ইরা মুখার্জি
পর্ব – ১
উত্তর কলকাতার পুরোনো একতলা-বাড়িগুলোর গায়ে সময়ের দাগ খুব স্পষ্ট। ঝাপসা রঙের দেওয়ালে শ্যাওলার ছোপ, টিনের ছাদের নীচে শালিকদের বাসা, আর লোহার গেটের খোঁচা খাওয়া রঙ ম্লান হয়ে আছে বহুদিন। সেই রকমই এক বাড়ি, রায়বাড়ি—যার বারান্দায় বিকেলবেলা বাতাস অন্যরকম লাগে। এখানে প্রতিদিন বসে পড়েন অমলবাবু, সদ্য অবসর নেওয়া এক স্কুলশিক্ষক। হাতে এক কাপ চা আর সামনে পত্রিকা, যদিও অক্ষরের ভেতর ডুবে থাকার বয়স তার অনেক আগেই ফুরিয়েছে। চায়ের ধোঁয়া আর নিস্তব্ধতার ভেতর তিনি শুনতে পান আশেপাশের বাচ্চাদের চিৎকার, রাস্তায় সব্জিওয়ালার হাঁকডাক, আর মাঝে মাঝে হাওয়ার ঝাপটায় শিউলির গন্ধ।
অমলবাবুর বারান্দার একপাশ থেকে হঠাৎ চোখে পড়তে শুরু করল অপর এক বারান্দা। পাশের ভাড়া-বাড়ির ওপরে ছোট্ট রেলিঙ-ঘেরা কোণায় প্রায় প্রতিদিন বিকেলে এসে দাঁড়ায় এক তরুণী। পরনে সুতির জামা, হাতে অজস্র আঁকিবুঁকি ভরা খাতা। সে-খাতায় আঁকে, কখনও লিখে, কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে কিছু বলে যায়। মেয়েটির বয়স খুব বেশি হলে বাইশ-তেইশ। কলেজছাত্রী—এমন ধারণা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
প্রথম কদিন অমলবাবু তেমন খেয়াল করেননি। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন, মেয়েটি শুধু দাঁড়িয়ে থাকে না, মাঝে মাঝে বারান্দা পেরিয়ে তার বাড়ির দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিও ফেলে। একদিন চোখাচোখি হয়ে গেল। মেয়েটি বিন্দুমাত্র সংকোচ না করে মৃদু হাসল। অমলবাবুর মনে হলো, অনেক বছর বাদে তিনি যেন নতুন করে কারও অভিবাদন পেলেন।
সেই হাসিটাই অদ্ভুতভাবে গেঁথে গেল তাঁর দিনের ভেতর। বয়সের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি নিজের মনে প্রশ্ন করতে লাগলেন—এটা কেবল ভদ্রতা, না কি অন্য কোনো সঙ্কেত?
পরেরদিন আবার একই সময়ে মেয়েটি বারান্দায় এল। হাতে রঙতুলি। সে বসে কাগজে রঙ মাখতে শুরু করল। অমলবাবু চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎই খেয়াল করলেন, আঁকায় যেন তাঁর বারান্দার এক কোণ ভেসে উঠছে। ধীরে ধীরে তিনি বুঝলেন—মেয়েটি তার বারান্দাকে আঁকছে।
সন্ধ্যা নামল, আলো-আঁধারি ছড়িয়ে পড়ল গলিতে। অমলবাবুর বুকের ভেতর এক অদ্ভুত কৌতূহল জেগে উঠল। তিনি কি এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির নাম জেনে নিতে পারেন? নাকি দূরত্বই ভালো? সমাজ, প্রতিবেশী—সবকিছু মিলিয়ে প্রশ্নের ভার যেন আরও ঘনীভূত হতে লাগল।
কিন্তু তার পরেরদিন অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটল। বৃষ্টির ভিজে সন্ধ্যায় মেয়েটি ছাতা হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়েই বলল, “আপনি অমলবাবু তো? আমার নাম নন্দিনী।”
অমলবাবু হকচকিয়ে গেলেন। তিনি কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই নন্দিনীর চোখে ঝলসে উঠল এক নির্ভীক উজ্জ্বলতা—যেন এই অচেনা বারান্দাগুলো হঠাৎ করেই একে অপরকে চিনে ফেলেছে।
পর্ব – ২
অমলবাবু প্রথমে কিছু বলতেই পারলেন না। বয়সের ব্যবধান, অভিজ্ঞতার ভিন্নতা—সব মিলিয়ে তাঁর ভেতরে যে দেয়াল তৈরি হয়েছিল, সেটি যেন এক নিমিষে ভেঙে দিল নন্দিনীর ডাকে। তিনি শুধু হালকা মাথা নেড়ে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, আমি-ই অমল। তুমি তো পাশের বাড়িতে থাকো, তাই না?”
নন্দিনী হাসল, তার দাঁতের ফাঁক দিয়ে অল্প আলো বেরিয়ে আসার মতো ঝলকানি। “হ্যাঁ, আমি এখানে নতুন এসেছি। আর্ট কলেজে পড়ি। আপনি তো আমাদের স্কুলের পুরোনো শিক্ষক ছিলেন, অনেকে বলেছে। তাই ভেবেছিলাম চেনাই যাক।”
অমলবাবু মৃদু বিস্ময়ে তাকালেন। যে নাম তিনি বহু বছর ধরে শুনে এসেছেন—‘শিক্ষক অমল সেন’—সেই পরিচয় কেউ এত সহজভাবে আবার স্মরণ করিয়ে দিল। অবসরের পর থেকে তিনি নিজেকে যেন ভুলে গিয়েছিলেন। আজ সেই স্মৃতিটাই হঠাৎ নতুন রঙে ভেসে উঠল।
“তুমি আঁকছো তাই না? আমি দেখেছি কয়েকবার।” অমলবাবু সাবধানে বললেন।
“হ্যাঁ,” নন্দিনী খাতাটা দেখাল। কাগজে বারান্দার রেলিঙ, চায়ের কাপের ভেতর থেকে ওঠা ধোঁয়া, আর পত্রিকার ছাপা অক্ষর অদ্ভুতভাবে ফুটে উঠেছে। “আপনার বারান্দা আমার খুব ভালো লাগে। এত নীরব, অথচ এত গল্প জমে আছে মনে হয়।”
অমলবাবু অস্বস্তিতে হেসে ফেললেন। তাঁর সারা জীবনের নিস্তব্ধতাকে কেউ প্রথমবার এত সুন্দরভাবে চিনল। তিনি ভাবলেন, এই মেয়ে বয়সে ছোট হলেও তার চোখে দুনিয়াকে দেখার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।
সন্ধ্যার আলো ঘন হয়ে এল। পাড়ার আলো-আঁধারি নেমে এলো গলির মধ্যে। দূরে সব্জিওয়ালা হাঁকডাক করছে, কারও জানলার ফাঁক দিয়ে বাজছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। নন্দিনী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, যেন কথা শেষ হয়নি। তারপর হঠাৎ বলল, “আপনি একদিন আসবেন আমার আঁকা দেখতে? আমি তো সব আপনার বারান্দার গল্প আঁকি।”
অমলবাবু থমকে গেলেন। তিনি জানেন, তার এই বয়সে প্রতিবেশীর বারান্দা পেরোনো নিয়ে অনেক কথা উঠতে পারে। কিন্তু ভিতরের কৌতূহল তাঁকে নীরবে কুরে খেতে লাগল। তিনি ধীরে বললেন, “দেখা যাক, একদিন।”
পরের কদিন অদ্ভুত পরিবর্তন হলো। অমলবাবুর বারান্দা যেন প্রাণ ফিরে পেল। প্রতিদিনই তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন নন্দিনী আসবে, কখন সে হাসি দিয়ে তাকাবে। চায়ের ধোঁয়া যেন আর একলা ধোঁয়া নয়—তার ভেতরে এখন কোনো এক অচেনা তরুণীর নিঃশ্বাস মিশে আছে।
তবে অমলবাবুর ভেতরে ভয়ও জন্ম নিচ্ছিল। এই বন্ধুত্ব কি সমাজ মেনে নেবে? নাকি তাঁর নিঃসঙ্গতার ভেতর লুকিয়ে থাকা আকাঙ্ক্ষাকে একদিন কেউ ‘অপরাধ’ বলে চিহ্নিত করবে?
একদিন বিকেলে নন্দিনী নিজের খাতা উল্টে অমলবাবুকে দেখাল। ছবিতে তিনি নিজেই আঁকা—একটু ক্লান্ত, একটু নিঃসঙ্গ, তবু চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। অমলবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি কি সত্যিই এমন?”
নন্দিনী দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল, “হ্যাঁ। আপনি এমনই—আর এই সত্যিটাই আমি ধরতে চাই।”
সেদিন অমলবাবুর বুকের মধ্যে অজানা এক আলো জ্বলে উঠল। যেন তিনি আবার নতুন করে বেঁচে উঠছেন।
পর্ব – ৩
নন্দিনীর ছবিতে নিজেকে দেখে অমলবাবুর মনে হলো, আয়নার ভেতরেও তিনি এতটা স্পষ্ট করে নিজেকে কখনও খুঁজে পাননি। মেয়েটির আঁকায় তাঁর বয়স, নিঃসঙ্গতা, অথচ একটুকরো জেদী দীপ্তি সবটা যেন মিলে মিশে আছে।
সেই রাতটা অমলবাবুর ঘুম আসেনি। বিছানায় শুয়ে তিনি বারবার ছবিটার কথা ভেবেছেন। কত বছর ধরে তিনি শুধু নিয়মের ভেতর দিয়ে বেঁচে ছিলেন—স্কুল, পড়ানো, সংসার, তারপর অবসর। স্ত্রী অনেক আগেই চলে গেছেন, ছেলেমেয়েরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত। নিঃসঙ্গতা যেন এক অদৃশ্য জাল হয়ে তাঁকে ঘিরে ফেলেছিল। আর হঠাৎ এই তরুণীর উপস্থিতি সেই জাল ছিঁড়ে দিল।
পরদিন বিকেলে বারান্দায় এসে তিনি নিজেকে নতুন করে প্রস্তুত পেলেন। হাতে চায়ের কাপ, কিন্তু চোখ বারবার চলে যাচ্ছে পাশের বাড়ির দিকে। কিছুক্ষণ পরেই নন্দিনী হাজির হলো। সুতির পাঞ্জাবি, খোলা চুল, হাতে খাতা।
“আজ আপনি একেবারেই অন্যরকম লাগছেন, অমলবাবু,” নন্দিনী হেসে বলল।
“কেন, সেটা কি খারাপ?”
“না, বরং খুব ভালো। আপনার চোখে আজ আলো আছে। হয়তো আমার ছবিটা দেখে?”
অমলবাবু হেসে মাথা নেড়ে দিলেন। “তুমি বেশ স্পষ্টভাষী।”
“শিল্পীরা তো এমনই হয়। আড়ালে কিছু বলতে জানি না।”
সেই মুহূর্তে অমলবাবুর মনে হলো, এই মেয়েটি কেবল ছবি আঁকে না, সে মানুষকেও নতুন করে দেখতে শেখায়। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল—যদি নন্দিনী না থাকত, তবে কি তিনি এই বয়সে আবার এমন আলো খুঁজে পেতেন?
বিকেল গড়ালে হাওয়ায় শিউলির গন্ধ ভেসে এল। নন্দিনী হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলল, “আপনি জানেন, আমার বাবা-মা কেউ নেই। ছোটবেলা থেকেই মামার কাছে বড় হয়েছি। মামার সংসারে আমার জায়গা ছিল না। তাই আমি আঁকায় ডুবে থাকি। এখনো এখানে ভাড়া থাকি এক বন্ধুর সঙ্গে। সংসারের কোনো বাঁধন নেই।”
অমলবাবু চুপ করে শুনলেন। এই মেয়েটির হাসির আড়ালে এমন এক শূন্যতা লুকিয়ে আছে, যা হয়তো তাঁর নিজের নিঃসঙ্গতার সমান গভীর। দুজনের চোখ মিলল, আর সেই নীরবতায় যেন এক অদৃশ্য সেতু গড়ে উঠল।
হঠাৎ গলির মোড় থেকে কারও কণ্ঠ ভেসে এল, “নন্দিনী! তুই এখানে?” নন্দিনী চমকে উঠল। এক লম্বা ছেলেকে দেখা গেল রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। হাতে স্কেচবুক, মুখে অচেনা তাচ্ছিল্যের ছায়া।
নন্দিনী সংক্ষেপে বলল, “আমার কলেজের বন্ধু। নাম সৌরভ।”
অমলবাবুর বুকের ভেতর হালকা ব্যথার মতো কিছু বিঁধল। যেন হঠাৎ তিনি বুঝতে পারলেন, এই গল্পে কেবল তিনি আর নন্দিনী নেই—অন্য কারও উপস্থিতিও ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছে।
পর্ব – ৪
সৌরভের হঠাৎ উপস্থিতিতে বারান্দার হাওয়া ভারী হয়ে উঠল। ছেলেটি গলির নিচ থেকে অমলবাবুর দিকে তাকিয়ে হালকা কৌতুকের ভঙ্গিতে বলল, “আপনিই অমলবাবু? নন্দিনী অনেক বলেছে আপনার কথা। বারান্দার গল্প, চায়ের কাপ, সবই নাকি আপনার কৃতিত্ব।”
অমলবাবু হকচকিয়ে গেলেন। বয়সের কারণে হয়তো নয়, বরং এই অচেনা তরুণের দৃষ্টিতে যে একধরনের দখলদারিত্ব আছে, সেটাই তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলল। নন্দিনী তাড়াতাড়ি নীচে নেমে গেল, আর তারা দুজন একসঙ্গে গলি ধরে চলে গেল।
বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে অমলবাবুর মনে হলো, তাঁর জীবনে নতুন করে যে আলো জ্বলতে শুরু করেছিল, সেটা হঠাৎ নিভে গেল। যেন বুঝলেন, নন্দিনীর জগতে তাঁর কোনো জায়গা নেই। তিনি কেবল এক নিঃসঙ্গ মানুষ, যে অন্যের গল্পে একটু সময়ের জন্য জায়গা পায়।
তবে সন্ধ্যার দিকে অবাক করে দিয়ে নন্দিনী আবার এসে দাঁড়াল। মুখে ক্লান্তি, চোখে অদ্ভুত অস্থিরতা।
“আপনি ভাবছেন নিশ্চয়ই আমি ওর সঙ্গে—” নন্দিনী নিজেই থেমে গেল।
অমলবাবু চুপচাপ চা টানছিলেন। তিনি বললেন, “আমি কিছু ভাবছি না। তোমাদের বয়স, তোমাদের বন্ধুত্ব—সবটাই স্বাভাবিক।”
নন্দিনী হঠাৎ চুপ করে তাকাল তাঁর দিকে। “না, ব্যাপারটা তেমন নয়। সৌরভ আমার বন্ধু বটে, কিন্তু ও আমার আঁকাকে কখনো বোঝে না। সবসময় সমালোচনা করে। আপনিই বরং একমাত্র মানুষ, যিনি আমার ছবির ভেতর সত্যিটা খুঁজে পান।”
অমলবাবুর বুকের ভেতর যেন হালকা একটা কাঁপুনি উঠল। তিনি জানেন, এই কথাগুলো তাঁর বয়স, সমাজ—সবকিছুর সঙ্গে মেলে না। কিন্তু তবুও তিনি অনুভব করলেন, জীবনের এই সায়াহ্নে নন্দিনী তাঁকে এমন এক স্বীকৃতি দিয়েছে, যা তাঁর দীর্ঘ শিক্ষকজীবনেও কেউ দেয়নি।
“তুমি অনেক বড় শিল্পী হবে, নন্দিনী,” তিনি ধীরে বললেন। “কিন্তু একটা কথা মনে রেখো—শিল্পের ভেতরে কখনো অহংকার ঢুকতে দেবে না। আর জীবনে কাউকে ভুল বোঝাতে দিও না।”
নন্দিনী মাথা নেড়ে বলল, “জানি। কিন্তু একটা কথা বলি, অমলবাবু? আপনি থাকলে আমার একা লাগেনা। এই বারান্দাটাই যেন আমার নিজের জায়গা।”
অমলবাবুর হাতে থাকা কাপটা কেঁপে উঠল। শব্দটা ছোট হলেও তাঁর মনে রণন তুলল। কত বছর পর কেউ তাঁকে এভাবে নিজের জায়গা বলল!
তবে এই অদ্ভুত বন্ধুত্বের ভেতরেই এক ভয়ও ঘনিয়ে আসছিল। পাড়ার মানুষ ইতিমধ্যেই ফিসফিস শুরু করেছে। অমলবাবু জানেন, সমাজের চোখ কখনও সরল সম্পর্ক বোঝে না।
আর সেদিন রাতেই দরজার ফাঁক দিয়ে তিনি শুনলেন পাশের বাড়ির এক মহিলার গলা—
“ওই মেয়েটা রোজ ওই বুড়োর বারান্দায় দাঁড়ায় কেন রে? নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে।”
অমলবাবুর বুকের ভেতর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল।
পর্ব – ৫
সেই রাতটা অমলবাবু একটুও ঘুমোতে পারলেন না। বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে একদিকে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন, আরেকদিকে গলির নিস্তব্ধতা শুনলেন। সমাজের এই ফিসফিসানি যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ার আগেই তাঁর দিনগুলোকে অস্বস্তিতে ভরিয়ে দিল। এত বছর তিনি এক নিখুঁত জীবন কাটিয়েছেন—শিক্ষক হিসেবে সুনাম, ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসা, প্রতিবেশীদের শ্রদ্ধা। এখন বয়সের শেষপ্রান্তে এসে কেন তাঁর উপর এমন আঙুল উঠছে?
ভোরবেলা উঠে দেখলেন, মনের ক্লান্তি শরীরে ছাপ ফেলেছে। পত্রিকার অক্ষর যেন চোখের সামনে নেচে বেড়াচ্ছে। তিনি নিজেকে বোঝাতে লাগলেন—এটা কেবলই এক বন্ধুত্ব, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু সমাজ কি এভাবে বুঝবে?
বিকেলবেলা স্বাভাবিক নিয়মে নন্দিনী এসে দাঁড়াল বারান্দায়। চুল খোলা, হাতে তুলি আর রঙ। যেন কিছু হয়নি। সে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “অমলবাবু, আজ একটা নতুন ছবি শুরু করেছি। চাইলে আপনি এসে দেখুন।”
অমলবাবু হালকা দ্বিধায় বললেন, “আজ নয়, নন্দিনী। আমার শরীরটা খুব ভালো লাগছে না।”
নন্দিনী ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “আপনি কি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন?”
অমলবাবু চমকে উঠলেন। মেয়েটি এত সহজেই তাঁর মনের ভেতরের সত্যিটা ধরে ফেলল! তিনি জোর করে হেসে বললেন, “না রে, শরীরটাই কেমন করছে। বয়স তো আর কম হলো না।”
নন্দিনী নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “আপনি জানেন, ছোটবেলা থেকে আমি কারও সঙ্গে এমন করে কথা বলিনি। এখানে আসার পর থেকে মনে হয় এই বারান্দা আমাকে একটা ঘর দিয়েছে। আপনার সঙ্গটা ছাড়া আমি বাঁচব না।”
অমলবাবুর বুক ভারী হয়ে উঠল। তিনি একদৃষ্টে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেখানে একটুও ভণিতা নেই, কেবল গভীর সত্যি। অথচ এই সত্যিই তাঁর সবচেয়ে বড় বিপদ।
গলির মোড়ে হঠাৎ আবার দেখা দিল সৌরভ। এ বার তার চোখে সরাসরি অভিযোগ। “নন্দিনী, তুই আবার এখানে? সবাই তো পাড়ায় কথা বলছে। এটা কি ঠিক হচ্ছে?”
নন্দিনী ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল, “সৌরভ, তুমি বুঝবে না। শিল্পের সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, সেটা সমাজের নিয়মে বাঁধা যায় না।”
অমলবাবুর গলা শুকিয়ে এলো। তাঁর মনে হলো, বয়সের সীমা আর সমাজের বাঁধন মিলেমিশে তাঁকে একটা দুঃসহ পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়েছে।
সেদিন রাতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—যদি এই সম্পর্ক তাঁকে হেয় করে, তবে হয়তো একদিন তাঁকেই সরে যেতে হবে। কিন্তু নন্দিনীর চোখে যে বিশ্বাস তিনি দেখেছেন, সেটা ভেঙে দেওয়ার সাহসও তাঁর নেই।
বারান্দার বাতাসে সেই রাতে এক অদ্ভুত ভার জমে রইল—যেন সময় নিজেই ঠিক করে দেবে, এ সম্পর্ক বন্ধুত্বের সীমানা ছাড়িয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
পর্ব – ৬
পরের কয়েকদিন বারান্দার হাওয়া যেন কেমন ভারী হয়ে থাকল। অমলবাবু নিজের রুটিনে কঠোর হতে চেষ্টা করলেন—সকালে বাজার, দুপুরে বই পড়া, বিকেলে চা—কিন্তু তবুও দৃষ্টি বারবার সরে গেল পাশের বারান্দায়। নন্দিনী এলো, দাঁড়াল, আঁকল, কথা বলল, কিন্তু অমলবাবুর ভেতরে দ্বিধা ক্রমশ গাঢ় হতে লাগল।
এক বিকেলে নন্দিনী হঠাৎ বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে বলল, “আপনি জানেন, ছোটবেলায় আমি সবসময় ভাবতাম একটা গাছের সঙ্গে কথা বলব। ও বুঝবে আমার দুঃখ-সুখ। কিন্তু আজ মনে হয় সেই গাছটা আপনি। আমি আপনাকে আমার সব বলতে পারি।”
অমলবাবুর বুক কেঁপে উঠল। তিনি চুপ করে ছিলেন, যেন কোনো শব্দ বেরোলে সম্পর্কটা ভেঙে পড়বে।
ঠিক তখনই গলির মোড় থেকে আবার ভেসে এল সৌরভের গলা।
“নন্দিনী, কলেজে সবাই কথা বলছে। তুই প্রতিদিন ওই অমলবাবুর সঙ্গে কেন দাঁড়িয়ে থাকিস? লোকজন তো খারাপই ভাববে।”
নন্দিনী তিরিক্ষি হয়ে উত্তর দিল, “মানুষের চিন্তাধারা যদি এত ছোট হয়, তাহলে আমি কি করব? ও আমার বন্ধু। এর মধ্যে খারাপ কিছু নেই।”
সৌরভ কটমট করে তাকাল। তারপর অমলবাবুর দিকে চোখ ঘুরিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, “অমলবাবু, আপনি তো শিক্ষক ছিলেন। অন্তত আপনাকেই উচিত এই মেয়েটাকে বুঝিয়ে দেওয়া।”
এই এক মুহূর্তে অমলবাবুর গলা শুকিয়ে গেল। তিনি বলতে চাইলেন, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। নন্দিনী তড়িঘড়ি নেমে গিয়ে সৌরভকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
সেদিন রাতে অমলবাবুর ঘুম ভাঙল বৃষ্টির শব্দে। ভিজে অন্ধকারে মনে হলো, তাঁর সমস্ত সযত্নে গড়া জীবনভবন কেঁপে উঠছে। তিনি জানেন, সমাজ তাকে কেবল দোষী হিসেবেই দেখবে—কেউ বুঝবে না তাঁর নিঃসঙ্গতা, তাঁর স্নেহ, তাঁর আকস্মিক আলো খোঁজা।
পরেরদিন সকালে পাড়ার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে তিনি শুনলেন দু’জন লোক বলছে,
“ওই মেয়েটা রোজ ওই বুড়োর সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু একটা তো আছে।”
“আরে থাক, এই বয়সে এসব লজ্জার কথা!”
অমলবাবু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলেন। হাতে খবরের কাগজ কাঁপছিল।
সন্ধেবেলায় নন্দিনী এল আগের মতোই। তার মুখে খেয়াল করলেন একরাশ জেদ। “অমলবাবু, আপনি কিছু শুনছেন না তো? আমি জানি, পাড়ায় অনেক কথা হচ্ছে।”
অমলবাবু নিচু গলায় বললেন, “শুনছি। আর তাই ভয়ও পাচ্ছি।”
নন্দিনী দৃঢ় স্বরে বলল, “ভয় পাবেন না। আমি চাই না আপনি সরে যান। আমি চাই এই বারান্দাটা যেন আমাদের বারান্দা হয়ে থাকে।”
অমলবাবুর চোখ জলে ভরে গেল। তিনি বুঝলেন, লড়াইটা এখন আর কেবল সমাজের সঙ্গে নয়—নিজের ভেতরকার দ্বিধার সঙ্গেও।
পর্ব – ৭
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু পাড়ার ফিসফিসানি ক্রমেই জোরাল হচ্ছিল। অমলবাবু যতই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চান, ততই যেন নন্দিনীর টান তাঁকে কাছে টেনে নেয়। তাঁর ভেতরে প্রতিদিন এক দ্বন্দ্ব চলতে লাগল—একদিকে স্নেহমাখা বন্ধুত্ব, অন্যদিকে সমাজের অবিশ্বাস।
এক সন্ধ্যায় নন্দিনী হঠাৎ বারান্দায় এসে বলল, “আপনি জানেন, আজ ক্লাসে আমি একটা ছবি এঁকেছিলাম। শিক্ষক বললেন, ছবিটার ভেতরে এক ধরনের অচেনা আলো আছে। আমি জানি, সেই আলোটা এসেছে আপনার থেকে।”
অমলবাবু হতচকিত হয়ে তাকালেন। বয়সের ভারে ক্লান্ত শরীর, মুখে কুঁচকানো দাগ—এ সবের ভেতরে কোনো আলো থাকতে পারে ভেবেই তিনি এতদিন বেঁচে ছিলেন না। তবু নন্দিনীর কথাগুলো যেন তাঁর বুকের মধ্যে নতুন করে প্রাণ জাগিয়ে দিল।
“নন্দিনী,” তিনি ধীরে বললেন, “আমি ভয় পাচ্ছি। তোমার বয়স, তোমার ভবিষ্যৎ—সবটাই সামনে পড়ে আছে। আমি তো শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি।”
নন্দিনী মাথা নেড়ে বলল, “আপনি যা ভাবছেন, তা আমি ভাবছি না। আমি শুধু জানি, আপনার সঙ্গ ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”
ঠিক তখনই গলির মোড় থেকে আবার দেখা দিল সৌরভ। এ বার আর তার চোখে কৌতুক নেই—রাগ আর বিদ্রূপ মেশানো আগুন।
“নন্দিনী, তুই কি বুঝতে পারছিস না, পাড়ায় কী হচ্ছে? কাল কলেজে আমাদের শিক্ষকও ইঙ্গিত করলেন। এই সম্পর্ক মানে কেবল কলঙ্ক।”
নন্দিনী ঝড়ের মতো গর্জে উঠল, “শিল্প আর স্নেহকে কলঙ্ক বলা যায় না, সৌরভ! তুমি বোঝো না বলেই সবকিছু ভুল মনে হয় তোমার কাছে।”
সৌরভ এবার সরাসরি অমলবাবুর দিকে তাকাল। “অমলবাবু, আপনি শিক্ষক ছিলেন। অন্তত আপনি বলুন, এ সব কি ঠিক হচ্ছে?”
অমলবাবু অনুভব করলেন, যেন তাঁকে এক অদৃশ্য আদালতে দাঁড় করানো হয়েছে। সমস্ত প্রতিবেশী, সমাজ, এমনকি তাঁর নিজের অতীতও যেন বিচারকের আসনে বসে গেছে। ঠোঁট শুকিয়ে গেল, কিন্তু তিনি কোনো কথা বললেন না।
নন্দিনী এক ঝটকায় সৌরভকে এড়িয়ে ফিরে এল তাঁর বারান্দায়। মুখে লাল হয়ে ওঠা জেদ, চোখে অশ্রুর ঝিলিক।
“অমলবাবু, একদিন সবাই বুঝবে। এই সম্পর্ককে সমাজ যেমন দেখে, সেটা আমাদের সত্যি নয়। আমি জানি, আপনি ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু আমি ভয় পাই না।”
অমলবাবুর বুক কেঁপে উঠল। তিনি বুঝলেন, এই মেয়েটির সাহস তাঁর থেকেও অনেক বেশি। অথচ তিনিই বারবার পিছিয়ে যাচ্ছেন।
রাতের দিকে আকাশ ভিজে উঠল হালকা বৃষ্টিতে। অমলবাবু বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবলেন—এই সম্পর্ক কি সত্যিই কেবল বন্ধুত্ব, নাকি নিঃসঙ্গতার অতলে জন্ম নেওয়া অন্য কোনো নামহীন টান?
পর্ব – ৮
বৃষ্টির পরদিন সকালটা যেন অদ্ভুত শান্ত ছিল। গলির ধুলো ধুয়ে গিয়েছিল, জানলার পাশে ভিজে শিউলি ছড়িয়ে পড়েছিল সাদা গালিচার মতো। অমলবাবু ভেবেছিলেন নন্দিনী হয়তো আজ আর আসবে না, সমাজের চাপ তাকে দূরে ঠেলে দেবে। কিন্তু বিকেলের দিকে বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে যখন তিনি চা খাচ্ছিলেন, তখনই নন্দিনী এল, হাতে নতুন ক্যানভাস।
“আজ একটা অন্যরকম ছবি শুরু করেছি,” সে বলল, চোখে একরাশ দীপ্তি।
অমলবাবু চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন।
নন্দিনী ক্যানভাস ঘুরিয়ে ধরল। আঁকায় দেখা যাচ্ছে—দু’টি বারান্দা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, মাঝখানে এক অদৃশ্য সেতু জুড়ে দেওয়া। সেতুর ওপারে দু’টি ছায়ামূর্তি—একজন বয়স্ক, অন্যজন তরুণী।
অমলবাবুর বুক হালকা কেঁপে উঠল। “তুমি কি নিশ্চিত, এ ছবিটা মানুষ মেনে নেবে?”
নন্দিনী হাসল। “শিল্প মানুষের মেনে নেওয়ার জন্য হয় না, অমলবাবু। শিল্প নিজের সত্যি বলার জন্য হয়।”
এই দৃঢ় উচ্চারণ শুনে অমলবাবুর মনে হলো, তিনি যেন আবার শিক্ষকজীবনের ক্লাসরুমে ফিরে গেছেন। তবে এ বার তিনি ছাত্র, আর নন্দিনী শিক্ষক।
ঠিক তখনই পাশের বাড়ির ছাদ থেকে কয়েকজন মহিলা উঁকি দিয়ে হাসাহাসি করল। কানে এলো চাপা গুঞ্জন—
“দেখছিস তো, আজ আবার ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”
“এই মেয়েটার কোনো লজ্জা নেই।”
অমলবাবুর চোখ নামিয়ে গেল। কিন্তু নন্দিনী দমে গেল না। সে ঠান্ডা গলায় বলল, “ওরা হাসুক। যতক্ষণ আপনি আমার পাশে আছেন, আমি ভয় পাই না।”
সন্ধ্যা নামার পর হঠাৎই দরজায় টোকার শব্দ এল। অমলবাবু দরজা খুলতেই দেখলেন সৌরভ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কঠিন ভঙ্গি।
“অমলবাবু, আমি আজ সরাসরি বলতে এসেছি। আপনি নন্দিনীকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছেন। সমাজে এই সম্পর্কের কোনো মানে নেই। দয়া করে থামুন।”
অমলবাবু অবাক হয়ে বললেন, “আমি? আমি তো কেবল একজন একলা মানুষ। নন্দিনী এসেছে, কথা বলেছে—এর ভেতর আমি কোনো দোষ খুঁজে পাইনি।”
সৌরভ গলা চড়াল, “দোষ আছে, অমলবাবু। আপনার বয়স, আপনার অবস্থান—সব কিছু মিলিয়ে এটা অস্বাভাবিক। আমি নন্দিনীকে হারাতে চাই না।”
অমলবাবুর বুক কেঁপে উঠল। তিনি বুঝলেন, বিষয়টা এখন আর কেবল সমাজের নয়, নন্দিনীর জীবনেরও মোড় ঘোরানো মুহূর্ত।
সেদিন রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন—
“আমি কি সত্যিই তাকে আঁধার থেকে আলোয় আনছি, নাকি আলো থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি অন্ধকারে?”
পর্ব – ৯
সেদিন রাতটা অমলবাবুর কাছে দীর্ঘ হয়ে উঠল। নিজের ঘরের অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে তিনি ভেবেই চললেন—সৌরভের কথা কি সত্যিই ভুল নয়? হয়তো তিনি এক তরুণীর জীবনে এমন এক ছায়া ফেলছেন, যা সমাজ কোনোদিন মেনে নেবে না। অথচ হৃদয়ের গভীরে তিনি জানেন, নন্দিনীর উপস্থিতি ছাড়া তাঁর দিনগুলো এখন আর চলেই না।
পরদিন বিকেলবেলা নন্দিনী এল আগের মতোই, তবে মুখে একরাশ ক্লান্তি। হাতে ক্যানভাস থাকলেও তাতে কোনো ছবি নেই। সে নিঃশব্দে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল, যেন কথা বলার শক্তিও নেই।
অমলবাবু ধীরে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে, নন্দিনী?”
নন্দিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আজ কলেজে সবাই আমার দিকে আঙুল তুলেছে। বলেছে আমি নাকি আমার থেকে অনেক বড় এক মানুষের সঙ্গে অস্বাভাবিক সম্পর্ক করছি। আমি প্রথমে প্রতিবাদ করেছিলাম, কিন্তু শেষে আর পারলাম না।”
অমলবাবুর বুক ভারী হয়ে উঠল। তিনি ঠান্ডা গলায় বললেন, “দেখো, আমি চাই না তোমার জীবনে কোনো কলঙ্ক লাগুক। চাইলে তুমি আমাকে এড়িয়ে যেতে পারো।”
নন্দিনী চোখ তুলে তাকাল। চোখে অশ্রু ঝলমল করছে, তবু গলায় অদ্ভুত দৃঢ়তা। “না, আমি চাই না আপনি সরে যান। আপনি জানেন না, আপনার উপস্থিতি আমার আঁকাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি যদি সমাজের ভয়েই আপনাকে হারাই, তবে আমার শিল্পও মরে যাবে।”
ঠিক তখনই নিচ থেকে সৌরভের কণ্ঠ ভেসে এল, ক্ষুব্ধ আর ব্যঙ্গমিশ্রিত—
“দেখছি, আজও তোমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো। নন্দিনী, একদিন বুঝবি, এ কেবল এক ভ্রম।”
নন্দিনী রেলিঙে ভর দিয়ে চিৎকার করে উত্তর দিল, “না সৌরভ, ভ্রম নয়। আমি আমার সত্যিটা খুঁজে পেয়েছি।”
অমলবাবুর বুকের ভেতর ঝড় বয়ে গেল। তিনি জানেন, এই উচ্চারণ সমাজে একপ্রকার ঘোষণা। এখন আর গোপন কিছু রইল না। পাড়ার লোকজন আরও ফিসফিস করবে, আরও আঙুল তুলবে।
কিন্তু সেই মুহূর্তে নন্দিনীর হাত তাঁর বারান্দার রেলিঙে এসে ছুঁল। অমলবাবু অনুভব করলেন, এত বছরের শূন্যতা যেন ভরে উঠল।
রাত নামল ধীরে ধীরে। গলির আলোয় নন্দিনীর মুখ অদ্ভুত দীপ্তিতে জ্বলছিল। সে বলল, “অমলবাবু, আগামীকাল আমি আমার নতুন প্রদর্শনীর ছবি আঁকতে শুরু করব। আর এই প্রদর্শনীর নাম দেব—‘অপরিচিত বারান্দা’। জানেন কেন? কারণ এই বারান্দাই আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।”
অমলবাবু কোনো কথা বলতে পারলেন না। তাঁর চোখে কেবল অশ্রু জমল, আর মনে হলো—সমস্ত দ্বিধা, ভয়, সমাজের বাঁধন মিলিয়ে এই মুহূর্তটা হয়ে উঠেছে জীবনের সবচেয়ে সত্যি স্বীকৃতি।
পর্ব – ১০
প্রদর্শনীর দিন ঘনিয়ে আসছিল। নন্দিনী প্রতিদিনই ক্যানভাসে রঙ মাখত, অমলবাবুর বারান্দার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি নীরবতা, প্রতিটি দৃষ্টি তার ছবিতে ধরা পড়ছিল। ছবিগুলো ক্রমশ যেন কেবল বারান্দার চিত্র নয়—অমলবাবু আর নন্দিনীর অদৃশ্য সম্পর্কের দলিল হয়ে উঠছিল।
অমলবাবু ভিতরে ভিতরে অস্থির ছিলেন। একদিকে ভয়—প্রদর্শনীতে যখন ছবিগুলো মানুষ দেখবে, তখন কি আরও আঙুল উঠবে না? অন্যদিকে অদ্ভুত এক গর্ব—তিনি জানতেন, এই ছবির ভেতরে তাঁর একাকী জীবনের অচেনা আলো ধরা পড়েছে।
প্রদর্শনীর দিন এলো। কলেজের বড় হলঘরে সারি সারি ক্যানভাস সাজানো। প্রথম ছবিতে দেখা গেল—এক নিঃসঙ্গ মানুষ চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে এক অচেনা শূন্যতা। দ্বিতীয় ছবিতে দেখা গেল—এক তরুণী তার বারান্দা থেকে সেই মানুষটিকে আঁকছে। তৃতীয় ছবিতে দুটো বারান্দা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, মাঝখানে অদৃশ্য সেতু।
মানুষ ভিড় জমাল। কেউ বলল, “অদ্ভুত গভীর ছবি।” কেউ বলল, “কিন্তু বারান্দার ওই মানুষটা কে?”
সৌরভও ছিল, তার চোখে এখনো রাগ, কিন্তু অদ্ভুত এক পরাজয়ও মিলেমিশে গেছে।
অমলবাবু চুপচাপ পেছনে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন। হঠাৎ এক বৃদ্ধা এগিয়ে এসে বললেন, “ছবিগুলোতে এমন এক নিঃসঙ্গতা ধরা পড়েছে, যা কেবল সত্যি হলে আঁকা যায়।”
অমলবাবুর বুক ভরে উঠল। হয়তো সমাজ এখনো সন্দেহ করবে, কিন্তু শিল্পের ভেতরে লুকোনো এই সত্যিটা আজ অনেকেই বুঝে ফেলেছে।
প্রদর্শনীর শেষে নন্দিনী অমলবাবুর কাছে এসে দাঁড়াল। চারদিকের ভিড় উপেক্ষা করে সে বলল, “অমলবাবু, আপনি জানেন আজকের প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় সাফল্য কী? আমি অবশেষে আমার জীবনের আলো খুঁজে পেয়েছি। আর সেটা আপনার কাছ থেকেই।”
অমলবাবুর চোখ ভিজে উঠল। তিনি নিচু গলায় বললেন, “নন্দিনী, আমি হয়তো তোমার সঙ্গে অনেক দূর যেতে পারব না। বয়স, সময়—সবই আমার সীমা। কিন্তু মনে রেখো, তোমার শিল্প যদি একদিন মানুষকে আলো দেখায়, তবে তাতে আমার এই বারান্দারও একটু অংশ থাকবে।”
সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে অমলবাবু বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। গলির বাতাসে শিউলির গন্ধ, দূরে ভেসে আসা রবীন্দ্রসঙ্গীত, আর আকাশের তারা যেন তাঁর জীবনের সব নিঃসঙ্গতা মুছে দিল। তিনি জানতেন, তাঁর দিন হয়তো শেষের দিকে, কিন্তু নন্দিনীর আঁকায় তিনি বেঁচে থাকবেন।
নন্দিনীর প্রদর্শনীর নাম হয়ে রইল—“অপরিচিত বারান্দা”।
আর সেই নামের ভেতরে চিরকালের মতো জড়িয়ে রইল দু’টি জীবনের নীরব অথচ গভীর বন্ধন।
সমাপ্ত
				
	

	


