Bangla - প্রেমের গল্প

অপরিচিতের কাছে আত্মসমর্পণ

Spread the love

সুতপা দাস


রাতের ট্রেনটা যেন এক অদ্ভুত ছায়াচ্ছন্ন সুরের মতো ছুটে চলছিল অন্ধকার গাছপালা আর ফাঁকা স্টেশনের পাশ দিয়ে। জানালার কাচে প্রতিফলিত হচ্ছিল ভেতরের ম্লান আলো, আর তার ভেতরেই বসে ছিল অদ্রিজ—এক হাতে বই, আরেক হাতে অচেতনভাবে কলম ঘোরাচ্ছিল। ভিড়ের বগি হলেও চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল, যাত্রীদের অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে, কেউ কেউ চুপচাপ ফোনের আলোয় স্ক্রল করছে। অদ্রিজ বই পড়ার ভেতর ডুবে থাকার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার চোখ বারবার সরে যাচ্ছিল জানালার বাইরে, অন্ধকারে দৌড়তে থাকা আলো-ছায়ার খেলায়। তার ভিতরটা যেন অস্থির, একাকিত্বের ভার মিশে আছে দেহভঙ্গিতে। ঠিক তখনই দরজার দিক থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো এক মেয়ের পায়ের শব্দ। ছন্দময় অথচ দৃঢ়। অদ্রিজ অল্প মাথা তুলে দেখল—গাঢ় নীল সালোয়ার পরে এক মেয়েটি তার বিপরীতে বসে পড়ল। প্রথম মুহূর্তে সে ভেবেছিল হয়তো কেবল আরেকজন যাত্রী, কিন্তু কিছু একটা ভিন্ন অনুভূতি জেগে উঠল বুকের ভেতরে। মেয়েটির মুখ শান্ত, কিন্তু চোখে যেন এক অনাবিষ্কৃত গল্প জমে আছে। আলো-আঁধারের ভেতর অদ্রিজ লক্ষ্য করল তার খোলা চুলের ভাঁজে ঝরে পড়া ছায়া, ঠোঁটে জমে থাকা এক অদ্ভুত নিঃশব্দ হাসি। কোনো কথা হলো না, তবু মুহূর্তের মধ্যে তাদের চোখ একে অপরের সঙ্গে আটকে গেল—যেন অচেনা অথচ গভীর এক টান খেলা করছে। অদ্রিজ কলম ঘোরানো থামিয়ে দিল, বইয়ের অক্ষরগুলোও হঠাৎ অস্পষ্ট লাগল তার কাছে।

ট্রেনের ছন্দময় ঝাঁকুনির মধ্যে দুজনেই নিজেদের নীরবতাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছিল, কিন্তু চোখের দৃষ্টি যেন বারবার কথার চেয়ে বড় হয়ে উঠছিল। ঐশী (মেয়েটির নাম) জানালার পাশে একটু হেলে বসল, বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে থাকার ভান করলেও সে মাঝে মাঝে অদ্রিজের দিকে চোরা চোখে তাকাচ্ছিল। অদ্রিজ টের পাচ্ছিল, কিন্তু সে কিছু বলল না। তার মনে হচ্ছিল এই মেয়েটির মধ্যে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস আছে, অথচ কোথাও এক চুপচাপ ভয় লুকিয়ে আছে। মেয়েটির হাতের আঙুলগুলো চুপচাপ খেলছিল নিজের ওড়নার প্রান্তে—এক ধরনের অস্থিরতা, যা তার ভেতরের অশান্তির ছাপ বহন করছে। অদ্রিজ হালকা গলায় কাশল, যেন বই থেকে মন সরানোর অজুহাত খুঁজছে। ঐশী তাকাল এক ঝলক, চোখে মৃদু বিস্ময় আর তারপর দ্রুত সরে গেল অন্যদিকে। কিন্তু সেই এক ঝলকেই অদ্রিজ অনুভব করল, যেন পুরো বগির সমস্ত আলো এসে জমে গেছে সেই চোখদুটোতে। সে চোখে লুকানো এক অদ্ভুত প্রশ্ন, যা হয়তো কোনোদিন বলা হবে না। ঐশী জানত না কেন তার বুকের ভেতর হঠাৎ করেই ঢেউ উঠছে। হয়তো দীর্ঘদিনের নিঃসঙ্গতার ভিড়ে এই অপরিচিতের উপস্থিতি তাকে নাড়িয়ে দিল, কিংবা হয়তো এই নীরব রাতই দুজনকে অদ্ভুতভাবে কাছাকাছি এনে দিল।

ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল, ট্রেন থেমে গেল এক নির্জন স্টেশনে। অদ্রিজ মাথা তুলল, চারপাশে কেবল কয়েকজন নামছে বা উঠছে, কিন্তু ঐশী কোথাও যাচ্ছিল না। বরং সে আরও স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে সিটে হেলান দিল। সেই মুহূর্তে তাদের চোখ আবার মিলল—এবার দীর্ঘক্ষণ। ভেতরে অদৃশ্য টান যেন তাদের কথা বলার আগে একে অপরকে চিনিয়ে দিচ্ছে। অদ্রিজের মনে হচ্ছিল—সে যদি কিছু না বলে তবে হয়তো সুযোগটা চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে। অথচ শব্দ মুখে আসছে না। একই সঙ্গে ঐশীরও মনে হচ্ছিল, এই ছেলেটির নীরবতার ভেতরে লুকিয়ে আছে কিছু, যা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দুজনের নীরবতা ভাঙতে পারল কেবল ট্রেনের ঝাঁকুনি আর রাতের গাঢ় অন্ধকার। একটিও শব্দ উচ্চারণ করা হলো না, কিন্তু সেই মুহূর্তের অচেনা সান্নিধ্য তাদের ভেতরের সমস্ত চিন্তা, সমস্ত একাকিত্বকে অদ্ভুতভাবে একসূত্রে বেঁধে দিল। সেই চোখাচোখি, সেই অচেনা টানই হয়ে উঠল তাদের কাহিনির প্রথম সুর—এক রাতের জন্য ভাগ্য যেন নিঃশব্দে লিখে দিল এক অচেনা আত্মসমর্পণের শুরু।

ট্রেনের হঠাৎ থেমে যাওয়াটা যেন এক অদ্ভুত নীরবতা নামিয়ে আনল। কানে কেবল শোনা যাচ্ছিল গাড়ির যান্ত্রিক শব্দ আর বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। জানালার বাইরে অন্ধকার মাঠ, কোথাও দূরে এক-আধটা আলো ঝলকাচ্ছে। ভেতরে যাত্রীরা অস্থির হতে শুরু করেছে—কেউ ঘড়ি দেখছে, কেউ বিরক্তি প্রকাশ করছে। কিন্তু এই থেমে যাওয়া মুহূর্তটাই যেন অদ্রিজের ভেতরে জমে থাকা কথাগুলোকে মুক্ত করার সুযোগ করে দিল। সে বইটা বন্ধ করল, এক মুহূর্ত চোখের ভেতরের দ্বিধাকে জয় করে মৃদু স্বরে বলল—“ট্রেনের দেরি যেন নিত্যদিনের অভ্যাস।” তার কণ্ঠস্বর শান্ত, তবু যেন ভেতরে লুকোনো এক চাপা কৌতুক লুকিয়ে ছিল। ঐশী প্রথমে একটু চমকে তাকাল, যেন এতক্ষণ ধরে নীরবতাকে কেউ হঠাৎ ভেঙে দিল। তারপর ঠোঁটের কোণে এক হালকা হাসি ফুটে উঠল—“হ্যাঁ, মনে হচ্ছে যেন ট্রেনের চেয়ে অপেক্ষা করাই যাত্রীদের আসল কাজ।” সেই উত্তর শুনে অদ্রিজ অবাক হল, মেয়েটির কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা আর স্বচ্ছতা, যেন সে সাধারণ বাক্যকেও একেবারে অন্য মাত্রা দিয়ে ফেলছে। বগির ম্লান আলোয় তার মুখে সেই ক্ষণিক হাসি অদ্রিজকে অদ্ভুতভাবে ছুঁয়ে গেল।

আলাপটা সেখানেই থেমে যায়নি, বরং একে অপরের ভেতরের অস্থিরতা ভেঙে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। অদ্রিজ জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি পড়াশোনা করছেন নাকি কাজ?” ঐশী এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল—“দুটোই বলা যায়। পড়াশোনাই আসল, তবে সেটার সঙ্গে জীবনযাপনের লড়াইও চলছে। ইতিহাস নিয়ে পিএইচডি করছি। মানুষ ভাবে ইতিহাস মানে পুরোনো, কিন্তু আমি ইতিহাসকে দেখি ভবিষ্যৎ বোঝার আয়না হিসেবে।” তার কথায় অদ্রিজ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল, যেন এত সহজে এত গভীর একটা দৃষ্টিভঙ্গি শোনা যায় না প্রতিদিন। সে মৃদু হেসে বলল—“আমি বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করি। প্রতিদিন ভবিষ্যৎ বিক্রি করি, অথচ নিজের ভবিষ্যৎটা কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারি না।” ঐশী হেসে উঠল, তবে সেই হাসির ভেতরে কোথাও যেন একটা মৃদু সহানুভূতি ছিল। তার মনে হচ্ছিল এই মানুষটা কেবল কথোপকথন চালাচ্ছে না, বরং ভেতরের সত্যিটা নিঃসঙ্কোচে ভাগ করে নিচ্ছে। তারা দুজনেই বুঝতে পারল, অচেনা হওয়া সত্ত্বেও কথোপকথনের ভেতরে একটা আশ্চর্য স্বস্তি আছে, যেখানে নিজেকে কোনো মুখোশের আড়ালে রাখতে হয় না।

ট্রেন তখনও স্থির, যেন তাদের আলাপের জন্যই সময় থেমে গেছে। চারপাশের নিস্তব্ধতার ভেতর তাদের কণ্ঠস্বরই একমাত্র স্পন্দন হয়ে বাজছিল। অদ্রিজ জানতে চাইল—“আপনার মনে হয় না, এই যে অচেনা মানুষ হঠাৎ কথা বলে ওঠে, এটা অনেক সময় খুব অদ্ভুত লাগে?” ঐশী একটু ভেবে উত্তর দিল—“অদ্ভুত লাগে ঠিকই, তবে হয়তো সেই অদ্ভুততার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে এক অচেনা স্বস্তি। কখনো কখনো যাকে আমরা চিনি, তার চেয়ে অচেনা মানুষই সহজে আমাদের মনের কাছে পৌঁছে যায়।” কথাগুলো শুনে অদ্রিজের বুকের ভেতর কেমন একটা ধাক্কা খেল। সে চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে রইল, বাইরে অন্ধকার মাঠে হঠাৎ যেন দূরে বিদ্যুতের রেখা ঝলসে উঠল। তার মনে হচ্ছিল এই মেয়েটির প্রতিটি শব্দ যেন নিজের অতীতের গভীরে কোথাও গিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। ঐশীর দৃষ্টি ততক্ষণে আবার তার দিকে ফিরেছে, যেন চোখের ভেতরে লেখা রয়েছে এক নীরব প্রতিশ্রুতি—এই আলাপ হয়তো সাময়িক, কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে থাকবে এমন কিছু যা কখনো বিস্মৃত হবে না। ট্রেন তখন আবার চলতে শুরু করল, কিন্তু তাদের কথোপকথন যেন আলাদা এক গন্তব্যে ছুটতে লাগল, যেখানে সময়, অচেনা আর অনিশ্চয়তার সীমা একেবারেই অচল।

ট্রেন চলতে শুরু করেছে আবার, কিন্তু সময়ের তাল ঠিক যেন ভিন্ন কোনো ছন্দে বাজছে। জানালার বাইরে অন্ধকার দৌড়চ্ছে, ভেতরে আলো-ছায়ার খেলা। তাদের কথোপকথন এখন আর কেবল ছোট ছোট ভদ্রতার প্রশ্নে আটকে নেই; ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে ভেতরের দরজা। ঐশী একটু নরম স্বরে বলল—“আমার গবেষণা আসলে একধরনের লড়াই। ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করছি, বিশেষ করে বাংলার ঔপনিবেশিক সময়ের নারীদের জীবনের ওপর। সবাই ভাবে এই বিষয়গুলো কেবল বইতে থাকার মতো, অথচ আমি বারবার বুঝতে পারছি, এইসব অজানা কাহিনী আমাদের বর্তমানকেও স্পর্শ করে।” তার চোখে তখন এক অদ্ভুত জেদ, যেন নিজের কথার ভেতরেই সে শক্তি খুঁজে পায়। অদ্রিজ মন দিয়ে শুনছিল, কিন্তু তার বুকের ভেতর কোথাও যেন দোলা দিচ্ছিল। ঐশীর কণ্ঠে যে একাগ্রতা, তাতে অদ্রিজ বুঝতে পারছিল এই মেয়েটি কেবল নিজের জন্য বাঁচতে চায় না, বরং একটা বৃহত্তর উদ্দেশ্যের জন্য নিজেকে তৈরি করছে। সে হেসে বলল—“আমরা বিজ্ঞাপন করি, কয়েক সেকেন্ডে মানুষের মন জয় করতে চাই। আপনি ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন, যেখানে হয়তো একেকটা ঘটনার পেছনে শত বছরের ভার। ভাবুন তো, আপনার গবেষণা আর আমার পেশা—দুটো কতটা ভিন্ন।” ঐশী মুচকি হেসে উত্তর দিল—“ভিন্ন হলেও দুটোই আসলে মানুষের গল্প নিয়েই। আপনি ভবিষ্যতের গল্প বিক্রি করেন, আমি অতীতের গল্প উদ্ধার করি।” তাদের দুজনের চোখাচোখি হলো আবার, এবার আরও দীর্ঘক্ষণ, যেন ভেতরে ভেতরে সেই কথার মানে গিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে একে অপরের গভীর জায়গাগুলো।

অদ্রিজ চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ কথার মোড় ঘুরিয়ে দিল। “জানেন, কোনো কোনো গল্প আমরা লুকিয়ে রাখি। বাইরের পৃথিবীকে বলি না, শুধু বুকের ভেতর জমিয়ে রাখি।” ঐশী বিস্মিত চোখে তাকাল, তারপর শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল—“আপনার কি তেমন কোনো গল্প আছে?” অদ্রিজ একটু থমকে গেল, মনে হচ্ছিল দ্বিধার ভেতরে ডুবে যাচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে বলল—“ছিল… হয়তো এখনও আছে। একটা দীর্ঘ সম্পর্ক ছিল, ভেবেছিলাম শেষ পর্যন্ত চলবে। কিন্তু অনেক সময় ভালোবাসা থেকেও একসাথে থাকা যায় না।” কথাগুলো যেন তার ঠোঁট থেকে বেরোতে চাইছিল না, কিন্তু বেরিয়ে গেল। ঐশী কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল—“আমাদের প্রত্যেকেরই ভাঙনের অভিজ্ঞতা থাকে। আসলে ভাঙা সম্পর্কও আমাদের গড়ে তোলে, অন্যভাবে।” অদ্রিজ তাকাল তার দিকে, মনে হলো এই মেয়েটি শুধু শুনছে না, বুঝছেও। সে বুঝতে পারল, বহুদিন পরে কেউ তার ভেতরের শূন্যতার সঙ্গে সুর মিলিয়ে দিচ্ছে। সেই মুহূর্তে তাদের কথার ভেতরে একটা ব্যক্তিগত ছোঁয়া জন্ম নিল, যা সাধারণ আলাপের গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়ে একরকম আস্থার জায়গা তৈরি করল। ঐশী তার গবেষণার কথা যেমন খোলামেলা বলছিল, অদ্রিজও নিজের জীবনের ভাঙা অধ্যায়কে প্রথমবার এত সহজে প্রকাশ করতে পারছিল—যেন তারা বহুদিনের পরিচিত।

ট্রেনের ভেতর বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল, কিন্তু দুজনের কথোপকথন সেই ভার হালকা করে দিচ্ছিল। চারপাশে অন্য যাত্রীরা ঘুমিয়ে পড়েছে, মাঝেমাঝে দূরের আলো জানালার কাচে পড়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। ঐশী হাতের ওড়না গুটিয়ে টেবিলের ওপর রাখল, তারপর অদ্রিজের দিকে তাকিয়ে বলল—“আপনি জানেন, আমি যখন গবেষণার কাজ নিয়ে রাত জেগে থাকি, মনে হয় আমি একা। কিন্তু আজ অদ্ভুতভাবে মনে হচ্ছে, অপরিচিত হলেও আপনার সঙ্গে কথা বলতে এত সহজ লাগছে।” অদ্রিজ মৃদু হেসে উত্তর দিল—“আমিও তাই অনুভব করছি। হয়তো আমরা অপরিচিত বলে সহজে নিজেদের খুলে দিতে পারছি।” কথার ভেতরে যে সান্ত্বনা তারা পাচ্ছিল, তা কোনো প্রতিশ্রুতির ওপর দাঁড়ানো নয়; বরং ছিল নিছক উপস্থিতির সত্য। তাদের আলাপের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি দৃষ্টি একে অপরকে কাছে টেনে আনছিল—কোনো শারীরিক স্পর্শ ছাড়াই যেন তারা পৌঁছে যাচ্ছিল এক অন্তরঙ্গতার দ্বারপ্রান্তে। অদ্রিজ অনুভব করছিল, ঐশীর চোখের গভীরতায় সে নিজের শূন্যতাকে ভরাট করার মতো কিছু পাচ্ছে। আর ঐশী ভাবছিল, এই মানুষের নীরবতায় এমন এক স্পর্শ আছে, যা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। সেই মুহূর্তে তারা দুজনেই বুঝতে পারল—তাদের মধ্যে গড়ে উঠছে এমন এক সম্পর্ক, যা হয়তো সাময়িক, কিন্তু নিঃসন্দেহে গভীর।

ট্রেন তখন নিরবচ্ছিন্ন ছন্দে ছুটে চলেছে, একঘেয়ে শব্দ যেন নীরবতার সঙ্গীত হয়ে বাজছে। বাইরের অন্ধকার মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানিতে ভেঙে যাচ্ছে, কখনো দূরের গ্রাম্য আলো জানালার কাচে ছিটকে পড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঐশী আর অদ্রিজ তখন আর বিশেষ কিছু বলছে না। কথা শেষ হয়ে গেছে বলেই নয়, বরং নীরবতা এখন আরও গভীর, আরও অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে। অদ্রিজ জানালার পাশে বসে আছে, চোখ কিন্তু বইয়ের পাতায় নেই—আসলে অনেকক্ষণ আগেই বই বন্ধ করে দিয়েছে সে। ঐশীর মুখে হালকা আলো পড়ছে, জানালার বাইরের ঝলকানিগুলো সেই মুখে কখনো ছায়া, কখনো দীপ্তি এনে দিচ্ছে। অদ্রিজ লক্ষ্য করছিল, ঐশীর চোখের দৃষ্টি কেমন ধীরে ধীরে তার দিকে ভেসে আসছে, আবার সরে যাচ্ছে। সেই দৃষ্টি যেন কথার চেয়ে বেশি কিছু বলছে—অপ্রকাশিত, অথচ স্পষ্ট। যেন ভেতরের অজানা আবেগ স্রোতের মতো গোপনে বয়ে চলেছে। ঐশী হঠাৎ করে চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল, কিন্তু তার বুকের ভেতরেও যেন কোনো ব্যাখ্যাতীত কম্পন জেগে উঠল। তারা দুজনেই বুঝতে পারছিল, এই নীরবতাই আসলে তাদের সবচেয়ে বড় আলাপ।

নীরবতার ভেতরে চোখের এই খেলা তাদের ভেতরের জমে থাকা আবেগকে ধীরে ধীরে উন্মুক্ত করছিল। ঐশী নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছিল, ভেবেছিল এ শুধু ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত, কিছুক্ষণ পরেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু অদ্রিজের দৃষ্টি বারবার তার ভেতরে ঢুকে পড়ছিল, যেন সে অদৃশ্য কোনো সূত্র খুঁজছে। ঐশীর মনে হচ্ছিল, এই মানুষটা হয়তো তার ভেতরে জমে থাকা একাকিত্ব পড়ে ফেলছে। তার চোখে ধরা পড়ছিল অদ্রিজের ক্লান্তি, কিন্তু সেই ক্লান্তির ভেতরেও ছিল কোমলতার ছাপ। অন্যদিকে অদ্রিজ ভাবছিল, এতদিন ধরে যাদের সঙ্গে থেকেও নিজের নিঃসঙ্গতা লুকিয়ে রাখতে হয়েছে, আজ এই মেয়েটির চোখের ভেতরে সেই নিঃসঙ্গতার প্রতিধ্বনি খুঁজে পাচ্ছে। তারা দুজনেই কথার প্রয়োজন বোধ করছিল না, কারণ চোখের গভীরতার ভেতরে এমন সব কথা উঁকি মারছিল যা ভাষায় আনা যায় না। বাইরের অন্ধকারে ট্রেনের জানালায় তাদের প্রতিবিম্ব এক মুহূর্তের জন্য মিলেমিশে যাচ্ছিল, যেন দুই আলাদা জীবনের সীমারেখা মুছে যাচ্ছে।

মুহূর্তগুলো এতটাই গভীর হয়ে উঠেছিল যে সময়ের অস্তিত্ব যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। ঐশী হালকা শ্বাস টেনে অনুভব করছিল তার বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক স্পন্দন, যা তাকে একইসঙ্গে অস্থির এবং শান্ত করছে। অদ্রিজ তার দিক থেকে মুখ সরাতে পারছিল না, যেন ঐশীর চোখ তাকে টেনে নিচ্ছে গভীর অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। এ এক অদ্ভুত টান, যেখানে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, তবু আছে এক অচেনা নিশ্চয়তা। ঐশীর মনে হচ্ছিল, হয়তো এই মানুষটার সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না, তবু তার চোখে এমন কিছু আছে যা আজীবন থেকে যাবে। আর অদ্রিজ বুঝতে পারছিল, কথার সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে এই নীরবতার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এক অমূল্য সংযোগ। বাইরের ঝলকানি আলোয় তাদের দৃষ্টি যখন মিলল, তখন সেটা আর কেবল মুহূর্তের আলাপ নয়—বরং একে অপরের গভীরতম অনুভূতির নিঃশব্দ আত্মসমর্পণ। তাদের নীরবতা তখন গল্প হয়ে উঠেছে, আর চোখের ভাষা সেই গল্পের একমাত্র অনুবাদক।

ট্রেন তখন রাতের গভীরে ডুবে গেছে। চারপাশে অন্ধকারের পর্দা আরও ঘন, ভেতরের কেবিনে নীরবতা ভারী হয়ে ঝুলছে। যাত্রীদের বেশিরভাগই ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে, জানালার বাইরে দূরের গ্রামগুলো ফেলে আসা আলোয় কেবল ক্ষণিকের ঝলকানি। ঐশী এক মুহূর্তের জন্য নিজের চাদর ঠিক করে নিয়ে অদ্রিজের দিকে তাকাল, তারপর যেন দীর্ঘ নীরবতার পর হঠাৎ কথাগুলো তার ঠোঁট ভেঙে বেরিয়ে এলো—“জানেন, আমার পরিবার আমার এই জীবন, এই স্বাধীনতা কোনোদিন মেনে নিতে পারেনি। তারা চায় আমি যেন তাদের মতো জীবন যাপন করি, সাজানো-গোছানো, নিয়মের খাঁচায় বন্দি। আমি যখন গবেষণার কাজে শহরের বাইরে যেতে চাই বা রাত জেগে কাজ করি, তখন তারা ভাবে আমি ভুল করছি, আমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছি।” ঐশীর কণ্ঠে কোনো কান্না ছিল না, কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে ছিল দুঃখ আর অবসাদ। অদ্রিজ তার দিকে চেয়ে রইল, সেই চোখে সহমর্মিতা যেন স্বতঃসিদ্ধভাবে ফুটে উঠল। ঐশী গভীর শ্বাস নিল, তারপর ফিসফিস করে বলল—“আমি পালাচ্ছি আসলে, আমার নিজের ভেতর থেকে, পরিবার থেকে, তাদের প্রত্যাশা থেকে।” কথাগুলো যেন রাতের অন্ধকার ছেদ করে বেরিয়ে আসছিল, আর অদ্রিজ সেই শব্দগুলিকে নিঃশব্দে গ্রহণ করছিল।

অদ্রিজ হালকা হেসে বলল—“আমিও পালাচ্ছি… তবে অন্যরকমভাবে।” তার গলায় যেন ছিল একধরনের তিক্ত হাসি, এমন হাসি যেখানে লুকিয়ে থাকে অগোচর দুঃখ। ঐশী বিস্মিত চোখে তাকাল, “কিসের থেকে পালাচ্ছেন আপনি?” অদ্রিজ কয়েক মুহূর্ত কিছু না বলে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল। বাইরের অন্ধকারে তার মুখমণ্ডল আধা ঢাকা, আলো-ছায়ার খেলা তাকে আরও গম্ভীর করে তুলেছে। তারপর ধীরে ধীরে বলল—“আমার সম্পর্ক ছিল দীর্ঘ কয়েক বছর। একসময় ভেবেছিলাম জীবনটা সহজ হয়ে গেছে, সবকিছু স্থির। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম, আমরা দুজন দুই ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ। ভালোবাসা ছিল, কিন্তু একসঙ্গে থাকার জায়গা ছিল না। শেষ পর্যন্ত ভেঙে গেছে সব। এখন আমি পালাচ্ছি সেই স্মৃতি থেকে, সেই শূন্যতা থেকে। অনেকটা নিজের কাছ থেকেও পালিয়ে বেড়াচ্ছি।” অদ্রিজের গলায় কোনো অভিযোগ ছিল না, বরং ছিল একধরনের ক্লান্তি, যা তাকে আরও মানবিক করে তুলছিল। ঐশী চুপ করে তাকিয়ে রইল, যেন চোখ দিয়ে বলতে চাইছিল—“আমি বুঝতে পারছি।” সেই মুহূর্তে তাদের দুজনের মধ্যকার অচেনা টান আরও দৃঢ় হলো, কারণ তারা আবিষ্কার করল, দুজনেই আসলে অস্থিরতার ভেতর দিয়ে পথ খুঁজছে।

ট্রেনের শব্দ তখন একঘেয়ে গুঞ্জনের মতো বাজছিল, কিন্তু তাদের দুজনের ভেতরকার নীরবতা তার চেয়েও গভীর। ঐশী ধীরে ধীরে বলল—“অদ্ভুত না? আমরা দুজন একেবারেই অপরিচিত, অথচ এমনভাবে নিজের ভেতরের কথা বলে ফেলছি।” অদ্রিজ মৃদু হাসল—“হয়তো আমরা অপরিচিত বলেই পারছি। পরিচিত মানুষদের কাছে সব কথা বলা যায় না, কারণ তারা বিচার করবে। কিন্তু এখানে, এই অচেনা যাত্রায়, কোনো বিচার নেই। আছে শুধু শোনা আর বোঝা।” ঐশী অনুভব করল, তার বুকের ভেতরের চাপ যেন হালকা হয়ে গেছে। এতদিন ধরে যে কথাগুলো কেউ শুনতে চায়নি, সেগুলো আজ এক অচেনা মানুষ মন দিয়ে শুনছে। অন্যদিকে অদ্রিজও উপলব্ধি করছিল, তার নিজের ভাঙনের কাহিনী আর বোঝা এই মেয়েটির চোখে পৌঁছে গিয়ে নতুন অর্থ পাচ্ছে। তাদের দুজনের অতীতের ছায়া আলাদা, কিন্তু সেই ছায়া একসঙ্গে মিশে এক ধরনের আশ্রয় তৈরি করছে। হয়তো সামনের যাত্রা তাদের আবার আলাদা করে দেবে, তবু এই রাতের ট্রেনে তারা খুঁজে পেল নিজেদের ভেতরে জমে থাকা অস্থিরতার প্রতিধ্বনি। আর এই প্রতিধ্বনিই তাদের একে অপরের আরও কাছে টেনে আনল—কোনো প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন ছাড়াই, নিঃশব্দে।

রাত তখন অনেকটা গভীর হয়েছে। ট্রেনের ছন্দময় শব্দ যেন অচেনা এক সঙ্গীত হয়ে উঠেছে, যেখানে প্রতিটি কাঁপন দুজনের বুকের ভেতরের অস্থিরতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। চারপাশে প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, হালকা নাকডাকা বা ব্যাগের ঝনঝনানি ছাড়া বগির ভেতরে অন্য কোনো শব্দ নেই। ঐশী চুপচাপ জানালার কাচে মাথা রেখে চোখ বুজে আছে, কিন্তু ঘুম তার কাছে নেই। কাচের ওপারে বাইরের অন্ধকার যেন তাকে গ্রাস করছে, অথচ অদ্ভুতভাবে শান্তিও দিচ্ছে। অদ্রিজ তার দিকে তাকিয়ে আছে নিঃশব্দে, চোখ সরাতে পারছে না। নিজের ভেতরে সে অনুভব করছিল এক অদ্ভুত টান—এই মেয়েটি তার জীবনের সঙ্গে যুক্ত নয়, মাত্র কয়েক ঘণ্টার পরিচয়, তবুও কেন এত গভীর একটা আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে? অদ্রিজ ভাবছিল, সে যদি একটুখানি সরে গিয়ে ঐশীর কাছাকাছি বসতে পারত, যদি তার কাঁধে হালকা করে হাত রাখতে পারত, তাহলে হয়তো এই নিঃশব্দ টানাপোড়েন থেকে মুক্তি পেত। অথচ বাস্তব তাকে থামিয়ে রাখছে—এ এক অচেনা মেয়ে, আর এই সম্পর্ক হয়তো ভোর হলেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তার বুকের ভেতরের আবেগ বারবার তাকে টেনে নিচ্ছিল ঐশীর কাছে।

ঐশীও ভেতরে ভেতরে দ্বিধার সঙ্গে লড়ছিল। তার মনে হচ্ছিল, অদ্রিজের দৃষ্টি সে টের পাচ্ছে, কিন্তু সে নিজেকে সামলাতে পারছে না। এত দ্রুত কেন এভাবে মনের ভেতরে টান তৈরি হলো? সে তো চেয়েছিল নিজের গবেষণা আর জীবনের সংগ্রামের ভেতরে একা পথ চলতে, কাউকে জায়গা না দিতে। অথচ এই মানুষটা—যাকে সে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে চিনেছে—তার ভেতরে এমন সব সাড়া জাগাচ্ছে যা ব্যাখ্যা করা যায় না। ঐশী চোখ বন্ধ রেখেও অদ্রিজকে অনুভব করছিল, তার অস্থিরতাকে বুঝতে পারছিল। কিন্তু সেই অস্থিরতার সঙ্গেই একটা ভয় কাজ করছিল—যদি সবকিছু হঠাৎ ভেঙে পড়ে? যদি এই রাতের টানাপোড়েন ভোরের আলোয় কেবল এক ক্ষণস্থায়ী বিভ্রম হয়ে দাঁড়ায়? মাথা জানালার কাচে ঠেকিয়ে সে চেষ্টা করছিল নিজের ভেতরের স্পন্দনকে সামলে রাখতে, কিন্তু হৃদয়ের গভীর থেকে যে আকর্ষণ জন্ম নিচ্ছে, তাকে অস্বীকার করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না।

অদ্রিজ আস্তে আস্তে নিজের আসনে নড়েচড়ে বসলো, যেন একটু কাছে সরে আসতে চাইছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থেমে গেল। ভেতরে তার মনে হচ্ছিল, এ এক ধরণের নিষিদ্ধ আকর্ষণ, অথচ একেবারেই স্বাভাবিক। সে নিজের মনকে প্রশ্ন করছিল—“কেন? কেন এত তাড়াতাড়ি মনে হচ্ছে এই মেয়েটি আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে?” হয়তো উত্তর নেই। হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই জীবন মাঝে মাঝে অচেনা মানুষকে এত কাছে টেনে আনে। তাদের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছিল না, তবু নিঃশব্দ আলাপ চলছিল। জানালার বাইরের কালো অন্ধকারে আলো ঝলকে উঠল, সেই আলো এসে পড়ল ঐশীর মুখে। অদ্রিজের মনে হলো, যদি এখন হাত বাড়িয়ে ঐশীর হাতটা ধরতে পারত, তবে সব দ্বিধা কেটে যেত। কিন্তু সে তা করল না, বরং নিজেকে আরও গভীর নিঃশ্বাসে সামলাল। ঐশীও চোখ বন্ধ রেখেই অনুভব করছিল, দুজনের ভেতরে অদ্ভুত এক টানাপোড়েন চলছে—কাছে যাওয়ার ইচ্ছা আর দূরে থাকার ভয় যেন একসঙ্গে খেলছে তাদের হৃদয়ে। আর এই দ্বন্দ্বই রাতটাকে আরও দীর্ঘ, আরও তীব্র করে তুলল।

ট্রেনের আলো তখন ম্লান হয়ে এসেছে, যেন রাতকে আরও গভীর করার জন্যই আলো ইচ্ছাকৃতভাবে সরে দাঁড়িয়েছে। বগির ভেতর যাত্রীরা একে একে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে, কোথাও হালকা নাকডাকা, কোথাও আসনের ফাঁক থেকে ঝুলে পড়া হাতের অচেতন নড়াচড়া। পরিবেশ এমন এক নিরবচ্ছিন্ন নীরবতায় ঢেকে গেছে, যেখানে প্রতিটি শব্দই ভাঙতে চায় স্থিরতার জাদু। এই নিস্তব্ধতার মাঝেই অদ্রিজ আর ঐশীর মধ্যকার টানাপোড়েন ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করল। প্রথমে সামান্য নড়াচড়া—অদ্রিজ আসনে একটু সরে বসল, যেন অনিচ্ছাকৃতভাবে ঐশীর দিকে ঝুঁকছে। ঐশীও নিজের শরীর সামলে বসল, যদিও মনে হচ্ছিল সেটি ছিল নিছক কাকতাল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে অনুভব করছিল—অদৃশ্য এক শক্তি যেন তাদের আরও কাছে টেনে নিচ্ছে। মুহূর্তেই তাদের কাঁধ প্রায় স্পর্শ করল, আর ঠিক সেই সময় অদ্রিজের আঙুল হালকা করে ছুঁয়ে গেল ঐশীর হাত। এই স্পর্শ ছিল না ইচ্ছাকৃত, না-ইবা অস্বস্তিকর—বরং ছিল এমন এক অচেনা শিহরণ যা তাদের দুজনকেই একসঙ্গে থমকে দিল।

ঐশীর বুকের ভেতর হঠাৎ করেই যেন দ্রুততর হয়ে উঠল হৃদস্পন্দন। এতক্ষণ যে নীরবতায় সে নিজেকে আড়াল করেছিল, তা মুহূর্তে ভেঙে গেল। তার মনে হচ্ছিল, স্পর্শটা ক্ষণস্থায়ী হলেও এর ভেতরে আছে এক গভীর অন্তরঙ্গতার সংকেত। সে হাত সরিয়ে নিতে চাইল, কিন্তু পারল না। অদ্রিজও তার আঙুল ফিরিয়ে নিল না, বরং অচেতনভাবে থেমে গেল সেই বিন্দুতেই। এই নীরব স্পর্শে এমন কিছু প্রকাশিত হলো যা শব্দের প্রয়োজন ছাড়িয়েছে। জানালার বাইরে রাতের আঁধার ছুটে যাচ্ছিল দ্রুত, কিন্তু তাদের দুজনের ভেতরে সময় যেন থেমে গেছে। ঐশী অনুভব করল, এই অপরিচিত মানুষের উপস্থিতি এখন আর কেবল যাত্রাসঙ্গীর নয়—বরং এমন একজনের, যিনি তার নিঃসঙ্গতার গভীরতম স্থানে ঢুকে পড়ছেন। অদ্রিজও টের পাচ্ছিল, ঐশীর হাতের উষ্ণতায় সে যেন বহুদিনের শূন্যতা ভরাট করে নিচ্ছে। বাইরের ঠান্ডা হাওয়া জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসছিল, অথচ তাদের দুজনের শরীরের কাছে থাকা উত্তাপ সেই শীতলতাকে গলিয়ে দিচ্ছিল ধীরে ধীরে।

সেই মুহূর্তে নীরবতাই হয়ে উঠল তাদের সবচেয়ে বড় ভাষা। কোনো কথা বলার দরকার ছিল না, কারণ হাতের স্পর্শ আর দেহের নৈকট্যই সবকিছু বলে দিচ্ছিল। ঐশী জানত, এ স্পর্শ হয়তো স্থায়ী হবে না, ভোর হলেই তারা আলাদা পথে ছুটে যাবে। কিন্তু সেই ভয় তাকে দূরে সরিয়ে দেয়নি, বরং আরও কাছে টেনে এনেছে। অদ্রিজও ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারছিল, এই রাত হয়তো একরাতের, কিন্তু এর ভেতরে জন্ম নিচ্ছে এমন কিছু যা স্মৃতির গভীরে থেকে যাবে আজীবন। তাদের শরীর তখনও পাশাপাশি, হাতের আঙুলে নিঃশব্দ কাঁপন বয়ে যাচ্ছে, অথচ মুখে কোনো শব্দ নেই। কেবল চোখে চোখ পড়লে বোঝা যাচ্ছিল—তারা দুজনেই একে অপরের উপস্থিতিকে সম্পূর্ণভাবে অনুভব করছে। ট্রেন ছুটে চলছিল নিজের পথে, আর সেই যাত্রার গভীর অন্তরঙ্গতা তাদের দুজনের ভেতরে অচেনা অথচ অমূল্য এক বাঁধন তৈরি করে দিচ্ছিল। এ বাঁধন ভাষাহীন, প্রতিশ্রুতিহীন, কিন্তু তবু তার চেয়েও গভীর।

রাত তখন প্রায় গভীরতম অবস্থায় পৌঁছেছে। ট্রেনের ভেতর অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে, যেখানে প্রতিটি শব্দই যেন দূর থেকে ভেসে আসছে—চাকা-রেলের ঘর্ষণের একঘেয়ে সুর, হালকা দুলুনির মধ্যে ঘুমন্ত যাত্রীদের শ্বাস-প্রশ্বাস। ঐশী আর অদ্রিজ, দুজনেই একে অপরের ভেতরে এমনভাবে নিমগ্ন হয়ে আছে যে বাইরের জগত যেন সম্পূর্ণ অচেনা হয়ে গেছে। তাদের হাত তখনও স্পর্শে আবদ্ধ, কিন্তু সেই স্পর্শের ভেতরে জমে আছে অনন্তকালের গভীরতা। অদ্রিজ ধীরে ধীরে ঐশীর দিকে ঝুঁকে এলো, যেন চোখের গভীরতা দিয়ে কোনো অনুমতি চাইছে। ঐশীর দৃষ্টি তখন আর প্রতিরোধে নয়, বরং নিঃশব্দ সম্মতিতে সিক্ত। মুহূর্তেই সব বাঁধন ভেঙে গেল—তারা আর অপরিচিত নয়, আর যাত্রাসঙ্গী নয়, বরং হয়ে উঠল একে অপরের সবচেয়ে আপন। অদ্রিজের হাত যখন ঐশীর গাল ছুঁলো, তখন ঐশী অনুভব করল এক অচেনা উষ্ণতা, যা তার সমস্ত দ্বিধা মুছে দিচ্ছে। এই ছোঁয়া, এই নৈকট্য ছিল না কেবল শারীরিক—এ ছিল আত্মার পরস্পর সমর্পণ, যেখানে ভাষা কিংবা প্রতিশ্রুতির কোনো প্রয়োজন নেই।

ঐশী জানত, হয়তো এ রাতের পর আর কখনো দেখা হবে না। এই মানুষটা তার জীবনের সঙ্গে কোনোদিন জড়াবে না, কোনো সম্পর্কের বাঁধনে আটকে রাখবে না। অথচ তবুও আজ সে তাকে নিজের সমস্ত ভেতর দিয়ে স্বীকার করছে। এই স্বীকারোক্তি ছিল না কথায়, বরং ছিল তার দেহমন দিয়ে দেওয়া এক নিঃশব্দ আত্মসমর্পণ। অদ্রিজও একইভাবে বুঝতে পারছিল, এ যাত্রা তার জীবনের নিরন্তর শূন্যতার ভেতরে হঠাৎ করে আলো ফেলে দিয়েছে। সে চাইলে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারত, ভোরের অপেক্ষা করতে পারত, কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না। ঐশীর ঠোঁটে যখন তার ঠোঁট ধীরে ধীরে মিশে গেল, তখন সময় থেমে রইল, চারপাশের ট্রেনের শব্দ মিলিয়ে গেল দূরে। মুহূর্তের ভেতরে তারা নিজেদের হারিয়ে ফেলল একে অপরের ভেতরে। বাইরে হয়তো অন্ধকার রাত ছুটে চলছিল, কিন্তু তাদের জন্য সেই মুহূর্তই হয়ে উঠেছিল এক চিরস্থায়ী আলোকময়তা।

দুজনেই জানত—এ কেবল এক রাতের ঘটনা, হয়তো আগামী দিনের আলোয় তারা আলাদা পথ বেছে নেবে। তবুও সেই সত্য তাদের থামাতে পারেনি। কারণ কিছু মুহূর্ত থাকে, যা সময়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়; কিছু মানুষ আসে জীবনে, যারা চিরকালের নয়, অথচ সবচেয়ে গভীর চিহ্ন রেখে যায়। ঐশী অনুভব করল, সে যেন নিজের সবচেয়ে ব্যক্তিগত, সবচেয়ে নীরব ভেতরটা আজ অদ্রিজকে দিয়ে দিয়েছে—যেন সমস্ত বাঁধনহীন মুক্তির মধ্যেও এ এক আশ্চর্য অন্তরঙ্গতা। অদ্রিজও তার বুকের ভেতরে দীর্ঘদিনের শূন্যতা, আড়ষ্টতা ভেঙে দিয়ে ঐশীর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করল। এ সমর্পণ কোনো প্রতিশ্রুতি চাইছিল না, কোনো ভবিষ্যৎ দাবি করছিল না। এটি ছিল নিখাদ, কেবলমাত্র ওই রাতের, ওই মুহূর্তের। অচেনা থেকেও তারা হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে কাছের, আর সেই সত্যই তাদের আত্মার ভেতরে চিরকালের জন্য গেঁথে রইল।

রাতের শেষ প্রহরে যখন জানালার ওপারে আকাশ একটু একটু করে ফিকে হতে শুরু করল, ট্রেনের ভেতরে এক নতুন আলো এসে ঢুকল। সেই আলো ছিল না কেবল ভোরের সূর্যোদয়ের ইঙ্গিত, বরং ছিল শেষ হয়ে আসা এক যাত্রার চিহ্নও। অদ্রিজ আর ঐশী, যারা সারা রাত নিঃশব্দে একে অপরের ভেতরে ডুবে ছিল, এখন বুঝতে পারছিল—সময় এসে গেছে তাদের পৃথক পথে নিয়ে যাওয়ার। ট্রেনের চাকার শব্দ আরও স্পষ্ট শোনাচ্ছিল, প্রতিটি ঝাঁকুনিতে তাদের মনে হচ্ছিল—একটু পরেই শেষ হয়ে যাবে এই একসাথে থাকা। ঐশী জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, অদ্রিজ তাকিয়ে ছিল ঐশীর দিকে। তাদের দৃষ্টি একে অপরের ভেতরে আটকে যাচ্ছিল, কিন্তু তাতে কোনো প্রতিশ্রুতির ছায়া ছিল না, কোনো ভবিষ্যৎ গড়ার ইঙ্গিত ছিল না। কেবল এক নীরব উপলব্ধি—এই রাতই ছিল তাদের জন্য সবকিছু।

গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই বগির ভেতরে যাত্রীদের হালকা কোলাহল শুরু হলো। কেউ ব্যাগ গুছিয়ে নিল, কেউ ঘুম চোখ মুছে জানালার বাইরে তাকাল। সেই কোলাহলের মাঝেও অদ্রিজ আর ঐশীর মধ্যে নেমে এলো এক ভয়াবহ নীরবতা। তারা দুজনেই জানত, এখন আর কিছু বলার নেই। এ সম্পর্কের কোনো নাম নেই, কোনো সামাজিক বন্ধন নেই, কোনো ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিও নেই। তবুও এই কয়েক ঘণ্টা, এই নিঃশব্দ আত্মসমর্পণ, এই অন্তরঙ্গতা—এসবকিছু তাদের জীবনের স্মৃতিতে চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে। অদ্রিজ হালকা করে ঐশীর হাত ছুঁয়ে দিল শেষবারের মতো, যেন নিঃশব্দ বিদায় জানাল। ঐশী তার চোখের গভীরে তাকিয়ে রইল, ঠোঁটে সামান্য হাসি, অথচ সেই হাসির ভেতর লুকিয়ে ছিল বেদনা আর স্বীকারোক্তি—“আমরা আবার দেখা করব না, কিন্তু তবুও তুমি রয়ে গেলে আমার ভেতরে।”

ট্রেন যখন ধীরে ধীরে থামল, স্টেশনের কোলাহল ভেতরে ঢুকে পড়ল। লোকজন নেমে যাচ্ছে, ভিড় জমছে, প্রত্যেকে ছুটছে নিজ নিজ গন্তব্যে। এই বিশৃঙ্খলার মাঝেও অদ্রিজ আর ঐশীর দৃষ্টি শেষবারের মতো মিলিত হলো। তারা কেউ কোনো কথা বলল না, কোনো প্রতিশ্রুতিও দিল না। শুধু নিঃশব্দ বিদায় তাদের ভেতরে লিখে দিল এক চিরন্তন স্মৃতি। অদ্রিজ নামল এক দিকের দরজা দিয়ে, ঐশী নামল অন্য দিকের। ভিড়ের ভেতর ধীরে ধীরে তারা হারিয়ে গেল একে অপরের চোখের আড়ালে। তবুও দুজনেই জানত—এই ভোরের বিভাজন তাদের আলাদা করে দিলেও, রাতের সেই একান্ত মুহূর্ত তাদের আত্মায় অমর হয়ে রইল।

১০

দিন গড়িয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ গড়িয়ে মাস হয়ে যায়। জীবনের ছন্দ ফিরে আসে স্বাভাবিক গতিতে—ঐশী তার গবেষণার টেবিলে ফিরে যায়, অদ্রিজ নিজের কাজের ব্যস্ততায় ডুবে যায়। চারপাশের মানুষজন তাদের দেখে বুঝতেও পারে না, এই দুজনের অন্তরে কত গভীর এক রাতের স্মৃতি জমে আছে। অফিসের আলো-ছায়া, শহরের যানজট, লাইব্রেরির নিস্তব্ধতা—সবকিছুই যেন স্বাভাবিক, কিন্তু কোনো এক শূন্য মুহূর্তে হঠাৎ সেই রাতের ট্রেনযাত্রা ফিরে আসে। জানালার বাইরে অন্ধকার ছুটে যাওয়া দৃশ্য, হাতের অচেনা স্পর্শ, চোখের গভীর ভাষা—সবকিছু ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। তখন মনে হয়, এটি কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নয়, বরং যেন এক অচেনা স্বপ্ন। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারে, না, এটি ছিল বাস্তব, আর সেই বাস্তবই এখন পরিণত হয়েছে সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতিতে।

ঐশীর জীবন চলতে থাকে পরিবার ও সমাজের অগণিত বাঁধনের মধ্যে, তবুও সে মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায়। হয়তো রাত্রি গভীর হলে, গবেষণার খাতা বন্ধ করে জানালার বাইরে তাকিয়ে সে অনুভব করে—একটি ট্রেন ছুটে চলেছে দূরে কোথাও, আর সেই ট্রেনের এক বগিতে বসে আছে অদ্রিজ, তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঐশী জানে, বাস্তবে তারা হয়তো আর কখনো দেখা করবে না, কিন্তু সেই রাতের নৈকট্য আজও তার ভেতরে আলো ছড়ায়। অদ্রিজও নিজের ভাঙাচোরা সম্পর্কের অচলাবস্থা পেরিয়ে চলতে থাকে, তবে প্রতিটি নির্জন সন্ধ্যায়, প্রতিটি দীর্ঘ যাত্রায় তার মনে পড়ে যায় ঐশীর হাসি, ঐশীর চোখে লেখা সেই নীরব স্বীকারোক্তি। তারা দুজনেই জানে, জীবন তাদের ভিন্ন ভিন্ন পথে নিয়ে গেছে, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে সেই রাত আজীবন গোপন আলো হয়ে জ্বলে থাকবে।

এ আলো কখনো উজ্জ্বল দাবানলের মতো নয়, বরং এক নরম প্রদীপশিখার মতো—যা নিভে যায় না, কেবল মৃদু কাঁপে। ঐশী আর অদ্রিজ নিজেদের ভেতরে সেই আলো বহন করে চলে, যেন গোপন কোনো সম্পদ, যা কাউকে বলা যায় না, দেখানো যায় না। তারা হয়তো জীবনের অন্যান্য সম্পর্ক গড়বে, নতুন মুখ দেখবে, নতুন পথ খুঁজবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক অচেনা আকর্ষণ, এক মুহূর্তের আত্মসমর্পণ, এক রাতের ট্রেনযাত্রা—এসবই থেকে যাবে তাদের জীবনের অন্তর্গত কবিতার মতো। এটি ছিল না কোনো প্রতিশ্রুতির গল্প, না কোনো ভবিষ্যতের নির্মাণ; এটি ছিল কেবলমাত্র একটি মুহূর্ত, যা সময়ের সীমা ছাড়িয়ে অমর হয়ে গেছে। তারা আলাদা হলেও, তাদের স্মৃতির ভেতর সেই ট্রেনযাত্রা চিরকাল বেঁচে থাকবে, এক গোপন আলোর মতো, যা জীবনের অন্ধকারে দিশা দেখাবে নীরবে।

সমাপ্ত

 

1000058131.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *