Bangla - প্রেমের গল্প

অপরূপ

Spread the love

রূপালী রায়


গ্রামের এক কোণায় এক প্রাচীন মেলা বসেছিল, যেখানে সারা গ্রাম ও আশেপাশের অঞ্চলের লোকজন একত্রিত হয়েছিল। বাতাসে মিষ্টি রঙিন কাগজের ঝলকানি আর মিষ্টির গন্ধ মিশে গিয়েছিল। চারপাশে হইহই করে চলছিল হাসি-আলাপ, এবং কিছু কিছু ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে বলছিল তাদের যাদু-গল্প। এখানে ছিল কিছু পুরনো কাঠের খেলনা, ঝুলন্ত লাইট, আর সুরম্য ছোট ছোট দোকান। নির্বাণ, যার জীবনে এমন অনুষ্ঠান ছিল কিছুটা বিরক্তির, সে মেলাতে আসতে বাধ্য হয়েছিল। তার পিতা, একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি, আশা করেছিলেন যে, তার ছেলে গ্রামের রাজনৈতিক গুরুদের সঙ্গে মেলামেশা করবে। কিন্তু নির্বাণ একা ছিল, এবং তার মনে কিছুই ছিল না, শুধু ছিল এক অজানা আকর্ষণ যা তাকে এখানে আসতে বাধ্য করেছিল। যখন সে মেলাতে পৌঁছেছিল, এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা অপর্ণার দিকে তার চোখ পড়ল। অপর্ণা ছিল একটি সাধারণ গ্রামীণ মেয়ে, তবে তার চোখে কিছু ছিল যা নির্বাণের মনে গভীরভাবে ধ্বনি তুলল। তার মুখাবয়ব ছিল যেন, প্যাশন এবং আত্মবিশ্বাসের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। অপর্ণা তখন মেলার একটি স্টলে দাঁড়িয়ে একটি পুরনো বই হাতে নিয়ে পড়ছিল, আর তার মুখের একদম পাশে ছিল স্নিগ্ধ আলো। নির্বাণ যেন তাতেই আটকে গিয়েছিল। তার মধ্যে কিছু ছিল, যেন অপর্ণা একটি রহস্য, একটি অজানা পৃথিবী, যার দিকে সে কখনও তাকায়নি। মেলাতে নিত্যদিনের যে অস্থিরতা ছিল, তা এক মুহূর্তে বিলীন হয়ে গিয়েছিল, আর নির্বাণ জানত না, কেন সে এত আকৃষ্ট হচ্ছে অপর্ণার দিকে।

এদিনের সন্ধ্যাটি, যেদিন তার জীবনের এই অজানা যাত্রা শুরু হয়েছিল, সে কখনোই ভাবতে পারেনি। অপর্ণার সঙ্গে তার প্রথম কথা বলা ছিল যেন এক ছোট্ট গল্পের শুরু, তবে একটি গল্প যা অজানাকে জয় করার এবং আত্মবিশ্বাসের এক নতুন রূপ গড়ার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। প্রথমেই, অপর্ণা নির্বাণের কাছে তার বইটি ফিরিয়ে দেয় এবং হালকা হেসে বলে, “এটা একদিন আমি শেষ করব, কিন্তু এখন, আমি কিছুক্ষণের জন্য আপনাকে জানার সুযোগ দিব।” নির্বাণ সেদিন প্রথম বুঝতে পারে, অপর্ণা এমন এক মানুষ, যে নিজেকে সবসময় প্রশ্ন করে, যাকে জানলে তার হৃদয় আরও এক ধাপ খোলাখুলি হবে। অপর্ণার কথায়, তার মধ্যে এক অদ্ভুত মিষ্টি তীব্রতা ছিল, যা নির্বাণের ভেতর কিছুটা অস্থিরতা তৈরি করেছিল। তার সাথে কথা বলার পর, নির্বাণ অনুভব করে, যে তার জীবনে এরকম কিছু হবে, যা সে কখনো আশা করেনি। অপর্ণার কথার মাঝে ছিল এক ধরনের সাহসিকতা, যা নির্বাণকে এক অজানা পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিল।

এদিনের পর, মেলার শেষে নির্বাণ একা বাড়ি ফিরছিল। তার মাথার ভেতর অপর্ণার কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে জানত, মেলা এমন কিছু সাদামাটা ব্যাপার ছিল না, বরং এটি তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা ছিল। কিন্তু সেই রাতের পর, গ্রাম এবং তার পরিবারের মধ্যে থাকা প্রচলিত নিয়ম ও প্রত্যাশার বিরুদ্ধে তার কিছু অনুচিত প্রশ্ন শুরু হয়েছিল। নির্বাণ অনুভব করেছিল যে, অপর্ণা তার জীবনে আসার পর, তার নিজের পৃথিবী আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে এমন কিছু ছিল, যা তাকে তার পূর্ব পরিচিত গ্রাম্য জীবন থেকে বেরিয়ে যেতে প্ররোচিত করছিল। সে বুঝতে পারছিল না যে, এই সম্পর্কের মধ্যে কী ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে, কিন্তু তার মন সে দিন বুঝেছিল যে অপর্ণার প্রতি তার আকর্ষণ আর কিছু নয়, বরং তার নিজের সীমাবদ্ধতা ও সমাজের গণ্ডি ভেঙে নতুন এক পথের সন্ধান। একদিকে তার নিজস্ব পরিবার, সমাজ এবং গ্রাম, অন্যদিকে অপর্ণা—এই দ্বন্দ্ব তার মনে ক্রমেই বাড়তে শুরু করল। তবে নির্বাণ জানত, জীবনের এই যাত্রায় কিছু না কিছু বেছে নিতে হবে, আর অপর্ণা তার জীবনের সেই অজানা পথের দিশারি হতে পারে।

গ্রাম থেকে বাড়ি ফেরার পর নির্বাণের মনে ছিল অপর্ণার প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ, যা তাকে শান্ত থাকতে দিচ্ছিল না। মেলাতে প্রথম দেখা, তার পরের দিনের চিন্তা—এই অনুভূতি অবিরত তার মাথায় ঘুরছিল। কিছুদিনের মধ্যে, অপর্ণা ও নির্বাণের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এক সন্ধ্যায়, গ্রামে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, যেখানে নির্বাণের বাবা তাকে যেতে বলেছিল, তবে নির্বাণের মন ছিল অন্য দিকে। সেই দিন সে নিজেকে অপর্ণার সঙ্গে এক নির্জন জায়গায় পেতে চেয়েছিল। গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে, একটি পুরনো তালগাছের তলায় তারা একে অপরকে অপেক্ষা করতে বলেছিল। সেখানে, তারা একে অপরের সঙ্গে জীবনের শুদ্ধ ও অকপট কথা ভাগ করে নিতে চায়, যেখানে ছিল না কোনো ভীতি, কোনো সমাজের চাপ।

অপর্ণা তার জীবনের শৈশবকালীন স্মৃতির কথা বলে, যেখানে গ্রামের নিয়মকানুনের মধ্যে বেড়ে ওঠা তাকে কখনও কখনও অস্বস্তিতে ফেলত। তার মা-মনে মনে তাকে সব সময়ই শিখিয়েছিলেন, “পৃথিবী তোমাকে তোমার জায়গা দেখাবে, কিন্তু তুমি যদি তা মানতে না চাও, তবে তুমি নিজের পৃথিবী গড়ো।” অপর্ণা মনে করত, যে কোনো পরিস্থিতিতে সে নিজেকে অটুট রাখবে এবং সমাজের শর্তগুলোর বাইরে গিয়ে জীবনের স্বাদ নেবে। নির্বাণ তার সঙ্গে একমত হয়েছিল, কিন্তু সে জানত, তাদের মধ্যে একটি বড় অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে—একটি এমন পৃথিবী, যেখানে তাদের সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য নয়।

একদিন রাতে, যখন গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে ছিল, নির্বাণ ও অপর্ণা একে অপরকে জানাতে চেয়েছিল তাদের হৃদয়ের গভীরতা। গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে, অপর্ণা তাকে একটি পুরনো বাড়ির সামনে নিয়ে গিয়েছিল—একটি abandoned জমিদারবাড়ি, যেখানে দিনের বেলা কেউ আসত না। সে বাড়িটি রাতের অন্ধকারে নতুন কিছু অনুভব করছিল। অপর্ণা নির্বাণকে জানাল, এই বাড়িটি সে বহুবার দেখেছে, কিন্তু আজকের রাতেই তার কাছে এই বাড়িটি বিশেষ হয়ে উঠেছে। “এখানে কেউ থাকে না, নির্বাণ,” অপর্ণা বলল, “তবে এই বাড়ির অন্ধকারে, আমি কিছু পেতে চাই—আমাদের পৃথিবী, যেখানে তোমরা এবং আমি একসঙ্গে থাকতে পারব।” নির্বাণ তখন বুঝতে পারে, অপর্ণা যে সাহসিকতা নিয়ে তার কথা বলছিল, তা শুধু একটি জীবনের সত্য, যা তারা একে অপরের মধ্যে আবিষ্কার করতে চায়।

তারা গভীর রাতে কথা বলছিল, যখন একদিকে বাতাসের সুরের সাথে কিছু গুমোট শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অপর্ণার চোখে তখন এক ধরনের তীব্রতা ছিল, যেন সে কোনো অন্ধকার শক্তির সম্মুখীন। নির্বাণ তখন মনে মনে অনুভব করল, যে তাদের সম্পর্কের পথ একদিকে সুপ্রশস্ত হতে পারে, তবে অন্যদিকে, এখানে ভয় ও অনিশ্চয়তার এক অদৃশ্য বলয়ও রয়েছে। “যদি আমরা একসঙ্গে এই পৃথিবীতে চলতে চাই, তবে আমাদের একে অপরকে বিশ্বাস করতে হবে,” অপর্ণা বলল, তার চোখে এক অজানা শূন্যতার কষ্ট। নির্বাণ জানত, তাদের মধ্যে কিছু ছিল যা অন্যদের কাছে সম্ভব ছিল না, এবং সেই কারণেই তাদের সম্পর্ক এত অদ্ভুত ও গভীর হয়ে উঠেছিল।

রাত গভীর হয়ে আসছিল, এবং গ্রাম থেকে দূরে, এক শীতল বাতাসে তারা একে অপরকে আরও কাছে টানছিল। অপর্ণা তখন বলল, “এখানে, আমরা যদি একসঙ্গে থাকি, তবে আমরা আমাদের নিজের পৃথিবী তৈরি করব, যেখানে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম থাকবে না, শুধুমাত্র আমরা এবং আমাদের ভালোবাসা।” নির্বাণ, যার মনে সমাজের প্রত্যাশার ভার ছিল, সে অনুভব করছিল যে এই মুহূর্তে তার হৃদয়ের মধ্যে এক নতুন শক্তি জেগে উঠছে। অপর্ণার কথা শুনে, সে শপথ করেছিল, সে এখন যেভাবে চাইবে, সেইভাবে জীবন কাটাতে চাইবে, তার পরিণতি কিছুই হোক না কেন।

এই রাতেই, নির্বাণ বুঝতে পারে যে, অপর্ণা শুধু একটি মেয়ে নয়, বরং তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের সূচনা। পরদিন সকালে, সব কিছুই বদলে যাবে—গ্রামের প্রত্যাশা, পারিবারিক শর্ত, এবং সমাজের চোখে তাদের সম্পর্কের নতুন অর্থ। তবে নির্বাণ জানত, যে সম্পর্ক শুরু হয়েছিল অন্ধকারের মধ্যে, তা এখন আলোয় পরিণত হতে চলেছে।

গ্রামের যে অন্ধকার রাতে নির্বাণ এবং অপর্ণার সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে উঠেছিল, সেই রাতের পর থেকেই নির্বাণের জীবন এক নতুন দিশায় চলতে শুরু করেছিল। তার মন একদিকে অপর্ণার প্রতি আকর্ষণে ভরা, অন্যদিকে তার পরিবারের প্রত্যাশা এবং তার পিতার কঠোর শাসনের চাপ বেড়ে যাচ্ছিল। নির্বাণ জানত, অপর্ণার প্রতি তার অনুভূতি কোনও সাধারণ সম্পর্কের কথা নয়; এটি তার জীবনের নতুন পথ, যা সমাজের গণ্ডি ছড়িয়ে তাকে এক অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। তবে, এই সম্পর্কের মূল্য তাকে যে অন্ধকার পথ দিয়ে যেতে হবে, তা তাকে তার নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করছিল।

একদিন, নির্বাণের বাবা তাকে একান্তে ডাকেন। বয়সের ভার এবং গ্রামের রাজনৈতিক চাপের মধ্যে তিনি একজন গুরুতর পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত, যার প্রভাব সমাজের প্রত্যেকটি কোণায় ছিল। “নির্বাণ, তুমি জানো কি, আমাদের পরিবারের মর্যাদা কী?” তার বাবা শুরু করেন, যেন কোনো অনিবার্য দিক থেকে বিষয়টি খুলতে চান। নির্বাণ বুঝতে পারছিল, তার পিতা কোনওভাবে তার জীবন পরিবর্তন করতে চান, বিশেষ করে তার সম্পর্ক নিয়ে। “এটা শুধুই সম্পর্ক নয়, ছেলে,” তার বাবা বলেন, “এটা আমাদের পরিবারের সম্মান। তুমি যদি এসব আধুনিক ঝামেলায় জড়াও, তাহলে পুরো পরিবার শত্রুদের মধ্যে পড়বে। তুমি জানো না, অপর্ণা তোমার জন্য ঠিক নয়।” তার পিতার কথাগুলি তীরের মতো শোনা যাচ্ছিল, প্রত্যেকটি শব্দ যেন নির্বাণের হৃদয়ে গর্ত করে নিচ্ছিল।

নির্বাণ তখন অনুভব করল, তার পিতা শুধু তাকে নিজের সুরক্ষায় আটকে রাখতে চান, বরং তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপকে তার পরিবারের অপ্রকাশিত নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে চান। নির্বাণ জানত, সে যদি তার পিতার প্রত্যাশা পূরণ করতে চায়, তবে তাকে অপর্ণাকে ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু তার হৃদয় তার পিতার কথা শোনার পরও অপর্ণার প্রতি আগের মতোই দৃঢ় ছিল। এই দ্বন্দ্ব তার মধ্যে অবিরত তোলপাড় সৃষ্টি করছিল। তার পিতা তার উপরে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছিল, এমনকি তার ভবিষ্যতের কথা ভাবেও, যখন নির্বাণ নিজেকে এবং অপর্ণাকে বাঁচানোর জন্য একটি নতুন পথ খুঁজছিল। “তুমি যদি অপর্ণাকে ভালোবাসো, তবে তুমি আমাদের পরিবারের সম্মান বিকৃত করবে।” তার বাবা আরও বলেন, যেন প্রতিটি শব্দের মধ্যে শাস্তির ভয় রয়েছে।

নির্বাণ এখন এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ছিল। তার মন একটি দিক থেকে অপর্ণাকে চায়, কিন্তু আরেকটি দিক থেকে তার পিতার প্রত্যাশা এবং কর্তব্যের ভার তাকে ভর করছে। সে জানত, তার পিতা তাকে কখনো অপর্ণাকে গ্রহণ করতে দেবে না, কারণ পিতার ধারণা ছিল, এই সম্পর্ক শুধুই তার নিজের সুখের কথা, যা পুরো পরিবারের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। নির্বাণ এক দৃষ্টিতে ভাবল, “এটা কি আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারব? এই সব চাপ সত্ত্বেও কি আমি অপর্ণার প্রতি আমার ভালোবাসা ধরে রাখতে পারব?”

তবে, নির্বাণ জানত, তাকে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অপর্ণার সঙ্গেই তার ভবিষ্যত, নাকি তার পরিবারের ধারাবাহিকতার প্রতি নির্ভরশীলতা? এই প্রশ্ন তাকে গভীরভাবে দোলা দিতে শুরু করেছিল। একদিকে তার বাবার কঠিন হুকুম, অন্যদিকে অপর্ণার মুক্তিযুদ্ধের মতো আত্মবিশ্বাস—দ্বন্দ্বের এই ঝড় তার মধ্যে ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছিল। প্রতিদিনের কথা ছিল না, তবে পিতার সঙ্গে চুপচাপ খুনসুটির সেই দিনগুলো তাকে ক্রমেই চিরকালীন এক সংকটে পরিণত করছিল।

অপরদিকে, অপর্ণা তাকে বারবার সাহস জুগিয়ে যাচ্ছিল। “তুমি যদি সত্যিকারের সুখ চাও, তবে তুমি তোমার জীবন নিজেই বেছে নাও, নির্বাণ। পৃথিবী তোমাকে শেখাবে, তবে তুমি যদি নিজে থেকে কিছু করতে চাও, তবে তোমার ভয় পেলে চলবে না।” অপর্ণার এই কথা নির্বাণের মনে অদৃশ্য এক আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তবে পিতার অনুকম্পা আর সামাজিক প্রত্যাশার প্রতি তার অঙ্গীকার তাকে অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছিল।

এভাবে, একটি বড় সংকট শুরু হয়ে যায় নির্বাণের জীবনে, যেখানে তাকে নিজের ভেতরের আত্মবিশ্বাস এবং পরিবারের সম্পর্কের প্রতি দায়বদ্ধতার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। তার পিতা তাকে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে হুমকি দিতে থাকলে, নির্বাণ আরও একবার ভাবতে শুরু করল—কীভাবে সে একে অপরকে জয় করবে, অথবা তা কিভাবে সব কিছু ত্যাগ করে জীবনটাকে পুনঃনির্মাণ করবে।

নির্বাণের পরিবার এবং পিতার সঙ্গে সম্পর্কের দ্বন্দ্বে যখন সে নিজেকে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিল, তখন অপর্ণার জীবনে একটি নতুন চাপ আসে। গ্রামে তিনি কিছুটা আলাদা ছিলেন, একজন যুবতী যে সমাজের নিয়ম ও প্রত্যাশার বাইরে চিন্তা করে। অপর্ণার মায়ের সঙ্গে সম্পর্কও ততটাই জটিল ছিল। তার মা, শ্রীমতী সুকন্যা, ছিলেন একজন আস্থা এবং বিশ্বাসের প্রতীক, কিন্তু গ্রামীণ সমাজের প্রতি তার একটা গভীর শ্রদ্ধা এবং এক ধরনের ভয় ছিল, যা তাকে তার মেয়ে অপর্ণার স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে কখনোই পুরোপুরি মেনে নিতে দিত না। সুকন্যা একটি রক্ষণশীল মনোভাবের অধিকারিণী ছিলেন, যার জন্য তার মেয়ে অপর্ণার আধুনিকতা ও সাহসিকতা ছিল এক চ্যালেঞ্জ।

সুকন্যা জানতেন যে, অপর্ণা নিজের মতো করে জীবন কাটাতে চায়, কিন্তু তার নিজের মধ্যে ছিল এক ধরনের অবিচল বিশ্বাস, যে তার মেয়ে সমাজের প্রথা অনুসরণ না করলে কোনো ভবিষ্যত তৈরি করতে পারবে না। “তুমি কী ভাবছো অপর্ণা? এইভাবে চলতে থাকলে আমাদের গ্রাম তোমাকে গ্রহণ করবে না,” শ্রীমতী সুকন্যা একদিন তার মেয়ে অপর্ণাকে বলেছিলেন, যখন অপর্ণা তাকে নির্বাণের সঙ্গে সম্পর্কের কথা খুলে বলেছিল। সুকন্যা অপর্ণার সিদ্ধান্তে কিছুটা বিভ্রান্ত ছিল, এবং তার মধ্যে ছিল এক ধরনের উদ্বেগ, কারণ সে জানতো, গ্রামের নিয়মকানুন মেনে চলা যে কোনো তরুণীর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। “তুমি জানো না, মেয়েটি আমাদের সম্পর্কের জন্য কতটা সমস্যা তৈরি করতে পারে,” সুকন্যা বলেন, তার মেয়ে অপর্ণাকে সমঝানোর চেষ্টা করতে।

অপর্ণা, যিনি সবসময় স্বাধীনভাবে চিন্তা করে এবং তার নিজের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, সে মনে করত যে, সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মধ্যে কোনো ভুল নেই। “মা, আমি জানি তুমি আমার জন্য সেরা চাও, কিন্তু আমি আমার জীবন নিজের মতো করে চালাতে চাই,” অপর্ণা সুকন্যাকে বুঝিয়ে বলেন। “আমার মধ্যে একটি শক্তি আছে, যা আমাকে আমি হয়ে থাকতে শেখায়।” কিন্তু সুকন্যা তার মেয়ে অপর্ণার চোখে যে গভীর উদ্বেগ দেখতে পেতেন, তা তাকে স্তব্ধ করে দিত। সুকন্যা জানতেন, পৃথিবীকে মোকাবেলা করতে হলে, একে অপরকে সহ্য করতে হয়, এবং অপর্ণার মতো একজন স্বাধীন মনের মেয়ে সমাজের অঙ্গীকারে গিয়ে নিজের চিন্তাভাবনাকে জড়াতে পারবে না।

এছাড়া, অপর্ণার মায়ের মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্ব ছিল। তিনি নিজের জীবনে কখনও স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারেননি, এবং তিনি জানতেন যে, সমাজের প্রত্যাশা অনুযায়ী তার নিজের জীবন বাঁচানোই ছিল তার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত। অপর্ণা যে জীবন যাপন করতে চায়, তার মা মনে করতেন সেটা বিপজ্জনক হতে পারে। “তুমি কি সত্যিই জানো, অপর্ণা, যে এই সম্পর্কের ফল কী হতে পারে?” সুকন্যা তার মেয়ে অপর্ণাকে কঠোরভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন। “যদি তুমি এই সম্পর্কের প্রতি এতটাই আগ্রহী হও, তাহলে তুমি কীভাবে আমাদের পরিবারকে সমাজে সম্মানজনক অবস্থানে রাখতে পারবে?” তার মা অপর্ণার প্রতি যে উদ্বেগ ছিল, তা সে অস্বীকার করতে পারেনি।

তবে, অপর্ণা জানত যে, তার মা তার ভালো চায়, এবং তাকে কখনোই কোনো খারাপ পথের দিকে যেতে দেখতে চান না। সুকন্যা তার মেয়ে অপর্ণার বুদ্ধি এবং স্বাধীনতার প্রতি সম্মান রেখেছিলেন, তবে কখনও কখনও তিনি মনে করতেন, সেই স্বাধীনতার বিনিময়ে কিছু মূল্য রয়েছে। তবে একদিন, অপর্ণা তার মাকে বলেছিল, “মা, তুমি আমাকে বুঝতে চেষ্টা করো, আমি কি চাইছি, আমি যা ভাবছি, তা আমারই সিদ্ধান্ত। তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করো, তবে আমাকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দাও।”

তবে সুকন্যা বুঝতে পারেন, তার মেয়ে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। প্রতিদিনের নিত্যযাত্রায় যখন অপর্ণা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করেছিল, তখন সুকন্যা তাকে শাসন করতে চাইতেন না। তবে, তিনি জানতেন যে, অপর্ণার জীবনের এই নতুন অধ্যায়ে তাকে সহায়তা করার কোনো উপায় নেই, যদিও সুকন্যার মন ছিল তার মেয়ে থেকে দূরে। অপর্ণা জানত, তার মা তাকে ভালোবাসেন, তবে তার স্বাধীন চিন্তা এবং সিদ্ধান্তের প্রতি মায়ের সমর্থন দেওয়া কঠিন ছিল।

এভাবে, অপর্ণার মা সুকন্যা তাকে কিছুটা ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যদিও সেই সিদ্ধান্ত মনের মধ্যে অজানা ক্ষোভ রেখে গিয়েছিল। তবে, সুকন্যার মনের ভেতরে একটি নতুন আশা জন্ম নেয়, যে হয়তো তার মেয়ে একদিন নিজের জীবনের সত্যিকারের পথ খুঁজে পাবে। অপর্ণা বুঝতে পারল যে, তার মায়ের ভালোবাসা সত্ত্বেও, তাকে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এবং সেই সিদ্ধান্তই তার জীবনের নতুন সূচনা হতে চলেছে।

WhatsApp-Image-2025-07-05-at-2.41.51-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *