাদের কী করতে হবে?” অপর্ণার এই কথাগুলি, নির্বাণের কাছে এক আত্মবিশ্বাসী বার্তা হয়ে দাঁড়াল। তাদের জীবন ও সম্পর্কের প্রতি এক অসীম বিশ্বাস গড়ে ওঠে। তাদের সম্পর্কের সামনে যে বাধাগুলি ছিল, সেই সব বাধাকে অতিক্রম করতে গেলে সাহস এবং আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল। তবে, এই মুহূর্তে, তাদের মধ্যে এক ধরনের সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গড়ে ওঠে।
নির্বাণ জানত, গ্রামে তাদের সম্পর্কের শত্রু হিসেবে অনেকেই থাকবেন। তার পরিবার, বিশেষ করে তার বাবা, এই সম্পর্ককে কখনও মেনে নেবেন না। “তুমি যদি অপর্ণাকে বিয়ে করো, তাহলে আমাদের পরিবার সমাজে অপ্রত্যাশিত হয়ে পড়বে। তোমার ভবিষ্যতকে আমি ধ্বংস হতে দেব না।” তার বাবার এই কঠোর মন্তব্য, নির্বাণের হৃদয়ে এক কঠিন চেপে বসেছিল। তবে, নির্বাণ জানত, যদি তাকে তার জীবনের পথটি বেছে নিতে হয়, তবে তাকে পরিবার এবং সমাজের চোখে নিজেদের সম্পর্কের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। “আমার জীবনের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ, তা আমার হৃদয়ের ভিতরেই রয়েছে। আমি অপর্ণাকে ভালোবাসি। তার সঙ্গেই আমার ভবিষ্যত,” নির্বাণ একদিন নিজেকে বলেছিল, যখন তার পিতা তার বিরুদ্ধে কঠিন কথাবার্তা বলছিলেন।
অপর্ণা এবং নির্বাণ দুজনেই জানত, এই সিদ্ধান্তের ফলে তাদের সম্পর্কের পথে অন্ধকার এবং দ্বন্দ্ব আরও গভীর হবে, তবে তারা পিছিয়ে আসবে না। তারা চেয়েছিল, তাদের সম্পর্ক যেন আরও দৃঢ় হয়, যাতে তারা একে অপরকে আঁকড়ে ধরে জীবনের যাত্রা চালিয়ে যেতে পারে। এক রাতে, তারা সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের পরিবার এবং গ্রামকে তাদের সম্পর্ক সম্পর্কে জানিয়ে দিতে হবে। “আজ রাতেই আমরা আমাদের সম্পর্কের কথা সবাইকে জানাবো,” অপর্ণা বলেছিল, “এটাই আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হবে আমাদের প্রেমকে বৈধতা দেবার।” নির্বাণও একমত ছিল, “আমরা আমাদের সত্যের দিকে যাবো। একে অপরকে বিশ্বাস করে, আমরা এই যুদ্ধে জয়ী হবো।”
তারা প্রথমে নির্বাণের পরিবারকে জানিয়ে দেয়। তার বাবা এবং মা, যে অনেকদিন ধরেই তাদের সম্পর্ক নিয়ে কিছুটা সন্দিহান ছিলেন, তাদের মনের মধ্যে তীব্র বিরোধ তৈরি হয়ে যায়। “তুমি কি জানো, নির্বাণ, অপর্ণা তোমার জন্য উপযুক্ত নয়। তুমি নিজের জীবনের জন্য যা চাও, সেটা তুমি কখনোই পাবে না। আমি তোমার মঙ্গল চাই, তবে তুমি ভুল পথে চলছো,” নির্বাণের বাবা বলেন, তার কণ্ঠে রাগ আর হতাশা ছিল। কিন্তু নির্বাণের মন স্থির ছিল। “আমি আমার জীবন বেছে নিচ্ছি, বাবা। আমি জানি, আমার পথটি আমার হৃদয়ের কথা শুনে তৈরি হবে। অপর্ণাকে আমি ভালোবাসি এবং তার সঙ্গেই থাকব।” অপর্ণা তার মা শ্রীমতী সুকন্যার কাছে এসে বলেছিল, “মা, আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো, কিন্তু আমি আমার জীবনের জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই সম্পর্কটি আমার আত্মার শান্তি এনে দেবে।” সুকন্যা অপর্ণার চোখে কিছুটা কষ্ট ও উদ্বেগ দেখতে পেলেন, কিন্তু তিনি আর কিছু বললেন না।
পরবর্তী কিছু দিন, গ্রামও তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে মন্তব্য শুরু করেছিল। সমাজের নেতৃবৃন্দ, পুরোহিতরা, এবং পুরনো গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে এই সম্পর্কের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। “এটা আমাদের সংস্কৃতি ও সমাজের বিরুদ্ধে,” তারা বলেছিল, “এরা নিজেদের জীবন নিয়ে সমাজের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলছে।” তবে, অপর্ণা এবং নির্বাণের দৃঢ় মনোভাব এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, তাদের এই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে সহায়তা করছিল। “আমরা যদি সত্যিই নিজেদের বিশ্বাসে স্থির থাকতে পারি, তাহলে আমাদের কোনো কিছুই ঠেকাতে পারবে না,” অপর্ণা বলেছিল।
গ্রাম এবং পরিবার, সব কিছুর বিরুদ্ধেই, তারা জানত যে তাদের একে অপরের দিকে হাঁটা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। নিজেদের সম্পর্ককে সমাজের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তাদের সাহস এবং নির্ভীকতা ছিল একমাত্র শক্তি। “তোমার জন্য আমি পৃথিবীটাকে অতিক্রম করবো, অপর্ণা,” নির্বাণ বলেছিল, “তুমি জানো, তোমার পাশে আমি সব বাধা অতিক্রম করতে পারব।” অপর্ণা হাসতে হাসতে বলেছিল, “তুমি আমার সঙ্গী, নির্বাণ, এই পৃথিবীটার সব কিছুকে একসাথে জয় করতে পারব। আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করি, আর তাই আমাদের সম্পর্ক চিরকাল স্থায়ী হবে।”
এভাবেই, অপর্ণা এবং নির্বাণ সিদ্ধান্ত নেন, তারা একে অপরকে ছেড়ে কোনোদিন যাবে না, এবং তাদের সম্পর্কের পথে যে অন্ধকার ঘনীভূত ছিল, তা কেবলমাত্র তাদের ভালোবাসার আলোতে ভেসে যাবে।
৮
নির্বাণ এবং অপর্ণার জীবনে বহু সংগ্রাম ও কষ্টের পর, একদিন তারা বুঝতে পারে যে, তারা যতই ভালোবাসা এবং সহানুভূতির সাথে নিজেদের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, ততই তাদের সমাজ, পরিবার এবং নিজেরাও চায় তাদের সম্পর্কের প্রতিবন্ধকতা ভাঙতে। গ্রামবাসী এবং তাদের পরিবার, যারা প্রথমে তাদের সম্পর্কের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল, এখন তাদের প্রতিরোধ শুরু করতে পেরেছিল। যদিও তাতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, তবে তাদের সম্পর্কের প্রতি মানুষের মনোভাব সহজে বদলায়নি। কিন্তু অপর্ণা এবং নির্বাণ জানত, এটা শুধুমাত্র একটি প্রাথমিক বাধা, এবং তাদের একে অপরের প্রতি বিশ্বাস এবং ভালোবাসা, যা কখনোই হালকা হতে পারে না, সেটিই তাদের পথের সঠিক দিশা।
একদিন, গ্রামে এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল, যেখানে সব পুরনো সিদ্ধান্ত, মতামত এবং বিশ্বাসকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হবে। অপর্ণা এবং নির্বাণ নিজেদের সম্পর্কের কথা ওই সভায় জানানোর জন্য প্রস্তুত ছিল। তারা জানত, এই মুহূর্তটি তাদের জীবনের একটি নতুন সূচনা হতে পারে, যেখানে তারা সব প্রতিবন্ধকতা ভেঙে এক নতুন জীবনের পথে হাঁটতে পারে।
সভায়, অপর্ণা এবং নির্বাণ নিজেদের সম্পর্কের কথা খুলে বলল, তাদের জীবনের শুদ্ধতা এবং একে অপরের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার কথা ভাগ করে নিল। তাদের মধ্যে ছিল এক অদৃশ্য শক্তি—সত্যের শক্তি, যা সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। যদিও প্রথমে গ্রামের কিছু বড় ব্যক্তি তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে নিন্দা জানালেও, ধীরে ধীরে অন্যরা তাদের সত্য ও ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শুরু করল। তাদের সাহসিকতা দেখে কিছু গ্রামবাসী বুঝতে পেরেছিল, যে ভালোবাসা কখনো সমাজের কাঁটাতারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা সকল মানবিকতার ঊর্ধ্বে।
গ্রামের অনেক পুরনো মানুষ, যারা তাদের সম্পর্কের প্রথম দিকে বিপক্ষে ছিলেন, এবার তাদের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি দেখানোর চেষ্টা করছিল। দ্যুতি, যিনি গ্রামের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, একদিন নির্বাণ এবং অপর্ণাকে দেখে বলেন, “তোমরা প্রমাণ করেছ যে, ভালোবাসা যদি সঠিক হয়, তবে তা প্রতিটি প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করতে পারে। আজ, আমি তোমাদের সম্পর্ককে আমার সম্মান দিচ্ছি।” এই কথাগুলি নির্বাণ এবং অপর্ণার জন্য একটি বিশাল জয় ছিল, কারণ তারা তাদের সম্পর্কের মধ্যে যে কঠিন সত্যতা ছিল, তা এখন গ্রামবাসীও মেনে নিতে শুরু করেছিল।
এদিকে, অপর্ণার মা, শ্রীমতী সুকন্যা, তার মেয়ে ও নির্বাণের সাহসিকতায় কিছুটা শান্তি পেয়েছিলেন। তিনি জানতেন, সমাজ ও পারিবারিক চাপের মধ্যে অপর্ণা কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু তার সাহস এবং দৃঢ়তা দেখার পর তিনি অনুভব করেছিলেন, অপর্ণা যদি সত্যিই নিজের জীবনে সুখী হতে চায়, তবে তাকে তাকে সমর্থন করতে হবে। একদিন অপর্ণা তার মাকে বলেছিল, “মা, আমি জানি তুমি আমাকে সঠিক পথ দেখাতে চেয়েছ, কিন্তু আমি নিজের সিদ্ধান্তে স্থির আছি। আমি জানি, আমার ভালোবাসা সঠিক।” সুকন্যা এবার মায়ের মতো সমর্থন দিয়ে বলেছিলেন, “তুমি যদি সত্যিই বিশ্বাস করো, তাতে আমি তোমার পাশে আছি।”
নির্বাণের পরিবারও ধীরে ধীরে তাদের সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়। যদিও তার বাবা প্রথমে তাদের সম্পর্ককে মেনে নিতে চাইছিল না, তবে একদিন নির্বাণ তাকে বলেছিল, “বাবা, আমি জানি তোমার জন্য এটা খুবই কঠিন, কিন্তু আমি অপর্ণাকে ভালোবাসি। আমাদের সম্পর্ক শুধুই একটি সঙ্গীর সম্পর্ক নয়, এটি আমাদের দুজনের জীবনের পাথেয়। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তবে আমি আমার জীবনের পথ বেছে নিয়েছি।” তার বাবা কিছুক্ষণ নীরব থাকেন, পরে ধীরে ধীরে বলেন, “তুমি যদি সত্যিই সুখী হও, তবে তোমাকে থামানোর কোনো অধিকার আমার নেই।”
এই সিদ্ধান্তের পর, অপর্ণা এবং নির্বাণ একে অপরকে আরও গভীরভাবে বুঝতে শুরু করে। তাদের ভালোবাসা শুধু এক সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি তাদের জীবনের নতুন সূচনা ছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, পৃথিবী যতই কঠিন হোক, ভালোবাসা সঠিক পথে হাঁটলে তা অন্ধকারকেও জয় করতে পারে। তারা তাদের ভবিষ্যত একসঙ্গে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়—একটি নতুন পৃথিবী, যেখানে তারা সমাজের কোনও শৃঙ্খলা বা বাধাকে পাত্তা না দিয়ে তাদের প্রেমের শক্তির উপর ভর করে হাঁটবে।
গ্রামের মানুষদের মনোভাবও আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে থাকে। যখন অপর্ণা এবং নির্বাণের সম্পর্কের কথা সবাই জানে, তখন কিছু পরিবার তাদের ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে, এবং কিছু মানুষ তাদের সাহসিকতার প্রশংসা করতে থাকে। কিছু পুরনো ধ্যানধারণা ভেঙে যায়, আর তাদের সম্পর্ক এক নতুন সমাজের উদাহরণ হয়ে ওঠে, যেখানে প্রেম এবং সত্যিকার ভালোবাসা কোনো বাধাই মানে না।
অপর্ণা এবং নির্বাণ জানত, তাদের জীবন কখনোই সহজ হবে না, তবে তারা একে অপরের সঙ্গে সুখী এবং সম্মানিত জীবন কাটানোর জন্য একসঙ্গে শক্তি যোগাবে। তাদের ভালোবাসা, যা কখনোই সমাজ বা পরিবার দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল না, সেই ভালোবাসা এখন সকলের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল।
***




