Bangla - প্রেমের গল্প

অপরিচিতের কাছে আত্মসমর্পণ

Spread the love

অঙ্গনা বিশ্বাস


এক

ট্রেনের চাকার ঘর্ষণে তৈরি ছন্দময় শব্দ রাতের নীরবতাকে ভেঙে দিচ্ছিল, যেন এক অদ্ভুত সুর বাজছে চারপাশে। জানলার বাইরে অন্ধকারে ছুটে চলা গাছ, দূরের আলোছায়া মিশে যাচ্ছে দ্রুতগতির যাত্রায়। কেবিন ভরা নেই—কিছু যাত্রী অর্ধনিদ্রায়, কেউবা জানলার পাশে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। এর মাঝেই এক আসনে বসে থাকা এক যুবক—চোখে ক্লান্তির ছাপ, মুখে দিনের অবসাদ। কাজের ব্যস্ততা, জীবনের চাপ সব মিলিয়ে সে যেন নিজের ভেতরে ডুবে গেছে। তবুও, নিস্তব্ধতার মাঝে তার উপস্থিতি বোঝা যায়। সামনের আসনে বসে আছেন এক তরুণী—চোখ দুটো উজ্জ্বল, কৌতূহলী দৃষ্টি অন্ধকার ভেদ করছে। তার চাহনিতে আছে অনুচ্চারিত কিছু প্রশ্ন, আর মৃদু এক আকর্ষণ। প্রথমে দুজনেই অচেনা, কিন্তু সেই অচেনা ভাবটিই ধীরে ধীরে গলে যেতে শুরু করল। এক মুহূর্তে, যুবক মাথা তুলতেই তরুণীর চোখের সঙ্গে চোখ আটকে গেল—এবং যেন এক নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি বিনিময় হলো।

কথা শুরু হলো খুব সাধারণভাবে। “রাতের ট্রেন বেশ শান্ত, তাই না?”—তরুণীর মুখ থেকে বেরিয়ে আসা এই মন্তব্যে যুবক সামান্য অবাক হলেও ঠোঁটের কোণে টেনে আনল হালকা হাসি। উত্তর ছিল ছোট্ট, “হ্যাঁ, দিনের কোলাহলের থেকে আলাদা। অনেকটা নির্জন।” এই বিনিময় এতটাই সাধারণ যে মনে হতে পারে, এ নিয়ে বেশি কিছু ভাবার নেই। অথচ, এর মধ্যেই যেন লুকিয়ে ছিল অদ্ভুত এক টান। তারা দুজনেই বুঝতে পারছিল, কোনো অজানা শক্তি তাদের কথার সেতু তৈরি করছে। যুবক আর তরুণীর চোখে ভেসে উঠছিল একে অপরের প্রতি সামান্য কৌতূহল, সামান্য দ্বিধা। প্রথম পরিচয় হলেও তাদের মধ্যে তৈরি হলো এক অদ্ভুত শান্তি, যেন তারা একে অপরকে আগেই কোথাও চিনত। ট্রেনের আলো-অন্ধকার, জানলার বাইরে ছুটে চলা রাত, আর কেবিনের সুনসান পরিবেশ তাদের মধ্যে বাড়িয়ে তুলছিল এক অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতা।

যাত্রা চলছিল নিজের গতিতে, আর কথোপকথনের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছিল নীরবতারও এক সুর। অনেক সময় তারা কিছু বলছিল না, শুধু চুপচাপ একে অপরকে দেখছিল। এই নীরবতাই যেন অনেক বেশি অর্থপূর্ণ, অনেক বেশি গভীর। দুজনেই বুঝতে পারছিল, তারা একে অপরের ভেতর ঢুকে পড়ছে, অথচ কথায় তা প্রকাশ করছে না। যুবক অনুভব করছিল, অচেনা হলেও এই তরুণীর উপস্থিতি তাকে আশ্চর্যভাবে শান্ত করছে, আর তরুণীর মনে হচ্ছিল, এই অচেনা মানুষটির পাশে বসে থাকা যেন তার দীর্ঘদিনের একাকিত্বকে মুহূর্তে দূর করে দিয়েছে। রাতের ট্রেন, ছন্দময় চাকার শব্দ, বাইরের অন্ধকার আর কেবিনের ভেতরের ম্লান আলো—সবকিছু মিলে এক আবহ তৈরি করছিল, যেখানে অচেনা হলেও তারা একই জগতে, একই যাত্রায় বাঁধা পড়ে গেছে। তাদের বোঝাপড়া এখনও শুরু মাত্র, অথচ সেই সূচনা থেকেই অদ্ভুতভাবে মনে হচ্ছিল—এই যাত্রা শুধুই বাহ্যিক নয়, এটি ভেতরেরও এক যাত্রা, যা একে অপরের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

দুই

ট্রেনের ভেতরে আলো-অন্ধকারের এক অদ্ভুত খেলা চলছিল। কেবিনের ম্লান হলুদ আলো কখনও তাদের মুখ আলোকিত করছে, কখনও বা জানলার বাইরে অন্ধকারে গিলে নিচ্ছে। এই আলোছায়ার মাঝে তাদের চোখ দুটো যেন নিজেদের আলাদা এক জগৎ তৈরি করল। কথাবার্তা তখনও খুব কম, অথচ চোখে চোখ রেখে তারা যা বলছে, তা হয়তো দীর্ঘ আলাপচারিতার চেয়েও গভীর। তরুণী তার চুলের গোছা সরাতে সরাতে এক ঝলক তাকাল যুবকের দিকে—সে দৃষ্টি শুধু সামান্য ছিল না, তাতে ছিল নীরব আমন্ত্রণ। যুবক প্রথমে সামান্য অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে আটকাতে পারল না। সে একেবারে সরাসরি চোখ রাখল তার চোখের ভেতর। সেই চোখে ছিল অদ্ভুত এক নিশ্চুপতা, যা কথার চাইতেও জোরালো। দুজনের মধ্যেকার দূরত্বে ট্রেনের কোলাহল বা বাইরের দুনিয়া যেন গায়েব হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, ট্রেন চলছে বটে, কিন্তু সময় থেমে আছে, কেবল তাদের চোখের আলাপই এখন জীবন্ত।

এই চোখের ভাষার ভেতরে ছিল এক অদ্ভুত মিশ্রণ—কৌতূহল, দ্বিধা, আকর্ষণ, আর অচেনা এক পরিচিতি। তরুণীর চোখ যেন জিজ্ঞেস করছিল—“তুমি কি আমায় সত্যিই দেখতে পাচ্ছ?” আর যুবকের চোখে উত্তর লুকিয়ে ছিল—“হ্যাঁ, শুধু চোখে নয়, মনে।” তারা জানত না কতটা সময় এভাবে কেটে গেল। একেকটা চাহনি ছিল ক্ষণস্থায়ী, আবার সেই ক্ষণেই যেন অসীম। ট্রেনের জানলা দিয়ে ছুটে চলা বাতাসে যখন তাদের মুখে ছায়ার খেলা হচ্ছিল, তখন চোখগুলো আরও স্পষ্ট, আরও গভীরভাবে মিলেমিশে যাচ্ছিল। কেউ কিছু আড়াল করার চেষ্টা করছিল না। বরং তারা দুজনেই বুঝতে পারছিল, এই মুহূর্তের প্রতিটি বিনিময়ই কোনো এক অব্যক্ত সত্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তরুণী নিজের হাত দুটো কোলে রেখে চুপ করে বসে থাকলেও তার চোখে প্রতিনিয়ত নীরব কথা চলছিল। যুবকও চোখ নামিয়ে নিচ্ছিল মাঝে মাঝে, কিন্তু আবারও সেই একই টানে তাকিয়ে যাচ্ছিল। প্রতিবার তাকানো মানে ছিল নতুন এক স্বীকারোক্তি—যা মুখে উচ্চারণ করার সাহস তারা এখনও পায়নি।

ধীরে ধীরে তাদের দৃষ্টির সেতুটা এতটাই দৃঢ় হয়ে উঠল যে, কথার আর কোনো প্রয়োজন রইল না। তারা বুঝতে পারছিল, এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়েছে দুজন মানুষ। এই দৃষ্টি বিনিময়ে তারা শুধু বর্তমানকেই নয়, ভবিষ্যতের ইঙ্গিতও যেন খুঁজে পাচ্ছিল। প্রতিটি ঝলক যেন বলছিল, এ আকর্ষণ ক্ষণস্থায়ী নয়, এর মধ্যে আছে কিছু অপূরণীয়, কিছু অনিবার্য। চোখের কোণে জমে থাকা নীরবতা, দৃষ্টির গভীরতায় ফুটে ওঠা আবেগ—সবই মিলে যাচ্ছিল এক অব্যক্ত গল্পে। ট্রেনের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে তাদের চোখে চোখে তৈরি হচ্ছিল এক অদ্ভুত সুর, যা কেবল তারা দুজনই শুনতে পাচ্ছিল। হয়তো তারা জানত, এই রাত শেষ হয়ে যাবে, ট্রেন থেমে যাবে, তারা আলাদা পথে চলে যাবে। কিন্তু এই চোখের ভাষা—এই অন্তরঙ্গ নীরব আলাপ—তাদের ভেতরে এমন ছাপ রেখে দিচ্ছিল, যা আর কোনোদিন মুছে যাবে না। যেন প্রতিটি দৃষ্টি ভবিষ্যতের এক অনিবার্য সাক্ষাতের পূর্বাভাস হয়ে উঠছিল, আর সেই পূর্বাভাসের জাদুতেই তারা ডুবে যাচ্ছিল একে অপরের ভেতরে।

তিন

চোখের ভাষায় চলতে থাকা সেই নীরব কথোপকথন হঠাৎই ভেঙে দিল তরুণীর কণ্ঠস্বর। এক মুহূর্তের দ্বিধা কাটিয়ে সে হেসে জিজ্ঞেস করল, “যাত্রা কেমন চলছে?” কথাটা সাধারণ, একেবারেই স্বাভাবিক, অথচ সেই সাধারণতার ভেতরেই যেন লুকিয়ে ছিল এক বিশেষ অর্থ। যুবক সামান্য অবাক হলেও হাসল—তার ঠোঁটের কোণে জমে থাকা সেই হাসিতে ক্লান্তি ছিল, আবার এক ধরনের উষ্ণতাও। সে উত্তর দিল, “চলছে তো, তবে রাতের যাত্রা সবসময় একরকম নয়। কখনও খুব নির্জন লাগে, কখনও আবার মনে হয়—এই নির্জনতাতেই লুকিয়ে থাকে ভিন্ন এক শান্তি।” কথোপকথনের শুরুটা এতটাই হালকা যে অন্য কারও কাছে এর তেমন গুরুত্ব নেই। কিন্তু তারা দুজনেই বুঝতে পারছিল, এই বিনিময়ই তাদের ভেতরে জমে থাকা নীরব আকর্ষণকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তরুণী তার নিজের জীবনের কিছু ছোটখাটো গল্প বলতে শুরু করল—শৈশবের স্মৃতি, কলেজের বন্ধুত্ব, আর মাঝে মাঝে জমে থাকা নিঃসঙ্গতার কথা। যুবক প্রথমে কেবল শুনছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তারও কথার বাঁধ ভাঙতে শুরু করল। সে নিজের জীবনের চাপ, কাজের ব্যস্ততা, আর অজানা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা খুলে বলল। যেন এক অচেনা মানুষকেই বেছে নিয়েছে নিজের অন্তরঙ্গ শ্রোতা হিসেবে।

কথোপকথনের স্রোত ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকল। সাধারণ আলাপচারিতা থেকে তারা চলে গেল অনেক বেশি ব্যক্তিগত এক জগতে। তরুণী বলছিল তার অসম্পূর্ণ স্বপ্নের কথা—কোনো একদিন দূরে কোথাও গিয়ে নিজের জন্য একটি আলাদা জীবন গড়ে তোলার ইচ্ছে। তার কণ্ঠে মিশে ছিল স্বপ্নের ঝলক, আবার বাস্তবতার হতাশাও। যুবক মৃদু হেসে জানাল, সেও একসময় অনেক স্বপ্ন দেখেছিল—কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্নগুলো হারিয়ে গেছে দায়িত্ব আর বাস্তবতার চাপে। তার চোখে সেই মুহূর্তে এক ধরনের ক্লান্তি ছিল, যা তরুণী গভীরভাবে টের পেল। সে যেন বুঝতে পারছিল, এই মানুষটির ভেতরে জমে আছে অনেক অপ্রকাশিত ব্যথা, যা এতদিন কারও সামনে উচ্চারণ হয়নি। অথচ আজ, এই রাতের ট্রেনে, সে সমস্ত ভরসা রেখে বলে যাচ্ছে এক অচেনা মানুষকে। কথার মাঝে তারা থেমে যাচ্ছিল কখনও কখনও—বাইরে ঝাঁপসা অন্ধকারের দিকে তাকাচ্ছিল, আবার ভেতরে ফিরে এসে নিজেদের মন খুলে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এই ট্রেন কেবল তাদের বাহন নয়, বরং তাদের হৃদয়ের কথাগুলোকে একে অপরের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক মাধ্যম।

এভাবে ধীরে ধীরে তারা নিজের ভেতরের অঙ্গীকার খুলে দিচ্ছিল একে অপরের কাছে। এতদিন যেগুলো তারা নিজের কাছেও স্বীকার করতে পারেনি, আজ সেই কথাগুলো নির্ভয়ে বলছে—কারণ তারা জানে, হয়তো আর কখনও দেখা হবে না। এই রাতই তাদের একমাত্র সময়, আর এই সময়টুকুই যথেষ্ট একে অপরকে চেনার জন্য। তরুণী স্বীকার করল, মাঝে মাঝে সে অদ্ভুতভাবে শূন্যতা অনুভব করে, যদিও তার চারপাশে মানুষ ভরা থাকে। যুবকও বলল, তার জীবনে প্রায়ই এমন মুহূর্ত আসে, যখন মনে হয়, সে যেন কেবল যান্ত্রিকভাবে দিন কাটাচ্ছে। দুজনের কথায় মিল পাওয়া গেল—দুজনেই নিঃসঙ্গতা চেনে, দুজনেই হারানো স্বপ্নের কষ্ট বোঝে। এই মিলই তাদের কাছে অচেনাকে করে তুলল ঘনিষ্ঠ, অপরিচিতকে করে তুলল আপন। তারা বুঝতে পারছিল, সময় খুবই সীমিত, কিন্তু তাতে কী আসে যায়? এই রাতের আলাপই যথেষ্ট তাদের মনে এক অদ্ভুত ছাপ রেখে যাওয়ার জন্য। যে ছাপ হয়তো আর কোনোদিন মুছে যাবে না।

চার

ট্রেনের জানলার বাইরে রাতের অন্ধকার যেন তাদের ভেতরের অদ্ভুত টানকে আরও গভীর করে তুলছিল। যাত্রা চলছিল নিরন্তর, অথচ মনে হচ্ছিল সময় থেমে গেছে শুধু তাদের জন্য। কথোপকথনের স্রোত ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে উঠছিল—মাঝে মাঝে হাসি, কখনও নীরবতা, আবার সেই নীরবতার ভেতর থেকে উঠে আসা এক রহস্যময় দৃষ্টি। তরুণী হেসে যখন কোনো কথা বলছিল, যুবক মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছিল, যেন সেই মুহূর্তটাই যথেষ্ট তার ক্লান্ত দিনগুলোর অবসাদ মুছে দিতে। তাদের হাত দুটো একবার কাকতালীয়ভাবে ছুঁয়ে গেল, আর সেই স্পর্শ যেন এক অদ্ভুত কম্পন বয়ে দিল শরীরের ভেতর। কারও মুখে কিছু উচ্চারণ হলো না, কিন্তু দুজনেই অনুভব করল—এই স্পর্শ শুধুই আকস্মিক নয়, এর ভেতরে আছে এক নীরব চুম্বকীয় টান। যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাদের ধীরে ধীরে টেনে আনছে আরও কাছাকাছি।

এই আকর্ষণ এতটাই রহস্যময় যে, তারা নিজেরাও বুঝতে পারছিল না—কেন এক অচেনা মানুষ তাদের হৃদয়কে এত সহজে জড়িয়ে ধরছে। কথার ভেতর দিয়ে তারা একে অপরের স্বপ্ন, ব্যর্থতা, আনন্দ আর নিঃসঙ্গতা ভাগ করে নিয়েছে; এখন যেন শরীরী ভাষা, চোখের ভাষা সবকিছু মিলেমিশে এক অদ্ভুত রোম্যান্স তৈরি করছে। তরুণী যখন মাথা নিচু করে কিছু বলছিল, যুবক অন্যমনস্কভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকছিল—তার ঠোঁটের নড়াচড়া, চোখের পলক পড়া, এমনকি চুলে বাতাস খেলার দৃশ্য—সবকিছুতেই এক অদ্ভুত টান অনুভূত হচ্ছিল। আর যুবকের প্রতিটি হাসি তরুণীর মনে হচ্ছিল দীর্ঘদিনের চেনা কারও আশ্বাস, এমন এক স্নেহ যা সে অনেকদিন পায়নি। তাদের মধ্যে যে দূরত্ব ছিল, তা ক্রমশ ভেঙে পড়ছিল। তারা বুঝতে পারছিল, এই রাত তাদের আলাদা রাখবে না, বরং আরও কাছাকাছি টেনে আনবে। রহস্যের আবরণে মোড়া এই টান ক্রমেই রূপ নিচ্ছিল অব্যক্ত এক আবেগে।

ধীরে ধীরে সেই আবেগ এতটাই তীব্র হয়ে উঠল যে, তাদের মনে হলো, পুরো পৃথিবী যেন বাইরে থেমে আছে। ট্রেনের শব্দ, যাত্রীদের নিদ্রার গুঞ্জন, বাইরের অন্ধকার—সব মিলিয়ে তৈরি হচ্ছিল এক অদ্ভুত নির্জনতা, যেখানে তারা ছাড়া আর কেউ নেই। একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকা, মাঝে মাঝে হালকা হাসি, আবার সেই হাসির ভেতরে লুকিয়ে থাকা গভীর স্নেহ—সবকিছু যেন এক অদ্ভুত স্বপ্নের মতো লাগছিল। তারা জানত না, এই আকর্ষণ কোথায় নিয়ে যাবে তাদের। কিন্তু এই এক রাতের জন্য তারা নিশ্চিত ছিল—জীবন থেমে গেছে কেবল এই মুহূর্তকে ঘিরে। যেন একে অপরের অস্তিত্বই হয়ে উঠেছে এই রাতের একমাত্র সত্য। রহস্যময় সেই টান ধীরে ধীরে তাদের ভেতরে এক জ্যোতির মতো জ্বলছিল, আর তারা দুজনেই নিরুপায় হয়ে আত্মসমর্পণ করছিল সেই অদ্ভুত অনুভূতির কাছে, যা আগে কোনোদিন তারা অনুভব করেনি।

পাঁচ

ট্রেনের গাড়ি তখন অল্প আলোয় ভাসছে। জানলার বাইরের অন্ধকারে মাঝে মাঝে এক-একটা গ্রাম চোখের সামনে ভেসে ওঠে—দূরে ঝলসে ওঠা লণ্ঠনের মতো আলো, কিংবা অচেনা স্টেশনের ক্ষণিক থেমে থাকা। অথচ তাদের দু’জনের দৃষ্টি যেন জানলার বাইরে নয়, ভেতরের নীরবতার গভীরতায় ডুবে আছে। কথা ধীরে ধীরে কমে এসেছে, যেন শব্দের আর প্রয়োজন নেই। যে ভাষা তারা এখন ভাগ করে নিচ্ছে, তা চোখে চোখ রাখা, নিশ্বাসের ওঠানামা বোঝা, আর দু’জনের মধ্যে বিরাজ করা সেই গোপন আকর্ষণের অদৃশ্য স্রোত। ট্রেনের দোলায় এক মুহূর্তে সে তাঁর হাত রাখল সিটের ওপর, আর পরক্ষণে হালকা ছুঁয়ে গেল অপর হাতকে—কোনো উদ্দেশ্য নয়, তবু যেন উদ্দেশ্যহীনতার মধ্যেই জন্ম নিল এক নীরব স্বীকারোক্তি। তারা কেউই কিছু বলেনি, অথচ সেই স্পর্শে প্রকাশ পেল অনেক অজানা কথার সুর।

নীরবতার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ট্রেনের জানালা দিয়ে আসা হাওয়ার মধ্যে যেন অদৃশ্য সঙ্গীত বাজছে, সেই সুরের সঙ্গে মিলিয়ে তাদের শরীর-মন আরও কাছে আসছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসার মুহূর্তে তারা বুঝতে পারল—দূরত্ব আর নেই, শুধু অব্যক্ত উষ্ণতা। কারও চোখ কারও চোখে আটকে গেলে, মনে হচ্ছিল সেই দৃষ্টি অনন্তকাল ধরে চলবে, কোনো শেষ নেই। অন্ধকার আলো-ছায়ার খেলা, গাড়ির ভেতরে ক্ষণিক নড়াচড়া, দূরের বাঁশির আওয়াজ—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করেছিল, যা তাদের চারপাশের জগৎকে মুছে দিয়ে কেবল দু’জনকে একাকার করে দিচ্ছিল। তাদের নীরবতা যেন কথার থেকেও গভীর, হৃদয়ের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা আকাঙ্ক্ষাকে আরও স্পষ্ট করে তুলছিল। তারা জানে না কীভাবে এত দ্রুত এই ঘনিষ্ঠতা জন্ম নিল, কিন্তু অনুভূতিটা এতটাই প্রগাঢ় যে মনে হচ্ছিল—এটাই স্বাভাবিক, এটাই চিরকালীন।

মুহূর্তগুলো থেমে থেমে যেন অনন্তকাল প্রসারিত হচ্ছিল। দু’জনের চোখের ভাষা, হাতের হালকা নড়াচড়া, ঠোঁটে ক্ষণিকের হাসি—সবই ছিল এমন এক গোপন যোগাযোগ, যা শুধু তারা বুঝতে পারছিল। চারপাশের যাত্রীদের ভিড় সত্ত্বেও তারা যেন একটা অদৃশ্য বৃত্তের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, যেখানে বাইরের জগতের শব্দ, আলো কিংবা উপস্থিতি পৌঁছাতে পারছিল না। সেই বৃত্তে ছিল শুধু নীরব ঘনিষ্ঠতা—কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, কোনো সংজ্ঞা নেই, অথচ গভীরতায় ভরপুর। সেই রাতে, সেই ট্রেনের দোলে, তারা উপলব্ধি করল—কখনও কখনও নীরবতাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, আর এক মুহূর্তের স্পর্শও হয়ে ওঠে সারাজীবনের স্মৃতি। তাদের হৃদয় দুটো ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়তে শুরু করল, আর তারা বুঝে গেল—এই রাত শেষ হলেও, এই নীরব ঘনিষ্ঠতার অভিজ্ঞতা চিরকাল তাদের সঙ্গে থেকে যাবে।

ছয়

ট্রেন তখন অন্ধকারের বুকে এগিয়ে চলেছে, চাকার টক্‌টক্‌ শব্দ যেন রাতের নীরবতার সাথে একাকার হয়ে গেছে। এই দোলায় দুলতে দুলতে তাদের মধ্যে যে কথোপকথন শুরু হলো, তা ধীরে ধীরে যেন অতীতের দরজা খুলে দিল। প্রথমে সাধারণ কৌতূহল থেকেই কথার সূত্রপাত—কোথায় থাকেন, কী করেন, পরিবারে কারা আছেন। কিন্তু একটু পরেই সেসব সাধারণ আলোচনার ভেতর থেকে উঠে এল লুকিয়ে রাখা স্মৃতিগুলো, যেগুলো কাউকে সহজে বলা যায় না। সে জানাল এক ভাঙা সম্পর্কের গল্প, যেখানে প্রতিশ্রুতির আলো শেষমেশ ভেঙে পড়েছিল অন্ধকারের খাদের মধ্যে। অন্যদিকে সে-ও স্বীকার করল, তার জীবনের কিছু স্বপ্ন অর্ধেকেই থেমে গেছে, অনেক কিছু চাওয়া সত্ত্বেও মুঠোর ভেতর ধরা দেয়নি। তাদের কণ্ঠে আক্ষেপ, চোখে অস্পষ্ট অশ্রুর ছায়া—তবু এই মুহূর্তে সেই অতীত বলাটা যেন কষ্ট নয়, বরং এক ধরনের মুক্তি। কারণ দু’জনেই বুঝতে পারল, সামনে যে মানুষটি বসে আছে, সে বিচার করছে না, শুধু শুনছে, শুধু বোঝার চেষ্টা করছে।

যখন স্মৃতির ভারী দরজা খুলে গেল, তখন তারা দেখল, ভেতরে একই রকম ক্ষতচিহ্ন লুকিয়ে আছে। ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন জীবন, অথচ অভিজ্ঞতার গভীরে মিল খুঁজে পেল দু’জনেই। একাকিত্বের দীর্ঘ পথ, ভাঙা প্রতিশ্রুতির হাহাকার, সমাজের চোখ এড়িয়ে লুকিয়ে রাখা অশ্রু—সবকিছু যেন একসাথে জেগে উঠল। সে বলল, কেমন করে একসময় ভেবেছিল ভালোবাসা তার জীবনে স্থায়ী হবে, অথচ হঠাৎ একদিন সবকিছু ভেঙে গিয়ে তাকে শূন্য হাতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। অন্যজন শোনাল, কেমন করে কিছু স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে অনেক কাছের মানুষকে হারাতে হয়েছে, কীভাবে সাফল্যের পথে হাঁটতে গিয়ে ভিতরের মানুষটা ফাঁকা হয়ে গেছে। তাদের কথার মধ্যে ছিল না কোনো নাটকীয়তা, বরং ছিল অদ্ভুত সত্যতার এক গোপন আভা। মনে হচ্ছিল, এই অচেনা ট্রেনযাত্রা, এই কাকতালীয় দেখা, এটাই বোধহয় সেই মুহূর্ত যখন নিজের ভেতরের অন্ধকারকে নির্ভয়ে দেখানো যায়।

এই স্বীকারোক্তির মাঝেই তারা বুঝতে পারল, একে অপরের উপস্থিতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যে কথা বহুদিন বলা হয়নি, আজ অবলীলায় উচ্চারিত হচ্ছে, কারণ এখানে নেই কোনো দাবি, নেই কোনো সম্পর্কের চাপ—আছে শুধু বোঝাপড়া। তারা অনুভব করল, এই মানুষটিই হয়তো সেই ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে পারে, যা এতদিন ধরে ভিতরে ভিতরে কুরে খাচ্ছিল। ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকার যতই গভীর হচ্ছিল, তাদের ভেতরের আলো ততই উজ্জ্বল হচ্ছিল। তারা বুঝে গেল, অতীতের ছায়া হয়তো কখনও পুরোপুরি মুছে যাবে না, কিন্তু এই মুহূর্তে একজন অন্যজনকে পাশে পেলে সেই ছায়া আর ভয়ের মতো মনে হয় না। বরং মনে হয়, ছায়ার ভেতর দিয়েই খুঁজে পাওয়া যায় আলো, আর শূন্যতার ভেতর দিয়েই জন্ম নেয় নতুন পূর্ণতার স্বপ্ন। সেই রাতে, ট্রেনের দোলে বসে, দুই অচেনা মানুষ বুঝে গেল—হয়তো এই পরিচয়ই একদিন তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি হয়ে উঠবে।

সাত

রাত তখন যেন তার সমস্ত রহস্য উজাড় করে দিচ্ছিল। ট্রেনের গতি ধীর হয়ে এসেছে, জানলার বাইরে কেবল অন্ধকারের দীর্ঘ বিস্তার আর মাঝে মাঝে দূরের কোনো আলো হঠাৎ ভেসে ওঠে আবার মিলিয়ে যায়। ভেতরে নীরবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে চাকার ঝিম ধরা শব্দ, আর সেই নীরবতার ভেতরেই দু’জন মানুষ ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে নিজেদের আবেগের গভীরে। তারা জানে, সময় সীমিত, এই রাত তাদের হাতে একবারের মতো ধরা দিয়েছে, আর ভোর নামলেই হয়তো আর কোনোদিন একে অপরকে দেখা হবে না। তবু এই জেনেও তাদের মধ্যে যে আবেগ তৈরি হয়েছে, তা থামানো সম্ভব নয়। প্রতিটি মুহূর্ত যেন দীর্ঘায়িত হচ্ছে, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি দৃষ্টি বিনিময় যেন চিরস্থায়ী হয়ে যাওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছে। এই সীমিত সময়টুকুকে তারা উপভোগ করছে এমনভাবে, যেন এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে সারাজীবনের সমস্ত রঙ।

আলাপচারিতার ভেতর দিয়ে, ছোট ছোট হাসির ফাঁক দিয়ে, হঠাৎ হাত ছুঁয়ে যাওয়ার অজান্ত মুহূর্তে তাদের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ গভীর হয়ে উঠছিল। একসময় কথার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল, শুধু চোখ আর নীরবতা যথেষ্ট হয়ে উঠল। তারা অনুভব করল—কোনো প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন নেই, কোনো ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নেই, তবুও এই এক রাতই তাদের জীবনের সবচেয়ে আন্তরিক অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে চলেছে। অচেনা হলেও তারা একে অপরের সামনে এতটা উন্মুক্ত, এতটা নির্ভার, যেন বহুদিনের পরিচিত। ট্রেনের হালকা দুলুনি আর জানলার বাইরে রাতের নিস্তব্ধতা তাদের হৃদস্পন্দনকে আরও কাছে নিয়ে আসছিল। আলিঙ্গনের মুহূর্তগুলোয় যেন ভেঙে যাচ্ছিল সমস্ত একাকিত্বের দেয়াল, সমস্ত অতীতের ব্যথা। তাদের মনে হচ্ছিল, সময় থেমে গেছে, গন্তব্য নেই, শুধু এই যাত্রাই চিরকাল চলতে থাকবে।

রাত যত গভীর হচ্ছিল, তাদের ঘনিষ্ঠতাও ততই বেড়ে উঠছিল—শুধু দেহে নয়, মনে, আত্মায়। প্রতিটি স্পর্শ যেন এক ধরনের সান্ত্বনা, প্রতিটি হাসি যেন ক্ষত শুকিয়ে দেওয়ার ওষুধ। তারা জানত, ভোর হলে এই মায়াজাল ছিন্ন হয়ে যাবে, তবুও সেই ভোর নিয়ে কোনো ভয় ছিল না। বরং এই ভয়হীনতাই তাদের আরও কাছে টেনে আনছিল, কারণ যা কিছু পাওয়ার, তা এই রাতেই পেতে হবে। তারা আবিষ্কার করল, ভালোবাসা আসলে সময়ের মাপে মাপা যায় না; কখনো কখনো কয়েক ঘণ্টাই যথেষ্ট হয় মানুষের জীবনে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় লেখার জন্য। সেই রাত, সেই সীমিত সময়, সেই অচেনা ট্রেনযাত্রা—সবকিছু মিলিয়ে তারা যে গভীরতায় পৌঁছেছিল, তা হয়তো কোনো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সম্পর্কে বহু বছরের চেষ্টাতেও পাওয়া সম্ভব নয়। রাতের গভীরতা তাই তাদের আত্মাকে স্পর্শ করেছিল, রেখে গিয়েছিল এক অনন্ত স্মৃতি, যা হয়তো চিরকাল থেকে যাবে তাদের হৃদয়ের সবচেয়ে গোপন কোণে।

আট

ট্রেন তখন গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় ধীরে ধীরে ছুটে চলেছে, আর জানলার বাইরের অন্ধকার যেন আরও ঘন হয়ে এসেছে। এই অন্ধকারের ভেতরেই তারা খুঁজে পেল এক ধরনের আলোকময়তা—যেটা জন্ম নেয়েছিল তাদের ভেতরের সাহস থেকে, নিজেদের সবচেয়ে ভঙ্গুর দিকগুলো প্রকাশ করার ইচ্ছা থেকে। এতক্ষণ ধরে হাসি, কথা, নীরবতা, স্পর্শ—সবকিছু মিলিয়ে যে টান তৈরি হয়েছিল, তা এই মুহূর্তে যেন এক নতুন পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। দু’জনেই অনুভব করছিল, কোনো অদৃশ্য বাধা নেই আর, নেই কোনো সংকোচ বা সংশয়। একে অপরের চোখে চোখ রাখতেই যেন নীরবে বলে ফেলা গেল—“তুমি-ই সেই মানুষ, যার কাছে আমি আমার অন্তরের ভার, আমার সবচেয়ে গোপন ক্ষতচিহ্ন, আমার ভালোবাসা আর আমার ভয়—সবকিছু সমর্পণ করতে পারি।” এটি ছিল এমন এক স্বীকারোক্তি, যা মুখে উচ্চারিত হয়নি, তবুও মনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

তাদের আলাপ তখন আর সাধারণ যাত্রীসঙ্গের মতো রইল না; বরং যেন কোনো অদৃশ্য স্রোত তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল এক আত্মিক মেলবন্ধনের দিকে। সে বলল, কীভাবে বছরের পর বছর ধরে একাকিত্ব তাকে ধীরে ধীরে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলেছিল, কীভাবে সম্পর্কের ভাঙন তাকে আর কাউকে বিশ্বাস করতে দেয়নি। অন্যজন স্বীকার করল, তারও হৃদয়ে জমে আছে অগণিত ভয় আর হাহাকার, যা কাউকে বলা হয়নি আগে। কিন্তু আজ, এই ট্রেনের ছোট্ট কামরায়, এই অচেনা রাতের সাক্ষী হয়ে তারা দু’জনেই সমস্ত শিকল ভেঙে ফেলল। কোনো দ্বিধা ছিল না, কারণ তারা দু’জনেই জানত—এই মুহূর্ত আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। তাই না বললেই নয়, না ছুঁলেই নয়। এই এক রাতের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল তাদের সমস্ত স্বীকারোক্তির সত্য।

এমন এক সময় এলো, যখন তারা অনুভব করল, এ কেবল রোমান্টিক আকর্ষণ নয়—এ এক মানসিক, আবেগগত, এমনকি আধ্যাত্মিক আত্মসমর্পণ। তারা জানত, হয়তো কখনোই আর দেখা হবে না; সকালে নামার পর দু’জনেই হারিয়ে যাবে ভিন্ন ভিন্ন জীবনের ভিড়ে। কিন্তু এই জেনেও তাদের হৃদয় ভয় পায়নি। বরং এই সীমাবদ্ধ সময়ের ভেতরেই তারা সবকিছু বিলিয়ে দিতে চাইল—ভালোবাসা, ব্যথা, স্বপ্ন, প্রত্যাশা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে তারা বুঝল, সম্পর্কের সংজ্ঞা সবসময় স্থায়ীত্বে খুঁজতে হয় না; কখনো কখনো এক রাতই যথেষ্ট হয় এমন এক অনন্ত অনুভূতির জন্ম দিতে, যা চিরকাল মনে রয়ে যায়। এই স্বীকারোক্তিই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি—এক নিঃশব্দ চুক্তি, যেখানে প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন নেই, ভবিষ্যতের কোনো দাবি নেই, আছে শুধু এই রাতের নিখাদ সত্য।

নয়

ট্রেন তখন ধীরে ধীরে থামার পথে, জানলার বাইরে প্রথম ভোরের আবছা আলো ফুঁটে উঠছে। রাতের গাঢ় অন্ধকার সরে গিয়ে যেন বাস্তবতার রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, আর সেই বাস্তবতা তাদের দু’জনের হৃদয়ে এক অব্যক্ত কাঁপন জাগিয়ে তুলল। তারা বোঝে, যাত্রার শেষ মানেই এই রাতের জাদুরও সমাপ্তি। গত কয়েক ঘণ্টা ধরে যে অদ্ভুত জগতে তারা নিজেদের ডুবিয়ে রেখেছিল—হাসি, নীরবতা, চোখের ভাষা আর আলিঙ্গনে গড়ে তোলা সেই মায়াবী দুনিয়া—সবকিছু ভেঙে যাবে এই সকালের সঙ্গে। কামরার ভেতরে হঠাৎ যেন সময় আরও দ্রুত গতিতে বয়ে যেতে লাগল। তাদের কথাগুলো ছোট হয়ে আসছিল, কিন্তু চোখের গভীরতায় জমা হচ্ছিল অজস্র না-বলা কথা। তারা দু’জনেই জানত, আর কোনো উপায় নেই—এই বিদায় অবধারিত।

সেই মুহূর্তে প্রতিটি সেকেন্ড যেন সোনার মতো দামী হয়ে উঠল। হাতের হালকা স্পর্শকে তারা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল, যেন সময়কে আটকে রাখা যায়। একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকাই যেন হয়ে উঠল সবচেয়ে বড় আশ্রয়, কারণ কথায় আর সব বলা সম্ভব হচ্ছিল না। এক দীর্ঘ চুম্বনে তারা মুছে দিতে চাইল বিচ্ছেদের সব যন্ত্রণা—এমন এক চুম্বন, যেখানে একদিকে আকাঙ্ক্ষার উন্মাদনা, অন্যদিকে বিদায়ের বেদনাও মিলেমিশে ছিল। চোখ বুজে সেই মুহূর্তটুকুকে তারা মনে গেঁথে নিল, কারণ জানত, এটাই শেষ স্পর্শ, শেষ সান্নিধ্য। ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্মের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, ব্রেকের শব্দ ভেসে আসছে, আর সেই শব্দ যেন হৃদয়ের ভেতরেও এক ধরনের ছিন্নতার প্রতিধ্বনি তুলছিল।

অবশেষে ট্রেন থামল, আর সেই সঙ্গে ভোরের আলো যেন তাদের স্বপ্নের পর্দা সরিয়ে দিল। তারা দাঁড়িয়ে একে অপরের চোখে চোখ রাখল—চোখে ছিল ভেজা ঝিলিক, অথচ ঠোঁটে এক চাপা হাসি, যেন ব্যথাকে লুকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা। বিদায় জানানোর জন্য কোনো শব্দ যথেষ্ট ছিল না; শুধু এক দৃষ্টি, এক অঙ্গভঙ্গিই যথেষ্ট হয়ে উঠল। তারা দু’জনেই জানত, এই ভিড়ের মাঝে নামার পর হয়তো আর কখনো দেখা হবে না, কিন্তু এই রাতের স্মৃতি তাদের চিরকাল তাড়া করবে, আবার আশ্রয়ও দেবে। যখন তারা দু’দিকে এগিয়ে গেল, তাদের পদক্ষেপে ছিল ভারী নীরবতা—তবুও হৃদয়ের গভীরে রয়ে গেল সেই অনুভূতি, যা কখনো মুছে যাবে না। বিচ্ছেদের ছায়া তাদের ঢেকে দিলেও, সেই রাতের জাদু যেন তাদের আত্মায় চিরকালের মতো খোদাই হয়ে রইল।

দশ

ভোরের আলোয় ট্রেন থেকে নামার পর তারা দু’জনই আলাদা পথে চলে গেল—কেউ পেছনে ফিরে তাকাল না, তবুও দু’জনের হৃদয়ে একই রকম কাঁপন রয়ে গেল। শহরের ভিড়, কর্মব্যস্ত জীবনের শব্দ, প্রতিদিনকার বাস্তবতা—সবকিছুর মধ্যেও সেই রাত যেন তাদের ভেতরে এক অচল স্মৃতিস্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কাজের চাপ, দায়িত্ব, সম্পর্ক—যা-ই আসুক, সেই স্মৃতি মুছে দেওয়া যায়নি। অচেনা চোখের মিলন, নীরব স্পর্শ, দীর্ঘ আলিঙ্গন—সবকিছু মিলিয়ে সেই কয়েক ঘণ্টা যেন এক আজীবনের সমান হয়ে উঠেছিল। সময় যত এগোতে থাকে, তারা ততই অনুভব করে, হয়তো বাস্তবে তারা আর কখনো একে অপরকে খুঁজে পাবে না, কিন্তু অন্তরের গভীরে যে সংযোগ তৈরি হয়েছে, তা কোনো বিচ্ছেদ মানতে রাজি নয়। প্রতিটি নিঃসঙ্গ রাতে, প্রতিটি ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাদের মনে পড়ে যায় সেই ট্রেনের কামরা, যেখানে সময় থেমে গিয়েছিল।

দিন যায়, বছর কেটে যায়, তবুও স্মৃতির রঙ ফিকে হয় না। হয়তো নতুন সম্পর্ক আসে, নতুন মুখ, নতুন অভিজ্ঞতা, কিন্তু সেই এক রাতের আবেগ যেন অন্য সবকিছুর ভেতরে ছায়ার মতো থেকে যায়। তারা প্রত্যেকেই আলাদা জীবনে নিজের মতো করে বেঁচে থাকে, কিন্তু যখনই চোখ বুজে, মন ফিরে যায় সেই মুহূর্তে—ট্রেনের জানলার বাইরে অন্ধকারে ভেসে থাকা আলোয়, অথবা কামরার নরম আলোয় একে অপরের চোখে হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতিতে। এটা ছিল না কেবল শরীরী আকর্ষণ, ছিল না কেবল ক্ষণস্থায়ী আবেগ—এটা ছিল আত্মার গভীরে পৌঁছে যাওয়া এক নিঃশব্দ যোগাযোগ। তারা দু’জনেই বুঝেছিল, পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের ভেতরে একটা অংশ চিরকাল বাঁধা থাকবে সেই রাতের সঙ্গে, সেই অচেনা মানুষের সঙ্গে, যে অদ্ভুতভাবে তাদের ভেতরের শূন্যতা পূরণ করেছিল।

এভাবেই স্মৃতি হয়ে গেল অনন্ত—যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক অভিজ্ঞতা, যা কখনো পুরোনো হয় না। তারা হয়তো জানত, জীবন সবসময় সামনে এগোয়, পুরোনোকে পেছনে ফেলে দেয়; কিন্তু এই স্মৃতি তার ব্যতিক্রম। এটা এমন এক মুহূর্ত, যা শুধু মনে থেকে যায় না, বরং আত্মার গভীরে এক অমোঘ চিহ্ন আঁকে। ভবিষ্যতে যত সম্পর্কই আসুক, যত সাফল্য বা ব্যর্থতাই আসুক, সেই রাত তাদের পরিচয়ের আকাশে জ্বলজ্বলে এক নক্ষত্র হয়ে থাকবে। তারা জানত, একে অপরকে আর দেখা হবে না, তবুও মনে হচ্ছিল, হয়তো দেখা হয়ে গেছে এমন এক জায়গায়, যেখানে সময়ের নিয়ম চলে না। সেই রাতের ট্রেনযাত্রা, সেই চোখের ভাষা, সেই নিঃশব্দ আত্মসমর্পণ—সবকিছু মিলিয়ে তারা পেয়েছিল এক অমূল্য সম্পদ, যা মৃত্যু অবধি অটুট থাকবে। এভাবেই তারা দু’জনেই নিজের জীবনে ফিরে গিয়েছিল, কিন্তু হৃদয়ের গোপন কোণে রেখে গিয়েছিল এক অবিস্মরণীয় গল্প—“স্মৃতির অনন্ত।”

শেষ

1000065454.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *